গীতবিতান ছুঁয়ে বলছি ১.৬০

৬০

ভাবতে ভাল লাগছে, কলকাতা বড় হতে হতে গঙ্গা ‘পেরিয়ে মালদহ, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি এমনকী কোচবিহার ছাড়িয়ে বাংলাদেশে পৌঁছে গেছে। এই লাইনটি পড়ে নিশ্চয়ই অনেকের কপালে অবিশ্বাসের লাইন ফুটে উঠেছে, কলকাতার পিনকোড নাম্বার চব্বিশ পরগনাতেই শেষ হয়ে যায়। কলকাতা পুলিশের বিচরণের সীমানাও চিহ্নিত, তাহলে এখন কলকাতা থেকে প্রকাশিত খবরের কাগজগুলোর কলকাতা সংস্করণ শিলিগুড়িতো দূরের কথা, পুরুলিয়াতেও পাওয়া যায় না। এমন অনেক খবর কলকাতা সংস্করণে থাকে যা মফস্বলের সংস্করণে ছাপা হয় না আবার সেখানে ছাপা খবর কলকাতার সংস্করণ খুঁজে পাবেন না। তাহলে কলকাতা কী করে কোচবিহারে পৌঁছোল? বাংলাদেশে তো দূর অস্ত। কলকাতা শহরের নিজস্ব সংস্কৃতির চেহারাটা ষাট সালে কলেজে পড়তে এসে দেখেছি। কেউ পথেঘাটে বিপদে পড়লে মানুষ এগিয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। ষাট থেকে ঊনসত্তরের ট্রাম-বাসে কোনও মহিলার শ্লীলতাহানি হচ্ছে এমন ঘটনা বিরল ছিল। অবশ্য সেই সময় পথেঘাটে মহিলাদের একা দেখা যেত না। বাড়ির বউ মেয়েরা ম্যাটিনিতে সিনেমা দেখতে যেতেন কাজের লোককে সঙ্গে নিয়ে। উত্তর কলকাতার মধ্য তিরিশের বিবাহিত মহিলা পাশের পাড়ার আত্মীয়ের বাড়িতে আসতেন ওইরকম কাউকে নিয়ে। নিরাপত্তার কারণে নয়, সম্ভ্রম বজায় রাখতেই ওটা চালু ছিল। তখন সিনেমাহলগুলোতে লেডিজ সিটের ব্যবস্থা থাকত। কলকাতায় সেই চল নেই। জানি না মফস্বলেও তা টিকে আছে কি না।

থাকার কথা নয়। লক্ষ করবেন, কলকাতার পুরনো ঝরঝরে বাসগুলোয় এখনও ‘লেডিজ’ লেখা থাকে। মহিলারা সদর্পে সেগুলোয় অধিকার নেন। কিন্তু নতুন ঝাঁ-চকচকে বাসগুলোতে পুরুষ মহিলা আলাদা করা হয়নি। তাতে যে মহিলাদের অসুবিধে হচ্ছে তা মনে হয় না। বরং উল্টোটাই দেখতে পাই। লেডিজ মার্কা আসন খালি থাকলেও অল্পবয়সি মেয়েরা সাধারণ আসনেই বসছেন। যেহেতু ওই আসন পুরুষদের জন্য চিহ্নিত নয় তাই সেখানে বসার পূর্ণ অধিকার তাদের আছে বলে ঘোষণা করেন। পাতাল রেলের কামরায় দুটো লম্বা আসন মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট। লক্ষ করেছি সেখানে বসতে অনেক মেয়ের অনীহা আছে। সেই আসন খালি থাকা সত্ত্বেও বছর ষাটের দুই মহিলা সিনিয়র সিটিজেন মার্কা আসনে এসে বসলেন। কোনও বৃদ্ধ তাঁদের বিনীতভাবে লেডিজ সিটে গিয়ে বসতে বললে উত্তর শোনেন, ‘কেন যাব? আমরা কি সিনিয়র সিটিজেন নই।’

গত দশ-বারো বছরে কলকাতার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, ‘উড়ালপুল, ঝাঁ-চকচকে মর্গ থেকে শুরু করে লাক্সারি ট্যাক্সি, কলকাতা বড় হচ্ছে। পুরুষদের পরিবর্তন যতটা না চোখে পড়ছে, মেয়েদের বিস্তর বদল হচ্ছে। আমার এক বন্ধু বিদেশে থাকেন। বছর দশেক পরে কলকাতায় এসে ঘুরে ফিরে দেখে বললেন, আচ্ছা, কলকাতায় মানুষের হাতে এত টাকা এল কী করে?

কোথায় টাকা? অর্থাভাবে মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকাই এখন প্রধান সমস্যা।

‘আমার তো মনে হচ্ছে না।’ বন্ধু বললেন, সল্টলেকের দুটো সিটি সেন্টার, আনোয়ার শা রোডের বিরাট মলে যে জনতাকে কেনাকাটা করতে দেখলাম তাদের তো টাটা বিড়লার বাড়ির লোক বলে মনে হল না। কলকাতার রাস্তায় এত গাড়ি, পাঁচ লাখ থেকে পঁচিশ লাখ, কারা চড়ছে? হাজার হাজার বাইক তো আমাদের সময় ছিল না। সিনেমা দেখতে দুশো তিনশো টাকার টিকিট কেটে আমি আকাদেমিতে বহুরূপীর নাটক দেখেছি। এখন দেড়শো-দুশো টাকার টিকিটে হাউসফুল হচ্ছে। নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন এইসব নাটকগুলো মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তরাই দ্যাখে। কাগজে পড়লাম বাজারে হু হু করে দাম বাড়ছে। পিঁয়াজ আশি-নব্বই টাকা। গিয়ে দেখলাম ইলিশ মাছ নয়শো টাকা কেজি সত্ত্বেও মানুষ কিনছে। কোথাও কোনও বাজারে একটাও বিক্ষোভ দেখা যায়নি। তারপরে কী করে বলছেন অর্থাভাবে মানুষ কষ্টে আছে? দেখেশুনে মনে হচ্ছে মানুষের হাত বৈধ বা অবৈধ যে কোনও রাস্তায় টাকা আসছে। মনে পড়ছে এক পয়সা ট্রামের ভাড়া বাড়ানোয় কলকাতায় পুলিশ-জনতার যুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কত ট্রাম পুড়েছে মানুষের ক্ষোভের কারণে। এখন পাঁচগুণ দাম বেড়ে গেলেও মানুষ তা নিয়ে শুধু কথাই বলে, সেই বিক্ষোভ দেখায় না।

আমার পরিচিত একটি পরিবার, যাদের আয় দশ হাজার টাকার নিচে, তাদের ছেলেমেয়ে যে পোশাক পরে তা রীতিমতো দামি। কৌতূহল হল, প্রশ্ন করে জানলাম, আমরা এগুলো তো ইএমআইতে কিনেছি, ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে বিক্রেতারা। এক হাজার টাকার জিনিস বারোশো টাকায় বিক্রি করে প্রতি মাসে একশো করে নিয়ে যাচ্ছে। একবছরে শোধ হয়ে গেলে আবার বারো মাসে একশো টাকা দিতে ওরা নিশ্চয়ই পারে।

যা ছিল কলকাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ তা আজ কোচবিহারের পৌঁছে গিয়েছে। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়িতেও ঝাঁ-চকচকে দোকান হচ্ছে। তাদের ক্রেতাও তৈরি হয়েছে। টাকা আসছে কোত্থেকে? এ সব নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামান তাঁদের একজন বলবেন, ‘সবাই যে দু’নম্বরি করে টাকা রোজগার করছে তা নয়। আগে পরিবারের একজন অথবা দু’জন চাকরি করতেন। এখন বাবা-মা-ছেলে-মেয়ে চারজনেই চাকরি করছে। বাবা চাকরির শেষদিন যত মাইনে পাচ্ছেন ছেলে বা মেয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং এমবিএ-র দৌলতে তার দ্বিগুণ মাইনে ঘরে নিয়ে আসছে। বেশিরভাগ বাবা-মা ছেলেমেয়ের কাছে সংসারের জন্যে টাকা চান না। সেই টাকায় ওরা শখ মেটাচ্ছে বলে শপিং মলগুলোর এত রবরবা।

দ্বিতীয়টি আগেও ছিল কিন্তু দিন দিন আরও প্রকট হচ্ছে। ছেলে-মেয়ে যদি কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য বা সমর্থক হয় তাহলে তার ভাগে নানান সোর্স থেকে টাকা আসবেই। কোনও কনট্রাক্টর বৈধ উপায়ে টেন্ডার দিয়ে কাজের বরাত পেলে শুরু করার আগে নৈবেদ্য দিতে হবে। সেই নৈবেদ্যর অংশ অনেক হাতে পৌঁছে যাওয়ার সময় নবীন কর্মীও বঞ্চিত হবে না। কেউ বাড়ি বানাতে গেলে ওদের কাছ থেকেই ইট সিমেন্ট কিনতে হবে চড়া দামে। জিনিস যদি ভাল না হয় তাহলেও প্রতিবাদ করা যাবে না। এই যে জোরজবরদস্তি করে পাওয়া টাকা এখন বাতাসে উড়ছে। উড়তে উড়তে কলকাতা থেকে চলে যাচ্ছে কোচবিহারে। দু’হাজার টাকার টিকিট কেটে শচীনের টেস্ট ম্যাচের প্রায় সমাপ্তি দেখতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।

একটা সময় ছিল উত্তরবাংলার মফস্বল শহরের অনেক পরিবার ছেলের বিয়ে দেওয়ার সময় কলকাতার মেয়েকে গৃহবধূ করার কথা ভাবতেন না। ছেলের জেদে কলকাতার মেয়ে বউ হয়ে যদি কারও বাড়িতে আসে তাহলে পাড়া-প্রতিবেশীরা তাকে দেখতে যেতেন এবং বলতেন ‘এখানে থাকতে তো আসেনি, ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে আছে।’

এখন তাঁদের বাড়ির মেয়েরা কলকাতার মেয়েদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। পড়াশোনায়, সাজগোজে। সেদিন শিলিগুড়ির রাস্তায় একটি মেয়ের মুখে শুনলাম, ‘প্রসেনজিৎ বাদ, বয়স হয়ে গিয়েছে। এখন দেব ছাড়া কাউকে নায়ক বলে ভাবাই যায় না। ওদের চেয়ে আমাদের এখানে অনেক বিন্দাস ছেলে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *