২০
ঘুম থেকে উঠে স্বাভাবিক ছিলাম। যেমন থাকি। পৃথিবীতে কত কী রোজ ঘটে, খারাপ খবরে মনে মনে আলোড়িত হই, বুকে ভার নিয়ে কিছুক্ষণ কাটানোর পর দেখি কখন আবার স্বাভাবিক কাজকর্ম করছি। আমি বলি শোকের আয়ু বড়জোর চব্বিশ ঘণ্টা থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টা। প্রিয়জনকে দাহ করে এসে কত সময়ের পরে শ্রাদ্ধের কার্ড ছাপতে ব্যস্ত হতে হয়, সেইসঙ্গে যাদের নেমন্তন্ন করা হবে তাদের তালিকা তৈরি করা থেকে কার্ড পাঠানো, ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বসতে শোক পাখি হয়ে উড়ে যায় কখন টের পাওয়া যায় না। কামদুনিতে যে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে খুন করা হল, সেই বীভৎসতার কোনও তুলনা নেই। মহাভারতে আছে প্রতিশোধ নিতে ভীম দুঃশাসনের দুই পা ধরে শরীর দু টুকরো করেছিল। যতই অন্যায়ের বদলা নেওয়া হোক, ওই ভয়ঙ্কর দৃশ্য যারা দেখেছিল তাদের সহ্যশক্তি অকল্পনীয়। কামদুনির মেয়েটির ক্ষেত্রে তাই করেছিল আনসার আলি এবং তার সঙ্গীরা। মন খারাপ হলে কী করতে পারি আমরা? ভয়ে ভয়ে নিজের মেয়ের দিকে তাকাই আর শিউরে উঠি। ওকে যদি কোনও আনসার আলি ওইরকম করে? কী ক্ষমতা আমার? আমার মতো ওই বাংলার মেয়ের বাবাদের?
আজ আমার সামনে একটি ইংরেজি কাগজের সাপ্লিমেন্টারি খোলা রয়েছে। আমরা সবাই আনসার আলিকে মনে মনে খুন করছি, মেয়েটির জন্য আমাদের বুকে কান্না বাজছে, ওর মা-বাবার অসহায় চেহারা কল্পনা করে শিউরে উঠছি। আচ্ছা, আনসার আলি একজন বিবাহিত মানুষ ছিল যে পরে একটি ঘৃণ্য জানোয়ার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার বউ, ছেলেমেয়ে, ভাইরা?
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মাটিয়াগাছায় আনসারের একতলা সিমেন্টের বাড়ি। জানলা-দরজায় পর্দা, ঘরে টিভি, একটা শোকেস রয়েছে। এখন আশপাশের যে-কোনও শিশু দেখিয়ে দেবে আনসারের বাড়ি কোথায়। আনসারের মেয়ে সবে হাঁটতে শিখেছে। এক ছেলে ক্লাস এইটে পড়ে। গ্রামের মানুষ ওদের বয়কট না করলেও এখন এড়িয়ে চলে। আনসারের স্ত্রী এখন সারাটা সময় বসে থাকে দু’হাতে মুখ ঢেকে। স্বামীর কৃতকর্মের জন্য লজ্জায় পুড়ে মরছে সে প্রতিনিয়ত। মাঝে মাঝে ডুকরে কেঁদে, মুখ থেকে হাত না সরিয়ে বলছে, ‘ওকে পুলিশ ধরেছে, আইন যে সাজা দেবে, আমাদের সেটাই মাথা পেতে নিতে হবে।’ আনসারের বড় ছেলে এবার মাধ্যমিক পাস করেছে। কিন্তু সে এখন ঘরের বাইরে পা বাড়াতে পারছে না। যেদিন পুলিশ এসে ওর বাবাকে গ্রেফতার করল সেদিন থেকে তার সব বন্ধুরা সঙ্গ ত্যাগ করল।
এই পরিবারকে গ্রামের মানুষ এখনও একঘরে করেননি, কিন্তু দূরে দূরে থাকছেন। কোনও স্বামী যদি ধর্ষণ করে একটি তরুণীকে নৃশংসভাবে খুন করে তাহলে তার স্ত্রীর পৃথিবীটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। মহিলাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, অপরাধ প্রমাণিত হলে আনসারকে হয়তো মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতে পারে, তাঁর কী প্রতিক্রিয়া? মহিলার কঠিন গলায় উত্তর ছিল, ‘ওকে ওর পাপের মূল্য দিতে হবে।’
পরিবারের কেউ একবারও দাবি করেনি, আনসার নিরপরাধ। ওর ছয় সঙ্গী, যাদের মধ্যে পাঁচজনকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পেরেছে, তাদেরও এরা দোষী বলেই মনে করে।
প্রশ্ন হল, ছেলেমেয়ে, বউ, ভাইদের নিয়ে সংসারে থাকা আনসার কেন এমন করল? তার এই কাজের জন্যে পরিবারের সবার মুখ পুড়ল, একটুও ভাবল না সে?
আনসারের বাড়ির লোক মনে করছে তাদের এই দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী আনসারের মদের ওপর প্রচণ্ড আসক্তি। আগেও সে মদ্যপান করত কিন্তু তা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে যায়নি। বছর দুয়েক আগে কামদুনির গ্রামের গায়ে একটি প্রজেক্টে কেয়ারটেকারের চাকরি পায় আনসার আলি। তখন থেকে তার মদ্যপানের মাত্রা প্রচণ্ড বেড়ে যায়। চাকরির প্রয়োজনে সে রাতে বাড়িতে থাকত না। সন্ধের পরে প্রজেক্টের অফিসে সে বন্ধুদের নিয়ে আসর বসাত। মদ বেশি খেলে যে সে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে একথা গ্রামের সবাই জানত।
কিন্তু শুক্রবারে, যেদিন রাতে সে অপকর্মটি করে, সেদিন দুপুরে বাড়িতে এসেছিল। দুপুরের খাওয়া খেতে এসেছিল আকণ্ঠ পান করে। স্ত্রীর কথায় কর্ণপাত করার পাত্র ছিল না সে। যা পেরেছিল খেয়ে ফিরে গিয়েছিল চাকরির জায়গায়।
ধর্ষিতা মেয়েটি থাকত কামদুনি গ্রামে যা মাটিয়াগাছা থেকে কিছু দূরে। মাঝখানে জলাশয় রয়েছে। এই জায়গাটাকে আনসারের বাড়ি থেকে দেখা যায়। ছত্রিশ বছর বয়সি আনসার কলেজ ফেরত একাকী মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাশবিক উন্মাদনায়, কোনও পুরনো অপমানের প্রতিশোধ নিতে নয়। সে এবং তার সঙ্গীরা মদের কল্যাণে অমানুষ হয়ে গিয়েছিল।
একটি প্রাণ চলে গেল ভয়ঙ্কর অত্যাচারে। প্রায় সব আসামি ধরা পড়ল। অবশ্যই তাদের শাস্তি হবে। একটি পরিবার সেই পাপের বোঝা অনিচ্ছা নিয়ে বইতে বাধ্য হবে যতদিন বেঁচে থাকবে। যখনই এরকম অপরাধ ঘটে তখনই আমরা জেনে যাই এইটেই হবে, নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু কামদুনির মানুষ আমাদের অসাড় হয়ে যাওয়া বিবেককে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে গেল। তারা বলল, অপরাধীর চরম শাস্তি চাই। মন্ত্ৰী গেলেন, টাকা দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে চাইলেন। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল মেয়েটির আত্মীয়রা, টাকা নয়, চাকরি নয়, আমরা শুধু অপরাধীর শাস্তি চাই।’
আমি এবং আমার মতো মানুষরা চমকে উঠেছি। আজকের পৃথিবীতে যখন টাকা দিয়ে সব কিছু কেনা যায় তখন এই গরিব গ্রামবাসীরা বিক্রি হতে চাইলেন না। কয়েক লক্ষ টাকা এবং একটা চাকরি নিশ্চয়ই ওদের জীবনকে অনেক মসৃণ করে তুলতে পারত। যেখানে মন্ত্রী থেকে সাধারণ সরকারি কর্মচারী বাঁহাত বাড়িয়েই আছে সেখানে মেয়ের সম্মানের বিনিময়ে এঁরা সুখ কিনতে রাজি হলেন না। এরকম ঘটনা একুশ শতকে ঘটল যা আমাদের জীর্ণ হয়ে যাওয়া মূল্যবোধকে আবার জাগ্রত করল। কামদুনির পর অন্য জায়গায় ধর্ষিতা মেয়ের পরিবারও তাই এক কথা বলতে পারছে। এমনকী মুখ্যমন্ত্রীকেও এঁরা বলতে পেরেছেন, ‘টাকা বা চাকরি চাই না, শাস্তি চাই।’ মেয়েটি অনেক কষ্ট নিয়ে চলে গিয়েছে, কিন্তু অন্ধকারের উৎস থেকেও যে আলো উৎসারিত হয় তা নতুন করে জানতে পারলাম।
২১
আমরা যখন কয়েকজন একত্রিত হয়ে কথা বলি তখন আমাদের সবাই খুব সৎ, আদর্শে বিশ্বাস করি, দেশের মঙ্গল চাই। কোনও মন্ত্রীর ছেলে বা শালার বিপুল চুরি যখন ধরা পড়ে কাগজের হেডলাইন হয়, তখন মন্ত্রীকে কাঠগড়ায় তুলি। ওই অসৎ শালা বা ছেলের জামাইবাবু বা বাবাকে অবিলম্বে মন্ত্রিসভা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত। প্রধানমন্ত্রী যদি এই ব্যপারে দুর্বলতা দেখান তাহলে তাঁর সততা সম্পর্কে সন্দেহ করি। শেষ পর্যন্ত আমরা সিদ্ধান্ত নিই, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। এইসব রাজনৈতিক নেতারা চুরি করে দেশের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে বলে হা-হুতাশ করি। কথা শুনলে মনে হবে আমরা সততায় বিশ্বাস করি, কেউ অসৎ হলে তাকে ধিক্কার জানাই।
ধরা যাক, এই আমাদের কেউ স্ত্রীকে নিয়ে দার্জিলিং-এ বেড়াতে যাব। কিন্তু টিকিট কাউন্টারে গিয়ে জানল আগামী দেড় মাসে কোনও ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়িতে পৌঁছনোর উপায় নেই। কিন্তু স্ত্রী জেদ ধরেছেন, যেতে হলে দার্জিলিং-এ যাবেন, নইলে কোথও নয়। তৎকালে টিকিট কাটা যায়। বেশি টাকা দিতে হয় টিকিটের জন্যে। ইনি লাইন দিয়ে দেখলেন কাউন্টারে পৌঁছবার আগেই তৎকালের টিকিট শেষ হয়ে গেল। আজকাল টু-টিয়ার কামরার টিকিট দালালরা ক্রেতার অভাবে বিক্রি করে না। অন্যের নামের টিকিট নিয়ে বিপদে পড়তে হয় কারণ চেকার আইডেন্টিটি কার্ড দেখতে চান। তখন উদ্ধারকর্তা হিসাবে যদি কাউকে পেয়ে যান যাঁর পরিচিত কোনও মন্ত্রী আছেন, রেলের বড়কর্তা আছেন তাহলে আপনি হাসতে পারবেন। আপনার ওয়েটিং লিস্টের নাম্বার যদি একশো হয় তাহলেও ভিআইপি কোটায় ট্রেনে জায়গা পেয়ে যাবেন। এঁর স্ত্রী খুশি হলেন কিন্তু ইনি নিশ্চয়ই একবারও ভাববেন না নিরানব্বইজনকে টপকে বে-আইনি ভিআইপি হয়ে ওয়েটিংলিস্টের প্রথম দিকের দু’জন যাত্রীকে বঞ্চিত করলেন। না, অবশ্যই ভাববেন না।
ধরা যাক ট্রেন চললে রাত বাড়লে শোওয়ার জন্যে যখন বাঙ্ক ইনি নামাবেন তখন যদি চোখে পড়ে কোণের দিকে একটা পার্স এতক্ষণ চাপা পড়ে থাকায় কারও নজরে পড়েনি তখন কি কৌতূহলী হয়ে সেটা খুলে দেখবেন না। আর যদি সেই পার্সের মধ্যে হাজার পাঁচেক টাকা থাকে তাহলে ইনি কী করবেন? ট্রেন যখন শিয়ালদহ থেকে ছেড়েছে তখন ওই কামরায় যে যাত্রী ভোরবেলায় এসেছিলেন তিনি ফেলে গিয়েছেন। রেলকে খবর দিলে যাত্রী তালিকায় বার্থ নম্বর দেখে অবশ্যই পার্সটা মালিকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু যিনি পেলেন তিনি কি সেটা করবেন, না নিঃশব্দে পকেটে রেখে দেবেন? প্রশ্নটি আমি দশজন মানুষকে করেছি, মাত্র দু’জন মহিলা বলেছেন তাঁরা রেলকে বলবেন পার্সটা টাকা সমেত মালিককে ফেরত দিতে।
গত সপ্তাহে আমি ডুয়ার্সের একটি চা-বাগানে ছিলাম। এখন মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের জন্যে একটি দফতর তৈরি করেছেন। সেই উত্তরবঙ্গ বিষয়ক দফতরের মন্ত্রী হলেন শ্রীযুক্ত গৌতম দেব। গৌতমের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তিরিশ বছর আগে। তখন তৃণমূল ছিল না, সে কংগ্রেস কর্মী ছিল। শিলিগুড়ির কলেজে পড়ত। খুব ভদ্র এবং শাস্ত্র ছিল এই বুদ্ধিমান ছেলেটি। গৌতমের কানে গিয়েছিল আমি ডুয়ার্সে গিয়েছি। আমি সুহাসিনী চা-বাগানে ছিলাম এবং গৌতম তার দফতরের কাজে খুব কাছেই কোথাও যাচ্ছিল। সেই সুযোগ নিয়ে সে আমার সঙ্গে দেখা করতে এল। আমরা অন্তত একঘণ্টা কথা বললাম। আলোচনার বিষয় ছিল উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন। আমি তাকে কয়েকটা প্রস্তাব দিলাম এবং সে তার নানা অভিজ্ঞতার কথা বলল। সেরকম একটা অভিজ্ঞতা হল এইরকম-
সদরের হাসপাতালে জেনারেটর রাখা হয় কারণ বিদ্যুতের উপর ভরসা নেই। জানা গেল, প্রতিটি জেনারেটরের ভাড়া বাবদ সাপ্লায়ারকে ছিয়ানব্বই হাজার টাকা ভাড়া দিতে হত প্রতিমাসে। অথচ ওই জেনারেটরটি দোকানে বিক্রি হচ্ছে সাড়ে চার লক্ষ টাকায়। অর্থাৎ পাঁচ মাসের ভাড়ার টাকায় নতুন জেনারেটর হয়ে যাচ্ছে। এই অপচয় বন্ধ করতে মন্ত্রী ভাড়া বাতিল করে নতুন জেনারেটর কিনে দিলে নাটক শুরু হল। জলপাইগুড়ি থেকে সাপ্লায়ার একজন তৃণমূলের প্রথম শ্রেণির নেতাকে নিয়ে শিলিগুড়ি গিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে অনুনয় করতে লাগল তাকে ভাড়া-ব্যবস্থা চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ না করতে। এই সাপ্লায়ারকে নিয়োগ করেছে বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী, কিন্তু সে এর মধ্যে পাল্টি খেয়ে তৃণমূল নেতার স্নেহধন্য হয়ে গিয়েছে। ফলে তৃণমূল নেতাও মন্ত্রীকে স্নেহ দেখাতে অনুরোধ করেন। মন্ত্রী তাদের প্রচুর ভর্ৎসনা করেন এবং আদালতে ক্যাভিয়েট করে রাখেন যাতে সাপ্লায়ার ইনজাংশন পেতে না পারে। মন্ত্রী হিসাবে গৌতমের অভিজ্ঞতা হল চারধারে এত অসং কর্মচারী এবং কন্ট্রাক্টর শিকড় গেড়ে বসে আছে যে তাদের তাড়াতে গেলে সব কাজ ফেলে ওই নিয়ে পড়ে থাকতে হবে। তাঁকে সেক্রেটারিরা পরামর্শ দিয়েছেন, স্যার আপনি যদি উন্নয়নের কাজ করতে চান তাহলে এসবের পিছনে সময় নষ্ট করবেন না। আচ্ছা, ওই যে সাপ্লায়ার লোকটি উনি কি নিজের কাছে সৎ? তা যখন নন, তখন স্ত্রী ছেলেমেয়ের কাছে স্বীকার করেন, আমি অসৎ?
আমার পরিচিত এক ভদ্রলোকের ছেলে ষাট শতাংশ নম্বর পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেও কলকাতায় বড় কলেজগুলি দূরে থাক, সাধারণ কলেজেও ঈন্সিত বিষয়ের অনার্সে পড়ার সুযোগ পাচ্ছিল না। স্কটিশচার্চ কলেজও তাকে ফর্ম দেয়নি। ষাট পেয়েছিল বলে ভদ্রলোকের যে আনন্দ হয়েছিল তা ক’দিনেই হাওয়া বের হওয়া বেলুনের মতো চুপসে গেল। এইসময় কোনও একটি কলেজে ওই অনার্স নিয়ে পড়ার একটি সুযোগ পাওয়া গেল। অধ্যক্ষের চেষ্টায় ছেলেটি ওই অনার্স নিয়ে পড়তে পারে যদি ভদ্রলোক লাখ দেড়েক টাকা মিষ্টি খাওয়ার জন্যে দিতে রাজি থাকেন। এই ভদ্রলোক ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দেড় লাখ টাকা গোপনে দিয়ে কি ভাববেন, আমি অসৎ কাজ করলাম? যিনি দিলেন তিনি তো ভাববেনই না। একজন সরকারি চাকুরে ঘটনাটা বললেন। কেরানির চাকরি পেয়ে প্রথমদিন যে তরুণ রিসিভিং সেকশনে চিঠি নিয়ে রসিদ দেবে তাকেও বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘কিছু দিন, আমরা তো পেয়ে থাকি।’
হ্যাঁ, এরা সবাই যখন এক তখন এই চেহারা। যখন দলবদ্ধ তখন অবশ্যই আদর্শবাদী।
২২
জলপাইগুড়ি শহরের কালীবাড়িতে যাওয়ার পথে একটি চার রাস্তার সংলগ্নস্থল আছে। আমরা বলতাম চৌমাথার মোড়। সেই মোড়ের এক কোণে ছিল মামুর দোকান। ছোট্ট স্টেশনারি দোকানের মালিকের চেহারা ছোটখাটো হলেও সবসময় মজার কথা বলতেন। আমরা তখন স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্র। মামুর দোকানে খাতা কেনার অজুহাতে ওঁর রসিকতা শোনার লোভে যেতে খুব ভাল লাগত। এক রবিবারের সকালে গিয়ে দেখলাম ছোটখাটো চেহারার একটি ছেলে, আমাদের কাছাকাছি বয়সের, দোকানের ভিতরে মামুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মামু আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘এই যে, এটি হল আমার ভাগ্নে, রায়গঞ্জে থাকে। ভাগ্নে, এদের কথা তোমাকে বলেছিলাম।’ ছেলেটিকে, মনে হয়েছিল একটু লাজুক প্রকৃতির, আমাদের মতো সাইকেলে শহর দাপিয়ে বেড়ানো টাইপের নয়। তারপর স্কুল ছুটি হলে মাঝে মাঝে ও জলপাইগুড়িতে আসত। আমার বন্ধু নিশীথ বলত, ‘এ ব্যাটা একেবারে গুড়ি বয়, জমবে না।’
এর কয়েক বছর পরে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বছরের ছাত্র তখন ফিফথ ইয়ারে ভর্তি হওয়া ছেলেদের মধ্যে সেই গুডি বয়কে দেখতে পেলাম। তখন আমরা বেশিরভাগই ছাত্র ফেডারেশনের পরোক্ষ সমর্থক, কেউ কেউ ছাত্র পরিষদের। যেমন রঘুপতি যে পরে লালবাবা কলেজে অধ্যাপনা করেছে। রঘুপতি খদ্দর পরত, মনেপ্রাণে প্রফুল্ল সেনের শিষ্য ছিল। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব সেই কারণে চিড় খায়নি। সেই চৌষট্টি- পঁয়ষট্টি সালে রাজনীতি সম্পর্ক নষ্ট করত না যা এখন কল্পনা করা যায় না। দেখলাম, সেই গুড়ি বয় রঘুপতির সঙ্গে ঘুরছে। একদিন ছাত্র পরিষদ আয়োজিত গেট মিটিং-এ ওকে বক্তৃতা করতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। চমৎকার বলল। বাচনভঙ্গি থেকে স্বরক্ষেপ অন্যদের থেকে একদম আলাদা। অবাক হয়েছিলাম।
পরদিন আশুতোষ বিল্ডিং-এর দোতলার করিডরে মুখোমুখি হতেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি নিশ্চয়ই আমাকে চিনতে পারছ না?’
একটু বিব্রত হল সে। মামুর কথা মনে করিয়ে দিতে হাত ধরল আমার, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। অনেকদিন জলপাইগুড়িতে যাওয়া হয় না।’
তারপর দেখা হতেই নানান কথা হত কিন্তু রাজনীতি নিয়ে কথা বলত না সে, আমিও না। মনে রাখতে হবে সে সময় পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বিভিন্ন কারণে তীব্র কংগ্রেসবিরোধী। প্রফুল্ল সেন সততার প্রতীক, এ কথা যে-কোনও মানুষ বিশ্বাস করে, কিন্তু কংগ্রেসি নেতাদের আশু ঘোষের মতো কালো ছাপওয়ালা মানুষ বলে ধারণা চাউর হয়ে গিয়েছিল। কম্যুনিস্ট পার্টির দুটো ভাগ হয়ে গিয়েছে। নকশালদের পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এই সময়ে কংগ্রেস রাজনীতিতে ডুবে যাওয়ার সাহস খুব কম মানুষ দেখাতে পেরেছিলেন। আর এই তরুণ বাহিনীর ধাক্কায় অচল হয়ে পড়া বদ্ধ কংগ্রেসিরা ক্রমশ জায়গা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছিলেন। নতুন শব্দ কানে এল, যুব কংগ্রেস। আর এই যুব কংগ্রেসের নেতৃত্বে এল জলপাইগুড়ি শহরের মামুর দোকানে দেখা গুড়ি বয়টি। আন্দোলনে অংশ নিয়ে প্রচুর অত্যাচার সহ্য করে সে তখন শিরোনামে উঠে এসেছে। পশ্চিমবাংলার মানুষ তখন দুটো মানুষের বক্তৃতা মুগ্ধ হয়ে শুনত। ওঁরা বক্তৃতা দেবেন জানতে পারলে মানুষ ভিড় জমাত। একজন জ্যোতি বসু এবং অন্যজন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি।
যখন লেখালেখি শুরু করলাম তখন মিহিরবাবু নামের এক ভদ্রলোক বাড়িতে এসে একটা চিঠি দিলেন। তাতে লেখা, ‘সমরেশদা পুজোর দক্ষিণীবার্তায় একটা গল্প কি পেতে পারি? প্রিয়দাশ।’
তখন সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গেল বাৎসরিক। মহালয়ার সকালে পত্রিকা প্রকাশ উপলক্ষে প্রিয়দাশ একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতেন। কয়েকবার গিয়েওছিলাম। কিন্তু ততদিনে ওর অনেক উত্থান হয়েছে। এমপি হয়েছে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও হয়েছে। সে যত উপরে উঠেছে তত আমার সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে গেছে। তবে জেনেছিলাম, রায়গঞ্জ সম্পর্কে ভূমিপুত্র হিসাবে ওর টান প্রবল ছিল। জলপাইগুড়ির মামুর সেই লাজুক ভাগ্নের এই দ্রুত উঠে আসার কোনও তুলনা আমার জানা নেই। বেশিরভাগ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সাহিত্য পড়ার সময় পান না। কয়েকজন ব্যতিক্রম মানুষ আছেন। যেমন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রিয় দাশমুন্সি এবং সৌগত রায়। এই কারণেই এঁদের কাছের মানুষ বলে মনে হয়
তার পরের ঘটনার কথা সবার জানা। একটি মুখর মানুষকে ভয়ঙ্কর অসুস্থতা নীরব করে দিল চিরদিনের মতো। অনেক লড়াই, চিকিৎসাশাস্ত্রের সমস্ত অস্ত্রের ব্যবহার করেও তাঁকে সুস্থ করা সম্ভব হল না। দিন গেল, দিনের পর মাস, মাসের পর বছর। দিল্লির একটি হাসপাতালে জীবস্মৃত হয়ে বেঁচে আছে ‘প্ৰিয়দাস। ক্রমশ সেই ছোটচেহারাটা আরও ছোট হয়েছে। কোনও সাড় নেই। বোধহয় অনুভব ক্ষমতাও অসাড় হয়ে গেছে। কিন্তু প্রাণ আছে। হৃদপিণ্ড সচল হয়ে আছে বুকের খাঁচার ভিতরে।
পৃথিবীতে কত কী ঘটে যাচ্ছে তা প্রিয়দাশ জানেন না। এককালে যারা ওঁর সহকারী ছিল, যারা ওঁকে নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিল তারা আজ কেউ মন্ত্রী, কেউ এমপি, এমএলও। যেহেতু প্রিয়দাশের মস্তিষ্ক অসাড়, কোনও কিছুই তাঁকে স্পর্শ করে না, তাই এই নেতাদের কথাবার্তা কাজকর্মের খবর তাকে সুখ বা দুঃখ দিচ্ছে না।
মাঝে মাঝেই আচমকা কোনও প্রিয়জন চলে গেলে আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। ছাই হয়ে যাওয়া বা কবরের ভিতর মাটি হয়ে যাওয়া সেই মানুষটির সঙ্গে সঙ্গে সব কি শেষ হয়ে গেল? এই যে সারাজীবন ধরে একটি মানুষ কত পড়শোনা করল, রবীন্দ্রনাথের যে-কোনও গান চমৎকার গাইতে পারত, কত কিছু যে জানত, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেসব মুছে গেল? একজন লেখক বা গায়ক অথবা চিত্রশিল্পী চলে গেলে তার সৃষ্টি থেকে যায়। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ তো তেমন সৃষ্টি রেখে যেতে পারেন না। তাঁদের বেলায়? যে বন্ধুটি কফিহাউসে আমার পাশের চেয়ারে বসতেন, একই রাস্তায় যাঁর সঙ্গে আমি হেঁটে যেতাম, সেই চেয়ার অথবা রাস্তাটা তো ঠিকঠাক আছে। অনেক মানুষ সেগুলো ব্যবহার করবে, শুধু তাঁকে সেখানে দেখা যাবে না। আমার বন্ধু সুরকার দেবাশিস দাশগুপ্ত আচমকা চলে গেল। তার বেশ কিছুদিন পরে হঠাৎ গাড়িতে যেতে যেতে ফুটপাতের ভিড়ে কাউকে দেখে আমার মনে হত দেবাশিস হেঁটে যাচ্ছে। মনের ভুল। কিন্তু মনে ডার জমত। প্রিয়দাশ এই পৃথিবীতে আছে। এই পৃথিবীর অনেক জায়গায় তার স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। কিন্তু মৃত্যুকে দূরে রাখতে পারলেও জীবন থেকে সে অনেক দূরে সরে আছে। শরীর চলে গেলে বোঝার কোনও অবকাশ থাকে না, বোধ চলে গেলে শরীরও তো মূল্যহীন হয়ে যায়।
২৩
এটা কিন্তু খুব খারাপ রসিকতা হল
আজ সকালে কলকাতায় ফিরেই খবরটা পেয়ে ভেবেছিলাম, এটা খুব খারাপ রসিকতা। বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম যখন, তখন আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। ঋতু আমাকে সমরেশদা বলত, ফোনে বলত, ‘সমরেশদা, তুমি কি এখন কথা বলতে পারবে?’ মনে হত, পৃথিবীতে যে-ক’জন ভদ্রলোক আছেন, ঋতু তাঁদের একজন। এই যে আমি এই লেখাটা লিখছি, তখন ঋতু ওর বাড়িতে শুয়ে আছে, একটু পরে ওকে নিয়ে যাওয়া হবে নন্দনে, তারপর মহাশ্মশানে, তারপর ওর শরীর পৃথিবীতে থাকবে না—কিন্তু ঋতু থাকবে। আমি কখনওই বয়সে কুড়ি বছরের ছোট ছেলেটার এভাবে না-থাকা মেনে নিতে পারছি না।
ওর সঙ্গে প্রথম কথা বলি ‘এবং ঋতুপর্ণ’ অনুষ্ঠানে, যেটা সে টিভির জন্য তৈরি করছিল। প্রথম আলাপে বলল, ‘সমরেশদা, আমরা যদি পরস্পরকে ‘তুমি’ বলি?’ আমি হেসে বলেছিলাম, ‘যাক, একটু প্রোমোশন পেলাম। শুনেছি, তুমি ‘তুই’-এর ওপর ওঠো না।’ সে সরল বালকের হাসি হাসল।
তারপর মাঝে-মাঝে দেখা হত, এগিয়ে এসে গল্পো করত। ওইটুকু। সেসময় আমি খবরের কাগজে মাঝে-মাঝে চিত্র-সমালোচনা করতাম। ঋতুর ছবি ‘অন্তরমহল’-এর সমালোচনা লিখতে গিয়ে বিরূপ কথা লিখেছিলাম। বারংবার মনে হয়েছিল এ চিত্রনাট্য সম্পর্কে ততটা মনোযোগ দেয়নি, যতটা ছবির ‘মেকিং’ নিয়ে ভেবেছে। বেশ কিছু অযৌক্তিক ব্যাপার ছবিতে ছিল। সেটা বেশ কড়া ভাষায় লিখেছিলাম। তার কিছুকাল পরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে পেইন্টিং-এর প্রদর্শনীতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি ঋতু আসছে। এরকম ক্ষেত্রে সাধারণ পরিচালকরা এড়িয়ে যায় অথবা ঝগড়া করে। নিজের খারাপটাকে ‘ভাল’ প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু ঋতু আমাকে দেখে হাসতে-হাসতে এগিয়ে এসে নানা কথা বলল। ছবির বিষয়ে একটিও কথা নয়। যাওয়ার আগে বলল, ‘আমি ফোন করলে আমার বাড়িতে আসবে?’
দিন দশেক পরে ফোনটা এল। গেলাম ওর লেক গার্ডেন্স-এর বাড়িতে। ওর বসার ঘরে বসে বলল, সমরেশদা, তুমি কি আমার সঙ্গে কাজ করবে?’
আমি অবাক হলাম। সে তখন জানাল, ‘আমি রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটাকে আবার ছবিতে আনতে চাই।’
‘কেন?’ সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম।
উত্তর দিতে ঋতু যখন সময় নিচ্ছে, তখন বললাম, ‘বাঙালির মনে তপন সিংহ এবং ছবি বিশ্বাস এখনও জ্বলজ্বল করছে। তাই না?’
‘নিশ্চয়ই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’-কে হুবহু তো করব না। ওই গল্পের নির্যাস নিয়ে ছবিটা হবে। হ্যাঁ, রহমত এবং মিনি থাকবে।’ ঋতু বলল।
আমার মাথায় চটজলদি কিছু ভাবনা চলে এল। বললাম, ‘তা হলে সময়টা বছর দশেকের মধ্যে করো। এই আফগানিস্তান, যেখানে তালিবানরা আমেরিকানদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, গ্রামগুলোতে বোমা পড়ছে আর রহমত কলকাতায় আটকে রয়েছে। তার মেয়ে বড় হচ্ছে দেশে, আদৌ বেঁচে আছে কি না তা-ও জানা নেই, থাকে কলুটোলায় আফগানদের সঙ্গে।’
ঋতু আমাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর দিনের-পর-দিন আমরা ছবির গল্পের খসড়া তৈরি করলাম। আমাদের রহমত ফলের ব্যবসায় মার খাওয়ার মানুষকে কাবুলিওয়ালা হিসেবে ধার দিয়ে বেড়ায় না, ড্রাইভিং শিখে গাড়ি চালায়। ইউএসআইএস-এ চাকরি করা বাঙালি অফিসারের ড্রাইভার ছুটিতে যাওয়ায় তার জায়গায় রহমত এল গাড়ি চালাতে, যে-বাড়ির মেয়ের নাম মিনি।
ছবিটা যখন হিন্দিতে হবে, তখন আমি বললাম, ‘রহমত’-এর চরিত্রে অমিতাভ বচ্চনের কথা ছাড়া আর কাউকে ভাবতে পারছি না।’ সে হেসে বলল, ‘প্রথম দিন থেকে এই নামটাই ভেবে এসেছি। অমিতজি’র সঙ্গে কথা বলতে মুম্বই যাব।’
বললাম, ‘তা হলে এই অবধি থাক। তুমি ফিরে এলে চিত্রনাট্যের কাজ শুরু করা যেতে পারে।’
আপনারা জানেন সেই ছবি হয়নি। খুব দুঃখ পেয়েছিল ঋতু। আমার আপশোশ হয়েছিল এগিয়ে আসা প্রযোজক পিছিয়ে যাওয়ায়।
হঠাৎ একদিন ফোন, ‘আমি ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর হয়ে একটা কাগজ প্রতি সপ্তাহে সম্পাদনা করব। তোমাকে ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে হবে।’
আমি চুপ করে আছি দেখে বলল, ‘আমি জানি তুমি ‘আনন্দবাজার’-এর কাগজগুলোতেই লেখো, আমার অনুরোধ রাখবে না?’
‘না’ বলতে পারিনি।
‘কলকাতায় নবকুমার’ যখন বের হত তখন সে মাঝে-মাঝেই ফোন করত, ‘জমিয়ে দিয়েছ গো!’
সেটাই শেষ নয়। ঋতুর চাপে আরও দুটো ধারাবাহিক লিখলাম ওর কাগজে। রবিবার এলেই প্রথমে ওর সম্পাদকীয় ‘ফার্স্ট পার্সন’ পড়ি। কী সরলভাবে ওর লেখা বুকের ভেতর ঢুকে যায়। কিন্তু মা আর বাবাকে নিয়ে ওর নস্টালজিক লেখাগুলো যখন প্রায়ই ছাপা হত—তখন একটু-আধটু বকেছি। ও চুপ করে থেকেছে।
সুনীলদার স্মরণসভা হবে মোহরকুঞ্জে। ঋতু এল। সুন্দর বলল মঞ্চে দাঁড়িয়ে, যাওয়ার আগে বলল, ‘জানো, আমার না কেবলই দেরি হয়ে যায়।’
‘মানে?’
‘সুনীলদার গল্প পড়ে ছবি করব বলে ঠিক করলাম। কিন্তু যোগাযোগ করতে এত দেরি করলাম যে শুনতে পেলাম গল্পের ‘রাইট’ গৌতমদা নিয়ে নিয়েছে।’
আজ মনে হচ্ছে, এত তাড়াহুড়োর কী দরকার ছিল? যার নাকি কেবলই দেরি হয়ে যায়, আজ তার সেটা হল না কেন?
একটু-আধটু আনন্দ, অনেক-অনেক শোক নিয়ে মানুষ শেষ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
আমার সেই শোকের ভার আরও বাড়ল।
২৪
কয়েকদিন আগে গল্ফগ্রিনে গিয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দের নামাঙ্কিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। সেখানে পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড একটা বড় স্টল করেছিল বই-এর। এটি অতি উত্তম উদ্যোগ। ধরা যাক, আপনি গল্ফগ্রিন-লেক গার্ডেন্স এলাকায় থাকেন। আপনার বই পড়ার নেশা মেটানোর জন্য যেরকম বই-এর দোকান থাকা দরকার তা পাঁচ মাইলের মধ্যে নেই। রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে দু-তিনটি আছে। কিন্তু সেখানে যেতে দু’বার বাস পাল্টাতে হয়। কলেজ স্ট্রিটে পৌঁছতে পারলে কোনও সমস্যা থাকে না। কিন্তু সেই দক্ষিণ শহরতলি থেকে কলেজ স্ট্রিট শুধু বই কিনতে যাওয়ার কথা ভাবলেই ইচ্ছেটা মরে যায়। বাসের ভিড়, জ্যাম, প্রচুর সময় নষ্ট করার পর কলেজ স্ট্রিটে পৌঁছনোর বাসনা থাকার কথা নয়। কিন্তু আপনার পাড়ায় যদি মিনি কলেজ স্ট্রিট উঠে আসে তাহলে তো হাতে চাঁদ পাওয়ার কথা। হয়তো যা চাইছেন তার সবকটা বই পাবেন না, তবে বললে পরেরদিন ওঁরা আনিয়ে দেবেন। এই যেমন গল্ফগ্রিনের মেলা তিনদিন ধরে চলল। এই কলেজ স্ট্রিট প্রসঙ্গ মনে আসতেই আর একটা অভিজ্ঞতা স্মরণে এল। এখন বিদেশে মাঝেমাঝেই বাংলা বইমেলা হয়। এই যেমন আগামী চব্বিশে যে নিউইয়র্কে তিনদিনের বইমেলা হচ্ছে। নিউইয়র্কে বাঙালির সংখ্যা কত জানি না, তবে মেলায় প্রতিদিন হাজার ছয়-সাত বাঙালি যান। কয়েকবার এইসব মেলায় গিয়ে দেখেছি স্টলগুলোতে ভিড় করে বই কেনেন বাংলাদেশের বাঙালিরা। সুনীল, শীর্ষেন্দু, বুদ্ধদেবের সঙ্গে হুমায়ুন, জাফর ইকবালের বই ব্যাগভর্তি করে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশ থেকে নিয়ে যেতে একটি বইয়ের পিছনে যা খরচ পড়ে এবং বিক্রি না হওয়া বই-এর লোকসানের বোঝা কমাতে বিক্রেতারা একশো টাকার বইয়ের দাম দশ ডলার ধার্য করেন। অর্থাৎ একশো টাকার বই কিনতে হলে দশ ডলার দিতে হবে যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় পাঁচশো চল্লিশ টাকা। যাঁরা বই কেনেন তাঁদের বক্তব্য এই টাকায় বই না কিনলে তো পড়াশোনা বন্ধ করে অশিক্ষিত হয়ে বসে থাকতে হবে। পশ্চিমবাংলার কিছু মানুষ ওইসব মেলায় যান গানবাজনা বা সেমিনার শুনতে। স্টলগুলোয় যদি পৌঁছে যান তাহলে পারতপক্ষে বই কেনেন না। সঙ্গে যদি বাংলা পড়তে পারা বাড়ির ছেলে-মেয়ে থাকে এবং তারা বায়না ধরে বই কেনার জন্য তাহলে সান্ত্বনা দেন সামনেরবার দেশে ফিরে গিয়ে কিনে দেবেন। এরকম এক ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘বই কিনছেন না কেন?’ উত্তর হল, ‘কেন কিনব মশাই? একশো টাকার বই পাঁচশো চল্লিশ টাকায় কেনার মতো মূর্খ আমরা নই। সামনের শীতে দেশে যাব তখন কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে বই কিনব। ওরা বিশ পার্সেন্ট কমিশনও দেয়।’
‘আপনার বাড়ি কলকাতায়?’
‘হ্যাঁ। ওই একটু বাইরে।’
‘জায়গাটার নাম?’
‘এগরা।’
অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। মেদিনীপুর জেলার এগরা শহর থেকে বই কিনতে ওঁরা কলেজ স্ট্রিটে যাবেন? কত সময় লাগবে? খরচের কথা বাদ দিলাম, কদিনের জন্যে দেশে বেড়াতে গিয়ে ওই সময় নষ্ট করতে কেউ চাইবেন? নাকি আত্মীয়বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সম্পর্ক ঝালাই করতে বেশি উৎসুক হবেন? আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হল, বেশিরভাগ কলকাতার বাঙালির সঙ্গে গত পঁচিশ-তিরিশ বছরের বাংলা সাহিত্যের কোনও সম্পর্ক নেই। সমরেশ বসু আর সমরেশ মজুমদারের বই ওঁদের কাছে একাকার।
হতেই পারে। কলকাতার ক’জন বাঙালি নিয়মিত কিনে বা না কিনে বই পড়েন? জিরো জিরো কত পার্সেন্ট? আট কোটি বাঙালির জন্য যে কটা খবরের কাগজ বাংলায় ছাপা হয় তার বিক্রির সংখ্যা সম্ভবত বত্ৰিশ লাখ ছাড়ায়নি। ধরা যাক একটি কাগজ যদি চারজন বাঙালি পড়েন তাহলে সাত কোটি বাঙালির সঙ্গে বাংলা কাগজের কোনও সম্পর্ক নেই। গল্ফগ্রিনের ওই অনুষ্ঠানে আমার জন্য একটা দারুণ চমক অপেক্ষা করছিল।
মাননীয় লোকসভার সদস্য সৌগত রায় ওই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন এবং অনুষ্ঠান শুরুর আগে এবং সময়ে আমার পাশে বসেছিলেন। এই ভদ্রলোককে আমি টিভিতে অনেকবার দেখেছি। দেখে মনে হত অত্যন্ত উন্নাসিক, সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাঁকা কথা বলতে অভ্যস্ত একজন অহঙ্কারী রাজনৈতিক নেতা যিনি সব বোঝেন। এরকম মানুষ সম্পর্কে আমার আগ্রহ থাকতে পারে না। কিন্তু আমি এটুকু জানি তিনি অত্যন্ত শিক্ষিত, পড়াশোনা করা মানুষ। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, রাজনীতি করতে করতে তিনি এমন একটা মুখোশ পরে ফেলেছেন যা তাঁর মুখের চেহারা কেমন তা নিজেই ভুলে গিয়েছেন। এখন রাজনীতি করতে চাইলে পড়াশোনা করতে হয় না। তিন ছেলের প্রথম দু’জন ভাল পড়াশোনা করে জয়েন্ট দিয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেল। ছোটটা ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ক্লাস নাইনে যখন আটকে গেল তখন তাদের বাবা বললেন, যা তুই রাজনীতি কর। ছেলেটি দু’দিন দুই রাজনৈতিক দলের আঞ্চলিক অফিসে গেল কাউকে ভেলা করে। গিয়ে বুঝল একটি দল কদ্দিন গদিতে থাকবে এই আশঙ্কার কথা ফিসফিস করে বলছে। অন্য দলটি সোচ্চারে বলছে তিনবছর পরে নির্বাচন হলেই তারা ক্ষমতায় আসবে। ছেলেটি দ্বিতীয় দলে নাম লেখাল। দু’-তিনবার মিছিল করে পুলিশের লাঠি খেয়ে স্লোগান দিয়ে ওপরতলার নজরে পড়ে যাওয়ায় দ্রুত উন্নতি হয়ে গেল তার। এই ছেলে এমএলএ-এর টিকিট পেলেই নির্বাচিত হবে এবং মন্ত্রী হয়ে যাবে। তখন তার ঘরে আইএএস অফিসাররা অনুমতি নিয়ে ঢুকে স্যার স্যার বলবে। দুই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার দাদা তাকে দেখে কেঁচো হয়ে থাকবে।
কিন্তু সৌগত রায় তো ওইভাবে রাজনীতিতে আসেননি। মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দেওয়ার সময় সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমার সেইসব গল্প-উপন্যাসের কথা বলতে লাগলেন যা আমি তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে লিখেছি। যেসব বই-এর কথা এখন কোনও সাহিত্য সমালোচক উল্লেখ করেন না কারণ তাঁদের পড়ে ওঠা হয়নি সেগুলো, বিশ্লেষণ করতে ওঁর অসুবিধে হল না। জানালেন ওঁর প্রিয় উপন্যাস গর্ভধারিণী যেখানে চারটি ছেলেমেয়ে নকশাল বা উগ্রপন্থী না হয়েও সমাজব্যবস্থা পাল্টাতে চেয়েছিল। এমনকী আমার বন্ধু, মঞ্চে উপস্থিত থাকা শঙ্করলাল ভট্টাচার্যর অনবদ্য কাহিনি যা সে ক্রিক রো-র ভানু বসুকে নিয়ে লিখেছিল তার ও উল্লেখ করলেন তিনি। এই মানুষটির সঙ্গে টিভিতে দেখা সৌগত রায়ের বিন্দুমাত্র মিল থাকা তো দূরের কথা, দু’জনকে আলাদা মানুষ বলে মনে হয়েছে। রাজনীতি ছাড়া অন্য কোনও প্রফেশনে থাকা কোনও মানুষের পক্ষে এমন দ্বৈত চরিত্র বজায় রাখা সম্ভব নয়। আমি ওঁকে বিনীতভাবে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘সব কাজের শেষে রাত্রে যখন ঘুমাতে যান তখন মাথার ভিতর টনটন করে না?’ সৌগত রায় হেসে বলেছিলেন, ‘না সমরেশবাবু, হয় না।’