১৫
আমার বইয়ের ওড়িয়া ভাষার অনুবাদক যুগলকিশোরজির বয়স চুরাশি। টেলিফোনে কথা হত। একদিন বললেন, ‘আপনি অচ্যুত সামন্তের কথা শুনেছেন?’
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘না। কে তিনি?’
যুগলকিশোরজি আপশোশ করেছিলেন, ‘কি দেশে আমরা বাস করি। কলকাতা আর ভুবনেশ্বর কত কাছাকাছি অথচ এখানকার খবর আপনাদের কাছে পৌঁছয় না। অচ্যুত সামস্তকে আমরা কী চোখে দেখি তা এখানে না এলে বুঝতে পারবেন না। আপনি তো কাদম্বিনী পত্রিকার অনুষ্ঠানে আসছেন, তখন জানতে পারবেন।’
ভুবনেশ্বরে গিয়ে গেস্টহাউসের বেয়ারাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘ভাই, অচ্যুৎ সামন্তকে তুমি জানো?’
লোকটা অবাক হয়ে তাকাল, ‘কী বলছেন সাহেব। স্যরকে জানে না এমন লোক কি ভুবনেশ্বরে আছে?’
ভদ্রলোক রাজনৈতিক নেতা নন, হলে খবরের কাগজে নাম দেখতাম। যে ছেলেটি আমাকে এসকর্ট করবে তার নাম প্রদীপ পাণ্ডা। তাকে অচ্যুৎ সামন্তর কথা বলতেই সে হেসে বলল, ‘চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি।’
গাড়িতে উঠলে প্রদীপ বলল, ‘উনিশশো বিরানব্বই সালে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা সম্বল করে সার ক্ষুধা ও অশিক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করতে নেমেছিলেন। এখন এই একুশ বছর পরে বিভিন্ন শাখার বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিস তৈরি করতে পেরেছেন যেখানে কুড়ি হাজার দুশো বিয়াল্লিশটি অতি গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরা থেকে পড়াশোনা করে।’
‘কিস মানে কী?’
‘কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অফ সোস্যাল সায়েন্স।’ প্রদীপ বলল, ‘আর ‘কিট’ হল কলিঙ্গ ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজি। প্রায় একুশ হাজার ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করছে পঁচিশ রকমের প্রফেশন্যাল কোর্সে। পঁচিশ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ঝুড়িটি ক্যাম্পাসে ওদের ক্লাস হয়।’
ভাবলাম এই অচ্যুৎ সামন্ত নিশ্চয়ই অতিশয় ধনী ব্যক্তি। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিসের ছাত্র-ছাত্রীদের কী রকম বেতন দিতে হয়?’
প্রদীপ হাসল, ‘একটা পয়সাও নয়। কিন্ডার গার্টেন থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাস পর্যন্ত একদম ফ্রি-তে পড়ে ওরা। দেশের অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছেলেমেয়েদের এই সুযোগ দিয়েছেন সার। বেশিরভাগই আদিবাসী পরিবারের ছেলেমেয়ে।’
গাড়ি প্ৰথমে গেল কিস-এর ক্যাম্পাসে। গাড়ি থেকে নেমে বাঁধানো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দু’পাশের সুন্দর শিক্ষাসদনগুলো দেখে মুগ্ধ হলাম। বাঁক ঘুরতেই দেখলাম জনা কুড়ি ছেলে-মেয়ে লম্বা ঝাঁটা নিয়ে রাস্তার ধুলো পরিষ্কার করছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এরা কারা?’
‘ছাত্র-ছাত্রী। এক একটা ব্যাচের উপর এক একটা অংশ পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দেখুন, সারও ওদের সঙ্গে আছেন।’
একটি মধ্যবয়সি মানুষকে দেখতে পেলাম ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করছেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘উনি অচ্যুৎ সামস্ত?’
‘হ্যাঁ।’
আমরা দাঁড়ালাম। রাস্তা পরিষ্কার করে অচ্যুৎ সামন্ত এগিয়ে এসে নমস্কার জানালে প্রদীপ আমার পরিচয় দিল। ভদ্রলোক খুব আন্তরিক স্বরে বললেন, ‘আপনি এসেছেন বলে আমি খুব খুশি হয়েছি।’
দেখেই বোঝা যায় পঞ্চাশের নীচে ওঁর বয়স। ফর্সা, সুদর্শন চেহারা। পরনে খুব সাধারণ জামা-প্যান্ট।
বললাম, ‘এই এত বড় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়েও আপনি রাস্তা পরিষ্কার করছেন? এ দেশে এটা কল্পনা করা যায় না।’
‘কিন্তু এটাও একটা কাজ। এই সময় আমি ফাঁকা ছিলাম বলে ওদের কাজে হাত মেলালাম। যে রাস্তায় দু’বেলা হাঁটছি সেটাকে ঠিক রাখা আমাদের কর্তব্য।’ অচ্যুৎ সামন্ত বললেন, ‘চলুন।’
বলতে চাইছিলেন না প্রথমে, শেষপর্যন্ত একটু একটু করে যা জানলাম তা বিস্ময়ের অতীত। অচ্যুতের বাবা, একজন টাটা স্টিলের কর্মী। উনিশশো সত্তর সালে আচমকা মারা যান। সাত ছেলে-মেয়েকে নিয়ে অচ্যুতের মা বাধ্য হন ওড়িশার কালারাবাঙ্ক গ্রামে ফিরে যেতে। তখন অচ্যুতের বয়স চার কি পাঁচ। ছয় বছর বয়সেই অচ্যুৎকে চাষের ক্ষেতে কাজ করা থেকে শুরু করে নারকেল এবং কলা গাছ থেকে কলা পেড়ে বিক্রি করতে হত বেঁচে থাকার জন্য। অচ্যুৎ ম্লান হেসে বললেন, ‘তখন দিনে একবেলার খাবার রোজ পেতাম না। মা নদী থেকে গৌড়-গুগলি নিয়ে এসে আমাদের খাওয়াতেন। তার পর দাদা যখন জামশেদপুরে টাটা কোম্পানিতে কাজ পেলেন তখন অবস্থা সামান্য ভাল হল। কিন্তু আমি পড়তে খুব ভালবাসতাম। বাড়িতে আলো নেই বলে মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে গিয়ে পড়তাম। এইভাবে এমএসসি পাস করলাম কেমিস্ট্রি নিয়ে। তার পর দশ বছর লেকচারারের চাকরি করলাম। দেখুন, ওই ভয়ঙ্কর অভাব আমার কাছে ঈশ্বরের দান বলে মনে হয়। এই যে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি তার কারণ আমার শিক্ষা আছে। আমি লড়াই করেছি শিক্ষার জন্য। আজ সেটাই দরিদ্র বাচ্চাদের দিতে চাই।
সামন্ত বিয়ে করেননি। কারণ বিয়ে করলে পরিবারকে সময় দিতে হবে। এখন যে কুড়ি ঘন্টা প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করেন তা করতে পারতেন না। এত বড় শিক্ষা সাম্রাজ্যের মালিক হয়েও তিনি বেতন নেন অতি সামান্য। তাঁর অনেক কর্মচারীর চেয়েও কম। কিস-এর বাইরে যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তার ছাত্র-ছাত্রীদের বেতনের টাকায় এখনও তাঁকে জমি কিনতে হয় কারণ আরও বড় করতে চান কিটকে। রাজনীতিকে ঢুকতে দেননি তিনি। হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর কোনও ইউনিয়ন নেই। কিন্তু আছে চাকরির নিরাপত্তা। যারা হাতের কাজ শেখে, ছবি আঁকে, শিক্ষাশেষে তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করা হয়। আর এই কারণে দেশের বিখ্যাত অধ্যাপকদের নিয়ে এসেছেন অচ্যুৎ সামন্ত।
প্রায় তরুণ এই মানুষটির সামনে দাঁড়ালে শ্রদ্ধায় মাথা নিচু হয়ে আসে। প্রতিদিন ভোরে এবং রাতে শুতে যাওয়ার সময়ে মাকে প্রণাম না করার কথা এই মানুষটি ভাবতে পারেন না। কারণ মা শিখিয়েছিলেন, ‘অভাবকে হারাও, পড়াশোনা করো।’ অচ্যুৎ সামস্তর কাছে তাঁর মা-ই ঈশ্বর।
১৬
যখনই ওড়িশা বা অসম থেকে অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা আমাকে আমন্ত্রণ জানান তখনই আমার অস্বস্তি খুব বেড়ে যায়। প্রথমবার গিয়েছিলাম নওগাঁতে, সাহিত্য সম্মেলনে। অসম সাহিত্যের কয়েকজন বিখ্যাত কবি-ঔপন্যাসিকের নাম জানা ছিল কিন্তু তাঁদের কোনও লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। সত্যি কথা বললে বলতে হয়, অসম বা ওড়িশায় সাম্প্রতিক সাহিত্যের কোনও খবরই রাখার সুযোগ যেমন হয়নি, চেষ্টাও করিনি। নওগাঁতে গিয়ে অবাক হয়েছিলাম, হাজার হাজার মানুষ আশপাশের গ্রাম থেকে মিছিল করে উৎসবে যোগ দিতে এসেছিলেন। অসমবয়সি পাঠকদের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র- তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণ তো বটেই, আমাদের অনেক লেখা ওঁদের পড়া হয়ে গিয়েছে। এমনকী সেই সময়ে যে ছোটগল্প লিখেছি তার কথাও উল্লেখ করলেন একজন। অথচ আমি ওঁদের ভাষায় কোনও সাহিত্য সম্পর্কে কিছু বলতে পারছি না। যে লেখকদের নাম জানি তাঁরা গত হয়েছেন প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। অথচ ডুয়ার্সের যে চা-বাগানে আমি জন্মেছি সেখান থেকে অসম যেতে মাত্র একশো মাইল পেরোতে হয়। ভয়ঙ্কর হীনম্মন্যতায় ভুগেছিলাম। যখনই ওঁরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন অসম সাহিত্য সম্পর্কে আমার বক্তব্য কী, তখনই লজ্জিত হচ্ছিলাম। আমাকে সে যাত্রায় উদ্ধার করেছিলেন প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা। চমৎকার বাংলা বলতেন তিনি। বললেন, ‘অসমের পাশেই মেঘালয়। সেখানকার ভাষা তো আমি জানি না। অতএব আপনার না জানাটা অপরাধ নয়।’ কেউ কিছু প্রশ্ন করলে ভূপেনবাবু আমার হয়ে জবাব দিয়ে দিচ্ছিলেন।
একই ব্যাপার ঘটে ওড়িশাতে গেলে। ‘বিষুব খেলা’ নামের একটি বড় সাহিত্য-অনুষ্ঠানে গিয়ে শুনছি সবাই মাতৃভাষায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। শ্রোতারা ওড়িশার। আমাকে বলতে বলা হলে আমি ভাবলাম, তৃতীয় ভাষা ইংরেজিতে বলি। সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতারা অনুরোধ করলেন, বাংলায় বলুন। তাই বললাম, ওঁরা আমার বাংলা স্পষ্ট বুঝতে পারল, আম ওড়িয়া একটু আধটু বুঝি।
মাঝে মাঝে প্রশ্নটা মনে আসে। আমি ইংরেজিতে লেখা গল্প-উপন্যাস যে স্বচ্ছন্দে পড়তে পারি তার কারণ, আমাদের ওই ভাষাটা স্কুলের শুরুতেই শেখানো হয়। আমি তাই এখনকার আমেরিকান ছোটগল্প-উপন্যাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আর ওই ইংরেজি ভাষার দৌলতে ফরাসি, জার্মান, ইতালীয় থেকে শুরু করে স্প্যানিশ, মেক্সিকান লেখকদের লেখা পড়তে পারছি। আজ কলকাতার শিক্ষিত পাঠকরা লাতিন আমেরিকার লেখক ও তাঁদের সাহিত্য সম্পর্কে যে কথা বলতে পারেন তার জন্যে কৃতজ্ঞ থাকেন ইংরেজি ভাষার কাছে। এইখানে একটু অন্য প্রসঙ্গে যাচ্ছি। ইংরেজি ভাষা বলতে আমরা জানি নেসফিল্ড সাহেবের ব্যাকরণ, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ-এর অভিধান যা লালন করেছে। অর্থাৎ খোদ ইংল্যান্ডের ভাষা ব্রিটিশরা প্রায় দুশো বছর ধরে ওই ভাষাই আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেন। আমেরিকা থেকে প্রকাশিত বইগুলোর সাম্প্রতিকতম ইংরেজির সঙ্গে আমাদের শেখা ইংরেজির বেশ পার্থক্য লক্ষ করছিলাম! টি আই ও এন না লিখে এক্স এন লিখলেই তো উচ্চারণ একই থাকে। অর্থাৎ যেভাবে শব্দগুলো বলা হয় সেইভাবেই বানানটা লিখলে আমেরিকানরা বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করে। ওদের দেশে গিয়ে দেখেছিলাম, ব্রিটিশরা যা করতে অভ্যস্ত ওরা ঠিক তার উল্টোটা করে। এমনকী আলোর সুইচ নিচ থেকে উপরে তুললে তবে বাল্ব জ্বলে। তা কয়েক বছর আগে আমার একটি বাংলা উপন্যাসের চমৎকার অনুবাদ করে সুন্দর বই ছাপিয়েছেন, কলকাতার এক প্রকাশক। আমেরিকায় সেই বইটির যাতে বাজার পাওয়া যায় তাই আমাকে নিয়ে নিউইয়র্কে গিয়েছিল। নিউইয়র্কের প্রেস কাবে অনেক সাংবাদিকের সামনে সেই বই উন্মোচন করেছিলেন প্রেস ক্লাবের সভাপতি। খুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু দু’দিন পরে সভাপতিমশাই জানালেন, ‘আমি খুবই দুঃখিত তোমার উপন্যাসের পাঠক এখানে পাওয়া যাবে না। তোমার বইটি পড়ার চেষ্টা করেছি। ওটা যে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে তা ব্রিটিশদের ইংরেজি, এখানকার আমেরিকানরা পড়তে অভ্যস্ত নয়।’ ভদ্রলোক খুব ভুল কথা বলেননি। আমেরিকান বই-এর ডিস্ট্রিবিউটররা বই পড়ার পর তেমন আগ্রহ দেখাননি। লক্ষ করেছি, সিডনি অথবা দিল্লিতে, কিংবা কলকাতায় যেসব তরুণ-তরুণী ইংরেজি গল্প উপন্যাস পড়ে তার বেশিরভাগ ছাপা হয় আমেরিকায়। আমরা যখন মোরাভিয়া অথবা কামু পড়েছিলাম তখন কিন্তু আমেরিকান ইংরেজির রমরমা শুরু হয়নি।
প্রসঙ্গে আসি, আমরা বিশ্বসাহিত্য পড়ছি ইংরেজির দৌলতে কিন্তু প্রতিবেশী দুই রাজ্যের সাহিত্য সম্পর্কে উদাসীন থাকছি। এমন নয় যে ওঁদের সাহিত্যের অনুবাদ ইংরেজিতে হচ্ছে না। সেই বইগুলো আমাদের হাতে আসছে না কেন? এর দুটো কারণ আছে। এক, আমরা ওঁদের সাহিত্য পড়ার তাগিদ অনুভব করি না। হয়তো মনে মনে ভাবি, পড়ে লাভবান হব না। দ্বিতীয় কারণ হল, বইগুলো আমাদের এখানকার দোকানে অথবা লাইব্রেরিতে পাওয়া যায় না। ঘুরিয়ে বলা যায়, চাহিদা থাকলে নিশ্চয়ই পাওয়া যেত। অর্থাৎ আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। অল্পবয়স থেকে দেখেছি, বিহারী, ওড়িয়াদের নিয়ে বাঙালিবাবুরা রঙ্গ করছেন। এমনকী ওই কুৎসিত রসিকতায় পূর্ববঙ্গের বাসিন্দাদেরও বাদ দেয়নি পশ্চিমবাংলার বাবু। তারা হাসতে হাসতে ছড়া কাটত, ‘বাঙাল মনুষ্য নয় উড়ে এক জন্তু!’ অর্থাৎ এরা খুবই নিম্নশ্রেণির মানুষ। এই ফাঁপানো অহমিকায় নিজেদের উচ্চমার্গের মানুষ বলে ভেবে পর্বতমালা সিন্ধু দেখতে গিয়েছে, ঘরের পাশের ধানের শিষের উপর শিশিরবিন্দু দেখার কথা ভাবেনি।
গতমাসে ভুবনেশ্বরে গিয়েছিলাম কাদম্বিনী পত্রিকার সম্পাদিকা ইতি সামস্তের আমন্ত্রণে। শুনলাম, পত্রিকাটি পঞ্চাশ হাজারের উপর বিক্রি হয়। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে আমাকে যখন কথা বলতে বলা হল তখন আমি ক্ষমা চাইলাম। আমার অজ্ঞতার কথা দর্শকদের জানালাম। শুনে তাঁরা সানন্দে ক্ষমা করলেন হাততালি দিয়ে। বক্তৃতার পর তাঁরা এসে জানালেন, বাংলা সাহিত্যের সব খবর রাখেন। অনুযোগ জানালেন, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা দেখছেন না কেন? বাণী বসু কি নিয়মিত লেখেন না?
উত্তর দিয়েছি কিন্তু নিজেকে খুব অশিক্ষিত মনে হয়েছিল তখন, এখনও।
১৭
বাংলা সিনেমা থেকে মাতাল উধাও হয়ে গিয়েছে। এককালে তাদের রমরমা ছিল। ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়’। গান গাইতে গাইতে ছবি বিশ্বাস অপূর্ব অভিনয় করেছিলেন একটি মাতালের চরিত্রে। হিন্দি ছবিতে কেষ্ট মুখোপাধ্যায় তো মাতালের চরিত্রে বিখ্যাত ছিলেন। দেবদাস অন্তত বার-পাঁচেক সিনেমায় রূপান্তরিত হয়েছে। মাতাল দেবদাসকে যেমন পাঠক নিয়েছিল তেমনি প্রথমদিকের সিনেমাগুলিও জনপ্রিয় হয়েছিল। তখন মদ্যপান করলে বা সিগারেট খেলে কিন্তু লেখা হত না ওগুলি শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। কিন্তু সেটাই মাতালদের চিত্রনাট্যে রাখতে উদ্দীপ্ত করত না নির্মাতাদের। উত্তমকুমার মদ্যপান করে গান গাইছেন। মহিলা দর্শকরা মুগ্ধ হয়েছেন দেখে, পুরুষরাও আনন্দিত। এখন এইসব মাতাল চরিত্রদের সিনেমাতে দেখা যায় না। বিধিবদ্ধ সতর্কতার কারণে নয়, এখন মাতালদের খুঁজে বের করতে হয় আমাদের চারপাশে। জীবনে যা বিরল তা সিনেমায় দেখাতে চান না আজকের পরিচালকরা। শুধু মাতাল কেন, আজকের (একমাত্র বস্তাপচা অশিক্ষিত দর্শক ধরতে চাওয়া সিনেমাকে বাদ দিলে) বেশিরভাগ সিনেমায় কমেডিয়ান চরিত্র থাকে না বললেই হয়। তুলসী চক্রবর্তী, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, নবদ্বীপ হালদার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, অর্জিত চট্টোপাধ্যায়, শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়, চিন্ময় রায় থেকে রবি ঘোষ, যাঁরা কয়েকদশক ধরে বাঙালি দর্শকদের হাসির ঝরনায় ধুয়ে দিয়েছেন, তাঁদের জায়গা পূর্ণ হল না। এই সেদিন দুপুরে সাড়ে চুয়াত্তর ছবি দেখতে দেখতে খেয়াল হল, এই নিয়ে অন্তত দশবার দেখলাম। প্রতিবারেই মুগ্ধ হয়েছি তুলসী চক্রবর্তীর আর মলিনাদেবীর অভিনয় দেখে। হাস্যরস একবার গ্রহণ করলেই নাকি দ্বিতীয়বারে জোলো হয়ে যায়। এক্ষেত্রে হয় না কেন?
কিন্তু আমরা দেখলাম মাতালদের মতো কমেডিয়ানরাও সিনেমা থেকে উধাও। কেন? এক বন্ধু জানালেন, আমাদের জীবনে হাসি কোথায়? সবসময় তো ভারী ভারী সমস্যার চাপে নুয়ে আছি। জীবনে যা নেই তা সিনেমায় থাকবে কেন? তখনই খেয়াল হল, আমাদের সিনেমা থেকে গানও বাতিল হয়ে গিয়েছে। ‘তুমি যে আমার’ থেকে কয়েকশো সুপার হিট গানে আমরা নায়ক-নায়িকাদের সিনেমায় লিপ দিতে দেখেছি। বন্ধু বললেন, কোনওদিন গান না শিখে তুমি হঠাৎ ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’ গাইতে পারবে? পারবে না। কোনও সংগীতশিল্পীর জীবন নিয়ে ছবি হলে অবশ্যই গান থাকবে। নইলে নেচেকুঁদে গাছের ডাল ধরে যেসব গান কিছু ছবিতে আজও থেকে গিয়েছে তাদের গ্রামবাংলায় সিনেমা বলা হয় না, বলা হয় বই।
কীরকম বদলে গেল ব্যাপারগুলি। উত্তর কলকাতায় রাত বাড়লে মাতালদের দেখা যেত একসময়। হাতে টানা রিকশায় কাত হয়ে পড়ে আছেন তাঁরা। প্রতি রাতে এক সময়ে সেই রিকশাগুলি যেত যা দেখে আমরা সময় বলতে পারতাম। রিকশা থেকে নেমে অজস্র গালাগালি শুনতে শুনতে তাঁরা বিছানায় যেতেন। সকালে যখন থলি হাতে বাজারে যেতেন তখন কে বলবে রাতে আধশোয়া হয়ে ফিরেছেন। সেসময় উত্তর কলকাতায় কোনও বাড়িতে বসে মদ খাওয়ার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবত না। ঠাকুর্দা থেকে শুরু করে সব বয়স্করা বাড়িতে আছেন, মদ খাওয়ার সাহস কার হবে? কয়েকজন পাতিবাগান ভাটিখানা থেকে মদ গিলে ফেরে, তারা মদ্যপ, নিম্নশ্রেণির মানুষ বলে ঘৃণিত। রাস্তায় দুটি মাতাল চিৎকার করছে শুনে ভদ্রলোকরা ধমকে থামিয়ে দিতে পারতেন তখন। আর শনিবার দুপুরের ছুটির পরে দু’পাত্র খেয়ে মশলা পান চিবিয়ে গড়ের মাঠে শুয়ে অথবা ম্যাটিনি শো দেখে মুখ ধুয়ে উঠতিবাবু সন্ধের পরে বাড়িতে ফিরে মাথা ধরেছে বলে নিজের খাটে শুয়ে পড়লেই তরুণী স্ত্রী ঠোঁট ফোলাত, ‘আজ আবার? দাঁড়াও, মাকে বলে দিচ্ছি।’ তখন হাতে পায়ে ধরে তাকে ঠান্ডা না করে উপায় ছিল না। অথচ এই মাতালরা যখন সিনেমার পর্দায় মাতলামি করত তখন বাঙালি সপরিবার তা দেখে উপভোগ করত।
এখন উত্তর কলকাতার রাস্তায় খুঁজেও মাতাল দেখা যায় না। বছরের দুই-একদিন ব্যতিক্রম হলেও হতে পারে। সেই রিকশার পেঁচো মাতালদেরও আর দেখা যায় না। প্রায় বেশিরভাগ বাড়ির বয়স্করা চলে গেছেন। তাই বন্ধুরা রাত সাতটার পর এলে দু’তিন পেগ স্বচ্ছন্দে পাওয়া যায়। গিন্নিরাও মানানসই খাবার বানিয়ে দেন। কিন্তু ওই খেয়ে কেউ মাতাল হয় না। যদি কারও কথা একটু জড়িয়ে যায় তাহলে তাকে বন্ধুরা আর সঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করেন না। বাঙালি এখন মদকে গলায় পরাবার কায়দা শিখে ফেলেছে। যত মদ বার অথবা ক্লাবে বিক্রি হয় তার বহুগুণ বোতল যায় বাড়িতে বাড়িতে। এখন বিদেশি মদ ভারতে বোতলবন্দি হচ্ছে। সস্তায় ভারতীয় মদের চেয়ে মাঝামাঝি দামের মদের বিক্রি বেশি। সেদিন ক্লাবে একজন বলেই ফেললেন, সপ্তাহে তো দুদিন খাই, একটু দামি মদ খাব না কেন? লিভারটা তো রক্ষে পায়। কোনও ক্লাবের মেম্বার যদি পান ক’রে বেসামাল হয়ে পড়েন তাহলে শাস্তি হিসাবে তাঁকে কয়েকমাসের জন্যে ক্লাব থেকে সাসপেন্ড করা হয়। অতএব মদ খেয়ে আর কিন্তু মাতাল হওয়া চলবে না। কেউ যুক্তি দেন, ‘সিগারেটটা বন্ধ করুন। ওটা খুব ক্ষতি করে। তার চেয়ে দু-এক পেগ খেলে শরীর ভাল থাকে। রক্ত চলাচল সুষ্ঠুভাবে করে। সীমিত পান করলে হার্ট অ্যাটাক হয় না।’
অর্থাৎ মাতালরা যখন জীবন থেকে বর্জিত তখন তাদের সিনেমায় দেখা যাবে কেন? সিনেমার কোনও চরিত্র যদি ব্যবসার আলোচনা করতে করতে কোকাকোলা খাওয়ার মতো মুখ করে মদ্যপান করেন তাহলেও পর্দায় লিখতে হবে মদ্যপান স্বাস্থ্যর পক্ষে ক্ষতিকর। এইরকম মদ খাওয়ার কী দরকার? হয় চরিত্রটাকেই বাদ দাও নয় মদের গ্লাস সরিয়ে নাও। সিনেমা নাকি তরুণ সমাজকে শিক্ষা দেয়। এখনকার সিনেমা অন্তত মদ খেতে শিক্ষা দিচ্ছে না। সিনেমা দেখে শিক্ষিত না হয়েও তারা যে বিপুলভাব শিক্ষিত হচ্ছে তা বারগুলিতে ঢুকলে বোঝা যায়। একটা নিৰ্মল রসিকতা শুনলাম। একটি গরিলা হাতির প্রেমে পড়ে তার মায়ের কাছে বিয়ের অনুমতি চেয়েছিল। গরিলা মা অনুমতি দিল না কারণ হাতির দাঁত খুব উঁচু। বাংলা সিনেমা তার রসিকদের হারিয়ে ফেলেছে।
১৮
একমাত্র ভোট দিতে যাওয়া ছাড়া আমি এবং আমার মতো কোটি কোটি মানুষ কোনও রাজনীতি করি না। রাজনীতি করেন তাঁরাই যাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য অথবা সক্রিয় সমর্থক। এই সব মানুষের সংখ্যা শতকরা দশভাগের বেশি হতে পারে না। অর্থাৎ বাকি নব্বুই ভাগ মানুষ চাকরি অথবা ব্যবসা করেন, সংসারের সমস্যা সামলান। কেউ কেউ রকে বসে ফুটবল থেকে সিনেমা চটকান, কেউ গান গান, অভিনয় করেন অথবা গল্প কবিতা লেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু রাজনীতি করেন না।
কিন্তু এই আমি এবং আমার মতো মানুষেরা খবরের কাগজ পড়ি, টিভি দেখি। এইসব খবর আমাদের মনে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। যখন নন্দীগ্রামে গুলি চলেছিল, পুলিশের সেই গুলিতে নিরীহ মানুষ মারা গিয়েছিল, তখন সেই খবর পড়ে আমরা স্তম্ভিত হয়েছিলাম। ওই ঘটনার জন্যে দেশের বেশিরভাগ মানুষ তৎকালীন শাসককে ক্ষমা করতে রাজি হয়নি। এই আমি, যার সঙ্গে রাজনীতির কোনও সংশ্রব নেই, প্রতিবাদ মিছিলে হেঁটেছিলাম। টিভিতে সেই মিছিলে আমাকে দেখে বা কাগজের খবরে পড়ে কেউ কেউ বিস্মিত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, আপনিও হাঁটলেন? অর্থাৎ আমাকে যেন বাড়িতে থেকে কচ্ছপের মতো খোলের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে বসে থাকাই বেশি মানাবে।
কিন্তু এই আমি গত ছেচল্লিশ বছর ধরে লেখালেখির চেষ্টা করে আসছি। কোনও রূপকথা বা বানানো প্রেমের গল্প লেখার বাসনা আমার ছিল না। আমার আগে তারাশঙ্কর থেকে সমরেশ বসুর লেখার কাছে মাথা নত করে থাকি কারণ তাঁরা মানুষের কথা লিখে গিয়েছেন। বিভূতিভূষণ যেমন তাঁর দেখা মানুষের কথা লিখেছেন, তেমনই যখন কল্পনা করে লিখেছেন তাও আমাদের কাছে বাস্তব হয়ে গিয়েছে। যেমন, চাঁদের পাহাড়, অথবা দেবযান। এঁরা লেখা শুরু করেছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষে। স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতার জন্যে যেসব আন্দোলন চলছিল, হিন্দু- মুসলমান দাঙ্গায় যেভাবে মানুষ জড়িয়ে পড়েছিল এবং দেশভাগের ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়ায় জনজীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল, তার প্রতিফলন এঁদের লেখায় কি খুব উল্লেখযোগ্য ছিল? একটু খুঁটিয়ে দেখলে এর উত্তর হবে, হ্যাঁ, অবশ্যই ছিল। তারাশঙ্করের পাতালপুরী, গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম, উত্তরায়ণ বা মন্বন্তরে এই সময়টা টুকরো টুকরো ছড়িয়ে আছে। বিভূতিভূষণের অনুবর্তন বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা থেকে সমরেশ বসুর ‘আদাব’ তাঁদের সময়ের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি বা চিরকালীন সাহিত্য হয়ে গিয়েছে। অর্থাৎ সমকালীন ঘটনাগুলোর প্রতিফলন সাহিত্যের উপর পড়াই স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্রের রচনাতে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে।
আমার এক অধ্যাপক বন্ধু পরামর্শ দিয়েছিলেন, তোমার চারপাশে যা ঘটছে তাই নিয়ে লিখতে যেও না, বিষয়টির উপর অবিচার করবে। ভরদুপুরে নিজের ছায়া দেখা যায় না কারণ সূর্য মাথার উপর এলে ছায়া পায়ের তলায় থাকে। সূর্য যখন পশ্চিমে যাবে, যখন ছায়া লম্বা হয়ে পূর্বগামী হবে তখন তাকে দেখেশুনে ভেবেচিন্তে লিখলে অনেক বেশি যথাযথ হবে।
আমার মনে হয়েছিল, অধ্যাপক চাইছেন, বর্তমান যখন চলে যাবে তখন তাকে নিয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা উচিত। পরামর্শ গ্রহণ করতে পারিনি। আমি যে সময়ে বাস করছি তাকে আমার মতো করে জানছি। হয়তো এই জানাটার সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন না, কিন্তু আমার দেখার এবং বোঝার চোখে কোনও ভুল না থাকলে তা নিয়ে আমি লিখব না কেন?
কমিউনিস্ট পার্টি যখন দু’ভাগ হল, তখন কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র আমি। তখন থেকে ছাত্র ফেডারেশনের প্রভাব বেড়েছিল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়নে। আমরা বলতাম, কমিউনিস্ট পার্টির শিক্ষিত এবং সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিরা থেকে গিয়েছেন সিপিআই-এ, দক্ষ কর্মী এবং পটু নেতারা নতুন দল সিপিএম তৈরি করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার বন্ধুদের কেউ কেউ সিপিএমের ছাত্রনেতা হয়ে গেলেন, তাঁদের বক্তৃতায় এত বিদেশি ভাবনা থাকত যে শ্রোতারা ঠিক না বুঝলেও শিক্ষিত বলে স্বীকার করত। সেই সময়ের এই ছাত্রনেতাদের প্রতিপত্তি আকাশছোঁয়া ছিল, যদিও সরকারে ছিল কংগ্রেস। তারপর বন্ধুদের কয়েকজন সিপিএম ছেড়ে সশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন দেখল। হোস্টেলে থাকতাম বলে ওরা খিদে পেলে আমার ঘরে আসত। ওদের কথাবার্তা শুনে মনে হত ভয়ঙ্কর বিপ্লব এল বলে। যখন ‘কালবেলা’ লেখার কথা ভাবলাম তখন নকশাল আন্দোলনের মাত্র দশ বছর পূর্ণ হয়েছে। সে সময়ে যেসব নেতারা জীবিত ছিলেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বুঝেছি কারও সঙ্গে কারও তথ্যের মিল নেই। কেউ লেজটাকেই শুঁড় ভাবছেন কেউ শুঁড়টাকে লেজ। ওঁদের কথা হুবহু লিখলে রাবণের দশটা মুখ পাওয়া যাবে যার কোনওটাতেই গেঞ্জি গলানো যাবে না। অতএব আমি নিজে যা দেখেছি তাই লিখলাম। ছাপা হলে ওঁদের কেউ কেউ বললেন, এটা বানানো গল্প। তিরিশ বছর ধরে সেই বানানো কাহিনি যদি সওয়া লক্ষ কপি বিক্রি হয়েই চলে তাহলে পাঠকদের মুর্খ ভাবার কোনও কারণ নেই।
এই আমি আবার হাঁটলাম। শ্রদ্ধেয় কবি শঙ্খ ঘোষ ফোনে সময়টা বলে দিয়েছিলেন। না, কামদুনিতে একটি ছাত্রীকে ধর্ষণ করে বীভৎসভাবে খুন করার প্রতিবাদে আমি হাঁটিনি। খবরের কাগজের দৌলতে প্রতিদিন এই ঘটনাগুলো পড়ছি। কখনও পার্ক স্ট্রিট, কখনও গেদে, কখনও কামদুনি শিরোনামে উঠে আসছে। প্রতিদিন মৃত্যু দেখে দেখে যেমন একজন শ্মশানকর্মীর সেটা গা সওয়া হয়ে যায় আমাদের তেমন হয়েছে। কিন্তু আমি চমকে গিয়েছি, প্রবল নাড়া খেয়েছি ধর্ষিতার ভাই-বাবার বিবৃতি পড়ে। তারা টাকা বা চাকরি চায় না, আসামীর ফাঁসি চায়। একথা গ্রামে বলেছে, রাইটার্সে এসেও বলতে পেরেছে। আমার চারপাশে অনেক বিদ্বজ্জন যখন পুরস্কার, অর্থ ও পদের লোভে ক্ষমতার দরজায় লাইন দিয়েছেন মেরুদণ্ড ভেঙে, তখন ওই গ্রামের মানুষগুলো মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়েছে এরকম ঘটনা তো এখন ঘটে না। তাই তাদের সম্মান জানানোর জন্যে হেঁটেছি।
গত তিনদশক ধরে নিজের সময় বাদ দিয়ে লিখে যাচ্ছেন লেখক বন্ধুরা। কেউ কেউ ব্যতিক্রম। এবার আয়নায় নিজের মুখ দেখার সময় হয়ে গিয়েছে। নইলে মানুষ যখন প্রশ্ন করবে তখন মুখ আড়াল করার জন্যে আঙুল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পুনশ্চ।। আমার আগের লেখায় অসাবধানে ভুল লিখেছিলাম। শ্রীযুক্ত ভাস্কর রায় সংশোধন করে দিয়েছেন বলে আমি কৃতজ্ঞ। ভীম জরাসন্ধের দুই-পা ধরে চিরে ফেলেছিলেন, দুঃশাসন নয়। এই ভুলের জন্যে দুঃখিত।
১৯
আমাদের জীবনযাপনের ধরনটা কী দ্রুত বদলে গেল। মাঝে মাঝে খুব অস্বস্তি হয়, সেটা বেড়ে গেলে ভাল গান শুনতেও ইচ্ছে করে না। ধরুন, দিন আটেক পরে আমাকে একটা জরুরি কাজে শিলিগুড়িতে যেতে হবে। খবরটা আজই পেয়ে ফোন করলাম ট্রাভেল এজেন্টকে (আগে নিজেই রেলের টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে লাইনে দাঁড়াতাম)। এজেন্ট দেখে শুনে জানাল, আমার ওয়েটিং লিস্টের নাম্বার আঠাশ। টিকিট বের করব? জানতে চাইলাম, টিকিটটা কনফার্ম হবে তো?
এজেন্ট বলল, ‘যদি আপনার কপাল ভাল হয়, সাতাশজন জেনুইন প্যাসেঞ্জার যাওয়া ক্যানসেল করে, তাহলে পেতে পারেন। ফাইভ পার্সেন্ট চান্স আছে।
‘এখন তো শিলিগুড়িতে যাওয়ার প্রচুর ট্রেন হয়েছে। সব ট্রেনেই কি এক অবস্থা?
‘হ্যাঁ। যারা যাচ্ছেন তারা দু’মাস আগেই টিকিট কেটে রেখেছেন।’
‘দুমাস আগে তো আমার যাওয়ার কথা ছিল না।’
এজেন্ট বলল, ‘সরি স্যর। একটা পথ আছে, আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই রেলের বড়কর্তাদের পরিচয় আছে, তাঁদের বলুন। ভিআইপি কোটায় বাৰ্থ পেয়ে যাবেন।’
পরিচয় নেই যে তা নয় কিন্তু একটা বার্থের জন্য তাঁদের অনুরোধ করা মানে পরে তাঁদের প্রয়োজনের অনুরোধ আমাকে রাখতে হবে। তাছাড়া আমি যেতে পারব কি না তা জানা যাবে ট্রেন ছাড়ার তিন-চার ঘণ্টা আগে। সাতাশজনকে ডিঙিয়ে আমি একজন ভিআইপির ছদ্মবেশে বীরদর্পে যাব।
ভেবে দেখুন, কোথাও যেতে হলে আপনাকে দু’মাস আগে টিকিট কাটতে হবে। অর্থাৎ ইচ্ছেমতো বাইরে যাওয়ার কোনও উপায় রইল না। প্লেনের টিকিটের ক্ষেত্রে আবার আর এক খেলা। আপনি বেশ কিছুদিন আগে কাটুন, যে দাম এয়ারলাইন্স নেবে, যাওয়ার দিনে কাটলে তার দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে হবে। মজার কথা হল, যে ভাড়ায় কুয়ালালামপুর থেকে ঘুরে আসা যায়, ব্যাংককে যাওয়া আসা করা যায় সেই ভাড়ার দ্বিগুণ দিতে হয় মুম্বই যাতায়াত করতে। মানুষ বেড়েছে হু হু করে, তাই ট্রেনের সংখ্যা বাড়িয়েও জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। কোনও প্রিয়জন শেষশয্যায় জেনেও আপনি তার কাছে পৌঁছতে পারবেন না।
আমার কিছু বন্ধু রেলের টিকিটের তোয়াক্কা করেন না। তাঁরা নিজস্ব গাড়ি নিয়ে পুরীতে যান, বেনারসেও। ইদানীং রাস্তা সামান্য খারাপ হওয়া সত্ত্বেও শিলিগুড়িতে যাচ্ছেন। তেলের দাম নিয়ে মাথা ঘামান না। মুশকিল হল, ক’জন এই সুযোগ পাবেন? হঠাৎ মনে হল, অল্প বয়সে রকেট বাসে শিলিগুড়িতে গিয়েছি। বারো-তেরো ঘণ্টা সময় লাগত কিন্তু যাওয়া যেত। ট্রেনের টিকিট না পেয়ে ভাবলাম বাসেই যাব। খোঁজ নিয়ে জানলাম এখন অনেকগুলো বাস কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিলিগুড়িতে যাচ্ছে।
যাওয়ার আগের দিন টিকিট কাটতে গিয়ে আবার চোখ কপালে উঠল। ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই। এসি বাসে তো প্রশ্নই ওঠে না। নন এসি বাসের শেষ আসনটা পাওয়া যেতে পারে। সেই আসনে গেলে পৌঁছবার পরে নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে।
আমাদের রকের আড্ডার সনাতনদা সমস্যার কথা শুনে হেসে বললেন, ‘ব্যাপারটা কী জানো, তোমরা এখন সবাই বাবু হয়ে গিয়েছ।’
খোঁচা দিয়ে কথা বলা ওঁর স্বভাব। হজম করলাম।
‘শোনো, কোথাও যাওয়ার কথা ভাবলেই তোমরা এসি এক দুই তিনের কথাই ভাবো। আরে ট্রেনটায় তো আরও অনেক কামরা আছে।’ সনাতনদা বললে, ‘অর্ডিনারি থ্রি টিয়ারে চেষ্টা করলে আটদিন আগেই বার্থ পেয়ে যেতে।
‘এই গরমে যাব, ওখানে তো ফ্যান ঠিকঠাক ঘোরে না বলে শুনেছি।’
‘এইজন্যে বললাম, বাবু হয়ে গিয়েছ। তোমার ঠাকুর্দা ফ্যানের হাওয়া খেতেন? ইডেনে গিয়ে সারাদিন ধরে ক্রিকেট যখন দ্যাখো তখন মাথার ওপরে কি ফ্যান ঘোরে? যাও, দ্যাখো চেষ্টা করে।’
পাশেই এক বন্ধুর বাড়ি। তার কম্পিউটার জানাল অর্ডিনারি থ্রি টিয়ার ফুল হয়ে গিয়েছে। সনাতনদাকে জানাতে তিনি বললেন, ‘তাহলে তো আরও ভাল হয়ে গেল।’
‘মানে?’
‘তোমার ট্রেন কখন?’
‘সাড়ে আটটায়, শিয়ালদা থেকে যে ট্রেনটা ছাড়ে।’
‘তুমি সাড়ে সাতটায় প্ল্যাটফর্মে চলে যাও। দেখবে তখন ট্রেন না দেখা দিলেও একটা লাইন তৈরি হয়েছে। বেশ সুশৃঙ্খল লাইন। যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা ওই ট্রেনের আনরিজার্ভড, জেনারেল কামরায় উঠবে।
‘সর্বনাশ।’
‘আঃ, আর বাবুগিরি করো না তো। সাড়ে সাতটায় লাইনে দাঁড়ালে ট্রেন প্লাটফর্মে এলে দেখবে ভাল বসার জায়গা পেয়ে গেছ। সবাই তো রিজার্ভড কামরার জন্যে ছুটছে, আনরিজার্ভে ঢেউটা একটু কম। সনাতনদা হাসল।
‘তারপর? সারারাত বসে যাব?’
‘আরে বাবা, বাসে গেলে কী করতে? সেই বসেই তো যেতে হত।’
‘বাথরুম? ওটা তো নরক হয়ে যেত?’
‘তোমার যদি অসুস্থ না থাকে তাহলে বারো ঘণ্টায় দুই-একবার যেতে হবে। চোখ কান বুজে চলে যাবে। কে দেখছে?’
‘আর আশপাশের যাত্রীরা?’
‘এইটেই আসল কথা। একেবারে খাঁটি ভারতবর্ষকে দেখতে পাবে। দরিদ্র, দুঃখী, অশিক্ষিত মানুষের ভারতবর্ষকে পেয়ে যাবে। ফিরে এসে একটা জমজমাট মাটির গন্ধমাখা গল্পে সংগ্রামী মানুষের কথা লিখতে পারবে। বুঝলে?’
মানুষকে ঈশ্বর সৃষ্টি করেননি। তিনি আদম এবং ইভকে তৈরি করে চলে গিয়েছিলেন অন্য কাজে। আদম আর ইভ হেসে খেলে গান গেয়ে প্লেটোনিক প্রেম করে যাচ্ছিল। তখন শয়তান এল, জ্ঞান বৃক্ষের ফল খাওয়াল, তাই মানুষের বংশবৃদ্ধি হল। সম্ভবত সে কারণেই আমাদের রক্তে শয়তানের একটু না একটু অস্তিত্ব কাজ করে যাচ্ছে।’ সেই শয়তান পরামর্শ দিল, ‘ওরে এসব তোর পোষাবে না। তুই যাস না ঘরের বাইরে।’