৩৫
এই দু’হাজার তেরোতে শুধু বিশ্বাসের উপর ব্যবসা চলছে, এবং সেই বিশ্বাসও একতরফা, অপরপক্ষ মিথ্যে বলছে কি না, তা যাচাই করার তেমন সুবিধা নেই, করতে গেলে সম্পর্ক ভেঙে যাবে, এমন ঘটনা শুধু লেখক-প্রকাশকদের ক্ষেত্রেই সম্ভব। একজন লেখক তাঁর ক্ষমতা অনুযায়ী যা লিখলেন, তা একজন প্রকাশক বই ছেপে বিক্রি করছেন। সেই বই যা বিক্রি হবে তার দামের দশ বা পনেরো শতাংশ প্রকাশক লেখককে দেবেন। কিন্তু কত বই ছাপা হচ্ছে, কত বই বিক্রি হচ্ছে, তা প্রকাশকের মুখে জানতে হবে লেখককে। জনপ্রিয় নন, যাঁদের বই কম বিক্রি হয়, তাঁদের প্রাপ্তিযোগ কী রকম তা অনুমান করা যেতে পারে। কিন্তু যাঁদের বই পাঠক পড়তে চান, তাঁদের চোখ, কান, মুখ বন্ধ করে নির্ভর করতে হয় প্রকাশকের উপর।
এই অসম ব্যবসা আমার পূর্বসূরিদের আমল থেকে চালু হয়েছিল। প্রথমদিকে না হলেও পরের দিকে সতর্ক হয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজের বিশ্বভারতী প্রকাশনীর মাধ্যমে সঠিক বিক্রির খবর পেতেন। শরৎচন্দ্র মূলত দু’জন প্রকাশকের উপর নির্ভরশীল ছিলেন এবং এই নির্ভরতার ভিত ছিল বিশ্বাস। শোনা যায়, নজরুল ইসলামের প্রকাশক ছিলেন ডি এন লাইব্রেরি। প্রায়ই তিনি অল্পস্বল্প টাকা প্রকাশকের কাছ থেকে ভাউচারে নিতেন। একদিন প্রকাশক বললেন, তাঁকে নজরুল ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থটির স্বত্ব লিখে দিয়েছেন ওই টাকার বিনিময়ে। এই নিয়ে মামলাও হয়েছিল। তারাশংকর, বিভূতিভূষণ অথবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ব্যাপারে গা-সওয়া ভাব দেখেছি। এঁদের কারও কারও উত্তরাধিকারী আক্ষেপ করেছেন তাঁদের সঠিক প্রাপ্য দেওয়া হচ্ছে না। তখন বেশিরভাগ লেখকই অন্য কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর লেখালেখি করতেন। বিচারক এবং ডাক্তার অন্নদাশংকর রায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, নীহারঞ্জন গুপ্তের কাছে লেখাটাই ছিল বড় কথা। প্রকাশকরা কী দিচ্ছেন তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। গল্প শুনেছি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঘাটশিলা থেকে হাওড়ায় নেমে হেঁটে কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকের কাছে জানিয়েছিলেন তাঁর খুব টাকার প্রয়োজন। ফেরার পথে নিয়ে যাবেন। প্রকাশক ভেবে পাচ্ছিলেন না, ঠিক কত টাকা লেখক চাইছেন। সেই পঁয়ষট্টি-সত্তর বছর আগে তিনি তিন হাজার টাকার ব্যবস্থা রাখলেন কিন্তু ফেরার পথে বিভূতিভূষণ জানান, তাঁর দরকার চল্লিশটা টাকা, তার বেশি তিনি নেবেন না। এইরকম মনের লেখকদের খুবই পছন্দ করতেন প্রকাশকরা। শুনেছি, শংকরদা, মণিশংকর মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগী হয়েছিলেন প্রকাশকদের ছাপা ও বিক্রির খবর রাখতে। বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে প্রকাশক তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। যদিও শংকরদা তখন বিশাল চাকুরে কিন্তু প্রকাশককে বাধ্য করতেন অত্যন্ত অল্প দামে বই বিক্রি করতে। সেটা অবশ্যই ইতিহাস।
কিন্তু লেখাকেই যিনি জীবিকা হিসাবে নিয়েছিলেন সেই সমরেশ বসুর পক্ষে সম্ভব হয়েছে আনন্দ পাবলিশার্সের কল্যাণে। কলেজ স্ট্রিটের কোনও প্রকাশক যখন লেখককে বিক্রির স্টেটমেন্ট লিখিতভাবে দিতেন না তখন আনন্দ সেটা দিতে শুরু করল। বই-এর টাইটেল পেজে মুদ্ৰণ সংখ্যা লিখে দিত। ফলত, তারাই একমাত্র ব্যতিক্রমী হয়ে গেল। কম্পিউটারের মাধ্যমে হিসাব রাখার চল শুরু করেন তাঁরাই। ভাবতে অবাক লাগে, এখনও কলেজ স্ট্রিটের অধিকাংশ প্রকাশকের ঘরে কম্পিউটার ঢোকেনি। সমরেশ বসু আমাকে বলেছিলেন, ‘যখন আমি থাকব না, তখন আমার ছেলেমেয়েরা আর কার কাছ থেকে কী পাবে জানি না, কিন্তু আনন্দ ওদের ঠকাবে না।’
একজন প্রকাশক স্বীকার করলেন, তাঁর ব্যবসার স্বার্থে তিনি বাধ্য হন কোনও কোনও লেখককে বঞ্চিত করতে। বইমেলার আগে, ধরা যাক, তিনি পাঁচটি বই ছাপবেন। পাঁচটি বই-এর কাগজের দাম, ছাপার খরচ, মলাট-শিল্পীর দক্ষিণা, বাঁধাইওয়ালার পারিশ্রমিক এক। কিন্তু জনপ্রিয় লেখাটির বই সেই জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিক্রি হল হাজার দুয়েক। বাকিগুলো গড়পড়তা একশো-দেড়শো। অন্তত আট থেকে নয়শো বই বিক্রি না হলে যখন খরচ ওঠে না, তখন প্রকাশক কী করবেন? পাওনাদাররা দরজায় বসে আছে। ফলে জনপ্রিয় লেখকের বই বিক্রির টাকা থেকেই দায়মুক্ত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। বাধ্য হয়ে সেই লেখককে বলতে হচ্ছে, ‘বেশ ভাল বিক্রি হয়েছে, সাতশো বেরিয়ে গিয়েছে।’ লেখক সব বুঝেও হজম করলেন।
এই যে বিশাল বইমেলা প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলল, প্রচুর মানুষ ঘুরলেন, দেখলে আনন্দ হয় কিন্তু প্রকাশকদের প্রাপ্তিযোগ কীরকম? স্টলের ভাড়া, নিত্যকার খরচ সামলে কেমন বই বিক্রি হল? এবারের মেলায় ছোট প্রকাশকদের হা-হুতাশ শুনেছি। তাঁদের স্টলের বই এখনকার মেলার পাঠকদের আকর্ষণ করতে পারছে না। অনেক স্টল প্ৰায় ফাঁকা পড়ে থাকছে। সত্যি ছবিটা হল, পুরো বইমেলায় খুব বেশি হলে গোটা বারো স্টলে মানুষের ভিড় ছিল, চুটিয়ে ব্যবসা করেছেন তাঁরা। কারণ, তাঁদের প্রকাশনায় বাংলা সাহিত্যের পরলোকগত ও জীবিত জনপ্রিয় লেখকদের বই আছে। আবার একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, পাঁচ বছর আগে পরলোকগত যে লেখক বেশ জনপ্রিয় ছিলেন, এ বছর তাঁর সেই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে। বইমেলায় বিক্রির বহর দেখে জনপ্রিয় লেখকরা খুশি হবেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন জনপ্রিয় লেখক যখন বলেন, ‘তুমি একদিন স্টলে বসে দুশোটা বই-এ সই করেছ বলে ভেবো না বছর শেষে প্রকাশক তোমাকে বিরাট অঙ্কের বিক্রির খবর দেবেন। ভেবে খুশি হও, ওই দুশো জন বাড়িতে গিয়ে তোমার বই পড়ছেন।
অতএব লেখক-প্রকাশক প্রায় স্বামী-স্ত্রীর মতো। স্ত্রী সংসারের কাজ সামলে ভাবেন অফিস করে স্বামী বাড়ি ফিরবেন তাঁর জন্যে। স্বামী ভাবেন স্ত্রী বাড়িতে অপেক্ষা করে আছেন। স্বামী যদি দুপুরে নিজের চরিত্র নিয়ে খেলা করে আসেন, স্ত্রীর পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। যদি কোনওদিন স্বামী ধরা না পড়েন তাহলে আদর্শ দম্পতি হয়ে সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে অসুবিধে নেই।
৩৬
যদি বলি, গ্রুপ থিয়েটার হিসাবে প্রথম পরিচিতি পেয়েছিল বহুরূপী তাহলে কি তা খুব ভুল বলা হবে? গণনাট্য সঙ্ঘের নাটকগুলোকে ঠিক গ্রুপ থিয়েটারের নাটক বলতে কখনওই শুনিনি। পিছনে কোনও রাজনৈতিক আদর্শ নেই, কেউ অর্থের খলি নিয়ে দাঁড়িয়ে নেই, দলের সদস্যরা শুধু নাটকের নেশায় পকেটের টাকা ঢালছেন, রিহার্সালের খরচ, হলের ভাড়া থেকে বিজ্ঞাপনের খরচ সামলাচ্ছেন, এমনকী নিজেরাই রাস্তার দেওয়ালে পোস্টার সাঁটছেন, এমন সৃষ্টিশীল পাগলামো শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পর থেকেই।
মনে রাখতে হবে, তখন শ্যামবাজারের থিয়েটার রমরমিয়ে চলছে। স্টার, রঙমহলের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা গ্রুপ থিয়েটারের মাত্র একটি জায়গায় ছিল। তা হল নাটকের বিষয় এবং সেটা পরিবেশন করার পদ্ধতি। নইলে ছবি বিশ্বাস, উত্তমকুমার, জহর রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটক দেখতে অভ্যস্ত বাঙালিকে দর্শক হিসাবে পাওয়া যেত না। পেতে অনেক লড়াই, অনেক সময় লেগেছে। যদিও গণনাট্য সঙ্ঘ গ্রুপ থিয়েটারের জন্মদাত্রী তৰু বহুরূপীর নাটকগুলোর ওই শ্যামবাজারি থিয়েটারকে ম্লান করছিল বোদ্ধা নাট্যপ্রেমীদের কাছে। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা ছিল খুব কম। লিটল থিয়েটার গ্রুপকে আমার কখনওই গ্রুপ থিয়েটার বলে মনে হয়নি। তখন চলচ্চিত্র অভিনেতা হিসাবে বিখ্যাত উৎপল দত্ত এই দলের নাট্যকার অভিনেতা-পরিচালক ছিলেন বলে দর্শকরা ভিড় জমাত। পরবর্তীকালে কল্লোল বা তিতাস যে বিশাল ক্যানভাসে নির্মিত হয়েছিল তা গ্রুপ থিয়েটারের সাধ্যর বাইরে ছিল। তা ছাড়া এইসব নাটক মাসে দু-তিনবারের বেশি মঞ্চস্থ করার সাধ্য ছিল না। শ্যামবাজারের থিয়েটার যখন প্রতিমাসে কুড়িবার দেখার সুযোগ পাওয়া যেত তখন বহুরূপীর নাটক দুই কি তিনবার। কল্লোল-তিতাস পাল্লা দিয়েছিল স্টার, রঙমহলের সঙ্গে।
স্বাধীনতার দেড় দশক পরে গ্রুপ থিয়েটার হিসাবে হইচই শুরু হল নান্দীকারকে নিয়ে। নট্যকারের সন্ধানে ছয়টি চরিত্র করলেন কয়েকটি ছেলে-মেয়ে। যাঁরা ইতিহাসে পৌঁছে গিয়েছেন। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, কেয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে একঝাঁক প্রতিভাবান ছেলেমেয়ে যাঁরা অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চ বেঁধেছেন, মেকআপ করা শিখেছেন। শুধু চণ্ডীপাঠ নয়, জুতো সেলাই করতেও তাঁরা দক্ষ ছিলেন। পরে অজিতেশবাবু চলচ্চিত্রের একটি চরিত্রে জনপ্রিয় হলেও সেই কারণ নান্দীকারের নাটক দেখতে দর্শক টিকিট কাটতেন না। সম্ভবত নান্দীকারও প্রথম গ্রুপ থিয়েটারের দল যারা বৃহস্পতি-শনি-রবিবার নাটক করার সাহস দেখিয়েছে।
এই নান্দীকার থেকে বেরিয়ে বেশ কয়েকটি দলের জন্ম দিলেন যাঁরা তাঁরা চমকে দিলেন একের পর এক নাটক করে। শ্যামবাজারের থিয়েটারের প্যারালাল থিয়েটার তখন দর্শক টানছে।
সেই পঁয়ষট্টি সালে আমাদের মাথায় তখন নাটকের ভূত জেঁকে বসেছে। আমি সুব্রত ভট্টাচার্য, হরেন মল্লিক। দলের কনিষ্ঠ সদস্য নীলকণ্ঠ সেনগুপ্ত, যে পরে থিয়েটার কমিউন করেছিল। বিখ্যাত লেখকের নায়করা গল্পের নাট্যরূপ দিয়ে মন ভরছে না। গ্রুপ থিয়েটারের নাটক মানে বিদেশি নাটকের বাংলায়ন। বাদল সরকার, মোহিত চট্টোপাধ্যায় এবং মনোজ মিত্র আছেন যাঁরা আত্মনির্ভর। সেইসব নাটকের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরেছি আমরা। মোহিতদার বাড়িতে, তখন তিনি উত্তর শহরতলিতে থাকতেন, রবিবারের সকালে টু মেরেই কয়েকবার, মনোজদার পাকপাড়ার বাড়িতে গিয়েও হালে পানি পাইনি। আমরা কে হরিদাস যে ওঁরা নাটক দেবেন, তখন কিন্তু খুব রাগ হত। বড় দলগুলো যখন ওঁদের নাটকের জন্যে অপেক্ষা করে আছে তখন অনামী আমাদের কেন খুশি করবেন তা তখন বুঝতে চাইতাম না। মনে রাখতে হবে, তখন (জানি না, এখনও কিনা, চন্দন সেন বলতে পারবেন) নাট্যকাররা তাঁদের সৃষ্টির বিনিময়ে টাকা পেতেন না, হাততালি এবং প্রশংসা পেলেই তৃপ্ত হতেন।
শ্যামবাজারের মোড়ে পবিত্র পাঞ্জাবি হোটেল রাত সাড়ে ন’টার পর গ্রুপ থিয়েটারে মানুষজন আড্ডা মারতে আসতেন। ওই হোটেলের চারপাশে তখন বেশ কয়েকটি দলের মহলাঘর। প্রবোধবন্ধু অধিকারীর সঙ্গে প্রায়ই সেখানে ছুটে যেতাম। আলাপ হয়েছিল, নাটকের ঘ্রাণ পেতাম, নাটক পাইনি।
ক্রমশ গ্রুপ থিয়েটারগুলো প্রধান অভিনেতা বা পরিচালকের দল হিসাবে প্রচারিত হয়ে গেল। কোন্ দল? না শম্ভু মিত্রের দল। তেমনি উৎপল দত্তের দল, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের দল, অশোক মুখোপাধ্যায়ের দল, বিভাস চক্রবর্তীর দল, অরুণ মুখোপাধ্যায়ের দল, জোছন দস্তিদারের দল। ওইসব নাটকের আলোচনায় বেশিরভাগ আলো ফেলা হয় প্রধান কর্তার উপর। ক্রমশ একটা কথা চালু হয়ে গেল, ভাইদের নাম, দাদাদের নাম। কিন্তু এটাও বাস্তব, ওই দাদারা না থাকলে গ্রুপ থিয়েটার এক পা-ও এগোত না। পরে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত সিস্টেমটাকে ভাঙলেন। দলের সদস্যদের পরিচালকের আসনে বসিয়ে সরে দাঁড়ালেন অভিনয়ে। শম্ভুবাবুর মৃত্যুর পরে কুমার রায় ঠিক এই কাজটি করে গিয়েছেন।
কিন্তু এই ষাট-তেষট্টি বছরে গ্রুপ থিয়েটার দিয়েছে যা তার এক ফোঁটাও পায়নি। একটা প্রযোজনা করতে সদস্যদের ধারের বোঝা বেড়ে গেল, অ্যাকাডেমির হাউসফুলের টাকায় তা সামাল দেওয়া যায় না। একমাত্র ভরসা ‘কল শো’ যদি পাওয়া যায়। নাটক বহুপ্রশংসিত না হলে কল শোওয়ালা খুঁজে দলে চিত্র বা টিভির কেউ আছে কি না। গ্রুপ থিয়েটারে শ্যামবাজারের থিয়েটারের গন্ধ পেলে খুশি হয়।
ষাট বছর ধরে নিজেদের জীবন-যৌবন সম্বল নিংড়ে দিয়ে যাঁরা নাটক করছেন, কমপ্লিমেন্টারি টিকিটে সেই নাটক দেখে যদি বলি, ‘খুব ভাল, খুব ভাল’ তা হলে মুখগুলোতে তৃপ্তির বিভা ফুটে ওঠে। কিন্তু কতদিন?
এই অবধি শোনার পর একজন প্রবীণ নাট্যকর্মী হেসে বললেন, ‘আপনি সাম্প্রতিক খবর রাখেন না। যে-কোনও প্রথম সারির দল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ভাল অর্থসাহায্য এখন পাচ্ছে। অভিনেতারা অন্য দলের নাটকে অভিনয় করে পকেট ভারী করছেন, পরিচালকরাও অন্য দলের নাটক পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পরিচালনা করে দিচ্ছেন। আগেকার সেইসব আদর্শ চুলোয় গিয়েছে।’ আমি হতভম্ব। মুখ দিয়ে বের হল ‘ভালো। এটাও ভালো।’
৩৭
শ্যামবাজার থেকে এসপ্ল্যানেডে যাচ্ছিল ট্রামটা। কুড়ি বছর আগে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট কলেজ স্ট্রিট হয়ে ধর্মতলা স্ট্রিট ধরে যে ট্রামটা কুড়ি মিনিটে গন্তব্যে পৌঁছত তার এখন অন্তত চল্লিশ মিনিট লাগে ট্রাফিকের জন্যে। জানলার পাশে বসেছিলাম। হঠাৎ কানে এল কথাগুলো। সামনের আসনে বসে দুই ভদ্রলোক কথা বলছিলেন। ‘সুরজ নাড়েড়ুর উপর আর ভরসা করা যাচ্ছে না।’ ‘সাব্দশ অনেক বেশি ডিপেন্ডেবল।’ দূর। এখন ট্রেভর ছাড়া আর কেউ নেই।’ ‘আপনি প্রদীপ চৌহানের কথা ভুলে যাচ্ছেন? কোত্থেকে কোথায় উঠে এল। এক হাজার স্কোর করা মুখের কথা নয়।’ ‘তা জানি, কিন্তু আমাদের সি অ্যালফোর্ড?’ ‘বলবেন না ভাই। কলকাতাতেই ওর যা কেরামতি। অল ইন্ডিয়াতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ব্যাটা চোর।’ ‘একটু রেগে গেছেন মনে হচ্ছে।’ ‘রাগব না। ডোবাবার ওস্তাদ। ওর পূর্বপুরুষটাও তো ওইরকম।’ ‘কিন্তু আর কেউ তো ওর পরে বাংলায় এল না।’
আমার পাশে বসেছিলেন নিরীহ চেহারার প্রৌঢ়। নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, ওরা কাদের কথা বলছেন বলুন তো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
আমি হেসে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনি কি ইংরেজি খবরের কাগজ পড়েন?’
‘হ্যাঁ। নিয়মিত পড়ি।’
‘খেলার পাতায় ইন্টারেস্ট আছে?’
‘নিশ্চয়ই। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, ব্যাডমিন্টন এমনকী গল্ফের খবর জানি। টাইগার উড্স সম্পর্কে অনেক কথা বলতে পারব।’
‘একদম নীচের দিকে একটা খেলার খবর ছাপা হয়। ঘোড়দৌড়ের খবর। সেটা বোধহয় দ্যাখেন না।’
‘নাঃ। ওটা আবার খেলা নাকি?’
‘ইংরেজরা বলেছে ওটা রাজার খেলা। কিংস স্পোর্টস। ওঁরা সেই খেলার চালকদের কথা বলছেন। যাঁরা ওই খেলার সমঝদার তাঁদের কাছে ওই নামগুলো মেসি, তেন্ডুলকর অথবা লিয়েন্ডারের মতো গুরুত্বপূর্ণ। কখনও রেসের মাঠে গিয়েছেন?’
ঠনঠনের কালীমন্দিরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল ট্রাম। ভদ্রলোক দুটো হাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ‘ছি ছি। এই বয়সে বদনাম যেচে নেব? রেস খেলে সর্বস্বান্ত হওয়ার কোনও বাসনা আমার নেই। বাড়িতে মুখ দেখাতে পারব না।’
এই সেদিনও মধ্যবিত্ত বাঙালি মনে করত জুয়া খেলা খুব খারাপ। রেস তো বটেই, শেয়ার মার্কেটে টাকা খাটানোর কথা চিন্তাও করত না। ফাটকা খেলে সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে কত পরিবারের—এই গল্প চালু ছিল। কিন্তু গত সাত-আট বছরে অবস্থাটা আচমকা বদলে গেল। আমার পাড়ায় রকের আড্ডায় রবিবারের সকালে গেলে যেসব সংলাপ অবশ্যই শোনা যায়, তা এইরকম—’একটু অপেক্ষা কর, মার্কেট উঠবে।’ ‘কাল একশো তিরিশ কমেছে।’ ‘রিলায়েন্স যে দরে কিনেছিলাম তা তিনদিনেই পঞ্চাশ নেমে গিয়েছে।’ ‘অথচ দ্যাখ সেল আমি একসময় কিনেছিলাম আঠাশ টাকায়, বেড়ে বেড়ে সেটা একশো কুড়ি হল। বিক্রি করলে চারগুণ প্রফিট। ভাবলাম আরও বাড়বে। শেষপর্যন্ত বিক্রি করেছি আটান্নতে।’ ‘বেশি লোভ করলে ঠকতে হবে। আগে মার্কেটটাকে বুঝতে হবে।’ ‘আমি বাবা হোল্ড করি না। দিনেদিনেই কেনাবেচা। একশো দশে সকালে কিনে দুপুরে একশো এগারো হলেই বেচে দাও। যা আসে তাই লাভ।’ ‘বাঃ বাঃ। যদি দুপুরে সেটা একশো না হয়, কী করবি?’ ‘আমি কি বুদ্ধ? ঠিক খবর থাকে কোটা একশো এগারো হবে।’
আচমকা শুনলে আপনি বুঝতেই পারবেন না ওরা কী বিষয় নিয়ে কথা বলছে। ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট বস্তুটি কী তা আপনার অজানা। অথচ এরা সবাই মধ্যবিত্ত। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে পোস্ট অফিস, ব্যাঙ্কে বেশিরভাগ টাকা জমা রেখে রোজ সকাল দশটায় শেয়ার বেচাকেনার দোকানে গিয়ে বসেন। বিকেল সাড়ে তিনটে-চারটে পর্যন্ত ভারতীয় শেয়ার মার্কেটের উত্থান-পতন মন দিয়ে লক্ষ করেন। অফিসে যেমন ভাত খেয়ে যেতেন এখানেও তেমনি আসেন। মাঝে-মাঝে চা চলে। কেউ পাঁচ কেউ দশ হাজার লাগিয়ে চার পাঁচশো লাভ হওয়া মাত্র বিক্রি করে দেন। ভাবেন, কুড়িদিন এমন চললে মাসে আট-দশ হাজার লাভ। ওই দশ হাজার ব্যাঙ্কে রাখলে সারা বছরে যে সুদ পাওয়া যেত তাতে চিড়ে ভিজত না। আবার কেউ কেউ এক দুই লাখ লাগিয়ে গম্ভীর মুখে বসে থাকেন। শেয়ারের দাম কমছে তাই বিক্রি করা যাবে না। অর্থমন্ত্রীর শ্রাদ্ধ করেন মনে মনে। রাতে ঘুমের ওষুধ খান। তারপর দাম পড়ছে তাই বিক্রি করলে মহাক্ষতি, এই অবস্থাটা অনেকটা ফোঁড়ার পুঁজ জমছে অথচ মুখ হচ্ছে না ওষুধ লাগিয়ে, তার যন্ত্রণার চেয়েও অনেকগুণ কষ্টকর। কিন্তু বাঙালি আজ খোলাখুলি শেয়ারে টাকা খাটাচ্ছে। বাড়ির লোক ভাবছে, রিটায়ার করে তো আর বাড়িতে বসে নেই। মেয়েকে তার প্রেমিক জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমার বাবা এখন কী করেন?’ প্রেমিকা গর্বের সঙ্গে জবাব দেন, ‘শেয়ার মার্কেট নিয়ে আছে। প্রেমিক বলে, ‘বাঃ।’
শেয়ার কেনাবেচার এই ব্যবসায় কি পকেট হালকা হয়ে যায় না? অবশ্যই হয় কিন্তু সেটাকে সামাল দেওয়ার পথটাও একটু একটু করে নেশায় ডুবে থাকা খেলোয়াড়রা খুঁজে নেয়। তখন ঢেউ-এর উপর নৌকো দক্ষহাতে সামলে রাখার খেলা। খবরের কাগজটা নিয়মিত মন দিয়ে পড়তে হয়। ইস্পাত, কয়লা, রাসায়নিক দ্রব্য, ব্যাঙ্ক জাতীয় শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন ব্যবসায় গুরুত্ব কমবেশি আন্দাজ করে শেয়ার কেনা বা বেচার সিদ্ধান্ত নিতে যাঁরা সক্ষম হন তাঁরাই ঢেউগুলোর ছোবল বাঁচাতে পারেন। এছাড়া বিভিন্ন পত্রিকা বা টিভিতে শেয়ার বাজারের অবস্থা নিয়ে প্রতিদিন যে আলোচনা চলে তাও খেলোয়াড়দের উপকারে লাগে।
শেয়ারে টাকা খাটানো কি জুয়ার পর্যায়ে পড়ে? আগে ফাটকা খেলে সর্বস্বান্ত হওয়ার যে ধিকার সাধারণ মানুষের মনে তৈরি হত এখন সেটা মিইয়ে গিয়েছে। পাঁচ হাজার টাকার শেয়ার কিনে গিয়েছিলেন বাবা, কুড়ি বছর পরে ছেলে সেটা ছ’লাখ টাকায় বিক্রি করেছে এমন ঘটনার নজির তো ভুরি ভুরি। কিন্তু শেয়ার এখন কিছুটা গ্রহণযোগ্য খেলা হলেও রেস থেকে অধিকাংশ বাঙালি দূরে সরে থেকেছে। ওই সুরজ নাড়েড়ু, পি. ট্রেভর ইত্যাদি নাম তাদের অজানা। আর নামগুলো যাদের জানা তাদের কাছে রেস শুধু রেঙ্গুড়ের খেলা নয়, অনা উন্মাদনার জগৎ। সেটা পরে আলোচনায় আসতে পারে।
৩৮
পুরুষ এবং নারী ছাড়া আরও একটি মানবপ্রজাতির কথা বাল্যকালে জানতাম না। চা-বাগানে অথবা জলপাইগুড়ি শহরে, আমার বাল্যকালে, তাদের দর্শন পাইনি। যখন আমি ক্লাস এইটে তখন হাসপাতালের সামনে ওদের দেখতে পেলাম। আমরা তিনজন তখন তিন সাইকেলে, অবাক চোখে দেখছি ওদের। মেয়েদের মতো শাড়ি পরার চেষ্টা করেছে কিন্তু সেটা ঠিকঠাক হয়নি। চোয়াড়ে মুখ, চুল ছেলেদের মতো ছাঁটা, একজনের হাতে ঢোল, সবাই পান চিবোচ্ছে’, আশপাশের দোকানিদের কৌতূহলী মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘শালা, হাসপাতাল বলল নাম দেবে না। তোমরা বল, এই পাড়ায় কার বাচ্চা হয়েছে গ ‘?’ কর্কশ গলায় স্বর। গো না বলে গ বলল।
এক দোকানি ফাজিল গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কোত্থেকে আসা হল?’
‘তোমার বাপের বাড়ি, শিলিগুড়ি থেকে।’ বিরক্ত হয়ে ঢোল বাজাতে বাজাতে ওরা চলে গিয়েছিল দিনবাজারের দিকে।
পাশের সাইকেলে বসা মন্টি জানাল, ‘এরা হিজড়া’।
সেই প্রথম দর্শন, বাড়িতে ফিরে অভিধান দেখলাম। হিজড়ার অর্থ হল নপুংসক। অর্থাৎ পুরুষ বা নারী কোনটাই নয়। বড় পিসিমার কাছে তখনও কিছু লুকাতাম না। বিষয়টা জানালে তিনি বললেন, ‘ভগবানের মার। কী করবে বেচারারা। অর্জুন তো বৃহন্নলা হয়েছিলেন ছদ্মবেশ ধারণের সময়।’ সঙ্গে সঙ্গে পিতামহের আলমারি থেকে পৌরাণিক অভিধান বের করলাম, ‘অর্জন মন্ত্রশিক্ষার্থ স্বর্গবাসকালে উর্বশীর অভিশাপে ক্লীবত্বপ্রাপ্ত হন। অজ্ঞাতবাসের বৎসরে অর্জুন ক্লীবরূপে এই নাম গ্রহণ করেন। বিরাট নগরে রাজকন্যা উত্তরার নৃত্যগীতাদির ইনি শিক্ষক হন।
মাস তিনেক বাদে পাড়ায় তীব্র উত্তেজনা। একটি বাড়ির সামনে কয়েকজন নপুংসক উত্তেজনাটা তৈরি করেছে। তাদের দাবি হল, এই বাড়ির যে মেয়েটি খেলাধুলায় ছেলেদের হারিয়ে প্রথম হয়, যার মুখের গড়ন মেয়েদের মতো নরম নয় সে আসলে তাদেরই মতন। বাবা-মা তাকে মেয়ে সাজিয়ে রেখেছে। ওই নপুংসককে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। বাবা-মা তীব্র প্রতিবাদ করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু নপুংসকদের দলটি ছাড়ার পাত্র নয়। তারা ভয়ঙ্কর আচরণ করতে লাগল। আমরা সোনাকে চিনি। সত্যি সে একশো মিটার দৌড়ে ছেলেদের হারিয়ে দেয়। পুলিশ এল। তারা হামলাকারীদের সরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সোনাকে নিয়ে ওর বাবা-মা সেই রাতেই জলপাইগুড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছিল তার খোঁজ পাইনি।
কলকাতার বাড়িতে এসে ওদের পথে-ঘাটে দেখতে পেতাম কখনও সখনও। শুনতাম কারও বাচ্চা হলে ওরা ঠিক হাজির হয়ে যেত। টাকা, চাল, ডাল নিয়ে আশীর্বাদ করে ফিরে যেত। এম এ পড়ার সময় এক সহপাঠীর মুখে চমকপ্রদ ঘটনা শুনলাম। আউটরাম ঘাটে একটি মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। দ্বিতীয় দিনেই প্রেম। তৃতীয় দিনে সে আবিষ্কার করে মেয়েটি নপুংসক, মেয়ে বলে ভুল করে ফেলেছিল। খুব ভেঙে পড়েছিল ছেলেটি, প্রথম প্রেম বলে কথা!
গত পাঁচবছরে ছবিটা পাল্টে গেল দ্রুত। রাতের ট্রেনে ঘুমিয়ে আছি। কর্কশ গলায় যে ঘুম ভাঙাল তার দাবি, টাকা দাও।’ এসি টু টিয়ারে ঢুকে মাঝরাতে কী করে একজন নপুংসক ভিক্ষে দাবি করতে পারে, তা জানতে চেয়েছিলাম কামরার কন্ডাক্টরের কাছে। ভদ্রলোক মিনমিনে গলায় বলেছিলেন, ‘ওরা বর্ধমান থেকে উঠে বোলপুরে নেমে যায়। আবার শেষ রাতের ট্রেনে বোলপুর থেকে ওঠে। আপত্তি করলে ভয়ঙ্কর আচরণ করে।’
‘তাই বলে আমাদের নিরাপত্তা দেখবেন না?’
‘না স্যর’ ওরা কারও ক্ষতি করে না, শুধু দান নেয়। আসলে, ওরা যদি পুরুষ হত তাহলে পুলিশ দিয়ে নামিয়ে দেওয়া যেত। মুশকিল হল…।
শুধু রাতের ট্রেন নয়, দিনের লোকাল ট্রেনের যাত্রীদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে ওরা। ভাব দেখে মনে হয়, আমরা নপুংসক বলে কি মানুষ নই?
নপুংসকদের নাগরিক অধিকার ভারতীয় সংবিধান দিয়েছে। তারা ভোট দিতে পারে। নির্বাচনে দাঁড়াতে পারে। এই তথ্য জানতে পারলাম এ্যাটর্নি শৈবাল গাঙ্গুলির কাছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই অধিকার তারা ব্যবহার করছে না কেন? আমার জ্ঞানত ওদের কাউকে কখনও পশ্চিমবঙ্গের কোন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেখিনি।
.
আমার পরিচিত এক পুলিশ অফিসার তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন। তাঁর আত্মীয়ের বাড়িতে ভরদুপুরে হাজির হয়ে পুত্রসন্তান হওয়ার কারণে দশ হাজার টাকা দাবি করে কয়েকজন নপুংসক। তারা টাকা না পেলে বসার ঘরের সোফা থেকে উঠবে না বলে জানায়। বাড়ির মহিলারা এক হাজার দিতে পারবে জানালে ওরা এগারো হাজার দাবি করে। খবর পেয়ে পুলিশ অফিসার সেখানে গিয়ে জানতে চান, কোন্ অধিকারে তারা বাড়ির ভিতরে ঢুকে সোফায় বসেছে? বিস্তর ঝামেলা করে তিনি তাদের বিদায় করতে পারেন।
এই যে ওরা ক্রমশ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে তার পিছনে নিশ্চয়ই যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ওরা যে ডেরায় থাকে সেখানে কোনও নিরাপত্তা নেই। কোনও বাড়িওয়ালা ওদের ঘরভাড়া দেবে না। বহুকাল ধরে ওদের দেখলে মানুষ মজা পাওয়া হাসি হাসে। পৃথিবীতে করুণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকতে থাকতে ওরা নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে চাইছে। একশোদিনের কাজ ওরা পায় না, কোনও নপুংসক যদি শ্রমের বিনিময়ে অর্থ রোজগার করতে চায় তাহলে তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হয় না। এর ফল তো অন্যভাবে প্রকাশ পাবেই।
কিন্তু আর একটি দৃশ্য দেখা যাচ্ছে এই শহরে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে রেসকোর্স, ফোর্ট উইলিয়ামের রাস্তা তো বটেই, অনেক নির্জন রাস্তার ক্রসিং-এ সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকে ওরা। গাড়ি থামলেই এসে হাত বাড়ায়। মুখে ফিল্মের নায়িকার প্রসাধন, ঠোঁটে রহস্যের হাসি। কোথায় ছিল এরা এতদিন? হঠাৎ নির্জন রাস্তার মোড়ে কেন উদয় হল? পুলিশ দেখেও অন্ধ হয়ে থাকছে।
এক বয়স্ক বন্ধু তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বললেন। রোড লাইটে দাঁড়িয়েছিলেন ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে। তখন সন্ধে। ফুটপাত থেকে নেমে আসা মূর্তিটিকে নপুংসক ভেবে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়েছিলেন চালক। তখনই কানে এল, ‘স্যর, এদিকে তাকান, আমি হিজড়ে নই। আমি মেয়ে, হিজড়ে সেজে এসেছি। গাড়িতে উঠব?’
৩৯
সকালে লিখতে বসে পার্থর কথা মনে এল। বাংলার অধ্যাপক পার্থর স্মৃতিশক্তি অসাধারণ ছিল। যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবিতার ক’টা লাইন কিছুতেই মনে করতে পারছি না। ওঁর ‘দূরে দূরে গ্রাম’ কবিতাটি স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমি জানি পার্থকে ফোন করলে ও সঙ্গে সঙ্গে বলে দেবে কবিতার নাম যার একটা লাইনে গোবি সাহারার কথা ছিল। ডায়েরি বের করে পার্থর নাম্বার বের করলাম। ল্যান্ড লাইন। আজকাল মোবাইল নাম্বারেই ফোন করতে হয়। অনেকেই ল্যান্ড লাইন সারেন্ডার করেছেন মোবাইল ব্যবহার করার পরে। পার্থর নাম্বার ডায়াল করতে গিয়ে দুটো কারণে থমকালাম। প্রথম কারণ, লাইনটা মাথায় হুট করে চলে এল, ‘একখানি মেঘ এনে দিতে পার গোবি সাহারার বুকে।’ কিন্তু আগে পরে কিছুই মনে পড়ছে না। পার্থ অবলীলায় বলে দিতে পারবে। দ্বিতীয় কারণটা একটু অস্বস্তিকর। পার্থকে শেষ ফোন করেছিলাম কবে? দু’-চার বছর তো নয়ই, তারও বহু আগে। আজ ফোন করে নিজের সমস্যার কথা বললে ও কি কিছু ভাববে? ভাবতেই পারে। তাহলে আমাকে একটু ভ্যানতারা করতে হবে। করে প্রশ্নটা করাই ভাল।
রিং হচ্ছে। একটু পরে একজন মহিলা রিসিভার তুলে ‘হ্যালো’ বললে আমি সবিনয়ে বললাম, ‘আমি সমরেশ বলছি। পার্থ কি বাড়িতে আছে?’
কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ। তারপর মহিলা বললেন, ‘না নেই। পার্থ দু’বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন।’
কেঁপে উঠলাম। আচমকা গলার ভিতরে কি একটা আটকাল। দ্রুত রিসিভার নামিয়ে রাখলাম। মিনিট পাঁচেক চোখ বন্ধ করে বসে থাকার পর সোজা হলাম। ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই অবাক হয়েছেন। কিন্তু -! আবার ফোন করে কথা বলার কোনও মানে হয় না। দুই বছর আগে পার্থ তার যাবতীয় জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে চলে গিয়েছে। না। চলে গিয়েছে বলাটা সঠিক নয়। কেউ নিজের ইচ্ছেয় যেমন জন্মায় না, তেমনই কোথাও চলে যায় না। যেভাবে আচমকা হাওয়ার ধাক্কায় মোমবাতি নিভে যায়, তেমনই হৃদযন্ত্র থেমে যায়। পার্থর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। আমি ডায়েরির পাতায় ওর নাম এবং নম্বর কেটে দিলাম।
কি সহজে নামটি খারিজ হয়ে গেল ডায়েরির পাতা থেকে। দু’বছর আগে যে মারা গিয়েছিল সে একটু আগে পর্যন্ত আমার কাছে জীবিত ছিল। কৌতূহল হল। আদ্যাক্ষর ‘এ’ থেকে শুরু করলাম। অনিল মিত্র, আমার স্কুলের সহপাঠী, বহুকাল যোগাযোগ নেই। এখনও কি সে বেঁচে নেই। ল্যান্ডলাইনের নাম্বারটা ঘোরালাম। কানে এল, ‘দিস নাম্বার ইজ নট একজিস্টিং।’ অর্থাৎ নাম্বারটা বদলে গিয়েছে। নাম্বার বদলে যাওয়া মানে যার নাম্বার সে মরে গিয়েছে তা ভাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু অনিলকে চেনে এমন কেউ কলকাতায় থাকে কি না জানা নেই। পরিবর্তিত নাম্বার খোঁজার চেষ্টা করেও লাভ হল না। এখন অনিল যদি নিজে আমাকে ফোন না করে তাহলে আর যোগাযোগ সম্ভব হবে না। আর সেটা না হলে জীবিত বা মৃতের মধ্যে তফাত কী থাকল।
কিন্তু আর একটা ঘটনা ঘটল। বছর তিরিশেক আগের ডায়েরি পুরনো হয়ে গেলে নতুন ডায়েরিতে নাম্বার লিখতে খুব বিরক্ত হতাম। এ থেকে শুরু করে জেড, সব কটা নাম লিখতে হাত ব্যথা হয়ে যেত। হিন্দু বাঙালির নাম জেড দিয়ে সাধারণত হয় না। কিন্তু আমার বন্ধু জুলফিকার কিছুতেই জে দিয়ে নামের বানান শুরু করত না। এক্স-এর পাতা খালি থাকত। মোবাইল এসে যাওয়ায় সেই পরিশ্রম নেই। সেভ আর ডিলিটের সৌজন্যে আসা-যাওয়ার দুই দ্বার খোলা যাচ্ছে সহজেই। আজ কেমন ঘোর লাগল বলে ডায়েরির পাতা ওল্টালাম। স্মৃতি থেকে নামগুলো কাটকে কাটতে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে নিজেই শিউরে উঠলাম। এই যে এত মানুষ, যাঁদের আমি চিনতাম, যাঁদের কাজে এবং উপদেশে আমি সমৃদ্ধ হয়েছি তাঁরা আজ পৃথিবীতে নেই। আমার স্কুলের মাস্টারমশাইয়েরা প্রায় সবাই চলে গিয়েছেন। একজন এখনও সক্রিয় হয়ে কবিতা লিখে খাচ্ছেন শারদীয় সংখ্যায়। সেই বেণু দত্তরায়, যিনি আমাকে প্রথম লেখালেখির গল্প শুনিয়েছিলেন, তিনি এখনও এই পৃথিবীতে আছেন। বুক ভরে গেল নির্মল আরামে। আমার কলেজের অধ্যাপকরা – কনক বন্দ্যোপাধ্যায়, গুরুদাস ভট্টাচার্য, বিপিনবাবুরা কবে চলে গিয়েছেন। যে দু’জন আছেন, সেই গৌরমাহন মুখোপাধ্যায় এবং আলোক রায়ের কথা ভাবলেই নিজেকে ছাত্র বলে মনে হয়। লিখতে এসে যাঁদের ছায়ায় ছিলাম সেই বিমল কর, সাগরময় ঘোষ থেকে শুরু করে গজেন্দ্রকুমার মিত্র, সমরেশ বসু, বরেন গঙ্গোপাধ্যায় এখনও স্বপ্নে আসা-যাওয়া করেন। আর যাঁর কাছ থেকে দু’হাত ভরে নিয়েছি, মাঝরাতে লিখতে লিখতে আচমকা আটকে দিয়ে ফোন করে ঘুম ভাঙিয়ে প্রশ্ন করতেই যিনি তথ্য দিয়ে ফোন রাখতেন সেই সন্তোষকুমার ঘোষকে মৃত মানুষ বলে ভাবতে এখনও আমার কষ্ট হয়। কাটতে কাটতে ডায়েরির নামগুলো ক্রমশ ছোট হয়ে গেল। হঠাৎ মনে হল, থাক এটা। ডায়েরিতে নাম তোলা তো বহুকাল বন্ধ করেছি, মোবাইলটা দেখি। ডিলিট টিপতে টিপতে হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল।
সবাই চলে যাচ্ছেন এক এক করে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে সুনীলদার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁর শরীর খারাপ অথবা মৃত্যুর ছায়া দেখতে পাচ্ছেন, এমন কোনও প্রসঙ্গেই তিনি কথা বলেননি। গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে যে সব বিষয় নিয়ে কথা বলেছি, তাই বলতে বলতে আমার মনে হত, এত শীর্ণ হয়ে গেছেন যিনি, চট করে চেনা মুশকিল যাঁকে, তিনি জীবনের সব স্বাদ এখনও আগের মতোই পেতে চান। স্বর্গ নিয়ে কথা উঠেছিল। বলেছিলেন, ‘তিনটে কারণে আমি স্বর্গে যেতে রাজি নই। প্রথমত, ওখানে কেউ বই পড়ে না। দ্বিতীয়ত, স্বর্গীয় মদিরায় নেশা হয় না, তৃতীয়ত, স্বর্গের সুন্দরীরা মানবী নয়।’ কথাগুলোতে চমক ছিল, আমরা খুশি হয়েছিলাম। এখন ভাবি, তাহলে সুনীলদা কোথায় গিয়েছেন?
একটার পর একটা নাম মুছে ফেলছি মোবাইল থেকে। সেইসব প্রিয় নাম যাঁদের সান্নিধ্যে কত সময় কেটেছে আমার। সন্তোষদার নামটা আসতেই বাক্যটি মনে পড়ে গেল। একজন বললেন, ‘অনেক ঘুরেছি আমি, এবার মরণের পাশে শুয়ে থাকি।’ দ্বিতীয় জন চমকে উঠলেন, ‘সর্বনাশ, তাহলে মরণও যে গর্ভবতী হবে।’ সেই আশি-বিরাশি সালে সন্তোষকুমার ঘোষের বলা কথাগুলো মনে পড়ায় বুঝলাম কেউ কেউ মৃত্যুকেও লীলাসঙ্গিনী হিসাবে ভাবতে পারতেন। যাঁরা গেছেন তাঁদের নাম মোবাইল থেকে মুছে দিলেই কি তাঁরা চলে যাবেন? তাহলে ভাল কোনও রান্না খেলেই বহুবছর আগে চলে যাওয়া মায়ের মুখ মনে পড়ে কেন? হঠাৎ মোবাইলের বোতামে আঙুল থেমে গেল। ডিলিট করার আগে নামটা দেখলাম। আমার ডাকনাম। এই নামেই নিজের নাম্বার সেভ করেছিলাম প্রথম দিকে। এই নামে যাঁরা ডাকতেন তাঁরা সবাই চলে গেছেন। নাম্বারটাও মুখস্থ এখন। অতএব ডিলিটে চাপ দিলাম, স্বচ্ছন্দে।