৪০
ছেষট্টি বছর চলে গিয়েছে কিন্তু এখনও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মনের পরিবর্তন কতটা হয়েছে তা নিয়ে আর যার যাই হোক, আমার কোনও সন্দেহ নেই। বাজারে দরাদরি করে, যে বঙ্গসন্তানটি মাছ কিনছেন, তাঁকে ফাঁক পেলে পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে জবাব পাবেন, ‘কেন? কথা শুনে বুঝতে পারছেন না যে আমি বাঙালি?’
‘আপনি বাঙালি তা বুঝতে পারছি, কোথাকার বাঙালি?’
‘ও। না না। আমার পূর্বপুরুষরা কেউ ওপার বাংলায় ছিল না। আমি পশ্চিমবাংলার বাঙালি।’ ভদ্রলোক মাথা নেড়ে চলে যাবেন।
কলকাতা কেন, বহরমপুরের বাসস্ট্যান্ডে, শিলিগুড়ির এয়ারভিউ হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে দশজন বঙ্গসন্তানকে ওই প্রশ্নটা করলে, নয়জনই প্রথমে বলবেন তিনি বাঙালি। তারপর যোগ করবেন, দেশ ছিল বরিশালে। আমি জন্মেছি এই পশ্চিমবঙ্গে, তাই আমি এখানকার বাঙালি। বাংলাদেশি নই।
বাঙালির জিভে ‘আমি বাঙালি’ ছাড়া চট করে অন্য শব্দ আসে না। কলকাতা থেকে কোচবিহারের মানুষ বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে এই অর্ধসত্য বললে যেভাবে নেওয়া যায়, বিদেশে গিয়ে তা মেনে নিতে অসুবিধে হয়। বছর দশেক আগে নিউ ইয়র্কে যাওয়ার সময় দুবাই বিমানবন্দরে একটি তরুণ বঙ্গসন্তানের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সে ওইবারই প্রথম বিদেশে যাচ্ছে চাকরি-সুত্রে। বেশ উত্তেজিত হয়ে ছিল। কেনেডি এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে বিশাল লাইন, ছেলেটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে। মাঝে-মাঝেই আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, ‘এদের ইংরেজি উচ্চারণ বুঝতে পারব তো?’ অভয় দিয়ে বললাম, ‘নিশ্চয়ই পারবে। মন দিয়ে শুনবে।’
ছেলেটিকে ডেকে ইমিগ্রেশন অফিসার এর পাসপোর্ট এবং ফর্ম পরীক্ষা করলেন। আমি কথা শোনার দূরত্বে দাঁড়িয়ে। অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইউ আর ফ্রম?’
ছেলেটি জবাব দিল, ‘ক্যালকাটা।’
‘ক্যালকাটা?’ অফিসার আবার পাসপোর্ট দেখলেন। ‘আর ইউ সিওর!’
‘ইয়েস স্যর,’ ক্যালকাটা, ক্যাপিটাল অফ ওয়েস্টবেঙ্গল।’
অফিসার ছেলেটিকে এক পাশে দাঁড়াতে বলে আমায় ডাকলেন। আমার পাসপোর্টে ছাপ পড়ার পর সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওর কথা বুঝতে পারেননি?’
‘না। ও এমন একটা দেশের নাম বলল যা পাসপোর্টে লেখা নেই।’
‘ও ভুল করেছে। ওয়েস্টবেঙ্গল হল ইন্ডিয়ার একটি অংশ। ছেলেটি ইন্ডিয়ান এবং ইন্ডিয়া থেকে এসেছে।’
অফিসার আবার ডাকলেন, ছেলেটিকে, ‘আর ইউ ইন্ডিয়ান?’
দ্রুত মাথা নাড়ল ছেলেটি। ইয়েস, ইয়েস স্যর।’
বাইরে বেরিয়ে এসে রুমালে কপালের ঘাম মুছে ছেলেটি বলেছিল, ‘কলকাতায় থাকতে কেউ নিজেকে ও ইন্ডিয়ান বলে না বলে, বলার অভ্যাস তৈরি হয়নি।’
এটাই সত্যি কথা। ছেষট্টি বছরেও অভ্যেসটা তৈরি হল না। তেলেঙ্গানা তৈরি হলে প্রতিবাদ ওঠে অন্ধ্রপ্রদেশ ভাঙা চলবে না। গোর্খাল্যান্ডের দাবি উঠলে বলা হয় বাংলাকে টুকরো হতে দেব না। কেউ বলেন না, ভারতবর্ষকে আর খণ্ড খণ্ড করতে দেব না। আমাদের মনেই থাকে না আমরা ভারতবর্ষের নাগরিক, সেটাই অন্যতম পরিচয়।
একটা সমীক্ষায় পড়ছিলাম, পশ্চিমবাংলায় কুড়ি শতাংশ মানুষের রেশন কার্ড নেই। ভোটার লিস্টে নাম তোলেননি-দের সংখ্যা অন্তত তিরিশ শতাংশ। আধার কার্ড তো আমারও নেই। আবেদন করে বসে আছি। কবে পাব জানি না, কিন্তু এগুলো একজন ভারতীয়ের সঠিক পরিচয়পত্র নয়। আপনি যদি একজন ভারতীয় হন তা হলে আপনার পাসপোর্ট থাকা দরকার। পশ্চিমবঙ্গে দশ শতাংশ লোকের পাসপোর্ট আছে কি না তাতে আমার সন্দেহ আছে। পাসপোর্টের প্রথম পাতায় ভারতের রাষ্ট্রপতির একটি নির্দেশ ছাপা থাকে। তাতে বলা হয়েছে ওই পাসপোর্টের মালিককে ভারতের রাষ্ট্রপতির আদেশ অনুযায়ী দেশের অভ্যন্তরে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কোনও ঝামেলা বা সমস্যা হলে প্রশাসন তাকে সবরকমের সহযোগিতা এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। অর্থাৎ দেশের মধ্যেও ওই ছোট্ট বইটি আপনাকে বিপুল সাহায্য করবে। কিন্তু মানুষের ধারণা বিদেশে যেতে গেলেই পাসপোর্ট দরকার। যার দার্জিলিং যাওয়া হয়নি সে কেন পয়সা খরচ করে পাসপোর্ট করবে?
ধাক্কা খেতে হয় যখন খবর আসে, ছেলে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে বস্টনের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এখনই তার পাশে যাওয়া দরকার। যাওয়া-আসার প্লেনের ভাড়া, ওখানে থাকার এবং অন্যান্য খরচ আপনি স্বচ্ছন্দে করতে পারেন কিন্তু যেতে হলে একটি পাসপোর্ট চাই। যেটা আপনার নেই। পাসপোর্ট করার কথা কখনওই চিন্তা করেননি। সব কাগজপত্র জোগাড় করে তৎকালে পাসপোর্ট পাওয়ার আবেদন করে দেখবেন অনেক কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। যদি আপনার পরিচিত কোনও আইএএস অথবা আইপিএস অফিসার আপনাকে প্রশংসাপত্র লিখে দেন তা হলে আপনি ভাগ্যবান। কয়েকদিন আগে ভারতের বস্তিবাসী ছেলেমেয়েদের একটি দল ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল খেলতে পোল্যান্ডে গিয়েছিল। কলকাতায় যে দুটি ছেলে সুযোগ পেয়েছিল তাদের পাসপোর্ট না থাকায় নির্বাচিত হয়েও যাওয়া আটকে গিয়েছিল। দুর্বার মহিলা সমিতি উদ্যোগী করে আইএএস, আইপিএস অফিসারদের কাছে তদ্বির করায় ওরা পাসপোর্ট পেয়েছিল। অথচ যে-কোনও নাগরিক যদি পাসপোর্টের আবেদন সাধারণ নিয়মে করেন তা হলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর হাতে পাসপোর্ট পেয়ে যাবেন। এটি তাঁর ভারতীয় হিসাবে পরিচয়পত্র এবং বিদেশে যাওয়ার হাতিয়ার। কিন্তু বাঙালিদের অদ্ভুত অনীহা থাকায় তাঁরা এ নিয়ে মাথা ঘামান না। অথচ কেরল বা পাঞ্জাবের মানুষদের পাসপোর্ট সঙ্গে রাখার একটা প্রবণতা দেখা যায়। বিদেশে এঁদের বিভিন্ন কাজে দেখতে পাই। যেসব অশিক্ষিত মানুষ এখানে বেকার হয়েছিলেন বিদেশে শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠাচ্ছেন, কেরলে এঁদের হার খুব বেশি। প্রতিবেশী বাংলাদেশে অন্তত পঞ্চাশভাগ মানুষের পাসপোর্ট আছে। তাঁদের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়াতে গিয়ে আনস্কিলড্ লেবারের কাজ করে দেশে টাকা পাঠান। বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়ের ওঁরা একটা বড় দায়িত্ব বহন করেন।
পাসপোর্টের একটি কলমে লেখা আছে ন্যাশনালিটি, ইন্ডিয়ান। এই ভারতীয়ত্ব বোধ তৈরি হওয়া অত্যন্ত জরুরি যা কি না পাসপোর্ট সাহায্য করে। বিদেশে অনেক রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ডে লেখা থাকে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট। ভিতরে ঢুকে দেখা যায় তার মালিক পাকিস্তানি। আমি কোনও ভারতীয়কে ভারতীয় রেস্টুরেন্ট চালাতে খুব কম দেখেছি। ভারতের নাম অন্য দেশের মানুষ ব্যবহার করে ব্যবসা করছে অথচ আমরা নির্লিপ্ত। আজকের কাগজে দেখলাম কলকাতার পাসপোর্ট অফিসের বড়কর্তা জানিয়েছেন, তাঁর অফিসের সামনে পাসপোর্ট মেলা হবে যাতে লোকে সহজে পাসপোর্ট পেতে পারেন। পৃথিবীর অন্য দেশের মানুষ এইরকম মেলার কথা শোনেনি।
৪১
সকালের কাগজে খবরটা পড়লাম। একজন বয়স্কা মহিলা প্রতি ভোরে যেমন মন্দিরে পুজো দিতে যান, কালও গিয়েছিলেন। ফেরার সময় শুনশান রাস্তায় দুটো মোটরবাইক চলে এল তাঁর দু’পাশে। তাদের চালকদের মুখ ভয়ঙ্কর হেলমেটের আড়ালে। ওরা হাত বাড়াল। একজন ভদ্রমহিলাকে শক্ত করে ধরে রাখল। অন্যজন তাঁর হার, দুল হ্যাঁচকা টানে খুলে বাইকের গতি বাড়িয়ে উধাও হয়ে গেল। ভদ্রমহিলা স্তম্ভিত। হুঁশ ফিরলে থানায় গেলেন। পুলিশ অফিসার আন্তরিক সহযোগিতা করলেন। অভিযোগ লিখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দেখুন তো, এদের কেউ কি না।’ স্থানীয় অপরাধীদের ছবি একের পর এক দেখালেন তিনি। কিন্তু ওই অমানুষদের মুখ ভদ্রমহিলার অচেনা। যারা ছিনতাই করেছিল তাদের মুখ তিনি দেখতে পাননি। পুলিশ অফিসার অনুরোধ করলেন, ‘আপনি মনে করার চেষ্টা করুন। ওদের মুখের বর্ণনা দিন।’
ভদ্রমহিলা সেই চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁর সামনে মাথা মুখ চিবুক ঢাকা হেলমেট। চোখ আর মুখের জায়গায় তিনটে গর্ত। ইংরেজি ছবির ঘোস্টদের মুখ যেমন হয়।
ঘোস্ট একটি কল্পিত ভয়ঙ্কর প্রেত যাকে নিয়ে অনেক গল্প বা ছবি তৈরি হয়েছে। পড়ার বা দেখার সময়টা বেশ কেটে যায়। কিন্তু গত তিন বছরে কলকাতার রাস্তায় যেভাবে মিনি ঘোস্টের প্রতাপ বাড়ছে তা নিয়ে কেউ এখনও মুখ খোলেনি।
অল্পবয়সে গোটা পাড়ায় এক বা দু’জন- মোটরবাইক রাখতেন। হালকা বাইকটির নাম ছিল রয়্যাল এনফিল্ড। ভারীটির নাম বুলেট। তখন বুলেট চালাতেন বেশ শক্তিশালী আরোহী। ষাট-সত্তর সালে কলকাতার রাস্তায় এঁদের কদাচিৎ দেখা যেত। এল স্কুটার। একটি ইংরেজি ছবির দৌলতে তার প্রচার হল ব্যাপক। কিন্তু স্কুটার মানুষের প্রয়োজন মেটাত একটু দূরের বাজারে যাওয়া, বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনা এবং পৌঁছে দেওয়ার কাজে সাইকেলের বিকল্প হিসাবে কেউ কেউ ব্যবহার করতেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা শতকরা একের বেশি নয়। আমাদের জীবনযাপনে স্কুটার কখনওই সমস্যা তৈরি করেনি। কিন্তু লক্ষ্য করলাম স্কুটারের ব্যবহার একটু-একটু করে কমছে।
.
গিরিশ পার্কের লাল আলোয় সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এ আমার গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। বাঁ পাশের মিনিবাসের সঙ্গে সামান্য ব্যবধান। একটা সাইকেল সোজা চালানো যেতে পারে। হঠাৎ গর্জন কানে এল। প্রথমে মিনিবাসের গায়ে, পরেই আমার গাড়ির দরজায় ঘষটানি খেতে-খেতে একটা মোটরবাইক প্রায় আছড়ে পড়তে পড়তে সোজা হল সামনে। বছর কুড়ির ছেলেটির মুখ ঢেকে গিয়েছে হেলমেট। তড়িৎ গতিতে সে বাইক নিয়ে উধাও হয়ে গেল বিবেকানন্দ রোড ধরে। মিনিবাসের ড্রাইভার তার জানা যাবতীয় অশ্লীল শব্দ উগরে দিচ্ছে। নেমে দেখলাম যেখানে যাচ্ছিলাম সেখানে না গিয়ে এখনই গ্যারাজে যেতে হবে। ট্রাফিক সার্জেন্টকে ডেকে দেখালাম ক্ষতচিহ্ন। তিনি সবিনয়ে বললেন, ‘আপনি থানায় গিয়ে ডায়েরি করুন। যদিও ছেলেটাকে ধরা যাবে না। নাম্বার দেখেছেন?’
‘এত দ্রুত চলে গেল, সুযোগ পাইনি।’
‘পেলেও লাভ হত না। হয়তো ওই নাম্বারের অস্তিত্বই নেই।’
‘আপনারা অ্যাকশন নিচ্ছেন না কেন?
‘কার বিরুদ্ধে নেব? এখন রাস্তায় গাড়ির আগে থাকে বাইক।’
সার্জেন্ট আর সময় নষ্ট করেননি। গ্যারাজে গিয়ে জানলাম সাড়ে চার হাজার খরচ করতে হবে। ইন্সুরেন্স আছে, কিছু পাব, সবটা নয়। সেটা ডায়েরি না করলেও পাওয়া যাবে। তা হলে আমি থানায় গিয়ে কী করব? একটা বাইক আমার গাড়িকে ক্ষতবিক্ষত করেছে যার নাম্বার জানি না, চালকের মুখ দেখিনি। পুলিশ কি করতে পারে এই ক্ষেত্রে।
গত তিন বছরে রাস্তা থেকে স্কুটার প্রায় উধাও, কিন্তু প্রতিদিন বাইকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিদেশি শিল্পপতির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাইক তৈরির কারখানা করতে চেয়েছিলেন। নাম দিয়েছিলেন অর্জুন। আমি আতঙ্কিত হয়েছিলাম। কারখানাটা হয়নি কিন্তু ব্যাঙ্ক লোনের কল্যাণে হাজার হাজার তরুণ বাইক কিনে ফেলেছে। রাস্তায় তারা বাইক চালাচ্ছে বেপরোয়াভাবে। আগে তারা একটা ধার দিয়ে যেত, এখন বুক ফুলিয়ে মাঝখান দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটছে। পেছনের গাড়িগুলোর হর্ন তাদের কানে ঢুকছে না। লক্ষ করেছি এদের অনেকেরই কানে গানের তার গোঁজা। এদের কোনও হুঁশ নেই। কিন্তু পিছনের ড্রাইভাররা ব্রেকে পা রেখে তটস্থ হয়ে থাকেন, লাগলেই তো বাইক উড়ে যাবে। সামান্য ফাঁক পেলেই এদের বাইক রাস্তা তৈরি করে নেয়। বেশির ভাগের বয়স তিরিশের মধ্যে। যে সব বাবা-মা এই ছেলেদের বাইক কেনার টাকা দেন তাঁরা একবারও ভাবেন না বাইকসমেত ছেলে বাড়িতে নাও ফিরে আসতে পারে। বাইকে বসে ইঞ্জিন চালু করলেই কি মনে বেপরোয়া ভাব চলে আসে? জীবনের যাবতীয় হতাশাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার জন্যেই কি ওই গতির ঝড় তোলা?
পুলিশের একজন কর্তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ‘আগের আমলে পার্টির কৃপায় ক্যাডাররা বাইক পেত। ওই বাইকের জন্য ক্যাডাররা অনুগত থাকত। এই আমলেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বেড়ে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গের এমন কোনও স্থান নেই যেখানে বাইকবাহিনী দেখতে পাবেন না। যে-কোনও মিছিলের সামনে তারা বুক ফুলিয়ে চলে। এই বাইকবাহিনীর অত্যাচার বন্ধ করতে গেলে বিপদে পড়তে হবে। এদের পিছনে দাদারা আছেন।’
গ্রামে দাদারা থাকতে পারেন। ভাইরা বাইকে চেপে নির্দিষ্ট লোককে গুলি করে এলে তাঁরা স্নেহের ছাতি ধরছেন। কিন্তু শহরে? এই কলকাতায়?
পুজোর সময় রাস্তার যা অবস্থা তাতে আঁতকে উঠতে হয়। গাড়ির সংখ্যা রোজ বাড়ছে। বাড়ছে বাইকও। সরকার অন্ধ হয়ে নতুন গাড়ির ছাড়পত্র দিচ্ছে। এত গাড়ি এবং বাইকের জন্যে কলকাতার রাস্তা প্রশস্ত নয় জেনেও সংযত হচ্ছে না।
লাল আলোয় দাঁড়িয়েছিলাম। পাশের বাইকে হেলমেট পরা চালক। পিছনে সাত বছরের স্কুল-ফেরত বালক। যার মাথায় হেলমেট নেই। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওকে হেলমেট পরাননি কেন?’ উত্তর এল, ‘নেই, তাই।’ শ করে বেরিয়ে গেল বাইক। রাস্তায় রেলিং-এ আটকানো বোর্ডের কবিতা মনে পড়ল, বাবার মাথা দামী বলে হেলমেট, শিশুর তো দামি নয়। কী দরকার! গাড়ি চালাচ্ছে হেলমেটধারী, পেছনে খালি মাথায় বউ ছেলে-মেয়ে। চমৎকার। খিদিরপুর, রাজাবাজার ইত্যাদি এলাকায় হেলমেটের ব্যবহার নেই। কেউ তোয়াক্কা করে না। আইন আছে, ব্যবহার না করলে জরিমানা দিতে হবে। কে মানে আইন?
বাইক ছুটছে। চালকের কাঁধে চিবুক রেখে যিনি বসে আছেন পিছনের আসনে তাঁর খোলা চুল বাতাসে উড়ছে। এই পথ যদি না শেষ হয় ভঙ্গি। চমৎকার।
এভাবে চালালে যে-কোনও দিন ওরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে না। গানের লাইনটাই সত্যি হয়ে যাবে।
৪২
কলেজ শেষ করে আমরা কয়েকজন নাটকের দল খুলেছিলাম। লেখালিখির ভূত তখনও জন্মায়নি। বেশ ছিলাম। তখন সংলাপ মুখস্থ হয়ে যেত আড়াই দিনে। রিহার্সাল দিতে দিতে মনে গেঁথে যেত। সেসময় আমাদের একটা খেলা ছিল। রিহার্সালের বাইরে আড্ডা দিতে দিতে আমাদের একজন নাটকের যে-কোনও দৃশ্যের যে-কোনও চরিত্রের সংলাপ বলতাম, পরের সংলাপ ঠিকঠাক শোনাটাই স্বাভাবিক ছিল।
তারপর নাটক ছেড়ে লেখার ভূতটাকে কাঁধে নিয়ে প্রায় চারদশক কাটিয়ে দিলাম। গল্প বা উপন্যাস লিখতে লিখতে অভিনেতা দুলাল লাহিড়ীর অনুরোধে তিনদিনে নাটক লিখে ফেললাম। সিরিও কমিক। দুলাল খুব খুশি। ওর কাছে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে নাটক নিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ ছিল। সাত চরিত্রের নাটক। সপ্তম চরিত্রটিকে মাত্র দুবার দেখা যাবে। গোটা বারো সংলাপ। দলটিও বেশ মজবুত। প্রয়াত সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁকে ছাড়া নহবত নাটক ভাবা যায় না, রঞ্জিত মল্লিক, দুলাল, শকুন্তলা বড়ুয়ার মতো বিখ্যাত অভিনেতারা রিহার্সাল শুরু করলেন। প্রথমদিকে আমি রিহার্সালে যেতাম না। হঠাৎ সত্যদা আমাকে অনুরোধ করলেন রিহার্সালে যেতে। গেলাম। গিয়ে শুনলাম বিদেশের উদ্যোক্তারা নাটক দলের সদস্যদের সংখ্যা ছয়ে রাখতে চান কিন্তু নাট্যকার হিসাবে আমি যদি যাই তা হলে এঁরা সাতজনের দায়িত্ব নেবেন। সত্যদা জানালেন, ‘তুমি চলো ভাই আমাদের সঙ্গে ওই ছোট চরিত্রটিতে অভিনয় করে দাও।’
চরিত্রটি একজন উকিলের, যার বয়স আমি উল্লেখ করিনি। কিন্তু প্রস্তাব শুনে চমকে উঠলাম। তীব্র আপত্তি জানালাম। আমার দ্বারা আর অভিনয় করা সম্ভব নয়। সত্যদা বোঝালেন, ‘তোমার কোনও ভয় নেই ভাই, সংলাপ তো তোমারই লেখা, মঞ্চে এসে গড় গড় করে বলে যাবে। উকিল হিসাবে তোমাকে বেশ মানাবে।
রঞ্জিতও আমাকে উৎসাহ দিলেন। কিন্তু অত বিখ্যাত অভিনেতাদের সঙ্গে অভিনয় করতে পারব কি না তাতে নিজের সন্দেহ ছিল। সত্যদা বললেন, ‘নো প্রব্লেম। বেলার সঙ্গে আমার সংলাপ বেশি। আমি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকব, ভুলচুক হলে ঠিক সামলে নেব। তুমি আর না বোলো না বাপু।’
গিলতে বাধ্য হলাম।
তারপর শুরু হল নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। প্রথমদিকে সংলাপ শুনে উগরে দিতে অসুবিধে হচ্ছিল না। কিন্তু সেটা বন্ধ হতেই সংলাপ গুলিয়ে যাচ্ছিল। কিছুতেই পরের সংলাপ মনে রাখতে পারছিলাম না। সাইকেল চালানো, সাঁতার একবার শিখলে জীবনভর ভোলা যায় না। কিন্তু এই ব্যাপারটা সংলাপ মুখস্থ রাখার ক্ষেত্রে খাটে না তা জানলাম। অথচ সংলাপগুলি তো আমিই লিখেছিলাম। সত্যদা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে আমাকে সাহায্য করছিলেন। ধরা যাক, আমার সংলাপ ছিল, ‘কাল সকাল দশটায় আপনি আমাদের অফিসে অবশ্যই আসবেন।’ আমি হাতড়াচ্ছি দেখে ঝটপট সত্যদা বললেন, ‘হ্যাঁ বলুন, কখন যেতে হবে?’ সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যাওয়ায় আমি আমার সংলাপ বলতে পারলাম! রঞ্জিত মল্লিক বললেন, ‘হয়ে যাবে। একসময় আপনি নাটক করতেন বলে শুনেছি। অনভ্যাসে একটু অসুবিধে হতেই পারে, কদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। ভাল হচ্ছে, বেশ ভাল।’
বিদেশে যাওয়ার আগে একটা ক্লোজডোর শো করা হল। নাটক দেখে সবাই খুশি এবং আশ্চর্য ব্যাপার, আমার সংলাপ ঠিকঠাক ছিল। ফলে আমার নিজের উপর আস্থা বেড়ে গেল। আমরা রওনা হলাম নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে।
নিউ ইয়র্ক এয়ারপোর্টে এক ডলার গার্ড ফেললে তবেই মাল বইবার ট্রলি পাওয়া যায়। আমরা সবাই যখন সেইভাবে ট্রলি নিচ্ছি তখন সত্যদা বেঁকে বসলেন। বললেন, ‘আমাদের গরিব দেশে যখন বিনা পয়সায় ট্রলি পাওয়া যায় তখন এখানে এসে কেন পয়সা দিয়ে ট্রলি নেব। আমি নেব না।’ বুঝিয়েও যখন কাজ হল না তখন আমরা ঠিক করলাম ওঁর মালপত্র আমরাই আমাদের ট্রলিতে ভাগাভাগি করে নেব। বেল্ট থেকে মালপত্র নামাতে গিয়ে দেখা গেল সত্যদার বড় চামড়ার ব্যাগটা ফেটে গিয়েছে, জামাকাপড় দেখা যাচ্ছে। সত্যদা চেঁচামেচি শুরু করলে বিমান কর্তৃপক্ষ তাঁকে ওই সাইজের একটি নতুন স্যুটকেশ পাল্টে দিল। সত্যদা আনন্দিত। বললেন, ‘এইটে ভাল হল। আমার স্যুটকেসটা খুব পুরনো হয়ে গিয়েছিল।’
বিদেশের প্রথম শো-তেই ঘটনাটা ঘটল। নাটক বেশ চলছিল। আমিও মঞ্চে যাওয়ার পরে প্রথম দুটো সংলাপ ঠিকঠাক বললাম। কিন্তু পরের সংলাপ গুলিয়ে যেতেই পাশ থেকে সত্যদার গলা কানে এল, ‘মার…।’ সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনি কিছু বললেন। যা বললেন তা জোরে বলুন যাতে সবাই শুনতে পায়।’ সত্যদা বিন্দুমাত্র ঘাবড়ে না গিয়ে বললেন, ‘আপনি সত্যিকারের উকিল। ঠোঁট নাড়লেই সংলাপ বুঝতে পারেন। ওই যে কখন যেন যেতে হবে—!’ আমি বাকি সংলাপ বললাম।
সাজঘরে এসে সত্যদা বললেন, ‘তুমি তো ভাই ডেঞ্জারাস ছেলে–!’
বললাম, ‘আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন, সাহায্য করবেন।’
সত্যদা বললেন, ‘সাহায্য শুধু মিত্রভাবে না, শত্রুভাবেও করা যায়। হামাগুড়ি দেওয়া শিশুকে মা মাঝে মাঝে একা হাঁটতে দেয়। তাই না?’
৪৩
ষাটের দশকের মাঝামাঝি কিছু মাস কেটেছিল নিয়মভাঙার খেলা খেলে। থাকার জায়গা ছিল বাসব দত্ত লেনের একচিলতে ঘরে, খাওয়া-দাওয়া যত্রতত্র। বাড়িওয়ালির নির্দেশ ছিল রাত এগারোটা বেজে গেলে ঘরে না ফিরতে, মূল দরজা খোলা হবে না। অনেক তাড়াহুড়ো করে বীণা সিনেমার সামনে বাস থেকে নেমে যখন দেখছি সোয়া এগারোটা বেজে গিয়েছে, দরজা খোলা হবে না, তখন কোনওরকমে হাজির হয়েছি পার্ক সার্কাস কবরখানায়। সেখানে আমার কিছু দামাল বন্ধু টিনের ছাদওয়ালা বাখারির ঘরে রাত কাটাত। ওইরকম একটা সময়ে নিশিয়ামার সঙ্গে আমার পরিচয়। জাপানের ছেলে নিশিয়ামা কলকাতায় এসেছে কোনও একটা প্রোজেক্টে-এ মাস তিনেকের চাকরি নিয়ে। ইংরেজি বলত ভাঙা ভাঙা, যা বুঝতে সুবিধে হত আমার। একত্রিশে ডিসেম্বর কলকাতায় তখন শীত পড়ত। সেই নিউইয়ার্স ইভ সে আমার সঙ্গে কাটাবে বলে জানাল। সন্ধেবেলা তাকে নিয়ে গেলাম কবরখানায়। চারপাশের পৃথিবীটা ঝুম হয়ে আছে। শিশির পড়ছে টুপটাপ। সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে সঙ্গত করে নিশিয়ামা বলল,’চল এখান থেকে যাই। মনে হচ্ছে কবরের ভিতর যারা শুয়ে আছে তারা খুব কষ্ট পাচ্ছে।’
‘কেন মনে হচ্ছে?’
‘বাঃ, আজ ওরা আনন্দ করতে পারছে না যে।’
সেখান থেকে চলে এলাম ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের এক বড় পানশালায়, যেখানে নাবিকরা এসে জোটে। হুল্লোড়, নাচ গান যখন তুঙ্গে নিশিয়ামা বলল, ‘চল বেরিয়ে পড়ি।’ বেরিয়ে একটা টাঙা ভাড়া করল সে। তারপর সেই টাঙায় ময়দানের চারপাশে চক্কর মারলাম অনেকক্ষণ ধরে। সে সময়ের পুলিশ আজকের মতো সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়নি। ময়দানের আকাশে সে রাতে মেঘ ছিল না। প্রচণ্ড ঠান্ডা সত্ত্বেও রাতের নির্জনতাকে উপভোগ করেছিলাম চুটিয়ে। আড়াইটে নাগাদ আমরা ফিরে গেলাম ওর হোটেলে। সদর স্ট্রিটের একটা মাঝারি হোটেলে থাকত নিশিয়ামা। নেমে বলল, ‘চল’।
তখন একটু অবসাদ ছড়িয়েছিল শরীরে, বললাম, ‘কোথায়?’
‘এমন একটা জায়গায় নিয়ে চল যেখানে জল আছে আদিগন্ত, যেখানে সূর্য ওঠে রাজার মতো।’
ভাবলাম গঙ্গার ধারে গেলে ওপারটা দেখা যায়। চলবে না। শেষে খেয়াল হল, ডায়মণ্ডহারবার ছাড়ালে ওইরকম জায়গা পাওয়া যেতে পারে। নিশিয়ামাকে বললে সে মাথা নেড়েছিল, ‘ইয়েস, ডায়মণ্ড, ম্যানেজার টোল্ড মি।’
আমি জানতাম না সে হোটেলের গাড়ি ঠিক করে রেখেছিল। সেই গাড়িতে চেপে রওনা হলাম তিনটে নাগাদ। তখন রাত জেগে জেগে ও চৌরঙ্গি পার্ক স্ট্রিট ঘুমাতে যায়নি। নিশিয়ামাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তুমি এরকম জায়গায় যেতে চাইছ কেন?’
ভাঙা ইংরেজিতে নিশিয়ামা আমাকে জানিয়েছিল, প্রতিবছর পয়লা জানুয়ারির ভোরে নদী বা সমুদ্রের ধারে গিয়ে সে প্রথম সূর্যের দর্শন করে। তার চিকন আলো শরীরে মাখে। যাতে সারাটা বছর সে সুস্থ থাকে সেই প্রার্থনা করে। সে খুব জোর দিয়ে বলল, আমাদের এই গ্রহ তৈরি হয়েছে সূর্যের শরীর ভেঙে। তারপর থেকে আমরা সূর্যের চারপাশে ঘুরেই চলেছি। সূর্যের আলো যদি না পেতাম তা হলে যে কী হত তা ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়। পয়লা জানুয়ারির ভোর তাই সে কৃতজ্ঞতার ভোর বলে মনে করে।
আমরা যখন ডায়মণ্ডহারবার পেরিয়ে সেই বিস্তৃত জলরাশির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তখনও পৃথিবীতে অন্ধকার। গাড়ি থেকে নেমে জালের ধারে গিয়ে নিশিয়ামা হাতজোড় করে কিছু শব্দ যা মন্ত্রের মতো মনে হয়েছিল, আউড়ে গেল। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আমি সিগারেট ধরালাম। এই জাপানি যুবক একজন ইঞ্জিনিয়ার। যে দেশ থেকে এসেছে তারা বিজ্ঞানচর্চায় আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। অথচ এই মুহূর্তে শুর সিল্যুয়েট হয়ে থাকা শরীর দেখে সেসব বোঝার উপায় নেই। তারপর আকাশ রং বদলাল। পূর্ব দিকে তিনি উদিত হলেন। জলের ওপর আলোর রেখা আঁকা হল। সেই বিশাল সূর্যের দিকে বছরের প্রথম দিকে তাকিয়ে কেমন যেন নাড়া খেলাম। বুক ভরে শ্বাস নিয়েছিলাম।
এই ভোর নিয়ে, সূর্য ওঠা নিয়ে কত কবিতা লেখা হয়েছে, গদ্যকারেরাও তত দার্শনিক কথা লিখতে কার্পণ্য করেনি। বাংলা গানেও ভোর নিয়ে চর্চা হয়েছিল। নতুন সূর্য জাগো প্রভাত হল। প্রতিদিন কি নতুন নতুন সূর্য জাগে? না প্রতিদিনের ভোরটা অন্যদিনের থেকে একটু আলাদা হয়? দ্বিতীয়টির কিছুটা সত্যি, যদি যে দেখেছে তার কল্পনাশক্তি প্রবল হয়, যখন ভোরে হাঁটতে যেতাম, তিস্তার পাড় ধরে যেখানে সূর্য উঠত সেখানে থেমে গিয়ে পিতামহের শেখানো ‘ওঁ জবাকুসুম…’ আবৃত্তি করতাম, তখন পৃথিবীটাকে যে চোখে দেখতাম, সেই দেখার সঙ্গে কলকাতার বাড়ির ছাদ থেকে সূর্য উদয়ের সময়টায় কোনও মিল খুঁজে পেতাম না। মনে আছে ঘনিষ্ঠ এক দাদার মৃতদেহ নিয়ে শ্মশানে যেতে হয়েছিল। সে সময় ইলেকট্রিক চুল্লির ব্যবস্থা ছিল না সেই শ্মশানে। মধ্যরাত্রে সেখানে পৌঁছে দাহের ব্যবস্থা করা, শোক সামলানো ইত্যাদি করতে করতে ভোর হয়ে আসছিল। দেহ যখন চিতায় তোলা হল তখন পাশের নদীর ওপারে গাছের ফাঁক গলে সূর্য দেখা দিল। সূর্যের কিরণ আর চিতার আগুন যেন একাকার হয়ে গেল। সেই ভোর হওয়ার সময় কেউ বলেছিল, ‘বড় ভাগ্যবান মানুষ, শুভ মুহূর্তে শরীরে আগুন পড়ল, যেন সূর্যদেব নিয়ে যেতে এলেন। আমি লোকটার মুখে অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। ওরকম ভয়ঙ্কর ভোরের স্মৃতি আজ পর্যন্ত ভুলতে পারিনি।
গোটা পৃথিবী জুড়েই তো সূর্য ওঠে। ভোর হয়। কোপেনহেগেন-এ যে সূর্যকে ভরদুপুরে দেখেছি যখন রাতদুপুর হওয়ার কথা তখনও সে সমান তেজি। জানলা বন্ধ করে পরদা টেনে তবে ঘুমের প্রার্থনা করতে হয়। ওখানে কি ভোর হয় না? জানতে পারলাম হয়। তবে রাত নামতে না নামতেই ভোরের প্রস্তুতি। আবার একটা সময় আসে রাত না যেতে যেতে শিশু ভোরকে গিলতে আসে রাত। ও ভোর আমার নয়, আমাদের নয়, তবু ও-দেশের কবি-লেখকরা ভোরের কথা লেখেন। এই ভোর মুক্তির ভোর। অনুমান করা হয় সেই আদিমকালে সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ত। অন্ধকার নামছে আর অন্ধকার মানে নিরাপত্তাহীনতা। তারপর যখন রাত শেষ হয়ে আলো ফুটত তখন তারা আনন্দে উত্তাল হত। ওই পূর্ব দিক আলোকিত করে ওঠা অগ্নিগোলকটির জন্যে তারা বেঁচে আছে এই বোধ থেকে নতজানু হত। সূর্য মানুষের প্রথম ঈশ্বর হয়ে গিয়েছিল। সেই আদিম মানুষগুলোর মানসিকতার পরিমার্জিত ভাবনা নিশিয়ামার মনে এখনও বেঁচে আছে।
শুনেছিলাম এবং জেনেছিলাম, পৃথিবীর যেসব জায়গা থেকে সূর্যোদয় পূর্ণরূপে দেখা যায় তার মধ্যে একটি হল সান্দাকফু। বছর তিরিশেক আগে সেখানে পৌঁছতে হাঁটাই একমাত্র উপায় ছিল। অভিজ্ঞরা বলেছিলেন সমতলের সূর্যোদয়ের সঙ্গে ওখানকার সূর্যোদয়ের আকাশ- পাতাল পার্থক্য। বাসনা হয়েছিল সেই দৃশ্য দেখার।
কয়েকজন বন্ধু হাজির হয়েছিল মানেভঞ্জন-এ। ওই অবদি বাস যেত। তারপর হাঁটাপথ। জানলাম খাবার ওখান থেকেই কিনে নিয়ে যেতে হবে। যে আমাদের মোটবাহক সে পথ যেমন চেনে তেমনই রান্নাও করে।
সারাদিন হেঁটে যখন টংলুতে পৌঁছলাম তখন শরীরের অবস্থা খুবই কাহিল। একটার পর একটা পাহাড় ভাঙতে ভাঙতে অনভ্যস্ত পা আর এগোতে চাইছিল না। সন্ধেও হয়ে এসেছিল। রাতটা সেখানেই কাটিয়ে পরদিন আবার পাহাড় ভেঙে সান্দাকফুতে পৌঁছলাম দুপুরের পর। গিয়ে দেখলাম চারপাশ কুয়াশার আড়ালে। কুয়াশা থাকলে সূর্য দেখব কী করে?
ঠান্ডা তখন জিরো ডিগ্রিতে নেমেছে। বাইরের কাচের ঘরে বসা যাচ্ছে না। ভিতরের ঘরের ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বেলেও শীত যাচ্ছিল না। রাত থাকতেই বৃষ্টি শুরু হল। ওই বৃষ্টি কুয়াশাদের ঝেঁটিয়ে দূর করে দিয়েছিল। সর্বাঙ্গ কাপড়ে মুড়ে রাত সাড়ে তিনটের সময় বাইরের ঘরে কাচের জানলার কাছে গিয়ে দেখলাম সেটা জলে ভিজে ঝাপসা হয়ে রয়েছে। ঠান্ডায় হাত অবশ হয়ে গেলেও ওটাকে পরিষ্কার করার পর শুধু ঘন অন্ধকার ছাড়া কিছু নজরে আসছিল না। কিন্তু মোটবাহক আমাদের জানিয়েছিল ওই সময় থেকে সূর্য ওঠা শুরু হয়। কিন্তু কোথায় সূর্য?
মিনিট দশেক বাদে আমাদের একজন দেখতে পেল একেবারে ডানদিকের আকাশের শেষে অন্ধকারের গায়ে একটা লাল ডট দেখা যাচ্ছে। ওটা কী বস্তু তা বুঝতে পারছিলাম না প্রথমে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই জট থেকে একটা লাল সরলরেখা অন্ধকার ভেদ করে এগোতে লাগল। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম রেখাটা আমাদের সামনে দিয়ে এগিয়ে গেল, গিয়ে থেমে গেল আচমকা। তারপর থেমে থামল কিছুক্ষণ। এবার লাল রঙ আরও তীব্র হতেই থেমে থাকা জায়গাটাকে দেখা গেল। লাল বরফের চূড়ো। ওটা যে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ো তা বুঝেও নিজের চোখকেই অবিশ্বাস করছিলাম। ধীরে ধীরে লাল রঙ পাল্টে গিয়ে সোনালি হয়ে গেল। দেখলাম পাহাড়ের বরফকে তখন সোনা বলে মনে হচ্ছে। এই সময় থেকে আলোর রেখা দ্রুত উঠে গিয়ে পৃথিবীর অন্ধকারকে পাতলা করে দিল। সূর্য জানান দিতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা একসময় হাড়-সাদা হয়ে গেল।
এইভাবে ভোর হওয়া আমি কখনও দেখিনি। তখন সামনের ঘাসে কুচি কুচি তুষারের ওপর লেবুপাতার আলো ছড়িয়েছে। বন্ধুদের একজন বলল, ‘এ যেন ঈশ্বর দর্শন, বল।’
তবু রাত শেষ হলে যেমন ভোর চাই তেমনি ভোর হওয়ায় জন্যে রাতটাও যে দরকার। ভোরে আলোয় রাতের গল্প করতে যে খুশি জাগে। চলে যাওয়া দিনগুলো মানেই তো রাতের অন্ধকারে ডুবে যাওয়া স্বপ্ন। কবি তুষার কান্তি রায় যাঁর বয়স এখন চল্লিশ, চমৎকার লাইন লিখেছেন-’সংসারী রোদে/কিছু আলাপী শিশির লেগে আছে, ফোঁটা ফোঁটা/উঠোনের একপাশে জবুথবু/শুয়ে থাকা সোনালি অঘ্রাগে/খুঁটে যায় চতুর চড়ুই।’
.
এই ভোর হওয়ার আগের যে সময় তা নাকি স্বপ্নের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছেলেবেলা থেকে মা-মাসিদের মুখে শুনে এসেছি ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। তখন ভাবতাম কোনও মানুষ রাত ন’টায় ঘুমাতে গিয়ে যেসব স্বপ্ন মাঝরাত পর্যন্ত দেখল সেগুলো মিথ্যে হয়ে গেল, কিন্তু এই ভোর ভোর সময়টার যে স্বপ্ন দেখল তা কী করে সত্যি হয়ে যাবে? কেউ যুক্তি দিয়ে বোঝাতে পারেনি আমাকে।
ইদানীং কেন, বহুকাল আমি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখি না। যা দেখি তা জেগে জেগে। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন হোস্টেলে থাকতে হত। খাওয়া-দাওয়া খুবই নিচু মানের ছিল। তখন যেসব ছেলে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখত তাদের বলা হত ওই খাবার খেয়ে পেট গরম হয়ে গিয়েছে। সাধারণত ওই সব স্বপ্ন দেখে ছেলেরা ভয় পেয়ে যেত। বর্ধমানের যে ছেলেটি মাঝরাত্রে স্বপ্ন দেখে ভয়ে কেঁদে উঠেছিল, উদ্বিগ্ন হয়ে তক্ষুনি বর্ধমান চলে গিয়েছিল, অনেক প্রশ্নের পরে জানা গিয়েছিল সে স্বপ্নে তার মা-কে মরে যেতে দেখেছে। আলো ফুটতেই সে ছুটে গিয়েছিল বর্ধমানে, ফিরে এসেছিল হাসিমুখে বিকেলে। সে তার মা-কে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় দেখে এসেছে। কিন্তু তারপর থেকে হোটেলের ঠাকুরের রান্না ঝাল ঝাল পোস্ত খাওয়া বন্ধ করেছিল ছেলেটি। তার ধারণা ওই পোস্ত খাওয়ার কারণেই সে খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। আবার আমার রুমমেট জগদীশ ইনস্টলমেন্টে স্বপ্ন দেখত। প্রথম রাত্রে দেখল সে নদীর ধার দিয়ে হাঁটছে। নদী পার হবে। হঠাৎ নৌকা এল সেখানে। জগদীশ দেখল তার বাবা নৌকো চালাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল তার। আমাকে জানিয়ে স্বপ্নের বিষয় বলে চিন্তায় পড়ল, বাবার কিছু হয়নি তো। এক গ্লাস জল খেয়ে সে আবার ঘুমিয়ে পড়তেই স্বপ্ন দেখল, ‘নৌকো চলছে বিশাল বিশাল ঢেউ পার হয়ে। তার পাশে বসে আছে বাবা-মা-ভাইবোন। নৌকো চালাচ্ছি আমি।’ পরের দিন জগদীশ কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাত থেকে একটা বই কিনে ফেলল। বইটার নাম ‘স্বপ্নফল কল্পদ্রুম’। কোন্ স্বপ্নের কী মানে তার অভিধান গোছের বই। জগদীশের আপশোশ, সে কখনও ভোরে স্বপ্ন দেখতে পায় না।
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমাদের এক সুন্দরী সহপাঠিনী ছেলেদের সঙ্গে কথা বলত না। তার চলাফেরায় এক ধরনের দাম্ভিকতা প্রকাশ পেত। কিন্তু ওই অহঙ্কারী সুন্দরীকে সবাই খুব পছন্দ করতাম। একদিন করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে ভ্রূ তুলে আমার দিকে তাকাল। পরে সুনীলদার লেখা ‘ভ্রূ-পল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে’ পড়ে মনে হয়েছিল সেই তাকানোটা ওইরকম ছিল।
মজার কথা হল, পরের ভোরে স্বপ্ন দেখলাম, কিন্তু সেই স্বপ্নে সে এসে গেল। আমার চোখের ওপর চোখ রেখে বলল, ‘এতদিন কোথায় ছিলে?’ তার চারপাশে গভীর জঙ্গল। অনেক উঁচুতে আকাশের নীল।
উত্তর দিতে গিয়ে তোতলা হয়ে গেলাম। বোধহয় সেই কারণেই ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড়িয়ে জানলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। কলকাতার আকাশে সূর্যকে মাঝে মাঝেই ঘষা আধুলির মতো দেখায়। বুঝলাম ভোর হচ্ছে। হৃদয়ের একূল-ওকূল দুকূল ভেসে গেল। ভোরের স্বপ্ন তো সত্যি হয়। দিন তিনেক না কামানো তরুণ গালের দাড়ি বেশি যত্নে কামাতে গিয়ে চোয়াল থেকে রক্ত ঝরালাম। সরিয়ে রাখা আমার সেরা শার্টটি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম সাত সকালে। সে যখন আশুতোষ বিল্ডিং-এর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসবে তখন সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেই তার গজদাঁত দেখতে পাব। নিশ্চয়ই তার চোখে বন্ধুর চাহনি থাকবে।
কিন্তু ক্লাসের প্রায় সব ছেলেমেয়ে চলে এল, সে এল না। সেদিন তো নয়ই, তার পরের দিনেও তার দেখা পেলাম না, শেষ পর্যন্ত এক সহপাঠিনীর কাছ থেকে জানা গেল সে আর কোনওদিনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবে না। তার বাবা দিল্লিতে বদলি হওয়ায় সপরিবারে সেখানে চলে গিয়েছে।
ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ব্যাপারটা বললে সে বোঝাল, ‘ভোরের স্বপ্ন মিথ্যে হত যদি তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরও সে উদাসীন থাকত। তা তো হয়নি। সে তো দেখা করার সুযোগই পেল না। যদি কোনওদিন দেখা হয়, দেখবে স্বপ্নটা সত্যি হয়ে গিয়েছে।’
বছর দুই আগের বইমেলায় একটি মিষ্টি মেয়ে আমার সামনে এসে হাসতেই তার গজদাঁত দেখতে পেলাম। মনে হল খুব চেনা চেনা। মেয়েটি বলল, ‘আপনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন বাংলা নিয়ে, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার মামাই, মানে আমার মায়ের মা আপনার সঙ্গে পড়তেন। মামাই এখন দিল্লিতে। আপনার সব বই ওঁর পড়া। মেয়েটি আবার হাসল।
এত বছর পরে আমি কল্পনা করতে চাইছিলাম না তাকে। কিন্তু সেই ভোর আর তখন দেখা স্বপ্নটা চলে এল সামনে।
৪৪
বছর বত্রিশ আগে সান্দাকফু গিয়েছিলাম। ঘুম থেকে সুখিয়াপোখরি হয়ে মানেভঞ্জন পর্যন্ত বাসে যাওয়া যেত। তারপর হাঁটতে হত। উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ ভেঙে থমকে দাঁড়াতে হত টংলুর কাছাকাছি গিয়ে। আকাশ আড়াল করা পাহাড় সামনে। মানেভঞ্জন থেকে যে মালবাহক আমার সঙ্গী হয়েছিল সে বলেছিল, ‘সাব, ওই পাহাড় সন্ধের মধ্যেই পেরিয়ে যেতে হবে, জোরে পা চালান।
শরীরে ক্লান্তি জমেছিল অনেকটা হেঁটে আসায়, ওর কথা শুনে সেটা বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ। কপাল ভালো বলে পুরো পাহাড় ডিঙোতে হয়নি। একটা ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত সরকারি অফিস পেয়ে গিয়েছিলাম রাত কাটানোর জন্যে। খবরটা দিয়েছিলেন যিনি, তিনি থাকেন মিনিট চল্লিশেক দূরে। আসার পথে সেখানকার একমাত্র রুটি-তরকারির দোকানে তাঁর সঙ্গে আলাপ। এককালে বনবিভাগে কাজ করতেন। এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন গ্রামের বাড়িতে। তখন আমার চোখে নেপালি, লেপচা, সিকিমিজরা একই চেহারার মানুষ বলে মনে হত। ভুটানিদের গড়ন যেহেতু একটু আলাদা তাই ওঁদের এই দলে ফেলতাম না। জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ায় আমাদের বাড়ির সামনে ফরেস্ট এবং পিডব্লিউডি
ডিপার্টমেন্টের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা ভাড়া থাকতেন। তাঁদের অধিকাংশই পাহাড়ের মানুষ।
সিন্টু নামের একটি কিশোরী খুব সেজেগুজে থাকত ওদের এক পরিবারে, আমার সঙ্গে সিনেমার নায়িকার মতো পোজ দিয়ে কথা বলত। আমি তাকে নেপালি বলেই ভাবতাম। একদিন সেটা জিজ্ঞাসা করলে সে ফোঁস করে উঠেছিল। বলেছিল, ‘আমি নেপালি হব কেন? আমি লেপচা’। তারপর থেকে সে আমাকে দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নিত।
ওই অবসর জীবন কাটানো ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি একজন লেপচা’।
‘কী করে আপনাকে একজন নেপালি থেকে আলাদা করে চিনব?’
‘তফাত নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আপনি চট করে ধরতে পারবেন না।’ কথাটা বলে বড়ো শ্বাস ফেলে ভদ্রলোক চারপাশের পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই দেশ আমাদের। আপনি খাবার খান, আমি গ্রামে যাচ্ছি। একটা লেখা পাঠিয়ে দেব, পড়ে দেখবেন।’
ভদ্রলোক চলে গেলেন। খাওয়া শেষ হতেই একটা বাচ্চা ছেলে ছুটে এসে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে চারপাতার টাইপ করা লেখা আমায় দিয়ে চলে গেল। টংলুর ভাঙা অফিসবাড়িতে মোমবাতি জ্বালিয়ে সেই লেখাটা পড়ে ফেললাম। ইংরেজি বাক্যে কোনো ভুল নেই কিন্তু আমার কিছু ভুল ভেঙে গেল।
পলাশীর যুদ্ধ জয় করে ইংরেজরা যখন একটু একটু করে দক্ষিণবঙ্গ দখল করে নদী পেরিয়ে উত্তরবঙ্গে পা রাখল, তখন সিকিম রাজ ও ভুটানের রাজা প্রবল বিক্রমে রাজত্ব করছেন। ভুটানের রাজত্ব তখন জলপাইগুড়ি জেলাতেও বিস্তৃত ছিল। এখনও সেখানে একটি জায়গা রয়েছে যার নাম ভোটপট্টি। ওপাশে ছিলেন কোচবিহারের রাজা। সিকিমের এদিকের পাহাড়টা ছিল লেপচাদের দখলে।
দুজন ইংরেজ পরিব্রাজক ঘুরতে ঘুরতে এই পাহাড়ে এসে দেখলেন এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইংল্যান্ডেও নেই। তাঁরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে জানালেন, অবিলম্বে এই পাহাড়ের দখল নিতে।
ইংরেজরা প্রথমে তাদের সীমিত শক্তি নিয়ে পাহাড় দখল করতে চেয়েছিল। কিন্তু লেপচারা শুধু তির-ধনুক নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ করে তাদের এমন নাস্তানাবুদ করল যে, তারা প্রায় কিশনগঞ্জের কাছে পিছিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করল। লেপচা যোদ্ধারা নেমে এসেছিল পাহাড়ের নীচে, ওদের পিছু ধাওয়া করে। শত্রু পালিয়েছে জেনে তারা আনন্দ উৎসব করতে লাগল। ইংরেজরা আবার শক্তি বাড়িয়ে আক্রমণে এলে লেপচা সেনাপতি চিৎকার করতে লাগলেন, ‘স্যালিগ্রি-স্যালিগ্রি’। শব্দটির অর্থ হল, ধনুকে ছিলা পরাও। অর্থাৎ যুদ্ধের জন্য তৈরি হও।
শব্দটি ইংরেজদের কানে পৌঁছোল, ‘শ্যালগিরি-শ্যালগিরি’-তে রূপান্তরিত হয়ে। এই শ্যালগিরি থেকেই জায়গাটার নাম হয়ে গেল শিলিগুড়ি।
পড়ে মজা লাগল। বাল্যকাল থেকে কতবার শিলিগুড়িতে গিয়েছি কিন্তু শিলিগুড়ি নামটি কীভাবে তৈরি হয়েছে তা নিয়ে কৌতূহল হয়নি। পরে অনেককে জিজ্ঞাসা করেছি। বাঙালিদের স্বভাব একমত না হওয়া। কেউ অন্য ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু স্যালিগ্রি থেকে শ্যালগিরি হয়ে শিলিগুড়ি আমার কাছে বেশ নাটকীয় মনে হয়েছে।
কার্সিয়াং-এ আমি প্রথম পা রেখেছিলাম উনিশ বছর বয়সে। তখন স্কটিশের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। সঙ্গী ছিল প্রয়াত লেখক, আমার সহপাঠী শৈবাল মিত্র। সেই যাওয়াটা মনে আছে। কারণ, আধঘণ্টা ট্রেনটা থেমে দার্জিলিং-এ যাবে শুনে একটি নেপালি রেস্টুরেন্টে ভাত খেতে গিয়ে থ্রি-এক্স রামের বোতলে তরল পদার্থকে রাম বলে ধরে নিয়ে বোকা বনেছিলাম। ওটায় ভিনিগার ছিল।
এখন কার্সিয়াং নামটি শুনলেই সেই দিনটা সামনে চলে আসে। এই কার্সিয়াং শব্দটির অর্থ কী? টংলুর ওই রাতে কাগজটি পড়ে জানতে পারলাম, মূল শব্দটি হল ‘খর্সং’। খর্সং মানে শুকতারা। লেপচা শব্দ। যেভাবে জানতাম, তা হঠাৎ বদলে গিয়ে জায়গাটা কী রকম সুন্দর হয়ে গেল!
কাগজটিতে লেখা ছিল, উঁচু পাহাড় বলে ঝড়বৃষ্টি হত প্রায়ই। বিদ্যুৎ চমকাত, বাজ পড়ত খুব। লেপচা ভাষায় বাজকে দোর্জলং বলা হয়। দোর্জলং থেকে দোর্জলিং, তা উচ্চারণে দাঁড়াল দার্জিলিং।
এই পাহাড়, পাহাড়ের জনপদগুলো যদি লেপচা অধ্যুষিত ছিল, তাহলে তারা সংখ্যালঘু হয়ে গেল কী করে। কাগজটিতে তার নানা কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
গ্রামের দিকে যে কারণটি দায়ী, তা হল বড়োভাই মারা গেলে যদি তার স্ত্রী সন্তান উৎপাদনে সক্ষম থাকেন তাহলে অবিবাহিত ছোটো ভাইদের একজনকে তাকে বিয়ে করতেই হবে। যাতে বিধবা জমির ভাগ নিয়ে অন্য সংসারে চলে যেতে না পারেন। সেই যাত্রায় এই রকম উদাহরণ আমি সান্দাকফুর আগে বিবেকভঞ্জনে দেখেছি।’
ইতিহাস বলে, বাইরের মানুষের ঢল সামলে ভূমিপুত্ররা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েন। প্রথমে দক্ষিণ বাংলা, পরে পূর্ব বাংলার মানুষের ঢেউ উত্তর বাংলার ভূমিপুত্রদের এই নিয়মেই পিছনে ফেলেছে।
আমেরিকান আদিবাসীদের পিছনে ফেলে দিয়েছে ইউরোপ থেকে আসা মানুষেরা। এই বিভাজন তাড়াতাড়ি দূর হোক, এটাই সুস্থ মানুষ আশা করবে। জল আর মাটির উপর অধিকার তাদেরই, যারা রক্ষণাবেক্ষণ করে আন্তরিকভাবে।