গীতবিতান ছুঁয়ে বলছি ১.১০

১০

কলকাতায় পড়তে এসে মেসে উঠেছি। প্রথমদিনের দুপুরের খাওয়ার সময় অন্যান্যদের পাশাপাশি বসেছি। সামনে কলাপাতা, মাটির গ্লাস। ভাত এল। যেভাবে ঠাকুর হাতা দিয়ে পাতায় ফেলল তাতে মনে হল সাদা বল গড়িয়ে যাচ্ছে। চটপট ধরে ফেলে বুঝলাম ওটা ভাত, শক্ত হয়ে দলা পাকিয়েছে। তারপর যে তরল পদার্থটি পাতায় পড়ে চারধারে ছড়িয়ে গেল তাকে প্রথমে ডাল ভেবেছিলাম। পাশে বসা ছেলেটি তাই ভাত দিয়ে মেখে তৃপ্তির সঙ্গে খাচ্ছে দেখে একটু মুখে দিয়ে বুঝলাম ওটা ডাল নয়। জানতে পারলাম ওই তরল পদার্থটির নাম পোস্ত। রান্নার কারণে সেই বিস্বাদ তরল পোস্তটিকে বর্জন করেছিলাম। সেই পোস্ত খাওয়াতে চাইলে সবিনয়ে আপত্তি জানাতাম। জলপাইগুড়িতে আমাদের বাল্যকালে পোস্ত কেউ খেত না। ওদিকে ওটা অচল ছিল। এখনও ঢাকা বা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ পোস্ত খেতে অভ্যস্ত নন। বছর দশেক বাদে এক বন্ধুর বাড়িতে খেতে গিয়ে আলু-কুচো চিংড়ি দেওয়া একটা মাখা মাখা তরকারি খেয়ে এত ভাল লাগল যে আবার একটু চেয়ে নিলাম। বন্ধু জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি পোস্ত ভালবাস?’ পোস্ত? আমি চমকে উঠেছিলাম। এতদিন সেই মেদিনীপুরের ঠাকুরের কল্যাণে পোস্ত ভেবে যাকে সরিয়ে দিয়েছিলাম সেটাই পোস্তর শেষ কথা নয়? জানলাম ঝিঙে সহযোগে তার স্বাদ বেশ ভাল হয়। সবকিছু ছেড়ে পোস্ত বাটা দিয়ে অনেকটা ভাত খাওয়া যায়। মেদিনীপুর ছাড়া বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমানেই এর চল ছিল খুব। কিন্তু জল শুকিয়ে যেই ওর চেহারা বদলে গেল তখন আঞ্চলিকতার সীমা ছাড়িয়ে গেল। মনে আছে, মেলবোর্নে শ্রীযুক্ত প্রতীশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে এক পার্টিতে পোস্ত পরিবেশন করা হয়েছিল। আমার রেসিপি শুনে মিসেস বন্দ্যোপাধ্যায় ওটা তৈরি করেছিলেন। অতিথিদের বেশিরভাগই ছিলেন বাংলাদেশের মানুষ যাঁরা পোক্তর স্বাদ আগে জানতেন না। সেই রাত্রের পর মিসেস বন্দ্যোপাধ্যায়কে পোস্ত রান্না শেখাতে এর বাড়ি ওর বাড়ি যেতে হয়।

পোস্ত-প্রসঙ্গ মাথায় এল খিদিরপুরের ফ্লাইওভারের পাশে ইয়ং বেঙ্গল রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে। ওঁদের কথায় পরে আসছি।

আমাদের যৌবনের শুরুতে বাড়ির বাইরে গিয়ে খাওয়ার কথা উঠলে প্রথমেই মোগলাই খাবারের কথা ভাবতাম। কলকাতায় তখন চারটে নামকরা রেস্টুরেন্ট ছিল। চিৎপুরে রয়্যাল, চাঁদনির পেছনে সাবির আর এলিট সিনেমার সামনে আমিনিয়া এবং নিজাম। ওদের বিরিয়ানি, চাপ, কোর্মা খেয়ে ধন্য হয়ে যেতাম। তখন পয়সা পকেটে তেমন থাকত না। কিন্তু নিজামের কল্যাণে আমাদের খাওয়া আটকাত না। অন্য তিনটি রেস্টুরেন্টের তুলনায় নিজামের খাবার ছিল অনেক সস্তা। এম এ পড়ার সময় কুড়ি পয়সায় একটা মাংসের রোল আরাম করে খেয়েছি। তারপর যখন জানতে পারলাম ওটা গরুর মাংসের রোল ছিল তখন বেশিরভাগ বন্ধু খাওয়া বন্ধ করলেও অনেকেই সেটা দীর্ঘকাল চালিয়ে গিয়েছে। যাই হোক, বিরিয়ানি খাওয়া সে সময় খুব আকর্ষণীয় ছিল। ছাত্রাবস্থায় চিনে বা মাদ্রাজি খাবারের জন্য বাঙালিকে উৎসুক হতে দেখিনি।

এর কিছু বছর পরে বাঙালি হঠাৎ স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে আবিষ্কার করল চিলে খাবার স্বাস্থ্যের পক্ষে নিরাপদ। বাঙালির মেনুতে তখন ফ্রায়েড রাইস, চাউমেন এবং চিলি চিকেন ছাড়া খুব কম ক্ষেত্রে চতুর্থ পদ থাকত। ওয়াটার্লু স্ট্রিটের অম্বর, পার্ক স্ট্রিটের গাদা গাদা চিনে খাবারের রেস্টুরেন্টে বাঙালি উৎসব হলেই লাইন দিত। অথচ এই বাঙালিই কয়েক বছর আগে কেঁচো, ইঁদুরের গন্ধ জাতীয় ভাবনা ভেবে চিনে খাবারকে দূরে সরিয়ে রাখত। কলকাতায় ধীরে ধীরে চিনে খাবার এত জনপ্রিয় হয়ে গেল ডালহৌসির অফিসপাড়ায় তো বটেই, গলির মধ্যেও চাউমেন ফ্রায়েড রাইসের স্টল চালু হয়ে গেল। এগুলো যে চিনের মূল ভূখণ্ডর খাবারের সঙ্গে আদৌ মেলে না তা জানতাম না। জানলাম আমেরিকায় একটি চিনেপাড়ায় গিয়ে। সেখানকার রেস্টুরেন্টে চাউমেনের অর্ডার দিয়ে পেলাম শুকনো নেতিয়ে যাওয়া কালচে নুডলস যার সঙ্গে আমাদের জানা চাউমেনের কোনও মিল নেই। বেয়ারা থেকে ম্যানেজার প্রমাণ করতে চাইলেন ওটাই চাউমেন, আমি ভুল বলছি। শেষপর্যন্ত আমি চেহারাটা বোঝাতে পারলাম। এঁরা হো হো হাসি হেসে বললেন, আপনি ভুল অর্ডার দিয়েছেন। এর নাম হল লোমেন।’ একজন চিনে অধ্যাপক বলেছিলেন, পৃথিবীর সব দেশেই আমরা চিনে খাবার পৌঁছে দিয়েছি কিন্তু দেওয়ার সময় সেই দেশের মানুষের রুচি অনুযায়ী রেসিপি পাল্টেছি, কখনও নামও।

চিনে খাবারের পাশাপাশি মাদ্রাজি খাবার জনপ্রিয় হলেও তা কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হল। এই খাবারের পক্ষে যুক্তি হল, ধোসা, বড়া খেলে শরীরের ক্ষতি হয় না। এখন একটা মশলা ধোসার দাম প্রচুর বেড়ে গেলেও মাছ-মাংসের কাছাকাছি নয়। যাঁরা নিরামিষ পছন্দ করেন তাঁরা বেশ স্বস্তির সঙ্গে মাদ্রাজি দোকানে ঢুকতে পারছেন। তবু বাঙালি বিকেলের জলখাবার হিসেবেই এই খাবার খেয়ে থাকে, লাঞ্চ বা ডিনারে ইডলি বা ধোসা তাদের না পসন্দ।

আর একটু সময় বয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল, বাড়িতে মা-মাসিরা নেই, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করেন। সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট খেয়েই ছুটতে হয়, ফিরতে রাত আটটা। তখন রান্না করার মতো শরীরের অবস্থা থাকে না, মনেরও। এলাকায় তিন কি চারটি হোম ডেলিভারি সেন্টার আছে। ফোন করলেই খাবার এসে যাবে। রুটি ডাল সবজি মাংস। রোববারের দুপুরে আর হোম ডেলিভারিকে বলা নয়। একটু মুখ বদলানো দরকার। তাহলে কি চাইনিজ? অবশ্যই নয়। মা-মাসিমারা যা রাঁধতেন, চেষ্টা করলেও যার কাছাকাছি বাড়িতে রান্না করতে পারবেন না স্ত্রী, তাই গোগ্রাসে গেলার জন্য বাংলা খাবারের রেস্টুরেন্ট খুঁজে রাখতেই হয়। কোয়ালিটি ইনে গেলে দারুণ সাজিয়ে গুছিয়ে যা দেয় তা অবশ্যই খারাপ নয় কিন্তু মা-মাসির হাতের স্বাদ পাওয়া যায় না। যে বাঙালি এককালে বাইরে বেরিয়ে বাংলা খাবারের কথা ভাবতেই পারত না, তার চোখের সামনে ভজহরি মান্না গোছের সাজানো বাংলা রেস্টুরেন্ট শুধু নয়, গড়িয়াহাট মার্কেটের ভেতরে, জগুবাবুর বাজারের উল্টোদিকে, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে, এস এন ব্যানার্জি রোড দিয়ে ঢুকতেই যেসব দোকান নানা রকমের ডাল, ভাজা, ছ্যাঁচড়া, সুক্তো, তরকারি এবং মাছের চমৎকার রান্নার স্বাদ পাওয়া যায় তা অতুলনীয়। এদের সঙ্গে যোগ হয়েছে মার্কুইস স্ট্রিট-ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মোড়ের কয়েকটি দোকানে বাংলাদেশের হেঁসেল থেকে উঠে আসা বাঙালি খাবার। ভর্তা থেকে যেমন যেমন মাছ তেমন তেমন রান্নার স্বাদ নিতে পারছে বাঙালি ওখানে গিয়ে। বাড়িতে যা রান্না করা সম্ভব নয়, স্মৃতিতে যা আছে তা বাস্তবে পাওয়া কম কথা নয়।

এদের থেকে কিছুটা দূরে খিদিরপুরের মোড় পেরিয়ে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে কার্ল মার্কস সরণিতে ঢুকতেই পেয়ে যাবেন হোটেল ইয়ং বেঙ্গল। ওদের যে-কোনও রান্না আপনাকে তৃপ্ত করবে। হোটেলের কর্ত্রী পৃথা লক্ষ্য রাখেন সে ব্যাপারে।

ঘরে যা ছিল অঢেল তা আর ঘরে পাওয়া যাচ্ছে না বলে কোনও আপশোশ নেই। হাজার টাকার ইলিশ কিনে ভাল রান্না না হলে মন খারাপ হবেই। তিনশো টাকায় দুজন তৃপ্তি করে খেতে এইসব দোকানের সন্ধান নিন। ভাল লাগবে।

১১

পেট্রোলের দাম দু’টাকা বেড়ে আট আনা কমছে। আর ওই দেড় টাকা কয়েকগুণ হয়ে এখন বিরাশি টাকায় দাঁড়িয়ে টলমল করছে। এই অবস্থায় কলকাতা শহরের রাস্তায় যানজট কম হওয়ার কথা, রাস্তা খানিকটা ফাঁকা হওয়াই উচিত। কিন্তু হচ্ছে না। আমার এক মধ্যবিত্ত বন্ধু তেলের দাম প্রচণ্ড বেড়ে যাওয়ার পরে ভেবেছিলেন গাড়ি বিক্রি করে দেবেন। সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার গাড়ি চার বছর পরে দেড়লাখ টাকা দাম না পেয়ে গ্যারাজে রেখে দিয়েছেন। সেই গ্যারাজের ভাড়া মাসে বারোশো টাকা, ড্রাইভারের মাইনে সাত হাজার। যেখানে তাঁকে যেতে হয় সেখানে যাওয়া-আসা করতে মাসে তেল মোবিল কিনতে হচ্ছে চার হাজার টাকার। অর্থাৎ প্রতি মাসে অন্তত বারো হাজার দুশো টাকা গাড়ির কারণে খরচ করতে হবে, এ ছাড়া টুকটাক মেরামতির প্রয়োজন হলে সেটা উপরি। বন্ধু ঠিক করলেন সপ্তাহে তিনদিন গাড়ি বের করবেন। দু’দিন তেলের খরচ বাঁচবে তাতে। উল্টোডাঙা থেকে অটোয় চেপে শোভাবাজারে এসে মেট্রো ধরে কালীঘাটে যাবেন। কিন্তু কয়েকদিন পরে তাঁর মনে হল তিনি দু’দিন গাড়ি পথে বের না করলেও রাস্তায় যানজট বেড়েই চলেছে। কোথাও তিনি শুনেছিলেন, আমেরিকায় একবার তেলের সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় কোনও একটা স্টেটে ঘোষণা করা হয়েছিল মাসের বেজোড় সংখ্যার তারিখে যেসব গাড়ি চলবে তার নাম্বারে শেষ সংখ্যা বেজোড় থাকতে হবে। জোড় সংখ্যার তারিখে জোড় নাম্বার। যার গাড়ির শেষ সংখ্যা এক তিন পাঁচ সাত বা নয় সে দুই চার ছয় বা আট তারিখে গাড়ি রাস্তায় বের করতে পারবে না। যার দুই সংখ্যাই গাড়ির নাম্বারে আছে তার অসুবিধে নেই। কিন্তু বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরের স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরতে তো মহা সমস্যায় পড়তে হবে। অতএব প্রতিবেশীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সংখ্যা অনুযায়ী গাড়িতে একত্রে যাতায়াত শুরু করলেন। এতে শুধু তেলের খরচ বাঁচল না, হাইওয়েতে টোল ট্যাক্স দিতে যখন এক সওয়ারির গাড়িকে দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে তখন তিন-চার সওয়ারির গাড়ির জন্যে অনেক বেশি গেট খুলে দেওয়ায় বিন্দুমাত্র অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। ফেরার সময় নির্দিষ্ট সময়ে স্টেশনে এসে নামতে হচ্ছে একসঙ্গে বাড়িতে ফেরার জন্যে। নিজের অসুবিধা হলেও বাড়ির লোকেরা খুশি হচ্ছেন তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে।

বন্ধু বললেন, ‘সরকার কি এই নিয়মটা এখানে চালু করতে পারেন না?’

আমার দেখা যানজট যে সব শহরে কুখ্যাতি অর্জন করেছে তার প্রথমে ছিল ঢাকা। বিকেলে দশ মাইলের পথ যেতে দু’ঘণ্টা সময় গাড়িতে বসে কাটাতে হতে। প্রচুর গাড়ি এবং রিকশার অধিকাংশই ওই যানজটের কারণ। গত মাসে গিয়ে দেখলাম জট একটু আলগা হয়েছে আকাশ-পথের কল্যাণে। আমাদের কলকাতায় এই ব্যবস্থাটা খুব কাজে লেগেছে পার্ক সার্কাস থেকে ভিক্টোরিয়া পর্যন্ত পথটায়। বাকি কলকাতায় যাঁরা গাড়ি চালান, তাঁদের মহাচালক পুরস্কার দেওয়া উচিত। কিন্তু এত গাড়ি পথে কেন? নতুন রাস্তা নেই, গাড়ির সংখ্যা পথের চেয়ে বেশি তবু সরকার কেন প্রতিদিন শয়ে শযে গাড়ি বিক্রির অনুমতি দিচ্ছে। আজকাল কিছু জমা দিলে ব্যাঙ্ক গাড়ি কেনার টাকা ধার দিচ্ছে। আড়াই তিন লাখে গাড়ি কেনার লোভ অনেকেই সামলাতে পারেন না। সরকার তার আয়ের কথা ভেবে অবিরত ঘুড়ির সুতো ছাড়ার মতো গাড়ির সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। ফলে যাঁদের নাভিশ্বাস উঠছে তাঁরা প্রতিদিন গাড়ি বের করছেন না। ড্রাইভারকে ছাড়িয়ে দিয়ে সেন্টার থেকে দৈনিক দুশো চল্লিশ টাকার ড্রাইভার নিচ্ছেন যখন প্রয়োজন হচ্ছে। ফলে মেট্রোতে ভিড় উপচে পড়ছে।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাস্তায় বাসের সংখ্যা কমে যাওয়া। একজন বাসের মালিক বললেন, ‘সরকার আমাদের ধমকাচ্ছে, বাস না চালালে শাস্তি দেবে বলে। আচ্ছা বলুন তো, ডিজেলের দাম বছর বছর বেড়ে গেল কিন্তু আমরা বেশি ভাড়া নিতে পারব না। গাড়ির পার্টসের দাম হু হু করে বেড়েছে। যা টিকিট বিক্রি হয় তার একটা অংশ ড্রাইভার কন্ডাকটর নিয়ে নেয়। পুলিশকে দিতে হয় যা তা মালিকের পকেট থেকেই যায়। সেই যে একটা গল্প পড়েছিলাম, শাইলক নামের একটা লোককে বলা হয়েছিল তুমি মাংস কাটতে পার কিন্তু এক ফোঁটা রক্ত না পড়ে, আমাদের অবস্থা ঠিক তেমনই।’

আমি হেসে বললাম, ‘তুলনাটা ঠিক হল না। বরং গীতায় আপনাদের সম্পর্কে চমৎকার উপদেশ বলা আছে, কর্ম করে যাও, ফলের কথা ভেবো না।’

রাস্তায় বাস কমাতে বাধ্য হচ্ছেন মালিকরা। শুনছি ধর্মঘটে যাবেন। গিয়ে কী হবে? সরকার যদি না চায় তাহলে দু’দিন ধর্মঘট করলে সমস্যার সুরাহা হয়ে যাবে? এদেশে যত অন্যায় হোক তার বিরুদ্ধে ধর্মঘট করলে শুধু সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন, সরকারের কিছু যায় আসে না। দুদিন পরে আবার একই ছবি!

তেলের দাম থেকে সরকার ভাল টাকা কমিশন পান। অন্য রাজ্যে শুনেছি সেই কমিশনের টাকা কিছুটা ছেড়ে দিয়ে দামটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে সেখানকার সরকার। আমাদের পশ্চিমবাংলার সরকারের আর্থিক অবস্থা এতটা খারাপ সে সেই বদান্যতা দেখাতে পারে না।

.

এই অবধি লেখার পর একটা ফোন এল। আমার এক আত্মীয় উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘জানো, কাল সাউথ সিটি মলে একজন মা তার মেয়েকে উনিশ হাজার টাকার সালোয়ার কামিজ কিনে দিল।’ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘টাটা বা বিড়লার কেউ?’ উত্তর এল, ‘দূর। দেখে মনে হল খুব সাধারণ পরিবারের। এখন সবাই ওরকম কেনে।’

মলগুলোয় গেলে মনে হবে পশ্চিমবাংলার মানুষের টাকার অভাব নেই। আট হাজার টাকার জুতো কিনছেন আয়কর কর্মচারীর মেয়ে। নিম্নবিত্ত বাড়ির মেয়ে দু’হাজার টাকার জিন্স কিনছেন স্বচ্ছন্দে। আর যাঁরা সেখানে পৌঁছতে পারছেন না তাঁরা বাড়িতে বসে ইনস্টলমেন্টে দামী জামাকাপড় কিনছেন। কী করে শোধ দেবেন জানেন না। পাঁচজনে সিনেমা গেলে হাজার টাকার টিকিট কাটতে হয়। টাকা না থাকলে সম্ভব।

আর এই বাড়তি টাকা রাস্তার সমস্যা বাড়িয়েছে বহুগুণ। হাজার হাজার মোটরবাইক নেমে পড়েছে পথে। কোনও নিয়মকানুন মানছে না ওই বাইক চালকরা। যানজটে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির গা ঘষে দিয়ে স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে যাচ্ছে সামনে। হেলমেট থাকায় তাদের মুখ কতটা বীভৎস তা বোঝা যাচ্ছে না। আবার বাবা-মায়ের মাথায় হেলমেট, বাচ্চার মাথায় কিছু নেই দৃশ্যটি দেখে ভাবতে বাধ্য হই ওরা যেন ঠিকঠাক বাড়ি ফিরে যায়। এক পুলিশ খবরটা দিলেন, ‘কলকাতায় বিশেষ কয়েকটি পাড়ায় হেলমেট ছাড়া বাইক চালালে আমরা চোখ বন্ধ করে থাকি। কী দরকার ঝামেলা বাড়াবার।’

আমার মনে হচ্ছে গোটা কলকাতাতেই পুলিশ আর ঝামেলা বাড়াতে চাইছে না।

১২

সন্তান উপযুক্ত হয়ে যদি বাবা মায়ের পাশে না দাঁড়িয়ে নিজের জগৎ তৈরি করে নিত তাহলে আত্মীয়রা তাকে স্বার্থপর বললেও আমার বিধবা বড় পিসিমা বলত, ‘ও আর একটা পাখির মতো কাজ করল।’ বাল্যকালেও ওই তুলনাটা একটুও ভাল লাগত না। পাখি শব্দটি শুনলে একটা নরম অনুভূতি হত। আমার কাছে পাখি ছিল, টিয়া, ময়না, চড়ুই এবং বেশ ঝগরুটে হলেও শালিক। শালিক যখন হাঁটে তখন তাকে বেশ অহংকারী বলে মনে হত। কিন্তু ডানা মেলে উড়লেও কাক বা শকুনকে পাখি বলে ভাবতে চাইতাম না। ওরা খুব হিংস্র। পাখি শব্দটার সঙ্গে হিংসার কোনও সম্পর্ক নেই। অন্য শব্দ না পেয়ে পাখি বলা হয় ওদের। বড় পিসিমা নিশ্চয়ই ওই স্বার্থপর ছেলেটিকে কাক বা শকুনজাতীয় পাখি ভেবে বলেছে কথাটা। আর একটু বড় হয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। আমাদের বাগানে বিস্তর গাছ-গাছালি ছিল। তার একটা উঁচু ডালে বাসা তৈরি করে একটা কাক ডিম পেড়েছে। এই সময় ওদের চেহারা তেমন কর্কশ থাকে না। দেখতাম, মা-কাক ডিমে তা দিচ্ছে আর পুরুষ-কাক বাসার আশেপাশে ঘুরছে। তারপর ডিম ভেঙে বাচ্চা বের হল। তখন মা-কাক মাঝে-মাঝে উড়ে যেত এবং পুরুষ-কাক, সে বাবা কি না তা জানি না, বাসায় এসে পাহারা দিত। মা-কাক ফিরে আসত গলা ভর্তি খাবার নিয়ে। বাচ্চারা সেটা খাওয়ার জন্যে উপরে মুখ তুলে ছটফট করত এবং মা-কাকই তার গলায় রাখা খাবার বের করে একটু একটু করে, খাইয়ে দিত। এই সময় মা-কাককে কিন্তু পাখি বলে ভেবে নিতে কষ্ট হত না। আক্রান্ত না হলে এই সময় মা-কাক তার কর্কশ গলা বের করত না।

একটু একটু করে মায়ের দেওয়া খাবার খেয়ে বাচ্চা কাকের গায়ে লোম গজাত। একসময় বাসায় বসে ডানা ঝাপটাতে চেষ্টা করত। তারপর একদিন মায়ের চোখের সামনে ডানা মেলে দিত আকাশে। আর ফিরে আসত না বাসায়। মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যেত।

বড়পিসিমা কেন সেই ছেলেটির সঙ্গে পাখির বাচ্চার তুলনা করেছিলেন তা বুঝতে পারলাম। সেই বয়সে যে-কোনও পাখির দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, এই ব্যাটাও একটা স্বার্থপর পাখি মাকে কাঁদিয়ে দিয়ে এখন দিব্যি একা ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মাসখানেক বাদে গাছের তলায় গিয়ে দেখলাম কাকের বাসা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে। সঙ্গীকে নিয়ে কাক মা উধাও। সন্তান বাসা ছেড়ে উড়ে যাওয়ার পরে কাক মায়ের কাছে বাসার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে। সে আর বাসায় বসে সন্তানের অপেক্ষা করবে না। রোদে জলে ভিজে গাছের ডালে বসে থাকবে যদি না আবার মা হতে হয়। হলে সে নতুন বাসা বাঁধবে। বড়পিসিমা সন্তান পাখির কথা ভেবেছিলেন, মায়ের কথা ভাবেননি। এখানেই পাখির মায়ের সঙ্গে মানুষের মায়ের বিপুল পার্থক্য। মানুষ-মা সন্তান চলে গেলে বাসা ছেড়ে চলে যান না। স্বামীর সঙ্গে পড়ে থাকেন তাঁর বাসায়। হয়তো ভাবেন সন্তান আবার ফিরে আসবে। পাখি-মা হয়তো ক্ষণিকের জন্যে কষ্ট পায়। মানুষ-মা আজীবন ক্ষত বুকে নিয়ে বেঁচে থাকেন। বাবা মাকে ছেড়ে সন্তানের চলে যাওয়ার পিছনে তার নিজস্ব কিছু কারণ আছে যেগুলো আঁকড়ে সে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারে। কলকাতায় ভাল চাকরি নেই, থাকলেও উন্নতির পথ বন্ধ। কলকাতায় কাজ করার পরিবেশ নেই, যেটা হায়দরাবাদে আছে। হায়দরাবাদে যতটা আছে, তার বহুগুণ বেশি পাওয়া যাচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। পড়াশোনা করেছি ভালভাবে থাকব বলে। কলকাতায় ঘাট হাজার, হায়দরাবাদে এক লাখ, আমার কোন্ চাকরি নেওয়া উচিত? আবার ক্যালিফোর্নিয়ায় আট হাজার ডলারের (পাঁচ লাখ ভারতীয় টাকা) চাকরিটা না নেওয়া কি বোকামি নয়? যতদিন নিজস্ব সংসার না হচ্ছে ততদিন নিশ্চয়ই বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাতে পারি। এখানে পৌঁছনো পর্যন্ত বাবার যা খরচ হয়েছে তা ফিরিয়ে দেওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই। যতটুকু পারি নিশ্চয়ই দেব। মুশকিল হল বিয়ের পর স্ত্রী যদি নিজস্ব বাড়ির আবদার করে তাহলে ইচ্ছেটা বাস্তবায়িত হয় না।

এই অবধি বুঝতে পারি। সেদিন কাগজে দেখলাম বৃদ্ধ পিতামাতাকে বড় ছেলে নির্মম অত্যাচার করছে যাতে তাঁরা বসতবাড়ি ওর নামে লিখে দেন। ভদ্রলোকের দুই ছেলে। ছোটটি নির্জীব ধরনের। রোজগার নিয়মিত নয়। বড় ছেলে টাকা দিচ্ছে না। দেবে বাড়ি নিজের নামে পাওয়ার পর। সে শাসকদলের সঙ্গে জড়িত। তার কথাবার্তা শুনলে বোঝা যায় বাড়িটা পেলেই বাবা মাকে বাইরে বের করে দেবে। বৃদ্ধ বাবা-মা থানায় গিয়েছিলেন নিরাপত্তার জন্য। থানা উপদেশ দিয়েছে ছেলের সঙ্গে সমঝোতা করতে। যে ছেলের অসুখে এঁরা একসময় রাত জেগেছেন এখন তার মুখে প্রতিদিন অশ্লীলতম গালাগাল শুনতে হচ্ছে। তার সঙ্গে কীভাবে সমঝোতা করবেন তা থানা বলেনি। এই বৃদ্ধ বাবা-মা মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে সাহায্য চেয়েছেন।

আর একটি খবরে দেখলাম বাড়ি থেকে পুত্র তার মাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। মা স্টেশনের প্লাটাফর্মে বসে ভিক্ষে চাইছেন। এইসব পুত্ররা বেশি পড়াশোনা করে বিলেত আমেরিকায় চলে যেতে পারেনি। হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করায় মা বাড়িতে ফিরে যেতে পেরেছেন বলে ভদ্রমহিলাকে প্ল্যাটফর্মে পড়ে মারা যেতে হবে না। এখনও এদেশে আইনি ব্যবস্থা নষ্ট হয়নি।

আমার মনে পড়ে না, বাল্যকাল, তরুণ বয়স, যৌবনে কখনও কাগজে এমন খবর পড়েছি কি না যেখানে হাইকোর্টকে নির্যাতিত বাবা মায়ের পাশে এসে দাঁড়াতে হয়েছিল। সম্ভবত তখন ঘটনা ঘটলেও এত প্রবল ছিল না। তাই কোর্টকে কথা বলতে হয়নি। এখন হচ্ছে। খবর পেয়ে এক পরিচিত বৃদ্ধ দম্পতির কাছে গিয়েছিলাম। রিটায়ার করেছেন কুড়ি বছর আগে। যা পেয়েছিলেন অফিস থেকে তা একটু একটু করে শেষের মুখে। ছেলে অত্যাচার করত না কিন্তু সে এত বেআদবী জীবনযাপন করত যে বাড়িতে ঢুকতে নিষেধ করেছেন। এখন মাছ খাবেন না, দামি তরকারিও নয়। ভাত আলু সেদ্ধ এবং ডাল খেয়ে ভাবেন এতে পেট ভাল থাকবে। ব্যালকনিতে বসে থাকেন ধূসর চোখে। প্রশ্ন করতে বললে, ‘ভাল আছি ভাই।’

সব পাখি কি মাকে ছেড়ে উড়ে যায়? বাবুই পাখির কথা মনে পড়ছে, আমাদের বাগানে বাসা বাঁধত, ডিম ফুটে বাচ্চা হত। তারপর তারা দলেই থেকে যেত। ওরা দলবদ্ধ পাখি। মানুষ নয়।

১৩

সেটা উনিশশো চুরাশি সাল। হঠাৎ এক সকালে সুপ্রিয়দার ফোন এল। সুপ্রিয় ব্যানার্জি তথা ইউএসআইএসের একজন প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয় অফিসার। খুব মিশুকে। রসিকজন। বললেন, ‘ভাই সমরেশ, একটি বাঙালি প্রতিজ্ঞা করেছে টিভি মিডিয়ায় কাজ করবে বলে। এখন তো টিভিতে সরকারি প্রোগ্রাম ছাড়া কিছু হয় না, সেগুলোর মান ভাল নয়। সে চাইছে নিজেরাই ভাল ভাল প্রোগ্রাম বানাবে, বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে সময় বিক্রি করে দূরদর্শনকে ভাড়া দিয়ে কিছু লাভ করবে। তুমি যদি ওর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গল্প এবং চিত্রনাট্যের দায়িত্ব নাও তাহলে আমি খুব খুশি হব।’

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘ভদ্রলোকের নাম কী?’

‘জোছন দস্তিদার’।

আমি তো হ্যাঁ বললাম। কিন্তু তার পরেই মনে হল জোছনবাবু আমাকে পছন্দ করবেন না। তখনও আমি ‘দেশ’ পত্রিকায় চলচ্চিত্র- সমালোচনা করি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাগৈতিহাসিক গল্প অবলম্বনে ছবি করেছিলেন যার খুব বিরূপ সমালোচনা করেছিলাম। তাছাড়া ভদ্রলোক বামপন্থী রাজনীতিতে শুধু বিশ্বাসই করতেন না, পার্টির খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আর তখন আমার ‘কালবেলা’ বেরিয়ে গিয়েছে। আমার ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে জোছনবাবুর ফোন এল, ‘নমস্কার সমরেশবাবু। সুপ্রিয় নিশ্চয় সব কথা বলেছে। চলে আসুন আমার পণ্ডিতিয়ার অফিসে, কাল বিকেল তিনটেতে পারবেন?’

অতএব গেলাম। গিয়ে দেখলাম কলকাতার নাট্যজগতের বিখ্যাত কিছু ব্যক্তিও এসেছেন। কী ধরনের প্রোগ্রাম হবে তা নিয়ে আলোচনা হল। বেরনোর সময় একজন একটা খাম ধরিয়ে বলল, ‘গাড়িভাড়া বাবদ সামান্য কিছু–!’ পরে খাম খুলে পেলাম একশো টাকা। শুধু আমি একা নই, সবাই পেয়েছেন। যাতায়াত বাড়ল। শেষে আমিই বললাম, ‘এলেই টাকা দিচ্ছেন, এটা বন্ধ করুন।’

জোছনবাবু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাত বাড়ালেন, ‘তোকে তুই বলব, আমাকে তুই বলতে বাধবে, অনেক বড় বয়স, তুমি বলিস।’

আমাদের অফিস হল আনোয়ার শা রোডের কাছে শ্যামল সেনগুপ্তর বাড়িতে। প্রতিষ্ঠানের নাম রাখা হল সোনেক্স। শ্যামলবাবু পার্টনার। আমি সফটওয়ারের দায়িত্বে। তখন গৌতম ঘোষ দূরদর্শনে প্রতি বৃহস্পতিবার এক একটি ছোটগল্প নিয়ে বাংলা গল্প বিচিত্রা করছিল যা ধারাবাহিক নয়। প্রযোজক ছিল দেজ মেডিক্যাল। হঠাৎ জরুরি কাজে গৌতম মুম্বই চলে গেলে আমরা দায়িত্ব পেলাম শেষ করতে। তদ্দিনে রমাপ্রসাদ বণিক আমার সহকারী হিসাবে যোগ দিয়েছে। ঠিক হল আমার ‘উৎসবের রাত’ গল্প দুই পর্বে করা হবে। পরিচালনা করবেন বিভাস চক্রবর্তী, ওঁকে সাহায্য করবে রমাপ্রসাদ। যেহেতু তখনই বিভাসবাবু দূরদর্শনের কর্মী তাই রমাপ্রসাদের নাম পরিচালক হিসাবে যাবে। এখানে বলা ভাল, যেহেতু তখন বাইরের প্রযোজক দূরদর্শনে কাজ শুরু করেননি এবং দ্বিতীয় কোনও চ্যানেল ছিল না তাই ক্যামেরাম্যান থেকে এডিটর, এমনকী মেকআপম্যানের কাজ দূরদর্শনের কর্মীরা বেনামে করতেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং তৃপ্তি মিত্রকে নিয়ে শুটিং শুরু হল আমার লেখা চিত্রনাট্যে। দেখার পর ‘দে’জ মেডিক্যাল’-এর ভূপেন দে মশাই বললেন, ‘একটা বড় কিছু করুন।’ জোছনদা বললেন, ‘সমরেশ, ফাটাফাটি কিছু কর।’ আমি আমার চারপাশের মানুষগুলিকে দেখলাম। রোজই তো দেখি আলাদা করে কিছু চোখে পড়ে না। কিন্তু, ধরা যাক, বছর দশেক বিদেশে থাকার পর যদি কলকাতায় ফিরতাম তাহলে নিশ্চয়ই অনেক পার্থক্য বুঝতে পারতাম। এই ভাবনা থেকে গল্পটা চলে এল। আমার নায়ক গৌরব দশ বছর বাদে কলকাতায় ফিরল। লিখে ফেললাম গোটা পাঁচেক পর্ব। নাম রাখলাম ‘তেরো পার্বণ’। তখনও পশ্চিমবঙ্গে বাংলা সিরিয়াল নাটক টিভিতে শুরু হয়নি। চিত্রনাট্য পড়ার পর জোছনদা বললেন, ‘কী করে ভাবলি এটা। আয় তোকে জড়িয়ে ধরি।’ অনেকবার ফোন এল তাঁর, ‘সমরেশ, আমি ঠিক করলাম গৌরব, মানে গোরার চরিত্রে তাপস পালকে নেব।’ আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘সর্বনাশ। আমি মানতে পারছি না। তাপস পালকে দেখে কি দর্শকদের মনে হবে দশ বছর বিদেশে থেকে এসেছে?’

‘ভাবিস না। আমি করিয়ে নেব।’

‘পারবে না। ওখানে থাকতে থাকতে কথা বলা, হাঁটাচলা অন্যরকম হয়ে যায়।’

‘তাহলে কাকে নেব।’

উত্তরটা দিতে পারিনি। কারও নাম মনে আসছে না। হঠাৎ মনে এল দিল্লি বা বোম্বেতে অনেক বাংলা নাটকের দল আছে। তাদের ছেলেরা নিশ্চয়ই কলকাতার থেকে একটু আলাদা হবে। কিন্তু আমি তো কাউকে চিনি না।

পরদিন দেখা হওয়ামাত্র জোছনদা বললেন, ‘তোর মতো আমিও পারফেকশনে বিশ্বাস করি। কিন্তু পাচ্ছি কোথা?’ তাছাড়া তেরো পার্বণ গ্রাম বাংলার সিরিয়াল। নামকরা কেউ না থাকলে লোকে দেখবে কেন?’

বলতে চাইলাম গল্পের জন্য দেখবে, বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে বলে বললাম না। জোছনদা আমাকে তিনদিন সময় দিলেন। তার মধ্যে ঠিকঠাক কাউকে না পেলে তাপস পালই করবে। সামনের সপ্তাহে শুটিং আরম্ভ। পরিচালক জোছনদাই।

শীতের বিকেল। দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখছি। কয়েকটা বাচ্চার সঙ্গে বেণু ব্যাডমিন্টন খেলছে। ও জোছনদার আত্মীয় এবং সোনেক্সের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। রমাপ্রসাদ বণিক এল পাশে। খেলা দেখতে দেখতে বলল, ‘ছেলেটা খুব স্মার্ট।’

সঙ্গে সঙ্গে আমি বেলুকে ডেকে পাঠালাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘অভিনয় করবেন?’

সে বলল, ‘দিল্লিতে থাকতে নাটক করেছি। গাইড করলে চেষ্টা করব।’

তাকে যেতে বলে জোছনদার কাছে গিয়ে প্রস্তাবটা দিতে তিনি হাঁ হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘ওর মুখটা দেখেছিস? পাবলিক ওই মুখ টিভিতে দেখতে চাইবে?’

বললাম, ‘ওর অভিনয় দেখবে।’ রমাপ্রসাদ সমর্থন করেছিল আমাকে।

তেরো পার্বণ ইতিহাস তৈরি করেছিল। বোম্বের বাঙালি মেয়ে খুশি মুখার্জি এয়ার হোস্টেসের চাকরি সামলে নায়িকার চরিত্র করেছিল। কিশোরী ইন্দ্রাণী হালদার থেকে অনেকের প্রথম কাজ হয়েছিল ওই সিরিয়ালে। বৃহস্পতিবার রাত আটটায় বাঙালি টিভির সামনে বসেছিল বহু মাস। আজ সুপ্রিয়দা নেই। জোছনদাও চলে গিয়েছেন। কাজপাগল জোছনদাকে মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। অবাক হয়ে ভাবি, দীর্ঘদিন একসঙ্গে থেকেছি কিন্তু তাঁর মুখে কখনও রাজনীতির কথা শুনিনি। প্রথম টেলিকাস্টের রাতে ফোন করেছিলেন, ‘তুই ঠিক, আমি ভুল করছিলাম। বেণুকে বাঙালি অ্যাকসেপ্ট করেছে। আমার পাশে থাকিস ভাই।’

কোথায় আর থাকতে পারলাম!

১৪

সুমনের নাম আমি প্রথম জেনেছিলাম জুলি বউদির মুখে। জুলি বউদি রমেন পাইনের স্ত্রী। থাকতেন ওয়াশিংটনের কাছাকাছি সুন্দর শহরতলিতে। রমেনদা ভয়েস অফ আমেরিকায় চাকরি করতেন। সুমন তাঁর সহকর্মী ছিলেন। তখনও নামের আগে কবীর বসেনি। জুলি বউদি বলেছিলেন, ‘দারুণ গায় গো ছেলেটা।’

তারপর সুমন আজ ইতিহাস তৈরি করল, সেই ‘তোমাকে চাই’ থেকে আমি তার ভক্ত হয়ে গেলাম। শুনলাম, সে ছদ্মনামে লেখালেখি করত একসময়। আমি আদার ব্যাপারী তাই ওই জাহাজের কাছে পৌঁছনোর সুযোগ হয়নি।

তার নাম বাড়তে লাগল। গানগুলো আমার বুকে বসে গেল। রবীন্দ্রনাথ এবং সলিল চৌধুরির নাম মনে রেখেই বলছি, ওর গানের ভাষা একদম অন্যরকম। যে রকম হলে আজকের গান ঠিকঠাক হয় সেইরকম। বাংলা গানে ‘জীবন মুচকি হাসে’ লেখার হিম্মত দূরের কথা, ভাবনাটা মাথায় তো কারও আসেনি। ক্রমশ অবস্থা পাল্টাতে লাগল। ওর নামের পাশে বাড়তে লাগল বদনামও। এক বন্ধু কলামন্দিরে ওর অনুষ্ঠান দেখে এসে রেগে টঙ! বলল, ‘গান শুনতে গিয়েছিলাম, ওর বকবকানি শুনতে যাইনি। আর কি মারাত্মক বকবকানি! একে গালগাল দিচ্ছে, ওর পিতৃশ্রাদ্ধ করছে যে সব শব্দ বলে, কথায় দু’কথায় যে রকম রেগে উঠছে, তা কোনও গায়ককে স্টেজে দাঁড়িয়ে করতে দেখিনি। ভয়ঙ্কর মানুষ।

বাঙালি তিলকে তাল করে। ভাবলাম বন্ধুও তাই করছেন। কিন্তু একজন সাংবাদিক বললেন, ‘সুমন গাইতে গিয়ে প্রায়ই মেজাজ হারায়।’ আমি বুঝে নিলাম, এই গায়ক অত্যন্ত বদরাগি। এরকম লোকের গান দূর থেকে শোনাই ভাল, কাছে যাওয়ার দরকার কী!

এর বেশ কয়েক বছর পরে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরে যে বঙ্গ সম্মেলন হয়েছিল, তাতে বাংলা সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা বলার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখি সৌমিত্রদা (চট্টোপাধ্যায়) যাচ্ছেন সপরিবারে, কৌশিক সেনও দলবল নিয়ে। খুশি হলাম, এতদূরের পথ একা যেতে হবে না। আমরা প্লেনের সিটে বসে পড়ার পরে হস্তদন্ত হয়ে সুমন ঢুকল, সঙ্গে তার সহকারী। তার সিট আমার দুই সারি পরে। ছবিতে দেখেছি, সামনাসামনি ওই প্রথম। দিল্লিতে প্লেন বদলাতে হয়েছিল। সেখানেই আলাপ। কে করিয়ে দিয়েছিল মনে নেই, হাত জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘আরে বাস! কী সৌভাগ্য! ভাবতেই পারছি না।’ একটুও বিগলিত হইনি। কারণ অভিজ্ঞতা বলছে, বিখ্যাত মানুষরা পড়ার সময় পান না।

কিন্তু নিউইয়র্ক থেকে ফিলাডেলফিয়াতে একই গাড়িতে যেতে যেতে বুঝতে পারলাম, আমার লেখার সঙ্গে ও বেশ পরিচিত, যেমন ওর গানের সঙ্গে আমি। দুই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মধ্যে চটজলদি গা-ঢলাঢলি সম্পর্ক তৈরি হয় না। আমরা তাই ভদ্রলোকদের মতো দূরত্ব রেখে পথটা পেরিয়েছিলাম।

পাঁচতারা যে হোটেলে বঙ্গ সম্মেলন হচ্ছে, তার সামনে আমাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে স্বেচ্ছাসেবক চলে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘একটু অপেক্ষা করুন, প্রেসিডেন্ট নিজেই, আপনাদের ভিতরে নিয়ে যাবেন।’

দীর্ঘ বিমানযাত্রা এবং তারপরে প্রায় চার ঘণ্টা গাড়িতে বসে আমরা তখন বেশ ক্লান্ত। সৌমিত্রদাদের ওরা জেএফকে থেকে কীভাবে নিয়ে এসেছে জানি না। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সুমন বলল, ‘এখন প্রায় সন্ধে। এই সময় পৃথিবীটাকে অন্যরকম লাগে।’

বললাম, ‘আপনি তো বেশ কিছু বছর এ দেশে ছিলেন। এখানে এর আগে নিশ্চয়ই এসেছেন।’

‘হ্যাঁ। এই শহর মুক্তির শহর।’

আমরা গল্প করছি আর দেখছি, দারুণ দারুণ সুন্দরীরা শাড়িতে নিজেদের জড়িয়ে হোটেলে ঢুকছেন ব্যস্ত হয়ে। পুরুষদের বেশিরভাগের পরনে চোখধাঁধানো পাঞ্জাবি আর রঙিন ধুতি। কিন্তু আধঘণ্টা হয়ে গেল কেউ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন না।

শেষপর্যন্ত সুমন একজনের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলল, ‘এই যে ভাই, আমরা কলকাতা থেকে এসেছি। কর্তাদের একটু ডেকে দেবেন?’ লোকটি ঘাড় নেড়ে চলে গেল।

ঘণ্টাখানেক যাওয়ার পর দেখলাম সুমনের মুখ থমথমে। সে আমায় বলল, ‘ভাল কথায় কাজ হবে না। আমি গালাগাল দিচ্ছি, কিছু মনে করবেন না।’

তারপর তার মুখ থেকে যে সব শব্দ ছিটকে বের হল তা আমার কালপুরুষের খুরকি, কেলোদের অস্ত্র ছিল। সঙ্গে সঙ্গে শৌখিনবাবু এবং বিবিরা চোখ বন্ধ করে আমাদের দেখল। ততক্ষণে মনে পড়ে গিয়েছে সেই বন্ধুর কথা যে কলামন্দিরের অনুষ্ঠান দেখে বিরক্ত হয়েছিল।

মুশকিল হল, ওইসব শব্দে তেমন প্রতিক্রিয়া হল না। সুমন বলল, ‘বাংলায় হল না। এবার ইংরেজিতে দিতে হবে শালাদের।’

কিন্তু তখনই এক উদ্যোক্তা দেখা দিয়ে ক্ষমা চাইলেন। সুমন বলল, ‘আমার কাছে ক্ষমা চাইলে চলবে না, সমরেশদার কাছে চান।’

ওরা আমাদের হোটেলের রিসেপশনে নিয়ে গেল। সুমন এবং তার সহকারীর ঘর ঠিক আছে। আমাকে থাকতে হবে একজন অপরিচিতের সঙ্গে যিনি চাবি নিয়ে এখন বাইরে গিয়েছেন। আমি কারও সঙ্গে ঘর শেয়ার করব না এরকম একটা চুক্তি ছিল। সেটা উদ্যোক্তাকে মনে করিয়ে দিলে তিনি দুঃখপ্রকাশ করে বললেন, তাঁর কিছু করার নেই। কথা বাড়ছিল, শেষপর্যন্ত বললাম, ‘আমাকে একটা চাদর আর বালিশ দিন, আমি ওই সোফাতেই শুয়ে পড়ব। সুমন, আপনি ঘরে যান।’

সুমন বলল, ‘অসম্ভব। আপনি এই সোফায় শুলে আমরাও এখানেই থেকে যাব। দরকার হলে এই মেঝেতেই।’

কিছুতেই ওকে বোঝাতে পারছি না। আমার একটা হিল্লে না হওয়া পর্যন্ত সে তার জন্যে বরাদ্দ ঘরে যাবে না। প্রায় ঘণ্টাখানেক এইভাবে চলার পর আমি ঘর পেলাম। তার গল্প এখানে অপ্রাসঙ্গিক। আমাকে সুস্থির দেখে সুমন চলে গেলে আমি ভাবছিলাম, এই রগচটা, মুখ আলগা লোকটার দোষকীর্তন করে লোকে খুশি হয় কিন্তু কয়েকঘন্টার সামান্য আলাপে সুমন যা করল, তা ক’জন করে? একজন শিল্পী নানান কারণে চারপাশের মানুষদের প্রতি বিরক্ত হয় কিন্তু তার বুকের ঘরে মন না থাকলে সে শিল্পী হতে পারে না। স্বীকার করছি, প্রতিবাদের ভাষায় শালীনতা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু দেখশুনে তো কেউ কেউ খেপে যেতেই পারেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *