গায়েবী আওয়াজ

গায়েবী আওয়াজ

জায়গাটা বেশ নির্জন, মন্তব্য করল জিমি পারকার। গাড়ির সামনের সিটে বাবার পাশে বসে আছে সে।

হবারই কথা, পেছনের সিটে বসা অয়ন হোসেন সায় দিল। সামনের ত্রিশ মাইলের ভেতর উইলো ক্রিকই একমাত্র জনবসতি। পুরো রাস্তাটা আমরা ফাঁকাই পাব। কদাচিৎ দুএকটা পুরনো গাড়ির দেখা মিলতে পারে। হয়তো কোনও কাজে শহরে যাচ্ছে। নইলে দুপাশে বিস্তীর্ণ মাঠ অথবা সারি সারি গাছ–এ ছাড়া কিছু দেখার নেই।

খুব তো জ্ঞান দিয়ে দিলি! জিমি মুখ ভেঙচাল।

যা-ই বলো, গাড়ি চালাতে চালাতে বললেন জিমির বাবা ডা. গ্যারি পারকার, অয়নের এই দিকটা কিন্তু আমার বেশ লাগে। সবকিছুতেই ওর ইন-ডেপথ নলেজ।

নলেজ না ছাই! জিমি বিরক্ত কণ্ঠে বলল। ও যে কোলের ওপর একটা গাইড বুক নিয়ে বসেছে, তা তো দেখতে পাচ্ছ না।

তোমার তো তা-ও নেই, হেসে বললেন ডা. পারকার। সে যাক, অয়ন, তোমার গাইড বুক উইলো ক্রিক সম্পর্কে কী বলছে?

ডিটেইল কিছু নেই, বইয়ের পাতা ওল্টাল অয়ন। জায়গাটা ছোট্ট। লোকসংখ্যা খুবই কম। মাত্র একশো ছাব্বিশ জন। শহর বলা যাবে না, আবার গ্রামও নয়। গ্রাম্য শহর বলাই বোধহয় যুক্তিসঙ্গত হবে। জায়গাটার তেমন কোনও উন্নতি হয়নি-সেই পুরনো যুগেই পড়ে আছে।

বলিস কী! জিমির কণ্ঠে অবিশ্বাস।

অবাক হবার কিছু নেই, বলল অয়ন। আমেরিকার আনাচে কানাচে এমন বহু জায়গা রয়েছে, যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। সেখানকার মানুষরাই আসলে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে চায়।

তা হলে উইলো ক্রিক টিকে আছে কী করে?

কাঠের ব্যবসা! অধিবাসীরা প্রায় সবাই কাঠ ব্যবসার সঙ্গে কোনও না কোনোভাবে জড়িত। লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টির আঠারো শতাংশ কাঠ এখান থেকে সাপ্লাই হয়। এ ছাড়া আছে প্রসপেক্টিং। সোনার খোঁজে বহু নোক এই এলাকার বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। উইলো ক্রিককে টিকিয়ে রেখেছে এরাই।

আর শুনতে চাই না। তোর লেকচার থামা। একরাশ বিরক্তি ঝরল জিমির গলায়। বক্ করে মাথা ধরিয়ে দিচ্ছিস। আমরা যাচ্ছি মাছ ধরতে, থাকব নদীর ধারে ক্যাম্প করে-শহর নিয়ে গবেষণা করার দরকারটা কী?

তা হলে কি গোটা রাস্তা বোবার মত বসে থাকব?

কেন, তোর স্টকে লেকচার ছাড়া অন্য কিছু নেই?

তা আছে। তবে শোন…

মাছ ধরার ঝোঁক আছে অয়নের বাবা শাহাদাত হোসেন আর জিমির বাবা ডা. গ্যারি পারকারের। বেশ কিছুদিন থেকেই দুজনে ফিশিঙে যাবার পরিকল্পনা করছিলেন। উইলো ক্রিকের খবর পেয়েছেন ডা. পারকারের এক সহকর্মীর কাছ থেকে জায়গাটা নাকি মাছ ধরার জন্য অসাধারণ। সঙ্গে সঙ্গে উইকএণ্ডে মাছ ধরার প্রোগ্রাম করে ফেললেন দুজনে। অয়ন আর জিমিও সেইসাথে জুটে গেল। কিন্তু রওনা হবার ঠিক আগ মুহূর্তে একটা জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় শাহাদাত সাহেব আসতে পারেননি। তাঁকে ফেলে ওরাও আসতে চায়নি। কিন্তু শাহাদাত সাহেব একরকম ঠেলেঠুলেই ওদের পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার জন্য বাকিদের প্ল্যান-প্রোগ্রাম বানচাল করতে চাননি।

উইলো ক্রিকে যখন পৌঁছুল ওরা, তখন আঁধার নামতে শুরু করেছে। পশ্চিম আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে লাল আভা। শহরের ধুলোমলিন পথের একপাশে গাড়ি থামালেন ডা. পারকার।

এহ হে, রাত হয়ে গেল! জিমি বলল। বেলা থাকতেই পৌঁছুব ভেবেছিলাম। ক্যাম্প খাঁটিয়ে ছিপ ফেলা যেত।

রাস্তা এত খারাপ হবে, বুঝতে পারিনি, ভা, পারকার বললেন। স্পিডই তুলতে পারলাম না।

থামলাম কেন, আঙ্কেল? অয়ন জিজ্ঞেস করল।

বড়শির জন্যে টোপ কিনতে হবে, ভুলে গেছ? তা ছাড়া রাতটাও বোধহয় এখানেই কাটাতে হবে। অন্ধকারে ক্যাম্পের জায়গা খোঁজা, তবু খাটানো….অনেক ঝামেলা।

কিন্তু এখানে থাকব কোথায়? জিমি প্রশ্ন করল।

কিছু একটা নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে–হোটেল বা কটেজ। ওটা কোনও ব্যাপার না, এসো।

জেনারেল স্টোরটা সহজেই পাওয়া গেল। কাউন্টারে দাঁড়ানো লোকটাকে প্রয়োজনের কথা জানাতেই বলল, এই রাতের বেলা টোপ দিয়ে করবেন কী?

এখুনি লাগবে না অবশ্য, ডা. পারকার বললেন। সকালে হলেই চলবে।

ঠিক আছে, ব্যবস্থা করে রাখব। সকালে নিয়ে যাবেন। আপনার নামটা…

গ্যারি পারকার।

আমি জস ওয়াইন, এই প্রথম হাসল লোকটা। ভাল কথা, রাতে থাকছেন কোথায়?

ক্যাম্পিঙের সরঞ্জাম সবই ছিল, কিন্তু এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ওগুলো খাটানো অনেক সমস্যা। এখানে হোটেল জাতীয় কিছু নেই?

কীসের হোটেল? ডেভের সরাইখানা আছে। এবার কানের কাছে মুখ এনে জস ফিসফিসাল, কিন্তু ওখানে না গেলেই ভাল করবেন। জায়গাটায় ভূতের আসর আছে।

কথাটা শুনে কনুই দিয়ে জিমিকে একটা গুঁতো দিল অয়ন।

ভূতের আসর! ডা. পারকার অবাক হলেন। ভূত বলে কিছু আছে নাকি?

এতকিছু তো জানি না। তবে ওখানে ভৌতিক ব্যাপার-স্যাপার ঘটছে। লোকজন তো ভয়ে ওখানে পা মাড়ানোই ছেড়ে দিচ্ছে। আপনাদের যদি থাকার খুব বেশি সমস্যা হয় তো, আমার বাড়িতে একটা কামরা খালি আছে। রাতটা কাটিয়ে দিতে পারেন। ভাড়া-টাড়া লাগবে না।

যত্তোসব আজগুবি কথাবার্তা… বিরক্ত হলেন ভা, পারকার, তবে কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই হুড়মুড় করে দরজা ঠেলে স্টোরের ভেতরে ঢুকল এক তরুণ। হাপাচ্ছে।

আরে, জনি যে! জস ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলল। কী হয়েছে?

আর বলবেন না, তরুণ বলল। সরাইখানায় গিয়েছিলাম।

আবার?

কী করব বলুন? দুধ ডেলিভারি দিতে হবে না?

তারপর?

তারপর আর কী! আবার সেই গায়েবী আওয়াজ! বার ভর্তি লোকে শুনেছে। যে যেভাবে পেরেছে, পড়িমরি করে ছুটেছে। মিসেস পিনম্যান তো ভয়ে অজ্ঞানই হয়ে গেলেন।

সর্বনাশ!

ভদ্রমহিলার অবস্থা বিশেষ ভাল না। এদিকে ডাক্তার স্টুয়ার্ড তো শহরে নেই। কী যে হবে!।

কথাটা শুনেই ডা. পারকার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন, আমি একজন ডাক্তার। সাহায্য করতে পারব। রোগী কোথায়?

সরাইখানায়, ভুরু কুঁচকে বলল জনি। কিন্তু জেনেশুনে ভূতের আচ্ছাখানায় যাওয়াটা কি উচিত হবে?

ননসেন্স! তুমি আমাকে নিয়ে যাবে কি না বলো!

কী যেন ভাবল জনি। তারপর বলল, চলুন। আমি কিন্তু ভেতরে ঢুকব না। দূর থেকে দেখিয়ে দিয়েই ভাগব।

ঠিক আছে, চলো।

ভেতরে ভেতরে কৌতূহলে মরে যাচ্ছিল অয়ন আর জিমি। এমন সুযোগ আসায় খুশিতে লাফিয়ে ওঠার অবস্থা। ডা. পারকারের সঙ্গে ছুটল

দুই

সরাইখানার নাম: উইলো ক্রিক ইন। মালিক ডেভিড পিনম্যান। বাইরে একটা সাইনবোর্ড ঝোলানো আছে। বোঝা গেল, সরাইয়ের মালিকের স্ত্রী-ই অজ্ঞান হয়ে গেছে।

দরজায় টোকা দিতেই বয়স্ক একজন লোক উঁকি দিল। ডা. পারকার বললেন, আমি একজন ডাক্তার। শুনলাম, কে নাকি এখানে অসুস্থ হয়ে পড়েছে,..

আসুন, আসুন, তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়াল নোকটা। আমি ডেভিড পিনম্যান, এই সরাইখানার মালিক। আমার স্ত্রী… হঠাৎ ভয় পেয়ে…

ঘটনাটা আমি শুনেছি, ডা. পারকার বাধা দিলেন। চলুন রোগীকে দেখা যাক। কোথায় তিনি?

বিছানায়, এখনও জ্ঞান ফেরেনি।

ভেতরে ঢুকে পিনম্যানের সঙ্গে রোগীর ঘরে চলে গেলেন ডা. পারকার। অয়ন আর জিমি দাঁড়িয়ে রইল হলঘরে।

ঘরটা তেমন বড় নয়। অল্প কয়েকটা চেয়ার টেবিল আছে। তবে সেগুলো এই মুহূর্তে খালি। আর আছে একটা বার। কাউন্টারটা মাঝারি আকৃতির। দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দেয়া ব্ল্যাকে সারি সারি মদের বোতল। দেখলে অনেকটা ওয়েস্টার্ন ছবির কথা মনে পড়ে যায়। গোটা কামরায় একজন মাত্র মানুষকে দেখা গেল। কাউন্টারের পেছনে ফ্যাকাসে মুখে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। সেদিকেই এগিয়ে গেল ওরা

হ্যালো! একটু হেসে বলল অয়ন।

হ্যালো! প্রত্যুত্তর দিল মেয়েটাও, কিন্তু গলা কাঁপছে।

আমি অয়ন হোসেন, ও জিমি পারকার। ওই যে ডাক্তার এলেন-জিমির বাবা, গ্যারি পারকার।

নতুন এসেছ বুঝি? বেড়াতে?

উঁহুঁ, মাছ ধরতে। এসেই তো শুনলাম কী সব নাকি ঘটছে এখানে। ব্যাপারটা কী?

প্লিজ, ওসব আলোচনা কোরো না। এমনিতেই ভয় লাগছে। মেয়েটা দারুণ নার্ভাস। তোমরা কিছু খাবে?

পেটে হাত বোলাল জিমি, ছুঁচোর নাচানাচি শুরু হয়ে গেছে। বলল, স্যাণ্ডউইচ হবে? দারুণ খিদে পেয়েছে।

নিশ্চয়ই। দুমিনিট লাগবে।

দুমিনিট নয়, পাঁচ মিনিট লাগল মেয়েটার ফিরতে। ততক্ষণে অয়নরা একটা টেবিল দখল করল। এর মধ্যে তিনজন লোক হলঘরে এল ভেতর থেকে। মেয়েটার খোঁজ করল-রাতের খাবারের জন্যে। এই সুযোগে জানা গেল, মেয়েটার নাম লিসা। একটু অবাকই হলো অয়ন। ওর ধারণা ছিল ভূতের ভয়ে সবাই সরাইখানা ছেড়ে পালিয়েছে। এখন মনে হচ্ছে, সেটা ভুল।

লিসা ফিরতেই অয়ন বলল, একটু বসুন না, কথা বলি।

সরি, কাজ আছে। বোর্ডারদের খাবার দিতে হবে। তারপরই আমি বিদায় হচ্ছি। আর এ-মুখো হব না।

যাবেন কোথায়?

আপাতত আমার খালার বাসায়। শহরের উত্তরে থাকেন তিনি। এরপর কী করব, জানি না। অন্তত এখানে আর চাকরি করব না।

কথা শেষ করে লিসা কিচেনে চলে গেল।

অয়নের কপালে কুটি। স্যাণ্ডউইচ ছুঁয়েও দেখল না। ব্যাপারটা লক্ষ করে জিমি বলল, কী ভাবছিস?

এখানে একটা গণ্ডগোল আছে।

গণ্ডগোল! আছে তো ভূত!

ধ্যাৎ, ভূত-ফুত সব বোগাস! ঝামেলা অন্য কোথাও।

শিয়োর হচ্ছিস কীভাবে? শেক্সপিয়র কী বলেছেন, জানিস তো? দেয়ার আর মেনি থিংস ইন হেভেন অ্যাণ্ড আর্থ…

ফাজলামি করিস না, জিমি। বি সিরিয়াস। ভূত বলে কিছু নেই। এখানকার গলদটা আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে।

আরেকটা রহস্য? জিমির চোখ চকচক করে উঠল।

মন্দ কী?

কিন্তু শুরু করবি কোত্থেকে? কোনও সূত্র-টুত্র তো চোখে পড়ছে না।

প্রথমে মূল ঘটনাটা জানতে হবে আমাদের। এখনও তো কিছুই জানি না। চল, কিচেনে গিয়ে লিসাকে চেপে ধরি।

রেগে গিয়ে যদি ঝাঁটাপেটা করে? জিমির কণ্ঠে সংশয়।

কপালে থাকলে খাবি ঝাটাপেটা! অয়ন হাসল।

তা হলে চল, জিমি উঠে দাঁড়াল। কপালের লিখন পরখ করে আসি।

দুবন্ধুকে কিচেনে ঢুকতে দেখে চমকে গেল লিসা।

আরে! তোমরা এখানে কেন? কী চাই?

সরি, ক্ষমা চাইল অয়ন। আপনার সময় নেই দেখে ভাবলাম এখানে এসেই কথা বলি।

তোমাদের মতলবটা কী বলল তো?

আমরা আসলে এখানকার ভূতটা সম্পর্কে জানতে চাইছিলাম।

আবার ওই প্রসঙ্গ? প্লিজ, বললাম তো এ নিয়ে কথা বলতে চাই না। এক্ষুণি হয়তো আবার গায়েবী আওয়াজ শোনা যাবে।

তাই নাকি! আওয়াজটা কী রকম?

হুবহু মি. রেকটারের গলার মত।

মি, রেকটারটা আবার কে? জিমি জিজ্ঞেস করল।

প্রসপেক্টর। এখানেই থাকত, নিচতলার কোণের কামরাটায়।

তার গলা শুনে ভয় পাবার কী আছে?

কারণ ভদ্রলোক মারা গেছেন… দুমাস আগে… ওই কামরাতেই।

কীভাবে মারা গেলেন?

অসুস্থতায়। সারাজীবন শরীরের ওপর তোক অত্যাচার করেননি! হাজারটা রোগ ছিল।

ভূতের উপদ্রব কি তখন থেকেই?

না, সেটা শুরু হয়েছে গত এক সপ্তাহ ধরে।

ইন্টারেস্টিং! অয়ন মন্তব্য করল।

সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় হয়ে গেল লিসার। বলল, তোমাদের চালাকি আমি ধরে ফেলেছি, ছেলেরা। কৌশলে আমার পেট থেকে কথা বের করতে চাইছ। এই আমি মুখে কুলুপ আঁটলাম। আর কিছু বলব না। এখন যাও!

প্লিজ, প্লিজ, হাত জোড় করে অনুনয় করতে লাগল অয়ন, এমন করবেন না। পুরো গল্পটা শেষ করুন, প্লিজ। নাকি পা ধরব?

খবরদার, আমাকে ছোঁবে না!

তা হলে বলুন না!

ভারি নাছোড়বান্দা দেখছি! দারুণ জ্বালাতে পারো।

জ্বালানোর আর দেখেছেন কী? একগাল হাসল অয়ন। স্কুলে আমাদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে এক স্যর তো টাকমাথাই হয়ে গেলেন। এখন ওনাকে সবাই ডাকে-টেকো স্যর!

হেসে ফেলল লিসা। বলল, থাক, আর চাপা মারতে হবে না। আসল কথা বলো-ভূত নিয়ে তোমাদের এত আগ্রহ কেন?

বিশ্বাসযোগ্য একটা গল্প সাজাতে এক সেকেন্ড সময় নিল অয়ন। বলল, সামনে আমাদের একটা প্রতিযোগিতা আছে। স্কুলের সবাই যে যার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা লিখে জমা দেবে। যে ফাস্ট হবে, তার জন্যে একগাদা পুরস্কার আছে। ভেবে দেখুন, এরকম একটা গা ছমছমে অভিজ্ঞতা যদি জমা দিতে পারি, ফাস্ট হওয়া ঠেকায় কে? তাই বলছিলাম, যদি একটু সাহায্য করেন…

মনে হলো গল্পটা লিসা বিশ্বাস করেছে। একটু ভেবে সে বলল, ঠিক আছে, করব সাহায্য। বলো, কী জানতে চাও?

এক সপ্তাহ আগে ঠিক কী ঘটেছিল?

কী আবার ঘটবে? সন্ধ্যাবেলা বার ভর্তি লোকজন আড্ডা জমাচ্ছে হঠাৎ একটা পেঁচা ডেকে উঠল…

পেঁচা! ঘরের ভেতর?

হ্যাঁ। তারপর শুরু হলো কাশির শব্দ, ঠিক যেভাবে বুড়ো রেকটার কাশত। তারপর তার গলা শোনা গেল।

কী বলল সে?

পালাও, সবাই পালাও! মহাবিপদ নেমে আসছে, মহাবিপদ! এরপর কী যে হুড়োহুড়ি শুরু হলো, আমার আর হুঁশ ছিল না।

কিন্তু ভূতটা হঠাৎ এ-কথা বলল কেন? বিশেষ কোনও ঘটনা কি ঘটেছিল তার আগে?

নাহ, আমার তো মনে পড়ে না।

হুঁ, একটু চিন্তিত হলো অয়ন।

কবার ঘটেছে এমন?

চার… না, আজকেরটা নিয়ে পাঁচবার। প্রতিবারই হলঘরে বেশ কয়েকজন করে লোক ছিল।

লোক না থাকলে কিছু ঘটে না?

না। মানে, এখন পর্যন্ত ঘটেনি।

তারমানে আওয়াজগুলো হচ্ছে শুধুমাত্র ভরা মজলিশে, আনমনে মাথা ঝাঁকাল অয়ন। ইন্টারেস্টিং!

মানে? লিসা ভুরু কোঁচকাল।

না, কিছু না। এবার বলুন, ভুতুড়ে কাণ্ডের ফলাফল কী দাঁড়িয়েছে?

সেটাও বলে দিতে হবে? সরাইখানার নাম ডুবেছে। বোর্ডাররা সব ভেগেছে। লোকজন আসা বন্ধ হয়েছে। আজ কী ভেবে কয়েকজন এসেছিল, কাল থেকে আর কেউই আসবে না।

বোর্ডার নেই বলছেন কেন? জিজ্ঞেস করল জিমি। আমরা যে তিনজনকে দেখলাম!

এরাই শুধু আছে। অন্যদের তুলনায় সাহস একটু বেশিই বোধহয়। এখনও পালায়নি। তবে শীঘ্রি পালাৰে, কোনও সন্দেহ নেই।

কবে থেকে এখানে আছে ওরা?

এক সপ্তাহের কিছু বেশি। প্রথম ঘটনার দুদিন আগে এসেছে এরা।

একই সঙ্গে?

নাহ। একজন সকালে, বাকি দুজন সন্ধ্যায়–আলাদা আলাদা।

বোর্ডারদের সম্পর্কে বলুন।

বয়স্ক একজন আছেন, তিনি হলেন প্রফেসর হার্ডিন। জিয়োলজিস্ট। এখানকার বনভূমির ওপর গবেষণা করছেন। আত্মভোলা মানুষ, কোনোকিছুতেই তার মনোযোগ নেই। বাকি দুজন কাঠ ব্যবসায়ী। একজন ড্যান কলসন, অন্যজন সেথ বেকার। তিনজনেই প্রথমবারের মত এসেছেন উইলো ক্রিকে।

ভূত সম্পর্কে এবার বলুন। মানে মি. রেকটার সম্পর্কে।

বলার মত তেমন কিছু নেই। শান্তশিষ্ট মানুষ ছিলেন। কারও সঙ্গে ঝামেলায় জড়াতে দেখিনি কোনোদিন। সারাজীবন উইলো ক্রিকের আশপাশ চষে বেড়িয়েছেন সোনার খোঁজে। কিন্তু খনি-টনি পাননি। সরাইখানার কামরাটা ভাড়া করেছিলেন জিনিসপত্র রাখার জন্য। নিজে বেশিরভাগ সময় বাইরেই থাকতেন।

কামরাটার এখন কী অবস্থা?

তালাবদ্ধ। মি. রেকটারের জিনিসপত্র এখনও ভেতরে পড়ে আছে। সেদিনও মি. পিনম্যান ভাবছিলেন ওগুলো বিক্রি করে দেবেন।

তাতেই ভূতটা খ্যাপেনি তো? জিমি আচমকা বলল।

কে জানে! ঠোঁট ওল্টাল লিসা। কিন্তু সেটাই যদি কারণ হয় তো জিনিসপত্রের কথা বলে না কেন? কেন সবাইকে পালাতে বলে?

এটাই জানতে হবে, বিড়বিড় করল অয়ন। তারপর বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, লিসা। অনেক তথ্য দিলেন। আমরা এবার যাই।

কিচেন থেকে বেরিয়ে এল দুজনে। দেখল, হলঘরে দাঁড়িয়ে পিনম্যানের সঙ্গে কথা বলছেন ডা. পারকার। ওদের দেখে বললেন, এই তো অয়ন-জিমি। ছেলেরা, এক দৌড়ে গাড়ি থেকে আমার ওষুধের ব্যাগটা নিয়ে এসো দেখি।

কেমন দেখলে রোগী? জিমি জিজ্ঞেস করল।

তেমন সিরিয়াস কিছু না। হার্ট একটু দুর্বল। তাই ভয়ে কাহিল হয়ে গেছে।

সরাইখানা থেকে দুজনে বেরিয়ে এল। হাঁটতে হাঁটতে অয়ন বলল, কেউ একজন সরাইখানাটা খালি করতে চাইছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন?

ভুতুড়ে আওয়াজটাই বা হচ্ছে কীভাবে? জিমি জিজ্ঞেস করল।

ওটা কোনও ব্যাপার না। লুকানো টেপ রেকর্ডার বা স্পিকার হয়তো ব্যবহার করা হচ্ছে।

হুম। তা হলে আমাদের পরবর্তী চালটা কী হবে?

বুঝতে পারছি না। রহস্যজনক তিন বোর্ডারের ঘর তল্লাশি করতে পারলে ভাল হতো। সেইসঙ্গে রেকটারের ঘরটাও। আমার ধারণা রেকটারের মৃত্যুর সঙ্গে এই রহস্যটার কোনও যোগসূত্র আছে।

কিন্তু ঘর তল্লাশি করবি কীভাবে?

দেখি, উপায় একটা বেরিয়ে যাবে।

ব্যাগ নিয়ে ফিরে এসে ওরা দেখল, হলঘরে বোর্ডাররা খেতে বসেছে। ভা, পারকারকে ব্যাগ দিতেই তিনি রোগীর ঘরে চলে গেলেন। একটানে জিমিকে এককোণে নিয়ে এল অয়ন। ফিসফিস করে বলল,

এই-ই সুযোগ! সবাই খেতে বসেছে। ওদের রুমগুলো দেখে আসি।

মাথা খারাপ! ধরা পড়ে যাবি তো!

পড়ব না। কারণ তুই থাকছিস এখানে। কারও খাওয়া যদি আগেভাগেই শেষ হয়ে যায়, তা হলে সঙ্কেত দিবি। পনেরো মিনিটের মধ্যেই ফিরব আমি।

কী সঙ্কেত দেব?

দুএকটা কাঁচের গ্লাস ভাঙতে পারবি না?

নিশ্চয়ই। কিন্তু তুই ঢুকবি কীভাবে? সবাই নিশ্চয়ই দরজা বন্ধ করেই খেতে এসেছে।

জানালা খোলা পাব নির্ঘাত। তুই থাক এখানে। আমি গেলাম।

শিস দিতে দিতে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল অয়ন। ওর অনুমান ভুল নয়। সবগুলো রুমেরই জানালা খোলা পেল। দ্রুত তল্লাশি চালাল ও।

প্রফেসরের রুমটা এক নজরেই চিনতে পারল। দারুণ অগোছালো। বইপত্র, কাপড়চোপড় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। অস্বাভাবিক কোনও কিছু পেল না।

বাকি দুটো রুমের কোনটা কার, বোঝা গেল না। তবে এরা ভারি সচেতন। ব্যাগ, সুটকেসে তালা। কোনোকিছু বাইরেও পড়ে নেই। একটা ঘরের টেবিলের ড্রয়ারে এক বাণ্ডিল তাস পেল অয়ন। কেমন জানি সেগুলো অন্যরকম। অন্য ঘরের বিছানার তলায় হাত দিয়ে ও রীতিমত থমকে গেল।

একটা পিস্তল।

বরাদ্দ পনেরো মিনিট পেরিয়ে যাচ্ছে। আঁতিপাঁতি করে আরও কিছু খোঁজার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সেটা আর সম্ভব হলো না। হলঘরে ফিরে গেল ও।

বোর্ডারদের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। ডা. পারকারও রোগী দেখে ফিরে এসেছেন। জিমি জিজ্ঞেস করল, কিছু পেলি?

জবাব না দিয়ে মি. পিনম্যানের দিকে এগিয়ে গেল অয়ন। বলল, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলার ছিল, স্যর।

ঠিক তক্ষুণি একটা পেঁচার ডাক শোনা গেল। সরাইয়ের মালিকের চেহারায় আতঙ্ক ফুটল। এবার কাশির শব্দ শুরু হলো। ভয়ানক কাশি। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে, কাশতে কাশতে কারও জান বেরিয়ে যাচ্ছে। তীক্ষ্ণ চোখে সবার ওপর নজর বোলাল অয়ন। সবাই স্থির হয়ে গেছে।

পালাও! পালাও! একজন বৃদ্ধের কাঁপা কাঁপা গলা শোনা গেল। বাঁচতে চাইলে পালাও এখনি। বিপদ নেমে আসছে। মহাবিপদ!

আরেকবার পেঁচার ডাক শোনা গেল। তারপর সব চুপচাপ। অনেকক্ষণ কেউ কথা বলল না। শেষে নীরবতা ভাঙল অয়ন।

সত্যিই ভূত আছে এখানে। আমরা কেউই নিরাপদ নই। মি. পিনম্যান, এরপরও সরাইয়ে লোকজন আসতে দেয়া বা থাকতে দেয়া ঠিক হচ্ছে না আপনার। এক্ষুণি সবাইকে বের করে তালা ঝুলিয়ে দিন।

ছেলেটা ঠিকই বলেছে, প্রফেসর হাডিন বললেন। ভাল-মন্দ কিছু ঘটে গেলে শেষে তুমিই ফাসবে, ডেভ।

পিনম্যানকে দেখে মনে হলো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বলল, সরাইখানা বন্ধ করে দিলে আপনারা যাবেন কোথায়?

আমার গাড়ি আছে, বলল এক বোর্ডার, পরে জানা গেল-তার নাম ড্যান কলসন। আমি এক্ষুণি ভাগছি শহর ছেড়ে। ভূতের হাতে জান খোয়াবার কোনও শখ আমার নেই।

শহরের লোকের সঙ্গে গত কদিনে পরিচয় হয়ে গেছে, বলল তৃতীয়জন। অর্থাৎ সেথ বেকার। থাকার একটা ব্যবস্থা করতে পারব।

 আমিও, প্রফেসর বললেন।

আর আমরা তো গাড়িতেই রাত কাটিয়ে দিতে পারি, অয়ন বলল। তা হলে দেরি কেন? সরাইখানা খালি করে দিন, মি. পিনম্যান। এক্ষুণি!

সবাই তাড়াহুড়ো করে হলঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কে কোন রুমে গেল, লক্ষ রাখল অয়ন। শেষে বুঝল, পিস্তলের মালিক সেথ বেকার।

আধঘণ্টার মধ্যে সরাইখানা খালি হয়ে গেল। এই ফাঁকে বুড়ো রেকটারের ঘরটা দেখতে গেল অয়ন আর জিমি। কিন্তু লাভ হলো না। দরজায় মান্ধাতা আমলের একটা পুরনো তালা ঝুলছে। কবাটের চারপাশে কিছু আঁচড়ের দাগ দেখা গেল, সম্প্রতি দাগগুলো পড়েছে। এই একটা কামরাতেই শুধু জানালা নেই। ভেতরটা দেখা গেল না। হতাশ হলো ওরা।

বোর্ডাররা চলে যাবার পর সরাইখানা বন্ধ করে দিল পিনম্যান। সদর দরজায় তালা ঝুলিয়ে অসুস্থ স্ত্রী সহ এক প্রতিবেশীর বাড়িতে চলে গেল।

গাড়িটা সরাইখানার কাছাকাছি কোথাও পার্ক করুন, আঙ্কেল, গাড়িতে উঠে অয়ন বলল। এমন কোথাও, যাতে ওখান থেকে দেখা না যায়।

হঠাৎ হেসে উঠলেন ডা. পারকার। তোমরা তা হলে এবার ভূতের পেছনে লেগেছ?

নিঃশব্দে হাসল অয়ন।

তাই তো বলি, স্টোরকিপার তার বাড়িতে থাকার প্রস্তাব দেবার পরও অয়ন হোসেন গাড়িতে রাত কাটাতে চায় কেন?

আপনার কোনও অসুবিধে হবে না তো?

উঁহুঁ, তোমরা শুধু বিপদে না পড়লেই হয়। সরাইখানা থেকে সবাইকে বের করে দিলে কেন? তুমি অমনভাবে না বললে তো রাতটা ওখানেই কাটানো যেত।

অয়ন আসলে ভূতটার নিয়মে খেলতে চাইছে, জিমি বলল।

ভূতের ইচ্ছেমত জায়গাটা খালি করে দিল ও। এবার দেখবে, কী করে ভূতটা। ঠিক বলিনি?

এগজ্যাক্টলি! অয়নের মুখে একচিলতে হাসি খেলা করে গেল।

তিন

সারারাত পালা করে পাহারা দিল অয়ন আর জিমি। মাঝে মাঝে গাড়ি থেকে নেমে চক্করও দিল। কিন্তু কোনও লাভ হলো না। রাত দুটোর দিকে জিমির অবশ্য একবার মনে হলো সরাইখানার পেছনের ঝোপে কী যেন নড়াচড়া করছে। কিন্তু ওখানে গিয়ে কিছু দেখতে পেল না।

সকাল হলো। কাছের একটা বাড়ি থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে শুকনো খাবার দিয়ে নাশতা সারল ওরা।

আজ সারাদিন মাছ ধরব, ডা. পারকার বললেন। তোমরা তৈরি?

ইতস্তত করল অয়ন আর জিমি। জবাব দিল না।

বুঝেছি, ডা. পারকার মুচকি হাসলেন। এখনও মাথা থেকে ভূতের চিন্তা নামেনি। মাছ ধরার প্রোগ্রাম তা হলে বাদ দিতে হচ্ছে।

তুমি রাগ করছ না তো! জিমি বলল।

নাহ, আমারও মজাই লাগছে। দেখি তোমরা ভূতটাকে ধরতে পারো কি না। তবে যা করার তাড়াতাড়ি করবে। আজ সন্ধ্যায়ই আমরা চলে যাব। কাল আমার অফিস আছে, তোমাদের স্কুল খোলা।

সময় বড় কম! জিমি মিনমিন করল।

ভুল বললি, অয়ন প্রতিবাদ করল। বেশ কিছু সূত্র পেয়েছি। এখন শুধু সেগুলো পরীক্ষা করা বাকি।

তাই নাকি! কই, আমাকে তো বলিসনি।

সময় হয়নি।

আমি মিসেস পিনম্যানকে দেখতে যাচ্ছি। তোমরা কী করবে? ডা. পারকার বললেন।

এখানেই থাকব, আঙ্কেল। সরাইখানার ওপর নজর রাখা দরকার।

বেশ, আমি যাচ্ছি। তোমরা সাবধানে থেকো।

ডা. পারকার চলে গেলেন।

ব্যাপারটা কী, অয়ন? জিমি বলল। কী সূত্র পেয়েছিস তুই?

পরে বলব, অয়ন গাড়ি থেকে নামল। আমাকে এখন জানতে হবে, নিরীহ একজন কাঠ ব্যবসায়ী পিস্তল দিয়ে কী করে?

অয়নের দৃষ্টি অনুসরণ করল জিমি। সেথ বেকার সরাইখানার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

ওকে সন্দেহ করছিস?

লোকটার কাছে পিস্তল আছে।

নিরাপত্তার জন্যে রাখতে পারে।

আসলেই কি তাই? জানা দরকার।

আরে! হঠাৎ জিমি বলল। মিস্টার পিনম্যান এদিকেই আসছেন। সঙ্গে যেন কে?

চাপা দাড়ি-গোঁফঅলা এক লোকসহ সরাইয়ের মালিক সোজা সরাইখানার দরজায় চলে গেল। লোকটার হাতে সুটকেস, সম্ভবত নতুন এসেছে। পিনম্যানকে তালা খুলতে দেখা গেল।

আজব ব্যাপার! জিমি বিস্মিত হলো। লোকটা কি আবার ভাড়াটে ঢোকাচ্ছে নাকি?

জানা দরকার, বলে দ্রুত চিন্তা করল অয়ন। জিমি, তুই বেকারকে ফলো কর। চোখে পড়িস না, সাবধান! কোথায় যায়, কী করে-লক্ষ রাখবি। আমি এদিকটা দেখছি।

ওকে!

সেথ বেকার যেদিকে গেছে, সেদিকে চলে গেল জিমি। রহস্যজনক আগন্তুকসহ পিনম্যান ততক্ষণে সরাইখানায় ঢুকে পড়েছে। অয়নও সেদিকে গেল।

আগন্তুককে হলঘরটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছিল পিনম্যান। এমন সময় ভেতরে ঢুকল ও।

আরে! তুমি এখানে! পিনম্যানের কণ্ঠে স্পষ্ট বিস্ময়।

দরজা খোলা দেখে কৌতূহল হলো, অয়ন বলল। আগন্তুকের সুটকেসটা মেঝের ওপর, সেটার দিকে একবার তাকাল। ওনাকে তত চিনলাম না।

ইনি ড. ল্যাণ্ডন, আমেরিকান সাইকিক রিসার্চ সেন্টার থেকে এসেছেন, পিনম্যান পরিচয় করিয়ে দিল। ভূতের ব্যাপারে তদন্ত করতে।

আমি অয়ন হোসেন, হাত মেলাল অয়ন। আপনি খবর পেলেন কীভাবে, ডক্টর?

আমাদের অনেক সোর্স থাকে, উ, ল্যাণ্ডন হাসলেন। কোথাও অস্বাভাবিক কিছু ঘটলে মুহূর্তেই ছুটে যেতে হয় কিনা!

ইন্টারেস্টিং! আপনি এসেছেন কখন?

সকালেই। এনিওয়ে, রেকটারের ঘরটা এবার দেখতে হয়, মি. পিনম্যান।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! আসুন। পিনম্যান বলল।

আমি সঙ্গে থাকতে পারি? অয়ন অনুরোধ করল।

থাকবে? একটু ইতস্তত করলেন ড. ল্যাণ্ডন।বেশ!

তালা খুলতে বেশ কিছুটা সময় লাগল পিনম্যানের, জং ধরে গেছে। দরজা খোলার পর ধুলোবালির একটা গন্ধ এসে লাগল নাকে। একটু অপেক্ষা করে ওরা ভেতরে ঢুকল। সুইচ টিপে বাতি জ্বালল পিনম্যান।

ঘরটা ছোট একটা কাঠের বিছানা আর আলমারি রয়েছে ভেতরে। একপাশে স্তূপ করা আছে প্রসপেক্টিঙের জিনিসপত্র-গাঁইতি, কোদাল, চালুনি, ইত্যাদি।

এটা আসলে স্টোররুম, সরাইয়ের মালিক বলল।.রেকটার তার জিনিসপত্র রাখার জন্য ঘরটা নিয়েছিল। নিজে কখনও থাকত না।

ইন্টারেস্টিং! ঘুরে ফিরে মন্তব্য করলেন ড. ল্যাণ্ডন। মনে হচ্ছে এ ঘরটার মাঝেই রহস্য লুকিয়ে আছে। অশুভ একটা কিছুর উপস্থিতিও যেন টের পাচ্ছি।

বলেন কী!

হ্যাঁ। যদি কিছু মনে না করেন, আমি এখানে সম্পূর্ণ একা থাকতে চাই, মি. পিনম্যান। কেউ যেন বিরক্ত না করে।

একা! কেন?

আত্মাটার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করব। সঙ্গে কেউ থাকলে সেটা সম্ভব হবে না। বুঝতেই পারছেন।

কিন্তু বিপদ হতে পারে।

এসব কাজে আমার অভিজ্ঞতা আছে। চিন্তা করবেন না।

তা হলে আমরা চলে যাব?

খুব ভাল হতো।

বেশ, কাধ ঝাঁকাল অয়ন। চলুন, মি. পিনম্যান।

কেউ কোথাও যাচ্ছে না! হঠাৎ দরজা থেকে ভেসে এল একটা পরিচিত কণ্ঠ।

পাঁই করে ঘুরল অয়ন। উদ্যত পিস্তল হাতে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সেথ বেকার। বলল, যথেষ্ট হয়েছে! ওই ভাড়টাকে আমি আর কোনও সুযোগ দিছি না। আমার জিনিস আমিই খুঁজে নেব।

কার কথা বলছেন? পিনম্যান হতভম্ব।

ড. ল্যাণ্ডন ওরফে ড্যান সনের কথা, অয়ন শীতল গলায় বলল।

কী! পিনম্যান বিস্ময় ঠেকাতে পারল না।

বিচ্ছু ছেলে, সেথ বেকার হাসল। তুমিও ওকে চিনতে পেরেছ তা হলে?

সহজ ব্যাপার, অয়ন বলল। ড্যান কলসনের সুটকেস বয়ে বেড়ানো ড. ল্যাণ্ডনের উচিত হয়নি।

একটানে নকল গোঁফ-দাড়ি খুলে ফেলল কলসন। তার চেহারা হিংস্র দেখাচ্ছে। গর্জন করে বলল, আমাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না! সমস্ত সোনা আমার!

মুঠো করা হাত থেকে কিছু একটা ছুঁড়ে দিল সে মেঝেতে। দুম! করে একটা শব্দ হতেই ঘর সাদা ধোয়ায় ভরে গেল। ভয়ানক ধাক্কা খেয়ে অয়ন আর মি. পিনম্যান দেয়ালে আছড়ে পড়ল। পেটে একটা বেমক্কা পুঁতো খেয়ে ধরাশায়ী হলো সেখ বেকার, উড়ে গিয়ে পড়ল করিডরে। তাকে টপকে ছুটল কলসন। হলঘরে নিজের সুটকেসের কাছে পৌঁছুতে চাইছে। কিন্তু করিডর পেরোতেই দেয়ালের আড়াল থেকে কে জানি এক পা বাড়িয়ে তাকে ল্যাং মারল। হুমড়ি খেয়ে হলঘরের মেঝেতে পড়ে গেল সে। সামলে ওঠার আগেই আক্রমণকারী চোখে মুখে কী যেন ছিটিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চোখে জ্বালা-পোেড়া শুরু হলো, সেইসঙ্গে হাঁচি! মরিচের গুড়ো ঢেলে দিয়েছে শয়তানটা! মুহূর্তেই কলসন ঘায়েল হলো।

মুচকি হেসে বয়ামের মুখ আটকাল জিমি পারকার। নাক-মুখ থেকে রুমাল সরিয়ে চেঁচিয়ে বলল, অয়ন, তোরা ঠিক আছিস?

মেঝে থেকে পিস্তলটা কুড়িয়ে নিয়ে বেকারের দিকে তাক করল অয়ন। বলল, নড়াচড়া না করলেই ভাল করবেন।

তারপর চেঁচাল, আমরা ঠিক আছি, জিমি। একেবারে ঠিক!

চার

ড্যান কলসন আর সেথ বেকারকে শেরিফের হাতে তুলে দেয়া হলো। কয়েক ঘণ্টার ভেতরই রেকটারের ঘরের মেঝের তক্তা সরিয়ে বেশ কিছুটা কাঁচা সোনা একটা প্যাকেটের ভেতর পাওয়া গেল। সারাজীবন চেষ্টা করেও কোনও খনি আবিষ্কার করতে পারেনি বৃদ্ধ, তবে অল্প-স্বল্প যা পেয়েছে, তা ওই প্যাকেটে জমিয়ে রেখেছিল। পরিমাণে তা অবশ্য খুব কমও নয়।

সরাইখানা আবার খুলে দেয়া হলো। হলঘরে বসে কৌতূহলী বাসিন্দাদের কাছে সব খুলে বলল অয়ন আর জিমি।

ভূত বলে কিছু নেই, অয়ন শুরু করল। এ কারণে প্রথমেই আমাদের ধারণা হলো, কেউ একজন সরাইখানাটা খালি করতে চাইছে। বুড়ো রেকটারকে এর মধ্যে টেনে আনায় বুঝে গেলাম, ওই তালামারা ঘরেই লুকিয়ে আছে সমস্ত রহস্য। তার প্রমাণও পাওয়া গেল। রেকটারের ঘরের তালা কেউ ভাঙার চেষ্টা করেছে, কাটের পাশের আঁচড়ই তার প্রমাণ। কিন্তু ওই তালা ভাঙতে গেলে যে-রকম শব্দ হবে, তাতে ধরা পড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই আমদানি করা হলো রেকটারের ভূত, সেইসঙ্গে একজন ভূত বিশেষজ্ঞ-যে কিনা বিনা বাধায় ওই ঘরে ঢুকতে পারবে, উদ্ধার করতে পারবে লুকানো সোনা-কারও মনে সন্দেহ না জাগিয়ে। এই কাজটা করল ভ্যান কলসন।

সেটা তুমি বুঝতে পেরেছিলে? ডা. পারকার প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ। ওর ঘরে আমি এক বাণ্ডিল বিশেষ রকমের তাস পেলাম, যেগুলো ম্যাজিশিয়ানেরা পাসিঙের জন্য ব্যবহার করে। আর ও যদি ম্যাজিশিয়ান হয়েই থাকে, তা হলে ভেন্ট্রিলোকুইজম বা অন্য কোনও ম্যাজিকের কৌশলের মাধ্যমে মাধ্যমে গায়েবী আওয়াজ করা কোনও সমস্যাই নয়। দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে তেমন অসুবিধে হলো না। রেকটারের সঙ্গে তার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। গলার স্বর নকল করায় সে মহা-ওস্তাদ।

কিন্তু লুকানো সোনার খবর সে পেল কীভাবে? পিনম্যান প্রশ্ন করল।

রেকটার নাকি মাঝে মাঝে উইলো ক্রিকের বাইরে যেত। এভাবেই একদিন কলসনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। কলসন জবানবন্দিতে বলেছে, বুড়োই নাকি গল্পচ্ছলে তার জমানো সোনার কথা বলেছিল। তার মৃত্যুর পর খোঁজ-খবর নিয়ে সে আন্দাজ করে নেয়, সোনা সরাইখানাতেই আছে। সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে তারপরেই সে উইলো ক্রিকে আসে। গতরাতে সরাইখানা খালি হবার পর সে চলে যায়নি। শহরের বাইরে গিয়ে নিজের গাড়িটা লুকিয়েছে। তারপর ছদ্মবেশ নিয়ে ফিরে এসেছে সকালে। ভুল করে সুটকেসটা পাল্টায়নি, অথবা হয়তো কেয়ারই করেনি; আর সেটা দেখেই আমি বুঝতে পারি, ভ্যান কলসন আর ড. ল্যাণ্ডন। একই লোক। এ ছাড়াও লক্ষ করলাম… রেকটারের ভূত, উ, ল্যাণ্ডন আর বন্ধ কামরা–সব এক সুতোয় বাধা, তাই আর কোনও সন্দেহ রইল না।

সেখ বেকারের ব্যাপারটা কী? ডা. পারকার বললেন। সে কীভাবে জড়িত হলো?

সে এখনও জবানবন্দি দেয়নি, তবে ব্যাপারটা অনুমান করে নেয়া যায়। কলসনের মত সে-ও সম্ভবত রেকটারের সঙ্গে পরিচিত হয়, আর সোনার কথা জানতে পারে। তবে বেকার মাথামোটা লোক, কলসনের মত কূটবুদ্ধি নেই। দরজার তালা ভাঙার চেষ্টা করেছিল সেই। গায়ের জার দিয়ে সে বহু আগেই সোনা উদ্ধার করত, যদি না কলসন এসে ভূতের ভয় ছড়ানো শুরু করত। জাদুকরকে সে চিনত আগে থেকেই, যদিও কলসন ওকে চিনত না। গায়েবী আওয়াজে তাই বেকার ভয় পায়নি, কলসনকে প্রতিদ্বন্দ্বী জেনেও বাধা দেয়নি। কেননা, ব্যাপারটায় সে-ও লাভবান হচ্ছিল। বেকার শুধু অপেক্ষা করছিল সরাইখানা খালি হবার জন্য। কাল রাতে সে নিশ্চয়ই রেকটারের কামরায় হানা দেবার চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু আমি আর জিমি পাহারা দিচ্ছিলাম বলে সরাইখানায় ঢুকতে পারেনি। সকালে যখন কলসন ভোল পাল্টে হাজির হলো, মরিয়া না হয়ে তার উপায় ছিল না।

ঠিক! জিমি এবার বলল। ওর পিছু নিয়ে আমি দেখলাম, ব্যাটা সরাইখানার চারপাশে ঘুরঘুর করছে। শেষে কীভাবে যেন পেছনের একটা জানালা খুলে পিস্তল হাতে ঢুকেই পড়ল। বুঝলাম, অয়নরা বিপদে আছে। তাই পেছন পেছন আমিও ঢুকে পড়লাম। অস্ত্রশস্ত্র তো আর কিছু নেই, কিচেনে গিয়ে পেলাম মরিচের গুঁড়ো। বয়ামটা হাতে নিয়ে দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম,..

ভয়াবহ জিনিসটার আইডিয়া মাথায় এল কী করে? জস ওয়াইন প্রশ্ন করল। কলসনের তত বারোটা বেজে গেছে।

ওটা অয়নের নীতি, জিমি বলল। বেকায়দা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য হাতের কাছের জিনিস ব্যবহার করা। আমি প্রয়োগ করেছি শুধু।

সবাই হাসল।

যা হোক, আন্তরিক কণ্ঠে বলল পিনম্যান। তোমাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। তোমরা না থাকলে আমার ব্যবসা লাটে উঠে যেত।

ও কিছু না, অয়ন বলল। সোনাগুলো তোবোধহয় এখন। আপনাদেরই সম্পত্তি। কী করবেন ও দিয়ে, ভেবেছেন কিছু?

না, ভাবিনি।

আমি একটা বুদ্ধি দিই?

দাও।

শহরের উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করুন। বড় পিছিয়ে আছেন আপনারা। এ যুগে ভূত-প্রেত বিশ্বাস করলে চলে?

তা-ই হবে, সবাই একমত হলো।

অনেকক্ষণ ধরেই ঘড়ি দেখছিল জিমি। এবার সুযোগ পেয়ে ডা. পারকারকে বলল, বাবা, সন্ধ্যা হতে বেশ দেরি আছে। চাইলে এখনও আমরা ফিশিঙে যেতে পারি। উইলো ক্রিকে আসাটা একেবারে ব্যর্থ হবে না।

তাই তো! ডা. পারকার বললেন। কিন্তু টোপ?

আমি নিয়ে এসেছি, একটা প্যাকেট তুলে দেখাল জস ওয়াইন।

তা হলে দেরি কেন? প্যাকেটটা ছোঁ মেরে ছুটল অয়ন আর জিমি। ডা. পারকারও ওদের অনুসরণ করলেন।

একটু পরই চলে গেল ওরা। সরাইখানার সামনে দাঁড়িয়ে বিদায় জানাল সবাই। খানিক পরেই একটা ঝরঝরে গাড়ি এসে থামল। শহরের বাইরে গিয়েছিলেন ডাক্তার স্টুয়ার্ড। সবেমাত্র ফিরেছেন। ভিড়ের সামনে এসে বোকা বোকা কণ্ঠে বললেন, এখানে এত ভিড় কীসের? আমি কি কিছু মিস করেছি?

কথাটা শুনে সবাই হাসতে শুরু করল। পিনম্যান বলল, তেমন কিছু, ডাক্তার। ছোট্ট দুটো ছেলেই ঝামেলাটা সামাল দিয়েছে।

ব্যাপারটা কী?

সে এক লম্বা গল্প। বলব আপনাকে। আসুন। দল বেঁধে সবাই সরাইখানায় ঢুকল। টেবিল আর খালি পড়ে রইল। বারেও খদ্দের ভিড় জমাল। মিসেস পিনম্যান কিচেনে ব্যস্ত হলো, লিসা ব্যস্ত হলো খাবার পরিবেশনে। আর পিনম্যান হাঁকডাক শুরু করল তার চিরাচরিত স্বভাবে।

আবার জমে উঠেছে সরাইখানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *