গিরিজাসুন্দরী (রাজধানীর রাজবর্তে রমণী-হত্যা)
প্রথম পরিচ্ছেদ
পৌষমাস শীতের সময়, দিবা ১০টার সময় স্নান করিবার উদযোগ করিতেছি, এমন সময় সংবাদ পাইলাম, মাথাঘসা গলিতে গিরিজাসুন্দরী নাম্নী একটি রমণী হত্যা হইয়াছে। কে হত্যা করিয়াছে, এবং কি নিমিত্তই বা হত্যা করিয়াছে, তাহা এ পর্যন্ত স্থিরীকৃত হয় নাই। আরও সংবাদ পাইলাম, আমাকে এখনই এই অনুসন্ধানে গমন করিতে হইবে।
‘খুনি মোকদ্দমার অনুসন্ধানে গমন করিতে হইবে’ এইরূপ সংবাদ পাইলে, আর কালবিলম্ব করিবার অধিকার নাই। সুতরাং সংবাদ পাইবামাত্র ঠিকাগাড়ি আনিবার নিমিত্ত আমি একটি লোককে পাঠাইয়া দিলাম, ও সেই অবকাশে আমিও শীঘ্র স্নানের কার্য সম্পন্ন করিয়া লইলাম। যেমন গাড়ি আসিল, অমনি তাহাতে আরোহণ করিয়া মাথাঘসা গলি অভিমুখে প্রস্থান করিলাম। মাথাঘা গলিতে সারি সারি যে সকল দোতালা খোলার ঘর আছে, উহার একখানি ঘরের সম্মুখে লোকের ভিড় দেখিয়া স্থির করিলাম, এইস্থানেই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে। সেইঘরের যে কত নম্বর ছিল, অনেক দিবসের ঘটনা বলিয়া তাহা এখন আমার স্মরণ নাই; সুতরাং, এখন আর তাহা মনে করিয়া আনিতে পারিতেছি না, অথবা আমার সেই সময়ের ডায়রীখানিও খুঁজিয়া পাইতেছি না। যাহা হউক, সেইস্থানেই আমি আমার গাড়ি হইতে অবতরণ করিলাম। দেখিলাম, আমার অনুমান সত্য। জানিলাম, সেই বাড়ীর নিম্নের একখানি ঘরে একটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে।
আমি সেই ঘরের সন্নিকটে গমন করিলাম। দেখিলাম, সদর রাস্তার উপর সেই ঘরের দরজা; বাড়ির ভিতরের সহিত ঐ ঘরের কোনরূপ সংস্রব নাই। ঘরখানি নিতান্ত ক্ষুদ্র, দৈর্ঘ্যে ছয় হস্ত, এবং প্রস্থে পাঁচ হস্তমাত্র হইবে। সেই ঘরের ভিতর তৈজস পত্রের মধ্যে কেবল একখানি তক্তাপোষ, তাহার উপর একখানা পার্টি ও একটি বালিস। এই তক্তাপোষের নিম্নের আম্রকাষ্ঠের একটি বাক্স, এবং তাহার নিকটে একখানি ছোট জলচৌকির উপর কতকগুলি পিতল—কাঁসার বাসন। তক্তাপোষের সম্মুখে ঘরের দরজার নিকট একটু স্থান আছে, উহারই উপর একটি মৃতদেহ পড়িয়া রহিয়াছে। সেই মৃতদেহ একখানি মোটা চাদরের দ্বারা আবৃত। ঘরে রক্তের স্রোত বহিতেছে। কিন্তু ঘরের সম্মুখে রাজবর্থের উপর রক্তের চিহ্ন আরও যেন তাধিক বলিয়া বোধ হয়। মনুষ্যের দেহ হইতে এত রক্ত যে বাহির হইতে পারে, তাহা অনুমান করা সাধারণের পক্ষে নিতান্ত সহজ নহে। কিন্তু আমরা এরূপ অবস্থা অনেক দেখিয়াছি, সুতরাং আমরা সহজেই স্থির করিতে পারি যে, সুস্থকায়া যুবতীর শরীর হইতে এত রক্ত নির্গত হওয়া, নিতান্ত অসম্ভব নহে। যাহা হউক, বাহির হইতেই ঘরের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, আমি আস্তে আস্তে সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম।
গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম সত্য; কিন্তু এমন একটু রক্তবিহীন স্থান পাইলাম না, যে স্থানে কিয়ৎক্ষণ স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া ঘরের এবং মৃতদেহের অবস্থা উত্তমরূপে দেখিয়া লই। অগত্যা সেই রুধির-রঞ্জিত মৃত্তিকার উপর দাঁড়াইয়াই অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিলাম। যে মোটা বস্ত্রের দ্বারা সেই মৃতদেহ আবৃত ছিল, সেই বস্ত্র প্রথমে উঠাইয়া মৃতদেহটি উত্তমরূপে দেখিতে ইচ্ছা করিলাম। বস্ত্র উন্মোচিত হইলে দেখিলাম, ভয়ানক দৃশ্য! যে দৃশ্য সহজে দেখিতে পাওয়া যায় না, সহস্র মৃতদেহের ভিতর যাহা অনুসন্ধান করিলে একটিও পাওয়া যায় কি না সন্দেহ, ইহা সেইরূপ।
অনুসন্ধানের পূর্ব্বেই মনে করিয়াছিলাম, অগ্রে এই মৃতদেহের আপাদমস্তক উত্তমরূপে দেখিয়া, পরিশেষে যেরূপ ভাবে কার্য্য করিবার প্রয়োজন বোধ করিব, সেইরূপই করিব। কিন্তু বস্ত্র উন্মোচন করিবার পর দেখিলাম, আমার সেই ইচ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইলাম না। পা হইতে আরম্ভ করিয়া কেবল গলা পর্যন্তই দেখিতে পাইলাম, তাহার ঊর্দ্ধাংশ দেখা আমার অদৃষ্টে আর ঘটিয়া উঠিল না।
কেবল আমি নহি, সেইস্থানে যে সকল ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন, সকলের ভাগ্যই আমার ভাগ্যের সহিত মিলিল। কেহই উহার মস্তক দেখিতে পাইলেন না। দেখিবেন কোথা হইতে? মস্তক শরীর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে সত্য, কিন্তু কোথায় যে তাহা পড়িয়া আছে, তাহা কাহারও নয়নগোচর হইল না। সেই ঘরের ভিতর বা নিকটবর্তীস্থান সকলে বিশেষরূপে অনুসন্ধান করিয়া, সেই মস্তকের কোন সন্ধানই পাওয়া গেল না।
অবয়ব দেখিয়া বোধ হইল, এই রমণীর বয়ঃক্রম ত্রিশ বা পঁয়ত্রিশ বৎসরের অধিক হইবে না, কিন্তু অল্প হইলেও হইতে পারে। বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম, দেহ বলিষ্ঠ ও গোল, এবং কিঞ্চিৎ খৰ্ব্ব। দুই হাতে দুগাছি ডায়মণ্ড কাটা সোনার বালা আছে, পরিধানে সিমলার একখানি পরিষ্কার শাড়ী। দেহটি উল্টাইয়া উত্তমরূপে দেখিলাম, বক্ষে, পৃষ্ঠে, পার্শ্বে অনেকগুলি অস্ত্রের চিহ্ন, প্রায় সকল গুলিই সাংঘাতিক। ক্ষতস্থান দেখিয়া বোধ হয়, ভোজালী বা সেই প্রকার কোন তীক্ষ্ণ অস্ত্রের দ্বারা এরূপ সবলে আঘাত করা হইয়াছে যে, সেই প্রকার একটি আঘাত পাইলেই, যেমন বলিষ্ঠ স্ত্রীলোকই হউক না কেন, তাহাকে শমন-সদনে গমন করিতেই হইবে।
ঘরের ভিতর উত্তমরূপে খুঁজিয়া দেখা হইল, মস্তক ত পাওয়া গেলই না, ছুরিরও কোনরূপ চিহ্ন সেইস্থানে কেহই দেখিতে পাইলেন না। গৃহের যে সকল দ্রব্যাদি যেস্থানে ছিল, তাহার কিছুমাত্র বিপর্যয় ঘটিয়াছে বলিয়া বোধ হইল না, বা কোন দ্রব্য যে সেইস্থান হইতে অপহৃত বা স্থানান্তরিত হইয়াছে, তাহাও অনুমানে আসিল না।
ঘরের এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমি বাহিরে আসিলাম। যে পুলিস-কাচারী এই ঘটনার প্রথম সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তিনি বাহিরেই ছিলেন। কিরূপ অবস্থায় কাহাকর্তৃক ও কিরূপভাবে তিনি এ সংবাদ প্রাপ্ত হন, তাহা জিজ্ঞাসা করিলে তিনি কহিলেন যে, সেইদিবস দিবা নয়টার সময় যখন তিনি তাঁহার থানায় উপস্থিত ছিলেন, সেই সময়ে বাড়ীওয়ালী বামা বেওয়া থানায় গিয়া, তাঁহাকে সংবাদ প্রদান করে যে, তাহার বাহিরের ঘরের ভাড়াটিয়া গিরিজাসুন্দরীকে কে হত্যা করিয়াছে। গিরিজাসুন্দরী রামময়বাবুর বাড়ীতে চাকরাণীর কার্য্য করিত। সে দিন প্রাতঃকালে সে তাহার মনিবের বাড়ীতে কর্ম করিতে না যাওয়ায় তাহার মনিব রামময়বাবু স্বয়ং তাহার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত তাহার ঘরে প্রথম গমন করেন। তিনিই এইরূপ অবস্থা সৰ্ব্ব প্রথমে দেখিতে পাইয়া বাড়ীওয়ালী ও অপর অনেককেই কহেন। রামময়বাবুর কথা শুনিয়া সেই বাড়ীর এবং অপরাপর বাড়ীর অনেকেই আসিয়া এই অবস্থা দেখিতে পায়। পরিশেষে বামা থানায় গিয়া, এই সংবাদ প্রদান করে।
কর্ম্মচারীর নিকট এই অবস্থা অবগত হইয়া রামময়বাবুকে ডাকিলাম। রামময়বাবুও সেই সময়ে সেইস্থানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁহাকে বিশেষ করিয়া জিজ্ঞাসাবাদ করায় তিনি যাহা কহিলেন, তাহা বিশেষ মনোযোগের সহিত আমি শ্রবণ করিলাম; এবং এক এক করিয়া তাঁহার সমস্ত কথা আমি লিখিয়া লইলাম। তিনি যাহা বলিয়াছিলেন, তাহার সারমা এইরূপ :—“আমি এই মাথাঘসা গলিতেই থাকি। আমার জন্মস্থান এখানে নহে, কিন্তু চাকরির নিমিত্ত আমাকে এইস্থানেই থাকিতে হইয়াছে। আমি যে চাকরি করি, তাহাতে প্রায়ই ছুটি পাই না। কাজেই আমার সামান্য বেতন হইলেও, পরিবার নিকটে না রাখিলে চলে না, ও ছেলেটির লেখাপড়া হয় না। এইরূপ নানা কারণে আমাকে পরিবার লইয়া কলিকাতায় থাকিতে হইয়াছে। আমার স্ত্রী এবং দশ বৎসর বয়স্ক একটি পুত্র ভিন্ন অপর আর কেহই কলিকাতায় নাই। আমার স্ত্রীর শরীর বিশেষ সুস্থ নহে বলিয়া, তিনি সংসারের সমস্ত কার্য্য নিজে করিয়া উঠিতে পারেন না। সুতরাং অপারক হইলেও আমি এই চাকরাণী রাখিতে বাধ্য হইয়াছি। প্রায় দুই বৎসর পর্যন্ত এ আমার নিকট কর্ম্ম করিতেছে, কিন্তু রাত্রিকালে আমাদিগের বাড়ীতে থাকে না। রাত্রি নয়টা হইতে না হইতেই যেমন আমাদিগের শাহারাদি শেষ হইয়া যায়, সেও অমনি আপন বাসায় গমন করে, এবং পরদিবস প্রাতঃকালে আমাদের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হয়। আজ প্রাতে সে তাহার কর্মে না যাওয়ায়, তাহাকে ডাকিবার নিমিত্ত আমি তাহার বাসায় আসিয়াছিলাম। প্রায় একমাস পূর্ব্বে তাহার অসুখ হইয়াছে বলিয়া, সে আর একদিবস কর্ম্মে যায় নাই; সেইদিবস অনুসন্ধান করিয়া আমি তাহার বাসা বাহির করি, এবং জানিতে পারি যে, সে প্রকৃতই অসুস্থ হইয়াছিল। আজ আমি যখন তাহার বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন দেখিলাম, তাহার ঘরের দরজা বন্ধ। ভাবিলাম, সে তাহার ঘরের ভিতরেই আছে। এই ভাবিয়া তাহাকে ডাকিবার নিমিত্ত যেমন তাহার দরজায় ধাক্কা দিলাম, অমনি তাহার দরজা খুলিয়া গেল। বাহির হইতে “ঝি ঝি” বলিয়া ডাকিলাম। কিন্তু ঝির উত্তর না পাইয়া, যেমন ঘরের ভিতর প্রবেশ করিব ভাবিলাম, অমনি এই ভয়ানক দৃশ্য আমার সম্মুখে পড়িল। আমি ক্ষণকালের জন্য চেতনা হারাইলাম। তখন আমার কি করা কর্তব্য, তাহা ভুলিয়া গেলাম। ভাবিলাম, এখন এইস্থান হইতে পলায়ন করাই কর্তব্য। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবিলাম, আমি পলায়ন করিলে যদি সকলে আমারই উপর সন্দেহ করে, তাহা হইলে আমার কি দশা ঘটিবে? এই ভাবিয়া আমি বাড়ীওয়ালীকে ডাকিলাম, তাহার সহিত এই বাড়ীর অনেকেই আসিয়া এই অবস্থা দৃষ্টি করিল। দেখিতে দেখিতে পথে ভিড় জমিয়া গেল। পরিশেষে সকলের বিবেচনায় থানায় সংবাদ দেওয়া স্থির হইলে, বাড়ীওয়ালী গিয়া থানায় সংবাদ প্রদান করিল। ক্রমে আপনারা সকলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ইহাই আমি জানি, ইহা ব্যতীত আর কিছুই আমি অবগত নহি।”
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রামময়বাবু যাহা বলিলেন, তাহা বিশেষরূপে অবগত হইয়া পরিশেষে বামা-বাড়ীওয়ালীকে দুই চারি কথা জিজ্ঞাসা করিব বলিয়া তাহাকে ডাকাইলাম। সে আমার নিকট আগমন করিয়া যাহা কহিল, তাহার সমস্ত কথাই রামময়বাবুর কথার সহিত মিলিয়া গেল। তখন ভাবিলাম, হয় উভয়েই মিথ্যা কথা কহিতেছে, না হয়, উভয়ের কথাই প্রকৃত কিন্তু যেরূপভাবে রামময়বাবু আমার কথার উত্তর প্রদান করিলেন, তাহাতে যে তিনি প্রকৃত কথা গোপন করিতেছেন, তাহা কিন্তু আমার বোধ হইল না।
গিরিজাসুন্দরী সম্বন্ধে বামাকে আরও দুই চারি কথা জিজ্ঞাসা করিতে আমার ইচ্ছা হইল। কিন্তু আমার সেই ইচ্ছা পূর্ণ করিবার পূর্ব্বে দুই একটি সামান্য চিন্তার উপর আমার মন পড়িল। উহা নিতান্ত সহজ চিন্তা। তাহা এই :
১ম। ইহা আত্মহত্যা কি হত্যা? যখন মস্তক খুঁজিয়া পাইতেছি না, অস্ত্রের সন্ধান নাই, ঘরের নিকটস্থিত পথের উপর যখন রক্তের চিহ্ন রহিয়াছে, তখন পাগল ভিন্ন অপর কেহই ইহাকে আত্মহত্যা বলিতে পারে না। সুতরাং এ হত্যা।
২য়। যদি হত্যাই হয়, তাহা হইলে এ হত্যার উদ্দেশ্য কি? চুরি করা এই হত্যার উদ্দেশ্য বলিয়া অনুমান হয় না। গিরিজাসুন্দরী নিতান্ত দরিদ্র বিধবা স্ত্রীলোক; দাস্যবৃত্তি করিয়া সে জীবনধারণ করে। ঘরে মূল্যবান দ্রব্য কিছুই নাই, যাহা কিছু সামান্য দ্রব্য আছে, তাহারও কিছুমাত্র যে স্থানান্তরিত হইয়াছে, তাহা বোধ হয় না। কিন্তু হস্তে সোণার বালা রহিয়াছে। চুরি করাই যদি এই হত্যার উদ্দেশ্য হয়, তাহা হইলে বালাদ্বয় অপহৃত হইল না কেন?
৩য়। বালা আসিল কোথা হইতে? বাড়ীর সকলেই এবং রামময়বাবু কহিতেছেন, গিরিজাসুন্দরী বিধবা। তাহার হাতে সোণার বালা কেহ কখন দেখে নাই, এরূপ বালা খরিদ করিবার সামর্থ্যও তাহার নাই। এরূপ অবস্থায় তাহার হস্তে সোণার বালা আসিল কোথা হইতে? অনেক চোরে হত্যা করিয়া দ্রব্যাদি অপহরণ করে, ইহাই এতদিবস দেখিয়া আসিতেছি। কিন্তু তাহার বিপরীত অর্থাৎ হত্যাকারী তাহার নিজের ঘর হইতে অলঙ্কার আনিয়া, যাহাকে হত্যা করিবে, তাহাকে তাহা পরাইয়া দিয়া, পরিশেষে হত্যাকাৰ্য্য যে সম্পন্ন করিবে, ইহা আমি স্বপ্নেও ভাবিতে পারি না।
৪র্থ। তবে কি মনোবিবাদসূত্রে এই হতভাগিনী হতা হইয়াছে? যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে এমন কোন লোক দেখিতে পাইতেছি না, যাহার সহিত গিরিজার বিশেষ মনোমালিন্য আছে। যদিচ কাহারও সহিত ইহার কোনরূপ শত্রুতা থাকিত, তাহা হইলে এই বাড়ীর এতগুলি লোক, কি তাহার বিন্দুবিসর্গও জানিতে পারিত না? আর মনোবিবাদ সূত্রে কেহ হত্যা করিলেই বা তাহার মস্তক লইয়া সে প্রস্থান করিবে কেন?
৫ম। হত্যার পর শৃগাল-কুকুরের দ্বারা তবে কি তাহার মস্তক অপহৃত হইয়াছে? রামময়বাবুর কথা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে তাহাই বা বলি কি প্রকারে? প্রথমে আসিয়া তিনি এই ঘরের দরজা যেরূপ দেখিয়াছেন, তাহাতে সেই ঘরের ভিতর হইতে শৃগাল কি কুক্কুর যে বাহির হইয়া গিয়াছে, তাহা অনুমান করা নিতান্ত সহজ নহে।
এইরূপ কয়েকটি চিন্তার পর, কিছুতেই স্থির করিতে পারিলাম না—এই হত্যার উদ্দেশ্য কি? কি কারণে হত্যা হইয়াছে? ইহাই যদি অনুসন্ধানকারী কর্ম্মচারী স্থির করিয়া উঠিতে না পারেন, তাহা হইলে কাহার দ্বারা হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে, তাহা স্থির করা সেই কৰ্ম্মচারীর পক্ষে একেবারে অসম্ভব। সুতরাং পাঠকগণ ভাবুন দেখি, আমি এই অনুসন্ধানে কতদূর কৃতকার্য্য হইতে পারিব! কিন্তু কি করি, আমরা পরাধীন, পরের আদেশের অনুগামী; সুতরাং, আমার দ্বারা সহজে এই মোকদ্দমা ধৃত হইবে না, জানিয়াও, কিন্তু এই অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না। পারি বা না পারি, এই অনুসন্ধানেই নিযুক্ত থাকিতে হইল।
যে স্থানে আমি উপবিষ্ট ছিলাম, সেইস্থান হইতে উঠিয়া বামাকে সঙ্গে লইয়া তাহার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। বামার ঘরে উপবেশন পূর্ব্বক আস্তে আস্তে বামাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম। পূর্ব্বে রামময়বাবুর নিকট যাহা অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহা ব্যতীত গিরিজাসুন্দরী সম্বন্ধে কেবল এইমাত্র জানিতে পারিলাম, প্রায় দুই বৎসর হইতে গিরিজা বামার বাড়ীতে বাস করিতেছে। ইহার পূর্ব্বে সেই পাড়ার ভিতর অনেক বাড়ীতে সে বাস করিয়াছে, এবং অনেকস্থানে সে চাকরাণীর কর্ম্মও করিয়াছে। তাহার বাসস্থান—মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত একখানি ক্ষুদ্র পল্লীতে। সেইস্থানে তাহার ভ্রাতা, ভ্রাতৃ-জায়া প্রভৃতি এখনও অনেক আত্মীয়-স্বজন আছে, সে কৈবর্ত্ত বলিয়া পরিচিত। যতদিবস সে কলিকাতায় আছে, চাকরাণী-বৃত্তি করিয়াই সে জীবনযাপন করে। কিন্তু তাই বলিয়া তাহার চরিত্র যে একেবারে দোষ-শূন্য, তাহা নহে। দেশে তাহার চরিত্র কলুষিত হওয়ার পর, একটি লোকের সহিত সে কলিকাতায় আগমন করে। কিছুদিবস পরে সেই ব্যক্তি ইহাকে পরিত্যাগ করিয়া গমন করিলে, পরিশেষে এইরূপ অভাগিনীদিগকে জীবন ধারণের নিমিত্ত যেরূপ উপায় অবলম্বন করিতে হয়, এও সেই পন্থা অবলম্বন করিয়া চাকরাণীবৃত্তি আরম্ভ করে, এবং চাকরাণীদিগের মতই আপনার চরিত্র কলঙ্ক-রাশিতে দিন দিন আবৃত করিতে থাকে। এই নিমিত্তই মনিবের বাড়িতে থাকিবার স্থান থাকিলেও, কোন মতেই সেইস্থানে রাত্রিযাপন করিতে পারে না। অথচ মাসে মাসে যাহা কিছু বেতন পায়, তাহা ঘরভাড়ার নিমিত্তই প্রদান করিতে হয়।
বামার নিকট উপরি-উক্ত কথাগুলি জানিতে পারিলাম। কোন্ কোন্ ব্যক্তি যে গিরিজার ঘরে যাতায়াত করিত, তাহা বামা বা অপর কেহই বলিতে পারিল না সত্য, কিন্তু কোন না কোন ব্যক্তি যে কখন না কখন সেই ঘরে থাকিত, তাহা সকলেই কহিল।
বামার নিকট হইতে এই ব্যাপার অবগত হইয়া, আমি পুনরায় বাহিরে আসিলাম। দেখিলাম, সেই ঘর হইতে মৃতদেহ বাহির করিয়া পথের উপর আনা হইয়াছে; শীঘ্র ‘ডেড্হাউসে’ পরীক্ষার্থ পাঠান হইবে। মৃতার আত্মীয়স্বজন প্রভৃতি কেহই উপস্থিত না থাকায়, এবং অপরাপর কোন ব্যক্তি সেই মৃতদেহ বহন করিয়া লইয়া যাইতে সম্মত না হওয়ায়, ডোমদিগের আশ্রয় গ্রহণ করা হইয়াছে। সেই মৃতদেহ বহন করিয়া লইয়া যাইবার নিমিত্ত তাহারা প্রস্তুত হইয়া সেইস্থানে দণ্ডায়মান আছে।
গৃহ হইতে মৃতদেহ বাহির করার পর, পুনরায় সেই গৃহ উত্তমরূপে অনুসন্ধান করা হইল। কিন্তু হত্যাকারী এই কার্য্য সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত যে সাংঘাতিক অস্ত্র ব্যবহার করিয়াছিল, সেই অস্ত্রের, বা মৃতার মস্তকের, কোনরূপ সন্ধান সেই ঘরের ভিতর পাওয়া গেল না। হতাশ হইয়া আমরা সেইস্থানে পুনরায় উপবেশন করিলাম। এক এক করিয়া পূর্ব্বকথিত সাক্ষ্য, এবং বামার বাড়ীর ভাড়াটিয়াগণের বিস্তৃত জবানবন্দী, লিখিয়া লইতে লাগিলাম। ডোমগণ কর্তৃক মৃতদেহ ডেড়হাউসে নীত হইল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
এইরূপে সেই দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল, কাহার দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে, তাহার সন্ধানই হইল না। পরদিবসও অতিবাহিত হইল, কিন্তু কার্য্যের কিছুই হইল না।
তৃতীয় দিবসে আমার মনে একটু কৌতূহল আসিয়া উপস্থিত হইল। ভাবিলাম, যে স্ত্রীলোক চিরদিবস চাকরাণী—বৃত্তি অবলম্বন করিয়া দিনযাপন করিয়াছে, সে তাহার মৃত্যুকালে কিছু রাখিয়া যাইতে পারিয়াছে কি না? এই ভাবিয়া সেই ঘরের ভিতর পুনরায় প্রবেশ করিলাম, সেইস্থানে যে সামান্য বাক্সটি ছিল, তাহা খুলিয়া দেখিবার ইচ্ছা করিলাম। কিন্তু কি দিয়া যে খুলিব, তাহা স্থির করিতে পারিলাম না। কারণ, পূর্ব্বে যখন সেই ঘরের ভিতর অস্ত্রের নিমিত্ত উত্তমরূপে অনুসন্ধান করা হইয়াছিল, তখন ঐ বাক্সের চাবি কোনস্থানে দেখিতে পাওয়া যায় নাই। লাসের কোমরেও দেখা গিয়াছিল; উহাতে যে ঘুন্সী ছিল, তাহাতে কেবলমাত্র একটি সোণার মাদুলি ভিন্ন অপর আর কিছুই ছিল না। সুতরাং চাবি না পাইয়া একবার ভাবিলাম, বাক্সের তালা ভাঙ্গিয়া ফেলি; দেখি উহার ভিতর কি আছে। আবার মনে উদয় হইল, তালাটি না ভাঙ্গিয়া অপরের চাবি দ্বারা উহা খুলিবার চেষ্টা করিলে হয় না কি? মনে মনে এইরূপ কল্পনা করিতেছি, এমন সময় হঠাৎ ভাবিলাম, এ দেশের অনেক স্ত্রীলোক তাহাদিগের বাক্স প্রভৃতির চাবি অনেক সময়ে আপনাদের নিকট না রাখিয়া, ঘরের কোন না কোনস্থানে লুকাইয়া রাখিয়া থাকে। এও যদি তাহাই করিয়া থাকে, তাহা হইলে এই ঘরের ভিতরের লুক্কায়িত স্থান সকল, অর্থাৎ বেড়ার পার্শ্ব, দরমার নিম্ন, চালের ভিতর, বিছানার নিম্নদেশ প্রভৃতি স্থান সকল, আর একবার বিশেষ করিয়া দেখা আবশ্যক। এইরূপ অবস্থায় যদি চাবি পাই ভালই, নচেৎ পূৰ্ব্বকথিত যে কোন উপায়েই হউক, এই বাক্স খুলিয়া ফেলিব। এই ভাবিয়া সেই ঘরের এক প্রান্ত হইতে আরম্ভ করিয়া, প্রত্যেক প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য স্থান সকল উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিলাম। সেই ক্ষুদ্র ঘরের ভিতর প্রায় তিন ঘণ্টাকাল অনুসন্ধান করিয়া চাবির কোন সন্ধানই পাইলাম না। কেবল একস্থানে বেড়ার গায়ে তিন চারিখানি কাগজ প্রাপ্ত হইলাম। আমার সঙ্গে আর একজন নিম্ন-পদস্থ কৰ্ম্মচারী ছিল, এই কাগজগুলি তাহার হস্তে প্রদান করিয়া কহিলাম, এইগুলি এক একখানি করিয়া পড়িয়া দেখ দেখি, ইহার ভিতর আমাদিগের আবশ্যক অনুযায়ী কোন কথা জানিতে পাওয়া যায় কি না। কর্ম্মচারী কাগজ কয়েকখানি লইয়া বাহিরে গমন করিল। আমি অপর এক ব্যক্তির নিকটস্থিত একটি চাবির সাহায্যে সেই বাক্স খুলিয়া ফেলিলাম। দেখিলাম, উহার ভিতর কয়েকখানি পরিধেয় ও একটি কাচের বাটি ব্যতীত অপর আর কিছুই নাই। এই কাচের বাটীতে একটি সিকি ও কয়েকটি মাত্র পয়সা রহিয়াছে।
ঘরের ভিতরের অনুসন্ধান শেষ হইলে আমি বাহিরে আসিলাম। আমার নিম্নপদস্থ সেই কৰ্ম্মচারীকে সেই কাগজের বিষয় জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম, উহার ভিতর আমাদিগের আবশ্যকোপযোগী কোন কথাই নাই। সেই কাগজের মধ্যে দুই তিনখানি খাজানার রসিদ, আর একখানি তাহার বাড়ীর পত্র। কর্ম্মচারীর নিকট যদিও জানিতে পারিলাম, ইহাতে আমাদিগের প্রয়োজনীয় বিষয় কিছুই নাই; তথাপি সেই কাগজগুলি আমি পুনরায় গ্রহণ করিয়া দেখিলাম। দেখিলাম, ইহার মধ্যস্থিত তিনখানি কাগজ বাস্তবিকই রসিদ। অবশিষ্ট যে কাগজখানি ছিল, তাহা তাহার দেশ হইতে লিখিত একখানি পত্র। পত্রখানি অতিশয় দীর্ঘ, অনেক কথার মধ্যে উহাতে লেখা আছে :—
“আমি এখন বেশ বুঝিতে পারিতেছি, প্রসন্ন তোমার নিকট ভিন্ন আর কোনস্থানে গমন করে নাই। সে যে তোমার নিকট গমন করিবে, একথা সে অনেকবার অনেকের নিকট বলিয়াছে। তোমার সহিত যে তাহার মনের বিশেষ মিল ছিল, তাহাও সকলে বলিয়া থাকে। এরূপ অবস্থায় সে যখন হঠাৎ আমার ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে, তখন তোমার নিকট না যাইয়া আর কোথায় যাইবেন তাহার বাপের বাড়ী প্রভৃতি যে সকল থাকিবার জায়গা ছিল তাহা আমরা উত্তমরূপে দেখিয়াছি; সেখানেও তাহাকে পাই নাই। তোমাকে আমি পূর্ব্বে যেরূপ দেখিতাম, এখনও সেইরূপ দেখি। তুমি গ্রাম পরিত্যাগ করিয়াছ বলিয়া, তোমাকে আমি কখন ঘৃণার চক্ষে দেখি নাই। তোমার অদৃষ্টে যে কলঙ্ক ছিল, তাহা তোমার ঘটিয়াছে সত্য; কিন্তু, আমরা তোমাকে ঘৃণা করিব কেন? প্রসন্ন তোমার আপন ভগিনী না হইলেও, যখন সে আমার স্ত্রী, তখন সে তোমার ভগিনী-স্থানীয়া। আর তুমিও তাহাকে আপনার ভগিনীর মত দেখিয়া থাক, এরূপ অবস্থায় তুমি আর আমার সর্ব্বনাশ করিও না। যদি সে বুঝিতে না পারিয়া, তোমার নিকটে গমন করিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার অন্তরে নীচ-প্রবৃত্তির বীজবপন করিও না। তাহার চরিত্র কলুষিত করিয়া তাহার এবং আমার উভয়েরই সর্ব্বনাশ করিও না! এ কার্য্যে তোমার কোন উপকার হইবে না; অপরন্তু, অনিষ্টের সম্ভাবনাই অধিক। মনুষ্যমাত্রেরই স্বভাব—আপনার মান বজায় রাখিতে গিয়া প্রাণের দিকে লক্ষ্য করে না। ভাবিও না যে, আবশ্যক হইলে আমিও সেই পথ আশ্রয় করিব না। তুমি পত্র—পাঠ-মাত্র আমার এই পত্রের উত্তর প্রদান করিও, এবং প্রসন্ন যদি সেখানে গিয়া থাকে, (যদি কেন, সে নিশ্চয়ই গিয়াছে) তাহা হইলে তাহাকে যত্ন করিয়া রাখিবে, এবং আমাকে খবর প্রদান করিবে। যদি এই পত্রের উত্তর না দেও, তাহা হইলে আমি নিজেই তোমার সেইস্থানে গিয়া যাহা বিবেচনা হয়, তাহা করিব। আমার উপর কোনরূপ দোষারোপ করিতে পারিবে না। পত্রের উত্তর দিতে বিলম্ব করিও না। ইতি—
তোমার ভগিনীপতি!
শ্রীনবকৃষ্ণ দাস।
মে, ****
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
পত্রখানি একবার করিয়া ক্রমে তিন চারিবার পড়িলাম, এবং উল্টাইয়া উত্তমরূপে দেখিলাম। কিন্তু ইহার অর্থ উত্তমরূপে বুঝিতে পারিলাম না, বা এই পত্রখানি যে কোন তারিখের লেখা, তাহাও উহাতে খুঁজিয়া পাইলাম না। পত্রের ভাবে কেবল এইমাত্র বোধ হইল, এই পত্রের লেখক গিরিজার ভগিনীপতি। গিরিজার ভগিনী মরিয়া যাওয়ায় সে পুনরায় বিবাহ করিয়াছে। আরও বুঝিলাম, তাহার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, স্বামী পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করিয়াছে। ইহাতে তাহার সন্দেহ—তাহার স্ত্রী, গিরিজার নিকট কলিকাতায় আসিয়াছে।
নবকৃষ্ণ দাসের এই অনুমান যদি সত্য হয়, প্রকৃতই যদি তাহার স্ত্রী এইস্থানে স্বামীর অমতে আসিয়া থাকে, এবং এরূপ অবস্থায় তাহার মনে যদি আপনার স্ত্রীর চরিত্র সম্বন্ধে কোনরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হয়; তাহা হইলে নবকৃষ্ণ দ্বারা যে এই হত্যা কাৰ্য্য সম্পন্ন হইতে না পারিবে, একথা কে বলিতে পারেন? নবকৃষ্ণ তাহার পত্রের একস্থানে স্পষ্টই লিখিয়াছে, “মানবমাত্রই আপনার মান বজায় রাখিতে গিয়া প্রাণের দিকে লক্ষ্য রাখে না।’ একথা যাহার মনে উদয় হইতে পারে, তাহার দ্বারা যে সেই কাৰ্য্য সম্পন্ন হইতে পারে না; তাহাই বা কি প্রকারে বলি? তাহার লেখা-মত সে হয় ত নিজেই আসিয়া, এই নৃশংস কার্য সম্পন্ন পূর্ব্বক আপনার স্ত্রীকে লইয়া প্রস্থান করিয়াছে। কিন্তু কই এরূপভাবের অপর কোন স্ত্রীলোক যে এই ঘরে ছিল, তাহাত বাড়ীর তাপর আর কেহই বলিতে পারে না। তবে যাহাতে কেহ উহার আগমন বৃত্তান্ত না জানিতে পারে, এই ভাবিয়া যদি গিরিজাসুন্দরী তাহাকে ঘরের ভিতর সর্ব্বদা বন্ধ করিয়া রাখিয়া থাকে, তবেই অপরের জানিবার সম্ভাবনা অল্প। এই ভাবিয়া এ সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান করিতে সঙ্কল্প করিলাম, পত্রখানি সঙ্গে লইয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। আপনস্থানে প্রত্যাগমন করিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল; সুতরাং, সে দিবস তাপর আর কোন কার্য্যই হইল না। পরদিবস প্রাতঃকালে সেই পত্র আমার ঊর্ধ্বতন কর্ম্মচারীকে দেখাইলে, তিনিও আমার মনের ভাব বুঝিলেন। দেখিলাম, আমার মতে মত দিয়া তিনিও আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন।
সেইদিবস অপরাহ্ন চারিটার সময় কলিকাতা পরিত্যাগ পূর্ব্বক একখানি ষ্টীমারে উঠিয়া ভাগীরথীর উপর দিয়া গমন করিতে লাগিলাম। সন্ধ্যার পরেই ষ্টীমার গিয়া উলুবেড়িয়ায় উপস্থিত হইল। তীরে উত্তীর্ণ হইয়া দেখিলাম, সেইস্থান হইতেই মেদিনীপুরের খাল আরম্ভ হইয়াছে। দেখিলাম, সেই খালের ভিতর একখানি ছোট টামার বংশীধ্বনির সহিত ধূমরাশি উদ্গীরণ করিতে করিতে যাত্রীদিগকে সাদরে সম্ভাষণ করিতেছে। সেই খালের তীরে সারি সারি মুড়িমুড়কি ও পানের দোকান, দোকানে প্রায়ই পুরুষ মানুষ নাই, স্ত্রীলোকগণ বসিয়া দোকানদারী করিতেছে। এ দোকানদারীর অর্থ কেবল জিনিস বিক্রয় নহে তাহাদিগের উদ্দেশ্য স্বতন্ত্র, দোকানদারীর “দোকানদারী” মাত্র।
এই অবস্থা দৃষ্টি করিতে করিতে আমি সেই ক্ষুদ্র ষ্টীমারের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম। কিন্তু ষ্টীমারে উঠিতে পারিলাম না, সারং সাহেবের বদান্যতার উপর নির্ভর করিয়া সেই নিতান্ত অপরিসর স্থানে দাঁড়াইয়া থাকিতে হইল। সেইস্থানে আরও অনেক লোক আমারই মত দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার মধ্যে কেহ কেহ অগ্রে উঠিবার নিমিত্ত সারং সাহেবের স্তবস্তুতি করিতে লাগিল; কিন্তু, সে দিকে সারং সাহেবের দৃষ্টি পড়িল না। তবে মধ্যে মধ্যে দুই একজন খালাসি আসিয়া যাত্রীদিগের উপর মধুবৃষ্টি আরম্ভ করিল। কেহ বা ষ্টেশন মাষ্টারবাবুর আগমনের পথ পরিষ্কার করিবার নিমিত্ত সেই যাত্রীগণকে নিরর্থক ধাক্কা প্রদান করিতে লাগিল। যে স্থানে স্ত্রীলোকের সংখ্যা অধিক, সেইস্থানেই ধাক্কার স্রোত কিছু প্রবল বহিল। একটি বৃদ্ধা স্ত্রীলোক সেই স্রোতোবেগ সম্বরণ করিতে না পারিয়া, সেই খালের ভিতর পড়িয়া গেল, কিন্তু ডুবিল না। তাহার একজন আত্মীয় তাহাকে জল হইতে উঠাইয়া তাহার জীবন রক্ষা করিল।
সময়-মত সারং সাহেব যাত্রীগণকে উঠিবার নিমিত্ত আদেশ প্রদান করিল। ষ্টীমারখানি একে নিতান্ত ক্ষুদ্র, তাহাতে খালাসিদিগের দ্বারা অধিকৃত কিয়দংশ স্থানে কাহারও পা দিবার ক্ষমতা নাই। কাজেই অৰ্দ্ধেক লোক উঠিতে না উঠিতে উহার সমস্ত স্থান পূর্ণ হইয়া গেল। অবশিষ্ট অর্দ্ধেকের নিমিত্ত তখন আর কি করা যাইতে পারে? তাহাদিগকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক কোম্পানির টাকা লোকসান করা যাইতে পারে না, অথচ অপর কোন উপায়ও নাই। কাজেই সেই লোকদিগের মধ্যে মধ্যে কিছুমাত্র স্থান না থাকিলেও, এরূপভাবে সমস্ত লোককে বসাইয়া দেওয়া হইল যে, দেখিলে বোধ হয়—সেই সমস্ত মনুষ্য জমিয়া এক হইয়া গিয়াছে। ওঠা বসা, পাসফেরা ত পরের কথা, অঙ্গের কোনস্থান নাড়িবার ক্ষমতা কাহারও নাই। যদিও আমাকে সেই ষ্টীমারে উঠিতে হইল, তথাপি আমার ভাগ্যে ততটা ঘটিল না। ভাগ্যক্রমে পূৰ্ব্বে আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর টিকিট খরিদ করিয়াছিলাম বলিয়া, এইরূপ কষ্ট হইতে অনেকটা নিষ্কৃতিলাভ করিলাম।
ষ্টীমার চলিল, সেইখাল বাহিয়া ক্ৰমে গমন করিতে লাগিল। মধ্যে মধ্যে লকগেট সকল পার হইয়া, উচ্চ নীচ জলের উপর দিয়া এবং দামোদর, রূপনারায়ণ প্রভৃতি নদী সকল উত্তীর্ণ হইয়া, ক্রমে গমন করিতে লাগিল। মেদিনীপুরে যাঁহারা গমন করিয়াছেন, তাঁহারা লকগেটের অবস্থা দেখিয়া নিশ্চয়ই বিস্মিত হইয়া থাকিবেন। কিন্তু, সেই খালপথে একটি অদ্ভুত পুল নির্ম্মিত আছে, তাহা অনেকেই অবগত হইতে পারেন না বলিয়া, আমাকে এইস্থানে উহার একটু আভাস দিতে হইতেছে। পাঁচকুড়া নামক স্থানে উত্তীর্ণ হইয়া আরও কিয়দ্দূর গমন করিলে, একটি পুল আছে, উহা দৈর্ঘ্যে দুই তিন শত হস্তের কম নহে। সেই পুল ষ্টীমারের উপর হইতে সহজে লক্ষিত হয় না। যে সকল পুল সদাসর্বদা দেখিতে পাওয়া যায়, ইহা সে প্রকারের পুল নহে। অর্থাৎ এই পুলের নিম্নে জল এবং উপর দিয়া মনুষ্য যাতায়াত করে না, ইহা তাহার বিপরীত! এই পুলের নিম্নে একটি প্রকাণ্ড মাঠ আছে। এই মাঠে গরু মহিষ প্রভৃতি সর্ব্বদা চরিয়া থাকে; এবং সেইস্থান দিয়া মনুষ্যগণ সৰ্ব্বদা যাতায়াত করিয়া থাকে। কিন্তু পুলের উপর দিয়া খাল নির্ম্মিত হইয়াছে, এই খাল সৰ্ব্বদা জলে পূর্ণ থাকে। সেই জল দিয়া ষ্টীমার নৌকা প্রভৃতি সৰ্ব্বদা যাতায়াত করিয়া থাকে। আমি ভারতের অনেক স্থানে ভ্রমণ করিয়াছি, কিন্তু আজ পর্যন্ত এরূপ পুল কোনস্থানে আমার নয়নগোচর হয় নাই।
এইরূপে খাল বাহিয়া সমস্ত রাত্রি গমন করিতে হইল। পরদিবস প্রাতঃকালে আমি মেদিনীপুর সহরে গিয়া উপস্থিত হইলাম। আমাকে যে গ্রামে গমন করিতে হইবে, সেই গ্রাম মেদিনীপুর হইতে বহুদূর ব্যবহিত। সেইস্থানে গমন করিতে হইলে গো-যান ভিন্ন অপর আর কোন উপায় নাই, তাহাও সমস্ত পথে নহে। গ্রামের নিকটবর্তী পথে সাত ক্রোশের মধ্যে গাড়ি গমনাগমনের পথ নাই; সুতরাং, সেই পাঁচ সাত ক্রোশ পথ হাঁটিয়াই গমন করিতে হয়।
মেদিনীপুর হইতে একখানি “উড়ে গাড়ি” ভাড়া করিয়া “গোঠের” নিকট দিয়া চলিলাম। ইহা একটি ক্ষুদ্র পাহাড়ের উপরস্থিত অতিশয় মনোরম স্থান। কথিত আছে, ইহা বিরাটরাজার গো-গৃহ; সুতরাং, এইস্থান দেখিবার নিমিত্ত অনেক হিন্দু সৰ্ব্বদা যাতায়াত করিয়া থাকে। উহার উপর পুরাতন বাড়ীর চিহ্ন সকল এখনও বিদ্যমান; আমি সেইস্থান অতিক্রম করিয়া ক্রমে চলিতে লাগিলাম। সেইস্থান হইতে কয়েক ক্রোশমাত্র পথ অতিবাহিত করিয়া আমাদিগের শকট ক্রমে বিস্তৃত ও হিংস্ৰজন্তু সমাকীর্ণ একটি শালবনের ভিতর উপস্থিত হইল। পথের দুই পার্শ্বস্থিত নিবিড় শালবনের মনোহর শোভা সন্দর্শন করিতে করিতে ক্রমে গমন করিতে লাগিলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
এইরূপ দুইদিবস কাল গরুর গাড়িতে এবং একদিবস পদব্রজে চলিয়া, পরিশেষে আমার নির্দিষ্টস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম!
নবকৃষ্ণ দাস বাড়ীতেই ছিল, সেইস্থানে গমন করিবামাত্র সে আসিয়া আমাদিগের নিকট উপস্থিত হইল। যে পর্যন্ত নবকৃষ্ণ দাসের সহিত আমার সাক্ষাৎ না হইয়াছিল, সেই পর্য্যন্ত আমার প্রকৃত পরিচয় সেইস্থানের কেহই পাইয়াছিলেন না। সকলের নিকট আমি অন্যরূপ পরিচয় দিয়াছিলাম। কিন্তু যেমন দেখিলাম, নবকৃষ্ণ আমার সম্মুখে আসিয়াছে, অমনি আমি আমার প্রকৃত পরিচয় প্রদান করিয়া তাহাকে কহিলাম, “কোন বিশেষ প্রয়োজনের নিমিত্ত আমি তোমারই নিকট আগমন করিয়াছি।”
উত্তরে নবকৃষ্ণ কহিল, “আমার নিকট প্রয়োজন আছে? কি প্রয়োজন, বলিতে আজ্ঞা হউক।’
আমি। তুমি কলিকাতা হইতে কতদিন আগমন করিলে?
নবকৃষ্ণ। প্রায় দুই বৎসর হইল, আমি কলিকাতা হইতে বাড়িতে আসিয়াছি। তাহার পর আমি আর সেইস্থানে গমন করি নাই।
আমি। তুমি গিরিজাসুন্দরীকে চেন?
নব। চিনি বই কি, তাহার কনিষ্ঠ ভগিনীকে আমি পূর্ব্বে বিবাহ করিয়াছিলাম।
আমি। তোমার সে স্ত্রী এখন কোথায়?
নব। অনেকদিবস হইল, তাহার মৃত্যু হইয়াছে।
আমি। তাহার পর তুমি আর বিবাহ করিয়াছ কি? নব। তাহার পর আমি পুনরায় বিবাহ করি।
আমি। তোমার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর নাম প্রসন্ন নয় কি?
নব। হাঁ মহাশয়! আপনি তাহার নাম জানিলেন কি প্রকারে?
আমি। আমি যে প্রকারে জানি, তাহা তোমাকে পরে বলিব। তোমার সে স্ত্রী এখন কোথায়?
নব। সে যে এখন কোথায়, তাহা আমি ঠিক বলিতে পারিতেছি না। আমার সহিত কলহ করিয়া সে চলিয়া গিয়াছে। কোথায় গিয়াছে, তাহা আমি জানি না। অনেক স্থানে তাহার অনুসন্ধান করিয়াছি; কিন্তু, কোনস্থানেই তাহার সন্ধান পাই নাই। আপনি কি তাহার কোন সন্ধান অবগত আছেন।
আমি। তুমি গিরিজাসুন্দরীর বাসা চেন কি?
নব। চিনি বই কি, কলিকাতার মাথাঘসা গলিতে তাহার বাসা।
আমি। তোমার স্ত্রী প্রসন্ন সেইস্থানে গমন করে নাই ত?
নব। না, সে সেইস্থানে যায় নাই।
আমি। সে যে সেইস্থানেই গিয়াছে, ইহা স্থির করিয়া তুমি গিরিজাকে এক পত্র লিখিয়াছিলে, একথা তোমার মনে হয় কি?
নব। তাহা মনে আছে বই কি। আমার প্রথমে সন্দেহ হইয়াছিল, সে সেইস্থানে গিয়াছে। কিন্তু পরে জানিতে পারিলাম, সে সেইস্থানে গমন করে নাই।
আমি। প্রসন্ন যে কলিকাতায় গিরিজার বাসায় যায় নাই, তাহা তুমি কি প্রকারে জানিতে পারিলে? নব। পরে আমি গিরিজার নিকট হইতেই অবগত হইয়াছি, সে সেইস্থানে যায় নাই।
নবকৃষ্ণের এই শেষ কথা শুনিয়া আমার মনে একটু সাহস হইল। ভাবিলাম, মিথ্যাকথা আর কতক্ষণ গোপন থাকিতে পারে? কথায় কথায় নবকৃষ্ণের মুখ দিয়া এখন আসল কথা বাহির হইয়া পড়িতেছে। যদি সে কলিকাতায় না যাইবে, তাহা হইলে গিরিজার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল কি প্রকারে? যদিও সে প্রথমে বলিয়াছিল, দুই বৎসরের মধ্যে সে কলিকাতায় যায় নাই; কিন্তু এখন তাহারই মুখ দিয়া একরূপ প্রকাশ হইতেছে যে, গিরিজার মুখেই সে শুনিয়াছে—তাহার স্ত্রী সেইস্থানে যায় নাই। যদি নবকৃষ্ণের কলিকাতায় যাওয়া স্থির হয়, তাহা হইলে সেই হত্যা যে তাহার দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই, একথা বিশ্বাস করি কি প্রকারে? এখন বোধ হইতেছে, এতদিবস পরে আমি অনুসন্ধানের ঠিক পথ প্রাপ্ত হইয়াছি।
এইরূপ ভাবিয়া আমি নবকৃষ্ণকে পুনরায় কহিলাম, “তুমি কহিলে—তোমার স্ত্রী কলিকাতায় গিরিজার নিকট গমন করে নাই। আরও কহিলে—একথা তুমি গিরিজার নিকট হইতেই অবগত হইয়াছ। যদি দুই বৎসর তুমি কলিকাতায় যাও নাই, তবে গিরিজার সহিত তোমার দেখা হইল কি প্রকারে?”
নব। কেন মহাশয়! কলিকাতায় গমন না করিলে কি আর তাহার সহিত সাক্ষাৎ হয় না? গিরিজা কি এখানে আসিতে পারে না?
আমি। আসিতে পারিবে না কেন? কিন্তু, সে ত এখন তাহার দেশে আইসে নাই যে, তুমি তাহার নিকট তোমার স্ত্রীর সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছ?
নব। আপনাকে কে বলিল যে সে দেশে আইসে নাই? তিন দিবস হইল, আমার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইয়াছে। সে আপনার বাড়ীতে আছে। তাহার আগমন সংবাদ জানিতে পারিয়া, আমি তাহার সহিত গিয়া সাক্ষাৎ করি; এবং তাহারই নিকট অবগত হইতে পারি যে, প্রসন্ন তাহার নিকট গমন করে নাই।
নবকৃষ্ণের কথা শুনিয়া আমি চতুৰ্দ্দিক অন্ধকার দেখিলাম। ভাবিলাম, যে গিরিজাসুন্দরী ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়াছে, যাহার মৃতদেহ আমি স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি, সে মরে নাই। কলিকাতা হইতে সে দেশে প্রত্যাগমন করিয়াছে, একথা আমি কিরূপে বিশ্বাস করিতে পারি? তবে কি নবকৃষ্ণ আমাকে বঞ্চনা করিবার অভিলাষে এই ছল অবলম্বন করিয়া, আমার চক্ষুতে ধূলিমুষ্টি নিক্ষেপ করিবার চেষ্ট করিতেছে? সে কি মনে করিয়াছে যে, তাহার কথায় বিশ্বাস করিয়া তাহাকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক আমি সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিব? যাহা হউক, যখন একটা নূতন এবং অস্বাভাবিক কথা আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন এ বিষয় আমাকে উত্তমরূপেই দেখিতে হইবে। গিরিজাকে স্বচক্ষে না দেখিয়া আমি কোনরূপেই নবকৃষ্ণের কথা বিশ্বাস করিব না।
মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া আমি নবকৃষ্ণকে কহিলাম, “যখন তুমি বলিতেছ যে, গিরিজাসুন্দরী তাহার বাড়ীতেই আছে, এবং কেবলমাত্র তিনদিবস হইল, তাহার সহিত তোমার সাক্ষাৎ হইয়াছে, তখন আমার ইচ্ছা যে, তুমি আমার সহিত একবার সেইস্থানে গমন কর। কারণ গিরিজাসুন্দরীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার আমার বিশেষ প্রয়োজন আছে।” আমার কথায় নবকৃষ্ণ সম্মত হইল। সেইস্থান হইতে গিরিজাসুন্দরীর বাড়ি বহুদূর নহে, দুই ক্রোশ মাত্র ব্যবহিত। সেই সময়েই আমরা সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম, এবং দুই ঘণ্টাকালমাত্র পদব্ৰজে গমন করার পরই তাহার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
গিরিজার কনিষ্ঠ ভ্রাতা সেই সময়ে তাহাদিগের বাড়ীর বাহিরে কৃষি-কাৰ্য্যোপযোগী কোন কার্য্যে নিযুক্ত ছিল। নবকৃষ্ণ তাহাকে ডাকিবামাত্র সে আমাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার নিকট আমার পরিচয় প্রদান করিয়া, আমি যে কার্য্যের নিমিত্ত সেইস্থানে গমন করিয়াছি, তাহা তাহাকে কহিল। সে নবকৃষ্ণের কথা শুনিয়া বলিল,
“আজ কয়েকদিবস হইল, দিদি কলিকাতা হইতে এখানে আগমন করিয়াছিলেন। বহুদিবস পরে হঠাৎ যে কি কারণে আসিয়াছিলেন, তাহা কাহাকেও কহেন নাই; কেবল বলিয়াছিলেন যে, তীর্থপর্যটনে গমন করিবার মনস্থ করিয়াছেন, এই নিমিত্ত মধ্যে আমাদিগকে দেখিতে আসিয়াছিলেন। আপনার সহিত তাঁহার যে দিন সাক্ষাৎ হয়, তাহার পরদিবসই তিনি এ স্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছেন। কোথায় গমন করিবেন, তাহার কিছুই আমাকে বলিয়া যান নাই। বাড়ীতে স্ত্রীলোকদিগের নিকট প্রথম বলিয়াছিলেন, তিনি প্রথমে কলিকাতায় গমন করিবেন, পরিশেষে সেইস্থান হইতে তীর্থপৰ্যটনে বহির্গত হইবেন। কিন্তু পরে আবার ইহাও বলিয়াছিলেন, তীর্থপর্যটন না করিয়া তিনি আর কলিকাতায় গমন করিবেন না। কলিকাতায় যাইবার পূর্ব্বে তিনি প্রথমে বাড়ী আসিবেন, আমাদিগের সকলের সহিত দেখা শুনা করিয়া তাহার পর কলিকাতায় গমন করিবেন। আরও বলিয়া গিয়াছেন, প্রথমে তিনি বৈদ্যনাথে গমন করিবেন, সেইস্থানে কয়েকদিবস থাকিয়া কাশীধামে যাইবেন। কাশীধামে পৌঁছিয়া সেইস্থান হইতে তিনি বাড়ীতে পত্র লিখিবেন।”
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
গিরিজাসুন্দরীর ভ্রাতার নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া, আমি সেইস্থানেই উপবেশন করিলাম সামান্য পল্লিগ্রামের ভিতর একজন দারোগা আসিয়াছেন, এই কথা নক্ষত্র বেগে চারিদিকে প্রচার হইয়া পড়িল। গ্রামে চৌকিদারগণ কোমরে চাপরাস আঁটিয়া, মস্তকে পাগড়ি বাঁধিয়া, লাঠিহস্তে সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। নিকটে আসিয়া ভূমিষ্ট হইয়া প্রণাম করিয়া, ক্রমে দূরে গিয়া উপবেশন করিতে লাগিল। গ্রামের বালক-বালিকাগণ আসিয়া আমাদিগের চতুৰ্দ্দিক ঘেরিয়া দাঁড়াইল। পরিশেষে সেই গ্রামের জমীদার পঞ্চায়েৎ প্রভৃতি গণ্যমান্য ভদ্রলোকগণও আসিয়া ক্রমে উপস্থিত হইলেন। ইহাদিগের নিকটেও অবগত হইলাম, গিরিজা বাস্তবিকই এইস্থানে আগমন করিয়াছিল। কেহবা তাহাকে স্বচক্ষে দর্শন করিয়াছেন, কেহবা অপরের মুখে শ্রবণ করিয়াছেন।
ইহাদিগের নিকট হইতে যতদূর অবগত হইতে পারিলাম, তাহাতে আমার মনে আর কোন সন্দেহই রহিল না। বেশ বুঝিলাম, গিরিজাসুন্দরী হতা হয় নাই; এবং সে এই গ্রামে আগমনও করিয়াছিল। এখন ভাবিলাম, গিরিজার ঘরে যে একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সে যদি গিরিজার দেহ না হয়, তবে কাহার দেহ? এ সম্বন্ধে আমার মনে যুগপৎ দুইটি কথার উদয় হইল। প্রথম যে গিরিজাসুন্দরীর বাড়িতে আমরা এখন বসিয়া আছি, যে গিরিজাসুন্দরী এখানে আগমন করিয়া তীর্থপর্যটনের নাম করিয়া, এইস্থান পরিত্যাগ করিয়াছে, সেই গিরিজাসুন্দরী কলিকাতায় যে ঘরে থাকে, আমরা সেই ঘরেই মৃতদেহ পাইয়াছি, কি, অপর কোন গিরিজার ঘরে এই ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়াছে? আমরা ভুল করিয়া সেই গিরিজার অনুসন্ধানের পরিবর্তে এই গিরিজার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়াছি? ইহার প্রকৃত তত্ত্ব এখন কি প্রকারে পাওয়া যাইতে পারে? যদি এই গিরিজাকে পাওয়া যাইত, তাহা হইলে কলিকাতায় সেই বাড়ির সকলকে দেখাইলেই জানিতে পারিতাম, আমরা এক গিরিজার অনুসন্ধানে অপর গিরিজায় অনুসন্ধান করিয়াছি কি না। কিন্তু যখন বর্ত্তমান গিরিজাকে পাওয়া যাইতেছে না, তখন সেই উপায় নাই। এদিকে আমরা দেখিতে পাইতেছি, এই গিরিজার ভগিনীপতি নবকৃষ্ণ দাস। নবকৃষ্ণ এই গিরিজাকেই আপনার স্ত্রীর কথা উল্লেখ করিয়া পত্র লিখিয়াছিল; এবং সে এখানে আগমন করিলে তাহাকে সেই কথা জিজ্ঞাসাও করিয়াছিল। যে গিরিজার ঘরে এই হত্যা সম্পন্ন হইয়াছে, সে যদি এই গিরিজাই না হইবে, তাহা হইলে সেই ঘরে এই পত্র কিরূপে পাওয়া গেল। কিন্তু আবার আর এক কথা, ইহাও হয় ত হইতে পারে যে মাথাঘসা গলিতে দুইজন গিরিজা থাকিত, এক ডাকপিয়ন গিরিজার পত্র অপর গিরিজাকে অর্থাৎ যাহার ঘরে এই হত্যা সম্পন্ন হইয়াছে, তাহাকেই ভ্রমক্রমে প্রদান করিয়াছে। সে যখন দেখিয়াছে, সেই পত্র তাহার নয়; তখন সে আপনার ঘরে সেই পত্র রাখিয়া দিয়াছে। এরূপ অবস্থায় এক গিরিজার পত্র অপর গিরিজার ঘরে পাওয়া কিছুই একেবারে অসম্ভব নহে। এরূপ অবস্থায় যে গিরিজার ঘরে সেই মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই এই গিরিজা কি না, তাহা স্থির করা, দেখিতেছি, নিতান্ত সহজ নহে। এখন কেবল ইহার একমাত্র এই উপায় দেখিতেছি যে, যাহারা সেই গিরিজাকে উত্তমরূপে চিনে, তাহাদিগের নিকট হইতে, উহার কিরূপ চেহারা ছিল, উত্তমরূপে জানিয়া লইয়া নবকৃষ্ণ প্রভৃতি সকলের প্রদত্ত এই গিরিজার চেহারার সহিত মিলাইয়া দেখা ভিন্ন আর কোনরূপ উৎকৃষ্ট উপায় দেখিতে পাইতেছি না। কিম্বা উপস্থিত-মত নবকৃষ্ণ হউক, বা অপর কোন ব্যক্তিই হউক, যিনি কখনও কলিকাতায় গিয়া, এই গিরিজাসুন্দরীর বাসা দেখিয়া আসিয়াছে, তাহাদিগের কাহাকেও সঙ্গে করিয়া কলিকাতায় গিয়া, যাহাতে এই গিরিজার ঘরখানি ঠিক করিতে পারি, তাহা একবার দেখা আবশ্যক। যে ঘরে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, সেই ঘরই যদি তাহাদের কেহ দেখাইয়া দেয়, তাহা হইলে জানিতে পারিব—আমরা যে গিরিজাসুন্দরী হতা হইয়াছে বলিয়া সন্দেহ করিতেছি, সে গিরিজাসুন্দরী বাস্তবিকই হতা হয় নাই। তাহার ঘরে অপর কোন স্ত্রীলোক হত হইয়াছে, গিরিজা প্রাণের ভয়ে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিয়াছে।
আমার দ্বিতীয় চিন্তা—যে গিরিজার বাড়ীতে আমরা এখন উপবিষ্ট, তাহার ঘরেই যদি এই হত্যা সম্পন্ন হইয়া থাকে, এবং সেই হতা রমণী যদি গিরিজা না হয়, তাহা হইলে সে স্ত্রীলোকটি কে? কেমন করিয়া বলিব, সেই স্ত্রীলোকটি প্রসন্ন নহে। পূর্ব্বোক্ত পত্র পাঠ করিয়া এখন কিরূপে বিশ্বাস করিব, প্রসন্ন সেইস্থানে গমন করিয়া গিরিজার সহিত মিলিত হয় নাই? কিরূপে অনুমান করিব, সেইস্থানে প্রসন্নের চরিত্রও কলুষিত হয় নাই, এবং কি প্রকারেই বা ভাবিব, নবকৃষ্ণ কলিকাতায় গিয়া এই সকল অবস্থা স্বচক্ষে দৃষ্টি করিয়া, ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হইয়া, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করে নাই? যদি আমার দ্বিতীয় অনুমান সত্য হয়, তাহা হইলে গিরিজার পক্ষে সেই গৃহ পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করা অসম্ভব নহে। কিন্তু এরূপ অবস্থায় কোন্ সাহসের উপর নির্ভর করিয়া গিরিজা বাড়ীতে আগমন করিবে, এবং কোন্ সাহসেই বা সে পুনরায় নবকৃষ্ণের সহিত সাক্ষাৎ করিবে? আর নবকৃষ্ণই বা পুনরায় এখানে আসিয়া সকলের সম্মুখে গিরিজাকে প্রসন্নের কথা জিজ্ঞাসা করিবে?
এইরূপ সম্ভব ও অসম্ভব নানারূপ চিন্তা মনে উদিত হইয়া নানারূপ সন্দেহ আসিয়া ক্রমে উপস্থিত হইতে লাগিল। যে আশার উপর নির্ভর করিয়া এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলাম, তাহা ক্রমে হৃদয় হইতে দূরে পলায়ন করিতে লাগিল। কোন্ পথ অবলম্বন করিব, কাহার অনুসন্ধানে অতঃপর নিযুক্ত হইব, তখন তাহাই মনে উদয় হইতে লাগিল।
এইরূপ নানাপ্রকারে ভাবিতে ভাবিতে সে দিবস সেই গ্রামেই অতিবাহিত করিলাম। সেইস্থান হইতে উঠিয়া সেই গ্রামের একজন বদ্ধিষ্ণু ব্রাহ্মণের বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যে সকল ব্যক্তি পূর্ব্বোক্তস্থানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারাই আমাকে সেইস্থানে লইয়া গেলেন। সেইস্থানে আহারাদির উদ্যোগ হইল। দেখিতে দেখিতে কোথা হইতে মৎস্য দধি দুগ্ধ আসিল। কে যে সংগ্রহ করিল বা তাহার মূল্যই বা কে প্রদান করিল, তাহা বলিতে পারি না। আমি মূল্য দিতে চাহিলাম, কিন্তু কেহই লইলেন না। যাঁহার বাড়ীতে আহারাদির উদ্যোগ হইল, শুনিলাম, উহার মূল্য তাঁহাকেও দিতে হইল না। কিন্তু আহারের উত্তম উদযোগ হইল। বুঝিলাম, চৌকিদারগণই সমস্ত সংগ্রহ করিল। আহারাদি করিয়া আমি সেইস্থানে শয়ন করিলাম, দিন অতিবাহিত হইল; রাত্রিও সেইস্থানে কাটাইলাম। কিন্তু এখন যে কি করিব, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে না পারিয়া পরদিবস প্রত্যূষে সেই গ্রাম পরিত্যাগ করিলাম।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
নবকৃষ্ণ আমাকে পূৰ্ব্বেই বলিয়াছিল গিরিজাসুন্দরী মাথাঘসার গলিতে থাকে। আরও বলিয়াছিল যে, সে নিজে দুই বৎসর কলিকাতায় গমন করে নাই। তথাপি সেই স্থান হইতে কলিকাতায় আসিবার কালীন তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া আসিতে পারিলাম না। গিরিজার যে ভ্রাতার সহিত সেইস্থানে প্রথমে আমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, সে তিন মাস পূর্ব্বে কলিকাতায় আগমন করিয়াছিল, এবং পাঁচ সাতদিবস গিরিজার বাসাতেই ছিল। একথা আমি সেই গ্রামেই জানিতে পারিয়াছিলাম, সুতরাং তাহাকেও সঙ্গে করিয়া কলিকাতায় আনিলাম। আরও গ্রামের লোকের নিকট হইতে গিরিজার আকার অবয়ব গঠন প্রভৃতির যতদূর সংগ্রহ করিতে পারিলাম, তাহাও লিখিয়া লইলাম।
আমরা যে পথে গমন করিয়াছিলাম, সেই পথেই কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। যে থানায় আমি থাকি, সেই থানায় নবকৃষ্ণকে রাখিয়া, গিরিজার সেই ভ্রাতাটিকে সঙ্গে লইয়া মাথাঘসা গলি-অভিমুখে চলিলাম। তাহার নিকটবৰ্ত্তীস্থানে উপস্থিত হইয়া উহাকে বলিলাম, “এখন চল, তোমার দিদি কোন ঘরে থাকেন, তাহা আমাদিগকে দেখাইয়া দেও।” আমার কথা শুনিয়া সে অগ্রে অগ্রে চলিল, এবং যে ঘরে এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইয়াছে, বা যে ঘর হইতে আমরা পূর্ব্বকথিত পত্র প্রাপ্ত হইয়াছি সেই ঘরে গিয়া উপস্থিত হইল ও কহিল, “এই ঘরে আমাদের দিদি থাকিতেন, এবং আমিও কলিকাতায় যে কয়দিন ছিলাম, এই ঘরেই অতিবাহিত করিয়াছি।” উহাকে দেখিয়া সেই বাড়ির অনেকেই চিনিতে পারিল, এবং কহিল, “বাস্তবিকই এ এই ঘরে কয়েকদিবস গিরিজার নিকট ছিল। তাহার ভাই বলিয়া সকলের নিকট আপনার পরিচয় প্রদান করিয়াছিল।”
এতক্ষণ পরে অনুসন্ধানের এক অধ্যায় শেষ হইল। সকলের অনুমান মিথ্যা হইল। গিরিজাসুন্দরী হত হইয়াছে বলিয়া স্থির হইয়াছিল, তখন তাহার বিপরীত প্রমাণ হইল। সকলেই জানিতে পারিলেন, গিরিজাসুন্দরী মরে নাই। সে তীর্থপর্যটনের নাম করিয়া কোন স্থানে গমন করিয়াছে।
এই অনুসন্ধানের দ্বিতীয় অধ্যায় আরম্ভ হইবার পূর্ব্বেই সকলেই আমার ন্যায় অনুমান করিয়া স্থির করিলেন যে, নবকৃষ্ণের স্ত্রী প্রসন্নের ভিন্ন সেই মৃতদেহ আর কাহারও নহে। সুতরাং, এখন নবকৃষ্ণের উপরই সকলেরই লক্ষ্য পড়িল। যে প্রসন্নকে হত্যা করিয়াছে, এই অনুমানে সকলেই নবকৃষ্ণকে লইয়া পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিলেন। নবকৃষ্ণের উপর কোনরূপ প্রমাণ না থাকিলেও সকলেই তাহাকে স্পষ্ট কহিলেন, “গিরিজার ঘরে যে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে, তাহা প্রসন্নের ভিন্ন অপর কাহারও মৃতদেহ নহে। এই হত্যা তোমাভিন্ন অন্য আর কাহারও দ্বারা সম্পন্ন হয় নাই।”
গিরিজার যে ভ্রাতা আমার সহিত আগমন করিয়াছিল, তখন তাহার দিকে আর কাহারও লক্ষ্য রহিল না। সে সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক আস্তে আস্তে প্রস্থান করিল। পরে তাহাকে আর সেইস্থানে দেখিতে পাইলাম না, অনুসন্ধানে তাহাকে আর কলিকাতার ভিতরে খুঁজিয়া পাইলাম না। শুনিলাম, সেইদিবসই সে কলিকাতা পরিত্যাগ পূর্ব্বক আপনার দেশাভিমুখে প্রস্থান করিয়াছে।
নবকৃষ্ণ তাহার স্ত্রীকে হত্যা করা অপরাধে ধৃত হইয়াছে, একথা দেখিতে দেখিতে চতুৰ্দ্দিকে প্রকাশ হইয়া পড়িল। সংবাদপত্র সমূহও এ সংবাদ দ্বারে দ্বারে প্রচার করিতে ত্রুটি করিলেন না। সকলেই এখন জানিতে পারিলেন, পূর্ব্বে যে মৃতদেহ গিরিজার মৃতদেহ বলিয়া সাব্যস্ত হইয়াছিল, তাহা গিরিজার নহে, অপরের–নবকৃষ্ণ দাসের বনিতা প্রসন্নের।
এ সম্বন্ধে নবকৃষ্ণের উপর সকলের যদিও বিশেষ সন্দেহ হইল, কিন্তু অনুসন্ধানের প্রথম পন্থা অবলম্বনে কেহই সমর্থ হইলেন না। কারণ, সেইস্থানে এমন কি কলিকাতাতে নবকৃষ্ণকে যে কেহ সেই সময় দেখিয়াছে, তাহা কেহ বলিল না। কিন্তু এদিকে আবার নবকৃষ্ণের অস্বীকার। নবকৃষ্ণ বলিতে লাগিল, সে কলিকাতায় আগমন করে নাই বা তাহার স্ত্রী প্রসন্ন তাহা কর্তৃক কখনই হতা হয় নাই। নবকৃষ্ণ যদিও এইরূপ বলিতে লাগিল, কিন্তু তাহার কথায় কেহই বিশ্বাস করিল না; হাসিয়া সকলেই তাহার কথা উড়াইয়া দিতে লাগিল। অতঃপর সাব্যস্ত হইল, নবকৃষ্ণের দেশে গিয়া পুনরায় তাহার সম্বন্ধে ভালরূপ অনুসন্ধান করা। যে সময়ে কলিকাতায় এই হত্যাকাৰ্য্য সমাহিত হইয়াছে, সেই সময়ে নবকৃষ্ণ কোথায় ছিল? এই অনুসন্ধানে যদি জানিতে পারা যায়, নবকৃষ্ণ সেই রাত্রিতে তাহার দেশে ছিল, তাহা হইলে এ কাৰ্য্য নবকৃষ্ণের কৰ্ম্ম নহে। নতুবা নবকৃষ্ণ ব্যতীত এ কার্য্য অপরের দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে। আরও সাব্যস্ত হইল, এ অনুসন্ধানে আমাকেই পুনরায় তাহার দেশে গমন করিতে হইবে; ও আমার সহিত অপর দুইজন কর্মচারী গমন করিবেন।
পরদিবস নবকৃষ্ণকে লইয়া পুনরায় কলিকাতা পরিত্যাগ করিলাম। সময়মত আমরা সকলেই নবকৃষ্ণের বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। যে রাত্রিতে কলিকাতায় সেই হত্যাকাৰ্য সম্পন্ন হয়, নবকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করায় সে আমাদিগকে কহিয়াছিল যে, সেই দিবস সে তাহার নিজ গ্রামেই ছিল। ঘোষদিগের বৈঠকখানায় পাড়ার অপরাপর লোকদিগের সহিত রাত্রি বারটা পর্য্যন্ত অতিবাহিত করিয়াছিল। তৎপরে গিয়া আপনার গৃহে শয়ন করে। সে যখন তাহার বাড়ীতে প্রত্যাগমন করে, সেই রাত্রিতে তাহার বৃদ্ধা মাতা তাহার জন্য দরজা খুলিয়া দেয়।
নবকৃষ্ণ যে হত্যা অপরাধে ধৃত হইয়াছে, তাহা আমাদিগের সেই গ্রামে উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই সকলে জানিতে পারিয়াছে। কিন্তু এ সংবাদ প্রথমে যে কে প্রদান করিল, তাহা কিন্তু কেহই অবগত নহেন, অথচ আসল কথাটি সকলেই শুনিয়াছেন। নবকৃষ্ণকে লইয়া প্রথমেই আমরা তাহার বাড়ীতে গমন করিলাম। একজন কর্মচারীর নিকট নবকৃষ্ণকে দূরে রাখিয়া, আমরা দুইজন তাহার মাতার নিকটে গমন করিলাম। ডাকিবামাত্র বৃদ্ধা আসিয়া আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত হইল। সেই রাত্রিতে নবকৃষ্ণ তাহার বাড়ীতে ছিল কি না, জিজ্ঞাসা করায় বৃদ্ধা তাহার প্রকৃত উত্তর দিতে পারিল না। কেবল উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন আরম্ভ করিল, এবং বার বার কহিতে লাগিল, “তোমরা আমার নবকৃষ্ণকে ছাড়িয়া দেও। আমরা ভিক্ষা করিয়া খাইব, তথাপি আর আমরা এখানে থাকিব না।” বৃদ্ধা মধ্যে মধ্যে প্রসন্নের উদ্দেশে সহস্ৰ সহস্ৰ অকথ্য গালি বর্ষণ করিতে লাগিল। কিন্তু আমাদিগের জিজ্ঞাসিত কোন কথারই প্রকৃত উত্তর দিল না, বা পুত্রের ভাবী অমঙ্গলের আশঙ্কায় শোকে নিতান্ত অস্থির হইয়া কোন কথারই উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ হইল না।
পরিশেষে কালীপ্রসন্ন ঘোষের বৈঠকখানায় গমন করিলাম। তাঁহারা কেহই বাহিরে আসিলেন না। যাঁহার কথা জিজ্ঞাসা করি, জানিতে পারি, তিনিই বাড়ীতে নাই—স্থানান্তরে গমন করিয়াছেন। বুঝিলাম, গ্রামের লোকগণ নিতান্ত ভীত হইয়াছে, এবং ইচ্ছা করিয়াই পুলিসের সম্মুখে আগমন করিতেছে না। গ্রামের অপরাপর লোকদিগের মধ্যে যাহাকে পাওয়া গেল, তাহারা কোন কথাই কহিল না। এমন কি, ঘোষদিগের বৈঠকখানায় পাড়ার সকলে সন্ধ্যার পর যে উপবেশন করে, তাহা পর্য্যন্ত অস্বীকার করিতে লাগিল। সুতরাং প্রকৃত কথা যে কি, তাহা স্থির করা এখন এক প্রকার অসম্ভব হইয়া উঠিল; এবং নবকৃষ্ণ দোষী কি না, তাহাও সাব্যস্ত করা সহজ হইল না।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
সে দিবস আমরা সে গ্রামেই রাত্রিযাপন করা স্থির করিলাম। গ্রামের মধ্যে ঘোষদিগের সেই বৈঠকখানা ব্যতিরেকে আমাদিগের থাকিবার উপযুক্ত তাপর স্থান আর দেখিতে পাইলাম না। সুতরাং আমরা সেইস্থানেই রাত্রিযাপন করা স্থির করিয়া, সেইস্থানেই গিয়া উপবেশন করিলাম। বাড়ী হইতে কোন পুরুষ বাহির হলেন না, কেবলমাত্র একটি চাকর বাহিরে আসিয়া কহিল, “বাবুরা বাড়ীতে নাই, সুতরাং কিরূপ করিয়া আপনারা এখানে থাকিবেন। থাকিবার নিমিত্ত অপর কোনস্থান দেখিলে ভাল হয়।” আমরা কিন্তু সেই পরিচারকের কথায় কর্ণপাতও করিলাম না, সেইস্থানেই বসিয়া রহিলাম। আমাদিগের মধ্যে এক ব্যক্তি কহিলেন, “বাবুরা কেহ বাড়ীতে থাকুন, বা না থাকুন, আমরা কিন্তু অন্য কোনস্থানে গমন করিব না; এইস্থানেই রাত্রিযাপন করিব। আহারাদির কোনরূপ যোগাড় হয়, ভালই; নচেৎ তাহাতেও ক্ষতি নাই। এই রাত্রিকালে আমরা অপর আর কোনস্থানে গমন করিব না।’
চাকরটি এই কথা শুনিয়া বাড়ির ভিতর গমন করিল, কিন্তু আর বাহিরে আসিল না। আমরা সেই বৈঠকখানার ভিতর প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, উহার মধ্যে এককোণে দুইটি সপ রহিয়াছে। সেইস্থানে সপ দুইটি পাতিয়া লইয়া আমরা উপবেশন করিলাম। তখনও সেই বাড়ী হইতে কোন ব্যক্তিই বাহিরে আসিল না, বা পাড়ার অপর লোকজন কাহাকেই সেইস্থানে দেখিতে পাইলাম না। কেবল পাড়ার ছোট ছোট কতকগুলি বালক বালিকা আমাদিগকে বেষ্টন করিয়া রহিল।
এইরূপে প্রায় একঘণ্টা অতিবাহিত হইয়া গেল। যখন সকলেই বুঝিতে পারিল যে, আমরা সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া অদ্য আর গমন করিতেছি না, তখন তামাক লইয়া সেই চাকরটি পুনরায় আমাদিগের নিকট আগমন করিল আমার সমভিব্যাহারী অপর কর্ম্মচারীদ্বয়ের ধূমপান অভ্যাস ছিল; সুতরাং, তাঁহারা উহা গ্রহণ করিয়া আপনাপন শ্রম দূর করিতে লাগিলেন। ক্রমে সেই চাকর আমাদিগের হস্তপদ প্রক্ষালনোপযোগী জল আনিয়া উপস্থিত করিল, হস্তপদ প্রক্ষালনপূর্ব্বক আমরা পুনরায় সেইস্থানে উপবেশন করিলাম। ক্রমে জল-খাবারের বন্দোবস্ত হইল। সেই সামান্য পল্লীগ্রামে বাতাসা ভিন্ন অপর কোন মিষ্ট দ্রব্য পাওয়া যায় না, সুতরাং সেই ভৃত্য একখানি থালায় কতকগুলি বাতাসা এবং পানোপযোগী এক কলসী জল আমাদিগের নিকটে রাখিয়া প্রস্থান করিল। এখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। আমরা জল পান করিয়া সেইস্থানে উপবেশন করিলাম, কেহ বা সেইস্থানে শয়ন করিলেন। এই সময়ে একটি লোক সেই বাটী-মধ্য হইতে বহির্গত হইয়া আমাদিগের নিকটে আসিলে জানিলাম, সেই বাড়ীর কর্তৃপক্ষীয়দিগের মধ্যে তিনি একজন। তিনি বাড়ি ছিলেন না, কোন কার্য্যোপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন, এখনই সেইস্থান হইতে আগমন করিতেছেন। এই বলিয়া পরিচয় প্রদান পূর্ব্বক তিনি আমাদিগের নিকট উপবেশন করিলেন। দেখিলেন, আমরা তাহার উপর কোনরূপ অসৎ ব্যবহার করিলাম না, বা এই হত্যা অপরাধে তাঁহাকে ধৃত করিয়াও লইয়া গেলাম না। এই ব্যাপার দৃষ্টি করিয়া অপরাপর ব্যক্তিবর্গেরও সাহস হইল, ক্রমে এক এক করিয়া সকলেই সেইস্থানে আগমন করিলেন। পূর্ব্বে আমরা যে স্থানে বসিবার নিমিত্ত একটু স্থান পাইতেছিলাম না, এখন সেইস্থানে আমাদিগের নিমিত্ত উত্তম শয্যা রচিত হইল। আহারেরও সুন্দর আয়োজন হইল। কোথা হইতে একজন ব্রাহ্মণ আসিয়া রন্ধন কার্য্যে প্রবৃত্ত হইল। সময়ে আমরা উত্তমরূপে আহারাদি করিয়া সেইস্থানেই রাত্রিযাপন করিলাম।
পরদিবস প্রাতঃকালে দেখিলাম, আমাদিগকে দেখিয়া আর কেহই ভীত নহেন। আমাদিগের উদ্দেশ্য কি, কি নিমিত্ত আমরা সেইস্থানে গমন করিয়াছি, তাহা উত্তমরূপে তাহাদিগকে বুঝাইয়া দিলে দেখিলাম, যিনি যাহা জানিতেন, তিনি তাহাই বলিলেন। কেহ বলিল, নবকৃষ্ণ প্রকৃতই সেই রাত্রিতে সেই গ্রামে উপস্থিত ছিল। কেহ বলিল, তাহার সহিত নবকৃষ্ণ অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত ঘোষদিগের বৈঠকখানায় বসিয়াছিল। কেহ কহিল, সেইদিবস দিবাভাগে সে নবকৃষ্ণকে সেইগ্রামে দেখিয়াছে। এইরূপ যে যাহা জানিত, তখন দেখিলাম, সকলেই এক এক করিয়া আমাদিগের নিকট বলিতে লাগিল। কিন্তু নবকৃষ্ণকে বাঁচাইবার নিমিত্ত ষড়যন্ত্র করিয়া ইহারা সকলে মিথ্যা কথা বলিতেছে, কি সকলেই প্রকৃত কথা বলিতেছে, তাহা কিন্তু তখন স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
আমরা গ্রামের লোকদিগের সহিত যেরূপ ব্যবহার করিলাম, তাহাতে সকলেই আমাদিগের উপর বিশেষ সন্তুষ্ট হইলেন। প্রথম দিবস যাঁহারা আমাদিগকে বসিবার নিমিত্ত একটু স্থান প্রদান করিতেছিলেন না, এখন তাঁহারা পরদিবসও আমাদিগকে সেইস্থান হইতে যাইতে দিলেন না। বিশেষ সমাদরের সহিত পরদিবসও আমাদিগকে সেইস্থানে রাখিলেন। আমরাও বিশেষ আপত্তি না করিয়া তাঁহাদিগের প্রস্তাবে সম্মত হইলাম।
দিবা বারটার সময় দেখিলাম, একজন ডাকপিয়ন আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইল, এবং একখানি পত্র কালীপ্রসন্ন ঘোষের হস্তে প্রদান করিয়া সেইস্থানে উপবেশন করিল। কলিকাতার পাঠকগণ আমাকে এইস্থানে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, ডাকপিয়ন পত্র প্রদান করিয়া সর্ব্বদা চলিয়া গিয়াই থাকে। তবে এ ব্যক্তির সেইস্থানে উপবেশন করিবার প্রয়োজন কি? ইহার উত্তরে আমি কলিকাতার পাঠকগণকে এইমাত্র বলিতে পারি যে, পল্লিগ্রামের ডাকপিয়নদিগের ঘরের পয়সা খরচ করিয়া প্রায়ই আহার করিতে হয় না। প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই এমন অনেক লোক আছেন, যাঁহাদিগের বাড়ীতে ডাকপিয়ন গমন করিলেই আহার করিতে পায়। এই নিমিত্ত পিয়নগণ অপরাপর বাটির চিঠি বিলি করিয়া যে বাড়ীতে সময়-মত উপস্থিত হইতে পারিলে; আহারের ভাবনা ভাবিতে হইবে না, সেই সকল বাড়ীতে প্রায় দুই প্রহরের সময় পত্র লইয়া উপস্থিত হয়, এবং আহারাদি করিয়া পরিশেষে সেইস্থান পরিত্যাগ করে। এই নিমিত্ত ডাকপিয়ন আসিয়া সেইস্থানে উপবেশন করিল।
কালীপ্রসন্ন পত্রখানি পড়িলেন, পড়িয়া পত্রহস্তে সেইস্থান হইতে উঠিয়া গেলেন। তাঁহার সঙ্কেতানুযায়ী আরও দুই একজন তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিল। সেইস্থান হইতে যে তাঁহারা কোথায় গেলেন, তাহা আমরা দেখিতে পাইলাম না। প্রায় অৰ্দ্ধঘণ্টা পরে একজন লোক আসিয়া আমাকে কহিল, “কালীপ্রসন্নবাবু আপনাকে কিছু বলিতে চাহেন। যদি আপনি আমার সহিত গমন করেন, তাহা হইলে আমি তাঁহার নিকট আপনাকে লইয়া যাইতে পারি।” এই কথা শুনিয়া আমি আর কোন কথা না বলিয়া সেইস্থান হইতে উঠিলাম, ও সেই লোকটির পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলাম। দেখিলাম, আমরা যে বৈঠকখানায় বসিয়াছিলাম, তাহার পশ্চাদ্ভাগে কালীপ্রসন্ন এবং আরও চারি পাঁচজন লোক দাঁড়াইয়া আছেন। আমি সেইস্থানে উপস্থিত হইবামাত্র কালীপ্রসন্নবাবু সেই পত্রখানি আমার হস্তে প্রদান করিয়া কহিলেন, “দেখুন দেখি, এই পত্রের উদ্দেশ্য কি?” পত্রখানি বাঙ্গালায় লেখা। একবার দুইবার করিয়া ক্রমে ক্রমে তিনি চারিবার সেই পত্রখানি পাঠ করিলাম, উহা পাঠে আমি নিতান্ত বিস্মিত হইলাম। ক্ষণকাল আমার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। আমি সেইস্থানে উপবেশন করিলাম। সেই পত্রে কি আছে, তাহা জানিতে পারিলেই পাঠকগণ বুঝিতে পারিবেন, আমাদিগের পক্ষে এরূপ পত্র কি ভয়ানক! উহাতে লেখা ছিল—“আমি শুনিলাম, নবকৃষ্ণ তাঁহার স্ত্রী প্রসন্নকে হত্যা করিয়াছে বলিয়া, কলিকাতায় ধৃত হইয়াছে। একথা সত্য কি না, জানি না। যদি সত্য হয়, তাহা হইলে বড় ভয়ানক কথা! যে স্ত্রীলোক হত্যা হয় নাই, তাহাকে হত্যা করিয়াছে বলিয়া, যদি একজনের দণ্ড হইয়া যায়, তাহা হইলে বড়ই অন্যায় হইবে। আমি আপনার বিশেষ পরিচিত, এবং নবকৃষ্ণের কোন আত্মীয়; তথাপি আমি এ পত্রে আমার নাম প্রকাশ করিলাম না। কারণ কি জানি, পুলিস যদি পরিশেষে আমাকে লইয়াই টানাটানি করে। এই নিমিত্ত আপনাকে লিখিলাম। যদি আপনার বিবেচনায় ভাল হয়, তাহা হইলে পুলিসে সংবাদ প্রদান করিবেন, না হয়, যাহা ভাল বিবেচনা হয়, তাহাই করিবেন। প্রসন্ন এখন শামসায়ের গ্রামে তাহার মামার ভগিনীপতি রাজকুমারের বাড়ীতে আছে। নবকৃষ্ণের সঙ্গে সে ঝগড়া করিয়া প্রথমে আমার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হয়, কিছুদিবস আমার বাড়ীতেই ছিল। কিন্তু আজ কয়েক দিবসমাত্র হইল, সে রামকুমারের বাড়ীতে গমন করিয়াছে। অদ্য প্রাতঃকালেও আমি সংবাদ পাইয়াছি, সে সেইস্থানেই আছে। সে হত্যা হয় নাই, বা নবকৃষ্ণও তাহাকে হত্যা করে নাই। ইতি শ্রী—”
নবম পরিচ্ছেদ
এই পত্র পাঠ করিয়াই আমার মনে বেশ বিশ্বাস হইল যে, প্রসন্ন হতা হয় নাই; আমরা বিষম ভ্রমে পতিত হইয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছি। সেই পত্র আনিয়া পরিশেষে আমার সমভিব্যাহারী কর্মচারীদিগকে দেখাইলাম, তাঁহারাও উহা পাঠ করিয়া চমকিত হইয়া উঠিলেন। সেইদিবসই একজন কর্মচারীর সহিত নবকৃষ্ণকে শামসায়ের গ্রামে পাঠাইয়া দিলাম। সেই গ্রাম সেইস্থান হইতে পনর ক্রোশমাত্র ব্যবহিত। আমি অপর কর্ম্মচারীর সহিত সেইস্থানে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। তিনদিবস পরে সেই কর্ম্মচারী নবকৃষ্ণের সহিত প্রত্যাগমন করিল দেখিলাম, যে মরিয়া গিয়াছে বিবেচনায়, আমরা অনুসন্ধান করিতেছিলাম, সেই প্রসন্নও তাহাদিগের সহিত আসিয়া উপস্থিত হইল। আমরা সকলেই বিশেষ লজ্জিত হইয়া নবকৃষ্ণকে তৎক্ষণাৎ ছাড়িয়া দিলাম। সে হাসিতে হাসিতে আপনার স্ত্রীকে লইয়া আপনার ঘরে প্রস্থান করিল।
হত্যার পর ক্রমে পরদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। যে সকল পথ আমরা অবলম্বন করিয়াছিলাম, এক এক করিয়া তাহার সমস্তই পরিত্যাগ করিতে হইল। এখন ভরসার মধ্যে রহিল—যদি গিরিজাসুন্দরী কোন কথা বলিতে পারে। কিন্তু তাহাকেই বা পাই কোথায়?
গিরিজাসুন্দরী তাহার ভ্রাতাকে কোন পত্রাদি লিখিয়াছে কি না? অথবা অন্য কোন উপায়ে তাহার ভ্রাতা গিরিজার কোন সংবাদ অবগত হইতে পারিয়াছে কিনা? তাহা আর একবার জানিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিবার সঙ্কল্প করিলাম। সেইস্থান হইতে তাহাদিগের বাড়ী অতি নিকট; পাঠকগণ জানেন, এ গ্রাম দুই ক্রোশমাত্র দূরে স্থাপিত। সেইদিবসই আমরা সেইস্থান পরিত্যাগ পূর্ব্বক গিরিজাসুন্দরীর গ্রামে উপস্থিত হইলাম। তাহার ভ্রাতাকে বাড়ীতে পাইলাম। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে দেখিলাম, ভীত হইয়া প্রথমে সে সকল কথা অস্বীকার করিল। কিন্তু পরিশেষে কহিল, সে গিরিজার সংবাদ পাইয়াছে।
“গিরিজা এখন কোথায় আছে?”
“কাশীধামের গণেশ মহল্লায় চিনিবাস দাসের বাড়ীতে আছে, আরও আট দশদিন সেইস্থানে থাকিয়া বিন্ধ্যাচলে বিন্ধ্যবাসিনী দর্শনে গমন করিবে।”
“কাহার নিকট হইতে তুমি এ সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছ।”
“পত্র পাইয়াছি, কাশীধাম হইতে তিনি পত্র লিখিয়াছেন।”
“পত্রখানি কোথায়?”
“ছিঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছি।” এই কথাটি কিন্তু সে মিথ্যা বলিল, পরিশেষে তাহাকে অনেক করিয়া বুঝাইয়া বলায়, সে পত্রখানি বাহির করিয়া দিল। উহাতে গিরিজার যে ঠিকানা লেখা ছিল, তাহা কিন্তু সে প্রকৃতই বলিয়াছিল।
তাহার নিকট হইতে পত্রখানি গ্রহণ করিয়া, আমরা প্রথমে কলিকাতায় আসিলাম। সমস্ত অবস্থা আমাদিগের ঊর্দ্ধতন-কৰ্ম্মচারীকে বলিয়া পরিশেষে কাশীধামে গমন করাই স্থির করিলাম। এবার আমার সহিত অপর আর কোন কর্ম্মচারী গমন করিলেন না, আমাকে একাকীই গমন করিতে হইল। গণেশ মহল্লা আমার সুপরিচিত ছিল, সুতরাং চিনিবাস দাসের বাসা বাহির করিতে আমাকে বিশেষ কোন কষ্টই পাইতে হইল না। গিরিজা সেই বাড়ীতেই ছিল, তাহাকেও অনায়াসে পাইলাম। প্রথমে গিরিজা বা চিনিবাসকে আমরা প্রকৃত পরিচয় দিলাম না। গিরিজাকে কহিলাম, “তুমি যদিও আমাকে চিনিতে পারিবে না; কিন্তু, আমি তোমাকে চিনি। তোমার গ্রামের তিন চারি ক্রোশ ব্যবধানে আমার বাড়ী। আমি এইস্থানে আগমন করিব জানিতে পারিয়া, তোমার ভ্রাতা তোমার সংবাদ লইবার নিমিত্ত আমাকে বলিয়া দিয়াছিলেন। এই নিমিত্তই আমি এইস্থানে আগমন করিয়াছি।” গিরিজা আমার সহিত যেরূপ ভাবে কথাবাৰ্ত্তা কহিতে লাগিল, তাহাতে আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম সে আমার কথায় বিশ্বাস করে নাই। অধিকন্তু কহিল, “অদ্য প্রাতঃকালে আমি আমার ভ্রাতার নিকট হইতে এক পত্র প্রাপ্ত হইয়াছি, কিন্তু তাহাতে তিনি ত আপনার কোন কথা উল্লেখ করেন নাই?”
গিরিজার কথায় আমি বুঝিলাম, যখন সে তাহার ভ্রাতার নিকট হইতে পত্র প্রাপ্ত হইয়াছে, তখন নিশ্চয়ই সে সকল কথা জানিতে পারিয়াছে। সুতরাং মিথ্যা কথা বলিয়া আর কোন লাভ নাই, এখন তাহাকে প্রকৃত কথা বলিয়াই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়া আবশ্যক। বিশেষ হিন্দুর পক্ষে যে স্থান অতি পবিত্র, বহুদূর হইতে যে স্থানে হিন্দুগণ তীর্থ করিতে আইসে, কার্য্যের অনুরোধে সেইস্থানে মিথ্যা বলিয়া পাপসঞ্চয় করা অপেক্ষা প্রকৃত কথা বলাই কৰ্ত্তব্য। এই ভাবিয়া তাহার নিকট আমার প্রকৃত পরিচয় প্রদান করিলাম। যে বিভাগে আমি বহুদিবস হইতে কৰ্ম্ম করিতেছি, সেই বিভাগের কার্যপ্রণালী হৃদয় হইতে শীঘ্র দূর করা নিতান্ত সহজ নহে। স্বভাব একবার যে পথ আশ্রয় করে, তাহা সহজে পরিত্যাগ করা নিতান্ত সহজ নহে। আমি মনে মনে যদিও স্থির করিলাম, এই পুণ্যধামে আর মিথ্যা কথা কহিব না; কিন্তু, গিরিজাকে আমার প্রকৃত পরিচয় প্রদান করিবার পরই আমার মুখ দিয়া বাহির হইল, “তুমি তোমার ঘরে একটি স্ত্রীলোককে হত্যা করিয়া পলায়ন করিয়াছ। তোমার নামে হত্যা অপরাধে ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে। তোমাকে ধৃত করিবার নিমিত্ত আমরা বিশেষ চেষ্টা করিয়া নানাস্থানে ভ্রমণ করিতেছিলাম; পরিশেষে তুমি এইস্থানে আজ জানিতে পারিয়া আমিও এইস্থানে আগমন করিয়াছি, এবং তোমাকেও প্রাপ্ত হইয়াছি। এখন যদি তোমার কোন কথা বলিবার থাকে, বলিতে পার। নতুবা আমার সহিত তোমাকে কলিকাতায় গমন করিতে হইবে; এবং সেইস্থানে নিশ্চয়ই তোমাকে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলিতে হইবে।”
আমার কথা সমাপ্ত হইলে, গিরিজার মুখ শুষ্ক ও বিবর্ণ হইয়া গেল। কাঁপিতে কাঁপিতে সে সেইস্থানে বসিয়া পড়িল। পরিশেষে অনেকক্ষণ পরে কহিল, “আমি কাহাকেও হত্যা করি নাই, বা হত্যাসম্বন্ধে আমি কিছুই অবগত নহি।”
ইহাকে এখন আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন ভাবিয়া গিরিজাকে সঙ্গে লইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। আমার সহিত গমন করিতে প্রথমে গিরিজা অনেক আপত্তি করিল, অনেকের দ্বারা অনেকরূপ অনুরোধ করাইল। পরিশেষে স্ত্রীলোকের প্রধান সহায় রোদনের আশ্রয় লইয়া পাড়ার লোকজনকে একত্র করিল। আমি কিন্তু কিছুতেই কর্ণপাত না করিয়া তাহাকে সঙ্গে লইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলাম।
গণেশ মহল্লা হইতে তাহাকে বাঙ্গালী টোলায় লইয়া গেলাম। সেইস্থানে আমার একটি পরিচিত স্থান ছিল। যখন আমি কাশীধামে গমন করিতাম, তখন আমি সেইস্থানেই থাকিতাম। গিরিজাকে সঙ্গে করিয়া আমি সেইস্থানেই লইয়া গেলাম; কারণ, ভাবিলাম, যদি তাহাকে একাকী আমার নিকট রাখিতে পারি, তাহা হইলে তাহাকে ভয় দেখাইয়া বা বুঝাইয়া, যে প্রকারে হউক, মূল কথা তাহার নিকট হইতে বাহির করিয়া লইলেও লইতে পারিব। কারণ, সে সামান্য স্ত্রীলোক, তাহাতে কাহারও সহায়তা বা পরামর্শ না পাইলেই, সে প্রকৃত কথা প্রকাশ করিয়া ফেলিবে, ইহা আমার ধ্রুব বিশ্বাস। এইরূপ ভাবিয়া তাহাকে লইয়া বাঙ্গালীটোলায় আমার সেই বাসায় গমন করিলাম। প্রথমে তাহাকে অনেকরূপ ভয়-ভাবনা দেখাইলাম, কিন্তু সে কিছুতেই ভীত হইল না। যখন দেখিলাম, ভয় দেখাইয়া উহার কিছুই করিতে পারিব না, তখন তাহাকে মিষ্ট কথা বলিয়া অনেকরূপ বুঝাইতে লাগিলাম। আমি যেরূপে পারি, তাহার আন্তরিক কথা বাহির করিবার চেষ্টা করিলাম। তাহাকে বলিলাম যে, “যদি তুমি সমস্ত খুলিয়া ঘটনাগুলি আমার সাক্ষাতে বল, তাহা হইলে তুমি যাহাতে এই মোকদ্দমায় লিপ্ত না হইয়া সাফাই থাকিতে পার, সাধ্যানুসারে তাহার চেষ্টা করিব। তোমাকে কোনমতেই চূড়ান্ত বিচারের জন্য হাকিমের নিকট উপস্থিত করিব না। এইরূপ কথার পর তাহাকে অনেক বিষয় জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু, সকল কথার অসম্বদ্ধ উত্তর ভিন্ন, প্রকৃত ব্যাপার অবগত হইতে পারিলাম না। পরিশেষে যখন এইরূপে একদিবস অতীত হইয়া গেল, তখন তাহার প্রাণরক্ষা করিব বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিলাম। সে আমার ব্যবহারে বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়া আমার নিকট সকল কথা প্রকাশ করিল। কথোপকথন ছলে যে সকল কথা বাহির হইল, তাহার অনুপূর্ব্বিক সমস্ত বিবরণ এই স্থানে বর্ণিত না হইয়া, স্থূল বিষয়গুলিই এই স্থানে লিপিবদ্ধ হইল।
দশম পরিচ্ছেদ
গিরিজা আমাকে যাহা কহিল, তাহা শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। যে ভাবনা আমি কেন, কোন কর্মচারীর মনে ক্ষণকালের নিমিত্তও প্রবেশ করে নাই, এখন দেখিলাম, গিরিজা সেইরূপ এক অদ্ভুত কাহিনী বাহির করিল। গিরিজা কহিল, “মহাশয় আমি যে কার্যের নিমিত্ত আপনার হস্তে পতিত হইয়াছি। তাহাতে আমার সম্পূর্ণ দোষ না থাকিলেও আমার কিছুমাত্র দোষ নাই, তাহা আমি বলিতে পারি না। কিন্তু আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই, যে ইহার পরিণাম এত দূরে দাঁড়াইবে! আপনি আমার পূর্ব্বকার সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়াছেন, আমি বিধবা গৃহস্থ রমণী। কিন্তু নানা প্রলোভনে পতিত হইয়া আমি কোন একজন লোকের সহিত আমার গৃহ পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হই। সেই আমাকে কলিকাতায় লইয়া যায়, এবং কিছুদিবস পরে সে আমাকে পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান করে; ইহা অনেকদিনের কথা। সেই সময় অনন্যোপায় হইয়া আমি দাস্যবৃত্তি অবলম্বন করি। সিমলার বিধুবাবুর বাড়ীতে যদিও দাস্যবৃত্তি করিতে প্রবৃত্ত হই, তথাপি নিজের স্বভাব পরিত্যাগ করিতে পারি না। আমার যে ঘর ভাড়া ছিল, তাহাও ছাড়িয়া দিতে সমর্থ হইলাম না। বিধুবাবুর একটি বিধবা কন্যা ছিল, তাহার নাম ও আমার নাম একই। তিনি আমাকে বিশেষ ভালবাসিতেন, এবং আমাকে মিতিন মিতিন বলিয়া ডাকিতেন। তিনি মনিব, আমি চাকরাণী হইলেও কিন্তু তিনি আমাকে সেরূপভাবে দেখিতেন না, আমাকে ভগিনীর মত ভালবাসিতেন। সময়ে সময়ে তাঁহার মনের কথা আমার নিকট প্রকাশ করিতেন। এমন কি, যে সকল কথা কেবল তিনি ভিন্ন অপরের জানিবার উপায় নাই, সেই সকল কথাও আমার নিকট প্রকাশ করিতে কিছুমাত্র সঙ্কুচিত হইতেন না। মিতিন আমার বাল্যবিধবা, তিনি যে কখনও তাঁহার স্বামীর সোহাগ প্রাপ্ত হইয়াছেন, তাহা আমার বোধ হয় না। যখন তিনি যৌবনে উপনীত হয়েন, তখন আমারই মত তাঁহারও ভাগ্য পুড়িয়া যায়। কিন্তু, বড়লোকের বাড়ী নানা লোকজনে সদাসৰ্ব্বদা পূর্ণ থাকিত বলিয়াই, তিনি সকল সময়ে আপন মনোরথ পূর্ণ করিতে সমর্থ হইতেন না। সেই নিমিত্তই পরিশেষে তিনি আমার সহিত এত ভালবাসা স্থাপন করেন। আমার মিতিন এখন তাঁহার যৌবনকাল ক্রমে অতিক্রম করিতে লাগিলেন। কিন্তু যৌবনের লালসা নিবৃত্ত না হইয়া ক্রমেই আরও বর্দ্ধিত হইতে লাগিল। সেই সময়ে তাঁহারই পরামর্শ-মত আমি তাঁহাদিগের বাড়ীতে রাত্রিযাপন করিতে লাগিলাম। কিন্তু আমার ভাড়া করা ঘর পরিত্যাগ করিলাম না। সেই ঘরের ভাড়া এখন আর আমাকে দিতে হইত না, আমার মিতিন গিরিজাসুন্দরীই উহা প্রদান করিতেন। কেবল ঘরভাড়া কেন, উহা ব্যতীত সময়ে সময়ে আমি আরও অনেক অর্থ তাঁহার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইতাম। এই সময়ে আমার মিতিন নিত্য গঙ্গাস্নান আরম্ভ করিলেন। আমি তাঁহার সঙ্গে গমন না করিলে তাঁহার গঙ্গাস্নান হইত না। রাত্রিশেষে প্রত্যহই আমি তাঁহার সহিত গমন করিতে লাগিলাম। কিন্তু বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া একবারে ভাগীরথী তীরে গমন না করিয়া প্রত্যহই তিনি প্রথমে আমার সেই ভাড়াটিয়া ঘরে গমন করিতেন। সেইস্থানে প্রায় এক ঘণ্টাকাল অতিবাহিত করিয়া, পরিশেষে তাঁহার তথাকার উপার্জিত পাপ সকল নাশ করিবার মানসে সেই পাপনাশিনী গঙ্গার নিকট গমন করিয়া স্নান করিতেন। তিনি প্রত্যহ আমার ঘরে যে কেন গমন করিতেন, তাহা আমি স্পষ্ট করিয়া আর বলিব না; ইহাতে আপনি যেরূপ বুঝিতে পারেন, তাহাই বুঝিয়া লউন।
“এইরূপ অনেকদিবস অতীত হইয়া গেল। পরিশেষে বাবুর মনে কিরূপ সন্দেহ হওয়ায়, তিনি আমাকে কাৰ্য্য হইতে অপসারিত এবং রাত্রিদিন আমার ঘরের নিকট একটি লোক পাহারায় নিযুক্ত করিলেন। সেইদিবস হইতে মিতিনের সহিত আমার দেখা শুনা বন্ধ হইল। প্রত্যূষে গঙ্গাতীরে গমন করিয়া তাঁহাকে আর দেখিতে পাইতাম না; বাবুর বাড়িতে গমন করিতে চাহিলে, দ্বারবানগণ আমাকে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে দিত না। আমার উপর সকলে যে কেন এরূপ ব্যবহার আরম্ভ করিলেন, তাহা কেহ স্পষ্ট করিয়া কহিলেন না। কিন্তু আমি মনে মনে সকল বুঝিতে পারিলাম।
“এইরূপ অবস্থা দেখিয়া আমি আমার ভাড়াকরা ঘর ছাড়িয়া দিলাম, এবং এখন যে স্থানে কৰ্ম্ম করিতেছি, সেই বাড়ীতে চাকরাণীর কৰ্ম্মে নিযুক্ত হইলাম। সেই সময়ে বিধুবাবুর একটি চাকরাণীর সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়। যে স্থানে আমি কর্ম্ম করিতেছি, তাহা আমি তাহাকে দেখাইয়া দিই। তাহার নিকট হইতে মিতিনের সংবাদ গ্রহণ করি, আমারও অবস্থা আমার সইয়ের নিকট বলিবার নিমিত্ত তাহাকে অনুরোধ করি
“এই ঘটনার দুইদিবস পরে সেই চাকরাণী পুনরায় আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করে, ও বলিয়া যায়, ‘গিরিজাসুন্দরী আগামী সোমবারে কালীঘাটে গমন করিবেন। যদি পার, সেইস্থানে গমন করিও, তাহা হইলে সেইস্থানে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে।’
“সোমবারে আমি আমার মনিবের নিকট ছুটি লইয়া কালীঘাটে গমন করিলাম। বহুদিবস পরে সেইস্থানে আমার মিতিনের সহিত সাক্ষাৎ হইল, কিন্তু অধিক কথা কহিবার সময় হইল না। কেবলমাত্র তিনি কহিলেন, ‘পথের ধারে একখানি ঘরভাড়া করিয়া পুনরায় আগামী সোমবারে এইস্থানে আগমন করিও। কোথায় যে ঘরভাড়া লইয়াছ, তাহা আমাকে বলিয়া যাইও।’ আমি তাহাই করিলাম, এই বর্ত্তমান ঘরখানি ভাড়া করিয়া পুনরায় সোমবারে কালীঘাটে গমন করিয়া তাঁহাকে সংবাদ প্রদান করিলাম। ‘পরদিবস গঙ্গার ঘাটে দেখা হইবে’ এই বলিয়া তিনি প্রস্থান করিলেন।
“পরদিবস প্রাতঃকালে আমি গঙ্গার ঘাটে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, তিনিও আসিয়া উপস্থিত হইলেন, কিন্তু তাঁহাকে কোন কথা না বলিয়া তাঁহার জ্ঞাতসারে দূরে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। যখন দেখিলাম, তিনি স্নান সমাপন করিয়া গমন করিবার উদ্যোগ করিতেছেন, তখন তাঁহাকেও কিছু না বলিয়া তাঁহার অগ্রে অগ্রে অর্থাৎ দূরে দূরে চলিলাম। তাঁহার সহিত একজন চাকরাণী ছিল মাত্র দেখিলাম। আমি যে পথ দিয়া গমন করিতেছিলাম, তিনিও তাহার অনুসরণ করিতেছিলেন। ক্রমে যে পথে আমি ঘরভাড়া করিয়াছিলাম, সেই পথে প্রবেশ করিলাম, তিনিও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতে লাগিলেন। আমি আমার ঘরের নিকট আসিয়া দরজা খুলিলাম, ও সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। মিতিন আমার ঘর দেখিয়া লইয়া প্রস্থান করিলেন, কিন্তু সেই সময়ে আমাকে আর কোন কথা বলিলেন না।
“পরদিবস অতি প্রত্যূষে তিনি আসিয়া আমার দরজায় ধাক্কা দিলেন, আমি দরজা খুলিয়া দিলাম। সেইদিবস হইতে আবার পূর্ব্বরূপ চলিতে লাগিল, এইরূপ বহুদিবস কাটিয়া গেল; পরিশেষে, সেই নিদারুণ-দিবস আসিয়া উপস্থিত হইল। পূর্ব্বের মত যেমন তিনি এবং হরিবাবু আমার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন, আমি ঘর হইতে বহির্গত হইয়া পথের উপর দাঁড়াইয়া রহিলাম। পরিশেষে যখন হরি প্রথমে আমার ঘর পরিত্যাগ করিলেন, তাহার পশ্চাৎ যেমন গিরিজা দরজার বাহিরে আসিল, অমনি বিধুবাবুর পুত্র রামবাবু কোথা হইতে আসিয়া হঠাৎ তাঁহাকে আক্রমণ করিল, এবং সেই রাজবর্ম্মের উপর তাঁহাকে ভীষণ-ছুরিকাঘাত করিতে লাগিল। গিরিজা আমার সেই স্থানে পড়িয়া ইহজীবন পরিত্যাগ করিল, রক্তে সেইস্থান ভিজিয়া গেল। পরিশেষে তিনি গিরিজার মৃতদেহ সেইস্থান হইতে উঠাইয়া, আমার ঘরের ভিতর নিক্ষেপ করিলেন; আমাকেও সমুচিত শাস্তি দিবার নিমিত্ত সেই ঘরের ভিতর এবং বাহিরে অনুসন্ধান করিলেন। আমি মৃতের ন্যায় চুপ করিয়া সেই অন্ধকারের মধ্যে একটি গ্যাসের থামের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া ছিলাম। সুতরাং, তিনি আমাকে দেখিতে না পাইয়া, গিরিজার মস্তক কাটিয়া তাহার একখানি গামছায় করিয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। বোধ হয়, দুই মিনিটের মধ্যে তিনি এই সমস্ত কার্য্য শেষ করিয়া চলিয়া গেলেন। গ্যাস নিবিয়া যাওয়ার অতি অল্পক্ষণ পরেই এই ঘটনা ঘটিয়াছিল। এই অবস্থা দেখিয়া আমি নিতান্ত ভীত হইলাম। আস্তে আস্তে আমার ঘরে প্রবেশ করিয়া বাক্সের ভিতর আমার যে কয়েকটি টাকা ছিল, তাহা সংগ্রহপূর্বক আমার ঘরের দরজা বাহির হইতে বন্ধ করিয়া সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। ইহাই আমি জানি। ইহা ব্যতীত কোন কথা আমি অবগত নহি।”
গিরিজার এই কথা শুনিয়া আমি বিশ্বাস করিলাম। তাহাকে সঙ্গে করিয়া কলিকাতায়ও আনিলাম। অনুসন্ধানে বিধুবাবুর বাড়ীও পাইলাম; তাঁহার পুত্র রামবাবুর সহিত সাক্ষাৎও হইল। গিরিজাকে বাস্তবিকই সেই বাড়ীতে পাওয়া গেল না, কিন্তু সকলেই কহিল, গিরিজা তীর্থপর্যটনে গমন করিয়াছে। যাহা হউক, অতঃপর রামবাবু এই হত্যা সম্পন্ন করিয়াছেন বলিয়া ধৃত হইলেন। কিন্তু বড় কৌন্সলীর কুটিল আইনের তর্কে এই মোকদ্দমা টিকিল না। কেবলমাত্র পরিচারিকা গিরিজা ভিন্ন আর কোন সাক্ষী ছিল না। তাহাতে সেই মৃতদেহই যে রামবাবুর ভগিনী গিরিজার দেহ, তাহা অপর সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণ হইল না। কাজেই রামবাবু এই হত্যা করিয়াও নিষ্কৃতিলাভ করিলেন কিন্তু যে পরিমিত অর্থ উকীল কৌন্সলীর ঘরে প্রয়োগ করিল, তাহাতেই তাঁর যথেষ্ট শাস্তি হইল। সেই সময় হইতে তাঁহার অবস্থার আর পরিবর্ত্তন হইল না। নিত্য দরিদ্র না হইলেও এখন আর তিনি বড় মানুষ নহেন।
[বৈশাখ, ১৩০১]