১
আমার গল্পের বই পড়া শুরু হয়েছিল মোহন সিরিজ দিয়ে। তখন মনে হত, শশধর দত্তের মতো বড় লেখক আর দ্বিতীয়টি নেই। ওঁর বইগুলো পড়তে হত স্কুলের বইয়ের নীচে লুকিয়ে রেখে। তেরো বছর বয়সে মোহনের প্রেমিকা রমাকে অপ্সরা বলে মনে হত। কোনও সমস্যায় পড়লেই শশধর দত্ত লিখতেন, ‘কখন কেমন করিয়া কি হইয়া গেল জানা নেই’, মোহন সমস্যার সমাধান করে ফেলত। ওইসব পড়তে পড়তে হাতে এল স্বপনকুমারের দীপক গোয়েন্দার গল্পগুলো। বেশ জমে গেলাম। এই বইগুলো সাপ্লাই দিতেন পাশের বাড়ির কমলা কাকিমা। সঙ্গে হুসিয়ারি থাকত, ‘কেউ জানতে পারলে খবরদার আমার নাম বলবি না। এসব বই তোদের পড়ার কথা নয়। তুই মাথায় লম্বা হয়ে গেছিস বলে পড়তে দিচ্ছি।’
তখন জলপাইগুড়ির একটি বইয়ের দোকানে ওইসব বই পাওয়া যেত। কমলা কাকিমা টাকা দিতেন আর আমি কিনে এনে তাঁকে দিতাম। প্রথম দিন দোকানদার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে পড়বে এই বই? তুমি?’
‘না। কমলা কাকিমা।’
‘মিছে কথা বলছ না তো?’
কমলা কাকিমা তখনও শর্তটা শোনাননি, তাই সাহস করে বলে ফেলেছিলাম, ‘আপনি চলুন, গেলেই জানতে পারবেন।’
দোকানদার আমাকে বিশ্বাস করলেন।
কমলা কাকিমার বিয়ে হয়েছিল বছর তিনেক আগে। বাদল কাকুর সঙ্গে। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় বাদল কাকুর মা মারা যায়। তারপর থেকে কমলা কাকিমা সারাদিন একাই বই পড়ে সময় কাটায়। বাদল কাকু কাজ থেকে ফিরে এলে ওই বাড়িতে রেডিও বাজে। ওই বয়সে আমি বুঝেছিলাম কমলা কাকিমার কোনও বান্ধবী আমাদের পাড়ায় নেই। আমি ছাড়া কেউ ওঁদের বাড়িতে যেত না। বিকেলবেলায় জানলায় দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকতেন, ‘এই, এসো, তোমার সঙ্গে গল্প করি।’
আমাদের গল্পের বিষয় ছিল দস্যু মোহনকে ঘিরে। সেইসময় মাইকে ‘আলোছায়া’ সিনেমার তরফ থেকে সারা শহরে ঘোষণা করা হল, ‘দস্যু মোহন’ নামে সিনেমা শুক্রবার থেকে দেখানো হবে। কমলা কাকিমা খুব উত্তেজিত। বললেন, প্রদীপকুমার হয়েছেন দস্যু মোহন আর সুমিত্রা দেবী রমা। কী দারুণ ব্যাপার! সিনেমাটা দেখতেই হবে।
শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। তখনও আমাকে একা সিনেমা দেখতে দেওয়া হত না। দেবদেবী বা অবতারের ছবি এলে আমাকে বড়পিসিমার পাশে রিকশায় বসে ম্যাটিনি শোতে যেতে হত। তবু খুব সাহস করে প্রস্তাবটা বড়পিসিমার কাছে পেশ করলাম। তিনি মাথা নাড়তে নাড়তে পিতামহকে জানালেন। পিতামহ গর্জে উঠলেন, ‘তুমি বন্দুকবাজ দস্যু হতে চাও? তোমার বাবা মা আমার কাছে পাঠিয়েছেন মানুষ হওয়ার জন্য। তুমি আমাদের মুখে কালি মাখাতে চাও?’ চুপসে গিয়েছিলাম।
কমলা কাকিমা ড্যাং ড্যাং করে বাদল কাকুর সঙ্গে নাইট শোতে সিনেমাটা দেখে এলেন। পরদিন বিকেলে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যাঁরে, তুই কবে দেখবি। উঃ, কী ভালো, কী ভালো!’
আমার দেখা হবে না শুনে তিনি একটুও দুঃখিত হলেন না। বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে? আমি তোকে সিনেমার গল্পটা সুন্দর করে বলব। তুই চোখ বন্ধ করে শুনিস, দেখবি সিনেমাটা দেখা হয়ে যাবে।’
ওই প্রথম কমলা কাকিমাকে আমার অপছন্দ হল।
দুদিন পরে স্বপনকুমারের নতুন বই কিনে আনতে পাঠালেন কমলা কাকিমা। তখনও তিনি সিনেমার গল্পটা আমাকে বলেননি। উল্টে একটা নতুন শাড়ি দেখিয়ে বলেছেন, ‘এই শাড়িটা কিনলাম। রমা পরেছিল। কী সুন্দর!’ শুনে মেজাজ খারাপ হলেও বই কিনতে গিয়েছিলাম।
দোকানে ভিড় ছিল। খানিকটা অপেক্ষা করার পর বইয়ের নাম বললে দোকানদার মাথা নাড়লেন, ‘না। এখন নেই। সামনের সপ্তাহে এসো, পেয়ে যাবে।’
‘এম্মা! তুই স্বপনকুমার পড়িস নাকি?’
পিছন থেকে যে কণ্ঠস্বর ভেসে এল সেটা ঝুমুরদির। আমাদের পাড়ায় বাড়ি, কলেজে ঢুকেছে সে-বছর।
দোকানদার হাসল, ‘ও মোহন সিরিজ আর স্বপনকুমার কিনে নিয়ে যায় মাঝে মাঝে—বলে কোনও এক কাকিমা কিনতে পাঠিয়েছেন। নিজে পড়ে কিনা কে জানে!
ঝুমুরদি নাক সিটকালো, ‘ছিঃ। তোর টেস্ট এত খারাপ?’
‘খারাপ বলছ কেন? গোয়েন্দা দীপক তো দারুণ।’
‘ছাই। গোয়েন্দা গল্প পড়তে হলে কিরীটি রায় পড়বি।’
‘সে আবার কে?’ আমি অবাক।
‘চল আমার সঙ্গে।’
ঝুমুরদি গম্ভীর মুখে পুরোটা পথ এল। বাড়ির দরজায় আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতর থেকে একটা বই নিয়ে এসে বলল, ‘ঠিক দুদিন সময় দিচ্ছি, তার মধ্যে পড়ে নিয়ে আমাকে ফেরত দিয়ে যাবি। ছি ছি ছি, তুই ওসব পড়ে নিজের চরিত্র নষ্ট করছিস?’
‘এমন করে বলছ কেন? মোহনকে নিয়ে সিনেমা হয়েছে তো!’
‘গাঁজা, স্রেফ গাঁজা, যা।’ ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল ঝুমুরদি।
বইটি দেখলাম। লেখকের নাম নীহাররঞ্জন গুপ্ত। বইয়ের নাম কালো ভ্রমর। ফেরার পথে কমলা কাকিমাকে জানিয়ে এলাম, বইটি পাওয়া যায়নি। কমলা কাকিমা বললেন, ‘ইস!’ তারপরই আমার হাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোর হাতে ওটা কি বই?’
‘নীহাররঞ্জন গুপ্তের কালো ভ্রমর।’ ওঁকে স্বপনকুমার কেনার জন্য যে টাকা দিয়েছিলেন তা ফেরত দিয়ে দিলাম। ভালো ছেলের মতো বললাম, ‘তুমি কি এই বই পড়তে চাও?’
‘ভ্যাট! আমি ওই ভ্রমরটোমর পড়ি না।’
.
রাত সাড়ে সাতটায় পড়ার বইয়ের নীচে রেখে কালো ভ্রমরের পাতা খুললাম। বড় পিসিমার চিৎকার কানে ঢুকতেই দেখলাম পৌনে ন’টা বাজে। তাড়াতাড়ি বইটা লুকিয়ে রেখে রাতের খাবার খেতে গেলাম। পিতামহ বললেন, ‘খুব মেঘ করেছে বৃষ্টি হবে। খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ো। ভোরে বৃষ্টি না হলে হাঁটতে বের হব।’
ওই বয়সে আমি রোজ প্রার্থনা করতাম যাতে ভোরবেলায় বৃষ্টি হয়। না হলে ভোর সাড়ে চারটের সময় পিতামহ আমাকে বিছানা থেকে তুলে হাঁটতে নিয়ে যেতেন। বললাম, ‘আমাকে একটা হোমওয়ার্ক শেষ করতেই হবে। তারপর শুয়ে পড়ব।’
আমাকে সেসময় আলাদা ঘর দিয়েছিলেন পিতামহ। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করতে পারতাম। ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করেই কালো ভ্রমর টেনে নিলাম। প্রায় গোগ্রাসে গিলে ফেলে বসে রইলাম রোমাঞ্চিত হয়ে। ঝুমুরদির কথা খুব সত্যি। এর কাছে দস্যু মোহন বা স্বপনকুমার একেবারেই পানসে। কমলা কাকিমা ওই পড়ে বুঁদ হয়ে আছে, আমাকেও দলে টেনেছিল। ঠিক করলাম এখন থেকে শুধু নীহাররঞ্জন গুপ্তই পড়ব। ঠিক তখনই বন্ধ দরজার বাইরে থেকে পিতামহের গলা ভেসে এল, ‘হোমওয়ার্ক হয়েছে?’
চমকে সোজা হয়ে বসে বললাম, ‘হ্যাঁ। হয়েছে।’
‘তাহলে শুয়ে পড়ো।’
তখন থেকে ঝুমুরদি আমার প্রিয় মানুষ। কমলা কাকিমার বাড়িতে আর যাই না। কয়েকবার জানলায় দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়েছেন। ব্যস্ততার ভান করে এড়িয়ে গিয়েছি। সেসময় ঝুমুরদিই আমার ভরসা। কিন্তু আরও একটা বই দেওয়ার পর ঝুমুরদি বলল, ‘তুই বাবুপাড়া পাঠাগারে ভর্তি হয়ে যা। কিরীটি রায়ের সব বই ওখানে পেয়ে যাবি।’
ঝুমুরদি আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে লাইব্রেরিয়ান সুনীল পাত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তিনি বললেন, ‘তুমি তো মাইনর, তিরিশ টাকা দামের মধ্যে বই নিতে পারবে। এই ফর্মটা ভর্তি করে অভিভাবককে দিয়ে সই করিয়ে নিয়ে এসো। তিরিশ টাকা জমা রাখতে হবে। মাসিক চাঁদা এক টাকা।’ অনেক ঘ্যানর ঘ্যানর করে বড় পিসিমার কাছ থেকে টাকা আর সই আদায় করতে পেরেছিলাম এই শর্তে যে, পরীক্ষার ফল যেন খারাপ না হয়।
আমাকে তখন কে পায়। লাইব্রেরি ভর্তি হাজার হাজার বই। আমি কোনও বইয়ের দিকে না তাকিয়ে নীহাররঞ্জন পড়ে চলেছি। বঙ্কিম- রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র দেখলেই মুখ ঘুরিয়ে নিই। স্কুলের বইতে যাঁদের রচনা থাকে তাঁদের বই খুব কঠিন হয় বলে বিশ্বাস ছিল।
একদিন সুনীলদা বললেন, ‘তুমি তো ডিটেক্টিভ গল্প পড়তে পছন্দ করো, তাহলে এঁদের বই তোমার পড়া উচিত। দীনেন্দ্রকুমার রায় এবং শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।’ বাধ্য ছেলের মতো আমি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম এই ভেবে যে পরদিনই ফেরত দিয়ে দেব। তাতে সুনীলদার কথা রাখা যাবে। পরদিন ফেরত দিতে হয়েছিল কারণ রাত জেগে মোমবাতি জ্বালিয়ে ব্যোমকেশ পড়েছি মুগ্ধ হয়ে। পরের বইটি চাই।
তখন নীহাররঞ্জন গুপ্তকে আর আগের মতো আকর্ষণীয় মনে হচ্ছিল না। ব্যোমকেশের পাশে কিরীটিকে তেমন স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হত না।
সেসময় লাইব্রেরিতে একটি মেয়েকে দেখতাম। আমি তখন চৌদ্দ, তার বয়সও আমার কাছাকাছি। তার গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ হলেও মুখের গড়ন ছিল অপূর্ব সুন্দর। লম্বা মোটা বেণী হাঁটু ছুঁয়ে যেত, এখনও তার চোখদুটো মনে পড়ে। চৌদ্দ বছর বয়সে তাকে বর্ণনা করার কোনও ভাষা খুঁজে পাইনি।
একদিন লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখলাম সুনীলদা মেয়েটিকে বলছেন, ‘তুমি সাতদিনেও বইটি পড়ে শেষ করতে পারোনি, আবার রিনিউ করতে চাইছ?’
মেয়েটি হাসল, ‘আমি দুবার পড়েছি, আরও একবার পড়ব।’ সুনীলদা বললেন, ‘খুব খুশি হলাম নীপা।’
শুনে আমি অবাক হলাম। এমন কী বই যা দুবার পড়ার পরেও আরও একবার পড়বে নীপা নামের মেয়েটি? শরদিন্দুর বই নিয়ে সোজা মেয়েটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কি শরদিন্দুর কোনও বই পড়ছ?’
‘না তো!’ মেয়েটি বিস্মিত হল।’
‘ও!’ আমি থিতিয়ে গেলাম।
‘কেন এই প্রশ্ন?’ সে বড় চোখে তাকাল।
‘আমি এখন শরদিন্দুর বই পড়ি তো, তাই।’
‘ওঃ। ওসব বই কি দুবার পড়া যায়?’ নীপা হাসল। এবার ওর গজদাঁত দেখতে পেলাম, ‘রহস্য জানা হয়ে গেলে সব শেষ হয়ে যায়।’
‘তোমার বইটির নাম কি?’
‘শেষের কবিতা?’
‘কবিতার বই?’
‘ও ভগবান! শেষের কবিতার নাম শোননি? রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত উপন্যাস। এই বইয়ের অনেক লাইন আমি ডায়েরিতে লিখে রেখেছি।’
নীপা চলে গেল। আমি ফাঁপড়ে পড়লাম।
সাতদিন পরে নীপা লাইব্রেরিতে বইটি ফেরত দিলে আমি পড়ার সুযোগ পেলাম। এ কীরকম বই? কীরকম ভাষা? পড়ে বুঝতে পারছি না আবার না পড়েও পারছি না। একটা লাইনের মানে অনেকরকম হয়ে যাচ্ছে। অমিতকে পছন্দ হচ্ছে না কিন্তু লাবণ্যকে খুব ভালো লাগছে। একবার পড়ার পর মনে হল আর একবার পড়া উচিত। আর পড়তে পড়তে আমি হাবুডুবু খেতে লাগলাম।
আমার জীবনে কমলা কাকিমা, ঝুমুরদি এবং নীপা তিনরকম ভূমিকা নিয়েছিল, সন্দেহ নেই যে যার মতো। কিন্তু নীপা আমাকে সমুদ্রের সন্ধান দিয়েছিল, তার কাছে এই জন্মে ঋণী হয়ে আছি।
.
আমার বন্ধু নিশীথ গল্প-উপন্যাস পড়ার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা পেত। ওর মা মনে করতেন সাহিত্য পড়লে কেউ নষ্ট হয়ে যায় না। সত্যি কথা বলতে কি, সাহিত্য শব্দটি আমি প্রথম শুনেছিলাম মাসিমার মুখ থেকে। অসম্ভব সুন্দরী মহিলা ছিলেন। স্কুলে পড়াতেন। নিশীথের বাবাকে সবসময় অসুস্থ চেহারায় দেখেছি। তিনি নিজের মতো থাকতেন। মাসিমা খুবই হাসিখুশি। বলতেন, ‘বাংলা বই পড়তে হলে তোকে বঙ্কিম দিয়ে শুরু করতে হবে। এক লাফে শেষের কবিতা পড়লে বুঝবি কি করে? তাছাড়া শেষের কবিতার অমিত রায় যেমন রবীন্দ্রনাথের বানানো তেমনই লাবণ্যও। বাস্তবে ওরকম মানুষ হয় না। রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পগুলো পড়, দেখবি চরিত্রগুলো তোর খুব চেনা।’
পছন্দ হয়নি ওঁর কথা, বলেছিলাম, ‘লাবণ্য কি বাস্তবে হয় না?’
চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে না বলেছিলেন মাসিমা।
‘তোমাকে একটা কথা বলতে পারি?’ সাহস করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
‘কি বলবি, বল্।’
‘তোমার সঙ্গে লাবণ্যের অনেক মিল আছে বলে আমার মনে হয়েছে।’ আমি কথাগুলো শরীরের সব রক্ত যেন মুখে উঠে এল। সেটা কাটাতে চেঁচিয়ে বললেন, ‘ভ্যাট। আমি কি ওইরকম নেকু? খুব পেকে গিয়েছিস তুই!’
কিন্তু আমার মনে হতে লাগল লাবণ্য কখনই নেকু হতে পারে না। কোথায় ন্যাকামি করেছে? নিশীথ রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস পড়ে না। সে নাকি এখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ছে। বাংলা সাহিত্যে কত লেখক আছেন? বাবুপাড়া পাঠাগারে গিয়ে তাঁদের তালিকা দেখে আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। অ্যাতো লেখক? তাঁরা যত বই লিখেছেন তা পড়ে শেষ করতে কত বছর লাগবে? বই ঘাঁটাঘাটির সময় বড়দের সংলাপ কানে আসত। তাঁরা যেসব লোকের বইয়ের কথা বলতেন তা আমার জ্ঞানের বাইরে ছিল। একজন বলতেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সব রচনা পড়ে শেষ করতে আমার দু-বছর লেগে গেল।’ লোকটির দিকে বিস্ময়ে তাকিয়েছিলাম, এইসময় কানে এল, ‘আবার ব্যোমকেশ নাকি?’
মুখ ফিরিয়ে দেখলাম নীপা দাঁড়িয়ে, হাতে বই।
সঙ্গে সঙ্গে মাসিমার কথা মনে এল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা, লাবণ্যকে তোমার কেমন লেগেছে?’
‘হ-ঠাৎ?’ ঠ-এর উচ্চারণ এত সঠিকভাবে করল যে কানে লেগে গেল।
‘তোমার কি ওকে নেকু নেকু মনে হয়েছে?’
‘যাচ্চলে! ভাবিনি তো! লাবণ্যকে আমার খুউব ভালো লেগেছে কিন্তু আমি কখনও লাবণ্য হতে চাইব না!’ নীপা বলল।
‘কেন?’
‘আমি যেমন দুর্গা, লক্ষ্মী বা সরস্বতী হতে চাইব না তেমনই লাবণ্যও না। ওটা কল্পনার চরিত্র। স্বর্গের ফুলের মতো।’ নীপার কথা শেষ হওয়া মাত্র সুনীলদা এসে দাঁড়ালেন, ‘কী নিয়ে কথা হচ্ছে? লাইব্রেরির ভেতরে এত কথা বললে অন্যের অসুবিধা হতে পারে।’
ব্যাপারটা একদম গুলিয়ে গেল। যাকে এত ভালো লেগেছে, যার ভাবভঙ্গি আমি কল্পনা করে নিয়েছি, যার কথা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছে তাকে নীপা স্বর্গের ফুল বলে সরিয়ে দিচ্ছে, আবার মাসিমা বলেছেন নেকু। সেই চৌদ্দ বছর বয়স থেকে যে রহস্য তৈরি হয়েছিল আজও তার সমাধান খুঁজে পাইনি।
কিন্তু খুব মুশকিলে পড়ে গেলাম আমি। সমবয়সী বটেই, আমার চেয়ে যারা বছর পাঁচেকের বড় সেইসব মেয়েদের মধ্যে লাবণ্যকে খুঁজতে চাইলাম। আমাদের বাড়িতে থাকতাম তিনজন। একজন বৃদ্ধ, দ্বিতীয়জন প্রৌঢ়া আর আমি। বড়পিসিমার কাছে যাঁরা আসতেন তাঁদের সবাই হয় প্রৌঢ়া নয় বৃদ্ধা। পাড়ার মেয়েরা স্কুলে যাওয়া-আসা করত অভিভাবকের সঙ্গে, বাড়ির বাইরে অন্য কোথাও যেতে হলে মা-পিসি সঙ্গে থাকত। ফলে তাঁদের সঙ্গে গল্প করার কোনও সুযোগ পাওয়া যেত না। আচমকা আমার ভাগ্য প্রসন্ন হয়েছিল বাবুপাড়া পাঠাগারে নীপার সঙ্গে কথা বলার পর। নীপার বাবা বেশ বড়সড় সরকারি অফিসার। একবছর আগে বদলি হয়ে এসেছেন। তাই নীপা আমাদের জলপাইগুড়ির মেয়েদের মতো অভিভাবক সঙ্গে নিয়ে ঘুরত না। লাইব্রেরিতে আসত রিকশায় চেপে, একাই।
আমাদের বাড়ির একদিকে যেমন কমলা কাকিমাদের বাড়ি, অন্যদিকে বংশীদাদু। বিশাল বাড়ি। শুনতাম ওঁর ছেলেদের কেউ দিল্লিতে থাকেন, কেউ লন্ডনে। বংশীদাদু খুব সাহেব মানুষ। বিকেলে ছড়ি এবং পাইপ হাতে নিয়ে হাঁটতে যেতেন তিস্তার বাঁধে। পিতামহের সঙ্গে কথা বলার সময় খুব কম বাংলা শব্দ ব্যবহার করতেন। হঠাৎ ওই বাড়িতে বেশ হৈ চৈ। শুনলাম বংশীদাদুর জামাই আমেরিকায় যাচ্ছেন বছর খানেকের জন্য। ততদিন তাঁর মেয়ে এবং নাতনি ওই বাড়িতে থাকবেন। বছরটা যাতে নষ্ট না হয় তাই নাতনিকে নিয়ে গিয়ে করলা গার্লস স্কুলে ভর্তি করে দিলেন বংশীদাদু। একদিন স্কুলে যাওয়ার সময় নাতনিকে দেখলাম। দরজায় দাঁড়ানো মাকে চুমু খেয়ে রিকশায় উঠে স্কুলে চলে গেল।
আমি চমকিত। জলপাইগুড়ির কোনও চৌদ্দ-পনের বছরের মেয়ে প্রকাশ্যে মাকে জড়িয়ে ধরে দুই গালে টপাটপ চুমু খায় বলে কখনও শুনিনি, দেখা দূরের কথা।
.
আমাদের একটা গোপন আড্ডা ততদিনে তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেই আড্ডায় আমি শ্রোতা হিসেবে থাকি। বাড়ির পাশেই তিস্তার বাঁধ। তার সিকি মাইল দূরে জলের ধারা যা তখনও গভীর ছিল। মাঝখানের বালির চরে লম্বা লম্বা কাশবন। স্কুল ছুটির পরে বাড়ি ফিরেই কিছু খেয়ে নিয়ে খেলতে যাওয়ার কথা বলে আমরা ওই কাশবনের গভীরে চলে যেতাম! জলের ধারে কাশবনের আড়ালে বসে বন্ধুরা সিগারেট ধরাতো। একটা নাম্বার টেন সিগারেট তিনজনে পালা করে টানতো। প্রথম কয়েক সপ্তাহ আমি সিগারেটে অংশ নিতে চাইনি। বড়পিসিমার ঘ্রাণশক্তি খুব বেশি। ঠিক গন্ধ পেয়ে যাবেন মুখে, আর পেলে যে কী হবে তা কল্পনা করা যাবে না। কিন্তু ভয়ের শক্তি নিষিদ্ধ কৌতূহলের চেয়ে বেশি নয়। আমি একটাই টান দিতাম আর তারপরে খানিকটা কেশে তিস্তার জলে বারংবার কুলকুচি করে নিতাম। নিশীথরা কাশতো না। ওরা ওই বয়সেই ধোঁয়া দিয়ে রিং বানাতে পারত। ঘণ্টাখানেকের ওই আড্ডায় আমরা যে যার মনের কথা বলতাম। গোবিন্দ রোজ রোজ প্রেমে পড়ত। তার প্রেমিকাদের বয়স
অন্তত দশ থেকে পনের বছর বেশি। কেউ বউদি, কেউ কাকিমা। আমি তাদের কথা শুনতে না চাইলে নিশীথ গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘তুই চরিত্রহীন পড়িসনি বলে রি-অ্যাক্ট করছিস।’
‘চরিত্রহীন?’
‘শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত উপন্যাস। কিরণময়ী দিবাকরের চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিল। দিবাকরের দাদার সঙ্গে তার প্রেম ছিল। রেঙ্গুনে যাওয়ার জাহাজে কিরণময়ী দিবাকরকে চুমু খেয়েছিল আচমকা। তারপর শরৎচন্দ্র কি লিখেছেন জানিস? ঘাবড়ে যাওয়া দিবাকরের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরণময়ী খিলখিল শব্দে হেসে উঠেছিল। উঃ। চুমু খাওয়ার চেয়ে খিলখিল শব্দটা অনেক বেশি সেক্সি।’ নিশীথ বলেছিল।
তখনও সেক্সি শব্দটি শুনলে কান গরম হয়ে যেত। মাঝে মাঝে ভাবতাম ওরা খারাপ কথা বলে, ওদের সঙ্গে মিশব না। কিন্তু কাদের সঙ্গে মিশব? সেই ক্লাস থ্রি থেকে তো একসঙ্গে পড়ছি।
তা এইরকম এক আড্ডায় আমি বংশীদাদুর নাতনির কথা ওদের বললাম। চৌদ্দ-পনের বছর বয়স শুনে গোবিন্দ এমনভাবে হাত নাড়ল যেন আমি দু’বছরের শিশুর কথা বলেছি। নিশীথ বলল, ‘এমনটি ভেসেল, সাউন্ড মাচ! যাদের ভেতরে কিছু নেই তারাই ওইসব করে পাঁচ পাবলিককে দেখায়। ওর চেয়ে তোর ওই নীপা মেয়েটি দারুণ ইন্টারেস্টিং! যা বলিস তা শুনে মনে হয় গভীরতা আছে। একদিন তোর সঙ্গে গিয়ে ওকে দেখে আসব।’
গোবিন্দ জিজ্ঞাসা করল, ‘নীপার বয়স কত?’
বললাম, ‘আমাদের বয়সী।’
‘দূর।’ অদ্ভুত শব্দ করেছিল গোবিন্দ।
‘যাক?’
‘আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।’
অজিত হেসেছিল, ‘তোর যত ইন্টারেস্ট বড়দের দিকে।’
‘নিশ্চয়ই। কোনও রিস্ক নেই। সমবয়সী হলেই বিয়ে করতে বলবে। বহুৎ ঝামেলা। কাকিমা দিদিরা তো তা বলবে না।’ গোবিন্দ বলেছিল।
কিন্তু আমি ঠিক করলাম কখনই ওদের সঙ্গে নীপার কাছে যাব না।
তখন আমি পনের। ফুলপ্যান্ট সবে পরছি। এক বিকেলে দেখি আমাদের গলির মুখে একটি অচেনা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমাঝেই ঘড়ি দেখছে। একটু কৌতূহল হল। দূর থেকে লক্ষ না করে কাছে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি বংশীদাদুর নাতনি রিকশায় স্কুল থেকে ফিরছে। তাকে দেখে ছেলেটির মুখে হাসি ফুটল। মেয়েটি গম্ভীর মুখে বসেছিল। রিকশা ছেলেটির পাশ দিয়ে যখন ওদের বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন মেয়েটি একটা দলা পাকানো কাগজ ছুঁড়ে দিল। কাগজটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একটু দূরে গিয়ে পড়ল। মেয়েটি তাদের বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলে ছেলেটি এগিয়ে যাচ্ছিল কাগজটা তুলতে। তখনই সে আমাকে দেখতে পেল। দেখে কিছুই হয়নি ভান করে উল্টোদিকে হেঁটে চোখের আড়ালে চলে গেল। আমি দ্রুত কাগজের দলাটাকে তুলে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম। মনে হচ্ছিল কোনও গোপন খবর জানতে পারব ওটা খুললে। কিন্তু ওই মেয়েটা তো বেশিদিন এখানে আসেনি, এর মধ্যে ছেলেটার সঙ্গে কী করে এসব হল। কাছাকাছি কেউ নেই নিশ্চিত হয়ে কাগজটাকে সোজা করলাম। মেয়েলি হাতে দুটো লাইন লেখা আছে, ইংরিজিতে। কাকে লিখছে তার নাম যেমন নেই, কে লিখছে তাও বোঝায়নি। হাতের লেখা খুব সুন্দর। দ্বিতীয়বার পড়লাম, Short absence quickens love, long absence kills it. মানে করলাম, ‘অল্প বিরহ ভালোবাসাকে বাড়িয়ে দেয়, দীর্ঘ বিচ্ছেদে ভালোবাসা মরে যায়।’ পড়ার পরে আমার মাথা থেকে লাবণ্য উধাও হয়ে গেল।
লাইব্রেরিতে নীপার সঙ্গে দেখা। হাতের বই ফেরত দিতে যাচ্ছিল। কী বই জিজ্ঞাসা করলে বলল, ‘এটা এমন একটা বই যা তুমি হজম করতে পারবে না।’ বলে সে তার গজদাঁত দেখাল।
‘কেন পারব না? খুব খটোমটো?’
‘বেশ, তুমি এটা নিয়ে যাও এন্ট্রি করিয়ে। পড়ে বলো।’
নিয়ে এলাম। লেখকের নাম প্রথম পড়লাম, যাদ্ধাবর। বইয়ের নাম দৃষ্টিপাত। প্রথমদিকে একটু খটোমটো লাগলেও শেষ পর্যন্ত মজে গেলাম। আঃ, কি সব লাইন, বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।
এই দৃষ্টিপাতের কথা নিশীথকে বললাম কাশবনের মধ্যে বসে। নিশীথ হেসে বলল, ‘আমি একটা খাতায় লাইনকে লাইন তুলে রেখেছি কোটেশন হিসেবে। যে-কোনও মেয়েকে বললে গলে জল হয়ে যাবে।’
ওরা যখন সবে সিগারেট ধরিয়েছে তখন কিছুটা দূর থেকে মেয়েদের গলা ভেসে এল। এ ওকে ডাকছে, এরকম জায়গায় মেয়েদের আসার কথা নয়। কিন্তু গলাগুলো ভেসে আসছে তিস্তার দিক থেকে। আমরা সন্তর্পণে কাশবন সরিয়ে জলের দিকে তাকালাম।
তিস্তার স্রোতে পাহাড়ে ভেঙে পড়া জঙ্গলের মোটা ডাল, গুড়ি ভেসে আসছে। কিছু আদিবাসী মেয়ে সেই কাঠ ধরার জন্য স্রোতে নেমেছে অনেক ওপর থেকে। জীবন বিপন্ন করে ওগুলো তুলে নিয়ে আসছে পাড়ের দিকে। তারপর সেই কাঠগুলো কেটে টুকরো করে শহরে যাবে বিক্রি করতে। যার বিনিময়ে ওরা চালডাল কিনতে পারবে। এই নির্জন নদীর চরে কোনও মানুষ না থাকায় ওরা শাড়ি বাঁচানোর জন্য বিবস্ত্র হয়ে জলে নেমেছে। সেই প্রথম আমি নগ্ন নারী-শরীর দেখলাম দূর থেকে।
২
বই পড়ার স্বাদ যখন পাল্টাতে শুরু করেছে তখন আর একটি ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল মনে। আমার হস্টেলের বন্ধুদের মুখে শুনতাম খুব কঠোর নিয়মের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তারা লুকিয়ে চুরিয়ে স্বাধীনতা ভোগ করে নিত। হস্টেলের সুপার প্রতি শনিবার জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ির বাড়িতে যেতেন। ফিরে আসতেন রবিবারের বিকেলে। ওই সময়ের দায়িত্ব থাকত অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারের ওপর যিনি আমাদের ইতিহাস পড়াতেন এবং অতি নিরীহ ধরনের মানুষ ছিলেন। হস্টেলের নিজের ঘরে বই মুখে নিয়ে বসে থাকাই তাঁর পছন্দের ছিল। আমার কয়েকজন বন্ধু রাত আটটায় খেয়ে নিয়ে স্যারের ঘরে গিয়ে গুডনাইট বলে বিছানায় কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে পিছনের দরজা দিয়ে চলে যেত রূপশ্রী অথবা আলোছায়া সিনেমাহলে। নাইট শো দেখে চুপিচুপি ফিরে এসে যে যার বিছানায় শুয়ে পড়ত। ইতিহাসের স্যার টেরও পেতেন না। ওদের মুখে সেইসব সিনেমার গল্প শুনতাম যা আমার কাছে নিষিদ্ধ ফলের ঘ্রাণ নেওয়ার মতো আকর্ষণীয় ছিল। ওরা আমাকে সঙ্গী হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করত কিন্তু আমি সাহসী হতাম না। আদর্শবান পিতামহ মাঝে মাঝে আমার কাছে আতঙ্কের বস্তু ছিলেন। কিন্তু মাটির কলসি যেমন সিমেন্টের চরিত্র হনন করে তেমনই বন্ধুদের উৎসাহে এক শীতের রাতে পাশবালিশের ওপর লেপ চাপা দিয়ে রূপশ্রীতে ঢুকেছিলাম ওদের সঙ্গে। সওয়া পাঁচ আনার টিকিট কেটেছিল ওরা যাতে খুব কাছ থেকে পর্দাটাকে দেখা যায়। সেই ছবির নায়িকা আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। কিন্তু তার চাহনি, কথা বলার ভঙ্গী এবং সবশেষে যখন মনে হল তিনি আমার দিকে তাকিয়েই ‘তুমি যে আমার’ গানটি গাইছেন তখন কীরকম উদাস হয়ে গেলাম। সে-রাতে ধরা পড়িনি, পড়লেও আমি বোধহয় সম্মোহনমুক্ত হতাম না। সেদিন জানতাম না, অনেক পরে যখন পড়লাম, ‘তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ’, তখন সেই উদাস হওয়া সময়টার যথার্থতা বুঝতে পেরেছিলাম।
কিন্তু সেই ছবির নায়িকাকে দেখার পর আমার মনে যে গরম বাতাস বইল তাকে শীতল করার আর কী পথ ছিল? সেই পনেরো বছর বয়সে আমার যে একটু ছোট অথবা সমবয়সি কিংবা দু-তিন বছরের বড় ললনাকে নেহাৎই নাবালিকা বলে মনে হতে লাগল। বাবুপাড়া পাঠাগারে গিয়ে দেখলাম নীপা আসেনি। সুনীলদা বললেন, ‘বেচারা অসুস্থ। আমাকে শেষবার এসে বলেছিল জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠকবিতা পড়তে চায়। সেদিন বইটা অন্য কেউ নিয়ে গিয়েছিল বলে দিতে পারিনি। এখন পাঠিয়ে দিলে বিছানায় শুয়ে পড়তে পারত।
মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল, ‘কবিতার বই?’
একটু বোধহয় তাচ্ছিল্য ছিল, সেটা বুঝে সুনীলদা বলেছিলেন, ‘কবিতার একেকটা লাইন তিন-চারশো বছর বেঁচে থাকে হে। ভারতচন্দ্রের নাম শুনেছ? শোননি। অশিক্ষিত। সেই কবে লিখেছিলেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’, এখনও এই লাইনটা চমৎকার বেঁচে আছে! বোঝার চেষ্টা কর।’
হঠাৎ মনে হল আমিই বইটা পৌঁছে দিতে পারি নীপাকে। বললাম। সুনীলদা খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘বইটা তোমার নামে এন্ট্রি করে দিচ্ছি। তুমি ওকে দিয়ে এসো। আর যে বইটা ওর কাছে আছে সেটা নিয়ে এসে তোমার পছন্দের বই তুমি লাইব্রেরি থেকে নিয়ে যেও।’
সুনীলদাই একটা চিরকুটে ঠিকানা লিখে দিলেন। ওর বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় মনে হল আমরা প্রায় সমবয়সি হওয়া সত্ত্বেও ওকে কখনই নাবালিকা বলে মনে হয়নি। উল্টে নিজেকেই তুলনায় ছোট বলে মনে হয়েছে। ওর কথাবার্তা, পড়াশুনা, তাকানো ওই বয়সি মেয়েদের থেকে একদম আলাদা। কিন্তু সেসব দেখে মনে সম্ভ্রম-বোধ তৈরি হয় কিন্তু মনে গরম বাতাস বয়ে যায় না।
নীপার বাবা বাড়িতে ছিলেন। আমার পরিচয় পেয়ে বললেন, ‘নীপার কাছে তোমার কথা শুনেছি। কী বই ওটা?’
দেখে বললেন, ‘এসো, নীপা এখন একটু ভালো।’
‘কী হয়েছে ওর?’
‘ম্যালেরিয়া।’
খাটের উপর বালিশে হেলান দিয়ে বসে নীপা জানলার বাইরের গাছটাকে হয়তো দেখছিল, বাবার গলা শুনে মুখ ফেরাল। বাবা বললেন, ‘দ্যাখ, তুই অসুস্থ শুনে সমরেশ দেখা করতে এসেছে।’
কিছুদিন জ্বরে ভুগলে মুখ হয়তো নীরক্ত দেখায়, কিন্তু নীপাকে খুব শীর্ণ দেখাচ্ছে। পরনে প্রায় পা ঢাকা পোশাক যাকে কখনই সেমিজ বলা যাবে না। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল নীপা। ওই মুহূর্তে ওকে বালিকা বলে মনে হচ্ছিল। নীপার বাবা বিছানার পাশের চেয়ারটাকে দেখিয়ে বসো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
বেশ রুগ্ন গলায় নীপা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী বই ওটা?’
আমি ওর হাতের সামনে বিছানার উপর বইটাকে রাখলাম। ও বইয়ের নাম দেখে এমন মুখ করল যে মনে হল মেঘ ভেঙে সূর্য বেরিয়ে এল। দ্রুত বই তুলে নিয়ে পাতা উল্টে আমার দিকে তাকাল, ‘কী আশ্চর্য ব্যাপার! তুমি এই বই লাইব্রেরি থেকে নিয়েছ?’
সত্যি কথাটা বললাম। শুনে সে মাথা নাড়ল, ‘তাই বলো। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।’ আমি সুনীলদাকে বলে রেখেছিলাম। তুমি না নিয়ে এলে অন্য কেউ হয়তো আবার নিয়ে যেত। তুমি এখন কী বই পড়ছ?’
‘রবীন্দ্রনাথের গোরা নিয়ে গিয়েছিলাম।’
‘পড়েছো?
‘না। ভালো লাগেনি। বড্ড খটোমটো। আজ ফেরত দিয়েছি।’
‘তুমি এখনই গোরা পড়তে গেলে কেন?’
‘কী করে বুঝব? রবীন্দ্রনাথের লেখা বলে নিয়েছিলাম।’
‘বাবা বলেন মাথার চুলে পাক না ধরলে গোরা বোঝা যায় না।’ কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ চুপচাপ কবিতার বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে সে স্থির হল। তারপর বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলল, ‘তুমি আবৃত্তি করতে পার?’
‘মোটামুটি।’
‘তাতেই হবে। এই এখান থেকে পড়তে শুরু করো।’ বইটি এগিয়ে দিল নীপা। একটু নার্ভাস হয়ে জায়গাটায় চোখ রাখলাম। ওপরেও অনেকগুলো লাইন রয়েছে যেগুলো নীপা আমাকে পড়তে বলেনি। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছিল তবু একটু কেশে নিয়ে আমি পড়া শুরু করলাম
‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবন্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে,
‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।’
এই অবধি পড়ার পরেই মনে হল আমি বনলতা সেনকে চোখের সামনে দেখছি। পাখির নীড়ের মতো চোখ কীরকম তা বুঝতে পারছি না, কিন্তু তার চুল, মুখ, চোখ যেন আমাকে কী গভীর সম্মোহনে নিয়ে গেল। এবং তখনই মনে হল সিনেমায় দেখা সেই নায়িকার সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন বনলতা সেন। অদ্ভুত শিহরণ ছড়িয়ে পড়ছে আমার শিরায় শিরায়। নীপা বলল, ‘পরের লাইনগুলো পড়ো।’
কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর বিশ্বাসঘাতকতা করল। শেষ লাইনটি মনে মনে পড়লাম।
নীপা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার কী হল?’
আমি হাসলাম। হেসেই বুঝতে পারলাম হাসিটায় কোনও অর্থ তৈরি হল না। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই কবিতাটার কথা তুমি আগে জানতে?’
‘অনেকের কবিতা নিয়ে একটা সংকলন বেরিয়েছিল তাতে এই কবিতা ছিল, পড়েছিলাম। বাবা বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের পরে যত প্রেমের কবিতা লেখা হয়েছে এই কবিতা তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।’ নীপা বইটি ফিরিয়ে নিল।
আমি বললাম, ‘যাই।’
নীপা নীরবে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।
সেই শেষ বিকেল আধো সন্ধের মুখে কিছু আলো পৃথিবীতে তখনও নেতিয়ে ছিল। আমি দুদ্দাড় পায়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম তিস্তার পাশে। সামনে দীর্ঘ বালির চর, চরের মাঝখানে কাশবন বাতাসে দুলছে। কয়েক ডজন বক আকাশে ছবি আঁকতে আঁকতে দোমহনির দিকে উড়ে গেল। একাকী ডাহুক শীর্ণ জলের ধারে বসে কাতর গলায় ডেকে চলেছে। আকাশ চুঁইয়ে তিরতিরে অন্ধকার নেমে আসার সেই সময়ে আমি পৃথিবীর সমস্ত গণ্ডির বাইরে চলে এসে চুপচাপ একটা পাথরের ওপর বসে আছি। আমার চোখের পাতায় সে, চোখ খুললে সে, আবার দুপাশে সে, যার চোখ পাখির নীড়ের মতো, যার চুল বিদিশার রাতের মতো কালো, সে বাতাসের স্বরে ফিসফিসিয়ে আমাকে বলছে, ‘তুমি যে আমার।’
কী আশ্চর্য! ঠিক তখনই চাঁদ যেন বালি ভেদ করে উঁকি মারল। একটু একটু করে মায়াময় হয়ে উঠল চরাচর। তারপর তার শরীর থেকে ছিটকে আসা জ্যোৎস্না যেন সরাসরি আমার বুকের ভেতর ঢুকে গেল। নিজেকে তখন কী পবিত্র আলোকিত বলে মনে হচ্ছিল। ওইভাবে আমি কয়েকটা জীবন বনলতা সেনের সঙ্গে বসে থাকতে পারি।
সেই সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরেছিলাম অভ্যেসে। পিতামহের শাসন, রাতের খাবার নিষিদ্ধ হওয়ার আদেশে একটুও বিচলিত হইনি। কাউকে বলা যাবে না, যায় না, আমার প্রাপ্তির কথা। বইয়ের পাতা থেকে যিনি উঠে এলেন আর সিনেমার পর্দা থেকে যিনি নেমে এলেন তারা তখন একাকার। আমার পরিচিত কোনও মেয়ে ওর ধারে কাছে আসে না। নীপার কথা মনে এল। না, নীপাও না। নীপা অনেকটা রেললাইনের মতো, ঠিকঠাক ছুটে যায়। আর আমার মনে যে এল সে জলযানের মতো, ঢেউ ভেঙে ভেঙে, ঢেউ গড়ে গড়ে, বেঠিকের খুশি ছড়ায়।
তখন আমি গৃহ ও লাইব্রেরিমুখী। স্কুলের বাইরে অন্যজীবন বাতিল। বন্ধুরা বিস্মিত। তিস্তার চরের কাশবনে লুকিয়ে সিগারেট খাওয়ার গোপন আনন্দ আমাকে একবিন্দুও টানছে না। পাশের বাড়ির মেয়েটি সম্পর্কে কোনও কৌতূহল তৈরি হচ্ছে না।
সুনীলদা হেসে বললেন, ‘তোমার কী হল বলো তো?’
আমি হকচকিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, ‘নীহার গুপ্ত, শরদিন্দু পড়তে না পড়তেই শেষের কবিতা পড়লে। গোরা যেদিন নিলে তার পরের দিন ফেরত দিলে। বুঝলাম হজম করতে পারনি। এখন দেখছি সেসব ছেড়ে একটার পর একটা জীবনানন্দের বই নিয়ে যাচ্ছ। একদম বদহজম হয়ে যাবে যে।’
ভালো না লাগায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কেন?’
‘জীবনানন্দকে বুঝতে হলে শুধু হৃদয় দিয়ে নয়, সঙ্গে শিক্ষারও দরকার। যেমন, মুখ তার শ্রাবন্তীর কারুকার্য। ব্যাপারটা কী তা না জানলে রস গ্রহণ করতে পারবে না। সেই জানাটা শিক্ষা ছাড়া সম্ভব নয়।’ সুনীলদা বললেন।
তর্ক করিনি। কিন্তু আমার তো স্কুলের পড়াশুনা নিশ্চয়ই অতি সামান্য তবু আমি আমার মতো তো জীবনানন্দের কবিতাকে বুঝতে পারছি। যেমন, এর আগের বার নিয়ে গিয়েছিলাম যে বইটি তার নাম, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি।’ তার একটি কবিতা কি আমি কোনওদিন ভুলতে পারব?
‘তুমি তো জানো না কিছু–না জানিলে,
আমার সকল গান তবুও তোমাকে লক্ষ্য করে;
যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে–
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে।’
একটুও বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। বরং মনের মধ্যে অদ্ভুত একটি প্রতিমা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আমি বিশ্বাস করছিলাম এই কবিতাটিও জীবনানন্দ বনলতা সেনকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন।
হঠাৎ মনে হল, এরকম একজন মহিলাকে কবি নিশ্চয়ই দেখেছেন। তিনি হয়তো এই বাংলায় আছেন। কোথায় আছেন। তাঁকে না দেখে বেঁচে থাকার কোনও মানেই হয় না। কিন্তু কোথায় গেলে পাব তাকে?
তখন মনে হত, ‘সারাদিন মিছে কেটে গেল; সারারাত বড্ড খারাপ।’ স্কুলের টিফিন-ছুটিতে নিশীথ আমার হাত ধরে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘সত্যি বল তো। তুই প্রেমে পড়েছিস, না?’
হ্যাঁ, আমার প্রথম প্রেমিকার নাম বনলতা সেন।
৩
স্কুলের শেষ ধাপে উঠেই আমাদের মধ্যে প্রথম প্রেমে পড়েছিল স্বপন। কল্পনায় প্রেম নয়, রীতিমতো রক্তমাংসের কৈশোর পার হব হব মেয়ের সঙ্গে। কীভাবে প্রেমের সূত্রপাত হয় তা কিছুতেই বলতে চায়নি সে। কাঁধ নাচিয়ে বলত, ‘হয়ে গেল।’
এই প্রেমে পড়া বোধহয় একধরনের ছোঁয়াচে অসুখ। অসুখই কারণ, দেখেছি, সুখের চেয়ে অসুখেই বেশি ভোগে অসুস্থরা। স্বপন প্রেম করছে জানার কয়েকদিনের মধ্যে নিশীথ জানাল তার জীবনেও এক কিশোরী এসে গিয়েছে। ওদের পথে হাঁটল তপনও। এই যে জীবনে একজন এসে গেল এর মানে এই নয়, নির্জন নদীর ধারে অথবা কোনও পার্কে পাশাপাশি বসে হাতে হাত রেখে ‘তুমি আছ আমি আছি’ বলা কারণ তার কোনও সুযোগই ছিল না। জলপাইগুড়ির অবিবাহিতা মেয়েদের অভিভাবক ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল শুধু স্কুল বা কলেজের জন্য। বাড়িতে অবসর নেওয়া কোনও অভিভাবক থাকলে তাঁকে দেখা যেত ছাত্রীটির পিছন পিছন যেতে। আমাদের ওই বয়সে কোনও রেস্টুরেন্টে শহরের মেয়েদের খেতে দেখিনি। মফস্বল থেকে যাঁরা আসতেন তারা সপরিবারে সেখানে ঢুকতেন। একটি বা দু-তিনটি মেয়ে রেস্টুরেন্টে বসে খাবার খাচ্ছে এই দৃশ্য কল্পনার অতীত ছিল। সেক্ষেত্রে প্রেমিকার সঙ্গে প্রেমিকের দেখা করার সুযোগ বড় কম ছিল। ছেলেবেলা থেকে বাড়িতে যাতায়াত থাকলেও একটু বড় হলে অভিভাবকরা পাহারায় সামনে থাকতেন।
তবু প্রেম হত। অবশ্য যদি তাকে প্রেম বলা যায়। যেমন স্বপন, নিশীথ অথবা তপনের হয়েছিল। এদের প্রেমিকারা রিকশায় স্কুলে যেত। বাড়ি থেকে ঠিক করা মাসের রিকশাওয়ালা। বর্ষাকাল তো বটেই, চৈত্র-বৈশাখেও রিকশায় হুড তোলা থাকত। রিকশা স্কুলের সামনে থামলে তিনি যখন গেটমুখী হতেন তখন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো ও ঠোঁটে মোনালিশার হাসি ফুটলে পৃথিবীটা আচমকা অন্যরকম হয়ে যেত। ক্রমশ রিকশা থামতে লাগল গেট থেকে দূরে, একটু একটু করে সেই দূরত্বটা বাড়ত। তখন রিকশাওয়ালাকে খুশি করতে পারলে স্বপ্ন সার্থক। তার হাত দিয়েই চিঠি আসাযাওয়া করত।
স্বপন প্রেমে পড়তেই আমাকে বলল, ‘ছুটির পর রোজ রোজ লাইব্রেরিতে যাওয়া তোর চলবে না। বন্ধুদের কথা কেন ভাবছিস না?’
অবাক হয়েছিলাম, ‘কী বলছিস, বুঝতে পারছি না।’
‘আজ স্কুল ছুটির পরে তুই আমাদের সঙ্গে তিস্তার চরে যাবি। প্লিজ।’
অতএব যেতে হল। কাশবনের মধ্যে তিস্তার জলের পাশে সেই অপরাহ্ণে আমি জানতে পারলাম স্বপন প্রেমে পড়েছে। সেই প্রথম একজন প্রেমিককে সামনাসামনি দেখতে পেলাম। এতদিনের চেনা স্বপন এখন অচেনা, যেন নন্দনকানন থেকে নেমে এসেছে। পকেট থেকে একটা খাম বের করে সে এগিয়ে ধরল, ‘পড়।’
খাম থেকে চিঠি বের করলাম। কোনও সম্বোধন নেই, কয়েকটা লাইনের পর কোনও নাম নেই। লাইনগুলো এইরকম, ‘অমন চোখে কী দ্যাখো তুমি? মনের কথা কাগজে লিখলে তো পড়ে জানতে পারি। জানা হলে আমারটাও জানাতে পারি।’ পড়ে শরীরে শিহরণ এল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কার লেখা? কী নাম?’
স্বপন বলল, ‘ওই কাগজে কি কারও নাম লেখা অছ? নেই।’
‘এটা আমাকে পড়তে দিলি কেন?’
‘দ্যাখ, যে লিখেছে সে আমার মনের কথা জানতে চেয়েছে। তুই লিখে দে।’
‘আমি?’ অবাক হয়ে গেলাম।
‘শোন, আমাদের মধ্যে তুই সবচেয়ে বেশি বাইরের বই পড়িস, লাইব্রেরিতে যাস। যেসব বই পড়েছিস তা থেকে ভালো ভালো লাইন তুলে নিজের মতো করে লিখে দে। লেখার সময় ভাববি, তুই স্বপন হয়ে গিয়েছিস।’
আমি মাথা নাড়ছি দেখে নিশীথ বলল, ‘স্বপন তোকে হাফ সিগারেট খাওয়াবে।’
তপন বলল, ‘আমি হেমন্তর গান গাইছি, তোর লেখার সময় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক।’
বাড়িতে নিয়ে এলাম কাগজটা। সন্তর্পণে। পিতামহ বা বড়পিসিমা দেখলে আমার কপালে যা জুটবে তা অনুমান করে ওটাকে অ্যালজেব্রা বইয়ের ভেতর লুকিয়ে রাখলাম। রাতের খাওয়া শেষ হলে দরজায় ছিটকিনি তুলে দিয়ে কাগজটাকে বের করলাম। ‘মনের কথা লিখলে তো পড়ে জানতে পারি।’ বুঁদ হয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ! যে লিখেছে সে যে মেয়ে তা হাতের লেখা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। কীরকম দেখতে সেই মেয়ে, তাকালে কেমন লাগে? তখনই খেয়াল হল রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য অথবা জীবনানন্দের বনলতা সেন সম্পর্কে ওদের স্রষ্টারা যত বৰ্ণনাই করে থাকুন না কেন পড়ার পর মনে মনে যে চেহারা তৈরি হয়ে যায় তা পাঠকের নিজের তৈরি। এই চিঠির লেখিকা কি সুচিত্রা সেনের মতো তাকাতে পারে নাকি নীপার মতো গম্ভীর?
কিন্তু তখনই ভাবনার সূতো গুটিয়ে নিলাম। এই মেয়েটি, যত সুন্দরীই হোক, চিঠি লিখেছে স্বপনকে উদ্দেশ্য করে। তাই তার সম্পর্কে যা কিছু ভাবার তা স্বপনই ভাববে। আমার ভাবা খুবই অনৈতিক। কিন্তু কী লিখি? হঠাৎ শেষের কবিতার লাইন মনে এল। সাদা কাগজে সুন্দর লিখে ফেললাম, ‘পথ যদি বাঁধে বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দু’জন চলতি হাওয়ার পন্থী।’ মনে হল, আর কিছু লেখার দরকার নেই, অল্পকথায় অনেক কথা বলা হয়ে গেল।
পরদিন স্কুলে গিয়ে স্বপনকে কাগজটা দিতেই সে বলল, ‘একি, এত কম লিখলি? আমি যে ওর সঙ্গে যুগ যুগ ধরে থাকতে চাই তা লিখলি না?’
নিশীথ লেখাটা পড়ে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল, ‘সমরেশ ঠিক করেছে। দ্যাখ, এখন তোর মেয়েটাকে ভালো লাগছে, পরে তো নাও লাগতে পারে। সমরেশ তোর কেটে পড়ার রাস্তাটা খোলা রেখে দিয়েছে।’
‘মানে?’ স্বপন বলল কিন্তু আমি অবাক হলাম অনেক বেশি।
‘দ্যাখ, এই যে বন্ধনহীন গ্রন্থি, এর মানে কী? গ্রন্থি মানে তো বাঁধন কিন্তু তার কোনও বন্ধন নেই। কাঁঠালের আমসত্ব। আর চলতি হাওয়ার পন্থী মানে যেমন হাওয়া বইবে তেমনভাবে তোরা চলবি। যুগ যুগ একসঙ্গে থাকব লিখে না থাকলে তোকে ফাঁসাতে পারে। চুক্তিভঙ্গ করা অপরাধ।’
আমি এইসব ভেবে লাইনদুটো লিখিনি। শোনার পর মনে হল, অমিত আর লাবণ্য উপন্যাসের শেষে বিদায় জানিয়ে যে যার মতো আলাদা হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ কি তার ইঙ্গিত আগেই রেখে গিয়েছেন? কিন্তু বিকেলে বাবুপাড়া পাঠাগারে গিয়ে মনে হল আমি নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ভুল ভেবেছি। তিনি নিশ্চয়ই পাঠ্যবই-এর দাদুমার্কা কবি-লেখক নন, তাঁর লেখার মধ্যে যখন দু’রকম অর্থ করা লাইন থাকে তাহলে তিনি অবশ্যই রসিক মানুষ ছিলেন। সুনীলদাকে বললাম, আমি রবীন্দ্রনাথের বই পড়তে চাই।’
যেন আকাশ থেকে পড়লেন তিনি, ‘সর্বনাশ! ফুল দস্যুমোহন টু রবীন্দ্রনাথ। পুরো রবীন্দ্রনাথ পড়ে বুঝতে তোর পাঁচ বছর লেগে যাবে। শুধু উপন্যাস বা কবিতা নয়, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ, রম্যরচনা আর চিঠিপত্র। রবীন্দ্রনাথকে জানতে হলে সবগুলোই পড়া উচিত।’
আমি ঢোক গিললাম। আমার অবস্থা দেখে বোধহয় করুণা হল সুনীলদার, ‘আচ্ছা, প্রথমটা এই বইটা দিয়ে শুরু কর।’ সঞ্চয়িতা নিয়ে এলাম বাড়িতে। শার্টের নীচে লুকিয়ে নয়, হাতে ঝুলিয়ে। পিতামহ এবং বড়পিসিমা বারান্দায় বসে গল্প করছিলেন। দেখলাম বড়পিসিমা ইশারা করছেন বইটাকে লুকিয়ে ফেলার জন্য। পিতামহ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী বই ওটা?’
এগিয়ে দিলাম। বইয়ের পাতা উল্টিয়ে চোখ রাখতেই তাঁর মুখে বেশ প্রসন্নভাব ফুটে উঠল, ‘যাক, এতদিনে তোমার চৈতন্য হয়েছে। যদিও কতটা মন দিয়ে পড়বে তাতে আমার সন্দেহ আছে।’
ঘরে ফিরে মনে হল যেহেতু এটা কবিতার বই তাই পিতামহ ছাড়পত্র দিলেন, গল্প উপন্যাস হলে দিতেন না। কয়েকদিন আগেও বলেছেন, ‘নাটক, নভেল পড়ে সময় নষ্ট কোরো না।’ কিন্তু কবিতার প্রতি তাঁর যে মমত্ব আছে তাও তো কখনও বুঝিনি। বুঝলাম রবীন্দ্রনাথের এই বইটির জন্য অনুমতি পাওয়া গিয়েছে।
আমি সঞ্চয়িতা পড়লাম স্বপনের জন্য। ভালো ভালো লাইন পেলেই এটা খাতায় টুকে রাখতে লাগলাম। দু’দিনেই ওটা ফেরত দিয়ে গীতবিতান নিয়ে এলাম। আর, প্রত্যেক পাতায় দারুণ দারুণ লাইন। কবিতা বা গানের বাকি অংশ ভুলে যাচ্ছি তৎক্ষণাৎ কিন্তু হাঁসের মতো শুধু দুধটুকু খাতার পাতায় লিখে রাখছি।
স্বপন জানাল, চিঠির জবাব এসেছে। পড়লাম। একটাই লাইন, ‘আমি তোমার মর্মে কীরকম আছি?’
চিঠির জবাব লিখতে একটুও দেরি হল না। লিখলাম, ‘এসেছিলে তবু আসো নাই, জানায়ে গেলে।’ তারপর মনে হল এই লাইনটাকে একটু বদলে দেওয়া যাক। আরেকটা সাদা কাগজে লিখলাম, ‘এসেছ তবু আসোনি, তোমার লেখা জানিয়ে দিল।’ প্রথম লেখাটা আমি ছিঁড়ে ফেলায় বন্ধুরা দেখতে পায়নি, দ্বিতীয়টা পড়ে প্রশংসার বন্যা বয়ে গেল, ‘কী লিখেছ গুরু। ফাটাফাটি।’
তার পরদিন নিশীথের অনুরোধে আমাকে আবার যেতে হল. ওই তিস্তার চরে। নিশীথ ভণিতা না করে জানাল তার প্রেমে একজন পড়েছে কিন্তু সে ঠিকঠাক পড়েনি। ওর ভাষায় মেয়েটা কাবেরী বসুর মতো দেখতে কিন্তু তার বাবা মহা খিটকেল আর মা হেভি দজ্জাল। ওই দুজনের ভয়ে সে পা বাড়াচ্ছে কিন্তু ফেলতে পারছে না। তবু মেয়েটি যখন চিঠি লিখেছে তখন তো একটা জবাব দেওয়া উচিত। নিশীথ বলল, তুই লিখে ছো
নিশীথকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তোর প্রেমিকার নাম বল! ‘
সে মাথা নেড়েছিল, ‘নামে কী এসে যায়। গোলাপকে যে নামেই ডাকবি সে সুগন্ধ ছড়াবেই।’ তারপর হেসেছিল, ‘তুই কি স্বপনের প্রেমিকার নাম জানিস?’
স্বীকার করতেই হল, জানি না।
‘তাহলে আমারটাও অজানা থাক।’ নিশীথ বলেছিল।
নিশীথের পরে তপনেরও প্রেমিকা এসে গেল। প্রতি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ থেকে কোটেশন দিতে দিতে স্টক শেষ হয়ে যাচ্ছিল। কারণ সব লাইন তো কাজে আসছিল না। যা জানতে চাইছে তার সঙ্গে মেলে এমন লাইন দরকার। লাইব্রেরিতে গেলাম। অনেকদিন পরে নীপার সঙ্গে দেখা। সে চোখ বড় করে বলল, একি শুনলাম? তুমি নাকি রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ছ?’
‘তাতে অবাক হওয়ার কী আছে?’
রহস্যময়ীর হাসি হাসল সে। তারপর বলল, ‘আজ কী বই নিচ্ছ?’
‘ভাবছি। তুমিই সাজেস্ট করো।’
‘কবিতা?’
‘না, গল্প উপন্যাস।’
‘তাহলে বঙ্কিমচন্দ্র পড়ো।’
‘ওঁর লেখা কোন উপন্যাসে শেষের কবিতার মতো দারুণ দারুণ লাইন আছে যা পড়লেই খুব ভালো লাগে?’ জিজ্ঞাসা করলাম।
‘ও বাব্বা! তুমি ভালো লাইন পড়তে চাও, ভালো উপন্যাস নয়! যাযাবরের দৃষ্টিপাত-এর কথা কি বলেছি কখনও? দৃষ্টিপাত পড়ো।’ কথাগুলো বলেই চলে গেল নীপা।
আমি বলতেই পারলাম না, যাযাবরের দৃষ্টিপাত আমাকে আগেই পাগল করেছে। আমার খাতার পাতা যাযাবরের কোটেশনে ভরে গিয়েছে। আঃ, কী সব জ্বলজ্বলে লাইন। আবেগের বেগে ভেসে একটার পর একটা চিঠির উত্তর দিতে দিতে মনে হত আমি আমারই প্রেমিকাকে চিঠিগুলো লিখছি।
একসময় যখন সব কোটেশনই ফুরিয়ে গেল, আবার শুরু হল নতুন বইয়ের সন্ধান। যে উদ্দেশ্যে সন্ধান চলেছিল তা থেমে গেল চিঠিগুলো নিশীথের প্রেমিকার বাবার হাতে পড়ার পরে।
৪
আমি তখন ষোল। স্কুলের শেষ পরীক্ষা দিয়ে পৃথিবীর দখল নেওয়ার স্বপ্ন দেখছি। সেসময় কত চমৎকার কল্পনা করে নিয়ে তার ভেতরে বাস করতাম। কৈশোরে যখন প্রথম রেলগাড়ি দেখেছিলাম তখন গিয়েছিলাম দাদামশাইয়ের বাড়িতে মায়ের সঙ্গে। দাদামশাইয়ের বদলির চাকরি ছিল। ঘাঁটি ছিল নদিয়ার গেদে গ্রামে। জলপাইগুড়ি থেকে তার দূরত্ব অনেক। অতি-শৈশবে সেখানে গিয়েছিলাম যার স্মৃতি প্রায় সাদা। দাদামশাই যখন জলপাইগুড়ি জেলার ভোটপট্টি স্টেশনের মাস্টার হয়ে এলেন তখন আমার অবস্থা অপুর মতো। দুটো ট্রেন লাইন, একটা স্টেশন ঘর, পিছনে স্টাফ কোয়াটার্স আর দুদিকে আদিগন্ত মাঠ। বক আর ফিঙে আড্ডা মারত গোটা দিন। গিয়ে যেদিন পৌঁছেছিলাম সেদিন আকাশে কালচে মেঘ সেঁটে ছিল। হারাবার ভয়টয় নেই বলে আমি তখন সম্পূর্ণ স্বাধীন। রেললাইনের ওপর ছুটছি আর ফিরছি। হঠাৎ লাইনে কাঁপুনি শুরু হল। তারপর তাকিয়ে দেখি ভয়ঙ্কর আওয়াজ তুলে আকাশে কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে ছুটে আসছে দৈত্য। এক ছুটে প্ল্যাটফর্মের ধারে গিয়ে দেখলাম দাদামশাইয়ের এক কর্মচারী পতাকা নাড়ছে। সেকারণেই ওই বিশাল দৈত্য যেন রূপকথার কাঠির স্পর্শ পেয়ে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেল। বুঝলাম এরই নাম রেলগাড়ি। দুতিনজন নেমে এল তার পেট থেকে, এক দুজন উঠল। যাকে দৈত্য মনে হয়েছিল সেটাই যে ইঞ্জিন বুঝে মুগ্ধ হয়ে দেখলাম, একজন রোগা মানুষ মাথায় ফেট্টি বেঁধে আমার দিকে করুণার চোখে তাকাল। তারপর হাত তুলে কিছু টেনে ধরতেই তীব্র হুইসল বেজে উঠল এবং রেলগাড়ি চলতে শুরু করল। সেই মুহূর্তে আমি স্বপ্ন দেখলাম, বড় হয়ে ওই লোকটার মতো রেলগাড়ির ড্রাইভার হব। এইরকম একটা ইঞ্জিনে চেপে ছুটে যাব পৃথিবীর সব রেললাইন দিয়ে। প্রিয়জন, যারা, তখন চায়ের বাগানে থাকত, যারা কাছাকাছি রেললাইন নেই বলে রেলগাড়ি দেখেনি তাদের রেলগাড়ি দেখাব। তখনও আমি সেই আর্তি শুনিনি, ‘অপু, আমাকে রেলগাড়ি দেখাবি?’
বাবুপাড়া পাঠাগারকে আমার স্বপ্নের সমুদ্র বলে মনে হত। হাত বাড়াও আর মুঠোমুঠো স্বপ্ন তুলে নাও। তখনও আমি বঙ্কিম-শরৎ- রবীন্দ্রনাথ ছুঁয়ে দেখিনি। পাঠাগারের আলমারিতে সাজানো বইগুলো দেখলেই মনে হত ওইসব বই বয়স্কদের জন্য, যাঁরা গভীর ভাবনাচিন্তা করেন। লাইব্রেরিয়ান সুনীলদা মজা করে বলতেন, ‘পুকুর ডোবায় সাঁতার কেটে যে কী সুখ হচ্ছে তোর! এবার নদীতে নাম, নইলে সাগরে সাঁতার কাটবি কী করে?’
আমার তখন বয়ে গিয়েছে সাগরে সাঁতার কাটতে। তখন লাইব্রেরিতে বসে বিভিন্ন পত্রিকার পাতা ওল্টাতাম। জেনে গিয়েছি ওই ত্রিমূর্তির ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে কল্লোল পত্রিকার লেখকরা নতুন ধরনের লেখা লিখেছেন। আমার সেসবে আগ্রহ নেই। একদিন, নাম মনে নেই এখন, পত্রিকার পাতায় ছাপা ছোট গল্প পড়ে ফেললাম। একটি মানুষ সভ্যজগৎ থেকে অনেক দূরে গভীর জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ের গুহায় বাস করত। একাই। নদীতে মাছ ধরত। তাই আগুনে ঝলসে খেত। তার সঙ্গে জঙ্গলের বানরদের খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল। কোনও ভয়ঙ্কর জন্তু সেদিকে এলে বানররা চিৎকার করে সতর্ক করত। সেই মানুষটি যখন বৃদ্ধ হয়ে মারা গেল তখন বানররা তার মৃতদেহ ঘিরে চুপচাপ বসেছিল।
কোনও গোয়েন্দা বা রহস্যগল্প নয় কিন্তু পড়ার পর মন খারাপ হয়ে থাকল অনেকক্ষণ। তারপর রাতে স্বপ্ন দেখলাম। একটা উঁচু পাহাড়ের গুহায় আমি আছি। গুহার সামনে চাতাল, ওপর থেকে ঝরনার একটা ধারা গুহার পাশ দিয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। সেই জলে স্নান করি, খাই। আশ্চর্য, গুহার ভেতরে রান্নার ব্যবস্থাও আছে। জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়ে রান্না করি। নীচের নদী থেকে মাছ ধরে নিয়ে আসি। আর খুব স্বাভাবিক
ব্যাপারের মতো আমার গুহায় প্রচুর চাল ডাল আলু এবং তেল রয়েছে। আছে থালা গ্লাস আর কড়াই। ওখানে গরম পড়ে না। চাতালে বসলে অনেকটা দূরের রাস্তা দেখা যায়। সারাদিনে দুটো ঘোড়ায় টানা গাড়ি সেই রাস্তা দিয়ে পড়ি কি মরি করে ছুটে যায়। আমার সেই চরাচরে অজস্র পাখি, পাহাড়ি ছাগল আর শেয়াল ঘুরে বেড়ায়। স্বপ্ন ভাঙার পর আবিষ্কার করলাম আমার ওই রাজত্বে কোনও বানর ছিল না। কেন ছিল না তা জানি না।
স্বপ্নটা মনের ভেতরে গেঁথে গেল। জেগে জেগেও স্বপ্নটা সাজাই যখন একা থাকি। ক্রমশ স্বপ্নটা বড় হতে থাকে। অনেক ডালপালা গজায়। আর তার মধ্যে আমি বেশ আমেজ নিয়ে থাকি। একটা বিষয় লক্ষ করার মতো, আমার স্বপ্নে কোনও নারী আসছে না। অথচ সুন্দরীদের দেখতে আমার বেশ ভালোই লাগত।
পরীক্ষার ফল বের হওয়ার ক’দিন আগে নীপার সঙ্গে পাঠাগারে দেখা। হেসে বলল, ‘অনেকদিন দেখিনি। আছ কেমন!’
‘ভালো। রেজাল্টের আশায় আছি।’ বললাম।
‘হ্যাঁ। আমিও। রেজাল্ট পেলেই কলকাতায় যেতে হবে ভর্তি হতে।’
‘কলকাতার কলেজে পড়বে?’
‘হ্যাঁ। তুমি?’
‘এখনও ঠিক হয়নি। দাদু বলেছেন ভালো রেজাল্ট না হলে জলপাইগুড়িতেই পড়তে হবে। এ সি কলেজে।’ তারপর ওর হাতে বই দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী বই?’
‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শুনেছ?’
‘শুনেছি। পড়িনি।’
‘অশিক্ষিত।’ বলেই হেসে ফেলল নীপা, ‘আজে বাজে বই পড়ে কীভাবে সময় নষ্ট করেছ তুমি। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী না পড়লে তাকে আমি বাঙালি বলে ভাবব না। কিন্তু এটা পথের পাঁচালী নয়।’
অশিক্ষিত শব্দটি জামায় ময়লা লাগার মতো মনে লেগে গিয়েছিল। থমকে গিয়েছি দেখে নীপা বলল, ‘এই বইটা পড়। আমি ফেরত দিচ্ছি, তুমি নিয়ে যাও।’
বইটি আমার হাতে দিল নীপা। নাম পড়লাম, ‘চাঁদের পাহাড়।’
সেদিন বাবুপাড়া পাঠাগারের সামনে দাঁড়িয়ে নীপা আমাকে কিছু তথ্য দিল। বিভূতিভূষণ, ওর মতে, রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলাভাষায় প্রথম তিনজন লেখকের একজন। গ্রামের মানুষ, অত্যন্ত সরল জীবনযাপন করতেন। তাঁর লেখা পড়লে মনে হবে ছবি দেখছি। বাংলার জল-মাটি– ঘাসের গন্ধ যেন লেখার মধ্যে ছড়িয়ে থাকে। কখনওই বিদেশে যাননি। তাঁর চাহিদাও খুব কম ছিল। কিন্তু এই মানুষটির কল্পনাশক্তি কী অসাধারণ ছিল তার প্রমাণ হল ‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাস। আফ্রিকার পটভূমিতে একটি বেকার বাঙালি তরুণকে নিয়ে গিয়ে এই লেখা যখন লিখেছিলেন তখন অনেক শিক্ষিত বাঙালি সেখানকার ভুগোল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। বিভূতিভূষণ জাতীয় গ্রন্থাগারে দিনের পর দিন গিয়ে পড়াশুনা করে তথ্য নিয়ে কল্পনার ওপর নির্ভর করে যে উপন্যাস লিখলেন তার বাস্তবতা পরবর্তীকালেও কেউ অস্বীকার করতে পারেনি। পড়লে মনে হবে লেখক নিজে ওই অঞ্চলে গিয়ে দেখে লিখেছেন।
রিক্সা নিয়ে নীপা চলে গেল।
এই প্রথম আমি কোনও লেখকের ব্যক্তিগত খবর পেলাম।
সেই রাতে চাঁদের পাহাড় পড়তে পড়তে আমি শংকর হয়ে গেলাম। কী অসাধারণ টান কাহিনীর। কোনও লেখক ওই জায়গাগুলো না দেখেও এমন বাস্তব লেখা লিখতে পারে তা বিশ্বাস করা কঠিন। রহস্যের টানে বই শেষ করে যখন ঘুমাতে গেলাম তখন মধ্যরাত।
সেই রাতে স্বপ্ন দেখলাম আমি একটি ফ্ল্যাগ স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। চারধারে কোনও মানুষ নেই। বুনোঝোপ আর কাঁটাগাছ ছড়ানো মাঠ দুধারে। দিনে দুটো ট্রেন আসে যায়। সেই ট্রেনে আমার জন্য জল, চাল, ডাল, আলু আসে। স্টেশন মাস্টারের জন্য একটা বন্দুক দিয়েছে সরকার। সেটার গায়ে জং ধরেছে। সন্ধে নামলেই কাছে দূরে বন্যজন্তুর হাঁকডাক শুরু হয়ে যায়। তখন দরজা বন্ধ করে লণ্ঠনের আলোয় ডায়েরি লিখি।
আমি যেন শংকর হয়ে গেলাম। আশ্চর্য, এই স্বপ্নেও কোনও নারী নেই। কিন্তু এক পূর্ণিমার রাতে যখন আকাশ মাতিয়ে গোল চাঁদ আমার দিক তাকাল তখনই ঘুম ভেঙে গেল!
চাঁদের পাহাড়ের রোমাল আমার সারাজীবনের পাথেয় হয়ে গেল।
পরীক্ষার ফল বেরবার আগের দিন নিশীথ আমার কাছে বন্ধুদের নিয়ে এল। সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। প্রেমিকাদের কাছে ওদের হয়ে আমি যেসব প্রেমপত্র লিখেছিলাম তার কয়েকটা অভিভাবকদের হাতে পড়েছে। তাঁরা ক্ষেপে গিয়েছেন খুব। বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে যখন শাসিয়েছেন তখন ওরা অস্বীকার করেছে, বলেছে ওগুলো ওদের লেখা নয়। তখন হাতের লেখার পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। দেখা গিয়েছে হাতের লেখার মধ্যে পার্থক্য আছে। তখন চাপ দেওয়া হয়েছে কে এই চিঠি লিখেছে তার নাম বলার জন্য। বন্ধুরা হলফ করে বলল, তারা আমার নাম বলেনি।
নিশীথ বলল, ‘ভুলটা তুই করেছিস।’
আমি অবাক, ‘আমি? তোরাই তো আমাকে লিখতে বলেছিলি।’
‘বালছিলাম। কিন্তু তুই তোর মতো করে লিখলি কেন?’
‘আমি তো আমার মতোই লিখব।’
নিশীথ বলল, ‘ওটাই তো ভুল করেছিস। তুই যদি রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা নকল করে লিখতিস তাহলে কোনও সমস্যা হত না।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘বুঝতে পারছি না।’
‘কে লিখেছে যখন জানতে চাইল তখন বলতে পারতাম রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন।’ নিশীথ হাসল, ‘ওঁর মতো হাতের লেখা তো আর কারও নেই।’
কথাটা কানের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করল। রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা দেখার ইচ্ছে প্রবল হল। কিন্তু শেষ-পরীক্ষার ফল প্রাপ্তির উত্তেজনায় সেই ইচ্ছে তখনকার মতো চাপা পড়ে গেল। ফাঁকি দিতে অভ্যস্ত একটি ছাত্রের যা নম্বর পাওয়া উচিত তার থেকে ঢের বেশি নম্বর পেয়ে যাওয়ায় অভিভাবকরা বাধ্য হলেন কলকাতায় পড়তে পাঠাতে। আমার বন্ধুদের মধ্যে অজিত ছাড়া বাকিরা রয়ে গেল জলপাইগুড়িতে, আনন্দচন্দ্র কলেজের ছাত্র হয়ে।
স্কটিশের বাংলা অনার্স আর সেন্ট পলসের ইকনমিক্স অনার্সের মধ্যে প্রথমটা বেছে নেওয়ায় বাবা লিখলেন, ‘তুমি তোমার ভবিষ্যতের সর্বনাশ করিতে চলিয়াছ, ফল তুমিই ভোগ করিবে।’
স্কটিশে তখন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন বিখ্যাত কয়েকজন। কনক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন রবীন্দ্রশিষ্য চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র। গুরুদাস ভট্টাচার্য, গৌরমোহন মুখোপাধ্যায়, বিপিনকৃষ্ণ ঘোষ, অলোক রায়-এর মতো পণ্ডিতজনের সামনে পড়ল সাহিত্যপাঠে বিভ্রান্ত এই তরুণ। গৌরমোহন স্যার প্রথমদিনেই জিজ্ঞাসা করলেন, সবাইকে ছেড়ে এই আমাকে, ‘ভারতচন্দ্র পড়েছ?’
কে ভারতচন্দ্র? বাবুপাড়া পাঠাগারে এই নামের কোনও লেখকের বই ছিল না। অতএব বাধ্য হলাম মাথা নেড়ে না বলতে। তিনি আদেশ দিলেন ‘ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর পড়বে। পড়ে এক হাজার শব্দের মধ্যে গদ্যে লিখে সামনের সপ্তাহে আমাকে দেখাবে।
কনকবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভানু সিংহের পদাবলী নিয়ে কথা বললে কে কে আমার সঙ্গে যোগ দেবে?’
কয়েকজন হাত তুলল। ভানু সিংহ নামের কোনও লেখকের কথা এই প্রথম শুনলাম। সুনীলদা কেন পাঠাগারে এঁদের বই রাখেননি কে জানে!
গুরুদাস ভট্টাচার্য বললেন, ‘ফুলমতি ও করুণার বিবরণ তোমাদের পড়া হয়ে ওঠেনি অনুমান করছি, কিন্তু বাংলায় অনার্স যারা নিয়েছে তারা আলালের ঘরে দুলালের পাতা উল্টে এসেছে বলে কি বিশ্বাস করতে পারি?’
অনেক হাত উঠল।
নিজেকে অশিক্ষিত বলে মনে হল। আমার পাশে বসা ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এসব বই কোথায় পাওয়া যায় ভাই?’
‘লাইব্রেরিতে পাবে। আজই কার্ড করিয়ে নাও।’
ক্লাসের পর লাইব্রেরির কার্ড করিয়ে ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর চাইলাম। লাইব্রেরির কর্মী বললেন, ‘আগে ওঁর মঙ্গলকাব্য পড়ো—।’
‘না না স্যার বলেছেন বিদ্যাসুন্দর পড়তে!’
ভদ্রলোক একটা বাঁধানো মোটা বই ইস্যু করলেন, ‘এতে সব আছে।’
বইটি হাতে নিয়ে দেখলাম পুরোটাই কবিতায় লেখা। যাওয়ার সময় ভদ্রলোককে বললাম, ‘দুর্দিনেই এটা শেষ করে শ্রীভানু সিংহের পদাবলী নিয়ে যাব।’
দেখলাম, ভদ্রলোকের চোখ রসগোল্লার মতো বড় হয়ে গিয়েছে।