গীতবিতান ছুঁয়ে বলছি ১.২৫

২৫

আমাদের অল্পবয়সের জনপ্রিয়তার চূড়োয় ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেসময় মান্না দে’র গান আমরা অল্প অল্প শুনছি। শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুণমুগ্ধ ছিলেন বেশ কয়েক হাজার শ্রোতা। কিন্তু সেই কোনও এক গাঁয়ের বধূ, রানার, পাল্কির গান থেকে যে গায়ক আমাদের ধন্য করেছেন তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আর যাঁর গান শুনে জীবনে প্রেম শব্দটি জানান দিয়েছিল, যাঁর গায়কী বুকের গভীরে রোমান্টিসিজমের ঢেউ এনেছিল তিনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। জলপাইগুড়ির সেই কিশোর স্বপ্নেও ভাবেনি যে এই দু’জনের সংস্পর্শে কখনও আসতে পারবে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য পেয়েছি, কখনও স্নেহ করেছেন, কখনও বিরক্ত হয়েছেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সামনে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু টেলিফোনে কথা হয়েছে, একবার আবদার করায় কথা থামিয়ে গানও শুনিয়েছিলেন। একজন মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় পাওনা আর কী হতে পারে।

স্কুলের শেষদিকে আর একজন গায়ক আমাদের আপ্লুত করলেন। আমরা সুবীর সেনের নাম শুনলাম। ‘ওই উজ্জ্বল দিন’ গানটাকে কোরাসে গাইতে লাগলাম। তখন প্রতি বছর দু’টো গান পুজোর আগে রেকর্ডে বের হত। বড় রেকর্ড গ্রামোফোনে বাজানো হত। সেই দুটো গানের একটাও যদি মনে না ধরত তাহলে গায়ক অন্তত একবছর পিছিয়ে যেতেন। আধুনিক বাংলা গান প্রতিবছর সেই পরীক্ষায় এমন উত্তরে যেত যে সময়টাকে স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। সুবীর সেনের ‘সন্ধ্যা লগনে স্বপ্ন মগনে’, ‘রাত হল নিঝুম’, ‘তুমি বলেছিলে মনের মুক্তো যায় না তো ওগো কেনা’, ‘তুমি আমার প্রেম’, ‘নয় থাকলে আরও কিছুক্ষণ’, ‘আমার বুকের ঘরে ঢুকে গেল’। কেউ কেউ বলত সুবীর সেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ঘরানার গায়ক। আমার সেকথা মনে আসত না। তাঁর কণ্ঠস্বর এবং গায়কী অনেক কাছের, ওই বয়সের তরুণ মনের চাওয়ার সাথে মিশে যেত। তারপর তিনি মুম্বই চলে গেলেন। হিন্দি ফিল্মে তাঁর গান সুপারহিট হল। মহম্মদ রফি থাকা সত্ত্বেও ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেলেন। বাংলা গান গাইছেন না দেখে আমরা খুব ক্ষুব্ধ। কিন্তু তারপর আচমকা নীরব হয়ে গেলেন।

সুবীর সেনকে নিয়ে তখন নানা গুজব। একসময় তাও শেষ হল। তখন একদম চুপচাপ। ওঁর সম্পর্কে ঘনিষ্ঠজনেরা নিশ্চয়ই ওয়াকিবহাল ছিলেন কিন্তু আমার মতো সাধারণ মানুষ একেবারেই অন্ধকারে ছিলাম। বহু বছর পরে জানতে পারলাম, সুবীর সেন এখন কলকাতায় পাকাপাকি, আবার গান গাইছেন। কিন্তু এই পর্বের গানগুলো সোনার দিনগুলিকে ফিরিয়ে আনল না। আমার কাছে সুবীর সেন একজন সুদর্শন মানুষ, উত্তমকুমারের সঙ্গে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, জ্যোৎস্নাভেজা এক রাতের নায়ক। রাতের আকাশের দিকে তাকালেই লাইনগুলি হুড়মুড়িয়ে আসে, ‘মন নাই প্রেম নাই, আপনারে যেন তাই, কত একা মনে হয়, হাওয়া শুধু কথা কয়।

এই সময় একটি সুরপাগলের সঙ্গে আলাপ হল। দীর্ঘকাল মুম্বইতে আর ডি বর্মনের সহকারী হিসাবে কাজ করেছে, কলকাতার গানের জগতে কিছু করার চেষ্টা করছে। ছেলেটার ডাকনাম রামজি, ভাল নাম সৌমিত্র চ্যাটার্জি। বিখ্যাত নায়কের নামে নাম বলে সে রামজি হিসাবেই পরিচিত হতে চায়। আমি তখন অরিজিৎ গুহের সাথে টিভি সিরিয়াল বানাই। রামজির সাথে পরিচয় সেখানে তার কাজ করতে আসার সূত্রে। চমৎকার গিটার বাজায় সে। একদিন আড্ডা মারতে গিয়ে জানতে পারলাম সে সুবীর সেনের গানের অনুষ্ঠানে গিটার বাজায়। কোথায় থাকেন সুবীর সেন? জেনে খুব অবাক হলাম। বাংলায় প্রথম টিভি সিরিয়ালের প্রযোজক ছিল জোছন দস্তিদারের সোনেক্স। গল্প ও চিত্রনাট্যের দায়িত্ব ছিল আমার উপরে। সোনেক্সের অফিস ছিল পণ্ডিতিয়া রোডে। রোজই যেতে হত। কিন্তু আমি তখন জানতাম না ওই অফিস থেকে মাত্র তিন মিনিট দূরে সুবীর সেনের বাড়ি। রামজি জানাল, ওই বাড়িতে সুবীর সেন সকালে এসে রাত পর্যন্ত থেকে গল্ফগ্রিনের বাড়িতে চলে যান। ওই বাড়িতে তিনি একাই থাকেন, পরিচিতরা এলে আড্ডা জমে। রামজির সঙ্গে সুবীর সেনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। দুটো ঘর। দেখলেই বোঝা যায়, মেয়েদের স্পর্শ ওখানে পড়েনি। একেবারে মেসবাড়ির মতো অবস্থা। সেসময় প্রচুর বেড়াল ছিল ওঁর বাড়িতে। প্রথম দিনেই সম্পর্কটা এমন জমে গেল যে মনে হচ্ছিল উনি অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্যে। রেকর্ডের মাধ্যমে তিনি আমার কাছে পৌঁছেছিলেন, কিন্তু বুঝলাম আমার দু’চারটে লাইন তাঁর পড়া আছে।

