গাবার ব্যাপারস্যাপার – সৌরভ মুখোপাধ্যায়

গাবার ব্যাপারস্যাপার – সৌরভ মুখোপাধ্যায়

এই জানুয়ারিতে গাবা তিন বছরে পড়েছে। বাড়িসুদ্ধ লোক হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে তাকে নিয়ে।

এই পর্যন্ত পড়েই তোমরা ভাবছ, এ আর এমন কী বলার মতো কথা হল! আজকালকার দিনে কোন বাচ্চাটা আর দুষ্টু নয়! পাড়ায়, অন্য পাড়ায়, প্রতিবেশীদের ঘরে, আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে যত বাচ্চাকাচ্চা দেখা যাচ্ছে, সবাই তো ‘বিচ্ছু টু দ্য পাওয়ার ইনফিনিটিভ’। বড়োরা কেবলই বলেন, এখনকার বাচ্চারা নাকি আগের দিনের বাচ্চাদের মতো নয়। মানে, তাঁরা নিজেরা ছেলেবেলায় যেমন ছিলেন আর কী! ঠান্ডা-ঠান্ডা, শান্ত, সুবোধ, ভালোমানুষ টাইপ।

এই আমাদের পাশের বাড়ির তাতুনের বাবাই তো উঠতে-বসতে বলেন, ‘আমি তো ছেলেবেলায় একরকম হাঁদামতোই ছিলাম বলতে গেলে! ছেলেটা কী করে যে এত হাতে-পায়ে দুরন্ত হল কে জানে!’

তবে কী জানো, তাতুনের ঠাম্মা তার উত্তরে যা বলেন, সেটাও আমাদের চুপিচুপি শোনা হয়ে গিয়েছে। ‘হাঁদা ছিলে না আরও কিছু! কুকুরের ল্যাজে ক্যানেস্তারা বেঁধে দেওয়া, লোহার শিক গরম করে বন্ধুদের চেপে ধরতে বলা, ব্যালান্সের খেলা দেখাতে গিয়ে মগডাল থেকে পড়ে হাতভাঙা—এসব কার কীর্তি?’

শুনে সত্যিই আমরা মুচকি হেসেছিলাম। এসবের পাশে তাতুন তো দেবদূত! সে শুধু মাঝেমধ্যে বিকট বায়না জুড়ে বাড়ি মাথায় করে, রাগ হলে ঘরের জিনিসপত্র ভেঙে গুঁড়ো-গুঁড়ো করে রাখে, আর একে-তাকে ধুমধাড়াক্কা কিল, ঘুসি কষায়। আমরা মনে করি, এসব নিতান্তই নিরামিষ দুষ্টুমি। অন্তত তার বাবার রেকর্ডের পাশে রাখলে।

যাক সে কথা। এ গল্প তাতুনের নয়, গাবার। এতক্ষণ ধরে যেসব দুষ্টুমি-দুরন্তপনার উদাহরণ তোমরা শুনলে, গাবাও এই সমস্ত কাণ্ডকারখানা ঘটায় ভেবেছ নাকি?

উঁহু, এসবের ধার মাড়ানোর ছেলে সে নয়। তার কীর্তিকলাপ আরও সূক্ষ্ম, অনেক প্যাঁচপয়জার লুকিয়ে থাকে তার কাজকর্মের মধ্যে। সেসব বুঝে উঠতেই নাভিশ্বাস উঠে যায় সক্কলের। একমাত্র দাদুভাই ঠিকঠাক ধরতে পারেন তার গতিপ্রকৃতি।

