৫০
জলপাইগুড়ির সেই দিনগুলো কী শান্তিতে ডুবে ছিল। জিনিসপত্রের দাম তখনও ধরাছোঁয়ার মধ্যে ছিল, রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেনি। আমরা যারা ছাত্র ছিলাম তারা ঠিকঠাক ক্লাস করতে পারতাম। জলপাইগুড়িতে তখন দুটো লাইব্রেরি ছিল। যেখানে বিকেল হলেই ভিড় জমত। বাবুপাড়া লাইব্রেরি আর বান্ধব পাঠাগারে বাংলা সাহিত্যের যাবতীয় সম্পদ পাওয়া যেত। লোক তখন বই পড়ত।
অনেকগুলো ফুটবল-ক্রিকেট ক্লাব ছিল যারা নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় রেখে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করত। ছিলেন সত্যেন্দ্র প্রসাদ রায়। সবাই খ্যাঁদাদা বলে ডাকত তাঁকে। হাফহাতা পাঞ্জাবি আর ধুতি, মাথায় কদমছাঁট সাদাকালো চুলের মানুষটিকে এখনও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই। অনেকগুলো চা-বাগানের মালিক হয়েও রোজ বিকেলে টাউন ক্লাবে হাজির হতেন। খেলার উন্নতির জন্যে সময় ও অর্থ খরচ করতেন নির্দ্বিধায়। ভালো ফুটবল খেলতেন। ওঁর পায়ের রেইনরো কিকের কথা নিশ্চয়ই প্রবীণদের মনে আছে।
পাড়ায় পাড়ায় গানের স্কুল ছিল। তরু রায়কত থেকে সৌমেন সিংহ রায়, লীনা ঘটক থেকে মানবেন্দ্র দাক্ষীর মতো সংগীতে নিবেদিত মানুষদের নিয়ে গর্ব করতাম আমরা। নাটক করতেন আর্য নাট্য সমাজের সদস্যরা। আরও অনেক দল। এইসব দেখে দেখে আমি বড়ো হয়েছি। আর সেইসঙ্গে বন্ধু অজিত রায়চৌধুরির দিদি আমাকে জানবৃক্ষের ফল খাইয়েছিলেন। ভদ্রমহিলা কলকাতা থেকে প্রকাশিত অনেকগুলি পত্রিকা নিয়মিত রাখতেন। সেগুলো আমাকে পড়তে দিতেন, বলতেন, ‘এগুলা না পড়লে তুই নদীতেই পড়ে থাকবি, সমুদ্রের কথা জানবি না।’ প্রতি মাসে নিয়ে আসতাম পত্রিকাগুলো। হঠাৎ একটা নতুন পত্রিকা পেলাম, নরনারী। নিষিদ্ধ বস্তুর স্বাদ পেয়ে কান গরম হত। চোরের মতো ফেরত দিতে গিয়ে ধমক খেয়েছিলাম দিদির কাছে।’ ওইরকম মুখ করে আছিস কেন? কেনো বই পড়া খারাপ নয়। খারাপটাকে না জানলে ভালোকে বুঝবি কী করে?’ আমার তখন সবে গোঁফ উঠেছে, ‘চরিত্রহীন’ পড়া নিষেধ। নিষিদ্ধ কিছুর উপর আকর্ষণ সবসময় বেশি! দিদির কাছ থেকে শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন নিয়ে তিস্তার বাঁধে বসে এক দুপুরে কত কী পাব ভেবে পড়তে শুরু করেছিলাম। হতাশ হতে হতে বইটা বন্ধ করে ভাবছিলাম এই রকম সাধারণ কাহিনির নাম চরিত্রহীন রেখেছিলেন শরৎচন্দ্র। আর অভিভাবকরা বোধহয় না পড়ে শুধু নাম দেখেই বইটা না পড়তে আদেশ দিয়েছেন। তুব গল্প পড়ার টানে আর একটু এগিয়ে যেতে চমকে উঠলাম। ওই বয়সে আমার শরীরে কাঁটা ফুটল। কিরণময়ী দিবাকরকে চুমু খেল বলে নয়, চুমু খেয়ে, শরৎচন্দ্র লিখলেন, ‘খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।’ আমি সেই খিল খিল হাসিতে প্রথম যৌবনের গন্ধ পেলাম।
কী অদ্ভুত ভালোলাগার মধ্যে কেটেছে সেই দিনগুলো। আমি থাকতাম হাকিম পাড়ায়। পাড়ায় সবাই সচ্ছল, শিক্ষিত। কোনো চিৎকার চেঁচামেচি ছিল না। ওরকম পাড়া আরও অনেকগুলো শহরে ছিল। সেই সময় কয়েকটি পাড়ায় কয়েকজন দাদা ছিলেন। তখন মস্তান, হিরো ইত্যাদি শব্দ ব্যাপকভাবে চালু হয়নি। এই দাদারা পাড়ার সম্মান রাখার জন্য নেতৃত্ব দিতেন। কোনো তোলা আদায় নয়, কাউকে চাপ দিয়ে টাকা রোজগারের ধান্দা তাঁদের ছিল না। তাঁরা রাজনৈতিক দলের মদতপুষ্ট ছিলেন না। এই দাদাদের দশ-পনেরো জন শিষ্য থাকত। কোনো বেপাড়ার ছেলে যদি তাঁদের পাড়ার মেয়েকে টাঙ্কি মারত তাহলে ক্ষেপে যেতেন দাদারা। টাঙ্কি শব্দটি তখন জলপাইগুড়িতে খুব চালু ছিল। অনেকদিন পর এই লেখা লিখতে গিয়ে মনে এল। দাদা তখন তাঁর দল নিয়ে সেই বেপাড়ার ছেলেটিকে ঠ্যাঙাতে যেতেন। প্রায় প্রত্যেকের হাতে থাকত হকি স্টিক। বোমা, পাইপগান বা ছুরি জাতীয় অস্ত্র ব্যবহার করা হত না। ছেলেটি যে পাড়ার সেই পাড়ার দাদা তাঁর দলবল নিয়ে আক্রমণের মোকাবিলা করতেন। হইহই কাণ্ড। কয়েকজনের মাথা ফাটত, থানায় নিয়ে গিয়ে পুলিশ ব্যবস্থা করত। সব ঠিক হয়ে গেলেও ছেলেটিকে বলা হত ওই পাড়ায় পা না দিতে। এই যে পাড়ার সম্মান রাখার মহান কর্তব্যবোধ ওঁদের মনে যে আবেগ থেকে জন্মাত তা ধীরে ধীরে উধাও হয়ে গেল। মারপিট করতে করতে শহরের কে সেরা দাদা তা পাবলিক ভেবে নিত। এইসব দাদাদের অনেকেই পরবর্তী জীবনে সুস্থ জীবনযাপন করেছেন। কেউ ব্যাবসা, কেউ চাকরি। এই মুহূর্তে যাঁদের নাম মনে আসছে তাঁদের মনেই রেখে দিলাম। তাঁরা তো বটেই, তাঁদের ছেলে-মেয়েরা অস্বস্তিতে পড়বেন।
শ্যামলদা,–-শ্যামলকান্তি রায় সেই অর্থে দাদা ছিলেন না। কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে বিকম পাশ করে আসা শ্যামলদা ছিলেন রায়কত পাড়ার একটি বর্ধিষ্ণু পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। বাবা বিখ্যাত আইনজীবী, দাদা-ভাইরাও সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বাঁধাধরা জীবন শ্যামলদাকে টানত না। বোহেমিয়ান হতে গিয়ে সেই সময়ের জলপাইগুড়ি শহরে তিনি যেসব নিয়ম ভেঙেছিলেন তা অনেকেই সমর্থন করেনি। বিশেষ করে যাঁরা শৃঙ্খলা পছন্দ করেন। শ্যামলদার বাবাও সেই দলে ছিলেন। শ্যামলদার সঙ্গে তাঁর কয়েকজন শিষ্য সবসময় ঘুরতেন। তখন বুঝিনি, এখন মনে হয়, শ্যামলদা হতাশায় আক্রান্ত হয়ে মেকি সভ্যতাকে আঘাত করতে এমন সব মানুষের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছিলেন যাদের অসামাজিক বলা হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শ্যামলদা আচমকা উধাও হয়ে যান। একটি বোহেমিয়ান মানুষের উধাও হওয়া নিয়ে প্রথমে কথা ওঠেনি। বেশ কিছুদিন পরে জলপাইগুড়ির কিছু দূরে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি তিস্তার একটি শাখানদীতে যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল ফুলে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় চেনা যাচ্ছিল না, সেই মৃতদেহ জলপাইগুড়ির মর্গে নিয়ে আসা হলে প্রচারিত হল ওটা শ্যামলদার শরীর। পুলিশের অনুরোধে শ্যামলদার পুরো পরিবার মর্গে গিয়ে মৃতদেহকে শ্যামলদার বলে আইডেন্টিফাই করতে পারলেন না। গল্প চালু হল, যুদ্ধের সময় জলপাইগুড়ির কয়েকজন ছেলে পূর্ব-পাকিস্তানের একটি ব্যাংক লুঠ করে কোটি টাকা নিয়ে ফিরে আসছিল। তাদের মধ্যে একজন সততা দেখাতে তাকেই খুন করে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বেওয়ারিশ লাশকে পুড়িয়ে দেওয়ার সময় যারা সাক্ষী ছিল তাদের স্পষ্ট বিশ্বাস ওটা শ্যামলদারই দেহ। শ্যামলদার সঙ্গে যারা উধাও হয়েছিলেন তাঁরা পরে ধনী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। শ্যামলদার পরিবার তাঁকে কেন চিনতে পারলেন না, তা নিয়ে জলপাইগুড়ির মানুষ একসময় দুভাগে বিভক্ত হয়েছিলেন।
সেই সময় এই অত শান্তির জীবনেও শ্যামলদার চরিত্র আমার কাছে আকর্ষণীয় ছিল। বুঝেছিল নিয়মে যাঁরা থাকেন, তারা দৃষ্টি আকর্ষণ করেন না। নিয়ম ভেঙে যাঁরা বর্ণময় জীবনে খুশি থাকেন তাঁরা হয়তো বেশিদিন বাঁচেন না কিন্তু একটা দাগ রেখে যান।
৫১
তখন সংসারে মায়া ছিল। যাবতীয় মনোমলিন্য, ঈর্ষা মাথা নামিয়ে নিত ওই মায়ার জন্যে। ওই কারণেই, হয়তো, বাড়িতে আসা নতুন বৌ জড়িয়ে যেতেন সবার সঙ্গে।
পনেরো, ষোলোজনের পাত পড়ত দু’বেলা, রান্নার লোকের হাতে থাকত না দায়িত্ব। ছেলেরা তো বটেই, মেয়েরাও নিজেরা রান্না না করলে তৃপ্ত হতেন না। তাঁদের যিনি প্রধানা, তিনি কার কী পছন্দ, কোন্টা না-পছন্দ তার খবর রাখতেন। খেতে বসে দিব্যি টের পেতাম সেটা। বাড়ির ভেতরে পা দেওয়ার পর মা-পিসিরা প্রত্যেকের মনের ভেতরটা দেখতে পেতেন। বোধহয় ওই কারণেই অদৃশ্য মায়ার স্পর্শ পেতাম আমরা। এসব পঞ্চাশ কী ষাট বছর আগের কথা।
বাড়িগুলোর দুটো ভাগ ছিল। বাইরেটা ছেলেদের। কিন্তু বয়স্ক পিতামহ সেখানে অবস্থান করলে, তাঁর ছেলেদের গলা শোনা যেত না। ভেতরটা ছিল মেয়েদের রাজত্ব। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। শুধু আমরা যারা তখনও হাফ প্যান্ট ছাড়িনি, অবলীলায় ঢুকে পড়তাম। কিন্তু যেই নাকের নীচে কালচে রেখা ফুটল, অমনি চোখ ঘুরিয়ে ধমক দিতেন তাঁরা, ‘অ্যাই ছোঁড়া, এখানে কী শুনতে এসেছিস? যা ভাগ!’ অথচ প্রবীণ কাজের লোকদের দেখেও তাঁরা দেখতেন না। যেন তাঁরা পুরুষ নন।
এই যে সংসার, যা বেশির ভাগ বাঙালির অভিজ্ঞতায় এখনও স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে, সেখানে কিছু কিছু মানুষ মাঝেমাঝেই আনাগোনা করতেন। এক বিকেলে বড় পিসিমা আমাদের মোয়া আর নারকোলের নাড়ু পরিবেশন করে মাথা দুলিয়ে হেসে বললেন, ‘কাল তোদের ফুলমাসি আসবে।’
শোনা মাত্র পৃথিবীটা যেন ফাল্গুনের পলাশে রাঙা হয়ে যেত। ফুলমাসি মানেই কত নতুন কথা শোনার সুযোগ, ফুলমাসি মানেই কাননবালার গান। বড় পিসিমা আরও জানালেন, ‘তালুই মশাই ওকে পৌঁছে দিয়েই চলে যাবেন লিখছেন। এ কেমন কথা! মেয়ের বাড়িতে তে-রাত্তির না হোক, একটা রাত তো থাকতে পারেন।’
বড় পিসিমা যাকে তালুই মশাই বললেন, তিনি আমার দাদামশাই, মায়ের বাবা। চোদ্দো বছরে মাকে এই সংসারে পাঠিয়েছিলেন। বছরে একবার তিনি এসে মেয়েকে দেখে যান। অনুরোধে একটা রাত থাকেন। মা বাপের বাড়ি যান দু’বছরে একবার। তখন আমরা তাঁর সঙ্গী, আহা কী আনন্দ। ফুলমাসি মায়ের ছোট বোনদের একজন। তিনি যে নিজের বোন নন, মায়ের কাকার মেয়ে, তা বুঝতে পারিনি কৈশোর কালেও। বড় পিসিমা হেসে মাকে বললেন, ‘যে ক’দিন ফুল এখানে থাকবে, তদ্দিন তুই ওদের যত্নআত্তি করবি। নইলে ফিরে গেলে ওর মুখে কিছু শুনলে তোমার মা দুঃখ পাবেন।’ মা বললেন, ‘ওইটুকুনি পুঁচকি মেয়েকে আবার কী যত্ন করব? আমরা যেমন আছি, তেমন থাকবে।’
তখন বড়, সেজ আর ছোটর মাঝখানে যিনি থাকতেন, তাঁকে ন’কাকা বলা হত কেন? কিন্তু স্বীকার করতেই হবে ডাকটায় একটা মোলায়েম মিষ্টিভাব জড়ানো থাকত। আবার দেখা যেত এই ন’কাকা বা ন’মামারা সংসারে তেমন গুরুত্ব পেতেন না অথবা নিতেও চাইতেন না। অনেকটা পাণ্ডবদের নকুলের মতো। আমার ন’কাকা ছিলেন খুব শান্ত প্রকৃতির। কলেজের পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন এবং প্রায়ই দেখতাম চুল আঁচড়াচ্ছেন। তাঁর দাদাদের অবাধ্য যেমন হতেন না, তেমনি ঘনিষ্ঠতাও দেখাতেন না। বিকেল বেলায় সেই ন’কাকা ইশারায় কাছে ডেকে বললেন, ‘শুনলাম তোর ন’মাসি আসছেন। খবরটা কি ঠিক?’ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। তিনি একটা শ্বাস ফেলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। ফুলমাসি এর আগে যত বার এসেছে, ন’কাকাকে কথা বলতে দেখিনি। তা হলে আজ ন’কাকা ওইভাবে শ্বাস ফেলল কেন?
পরদিন রবিবার বাড়িতে সবাই। দাদামশাই নামলেন রিকশা থেকে আমরা ছুটে গেলাম। ধুপ ধুপ করে পা ছোঁওয়া। রিকশায় বসে ফুলমাসি চোখ পাকালো, ‘অ্যাই, আমাকে প্রণাম করছিস না তোরা?’ কে আগে প্রাণ করিবেক দান, বলে এগিয়ে যেতেই রিকশা থেকে লাফিয়ে নামল ফুলমাসি। তারপর দে দৌড়, দে দৌড়।
বাড়ির পাশের মাঠ পেরিয়ে ফুলমাসি ছুটছে। লম্বা বেণী পিঠের ওপর নাচছে, আমরা কয়েকজন তাকে ধরতে পারছি না। গাছগাছালি পেরিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বুকে হাত রেখে ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে ফুলমাসি বলল, ‘আর না!’ আমরা পা ছুঁতে যেতেই ঘাসের ওপর বসে পড়ে বলল, ‘একদম না। গতবার যে গানটা শিখিয়ে দিয়েছিলাম, তার মাঝখানের চারটে লাইন শোনা আগে।’
‘কোন্ লাইন, কোন্ লাইন?’ কলকলিয়ে উঠলাম আমরা।
‘ওই যে ভাইয়ে-মায়ে—।’ মিটিমিটি হাসল ফুলমাসি।
‘ভাইয়ে-মায়ে এত স্নেহ—কোথায় গেলে পাবে কেহ—।’ গান না চিৎকার তাতে কী এসে যায়। হাত তুলে আমাদের থামিয়ে ফুলমাসি বলল, ‘আমার সঙ্গে গা।’ আহা, বুক জুড়িয়ে গেল।
এখন পিছনে তাকালে ফুলমাসির মুখটা মনে আসে? ফুলমাসি কি সুন্দরী ছিল? গায়ের রং কি চাঁপার মতো? মনে পড়ল না। আসলে এ সব নিয়ে তখন মাথা ঘামাতাম না। ওর গান, হাসি, আমাদের কাছে নতুন কত খবর পৌঁছে দেওয়ার চেহারাটাই বড় হয়ে উঠেছিল।
রাঙাঠাকুমার কথা মনে পড়ছে। দুটো বাড়ি পার হলেই ওঁর ছেলের বাড়ি। সেই অর্থে আত্মীয় নন, কিন্তু পাড়ার সবার রাঙাঠাকুমা তিনি। কাঁচা আম উঠলেই ওঁর ব্যস্ততা বাড়ত। রোজই এর বাড়ি-ওর বাড়ি যেতেন, কাচের বোতল হাতে নিয়ে। সেই বোতলে ওঁর ভালবাসা ভরা থাকত। যার নাম কাসুন্দি। একদিন দুটো বোতল নিয়ে এলেন। বড় পিসিমা বললেন, ‘এ কী! দুটো বোতল কেন?’
রাঙাঠাকুমা বললেন, ‘দ্বিতীয়টা ফুলের জন্য নিয়ে এলাম।’
কোথায় থাকেন ফুলমাসি? কোথায় থাকেন রাঙাঠাকুমা? দুজনের দেখা হয়েছে বহু সময়ের ব্যবধানে বার কয়েক। ফুলমাসি প্রণাম করতে গিয়েছিল রাঙাঠাকুমাকে। বুকে জড়িয়ে ধরে রাঙাঠাকুমা বললেন, ‘যদি বেঁচে থাকি, তবে তোর ফুল বাবুকেও কাসুন্দি খাওয়াব।’
এইসব সম্বোধনগুলো আচমকা টুপটাপ মরে গেল। রাঙাকাকা, নকাকা, ফুলমাসি, রাঙাঠাকুমা, সুন্দরপিসি অথবা তালুইমশাইরা উধাও হয়ে গিয়েছেন। বাবা মা চলে যাওয়ার পর এখন আমাদের সংসার স্বামী-স্ত্রী ও একটি সন্তানের। যদি মাও তাঁর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হয়ে থাকেন, তাহলে মামা বা মামাতো ভাইবোনদের দেখতে পাবে না আমাদের সন্তানেরা। যে শিশুটি বড় হচ্ছে, কলকাতার হাজার স্কোয়্যার ফুটের ফ্ল্যাটে, তার কাকার সংসার হয়তো হায়দরাবাদ অথবা মুম্বইতে। দেখা হওয়াটা প্রায় দুর্ঘটনার মতো। আর পিসি যদি থাকেন তা হলে মা-বাবার মৃত্যুর পরে ভাইয়ের সংসারে আসার স্বস্তি তিনি পান না। ফলে পিসতুতো ভাইবোনদের চেহারা কী রকম তাই-ই জানে না অনেক বালক-বালিকা।
মাঝে মাঝে মনে হয়, এখন দুটি মানুষের বৈবাহিক সম্পর্ক শুরু হওয়া মাত্র তারা সতর্ক থাকে যাতে সন্তান না আসে। কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের হদিশ পেলে সন্তানকে নিয়ে আসা হয়। তারপর প্রতিটি দিন সেই সস্তানের পিছনে ব্যয় করা হয় যাবতীয় মনোযোগ। কিনে দেওয়া হয় সুযোগগুলো, যাতে সে তেইশ-চব্বিশে এমন একটি চাকরি পায়, যার শুরু হবে ষাট হাজারে। সেই চাকরির ডানায় জোর এলে সন্তান পাখি হয়ে উড়ে যাবে জেনেও এই কর্তব্য থেকে নিস্তার নেই। একজন মুরগির ব্যবসায়ী বলেছিলেন, ‘দিশি মুরগি বড় হতে অনেক বেশি সময় নেয়। ওজনেও মার খাই। তার চেয়ে ব্রয়লারে অনেক লাভ। কয়েক সপ্তাহেই নাদুশ-নুদুশ।’
ন’কাকা-ফুলমাসিদের সময়ে ব্রয়লার চিকেন ছিল না।
ভাবতে কী রকম বিস্ময় জাগে, এরা কেউ আমাদের পরের ছেলে বলে ভাবতেন না, আমার মামার বাড়িতে সবচেয়ে প্রবীণাকে আমরা বড়মা ডাকতাম। মা-ঠাকুমা, দিদিমার ওপরে বড়মা। এই বড়মা তাঁর ঠাকুরকে সময় দেওয়ার পর আমরা যাতে ভাল থাকি, সে দিকে নজর রাখতেন, সংসারের ভার থাকত দিদিমা বা মাসিদের ওপর। কিন্তু তাঁকে অসম্মান করার সাহস কেউ দেখাত না। আমার বড় পিসিমার এগারো বছরে বিয়ে হয়েছিল। বারোতে বিধবা হয়ে বাপের সংসারে ফিরে এসেছিলেন। আমার বাবা তখন শিশু। আমৃত্যু থেকে গিয়েছেন বাবার সঙ্গে। ভাইদের বড় করেছেন, মানুষ করার চেষ্টা করেছেন আমাকে মা-কাকিমাদের তো বটেই, নাতবৌদেরও ভালবাসতেন খুব। তাঁর কথাই ছিল অন্দরমহলের শেষ কথা। এক ভাইয়ের নতুন বৌ এসে উদ্ধত গলায় বলেছিল, ‘আপনি বলার কে? আপনি তো এ বাড়িতে আশ্রিত।’ বাড়িতে যেন বজ্রপাত হয়েছিল। সবাই একত্রিত হয়ে সেই বউয়ের স্বামীকে, যে কিনা বাড়ির ছেলে, বলা হল, বৌ নিয়ে আলাদা সংসার করতে। সে যেতে বাধ্য হয়েছিল, কিন্তু মজার ব্যাপার হল, যেতে বাধা দিয়েছিল বড় পিসিমা, ‘ছি ছি ওরা যাবে কেন? তার চেয়ে আমাকে তোরা কাশীতে পাঠিয়ে দে।’
এই ধরনের পিসিমাও আজ হারিয়ে গিয়েছেন। মায়ার কাজল মুছে গিয়েছে আমাদের। এখন বেঁচে থাকা স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে। হঠাৎ খেয়াল হল, বাল্যকালে টম্যাটো বা চিলি সস ছিল না। ছিল কাসুন্দি। তারপর কাসুন্দি লোপ পেয়ে গেল। পরিপাটি করে বানানো ঝামেলা। কাসুন্দির স্বাদ ভুলে গিয়েছিলাম। বহু বছর পরে কাসুন্দি ফিরে এল বাক্সবন্দি হয়ে স্বাদে খামতি হলেও কাসুন্দি তো।
ফুলমাসি, বড়পিসিমা, রাঙাঠাকুমারা তো আর নতুন চেহারায় ফিরে আসবেন না।
৫২
‘ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি ভালবাসবে।’
তখন আমার নবীন বয়স। এক সন্ধ্যায় প্রথম ওই লাইনটা কানে যাওয়া মাত্র মন ঝিমঝিম করতে লাগল। ভালবাসতে চোখের জল ফেলতে হয়। ঠিক আছে। কিন্তু ক’ফোঁটা? আমার মনে বারংবার ঘুরে ঘুরে এই প্রশ্নটা ফিরে আসে। শোকে মানুষ কাঁদে, কেঁদে ভাসায়। ভালবাসার জন্যে যখন মানুষ কাঁদে তখন কি সেই কান্না কেউ দেখতে পায়? পরে, অনেক পরে, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর কফি হাউসের আড্ডায় পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে পেয়ে প্রশ্নটা করে বসলাম। শুনে তিনি গম্ভীর হলেন, বললেন, ‘আমি তো ভাবিনি। মান্না গাইবার সময় এমনভাবে ওই ক’ফোঁটা শব্দ দুটো এক করে উচ্চারণ করেছেন যে সত্যি তল পাওয়া যায় না।’ প্রশ্নটা মনে লেগে ছিল। আরও বহুবছর পরে ইন্টারন্যাশন্যাল ক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে মান্না দে এসেছিলেন। কথা বলার সুযোগ হয়েছিল মুখোমুখি বসে। ফশ করে প্রশ্নটা করে বসলাম তাঁকে।
অবাক হয়েছিলেন। তার পর হেসে বলেছিলেন, ‘কেউ সিন্ধুতেও বিন্দু পায় না, আবার কেউ কেউ বিন্দুতেই সিন্ধু পেয়ে যায়।’ বুঝলাম এড়িয়ে যাচ্ছেন, জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনি জানতে চেয়েছেন ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ? কত ফোঁটা ফেললে তবে ভালবাসা যায়?’
গুনগুন করলেন, ‘কান পেতে শুনেছ কি অস্ফুট কোন কথা তার?’
আমি জবাব পেয়ে গেলাম।
‘আমি কান পেতে রই।’ যা কানে ঢোকে তার জন্যে কেউ কান পাতে না। মনের মধ্যে আর একটা মন আছে, যে কান পাততে জানে। সে-ই চোখের জল ফেলতে জানে।
.
দুমাসের ওপরে আইসিইউ-তে ছিলেন। এই কষ্ট তাঁর পাওনা ছিল না। জীবন এক নিয়মে বয়ে যায় না, শেষ হয় না। গতকালই তাঁর একটা গান শুনে চমকে উঠেছিলাম, ‘দীপ ছিল শিখা ছিল, তবু তুমি ছিলে না বলে আলো জ্বলল না।’ আজ মনে হচ্ছে যতদিন তাঁর গলায় সুর ছিল ততদিন মরণ সাহস পায়নি। আজ সুর নেই তাই আলো জ্বলল না, মরণ সাহসী হল।
অল্প বয়সে বেসিক রেকর্ডের পাশাপাশি সিনেমার গান আমাদের মুখে মুখে ফিরত। তখন হেমন্তবাবুর একচেটিয়া রাজত্ব। মানবেন্দ্রবাবু, শ্যামল মিত্ররা আছেন, কিন্তু সিনেমায় উত্তমকুমারের লিপে হেমন্তবাবুর গান এমন মিলেমিশে গিয়েছিল যে আমরা অন্য গায়কের কথা ভাবতে পারতাম না। উনিশশো উনিশ সালে যাঁর জন্ম তাঁকে আগে হিন্দি গানে জনপ্রিয়তার শিখরে উঠতে হয়েছে। পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে বাংলা গানের শ্রোতাদের চমকে দিলেন।
‘তীর ভাঙা ঢেউ’ থেকে শুরু করে একের পর এক বেসিক রেকর্ড হিট হওয়া সত্ত্বেও বাংলা সিনেমা তাঁকে প্রায় ব্রাত্য করে রেখেছিল অনেককাল। ‘ডাক হরকরা’ ছবিতে একটি অনবদ্য ঘটনা ঘটল। তারাশংকরের লেখা, সুধীন দাশগুপ্তের সুরে মান্না দে গাইলেন, ‘তোমার শেষ বিচারের আশায়’ এবং ‘লাল পাগুড়ি বেঁধে মাথে।’ লিপ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রবাদপ্রতিম গায়ক শাস্তিদেব ঘোষ। আমরা মুগ্ধ হয়েছি কিন্তু তবু মান্না দে-কে মধ্যচল্লিশ অবধি অপেক্ষা করতে হল রোমান্টিক বাংলা গান গাইবার সুযোগের জন্য। এল শঙ্খবেলা। উত্তমকুমারের লিপে তাঁর গান বাঙালির বুকে বিঁধে গেল। সাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘোষ এক আড্ডায় বলেছিলেন, ‘বাংলা আধুনিক গানের দুটো কলজে। একটি হেমন্ত অন্যটি মান্না দে।’
আমরা যারা ভালবাসার কথা বলি, যাদের বুকে এখনও ঘূর্ণি ওঠে তাদের জন্যে আছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তাঁর গান, তাঁর কবিতা যেখানে গিয়ে থামে সেখানে মান্না দে’র গান গুনগুনিয়ে ফেরে। জামাপ্যান্ট পাল্টে নিজের বিছানায় পাজামা গেঞ্জি পরে শোওয়ার যে আরাম সেইরকম অনুভূতি হত আমার। ‘আমি নিরালায় বসে’ গানটি শুনতে শুনতে মনে হত এ তো আমারই কথা। বহু বছর বাদে কফিহাউসে ঢুকতেই মান্না দে চলে এলেন বুকের ভেতরে। চারপাশের টেবিলগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হত গানটা কি ভয়ঙ্কর সত্যি। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছবির গানগুলোকে বাদ দিলে, এবং অবশ্য চৌরঙ্গির ‘বড় একা লাগে’-কে সরিয়ে রাখলে মান্না দে-র জনপ্রিয় গানগুলো প্রচারিত হয়েছিল বেসিক রেকর্ডের মাধ্যমে। আর তার কথা সুর এবং গায়কি মিলেমিশে এমন একটা রসায়ন তৈরি করেছিল যে বাঙালি জানতে পেরেছিল, ‘ভালবাসা কারে কয়’।
মান্না দে-র বেশিরভাগ গানে চিনচিনে ব্যথা মিশে আছে। শুনেছি কথা পছন্দ না হলে তিনি গাইতে রাজি হতেন না। প্রচলিত ভাবনা এড়িয়ে গিয়ে নতুন ঢঙে গাওয়া গানের কথাগুলো সরাসরি ঢুকে যেত মনে। ‘তুমি নিজের মুখে বললে সেদিন/সবই তোমার অভিনয়/সত্যি কোনও কিছু নয়/আমি দুঃখ পেলেও খুশি হলাম জেনে।’ শুনতে শুনতে এই খুশি হওয়া মুখের অভিব্যক্তি কীরকম হতে পারে ভেবে কূল পাইনি।
আবার, ‘তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছে, দিতে পারনি/কি তার জবাব দেবে যদি বলি আমিই কি হেরেছি/তুমিও কি একটু হারোনি?’ ভাবা যায়? এভাবে ভালবাসা নিয়ে প্রায় গবেষণা আর কোনও গায়ক করেছেন বলে আমার জানা নেই। যত তিনি করেছেন তত আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি।
দুঃখের জগৎটা এত বড় যে সেখানে বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বলেই মান্না দে শ্রোতাদের বন্ধুত্ব পেয়েছিলেন। আমাদের উত্তর কলকাতার হেদুয়ার কাছে ওঁর বাড়ি। সেই বাড়ি ছেড়ে কাকার হাত ধরে মুম্বইয়ে গিয়েছিলেন। কলকাতায় আসা যাওয়া ছিল কিন্তু অবসর নিয়ে চলে গেলেন বেঙ্গালুরুতে। কেন? মেয়ে সেখানে থাকে বলে? মুম্বই কেন ছেড়ে গেলেন এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘ওখানে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে।’ এটা কি অভিমান? কেউ কি তাঁকে প্রশ্ন করেছিল, ‘কলকাতা ছেড়ে গেলেন কেন?’ করলে কি একই উত্তর দিতেন?
আমার এক বন্ধু রসিকতা করতেন, ‘মান্না দে খেজুর গাছের মতো।’
বিরক্ত হয়েছিলাম, ‘তার মানে?’
‘ভদ্রলোক এককালে কুস্তি করতেন, শরীর-স্বাস্থ্য দেখে যে জানে না সে ভাবতে পারে উনি একজন বক্সার। কিন্তু যখন গান গান তখন স্বর্গে থাকা ঊর্বশীরাও কেঁদে ভাসায়। খেজুর গাছকে দ্যাখো। কোথাও কমনীয়তা নেই। অথচ তার বুক থেকে অমৃতরস বেরিয়ে আসে স্বচ্ছন্দে। বন্ধুর কথা শুনে মাথা নেড়েছিলাম।
বছর দুই আগে মেলবোর্ন শহরের এক রাতের আড্ডায় একটি বাংলাদেশের যুবক গান ধরল, ‘বড় একা লাগে, এই আঁধারে, মেঘের খেলা, আকাশ পারে।’ গান শেষ করে চোখের জল মুছল সে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাই কাঁদছেন কেন?’
‘ওই মেঘের ওপারে আমার বাংলাদেশ। ভাবলেই বড় একা লাগে। মান্না দা আমার মনের কথা কী করে গানে বললেন বলুন তো? সে ভেজা চোখে তাকিয়েছিল।
সেই যুবক তো বটেই, পৃথিবীর যত ভাবপ্রবণ মানুষ আজ কাঁদবে। সান্ত্বনা এই, ওঁর গাওয়া গানগুলো সিডিতে বাজবে, বাজবে আমাদের মনে।
৫৩
কলকাতার কলেজে পড়তে এসে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম, কারণ ওই কলেজে নেতাজি এবং বিবেকানন্দ একদা ছাত্র ছিলেন বলে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম কথাটা সত্যি নয়। এক বন্ধু বলেছিল, ওই কলেজে অনেক সুন্দরী ছাত্রী পড়াশোনা করেন এবং তাঁরা রীতিমতো আধুনিক। কলেজের প্রথম দিনের ক্লাসে গিয়ে আবিষ্কার করলাম ক্লাসরুমের অর্ধেকটা অংশে আমরা, ছেলেরা, বসে আছি। কিছুক্ষণ পরে অধ্যাপক এলেন এবং তাঁর পিছনে লাইন দিয়ে কয়েকজন মেয়ে। ক্লাসের অন্য অংশে, যথেষ্ট দূরত্ব রেখে। তাঁরা আমাদের দিকে তাকালেন না, মন দিয়ে অধ্যাপকের কথা শুনলেন এবং ক্লাস শেষ হলে তাঁর পিছন পিছন মেয়েদের কমনরুমে চলে গেলেন। আমার পাশে বসে শৈবাল, যে পরে বিখ্যাত নকশাল নেতা এবং তারপরে আরও বিখ্যাত লেখক হয়েছিল, নিচু গলায় আবৃত্তি করেছিল, ‘রাখাল গরুর পাল নিয়ে যায় মাঠে।’
পুরো একটা বছর স্কটিশ চার্চ কলেজের মেয়েরা ছেলেদের ছায়া না মাড়িয়ে পড়াশোনা করেছে। মাত্র তেপ্পান্ন বছর আগের ঘটনা। মেয়েদের কলেজের গেট হয়ে তাঁদের কমনরুমে পৌঁছে দিয়ে যেতেন তাঁদের অভিভাবক, অভিভাবিকারা। বিখ্যাত অভিনেতা জীবেন বসুকে দেখতাম তাঁর কালো গাড়িতে মেয়েকে নিয়ে আসতেন কলেজে, নিয়েও যেতেন মাঝে মাঝে। কলেজ থেকে বেরিয়ে বেথুনের মুখের বাসস্টপ পর্যন্ত কপাল ভাল থাকলে কোনও মেয়েকে দেখা যেত মাথা নিচু করে হেঁটে যেতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থাটা বদলালেও, দেখা যেত অভিভাবক মেয়ের মাথায় ছাতা ধরে পৌঁছে দিচ্ছেন, নিয়ে যাচ্ছেন। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ থেকে নিয়মটা ভেঙেছিল। তৃতীয় বর্ষে তো ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে নাটক করেছিল কলেজে। বলা বাহুল্য আমাদের দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই পরস্পরের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। সেই প্রেমগুলোর বেশিরভাগই সুস্থ পরিণতি পেয়েছে।
কিন্তু কলেজে কথা বলা, বসও কেবিনে চা খাওয়া শুরু হলেও দু-তিনজন ছাড়া কোনও মেয়েই সহপাঠীদের বাড়িতে নিয়ে যেতেন না। যেতে চাইলে ভয়ে আঁতকে উঠতেন। মেয়েদের কলেজে না ভর্তি হয়ে ছেলেদের সঙ্গে একসঙ্গে পড়ছেন বলে তাঁদের ভাল শাসনে থাকতে হত। কেয়া চক্রবর্তীর মতো কেউ কেউ প্রতিবাদী হয়ে নিয়মভঙ্গ করলেও বেশিরভাগই ওই শাসন মেনে নিতে বাধ্য হত। গ্র্যাজুয়েশনের পর বেশিরভাগ মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে পাত্রের সন্ধান করা হত। শুধু কলেজে কেন, কোনও মেয়েই তখন একা সিনেমা দেখতে যেতেন না। হয় মা-মাসি, নয় বাড়ির দাসীকে সঙ্গে রাখতে হত। শ্যামবাজারের সিনেমা হলগুলির দোতলায় তখন একটা অংশ অনলি ফর লেডিজ বলে চিহ্নিত করা ছিল। মেয়েরা একা, মা-বোন সঙ্গে থাকলেও একা, ছেলেদের পাশে বসে সিনেমা দেখতে অস্বস্তিবোধ করেন বলেই ওই ব্যবস্থা। আমি যখন তৃতীয় বর্ষে তখন কলেজ থেকে বের হয়ে একা বাসস্টপে যাচ্ছে এমন একটি মেয়েকে দেখে বন্ধুরা বাজি ধরেছিল ওর সঙ্গে কথা বললে মোগলাই পরোটা খাওয়া যাবে। আমি এগিয়ে গিয়ে কোন বাসে যাবে জিজ্ঞাসা না করে জানতে চেয়েছিলাম, টুবি অর নট টুবি! ওটা বাসের নাম্বার। মেয়েটি জবাব দেয়নি, তাই ফিরে আসার আগে বলেছিলাম আমি স্কটিশের অমুক হস্টেলে থাকি। সেই সন্ধেতে আমাকে হস্টেল থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন মেয়েটির পিসিমা। ভাইঝির সঙ্গে কথা বলার জন্যে প্রচণ্ড ধমক দিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে বসে। মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে ছেলেদের সঙ্গে পড়ছে বাড়ির অমতে, তাঁর উদ্যোগে। যদি চরিত্রে দাগ পড়ে তাহলে তাকেই দায়ী করা হবে। মেয়ে বাড়ি ফিরলে তার পা দেখা হত, বেশি ধূলো লেগেছে কি না। না লাগলে স্বস্তি পেতেন ওঁরা, মেয়ে ঘুরে বেড়ায়নি ভেবে নিশ্চিন্ত হতেন। বাড়িতে ঢোকার আগে মেয়ে যদি রাস্তার কলে পা ধুয়ে আসেন তা তাঁদের জানার কথা নয়।
আমাদের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব ছাত্রী পড়তেন তাঁদের কেউ কেউ শাঁখা-সিঁদুর পরে আসতেন অথবা কারও যে বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে তা জানিয়ে দেওয়া হত। আমরাও তাঁদের কিরকম উদাসীন হয়ে থাকতে দেখতাম। এইরকম একজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আমাদের এক সহপাঠী এগিয়ে গিয়ে বলেছিল, ‘তোমার এই উদাসীনতা সত্য কি না জানি না!’ মেয়েটি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করবেন।’ আগেই বলেছি, প্রেম হত, সেটা বাধা থাকত বলেই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু প্রেমের পর বিয়ে খুব বেশি হত না। তখন মেয়েপক্ষ বিচার করতেন, ছেলেটি কত রোজগার করে, কী জাত, গোত্র কী এবং পশ্চিমবঙ্গের পাত্রী হলে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা পরিবারে কখনওই নয়। বাঙাল-ঘটি ব্যাপারটা নিয়ে তখন মাথা ঘামাতেন অনেকে। কোনও মেয়ে নিয়ম ভাঙলেই বলা হত, ‘নির্ঘাৎ বাঙাল।’
চাকরি করতে গিয়ে দেখলাম যেসব মহিলা চাকরি করার অনুমতি পেয়েছেন বা আদায় করেছেন তাঁদের উপর কি ভয়ঙ্কর চাপ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগে বাঙালি মেয়েরা শুধু মেয়েদের স্কুল-কলেজে চাকরি করার অনুমতি পেত। অফিসগুলিতে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েরাই কাজ করতেন। যখন অর্থনৈতিক কারণে বাঙালি মেয়েরা অফিসে ঢুকলেন তখন সরকারি চাকরি তাঁদের লক্ষ্যে ছিল। এজি বেঙ্গল, আয়করে তখন মেয়েরা সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন। আমার সহকর্মী এক মহিলাকে ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে উঠে রান্না শেষ করে সবার জন্য গুছিয়ে রেখে সংসারের অন্য কাজ সাঙ্গ করে নৈহাটি থেকে ট্রেন ধরে অফিসে আসতে হত। আবার অফিস থেকে সন্ধে সাতটার মধ্যে বাড়ি ফিরে রাতের রান্না করতে হত। তাঁর শ্বশুরমশাই কাজের লোকের হাতের রান্না খেতে পারতেন না, শাশুড়ির প্রায়ই বাতের ব্যথা বাড়ত। পরে জানলাম এই ভূমিকায় তখনকার বেশিরভাগ চাকরিরতা মহিলাকে থাকতে হত। একসঙ্গে বাড়িতে ফিরে স্ত্রীর তৈরি চা খেয়ে স্বামী ক্লাবে যেতেন তাস খেলতে। রান্নাঘরে ঢুকে স্ত্রীকে সাহায্য করার ভাবনা তাঁর মাথায় আসত না। অবশ্য এটাও ঠিক, অনেক মহিলাই স্বামীকে রান্নাঘরে দেখতে চাইতেন না। তাঁর মনে মা-ঠাকুরমার ভাবনা কাজ করত।
গত দশ বছরে বাঙালি মেয়েদের অবস্থান তুমুল বদলে গিয়েছে। উত্তর কলকাতার যে রাস্তায় আমি থাকি সেখানে আশি সাল পর্যন্ত মেয়েদের পরনে শাড়ি অথবা স্কার্ট দেখেছি। দু-হাজার পর্যন্ত পোশাক বদলে সালোয়ার কামিজ এল। সে সময় দক্ষিণ কলকাতার রাস্তায় মেয়েরা প্যান্ট পরে ঘুরতে শুরু করেছেন। এখন উত্তর কলকাতার রাস্তায় জিনসের স্বাভাবিক ব্যবহারে অভ্যস্ত মেয়েরা। আমাদের সময়ে অভিভাবকরা ভয় পেতেন মেয়ে তার সহপাঠীর প্রেমে যেন না পড়ে। এখন তাঁরা জানেন, ওরা বন্ধু। মেয়েটি বলে, ‘দূর! ওর সঙ্গে প্রেম করব কেন? ওর কোন ম্যাচিওরিটি নেই।’ ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবিতে পাহাড়ি সান্যালের মুখে একটি সংলাপ ছিল, ‘ওর তো শিশুর মস্তিষ্ক।’ এখনকার মেয়েরা কলেজের সহপাঠীদের সম্পর্কে বোধহয় তাই ভাবে।
আগে আপনি থেকে তুমিতে নামতে গলা কাঁপত। এখন স্বচ্ছন্দ তুইতোকারি চলে। সেটা বিয়ের পরেও থেকে যায়। এখন রান্নাঘরে ঢুকলে স্বামীকে সঙ্গ দিতে হয়। নইলে হোমডেলিভারি বা রেস্তোরাঁর খাবার তো আছেই। আগের বাবা-মা-রা আজ নেই। এখন ওদের যাঁরা বাবা-মা তাঁরা এই পরিবর্তন মেনে নিয়েছেন। মেয়েরা আজ ছেলেদের থেকে কোনওদিকেই পিছিয়ে নেই। মাত্র পঞ্চাশ বছরে যদি এদেশে কোনও বিপ্লব হয়ে থাকে তাহলে তা মেয়েরাই করেছেন। সেদিন একজন বাবা আক্ষেপ করেছিলেন, মেয়ে বিয়ে করেছে আট বছর কিন্তু এখনও তিনি দাদু হতে পারেননি। মেয়েটির মা প্রস্তাব দিলে মেয়েটি জবাব দিয়েছে, ‘আমাকে বলছ কেন? এতকাল মেয়েরা মা হয়েছে, যন্ত্রণা সহ্য করেছে। এবার ছেলেদের ওই যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা নেওয়া উচিত। ওকে বলো।’
৫৪
ভালবাসার চেহারাটা কীরকম? সেই বালককাল থেকে যেসব ভালবাসার কথা শুনে এসেছি তার চেহারা একটু একটু করে বদলে গেল। ঠিক পুরোটা নয়, কিন্তু ভালবাসার ভঙ্গিটাই আর একরকম নয়। কলেজে পড়ার সময় মনে একটু একটু প্রেম প্রেম ব্যাপার আসেনি এমন দশটি ছেলের মধ্যে হয়তো দুই কি তিনটিকে পাওয়া যাবে। তখন প্রেমে পড়েছি বললে বন্ধুদের কাছে স্ট্যাটাস বাড়ত। চোখে চোখে কথা, একটু পাশাপাশি কথা না বলে হাঁটা, দেখা হলেই মুচকি হাসা, নির্দিষ্ট সময়ে কোনও জায়গা দিয়ে যাওয়াকেই প্রেমে পড়া বলা হত। আঙুলে আঙুলে ছুঁয়ে গেলে দু’জনের শরীরে যে বিদ্যুতের জন্ম নিত তারই প্রভাবে সারাদিন বসে বাতাস চেপে রাখতে কী ভালই না লাগত। এইসব প্রেমকে আরও গভীর করত ভয়। দুই পক্ষের অভিভাবকদের রাগী মুখ যত কল্পনায় আসত তত মনে হত, যা-ই হোক, এই প্রেম মার যেতে দেব না।
তোমাকে এক পলক দেখার জন্যে আমি এক লক্ষ মাইল হেঁটে যেতে পারি। ষাট দশকের এক কবি এই যে লাইনটা লিখেছিলেন তা যেন তখনকার সব তরুণের মনের কথা ছিল। অলকেন্দুর কথা মনে পড়ে। শ্যামবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে গোলবাড়ির কষা মাংস বারো আনায় কিনে খাব কি না ভাবছিলাম। কিনলে মাত্র চার আনা পকেটে পড়ে থাকবে। মাসের শেষ। হঠাৎ অলকেন্দু ঘেমো মুখে সামনে এসে দাঁড়াল, ‘যাক তোকে পেলাম। একটা টাকা ধার দে।’ অলকেন্দু কখনওই শোধ করবে না জানা থাকায় বললাম, ‘সরি’।
‘আচ্ছা, আট আনা দে। খুব বিপদে পড়েছি ভাই।’ করুণ গলায় বলল সে।
বিপদ শুনে নরম হলাম। জিজ্ঞাসা করলাম কারণটা।
‘আরে, সাতাশবার ওর দিকে তাকাবার পরে আজ-ই ও আমার দিকে তাকিয়ে স্বর্গীয় হাসি হাসল। ঠিক পাঁচটার সময় ও বাড়ির মোড়ে পিসির বাড়ি যাবে। রোজই যায় বলে জানি। তখন আজকের হাসিটাকে সেলিব্রেট করব। আট আনা দে, একটা গোলাপ ফুলের তোড়া কিনে ওকে দেব। আইডিয়াটা ভাল, কি বল?’ অলকেন্দু হাসল।
‘তুই বললি বিপদে পড়েছিস।’
‘বিপদ নয়? আজ যদি ওকে কিছু না দিই তা হলে সারাজীবন মুখ দেখাব কী করে? ভয়ঙ্কর বিপদ। আট আনা দে ভাই।’ হাত বাড়াল সে।
আট আনা নিয়ে মোড়ের ফুলের দোকান থেকে গোলাপের তোড়া কিনে তিরিশের বি বাসের হাতল ধরে অলকেন্দু চলে গিয়েছিল। গোলবাড়ির কষা মাংস সেদিন খাওয়া হয়নি কিন্তু আট আনার জন্যে শোক হয়নি। ভাল লেগেছিল।
অলকেন্দু সেই মেয়েটিকে বিয়ে করতে পেরেছিল? উত্তরটা জানার চেষ্টা করিনি। সেই বয়সে প্রেমটাই আমাদের কাছে গর্বের ব্যাপার ছিল, বিয়ে নয়। বিয়ের ব্যাপারটা শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার সমস্যা ছিল। আমাদের নয়।
ভোর পাঁচটার সময় হস্টেলে একটি মেয়ে এসে হাজির। তার চোখে জল। থাকে উল্টোদিকের বাড়িতে। এই হস্টেলের ছাদে দাঁড়ানো ফর্সা লম্বা ছেলেটির সঙ্গে তার নিয়মিত সাঙ্কেতিক কথা হত। দু’বছর ধরে চলছে। মেয়েটিকে বাড়ি থেকে বের হতে দেওয়া হত না। হঠাৎ তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তাই সে ভোরবেলায় বাড়ি থেকে পালিয়ে ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে এসেছে, জানতে চাইছে, বাবা-মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করবে কি না। ছেলেটি হ্যাঁ বললে তার বিবেক পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমরা সবাই একসঙ্গে হ্যাঁ বলে মেয়েটিকে সঙ্কটমুক্ত করেছিলাম। তখন যা বয়স তাতে দেবদাসের জন্যে কষ্ট হত। তখন সেই বয়স যখন অমিত আর লাবণ্যের মধ্যে কার ত্রুটি বেশি তা বুঝতে পারতাম না।
একটু একটু করে সামাজিক বাঁধন আলগা হতে লাগল। মূলত অর্থনৈতিক চাপই এই পরিস্থিতি তৈরি করল। পরিবারগুলো ভাঙতে লাগল। সংসারের প্রয়োজনে মেয়েরা চাকরি শুরু করলেন। মনে রাখতে হবে, সাতের দশকেও ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া মেধাবী ছাত্রীর পক্ষেই সম্ভব হত। আইএএস বা ডব্লুবিসিএসও তা-ই। সাধারণ মেয়েদের পক্ষে স্কুল-কলেজে চাকরির চেষ্টা ছাড়া উপায় ছিল সরকারি অফিসে যোগ দেওয়া। এখনকার মতো এমবিএ বা কম্পিউটার সায়েন্সের ডিগ্রি নিয়ে ভাল কাজ পাওয়া তখন আকাশকুসুম ছিল। তবু, মেয়ে চাকরি করছে মানে প্রেম করার অধিকার অর্জন করেছে, এমন ভাবনা অভিভাবকরা ভাবতে পারতেন না। পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনে দেখা যেত, ‘সরকারি চাকরিরতা পাত্রীর জন্যে প্রতিষ্ঠিত পাত্র চাই।’ যে মেয়েটি ছেলেদের সঙ্গে স্কুল-কলেজে পড়েনি, চাকরিতে এসে সে ছেলেদের সংস্পর্শে আড়ষ্ট হবেই। সেই সঙ্গে তার কৌতূহলও থাকবে। সাত এবং আটের দশকে দেখা গেল চাকরিরতা মেয়েদের অনেকেই সহকর্মী পুরুষকে পছন্দ করছে। অফিস পালিয়ে সিনেমা দেখছে, রেস্টুরেন্টে খাচ্ছে, তার পর বিয়ের পিঁড়িতে বসছে। তখনও ওদের বিয়ের ব্যাপারে অভিভাবকের খুঁত খুঁতানি ছিল। ছেলে, তার বংশ, গোত্র ইত্যাদি পরীক্ষা করার ছলে নিজেদের মতামত জানানো হত। কিন্তু নয়ের দশকের পরে তাঁরা হাত তুলে নিলেন। মেয়ে মাস্টারি করে রিসার্চের পর বড় চাকরিতে যে মাইনে পাচ্ছে তা বাবার স্বপ্নেও ছিল না। অথচ মেয়ে প্রেম করছে না, বিয়ের বয়স হয়েছে, মেয়ের মায়ের তাগিদে পাত্র খুঁজতে গিয়ে যোগ্য পাত্র পাচ্ছেন না বাবা। হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। সেইরকম যোগ্য পাত্রের খবর তাঁর পরিচিতরা রাখেন না। এই ধরনের সমস্যা প্রবল হয়ে যাওয়ার পর বাবা মেয়ের মাকে প্রশ্ন করেন, ‘দ্যাখো, তোমার মেয়ে প্রেম করছে কি না। যদি করে তা হলে আমি বেঁচে যাই। ‘
মেয়ের মা আঁতকে ওঠেন, ‘তার মানে? তুমি খরচ করবে না?’
‘নিশ্চয়ই যা যা করার সব করব। আমার কোনও দায়িত্ব থাকবে না বলে বেঁচে যাব।’
.
বিয়েটা যখন সহজ হয়ে গেছে তখন প্রেমের চেহারা বদলে গেল। আগে আপনি থেকে তুমিতে নামলে শিহরণ জাগত, এখন শুরু হচ্ছে তুই-এ। সেটা বিয়ের পরেও বেমালুম চলছে। এখন রাত এগারোটা পর্যন্ত কোনও ছেলের সঙ্গে আড্ডা মারা মানে প্রেম করা নয়। একসঙ্গে সিগারেট খাওয়া, নন্দনের পিছনে বসে সিগারেটে কিছু পুরে টানার মধ্যে কিছু অস্বস্তি নেই। তিনটি মেয়ে গল্প করতেই পারে ওদের তিন ছেলে বন্ধুর মধ্যে কে ভাল চুমু খায়। আর চুমু খেলেই যে প্রেমে পড়তে পারে এমন মূর্খ কেউ আছে? একটি মেয়ে সেদিন বলল, ‘আচ্ছা কাকু, দেবদাস শুধু ইডিয়ট নয়, অত্যন্ত প্রতিশোধপরায়ণ।’ বললাম, ‘মানে?’ মেয়েটি বলল, ‘শালা, সরি, ব্যাটা ড্রিঙ্ক করে লিভার পচিয়ে আর মরার কোনও জায়গা পেল না? পার্বতীর বাড়ির কাছে গিয়ে মরল যাতে মেয়েটার সংসারে সমস্যা হয়।’ আমার চোখ খুলে গেল। ওর সঙ্গিনী যে সদ্য সেক্টর ফাইভে ঢুকেছে, বলল, ‘তুমি খবরের কাগজে পাত্র চাই-এর বিজ্ঞাপন দেখেছ? এখন বাবা-মা মেয়ের ছবি ছাপিয়ে পাত্র ধরতে চাইছে। মেয়েগুলো প্রতিবাদ করে বলছে না কেন, আমরা শরীর দেখিয়ে বিয়ে করতে চাই না। বেশিদিন দূরে নেই, এই মেয়েরা ঠিক প্রতিবাদ করবে। দেখো।’
.
প্রেম, ভালবাসা খুব দ্রুত পোশাক বদলাচ্ছে, খারাপ কী!