৫
তিনদিন পরে কলকাতায় যাওয়ার ট্রেন ধরতে হবে। হলদিবাড়ি থেকে যে লোকাল ট্রেন জলপাইগুড়ি হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি অবধি যায় তার শেষের কামরাটি কেটে সেখানে দাঁড়ানো নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসের পিছনে জুড়ে দেওয়া হয়ে থাকে। ওই কামরায় আমাদের উঠতে হবে। আজ বিকেলে বাবুপাড়া পাঠাগারে যাওয়ার সময় স্টেশনে গিয়ে কামরাটাকে দেখে এলাম। কলকাতায় যাওয়ার ভিড় ঘিরে রেখেছিল কামরাটাকে। নিশীথ আর স্বপন সঙ্গে ছিল। বলল, ‘চিন্তা করিস না। আমরা দুপুরের ট্রেনে হলদিবাড়িতে গিয়ে তোর জন্য জায়গা দখল করে নিয়ে আসব।’
ওরা রূপশ্রীতে উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখতে চলে গেলে আমি পাঠাগারে ঢুকলাম। ক’টা দিন তো প্রিয় শহরে আছি, সিনেমা দেখে সময় কাটাতে চাইনি।
সেদিন সুনীলদা আসেননি। নতুন কেনা বইগুলো দেখছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা বই, যার নাম রিক্সাওয়ালা। ট্যাক্সি ড্রাইভার নামে একটা হিন্দি ছবি এই শহরে এসেছিল যা আমার দেখা হয়নি। কিন্তু রিক্সাওয়ালা নামে কোনও বই থাকতে পারে জানতাম না। বইটা বের করে দেখলাম তার লেখকের নাম লাও চাও। উপন্যাসটি কে অনুবাদ করেছিলেন এখন আর মনে নেই।
এই প্রসঙ্গে একটি বিশেষ কথা বলি, বাল্যকাল এবং কিশোর বয়সে বিদেশি বিখ্যাত বইগুলো বেশিরভাগ বাঙালি পড়ত বাংলায়, অনুবাদের মাধ্যমে। রবিন হুড, কাউন্ট অব মন্টিক্রিস্টো, আঙ্কল টমস কেবিন, গ্যালিভার্স ট্রাভেল ইত্যাদির স্বাদ সেইসব অনুবাদকরা চমৎকার পরিবেশন করেছিলেন। একেবারে পাঠ শুরুর সময়ে আমি সেইসব বই পড়িনি, কিন্তু পরে পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। এইসব অনুবাদকের মধ্যে যে দুজনের কথা মনে আছে তাঁরা হলেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় এবং সুধীন্দ্রনাথ রাহা। মাঝে মাঝে সাহিত্যিক গজেন্দ্রকুমার মিত্র অনুবাদের কাজে হাত লাগিয়েছিলেন। তাঁর অনুবাদ করা টেল অব টু সিটিজ এবং কাউন্ট অব মন্টিক্রিস্টো অনবদ্য। এই অনুবাদকরা (গজেন্দ্রকুমারকে ধরছি না) কখনওই সাহিত্যিকের সম্মান পাননি কিন্তু বাঙালি বালক- কিশোরের সবার সামনে বিশ্বসাহিত্যের বিশাল দরজা খুলে দিয়ে গিয়েছেন। ওই ক্লাসিক বইগুলো ইংরিজিতে পড়তে না পারলে অজানা থেকে যেত। আবার অনুবাদ খারাপ হলে বইগুলো সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হত। সেটা হয়নি বলে এঁদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
‘কী বই ওটা?’ পিছন থেকে সুনীলদার গলা ভেসে এল।
বললাম, ‘আপনি এসে গিয়েছেন। এটা অনুবাদ উপন্যাস, রিক্সাওয়ালা।
‘ও নতুন এসেছে। এখনও পড়া হয়নি। তুমি যেন কবে কলকাতায় যাচ্ছ?’
‘তিনদিন বাদে।’
‘কোন্ কলেজে ভর্তি হবে?’
‘জানি না। গিয়ে ঠিক করব।’
‘প্রেসিডেন্সিতে চেষ্টা করো। নইলে সেন্ট জেভিয়ার্সে।’
‘এই বইটা নিচ্ছি।’
‘নাও। এখন তো তুমি বড় হয়ে গিয়েছ। সব পড়তে শুরু করো। এখন তোমার কোটে ভালো কোনটে মন্দ তা বোঝার বয়স হয়ে গিয়েছে।’ সুনীলদা বললেন।
খুব খুশি হয়েছিলাম সুনীলদার কথায়। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছি, কলকাতায় পড়তে যাচ্ছি, যদিও আঠারো হতে আর একবছর দেরি তবু নিজেকে বড় বলে মন হলেও অন্যের মুখে সেটা শুনলে বেশ ভালো লাগে। সেই ভালোলাগা নিয়ে সোজা বাড়ি চলে আসছিলাম। করলা নদীর গা ঘেঁষে ঝুলনা পুলের ওপর দিয়ে বাড়িতে যেতে হবে। কিন্তু করলা নদীর ধার দিয়ে যাওয়ার সময় একটা আবছা অন্ধকারে সেই মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল যে আমার পাশের বাড়িতে এসেছে কয়েক বছর। এই মেয়ের ছুঁড়ে দেওয়া চিরকুট পেয়েছিলাম কোনও এক বিকেলে যা পড়ে অবাক হয়েছিলাম। যদিও সেটা আমার উদ্দেশ্যে ছিল না। সেই মেয়ে যাচ্ছিল কাজের লোকের সঙ্গে। আচমকা দাঁড়িয়ে সে বলল, ‘কংগ্রাটস’।
হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। তখনও ইংরিজি শব্দের সংক্ষিপ্ত উচ্চারণে অভ্যস্ত হইনি। তবু বোকা বোকা হেসেছিলাম। মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, ‘ক্যালে যাচ্ছ?’
ক্যাল মানে ক্যালকাটা বুঝতে পেরে বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘কী পড়বে? সায়েন্স না আর্টস?’
‘আর্টস।’
‘আচ্ছা! তার মানে লিটারেচার লাইক করো। কী বই ওটা?’
‘রিক্সাওয়ালা। লাও চাও-এর লেখা।’
‘মাই গড! তুমি চাইনিজ জানো নাকি?’
‘না। বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।’
‘ওঃ। অরিজিন্যাল না পড়লে কিছুই পড়া হয় না। তুমি ফ্লব্যেয়ার পড়েছ? মোপাসাঁ? আমিও পড়িনি। ইংরিজিতে ট্র্যান্সলেটেড হয়েছে কিন্তু আমি ফরাসি শিখে তবে পড়ব। কিন্তু এ্যালান পো নিশ্চয়ই পড়েছ?’
‘আমি এখনও বাংলা সাহিত্যের একভাগও পড়ে উঠিনি।’
চোখ বড় করে কাঁধ নাচাল সে। তারপর উল্টোদিকে চলে গেল। সেই সন্ধেবেলায় ঝুলনা পুলের রেলিংয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। নীচে স্রোত না থাকা নদী, চরাচর মানুষশূন্য। এই যে মেয়েটি, যার সঙ্গে আমার কখনওই কথা বলার সম্পর্ক তৈরি হয়নি সে যে-জগতে বাস করে তার কোনও সন্ধান আমার জানা ছিল না। ও যেসব লেখকের নাম বলে গেল তারা নিশ্চয়ই বিখ্যাত। ও তাঁদের লেখা পড়বে যে ভাষায় লেখাটা হয়েছিল সেই ভাষা শিখে। ভাবা যায়? এ্যালান পো নিশ্চয়ই ইংরেজিতে লিখেছেন। আজ পর্যন্ত সে লেখকের নাম শুনিনি। আমার মনে হচ্ছিল পৃথিবীজুড়ে কত বিখ্যাত সাহিত্যিক লিখে চলেছেন আর আমি তার বিন্দুবিসর্গ জানি না। অথচ আমার পাশের বাড়ির ওই মেয়ে সেসবের খেয়াল রাখে। নীপা কি ওই লেখকদের লেখা পড়েছে? তারপরেই মন ভার হয়ে গেল। এই মেয়ে বাঙালি হয়েও বাংলা সাহিত্যের কোনও খবর রাখে না। রাখলে কথা উঠতেই ও ওইভাবে চলে যেত না। বাঙালি হয়ে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে এই মনোভাব আদৌ মেনে নেওয়া যায় না।
বাড়িতে এসে দাদু-পিসিমার সঙ্গে সময় কাটিয়ে নীচের ঘরে গিয়ে লাও চাও-এর রিক্সাওয়ালা নিয়ে বসলাম। অন্য কোনও জীবিকায় সুযোগ না পেয়ে একটি তরুণ রিক্সাওয়ালা হয়েছিল। প্রতিটি দিন তাকে অভাব এবং জীবিকাবিষয়ক সমস্যায় নাজেহাল হতে হচ্ছিল। সে থাকত একটি নিচু মানের বস্তিতে। তরতর করে গল্প এগোচ্ছিল। চিনের মানুষের জীবনযাপনের বর্ণনা, খাদ্যাভ্যাস, রাস্তাঘাটের বর্ণনা গল্পের সঙ্গে চমৎকার মিশে ছিল বলে সহজেই তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাচ্ছিলাম। এই ছেলেটির জীবনে প্রেম এল। এরকম ক্ষেত্রে যেমন হয়, ছেলেটি সেই মেয়েটিকে আঁকড়ে ধরে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখতে চাইল। কিন্তু মেয়েটি শেষ পর্যন্ত তাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হল যখন, তখন দিশেহারা হয়ে গেল ছেলেটি। সেইসময় তার এক পরিচিত রিক্সাওয়ালা তাকে খুব বকাবকি করল একটি মেয়ের জন্য ভেঙে পড়ায়। সারাদিনের কাজের শেষে বিশ্রামের বদলে লোকটা ওকে নিয়ে গেল বারবণিতা পাড়ায়।
এই অবধি পড়ার পরে আমি খোলা দরজার দিকে তাকালাম। বাইরের বারান্দায় অন্ধকার। আমি কখনওই বারবণিতা পাড়া নিয়ে লেখা কোনও গল্প পড়িনি। এই উপন্যাসে যেভাবে বাস্তবচিত্র আঁকা হচ্ছে তাতে বারবণিতা পাড়া সম্পর্কেও নিশ্চয়ই বিশদ তথ্য থাকবে। এইসময় যদি দাদু বা পিসিমা ঘরে ঢোকেন তাহলে আমার মুখ দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন আমি নিষিদ্ধ কিছু পড়ছি। আঙুল কাঁপছিল, বইটা বন্ধ করে শ্বাস ফেললাম। ঠিক তখনই পিসিমা ঘরে ঢুকলেন, ‘কী রে, জিনিসপত্র কবে গোছাবি?’