কী করে পারেন? তারও কারণ আছে আসলে, গাবার দাদুভাই ছিলেন এক বাচ্চাদের স্কুলের হেডমাস্টারমশাই। এখন রিটায়ার করেছেন। এই সত্তর বছরেও দারুণ ফিট শরীর। রোজ সকালে জগিংয়ে বেরোন, ঘাড় সোজা করে হাঁটেন, টবের ফুলগাছগুলোর যাবতীয় পরিচর্যা নিজের হাতে করেন। এখনও চশমার প্রয়োজন হয়নি। আর মনটা এখনও তরতাজা। সারাজীবন কাটিয়েছেন খুদে পড়ুয়াদের নিয়ে, তাই বাচ্চাদের মেজাজমর্জি বুঝতে দাদুভাইয়ের জুড়ি মেলা ভার। তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের ভাবনাচিন্তার হদিশ পেতে হলে বড়োদের উচিত বাচ্চাদের লেভেলে নেমে আসা। আমাদের সব্বার মনের মধ্যে একটা শিশু বরাবর লুকিয়ে থাকে, বড়োরা যদি জোর করে সেটাকে দাবিয়ে না-রাখেন, তাহলেই ছোটোদের মন পরিষ্কার পড়তে পারা যায়।’

আর একটা কথা বলেন দাদুভাই। তিনি মনে করেন, তাঁর নাতি একটি একসেপশনাল শিশু। ওর মতো গভীর কল্পনাশক্তি এই বয়সের কোনো বাচ্চার মধ্যে তিনি দেখেননি। ভাবছ বুঝি বাড়িয়ে বলা? শোনো তবে, গাবার কাণ্ডকারখানার একটুখানি বলি তোমাদের।

জানুয়ারি মাসটায় জব্বর ঠান্ডা পড়ল না? রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে গাবা তাই একটু গরম দুধ খায়। সঙ্গে একটা-দুটো বিস্কুট। তার ঠাম্মা তাকে ছোট্ট একটা গেলাস কিনে দিয়েছেন। নিজেই দু-হাতে গেলাস ধরে ছোট্ট ছোট্ট ঢোক গিলে খেতে শিখে গিয়েছে গাবা। কিন্তু হঠাৎ কয়েকদিন ধরে অদ্ভুত একটা খেলা শুরু করে দিল সে।

রোজ সকালে উঠেই নানারকম জীবজন্তুর ভূমিকা নিয়ে নেয় সে। হরেকরকম জীবজন্তু চিনেছে সে আজকাল ছবির বই দেখে, টিভিতে অ্যানিমাল প্ল্যানেট দেখে। এর মধ্যে আবার চিড়িয়াখানাও ঘোরা হয়ে গিয়েছে। ফলে নিত্যনতুন জন্তুজানোয়ারের রোল নিয়ে বাড়ির লোককে নাকাল করে দিচ্ছে সে।

যেমন ধরো, একদিন হঠাৎ গাবার মা গ্লাসে করে দুধ নিয়ে গিয়ে দেখলেন, শরীরটাকে কুঁকড়ে কুণ্ডলি পাকিয়ে বিছানার এক কোণে শুয়ে আছে গাবা। গ্লাসটা সামনে এগিয়ে দিয়ে মা বললেন, ‘নাও গাবা, খেয়ে ফ্যালো!’

গাবা বলল, ‘কুঁই।’

মা আবাক, ‘কী হল, ধরো গ্লাসটা।’

‘কুঁই কুঁই, ক্যাঁও ক্যাঁও,’ গাবার উত্তর। গ্লাস ধরবে না কিছুতেই।

হাজার বুঝিয়েসুঝিয়ে, তর্জনগর্জন করেও কোনো ফল হয় না। সেই বিছানার কোণে কুঁইকুঁই করছে ছেলেটা। এদিকে দুধটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, এবার গরম হয়ে যাচ্ছে মায়ের মেজাজ। ‘তবে রে বেয়াড়া ছেলে, দেব নাকি দু-ঘা?’ বলে তিনি উঠতে যাচ্ছেন খাটের উপর, এমন সময় জগিং ফেরত দাদুভাইয়ের প্রবেশ।

খুব বেশি গবেষণা করতে হল না। আধমিনিট দেখে নিয়েই দাদুভাই ধরে নিলেন ব্যাপারটা। গাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ও, আজ তুমি টমি কুকুরছানা হয়েছ? গ্লাসে খাবে না, চ্যাপটা ডিশ থেকে চেটে-চেটে খাবে, তাই তো?’

গাবা ঘাড় নাড়ল। গ্লাস থেকে ডিশে ঢেলে দেওয়া হল দুধ। চুকচুক করে খেতে লাগল সে। ঠিক যেমন কুকুররা খায়। এই রকম চলছিল। কোনো দিন গাবা ম্যাওপুষি হয় তো, কোনো দিন প্যাঁকপ্যাঁকে হাঁস। আবার কোনও দিন ডিসকভারি চ্যানেলের সেই জায়ান্ট পান্ডা। কিংবা অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটে দেখা পেঙ্গুইন। একদিন দেখা গেল, একটা বড়ো প্লাস্টিকের ঝুড়ি টেনে আনছে রান্নাঘর থেকে। শরীরটা পুরো তার মধ্যে ঢুকিয়ে, শুধু মাথাটা আর হাত-পায়ের চেটো বের করে বসে আছে। সেদিন কিন্তু মা সঙ্গে-সঙ্গেই বুঝতে পেরেছিলেন। হেসেও ফেলেছিলেন ফিক করে। বলেছিলেন, ‘কচ্ছপের দুধ খাওয়া জন্মেও দেখিনি বাপু! আজ তা-ও দেখা হয়ে গেল!’

বেশিরভাগ দিনই অবশ্য মুশকিল আসানের জন্য দাদুভাইকে আসরে নামতে হয়। অন্য কেউ বুঝতেই পারেন না যে! গাবা তো আর কথা বলে বুঝিয়ে দেবে না আজ কী হয়ে বসে আছে সে। এ মা, জন্তুতে আবার মানুষের ভাষা বলে নাকি? অগত্যা সেই দাদুভাই! যেদিন গাবা হাতি সেজে বসে ছিল, কিছুতেই সমাধান হচ্ছিল না কীভাবে শুঁড় দিয়ে দুধ খাওয়ানো যায়। দাদুভাইয়ের ব্রেনেই তো চলে এল চমৎকার আইডিয়াটা। একটা লম্বা স্ট্র নিয়ে এসে মুখে গুঁজে দিলেন, চোঁ চোঁ করে দুধ ফিনিশ।

হ্যাঁ, এবার আসল ঘটনাটা বলি। মানে, যে গল্পটা বলব বলে বসেছি। সেদিন সকালে জগিং থেকে ফিরে দাদুভাই শুনতে পেলেন তুলকালাম চলছে বাড়িতে। কাজের মাসি গলা সপ্তমে তুলে চেঁচাচ্ছে, ‘ই কী কাণ্ড বাপু, সাতসকালে বিছানাটা ভিজিয়ে ফেললে গা! এই শীতের বেলা কেচে শুকোতে হাড়কালি হয়ে যাবে নে? ছেলে কিন্তু ভারি পাজি হয়ে উঠছে, যাই বলো তোমরা!’

রান্নাঘরে গাবার মায়েরও গলা বেশ উত্তপ্ত। তিনি বলছেন, ‘এই রকম দুষ্টুমি তো আগে করত না? যদি এমন করতে থাকে, তাহলে কিন্তু ঘরে বন্ধ করে রেখে দেব সারাদিন।’

দাদু চুপিচুপি ঠাম্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্যাপার কী? সকালবেলাতেই গ্লোবাল ওর্য়ামিং বেড়ে গেল কেন?’

ঠাম্মা গাবার ঘরের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘গ্লাসভর্তি দুধ বিছানায় ফেলে দিয়েছে। নিজের পায়েও ফেলেছে কিছুটা। সেই ভিজে চাদরের উপর দাঁড়িয়ে আছে, কিছুতেই নড়ছে না সেখান থেকে!’

আস্তে আস্তে গাবার ঘরের দিকে এগোলেন দাদুভাই। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলেন দৃশ্যটা। তিন বছরের ছোট্ট ছেলে হাসিমুখে সটান দাঁড়িয়ে আছে বিছানার উপর। দুটো হাত দু-দিকে ছড়ানো। একটা হাতে হলদে রঙের মাঙ্কি-ক্যাপটা ধরে রয়েছে। গ্লাসের দুধ পুরোটাই পায়ের কাছে উপুড় করে দিয়েছে মনে হচ্ছে। সপসপ করছে বিছানার চাদর-তোশক।

দাদুভাই কী বুঝলেন কে জানে! অনেকক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলেন। চোখে পলক পড়ছিল না। তারপর ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন নাতিকে, ‘উফ দাদু, এত বুদ্ধি ধরিস তুই…?’ আদরে-আদরে যেন অস্থির করে দেবেন ছোট্ট শরীরটাকে। এত উচ্ছ্বাস দাদুর চোখে-মুখে অনেক দিন দেখা যায়নি।

গাবার বাবা অফিসে বেরোবেন বলে জামার বোতাম আঁটছিলেন। রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে চাপা গলায় গাবার মাকে বললেন, ‘ব্যাস! দ্যাখো, বাবা ঠিক একটা ব্যাখ্যা বের করে ফেলেছেন! এক্ষুনি জানতে পারবে, কী না কী অসাধারণ একটা কিছু সেজে বসে আছে ও। সাপ-ব্যাং-বিচ্ছু যা হোক…!’

যতই আস্তে বলা হোক, দাদুর কানে ঠিক গেল। ঘাড়টা ঘুরিয়ে একটু ঝাঁঝালো গলায় দাদু বললেন, ‘সত্যিই যদি তুমি বুঝতে ও কী সেজেছে, ওকে মাথায় তুলে নাচতে। ওকে মেডেল দেওয়া উচিত!’

‘হয় রামগরুড়, নয় ট্যাঁশগোরু। এ ছাড়া আর কিছু তো বাকি আছে বলে মনে পড়ছে না!’ বাবা আবার হেসে ফেললেন, ‘গঙ্গাফড়িং থেকে সিন্ধুঘোটক, সবই তো সাজা হয়ে গিয়েছে এতদিনে!’

উত্তেজিতভাবে দাদু ওই অবস্থাতেই গাবাকে কোলে তুলে নিলেন, ‘তাহলে সবাই দেখবে এসো! এসো শিগগির, এসো সব্বাই!’

বারান্দায় রাখা একাট টবের পাশে গাবাকে নামিয়ে দিলেন দাদুভাই। তখনও সে দু-হাত দু-দিকে তুলে রয়েছে। এক হাতে হলুদ উলের টুপিটা ধরা। টবটার দিকে আঙুল দেখিয়ে দাদুভাই বললেন, ‘এখন বুঝতে পারছ, কী সেজেছে ও আজ?’

টবে একটা গোলাপচারা। দুটি মাত্র সরু ডাল উঠে এসেছে দু-দিকে, একটায় গাঢ় হলুদ কুঁড়ি সদ্য পাপড়ি মেলেছে। ছোট্ট গাছটার সঙ্গে দু-হাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকা একরত্তি ছেলেটার কী আশ্চর্য মিল। একহাতে ধরা হলুদ টুপিটা পর্যন্ত!

‘কাল বিকেলে যখন আমি গাছটার গোড়ায় জল দিচ্ছিলাম তখন ওকে বলি, গাছ পা দিয়ে মাটি থেকে জল টেনে নিয়ে যায়। বুঝে দ্যাখো, কীভাবে ও সেই কথাটা মনের মধ্যে নিয়েছে!’ আনন্দে, উত্তেজনায় গলা কাঁপছিল দাদুভাইয়ের। বিস্ময়ের ধাক্কায় বাকিদের মুখেও কথা নেই।

সাধে কী দাদুভাই বলেন, ছোটোদের মনের হদিশ পেতে গেলে ওদের কাছাকাছি নেমে আসতে হয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *