গীতবিতান ছুঁয়ে বলছি ১.৪৫

৪৫

গত সপ্তাহে জলপাইগুড়িতে গিয়ে দিন সাতেক ছিলাম। ট্রেনে সরাসরি নেমেছিলাম হাসিমারা স্টেশনে। অন্বিন্দু এসে নিয়ে গিয়েছিল ওর চা বাগান সুভাষিণীতে।

সেটা অনেককালের কথা, যখন চা বাগানের ম্যানেজাররা প্রায় রাজ্যপালের মতো জীবনযাপন করতেন। বাগানের মালিক ছিলেন রাষ্ট্রপতি। এঁরা নীচের তলার মানুষের সঙ্গে মিশতেন না। কাজের বাইরে কথা বলতেন না। সেই ভয়ংকর বাতাবরণ আর নেই। পরের দিন শুভব্রত ঘোষ এলেন। তিনি ওই বাগান তো বটেই আরও দুটি বাগানের মালিক। অত্যন্ত ভদ্র মানুষ। ডুয়ার্সের চা বাগানগুলো থেকে বাঙালি মালিকরা যখন নিজেদের দোষ অথবা পারিপার্শ্বিকের চাপে বিতাড়িত হয়েছেন, তখন শুভব্রতর মতো তরুণ বাঙালি এখনও ভালোবেসে ভালো কাজ করে চলেছেন, দেখতে খুব ভালো লাগে।

হাসিমারা স্টেশনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, শ-দুয়েক সম্পন্ন মানুষ কাঞ্চনকন্যা স্টেশন থেকে নেমে ভুটানের ফুন্টশিলিং-এ যাবেন বলে ব্যস্ত হয়েছেন। হাসিমারা ছোট্ট স্টেশন। কিন্তু এই ট্রেনের যাত্রীদের পাওয়ার আশায় ট্যাক্সিওয়ালারা ওঁত পেতে থাকেন। মোটা টাকায় তারা ৪৫ মিনিটে দূরের ভুটানি শহরে নিয়ে যায়। সেখানে হোটেল খুঁজে মোটা টাকার বিনিময়ে দিন এবং রাত কাটিয়ে পরের সকালে এঁরা থিম্পু, পারোতে বেড়াতে যান। সারা রাত ট্রেনে কাটিয়ে হাসিমারায় নেমে যাত্রীরা যদি মোটামুটি আরামদায়ক একটি রিসর্ট পেতেন তাদের আশেপাশের চা বাগানে বিকেলে নিয়ে গিয়ে চা তৈরির প্রক্রিয়া দেখানো হত এবং পরের সকালে ফুন্টশিলিং-এ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হত তাহলে, আমি নিশ্চিত, বেশিরভাগ থিম্পুযাত্রী একটা রাত পশ্চিমবঙ্গে থেকে যেতেন। পর্যটন বিভাগ এটা নিয়ে ভাবেননি, বেসরকারি ব্যবসাদাররাও নয়। জলপাইগুড়ির উৎসাহী তরুণরা দলবদ্ধভাবে উদ্যোগটা নিতে পারেন। আমার বিশ্বাস আছে, চা বাগানের মালিকরা এই ব্যাপারে সহযোগিতা করবেন। শুভব্রত তো এককথায় রাজি।

জলপাইগুড়িতে যাওয়ার দরকার ছিল। ঠিক হল, যাওয়ার পথে গায়েরকাটায় থামব। নইলে ফেরার পথে রাত কাটাব। গয়েরকাটা চা বাগানে আমার জন্ম হয়েছিল। ছোট্ট জায়গা, কিন্তু এর উপর দিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে অসম এবং ভুটানে গিয়েছে। গয়েরকাটায় কোনো হোটেল নেই। আমার অনেক গল্প উপন্যাসে গয়েরকাটার কথা রয়েছে। খুঁটিমারির জঙ্গল, নাথুয়ার ডায়না নদী, বানারহাট পেরিয়ে ভুটানে বেড়াতে যাওয়ার চমৎকার সুযোগ আছে। থাকার মধ্যে একটা পি ডবলিউ ডি বাংলো। কিন্তু সেখানে সরকারি আমলাদের ভিড়ে জায়গা পাওয়া যায় না। মনে আছে, বহুবছর আগে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আলিপুরদুয়ার যাওয়ার পথে শেষ বাস থেকে কোনো কারণে গয়েরকাটার চৌমাথায় নেমে কিছুর সন্ধান করায় বাস তাঁকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছিলেন না শক্তিদা। কেউ তাঁকে চিনত না। সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলে খোঁজ করলেন কেউ ‘দেশ’ পত্রিকা পড়ে কিনা। সেই সূত্র খুঁজে সন্ধ্যার পর পৌঁছোতে পারলেন আমার বাবার কাছে। রাতের আস্তানা জুটল!

জানতাম, এখনও চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পরেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমাদের ছেলেবেলায় যে গয়েরকাটাকে দেখেছিলাম তার সামান্যই বদলেছে। কিছু সেলুন, ভালো বাড়ি হয়েছে। একটা আধুনিক রেস্টুরেন্ট স্বপ্নের বাইরে। গয়েরকাটার কিছু উদ্যমী ছেলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। সুব্রত পাত্র, কানাই চ্যাটার্জি, শ্যামল এবং বুড়োরা একটা কিছু করার কথা ভেবে খুঁটিমারির জঙ্গলের একেবারে গায়ে প্রায় পরিত্যক্ত পার্কে টুরিস্টদের জন্য রিসর্ট করতে চাইল। কিন্তু পার্কের জমি সরকারের। পঞ্চায়েত নিয়ন্ত্রণ করে। পঞ্চায়েত দয়া করে ওদের এক বছরের জন্য কাজ করতে বলল। কিন্তু এক বছরের জন্যে কাজের সুযোগ পেয়ে ওরা কী করে টাকার ব্যবস্থা করে ওখানে সেটা বিনিয়োগ করবেন? রিসর্টের জন্য ঘরবাড়ি ইত্যাদি তো দরকার। এক বছর পরে উঠে যেতে হলে কেন ওরা টাকা নষ্ট করবে। আমি উত্তরবঙ্গ বিষয়ক মন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছি, পঞ্চায়েতের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি, এদের অন্তত পাঁচ বছরের জন্য কাজ করতে দিন। গয়েরকাটায় যদি ট্যুরিস্টরা ওই রিসর্টের জন্য আসে, তাহলে এলাকায় উন্নতি হবে। কিছু বেকার ছেলে কাজ পেয়ে যাবে। খুঁটিমারি জঙ্গলে তো প্রচুর বন্যপ্রাণী আছে। যদি বনমন্ত্রী প্রসন্ন হন, তাহলে হলং থেকে পোষা হাতি শীতকালে ওখানে এনে সকাল বিকেলে তার পিঠে ট্যুরিস্টদের জঙ্গলে ঘোরাবার ব্যবস্থা করলে, তাঁরাও আসতে উৎসাহিত হবেন। মন্ত্রীমশাই, পঞ্চায়েতের বন্ধুরা আশ্বাস দিয়েছেন তাঁরা উদ্যোগ নেবেন।

জলপাইগুড়িতে যাওয়ার জন্য, হাসিমারা থেকে বেরিয়ে মাইল দুই-তিন যাওয়ার পর গাড়ি থামাতে বললাম। বোধহয়, মান্ধাতার বাবার আমলে ওখানে একটা পিচের রাস্তা ছিল। এখন ভয়ংকর গর্ত চারধারে। যেন আকাশ থেকে বোমা ফেলে এই গর্তগুলো করা হয়েছে। ড্রাইভার আশ্বাস দিল, ‘মাত্র চার কিলোমিটার রাস্তা এই রকম, পরের রাস্তা ভালো।’ চার কিলোমিটারের এই হাল কেন? ‘স্যার, যিনি কনট্রাক্ট নিয়েছেন তিনি হয় দুর্বল, নয় আর তোলা দিতে পারছেন না।’ ড্রাইভার বলল। মন্ত্রীমশাই বললেন, ‘বামফ্রন্ট যাদের কনট্রাক্ট দিয়ে গিয়েছিল তিন বছরের জন্য, তাদের সরাতে আরও এক বছর লাগবে।

বিশ্বাস করুন, ওই চার কিলোমিটার গাড়িতে পার হতে আমার কোমরে যে ভয়ংকর ব্যথা শুরু হয়ে গেল, তারপর আবার সেই পথে ফিরতে পারিনি। ফেরার সময় বিনাগুড়ি পর্যন্ত গাড়িতে চেপে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে উঠে হাসিমারায় নেমেছিলাম। এবার জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়িতে যেতে পারিনি। বন্ধুরা বললেন, ‘আগে হাড় ভাঙত এখন ভাঙবে না মচকাবে।’

চারধারে এত পরিবর্তন হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে। কলকাতা থেকে দুর্গাপুরের রাস্তায় এখন প্লেন নামতে পারে। দু-ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায় সেখানে। খড়্গাপুরের রাস্তা তো রীতিমতো বিদেশের মতো। রাস্তা ভালো হলে উন্নয়ন হতে বাধ্য। তাহলে ডুয়ার্সের মানুষ কী দোষ করল? মন্ত্রীমশাই একটি ঘটনা বললেন, একটি জেনারেটরের দাম যেখানে সাড়ে চার লক্ষ টাকা, সেখানে সাপ্লায়ারকে ভাড়া দিতে হয় ১৬ হাজার টাকা। ভাড়া বন্ধ করে নতুন জেনারেটর কিনে দিলেই আন্দোলন শুরু হয়। শুধু বিরোধী দল নয়, শাসক দলের নেতারাও নতুন জেনারেটরে আপত্তি করেন। তাহলে রাস্তা ভালো হবে কেন? ফেরার পথে ট্রেনে প্রাক্তন পূর্তমন্ত্রী শ্রীযুক্ত ক্ষিতি গোস্বামী সহযাত্রী ছিলেন। সব শুনে বললেন, ‘ডুয়ার্সের মানুষের অসীম ধৈর্য, কলকাতার দিকে হলে আগুন জ্বলে যেত।’ মনে মনে বলেছিলাম, কত কাল? আর কত কাল?

৪৬

ইট কাঠ সিমেন্টের বাড়ির দিকে যখন আমরা তাকাই, তখন ভালো দেখালে প্রশংসা করি। কিন্তু যার উপর ওটা দাঁড়িয়ে আছে তার কথা মনেই আসে না। প্রদীপ জ্বালবার আগে সলতে পাকানোর গল্পটা থাকে, যেমন কয়েকবার আছাড় না খেলে সাইকেল চালানো শেখা যায় না। কিন্তু কে সলতে পাকাতে শিখিয়েছিল অথবা ক-বার আছাড় খেতে হয়েছিল তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। বাড়ির ভিত যেহেতু মাটির তলায় থাকে এবং সেটা চোখে দেখা যায় না, তা নিয়ে দর্শকরা মাথা না ঘামালেও, বাড়ি জানে সে কার উপর দাঁড়িয়ে আছে। অবশ্য অকৃতজ্ঞ হলে আলাদা কথা।

জীবনের ক্ষেত্রেও আমি এই তত্ত্বে বিশ্বাস করি। বালকবেলা থেকে কিশোরকাল পর্যন্ত সময়টায় কেউ না কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। নতুন পথের খবর দিয়ে থাকেন। আর সেটাই জীবন বদলে দেয়। এই আমি, এখনও লেখালেখি করে যাচ্ছি, লিখে চমৎকার বেঁচে আছি, আমার জীবনেও দুজন মানুষ নির্মাতার ভূমিকায় ছিলেন। তাঁরা তখন যেমন জানতেন না যে আমাকে নির্মাণ করছেন, আমিও তখন তাঁদের ভূমিকা আমার জীবনে কী মহামূল্যবান হবে তা বুঝতে পারিনি।

জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে পড়তাম ঠাকুরদার আশ্রয়ে থেকে।

জন্মেছিলাম ৫০ মাইল দূরের গয়েরকাটা চা বাগানে। তিনছুটিতে ছুটে যেতাম সেখানে। চা গাছ, আংরাভাসা ঝরনা, রবিবারের হাট আর সমবয়সি মদেশিয়া বন্ধুদের সঙ্গে সময়টা কেটে যেত হু হু করে। এখনকার ন্যাশন্যাল হাইওয়ের নাম তখন ছিল আসাম রোড। ঘণ্টায় একটা বাস যেত কিনা সন্দেহ। মাঝেমধ্যে দু-একটা প্রাইভেট গাড়ি। বাসের সামনে লেখা থাকত নাথুয়া, বানারহাট, আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা, কোচবিহার। কখনও না যাওয়া জায়গাগুলোর নাম দেখে ভাবতাম, আহা বাসটাতে যদি উঠে পড়তে পারতাম। ডুয়ার্সটাকে বেশ চেনা হয়ে গিয়েছিল শুধু নাম দেখেই। আমার জগৎ ছিল তখন টিয়াপাখির ঝাঁকে, বাতাবিলেবুর ফুলের গন্ধে, ঝরনার জলের পাথরের খাঁজে লুকিয়ে থাকা নোনা চিংড়িদের নিয়ে। আর এই সময় আমার ভাইদের পড়াতে এলেন একজন নতুন গৃহশিক্ষক। নাম সতী মাস্টার।

নাইন-টেনে উঠেই আমি বাংলা সাহিত্য গিলতে শুরু করেছিলাম। দস্যু মোহন থেকে নীহার গুপ্ত। সতী মাস্টার একটু রোগা, উদাসীন, ময়লা পা-জামা এবং একই রকমের হ্যান্ডলুমের বহু ব্যবহৃত পাঞ্জাবি পরা একটি মানুষ যার পকেটে নস্যির ডিবে এবং নস্যিকলঙ্কিত রুমাল থাকত। বন্ধুরা বলল, সতী মাস্টার এবারের পুজোর সময় যে নাটক হবে তা পরিচালনা করবেন। গয়েরকাটায় তখন যেসব নাটক পুজোর সময় হত তার নারী চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করতেন তাঁদের মধ্যে সুখ্যাতি পেয়েছিলেন সুধীর ঘোষ। সতী মাস্টার নাকি রিহার্সালে তাঁকে বেশি করে তালিম দিচ্ছেন। আলাপ হল। পড়ার বইয়ের বাইরে যাঁরা আমাকে আকর্ষণ করেন তাঁদের নাম শুনে মাথা নাড়লেন তিনি। বললেন, আজ বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা করো।

গয়েরকাটা চৌমাথার পাশ দিয়ে গলির ভিতর একটি কাঠের বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে ছিলেন ওরা। নস্যি নাকে পুরে মধ্য তিরিশের মানুষটি রুমালে নাক মুছে বললেন, ‘কিছু পড়ার আগে তোমাকে ভাবতে হবে, কেন পড়ছ? দস্যু মোহন মানুষের কাহিনি নয়, ওটা অতি অবাস্তবভাবে ঠুনকো মনোরঞ্জনের চেষ্টা মাত্র। তোমার চারপাশে যাঁদের দেখছ তাদের বাইরে অজস্র মানুষ আছেন। এদের তুমি চেনো না। এদের সুখদুঃখ সংগ্রামের কাহিনি তোমার জানা নেই। যারা মানুষের গল্প লিখে গেছেন তাদের লেখা পড়লে ওই মানুষদের কথা তুমি জানতে পারবে। তোমার অভিজ্ঞতা বাড়বে। বিচার করতে শিখবে। কবিতা পড়?’

মাথা নেড়েছিলাম, ‘না।’

‘কবিতা পড়। চাঁদ ফুলের কবিতা নয়, মানুষের জন্য লেখা কবিতা। দাঁড়াও’।

একটা বই এনে পাতা বের করে বললেন, ‘এটা পড়ে দ্যাখো তো। এখনও মনে আছে। কবিতাটা পড়ে আমার ভিতরটায় অদ্ভূত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। মনে হচ্ছিল কবির মতো আমার কাজটা করা উচিত। এই পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়াটা আমারও দায়িত্ব। আমি সুকান্ত ভট্টাচার্যের নাম প্রথম জানলাম, ছাড়পত্র কবিতার কথা কেউ এর আগে বলেনি।

সতী মাস্টার আমার চোখের সামনে একটার পর একটা ভুবন তৈরি করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, পড়বে, দেখবে এবং মন চাইলে লিখবে। তারাশংকর-বিভূতিভূষণ-মানিক পড়বে। তারপর রবীন্দ্রনাথের বইতে হাত দেবে। সাঁতার শিখে না নিলে সমুদ্রের পাড়ে সাঁতরাবে কী করে? কলকাতায় পড়তে গেলাম। হঠাৎ সতী মাস্টারের চিঠি এল। ‘আমি একটা পত্রিকা বার করছি। নাম পারক। পাবক মানে আগুন। এখানকার লেখকদের লেখা পাঠালাম। কলকাতা থেকে বেশ কিছু লেখা জোগাড় করো। তারপর ভালো করে ছাপিয়ে পুজোর আগেই পত্রিকা আমার কাছে পাঠাও। প্রেসকে জিজ্ঞাসা করো কত টাকা লাগবে। পাঠিয়ে দেব। পত্রিকায় যেন যত্ন থাকে।’ পত্রিকা ছাপানোর অভিজ্ঞতা ছিল না, কোনো প্রেসে যাওয়ার দরকারও পড়েনি আগে, কিন্তু একজন প্রসূন বসুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। আগামী পত্রিকার সম্পাদক ও নবপত্র প্রকাশনীর প্রকাশক। তিনি যত্ন করে ‘পাবক’ ছাপিয়ে দিলেন। সেই পত্রিকা নিয়ে নিজেই গেলাম গয়েরকাটায়। জড়িয়ে ধরেছিলেন সতী মাস্টার। গয়েরকাটা থেকে তিনি চলে যান ময়নাগুড়িতে। সপরিবারে। সম্পর্ক ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। এখন তিনি নেই। কিন্তু কিছু লেখার সময় আমার পাশে এসে বসেন। বলেন, ‘মানুষের কথা লেখো সমরেশ।’

জলপাইগুড়ির জেলাস্কুলে আমরা যখন সিনিয়র ছাত্র, তখন একজন সুদর্শন যুবক এলেন বাংলার শিক্ষক হয়ে। আদ্দির পাঞ্জাবি এবং ধুতিতে একফোঁটা ময়লা নেই। যেন সিনেমার নায়ক। নাম সুরঞ্জন দত্তরায়। সবাই ডাকেন বেণুদা বলে। জানলাম বেণুদা কবি এবং গল্পকার। ঝটপট ভাব হয়ে গেল। সেই সূত্রে কত কথা। মানিকবাবুর পদ্মানদীর মাঝি আর অদ্বৈত মল্লবর্মনের তিতাস নদীর মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? সারল্য বিভূতিভূষণকে কতটা সাফল্য দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার অংশগুলোকেই ছোটোগল্প বলা যায়। কিন্তু ছোটোগল্পে রূপান্তরিত করলে বাস্তবতার সঙ্গে যে লড়াই লাগবে তা কবিতায় হয় না কেন? দরজা খুলে যেতে লাগল একের পর এক। ‘মুক্তি’ ছবিতে প্রমথেশ বড়ুয়া যেমন একটা পর একটা দরজা খুলে বিশাল সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন।

বেণুদা চলে গেলেন আলিপুরদুয়ারে, আমি কলকাতায়। আজ আশি বছর পেরিয়েও বেণুদা লেখার ব্যাপারে তরতাজা। কয়েকমাস আগে কলকাতায় এসে ধমক দিয়েছেন, ‘কী করছিস? কত করে বলছি, বৈকুণ্ঠপুরের রাজা দর্পদেব রায়কতকে নিয়ে একটা উপন্যাস লেখো। কানে যাচ্ছে না?’

কথা দিয়েছি এবার লিখব। আমার যাবতীয় কাজকর্মের ভিত এরা দুজন। আমার লেখক অস্তিত্বের এঁরাই জনক।

৪৭

আচ্ছা বলুন তো, জলপাইগুড়ি আর শিলিগুড়ির মানুষের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে ঝগড়া বাধাবার চেষ্টা কে প্রথম করেছিল? কেন করেছিল? জলপাইগুড়িতে কোনো ভালো উদ্যোগ সরকার নিলে শিলিগুড়ির লোক কেন আন্দোলনে নামবে? আবার শিলিগুড়িতে তেমন কিছু হলে জলপাইগুড়ির মানুষের গাল কেন ফুলবে?

আমাদের বাল্যকালে এরকম কথা কখনও শুনিনি। মনে আছে তখন তিস্তা ব্রিজ হয়নি, জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন তো দূর অস্ত। জলপাইগুড়ি স্টেশনটির কোনো গর্ব ছিল না। কয়েকটা লোকাল ট্রেন চলত শিলিগুড়ি থেকে হলদিবাড়ি পর্যন্ত। বিকেলে একটা ট্রেন আসত হলদিবাড়ি থেকে, তাতে কয়েকটা কামরা থাকত যা প্রথমে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস পরে দার্জিলিং মেলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হত কলকাতায় যাত্রীদের নামাতে। শিলিগুড়িতে দুটো স্টেশন ছিল। এটা এখনও আছে বাস টার্মিনাসের পিছনে, আরেকটা ছিল শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন। স্মৃতি বলছে, ওই টাউন স্টেশনটির রমরমা ছিল জলপাইগুড়ি স্টেশনের থেকে অনেক বেশি। আবছা মনে পড়ছে, বাবা-মায়ের সঙ্গে শিলিগুড়ি স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে পূর্ব পাকিস্তান দিয়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম স্বাধীনতার পর পর। কিন্তু শিলিগুড়ির গুরুত্ব ক্রমশ বেড়ে গেল। ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে যাওয়ার প্রধান দরজা শিলিগুড়ি। কলকাতা, বিহার, নেপাল থেকে ওখানেই মানুষ প্রথমে পৌঁছোয়। তাই শিলিগুড়িতে একটি আধুনিক এবং বিশাল স্টেশন তৈরির প্রয়োজন হয়ে পড়ল। স্টেশন তো এয়ারপোর্টের মতো শহর থেকে বহু মাইল দূরে তৈরি হতে পারে না। কিন্তু শিলিগুড়ি শহরের গায়ে অত বড়ো জমি কোথায়? শিলিগুড়ি শহর দার্জিলিং জেলার অন্তর্ভুক্ত। তার গায়ে শ্বাস ফেলছে জলপাইগুড়ির সীমান্ত। দেখা গেল জমি পাওয়া যেতে পারে জলপাইগুড়ি জেলার সীমার মধ্যে। সেখানে জমি পেলে যে স্টেশন তৈরি হবে তার নাম যদি শিলিগুড়ি রাখা হয়, তা মেনে নেবে না জলপাইগুড়ির মানুষ। তখন আমরা বেশ ছোটো। শুনেছি, এই নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল। জলপাইগুড়ির দুজন প্রখ্যাত ব্যক্তি সত্যেন্দ্রপ্রসাদ রায় এবং বীরেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ জেলাকে খুব ভালোবাসতেন। সত্যি-মিথ্যে জানি না, বীরেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ উদ্যোগী হয়ে সমস্যা মিটিয়েছিলেন, শিলিগুড়ির গায়ের নতুন স্টেশনটির নাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন চালু করে। তারপরে শিলিগুড়ি শহর বেড়েছে অনেক। জেলার সীমা উপেক্ষা করে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের চারপাশে বাস করছেন শিলিগুড়ির মানুষ। আর জলপাইগুড়ি থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অনেক মাঠ, ঘাট, গ্রাম, গঞ্জ পেরিয়ে যে বিশাল স্টেশনটি চালু হল তার নাম কিনা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন? কী ধরনের জেদ এইরকম প্রকৃতিবিরোধী কাজের পিছনে থাকে। এখন কেউ যখন নিউ জলপাইগুড়িতে নেমে দার্জিলিং বেড়িয়ে এসে আমায় বলেন, আপনার জলপাইগুড়ি দেখে এলাম, তখন তাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলতে বলতে হাল ছেড়ে দিয়েছি।

শিলিগুড়িতে মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। জলপাইগুড়ির সম্বল একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। জলপাইগুড়িতে কোনো শিল্প নেই। চা-বাগানের অফিসগুলো সব কলকাতায় চলে গেছে। আটষট্টির বন্যার পরে শহরটা বিয়ে না হওয়া বয়স্কা মেয়ের মতো বাপের বাড়িতে পড়ে আছে, যার বিয়ের বয়সটাও চলে গিয়েছে। রাস্তাঘাট থেকে বাড়িঘরের চেহারা সেই প্রাচীনকালের চৌহদ্দি থেকে বের হয়নি, সামগ্রিকভাবে তুলনায় শিলিগুড়ির বাতাসে টাকা উড়ছে। ব্যাবসাবাণিজ্য বেড়েছে হু হু করে। অবাঙালি ব্যাবসাদারদের দ্বিতীয় আবাস হয়ে গিয়েছে শিলিগুড়ি। পশ্চিমবাংলার অন্য কোনো শহরে এত হোটেল নেই। একমাত্র দার্জিলিং পাল্লা দিতে পারে। দামি গাড়ি এবং বাড়ির চেহারা দেখলেই দুটো শহরের অর্থনৈতিক পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়।

কিন্তু জলপাইগুড়ির গর্ব ছিল সাহিত্য, গান এবং নাটক নিয়ে। এগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি শিলিগুড়ি। জলপাইগুড়ির লোক বুক ফুলিয়ে বলতেন, টাকা থাকলে ইন্ডাস্ট্রি গড়া যায়, সংস্কৃতি নয়। আমাদের বেণু দত্তরায় আছেন, দেবেশ রায়, অশোক বসু, অর্ণব সেন আছেন, প্রাবন্ধিক আনন্দগোপাল ঘোষ, উমেশ শর্মা আছেন। শিলিগুড়িতে তো হাতের একটা আঙুলও গোনা যাবে না। শিলিগুড়ির লোক বলবে, পশ্চিমবাংলাকে ভারতের খেলাধুলার জগতে চিনিয়েছে শিলিগুড়ি। বিশেষ করে টেবল টেনিস। করে ঘি খেয়েছিল জলপাইগুড়ি রুনু গুহঠাকুরতা বা মণিলাল ঘটককে পেয়ে, এখনও তার গন্ধ শুঁকে যাচ্ছে। ব্যাপারটা এখন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে জলসাঘরের জমিদারের ফিটন গাড়ির পাশে মারুতির অবস্থানের মতো। অথচ দেখুন, দুই শহরের পাড়াগুলোর নামের কী মিল ছিল। হাকিমপাড়া, বাবুপাড়া, হসপিটালপাড়া দুই শহরেরই আছে। দুই শহরের বেশিরভাগ মানুষের পূর্বপুরুষ আজকের বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন। কিন্তু সময়ের বিচারে জলপাইগুড়ি শহরের পত্তন হয়েছিল অনেক আগে। অভিজাত মানুষের শহর হিসেবে সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিল জলপাইগুড়িতে।

তাহলে এত বিরোধ কি বানানো? যতদূর মনে পড়ছে, হাইকোর্টের বেঞ্চ কোন্ শহরে হবে এই নিয়ে ঝগড়া তুঙ্গে উঠেছিল। জলপাইগুড়ির বিখ্যাত আইনজ্ঞ পরলোকগত বিমল হোড় মশাই মরিয়া হয়েছিলেন ওটা জলপাইগুড়িতে নিয়ে আসতে। খোলা চোখে দেখলে শিলিগুড়ির মানুষের যুক্তি অনেক বেশি বাস্তব ছিল। যাতায়াতের সুবিধা, ভালো ভালো হোটেলে থাকার মামলা করতে এসে অসুবিধায় পড়বে না দু-পক্ষের মানুষ। জলপাইগুড়িতে এই দুটোর অভাব আছে। কিন্তু আবেগের কাছে যুক্তি হার মানলে আর কী করা যাবে। বোধহয় সেই কারণে আজও হচ্ছে হচ্ছে করেও জলপাইগুড়িতে হাইকোর্টের কাজ এখনও শুরু হয়নি।

কিন্তু এগুলো সবই বাইরের ব্যাপার। উত্তরবঙ্গ বিষয়ক মন্ত্রী শ্রীযুক্ত গৌতম দেবের কাজের জায়গা শুধু শিলিগুড়ি বা তাঁর নির্বাচনী এলাকা নয়, কোচবিহার থেকে মালদা পর্যন্ত। তার মধ্যে অবশ্যই জলপাইগুড়িও পড়ে। তাঁর কাছে আমরা উন্নয়নের জন্য অনুরোধ জানাতেই পারি। আর কিছু না হোক, রাস্তাগুলোয় যেন গাড়ি চলতে পারে। এর আগে একবার শিলিগুড়ি থেকে গাড়িতে জলপাইগুড়ি যেতে গিয়ে কোমরে ভয়ংকর আঘাত পেয়েছিলাম। তখনকার জাহাজমন্ত্রীর কাছে একটি নিবন্ধে আবেদন করেছিলাম, ওই রাস্তাটা কুড়ি ফুট খুঁড়ে জলপথ করে দিতে, যাতে লঞ্চে বা বাষ্পচালিত নৌকায় যাতায়াত করা যেতে পারে। তাতে দুটো সুবিধা, প্রতি বছর মেরামতির জন্য কন্ট্রাক্টরকে টাকা দিতে হবে না এবং মানুষ আহত না হয়ে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছোবে। দুই শহরকে একটু কাছাকাছি আনার জন্যে এইরকম একটা ব্যবস্থার দরকার। ও হ্যাঁ, গত সংখ্যার লেখা পড়ে একজন পাঠক জানিয়েছেন, আপনি তো মশাই এখন কলকাতার লোক, যতই ঘরে ফেরার কথা লিখুন কলকাতার গন্ধ। বনের পশু তার শাবকের গায়ে মানুষের গন্ধ পেলে ত্যাগ করে চলে যায়। হায়। কলকাতা বলে আমি নর্থ বেঙ্গলের লোক। এরপরে তো একটাই ইংরেজি শব্দ মনে আসছে। আউটসাইডার। না ঘাটকা, না ঘরকা।

৪৮

কিশোরকালে তিস্তার বাঁধে বসে আমরা বড়ো বড়ো ঢেউ দেখতাম। হাকিমপাড়ার বাঁধে বসলে ওপারের বার্নিশঘাট দেখতে পেতাম না। জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর, ওই তিন মাস তিস্তা প্রায় সমুদ্র হয়ে যেত। যদিও সেই বয়সে আমরা সমুদ্র দেখিনি কিন্তু ভেবে নিতাম সমুদ্র বোধহয় এই তিস্তার চেয়ে খানিকটা বড়ো হবে। আবার শীত-গ্রীষ্মে তিস্তার চরে পক্ষীরাজ ট্যাক্সি ছুটত যাত্রী নিয়ে, শরৎ এলে কাশফুল ফুটত।

আমরা তখনও জানি না, আমাদের প্রিয় স্যার বেণু দত্তরায় তিস্তা নদীকে নিয়ে উপন্যাস লিখছেন। তখনও বোধহয় দেবেশদার মাথায় তিস্তাপারের বৃত্তান্ত জন্ম নেয়নি। তারপর একটু একটু করে তিস্তা মরানদী হয়ে গেল। এখন এপার ওপার জুড়ে শুধু বালি আর বালি। কেউ বলেন, তিস্তা ব্যারেজ করে সব জল টেনে নেওয়া হয়েছে, কেউ বলেন, পাহাড় থেকেই কম জল নামছে।

গত সপ্তাহে সেই তিস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম শীর্ণ একটি ধারা বার্নিশের কাছাকাছি বইছে। মন খারাপ হয়ে গেল। আটষট্টির লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন আমি জলপাইগুড়ি থেকে যখন গয়েরকাটায় যাচ্ছিলাম তখন নদীটাকে ফুঁসতে দেখেছিলাম। তারপর ভয়ংকর চেহারা নিয়ে তিস্তা জলপাইগুড়ি শহরটাকে তছনছ করে পিছিয়ে দিয়ে গিয়েছিল কয়েক দশক। বাংলাদেশের একজন প্রভাবশালী স্ত্রী আমাকে রাতের আড্ডায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তিস্তার সব পানি আপনারাই নিবেন, আমরা কী দোষ করলাম?’ তাঁকে বোঝাতে পারিনি। তিস্তায় জল নেই বলে চরের উপরে দোতলা বাড়ি হয়ে গেছে। চাষ করছে মানুষ। নিশ্চিন্তে বাস করছে। ভদ্রলোক হেসে বলেছিলেন, ‘তাই যদি হয়, তাহলে আপনাদের মুখ্যমন্ত্রী আপত্তি করেন কেন? কোনো কিছু না থাকলে কি তা দিতে কেউ আপত্তি করে?

এবার গিয়েছিলাম কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে। দলগাঁওতে নেমে ঘোরাঘুরি করেছিলাম। ট্রেনে ভুটানে বেড়াতে যাওয়া একটি পরিবারের কর্তা ছেলেমেয়েদের বোঝাচ্ছিলেন, ‘আমরা এখন নর্থ বেঙ্গলে ঢুকে পড়েছি। নর্থ বেঙ্গলের হাসিমারা স্টেশনে নেমে জয়গাঁ হয়ে ভুটানে প্রবেশ করব।’

বাল্যকাল থেকে ওই শব্দটা শুনে আসছি। নর্থ বেঙ্গল। স্বাধীনতার আগে থেকেই নাকি তিনটি বেঙ্গল ছিল। ইস্টবেঙ্গল, ওয়েস্ট বেঙ্গল আর নর্থ বেঙ্গল। ইস্ট থাকলে ওয়েস্ট থাকবেই। নর্থ বেঙ্গল যখন আছে তখন কলকাতা, বর্ধমান, মেদিনীপুরকে সাউথ বেঙ্গল ভাবতে হবে। কিন্তু সাউথ বেঙ্গল কথাটা প্রচলিত নয়। ওই সব জায়গা নাকি ওয়েস্ট বেঙ্গল। ফারাক্কা পার হলেই নর্থ বেঙ্গল, যার শেষ কোচবিহারে। যে-কোনো নতুন মানুষ শুনলে ভাববেন নর্থ বেঙ্গল ওয়েস্ট বেঙ্গলের বাইরে। খুব সচেতনভাবে জেনে শুনে এই ব্যবধানটা তৈরি করা হয়েছে। অনেক পরে যখন বিশ্ববিদ্যালয় হল, তখন নাম দেওয়া হল নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজের আগে নর্থ বেঙ্গল বসিয়ে দেওয়া হল। ভেবে দেখুন তো, গোটা পশ্চিমবঙ্গে একটা সাউথ বেঙ্গল ইনিভার্সিটি বা সাউথ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ খুঁজে পাবেন কি না। এমনকি, ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ বা ইউনিভার্সিটির হদিস পাওয়া যাবে না। হ্যাঁ, দীর্ঘকাল নর্থ বেঙ্গল স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন চালু থাকার পর সাউথ বেঙ্গল চালু হয়েছে। ওটা নামেই শেষ।

পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখুন, পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে নর্থ বেঙ্গল চিরকাল অবহেলিত এলাকা হিসেবেই সরকার ভেবেছিল। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর গৌতম দেবকে উত্তরবঙ্গ বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হল। মুখ্যমন্ত্রীর মনে হয়েছে, উত্তরবঙ্গ এতকাল অনুন্নত ছিল, মন্ত্রী বসিয়ে যদি কিছুটা উন্নত করা যায়। দক্ষিণবঙ্গ বিষয়ক মন্ত্রীর দরকার নেই। পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ক তো নয়ই, কারণ ওসব জায়গা অনেক উন্নত। অর্থাৎ প্রকারান্তরে স্বীকার করা হল, উত্তরবঙ্গ অবহেলিত ছিল। এই যে এতকাল আমাদের একঘরে করে রেখেছিল কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট সরকার তার কারণে নতুন শিল্পটির দূরের কথা, পুরোনো চা-বাগানগুলো টিকে থাকার লড়াই-এ পিছিয়ে যাচ্ছিল। আমার এক আমেরিকান বন্ধু যে জলপাইগুড়িতে যেতে চাইছিল, সে দিল্লি থেকে ফোনে বলল, ‘নেটে টিকিট কেটে ফেলেছি ট্রেনের। ভায়া কলকাতা যাব।’

‘কোন্ ট্রেন?’ জিজ্ঞাসা করলাম।

‘উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস। ওই একটাই তো ট্রেন ওদিকে যায়। বন্ধু তার জ্ঞান জানাল।

‘কেন? দার্জিলিং মেল, তিস্তা তোর্সা, কাঞ্চনকন্যা ছাড়াও অনেক ট্রেন যাচ্ছে ওদিকে।’

বন্ধুটি বলল, ‘মাই গড! তাহলে এই ট্রেনটার নাম উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস হল কেন? আমি ভাবলাম অন্যগুলো বোধহয় উত্তরবঙ্গে যায় না। ভাবুন ব্যাপারটা। আমাদের কথা আলাদা। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এই বাহান্ন বছর ধরে কলকাতার মানুষদের মুখে তো কম কথা শুনলাম না। আমি নর্থ বেঙ্গলের, না ঘটি না বাঙাল। অতএব আমাকে বাটি বলা যায়। দেখতাম, বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখকরা যখন চব্বিশ পরগনা বা বীরভূমের পটভূমিকায় উপন্যাসে লেখেন তখন তাঁদের আঞ্চলিক লেখক বলা হয় না। আমি চা-বাগান নিয়ে লিখলেই শুনতে হয়, ‘আপনি আর চা-বাগান থেকে বের হতে পারলেন না। কেন বের হব? জ্ঞান হওয়ার পরে যে জায়গা প্রাণভরে দেখেছি, তা আমার লেখায় আলবাত আসবে।’ লক্ষ করেছিলাম, বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দারা, সেই কিরীটি রায় থেকে ফেলুদা হয়ে কাকাবাবু কলকাতার মানুষ। তেত্রিশ বছর আগে যখন কিশোর গোয়েন্দা উপন্যাস বড়ো কাগজে লিখতে শুরু করেছিলাম, তখন গোয়েন্দা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম অর্জুনকে। তার বাড়ি জলপাইগুড়ির কদমতলায়। রূপমায়া সিনেমার পাশের চায়ের দোকানে আড্ডা মারে। বয়স পঁচিশের নীচে। তার গুরু অমল সোম থাকেন হাকিমপাড়ায়। অর্জুনকে পাঠকরা ভালোবেসেছে।

আচ্ছা ভাবুন তো, শিলিগুড়ি থেকে জলপাইগুড়ি যাওয়ার রাস্তাটা অথবা হাসিমারা থেকে মাদারিহাট যাওয়ার পথটা কেন বছরের পর বছর ভয়ংকর গর্তে ভরা থাকবে? গত তেইশে এপ্রিল মাদারিহাট ছাড়াবার পর গাড়িতে বসে মনে হয়েছিল হাড়গোড় ভেঙে যাবে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী হয়তো বলবেন, ‘ওই রাস্তার মেরামতির কাজ চলছে’ হয়তো। কিন্তু বাজি রেখে বলতে পারি, বর্ষার পরে চাপা দেওয়া গর্তগুলো আবার বেরিয়ে পড়বে যাতে আবার খরচ করার সুযোগ পাওয়া যায়। বর্ধমান থেকে কলকাতার রাস্তা কখনোই ওরকম হবে না। কারণ, এখনও চিঠিতে ঠিকানা লেখা হয়, অমুক চন্দ্ৰ অমুক, বাবুপাড়া, শিলিগুড়ি, নর্থ বেঙ্গল।

আমরা যে কবে পশ্চিমবাংলার সক্রিয় নাগরিক হব!

৪৯

আমার বাড়িতে একটা কথা চালু আছে। আমি হয়তো তিনতলার ঘরে বসে লিখছি। একতলায় কেউ বেল বাজাল। আগে থেকে না জানিয়ে হুট করে বাড়িতে ঢুকে দাঁত বের করে ‘চলে এলাম সমরেশদা’ যাঁরা বলেন তাঁদের খুব খারাপ লাগে আমার। লেখা ছেড়ে নীচে নেমে অবান্তর কিছু কথা বলে উপরে উঠে এসে দেখি, লেখাটা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। তাই এসব ক্ষেত্রে আমি নীচে নামব না, বলে দেওয়া হবে উনি বাড়িতে নেই। বাড়িতে আছেন এবং লিখছেন বললে আগন্তুক আবদার করবেন, দু-মিনিটের জন্য নামতে বলুন, মাত্র দু-মিনিট। নেমে দেখেছি গ্যাজানোর সময়টা কুড়ি মিনিট হয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে মিথ্যে বলতে হয় বাড়ির লোকদের। কিন্তু কখনো কখনো বেল বাজে, আমি লিখছি, কাউকে বাড়িতে আসতেও বলিনি, অথচ বাড়ির লোক নীচ থেকে ঘুরে এসে বলে, ‘যাও, নীচে যাও।

প্রথম প্রথম অবাক হতাম, ‘কে এসেছে?’

উত্তর হত, তোমার দেশতুতো ভাই।

অর্থাৎ নর্থ বেঙ্গলের লোক হলে তার সাতখুন মাপ। বিশেষ করে জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, কোচবিহারের মানুষ হলে এবং তাঁকে সাতজন্মে না দেখলেও আমি নীচে যাব। এই নিয়ে মস্করা করে বাড়ির মানুষ। ‘উঃ, বদ্যিরা বাকি বদ্যিদের টানে, গুজরাটিরা শুনেছি গুজরাটিদের দেখে, নর্থ বেঙ্গলের লোক শুনলেই হয়ে গেল, সব আপত্তি উধাও।’

এটা হয়। স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। সেই নর্থবেঙ্গলের কাগজ হল এই উত্তরবঙ্গ সংবাদ। আমি জন্মেছিলাম গয়েরকাটা চা-বাগানে। পড়েছি জলপাইগুড়ি স্কুলে। ছেলেবেলায় গতকালের কলকাতার বাংলা কাগজ আজ আসত। পরে সকালের কাগজ বিকালে পেতাম। হঠাৎ ভোর না হতেই কদমতলার মোড়ে কাগজ বিক্রি দেখে অবাক হলাম। দিনের কাগজ ভোরেই পৌঁছে গেছে। সেই প্রথম দিকে কাগজের মান তেমন ভালো ছিল না। কলকাতার কাগজের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পিছিয়ে থাকত। কিন্তু সকালে আর কোনো কাগজ না দেখতে পাওয়ার আনন্দে টাটকা খবরগুলো গিলতে কী ভালো লাগত। শুধু শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি কেন, মালবাজার ময়নাগুড়ি- বানারহাট- বীরপাড়া থেকে ডুয়ার্সের নানান জায়গার মানুষ সেই প্রথম সকালের কাগজ সকালে পড়ার আনন্দ পেয়েছে। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও শিলিগুড়ি থেকে এই সাহসী উদ্যোগ নিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় সুহাস তালুকদার মশায়। আজ অবধি কলকাতার কাগজে লিখে হাত পাকাচ্ছি। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সূধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় তখন উত্তরবঙ্গ সংবাদের কলকাতার অফিসের সঙ্গে কর্মসূত্রে যুক্ত। সুধীদা একদিন টেনে নিয়ে গেলেন ওঁদের ডালহৌসির অফিসে। আলাপ হল সুহাসবাবুর সঙ্গে। বললেন, ‘আপনি নর্থ বেঙ্গলের ছেলে, এই কাগজও নর্থ বেঙ্গলের। আসুন না, একসঙ্গে কাগজটা বড়ো করা যাক।’

সুধীদার অনুরোধে কয়েকটা গল্প লিখেছি, পুজোর সময় নাটকও। কিন্তু তার বেশি জড়ানো হয়নি নানান কারণে। সুধীদা এবং সুহাসবাবুর মৃত্যুর পরে যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। দু-তিনবার কথা বলেছেন, ওঁর উত্তরসূরি, টেলিফোনে। কিন্তু জলপাইগুড়িতে গেলে লক্ষ করেছি উত্তরবঙ্গ সংবাদ সাবালক হয়ে গেছে। এখন তো আধুনিক যন্ত্রের কল্যাণে কলকাতার কাগজগুলো ভোরের ডুয়ার্সে পৌঁছে গেছে। তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে যায়নি উত্তরবঙ্গ সংবাদ। আমার এক সাহিত্যরসিক দাদা অনুপ ঘোষ নিয়মিত রাখতেন কাগজটা। জলপাইগুড়ির পাহাড়ি পাড়ায় তাঁর বাড়িতে আড্ডা মারতে গিয়ে দেখতাম টেবিলের উপর রাখা দুটি কাগজের মধ্যে ওটা রয়েছে। অনুপদা বলতেন, ‘আচ্ছা তুমি উত্তরবঙ্গ সংবাদে লেখ না কেন? ওরা চায় না, নাকি পারিশ্রমিক কম দেয় বলে লেখ না।’

হেসে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়েছিলাম।

কিন্তু যত বয়স বাড়তে লাগল, তত উত্তরবঙ্গ সংবাদ আমাকে টানতে লাগল। একবার গয়েরকাটার সুব্রত পালকে নিয়ে প্রায় জঙ্গলের গায়ে আংরাভাসা নদীর পাশে একটা জমি কিনতে গিয়েছিলাম, যেখানে বাকি জীবনটা চুপচাপ থাকব।

যা হোক, দীর্ঘকাল পরে প্রস্তাব এল এই কাগজে আমি ইচ্ছেমতো বিষয়ে খোলাখুলি লিখতে পারি। খুব ভালো লাগল। কলকাতার দুটি কাগজে নিয়মিত কলম লিখতে হয়। কিন্তু এই কাগজের পাঠক যাঁরা তাঁরা উত্তরবঙ্গে থাকেন, আমি যে রাস্তায় আশৈশব হেঁটে এসেছি সেই রাস্তায় হাঁটেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্যে আমি সুহাসবাবুর উত্তরসূরিদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আমার একটি ডাকনাম আছে। সেই নাম ডাকার মানুষ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। মালদার মাসিমাই বোধহয় একমাত্র বয়স্ক আত্মীয় যিনি ওই নামে ডাকেন। ৫৩ বছর ধরে কলকাতায় আছি। পরিচিত মানুষের সংখ্যা আর হিসেবে নেই। তাদের কাছে আমি সমরেশ বা সমরেশদা। এঁদের মুখে ডাকনাম শোনার কথাও নয়। কিন্তু যেই আমি জলপাইগুড়িতে পা রাখি অমনি কেউ না কেউ চেঁচিয়ে বলে, ‘আরে বাবলু, করে আসলি?’ এখনও কথাটা কানে গেলে বুক জুড়িয়ে যায়। যদিও কাউকে আজ অভ্যেসে বলি, আমি জলপাইগুড়ির ছেলে, তখন তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে। আমায় আর ছেলে বলার বয়স নেই। আমি এখন পূর্ণবয়স্ক লোক। ঠিক হ্যায় ভাই, কলকাতার লোক, কিন্তু নর্থ বেঙ্গলে পা দিলেই যে মনে মনে ছেলে হয়ে যাই।

বহু বছর আগে তিরিশ তো বটেই বাড়ির কাজের লোক এসে জানাল, ‘তোমার সঙ্গে কারা যেন দেখা করতে এসেছে। বসতে বলেছি’। আমি গম্ভীর হয়ে তাকাতেই সে বলল, ‘নর্থ বেঙ্গলের লোক, শিলিগুড়ির’। তাড়াতাড়ি নীচে নামলাম, দেখি বসার ঘরে তিনজন যুবক বসে আছে। যুবক না বলে তরুণ বলাই ভালো। প্রণাম করতে চেয়েছিল, আপত্তি শুনল।’

জিজ্ঞাসা করলাম ‘বলুন কী করতে পারি?’

–‘আপনি বলবেন না, আমরা শিলিগুড়িতে থাকি, শিলিগুড়ি কলেজে পড়ি। আপনার লেখা পড়ে বড়ো হয়েছি।’ একজন বিনীত ভঙ্গিতে জানাল।

আমি তাকালাম। আমাদের নর্থ বেঙ্গলের ছেলেদের চেহারা যেরকম হয়। তবে একজন একটু আলাদা। রোগা, ধীরে ধীরে কথা বলে।

জানলাম, ওরা ছাত্র হলেও নানান অনুষ্ঠান করে। এবার ওদের বাসনা একটি চলচ্চিত্র উৎসব করার। মেঘদূত সিনেমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এসেছে। আমি যদি ছবিগুলির নির্বাচন এবং প্রদর্শনের ব্যবস্থা করে দিই সেই আশায় ওরা এসেছে। রোগা ছেলেটি বলল, ‘আপনি তো দেশ পত্রিকায় চলচ্চিত্র সমালোচনা করেন, তাই ভাবলাম উদ্যোগ নিলে ব্যাপারটা সম্ভব হতে পারে।’

দেখলাম দুজন কথা বলছে আমাদের উত্তরবঙ্গীয় বাঙালির উচ্চারণে। ‘করে আসলি, যাস কই’, ধরনের। রোগা ছেলেটি চেষ্টা করছে স্বাভাবিক বাংলা বলতে। আমি ততক্ষণে কাত হয়ে গেছি। নর্থ বেঙ্গলে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল করতেই হবে। যোগাযোগ করতে বললাম প্রযোজক, পরিবেশক, পরিচালকের সঙ্গে। ওরা কয়েকদিন ছিল কলকাতায়। ফিরে গিয়ে আবার এল পাকা কথা বলার জন্য। ‘দৌড়ে’র পরিচালক শঙ্কর ভট্টাচার্য, বিখ্যাত অভিনেত্রী সুপ্রিয়া দেবী এবং আমাকে নিয়ে গেল উদ্বোধনের দিনে। গেলাম ট্রেনে, হইহই করে উৎসব শুরু হল। আমার আশঙ্কা হত ওদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে না তো! রোগা ছেলেটি আশ্বস্ত করত, ‘না, না হচ্ছে না’।

পরপর দু-তিন বছর ওরা উৎসব করেছিল মনে পড়ছে। সেই রোগা ছেলেটি আমার ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল। কলেজ থেকে বেরিয়ে এসে আইন পাশ করল। কলেজে সে কংগ্রেস ইউনিয়ন করত। কিন্তু কখনই রাজনীতি নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেনি। ওর বন্ধুরাও তাই। আমি খোঁজ রাখতাম।

কর্মক্ষেত্রে ওর বন্ধুরা কেউ ট্যাক্সির মালিক, কেউ ব্যাবসাদার। মাঝে মাঝে তাদের আন্তরিক ফোন পাই। কিন্তু রোগা ছেলেটির সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। জানতাম সে কংগ্রেস দলের নেতৃস্থানীয়, হঠাৎ শুনলাম সে তৃণমূলে যোগ দিয়েছে। তারপর তো পৃথিবীর দ্রুতগামী গাড়ির গতিকে ছাড়িয়ে ওপরে উঠতে উঠতে এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উত্তরবঙ্গ মন্ত্রী। একবার কী দু-বার ফোনে কথা হয়েছিল। একঝলক দেখেছিলাম শিলিগুড়ির একটি হোটেল উদ্বোধনের সন্ধ্যায়। উত্তরবঙ্গে সে প্রতিবছর অনেক ভালোলাগা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। শুনে আনন্দ হয়। সম্ভবত আমাকে সে কলকাতার মানুষ মনে করে। দিনকয়েক আগে ওর বিগত বন্ধুদের একজন ফোন করল। তার গলায় আগেকার সেই উত্তাপ একইভাবে রয়ে গেছে, গৌতমের হয়তো নেই। জীবন কেন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে। মানুষের ক্ষেত্রেও একই কথা। পরিবর্তন মেনে নেওয়া উচিত।

আমি কলকাতায় একরকম, কিন্তু নর্থ বেঙ্গলে পা দিলে কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যাই। জেনেশুনে নয়, অজান্তেই। ছেলেবেলার বন্ধু, পরে মুদির দোকানের মালিক বিকাশের সঙ্গে দেখা হলে সে পকেট থেকে সস্তার সিগারেট বের করে যখন বলে, ‘এটা খেতে পারবি তো—’ তখন গায়েরকাটা -বীরপাড়ার রাস্তায় আংরাভাসা ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে আমি স্বচ্ছন্দে সেটা নিয়ে বলি, ‘খুব হাওয়া, ধরাতে পারবি?’

এই আমার জায়গাগুলোতেও কর মান অভিমান। জলপাইগুড়ির লোক শিলিগুড়ির মানুষকে এককালে তির্যক কথা বলত! কেন? এই কলমে আমার যাবতীয় অভিজ্ঞতা এবং অনুভুতি পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *