৫৫
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে স্পষ্ট গলায় বলেছেন, সেখানকার জাতীয় সড়কগুলি আর মানুষ অথবা গাড়ির চলাচলের উপযুক্ত নেই। আমরা যারা উত্তরবঙ্গে যাতায়াত করি, তারা এই সত্যটিকে জানি এবং সে কারণেই মুখ্যমন্ত্রীর ওই মন্তব্যকে অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, জাতীয় সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। তারা সুকৌশলে এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষের যাতায়াতের সমস্যা এতটাই বেড়ে গেছে যে রাজ্য সরকারকে বাধ্য হয়ে রাস্তার গর্ত বুজিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে হয়েছে। কিন্তু উত্তরবাংলার বর্ষা এবং ভারী ট্রাকের চাকার চাপে আবার আগের চেহারায় ফিরে যাচ্ছে জাতীয় সড়ক। কেন্দ্রীয় সরকার নিশ্চয়ই এইসব জাতীয় সড়ক মেরামতির জন্য যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করেছে। কিন্তু তার ব্যবহার হচ্ছে না। রাজ্য সরকারের সমস্যা দুটি। প্রথমত, রাজ্যে সড়কগুলো থাকলেও তা মেরামতির এক্তিয়ার তাদের নেই। দ্বিতীয়ত, এই বাবদ যে খরচ হবে তা তাদের সাধ্যের বাইরে।
আমি আগেও লিখেছি, জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়িতে যাওয়ার চওড়া রাস্তা বছরের এগারো মাস আর রাস্তা বলে চেনা যায় না। তার চেয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থা জলদাপাড়া থেকে হাসিমারা যাওয়ার পথ। ভূটান এবং পশ্চিমবাংলা, তথা ভারতের যোগাযোগের প্রধান পথটিতে এক দেড়ফুট গর্ত দু’হাত অন্তর ছড়ানো। ব্যাপারটি এইভাবে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। খোঁজ নিয়ে জানলাম কেন্দ্রীয় সরকার রাস্তার মেরামতি একজনের বদলে কয়েকজন কন্ট্রাক্টরকে দিয়ে থাকে। এক একটি অংশের দায়িত্ব এক একজনের। তাঁরা রাস্তা সারান, টাকা পান। বর্ষায় রাস্তা ধুয়ে যায়। আবার তাঁরা দায়িত্ব পান এবং অর্থবান হন। কিন্তু জলঙ্গি ঝোরা থেকে তোরসা ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তাটিতে মৃত্যুগহ্বর ছড়িয়ে আছে। প্রশ্ন করলে দুটো উত্তর শোনা যায়, ওই অংশের কন্ট্রাক্টর খুব দুর্বল। তাঁর পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। আবার চুক্তি অনুযায়ী সময় শেষ হওয়ার আগে তাঁকে সরানো যাবে না। দ্বিতীয়টি খুব চমকপ্রদ। রাস্তা সারাতে নেমে রাজনৈতিক মস্তানদের চাওয়া বিরাট চাঁদার অঙ্ক দিতে না পারায় ভদ্রলোক হাত গুটিয়ে নিয়েছেন।
সত্যিটা ঠিক কী তা জানি না। সরকারি ইঞ্জিনিয়াররা আছেন। তাঁরা কেন চোখ বন্ধ করে আছেন? ভারতের নাগরিকরা নাস্তানাবুদ হচ্ছে, বিদেশি ভুটানিরা গালাগাল দিচ্ছে জেনেও তাঁরা কেন উদ্যোগ নিচ্ছেন না তা আমার বোঝার বাইরে। কয়েক মাস আগে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যখন উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়েছিলেন তখন সরকারি কর্তারা সতর্ক ছিলেন যাতে ওইসব ভয়ঙ্কর পথে তাঁকে যেতে দেওয়া না হয়। যদি যেতেন, আমি বিশ্বাস করি, মুখ্যমন্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে তখনই দায়িত্বে যাঁরা আছেন তাঁদের তুলোধোনা করতেন। কিন্তু মাদারিহাট ট্যুরিস্ট লজে রাত কাটিয়ে ফালাকাটা-জটেশ্বর-কোচবিহারে তাঁকে যেতে হল। হাসিমারা দিয়ে নয়। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হাওড়া স্টেশনে যেদিন গিয়েছিলেন সেদিন প্ৰশাসন ওই এলাকার চেহারা বদলে দিয়েছিল। কিন্তু পরের দিনেই আগের চেহারায় ফিরে গিয়েছিল স্টেশন চত্বর। বিদেশিদের সামনে আমাদের দীর্ণ চেহারা না তুলে ধরার যে সেন্টিমেন্ট কাজ করে সেটা বুঝি। কিন্তু রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে অন্ধকারে রাখা আদৌ সমর্থনযোগ্য কাজ নয়।
এই যে জাতীয় সড়ক এবং তার মতো কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত বিভিন্ন ব্যবস্থাগুলো যা সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেললে রাজ্য সরকারের কিছুই করার থাকে না, তাদের সম্পর্কে অন্য চিন্তা করার সময় এসেছে। এই প্রসঙ্গে আমেরিকার কথা মনে পড়ছে।
একসময়, যখন ছাত্র ছিলাম তখন শোনানো হয়েছিল যা খারাপ তা আমেরিকাই করে থাকে। আমেরিকা বুর্জোয়া রাষ্ট্র। পৃথিবীর দুর্বল দেশগুলো দখল কর শোষণ করে। পৃথিবীর অর্থনীতির চাবিকাঠি যেহেতু ওদের হাতে তাই যে-কোনও দেশকে ব্ল্যাকমেল করতে পারে। ওখানে যত বিয়ে হয় তার থেকে বেশি বিচ্ছেদ হয়ে থাকে। এখানকার বৃদ্ধ বাবা-মা অত্যন্ত অসহায়, সন্তানরা দেখে না। ইত্যাদি।
কয়েকবার যাতায়াতের পর কিছু জ্ঞানলাভ হল। আমেরিকা বুর্জোয়া রাষ্ট্র হতে পারে, এই মুহূর্তে অন্য দেশ তাদের দখলে নেই। তবে স্বার্থে ঘা লাগলে তারা ভয়ঙ্কর হতে জানে। কিন্তু দেশের নাগরিকদের ন্যায্য অধিকারকে সরকার বঞ্চিত করে না। বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা অসহায় অবস্থায় নেই। ওখানকার কোনও রাস্তায় এক ইঞ্জি গর্ত তৈরি হলে তা মেরামত করতে এক ঘণ্টার বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না। ওদের দেশ অনেকগুলো স্টেট নিয়ে তৈরি। ভারতের মতো। কিন্তু বৈদেশিক নীতি, অর্থনীতি এবং ডিফেন্স ও হোম, কেন্দ্রীয় সরকার তথা প্রেসিডেন্টের একচেটিয়া ক্ষমতায় থাকে। এর বাইরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্টেট বা রাজ্যগুলোকে সমস্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রেসিডেন্ট নাক গলান না। প্রায় প্রতিটি স্টেট নিজের সুবিধামতো আইন তৈরি করে। একবার লস এঞ্জেলস থেকে নিউ ইয়র্কে আসার পথে গ্রেহাউন্ড বাসে বসে ব্যাপারটা জেনেছিলাম। বাস অন্য কোনও নতুন স্টেটে প্রবেশ করছে তখনই ড্রাইভার যাত্রীদের জানিয়ে দিচ্ছেন সেই স্টেটের কোন কোন্ আইন মানতে হবে অথবা হবে না। যেমন, কোন্ স্টেট ধূমপানে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, কোন্ স্টেট করেনি।
আমাদের দেশেও এই প্রথা চালু করা উচিত। রাজ্যের নাগরিকদের স্বার্থ কেন্দ্রের হাতে থাকা অনেকগুলো ক্ষমতা, যা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না, তা রাজ্যের হাতে থাকা উচিত। রাজ্য সরকার যদি জাতীয় সড়কগুলি মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এবং অর্থ পেত তাহলে মানুষ বিপদে পড়ত না। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মানুষের স্বার্থে বাসের ভাড়া বাড়াতে চাইছেন না কিন্তু রাস্তার গর্তে পড়ে কত বাস বিকল হচ্ছে, সারাতে যে অর্থ চলে যাচ্ছে তার হিসাব কে রাখছে? কেন্দ্রীয় সরকার এখন নড়বড়ে। আগামী নির্বাচনের পর বহুদলীয় সরকার হলে সেটা টলমলে হবেই। আর তা হলে রাজ্যের মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়ে যাবে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, অবিলম্বে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানান যাতে রাজ্য জাতীয় সড়কগুলোর উপর পূর্ণ অধিকার পায়। বোধহয়, কেন্দ্রও বোঝা নামিয়ে খুশি হবে।
এছাড়া বিকল্প কোনও পথ নেই।
৫৬
এই সেদিনও আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। বাবা কাকা জ্যাঠারা সবাই একসঙ্গে, এক বাড়িতে। আমরা খুড়তুতো জ্যেঠতুতো ভাইবোনকে নিজের ভাইবোন ছাড়া ভাবতে পারি না। বাবা জ্যেঠারা বাড়িতে থাকার সময় একটু সন্তর্পণে থাকেন। কারণ মাথার ওপরে আছে আশিতে পা দেওয়া ঠাকুর্দা, বাহাত্তরের ঠাকুমা। একজন দেখেন বাইরের সংসার অন্যজন অন্দরমহল। বাবা জ্যেঠাদের সঙ্গে তাঁদের সমীহ করার সম্পর্ক, আমাদের সঙ্গে প্রাণখোলা। ছেলেরা প্রতি মাসের গোড়ায় তাঁদের বাবার হাতে নির্দিষ্ট টাকা দেয়। গ্রামে চাষ হওয়া ফসলের অর্থ তার সঙ্গে যোগ দিয়ে ঠাকুর্দা নিয়ম মেনে সংসার চালান। তাঁর উপর কথা বলার ক্ষমতা কোনও ছেলের থাকত না। ঠাকুমা ছেলেদের বউকে নিয়ে যেমন রান্নাঘর সামলাতেন তেমনই কার কী দরকার, কোন্ বউমার বাপের বাড়িতে কী অনুষ্ঠান আছে তার খবর রেখে ব্যবস্থা নিতেন। বাচ্চারা অসুখে পড়লে ওই বৃদ্ধা নাওয়াখাওয়া ভুলে যেতেন। সংসারে একটা অলিখিত কানুন চালু থাকত যা ভাবার কথা কেউ কল্পনাও করত না। অথচ ঠাকুর্দার নিজস্ব কোনও রোজগার অবসর নেওয়ার পর ছিল না কিন্তু পরিবারের সমস্ত ক্ষমতা তাঁর হাতেই থাকত।
একটু বড় হয়ে আমরা ইউরোপ আমেরিকার কাহিনি শুনতে পেলাম। সেখানকার ঠাকুর্দা-ঠাকুমারা নাকি খুব কষ্টে থাকেন। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে তাঁদের ত্যাগ করে চলে গিয়ে আলাদা সংসার পাতে। বছরের দু’দিন তাঁরা বাবা মায়ের খবর নেয়। সেই দু’দিনকে বলা হয় ফাদার্স ডে। মাদার্স ডে। আমরা কল্পনা করতাম, অসুস্থ বাবা মা বিছানা থেকে উঠে এক গ্লাস জল খেতে পারছেন না অথচ তাঁদের ছেলেমেয়েরা তখন কার্নিভালে যাচ্ছে, নানান আমোদ করছে। ওই লোকগুলোকে ভয়ঙ্কর খারাপ মনে হত। আমাদের ঠাকুর্দা-ঠাকুমাকে ওই অবস্থায় দেখার কথা কল্পনা করতে পারতাম না। অসম্ভব।
তারপর, এক সময় অর্থনৈতিক কারণের অছিলায় আমাদের একান্নবর্তী সংসার ভেঙে গেল। চাকরির কারণে প্রবাসে চলে যাওয়া ছেলের সঙ্গে তার স্ত্রী-পুত্রকে যেতে হত। ছেলেমেয়ের বড় হওয়ার ফলে ঘরের সমস্যা দেখা যেতে কোনও কোনও ছেলেকে আলাদা বাড়ি ভাড়া করতে হত। অনেক কালের চাপা পড়ে থাকা অভিমান, ঈর্ষা ইত্যাদি এই সংসারে মাথা তোলায় সম্পন্ন ছেলে অছিলা বের করে আলাদা হয়ে গেল। পুরনো বাড়িতে ঠাকুর্দা-ঠাকুমা থেকে গেলেন সেই ছেলে বা ছেলেদের সঙ্গে যাঁরা আর্থিক দিক্ দিয়ে তেমন সম্পন্ন নয়। এই সময় থেকে সঙ্ঘাত শুরু হয়ে গেল। এতদিন যে অভ্যাসে ঠাকুমা রান্নাঘর চালাতেন সেই অভ্যাসে ছোট সংসার চালাতে গিয়ে শুনলেন, ‘জিনসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। আগের মতো মাছের বড় টুকরো করা চলবে না। আজ দুভাগের বদলে চার ভাগ করতে হবে। দুবেলা ভাতের বদলে রাত্রে রুটি হলে ভাল হয়।’ বিরক্ত হতে হতে ঠাকুমা হাত গুটিয়ে নিলেন। বললেন, ‘বউমা, তুমি দায়িত্ব নাও। আমি তো অন্যভাবে সংসার করেছি, এখন তুমি কর।
ক্রমশ ঠাকুর্দার হাত থেকে ছেলের হাতে সংসারের ঝক্কি সামলানোর দায়িত্ব চলে গেল। ঠাকুর্দা-ঠাকুমা রোজ বিকেলে কালীমন্দিরে যান। গিয়ে পাঠ শোনেন। সব ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে জড়ো হয় বিজয়া দশমীতে। বৃদ্ধ বৃদ্ধার সেদিন যেন জন্মদিন হয়ে যায়।
আমার ঠাকুর্দা সারাজীবন চাকরি করে জলপাইগুড়িতে একটি বিশাল বাড়ি বানিয়েছিল। প্রতিটি ছেলেমেয়ের জন্য আলাদা ঘর। খাওয়ার ঘরে একটা লম্বা সিমেন্টের টেবিল, যার দু’পাশে কুটিটি চেয়ার। ঠাকুর্দার বাসনা ছিল ওই চেয়ারগুলোয় তিনি ছেলেমেয়ে নাতিনাতনিদের সঙ্গে বসে গল্প করতে করতে দু’বেলা খাবেন। যেহেতু আমি তাঁর কাছে থেকে স্কুলজীবন শেষ করেছি, তাই আমার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতেন। প্রতিদিন নিজে বাজার যেতেন। সাতানব্বই বছর বেঁচে থেকে মারা যাওয়ার দু’দিন আগেও সেটা করেছেন। তাঁকে কখনওই প্রেসারের ওষুধ খেতে দেখিনি। শেষ দশ বছর, আমি তখন কলকাতায়, আমার বিধবা বড় পিসিমা ছাড়া তাঁর পাশে কেউ ছিল না। কোনও ছেলের কাছে অর্থ সাহায্য নিতেন না। পেনশনের সামান্য টাকায় কীভাবে চালাতেন জানি না। আচমকা বাড়ি গিয়ে দেখেছি, সেদিনের দুপুরের মেনু ভাত ডাল আলুসেদ্ধ আর ঢেঁকিশাকের চচ্চড়ি। এই ঢেঁকিশাকটা তখন জলপাইগুড়িতে বিনা পয়সায় পাওয়া যেত। মনে আছে, বড় পিসিমা খাবার দিলেন। ঠাকুর্দা সেই লম্বা টেবিলের এক প্রান্তে, আমি অন্যপ্রান্তে। দু’পাশের আঠারোটি চেয়ার ফাঁকা। বাবা কাকারা যে যাঁর চাকরির জায়গায়। সেখানেই শেকড় গেড়েছেন। ওই ফাঁকা চেয়ারগুলো দেখে আচমকা ঠাকুর্দার বাসনা মনে পড়ে গেল। কী যে হল, বুক উপচে কান্না চলে এল চোখে। অনেকটা দূরে বসা ঠাকুমা সেটা দেখে বলতেন, ‘কেঁদো না। এটাই হওয়ার কথা। তবে এখন মনে হচ্ছে আমি একা নই। তুমিও আছ।’
প্রথমবার আমেরিকায় গিয়ে ভুলটা ভেঙেছিল। নিউইয়র্কের কুইন্সে থাকতাম। পাশের বাড়িতে এক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা প্রায় সারাদিন বকবক করতেন। আলাপ হল। কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করাতে বৃদ্ধ বললেন, ‘সপ্তাহের ছ’টা দিন খুব ভাল থাকি আমরা। রবিবার হলেই আতঙ্কিত হই। ওই দিন ছেলেমেয়েরা আমাদের দেখতে আসে। নাতিনাতনিরা সারাদিনে বাড়ি লণ্ডভণ্ড করে চলে যায়। প্রিয় জিনিস ভাঙে, গাছের ডালগুলোকে দুমড়ায়। এবার ঠিক করেছি ওদের বলব বাচ্চাদের সঙ্গে না নিয়ে আসতে। ভয়ঙ্কর। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘ওদের দেখে মনে স্নেহ আসে না’
‘নো। নট অ্যাট অল। তুমি যখন আমার বয়সে আসবে তখন যদি দ্যাখো যাবতীয় পছন্দের জিনিস তোমার নাতির বদমায়েশিতে নষ্ট হচ্ছে তখন দেখো স্নেহ বলে সেটা অনুভব হচ্ছে না। আমরা দুজনে নিরিবিলিতে একা থাকতেই স্বচ্ছন্দবোধ করি। বৃদ্ধ বলেছিলেন।
সেদিন সল্টলেকের একটি বাড়িতে গিয়েছিলাম। দোতলা বাড়ি। বৃদ্ধ বৃদ্ধা থাকেন। ছেলেদের একজন বেঙ্গালুরুতে বাড়ি করেছে, অন্যজন মুম্বইতে। দু’জনেরই পায়ে ব্যথা, হার্টের অসুখ। কাজের মহিলাই ভরসা। বললাম, ‘ছেলেদের কাছে চলে যান না!!’
‘অ্যাঁ? তাহলে এই বাড়ি কেন করেছিলাম?’ বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন।
বৃদ্ধা বললেন, ‘গেলে তো ওখানে ঝিগিরি করতে হবে।’
বৃদ্ধ বললেন, ‘আমরা চলে গেলে ওরা বাড়ি বিক্রি করে ভাগাভাগি করে নিত। ‘নিত’ মানে? আমি অবাক।’
‘বাড়িটাকে আমরা মিশনে দান করে দিয়েছি। ওরা এসে শ্রাদ্ধ করে দেখবে বিক্রি করতে পারছে না। হে হে হে।’ বৃদ্ধ হাসলেন।
বৃদ্ধা বললেন, ‘যাই বলুন, এই অসুখ-বিসুখ না হলে একা একা দু’জনের থাকতে বেশ ভালই লাগত। এই বয়সে কারও মন রেখে চলতে পারব না। বাচ্চাদের হ্যাপা আর সহ্য করতে পারি না।’
একান্নবর্তী পরিবারের ঠাকুর্দা-ঠাকুমারা আজ নেই, তখনকার নাতিনাতনিরাই আজ সেই বয়সে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এদের মনের চেহারাটা একদম বদলে গিয়েছে।
৫৭
যখন ছাত্র ছিলাম, সেই ষাট-পঁয়ষট্টি সালে তখন কেউ উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে যাচ্ছে শুনলে মন খারাপ হত না। কারণ, সে সময় ধনী পরিবারের ছেলেরা আইন পাশ করার পর ব্যারিস্টারি পড়তে ইংলন্ডে যেত। উকিল হওয়ার আগ্রহ আমার ছিল না, তার চেয়ে বেশি ছিল না বিদেশে পড়তে যাওয়ার আর্থিক সামর্থ্য। অতএব আমরা ধরে নিতাম বিদেশে পড়তে যায় একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষের সন্তানেরা। আমরা তখন কফি হাউসে আড্ডা মারছি, লিটল ম্যাগ বা গ্রুপ থিয়েটার নিয়ে প্রবল উত্তেজিত হয়ে আছি। আমাদের পকেটে পয়সা নেই কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবছি না। যাকে ভাল লেগেছে তাকে দেখার জন্যে এক লক্ষ মাইল হেঁটে যাওয়ার বয়স তখন
ওরকম সময়ে এক বিকেলে অনিল মন খারাপ করা মুখ নিয়ে কফিহাউসে এল। সে কয়েক মাস আগে শিবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রি পেয়ে মোটামুটি মাইনের চাকরি করছে। দারুণ গদ্য লেখে। ক্রিয়াবিহীন সেই গদ্যের লাইনে এমন বিরল শব্দ ব্যবহার করে যে কমলকুমার মজুমদার পর্যন্ত অবাক হতেন। সেই অনিল বলল, ‘আজ আমি তোদের কফি খাওয়াচ্ছি।’ সবাই অবাক। শংকর জিজ্ঞাসা করল, ‘মরেছে। চাকরি পেলেই বাঙালি বিয়ে করে। তাই খাওয়াচ্ছে।’
‘নারে। বিয়ে নয়। বিদেশে যাচ্ছি। আমেরিকায় চাকরি পেয়েছি।’
আমরা অবাক চোখে অনিলকে দেখেছিলাম সাতষট্টি সালে। খানিকটা দূরের টেবিলে সুনীলদা বসেছিলেন সঙ্গীদের নিয়ে। কয়েক বছর আগে সুনীলদা আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা লেখার দৌলতে গিয়ে কিছুকাল কাটিয়ে ফিরে এসেছিলেন। সুনীলদার দিকে তাকিয়ে অনিল বলেছিল, ‘বেশিদিন থাকব না। কয়েক বছর থেকে ডলার রোজগার করে ফিরে আসব। আমিও। দেখিস।’ অনিল চলে গেল। আমরা কেউ ওকে সি-অফ করতে এয়ারপোর্টে যাইনি। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মাস্টারমশাই-এর ছেলে কেন আমেরিকায় চাকরি করতে যাবে, এই প্রশ্ন করেছিল বন্ধুরা। যে আমেরিকা ভিয়েতনামে মানুষ মারছে, সেই সাম্রাজ্যবাদীদের দেশে কেন লিটলম্যাগ করা গদ্যকার যাবে?
আটষট্টি থেকে বাহাত্তর হঠাৎ জার্মানিতে যাওয়ার ঢেউ এল। তখন সেদেশে অনেক চাকরি খালি পড়ে আছে, উপযুক্ত লোক পাওয়া যাচ্ছে না। ইঞ্জিনিয়ার নয়, পলিটেকনিক্যাল স্কুল থেকে পাস করা ছেলেরা দরখাস্ত করে দিব্যি চাকরি পেয়ে গিয়েছে জার্মানিতে। আমরা যারা বিজ্ঞান নিয়ে পড়িনি তাদের সামনে কোনও সুযোগ ছিল না। তাই না-যাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয়েছিল।
পঁচাত্তর থেকে শুরু হল ইঞ্জিনিয়ার এবং ডাক্তারদের আমেরিকা যাওয়া। তাঁদের চাকরি পাওয়া তখন সহজ ছিল। একসময় সেটা থিতিয়ে গেলেও প্রবল হল কমপিউটার সায়েন্সের দৌলতে। এই আইটি-র চাকরিতে দুটো ভাগে ছেলে-মেয়েরা যাচ্ছে। এক, সরাসরি ওখানকার কোম্পানিগুলোতে চাকরি, দুই, ভারতীয় কোম্পানি যাদের শাখা অফিস ওখানে আছে অথবা আমেরিকান কোম্পানি যাদের শাখা অফিস ভারতে আছে এবং সেই ভারতীয় অফিসে যেসব কমপিউটার ইঞ্জিনিয়ার কাজ করেন তাঁদের কয়েক বছরের জন্য ডেপুটেশনে ওদেশে পাঠানো হয়। এঁদের অনেকেই চেষ্টা করেন কাজ শেষ হওয়ার আগে ওদেশে চাকরি জুটিয়ে নিতে। ভিসার কড়াকড়ির জন্য অনেকসময় সেটা সম্ভব হয় না। দেখতে দেখতে আমেরিকায় এমন কোনও শহর পাওয়া যাবে না যেখানে বাঙালি নেই। এটা অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রেও সত্যি। ইংলন্ড তো বাঙালির সেকেন্ড হোম। রাস্তায় হাঁটলেই বাঙালি। কিন্তু পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের পিছনে ফেলে একাত্তরের পর বাংলাদেশের বাঙালিরা জমিয়ে আছেন বিদেশে।
মনে আছে, চুরাশি সালে ওয়াশিংটনে একদম একা আমি বাঙালির সন্ধানে টেলিফোনের বই ঘেঁটেছিলাম হোটেলের ঘরে বসে। ব্যানার্জি, মুখার্জি, চ্যাটার্জিদের দেখার পর হঠাৎ পাইন দেখতে পয়ে কৌতূহলী হয়ে ফোন করতে চোস্ত ইংরেজিতে কেউ পরিচয় জিজ্ঞাসা করাতে বাংলায় বলেছিলাম, ‘আপনি কি বাঙালি?’ উত্তর হয়েছিল, ‘আপাদমস্তক বাঙালি। অধমের নাম রমেন পাইন। ভয়েস অফ আমেরিকায় আছি। আপনি?’ পরিচয় শুনে বললেন, ‘পয়তাল্লিশ মিনিট পরে হোটেলের লবিতে নেমে আসুন, আসছি।’ তখন রাত সাড়ে ন’টা। সওয়া দশটায় ভদ্রলোক এলে আমি অবাক। ইনি তো দূরদর্শনে খবর পড়তেন। সে রাতে ওঁর বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে ফিরতে আড়াইটে বেজেছিল।
কিন্তু এই রমেনদা আমেরিকার বাঙালিদের প্রতিনিধি নন। কথাটা বলেছিল মনোজ, মনোজ ভৌমিক। কলকাতায় গ্রুপ থিয়েটার করা ইঞ্জিনিয়ার মনোজ কেনেডি এয়ারপোর্টে আমাকে নিতে এসেছিল। আমি অবাক হয়ে দেখতাম, ওর পরনে পাজামা, খাটো পাঞ্জাবি, পায়ে চপ্পল। মাসটা মে হলেও এই পোশাকে আমেরিকায়, ঘরের বাইরে? গাড়িতে উঠে বললাম, ‘আপনি তো কফি হাউসে যাওয়ার পোশাক পরে আছেন!’ মনোজ হেসে বলেছিল, ‘আমি যা তাই আছি। বাকিরা ভেক ধরে আছে। এখানে এসে মেপে মেপে কথা বলে। সোম থেকে শুক্র ভোরে চা বানিয়ে বাথরুমে যায়। ব্রেকফাস্টা না খেয়ে গাড়ি নিয়ে স্টেশনে যায় ট্রেন ধরতে। কাঁটায় কাঁটায় অফিসে ঢোকে। আবার বিকেল হলে বাড়ি ফিরেই ডিনার খেয়ে বিছানায় যায় যাতে পরের ভোরে উঠতে পারে। শনিবারে জামাকাপড় কাচে, ঘর পরিষ্কার করে। রোববার সারা সপ্তাহের ডাল-ভাত রাঁধে। আর শনিবার বিকেলে বউকে নিয়ে তিরিশ চল্লিশ মাইল দূরের কোনও বাঙালির বাড়িতে গিয়ে আরও দশজনের সঙ্গে মিলে একই কথা বলে। গাড়ি চালাতে হলে ড্রিঙ্ক করতে পারে না, বউকে ড্রাইভিং শেখায় যদি ফেরার সময় স্টিয়ারিং ধরে তাহলে আধপেগ মদ গিলতে পারে। দেখে দেখে চোখ বন্ধ করে আছি।’ সারা দেশ ঘুরে মনোজকে রমেনবাবুর কথা বললে সে উত্তেজিত হয়ে নাম্বার নিয়ে ফোন করেছিল। বলেছিল, ‘আপনার কথা শুনে অক্সিজেন পেলাম।’ মনোজকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘এখানে এতই যখন অসুবিধে তখন দেশে ফিরে যাচ্ছেন না কেন?’ ‘যাব। দুটো ছবি তৈরির টাকা জোগাড় করে দেশে ফিরব। আমার স্বপ্নের ছবি।’ মনোজ গাড়ি চালাতে চালাতে হার্ট অ্যাটাকে চলে গেছে ক’দিন পরে।
যাঁরা বিদেশে আছেন তাঁরা তাঁদের মতো আছেন। ছেলেটি তিনবছর আগে চাকরি নিয়ে গেল। গিয়ে রুম শেয়ার করে থেকে দেশে প্রতিমাসে হাজার ডলার পাঠাচ্ছিল। তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করলেন তার বাবা-মা। একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া করায় সে দেশে পাঠাতে লাগল পাঁচশো ডলার। কিন্তু শনিবারের বাঙালিদের আড্ডায় ক’বার যাওয়ার পর বউ আবদার করল তাদের একটা বড় বাড়ি চাই যেখানে সে সবাইকে ডাকতে পারবে। ইএমআই-তে বাড়ি পাওয়া গেল। গাড়ি, ইনসিওরেন্স, খাওয়া, ইএমআই-এর দায় মিটিয়ে দেখা গেল হাতে পড়ে আছে চারশো ডলার। তা থেকে বাঁচিয়ে প্রতিবছর দেশে ফেরার বিমানভাড়া এবং গিফট কিনতে হবে। তাতে না কুলোলে একবার বউ যাবে, অন্যবার সে। দেশে গিয়ে কোনওভাবেই পকেটে টান পড়েছে বোঝানো যাবে না। এর পরে বাবা-মাকে টাকা পাঠাবার কোনও উপায় নেই। ইচ্ছে থাকলেও নেই। শহরের বাইরে হল দ্বীপের মতো বাড়ি। স্ত্রী টেলিফোনে অনর্গল কথা বলছেন ডিনার সেরে। এদেশে এসে সিগারেট বন্ধ। এসির জন্য জানলাও। স্বামী বিছানায় শুয়ে কল্পনা করেন সন্ধে সাড়ে সাতটায় গড়িয়াহাটের মোড়টাকে। চোখ বন্ধ করেন।
যদ্দিন বাবা-মা আছেন তদ্দিন দেশে না গেলে নয়। এঁরা চলে গেলে দায় ঢুকে গেল। ভাই-বোন থাকলে তখন বাড়ির ভাগটা উদার হয়ে ছেড়ে দেওয়া। না থাকলে, সল্টলেকের বড় বাড়িটা বিক্রি করতে আট বছর পরে না যাওয়ার কোনও মানে নেই। মহিলা বললেন, ‘একটা বিএমডব্লু, লেটেস্টের খুব ইচ্ছে ছিল। ও তো কিনে দেবে না। এই সুযোগ। কোন্ মুর্খ ছেড়ে দেয়, বলুন সমরেশদা?’
৫৮
আমার তখন চৌত্রিশ বছর বয়স, সবাই নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। শুধু এক বন্ধু বিয়ে করেনি। চাকরির পরের সময়টায় সে সমাজসেবা নিয়ে ব্যস্ত। তার বাড়িতে যেতেই মাসিমার মুখে একটি সংলাপ শুনলাম, ‘ও সমরেশ! এত করে বলছি কিন্তু ও কিছুতেই শুনছে না। তুমি যেখান থেকে পারো একটা ভদ্রগোছের মেয়ে এনে দাও। যে কোনও জাতের মেয়ে, হিন্দি, উর্দু যা বলে বলুক, শুধু মুসলমান যেন না হয়।’
কয়েকদিন আগে এই সংলাপটাই কানে এল। ‘আমার ছেলের জন্য ভাল মেয়ে পাচ্ছি না। যাকে পছন্দ করছি সে নাকি কাউকে মন দিয়ে বসে আছে। জাত নিয়ে আমার কোনও প্রশ্ন নেই, শুধু মুসলমান না হলেই হল।’ এই দু’জনের বয়সের ব্যবধান অন্তত চল্লিশ বছরের। তবু সংলাপ প্রায় এক। কেন?
বাঙালি হিন্দু (যাঁরা নিজেদের হিন্দু মনে করেন, জন্মসূত্রে) কবে থেকে বাঙালি
মুসলমানদের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি করে রেখেছেন তা নিয়ে কোনও সমীক্ষা হয়ে থাকলেও আমার চোখে পড়েনি। কেউ কেউ বলেন, ছেচল্লিশের দাঙ্গা, পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত হিন্দু বাঙালি যে ভয়ঙ্কর অত্যাচারের স্মৃতি তাদের উত্তরপুরুষের সামনে তুলে ধরেছিলেন তা থেকে পরের প্রজন্মের মানুষ মুক্ত হননি। স্বাধীনতার কিছু আগে পরে যাঁরা সব হারিয়ে ভারতে এসেছিলেন তাদের মনে মুসলমান বাঙালিদের সম্পর্কে তিক্ত ধারণা বদ্ধমূল হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ছেচল্লিশের দাঙ্গা যাঁরা দেখেননি, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া বা বর্ধমানের মানুষেরা যখন একই ভাবনা ভেবে থাকেন, তখন বিস্ময় জাগে। কেন?
ইতিহাস বলে এই ভূখণ্ডের কিছু মানুষ অত্যাচার অবহেলা উপেক্ষা সহা করে বেঁচে ছিলেন হাজার বছর আগে। সমাজের উচ্চ-মধ্য-নিম্ন শ্রেণিতেও তাঁদের জায়গা হত না। অস্পৃশ্য হিসেবে সমাজের কর্তারা তাঁদের ব্যবহার করে বর্জন করতেন। মহম্মদ ঘোরী যখন গৌড় দখল করেন, লক্ষ্মণ সেন পালিয়ে যান তখন মুসলমানরা ক্ষমতায় আসে। সমাজের মূল তিন শ্রেণির মানুষ শাসকরা ম্লেচ্ছ মনে করে দূরে সরে থাকায় শ্রেণিহীন মানুষেরা সেই সুযোগ গ্রহণ করেন। তাঁরা শাসকদলের সঙ্গে হাত মেলান। ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্যে মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। শাসকরা যেমন তাঁদের সাহায্য করে তেমনই মুসলমান হওয়ায় এই শ্রেণিহীন মানুষেরা পায়ের তলায় মাটি পেয়ে যান। নতুন ধর্ম তাঁদের বর্ম হয়ে যাওয়ায় আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হন। কিন্তু এই ধর্ম পরিবর্তন, ম্লেচ্ছ শাসকদের চাটুকার হওয়া সমাজের কর্তারা পছন্দ করেননি। ওরা তাঁদের বশংবদ হয়ে থাকছে না বলে ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন কিন্তু শাসন করতে পারেননি। নবীন ধর্ম তাঁদের শাসন করার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল।
বিদ্বেষের শুরু কি সেই থেকে! এক দল মানুষ আত্মরক্ষার জন্যে ধর্মান্তরিত হল, হয়ে মাথা তুলল বলে কি অহঙ্কারে ঘা লেগেছিল? একথার বিশ্লেষণ সমাজবিজ্ঞানীরা করবেন। আমরা শুধু জানি, দীর্ঘকাল একই গ্রামের অন্য প্রাস্তকে মুসলমানপাড়া বলে চিহ্নিত করা হত। তাদের ধরা মাছ কিনতে, চাষ করাতে হিন্দু বাঙালিদের কোনও সমস্যা হত না। কিন্তু বাড়ির অন্দরে দূরের কথা, বাইরের ঘরেও তাদের প্রবেশ করতে দেওয়া হত না। ছেলেবেলায় দেখেছি, কলাইয়ের গ্লাস বা থালা আলাদা করে রাখা হত যদি কোনও মুসলমান ধর্মীকে জল বা খাবার দিতে হয়। আমার সঙ্গে স্কুলে পড়ত তাহের নামের একটি ছেলে। যেই বড় পিসিমা জানতে পারলেন ওর নাম অমনি কাঁসার গ্লাসের বদলে কলাই গ্লাসে জল দিলেন তাকে। আমাকে ভেতরে ডেকে নিচু গলায় বললেন, ‘ওকে ভেতরে ঢোকাবি না। বাইরের বারান্দায় বসে কথা বল।’ অথচ তাহেরের বাড়ি গেলে ওর মা আদর করে ভেতরের ঘরে নিয়ে যেতেন। ওরা যা যেভাবে খায় তাই খেতে দিতেন। প্রথমবার বাড়ি ফিরে খাওয়ার কথা বলেছিলাম বলে আমাকে শীতের সন্ধ্যায় স্নান করতে হয়েছিল। কেন এই বিদ্বেষ? কেন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা এখনও বাংলাদেশের বাঙালিদের বাঙালি না বলে মুসলমান বলবে? ওই মুসলমান মেয়েটা বা মুসলমান ছেলেটা বলা কেন অভ্যাস হয়ে যাবে? আমরা তো কখনও ওই হিন্দু ছেলেটা বা হিন্দু মেয়েটা বলি না? বহুবার বাংলাদেশে যাতায়াত করে ও আমি কখনও কোনও মুসলমান বাঙালির মুখে হিন্দু ছেলেটা বা মেয়েটা জাতীয় সংলাপ শুনিনি। সেই পুরনো কথা আবার বলছি। আশি ভাগ হিন্দু বাঙালি কথা প্রসঙ্গে বলে থাকেন, ‘আমরা বাঙালি আর ওরা মুসলমান।’ অর্থাৎ ধর্মই ওদের পরিচিতি, ভাষা-সংস্কৃতি নয়।
অধ্যাপক আনিসুজ্জমান একটি প্রবন্ধে প্রশ্ন করেছিলেন, বাঙালি কে? উত্তরটা তিনি দিয়েছিলেন এই রকম, (এক) যিনি এই ভূখণ্ডে জন্ম নিয়েছেন, যাঁর মাতৃভাষা বাংলা এবং সেই ভাষায় তিনি কথা বলেন। (দুই) যিনি বিদেশে জন্ম নিয়েছেন, কিন্তু মাতৃভাষা বাংলা এবং সেই ভাষায় কথা বলেন। (তিন) যিনি এই ভূখণ্ডে জন্ম নিলেও যাঁর পূর্বপুরুষ অন্যদেশ থেকে একদা এসেছিল কিন্তু তাঁর মা এবং পরিবার বাংলা ভাষায় কথা বলেন, বাংলার সংস্কৃতিকে নিজের সংস্কৃতি বলে মনে করেন, তিনি বাঙালি। (চার) বিদেশে বাস করছে এমন বাঙালি পরিবারের সন্তান মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও বিদেশি ভাষায় স্বচ্ছন্দ। বাংলা বলেন না, বাংলা সংস্কৃতির ছায়া মাড়ান না, তিনি কখনও বাঙালি নন। (পাঁচ) ক্রমশ পশ্চিমবাংলা বা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা সন্তানের একাংশ বাংলা বর্জন করে অন্য সংস্কৃতি এবং ভাষায় আসক্ত হয়ে উঠেছে তাদেরকেও বাঙালি বলা সঙ্গত নয়।
অধ্যাপক আনিসুজ্জমানের এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী ধর্মের কোনও স্থান বাঙালিত্ব নির্ধারণে নেই। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাসকে কি আমরা হিন্দু গায়ক বলব? দিলীপ কুমার থেকে আমির খান, মহম্মদ রফি থেকে বন্যা, বাঙালি কি কখনও মুসলমান অভিনেতা, গায়ক বলেছি। নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথকে তো আমরা ধর্মের সাইনবোর্ড দিয়ে চিহ্নিত করি না। অথচ এই আমরাই কেন তীব্র মৌলবাদী হয়ে উঠি?
আমার এক বন্ধু ফোন করেছিলেন। তাঁর সদ্য খালি হওয়া একটি ফ্ল্যাট ভাড়া দেবেন। বললেন, ‘বারো হাজার চাইছি, তিন মাসের অ্যাডভান্স। এগারো মাসের কন্ট্রাক্ট। কিন্তু ভাই একটা সমস্যায় পড়েছি। কাল একটি ছেলে এল। সেক্টর ফাইভে আইটিতে চাকরি করে। ফ্ল্যাট দেখে খুব পছন্দ হওয়ায় তখনই টাকা দিতে চাইল। কিন্তু নাম শোনার পর আমার স্ত্রী আপত্তি করছেন।’
‘কেন?’ জিজ্ঞাসা করলাম।
ছেলেটির নাম মতিন খান। মুসলমান। বন্ধু বললেন। ‘ও’, ‘আপনার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করুন তো মতিনের বদলে আমির খান হলে উনি আপত্তি করতেন না খুশি হতেন?’ ফোন রেখে দিয়েছিলাম।
আমি লক্ষ করছি এই দূরত্বের কারণ নিজেদের আলাদা চিহ্নিত করতে বাংলাদেশের মুসলমানরা ধুতি পরেন না। খাবারে অতিরিক্ত মশলা ব্যবহার করেন। ভাষায় ফরাসি, উর্দু শব্দের আমদানি করছেন। এ পারের বাঙালিরা যা বলেন না তা এঁরা স্বচ্ছন্দে বলছেন। যেমন স্বামীকে জামাই বলার চল এপারে নেই। আমাকে নেমন্তন্ন করে দশ রকমের মাছের সঙ্গে পাঁঠা এবং গরুর মাংসের সসপ্যান টেবিলে রেখে বলছেন, ‘আপনি নিশ্চয় গরু খাবেন না।’
কিন্তু পাশাপাশি আর একটা ঘটনা ঘটছে। এপারের নব্বুইভাগ কি তারও বেশি লোক ধর্মাচরণ করেন না। তেমনই ওপারের নবীন সম্প্রদায় নিত্য নমাজ পড়ছেন না। না পড়ার কারণ হিসাবে নানা অজুহাত তৈরি করেছেন কোরানকে সামনে রেখে। যেমন কেউ অসুস্থ, কেউ মুসাফির ইত্যাদি। সেদিন একজন বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী দৃঢ় বিশ্বাসে বললেন, ‘আমার ঈশ্বর রবীন্দ্রনাথ’।
এপার বাংলার ক’জন মানুষ একথা বলতে পারেন।
৫৯
হিসেবটা কতটা সত্যি তা আমি জানি না। কিন্তু শুনতে শুনতে এবং দেখে দেখে কিছুটা বিশ্বাস হচ্ছে, সত্যি হলেও হতে পারে। সেদিন একটি কাগজে পড়লাম, এখন হিন্দু বাঙালি পরিবারে বিয়ে করে ছেলেমেয়েরা, অভিভাবকরা খুশি হয়ে অথবা না হয়েও মেনে নেয়। কার্ড ছাপায়, বাড়িতে বাড়িতে ক্যুরিয়ারের মাধ্যমে সেটা পাঠায়। বিয়েবাড়ি ভাড়া করে নিমন্ত্রিতদের খাওয়ায়। মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে চলে গেলে বাবা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন, ‘যাক। আমার দায়িত্ব শেষ। ও নিজে পছন্দ করেছে, গোলমাল হলে বলতে পারবে না, বাবা আমার জীবনটাকে নষ্ট করে দিল।’ ওই কাগজে পড়লাম, এখনকার অন্তত ষাট থেকে সত্তরভাগ বিয়ে হচ্ছে ছেলে-মেয়েদের পছন্দ অনুযায়ী।
মেয়ে অন্যের সংসারে চলে গেলে বাবা যদি ভাবেন নিষ্কৃতি পাওয়া গেল, ছেলের বউ এলে যুদ্ধের মতো মুখ করে থাকেন। বুঝতে চেষ্টা করেন বউমার চরিত্র। গম্ভীর বুদ্ধ থেকে লাফিং বুদ্ধ সচরাচর হয়ে ওঠা হয় না। একযুগে অশিক্ষিত শাশুড়িরা নতুন কচি বউকে গড়েপিঠে নিতেন, তাতে কাজ না হলে শাসনের বন্যা বইয়ে দিতেন। যে অভিজ্ঞতা তিনি তাঁর শাশুড়ির কাছ থেকে পেয়েছিলেন তার বদলা নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতেন না এখনকার বউমারা শিক্ষিতা, বিচক্ষণ। তাঁরা সংঘাতে যেতে চান না। উল্টে বলেন, ‘তোরা আলাদা ফ্ল্যাট দ্যাখ, তাতে সম্পর্ক ভাল থাকবে।’ ছেলের রোজগার ভাল হলে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে দু’কথায় রাজি হয়ে যাবে। ভাল না হলে নিশ্চিত নিরাপত্তা ছেড়ে বের হতে চাইবে না। যে ছেলেকে বোতলে দুধ খাওয়ানোর কাল থেকে গড়েপিঠে মা মানুষ করেছেন, বিয়ের পর তার ব্যাপক পরিবর্তন দেখে মা দরজা বন্ধ করে কাঁদবেন। যে ছেলে আগে কখনওই দুধ খেত না সে এখন বউ-এর কথায় চোঁ চোঁ করে খেয়ে নিচ্ছে। বিয়ের আগে যে অফিস থেকে রাত ১০টায় বাড়িতে ফিরত সে এখন ৬টায় ফিরছে। কর্তা যতই বলুন, এ সব সামান্য ব্যাপার, নজর দিও না। কিন্তু দিও না বললে হয়? বুক শুকিয়ে ওঠে। তার চেয়ে আলাদা হোক। রোজ চোখ চেয়ে দেখতে হবে না, ছেলে অফিসে চলে গেলে বউমা ‘শাশুড়ি মা, আমি আসছি’ বলে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছে। ফিরছে ছেলের গা ঘেঁষে বিকেল পেরিয়ে। তার চেয়ে ওরা আলাদা হোক। আগে মেয়ে বিয়ের পর দূরে যেতে বাধ্য হত, এখন ছেলেরা যাচ্ছে। না গেলে শাশুড়ি দেখছে, সংসারটা বেহাত হয়ে যাবে।
পঁচিশভাগ বিয়ে এখনও অভিভাবকদের পছন্দ অনুযায়ী হচ্ছে। শহর নয় মফস্বল, গ্রাম মিলিয়ে এই তথ্য দিয়েছে কাগজটি। ছেলে ভাল, বাবা-মায়ের কথা শোনে। এখনও বলে, তোমাদের পছন্দই আমাদের পছন্দ। বুক ভরে যায় বাবা-মায়ের। কিন্তু একি! যে মেয়ের রূপগুণ দেখে মুগ্ধ হন তার নাকি পছন্দের প্রেমিক আছে। উনিশ বছরের কলেজের মেয়ে নাকি প্রেম করছে পাঁচ-ছয় বছর ধরে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আগাম না জানা যাওয়ায় একটু এগোলেই ফোন আসছে, ‘আর এগোবেন না, দিতি আমার প্রেমিকা।’ ব্যাস সব গোলমাল হয়ে গেল। রেগে যাওয়া বাবা তার স্ত্রীকে বলেন, ‘আচ্ছা, যত সুন্দরী বাঙালি মেয়ে আছে তাদের সবাই কি একটা জুটিয়ে রেখেছে? তা হলে ছেলের বিয়ে দেবে কার সঙ্গে? শোন, সুন্দরী দরকার নেই, নাক-চোখ একটু ভাল, মানে তার প্রেমে কেউ পড়বে না, এমন মেয়ে খোঁজ কর।’ পাড়ার মেশোমশাই খবর আনলেন, ছবি দেখবেন। অপূর্ব সুন্দরী। এমএ পাস, স্কুলে পড়াচ্ছে। এই মেয়েকে চাই। প্রেম করে না তো? মেসোমশাই বললেন, ‘সত্যি কথা বলছি, কলেজে থাকতে একটা বাজে ছেলের পাল্লায় পড়ে চিঠিপত্র লিখেছিল। পরে ভুল বুঝে কাটিয়ে দিয়েছে। এখন সে সব অতীত। আজকাল এ সব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।’ মেশোমশাই চলে গেলে ঝিম হয়ে বসেছিলেন বাবা। মা মাথা নেড়ে বললেন, ‘যাক’। তবু সম্বন্ধের বিয়ে হচ্ছে। বিয়ের দিন বিউটি পার্লারের দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছে। মেয়ের চেহারার কোনও খুঁত যেন নিমন্ত্রিতরা বুঝতে না পারে। সিনেমার নায়িকারা ফলস চুল পরলে যদি দোষ না হয় তা হলে কনে পরলে হবে কেন? আগে কনে সাজাতেন দিদি-বউদিরা। এখন পেশাদার হাত দরকার। তার জন্যে ভাল টাকা ধরা থাকে। কাগজটি জানাচ্ছে, এর ফলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা যাদের ছিল সেই মেয়েরা সংসারী হচ্ছে।
এই সত্তর-পঁচিশের বাইরে একটা সংখ্যা আছে। এর দুটো ভাগ। এক, বিয়ে করব না। একা থাকব। দুই, বিয়ে করব না কিন্তু স্টে টুগেদার করব। দ্বিতীয়টির কথা তিরিশ বছর আগে উচ্চারণ করতে সাহসী হত না কেউ। দু’টি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ-নারী বিয়ের সার্টিফিকেট ছাড়া বাড়ি ভাড়া চাইতে এলে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হত। এখন হয় না। তবে এ সব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, দু’জনেই বেশ মোটা মাইনের চাকরি করে। অফিসের আলাদা গাড়ি ছাড়াও নিজেদের গাড়ি আছে। যে ভাড়া ওরা ফ্ল্যাটের জন্যে দেয় তা পেলে ফ্ল্যাটের মালিক ওদের স্ট্যাটাস নিয়ে মাথা ঘামায় না।
এর পরের বিশ্লেষণটি চমকপ্রদ। সত্তরভাগ পছন্দের বিয়ের বছর চারেকের মধ্যে ভেঙে যাচ্ছে এক চতুর্থাংশ। ভেঙে যাওয়ার পর আবার তাদের অনেকেই নতুন করে সংসার করছে। দ্বিতীয়বারের দু’জনেই বিচ্ছিন্ন হয়ে এসেছে। সম্বন্ধ করে যে পঁচিশভাগ বিয়ে হয় তার এক তৃতীয়াংশ বছর দুই-এর মধ্যে ভেঙে যাচ্ছে। অর্থাৎ পছন্দের বিয়ের চেয়ে সম্বন্ধের বিয়ে বেশি ভাঙছে। আবার বিচ্ছিন্ন হয়েও ডিভোর্স দিচ্ছে না এমন সংখ্যা সম্বন্ধের ক্ষেত্রেই বেশি। আমার পরিচিত একটি পরিবারের একমাত্র ছেলে চাকরি করত মুম্বইতে। অনেক সম্বন্ধ এল। পাত্রী পছন্দ হল যে দিল্লিতে থাকে। বিয়ের আগেই ওদের মেলামেশা এত বেড়ে গেল যে ছেলে কলকাতা আসার সময় পায় না। তার পর ধুমধাম করে প্রচুর লক্ষ খরচের মাধ্যমে বিয়ে হল কলকাতায়। আমরা আশীর্বাদ করে এলাম। ছেলের মা সংসার গুছিয়ে দিতে মুম্বই গেলেন। একটা বাচ্চাও হল। তারপর হঠাৎ মেয়েটি বাচ্চাসমেত ফিরে গেল দিল্লিতে। ছেলের মা ঘোষণা করলেন, মেয়েটির মাথা ঠিক নেই। তার বিরুদ্ধে যা তা অভিযোগ করেছে। স্বামীকে বলেছে মায়ের গোলাম। এখন মামলা চলছে। কবে শেষ হবে কেউ জানে না।
পছন্দের বিয়ে চট করে ভাঙতে কোনও পক্ষই চায় না। ভাঙলেই শুনতে হবে, ‘খুব তো ভালবেসে বিয়ে করেছিলে, সেই ভালবাসার পাখি উড়ে গেল?’ এই বিদ্রূপ এড়াতে অনেকেই পাশাপাশি আমৃত্যু থেকে যায়। দ্বীপের মতো।
আর স্টে টুগেদারের ক্ষেত্রে যাওয়ার দরজা তো সবসময় খোলা। আইন কিছু বলতে পারবে না। অ্যাডজাস্ট হল না বলে আলাদা হলাম, সব ল্যাটা চুকে গেল।
এতকাল বিয়ে ভেঙে গেলে এদেশের মেয়েরা ক্ষতিগ্রস্ত হত। বাপের বাড়িতে গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকত তারা। তাদের রক্ষাকবচ হিসাবে তৈরি হল আইনের ধারা, চারশো আটানব্বই-এ। বিনা দোষে মেয়েটির উপর স্বামী, শ্বশুরবাড়ির লোকজন অথবা স্বামীর বন্ধু যদি অত্যাচার করে তা হলে থানায় নালিশ করলে পুলিশ এই ধারায় প্রত্যেককে গ্রেফতার করতে বাধ্য। এই ধারায় গ্রেফতার হলে সহজে জামিন পাওয়া যায় না। কিন্তু এখনও কজন মেয়ে এই ধারায় আত্মরক্ষা করতে উদ্যোগী হয়। এখনও তো জড়তা যায়নি। আবার কেউ কেউ তো এই ধারার অপব্যবহার করে তৃপ্তির হাসি হাসেন, সেটাও সত্যি।
মহাপুরুষরা বলেন, সব কিছু ক্ষণস্থায়ী। বিয়ের ব্যাপারে সেটা খুব মিলে যাচ্ছে। এই সময়ে।