খুব রোগা হয়ে গিয়েছেন, বয়স ওঁর কণ্ঠে থাবা বসিয়েছে কিন্তু কথা বলেন চমৎকার ভঙ্গিতে। জানলাম, স্ত্রী গত হয়েছেন অনেক আগে। একমাত্র মেয়ে থাকে আমেরিকায়। তাঁর সামনে বসলে গানের জগতের নানা কাহিনি শুনতে পাই। গর্ব করে বলেন, ‘আমিই একমাত্র বঙ্গসন্তান যে মুম্বইতে গিয়ে পরপর দু’বছর সেরা গায়কের স্বীকৃতি পেয়েছি।’ গুরু মনে করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে। অভিমান, রবীন্দ্রনাথের সুর আত্মসাৎ করে হিন্দিগানের জগতে নাম করেছেন যে সুরকাররা তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বিশ্বভারতী।

নিয়মিত আড্ডা মারতে যাই। যাওয়া মানে কত ঘটনার কথা জানতে পারা। সন্ধে হলেই তাঁকে ঘিরে যারা সময় কাটায় তারা যে সবাই সু-উদ্দেশ্যে আসছে তা নয়, সুবীর সেন বুঝেও না বোঝার ভান করেন। একটা হরমোনিয়াম পড়ে থাকে বাইরের ঘরে। আমি উত্তেজিত করলে সেটা নিয়ে বসেন। গলায় জোর কমে গেলেও যখন গেয়ে ওঠেন, নিভু নিভু হল তারার প্রদীপ ওই, আপনার সাথে একা একা কথা কই’ তখন আচমকা অতীত ফিরে আসে। ওই গানের সুরকার ছিলেন তিনি নিজেই! বললেন, ‘সুরটা মাথায় আসতেই ছুটে গেলাম গৌরীদার কাছে। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের তখন চাহিদা তুঙ্গে। যখন গেলাম তখন তিনি স্নানের আগে তেল মাখছিলেন। সেই তেল হাতেই আমার সুর শুনে লিখে দিলেন, রাত হল নিঝুম, তারার দু’চোখে ঘুম।’ এরকম নানা গল্প। গর্ব করে বলেন, ‘সলিল চৌধুরির কথা ও সুরে শ্রেষ্ঠ গানটি তাঁর গাওয়া, ‘ধরণীর ধূলি….।’

কিন্তু যখন সবাই চলে যায় অথবা কেউ আসে না তখন গল্ফগ্রিনের নিরাপদ আবাসে ফিরে যাওয়ার আগে সুবীর সেন শরীরে নানা রোগ নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যান। আর এখন নিজের সাথে হয়তো একা একা কথা বলেন।

২৬

শোকের সময় আমাদের আবেগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণে থাকে না। হা-হুতাশের সময় এমন কথা বলে ফেলি যা অন্যসময় বলতাম না। একটু রসিকতা করছি, গম্ভীর মনের পাঠক-পাঠিকারা মার্জনা করবেন।

স্বামী-স্ত্রী তিনঘরের একটি সুন্দর বাড়িতে থাকেন যার ছোট্ট উঠোন রয়েছে। স্ত্রীর বাহান্ন, স্বামীর আটান্ন বছর চলছে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে বছর সাতেক আগে যারা দূরের শহরে থাকে। এই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, যেমন হয়, ভাব-ভালবাসার পাশাপাশি মতান্তর প্রায়ই ঘটে থাকে। তবে বারো ঘণ্টার বেশি কথা বন্ধ থাকে না। মেয়ে-জামাই পাঁচ বছরের নাতনিকে নিয়ে এল কয়েকদিনের জন্য। বাড়িতে খুশির হাওয়া, নাতনি বায়না ধরল সে দিদার সঙ্গে শোবে। দিদা এককথায় রাজি। দুটো রাত কাটল। ভদ্রলোক একাই মাঝরাত পযন্ত টিভি দেখে ঘুমিয়ে পড়েন। স্ত্রী পাশে থাকলে এই স্বাধীনতা পাওয়া যেত না। তৃতীয় রাতের বারোটার সময় চ্যানেল ঘোরাতে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখানো শুরু হল। ওই ছবি বহুবার তিনি ছাত্রাবস্থায় দেখেছেন কিন্তু স্ত্রীকে আক্ষেপ করতে শুনেছেন দেখা হয়নি বলে। নাতনির অত রাতে জেগে থাকার কথা নয়, স্ত্রীকে খবরটা দিলে তিনি মহানন্দে ছবিটা দেখতে পারবেন। প্রায় নিঃশব্দে স্ত্রী যে ঘরে শুয়েছিলেন তার বন্ধ দরজায় আলতো টোকা দিলেন তিনি পাছে নাতনির অসুবিধা হয়। কোন প্রতিক্রিয়া নেই। তৃতীয়বারে দরজা খুলে স্ত্রী ইশারায় জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার? স্বামী নিচুগলায় বললেন, ‘ঘরে চলো, বলছি।’

‘মানে?’ স্ত্রী অবাক।

‘আরে এসো, না হলে কী করে বুঝবে?’ স্বামী চোখ টিপলেন রহেস্যর হাসি হেসে।

স্ত্রী চাপা গলায় ধিক্কার দিলেন, ‘তোমার কি লাজলজ্জা নেই। ওপাশের ঘরে মেয়ে-জামাই শুয়ে আছে, ইস, কি ঘেন্না, কি ঘেন্না। মাসের পর মাস তাকিয়েও দ্যাখো না, যেই দুটো রাত নিশ্চিন্ত হয়েছি অমনি জ্বালাতে এলে?’ মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন স্ত্রী। চোরের মতো ঘরে ফিরেছিলেন স্বামী।

ভোর এল। সবাই দরজা খুলল কিন্তু ভদ্রলোকের ঘরের দরজা ভাঙতে হল। ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বললেন, ‘ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। চেঁচানোর সুযোগ পাননি।’ খবর কানে যাওয়ামাত্র স্ত্রীর দাঁতে দাঁত লেগে গেল। ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়ার পরে ফুলের মালা পরিয়ে ভদ্রলোককে উঠোনের চারপাইতে শোওয়ানো হল। মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার মাকে বলল, ‘বাবাকে শ্মশানে নিয়ে যাচ্ছে, একবার দেখবে না?’

দাঁত ফাঁক হল। কোনওরকমে শরীরটাকে উঠোনে নিয়ে গিয়ে স্বামীর মৃত শরীরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন স্ত্রী, ‘তখন আমার মাথায় কী ঢুকেছিল গো। তুমি কত করে ঘরে যেতে বললে, কেন আমি তোমার শেষ ইচ্ছে পূর্ণ করতে মাঝরাতে গেলাম না গো। ওহো ওহো, আমি যে পাপী হয়ে থাকলাম।’

মেয়ে এগিয়ে এসে মায়ের মুখে হাত চাপল, ‘এসব কী বলছ মা?’

মা বলল, ‘বলতে দে, বলতে দে, তোর বাবা ঠিক শুনছে, ক্ষমা করে দেবে আমাকে।

.

শোকের সময় আবেগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণে থাকে না, ওই ভদ্রমহিলা কয়েক ঘণ্টা পরে ওসব বলার জন্য লজ্জিত হবেন। সাধারণত পরিচিত অথবা আত্মীয়ের মৃত্যু মানুষকে যেমন শোকগ্রস্ত করে তেমনই বিখ্যাত কোনও ব্যক্তির মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মৃতদেহের কাছে শ্ৰদ্ধা জানাতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে অনেকেই বাড়তি কথা বলে থাকেন। বেঁচে থাকার সময়ে অনেক কুকর্ম করেছেন এমন লোকের মৃতদেহ দেখার সময় শোকগ্রস্তকে বলতে শুনেছি, ‘আহা! বড় ভাল লোক ছিলেন।’

আমার ছেলেবেলার জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী সনৎ সিংহের মৃত্যুর কদিন বাদে এক বন্ধু ফোন করেছিলেন, ‘আপনি বিখ্যাত গায়ক দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের স্টেটমেন্ট শুনেছেন?’

‘না। কী ব্যাপার?’ একটু অবাক হলাম।

‘উনি বলেছেন, সমসাময়িক সব শিল্পী চলে গিয়েছেন, আমি একা রয়ে গেছি।’ বন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওঁর কি স্মৃতি কাজ করছিল না?’

বললাম, ‘কেউ কেউ চলে গেলে নিজেকে খুব একা মনে হয়। সেরকম মনে হওয়াতেই বোধহয় বলেছেন।’

‘দ্বিজেনবাবু যখন মধ্যগগনে তখন যাঁরা জনপ্রিয় হয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই এখনও আমাদের মধ্যে আছেন। এরকম স্টেটমেন্ট তাঁদের কষ্ট দেবে।’ বন্ধু বললেন।

আমি নিশ্চিত জানি দ্বিজেনদা অতশত ভেবে কথা বলেননি। সনৎ সিংহের চলে যাওয়ার শোক তাঁকে একা করেছিল। দ্বিজেনদাকে আমি বহু বছর ধরে জানি। আমরা একাই রাস্তায় থাকতাম। মাঝে মাঝে রবিবারের সকালে তাঁর ক্লাস শেষ হলে আমি টু মারতাম। এমন নিপাট ভদ্রমানুষ আমি খুব কম দেখেছি। বয়সে অনেক ছোট হওয়া সত্ত্বেও বারংবার বলেও ওঁর আমাকে ‘আপনি’ বলা বন্ধ করতে পারিনি। এখন তিনি সল্টলেকের বাড়িতে চলে গেছেন। কথাবার্তা হয় না। কিন্তু দীর্ঘদিন যে ভদ্রতাবোধকে তিনি পালন করেছেন তা কখনওই ত্যাগ করতে পারেন না। সাময়িক আবেগে ওই কথাগুলো বলেছেন বলে আমি বিশ্বাস করি।

প্রিয় মানুষ যখন চলে যান তখন নিজেকে ভয়ঙ্কর একা মনে হয়। কেউ যখন দীর্ঘকাল বেঁচে থাকেন তখন তাঁকে অনেকবার ওই অভিজ্ঞতার সামনে পড়তে হয়। আমার পিতামহ, বড় পিসিমা, বাবার মৃত্যুর সময় আমি কলকাতায় ছিলাম। এঁরা গত হয়েছিলেন জলপাইগুড়ি শহরে। প্রত্যেকর ক্ষেত্রে খবর পাওয়ামাত্র তাঁকে ঘিরে থাকা আমার ছেলেবেলাটা চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। বুকের ঘর তখন শূন্য, মনে হত আমি একা হয়ে গেছি। বড়পিসিমা, যিনি বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে এসে বাবাকে এবং আমাকে লালন করেছিলেন তাঁর মৃত্যু সংবাদ সহ্য করা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। এই যে বারংবার একা হয়ে যাওয়া, এটা মানুষের পক্ষেই সম্ভব। আমাদের মধ্যে অনেকগুলো ‘একা’ আছে। প্রিয়জন চলে যাওয়ার সময় এক-একটি জানান দেয়। এই করতে করতে যখন সব একা ভেঙে পড়বে তখন চুপচাপ শেষ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই।

মনে পড়ছে সেই বৃদ্ধার কথা। মাথায় ভেজা গামছা, পরনে ময়লাটে ছোট থানকাপড়, বৃন্দাবনের গলি দিয়ে কোনমতে হাঁটছেন ভরদুপুরে। কতদিন সেখান আছেন জিজ্ঞাসা করাতে বললেন, ‘পাঁচ কুম্ভ পার হয়ে গেল তবু যমুনা আমাকে টেনে নিল না গো।’ এই সময়টাই ভয়ঙ্কর। যখন আবেগ ফুরিয়ে যায়।

২৭

গলায় গান কেউ কেউ পেয়ে যান অনায়াসেই, অনেকেই পান না। এই রহস্যের সমাধান এখনও অস্পষ্ট। কোটি কোটি মানুষ মায়ের পেট থেকে বের হচ্ছে, একই গঠন তাদের, গলার ভিতরটাও আলাদা নয় কিন্তু কেউ সুরে গাইবে, বেশির ভাগই বেসুরে। জলপাইগুড়ির সেই সময়ের বিখ্যাত সঙ্গীতাচার্য তরু রায়কত মশাই-এর কাছে প্রশ্নটা রেখেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘সবার গলায় সুর থাকে। যাদের বেসুরো মনে হচ্ছে তারা চর্চা করলেই সুরে গাইতে পারবে। চর্চা হল সেই হাওয়ার মতো যা গলার ভিতরের যাবতীয় আবর্জনা দূর করে দেয়।’

খুব উৎসাহিত হলাম। তখন চোদ্দো কি পনেরো। আমাদের একগাদা বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র গায়ক তপন ঘোষ। হেমন্ত আর তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান ফাটাফাটি গায়। কিন্তু হারমোনিয়াম বাজাতে পারে না, চর্চা তো দূর অস্ত। আমি তখন রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে জেনে ফেলেছি, ‘পাখিরে দিয়েছ গান, গায় সেই গান, তার বেশি করে না কো দান/আমারে দিয়েছ স্বর, আমি তার বেশি করি দান, আমি গাই গান।’ অতএব চর্চা করে গলায় সুর আনতে একজন গানের মাস্টারের শরণাপন্ন হলাম। তিনি একটা গান শোনাতে বললে বেশ আবেগ দিয়ে ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’ গাইতে লাগলাম। কিন্তু চার লাইন গাইবার পরে ভদ্রলোক ইশারায় থামতে বলে হাসলেন, ‘দ্যাখো, সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। গান গাইবার চেষ্টা তুমি কোরো না।’

আমি মরিয়া হলাম, ‘যদি খুব চর্চা করি?’

‘মরুভূমিতে কি তুমি হাজার চেষ্টা করে ধানচাষ করতে পারবে?’

সেই যে ধাক্কা খেলাম, তাতে মন ভাঙেনি। আমার জন্যে বাথরুম আছে। সেই চানঘরে গান গাওয়া তো কেউ আটকাতে পারবে না।,

কিন্তু তখন সেই ছাত্রাবস্থায় যিনি ভাল গান গাইতেন তার সঙ্গে ঠিক জুটে যেতাম। জলপাইগুড়িতে সেই সাতান্ন/আটান্ন সালে অন্তত পাঁচজন খুব ভাল নায়ক-গায়িকা ছিলেন। প্রদ্যোৎ বর্মণ এবং গীতা ঘটক তো কলকাতায় বেশ নাম করেছিলেন, এখন সেই সব শিল্পীরা যে কোথায় আছেন, জানি না।

স্কটিশের যে হোস্টেলে আমার জায়গা হল, তার পাশেই ছিল একটা গানের স্কুল। জানলা দিয়ে দেখতাম সুমিত্রা সেন গান শেখাতে আসছেন। একদিন তাঁকে প্রণাম করতেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তুমি কি গান শেখো?’ মাথা নেড়ে চলে এসেছিলাম। কী করে বলব আমার দ্বারা গান হবে না।

শেষপর্যন্ত স্থির করলাম, গাইতে না পারি, গান তো লিখতে পারি। তখন মেগাফোন কোম্পানির খুব নামডাক। কলকাতার রাস্তা ভাল না চিনলেও চলে গেলাম ওদের ধর্মতলার অফিসে। তখন দুপুর। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা যে লোকটি গম্ভীর মুখে বসে আছেন, তাঁর নাম যে কমল ঘোষ তা পরে জেনেছি। যাঁরা বাংলা গানের ইতিহাস জানেন, তাঁরা কমলবাবুকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।

কমলবাবু আমার দিকে তাকালেন। ‘কোনও দরকার আছে ভাই?’

একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘আমি গান লিখতে চাই।’

‘কেন?’ কমলবাবু চোখ ছোট করলেন।

‘আমার মনের মধ্যে গান আসছে, তাই।’ সাহস করে বললাম।

‘ওই টেবিলের পাশের চেয়ারে গিয়ে বসো।’

অনেকটা দূরত্বের চেয়ারে বসলাম। প্রায় আধঘণ্টা চলে গেল কিন্তু কোনও নির্দেশ আসছে না। আমি মনেমনে যাবতীয় আধুনিক বাংলা গানের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করে চলেছি। এইসময় একজন ঘরে এলেন। লম্বা, সিড়িঙ্গে চেহারা, পরনে পাঞ্জাবি আর একটু খাটো পাজামা।

কমলবাবু তাঁকে বললেন, ‘দ্যাখো তো, ওই ছেলেটি গান লিখতে চাইছে, কীরকম লেখে দেখে নাও।’

ভদ্রলোক কাছে এসে বললেন, ‘বাঃ, গান লিখবেন। কী নাম?’

নাম শুনে বললেন, ‘মজুমদার চমৎকার। ওখানে কাগজ আর পেন্সিল রয়েছে, টেনে নিন। প্রথম লাইনটা বলছি, তোমাকে বেসেছি ভালো। পরের লাইনগুলো সুন্দর করে লিখে ফেলুন।’ বলে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

পেন্সিল নিয়ে কাগজের উপর ঝুঁকে বসলাম। ভালোর সঙ্গে কি মেলাবো? আলো? কালো? জ্বালো। কিছুতেই মাথায় আসছিল না। একবার লিখলাম, দু’চোখে দেখেই আলো, কিন্তু পছন্দ হল না। গোটা দশেক দ্বিতীয় লাইন লিখে যখন কাটলাম তখন তিনি এলেন। কাগজটা টেনে নিয়ে দেখে বললেন, ‘দেখুন ভাই, সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। নিজের এবং অন্যের সময় আর নষ্ট করবেন না।

মুখ কালো করে বেরিয়ে এসেছিলাম। গান শিখতে চেয়ে এই কথাগুলোই তো জলপাইগুড়িতে শুনেছিলাম।

.

এই ঘটনার বাইশ কি তেইশ বছর পরে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কফি হাউসে আড্ডা মারছি, পাশের টেবিলে বসা একজন উঠে এলেন, ‘বসছি ভাই। আপনি তো চমকে দিয়েছেন। উত্তরাধিকার পড়েছি এখন কালবেলা পড়ছি। খুব ভাল লিখছেন। আমার অভিনন্দন নিন’ হাত বাড়ালেন তিনি। আমি হতবাক। দুই দশকের আগের মানুষটি আমার সামনে বসে। বললেন, ‘আমার নাম গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। চমৎকার লিখছেন।’

বলতে পারিনি সেদিনের কথা। বাংলা আধুনিক গানকে যিনি সমৃদ্ধ করেছেন, রবীন্দ্রনাথের পরে সলিল চৌধুরির পাশাপাশি যাঁর নাম উচ্চারিত হয় তিনি তো ভুল কথা বলেননি। আমার দ্বারা গান লেখা হল না। আর তিনি? প্রিয় গায়ক সুবীর সেনের মুখে শুনেছিলাম। একটা সুর মাথায় আসায় ভরদুপুরে সুবীরদা গৌরীপ্রসন্নের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি তখন স্নান করবেন বলে তেল মাখছিলেন। সেই অবস্থায় সুর শুনতে শুনতে গান লিখে দিয়েছিলেন। কাগজে তেলের দাগ ফুটে উঠেছিল। আমরা অনবদ্য গান পেলাম। ‘রাত হল নিঝুম, ফুলের দু’চোখে ঘুম’।

গান গাইতে না পারি, গান লিখতে না পারি কিন্তু ঈশ্বর পারেননি গান শোনা বন্ধ করতে। স্মৃতিতে গানের ভাণ্ডার এখনও অটুট রয়েছে।

২৮

রবিবারের সন্ধেবেলায় কালীঘাট মেট্রো রেলের স্টেশনে এসে শোভাবাজারে যাব বলে মেট্রোয় উঠেছিলাম। কামরা একেবারেই ফাঁকা। অবশ্য ভিড় থাকলেও ইদানীং সিনিয়র সিটিজেন চিহ্নিত বেঞ্চিতে বসার সুযোগ পাচ্ছি, বসে দেখলাম দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে গলা খুলে গল্প করছে। ওদের আশেপাশে কোনও মানুষ আছে বলে ওরা মনে করছে না। তিনজনের পরনে জিনস আর গেঞ্জি। পিঠে ঝাঁকড়া ব্যাগ। বসার জায়গা খালি পড়ে থাকা সত্ত্বেও ওরা বিপরীত দিকের দরজায় গায়ে দাঁড়িয়ে যে কথা বলে চলেছে তার ষাটভাগ ইংরেজি, দশভাগ হিন্দি এবং বাকিটা বাংলা। এরা যে ইংরেজিতে কথা বলে তা শুনলে নেসফিল্ড সাহেব ভিরমি খেতেন। শব্দগুলোকে সঙ্কুচিত করে ওরা যেখানে নিয়ে গিয়েছে তাতে অভ্যস্ত নাহলে বোঝা যাবে না। দেখলাম মেয়েটির জিনস নীচের দিকে প্রায়ই নেমে যাচ্ছে এবং সে শেষ মুহূর্তে সেটাকে ওপরে টেনে তুলছে। মুখ-চোখ শরীর বেশ সুশ্রী কিন্তু নিজেকে সুন্দরী দেখানোর কোনও চেষ্টাই নেই। ছেলেটাকে দেখে হতাশ হলাম। একজনের তো বেশ চোয়াড়ে মুখ, বেশ রোগা শরীর অথচ চুলের ঝুঁটি গার্টারে মোড়া। দ্বিতীয়জন মোটাসোটা, বেশ গবেট দেখতে। সে কথা বলার বদলে হাসছিল বেশি। বসে থাকা যাত্রীরা ওদের সোল্লাসে বলা কথাবার্তা শুনতে পছন্দ করছিল না কিন্তু কেউ মুখ খুলছিল না। পার্ক স্ট্রিট স্টেশন যখন আসছে তখন ঝুঁটিওয়ালা ছেলেটা চিৎকার করে ‘বাই’ বলে দরজার দিকে এগোতেই মেয়েটাও তার পাশে চলে এল। তারপর আমাদের মরা চোখের সামনে দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে প্রায় আ-আলজিভ চুমু খেল। লক্ষ্য করলাম সবাই দৃশ্যটি দেখছে কিন্তু পুতুলের মতো বসে আছে। ছেলেটা প্ল্যাটফর্মে নেমে হাত নেড়ে সাংকেতিক ভাষায় কিছু বলা মাত্র ট্রেন চলতে শুরু করল। মেয়েটি ফিরে গেল দ্বিতীয় ছেলেটির কাছে। গিয়ে আগের মতো সহজভঙ্গিতে গল্প করতে লাগল।

আমার তখন কীরকম বোধ হচ্ছিল? রেগে গিয়েছিলাম? সমাজটা কোথায় যেতে বসছে ভেবে ক্ষিপ্ত হয়েছিলাম? নাকি ঈর্ষায় শুকোচ্ছিলাম? হয়তো শেষটাই ঠিক। ওরা পরস্পরকে ভালবাসে। লজ্জা না করে ঠোঁটে ঠোট ছুঁয়েছে। সেকেন্ড তিরিশেক। আমাদের এই সাহস ছিল না। বছর দশেক আগে ছেলেমেয়েরা বড়জোর হাতে হাত রাখত। প্রথমবার যখন বিদেশে যাই, নিউ ইয়র্কের ফুটপাতে পরস্পরকে জড়িয়ে চুমু খাওয়া নারী-পুরুষকে স্ট্যাচু ভেবেছিলাম। ওদের দু’পাশ দিয়ে মানুষজন হেঁটে যাচ্ছিল কিন্তু কেউ মুখ ফিরিয়ে তাকাচ্ছে না। যেন চুমু খাওয়াটা অপরাধ নয়, হাঁ করে দেখাটাই অসভ্যতা। এই একই দৃশ্য টরন্টো অথবা মেলবোর্নে দেখতে অভ্যস্ত হয়েছি। চিন-জাপানের কথা জানি না। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে কেউ ভাবতেই পারত না। ট্রেনে, রাস্তায় চুমু খাওয়াকে পুলিশ প্রকাশ্যে অশ্লীল আচরণ হিসাবে কি ভেবে নিতে পারে? অন্তত এদেশে? আমি ততক্ষণে ওই প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য ঈর্ষা সরিয়ে সহানুভূতি আনার চেষ্টা করছি। ঠিক তখনই গিরিশ পার্ক স্টেশন চলে আসছিল। হঠাৎ মেয়েটি মোটকুর দিকে হাত নেড়ে দরজার দিকে কয়েক পা হেঁটেও আবার ফিরে গেল। আমার মনে জমা সমস্ত সহানুভূতিকে চটকে দিয়ে সে ছেলেটির মুখ দুই হাতে ধরে চুমু খেল। মোটকু সে সময় আদুরে বেড়ালের মতো চোখ বুজে ছিল, সক্রিয় হয়নি। দরজা খোলামাত্র মেয়েটা ‘বাই’ বলে যখন নেমে গেল তখনও ছেলেটার চোখ বন্ধ, কিন্তু হাত নাড়ছে।

সমস্যা বাড়ল। আগের ঝুঁটিওয়ালা যদি প্রেমিক হয় তা হলে মোটকুর সঙ্গে মেয়েটির কী সম্পর্ক? বন্ধ ঘরের মধ্যে প্রেমিক-প্রেমিকা যা করে তার কিছুটা না হয় এরা এই কামরায় করেছে। মেনে নেওয়া গেল, কিন্তু মোটকু তো মেয়েটার প্রেমিক নয়। বন্ধু বা ভাই হতে পারে। বন্ধু বা ভাইকে কি কেউ চুমু খায়? আবার এই যে দ্বিতীয়বার চুম্বন দৃশ্য দেখেও পাবলিকের কোনও প্রতিক্রিয়া বোঝা গেল না।

আমাদের কিশোর বা তরুণবেলায় যৌবন মানেই পাপ অথবা অন্যায় বলে ধরা হত যদি তাতে শরীরের ছায়া পড়ত। স্কটিশচার্চের ফার্স্ট ইয়ারে মেয়েরা প্রফেসারের পেছন পেছন ক্লাসে যেতেন, ক্লাস শেষ হলে সোজা তাঁদের জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে, গায়ে পড়ে, কথা বলতে চাইলে আপনি সম্বোধন করতে হত। তবু তার মধ্যে দু’জনে প্রেমরোগে আক্রান্ত হলে পর্দা ঢাকা রেস্তোরাঁর কেবিনে গিয়ে বসতে হত। প্রেমিকার হাত মুঠোয় নিয়ে ঠোঁটে ছোঁয়ালে মনে হত পৃথিবী আমার পকেটে। বাইরে বেরিয়ে দু’জনে দুই ফুটপাত ধরে হাঁটতে হত পাছে কেউ দেখে ফেলে।

‘জন্মেছিলাম চা-বাগানে’। প্রতি পুজোয় সেখানে যেতাম। কলেজে পড়ার সময় ছুটিতে গিয়ে বন্ধুর গাড়ি নিয়ে আশেপাশের চা-বাগানে গিয়েছিলাম ঠাকুর দেখতে। ওইরকম এক বাগানের মণ্ডপে দারুণ সুন্দরী ষোড়শীর দর্শন পেয়ে পুলকিত। প্রসাদ নেওয়ার সময় তার আঙুল আমার আঙুল ছুঁয়েছিল। সেই ছোঁয়াতে যে বিদ্যুৎ ছিল তা গোটা বছর ধরে লালন করেছিলাম। পরের বছর সেই বাগানে ঠাকুর দেখার বাহানায় গিয়ে তার দেখা পাইনি। এক বন্ধু খবর এনেছিল সাড়ে যোলোয় তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই বিদ্যুতের স্মৃতি এখনও অনুভব করি। বেশ স্বপ্ন-স্বপ্ন ব্যাপার।

মোটকু যখন শ্যামবাজারে। আমিও। ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিছু মনে কোরো না, ওই মেয়েটি তোমার কে হয়?’

‘বন্ধু’। মুখে ‘চিনে হাসি ফুটল তার।

‘যে আগে নেমে গেল সে ওই মেয়েটির-।’

‘বন্ধু, আমরা তিনজনেই বন্ধু। আরও দু’জন বন্ধু আছে।’

‘তাহলে যে তোমাদের চুমু খেল?’ সটান জিজ্ঞাসা করলাম।

‘কোথায় খেল? ঠোঁট দিয়ে প্যাট করল। হাত দিয়ে না করে ঠোঁট দিয়ে করল। হাত আর ঠোটের মধ্যে কী পার্থক্য আছে? কিন্তু আপনি প্রশ্ন করছেন কেন?’

উত্তর দিতে চাইনি। শুধু নিজের হাতে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে বুঝলাম, শরীর তোমার দিন গিয়েছে। মনের পিছু পিছু।

২৯   

আচ্ছা, এটা কেন হল? এই যে আমাদের সাহিত্য-সংগীত-খেলাধুলার জগৎটা গত ৩০-৩৫ বছর ধরে প্রায় বন্ধ্যা হয়ে গেল, তার কারণ কী? সেই বিদ্যাসাগর-মধুসূদন দত্তের পর থেকে আমরা যেসব কবি-সাহিত্যিককে পেয়েছি, যে ধারা বহুকাল ঠিকঠাক ছিল তা হঠাৎ শুকিয়ে গেল কেন? ভেবে দেখুন, প্রায় ৯০ বছর আগে কল্লোল- কালিকলম পত্রিকার কথা। একসঙ্গে অনেক প্রতিভাবান লেখক হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। একদিকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, আর একদিকে তারাশংকর, অচিন্ত্যকুমার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা কৃতজ্ঞ হলাম জীবনানন্দের আত্মপ্রকাশে। এমনকী যাঁরা খুব কম লিখে লেখা বন্ধ করেছিলেন তাঁদের কথা কোনওদিনও ভোলা সম্ভব নয়। অদ্বৈতমল্ল বর্মনের তিতাস একটি নদীর নাম অথবা বীরেন বসুর রঙরুট। আমার মাস্টারমশাই বেণু দত্তরায়ের মুখে শুনেছিলাম, অদ্বৈতমল্ল বর্মন তখন থাকতেন শ্রীমানি মার্কেটের কাছে অতি সস্তার মেসবাড়িতে। প্রুফরিডারের কাজ করে খুব সামান্য আয় হত। তারই উপর নির্ভর করতে হত তাঁকে। এই মানুষটি তাঁর আবাসের অভিজ্ঞতা লিখে ফেললেন উপন্যাসের আকারে। পাঠিয়ে দিলেন একটি প্রচারিত পত্রিকায়। তিতাস একটি নদীর ‘নাম’-এর সেই পাণ্ডুলিপি পেয়েও সম্পাদকের উদাসীনতায় ছাপা হল না। দীর্ঘদিন যাতায়াত করার পর লেখক জানতে পারলেন সেই পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থায় বেশিরভাগ মানুষ কলম বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু কয়েকজন ঘনিষ্ঠের উৎসাহে তিনি আবার লিখতে শুরু করেন কারণ প্রথমটির কোনও কপি ছিল না। এই দ্বিতীয়বার একই উপন্যাস লেখার পরে প্রথমবারের থেকে কী কী পার্থক্য লেখকের অজান্তে তৈরি হয়েছিল তা আমাদের জানার উপায় নেই। কিন্তু বাংলাসাহিত্য ধনী হল। তারাশঙ্করদের সেই বিশাল প্রতিভার পর পর এলেন বিমল কর, রমাপদ চৌধুরি, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সমরেশ বসু। শারদীয় সংখ্যায় এঁদের উপন্যাস পড়ার জন্যে বাঙালি পাঠক উন্মুখ হয়ে থাকতেন। আমি তখন একটি অতি বিখ্যাত সাপ্তাহিকে বছরে গোটা তিন-চার গল্প লিখে চলেছি। বড়দের পিঠ চাপড়ানিতে খুশি থাকতে হত। তখন লক্ষ্য ওই কাগজের শারদীয় সংখ্যায় গল্প লেখা। কিন্তু অতি বিখ্যাত লেখকদের লেখা ছাপা হওয়ার পর আমাদের মতো তরুণদের জন্যে জায়গা হত না। একবার গল্প-সম্পাদক বললেন, ‘একটা গল্প দিয়ে যাও, যদি জায়গা পাই ছেপে দেব।’ শুনে মনে হয়েছিল হাতে চাঁদ পেয়েছি। তখন আমার চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স। বিজ্ঞাপনে নাম নেই। শুনতে পেলাম ওই বছর সমরেশ বসুর উপন্যাস বড় হয়ে যাওয়ায় তরুণদের জন্যে জায়গা বের করা যায়নি। ইচ্ছে হচ্ছিল, সমরেশদার কাছে গিয়ে বলি, আপনি কেন এত বড় উপন্যাস লিখলেন, একটু কম লিখলে কী ক্ষতি হত! বলা হয়নি।

এঁদের পরে এলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। একটু আগে প্রফুল্ল রায় এবং সঙ্গে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। শংকর আর প্রফুল্লদা প্রায় একসঙ্গে। কবিরা তখন রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দকে অতিক্রম করার চেষ্টা করছেন। শক্তিদা তো ঔপন্যাসিকের মতোই জনপ্রিয়। কৃত্তিবাসের কবিরা তো ছিলেনই, তুষার রায়ের মতো দলছুট কবি আলোড়ন তৈরি করছেন। এদের পেছন পেছন, মান্না দের গাওয়া সেই গান, আমায় জায়গা দাও, বলে আমরা, আমি সঞ্জীব আর আমাদের পরে সূচিত্র বাংলা সাহিত্যের এক কোণের চিলতে জায়গার খোঁজ পেলাম। কিন্তু তারপর? ছবিটা খুব করুণ। একমাত্র প্রচেত গুপ্ত এবং কিছুটা তিলোত্তমা মজুমদার ছাড়া আর কেউ আমাদের আশাবাদী করতে পারেননি। লক্ষ করেছি যেসব লেখককে এখনও তরুণ লেখক বলা হয় তাঁদের বেশিরভাগের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। লিখে চলেছেন বহুকাল, চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, সাধারণ পাঠক তাঁদের বই পড়া দূরের কথা, কখনও শোনেনি এমন লেখকের সংখ্যা প্রচুর। বাংলা সাহিত্যে এরকম খরা কখনও আসেনি।

সংগীতের ক্ষেত্রেও একই চেহারা। সেই পঙ্কজ মল্লিক থেকে হেমন্ত-কণিকা-সুচিত্রা, সন্ধ্যা-শ্যামল- মানবেন্দ্র-সতীনাথ-মান্না-সুবীর- প্রতিমা থেকে নির্মলা মিশ্র। সত্তর দশক পর্যন্ত গানে-গানে ভরে ছিল। রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে প্রণব রায়, মোহিনী চৌধুরি, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় যে গান লিখে গিয়েছেন তা অতীত হওয়ার নয়। সুধীরলাল, অনুপম ঘটক, নচিকেতা, রবীন চট্টোপাধ্যায়ে, সুধীন দাশগুপ্তের সুরের ঢেউ কোনওদিনও বাঙালি ভুলতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথের পরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সুরকার গীতিকার সলিল চৌধুরী আমাদের গানের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। এঁদের উত্তরসূরি কবীর সুমন। যাঁর যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু তারপর? সম্মিলিত গানের গায়করা মাঝে মাঝে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন কিন্তু তারপরেই চিৎকার করে গেয়েও বাঙালির ঘুম ভাঙাতে পারেননি। আবার প্রশ্ন করি, কেন?

কেন গোষ্ঠ পাল, দুখীরাম মজুমদারের মতো বাঙালির গর্বের খেলোয়াড় একের পর এক চলে যাওয়ার পর চুনী গোস্বামী, পি কে ব্যানার্জী, কৃশানু-গৌতমদের পরে আর কলকাতার মাঠে খেলোয়াড় খুঁজে পাওয়া যাবে না? কেন চারজন বিদেশি আর অন্যান্য দেশের খেলোয়াড়রা প্রিয় ক্লাবে খেলেন বলে বাঙালিকে মাঠে ভিড় জমাতে হবে? চুনী গোস্বামীর কাছাকাছি প্রতিভার কোনও বাঙালি খেলোয়াড়কে গত পনেরো-কুড়ি বছরে দেখতে পেলাম না।

এই যে মন্দা, এটা কি সাময়িক? প্রতিবছর আইএএস পরীক্ষা হয়, ক’জন বাঙালি ওই সর্বভারতীয় পরীক্ষায় সফল হয় তার খবর আমাদের কাছে আসে না। গত তিরিশ বছরে যাঁরা চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে একমাত্র প্রসেনজিৎ ছাড়া আর কাউকে নায়ক ভাবার কোনও কারণ ঘটেনি। শুধু লাফিয়ে, কোমর বেঁকিয়ে গানের সঙ্গে নেচে খাদের খুশি করা যায় সেই দর্শকদের কি বাঙালি বলা যায়?

সব দিকে যখন খরা তখন একটা দিকে বাঙালি চড়চড় করে উপরে উঠেছে। সেটা রাজনীতি। শিক্ষার দরকার নেই, আক্রমণাত্মক কথা বলার দক্ষতা থাকলেই রাজনীতিতে উন্নতি অনিবার্য। বিধান রায়, প্রফুল্ল সেনরা যা পারেননি এঁরা তা পারছেন।

তবু, বাঙালির সান্ত্বনা, ভারতের রাষ্ট্রপতির পদটা এখন বাঙালির দখলে। এটাই একমাত্র প্রাপ্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *