1 of 2

গিরগিটি – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী

গিরগিটি – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী

সস্তা টিনের ঘর হলেও বাড়িটা তার ভাল লাগে। লোকজন একরকম নেই বললেই চলে। মোট আর-একঘর ভাড়াটে। তা-ও ঠিক পাশাপাশি ঘর না। উঠোন পার হয়ে বাঁ দিকের ভাঙা জিরজিরে একটা দেওয়াল ঘেঁষে ডুমুর আর পেঁপে-জঙ্গলের আড়াল করা নিচু একচালার একটা খুপরি নিয়ে বুড়ো মানুষটা ওধারে পড়ে আছে। ওর থাকা না-থাকা সমান কথা। সারা দিনের মধ্যে এক-আধবার যদি কাসির শব্দ কি যন্ত্রপাতি চালাবার টুংটাং আওয়াজ কানে আসে,—আসে না। ডুমুরগাছ পেঁপে-জঙ্গল ভাঙা নড়বড়ে পাঁচিল সামনে নিয়ে ঐটুকুন ডেরার জং-ধরা পুরনো টিনের দরজার আড়ালে বসে দিনরাত বুড়ো ভুবন সরকার কি করে দেখবার তিলমাত্র কৌতূহল বা ইচ্ছাও অবশ্য তার হয় না। বরং যদি কেউ এখন মায়ার ঘরে উঁকি দেয় তো দেখতে পাবে দেওয়ালে টাঙানো একটা বড় আরশির সামনে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে ও নিজেকে দেখছে। দেখছে আর যেন আনন্দের আতিশয্যে মৃদু শিস দেওয়ার মতন একটা গানের সুর জিহ্বা ও ঠোঁটের মাথায় জড়িয়ে রেখে রেখে তারপর একসময় নিজের নিশ্বাসের সঙ্গে বার করে সেটা ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে। গায়ের জামায় বোতাম নেই, আঁচলটা ঢিলে হয়ে মাটিতে লুটোয়, খোঁপার বাঁধন খুলে দেওয়াতে ঘাড়ে পিঠে কোমর অবধি একরাশ কালো চুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মাঝারো গড়ন। রঙ খুব ফর্সা না। কিন্তু মুখখানা সুন্দর। অন্তত মায়ার নিজের কাছে নিজের ছোট্ট পাতলা কপাল আর দু’ধারে একটু বেঁকে যাওয়া না-সরু-না-মোটা ভুরু ও ঢালুর দিকে ঈষৎ ছড়িয়ে পড়া নাক ও কালো পালক ঘেরা চোখের লালচে মত বা বলা যায় বাদামী রঙের চকচকে মণি দুটো অসম্ভব ভাল লাগে। হ্যাঁ, আর ওর কচি পেয়ারার মতন ছোট্ট সুগোল মসৃণ একখানা থুতনি। নিজের কাছে তো বটেই প্রণবের কাছেও এই চোখ এই নাক এই ভুরু গাল কপাল এবং বিশেষ করে শক্ত পালিশ গোল ছোট্ট থুতনিটা যে কত প্রিয় তা মায়া এই দু’বছরে বেশ বুঝে নিয়েছে। বাপ্, আদর করতে সকলের আগে প্রণব এই থুতনি ধরে নাড়া দেবে টিপবে রগড়াবে নয়তো থুতনির ওপর নিজের নাক কি গালটা চেপে ধরে ঘষবে। খসখসে গালের ঘষায় মায়ার থুতনির ছাল উঠে যায় যেন। কিন্তু তা কি আর কোনদিন গেছে! দু’বছর আগে কুমারী বয়সে যেমন ছিল আজও সেই থুতনি নিটোল অক্ষত হয়ে নিজের জায়গায় চুপ করে বসে আছে। যেন এর ক্ষয় নেই, বৃদ্ধি নেই, জরা নেই। কচি পেয়ারা। তুলনাটা মনে করে মায়া হাসল। অথচ দু-দুটো বর্ষায় না জানি কত সহস্র গাছের পেয়ারা বড় হল, পাকল কি পাকবার আগেই পোকা কি বাদুড়ের কামড়ে নষ্ট হয়ে নিচে ঝরে পড়ল। আনন্দের আতিশয্যে মায়া বাঁ হাতের দুটো আঙুল দিয়ে নিজের সুন্দর থুতনিটা একবার স্পর্শ করল। তারপর আরশির কাছ থেকে সরে এসে এধারের দেওয়ালের ব্রাকেটে কুঁচিয়ে রাখা খয়েরি-পাড় বুটিদার শাড়ি, আটপৌরে একটা ব্লাউজ ও শুকনো তোয়ালেটা টেনে নামাল। সাবানের কেস ও দাঁতন নিতে ভুলল না। কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে তখনি কি ও কুয়োতলায় গেল? না। এ-বাড়ির সুবিধা এই। কানে শুনতে খারাপ লাগে যে কল নেই। কিন্তু তাতে কি! দু’জন তো ওরা মানুষ। অফিসে যাবার আগে রাস্তার কল থেকে প্রণব দু’বালতি জল ধরে নিয়ে আসে। তাতেই তাদের রান্না আর খাওয়া কুলিয়ে যায়। বিকেলে এক-আধ বালতি আনতে হয়। তা-ও রোজ না।কোনো কোনো দিন। এদিকে স্নান হাত-মুখ ধোওয়া বাসনকোসন ধোওয়া কাপড়-কাচাকাচি সব, সব পাতকুয়োর জলে। কত সুবিধে। সারাদিন বালতি ডুবিয়ে ডুবিয়ে যত খুশি জল টেনে তোল কেউ কিছু বলবার নেই। তা ছাড়া ঘড়িধরা সময় নিয়ে কলে জল এলো কি চলে যাচ্ছে বলে যে তাড়াহুড়ো করে কাজ সারতে হয় না এটাই মায়ার সবচেয়ে ভাল লাগে। প্রচুর সময় নিয়ে আলসেমির নৌকোয় গা ভাসিয়ে দিয়ে এক-এক সময় এক-একটা কাজে হাত লাগালেই হল। আর বড় কথা ভিড় বলতে কিছু নেই এখানে। মায়া ছাড়া আর কারোর কুয়োতলায় কাজ আছে বলেও মনে হয় না। প্রণব সেই সাতসকালে দু’বালতি জল মাথায় ঢেলে খেয়ে অফিসে বেরিয়ে যায়। ফেরে বিকেল পাঁচটায়। আর কে? ওপাশের ঘরের বুড়ো? লোকটাকে মায়া কোনোদিন কুয়োতলায় দেখল না। ও আসলে স্নান করে কি না খায় কি না মায়ার সে সম্বন্ধে ঘোর সন্দেহ আছে। খায় নিশ্চয়ই। না হলে আর বেঁচে আছে কি করে! কিন্তু রান্না করে কি? তা হলে তো অন্তত এক-আধ বালতি কুয়ো থেকে কি কল থেকে হোক,—আর রান্না না করলেও এমনি তো জল খেতে হয়—সেইটাই বা কোথা থেকে আসে! রাত ন’টায় আর একবার রাস্তার কলে জল আসে। যদি তখন? কিন্তু তা-ও মায়ার চোখে পড়েনি। অবশ্য মাঝে মাঝে রাত বারোটায়ও জল আসে। তখন কি? তা অবশ্য মায়া বলতে পারে না। বা রাস্তার কল থেকে এত রাত্রে জল ধরে তার ঘরের সামনে দিয়ে কেউ যাচ্ছে কি না দুপুর রাত অবধি জেগে বসে থেকে লক্ষ্য করার মায়ার ইচ্ছা ধৈর্য কোনোটাই নেই। বড় কথা এখানে এ-বাড়ির উঠোন যেমনি ফাঁকা তেমনি কুয়োতলাটাও সারাক্ষণ ফাঁকা থাকে বলে মায়ার যখন ইচ্ছা তখন যতটা খুশি সময় নিয়ে কাজ করার সুবিধা আছে। এই চেয়েছিল ও, এমনটি সে চাইছে। শাড়ি শায়া ব্লাউজ এক হাতে, আর-এক হাতে দাঁতন সাবানের বাক্স নিয়ে ও উঠোনের ডান পাশের নিম গাছটার তলায় এসে দাঁড়াল। এখন বর্ষা ঋতু। পাতা ও ফলে ফলে গাছটা বোঝাই হয়ে আছে। দুটো-একটা নিমফল পাকছে। একটা-দুটো মাটিতে পড়ছে। আর পাকা নিমফলের লোভে রাজ্যের বুলবুলি উড়ে এসে কিচিরমিচির করছে উড়ছে ছুটোছুটি করছে ডাল থেকে ডালে। মায়া ওর সুন্দর থুতনি তুলে ওপরের দিকে তাকিয়ে পাখিদের নিমফল খাওয়া দেখল। নির্জন কুয়োতলার মতন নিমগাছটাও এ-বাড়ির একটা সম্পদ, অন্তত মায়ার কাছে, ভাবে ও। অবশ্য বাড়িওয়ালা বরদাসুন্দর বটব্যাল জল্পনা করছে, এপাশের নিমগাছ, ওপাশের ডুমুর আর পেঁপের জঙ্গল সাফ করে ফাঁকা উঠোনের সবটা জুড়ে বড় দোতলা পাকা দালান তুলবে। টিনের ঘর রাখবে না। কিন্তু সেটা কবে হবে, আজকালই হচ্ছে কি না শোনা যায়নি। অবশ্য তাই নিয়ে মায়া কি তার স্বামী প্রণব মাথা ঘামায় না। টিনের ঘর ভেঙে দিলে সস্তা ঘর খুঁজতে তারা কোন দিকে যাবে, না কি এখানেই দোতলার পাকা ঘরে একটু ‘সুবিধামতন’ ভাড়া হলে থেকে যাবে তা-ও তারা কিছু ঠিক করেনি। বরং সেসব না ভেবে মায়া সবুজ চকচকে চিকরিকাটা নিমপাতাগুলোর নাচানাচি দেখতে লাগল। আকাশের থমথমে মেঘলা ভাব কেটে গিয়ে একটু সময়ের জন্যে রোদ উঠতে পাতাগুলো যেন হাততালি দিয়ে হেসে উঠল। গাছের গুঁড়ি ঘেঁষে একটাল ইঁট কবে থেকে পড়ে আছে। মখমলের মতন পুরু নরম সবুজ শ্যাওলার একটা আস্তরণ সবগুলো ইঁটকে যেন জমিয়ে এক করে দিয়েছে। আগুনে রঙের দুটো ফড়িং সবুজ ইঁটের পাঁজা ঘিরে নাচানাচি করছে। ওপাশের ডুমুরের ডালে এত বড় একটা গিরগিটি স্থিরচোখে তাকিয়ে ফড়িং দুটোকে দেখছে। যেন কোথাও একবার একটু শান্ত হয়ে ওরা বসলে সে লাফিয়ে পড়ে ওদের ঘাড় কামড়ে ধরবে। করুণ চোখে ফড়িং দুটোকে আর একবার দেখে মায়া আস্তে আস্তে কুয়োতলার দিকে চলল।

কুয়োতলার এখানে-ওখানে লম্বা ঘাস গজিয়েছে। জায়গাটা সিমেন্ট করা নেই। গোড়ার দিকে মায়ার অসুবিধা হত। জল কাদা আর আগাছার জঙ্গলে দাঁড়িয়ে দড়ি বাঁধা বালতি নামিয়ে কুয়ো থেকে জল টেনে তুলতে ওর এমন গা ঘিনঘিন করত। কিন্তু আশ্চর্য, ক’দিনে এটা সয়ে গেছে। প্রণব খানছয়েক পুরনো ইঁট বিছিয়ে দেওয়ার পর থেকে মায়া আর কোনো অসুবিধাই বোধ করে না। বরং কুয়োতলার এই মাটি, লম্বা ঘাস, ঘাসের ফাঁকে চিকচিকে জল কাদা আর অগুনতি কিলকিলে মশার বাচ্চা দেখতে ওর এখন ভাল লাগে। যেন এগুলো না থাকলে খারাপ লাগত। বিয়ের পর থেকে এতকাল ওরা শহরের মাঝখানে যে বাড়িতে ছিল সেখানে সিমেন্ট করা শক্ত ঠনঠনে কলতলার বাঁধানো চৌবাচ্চার পাশে বসে একদঙ্গল মেয়েছেলের কাপড় কাচাকাচি কলরব আর তাড়াহুড়োর চাপে পড়ে মায়ার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠত। মাটি আকাশ ঘাস পোকার গন্ধ ছিল না। ছিল দেওয়াল আর দেওয়াল, আর কটকটে ফিনাইলের গন্ধ আর সস্তা সাবান হেয়ার-অয়েলের মিঠে পচা গন্ধ ভরা বদ্ধ বাতাসের গুমোট। কলতলায় যতক্ষণ থাকত মায়ার গা-বমি করত। এখানে খোলা হাওয়া আর ঘাসের শীষের দোলানি আর নিমগাছ থেকে ভেসে আসা পাকা নিমফলের গন্ধ আর বুলবুলির কিচিরমিচিরের এক আশ্চর্য নির্জন জগতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে মায়া যতক্ষণ খুশি প্রণবের কিনে দেওয়া ভাল সাবানটা মাখতে পারে,—যেভাবে খুশি। বাপস্, আগের বাড়িতে ইচ্ছামতন খোলা-গা হয়ে বসে মায়া একদিন সাবান মাখতে পারেনি। হ্যাঁ, মেয়েরাই—একটি মেয়ের গায়ের কাপড় সরে গেলে কি খুলে ফেললে এমন সন্দিগ্ধ কুটিল চোখে তাকায়? আর চোখ টেপাটেপি ঠোঁট টেপাটেপি। এখানে সেসব বালাই নেই। মায়া একটানে গায়ের ব্লাউজটা খুলে ফেলল। কাঁচুলি ও সায়ার বাঁধন আলগা করে দিতে সরসর করে সেগুলো আপনা থেকে খসে পড়ল। পা দিয়ে এক পাশে ও-দুটো ঠেলে সরিয়ে রাখল ও। এমনি জল দিয়ে কেচে দেবার ইচ্ছা। এখন শুধু পেঁয়াজের খোসার মতন পাতলা শাড়িটা ওর গায়ে পতপত করছিল। এলোমেলো হাওয়া। হাওয়ার ঝাপটায় শাড়িটা একসময় গায়ের চামড়ার সঙ্গে লেপ্টে যেতে হাড় ও মাংসের স্থূল সূক্ষ্ম বাঁকা ও আধ-বাঁকা রেখাগুলো একসঙ্গে জেগে উঠল। এ এক আশ্চর্য অনুভূতি! গায়ে জল ঢালার আগে রোজ ও কিছুক্ষণ এমনি দাঁড়িয়ে থেকে শাড়ির পতপত ও হাওয়ার সিরসিরানিটা অনুভব করে। যেন প্রত্যেকটা রোমকূপের মধ্যে হাওয়া ঢুকে গলা বুক পিঠ পেট কোমর তলপেট ঊরু হাঁটু হাঁটুর নিচে পায়ের মাংসল ডিম দুটোকে সতেজ স্নিগ্ধ করে দেয়। আঁচলটা আর গায়ে রাখে না ও। কোমরে জড়ায়। তারপর কুয়োপাড়ের উঁচু সিমেন্টের ওপর কনুইয়ের ভর রেখে কোমর থেকে থুতনি পর্যন্ত সবটা শরীর সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নিচের অন্ধকার জলের দিকে তাকায়। জলের আয়নায় নতুন করে সে নিজেকে দেখে। যেন চিনতে পারা যায় না এ-মায়া সেই মায়া, এই কপাল সেই কপাল, এই থুতনি সেই থুতনি, এ-বুক সেই বুক। কি, ঘরের আরশিতে এইমাত্র সে যা দেখে এসেছে—। যা সুন্দর শক্ত জমাট আর এখানে জলের অন্ধকারে তা কেমন বিশ্রী হয়ে পড়েছে। এ-অবস্থা দেখে মায়া প্রথমটায় চমকে ওঠে, ভয় পায়। তারপর অবশ্য কারণটা বুঝতে পেরে নিজের মনে ও হাসে। সামনের দিকে অতটা ঝুঁকে থাকলে নিজের ঐ চেহারা দাঁড়াবেই। সুতরাং ভয় মিছে। আসলে ওর—চট্ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের ওপর চোখ রেখে সে নিশ্চিন্ত হয়। তেমনি নিটোল মসৃণ জোড়া ফুলের স্বপ্ন হয়ে কার দিকে তাকিয়ে আছে ওরা সারাক্ষণ? কি দেখছে? মায়া আবার নিজের মনে একটুখানি হাসল। আবার জোরে হাওয়া বইছিল আর ওর সারা শরীর সিরসির করছিল, এমন সময় হঠাৎ ও চমকে উঠল। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে কে হেঁটে এল না! ব্যস্ত হয়ে আঁচলের খুঁটটা কোমর থেকে টেনে খুলে তাই দিয়ে ও কোনরকমে বুক ঢেকে তারপর ঘাড় ফেরাল। ঘাড় ফিরিয়ে মানুষটার চেহারা দেখে মায়া নিশ্চিন্ত হয়। ভয় পাওয়ার কিছু না। একটা হাঁড়ি হাতে করে ভুবন সরকার অদূরে পেয়ারা-চারাটার গুঁড়ি ঘেঁষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। যেন জল নিতে এসে কুয়োতলায় স্ত্রীলোক দেখে বুড়ো লজ্জা পেয়ে আর পা বাড়াচ্ছে না। মায়া কিন্তু ততটা লজ্জাবোধ করল না। কোনোদিনই করে না। পাঁকাটির মত সরু জিরজিরে হাত-পা, শুকনো খটখটে ক’খানা পাঁজর, শনের মত পাকা একমাথা লম্বা রুক্ষ চুল ও হলদে ফ্যাকাশে চোখজোড়া নিয়ে কালেভদ্রে যদি কখনও লোকটা তার সামনে এসে দাঁড়ায় কি পাশ কেটে চলে যায়, মায়ার মনেই হয় না একটা মানুষ, একজন পুরুষ। ঠিক বুড়ো হয়েছে বলে না, ওর ক্ষীণ হাত-পা নিষ্প্রাণ চাউনি, মন্থর চলার মধ্যে এমন একটা কিছু মিশে আছে যে, মায়ার কখনও কখনও ওকে দেখলে ডুমুরতলার ওধারের পুরনো ভাঙা পাঁচিলটা কি পেঁপে-জঙ্গলের পাশের মৃত নিপ্রাণ সহস্র ক্ষতচিহ্নযুক্ত মাদার গাছটার চেহারা মনে পড়ে। এর বেশি না। অথচ এ-ও যে বরদাসুন্দর বটব্যালের সাড়ে বারো টাকা ভাড়ার টিনের ঘরের ভুবন সরকার নামধেয় একজন মান্য-গণ্য বাসিন্দা এবং একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি মায়া ভুলে যায়।

একপাশে একটু সরে দাঁড়িয়ে মায়া অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু ভুবন জল নিতে অগ্রসর হচ্ছে না। যেন সাহস পাচ্ছে না।

‘নিন, আপনি জল নিয়ে যান।’ মায়া ডাকল।

মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল ভুবন। ডাক শুনে চোখ তুলল।

‘আপনি চান সেরে নিন। আমার পরে হলেও চলবে।’ কথা বলল না লোকটা। যেন পোকায় খাওয়া একটা শুকনো ডুমুরপাতা খসখস শব্দ করে উঠল।

‘আমার চান সারতে দেরি হবে।’ কথাটা বুড়োকে বুঝিয়ে বলা দরকার, না হলে বুঝবে না, টের পেয়ে মায়া রাগ না করে বরং শব্দ করে হাসল। ‘আপনাকে ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখে আমার চান করা চলবে কি?’

হাঁ করে তাকিয়ে ভুবন তার একমাত্র প্রতিবেশিনীর হাসি দেখছিল। না কি কচি সবুজ চিকরিকাটা নিমপাতার গায়ে বর্ষা-দুপুরের রৌদ্রের ঝিলিক দেখছে বুড়ো, ভাবল মায়া। তার ঠোঁটে চোখে সত্যি তখন মেঘ-ভাঙা এক আঁজলা হলুদ রোদ ঝিলমিল করছিল।

পেয়ারা-পাতার ছায়ায় দাঁড়িয়ে শুকনো কাঠের মত মানুষটা যেন আরো কালো হয়ে উঠলো।

‘না, আপনার চান সারা হোক। আমি ঘুরে আসছি, হাতের একটু কাজ বাকি আছে বটে।’ বলে বুড়ো আর দাঁড়ায় না, সরে যায়। কষ্ট লাগে মায়ার। হয়তো এভাবে বলা ঠিক হয়নি। যদি দাঁড়িয়ে থাকত ওখানে তো দোষ ছিল কি। তা ছাড়া জল নিতে ও বড়-একটা আসে কই। নিশ্চয় বিশেষ প্রয়োজন ছিল এখন। গায়ে জল ঢালার আগে বুকের আঁচলটা আবার কোমরে জড়াতে জড়াতে মায়া ভাবে। এ-বাড়ির ভাঙা পাঁচিল মরা গাছ কি ছাতাপড়া পুরনো ইঁটের পাঁজার সঙ্গে যে-লোকটার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে মায়া পরিতৃপ্ত ছিল আজ তাকে হঠাৎ আলাদা করে দেখতে যাওয়া, কি তার পায়ের শব্দে গা ঢেকে ফেলার মধ্যে কি একটা নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পেল না? মায়ার বুকের মধ্যে কেমন খচখচ করতে লাগল। এক টুকরো অনুশোচনা গলার কাছে আটকে থেকে যেন জায়গাটা জ্বালা-জ্বালা করে উঠল। স্নান করার আনন্দ তেমন করে ও অনুভব করতে পারল কই। সাবান-গোলা জল দুধের ধারা হয়ে ওর উষ্ণ কোমল ঝকঝকে চামড়ার ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। একলা মায়া ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ তা দেখছে বলে আজ আর সে মনে করতে পারল না। অথচ ওরা রোজ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখে, হ্যাঁ, সহস্র পাতার চোখ মেলে এ-বাড়ির নিমগাছ, রোদ কি-জল ঠেকাতে বড় বড় ছাতা মাথায় ওধারের পেঁপে গাছগুলো, এপাশের কচি পেয়ারা গাছটা, ওদিকের পাঁচিলের মাথায় কাকগুলো পর্যন্ত, ইঁটের পাঁজা ছেড়ে লাল ফড়িং দুটো উড়ে এসে ঘুরে ঘুরে মায়ার ভিজে চুল দেখে নাভি দেখে স্তন দেখে জঙঘা দেখে। কচি কলাপাতার বোঁটার মত ওর পিঠের ঋজু মসৃণ সুন্দর শিরদাঁড়া ঘেঁষে একটা মশা হুল ফুটিয়ে দিয়ে এতটা রক্ত খেয়ে পেট মোটা করে একসময় উঠে গেল। যেন মায়া টের পেল না। ভাল করে তোয়ালে দিয়ে গা রগড়াতে আজ তার হাত উঠছিল না। ভাবছিল ও মানুষটাকে এখানে দাঁড়াতে নিষেধ করা আর ডুমুরের মরা ডালটাকে এদিকে উঁকি দিতে বারণ করা এক কথা। যেন সেই অভিমানে ফড়িং দুটো এল না, পাঁচিলের মাথায় কাকগুলো নেই, পেঁপে গাছগুলো ছাতার আড়ালে মুখ ঢেকেছে, নিমগাছটা বুলবুলিদের ফল খাওয়াতে ব্যস্ত। মায়ার স্নান দেখতে কারো উৎসাহ নেই। ওদের একজনকে সরে দাঁড়াতে বলায় বাকি সবাই রাগ করেছে দুঃখ পেয়েছে। অথচ এদের চোখের সামনে নিজেকে মেলে ধরা খুলে দেওয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে পাঁচ বালতির জায়গায় পনেরো বালতি জল ঢেলেছে ও, প্রণবের কিনে দেওয়া সাবানটাকে বার বার ঘষে কদিনে ক্ষয় করে এনেছে।

মৃদু একটা আঘাত বুকে নিয়ে কোনো রকমে ও স্নান শেষ করল। ভাল করে মাথা মোছা হল না তোয়ালে বা কাপড়ের জল নিংড়ানো হল না। মন্থর ভারী পায়ে কুয়োতলা ছেড়ে ও ঘরে ফিরে এল। তখনি আবার তার আরশির সামনে দাঁড়াবার কথা। কিন্তু তা সে করল না। ভেজা কাপড়গুলো মেলে না দিয়ে দলা করে সেভাবেই দরজার পাল্লার ওপর রেখে দিল। টস্‌টস্‌ করে জল ঝরছিল সেগুলো থেকে। মায়া এক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে তা দেখল কিন্তু সে-সম্পর্কে ও কিছু ভাবছে বলে চোখ দেখে মনে হল না। চৌকাঠ পার হয়ে আস্তে আস্তে ও আবার উঠোনে নামল। আবার এক সেকেণ্ড কি ভাবল, তারপর ওপাশের ডুমুর-জঙ্গল ও ভাঙা পাঁচিলটার দিকে তাকিয়ে ডেকে বলল, ‘আমার হয়ে গেছে আপনি যান।’

কেউ সাড়া দিল না। টিনের ডেরা থেকে বেরোলো না কেউ। মায়া আর একটু সময় অপেক্ষা করল। একটা শালিক ওর পায়ের শব্দে উঠোনের ঘাস ছেড়ে উড়ে পেয়ারার ডালে গিয়ে বসল। এক পা এক পা করে মায়া ডুমুরতলার দিকে এগোয়।

টিনের চাল প্রায় মাথায় ঠেকে। ভিতরে ঢুকল না ও। চৌকাঠ ধরে দাঁডিয়ে একবার উঁকি দিয়ে দেখল। অবাক হল না, বরং মায়ার দুঃখ হল। মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছে। হাতের কাছে মাটিতে দুটো-একটা যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। কোনোটা জং-ধরা। কোনোটার হাতল নেই, কি মাথা ভেঙে গেছে। ওধারে দুটো গোল মতন কি যেন পড়ে আছে। ইলেকট্রিকের কলকব্জা কিছু হবে, মায়া অনুমান করল। পাশেই আর একটা জিনিস দেখে মায়া চিনল। টেবিল ফ্যান। দুটো ব্লেডই ভেঙে গেছে, একটা আছে। ওটা ইলেকট্রিক স্টোভ না হয়ে যায় না। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সব দেখা শেষ করে মায়া আবার বুড়োর মুখটা দেখতে লাগল। দুটো চোখ গর্তে ঢুকে পড়েছে। কপালের চামড়া ঠেলে পাকানো দড়ির মতন একটা মোটা শিরা বেরিয়ে আছে। কাঠের টুকরোর মতন দুটো চোয়াল। নাকটা উঁচু, গাল কপাল শুকিয়ে যাওয়ার দরুন আরো বেশি উঁচু দেখাচ্ছে। গলায় বুকে ক’খানা শুকনো হাড় ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। শিয়রের কাছে শূন্য অ্যালুমিনিয়মের ডেকচিটা পড়ে আছে। দেখে মায়ার দু’চোখ আবার ছলছল করে উঠল। একটু সময় ইতস্তত করে তারপর ও আস্তে ডাকল, ‘ঘুমিয়ে পড়লেন কি? ঘুমোচ্ছেন?’

‘হুঁ হুঁ কে?’ বুড়ো চমকে উঠে চোখ মেলে দরজার দিকে তাকাল, তারপর ব্যস্ত হয়ে পা দুটো গুটিয়ে সোজা হয়ে বসল। হাত দিয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে অল্প হাসল, হাই তুলল একটা। ‘ভাবলাম আপনার চানটা হোক, হাতের কাজটা সেরে ফেলি, আর এর মধ্যে কিনা চোখটা লেগে গেল।’

‘আমার হয়ে গেছে, যান।’ বলল মায়া, বলে চলে আসত চৌকাঠ ছেড়ে কিন্তু পারল না, দাঁড়িয়ে রইল। এই প্রথম ওর মুখোমুখি দাঁড়ানো। শুকনো মরা গাছ দেখে যেমন ভয় লজ্জা পাওয়ার প্রশ্ন মনে জাগে না এখানেও তাই। শূন্য হাঁড়িটা তুলে নিয়ে মায়ার সামনে দাঁড়িয়ে ভুবন ওর চোখের দিকে স্থির ভাবে তাকিয়ে যেন কি বলি-বলি করছে। মায়া মাটির দিকে চোখ নামিয়ে প্রশ্ন করল, ‘এইবেলা বুঝি রান্না-বান্না হবে?’ কোনার দিকে একটা উনুন ও কিছু ভাঙা বাঁশ কাঠের টুকরো মায়ার চোখে পড়েছে।

‘হুঁ, দিদি, ইচ্ছা ছিল সেরকম, তা শরীরটা যেন এখন আর নড়াতে ভাল লাগছে না।’ বলে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল ভুবন, চুপ করে রইল একবার, তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘বেলা এখন কটা ঠিক বাজবে দিদি?’

‘বারোটা হবে।’ মায়া মাটি থেকে চোখ তুলল। ‘অনেক বেলা হয়েছে।’ যেন মানুষটার চোখের রঙ এখন আর তেমন ফ্যাকাশে না থেকে একটু চকচকে হয়েছে দেখে মায়া ঘাড় ফিরিয়ে বাইরে ডুমুর-পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশের রোদ পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হল। শুকনো পাতার খসখস শব্দের মত নিশ্বাসের আর-একটা শব্দ কানে এল ওর।

‘আহা, কত ভাল লোকের সংসর্গে আছি আমি।’ যেন নিজের সঙ্গে কথা বলছিল বুড়ো। ‘দিদি আমার কষ্ট করে খবর দিতে এল কুয়োতলা অবসর হয়েছে, তুমি যাও।’

মায়া কথা বলল না। চোখের একটা প্রসন্ন ভাব নিয়ে বুড়োর হাতের শূন্য হাঁড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল শুধু। যেন বুড়ো আবার একটা কি বলি-বলি করছিল। টের পেয়েও মায়া চোখ তুলল না। দুটো লাল ফড়িং-এর একটা ইঁটের পাঁজা ছেড়ে এখানে উড়ে এসে ওর হাঁটুর কাছে ঘুরঘুর করছে দেখে মায়া অবাক হয় খুশি হয়।

‘ইচ্ছে করেছে অনেকদিন, সাহস হয়নি কথা বলতে, কিন্তু দিদি যে এত ভাল মানুষ আমি কি জানতাম!’ ভাঙা অসমান নোংরা দাঁত বার করে ভুবন অল্প শব্দ করে হাসল। ‘কেমন ভাল লোকের সংসর্গে বাস করছি আমি। আহা!’

‘বুড়োমানুষ আমার সঙ্গে কথা বলবেন তাতে—’ বাকিটা বলল না মায়া, সুন্দর পরিচ্ছন্ন দৃষ্টি দিয়ে তা বুঝিয়ে দিল।

‘বুঝতে পেরেছি বুঝতে পারি।’ ভুবন খুশি হয়ে মাথা নাড়ল। ‘সকল লোক কি আর সমান। সংসারে সব মানুষ একরকম হলে সৃষ্টি অচল হত।’

মায়া নীরব। ফড়িংটা এখন তার কানের কাছে খোঁপার পাশে ঘুরে ঘুরে উড়ছিল।

‘সকল লোক সমান না।’ ভুবন আবার বলল, ‘সেদিন রাস্তার কলে এই হাঁড়ি দিয়ে জল ধরতে গিয়ে কি কম নাকাল হতে হয়েছিল, দিদি, বড় বেশি অপমান হয়ে ফিরে এসেছিলাম।’

‘কে অপমান করল?’ মায়া বুড়োর চোখের দিকে তাকায়।

‘দিদির বয়সী একটা মেয়ে, বউ, কার বউ জানি না, রাস্তার ওধারের একটা টালির ঘরে যেন থাকে।’ বুড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

তার বয়সের একটি বউ বুড়োকে অপমান করেছে শুনে মায়ার দুঃখ এবং কৌতুহল হল। ‘কি বললে বউটা, কি বলছিল আপনাকে?’

‘আমি হা করে দাঁড়িয়ে আছি। আমি হা করে দাঁড়িয়ে থেকে ওকে দেখছি। ওকে দেখতে আমার কলের কাছে দাঁড়ানো। জল ধরতে যাওয়াটা কিছু না, ছুতো।’

‘ছি ছি ছি।’ মায়া সর্বাঙ্গে শিউরে উঠল। ‘এমন একটা বুড়ো মানুষকে এভাবে বলতে কি ওর—’

বাকিটুকু বলল না মায়া। কিন্তু তার চোখের বেদনা ভুবনকে অভিভূত করল। ‘সব মানুষ সমান না সকল চোখ এক না।’ একটা ভারী নিশ্বাস ফেলে ভুবন মৌচাকের মতন মস্ত কালো খোঁপা ঘিরে লাল ফড়িং-এর নাচানাচি দেখল। গাল ঘুরিয়ে মায়া আবার একটু সময় পেয়ারা-পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়া আষাঢ়-আকাশের হলদে আলো দেখছিল।

‘অনেক বেলা হল, এইবেলা রান্নাবান্না আরম্ভ করুন।’ ঘাড় ফিরিয়ে কথাটা বলতে গিয়ে মায়া চুপ করে গেল। ফ্যাকাশে মরা চোখ দুটোতে যেন অন্যরকম রঙ লেগে আবার চকচক করছে। ডান হাতের হাঁড়িটা বাঁ হাতে চালান দিয়ে ভুবন আস্তে আস্তে ঠোঁট নাড়ছে, যেন কি বলতে গিয়ে ইতস্তত করছে।

আর দাঁড়াল না, চৌকাঠ ছেড়ে মায়া উঠোনে নামল।

শুকনো ডুমুর-পাতার খসখস শব্দ শুনে আর-একবার ও ঘাড় না ফিরিয়ে পারে না। না, ভুল দেখেছে সে, মরা মাছের চোখ নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে বুড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। রুক্ষ জীর্ণ অস্থিসার একটি মানুষ। মৃত পত্রহীন মাদার গাছটার চেহারা মনে পড়ল মায়ার।

‘আমায় কিছু বলছেন?’

‘না,’ ভুবন মাথা নাড়ল। ‘বলিনি কিছু। দিদিকে দেখে ভাবছিলাম। দিদিকে দেখলে আমার কেবলই ওই ডালিমচারাটার কথা মনে পড়ে।’

‘কোথায় ডালিমচারা, কোনদিকে!’ যেন খুব বেশি চমকে উঠল মায়া। আঙুল দিয়ে ভুবন উঠোনের একটা পাশ দেখিয়ে দিতে মায়া সেদিকে তাকায়। অনেকদিন আগেই ওটা তার চোখে পড়েছে। কিন্তু এখন যেন নতুন করে ও ডালিমচারাটা দেখতে পেল। চারা বলা চলে না ঠিক। গাছ। লম্বা ঋজু একটি মেয়ের সুন্দর দুটো বাহুলতার মতন সুগোল মসৃণ দুটো কাণ্ড আকাশের দিকে একটুখানি উঠে তারপর থেমে গেছে। তারপর কচি কচি ডাল। যেন অনেকগুলো আঙুল! আঙুল ছেয়ে নতুন লালচে সবুজ পাতার ঝিলিমিলি। হাওয়ায় দুলছে নড়ছে। যেন আঙুল নেড়ে নেড়ে মেয়েটি নিজের এলোমলো চুলে বিলি কাটছে আর খিলখিল হাসছে। আর একটুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মায়া। আধফোটা একটা কলি সিঁদুরের রেখা হয়ে পাতার মাঝখান থেকে উঁকি দিয়ে আবার তখনি লুকিয়ে যাচ্ছে। আর একটু মনোযোগ দিয়ে দেখল মায়া। একবার দেখল। দুবার দেখল। বিস্ময়ে চোখের পলক পড়ছিল না। সুগোল সুঠাম আশ্চর্য বুজ দুটো ফল। পাতার আড়াল সরিয়ে সন্তর্পণে দুবার দেখিয়ে তারপর যেন লুকিয়ে ফেলল মেয়েটি আর খিলখিল হাসল। ছোট্ট একটা নিশ্বাস পড়ল মায়ার।

‘চারা না, গাছ।’ ঘাড় ঘুরিয়ে ও ভুবনের মুখের দিকে তাকায়। ভুবন মাথা নাড়ল।

‘নতুন গাছ। যৌবন লেগেছে গায়ে।’

মরা মাছের মত চোখদুটো আবার চকচক করছে কি না দেখতে মায়া আর মুখ ফেরায় না। যেন কি ভাবছিল ও। ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে ফিরে এল।

কি, পরের চোখে সে নিজেকে দেখছে? কে সেই পর? কেউ না। মানুষ না পুরুষ না। সংসারে একমাত্র পুরুষ প্রণব। তার স্বামী। যার মুখে রাতদিন তার রূপ যৌবন শরীরের অঢেল লাবণ্যের প্রশংসা শুনে শুনে মায়া এখন ক্লান্ত হয় বিরক্ত হয়। আর কোনো পুরুষের চোখেমুখে সে তার বাইশ বছরের যৌবনের স্তুতি দেখল না শুনল না। যদি দেখত শুনত তবে কি সে রাগ করত? মায়া ঠিক ভেবে পেল না। বুঝতে পারছিল না ও। হাজার পাতার চোখ মেলে নিম গাছটা তার দিকে তাকিয়ে থাকে, পেঁপে গাছগুলো চেয়ে চেয়ে দেখে, ভাঙা পাঁচিল মরা গাছ কাক শালিক বুলবুলির ঝাঁক যখন-তখন মায়ার হাত দেখছে পা দেখছে হাঁটু দেখছে পিঠ কোমর ভুরু চোখ চুল নখ সব। রাগ করে না ও, বরং খুশি হয়। যদি ওরা এমনভাবে ওর দিকে তাকিয়ে না থাকত তো তার মনে হত না সে বেঁচে আছে। সুতরাং—

দুপুরে খাওয়ার পরে চোখে আজ ঘুম আসেনি। শুতে গিয়ে শোয়া হল না। এক আশ্চর্য নেশায় মন শরীর আচ্ছন্ন হয়ে রইল। সত্যি তো। মরা মাদার গাছ কি নোনাধরা পাঁচিলটা যদি হঠাৎ মুখ ফুটে বলে ওঠে, ‘চমৎকার! কত সুন্দর তুমি’, অথবা ‘তোমাকে দেখে বর্ষার রজনীগন্ধা কি বৈশাখের চাঁপার কথা মনে পড়ে আমাদের’, তো সে কি খুব অবাক হবে? হয়নি। এখনও হল না। বরং নূপুর বাজার মতন উত্তেজনায় আনন্দে তার রক্তের মধ্যে মিষ্টি রিমঝিম একটা শব্দ হচ্ছিল। সেই কখন থেকে। শোয়া ছেড়ে একসময় ও উঠল। আস্তে দরজার দুটো পাল্লা ভেজিয়ে দিয়ে উঠোনের দিকের জানালাটা বন্ধ করে দিল। তারপর এসে ঘরের মাঝখানে দাঁড়াল। ঠিক মাঝ জায়গায় দাঁড়ালেই দেওয়ালের আরশিতে ও পায়ের নখ থেকে সিঁথির ডগা পর্যন্ত সব দেখতে পায়। না, আরশি-মুখ করে দাঁড়ালেও সব দেখা যায় কি! সব বাঁধন খুলে পা দিয়ে একদিকে ঠেলে সরিয়ে দিলে ও। আর সেই মুহূর্তে আয়নার দিকে তাকিয়ে ও স্থির স্তব্ধ হয়ে গেল। যেন রক্তের বাজনাটাও কিছুক্ষণের জন্য থেমে রইল। না, নিজের এই মূর্তি সে আগে কখনও দেখেনি, এভাবে! ডালিম গাছ। পাতা ফুল ফল কাণ্ড শাখায় শাখায় ছড়িয়ে পড়া যৌবনের সতেজ প্রগল্ভ লাবণ্য। পুলকের বিদ্যুৎ-শিহরন তার মেরুদাঁড়ায় খেলা করে গেল, টের পেল মায়া। আর রক্তের বাজনাটা যেন প্রচণ্ড শব্দ করে তখন বেজে উঠল ঝম্ ঝম্ ঝম্ ঝম্‌। ঘরের চালে শব্দ হচ্ছিল, বাইরে, গাছের পাতায়, পাঁচিলের গায়ে, কুয়োতলায়, ডুমুর-জঙ্গলে। আকাশ ভেঙে জোরে বৃষ্টি নামল, আর আয়নার সামনে নাচের ভঙ্গিতে ঘুরে ঘুরে কোটিবার ও নিজেকে দেখল।

অভ্যাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেল এটা। একদিন দু’দিন তিনদিন। এবং সেই সঙ্গে আর একটা জিনিস ও লক্ষ করল। অবশ্য তাতে প্রথম দিন ও ভয়ই পেয়েছিল, দ্বিতীয় দিন আর ভয়টা রইল না, মনটা একটু খারাপ লাগল। কিন্তু, অবাক হল মায়া, তৃতীয় দিন তার মনে হয় এ-ই স্বাভাবিক। প্রণবের কথা হাসি ওঠা বসা খাওয়া বিশ্রাম,তার জুতোর শব্দ সিগারেটের গন্ধ অফিসের গল্প বা মায়া রাঁধতে বসেছে আর পাশে বসে স্বামী তার গলায় কি পিঠের ঘামাচি খুঁটছে কি বিড়বিড় করে বাজারের হিসাব বলছে ইত্যাদি সব কেমন যেন মায়ার কাছে পুরনো, বড় বেশি একঘেয়ে ঠেকতে লাগল। যেন জন্মাবধি সে এসব দেখছে শুনছে। যেন শুনে শুনে দেখে দেখে এখন তার হাঁপিয়ে ওঠার সময় এল। এমনকি রাতটাও। আদর চুমু আবেগ উচ্ছ্বাস কোনো কিছুর মধ্যেই আর ও দিশেহারা হয়ে যেতে পারছিল না। যেন কতকাল ধরে চলেছে। যেন এসব কাজ এখন কিছুদিনের জন্য বন্ধ থাকলে ভাল হয়। বিছানার গন্ধ প্রণবের গায়ের গন্ধ চটচটে ঘাম আর গরম নিশ্বাসের হল্কা থেকে রেহাই পেতে সত্যি ও এক সময় উঠে পড়ে। ‘এর মধ্যেই তোমার জলতেষ্টা পেয়ে গেল!’ ঠাট্টার সুরে প্রণব বিড়বিড় করে। কিন্তু মায়া উত্তর দেয় না। গম্ভীর থাকে। সবটা আবহাওয়া তার কাছে অশ্লীল কুৎসিত ঠেকে। বিছানার অন্ধকারে আধশোয়া স্বামীকে কুৎসিত মনে হয়। বেশবাস ছেড়ে নিজেকে কুৎসিত মনে হয়। অথচ—অন্ধকার জানালায় একলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ও ভাবে।

প্রশ্নের জবাব দেয়নি ভুবন। ঘাড় গুঁজে মাছ কুটছিল। জলপচা সাদাটে ক’টা পেটফোলা ট্যাংরা মাছ। একটা ভোঁতা কাটারির বুকে পুঁছিয়ে পুঁছিয়ে পেট আলগা করে মাছের কালচে তামাটে রঙের নাড়ি-ভুঁড়ি বার করতে করতে ভুবন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যেন লোকটার নিশ্বাসের ঝাপটায় মাছির ঝাঁক ভনভন করে ওঠে। কিছু তার নাকের সামনে কিছু ঘাড়ের কাছে পিঠের ধারে উড়ে বেড়ায়।

‘আপনার বুঝি বঁটি নেই?’

ভুবন শুধু মাথা নাড়ল, কথা বলল না বা চোখ তুলে চৌকাঠের দিকে তাকাল না।

মায়া একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল।

‘বঁটি থাকলে সুবিধে হত। ছোট মাছ কাটারি দিয়ে কুটতে কষ্ট।’ বলে মায়া ঘাড় ফিরিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। আজকের দুপুরের চেহারাটা অন্যরকম। বৃষ্টিও পড়ছে আবার রোদও উঠেছে। সিল্কের মত সাদা নরম মেঘে মোড়া আকাশ থেকে কে যেন একটা রুপালি জাল ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে। রুপার সুতোর মতন সাদা ফিনফিনে বৃষ্টির ছাট এসে থেকে থেকে মায়ার পায়ের কাছে মাটি ভিজিয়ে দিচ্ছে। মাটি ঘাস গাছের পাতা ভাল করে ভিজতে না ভিজতে আবার দেখা যায় ঝকঝকে রোদের হাসি। লাল ফড়িং না। ঘাসফুলের মত ছোট্ট সাদা একটা প্রজাপতি ওর থুতনির কাছে উড়ে উড়ে বেড়ায়। মায়া ঘাড় ঘুরিয়ে ভুবনের দিকে তাকাল। এবার ও খুশি হল। ফ্যাকাশে হলদে চোখজোড়া মেলে মানুষটা হাঁ করে তাকে দেখছে। মায়া বাঁ পা নামিয়ে ডান পা-টা চৌকাঠের ওপর রাখল।

‘তা কারখানার কাজ কি করে গেল বললেন না তো?’

শুকনো মরা পোকায় খাওয়া গাছের বাকলের মতন বুড়োর ঠোঁটের চামড়া ঈষৎ বিস্ফারিত হল। বোঝা গেল হাসতে চেষ্টা করছে। বাঁ হাতের পিঠটা কপালে ঠেকিয়ে আবার হাঁ করে সে মায়ার মুখের দিকে তাকায়। অর্থাৎ অদৃষ্টে নেই তাই চাকরি গেছে। বুঝতে পেরে মায়া একটু সময় চুপ করে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘যাক, হাতের কাজটা যখন শেখা আছে কোনোরকমে চলে যাচ্ছে—যাবে। ঘরে বসে টুকিটাকি সারাইয়ের কাজ করছেন মন্দ কি!’

কিন্তু চোখ দেখে মনে হল না ভুবন তা ভাবছে। কি ভাবছে চিন্তা না করে মায়া আবার উঠোনের দিকে মুখ ফেরাল। ভিমরুলের চাকের মতন প্রকাণ্ড খোঁপার পরিবর্তে অল্প বয়সের একটি মেয়ের মতন চেরা বেণী আজ ও ঘাড়ের দু’দিকে ঝুলিয়ে দিয়েছে। হাওয়ায় দুটো বেণী নড়ছিল। স্কুলে পড়ার সময় বেণী করত ও। বউ হবার পর আজ এই প্রথম। আর এই বেণী তৈরি করার সময় অনেকদিন পর একধরনের বনজ লতার কথা বার বার মনে পড়ছিল তার। প্রণব এভাবে চুল-বাঁধা পছন্দ করবে না এটাও মায়া চিন্তা করেছে এবং স্বামী বাড়ি ফেরার আগেই ওটা ভাঙতে হবে ভেবে তার বুকের মধ্যে বেশ একটু টনটন করছিল। খসখস শব্দটা শুনে মায়া চমকে ঘাড় ফেরাল। ভুবন এবার দাঁত বার করে রীতিমত হাসছে।

‘কি হল? মাছ কোটা তো শেষ হয়েছে, এবার রান্না চাপান।’

‘তা চাপাব, এক সময় চাপালেই হল।’ হাত নেড়ে মাছের গায়ের মাছি তাড়ায় ভুবন। ‘রান্না আর খাওয়ার কথা এখন বড় একটা ভাবি না, দিদি, কেমন যেন ইচ্ছাই করে না হি-হি। একটা কাজ ছিল শেয়ালদার। বুঝিয়ে দিয়ে ফেরার সময় এই তো আজ আট দিন পর দুটো মরা ট্যাংরা আনলাম। রান্নাই বা আর রোজ হয় কোথা,—’

মায়া চুপ করে রইল।

হাওয়াটা একটু বেশি জোরে বইছিল বলে পিঠের বেণী দুটো একজোড়া সাপের মতন পরস্পর জাপটাজাপটি করে আবার কোমরের দু’দিকে সরে গিয়ে হিলহিল করছিল। যেন সাপের খেলা দেখতে বুড়ো চোখ বাঁকা করে ঘাড় কাত করে মায়ার পিঠের দিকে চেয়ে থাকে। ঘোলা জলের ওপর রোদ পড়লে যেমন একটা চিকচিকে সাদাটে আভা জাগে, বুড়োর চোখে আজ আবার সেই রঙ দেখল মায়া। কিছু বলল না ও, বরং ক্ষুদে প্রজাপতিটা এইবেলা বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছে, উড়ে উড়ে এসে ওর গলায় বুকে বসতে চেষ্টা করছে দেখে মায়া সেটাকে একসময় খপ্ করে মুঠোর মধ্যে ধরে ফেলে পরে ওটাকে উঠোনের দিকে ছুঁড়ে দিতে ঘুরে দাঁড়ায়। এবার ভুবন তার সবটা পিঠ ও কোমর দেখতে পাবে মায়া অনুমান করছিল। বাচ্চা প্রজাপতিটা বাইরে ঘাসের ওপর ছিটকে পড়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ মরার মতন শুয়ে থেকে পরে একসময় নড়েচড়ে উঠে দিব্যি উড়তে উড়তে পেয়ারা গাছের দিকে চলে গেল। মায়া খুক্ করে হাসল। ভুবনও হাসল। মায়া ঘুরে দাঁড়াল।

‘মরেনি। ভাবলাম হাতের চাপে চটকে শেষ হয়ে গেছে।’

‘কেন মরবে?’ ভুবন ঘাড় নাড়ল। ‘নরম মুঠো। এই চাপে কি আর ও মরে!’

মুখ ফিরিয়ে মায়া সাদা প্রজাপতিটাকে আর দেখতে পেল না। পেয়ারা-পাতার ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।

‘ভারি সুন্দর ছিল, এই এতটুকুন!’

ভুবন ঘাড় নাড়ল। ফাটা শুকনো রোদ-পোড়া গাছের বাকলের মতন পুরু ঠোঁট দুটো ছড়িয়ে আস্তে আস্তে বলল, ‘আরো সুন্দর লাগছিল দিদির থুতনির চারপাশে যখন ও ঘুরঘুর করছিল। মাছ! মাছ কুটব কি ছাই। আমি তখন থেকে কেবল ভাবছি কোন্ ফুলের সঙ্গে কোন্ ফলের সঙ্গে এই থুতনির তুলনা চলে। মচকা ফুল—না না না, করবী ফুলের তলার দিকটা, ছোট্ট বাটির মতন গোল হয়ে বোঁটার সঙ্গে যেটুকু লেগে থাকে,—অবিকল সে রকম। দিদির থুতনি দেখলে তাই মনে পড়ে। মিছে বলছি? আর একবার যখন আরশিতে মুখ দেখবেন কথাটা সত্য কি না বুঝবেন।’

মেরুদাঁড়ায় একটা শিহরন অনুভব করল মায়া, কিন্তু তা করতে গিয়েও সে ওটা আর টের পেল তাই আগের চেয়েও শান্ত স্থির চোখে ও ভুবনের মুখের দিকে তাকাল। একজন পুরুষের মুখে ও রূপের প্রশংসা শুনছে কি? না না, যা-ও একটু হাসির রোদ লেগে ঘোলাটে চোখ দুটো চিকচিক করছিল এখন আবার মরা মাছের চোখের মতন ঠাণ্ডা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। কাঠের টুকরোর মতন শুকনো হাঁটুর সঙ্গে দুটো হাত ঠেকানো। বরং ক্ষীণ একটা বেদনার ঢেউ বুকের মধ্যে অনুভব করল মায়া। অল্প হেসে বলল, ‘তা দেখব আরশিতে, দেখা যাবে সত্যি আমার থুতনি অত সুন্দর কি না। আপনি এইবেলা উঠুন। আসুন। আমি জল তুলে দিই আপনি মাছটা ধুয়ে ফেলুন। অনেক বেলা হল।’

দু’জনের পায়ের শব্দে গিরগিটিটা ওধারের পাঁচিলের মাথা থেকে লাফিয়ে ডুমুর-জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল। মায়া থমকে দাঁড়ায়। পিছন থেকে ভুবন বলল, ‘তা আমি না-হয় এতকাল কোনার দিকের ভাঙা ঘর নিয়ে ছিলাম, এখন উঠোনের এধারে নতুন ঘর তুলেছে বটব্যাল। আর ঘর তৈরির সঙ্গে সঙ্গে নতুন ভাড়াটেও পেল, এখন তো জঙ্গলটঙ্গলগুলো একটু সাফ করে ফেলা উচিত ওর, কিন্তু শালা কি এদিকে একবার উঁকি দিতে আসে? মাসকাবার হলে ভাড়া গুনতে হাজির হবার বেলায় ঠিক আছে।’

‘না খুব বেশি জঙ্গল কি!’ মায়া বলল, ‘আমার কিন্তু এই গাছটাছগুলো বেশ ভালই লাগছে। সস্তার মধ্যে বাড়িটা চমৎকার।’

একটা নিশ্বাস ফেলল ভুবন।

‘আমার ইচ্ছা করছে এই আগাছাগুলো তুলে ফেলে এধারটায় কিছু ফুলের গাছ করি।’

মায়া কথা বলল না।

‘তা এ-বছর আর হয় না।’ পিছন থেকে ভুবন পরে বলল, ‘আরো আগে পুঁতলে তবে ঠিক হত। এখন বীজ পুঁতলে শালার জলেই সব পচে ভূত হয়ে যাবে, গাছ বেরোবে না। আর গাছ বড় হতে হতে শীত এসে যাবে। শীতে আর দোপাটি তেমন ফোটে কই। উঁহুঁ।’

‘হ্যাঁ, সুন্দর।’ ঘাড় ফিরিয়ে মায়া বলল, ‘দোপাটি ফুল আমি খুব পছন্দ করি। ছোটবেলায় দেখতাম আমাদের স্কুলের বাগানে,—এমন দিনে গাছগুলো সাদা হয়ে থাকত।’

‘সাদা লাল গোলাপী অনেক রঙের হয়।’ ভুবন আস্তে আস্তে বলল, ‘আমার ইচ্ছা লাল দোপাটি করার। লাল ফুল দিদির বেণীতে মানাবে ভাল।’

মায়া হঠাৎ আবার কথা বলতে পারল না। ভুবনও চুপ করে রইল। কিন্তু কুয়োতলায় গিয়ে সে মুখ খুলল। মায়া জল ঢালছে আর দু’হাতে রগড়ে মাছের গায়ের ছাই ময়লা সাফ করতে করতে কি ভেবে সে বলল, ‘ছোটবেলার কথা ইস্কুলের পড়ার দিনগুলোর কথা দিদির খুব বুঝি মনে পড়ে।’

প্রথমটায় উত্তর দিল না মায়া, তারপর এক সময় আস্তে আস্তে বলল, ‘মনে পড়লেই আর কি করা যায়। দেখতে দেখতে বড় হলাম, স্কুল ছাড়লাম, তারপর বিয়ে হয়ে গেল।’ একটু থেমে পরে বলল, ‘হাজারবার মনে পড়লে কি ইচ্ছা করলেও এখন আর সেদিন ফিরে পাব না।’ নিজের মনে কথাটা বলে শেষ করে বিষন্ন চোখ দুটো ও আকাশের দিকে তুলে ধরল। রোদের আভা মুছে গিয়ে কালো বড় বড় মেঘের আনাগোনা আরম্ভ হল এবার। মাছ ধোয়া শেষ করে ভুবন সেগুলো রঙ-চটা ফুটো লোহার থালাটায় তুলে রেখে লম্বা নিশ্বাস ফেলল।

‘আর জল ঢালতে হবে না?’ মায়া চোখ নামাল।

‘না, আমার হয়ে গেছে।’ ঘাড় তুলে ফ্যাকাশে চোখে ভুবন ওর আপাদমস্তক দেখে। কুয়োর বাঁধানো কার্নিশের ওপর একটা পা, এক পা নিচে ইঁটের ওপর রেখে মায়া হাতের শূন্য বালতিটা একটু একটু আন্দোলিত করছিল বলে ওর বুক কোমর ঊরু মন্থর ঢেউয়ের মতন থেকে থেকে দুলছে কাঁপছে।

‘মন, দিদি। ছোটবেলার মনটা যদি আমরা কোনোরকমে ধরে রাখতে পারি তো বুড়িয়ে গিয়েও মাঝেসাঝে সে-দিনের নাগাল পাই। মিছে বলছি?’

আকাশে চোখ তুলল মায়া। চমকে ওঠার মতন কাউকে দেখছে না ও, কি কারো কথা শুনছে না। নিম গাছটা বুলবুলিদের ফল খাওয়াতে খাওয়াতে সারা দুপুরই এই বুলি আওড়ায়। উঠোনের চড়ুইগুলো, ওধারের ফড়িং দুটো,ডুমুর-জঙ্গলের ছায়ায় ঝিঁঝির দল সারাক্ষণই কি ডেকে ডেকে মায়াকে একথা শোনাচ্ছে না? আর, এটা ও বেশ বুঝতে পারে ওদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে এ-বাড়ির শ্যাওলা-ধরা ইঁটের পাঁজা, নড়বড়ে ভাঙা দেওয়াল, হয়তো মৃতপ্রায় হলুদ রঙের পেঁপে গাছটাও ফিসফিসে গলায় কেবল এই বলছে। এখন?

শান্ত সহানুভূতির চোখে মায়া ভুবনকে আবার দেখল।

‘যান, এইবেলা গিয়ে উনুনটা ধরিয়ে ফেলুন—অনেক বেলা হল।’

ভুবন স্থির। নির্বাক।

একটা বেণী ঘাড় ডিঙিয়ে ওর বুকের ওপর লুটোয়। চোখ বাঁকা করে মায়া তাই দেখে। এমন সময় হঠাৎ এক আঁজলা রোদ ওর বুকের সামনে দিয়ে থুতনি ঘেঁষে উড়ে গেল। এক ঝাঁক প্রজাপতি। উজ্জ্বল হলুদ বর্ণ। হাতের তেলোর মত বড় এক-একটা। ওরা ডালিম গাছটা লক্ষ করে ছুটে চলেছে। যেন দিশেহারা হয়ে হাতের বালতিটা ঠক্ করে একদিকে ছুঁড়ে ফেলল মায়া। ছুটল। পেয়ারা গাছের ডালে আঁচল বেধে গেল, নিচের দিকেও কি একটা কাঁটায় শাড়ির পাড় আটকে ওর মোরগফুল আঁকা সায়া বেরিয়ে পড়েছে।

কোনোমতে সামলে নিয়ে আবার এগোয়। ধরল একটাকে। বাঁ হাতের লম্বা সরু দুটো আঙুলের মাঝখানে আলতো করে একটা পাখা চেপে ধরে ও কুয়োতলায় ফিরে এল। ডান হতের মুঠোয় আঁচলটা। বুকের ওপর চেপে রেখেছে কোনোরকমে। স্বাস-প্রশ্বাসে জায়গাটা কাঁপছে।

এই প্রথম ভুবন শব্দ করে হাসল। যেন জং-ধরা খসখসে গলায় নতুন ধাতুর ধার শোনা গেল।

মায়া মুখ কালো করে ফেলল।

প্রজাপতিটাও হাত থেকে উড়ে গেল।

আঁচলটা অতিরিক্ত দ্রুততার সঙ্গে বুকে জড়ালে, গলায় তুলল ও এবং অন্য দিকে ফিরে তাকাল। কিন্তু কতক্ষণ?

এদিকে আবার ওকে তাকাতেই হয়।

তাকিয়ে অবশ্য নিশ্চিন্ত হয়। কাঠ। মরা কাঠ চুপ করে বসে আছে। দুটো হাত শুকনো নিষ্পত্র গাছের ডাল। জীর্ণ বাকল। ভিতরের শাঁস পুড়ে গেছে। অঙ্গার দেখা যায়।

‘উঠে ঘরে যান। সেই কখন তো মাছ ধোয়া হল। খাওয়া-দাওয়া করবেন না!’

‘আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিলাম।’

‘খুব বড় প্রজাপতি! এত বড় প্রজাপতি এখানে এসে আর আমি দেখিনি।’ মায়া বলল।

‘আমি প্রজাপতি দেখছিলাম না।’

মায়া বুড়োর চোখের মধ্যে তাকায়।

ঘোলা ফ্যাকাশে চোখ স্থিরভাবে ধরে রেখে ভুবন হাসে। ‘দিদির ছুটে যাওয়া দেখছিলাম। আহা রাজহংসীর গতিভঙ্গি। কথাটা মিছে বলছি? আয়নায় দেখবেন। ঘাড় ঘুরিয়ে যদি সম্ভব হয়। আমি এমন সুন্দর ছাঁদের পিঠ কোমর আর কারো দেখিনি।’

‘দেখব আয়নায়, রোজই তো দেখছি।’ ধমকের সুর বার করতে গিয়ে ও কোমল গলায় হাসল। ‘এইবেলা উঠুন, চলুন আমি উনুন ধরিয়ে দিই। আষাঢ়ের বেলা তা-ও হেলতে শুরু করেছে।’ মায়া নুয়ে হাত বাড়িয়ে মাছের থালাটা তুলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

‘কত ভাল লোকের সংসর্গে আছি আমি।’ পিছনে চলতে চলতে ভুবন বলল। ‘দিদির মন কত নরম!’

ডুমুরতলার নিচু চালার ভিতরে ঢুকল দু’জন আর সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। কয়লার ব্যবহার নেই বুঝতে কষ্ট হয় না। কবে যেন কয়লা আনা হয়েছিল। দু-চার খণ্ড এক কোনায় পড়ে আছে। তার ওপর উইয়ের ঢিবি মাথা জাগিয়েছে।

ভুবন বলল, ‘মাঝে-মধ্যে রান্নাবান্না যে না করি দিদি তা না, ওই ওধারের পুরনো বেড়ার বাঁশ কাঠ কিছু কিছু ভেঙে এনে কাজ চালাই আর কি।’ একটু থেমে পরে বলল, ‘তা কাঁচা ঘর বটব্যাল এমনিও রাখবে না। আস্তে আস্তে সবটাই পাকা করে ফেলবে। তখন আমাকেও উঠতে হবে বইকি।’

‘পরিবার সংসার কোনোদিনই ছিল না নাকি?’ উনুন সাজিয়ে আগুন দিতে তৈরি হবার আগে মায়া একবার ঘাড় সোজা করল। তার গলার বুকের উদ্ধত পেশীর সুন্দর ভঙ্গি দেখতে ভুবন ফ্যাকাশে চোখে আবার রঙ আনতে চেষ্টা করছে টের পেয়ে মায়া ঘাম মুছবার অছিলায় আঁচলটা নামিয়ে কোলের ওপর জড়ো করল। তারপর একটা পোকা বা মাকড়ের দিকে স্থির সর্তক দৃষ্টি রেখে টিকটিকি যেমন চুপচাপ বসে থাকে কতক্ষণ ও সেভাবে বসে রইল। কেনই বা থাকবে না! কুয়োতলায় যখন ও স্নান করে খোলা গায়ে সাবান মাখে, পাশের মুমুর্ষু মাদার গাছটা পিটপিট চোখে তাকিয়ে থেকে থেকে পরে হঠাৎ এক সময় যখন ওর সঙ্গে কথা বলে শব্দ করে নিশ্বাস ফেলে তখন কি ও অন্তত কিছুক্ষণের জন্য সতর্ক সন্দিগ্ধ চকিত হয়ে ওঠে না! ধারালো দৃষ্টি হেনে গাছটাকে পরীক্ষা করার পর মায়া নিশ্চন্ত হয়। চমক ত্রাস জয় করে আবার স্বাভাবিক গলায় গানের গুনগুনি তুলে বুকে পিঠে সাবান ঘষে। এখনও তাই হল। বাদলা দুপুরের পচা ভ্যাপসা গরম, তার ওপর ভুবনের পুরনো ছোট্ট আবর্জনায় ঠাসা ঘরের অস্বস্তিকর গুমোটে ঘেমে ও স্নান করে উঠছিল। কপালে গলায় ঘাম। গলার নিচে বুকের স্তনের পাশে পাশে মুক্তবিন্দু হয়ে মুহুর্মুহু ঘাম জমছে আর পরমুহূর্তে তারা ভেঙে গলে ঝরে পড়ছে। সবল সুস্থ হাতে আঁচল ঘষে ঘষে মায়া ঘাম মুছল। ভুবনের দিক থেকে চোখ সরাল না। যেন শরীরটাকে আরও একটু স্বস্তি দিতে শাড়ি সায়া গুটিয়ে হাঁটুর খানিক নিচে পর্যন্ত তুলে ধরল। তারপর আশ্চর্য ঠাণ্ডা নরম গলায় প্রশ্ন করল, ‘লঙ্কা পেঁয়াজ ঘরে আছে? পচা মাছ রসুন ছাড়া চলবে না কিন্তু।’

‘দেখি, হয়তো আছে।’ যেন অত্যন্ত অনিচ্ছায় নধর সুডৌল পায়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ভুবন ঘরের এদিক-ওদিক দেখে। ‘রসুন থাকতে পারে, পেঁয়াজ যেন ফুরিয়ে গেছে।’

‘নিয়ে আসুন, আমি উনুন ধরিয়ে দিলাম।’

ভুবন লঙ্কা পেঁয়াজ খুঁজতে উঠে গেল।

কিন্তু ফিরে এসে দেখল উনুন ধরেনি, কেবল গলগল করে ধোঁয়া উঠছে। আর ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় একজোড়া চোখ ছুরির ফলার মতন চকচকে ঝকঝকে হয়ে গেছে।

শুকনো পাতার খসখস শব্দ হল।

‘দিদির চোখের দিকে তাকাতে ভয় করে।’

‘কেন, কিসের ভয়।’ মায়া নরম গলায় হাসল।

‘বাঘিনী বনের মধ্যে শিকার খুঁজছে, সে-রকম দৃষ্টি, সেই চোখ।’ খসখসে গলায় ভুবন হাসে।‘মিছে বলছি না কিন্তু।’

মায়া কথা বলল না।

বৃষ্টিটা আরো জোরে চেপে এল।

কিন্তু জলের ঝমঝম ছাপিয়ে বাইরে অদ্ভুত একটা ডাক শোনা গেল। যেন ঘরের পিছনে অসহ্য উল্লাসে একটা ভুতুম পাখি গলা ছেড়ে ডাকছে।

আর সেই মুহূর্তে দপ্ করে উনুনে আগুন জ্বলে উঠল।

ভুবন খুশি। কালো চোখের মধ্যে আগুনের নাচ দেখতে পেয়ে মুখটা মুখের কাছে সরিয়ে আনল। ‘দিদির চোখজোড়া আরো সুন্দর আরো ভয়ানক লাগছে এখন।’

‘কি রকম, কিসের মতন শুনি?’ গর্বে নাসারন্ধ্র স্ফুরিত করল মায়া।

‘যেন বাঘিনী শিকার ধরেছে। খুশির রক্তে দু চোখ লাল।’ খসখস করে ভুবন হাসে।

মায়া কথা বলে না। কি ভাবে। তারপর আগুনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ‘আপনার ঘরে আরশি আছে?’

ভুবন মাথা নাড়ল। ‘ছিল। ভেঙে গেছে।’

‘তবে আর কি।’ যেন তাচ্ছিল্যের শীতলতা দিয়ে মায়া চোখের আগুন নিবিয়ে দিল!

‘নিন, পেঁয়াজটা ছাড়িয়ে ফেলুন। বসে থাকলে রান্না নামবে কি! শিলনোড়া থাকলে দিন চট্ করে লঙ্কা দুটো বেটে নিই। হলুদ কোথায়?’

মরা মাছের ফ্যাকাশে চোখ তুলে ভুবন ঘরের এদিক-ওদিক দেখে। তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বে উঠে যায়। কাঠ। মরা গাছ চোখের সামনে হাঁটছে। বিদ্যুৎশিহরন মেরুদাঁড়ার অর্ধেক পর্যন্ত এসে মিলিয়ে গেল টের পেয়ে মায়ার কান্না পায়। বাঁ হাতের কনিষ্ঠা ঠোঁটে ঠেকিয়ে চুপ করে ভাবে।

অফিস থেকে প্রণব সকাল সকাল ফেরে।

ফজলি আম নিয়ে এল, এক ডিবি পাউডার কিনে আনল।

মায়া হাসল। তা বিকেলে ও সেজেছিল ভাল। সুন্দর খোঁপায় এতবড় একটা নীল অপরাজিতা গোঁজা। সিঁদুরের ফোঁটাটা টকটক করছে সিঁথিমূলে। অপরাজিতা রঙের ব্লাউজ। ব্লাউজের সঙ্গে মিলিয়ে হাল্কা কমলা রঙ শাড়ি। ঠোঁটে রঙ আছে কি না প্রণব বুঝতে পারল না। তোয়ালের কোনায় আলতা লাগিয়ে ঠোঁট ঘষা হতে পারে। প্রণব অনুমান করল। তার ঘরে লিপস্টিক নেই।

‘নাও, এইবার পাউডারটা মেখে ফেল। পাউডার তো ফুরিয়েছিল।’

‘ব্‌বা। অফিস থেকে তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়েছ কি! আমার সুন্দর মুখের কথা ভেবে? বিকেলে কতক্ষণে পাউডার মেখে সাজব বলে!’

‘তো, তুমি কি মনে কর। তোমার কি মনে হয় না সারাক্ষণই আমি একটি মুখের কথা ভাবি? অফিসে যেতে, অফিসে বসে, অফিস থেকে বেরিয়ে?’

‘বাড়াবাড়ি। তুমি যে আমার কথা মনে কর না তা আমি কখনো মনে করি না। বরং দুঃখ, এটু বেশি মনে রাখো বলে। একটু কম করে যদি রাখতে আমি সুখী হতাম। আমার জীবন সুখের হত।’ মায়া একসঙ্গে অনেকগুলো কথা বলল।

আর ঘাঁটানো ঠিক হবে না ভেবে প্রণব চুপ করে গেল। কাপড়চোপড় ছেড়ে হাতমুখ ধোয়। পাউডার ও আম সরিয়ে রেখে মায়া চা করতে বসে।

ফুরফুরে একটা হাওয়া বইছিল।

বাদলা দুপুরের পর রোদ-লাগা বিকেল বড় চমৎকার। ভালয় ভালয় চা খাওয়াটিও হল। এক সঙ্গে বসে। মুখোমুখি হয়ে বসে গল্প করল দু’জন। একটা হলদে প্রজাপতি দু’জনের মুখের সামনে ওড়াউড়ি করল। সেই দুপুরের ডালিম-ডালে-বসা প্রজাপতি। দেখে তখনকার ছবিটা মনে হতে মায়া চুপ করে রইল।

‘কত বড় পতঙ্গ!’ একবার ইচ্ছা করছিল তার প্রণবকে বলে। বলে : ‘সুন্দর আরো কত জিনিস পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে একবার চোখ মেলে দেখো।’ কিন্তু একটা জরুরি কথা এসে যাওয়াতে মায়ার আর তা বলা হয় না। ইচ্ছা করেই চুপ করে রইল। তারপর অবশ্য ও কাজের কথায় মুখ খুলল :‘তা তোমার যখন বন্ধু তখন ওটা করে ফেল না। একটু কমিয়ে-টমিয়ে দেবে খরচ। এ-বয়সে প্রিমিয়াম চালাবার সাহস যদি না পাও তবে আর কবে পাবে, আর হবে কি।’

প্রণব চুপ করে মায়ার মুখ দেখে, কথা শোনে।

‘আমি তোমায় এটুকুন বলতে পারি। তিন হাজার টাকার ইন্সিওর করেও এই আয়ে আমরা সুন্দর চালিয়ে যেতে পারব। দুটি তো মুখ। তুমি আর আমি। কিছু কষ্ট হবে না প্রিমিয়াম চালাতে।’ মায়া চুপ করল।

প্রণব স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলল। মায়া মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। মনের ভাব বুঝতে পেরেছে আশঙ্কা করে প্রণব চুপ করে রইল। খরচ চালাতে পারবে কি পারবে না। ভবিষ্যতে এই সংসারে তিনটি মুখ হবে কি চিরকাল তারা এমনি দু’জন থাকবে। পলিসির চাঁদা চালাতে অসুবিধাটা কি ইত্যাদির আলোচনা আপাতত চাপা দিতে প্রণব হঠাৎ শব্দ করে হাসল।

চমকে উঠল মায়া।

‘খুব খুশি দেখছি!’

‘একটা মজার গল্প তোমাকে বলা হয়নি। আজ শুনলাম।’

প্রণব ঝুঁকে গলাটা বাড়িয়ে দেয়।

কিন্তু গল্প শুনতে স্ত্রীর খুব আগ্রহ নেই চোখের রঙ দেখে সে টের পেয়ে আবার গম্ভীর হয়। সোজা হয়ে বসে।

‘উঠি, উনুনে আঁচ দিতে হয়।’ হাই তুলে মায়া বাইরে উঠোনে গাছের মাথায় সোনার পাতের মতন রোদের শেষ ঝিকিমিকি দেখে। প্রজাপতিটা উড়ে বেরিয়ে গেছে। কোন্‌দিকে গেছে মায়ার চোখে পড়ছিল না। দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে একজোড়া বুলবুলি প্রাণপণে যত পারছিল ঠুক্‌রে ঠুক্‌রে নিমফল খেয়ে নিচ্ছিল। পাখার ঝাপটায় পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির জল ফোঁটা ফোঁটা হয়ে নিচে ঝরছিল। ডুমুর-জঙ্গলের দিকে চোখ গেল মায়ার। এ-বাড়িতে ওখান থেকে অন্ধকার নামে, সন্ধ্যা শুরু হয়। এর মধ্যেই দুটো জোনাকি এসে জুটেছে ওধারে। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল মায়া।

‘গল্পটা শুনবে?’ ভয়ে ভয়ে প্রণব প্রশ্ন করল।

‘কার গল্প কিসের গল্প!’ মায়া ঘাড় ফেরালো না।

‘অফিসে সুকুমার আমাকে বলল, সুকুমার ভঞ্জ।’

মায়া নীরব।

‘সুকুমারদের পাড়ায় ঘটনাটা ঘটেছে।’

কিন্তু ও-পক্ষের কোনোরকম উৎসাহ নেই লক্ষ করে প্রণব আবার দমে যায়। চুপ করে থাকে। মায়া উঠে দাঁড়ায়। ‘চলি—উনুনে—’

যেন শেষ উদ্যম নিয়ে প্রণব বেশ বড় গলায় হাসল : ‘গল্পটা শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে, তুমি বিশ্বাসই করবে না যে—’

‘আহা বলো না, এতক্ষণে তো বলা হয়ে যেত।’ বিরক্ত কণ্ঠস্বর। যেন গল্পটা অগত্যা শুনতেই হবে, হলে আর একজন ভীষণ অসন্তুষ্ট হবে চোখমুখের এমন ভাব প্রকাশ করে মায়া ধপ করে বেতের চেয়ারটায় বসে পড়ল। ‘কি গল্প শুনি?’

‘সুকুমারদের পাড়ায় এক ভদ্রলোক তার বাড়ির ঝিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। পরশুর ঘটনা। এদিকে বাড়িতে কান্নাকাটি। বেশ বড় বড় দু-তিনটি ছেলেমেয়ে। স্ত্রী, হ্যাঁ, ভদ্রলোকের স্ত্রীও যে অসুন্দরী এমন না। দিব্যি দেখতে-শুনতে মহিলা। সুকুমার দেখেছে। কাল চার-পাঁচবার নাকি ফিট্ হয়েছে। মহিলার দাদা এ জি অফিসের বড় চাকুরে। খবর শুনে ছুটে এসে কাল তিনি থানায় খবরও দিয়েছেন—কিন্তু তাতে কি আর—হা-হা।’ শব্দ করে প্রণব হাসল। ‘সুকুমারদের পাড়ায় সে এক বিশ্রী হই-চই—’

কিন্তু স্ত্রীর ভুরু দেখতে দেখতে প্রণবের হাসি মিলিয়ে গেল।

বড় তাড়াতাড়ি সে গম্ভীর হয়ে যায়। মনে হচ্ছিল সে নিজের মত হেসেছে।

‘কী রুচি তোমার, কী বিশ্রী স্বভাব!’ মায়া চেয়ার ছেড়ে উঠল। ‘এই গল্প শোনাতে তুমি পাগল হয়ে ছুটে এসেছ ঘরে।’ একবার থামল, উঠোনের ঘাসের দিকে তাকিয়ে কি ভাবল একটুক্ষণ, তারপর প্রণবের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল মায়া।

‘তুমি কি জান না যে এসব গল্প আমি কোনোদিনই ভালবাসি না। তোমায় কি আমি একদিন বলিনি যে এসব কুৎসিত ঘটনা ইচ্ছা হয় তুমি গিয়ে আর কাউকে শোনাবে। আর কাউকে যতক্ষণ খুশি বসে থেকে রসিয়ে ফেনিয়ে বলে শেষ করে তবে ঘরে ফিরবে। আমাকে না, আমার কাছে এসব—’ রাগে মায়া কাঁপছিল। ‘ছি ছি,—কোন্ ভদ্রলোক বাড়ির ঝির সঙ্গে পালালো, কোন্ লোক অফিসের টাইপিস্ট মেয়ে দেখে ভুলেছে, কোন্ ছেলে বাসে-দেখা মেয়ের কাছে প্রেমপত্র লিখল, এসব ছাড়া কি পৃথিবীতে আর গল্প নেই, ঘটনা ঘটে না? আমি অন্য রুচির মানুষ। আমি কখনো এসব কুৎসিত বাজে ছাইভস্ম কথাবার্তা ভালবাসি না, শুনি না। যদি ভাল কথা, সুন্দর কথা অফিসের বন্ধুদের কাছে শোন বাড়ি এসে বোলো, সারারাত বসে কান পেতে শুনব, শুনতে রাজি, বুঝলে।’

হিতে বিপরীত হল।—একলা চুপ করে অন্ধকার ঘনিয়ে আসা বারান্দায় বসে প্রণব ভাবল। স্ত্রীর অন্তরঙ্গ হওয়ার জন্য এই গল্প না করে অন্য কোনো প্রসঙ্গ তোলা উচিত ছিল। কি প্রসঙ্গ, এমন কোন বিষয় আছে যে, শুনলে মায়া খুশি হত! প্রণব তার দু’ বছরের বিবাহিত জীবনকে আর একবার সূক্ষ্মভাবে জরিপ করল। করে কিছু দেখতে না পেয়ে পেয়ারাতলার অন্ধকারের দিকে চেয়ে ছিল। অন্ধকারে একটা বিড়াল ঘুরঘুর করছিল। প্রকাণ্ড ধুমসি বিড়াল। ছাই রঙের। ধোঁয়া রঙের। যেন এই জন্যই দৃশ্যটা আরো খারাপ লাগছিল। তাকাতে ইচ্ছা করছিল না প্রণবের। অস্পষ্ট এলোমেলো চঞ্চল ঘোলাটে। বোঝা যায় না কোন্‌টা বিড়াল কোন্‌টা অন্ধকার। গুলিয়ে যায়। যেন এই ধরনের বিবাহিত জীবন তার। পুরুষের কাছে নারী এর চেয়ে স্পষ্ট পরিচ্ছন্ন হয়ে ধরা দেয় না। দেবে না! এক খাবলা অন্ধকার। হঠাৎ নড়েচড়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে, তারপর আবার চলন্ত ধূর্ত শিকারী মুখের গরম রক্ত মুছে চোখের নিমেষে জমে অন্ধকার হয়ে যায়। পেয়ারাতলার চাপ-চাপ অন্ধকারের কিছুটা নিরবয়ব নির্বোধ। অস্তিত্বকে রেণু রেণু করে রহস্যের অতল অন্ধকারে মিশিয়ে দিতে, নিশ্বাস ফেলার শব্দটি না করে সংসারের সাত কাজে নিজেকে ঢেলে দিতে মায়ার জুড়ি আর কেউ আছে কি না চিন্তা করে প্রণব যেমন ক্রুদ্ধ হল তেমনি হতাশ হল। হতাশই বেশি হল। যা স্বাভাবিক। সুখী না, বিয়ে করে এই জীবনে কেউ সুখী না। বন্ধুরাও বলে বটে। কেন সুখী না, কি দিয়ে সুখী না তার চুলচেরা হিসাব অবশ্য আজ পর্যন্ত কেউ দেয়নি। প্রণব তার নিজের সম্পর্কে একটা প্রামাণ্য হিসাবকারো কাছে তুলে ধরতে পেরেছে কি! পারল না। পারে না বলেই বুকের মধ্যে এক টুকরো কান্না নিয়ে মাটির অন্ধকার থেকে চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকায়। একটি মোটে তারা সেখানে। কিন্তু তা হলেও ঘোলাটে অন্ধকারের চেয়ে সূচের আগার মতন সূক্ষ্ম উজ্জ্বল একবিন্দু আলোর মধ্যে অনেক বেশি শান্তি অনেক আশা লুকিয়ে থাকে। রাত বাড়লে আলোর ফুটকি বাড়ে আশার ইশারা আকাশে অনেক দূর ছড়িয়ে পড়ে। কোন্ এক বন্ধু তাকে পরামর্শও দিয়েছিল। স্ত্রীর সঙ্গে খিটিমিটি বাধলে কথায় কাজে না বনলে চুপচাপ বসে রাত্রির অপেক্ষা করবে। আর একমুঠ অন্ধকার তোমার চারপাশে নামুক, আরো কিছু তারা মাথার ওপর ঝিকিমিকি করুক। তরপর। তাই চুপচাপ একলা অন্ধকারে মশার কামড় সহ্য করে বসে থেকে প্রণব গাঢ় গূঢ় রাত্রির অপেক্ষা করে। এটা প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে তার।

মায়া?

প্রণবের মত বাজে ভাবনাচিন্তা তার কোনোদিনই নেই। আজও করল না।

বরং ততক্ষণ ক্ষিপ্র সুন্দর হাতে ও নতুন করে ঘর ঝাঁট দিল। বিছানা পাতল। আলো জ্বালল। আরো যা কিছু শোবার ঘরে টুকিটাকি কাজ শেষ করে শেষবারের মতন দেয়ালের আয়নায় মুখখানা একবার দেখে নিয়ে আস্তে আস্তে রান্নাঘরের দিকে চলল। শোবার ঘরের পিছনে ছোট্ট চালা।

কিন্তু সেখানে পা দিয়ে তখনি তার আলো জ্বালতে ইচ্ছা হল না। অন্ধকার চালার নিচে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে ও বাইরের দৃশ্যটা দেখে। কাদের বাড়ির একটা লিচু চারা, একটা নারকেল গাছ ওধারে। তারপর আকাশ। আকাশের কিনারে সাদা এক পোঁছ আলোর ইশারা জেগেছে। তার অর্থ চাঁদ উঠছে। এখনি উঠবে। একটা অদ্ভুত সময়। বৃষ্টির ভিজে হাওয়া মায়ার চোখেমুখে লাগল।

আর ঠিক তখন ও শুনতে পেল কোনদিকে গাছের পাতার আড়ালে একটা পাখি যেন ঠোঁট ঘষছে। হয়তো পাখি পাখির ঠোঁট ঘষে দিচ্ছে। দৃশ্যটা কল্পনা করে মায়ার রোমাঞ্চ হল। ইচ্ছা করে ও খোঁপাটা খুলে ফেলল। ঘাড়ের কাছে বেণীটা একটু সময় সাপের মতন প্যাঁচ খেয়ে লেগে থেকে তারপর হঠাৎ লাফিয়ে পিঠ বেয়ে কোমরের ওপর এসে ঝুলতে লাগল।

একটা খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায় মায়া। একটু ঝুঁকে ঈষৎ বাঁকা হয়ে। আঁচলটা আর ঘাড়ে লেগে থাকে না, লুটিয়ে নিচে পড়ে।

বস্তুত তখন মায়ার সৌন্দর্য যে দেখেছে সে বলবে!

কিন্তু কে দেখবে!

কেউ দেখবার নেই বলে ভিজে হাওয়ার মতন একটা ভারী নিশ্বাস তার বুক ঠেলে গলার কাছে উঠে এসে যন্ত্রণা করতে থাকে। কিন্তু অল্পক্ষণ। খুব অল্প সময়ই প্রণবের জন্য ও দুঃখ করে। কেননা মায়া জানে এখানে এখন চাঁদ ওঠার দৃশ্য দেখতে প্রণবকে ডেকে আনলেও সে তা দেখতে পাবে না। পারে না।সেই চোখ নেই। পাখির ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকানোর শব্দ? সেই কান নেই। কেন নেই, আর কি নেই স্বামীর ভাবতে মায়া আজ বড় একটা গ্রাহ্য করে না। ভুলে থাকে। একটু একটু করে দু’ বছরের অভ্যাসের পর এখন, আজ, নিজেকে ও বেশ সবল শক্ত মনে করছিল। আর এই জন্যই প্রণব কাছে ছিল না বলে তার এত ভাল লাগছিল।

ডুমুর-জঙ্গলের মধ্যে গিরগিটিটা হঠাৎ কর্কশ শব্দে ডেকে উঠল। মায়ার বুকটা কাঁপল। একবার। পরমুহূর্তে ও সহজ স্বাভাবিক হয়ে বরং মনের স্ফুর্তিটাকে একটা সম্পূর্ণ রূপ দিতে হাত বাড়িয়ে খপ্ করে উড়ন্ত জোনাকিটাকে ধরে ফেলল। জোনাকি ছুলে কি হয় ছেলেবেলায় শোনা কথাটা মনে হতে ও ঠোঁট টিপে হাসল। এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে, রাত্রে বিছানায় সেটি করার ভয় অবশ্য নেই ভেবে মায়া নিচের ঠোঁটটা ঈষৎ বিস্ফারিত করে যেন প্রায় শব্দ করে আর একবার হাসল, তারপর পোকাটাকে দেখতে লাগল। হাতের মুঠ খুলে আবার বন্ধ করল ও। আবার খুলল। খুঁটিতে আর ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে না থেকে পা ছড়িয়ে বসল। ইঁট দিয়ে এক চিলতে বাঁধানো জায়গা। পা ঝুলিয়ে বসলে নিচের ঘাসে পায়ের গোড়ালি ঠেকে। মায়ার এটা ভাল লাগে। সাপের আস্তানা হবে ভয় দেখিয়ে প্রণব সব ঘাস কেটেছেঁটে জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেলতে চেয়েছিল,—মায়া দেয়নি। সাফ করতে হয়, সাপের ভয় থাকে, সামনের দিকের উঠোন পরিষ্কার কর। এটা নয়। রান্নাঘরের পিছনের এই ছোট্ট ঘাস লতা আগাছার জঙ্গল সম্পূর্ণরূপে মায়ার। তার নিজস্ব জগৎ। এখানে আর কারোর হাত লাগানো কি হাত বাড়ানো ও বরদাস্ত করে না। বলতে কি, ঘাসের মাথায় পা ঠেকলে পায়ের তলা যখন খসখস করে মায়ার খুব ভাল লাগে। চোখ বুজে ও এই খসখসটা অনুভব করে। যেন হাল্কা পাতলা মেয়েলি পা পেয়ে ঘাসের শীষগুলো ইচ্ছামতন সুড়সুড়ি দিতে থাকে। না, প্রণব একদিন ছোট্ট একটা পালক (সম্ভবত পায়রার) দিয়ে তার পায়ের তলায় সুড়সুড়ি দিয়েছিল, বেশ কিছুদিন আগে, কিন্তু মায়ার তা ভাল লাগেনি। বরং তার রাগ পেয়েছিল। মুখে বলেনি যদিও কিছু। কিন্তু চোখমুখের ও এমন ভাব করেছিল যে, তারপর আর একদিনও প্রণব এ ধরনের রসিকতা করতে সাহস পায়নি। কেন ভাল লাগেনি কেন খারাপ লাগল তা নিয়ে মায়া মাথা ঘামায় না। শুধু ঘটনাটা তার মনে আছে। এখানে এখন ঘাসের শীষে পা ঠেকিয়ে সেদিনের কথা ভেবে ও হাসল। বস্তুত প্রণবের অধিকাংশ কাজই কেন ভাল লাগে না একদিন ঠাণ্ডা মেজাজে বসে ভেবে দেখবে মায়া ঠিক করে রেখেছিল, কিন্তু বসা আর হয় না, যেন সময়ই পাচ্ছে না ও। বস্তুত যে জিনিস ভাবতে গেলে মন প্রফুল্ল না হয়ে বিষন্ন অবসাদগ্রস্ত হয় তাকে নিয়ে বসতে তার জন্য কিছুক্ষণ সময় নষ্ট করতে যেন প্রকৃতিই তাকে দিচ্ছে না! প্রণবকে নিয়ে ও যে কী মুশকিলে পড়েছে তা যদি ঈশ্বর জানত!

চমকে উঠল মায়া। হাতের মুঠ আলগা করে আলোর পোকাটাকে দেখতে না পেয়ে ও অবাক হল, হতাশ হল। একটু ভাবতে গেছে আর তখনি এমন সুন্দর জিনিসটা হারিয়ে ফেলল! এদিক-ওদিক তাকাল ও, হাতের পিঠ দেখল, পা, পায়ের নিচের ঘাস—কোথাও নেই। তা ছাড়া উড়ে যেতেও তো পারে না। যা-ই ভাবুক, যতক্ষণই ভাবুক মায়া চোখ বুজে ছিল না। উড়ে যাবার সময় পোকাটাকে ও দেখতে পেত। না, আছে!এমন একটা জায়গা বেছে নিয়ে দুষ্টু এসে বসবে মায়ার স্বপ্নের বাইরে কখন এল? চোখ ফেরাতে পারছিল না মায়া। ভিজে হাওয়ার স্পর্শ পেতে এখানে এসেই ও ব্লাউজের বোতাম খুলে দিয়েছিল। প্রণব না থাকলে খালি-গা হয়েই বসত। (গায়ে জামা না-রাখা প্রণব পছন্দ করে না। দিনের বেলা এমনকি রাত্রেও। দরজায় খিল না দেওয়া পর্যন্ত, আলো নিবিয়ে বিছানায় না ঢোকা পর্যন্ত মায়া বুক পিঠ ঢেকে রাখবে—হ্যাঁ, দাবি ছাড়া একে আর কি আখ্যা দেবে মায়া, স্বামীর দাবি? ভাবতে মায়ার বিশ্রী হাসি পায়, করুণা করে ও লোকটাকে মনে মনে। যাক সেসব।) এখন ও স্বপ্নাচ্ছন্নের মত নিজের বুকের দিকে চেয়ে রইল। সরু ঢালু জায়গাটুকুতে একটা সবুজ মুক্তা হয়ে স্থির হয়ে বসে আছে জোনাকিটা। মুক্তার গা থেকে ঠিকরে পড়া হাল্কা সবুজ আলোয় তার বুক এখন সত্যিকারের কাঁচা ফলের মতন দেখাচ্ছে। বিদ্যুৎশিহরন খেলা করে গেল মেরুদাঁড়ায়। মায়া অনুভব করল নিজের বুক দেখে এত বেশি মুগ্ধ অভিভূত ও আর কোনোদিন হয়নি। আর একদিনও না। ওকি? উড়ে যাচ্ছে! উড়ে গেল? হাঁ করে চেয়ে রইল মায়া। হাত উঠল না। হাত বাড়িয়ে আবার ওটাকে ধরবার তিলমাত্র চেষ্টাও করল না ও। বরং চরম তৃপ্তির পর দারুণ আলস্য ও অবসাদ নিয়ে মানুষ যে চোখে কোনো একটা কিছুর চলে যাওয়া দেখে ঠিক সেভাবে ও চুপচাপ ডুমুরতলার অন্ধকারের দিকে আলোর পোকার উড়ে যাওয়া দেখল। কতক্ষণ এমনি স্থির হয়ে একভাবে বসে কাটাল মায়ার খেয়াল ছিল না। যখন খেয়াল হল দেখল গাছের পাতা চুঁইয়ে জল পড়ার মতন বর্ষারাত্রির নীল ঠাণ্ডা জ্যোৎস্না তার নরম শরীরের ওপর একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে। আলস্যভঙ্গের হাই তুলে ও উঠে দাঁড়াল। ওধারে পেঁপে গাছের কাণ্ড আর নোনাধরা দেয়ালের মাঝখানে এক টুকরো মাকড়সার জালে কখন জানি দু-এক ফোঁটা বৃষ্টির জল লেগেছিল, জ্যোৎস্না পড়ে এখন চিকচিক করছে, অল্প হাওয়ায় থেকে থেকে কাঁপছে। না, উত্তরদিকে সাদা একটা ডেলা ছাড়া আকাশে আর কোথাও এক ফোঁটা মেঘ নেই। ঘাড় উঁচিয়ে মায়া সবটা আকাশ দেখতে চেষ্টা করল, তার নিজের ঘরের চালের জন্য বাকিটুকু দেখা গেল না যদিও। তা হলেও মায়ার মনে হল আজ রাত্রে আর বৃষ্টি হবে না। কী যে ভাল লাগছিল ওর। যেন শরতের রাত ভেবে একটা টিয়াপাখি কিচমিচ শব্দ করতে করতে রান্নাঘরের চাল ঘেঁষে একদিকে উড়ে গেল। কোনো আতা গাছে গিয়ে বসবে হয়তো, মায়া ভাবল, না কি কামরাঙা গাছে?

হ্যাঁ, হঠাৎ ভীষণ খারাপ লাগল তার কথাটা মনে হতে। এখন উনুন ধরাতে হবে। যদি উনুন না ধরায় ও যদি রান্না না করে, আজ, একটা রাত কি চলে না। খুব চলে। কেন চলবে না! অন্তত মায়ার কোনো অসুবিধা হয় না। আম আছে। প্রণব ফজলি আম এনেছে। একটা আস্ত আম যদি খায় ও তো ভাতের দরকার হয় না। তাই খেয়ে দিব্যি শুয়ে পড়তে পারে। কিন্তু প্রণব পারবে কি? ভাত না হলে? প্রস্তাবটা দেবে ভেবে মায়া ইতস্তত করতে লাগল। এক পা অগ্রসর হয়ে আবার দাঁড়াল ও। প্রণব কি ঘুমিয়ে পড়েছে? কেন জানি কেবলই মনে হচ্ছিল তার বারান্দার চেয়ারে বসে প্রণব ঘুমোচ্ছ।

বরদাসুন্দর বটব্যালের শহরতলির (ধরুন না টালা) এক জঙ্গলাকীর্ণ নির্জন বাড়ির ভাড়াটে দম্পত্তির রান্নাখাওয়ার বিস্তারিত বর্ণনা করতে গেলে গল্প দীর্ঘ হয়ে যাবে। কেবল এইটুকু বললে চলবে যে, মায়াকে রান্না করতে হল। প্রণব চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েনি। পায়চারি করছিল সিগারেট টানছিল। চিন্তামগ্ন। কিছু ভাবছে বুঝতে পেরে মায়া কাছে ঘেঁষেনি।

আয়োজন সামান্য। ভাত আর ইলিশমাছের ঝোল। চট্‌ করে রান্না হয়ে গেল। দু’জনে খেতে বসে কথা হল না।

যেন দু’জনেই ভাবছিল এখন কেউ কাউকে ঘাঁটাবে না। ভালয় ভালয় খাওয়া-দাওয়াটা শেষ হোক।

খাওয়া সেরে লবঙ্গ মুখে দিয়ে প্রণব পিঠটা এলিয়ে দিয়ে বিছানায় বসল।

এঁটো বাসন জড়ো করে রেখে হাত ধুয়ে মুখ মুছে মায়া ঘরে এল।

প্রণব হাত বাড়িয়ে হারিকেনের আলো ছড়িয়ে দিল।

মায়া চিরুনি হাতে আয়নার সামনে দাঁড়ায়।

শোবার আগে চুল আঁচড়ানো তার চিরদিনের অভ্যাস। মায়া পান খেয়েছে। ইলিশমাছ খেয়ে মুখে আঁশটে গন্ধ লাগছে বলে পান খেয়েছে। এমনি অভ্যাস নেই। প্রণব পান খায় না। কাকে দিয়ে মায়া পানের খিলিটা কিনিয়ে এনেছে প্রণব জিজ্ঞেস করল না। কেবল লাল টুকটুকে একজোড়া ঠোঁটের দিকে সে চেয়ে রইল।

‘ব্লাউজটা খুলে ফেল না হয়, খুব ঘামছ।’

মায়া শব্দ করল না বা প্রণবের দিকে তাকাল না।

সিলিং-এর দিকে চোখ রেখে প্রণব চুপ করে রইল।

চিরুনি চালাবার সময় মায়ার হাতের চুড়ির রিনঠিন শব্দ হয়। মায়ার হাত মাথা চুলের ছায়া এই এত বড় হয়ে দেয়াল ও সিলিং পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। ছায়ার দীর্ঘ ঢেউ হয়ে চুলটা উঠছে নামছে দুলছে। আর সেই ঢেউয়ের বুকে চিরুনির ছায়াটা একটা ছোট্ট নৌকো হয়ে নেচে নেচে চলেছে।

কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে প্রণব দৃশ্যটা দেখল। একটা পোকা ঘরে ঢুকেই আলোর কাছে ছুটে এসে হারিকেনের চিমনির গায়ে ঠোক্কর খেয়ে নিচে ছিটকে পড়ল। মেঝের আবছা অন্ধকারে পোকাটাকে আর দেখা গেল না।

‘আলো নিবিয়ে দেব?’ মায়া ঘুরে দাঁড়াল।

‘তোমার হয়ে গেছে?’ উৎসাহের চোখে প্রণব স্ত্রীর মুখ দেখল ও পিঠ টান করে সোজা হয়ে বসল।

‘হওয়া আর কি।’ তেমন ভাল করে কথার উত্তর দিল না মায়া। চিরুনি রেখে দিয়ে চুলে প্যাঁচ তুলে কোনোরকমে একটা এলোখোঁপা করে রাখল।

‘আলো নিবিয়ে দিই?’ মায়া আবার বলল।

‘যা ঘামছ জামাটা খুলেই ফেল।’ প্রণব ঈষৎ ঝুঁকে বসল।

মায়া আলোটা দেখতে লাগল।

প্রণব ইচ্ছা করে সামান্য হাসল।

মায়া নীরব।

হামাগুড়ি দিয়ে প্রণব বিছানায় লাগোয়া জানালার পাল্লাটা বন্ধ করে দিয়ে ঘুরে বসল।

মায়া মুখ তুলছিল না।

ভুরু পর্যন্ত হারিকেনের আলো লেগেছিল ওর। কপালটা অন্ধকার ছিল বলে অসংখ্য কুঞ্চন প্রণব দেখতে পেল না, তাই সাহস করে গলাটা একটু ভিজিয়ে মোলায়েম সুরে বলল, ‘না না আমি তো বলছি, তোমাকে অনুমতি দিচ্ছি। আর আমি আমার স্ত্রীকে দেখছি। অন্য কাউকে না।’

স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে মায়া ক্ষীণ হাসল। হাসির মধ্যেও দুটো চোখ জ্বলছিল। প্রণব ঢোক গিলল।

‘না না রিয়ালি বলছি। আমি যে অন্যায় কিছু করছি না ; আমি যে, আমিও যে তোমার মতন বাইরের এত লোকের এত সব কীর্তি কত বেশি অপছন্দ করি এটা তোমার কাছে প্রমাণ দিতে তোমাকেই দেখতে চাই। এর চেয়ে পবিত্র কাজ আমার পক্ষে আর কি আছে তুমিই তার রায় দাও।’

একটা টিকটিকি ঘরের চালে ডেকে উঠল।

একটা ভীষণ আপত্তি আঙুলের মাথায় ঝুলিয়ে রেখে মায়া ব্লাউজের বোতামে হাত দিল।

প্রণব একটা গাঢ় নিশ্বাস ফেলল। ‘আমার চেয়ে ভাল রুচি যে আর কারোর নেই তুমি কি আজ দু’বছর বিয়ের রাত থেকে কালকের রাত পর্যন্ত টের পাওনি? বিয়্যালি আমি আন্তরিকভাবে ঘৃণা করি সুকুমারদের পাড়ার সেই ভদ্রলোকদের ক্লাসের লোককে। ছি ছি ছি, শেষ পর্যন্ত ঝি! আমার উচিত হয়নি জঘন্য খবরটা এনে তোমার কানে তোলা।’

‘যাক আর বেশি বকতে হবে না। এইবার আলো নিবিয়ে দিই। শুতে দাও।’

একটু সময়ের জন্য প্রণব নিশ্বাস ফেলল, ‘কেন?’

‘লজ্জা করে, ভাল লাগে না।’

প্রণব একটা আক্ষেপের নিশ্বাস ত্যাগ করল।

‘লজ্জা করে।’ একটু থেমে পরে সে বলল, ‘বলো ভাল লাগে না, আমাকে তোমার ভাল লাগে না, তাই এরকম করছ।’

‘কি রকম?’

প্রণব কথা বলল না।

‘দু’বছর আমায় দেখে কি তৃপ্ত হওনি।’

‘হইনি হইনি।’ যেন প্রবল ক্রোধে প্রণব এবার ফেটে পড়ল। তৃপ্তি পাই না শান্তি পাই না বলে এখন বাতির আলোয় তোমার রূপ দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে, কিছুটা ক্ষতিপূরণ হোক।’

‘ও সেই জন্যেই ক্ষোভ।’ মায়া আঁচলটা তুলে বুকের ওপর জড়ো করল। একটু পায়চারি করল। দেয়ালের কাছে সরে গিয়ে আয়নার সামনে একবার দাঁড়াল। তারপর আস্তে আস্তে প্রণবের সামনে ফিরে এল।

‘সেই চিন্তা সেই ধ্যান তোমার। এই জন্যেই ঘরে আলো রেখে নিজেকে আমি দেখাতে চাই না।’ মায়া খুব আস্তে বলল না। তাতে অবশ্য ক্ষতি হল না। বেশ কিছুক্ষণ আগেই সুন্দর ফুটফুটে জ্যোৎস্নার আকাশ মেঘে মেঘে কালো অন্ধকার হয়ে উঠেছিল। এখন ঝমঝম করে বর্ষণ শুরু হল। যেন হুতুম পাখিটা অসময়ে দু’বার ডেকে উঠল।

আলো নিবিয়ে মশারির ধারগুলো টেনে দিতে দিতে মায়া বলতে লাগল, ‘সেই পাপ-চোখের সামনে নিজেকে খুলে ধরতে লজ্জা করে বইকি। ভালও লাগে না।’

‘বেশ তো, যাকে ভাল লাগে তাকে দেখাও, তার সামনে সব খুলে মেলে দাঁড়িও।’ প্রণব দেয়াল ঘেঁষে বিছানার একপাশে শুয়ে রইল। ‘আমি আর দেখতে চাই না।’

‘কে দেখছে কাকে দেখাচ্ছি যদি জানতে তো তোমার মন একটু উন্নত হত। রোজ রাত্রে আমার জন্যে তুমি এমন হ্যাংলামো করতে না।’

‘অ, তা হলে কেউ দেখছে,’ শ্লেষের সুর বার করল প্রণব। ‘তা হলে বলো এমন কেউ আছে যাকে সব দেখিয়ে সব দিয়ে তৃপ্তি পাও, আমাকে না?’

‘হ্যাঁ, আমার রূপ আমি আকাশকে দেখাই, বাতাস এসে আমার গায়ে গন্ধ শোঁকে, গাছ, গাছের পাতা, শালিক বুলবুলিরা আমার যৌবন দেখে। কোনো মানুষ না, পুরুষকে দেখাই না। তোমাকে দেখে দেখে পুরুষ জাতটার ওপর ঘেন্না ধরে গেছে, অন্তত আমার।’

‘কখন দেখাও’, যেন একটু হাসতেই চেষ্টা করল প্রণব। ‘আকাশের নিচে কোথায় বসে সব খুলে দাও আমাকে বলতে পার?’

‘ভদ্রভাবে কথা বলতে শেখো।’ মায়া শুয়ে ছিল। রাগ করে উঠে বসল। ‘নিশ্চয়ই আমাকে একসময় স্নান করতে হয়, কাপড় বদলাতে হয়। ইতর অভদ্র কোথাকার!’

কিছুক্ষণ আর কথা শোনা গেল না প্রণবের। যখন শোনা গেল মনে হল ঘুমে কথাগুলো গাঢ় ভারী হয়ে গেছে। অভিমানেও হতে পারে, মায়া ভাবল।

‘তাই তো বলি তোমার মতিগতি বোঝা ভার। তাই তো বন্ধুরা বলে নারী-চরিত্র। আর এদিকে আমি সারাক্ষণ ভেবে ভেবে মরি। পাউডার ফুরোতে পাউডার নিয়ে এলাম। ফজলি আমের চালান এসেছে, এক টাকার আম কিনে আনলাম।’

‘সস্তা জিনিস দিয়ে সস্তা জিনিস আদায় করো। আমার কাছে পাবে না। তেরো বছরের খুকির কাছে গিয়ে এই কান্না কেঁদো—পাবে। আমি আর তোমার কান্নায় গলে যেতে রাজি নই, যত খুশি চোখের জল ফেলো।’

সত্যিই প্রণব ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। যেন বালিশ ভিজে যাচ্ছে।

একটা বিশ্রী গুমোটে মায়ার মাথা ধরছিল। অন্ধকারেই আন্দাজ করে মশারির ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এসে তার ভাল লাগল। কান খাড়া করে শুনল। হঠাৎ আবার বৃষ্টিটা থেমে গেছে। টের পাচ্ছিল ও। আস্তে আস্তে বিছানার দিকের, না, উল্টোদিকের জানালায় সরে গিয়ে দুটো পাল্লা খুলতে বাইরের দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেল ও। ফুটফুটে জ্যোৎস্না। ‘মেঘের পর রৌদ্রের মতন।’ মায়া মনে মনে বলল। রাত্রেও চাঁদের আলো আর বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা চলছে। যেন কোনদিকে কদমফুল ফুটেছে। ভিজে হাওয়ায় টাটকা গন্ধ ভেসে আসছিল।

এক পা এক পা করে ও আর একবার বিছানার কাছে সরে এল। নাক ডাকছে, কাঁদতে কাঁদতে এইবেলা প্রণব ঘুমিয়েছে। কান খাড়া করে রাখল ও একটু সময়। আর ঠিক তখন মায়া শুনল বাইরে পাতার ঝোপে একটা পাখি ডানা ঝাড়ছে। একসঙ্গে অনেকগুলো জলের ফোঁটা ঝরে পৃথিবী আবার চুপচাপ। নিঝুম।

চিকরিকাটা আলপনায় ভুবনের পৈঠা ভরে গেছে। ডুমুরপাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়ে পড়ে এই কাণ্ডটি হয়েছে। এক সঙ্গে এত আলোছায়ার ঝিলিমিলি দেখে মায়ার চোখের পলক পড়ছিল আর তাকেও অপরূপ দেখাচ্ছে। অজস্র জ্যোৎস্না ছায়া বুকে মুখে মেখে খুঁটি ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে মায়া বসে আছে। একদৃষ্টে ভুবন তাকিয়ে দেখল।

‘নিন ধরুন।’

‘ছি, এতগুলো ফুল নিয়ে এলেন—মালা! দোপাটির মালা। কোথায় পেলেন?’

‘বউবাজার।’ খসখসে গলায় ভুবন উত্তর করল। স্টোভটা সারিয়ে পার্টিকে বুঝিয়ে দিতে ওদিকে যেত হল কিনা। বাজারের ভিতর দিয়ে ফিরছিলাম, হঠাৎ চোখ পড়ে গেল।’

মায়া কথা বলল না।

‘নিন, পরুন, মালাটা, গলায় আটকে দিন। একবার চেয়ে দেখি কেমন লাগে।’

‘এলোখোঁপা’, ভুবনের হাত থেকে মালাটা তুলে নিয়ে মায়া ক্ষীণ গলায় হাসল। ‘ভাল দেখাবে কি?’

‘সবরকম খোঁপাতেই ভাল দেখাবে। দিদির এই চুলে দোপাটি গুঁজলেই হল।’

‘সাদা ফুল।’

‘রাত্রে খুলবে ভাল। রাতের চুলে সাদা মানায়।’

খোঁপায় মালা জড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে মায়া বাইরের উঠোন দেখে। জলে জ্যোৎস্নায় গাছের পাতাগুলো চিকচিক করছে। হাওয়ায় নড়ছে। পেয়ারাপাতা থেকে টুপটাপ রুপালি জল ঝরছে।

‘সেই দুপুর থেকেই মগজে দোপাটি ফুল ঘুরছিল। কপাল ভাল পেয়ে গেলাম, দিদিকে সাজাতে পারলাম।’

মুখ ফিরিয়ে মায়া শব্দ না করে হাসল। কি একটু চিন্তা করে পরে আস্তে আস্তে বলল, ‘সাজাবার, সাজ দেখবার এত শখ। তাই তো জিজ্ঞেস করছিলাম পরিবার সংসার কি কোনোদিনই নেই, ছিল না?’

শুকনো পাতার খসখস শব্দ হয় ভুবনের গলায়।

‘ছিল, তা সেসব ইচ্ছা করে বলিনি, কি হবে বলে।’

‘তা, শুনি?’

‘একবার না তিনবার। তিন-তিনটে পরিবার ঘরে আনলাম, একটাও থাকেনি।’ ভুবন চুপ করল।

‘কোথায় ওরা?’

‘প্রথমটা মরেছে কলেরায়, দ্বিতীয়টা মরল ছেলে বিয়োবার সময়, হুঁ মা ছেলে বেরিয়েছিল। আর শেষটা পালাল আমাদের কারখানার এক ছোকরার সঙ্গে। তাও তো ক’বছর হয়ে গেল।’

কথা শুনে মায়া চমকে উঠল না, মরা কাঠের জীর্ণ কাঠামোটার দিক থেকে বিস্ময়ে ও চোখ ফেরাতে পারছিল না। কিন্তু কথা তখনও শেষ হয়নি, একটু থেমে ভুবন বলে, ‘এখন আবার আমাদের উল্টাডাঙ্গার শশী বায়না ধরেছে। আজ ছ’মাস ধরে ঝোলাঝুলি করছে। হুঁ, একটা মেয়ে আছে ওর হাতে। বিধবা ভাগ্নীর মেয়ে। সোমত্থ মেয়ে কাঁধে নিয়ে মাগি ভারি বিপদে পড়েছে, তাই শশী ঘুরঘুর করছে।

জলতরঙ্গের মিষ্টি বাজনার মতন মায়ার নরম হাসির ধ্বনিতে চারদিকের আলোছায়া কাঁপে। আবার কোনদিকে পাতার আড়ালে পাখি ডানা ঝাপটায়। হাসি থামতে মায়া বলল, ‘বলেন কি, এই বয়সে আবার! আপনি সাহস পান?’

‘পাই না, সাহস পাচ্ছি না বলে তো শশীকে কথা দেওয়া হচ্ছে না।’

‘না, না, পারবেন না। সাহস করবেন না।’ ব্যস্ত হয়ে মায়া বলল, ‘শশীকে বলে দিন এই বয়সে আর ওসব হয় না।’

‘তা বুঝি, তা কি আর বুঝি না দিদি।’ মুখের কাছে মুখ সরিয়ে এনে আবেগে ভুবন হিসহিস করে উঠল। ‘কিন্তু পিপাসা যে মেটে না, পিপাসার যে নিরবিত্তি নেই।’

পাথরের মতন স্থির শক্ত হয়ে গেল মায়া। এক মুহূর্ত। তারপর অনায়াস সহজ ভঙ্গিতে মরা গাছের জীর্ণ ডালের বেড় থেকে নিজেকে মুক্ত করল, করে সোজা হয়ে বসল। ফ্যাকাশে ঘোলা চোখে কতটা রক্তের জোয়ার এসেছিল আবছা অন্ধকারে বুঝতে না পেরে কেমন একটু অসহায়বোধ করল ও। তা হলেও সেই ভাবটা কাটাতে ওর দেরি হয় না, আস্তে আস্তে বলল, ‘শশীকে বারণ করে দিন, বুঝলেন, শশীকে বলে দিন যে এ বয়সে আর—’

‘বলব, আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি, শশীকে শেষ কথাটা বলে দেওয়াই ভাল।’

হঠাৎ আর কথা বলে না মায়া। ঘাড় ফিরিয়ে উঠোন দেখে। যেন নিজের ঘরের দিকে চোখ যেতে কি ভাবে।

‘কি, কর্তাবাবু কি জেগেছেন, এইবেলা জাগবেন?’ ভুবন গলা বাড়িয়ে দেয়। মায়া নিঃশব্দে মাথা নাড়ল, থুথু ফেলল, যেন থুথু ফেলতেই উঠোনের দিকে মুখ বাড়িয়েছিল ও। তারপর ঘুরে বসে শান্ত মোলায়েম গলায় বলল, ‘এই জংলা ছিটের সায়াটা আমাকে কেমন মানিয়েছে বলছেন না তো, কেমন দেখাচ্ছে?’

খসখসে গলায় ভুবন হাসল।

‘বলব, বলছি, ওটা পরনে দেখে তখন থেকেই তুলনাটা আমার মনের মধ্যে কেবল নড়াচড়া করছে। চিতাবাঘিনী, বনের চিতার মতন চমৎকার সরু ছিমছাম মাজাঘষা কোমর দিদির।’

‘তাই নাকি, ঘরে গিয়ে আয়নায় দেখব তুলনাটা ঠিক হল কি না।’

‘কেন, আবার আয়না কেন, আমার চোখকে কি দিদির বিশ্বাস হয় না?’ যেন এই প্রথম ভুবনের গলায় দুঃখের আওয়াজ বেরোল। ‘বুড়ো হয়ে গায়ের বল গেছে বটে, কিন্তু ভেতরে রসের বালব জ্বেলে রেখে দৃষ্টিটাকে আয়নার মত ঝকঝকে করে রেখেছি, ছানি পড়তে দিইনি, দিদির কি এখনো বুঝতে বাকি!’

যেন এই প্রথম মায়া ভয় পেয়ে আঁতকে উঠেছিল, এই প্রথম তার কান্না পেল, কিন্তু কোনোটাই ও হতে দিলে না। ভয় কান্না দুটোকেই জয় করার আশ্চর্য ক্ষমতা নিজের মধ্যে অনুভব করল ও। তাই উষ্ণ কোমল হাতটা মরা শুকনো কাঠের গায়ে তুলে দিয়ে অবলীলাক্রমে ও হাসল। ‘বিশ্বাস করি, তা না হলে কি আর দুপুর রাত্রে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে এই আয়নার সামনে দাঁড়াই, নিজেকে দেখি, বলুন?’

১৩৬৩ (১৯৫৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *