৩০
বাঙালির উপর রাজনৈতিক অত্যাচার হলে তাঁরা মুখ বুজে থাকবেন, অর্থনৈতিক চাপ প্রবল হলে হাহাকার করবেন কিন্তু রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করবেন না। সমর্থন বাড়াতে দলীয় পতাকা নিয়ে যাঁরা প্রতিবাদের মিছিল করেন তাঁদের সংখ্যা মোট বাঙালির কত সংখ্যক? শতকরা পয়েন্ট জিরো জিরো এক কি দুই। বৃহৎ সংখ্যায় বাঙালি মাছের চোখ নিয়ে সেই মিছিল দূর থেকে দেখেন। তাঁরা জেনে গিয়েছেন এসব প্রতিবাদে কোনও কাজ হয় না। বৃহস্পতি শুক্রবারে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বন্ধ ডাকা হলে বাঙালি ছোটে দিঘা, শান্তিনিকেতন বা পুরীতে। এপার বাংলার বাঙালিদের বৃহৎ অংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। পুজোর সময় তালেগোলে সাতদিন ছুটি ম্যানেজ করতে পারলে ট্রেনের টিকিট কাটতে ছোটেন, যাঁরা ছোটেন না তাদের অধিকাংশ সকালে মণ্ডপমুখী না হয়ে সন্ধ্যাবেলা নিজেদের দেখাতে বের হন। কিন্তু একটা ব্যাপারে প্রায় সমস্ত বাঙালি একত্রিত, তাঁরা সমালোচনা সহ্য করেন না। নিন্দে আর সমালোচনার পার্থক্য বোঝেন না।
কয়েক কিস্তি আগে এই কলমে একটি কথা জানিয়েছিলাম। লিখেছিলাম হিন্দু বাঙালি পাঠক মুসলমান বাঙালি পাঠকের চেয়ে অনেক বেশি মৌলবাদ। কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কিছু মানুষ মনে করলেন আমি ভয়ঙ্কর অন্যায় করেছি। টেলিফোনে ঝড় উঠল একের পর এক। আমি এপার বাংলার হিন্দু পাঠককে ছোট করেছি। কে কী পড়বে তা সে নিজেই ঠিক করবে। আমি লাঠি ঘোরানোর কে? এপার বাংলার পাঠক যদি বিরূপ হয় তাহলে আমাকে না খেয়ে মরতে হবে, কোনও প্রকাশক আমার বই ছাপবেন না। ইত্যাদি ধমকের পরে দু’জন মোক্ষ কথা বললেন টেলিফোনে। একজন বললেন, ‘বাংলাদেশিরা আপনাকে মোটা টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে তা লেখা পড়ে বুঝতে পারছি।’ দ্বিতীয়জন তালিবানি গলায় হুমকি দিলেন, ‘নাম পাল্টান মশাই, এখন থেকে নাম লিখুন কবীর সমরেশ। ছ্যা।’
কবীর সুমনের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল এবারের বইমেলায়। পুরনো সম্পর্ক, আড্ডা মারতে ভাললাগে। ওর গানের ভক্ত আমি, কখনও জিজ্ঞাসা করিনি, ইচ্ছাও করেনি ওর ধর্ম কী? অভিযোগ শুনে হেসেছিলাম। আচ্ছা, নামের আগে কবীর অথবা মাইকেল জুড়ে দিলে আমি কি পাল্টে যাব? জীবনযাপনের পথটা আলাদা হয়ে যাবে? আমি কি খুব নামাজ পড়ব অথবা গির্জায় গিয়ে মাথা ঠুকব? আমার পিতা পিতামহ নিয়মিত ঠাকুরঘরে গিয়ে বসতেন পূজো করতে। মা বড়পিসিমা দেবতামুখী ছিলেন। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তাঁদের এসব করতে দেখেছি কিন্তু ওঁদের অনুসরণ করিনি। কারণ তাগিদ অনুভব করিনি।
কোনও রাজনৈতিক নেতা যখন অবাস্তব কথা বলেন, সংবিধানকে উড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করেন তখন আমরা সেই তিন বাঁদর হয়ে যাই। দেখিনি, শুনিনি, অতএব বলার কিছু নেই। বাড়ির সামনের রাস্তায় যদি কোনও তরুণীকে কয়েকটি যুবক হেনস্তা করে তা হলে তাদের সমাজবিরোধী তকমা দিয়ে জানলা বন্ধ করে দিই। ঘনিষ্ঠ কোনও মূর্খ যদি সেই মেয়েটিকে সাহায্য করতে এগিয়ে গিয়ে আহত হয় তা হলে তাকে ভর্ৎসনা করি। ‘কী দরকার ছিল তোমার নাক গলাবার?’ এগুলোর কারণ বোঝা সহজ। কিন্তু গুলিয়ে যায় অনেক কিছু যা আমরা করে থাকি।
.
ক্যুরিয়ারে আমন্ত্রণপত্র এল। এটা সচরাচর আসে না। আমার পরিচিত বন্ধুরা এখন পিতামহ। বেশিরভাগেরই উত্তরসূরি মেয়ে। এই পৈতের জন্যে অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ। দুটো চিঠি। একটি সকালের অনুষ্ঠানের শেষে মধ্যাহ্নভোজনের জন্যে। দ্বিতীয়টি সন্ধের পর অমুক ক্লাবে পৈতে উপলক্ষে ককটেল এবং ডিনার। এই শেষের সংযোজনটি অতি অভিনব। আগে কখনও এরকম আমন্ত্রণ পাওয়া দূরের কথা শুনতেও পাইনি। দু’হাজার তেরোতে বাঙালি এখনও বাড়ির বালককে পৈতে পরিয়ে ব্রাহ্মণত্ব দিচ্ছে। আমার কৌতুহল হল।
ভাটপাড়ায় যেতে হয়েছিল। যে বাড়িতে আতিথ্য নিয়েছিলাম তাদের পদবি ভট্টাচার্য। কুড়ি থেকে তিরিশের মধ্যে চারজন যুবক আমার সামনে বসে। বড়টি স্কুলে পড়ায়, মধ্যম ব্যাঙ্কের চাকুরে, সেজ এমএসসি দেবে, ছোট কলেজে পড়ে। সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমাদের নিশ্চয়ই পৈতে হয়েছিল?’
বড় বলল, ‘হ্যাঁ, ঠাকুর্দা জোর করে দিয়েছিলেন।’
‘ও তাঁর ইচ্ছেটাকে এখনও সম্মান করছ?’
‘দূর। কবে ওসব চলে গিয়েছে। আমার একার নয়, ওদেরও।’
‘গায়ত্রী––?’
ছোট বলল, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনি কি উনিশ শতকে পড়ে আছেন?’
‘অবশ্যই না। কিন্তু তোমরা মাথা ন্যাড়া করে পৈতে ধারণ করেছিলে কেন?’
‘দাদা তো বলল, বাধ্য হয়ে। ঠাকুর্দার ভয়ে। এই তো দাদার বিয়ে হয়েছে, বউদি কায়স্থ। ওঁদের ছেলের বয়স দেড়। ঠাকুর্দা থাকলে বিয়েটাই হত না।’
‘তোমরা ভাটপাড়ার ভট্টাচার্য পরিবারের সদস্য। ধর্মাচরণ করো না?’
‘সময় কোথায়? তা ছাড়া যা করার মা করেন, এই বাড়িতে ঠাকুরঘর আছে, মেজদার কলকাতার ফ্ল্যাটে ঠাকুরের জন্যে কোনও ঘর নেই।’ ছোট থামল।
গত শ্রাবণে হইচই করে বাঁক নিয়ে তারকেশ্বরে যেতে যারা মাইক বাজাচ্ছিল তাদের জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম, ওরা অ্যাডভেঞ্চার করতে যাচ্ছে।
নিরীহ দেখতে একটি ছেলে, প্রাইভেট টিউশনি করে, স্বীকার করল, ‘খুব রাগ হয়, জানেন, আমাদের পুজোর মন্ত্রগুলো সংস্কৃতে বলতে হবে কেন? সংস্কৃত তো বুঝি না। বাংলায় কেউ লিখে দিলে না হয় চেষ্টা করতাম।’
টেলিফোনে ভেসে আসা শব্দাবলি মনে পড়ল। আমার ভ্রাতৃপ্রতিম কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ মজা করে কথা বলে, তাকে ব্যাপারটা বললে সে একটা গল্প শোনাল। রাম-রাবণের যুদ্ধ হচ্ছে। তখন যুদ্ধ শুরু হত সূর্য উঠলে, যুদ্ধে বিরতি পড়ত সূর্যাস্তে। এরকম এক সন্ধ্যায় রাবণ তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে যুদ্ধের কৌশল নিয়ে মিটিং করছেন। একজন হনুমানের কথা তুললে রাবণ রেগে গিয়ে বললেন, ‘ওই হনুমান! রামের ভয়ঙ্কর তিরের আঘাত আমি সহ্য করতে পারি কিন্তু হনুমানের দাঁত কিড়মিড়ানি সহা করতে পারি না।’
এই দাঁত কিড়মিড়ানি কতদিন চলবে তা আমার জানা নেই।
৩১
আমাদের বাল্যকালের জনপ্রিয় গায়ক সনৎ সিংহ চলে গেলেন! যে বয়সে গেলেন তাকে পরিণত বয়স বলা হয়। কিন্তু যাওয়ার আগে তাঁকে রোগযন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে কয়েক মাস। সেই সময় খবরটা শুনে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ‘বাবুরাম সাপুড়ে’, ‘এক একে এক’ ইত্যাদি গান বাল্যকালে আমাদের মুখে মুখে ঘুরত। বছর দশেক আগে আমি একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম। সেই স্বর্ণযুগের যেসব গায়ক-গায়িকা এখন আর অনুষ্ঠানে আসেন না, তাঁদের কয়েকজনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। সনৎ সিংহকে যখন ফোন করলাম তখন পরিচয় জেনে আমার লেখার কথাই বলতে লাগলেন এমনভাবে যে খুব বিব্রত হয়েছিলাম। অনুরোধ রেখে অশক্ত শরীরে এসেছিলেন। যখন গান ধরলেন তখন শ’পাঁচেক শ্রোতা এক নিমেষে চলে গিয়েছিলেন অতীতে।
কলেজ স্ট্রিটের বসন্ত কেবিনে আমাদের আড্ডা ছিল। তার পাশের গলির মুখে ছিল আমাদের এক বন্ধুর ছোট্ট কাপড়ের দোকান। সেটাও ছিল আমাদের ঠিকানা। পাশেই সিসিল হোটেল। তার কর্ণধার ছিলেন বিখ্যাত শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। গম্ভীর মুখে পান চিবোতে চিবোতে বেরিয়ে তাঁকে গাড়িতে উঠে কোথাও যেতে দেখতাম মাঝে মাঝে। ওঁর ছেলে দীপঙ্কর তখন বেশ ছোট্ট। আমাদের সঙ্গে আড্ডা মারার বয়সে পৌঁছয়নি। ‘মাটিতে জন্ম নিলাম’, ‘ওই ঝিরঝির বাতাসে’ বা ‘ত্রিনয়নী দুর্গা’-র গায়কের সঙ্গে কথা বলার সাহস আমাদের হয়নি। এক বিকেলে আমরা দুই বন্ধু গলির মুখের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, ধনঞ্জয়বাবু গাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। সাহস করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিছু খুঁজছেন?’ তিনি মাথা নাড়লেন, ‘হ্যাঁ। একজন গাড়ি নিয়ে আসবে। তোমরা আমাকে চেনো?’ লজ্জায় নত হলাম, ‘আপনাকে না চেনাটা অপরাধ।’
‘তাহলে আমাকে অপরাধী কোরো না’। রোজ তো দেখি অথছ নাম জানি না।’ নিজেদের নাম বলেছিলাম, গাড়ি এল তখনই, তিনি চলে গেলেন।
প্রায় পনেরো বছর পর শ্যামপুকুরের একটি অনুষ্ঠানে গাইতে এলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। তখনও দারুণ কণ্ঠ, গেয়ে যাচ্ছেন একের পর এক বিখ্যাত গান। শেষ গানের ঘোষণার সময় আমি একটা গানের লাইন চিরকুটে লিখে স্টেজে উঠে তাঁকে দিয়ে এলাম। কোনও কথা বলিনি। উঠে যাওয়ার আগে চিরকুটটি দেখে আবার বসে পড়লেন। বললেন, আমার বয়স হয়ে গিয়েছে। এই গান এখন মানায় না। কিন্তু যে অনুরোধ করেছে সেই সমরেশের তো এখনও বয়স আছে। তাই ওর জন্যে গাইছি। গান ধরলেন, ‘বাসরের দীপ।’ আমি স্তম্ভিত। পনেরো বছর আগে একবার শোনা নামটা তিনি কীভাবে মনে রেখেছিলেন তার ধন্দ এখনও যায়নি।
একটু বড় হয়ে কখন কেমন করে অখিলবন্ধু ঘোষের গানের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম তা এখন মনে নেই। ‘পিয়াল শাখার ফাঁকে’ গানটির চেয়ে ‘কবে আছি কবে নেই’ অথবা ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা’ গান দুটি আমাকে বেশি টানত। হেমন্ত, ধনঞ্জয়, তরুণ, শ্যামল, এইসব নক্ষত্রের থেকে একদম আলাদা, বুকের ভিতর তিরতিরে কান্না গুমরে মরে গানগুলো শুনলে।
বন্ধু দেবাশিস দাশগুপ্ত ওইসব নক্ষত্রের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। নিজে নাটকের সুর করত কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাস থেকে সলিল চৌধুরির স্নেহধন্য ছিল। দেবাশিসকে অখিলবন্ধুর কথা বললে সে জিজ্ঞাসা করত, ‘যাবেন?’
দেবাশিস আমাকে নিয়ে যেত হরিশ মুখার্জি রোড পেরিয়ে যে এলাকায় তার নাম শাঁখারিপাড়া। বেশ পুরনো বাড়ি। দোতলায় উঠে একেবারেই সাদামাঠা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আমার প্রিয় শিল্পীকে দেখতে পেলাম। প্রায় পাকা চুল, পরনে লুঙ্গি এবং ফুটো হয়ে যাওয়া গেঞ্জি, বাবু হয়ে বসে আছেন হারমোনিয়ামের সামনে। আলতো আঙুলে তার রিডে চাপ দিচ্ছিলেন। আমাদের দেখে অবাক হলেন। তার পরেই হেসে বললেন, ‘দেবাশিস এরকম ধূমকেতুর মতো উদয় হলে। বসো বসো’। এটি কে?’
দেবাশিস পরিচয় দিতে বললেন, ‘ভাল লাগল, আপনি গায়ক?’
মাথা নেড়েছিলাম, ‘সেই ক্ষমতা নেই। তবে গান ভাল লাগলে মন বসে যায়।’
‘যেমন?’
‘ও দয়াল বিচার করো।’
সঙ্গে সঙ্গে হারমোনিয়ামে সুরটা তুলে গলা খুললেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধ। এভাবে তিন হাত দূরে বসে ওঁর গান শুনে ধন্য হয়ে গেলাম। তার পরেই গাইলেন, ‘কবে আছি কবে নেই—!’ আজও যখনই গানটা শুনি আর একটা গানের কথা মনে পড়ে। তারাশঙ্করের কথা, ‘জীবন এত ছোট কেন?’ ওই যে লাইনগুলো, যে ক’টা দিন বাঁচব, সেই কটা দিন গান গেয়ে যেতে চাই, আরও গান, আরও গান প্রাণ ভরে। শুনলেই বুকের পাঁজরগুলো কান্নার হারমোনিয়ামের রিড হয়ে যায়।
গান থামিয়ে তিনি দেবাশিসকে বললেন, ‘সমরেশ প্রথমবার এল। একটু চা খাওয়ানোর দরকার, কিন্তু!’
দেবাশিস বলল, ‘আমি সামনের দোকানটায় বলে আসছি।’
বললাম, ‘দেবাশিস, আপনি বসুন। আমি যাচ্ছি।’
দেবাশিস আপত্তি করলেও অমি শুনিনি। রাস্তায় নেমে চাওয়ালাকে বললাম, ‘চা হবে?’ তিনি বললেন ‘হবে।’
‘কিছু যদি মনে না করেন, তিন কাপ অখিলবন্ধুবাবুর ঘরে—।’
শেষ করতে দিলেন না চাওয়ালা। মাথা নেড়ে বললেন, ‘না’ তারপর বিড় বিড় করলেন, ‘অনেক দিয়েছি, আর পারব না।’
ধাক্কাটা সামলে নিয়ে বললাম, ‘এই তিন কাপের দাম দিয়ে দিচ্ছি।’
হঠাৎ অদ্ভুত চোখে তাকালেন, ‘কোথায় থাকেন?’
‘শ্যামবাজারে।’
‘যান। পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনাকে দাম দিতে হবে না। শ্যামবাজারের লোক এসে অখিলদার চায়ের দাম দেবে, আমি এখনও মরে যাইনি মশাই।’
লোকটা যেন আমচকা বদলে গেল। ঘরে ফিরে এসে শুনলাম অখিলবন্ধু গাইছেন, ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা, আমি কাঁদি সাহারায়।’ চোখ বন্ধ করে ফুটো গেঞ্জি পরা সেই উদাস শিল্পীকে এখনও দেখতে পাই। মনের বাসরঘরে যিনি জেগে থাকতে চেয়েছিলেন, থাকছেন।
৩২
বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে টিভির সামনে বসে প্রার্থনা করছিলাম। আমার কোনও কল্পিত ঈশ্বর নেই। আমি নাস্তিক নই, কারণ যে মহামানবটিকে আমি আরাধ্য মনে করে শান্তি পাই তিনি আমাকে আস্তিক করে রেখেছেন। কথাটা শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষ আমাকে বলেছিলেন। ‘আপনি যদি রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করেন তাহলে নাস্তিক কেন হবেন!’ কিন্তু ওই সময়ে রবীন্দ্রনাথ নয়, পৃথিবী যে প্রাকৃতিক নিয়মে সৃষ্ট হয়েছে সেই নিয়মের কাছে মাথা নত করে বলছিলাম, আমাকে একটু শক্তি দাও। যে শক্তি পেলে আমি এক্ষুনি পিজি হাসপাতালে ছুটে গিয়ে ছেলেটির রক্তাক্ত শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে লাথি মেরে বলব, দূর হঠো। আমার সমস্ত ইচ্ছাকে একত্রিত করে ছেলেটির চারপাশে বলয় তৈরি করতে চাইছিলাম যাতে ওর প্রাণ শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে না পারে। অথচ এই ছেলেটিকে আমি কখনও চোখে দেখিনি।
মাঝেমাঝেই ছাত্র আন্দোলন হয়। ছাত্ররা তথাকথিত ভদ্রলোকদের মতো আচরণ করে তিরিশ পেরিয়ে গেলে। আদর্শের জন্যে আকাশ স্পর্শ করতে তাদের কারও কারও অবাস্তব উচ্ছলতা আছে। ব্যারিকেড ভাঙতে ওরা আনন্দ পায়, পুলিশের লাঠির আঘাত সহ্য করে, আহত হলে কাঁদে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন যদি হয় তাহলে খালি হাতে যখন আইন অমান্য করতে যায় তখন ওরা জানে সামনে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে তৈরি আছে, তবু যায়। ধরে নিয়ে ভ্যানে তোলে। বোধহয় অনাবশ্যক জঞ্জাল বলে ওদের জেলে নিয়ে গিয়ে ভাত না খাইয়ে দূরের রাস্তায় ছেড়ে দেয়। অল্প আহতরা চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি ফিরে গেলে কাগজওয়ালারা তাদের নিয়ে আর মাথা ঘামায় না।
কিন্তু এই যে ছেলেটি, যার নাম সুদীপ্ত গুপ্ত, তখন মৃত্যুর থাবায় আটকে পড়ছে, তার রক্তচাপ হু হু করে কমছে, নাড়ি অতি অস্বাভাবিক। পাঁচ মিনিট পরে টিভিতে জানলাম ওষুধে কোন কাজ না হলেও ডাক্তাররা চেষ্টা করে যাচ্ছেন ঝড়ো হাওয়ার কবল থেকে দেশলাই কাঠির চিলতে আগুনের শিখাকে বাঁচিয়ে রাখতে। টিভিটা বন্ধ করলাম। করার ঠিক আগের মুহূর্তে সুদীপ্তর দুটো ছবি দেখানো হচ্ছিল। আমি চমকে উঠলাম।
বন্ধ টিভির সামনে বসে অন্য একটি মুখের ছবি দেখছিলাম। তারও চোখ ছিল সুদীপ্তর মতো স্বপ্নালু। ঠোটের কোণে একইরকম কুঞ্জন। গালে হাত দিয়ে তার তাকানোর ছবিটা প্রতিটি শিক্ষিত বাঙালি একসময় দেখেছে। তিনি সুকান্ত ভট্টাচার্য। নামের তো বটেই, মুখের কী মিল দুজনের। সুকান্ত লিখেছিলেন, তিনি পৃথিবীটাকে শিশুদের বাসযোগ্য করে যাবেন। তারপর হলেন ইতিহাস। আহা, সেই বাসনা যদি পূর্ণ হত। আমাদের চারপাশে এত না-এর ধারালো বল্লম যে যাবতীয় বাসনা ক্ষতবিক্ষত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে।
এই যে সুদীপ্ত, তেইশ বছরের তাজা ছেলে, দেখলেই মনে হয় ও আর পাঁচটা গেঁজিয়ে যাওয়া ছেলের থেকে আলাদা, মাকে হারিয়েছিল গত বছর। দিদি, যাঁর মুখের আদল অনেকটা ওরই মতো, বিয়ের পর অন্য সংসারে। তাই বাড়িতে থাকত সে বাবার সঙ্গে। অর্থাৎ নারীবর্জিত বাড়িতে থাকার অসুবিধেগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল সে। এর মধ্যেই শুনেছিলাম, সে বেশ ভাল রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে পারে। ওর লেখালেখির হাতও চমৎকার। সকালে বেরিয়ে পড়াশোনা, ছাত্র ইউনিয়নের কাজ সেরে বাড়ি ফিরে সে নাকি অনেক রাত পর্যন্ত লিখত। কি লিখত, সুদীপ্ত? আচ্ছা, ওর সামনে লক্ষ্য কি ছিল? গায়ক, লেখক না রাজনৈতিক নেতা হওয়া। তৃতীয়টি হওয়ার জন্যে আজকাল শিক্ষার দরকার পড়ে না। এই মুহূর্তে যে দু’জন গায়ক রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে এমপি, এমএলও হয়েছেন, তাঁদের একজন উপেক্ষিত, অন্যজনকে রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে শুনি না। লেখকরা রাজনীতিতে আসেন না। যদি আসেন তাহলে তিনি মুখোশ পরে ক্রীতদাস হয়ে যান, আগের স্বাধীন সৃষ্টিশীল সত্ত্বাকে ভুলে থাকতে চান। তাহলে এই সুদীপ্তর ভবিষ্যৎ ভাবনা কী ছিল?
আমরা যখন ছাত্র তখন কংগ্রেস ক্ষমতায়। খাদ্য আন্দোলনের পর ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছেলেরা পথে নেমেছে। রাস্তায় স্লোগান দিচ্ছে, পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার একশো বারো। কিন্তু তখন বিধান রায়ের কংগ্রেস পুলিশকে উসকানি দিত না, বলত না অকারণে বিরোধীদের পেটাও। আজও ট্রাম-বাস জ্বালায় আন্দোলন মিশে থাকা সমাজবিরোধীরা। কিন্তু তার বাইরে একটা সাধারণ সৌজন্যবোধ দুজনের মধ্যে থেকেই যেত। পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি লোভ দেখাতো তখনও। চাকরির লোভ, ব্যবসার ক্ষেত্রে অনুগ্রহের লোভ। কিন্তু বেশিরভাগ ছাত্র তখন প্রতিষ্ঠানবিরোধী। সরকারের সমর্থক নয়। তাই সরকারের যে-কোনও গোলমেলে কাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে তাদের বেশির ভাগ অংশ ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দিত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছেই তাদের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যেত। পরে দু-চারজন ছাড়া কাউকেই আর রাজনীতির ধারে কাছে দেখা যেত না। অল্পবয়সের নানা উচ্ছ্বাসের মতো এটাও অনিবার্য ছিল।
টিভি খুললাম। জানলাম সুদীপ্তর শরীর আর সাড়া দিচ্ছে না ওষুধে। আর তখনই মনে পড়ল। মাস খানেক আগে একটি ফোন পেয়েছিলাম। অচেনা একটি ছেলে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনি সমসাময়িক সমস্যা নিয়ে লেখেন। কিন্তু আরও ভিতরে ঢোকেন না কেন?’ উত্তরে বলেছিলাম, ‘রাজনৈতিক ইস্তাহার আর সাহিত্য তো এক হতে পারে না। গোর্কির মাদার কোন দলের বুলেটিন নয়।’
‘বিরক্ত করলাম বলে কিছু মনে করবেন না।’ ছেলেটি তার নাম বলে ফোন রেখে দিয়েছিল। সুপ্রীত, সুশান্ত অথবা সুদীপ্ত। যে নামই হোক, তার মুখটা কি এই সুদীপ্তর মতো ছিল? ওই স্বপ্নালু চোখ, গালের পাশে হাত রেখে সে পৃথিবীকে কৌতুকের চোখে দ্যাখে?
পিজির সুপার জানালেন সুদীপ্ত আর নেই।
একদম অচেনা, অথচ গভীরভাবে জানা একটি ছেলের জন্যে আমি কাদলাম। অনেকদিন পরে।
৩৩
ক্লাস এইটে ওঠার পর আমার সহপাঠীরা বাড়িতে আসাযাওয়া শুরু করেছিল। বাড়িতে মহিলা বলতে বিধবা পিসিমা একা। তিনি যেচে ওদের সঙ্গে আলাপ করতেন, নাম জেনে নিয়ে মনে রাখতেন, এলেই নাড়ু অথবা মোয়া খেতে দিতেন। সেই লোভে ওরা সপ্তাহে অন্তত দু’দিন আসত। একদিন একজন নতুন ছেলেকে দেখে পিসিমা সস্নেহে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওমা, কি মিষ্টি দেখতে। কী নাম গো তোমার?’ সহপাঠী নাম বলল, ‘নজরুল রহমান।’ শোনামাত্র পিসিমার মুখে মেঘ জমল, শক্ত হয়ে গেল চোয়াল। তার পর নিজে না নিয়ে এসে কাজের লোককে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিলেন। সবার জন্যে কাঁসার থালায় নাড়ু এবং মোয়া, নজরুলের জন্যে এনামেলের থালায় একটা নাড়ু। ওর জল খাওয়ার গ্লাসও কাঁসার নয়। দেখলাম নজরুলের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। নাড়ুটা মুখে পুরে বলল, ‘আমি না এলে ভাল হত। চললাম।’ বন্ধুরা চলে গেলে পিসিমার সঙ্গে ঝগড়া করেছিলাম। সেটা অবশ্য একতরফা। বলে গিয়েছি আমি, পিসিমা জবাব না দিয়ে তাঁর কাজ করে গিয়েছেন। শেষপর্যন্ত মুখ খুলেছিলেন, ‘তোর ঠাকুমা যখন ছিল তখন ওদের বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হত না। যে পরিবারে যা নিয়ম, তা তো মানতেই হবে।’
নালিশ জানিয়েছিলাম ঠাকুর্দার কাছে। সব শুনে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, তুমি কি এই বাড়িতে মুরগির মাংস খেয়েছ?’ হকচকিয়ে গিয়ে বলেছিলাম, ‘না’। তিনি বলেছিলেন, ‘ব্রাহ্মণরা তো বটেই, ধর্মপ্রাণ হিন্দু মুরগি খায় না। তোমার পিসিমাকে দিয়ে সেটা যখন রান্না করাতে পারবে না তখন এ বিষয়ে কথা বোলো না।’
এমএ পড়ার সময় আমার সহপাঠী ত্রিদিব বলল, ‘একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিস? বাংলা গদ্যসাহিত্যে কোনও মুসলমান গল্পকার ঔপন্যাসিক নেই। আমি এই পশ্চিমবাংলার কথা বলছি।’ আমি প্রতিবাদ করেছিলাম, ‘কেন? সৈয়দ মুজতবা আলি?’ ত্রিদিব বলেছিল, ‘দূর। ওঁর মধ্যে সর্বধর্ম একাকার হয়ে আছে। গীতা উপনিষদ মুখস্থ বলতে পারেন, কোরান ঠোঁটস্থ, বাইবেল যে-কোনও ফাদারের চেয়ে ভাল পড়েছেন। ওঁর লেখা পড়লে মনে হবে কোনও ধর্মের ছাপ ওঁর মধ্যে নেই।’ ঠিক কথা।
পরে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এলেন মুর্শিদাবাদ থেকে। তাঁর লেখার ব্যাপ্তি এবং উৎকর্ষ তাঁকে একজন মুসলমান লেখক হিসাবে সীমাবদ্ধ করে রাখেনি।
এমএ পড়ার সময় সুব্রত এবং শবনমের প্রেম আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল। সুব্রতকে শবনমের পরিবার প্রস্তাব দিয়েছিল বিয়ে করতে হলে তাকে মুসলমান হতে হবে। এতে ওদের দু’জনেরই আপত্তি ছিল। শুনেছিলাম ওরা দু’জনেই দুটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছে, কেউ বিয়ে করেনি, ফলে একসঙ্গে থাকেনি। তখন স্টে টুগেদারের চল এবং সাহস ছিল না।
বছর দেড়েক আগে আমার পরিচিত একটি মুসলমান ছেলে এসে বলল, ‘কাকা, কোথাও একটা ফ্ল্যাট পাচ্ছি না। অফিস থেকে ভাড়া বাবদ আমি পনেরো হাজার পাব। কিন্তু আমার নাম শুনে কেউ ভাড়া দিতে রাজি হচ্ছেন না। আমাকে থাকতে হলে রাজাবাজার, খিদিরপুর, গার্ডেনরিচে যেতে হবে। কিন্তু ওইসব অবাঙালি এলাকায় আমি যেতে চাই না।’ ছেলেটির বাড়ি ছিল বারাসতের ওপাশে। অত্যস্ত শিক্ষিত, বড় চাকরি পেয়েছে, প্রতিদিন ওই দূরত্ব থেকে অফিস করতে অসুবিধে হচ্ছিল। আমি অনেক চেষ্টা করে কসবা এলাকায় একটা ফ্ল্যাট জোগাড় করে দিলে সে নেমন্তন্ন করে খাইয়েছিল।
হুমায়ুন আহমেদ আমার বন্ধু এবং ভাই বললে কম বলা হয়। বাংলাদেশে তার জনপ্রিয়তা শরৎচন্দ্রকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। ওর একটা দুশো টাকা দামের বই ছাপার জন্যে প্রকাশকরা ওকে দশ লক্ষ টাকা অগ্রিম দিত। বইমেলায় সেই বই অন্তত তিরিশ হাজার কপি বিক্রি হত। সেই হুমায়ুন আমাকে একান্তে বলল, ‘দাদা, আমাকে দেশ পত্রিকায় উপন্যাস লেখার সুযোগ করে দেবেন?’ আমি অবাক। বললাম, ‘দেশে উপন্যাস লিখলে তুমি এক লক্ষ টাকাও সম্মানদক্ষিণা পাবে না।’ সে বলল, ‘কোনও সমস্যা নেই। যে কাগজে রবীন্দ্রনাথ থেকে সমরেশ বসু লিখেছেন, সুনীলদা শীর্ষেন্দুদা আপনি লিখছেন সেখানে না লিখতে পারলে ভাল লাগে না।’ যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলাম। বোধহয় পরপর চার পুজোয় সে চারটে উপন্যাস লিখেছিল। আমি কৌতূহলী হয়েছিলাম। পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের প্রতিক্রিয়া সে জানতে চেয়েছিল। দেখলাম কেউ কোনও কথা বলছে না। অথচ সেই উপন্যাস মাস তিনেক পরে ঢাকায় বইমেলায় তিরিশ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। তিন-চারজন পাঠককে চেপে ধরলাম। তাঁরা বললেন, ‘পড়তে পারিনি ভাই। একে তো চরিত্রগুলোর নাম মুসলমানের, তার উপর আপা, দুলা ভাই, ফুপা ইত্যাদি সম্বোধন, নামাজ পড়া, রোজা রাখা ধাতে সইল না। কয়েক পাতা পড়ে অন্য উপন্যাসে চলে গিয়েছি।’ এই তথ্য হুমায়ুনকে বলতে পারিনি আমি। সে রবীন্দ্রনাথকে ঈশ্বর মনে করত। তাঁর গান বা কবিতার লাইন তুলে বই-এর নামকরণ করত।
পাকিস্তান আমলের গোড়ার দিকে পশ্চিমবাংলার বই পূর্ববাংলায় যেত। সম্ভবত আয়ুব খাঁয়ের আমল থেকে সেটা বন্ধ হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যখন আর কোনও বাধা রইল না তখন পশ্চিমবাংলার লেখকরা ওদেশের পাঠকের প্রিয় হয়ে উঠলেন। ক্রমশ পাঠকরা বেছে নিলেন পশ্চিমবঙ্গের চারজন লেখককে। এবার বাণিজ্যে নামল পাইরেট প্রকাশকরা। বিনা অনুমতিতে সস্তায় বই ছেপে বিক্রি করতে থাকল তারা। কিন্তু এইসব বই যাঁরা কিনে পড়ে চলেছেন তাঁরা নামাজ পড়েন, দিদিকে আপা বলে ডাকেন, রোজা রাখেন। কিন্তু ওই লেখকদের বইতে লক্ষ্মীপুজোর কথা, হিন্দুধর্মের প্রসঙ্গ থাকলেও পড়া বন্ধ করেন না। উপন্যাসের রসটাই তাঁরা উপভোগ করেন। পৃথিবীর যেখানে যেখানে বাংলাদেশিরা আছেন সেখানে হুমায়ুন যেমন বেঁচে আছে তেমনই এপার বাংলার ওই চারজন ওঁদের প্রিয় লেখক হয়ে আছেন।
গীতবিতান ছুঁয়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি, পশ্চিমবাংলার গরিষ্ঠ বাংলা বইয়ের পাঠকরা নিজেদের অজান্তেই কেমন করে মৌলবাদী হয়ে গিয়েছেন।
৩৪
তখন উনিশ অথবা কুড়ি। বঙ্কিম অনেক দূরের, শরৎচন্দ্র সম্পর্কে অদ্ভুত অনাগ্রহ, রবীন্দ্রনাথকে অতিরিক্ত সমীহ দেখিয়ে সরে থাকার চেষ্টা। পিছন ফিরে তাকালে নিজেদের সেই বয়সি মুখগুলোকে এখন অশিক্ষিত মনে হয়। কিন্তু সেটা এমন একটা সময় এবং বয়স যার মানসিকতা নিয়ে তর্ক উঠলে নিজের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে যাবে।
ষাট-বাষট্টির কলকাতার কফিহাউসটা ছিল আমাদের কাছে ডানা মেলার জায়গা। টেবিলে টেবিলে ছটফট করছে দারুণ কিছু লেখার ইচ্ছে নিয়ে টগবগে তরুণ রক্ত। বিখ্যাত বিদেশি লেখকদের অনেক লেখা তাদের পড়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে বেঁচে থাকতে গেলে একখানা হাঁসুলিবাঁক, আরণ্যক অথবা টোড়াই চরিতকে পিছনে ফেলা লেখা লিখতে হবে। না পারলে পাশাপাশি আর একটা জাগরী। সমরেশ বসু তখন শ্রীমতী কাফে ছেড়ে বিবরে ঢুকে পড়েছেন। তাঁর ছোটগল্পে তো বটেই, বিটি রোডের ধারে— গঙ্গা হয়ে নতুন গদ্যে বিবর লিখে আমাদের আরও উৎসাহিত করেছেন। মাথার ভিতরে অন্যতর বোধ কাজ করে চলেছে কিন্তু কাগজে কলমে সেটা কোনও সঠিক চেহারা পাচ্ছে না।
কবিতা লিখত শংকর দে। কবিতা ছাড়া কিছুই ভাবত না। একটু বেলায় ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে বালিশের পাশে মায়ের রেখে দেওয়া দুটো টাকা আর একতাড়া কাগজ নিয়ে চলে আসত কফিহাউসের টেবিলে। সারাদিন কফি আর পকোড়া। নিজের টাকা শেষ হলে কেউ যদি খাওয়ায়। দুপুরে দেখা হতেই বলত, ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতাটা আজ লেখা হয়ে গেল।’ মুখে সৃষ্টির উল্লাস। যদিও কালেভদ্রে বড় কাগজে তার কবিতা ছাপা হত। তাতে পরোয়া ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে নাম ছিল, যাতায়াত তেমন নয়। রসিকতা করেছিলাম, ‘তোর কবিতায় একজন বনলতা সেন থাকা দরকার।’ তিনদিন পরে দারুণ কবিতা লিখল সে, ‘একশো পদ্মের মতো তোমার মুখ।’ হেসে বলল, ‘পেয়ে গিয়েছি।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠিনী যিনি দুই বান্ধবী ছাড়া আর কারও সঙ্গে কথা বলতেন না, তাঁর নাম উচ্চারণ করে শংকর বলেছিল, ‘এবার সবাইকে আমার কবিতার কাছে নতজানু হতে হবে।’ আমি নিশ্চিত, সেই সুন্দরী এই খবর পাননি, কিন্তু শংকর তাতে ডুবে ছিল।
কফিহাউসে তখন বেপরোয়াদের পাশাপাশি কিছু গম্ভীর মানুষ। নির্মাল্যদা এবং সৌমিত্রদা ‘এক্ষণ’ বের করছেন কফিহাউসের টেবিল থেকে। তার সূচিপত্রে বিদ্বজ্জনেরা ঠাসা। ওদিকে শক্তিদা সুনীলদাদের আড্ডা। শক্তিদা কবিতা না বলে ‘পদা’ বলতেন। শংকর কখনও সখনও যেত এদের টেবিলে। ওর মুখে শুনেছিলাম বিছানায় একডজন পুঁচকে বালিশ না থাকলে শক্তিদার ঘুম আসত না। বিকেল শেষ হতেই শক্তিদার দলবল রওনা হত খালাসিটোলার পথে। সেখান থেকে কয়েকজন মধ্যরাতে বেরিয়ে কলকাতা শাসন করত। শংকর কখনওই এই পথে হাঁটেনি। বলত, ‘ভালবাসা ছাড়া অন্য কোনও নেশায় আমি নেই।’ ওর ‘স্বপ্নের মধ্যে চিৎপুর ফায়ার এ্যালার্ম’ আমাদের সমীহ আদায় করেছিল।
সেইসময় নিজেকে ভাঙতে মরিয়া ছিল একঝাঁক কবি, লেখক হওয়ার স্বপ্ন চোখে তরুণ। যাবতীয় নেশায় ডুবে যেতে বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না তাদের। কফিহাউসের চেয়ারে শরীর বেঁকিয়ে বসে তুষার রায় নিজের হাসি হেসে বলত, ‘ভাবা যায়!’ একটা ছোট্ট বুলেটের খাপে কামানের বোমা ভরলে যা হয় তাই ছিল সে। নিজেকে নিয়ে যেমন পারিপার্শ্বিক নিয়ে তেমনই ব্যঙ্গ করে গিয়েছে কবিতার লাইনে। ‘ওই ভাবে আত্মহননের পথে না হাঁটলে, তা, কী লিখত সে এর জবাবে ওর অনুসরণ করে বলি, ভাবা যায়।’
ওই নিয়মভাঙার মিছিলে শক্তিদা-সুনীলদার সঙ্গে যাঁরা ছিলেন তাঁরা এক এক করে হারিয়ে গিয়েছেন। ঝড়ের গতির গাড়ি আচমকা থামিয়ে সুনীলদা নিজেকে নিয়ন্ত্রিত করলেও শক্তিদাকে সমস্যায় ফেলেছিল। তবু সরে আসছিলেন আর আমরা অসামান্য কবিতাগুলো পেয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু বাকিরা হারিয়ে গেল কেন? জামশেদপুর থেকে এসেছিল কমল চক্রবর্তী। নতুন ধরনের গদ্য লিখত। শক্তিদা-সুনীলদার শিষ্যত্ব নিয়ে বারোদুয়ারি থেকে চাইবাসায় বাংলা-মহুয়া খেয়ে বেড়াত। অথচ চাকরি করত জামশেদপুরে। আমার মনে হত নিজেকে ধ্বংস করতে ওর যতটা আনন্দ লেখায় ততটা নয়। বন্ধুরা বলত, কমলকুমার মজুমদারের সার্থক উত্তরসূরি। একবার জামশেদপুরের আকাশছোঁয়া জলের ট্যাঙ্কের মাঝখানে আ- আলজিভ পান করে চিত হয়ে শুয়ে সে বলেছিল, ‘আসুন সমরেশ, চাঁদটাকে গিলে ফেলি।’ তার পর আচমকা হারিয়ে গেল। কৌরব নামের একটি দারুণ পত্রিকা করে চমকে দিয়েও আড়ালে চলে গেল। অথচ, কথা ছিল, ও আর একটা ‘ঢেঁাঁড়াই চরিতমানস’ লিখবে।
বছর সতেরো আগে গালুডি থেকে বান্দোয়ান যাওয়ার পথে দলমা পাহাড়ের ঠিক মাঝখানে আদিগন্ত শূন্য চরাচর দেখে কমলের মনে হয়েছিল ওটাই ওর পৃথিবী। মানুষ দূরের কথা, মাইলের পর মাইল গাছ নেই, জমি জলের চেয়ে সস্তা। যা সঞ্চয় ছিল তাই দিয়ে কয়েকজন সমমনের বন্ধুকে জুড়িয়ে বিঘের পর বিঘে জমি কিনে লক্ষ লক্ষ গাছ লাগিয়ে ফেলল সে। গাছগুলি যখন মাথা তুলল তখন ওর মনে হয়েছিল একটার পর একটা কবিতা লেখা হয়ে যাচ্ছে। কোনও কল্পিত ঈশ্বর নয়, বৃক্ষই মানুষের দেবতা। দূরের গ্রামে আদিম অন্ধকারে বসে থাকা শিশুদের তুলে নিয়ে এসে অক্ষর চেনাত। তাদের বাবা-দাদা-কাকা তখন মাওবাদের সত্য না জেনেও মাওবাদী। পরিচিতদের কাছে হাত পেতে পেতে সে ওই শিশুদের আলুসেদ্ধভাত খাইয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা মুখস্থ করাত। খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছে দেখলাম জায়গাটার নাম দিয়েছে, ভালোপাহাড়। মাওবাদীরা নিজেদের সন্তানের কথা ভেবে ওকে এড়িয়ে গিয়েছে। সেই শিশুরা আজ বালক অথবা তরুণ। মুখে শিক্ষার আলো।
প্রথমেই মনে হয়েছিল আমরা যা পারিনি তা কমল পেরেছে। ওই নাকি টুড়ু বাচ্চারা যারা শিশু থেকে পুনশ্চ বলতে পারে, ওই লক্ষ গাছেরা ছায়ায় মাটি স্নিগ্ধ করে রাখে তা একটি হাঁসুলিবাঁক, আরণ্যকের চেয়ে অনেক মূল্যবান। নেশার ঘোরে কমল যা লিখতে চেয়েছিল, নেশামুক্ত হয়ে তাই লিখে ফেলেছে।