গিন্নিদের প্রসঙ্গে
আমার বিয়ে হবার পরেই দেখলাম যে আমার মা-মাসিদের সহপাঠিনী যেসব গিন্নিদের এতকাল আমি মাসি-পিসি বলে ডেকে এসেছি, তাঁরা সবাই এখন সম্পর্কে আমার ননদ হলেন। বললেন, ‘এখন থেকে আমাদের দিদি বলে ডাকবি।’
শুধু তাই নয়, সেই মুহূর্ত থেকেই তাঁরা সব দিদির মতো এবং প্রায়-সমবয়সী দিদির মতো ব্যবহারও করতে লাগলেন, নিজেদের এবং পরস্পরের শাশুড়িদের আর স্বামীদের বিষয়ে এমন সব রোমাঞ্চকর কথা আমার কানে ঢালতে লাগলেন যে তাঁদের সমবয়সী ভাবা ছাড়া আমার উপায় রইল না।
তাঁদের অনেকের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কৈশোর থেকে হাসি-তামাশা করে এসেছি, এখন হয়ে গেলাম কারও কাকি, কারও মামি, কারও ছোটদিদিমা! কেউ কেউ বয়সে অনেক বড়ও ছিল, হয়তো দশ-বারো বছরের বেশি বড়, তারাও সম্পর্কে ছোট হওয়াতে, পত্রপাঠ পায়ের ধুলো নিয়ে বলতে শুরু করে দিল, ‘কবে মা-বাবাকে হারিয়েছি, এখন বলতে গেলে, মাথার ওপর খালি তোমরাই রইলে!’
এইসব নিকট আত্মীয়কুটুম্বদের কাছে থেকে আমি সংসার করার প্রথম পাঠ নিয়েছিলাম। আর সত্যি কথা বলতে কী এমন অকপট স্নেহ তাঁরা এমন দরাজ হাতে ঢেলে দিয়েছিলেন যে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম।
একদিন আমার ন-ঠাকুরঝি বললেন, ‘তুই যে কত ভাগ্যবতী তা জানিস না। তোর শাশুড়ি নেই! আমার ওই শাশুড়িটিকে নিয়ে আমি সারাজীবন হয়রান হয়েছি! সেই তাঁর শেষ চোখ বোজা পর্যন্ত। এই খাইয়ে-দাইয়ে, আঁচিয়ে, মুখশুদ্ধি মুখে দিয়ে নিজে খেতে গেলাম। এর মধ্যে তাঁর কোনও আত্মীয় এলেন দেখা করতে, তাকে হয়তো বললেন, “সেজো-বউমার সব ভাল, খালি ওই আমাকে খেতে দেয় না! কাল রাত থেকে এই বেলা অবধি শুকিয়ে রেখেছে!” তাই শুনে আত্মীয়াটি হাত-পা ছুড়ে একাকার! কিন্তু ভার নেবার বেলায় কেউ কোথাও নেই—!’ এই অবধি বলে হয়তো আমার দিকে তাকিয়ে বলতেন, ‘পুজোয় ভাগনে-ভাগনিকে কী দিবি বল্? জানিস তো শাস্ত্রে আছে এক ভাগনেকে কিছু দিলে, একশো বামুনকে খাওয়ানোর ফল দেয়!’ বলাবাহুল্য ভাগনেটির প্রায় আমার সমান বয়স, ভাগনি কিছু বড়! এমনি করে একটু একটু করে সংসার করার পাঠ নিতে লাগলাম।
এমএ পাশ করেছি। এক বছর শান্তিনিকেতনে, এক বছর কলকাতায় অধ্যাপনা করে কাটিয়ে সংসার সম্বন্ধে কিছুটা ওয়াকিবহাল হলেও, প্রশিক্ষণের যে অনেক বাকি, সেটা টের পেলাম কলকাতার এক নামকরা মহিলা সমিতির সদস্যা হয়ে। আজ পর্যন্ত সেইসব মহিলাদের আমি এমনি ভয় করি যে নাম করবার সাহস হল না।
মোট কথা তাঁরা ভাল ভাল জামাকাপড় পরে, একেকবার একেকজন অতিথিপরায়ণ সদস্যার বাড়িতে মিটিং করতেন। সেইসব মিটিং-এ নানা সৎকাজের উদ্দেশ্যে টাকা তোলা হত। যদি শোনা যেত সরকার, বা কোনও সরকারি, বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নারীদের ওপর অবিচার বা অন্যায় করেছে, অমনি সকলের সই নিয়ে বড়লাটের দপ্তরে আপত্তি জানানো হত। আর বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, অনেক সময়ই তার ভাল ফল দেখা যেত।
একবার মনে আছে, কয়েকজন জবরদস্ত সমাজসেবিকার সঙ্গে উত্তর কলকাতার কোনও বিশিষ্ট খবরের কাগজের আপিসে গিয়ে, নারীকল্যাণ সমিতিগুলোর সততা সম্বন্ধে বিশ্রী ইঙ্গিতপূর্ণ সম্পাদকীয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গেছিলাম। সম্পাদক আবার জ্যাঠামশাইদের চিনতেন।
আমার সঙ্গী গিন্নিরা কিছুক্ষণ ‘আপনাদের কি মা-বোন নেই?’ গোছের প্রতিবাদ জানাবার পর, সম্পাদকমশাই আমার দিকে ফিরে হঠাৎ বললেন, ‘বুঝতে পারছি, খুব অন্যায় করে ফেলেছি। ভুল তথ্যের ওপর নির্ভর করে অন্যায়টা করেছি। আপনি সঠিক তথ্য দিয়ে আপনাদের কাজ সম্বন্ধে যা যা লিখে দেবেন, আমরা হুবহু তাই ছাপব।’ তাই লিখে দিয়েছিলাম, ওঁরা ছেপেও ছিলেন। সাংবাদিকরা সবাই মন্দ নয়।
এই প্রসঙ্গে আমার জন্মের অনেক আগের একটা ঘটনা আরেকবার না বলে পারছি না। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সমাজ-উন্নয়ন কর্মের প্রথম যুগ। কোনও একটা রক্ষণশীল কাগজে, শিক্ষিত মেয়েদের সম্বন্ধে যাচ্ছেতাই মন্তব্য করে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল।
তখনও মেয়েরা নিজেদের হয়ে লড়তে শেখেনি, কিন্তু তাদের হয়ে লড়বার লোকের অভাব ছিল না। আমার মেজজ্যাঠামশাই উপেন্দ্রকিশোরের শ্বশুর দ্বারিক গাঙ্গুলী, ওই সম্পাদকীয়টুকু কেটে পকেটে নিয়ে, হাতে একটা মোটা লাঠি নিয়ে কাগজের আপিসে সম্পাদকের ঘরে গিয়ে হাজির হলেন।
হঠাৎ অমন গম্ভীরমুখো লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ পুরুষকে দেখে, সম্পাদক একটু থতমত খেয়ে বললেন, ‘তা আপনি কেন এসেছেন?’ দ্বারিক গাঙ্গুলী হাসলেন, ‘এসেছি আপনাকে আপনার কথা গিলিয়ে খাওয়াবার জন্য। টু মেক্ ইউ ইট ইয়োর ওয়ার্ড্স্!’
এই বলে সম্পাদকীয়টুকুকে গুলি পাকিয়ে, জল দিয়ে গিলিয়ে, বলেছিলেন, ‘কাল ওইসব কথা প্রত্যাহার করে সম্পাদকীয় না বেরোলে, অন্য এবং আরও শক্ত ওষুধ দিতে হবে।’ বলাবাহুল্য ওই সম্পাদকীয় বেরিয়েছিল।
সে যাই হোক, নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্মের পেছনে আরেকটা বেশ জোরালো প্রবাহ চোখে পড়ত। আমাদের সমিতির মিটিং উপস্থিত যে বাড়িতে হত, সেবাড়ির গৃহস্বামিনী যদি তার আগের মিটিং-এর গৃহস্বামিনীর চেয়েও ভাল জলযোগের ব্যবস্থা না করতেন, তা হলে তাঁর বড় লজ্জা হত। মাঝে থেকে আমাদের সুবিধা হত।
চা খেতে খেতে দেখতাম যে যার নিজের স্বামীর চুটিয়ে নিন্দা করছেন— ‘বাইরে থেকে দেখতে ওইরকম ভাল, টাকাকড়ি রোজগারও মন্দ করেন না; কিন্তু যে ওঁর সঙ্গে ঘর করেনি, সে বুঝবে না কী কঠিন ব্যাপার। ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মার্চের মধ্যে হাজার গরম পড়লেও পাখা চালাবার জো নেই! যেসব জিনিস কোত্থাও পাওয়া যায় না, সেইসব জিনিস, যে দামে তা কখনও পাওয়া সম্ভব নয়, সেই দামে এনে টেবিলে দিতে হবে! আয়া জবাব দিয়েছে তো আরেকটা আনো। ছয় মাসে তো এমনিতেই ষোলোটা এল গেল!’
মনে পড়ে গেল আমার স্বামী কোন বাড়ির গিন্নির গল্প বলেছিলেন। তিনি সখীদের কাছে মুখ উঁচু করে বললেন, ‘আমাদের বাড়ির ওনার বারোমাস ল্যাংড়া আম খাওয়া চাই।’ শ্রোতারা বললেন, ‘ওমা, তাই কি পাওয়া যায় নাকি?’ গিন্নি বললেন, ‘তা বললে তো চলবে না। ওনার অব্যেস!’
আরও বলি গিন্নিদের কথা। একবার আমার নন্দাই, বিখ্যাত বাঘশিকারি কুমুদ চৌধুরী এসে বললেন, ‘জামাইবাড়ি গিয়ে অবধি সেজোবউ চিঠি দেয়নি। তবে এবার চারপাতা ঠেসে লিখবে সন্দেহ নেই। কারণ আমি লিখেছি রবিবার ফুলবউ নেমন্তন্ন করে মোচার ঘণ্ট রেঁধে খাইয়েছে। অমন আমি জীবনে কখনও খাইনি!’
তবে একথা সত্যি যে স্বামীরা অন্য বাড়ির গিন্নিদের বড় বেশি প্রশংসা করেন। তারা রাঁধে ভাল, কী কম খরচে কী সুন্দর করে ঘর সাজায়, ছেলেমেয়েদের কী সুন্দর শিক্ষা দেয়, কী ঠান্ডা মেজাজ, কী মিষ্টি কথা, হেনাতেনা কত কী, যা শুনলে যে কোনও স্বাভাবিক স্ত্রীর হাড়পিত্তি জ্বলে যায়। এসব ক্ষেত্রে হাঁড়িপানা মুখ করে ঘর থেকে চলে যাওয়াই প্রকৃষ্ট পন্থা। এই প্রসঙ্গে একটা বিলিতি গল্প শুনুন। বাস থেকে নেমেই স্বামী বললেন, ‘তোমার ওপাশের মহিলাকে লক্ষ করেছিলে? তোমার বয়সি হয়তো কিন্তু কে বলবে—’
স্ত্রী বাধা দিয়ে বললেন, ‘কার কথা বলছ? ওই যে নখের পুরনো পালিশ না তুলেই নতুন পালিশ লাগিয়েছে?’ ‘তা তো দেখিনি—’ ‘ওই তো যার চুলের গোড়ার দিকে আসল রং বেরিয়ে পড়ছিল?’ ‘তাই নাকি?’ ‘আরে ওই যে হলুদপানা গায়ের রঙের ওপর বেগ্নি পোশাক পরে বাহার দিচ্ছিল? ওর নিশ্চয় পেট পরিষ্কার হয় না।’ ‘দেখো অত দেখবার সময় কোথায় পাব? কিন্তু কী সুন্দর চলাফেরা—’ ‘সময় পাওনি আবার কী? ওই যে মহিলা পায়ে এক সাইজ ছোট জুতো পরেছিল। জুতোর রং এক, ব্যাগের রং আর, বলিহারি! আবার ন্যাকার মতো আড়চোখে তাকাচ্ছিল! তাও যদি গলায় বোতামটা ভাঙা আর হাতঘড়িটা ৫ মিনিট স্লো না হত। না, আমি তাকে লক্ষ করিনি। আমার তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই!’