‘হুঁ। গোছাব।’ হঠাৎ মনে হল বই বন্ধ করে ভালো করেছি।
‘তোর কী হয়েছে?’ পিসিমার মুখে উদ্বেগ।
‘কী আর হবে? কিছুই হয়নি।’
‘মুখটা কীরকম লাগছে! খুব ভাবছিস বুঝি?’ কী ভাবব?’
‘এই যে অচেনা জায়গায় যাচ্ছিস। একা থাকতে হবে। ভয় করছে? তাহলে তোর দাদুকে বলি, গিয়ে দরকার নেই, এখানকার কলেজে ভর্তি হয়ে যা।’
‘দূর! আমার কিছুই মনে হচ্ছে না। কাল পরশু সব গুছিয়ে নেব।’
‘ঠিক আছে। ন’টার মধ্যে খাবার দেব। চলে আসবি, ডাকতে যেন না হয়।’ পিসিমা যেমন এসেছিলেন তেমনই চলে গেলেন।
আমি সন্তর্পণে আবার বই খুললাম।
ছেলেটি যেন আমার মতো। প্রথমে যেতে চাইছিল না, চাপে পড়ে ভয়ে ভয়ে বারবণিতা পাড়ায় ঢুকল সঙ্গীর সঙ্গে। খুব গরিব পাড়া সেটা। মেয়েগুলো বিকট সেজে দুপাশের ঝুপড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে, রসিকতা করছে নতুন লোককে খদ্দের ভেবে।
সঙ্গী ওকে নিয়ে ঢুকল একটি ঝুপড়িতে যেখানে অল্পবয়সি একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আর একজন যুবতী মহিলা কাছে এসে দাঁড়াতেই সঙ্গী বলল, আজ ওর প্রথমদিন, তাই আমিই টাকা দেব। ওর কাছে নেবে না।’
অল্পবয়সি মেয়েটি ছেলেটির হাত ধরে দরজা বন্ধ করল। ঝুপড়ির ভেতরে একটি কুপি জ্বলছে। মেয়েটা একটা সসপ্যান থেকে খানিকটা তরল পদার্থ গ্লাসে ঢেলে ছেলেটির সামনে এগিয়ে ধরল। ছেলেটি জিজ্ঞাসা করল, ‘কী এটা?’
মেয়েটি ফিক করে হাসল, ‘ভালোবাসা। খেয়ে নাও।’
ছেলেটি ঢক ঢক করে গিলে ফেলতেই মেয়েটি তার জামা খুলতে লাগল।
আমি আবার বই বন্ধ করলাম। যা শুধু অনুমানে ছিল তা এখন বইয়ের পাতায় প্রত্যক্ষ করতে পারব। বাংলা সাহিত্যে কারও বইয়ে এইরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানি না। সুনীলদার কথা মনে হল, ‘এখন তোমার কোনটে ভালো কোনটে মন্দ তা বোঝার বয়স হয়ে গিয়েছে।’ নিজেকে বললাম, পড়লেই তো আমি খারাপ হয়ে যাচ্ছি না। সাহিত্যে যখন এটা লেখা হয়েছে তখন নিশ্চয়ই কিছু যুক্তি আছে। সেই যুক্তিটা কী তা জানা দরকার।
বইয়ের দিকে হাত বাড়াতেই পিসিমার ডাক এল। খেতে গেলাম। সাধারণত দাদু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ হওয়ায় খাওয়ার সময় কথা বলেন না। অথচ আজ উল্টো হল। তাড়াতাড়ি খেয়ে বইমুখো হব ভেবেছিলাম কিন্তু দাদু আমার কলকাতা যাওয়ার প্রসঙ্গ তুললেন। কী করব সেখানে, কার সঙ্গে মিশব, কোন্ কলেজে পড়ব, হস্টেলে থাকতে হবে অবশ্যই, এইসব কথা বলে গেলেন অনেকটা সময় নিয়ে। শেষ পর্যন্ত পিসিমা আমাকে উদ্ধার করলেন।
ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে আবার শুরু করলাম এবং এই প্রথম আমি নারী-পুরুষের যৌনসঙ্গমের বর্ণনা পড়লাম। খুব নির্বাচিত কয়েকটা লাইন যার মধ্যে কোনও অশ্লীল শব্দ নেই কিন্তু ছবিটা এত স্পষ্ট যে চোখ বন্ধ করে বসেছিলাম।
ছেলেটি ফিরে এসেছিল তার বস্তিতে। কিন্তু সঙ্গীর অনুরোধেও দ্বিতীয়বার বারবণিতা পাড়ায় যায়নি। নিজেকে অপরাধী বলে ভাবতে আরম্ভ করল সে। আরও মুষড়ে পড়ল তাই। মনে হতে লাগল যাকে ভালোবাসত তার প্রতি প্রচণ্ড অন্যায় করেছে সে। মেয়েটি তাকে ত্যাগ করেছিল কিন্তু সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
এইখানে আমি মুগ্ধ হলাম। ছেলেটির অনুশোচনা পড়তে গিয়ে একটু আগের ঘটনার কথা ভুলে গেলাম অনায়াসে। তারপরে ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটল। ছেলেটি যৌনরোগে আক্রান্ত হল। যন্ত্রণা প্রবল হলে সে -সেই সঙ্গীর কাছে গিয়ে সমস্যাটা জানাল। লোকটা তাকে নিয়ে গেল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার তাকে ওষুধ দিয়ে বিশ্রাম নিতে বললেন। অথচ বিশ্রাম নিলে তাকে অভুক্ত থাকতে হবে। কিন্তু ছেলেটি যেন একটা কথা ভেবে স্বস্তি পেল। ভালোবাসার মানুষ চলে গেলে তো ভালোবাসা মরে যায় না। সে বারবণিতা পাড়ায় গিয়ে মেরে ফেলেছে। সেই অন্যায়ের শাক্তি হিসেবে তার শরীরে রোগ এসেছে। এটা তার প্রাপ্য ছিল।
কীরকম গুলিয়ে গেল। ওই যৌনসঙ্গমের বর্ণনা আর আমার কাছে তেমন উল্লেখযোগ্য ব্যাপার বলে মনে হচ্ছিল না। ওই ছেলেটির জন্য আমার কষ্ট হচ্ছিল। পরদিন স্বপনকে বললাম ব্যাপারটা। স্বপন বলল, ‘চল, তোকে দেখাই।’
কৌতূহল তো ছিলই। স্বপন আমাকে নিয়ে গেল শহরের বেগুনটুলি এলাকায়। স্বপন বলল, এই গলি দিয়ে সবাই শিল্পসমিতি পাড়ায় যায়। আমরা গেলে কেউ কিছু মনে করবে না।’
দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে আমি অবাক হয়ে গেলাম। লাও চাও যা লিখে গিয়েছেন তার অবিকল রূপ এখানে। সেই গরিব ঝুপড়ির বদলে টিনের ঘর আর গরিব মেয়েগুলোর পাউডার মেখে সিগারেট খাওয়া। হঠাৎ খুব কষ্ট হল ওদের জন্য, ওদের শরীরেও কি অসুখ আছে? কোনও বাঙালি লেখক কি এদের নিয়ে লিখেছেন? আমি তখনও জানতাম না।
৬
উনিশশো ষাট সালে কলকাতা শহরে আমার কোনও পরিচিত মানুষ ছিলেন না। স্কটিশ চার্চ কলেজে বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হওয়ার পর থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম কলেজেরই টমোরি মেমোরিয়াল হোস্টেলে। একদিকে আমহার্স্ট স্ট্রিট আর অন্যদিকে আপার সার্কুলার রোডের মধ্যে রামানন্দ চ্যাটার্জি স্ট্রিট নামে যে গলিটা তার গায়ে এই হোস্টেল। প্রত্যেক আবাসিকের জন্য আলাদা ঘর, অন্যের ঘরে গিয়ে আড্ডা মারা নিষিদ্ধ। স্কটিশ কলেজ হোস্টেল থেকে দশ-বারো মিনিটের হাঁটাপথ। হোস্টেল থেকে কলেজ আর কলেজ থেকে হোস্টেল, এই করেই প্রথম মাসটা কেটে গেল। একদিন গলিতে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালাম। এই রাস্তাটার নাম রামানন্দ চ্যাটার্জি স্ট্রিট কেন? বাবার আলমারিতে যেসব পুরনো পত্র-পত্রিকা দেখেছি তার মধ্যে একটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে রামানন্দ চ্যাটার্জির নাম দেখেছি। সেই বয়সে জেনেছিলাম দেশের বিখ্যাত মানুষদের নামে রাস্তার নামকরণ করা হয়। যেমন রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধি, সুভাষ বোস, জওহরলাল নেহরু। অবশ্য সেসব রাস্তা যেমন চওড়া তেমনই গুরুত্বপূর্ণ। ছোট গলির নামকরণের সময় তাঁদের কথা ভাবা হয় না। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হে খোকা, কী হয়েছে?’
হেসে বললাম, ‘আমি এই গলির নাম নিয়ে ভাবছিলাম।’
বৃদ্ধ বললেন, ‘আজকালকার ছেলেরা তো এসব নিয়ে মাথাই ঘামায় না, তুমি তাও ভাবছ। কিন্তু গলি বললে কেন? এটা স্ট্রিট। রামানন্দ চ্যাটার্জি স্ট্রিট। এভেনিউ, রোড, স্ট্রিট হল রাস্তার সম্মানজনক নাম। লেনকে গলি বলা যায়।’
‘কিন্তু এটা তো আমহার্স্ট স্ট্রিটের পাঁচভাগের এক ভাগ।’
‘হোক। যাঁর নামে রাস্তার নামকরণ হয়েছে তাঁকে তো ছোট করা যায় না। তুমি জানো তিনি কে ছিলেন?’ বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন।
‘বোধহয়, পত্রিকার সম্পাদক।’ শুকনো গলায় উত্তর দিলাম।
‘বাঃ। গুড়। সোজা চলে যাও। এই রাস্তা যেখানে সার্কুলার রোডে পড়ছে তার বাঁদিকে তাকালে যে বাড়িটাকে এখনও দেখতে পাবে সেখানেই রামানন্দবাবুর অফিস ছিল। যাও, দেখে এসো।’
বৃদ্ধের কথায় উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে গেলাম। ওই দিক দিয়ে কলেজে যেতে হয় না বলে নতুন লাগছিল। একটা লোহার বিশাল গেট, তার পিছনে বড় ফুলের বাগান, বাগানের পাশে দোতলা প্রাসাদ। এরকম বাড়ি আমি কলকাতায় এসে দেখিনি। গেটের গায়ে লেখা আছে, ‘লাহা বাড়ি।
গলির মোড়ে পৌঁছতেই বাড়িটাকে দেখতে পেলাম। এখন বোধহয় বাসযোগ্য নয়। এই বাড়ি থেকে বের হত মাসিক প্রবাসী পত্রিকা যা সম্পাদনা করতেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল ওই পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথ থেকে এমন কোনও লেখক নেই যিনি ওই পত্রিকায় লেখেননি। বাবার সংগ্রহে ওই পত্রিকার যেসব সংখ্যা রয়েছে তার পাতা আমি উল্টেছি। বাড়িটাকে দেখে বেশ গর্ব যেমন হল, মনও খারাপ হয়ে গেল। পত্রিকা বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকদিন আগে। কিন্তু তার স্মৃতি সহজে মোছার নয়। অনেক পত্রিকা জন্মায় এবং মরেও যায়, প্রবাসী তাদের থেকে অনেক আলাদ ভূমিকা নিয়েছিল। আমি সেদিন কল্পনা করেছিলাম, এই অফিসে একসময় বাংলা সাহিত্যের তাবড় তাবড় লেখকরা নিয়মিত আসতেন। রামানন্দবাবুর সঙ্গে তাঁরা আলোচনা করতেন।
হোস্টেলে একটা ছোট্ট লাইব্রেরি ছিল। সেখানে চোখ বোলাতে গিয়ে আমি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে একটি বই পেয়ে গেলাম। যেহেতু আমি যে গলিতে আছি সেটা তাঁর নামে নাম তাই আগ্রহ বাড়ছিল।
রামানন্দবাবু জন্মেছিলেন ২৯শে মে, ১৮৬৫ সালে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের চেয়ে মাত্র চার বছরের ছোট ছিলেন। তার জন্মশহর ছিল বাঁকুড়ায়। তিনি পরলোকগমন করেন ৩০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৪৩, কলকাতায়, রবীন্দ্রনাথের দু’বছর পরে। অর্থাৎ রামানন্দবাবু আমার মতোই মফস্বল থেকে কলকাতায় এসেছিলেন।
মডার্ন রিভিউ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক, যা কলকাতার গর্ব ছিল সেই রামানন্দবাবুকে বলা হত ভারতীয় সাংবাদিকতার জনক। বাঁকুড়ার পাঠকপাড়ার শ্রীনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সন্তান রামানন্দ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়ে আঠারো বছর বয়সে এন্ট্রান্স পাশ করেন। তারপর পড়তে আসেন কলকাতায়। তাঁর মেধা দেখে অধ্যাপক হেরম্ব চন্দ্র সেন তাঁকে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জারের সহ-সম্পাদকের পদ প্রস্তাব দেন। এই প্রস্তাব গ্রহণ করায় রামানন্দবাবুর জীবন ভারতীয় সাংবাদিকতার সেবায় নিয়োগ করতে সুবিধে হয়েছিল।
আশ্চর্য ব্যাপার, এইসব তথ্য আমি জলপাইগুড়িতে থাকতে জানতামই না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রচুর প্রতিভার জন্ম হয়েছিল বলে আমাদের সাহিত্য, সংবাদপত্র এবং রাজনৈতিক জীবন প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছিল। তখনই মনে প্রশ্ন এল, বিদ্যাসাগর মশাই থেকে শুরু করে জীবনানন্দ দাশ পর্যন্ত সময়টায় বাংলা সাহিত্য যত প্রতিভা পেয়েছে গত ষাট বছরে সেই তুলনায় কতটা ধনী হয়েছে? আমি কোনও তথ্য জানতাম না, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় আমার অশিক্ষা এত প্রবল ছিল যে তুলনা করার সাহস বা শক্তি ছিল না।
.
স্কটিশে যার সঙ্গে প্রথম সখ্যতা তৈরি হয়েছিল তার নাম শৈবাল মিত্র। সে তখন ছাত্র ফেডারেশন করত, পরের বছর স্কটিশের ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিল। তখন তার কথা শুনে মনেই হত না শৈবাল কখনও সাহিত্য করবে। বরং মনে হয়েছিল ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বিখ্যাত হবে।
মাস তিনেক ক্লাস করার পর শৈবাল আমাকে নিয়ে গেল কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে। সেই দুপুরে গমগমে কফি হাউসে টেবিলে টেবিলে যেসব কথা হচ্ছিল তার সম্মিলিত আওয়াজ আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল। প্রথমে মনে হয়েছিল এখানে বসে লোকে কথা বলে কী করে? কিন্তু চেয়ারে বসার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই আওয়াজের সঙ্গে ধাতস্থ হয়ে গেলাম। আমি জানলাম বাংলা সাহিত্যে লিটল ম্যাগের কী ভূমিকা! সেই ম্যাগাজিনে যারা লেখে তাদের অন্যতম আড্ডার জায়গা হল ওই কফি হাউস। আরও জানলাম, বিকেলের পর নামিদামি কবি-লেখকরা কফি হাউসে আসেন। রবিবারের সকালে অধ্যাপক এবং সিনেমার অভিনেতারা।
ক্রমশ আমি একটা আড্ডার শরিক হয়ে গেলাম। এই আড্ডায় যারা আসে, তারা কেউ প্রেসিডেন্সির ছাত্র, কেউ সেন্ট পানের কেউ বিদ্যাসাগরের। হঠাৎ একজন আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বল, আউট- সাইডারের কী কী ত্রুটি তোমার চোখে পড়েছে।’
প্রশ্নটার মানে বুঝতেই পারলাম না। আউটসাইডার বস্তুটি কী? আমি চুপ করে বসে আছি দেখে আরেকজন তথ্য জোগাল, ‘আরে, কামুর আউটসাইডারের কথা বলছে ও। পড়িসনি?’
তখন বুঝলাম ওটা একটা বইয়ের নাম যার লেখক কামু। এই বইটি নিশ্চয়ই ইংরিজিতে লেখা। আমি কখনও ইংরিজি উপন্যাস পড়িনি। যা পড়েছি তা অনুবাদের মাধ্যমে।
উত্তর দিচ্ছি না দেখে প্রশ্নকর্তা এমনভাবে ঠোঁট মোচড়ালেন যে আমি খুব লজ্জিত হলাম। এরা সবাই পড়েছে অথব আমি পড়িনি।
একটা অজুহাত দেখিয়ে কফি হাউস থেকে নেমে এসে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পুরনো বইয়ের স্টলের দিকে তাকালাম। তারপর একে একে স্টলে স্টলে ঘুরে প্রশ্ন করতে থাকলাম, ‘কামুর আউটসাইডার আছে?’
শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল বহু ব্যবহারে জীর্ণ চটি বইটি। বেশ সস্তায় পাওয়া গেল বইটি। ফুটপাতে বসে বিক্রি করছিল বই বিক্রেতা, বলল, ‘দাদা, কামুর আরেকটা বই আছে, নেবেন?’
‘কী বই?’
লোকটা আরেকটি চটি বই এগিয়ে ধরল। নাম পড়লাম, ‘দ্য ফল’। মনে আছে, দুটো বই কিনেছিলাম পাঁচ টাকায়। তখন আমার গোটা মাসের হাতখরচ বাবা বরাদ্দ করেছিলেন দশ টাকা। তা থেকে পাঁচ টাকা বইয়ের জন্য বেরিয়ে গেলে যে কী ভয়ঙ্কর অসুবিধের মধ্যে পড়ব সেই দুশ্চিন্তা ওই মুহূর্তে মাথায় আসেনি।
হোস্টেলে ফিরে অনেক রাত ধরে দু-দুবার আউটসাইডার পড়লাম। প্রথমে একটু হোঁচট খাচ্ছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ টি দেবের সাহায্যে শেষ পাতায় মসৃণভাবে পৌঁছে গেলাম।
কী অদ্ভুত ধরনের লেখা! বাংলাভাষায় এই ধরনের লেখা আগে কেউ লিখেছেন কিনা জানি না। হঠাৎ মনে হল, আমি নিজেই তো একজন আউটসাইডার। শব্দটার সঠিক বাংলা কী হবে? বহিরাগত? আগন্তুক? পরবাসী? নাঃ ঠিক হচ্ছে না। ঘরের মধ্যে থেকেও যে বেঘরে সেই আউটসাইডার
এই আলব্যের কামু ইংরেজ নন, ইংরিজি ভাষায় উপন্যাস লেখেননি। অবশ্যই ইংরিজি অনুবাদের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষ ওঁর বই পড়ছে। হঠাৎ মনে হয়েছিল, আমাদের সাহিত্যের বিখ্যাত সৃষ্টিগুলো কি ইংরিজিতে রূপান্তরিত হয়ে ইউরোপ-আমেরিবার পাঠকদের কাছে পৌঁছেছে?
.
পরের দিন কলেজের ক্লাসে গুরুদাসবাবু এলে তাঁকে প্রশ্নটা করেছিলাম। দারুণ কন্ঠস্বর যেমন ছিল, পাণ্ডিত্যও তেমনই। অনেক পরে মনে হয়েছে, উনি যদি রঘুপতির চরিত্রে অভিনয় করতেন তাহলে দারুণ মানাত।
গুরুদাসবাবু হাসলেন, ‘এদেশে ঢাকী পাওয়া খুব মুশকিলের ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ বাধ্য হয়ে নিজের ঢাক নিজেই বাজিয়েছিলেন। তা না করলে ওই নোবেল পুরস্কারটা বাংলার সাহিত্যের কপালে জুটত না। বঙ্কিমের কথা ছেড়ে দাও, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণরা তাঁদের সাহিত্যকে গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ভাবেননি। ওঁদের প্রকাশকরা সেসময় কোনও উদ্যোগ নেননি। আমি বিশ্বাস করি, অদ্বৈতময় বর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম যদি সঠিক অনুবাদে বেরত তাহলে সুইডেনের সাহেবরা নোবেল পুরস্কার দিতে বাধ্য হতেন।’
শৈবাল জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তাহলে অনুবাদ করা হচ্ছে না কেন?’
‘একেবারে হচ্ছে না তা বলা ঠিক নয়। হচ্ছে কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছে।’
‘বুঝতে পারলাম না স্যার।’
‘ধরো, মানিকবাবুর পদ্মানদীর মাঝির চমৎকার অনুবাদ করলেন কোনও একজন সাহিত্যমনস্ক অনুবাদক। সেই পাণ্ডুলিপি ছাপাবে কে? কলকাতায় যাঁরা ইংরিজি বই ছাপেন তাঁদের সংখ্যা খুব কম। তাঁরা নিশ্চিত বিক্রি হবে এমন বই প্রকাশ করেন। তবু, ধরো, আমাদের অনুবাদকের কপাল ভালো হওয়ায় পদ্মানদীর মাঝির ইংরিজি অনুবাদ ছাপা হল। দেখা যাবে, তিন বছরের মধ্যে চণ্ডীগড় বা বোম্বের পাঠক সেই বইয়ের সন্ধান পায়নি। যে ব্যবস্থা থাকলে একটি বইকে দেশের ভেতরে বা বাইরে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তা আমাদের ইংরিজি প্রকাশকের নেই। তাছাড়া এদেশীয় প্রকাশনার মান এত নিচু যে বিদেশি প্রকাশনার পাশে তার অবস্থা খুবই করুণ দেখায়। অথচ বিদেশি প্রকাশকদের বিপণন ব্যবস্থা এত সুশৃঙ্খল যে কলকাতায় বসে তাদের সব বই চমৎকার পেয়ে যাচ্ছি আমরা।’ গুরুদাসবাবু থামলেন।
প্রশ্ন করলাম, ‘ওই বিদেশি প্রকাশকদের মাস চুক্তি করা যায় না?’
‘অনেক রীতিনীতি মানলে হবে। প্রথমে ওরা পাণ্ডুলিপি পড়তে চাইবে। ভালো না লাগলে মন্তব্য করবে। কিছুটা ভালো লাগলে সংশোধন করতে বলবে। সেটা করা হলে উপন্যাসের বাক্য এবং প্রতিটি শব্দ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হবে। এবার অতি সামান্য কিছু কপি ছেপে নিজেদের দেশের পছন্দের বইয়ের দোকানে রাখবে যাতে পাঠকরা সেই বই পড়ে তাঁদের মন্তব্য জানাতে পারেন। যদি ওই মন্তব্যগুলো বইটির অনুকূলে যায় তাহলে তাঁরা বিশ্বব্যাপী প্রকাশনার দায়িত্ব নেবেন। এদেশের কোনও লেখক-প্রকাশক সেই উদ্যোগ নেননি। রবীন্দ্রনাথ নিয়েছিলেন। নিজের লেখা তাঁর সাহেববন্ধুদের পড়িয়েছিলেন। মুখে মুখে প্রশংসা ছড়িয়েছিল। শুধু ভালো লিখলেই হবে না, বিপণনের ব্যাপারটা ঠিকঠাক না জানা থাকলে লেখককে আঞ্চলিক ভাষার লেখক হয়েই থাকতে হবে।’ গুরুদাসবাবু বলেছিলেন।
পঞ্চাশ বছর পরে নিউ ইয়র্কের প্রেস ক্লাবে আমার একটি উপন্যাসের ইংরিজি অনুবাদের উদ্বোধনে গিয়ে মনে পড়েছিল গুরুদাসবাবুর কথা। তদ্দিনে ইংরিজি ভাষা দুরকম হয়ে গিয়েছে যা স্যার সঠিকভাবে জানতেন না।
৭
গুরুদাসবাবুর ক্লাস করতে খুব ভালো লাগত। তাঁর কণ্ঠস্বরে আকৃষ্ট না হয়ে উপায় ছিল না। রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে গিয়ে সেই সময়ের শান্তিনিকেতনের কথা এমনভাবে বলতেন যে আমরা ছবির মতো দেখতে পেতাম। ওর মুখেই চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা শুনেছিলাম। তাঁর বিখ্যাত বই রবিরশ্মি একসময় রবীন্দ্রানুরাগীদের মুগ্ধ করেছিল। স্যারের ক্লাসের পরে লাইব্রেরিতে গিয়ে বইটিকে নেড়েচেড়ে দেখেছিলাম। এই চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন আমাদের অধ্যাপক কনক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা।
কনক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সুপুরুষ আমি খুব কম দেখেছি। ফর্সা, লম্বা, ছিপছিপে শরীর, পরনে সাদা ধুতি এবং পাঞ্জাবি। মানুষটির মুখে সবসময় হাসি লেগেই থাকত। তাঁর পাণ্ডিত্য নিয়ে কোনও প্রশ্ন ছিল না। আমার মাঝে মাঝে মনে হত কনকবাবু, গুরুদাসবাবু অথবা গৌরমোহনবাবুর মতো মানুষ যাঁরা বাংলা বা বিদেশি সাহিত্য সম্পর্কে চমৎকার ওয়াকিবহাল, যাঁরা অনায়াসে সাহিত্যের রসগ্রাহী বিশ্লেষণ করতে পারেন তাঁরা লেখেন না কেন? অনেক পরে জেনেছি, অধ্যাপক বা শিক্ষকরা ভালো সমালোচক হয়ে থাকেন। ছিদ্র সন্ধান করে লেখককে নস্যাৎ করার মধ্যেই তাঁরা তৃপ্তি পেয়ে থাকেন। হাজার হাজার, বলা যেতে পারে আজ পর্যন্ত কয়েক লক্ষ অধ্যাপকের মধ্যে সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে দাগ কেটে যেতে পেরেছেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন। আমার মাস্টারমশাই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এবং শঙ্খ ঘোষের জন্য বাঙালি পাঠক চিরকাল গর্বিত থাকবে। শৈবাল পরে অধ্যাপনা করেছে, কয়েকটি চমৎকার উপন্যাস-গল্প লিখেওছে। কিন্তু সেসময় আমায় বলেছিল, যেসব গানের মাস্টার গান শেখান তাঁদের সবাই বড় গায়ক হিসেবে জনপ্রিয় হন না। কেউ কেউ হন।
অনেকেই লেখেন, কেউ কেউ লেখক। জীবনানন্দ কবিতার ক্ষেত্রে যা বলেছেন তা সাহিত্যের অন্য বিভাগেও প্রযোজ্য। কিন্তু এই যে কেউ কেউ লেখক তাঁদের লেখায় কি থাকলে আলাদা করা হয়? গুরুদাসবাবু বললেন, ‘বুঝহ রসিকজন যে জানো যেমন।’
এই গুরুদাসবাবু একদিন আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওহে তুমি কি কবিতা পড়ো?’
স্বীকার করলাম কবিতার প্রতি আমি আকৃষ্ট নই।
জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ছোটগল্প?’
‘হ্যাঁ।’ মাথা নেড়েছিলাম। তদ্দিনে আমি কয়েকটি ছোটগল্পের সংকলন পড়ে ফেলেছি। তাতে সুবোধ ঘোষের ফসিল, বিমল করের আত্মজা, রমাপদ চৌধুরীর ভিতির কান্নার মাঠ ইত্যাদি অসাধারণ গল্প ছিল।
‘পুনশ্চ পড়েছ? রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ ছোটগল্পের বই। অবশ্য বইটিকে কাব্যগ্রন্থ বলা হয় কারণ কবিতার ফর্মে লেখা। কিন্তু প্রায় প্রতিটি কবিতাই একেকটি চমৎকার ছোটগল্প। পড়ে ফ্যালো।’ গুরুদাসবাবু বলেছিলেন।
‘পুনশ্চ’ আমাদের পড়তে হবে দ্বিতীয় বর্ষে। তবু উদ্বুদ্ধ হয়ে বইটি নিয়ে গেলাম লাইব্রেরি থেকে। দেখলাম পুনশ্চের কবিতাগুলো লেখা হয়েছিল মোটামুটি ১৩৩৮ এবং ১৩৩৯ সালে। বলা ঠিক বেশিরভাগ কবিতাই ১৩৩৯-এ। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ তখন যথেষ্ট পরিণত বয়সে, মোটামুটি বাহাত্তর বছর বয়সে। ওই একবছরে অতগুলো দীর্ঘ কবিতা বোধহয় প্রতিভাবান কবিরাও লেখার কথা ভাবতে পারবেন না, লেখা দূরের কথা।
সেই রাতে পুনশ্চের কবিতাগুলো পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল গুরুদাসবাবুর কথা খুব সত্যি। আমার মনে হচ্ছিল আমি ছোটগল্প পড়ছি। তখনও আমি লেখালেখির স্বপ্ন দেখিনি। কখনও লিখতে চেষ্টা করব এমন ভাবনা ভাবিনি। বাংলায় অনার্স নিয়ে পড়া একটি ছাত্র যেমন ভারত, আমিও তাই ভাবতাম। এম এ পাশ করে গবেষণা শেষ করব। ভালো ফল হলে কোনও কলেজে নয়তো স্কুলে শিক্ষকতা করে জীবন কাটাবো। কিছু সহপাঠী রসিকতা করত, বাংলায় এম এ-দের আর একটা চাকরি চেষ্টা করলেই পাওয়া যায়। চিড়িয়াখানায় বাঘের হালে নিজেকে মুড়ে সারাদিন দর্শকদের মনোরঞ্জন করতে হয়। কোনও ভয় নেই কারণ পাশের খাঁচার বাঘটিও যে বাংলায় এম এ। তা সে রাতে পুনশ্চর কবিতা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল এসবই আমার জন্য লেখা। স্কুলে যে রবীন্দ্রনাথকে পড়েছি, নীপার জন্য যে ‘শেষের কবিতা’ পড়েছি তা থেকে এক মাইল আলাদা ওই কবিতাগুলো যা ছোটগল্পের মতো চমকপ্রদ। এই নির্বোধ তখন ভেবে ফেলল রবীন্দ্রনাথ যত বড় দার্শনিক হোন তিনি আমার মতো সাধারণ মানুষের জন্যও লিখতে পারতেন। বস্তুত, রবীন্দ্রনাথকে পাওয়ার তীব্র আগ্রহ মনে জন্মাল পুনশ্চ পড়ার পর থেকে।
পরের দিন ছিল কলেজ ছুটি। এমনই আচ্ছন্ন ছিলাম যে দুপুরবেলায় কাগজ কলম নিয়ে বসে ভাবলাম, রবীন্দ্রনাথ যা কবিতায় লিখেছেন তা যদি গদ্যে রূপান্তরিত করি তাহলে সেটাকে ঠিকঠাক ছোটগল্প বলা যাবে কি? কবিতায় ছোটগল্প নয়, গদ্যে ছোটগল্প। দুঃসাহস ভেতর থেকে এতটাই বেড়ে উঠেছিল যে সারা দুপুর ধরে অনেক কাটাকুটি করে একটি কবিতাকে গদ্যে ছোটগল্প বানিয়ে ফেললাম।
কলেজ খুললে খুব ভয়ে ভয়ে গুরুদাসবাবুকে ব্যাপারটা জানালাম। তিনি আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘তুমি একটা সাদা ঘোড়ার গায়ে কালো লাইন এঁকে দিলে লোকে সেটাকে জেব্রা বলবে? গদ্যে লেখার হলে রবীন্দ্রনাথ নিজেই তা লিখতেন। যিনি গল্পগুচ্ছের অনবদ্য গল্পগুলো লিখতে পেরেছেন তাঁর মনে হয়েছে পুনশ্চর লেখাগুলো কবিতাতেই লেখা উচিত। উনি শিব গড়ে গিয়েছেন, তুমি তাকে বাঁদর গড়তে চাইছ? তাছাড়া এটা আইনত অপরাধ, কপিরাইট আইনে তোমার শাস্তি হবেই।’ আর কথা বাড়াইনি। তখন রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী প্রায় এসে গিয়েছে। ওঁর মৃত্য হয়েছে মাত্র কুড়ি বছর আগে। মৃত্যুর তিন বছর পর জন্মানো সতেরো বছরের একটি তরুণের যাবতীয় উৎসাহে জল ঢেলে দিয়েছিলেন গুরুদাসবাবু। বুঝেছিলাম, ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর গদ্যে রূপান্তরকরণে কোনও অন্যায় নেই। কারণ তাঁর সৃষ্টিকর্মের দাবিদার (কপিরাইট আইনের সময় পার হয়ে যাওয়ায়) নেই। কিন্তু একটা ফর্ম থেকে আরেকটা ফর্মে রবীন্দ্ররচনাকে নিয়ে যাওয়া কেন অন্যায় হবে? এই যে বিভিন্ন রবীন্দ্র-উপন্যাস ছোটগল্প এমনকি কবিতা নিয়ে চলচ্চিত্র বা নাটক হচ্ছে যা রবীন্দ্রনাথ লিখে যাননি, তাদের তো কেউ কপিরাইট অ্যাক্ট ভাঙার জন্য কাঠগড়ায় তুলছে না বা শিবকে বাঁদর করা হচ্ছে বলছে না।
অতএব সেই গদ্যরচনাকে ছিঁড়ে ফেলতে খারাপ লেগেছিল বলে স্যুটকেসে তুলে রেখেছিলাম। এই একটা ব্যাপারের কথা ভাবলে আজ মজা লাগে। শৈশবে বা কিশোরকালে যা আমার কাছে মূল্যবান মনে হত তা সযত্নে রেখে দিতাম। সেটা লাল মার্বেল হোক অথবা মায়ের হাতের কাজ করা রুমালই হোক। এসবের কোনও মূল্য এখন নেই কিন্তু দেখলেই কীরকম আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। এত বছর পরে ওই লেখাটাকে খুঁজে পেলাম। লাইন টানা ছোট খাতায় লিখেছিলাম রবীন্দ্রনাথের কবিতার গল্পরূপ। কীরকম মমতা এল ঝাঁপিয়ে। আজ পড়তে গিয়ে সেই সতেরো বছরের একটি অলেখক তরুণকে আবিষ্কার করেও কিন্তু মমতাকে সরিয়ে দিতে পারলাম না। আজ যখন কপিরাইট আইনের সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছে তখন সেই বয়সের প্রয়াসটিকে তুলে ধরছি, প্রশ্রয় পেলে ভালো লাগবে। লাইনটানা খাতার পাতার ওপরে লেখা, ‘ক্যামেলিয়া’। তার নীচে সই নকল করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার নীচে মুল কবিতার রচনাকাল, ২৭শে শ্রাবণ, ১৩৩৯। তার পাশে একুশে নভেম্বর, ১৯৬০।
সেদিন ট্রামে উঠেছিলাম কলেজ স্ট্রিট যাব বলে। ফাঁকা ট্রাম। জানলার পাশের আসনে বসতেই নজরে পড়ল সামনের সিটে বসা একজনের দিকে। পাশে বসে আছে একটি বালক। পিছন থেকে প্রথমে তার ঘাড়ের ওপর সযেত্নে রাখা খোঁপা দেখতে পেলাম। তারপর সে একটু মাথা ঘোরাতেই মুখের একপাশের নিটোল রেখা চোখে পড়ল। সে কোলে রাখা একটি বই তুলে নিল। পিছন থেকে দেখলে মনে হচ্ছিল, আর একটু দেখি। তাই কলেজ স্ট্রিটে আমার নামা হল না। একটু অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিলাম, দেখি ওরা নেমে যাচ্ছে হিল সিনেমার স্টপে। আমাকে নিয়ে ট্রাম চলল ধর্মতলার দিকে। কেন জানি না, মন অন্যরকম হয়ে গেল।
অদ্ভুত ব্যাপার, সবাই বলে আমি সময় হিসেব করে চলতে পারি না। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার, ওরা যে ট্রামে আসে সেই ট্রামটিতে ঠিক উঠে পড়ি প্রায়ই। কিন্তু এগিয়ে গিয়ে কথা বলার ইচ্ছে প্রবল হওয়া সত্ত্বেও সাহস হয় না। আমরা নিছক সহযাত্রী। তার উজ্জ্বল চোখ, অনায়াসে কপালে পড়ে থাকা এক চিলতে চুল সুন্দর আঙুলে সরিয়ে নেওয়া দেখতে দেখতে ভাবতাম একটা ছুতো দরকার। যেটাকে আঁকড়ে ধরে আমি ওর কাছে পৌঁছে যেতে পারি। কত কী তো হতে পারে। কোনও গুন্ডা যদি অপমান করে ওকে তাহলে আমি ঝাঁপিয়ে পড়ব সম্মান বাঁচানোর জন্য। যে-কোনও সমস্যা ওকে যদি বিব্রত করে তাহলে আমি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেব। কিন্তু আমার কপালটা যেন একটা ঘোলা জলের ডোবা, সেখানে নিরীহ ব্যাঙ একঘেয়ে ডাক ডেকে যায়। কুমির বা হাঙর দূরের কথা, রাজহাঁসও সাঁতার কাটে না।
সেদিন ট্রামটা এল ঠাসাঠাসি ভিড় নিয়ে। তবু উঠলাম। আর উঠলাম বলেই তাকে দেখতে পেলাম। কিন্তু আজ ওর পাশে ছোট ভাই নেই। তার বদলে বসে আছে একজন ট্যাঁশ বাঙালি। গলায় টাই আর মাথায় টুপি পরে বসে আছে সঙের মতো। সহ্য করতে পারছিলাম না লোকটিকে। মনে হচ্ছিল টুপিটাকে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে ওকে ঘাড় ধরে ট্রাম থেকে নমিয়ে দিই। কিন্তু ও কিছু অন্যায় না করলে এসব করলে লোকে আমাকেই অপরাধী ভাববে। এই সময় লোকটা একটা মোটা চুরুট ধরাল আয়েশ করে। সঙ্গে সঙ্গে ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে হুঙ্কার দিলাম, ‘এ্যাই, ফ্যালো চুরুট’। যেহেতু এখনও সিগারেট চুরুট ট্রামে খাওয়া আইনবিরুদ্ধ হয়নি তাই লোকটা আমাকে পাত্তা না দিয়ে ধোঁয়া ওড়াতে লাগল রিং বানিয়ে। অতএব আমি একটানে মুখ থেকে চুরুট কেড়ে নিয়ে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। লোকটা কটমটে চোখে আমাকে দেখল। কিন্তু দেখার পর মুখ নিচু করে দ্রুত নেমে গেল ট্রাম থেকে। সে মুখ নামাল তার খাতার দিকে। খাতার ওপর লেখা তার নাম, কমলা। তার হাত কাঁপছিল এবং একবারও আমার দিকে তাকাল না। অন্যান্য যাত্রীরা বাহবা দিলেন, ‘বেশ করেছেন ভাই।’ কমলা উঠে দাঁড়াল। গম্ভীর মুখে নেমে গেল ট্রাম থেকে।
পরের দিন, তার পরেরও দিন এবং অনেকদিন ধরে কমলাকে দেখতে পেলাম না ট্রামে। সময় বদলেও দেখতে পেলাম না তাকে।
হাওয়া বদলাতে গেলাম দার্জিলিংয়ে। সেখানে দেখা হল মোহন- লালের সঙ্গে। তার সঙ্গে ছিল খুব রোগা যে মেয়ে তার নাম তনুকা। মোহনলালের বোন। তার পড়াশুনায় খুব ঝোঁক, খাবারে নয়। যেদিন চলে আসব সেদিন তনুকা বলল, ‘একটা জিনিস দেব আপনাকে। নেবেন। যখনই দেখবেন আমাদের কথা মনে পড়বে।’
সম্মতি জানাতেই সে বলল, ‘খুব দামি গাছ, এদেশের মাটিতে যত্নে বাঁচে।’
‘কী নাম গাছের?’
‘সে বলল, ক্যামেলিয়া।’
শুনে চমক লাগল। মনের অন্ধকার এক মুহূর্তে সরে গিয়ে কমলার মুখ চলে এল সামনে। বললাম, ‘সহজে বুঝি এর মন মেলে না?’
তনুকা লজ্জা পেল। খুশিও হল।
টবে বসিয়ে সেই গাছ নিয়ে এলাম কলকাতায়। যত্নে রাখলাম। পুজোর ছুটিতে গেলাম সাঁওতাল পরগনায়। ছোট্ট জায়গা। আমার সঙ্গে আছে ক্যামেলিয়া। সেখানেই দেখা পেলাম কমলার। শিশুগাছের নীচে বসে বই পড়ছে। সে যে আমাকে চিনেছে তা বুঝলাম আমাকে লক্ষ করছে না বলে।
একদিন দেখলাম ওরা চড়ুইভাতি করছে। কমলার পাশে একটি যুবক, শার্ট পরা, গায়ে রেশমের বিলিতি জামা। চুরুট খাচ্ছে পা ছড়িয়ে আর কমলা অন্যমনস্ক হয়ে টুকরো টুকরো করছে শ্বেত জবার পাপড়ি। পাশে পড়ে আছে একটি বিলিতি মাসিক পত্র।
মুহূর্তে অনুভব করলাম এখানে আমি বেমানান। কোনও প্রয়োজন নেই আমাকে। চলে যাব। যাওয়ার আগে অবাক হয়ে দেখি আমার টবের গাছে ফুল ফুটেছে! যে সাঁওতাল মেয়েটি আমার কাজকর্ম করে দেয় তাকে ডাকলাম। ভাবলাম ওর হাত দিয়ে শালপাতায় মুড়ে ফুলটাকে পাঠাব কমলার কাছে। মেয়েটি এসে হাসল, ‘ডেকেছিস কেনে?’
অবাক হয়ে দেখলাম আমার ক্যামেলিয়া ফুল মেয়েটির কানের পাশে চুলের ওপর গোঁজা, কালো গাল যেন আলোয় আলোকিত।
হেসে বললাম, ‘এমনি।’ তারপর যোগ করলাম, ‘এই জন্যেই।’
সেদিনই ফিরে এলাম কলকাতায়।
৮
স্কটিশ চার্চ কলেজের তিন বছর যা পেয়েছি তাই পড়েছি। পড়া না বলে গিলেছি বলাই ভালো। বঙ্কিমচন্দ্রের রোমান্টিক জগতের পাশাপাশি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনার ভয়ঙ্কর বাস্তবের রস গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি। কিন্তু গিললে যে তা হজম হবেই এই ধারণা পরে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। মোরাভিয়ার ‘দ্য উইমেন অব রোম’ পড়ে যতটা চমকিত হয়েছি ঠি ততটাই মুগ্ধ হয়েছি সমরেশ বসুর ‘শ্রীমতী কাফে’ পড়ে। কী করে এটা সম্ভব হয়েছিল জানি না। পরে বুঝেছি, সেটা ছিল আমার জীরনে আয়লার মতো পড়ার নেশা। ফলে যখন জল চলে গেল, সবকিছু ভাঙচুর। বেশিরভাগ নাম স্মৃতিতে থাকলেও বিষয় মনে নেই। গিলেছি কিন্তু হজম করতে পারিনি।
কলেজের তৃতীয় বর্ষে কফি হাউসের বন্ধুদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে একটা উপকার হয়েছিল। বিদেশি সাহিত্য সম্পর্কে একট। হালকা আন্দাজ তৈরি করতে পেরেছিলাম। ছোটগল্পের যাদুকর মোপাসাঁ যত ভালোই লিখে থাকুন না কেন, গল্পের শেষে তাঁর ওই চমক তৈরি করে পাঠকদের অবাক করার পদ্ধতিটাকে পছন্দ করেননি বিজ্ঞজনেরা। তাঁদের মনে হয়েছে সাহিত্যের নির্মল আনন্দের বদলে একটু স্থূল উপায়ে পাঠকের চেতনায় আঘাত দেওয়া হয়েছে।
মোপাসাঁর গল্পগুলো পড়ার সময় আমি সুবোধ ঘোষের গল্প পড়েছি। সেই ‘অযান্ত্রিক’, ‘ফসিল’, ‘সুন্দরম’ পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল মোপাসাঁর স্টাইলের সঙ্গে কোনও পার্থক্য নেই। সুন্দরম গল্পে মৃতা মহিলার লাশ পোস্টমর্টেম করছেন বৃদ্ধ ডাক্তার। এই অবধি গল্পটি ধীরে ধীরে যেভাবে পাঠকদের সম্মোহিত করছিল তা এক ঝটকায় বদলে গেল পরবর্তী সংলাপে। বন্ধ দরজার বাইরে বসে গল্প করছিল শবগৃহের দুজন কর্মচারী। একজন অন্যজনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বৃদ্ধ ডাক্তার আজ দেরি করছেন কেন?’ দ্বিতীয়জন উত্তর দিয়েছিল, ‘বুড়া পাতির মুখ দেখছে।’ ঝট করে পুরো গল্পটির চেহারা বদলে গেল। একটা ভয়ঙ্কর রসে পাঠক হাবুডুবু খেতে লাগল।
এই যে শেষ লাইনে গল্পের চেহারা বদলে যাওয়া, এদেশে চালু হয়েছিল সেই উনিশশো তেইশ থেকে যখন ‘কল্লোল’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র থেকে তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সবাই এই পথ অনুসরণ করেছিলেন। এমনকি ওঁদের পরবর্তী প্রজন্মের লেখক সমরেশ বসু, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরীও এই ধরনের ছোটগল্প প্রচুর লিখে গিয়েছেন। এর একটা সুবিধে ছিল। ছোটগল্প পড়তে আরম্ভ করে পাঠক নিজে যে জগৎ তৈরি করে নিচ্ছিলেন তা শেষ কয়েকটি লাইনে ভেঙে চুরমার করে অন্য জগতে তাঁকে পৌঁছে দেওয়ার কাজটা যদি বাস্তবসম্মত এবং রসগ্রাহী ও সাবলীলভাবে করা যায় তাহলে সেই গল্প ও গল্পকারের নাম পাঠক দীর্ঘকাল মনে রাখতে বাধ্য হবেন। জনপ্রিয়তার শিখরে ওঠা সম্ভব ছিল এইরকম লুকোচুরি খেলার মাধ্যমে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুঁইমাচা’ গল্পটির কথা। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই গল্পটির গোড়া থেকে লেখক পাঠকের সঙ্গে কোনওরকম লুকোচুরি খেলেননি। প্রত্যাশামতো পরিণতির দিকে গল্পটি এগিয়েছে। গল্পের শেষে কোনও মোচড় নয়, পাঠকের ভাবনাকে একটুও আছাড় না মেরে গল্পটিকে অন্যমাত্রা দিয়ে উত্তীর্ণ করেছিলেন লেখক
পঞ্চাশের মাঝামাঝি থেকে বিদেশের সাহিত্যের নবীন ঢেউ এদেশীয় সাহিত্যে চলে এলেও তাকে পুরোপুরি গ্রহণ করা হয়েছে বলে আমি মনে করি না। স্ট্রিম অব কানসাসনেশ আমাদের সাহিত্যকে কতটা প্রভাবিত করেছে সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মনে পড়ছে না, এই কলমে সেই গল্পটির কথা বলেছি কিনা। বললেও আরেকবার বলার বাসনা সামলাতে পারছি না। পাঠক মার্জনা করবেন।
গল্পটি ছিল এইরকম। বাবা রেলে চাকরি করতেন। অবসর নেওয়ার পর প্রতি বিকেলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটতে বের হন। সেই গোধূলিতে একটা ট্রেন যখন পাশের লাইনে ছুটে আসত তখন বাবা দাঁড়িয়ে যেতেন। দেখতাম ট্রেনের ড্রাইভার বাবাকে দেখে হাসিমুখে হাত নাড়ছেন। তৎক্ষণাৎ বাবার মুখে হাসি ফুটত। তিনিও তখন হাত নাড়া শুরু করতেন। পুরো ট্রেনটা বেরিয়ে যাওয়ার সময় গার্ডের কামরা আসত। দেখতাম গার্ডসাহেব বাবাকে দেখে হাত নাড়ছেন। ট্রেন চলে যাওয়ার পর বাবাকে অত্যন্ত সুখী মানুষ বলে মনে হত। যেন তিনি যে সাম্রাজ্য ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন বয়সের কারণে সেখানে এখনও ঠিকঠাক রয়েছেন। হাঁটতে হাঁটতে বাবা আমাকে কত গল্প শোনাতেন। সবই তাঁর রেলজীবনের অভিজ্ঞতার গল্প। তারপর সেই দিনটা এল। তখন রোদ মরে যাচ্ছে। তিরতিরে গোধূলির আলোয় আমি আর বাবা রেললাইনের পাশ ধরে হাঁটছি। দূরে ট্রেনের ইঞ্জিন দেখে বাবা দাঁড়িয়ে গেলেন। হাসিমুখে হাত তুললেন ওপরে। কিন্তু দ্রুতগামী ইঞ্জিনটা যখন আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল তখন ড্রাইভার হাত নাড়া দূরের কথা, ভুলেও আমাদের দিকে তাকাল না। বাবা বিড়বিড় করলেন, ‘বোধহয় নতুন ড্রাইভার।’ তারপর গোটা ট্রেনের শেষে গার্ডসাহেবের কামরা চোখের সামনে চলে এলে বাবা প্রবলভাবে হাত নাড়তে লাগলেন। কিন্তু গার্ডসাহেব উদাসীন মুখে চরাচর দেখতে লাগলেন। ট্রেন চলে গেলে বাবা দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। দেখলাম, তাঁর চোয়াল ঝুলে পড়েছে। চটজলদি ভেঙে পড়া মানুষটির হাত কাঁপছিল। তাঁর হাত ধরে বললাম, ‘বাড়ি চলো।’
কোনও চমক নেই, কোনও ইচ্ছাকৃত মোচড় নেই। একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী যতই নিজেকে তাঁর পূর্ব পেশার অঙ্গ ভাবুন না কেন, নবীন প্রজন্মের কাছে তিনি ধীরে ধীরে এমন প্রাক্তন হয়ে যান যে তারা আর পরিচিত থাকেন না। এই তথ্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলেও নিষ্ঠুর সত্য। কিন্তু এই সত্য সবাই মেনে নিতে সহজে পারেন না। এই যে জীবনের পরম সত্য আবিষ্কার করার প্রয়াস তা যে-কোনও লেখকের পক্ষে কিন্তু সহজসাধ্য ছিল না। চেষ্টাটা যে কষ্টসাধ্য তা বোঝা যেত অনেকের ক্ষেত্রে। অথবা মনে হতো, লেখক পরিণতিটা চাপিয়ে দিয়েছেন।
অর্থাৎ ছোটগল্পের চেহারা, আঙ্গিক এবং গঠন খুব দ্রুত বদলাতে লাগল। কিন্তু এই বদলানোর সার্থক প্রতিনিধিত্ব খুব স্বল্প গল্পেই পাওয়া গিয়েছে। বরং মোপাসাঁ অথবা ও হেনরির ঘরানার গল্প লিখতেই শক্তিমান লেখকরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। একটু এগিয়ে গিয়ে বলছি, পরবর্তীকালে একটি লেখকগোষ্ঠী শাস্ত্র-বিরোধী গল্প লেখার চেষ্টা করেছেন। ওঁরা চেয়েছিলেন নতুন সাহিত্য আন্দোলনের চেহারা দিতে। কয়েকবছর বেশ হৈচৈ করার পর তাঁরা মিইয়ে গেলেন যখন পাঠকদের অধিকাংশই ওই নতুন রীতি গ্রহণ করল না। এ প্রসঙ্গে সন্তোষকুমার ঘোষের কথা মনে পড়ছে। যে-কোনও নতুন কর্মে উৎসাহ যোগাতেন ওই মানুষটি। শাস্ত্র-বিরোধী গল্পকাররাও প্রথমদিকে তাঁর কাছে উৎসাহ পেয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত সন্তোষকুমার বলেছিলেন, মুশকিল হল কোনও কিছুর বিরোধিতা করতে হলে তাকে ভালোভাবে জেনে-বুঝে তবেই বিরোধিতা করতে হয়। ওরা শাস্ত্রটাকে ভালো করে আগে ভাবুক তারপর বিরোধিতা করুক। শাস্ত্রসম্মত একটি ভালো গল্প লেখার বিরোধিতার কথা ভাবুক।’
ভাবতে অবাক লাগে, কলেজজীবনে, গল্পগুচ্ছের গল্পগুলোর পাশাপাশি আমি ‘পুনশ্চ’র কবিতাগুলোতেই গল্প আবিষ্কার করেছিলাম। করে বুঝেছিলাম যা কবিতায় এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব তা ছোটগল্পের গদ্যে একেবারেই নয়। গত সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের ‘ক্যামেলিয়া’ কবিতার গদ্যরূপটি আবার পড়লাম। তারপর আবার কবিতাটিও। রবীন্দ্রনাথ যখন কবিতায় গল্প লিখেছিলেন তখন রসগ্রহণ করার সময় কি আমি যুক্তি খুঁজেছিলাম? বিন্দুমাত্র নয়। পাঠক, মনে করে দেখুন। ট্রামে যখন কবি এই মেয়েটিকে দেখলেন তখন কী স্বচ্ছন্দে লিখলেন, ‘সে চলেছিল ট্রামে তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়। যে মেয়েটিকে আমি চিনি না, আগে দেখিনি, উঁকি মেরে দেখে নিয়েছি তার খাতার ওপর কমলা শব্দটি লেখা এবং ধরে নিয়েছি ওটাই তার নাম, কিন্তু পাশে যে বসে আছে সে তার ভাই তা জানব কী করে? ভাইকে নিয়ে সে কলেজের রাস্তায় যাচ্ছে এই অনুমান করার সময় একবারও ভাবব না, ভাইয়ের কি স্কুল নেই?
সেই যে মেয়েটি, যে ট্রাম থেকে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে চলে গিয়েছিল, তাকে আর কখনওই কবি দেখতে পেলেন না নিত্য যাতায়াতের পথে। কিন্তু লিখলেন, ‘খবর পেয়েছি গরমের ছুটিতে ওরা যায় দার্জিলিংয়ে।’ খবরটা পেলেন কার কাছে? মেয়েটির বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করতে হন্যে হয়ে ঘুরেছিলেন? ট্রামে দেখা একটি মেয়ে যে উধাও হয়ে গেল তার খবর পাওয়ার পিছনে তৃতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব প্রয়োজন। তা কবি গেলেন দার্জিলিংয়ে। লিখে দিলেন, ‘শোনা গেল আসবে না এবার।’
কার কাছে শুনলেন? দার্জিলিংয়ে কবির পরিচিত কেউ নিশ্চয়ই বলেছিল আপনি যাকে খুঁজছেন, সেই কমলা এবার দার্জিলিংয়ে আসবে না। সে কি মোহনলাল? যার বোন তনুকা। কবিতায় সেটা একবারও বলা নেই। আর কী আশ্চর্য, তনুকা ভক্ত হিসেবে কবিকে উপহার দিল যে গাছের চারা তার নাম ক্যামেলিয়া। কমলার সঙ্গে মিলে গেল ফুলগাছের নাম।
আর এই যে বিস্তর ফাঁক, জোর করে মেলাবার চেষ্টা, সাঁওতাল মেয়েটির কানের ওপর ক্যামেলিয়ার ফোটা ফুল গুঁজে দিলে আলো করবে তার গাল, এইটে মাথায় রেখে লিখে যাওয়া, গদ্যে তা সম্ভব নয়। অথচ কবিতা পড়ার সময় একটুও হোঁচট খেতে হয় না, বরং বিষণ্ন মন একসময় ভোরের আলোয় আলোকিত হয়ে যায়।
ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই জানতেন। তাঁর নাটক কবিতায় এই ব্যাপারে যা নিবেদন করেছেন তা হল, ‘কবিতা হল সমুদ্র, সাহিত্যের আদিযুগের সৃষ্টি। …গদ্য এল অনেক পরে। বাঁধা ছন্দের বাইরে জমানো আসর। সূশ্রী-কুশ্রী ভালোমন্দ তার আঙিনায় এল ঠেলাঠেলি করে। ছেঁড়া কাঁথা আর শাল-দোশালা এল জড়িয়ে মিশিয়ে। গর্জনে ও গানে, তাণ্ডবে ও তরল তালে আকাশে উঠে গড়ল গদ্যবাণীর মহাদেশ। …এত অধিকার যে করবে তার চাই রাজপ্রতাপ; পতন বাঁচিয়ে শিখতে হবে এর নানারকম গতি-অবগতি। বাইরে থেকে এ ভাসিয়ে দেয় না স্রোতের বেগে, অন্তরে জাগাতে হয় ছন্দ, গুরু-লঘু নানা ভঙ্গিতে।
পরিষ্কার হয়ে গেল। ছেঁড়া ছাতা আর রাজছত্র একত্রিত হয়ে যে সবক্ষেত্রে বৈকুণ্ঠের দিকে যাবে তার বাধ্যবাধকতা নেই। ছোটগল্পকার ঠিক করবেন তার লক্ষ্য কী হবে। বৈকুণ্ঠের বদলে নরকও আসতে পারে স্বাভাবিক হয়ে। তৃতীয় বর্ষে অচিন্ত্যকুমারের লেখা ‘কল্লোল যুগ’ বইটি পড়লাম। তার আগে গৌরমোহনবাবুর ক্লাসে ভাসা ভাসা শুনেছিলাম।
বঙ্কিমচন্দ্রের দাদার একটি বড়গল্পকে প্রথম বাংলা ছোটগল্প বলা হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস এবং রসরচনায় যতটা ধ্যান দিয়েছেন ছোটগল্পে ততটা নয়। ছোটগল্প তার চেহারা পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের হাতে। ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’ থিওরিতে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বস্ত ছিলেন। তাঁর সমসাময়িক লেখকদের ছোটগল্প অত্যন্ত নিচুমানের বলে আলোচনায় আসে না।
গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের পরে ‘কল্লোল’-এর জন্ম! জন্মানোর অন্যতম উদ্দেশ্য নতুন কথা বলা। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ঘোরাফেরা করেছে মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তের সমস্যাগুলোর মধ্যে। আর শিলাইদহতে দেখা গ্রামের মানুষের জীবনযাপন যা তাঁর ছোটগল্পকে সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু শহরের বিত্তহীন অভাবী মানুষ, বস্তির মানুষ, মানুষের দৈনিক সমস্যা নিয়ে তিনি কিছু লেখেননি। ‘কল্লোল’-এর লেখকরা গোকুল নাগের নেতৃত্বে সেই তথাকথিত শুদ্ধতার বেড়া ভেঙে নীচের তলার মানুষদের ওপরে তোলার চেষ্টা করলেন। তাঁদের সব গল্পই যে উতরে গেল তা নয়, কিন্তু দাগ রেখে গেল। অচিন্ত্যকুমারের ‘দুইবার রাজা’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘সংসার সীমান্তে’, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘কয়লাকুঠি’ বের হওয়ামাত্র ‘কল্লোল’ পত্রিকা রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। রবীন্দ্রনাথ এই তরুণতর লেখকগোষ্ঠীর আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আপ্লুত হয়ে স্থির করলেন তাঁকেও সময়ের সঙ্গে পা মেলাতে হবে। লিখলেন ‘তিনসঙ্গী’-র গল্পগুলো। কিন্তু যাঁর হাতে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘অতিথি’-র মতো কালজয়ী গল্প বেরিয়েছে, তিনি ‘রবিবার’, ‘শেষকথা’ লেখার পর বুঝলেন ব্যাপারটা শৌখিন মজদুরি করা হয়ে গিয়েছে। স্বীকারও করেছেন একথা।
কলেজের প্রথম তিন বছরে ক্রমাগত গিলে গিয়েছি বাংলা সাহিত্যের অনেকখানি। এখন বুঝতে পারছি বেশ বদহজম হয়ে গিয়েছে ওইভাবে পড়ে যাওয়া। তাই আবার শুরু করেছি রবীন্দ্রনাথ। ‘গীতবিতান’ ছুঁয়ে ভাবি, গভীরে যেতে হবে, আরও গভীরে। ওপরের ঢেউ সাময়িক, যা কিছু স্থির তা গভীরেই থাকে।
৯
রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছিলেন বলেই শিক্ষিত বাঙালি তাঁর মৃত্যুর সত্তর-একাত্তর বছর পরেও স্বস্তিতে বাঁচতে পারছে। রবীন্দ্রনাথ জানতেন তাঁর কবিতার শতবর্ষ পূর্তিতেও বাঙালি পাঠক তাঁকে ত্যাগ করবে না। সেই পাঠক কে, কী তার পরিচয় তা জানার কৌতূহল ছিল রবীন্দ্রনাথের। ক’জন কবি এমন আত্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে পারেন? কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত জানতেন না যে তাঁর গান বাঙালির হৃদয়ে ঠিকঠাক বসতে অন্তত বাহাত্তর বছরও কম সময়, বসার পর তা মুক্তিমন্ত্র হয়ে বেঁচে থাকবে যতদিন বাঙালি বাংলায় কথা বলবে।
গীতবিতানের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবি এইসব গান তাঁর মনে কখন এল? প্রেম পর্যায়ের নয় নম্বর গানে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘কাল রাতের বেলা গান এল মোর মনে।’ বেশ কথা। সেসময় কবি কী করছিলেন জানি না কিন্তু, ‘তখন তুমি ছিলে না মোর সনে’ লিখে একাকীত্ব বুঝিয়েছেন। তাহলে কি রাতের বেলা একা থাকলে তাঁর মনে মাঝে মাঝে গান আসত? কেউ, বিশেষ কেউ কাছে থাকলে তাকে যে কথাটা বলা যায় না, বলতে বাধে, বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না, সেই কথাটা একা হলেই জ্বলে ওঠে সুরের হোমানলে? লিখেছেন, যখন তুমি আমার সঙ্গে থাকো তখন প্রাণপণে চাইলেও বলতে চাওয়া কথায় সুর লাগে না।
অতএব ধরেই নিতে পারি তিনি এইসব গান, যা তাঁর প্রাণের কথা, যা আমাদেরও কথা, লিখে গিয়েছেন যখন তাঁর পাশে কেউ ছিল না। মনে পড়ছে অমিয়া ঠাকুরের মুখে শোনা একটা ঘটনা। অমিয়া ঠাকুর হয়তো অতি-প্রচারিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ছিলেন না, সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবিতে তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। পরে বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতবিশেষজ্ঞ সুভাষ চৌধুরীর সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। বেকবাগানের কাছে থাকতেন। বার্ধক্যে পৌঁছেও তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাউদ্রেকররা সৌন্দর্যের অধিকারী। তখন আমি যুবক। তাঁর কাছে ঠাকুরবাড়ির গল্প শুনতে যেতাম। অমিয়া ঠাকুরের গলায় লিখি, ‘আমি তখন ঠাকুরবাড়ির নতুন বউ। সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকি, যদি কোনও ভুল করে ফেলি। তা এক ছুটির দুপুরে, খুব গরম পড়েছিল সেদিন, চারধার চুপচাপ, যে যার ঘরে ঘুমোচ্ছে, আমার কৌতূহল হল জানার, বাবামশায় কী করছেন। এখন ভাবলেই অবাক হই। আমি তখন পুঁচকে মেয়ে, কী সাহসে উকি মেরেছিলাম তাঁর ঘরে। দেখলাম তিনি শূন্য ঘরে একা বসে আছেন চেয়ারে। চোখ বন্ধ, হাতে তাল দিচ্ছেন সুর ভাঁজতে ভাঁজতে। আমি সরে আসার আগেই তিনি চোখ খুললেন, জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে ওখানে?’
আমি ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে দরজায় দাঁড়াতেই বললেন, ‘ও, তুমি! ভালো হয়েছে। এদিকে এসো।’
কী শাস্তি দেবেন এই আশঙ্কা নিয়ে কাছে যেতেই চেয়ার ঘুরিয়ে কাগজ খুঁজলেন। না পেয়ে একটা পোস্টকার্ডের পিছন দিকটায়, মানে যেদিকে ঠিকানা লেখা থাকে তার পাশের ফাঁকা জায়গাটায় দ্রুত কিছু লাইন লিখতে শুরু করলেন। তারপর লেখা হয়ে গেলে হাসলেন, ‘ব্যাস, হয়ে গেল।’ বলে ওই পোস্টকার্ডটা আমায় দিয়ে বললেন, ‘এটা তোমার কাছে রেখে দাও। কিন্তু গানটা পরিষ্কার করে লিখে আমাকে দিয়ে যেও।’
আমি ঘাড় নেড়ে পোস্টকার্ড উল্টে দেখতে পেলাম, ওটা ওঁকে লেখা জগদীশচন্দ্র বসুর চিঠি। উনি আমার মনের কথা বুঝে মাথা নেড়েছিলেন, ‘ঠিক আছে। নিয়ে যাও।’
.
এই ঘটনা প্রমাণ করে তাঁর মনে একলা হলেই গান আসত। হাতের কাছে কাগজ না থাকায় সেইসব গানের কিছুটা নিশ্চয়ই আমাদের অজানা থেকে গিয়েছে। গানের কথা এবং সুর মনে এলে হারিয়ে যেতে বেশি সময় নেয় না। তবু রবীন্দ্রনাথ কতগুলো গান লিখেছিলেন? গানগুলোর পরিচয় দেওয়া হয়েছে এইভাবে, পূজা, স্বদেশ, প্রেম, প্রকৃতি, বিচিত্র, আনুষ্ঠানিক। এছাড়া আছে ছয়টি গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যের গান। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভানুসিংহের পদাবলী, নাট্যগীতি ইত্যাদি। পুজা পর্বের গানের সংখ্যা ৬১৭, স্বদেশ পর্বের গান ৪৬, প্রেম ৩৯৫, প্রকৃতি ২৮৩, বিচিত্র ১৪০, আনুষ্ঠানিক ২১=১,৫০২। অর্থাৎ গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য ইত্যাদি ছাড়া এই পনেরোশো দুটি গানই রবীন্দ্রনাথের গানের প্রথম সারিতে জায়গা পেয়েছে। নৃত্যনাট্য এবং গীতিনাট্যের প্রচুর গান যা ওই পনেরোশো দুই-এর মধ্যে নেই তা অবশ্যই প্রেম পর্যায়ে জায়গা নিতে পারে এবং আমরা নাটকের কথা মনে না রেখে গানগুলি থেকে চমৎকার তৃপ্তি পেয়ে থাকি। এইসঙ্গে প্রেম ও প্রকৃতি পর্যায়ের ১০১টি গান, আনুষ্ঠানিক সঙ্গীতের ১৭টি গান, পূজা ও প্রার্থনার ৮৩টি গান, জাতীয় সঙ্গীত পর্যায়ের ১৬টি গান, নাট্যগীতির ১৩২টি গান, ভানুসিংহের পদাবলীর ২০টি গান যোগ করলে সংখ্যাটা হয় ১,৮৭১। এর সঙ্গে শাপমোচন, শ্যামা ইত্যাদির গান ধরলে সংখ্যাটা সম্ভবত দু’হাজারের কাছাকাছি হয়ে যাবে। এই এত গান রবীন্দ্রনাথ কি একলা থাকার সময়ে লিখেছিলেন? লিখেই দীনু ঠাকুরের কাছে পাঠাতেন সুর-স্বরলিপির জন্য? যখন জাহাজে চেপে বিদেশে যেতেন তখন দীনু ঠাকুর কোথায়? আমি জানি না, রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখার সুর নিজে কতগুলোর করেছেন, কতগুলো দীনু ঠাকুর করেছেন? কিন্তু প্রথমদিকে সমসাময়িক অনেকের লেখা গান রবীন্দ্রনাথের গান বলে চালু ছিল। এই দলে ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দিরা দেবী, অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী ইত্যাদি। এর বেশির ভাগই ব্রহ্মসঙ্গীত হলেও রবীন্দ্রনাথের গানের ধারার সঙ্গে শব্দ, বাক্য এবং অর্থের ব্যবহার প্রায় মিলে যাওয়ায় ওই ভুল হয়ে গিয়েছিল। প্রথম সংস্করণের গীতবিতানের (খ) পরিশিষ্টে এগুলোর সংযোজন ভুলবশত হলেও পরে বর্জিত হয়েছে। আবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের অন্তত পঁচিশটি লেখা গানে সুর দিয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে অতি উল্লেখ্য গান হল, অনেক দিয়েছ নাথ আমায়, প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন, দে লো সখী, দে পরায়ে গলে, নীরব রজনী দ্যাখো মগ্ন জ্যোছনায়। কিন্তু ক্রমশ সময় স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়েছে। এখন যাঁরা এই গানগুলো গান বা শোনেন তাঁরা রবীন্দ্রনাথের সুরই শুনছেন ভেবে থাকেন।
এই যে এত গান, সেই ভানুসিংহের পদাবলী থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ লিখে গেলেন যাদের অতিক্রম করতে পরবর্তী সময়ের গীতিকাররা অক্ষম হলেন তা কবি কীভাবে আয়ও করেছিলেন। বলা হয়, বাংলার পল্লীগীতি, লৌকিক গীতি, বিশেষ করে লালনের গান রবীন্দ্রনাথকে পথ চিনিয়ে দিয়েছিল। লালনের গানের আধুনিক চেহারা আমরা তাঁর গানে পেয়েছি। কিন্তু তার প্রয়োগ একদম আলাদা। রবীন্দ্রনাথের আগে বাংলা গান মূলত কীর্তন, পল্লীগীতি, শ্যামাসঙ্গীত, টপ্পা-জাতীয় গানে সীমাবদ্ধ ছিল। নিধুবাবুর টপ্পায় অনেক আধুনিক লাইন দেখেছি যা সেই সময়ের কবিতায় দেখতে পাইনি। যেমন ভারতচন্দ্রের লাইন, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতের মতো লাইন তাঁর কাছাকাছি সময়ের কবিরাও লিখতে পারেননি। মধুসূদন দত্ত চতুর্দশপদী অথবা কাব্যনাট্য লিখেছেন। অসাধারণ লাইন আছে সেখানে। কিন্তু তার প্রকাশ সময় ছাড়িয়ে তেমনভাবে হয়নি। রবীন্দ্রনাথ, সম্ভবত এঁদের কাছ থেকেই শিক্ষা নিয়েছেন, নিয়ে নিজেকে তৈরি করেছেন। এই তৈরি হওয়াটা এত নিপুণভাবে হয়েছিল যে এখন মনে হয় তিনি তাঁর সময়ের অনেক পরের মানুষের জন্য জন্মেছিলেন।
প্রেমপর্যায়ের একশো চুয়ান্ন নম্বর গানটি আমার কাছে বিস্ময়ের। কে দিল আবার আঘাত আমার দুয়ারে। গানটি শুনলেই মনের ভেতর একটা গল্প তৈরি হয়ে যায়। এখন বন্ধ দুয়ারে কেউ আঘাত দিচ্ছে, যা শুনে মনে পড়ছে কেউ এর আগেও এমনি আঘাত দিয়েছিল, যে আঘাত দিয়ে চলে গিয়েছিল সে কি আবার এখন ফিরে এসেছে? এই যে প্রশ্নটি গানের কথায় উঠে এসেছে গাইবার সময় শিল্পীরা কি তার তাৎপর্য বুঝে গেয়ে থাকেন? যে আঘাত দিয়ে বন্ধ দরজা খোলা না পেয়ে চলে গিয়েছিল সে এই রাত্রে কি আমাকে আবার খুঁজতে ফিরে এল? নাকি যে এসেছিল সে আমার জীবনের সব আকুলতার সঙ্গী হয়ে আমাকে মগ্ন করে ফিরে গিয়েছিল একাকী রেখে? আমি তার জন্য প্রদীপ নিবিয়ে আজও একা বসে আছি। সেই সেদিনের নবীন অতিথি কি আবার ফিরে এল? নাকি এখন যে দুয়ারে আঘাত করছে সে নতুন কেউ, অজানা কেউ!
এই যে রহস্যের মধ্যে ডুবে থাকা, আমাদের ডুবিয়ে রাখা তা তাঁর আগে আর কেউ সক্ষম হননি। গীতবিতান নিজেকে আবিষ্কার করার গ্রন্থ নয়, মনের মালিন্য দূর করার জন্য মানবিক ঝরনাধারা। তাই গীতবিতান ছুঁয়ে বসে থাকি সর্বনাশের আশায়।