গান্ধী-হত্যার চক্রান্ত কতদূর পূর্বজ্ঞাত ছিল? – নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
(মহাত্মা গান্ধী ১৯৪৮ খ্রীস্টাব্দের ৩০ শে জানুয়ারি শুক্রবার বিকাল পাঁচটা নাগাদ শিল্পীর বিড়লাবাড়ির প্রাঙ্গণে একটি প্রার্থনাসভায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। বিস্ময়ের বিষয় এই যে তৎকালীন ভারত সরকার গান্ধী—হত্যার চক্রান্তের খবর আগে থেকে জানা সত্ত্বেও জাতির জনকের জীবনরক্ষায় শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ডঃ জগদীশচন্দ্র জৈন নামক জনৈক অধ্যাপক গান্ধী—হত্যার পরিকল্পনার কথা আগেই জেনেছিলেন, এবং তিনি বিষয়টি বোম্বাই—এর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বি.জি খের এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোরারজী দেশাই—এর দৃষ্টিগোচর করেছিলেন। এই খবর ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলও যথাসময়ে পেয়েছিলেন, অথচ গান্ধীজীর মহামূল্য জীবনরক্ষার কোন ব্যবস্থাই করা হয়নি। গান্ধী—হত্যা মামলায় অধ্যাপক জৈন ছিলেন ফরিয়াদিপক্ষের প্রধান সাক্ষী। পরে অধ্যাপক জৈন এই বিষয় নিয়ে দুটি বই লেখেন, একটির নাম ”আই কুড নট সেভ বাপু”, অপরটির নাম ”মার্ডার অব মহাত্মা গান্ধী।” বই দুটি বর্তমানে সহজলভ্য নয়, কিন্তু সেগুলিতে উল্লিখিত তথ্য ও ঘটনাসমূহের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। বর্তমান আলোচনাটি উক্ত গ্রন্থদ্বয় অবলম্বনে রচিত। প্রয়োজনে অন্যান্য সূত্রের সাহায্যও নেওয়া হয়েছে। — লেখক)
গান্ধীজীর জীবনীকার প্যারেলাল লিখেছেন যে মহাত্মাকে প্রথম হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে পুনায়, যখন তিনি সেখানে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৪৪—এর সেপ্টেম্বরে গান্ধী—জিন্না আলোচনার প্রাক্কালে হিন্দু মহাসভার কিছু স্বেচ্ছাসেবক সেবাগ্রামে হাজির হয়েছিল গান্ধীজীকে জিন্নার সঙ্গে আলোচনায় নিরস্ত করার জন্য। সেখানে পুলিশ তাদের বাধা দেয়, এবং তাদের একজনের কাছ থেকে একটি ছোরা পাওয়া যায়। একজন পুলিষ কর্মচারী ওই ছোরাধারী স্বেচ্ছাসেবকটিকে জিজ্ঞাসা করেন যে সে শহীদ হতে রাজি আছে কিনা। প্রত্যুত্তরে সে বলে যে একমাত্র গান্ধীজীকে খতম করেই তা হওয়া সম্ভব। পরিহাসচ্ছলে তখন পুলিশ কর্মচারীটি বলেন, তাহলে সেটা তোমাদের নেতারাই স্থির করে ফেলুন; এ কর্মটি সাভারকর অনায়াসেই করতে পারবেন। জবাবে স্বেচ্ছাসেবকটি জানায় যে সাভারকর গান্ধীজীকে হত্যা করলে সেটা গান্ধীজীর পক্ষে বড় বেশি সম্মানের ব্যাপার হবে। তাঁকে মারার পক্ষে একজন জমাদারই যথেষ্ট।
প্রত্যক্ষভাবে গান্ধীজীকে হত্যা করার আর একটি চেষ্টা হয় ১৯৪৬—এর ২৮—শে জুন তারিখে যখন তিনি ট্রেনযোগে পুনা অভিমুখে গমন করেছিলেন। ট্রেনটিকে লাইনচ্যুত করার জন্য বড় বড় পাথরের চাঙড় রেললাইনের উপর রাখা হয়েছিল। এ যাত্রা গান্ধীজী বেঁচে যান। কিন্তু চূড়ান্ত দিনটি আসে ১৯৪৮—এর ৩০ শে জানুয়ারি তারিখে। নিয়মমত বিকাল পাঁচটা নাগাদ তাঁর প্রার্থনা সভায় গান্ধীজী গমন করছিলেন, দুই নাতনীর কাঁধের উপর হাত রেখে। ছোটখাট একটি জনতা তাঁর বাণী শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল। গান্ধীজী ধীরে ধীরে মঞ্চের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। যখন তিনি দুটি কি তিনটি ধাপ অতিক্রম করেছেন তখন অপেক্ষমান জনতা থেকে একজন তাঁর খুব কাছে ছুটে আসে এবং পর পর তিনবার তাঁর দেহের উপর গুলিবর্ষণ করে, এক ফুটেরও কম দূরত্ব থেকে। ”হা রাম” বলে গান্ধীজী তৎক্ষণাৎ মাটিতে পড়ে যান। আধঘন্টার মধ্যেই তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া যে কত ব্যাপাক ও গভীর হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয়। এই প্রসঙ্গে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ লিখেছেন : ”আমি আজও ভুলতে পারিনা আধুনিক ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানের জীবনরক্ষায় আমরা কী শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিলাম। বোমার ঘটনার পর (২০ শে জানুয়ারি গান্ধীজীর প্রার্থনাসভায় জনৈক মদনলাল নিক্ষিপ্ত বোমা, যে প্রসঙ্গ পরে আলোচিত হবে) দিল্লির সি.আই.ডি এবং পুলিশ বিভাগের স্বাভাবিক কর্তব্য ছিল তাঁর নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থা করা। বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া এমন কিছু শক্ত ব্যাপার ছিল না। প্রার্থনাসভা খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হত না, তা হত বিড়লাবাড়ির ঘেরা প্রাঙ্গণে। একটি ফটক দিয়েই লোকদের যাওয়া আসা করতে হত, কাজেই যারা যাওয়া আসা করে তাদের উপর পুলিশের নজর রাখা মোটেই কঠিন ছিল না। দুর্ঘটনার পর প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য থেকে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে হত্যাকারী অত্যন্ত সন্দেহজনকভাবেই সেখানে প্রবেশ করেছিল। তার কাজ ও কথাবার্তা সি.আই.ডি—দের নজর এড়িয়ে যাবার মত ছিল না। পুলিশ সামান্য তৎপর হলেই তাকে ধরা যেত এবং অস্ত্রহীন করা যেত। বিনা বাধাতেই সে একটি রিভলবার নিয়ে এসেছিল। গান্ধীজী প্রার্থনাসভায় হাজির হলে সে মৃদু অভিযোগের সুরে বলেছিল আপনি আজ দেরি করে এসেছেন। উত্তরে গান্ধীজী বলেছিলেন, হ্যাঁ। তিনি আর কিছু বলার পূর্বেই তিনটি গুলি তাঁর দেহ ভেদ করে যায় এবং তাঁর অমূল্য জীবনের অবসান ঘটে। এই দুর্ঘটনার পর সারা দেশে ক্রোধের প্রবাহ বয়ে যায়। কিছু লোক প্রকাশ্যেই সর্দার প্যাটেলকে অযোগ্যতার অভিযোগ অভিযুক্ত করেন। জয়প্রকাশ নারায়ণ খুবই সাহসের সঙ্গে এই প্রসঙ্গটি তুলছিলেন। …কলকাতার প্রফুলচন্দ্র ঘোষও একই অভিযোগ করেছিলেন। …সর্দার প্যাটেল নিজস্ব ভঙ্গীতে এই অভিযোগুলির সম্মুখীন হয়েছিলেন। তিনি নিঃসন্দেহে গভীর আঘাত পেয়েছিলেন, কিন্তু যে ভঙ্গীতে লোকেরা প্রকাশ্যে তাঁকে অভিযুক্ত করছিল তাতে তিনি আপত্তি জানিয়েছিলেন। …এই ঘটনার দু’মাসের মধ্যেই সর্দার প্যাটেল হৃদরোগে আক্রান্ত হন। আমার নিজের ধারণা তিনি যে আঘাত পেয়েছিলেন এটা তারই প্রতিক্রিয়া। …গান্ধীজী নিহত হবার পর লোকে যখন সর্দার প্যাটেলের বিরুদ্ধে অবহেলা ও অযোগ্যতার অভিযোগ করতে শুরু করল, তিনি অত্যন্ত আহত ও অপমানিত বোধ করেন। …এর পরেও তিনি চার বছরের মত বেঁচেছিলেন, কিন্তু কখনওই সুস্থ হতে পারেননি।”
সর্দার প্যাটেলকে গান্ধী হত্যার ব্যাপারে দোষারোপ করার কয়েকটি কারণ ছিল, কিন্তু প্যাটেলের পক্ষে আরও যা মর্মান্তিক হয়েছিল তা হচ্ছে এই যে এজন্য তাঁকে কোন কোন মহল থেকে অভিনন্দিত করা হয়েছিল। তাঁর সমালোচক ও প্রশংসাকারী উভয়পক্ষই সুনিশ্চিত ছিলেন যে গান্ধী হত্যা চক্রান্তের কথা প্যাটেল আগেভাগেই জানতেন। সমালোচকদের বক্তব্য ছিল সর্দার প্যাটেল গান্ধীজীর জীবনরক্ষার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করেননি, এবং তাঁর প্রশংসাকারীরা মনে করতেন সেটা তিনি সঙ্গতভাবেই ইচ্ছাকৃতভাবে করেননি। বস্তুত তৎকালীন সাম্প্রদায়িক হানাহানির পরিবেশে ভারতবর্ষে এমন লোক বহু ছিল যারা আন্তরিকভাবে মহাত্মার মৃত্যুর কামনা করত। যদিও দেশবিভাগ ও সাম্প্রদায়িক হানাহানির জন্য গান্ধীজী আড়াল করে রেখেছিলেন। তাদের মতে গান্ধীজীর শেষ উপবাসের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা করা এবং ভারত সরকারকে চাপ দেওয়া যাতে পাকিস্তানকে পঞ্চান্ন কোটি টাকা দান করা হয়। গান্ধীজীকে অনেকেই বিদ্রূপ করে মহম্মদ গান্ধী বলত। গান্ধীজীর প্রাণনাশ করা উচিত এই মর্মে প্রচারপত্রও বিলি হত। এই সকল কাজে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘেরও যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। এই শ্রেণীর লোকেরা গান্ধীজী নিহত হবার ফলে নিজেদের চাপা উল্লাসকে গোপন রাখতে পারেনি এবং তারা এই রকম ধারণা প্রচার করতে সমর্থ হয়েছিল যে সর্দার প্যাটেল বিচক্ষণতার সঙ্গে বিষয়টির যা ন্যায্য পরিণতি হতে পারত তা ঘটতে দিয়েছেন। এইরকম একটা ধারণা গড়ে ওঠার একটা কারণ ছিল এই যে, যদিও গান্ধীজীর প্রতি সর্দার প্যাটেলের আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত, তৎসত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় স্বংয় সেবক সেবক সংঘের প্রতি তাঁর কিছু দুর্বলতা ছিল। ১৯৪৮—এর ৬ ই জানুয়ারি তারিখে লউনউ শহরে একটি জনসভায় সর্দার প্যাটেল বলেছিলেন : ”কংগ্রেসের মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তি ক্ষমতায় আছেন যাঁরা মনে করেন যে নিছকই কর্তৃত্বের জোরে তাঁরা আর.এস.এস.কে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে সক্ষম। লাঠির জোরে কোন সংঘটনকেই আপনারা ভাঙতে পারবেন না। … মোটের উপর, আর.এস.এস—এর লোকেরা চোরডাকাত নয়। তারাও দেশপ্রেমিক যারা দেশকে ভালবাসে। কেবল তাদের চিন্তাধারা কিছুটা বিপথচালিত।”
পক্ষান্তরে প্যাটেলের প্রতি হিন্দু সংগঠন সমূহের ভক্তি বরবারই অটুট ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর হিন্দুমহাসভা গভীর ও আন্তরিকভাবে এই ”হিন্দুমনস্ক ভারতের বিসমার্কের” প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে।
প্যারেলাল লিখেছেন : ”বোম্বাই থেকে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে সর্দার প্যাটেল নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে চেয়েছিলেন, এবং গান্ধীজীকে বলেছিলেন যে তিনি চান যেন পুলিশ তাঁর প্রার্থনাসভায় যোগদানকারী প্রতিটি ব্যক্তির তল্লাসী করে। কিন্তু গান্ধীজী এ—ব্যাপারে একমত হতে অস্বীকার করেন এবং তাঁর প্রার্থনাসভায় পুলিশের উপস্থিতির ব্যাপারে তীব্র আপত্তি জানা। তিনি বলেন, প্রার্থনা সভায় যখন তিনি সর্বতোভাবেই নিজ—নিরাপত্তার বিষয়টি ঈশ্বরের ইচ্ছার নিকট সপে দিয়েছেন, তখন প্রার্থনাকালে যে কোন মানবিক—নিরাপত্তার ব্যবস্থাই তাঁর বিশ্বাস্রে কাছে অনুমতিযোগ্য হবে না। সর্দার কর্তৃক প্রস্তাবিত নিরাপত্তা গ্রহণে যদি তিনি সম্মতি জ্ঞাপন করেন সেটা তাঁর বিশ্বাসের ঘোষণা ও আচরণকে বিদ্রূপ করবে। তাঁকে অমনীয় দেখে সর্দার ভাগ্যের হাতেই সব ব্যাপারটা ছেড়ে দেন। কিন্তু যা একজনকে বিস্মিত করে তা হচ্ছে এই যে কর্তৃপক্ষের নিকট সুনির্দিষ্ট এবং পাকা খবর থাকা সত্ত্বেও তাঁরা চক্রান্তকারীদের খুঁজে বার করতে, গ্রেপ্তার করতে এবং তাদের পরিকল্পনা বানচাল করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এই ব্যর্থতা সেই গলদেরই পরিমাপক যা পুলিশ—সহ সরকারী বিভাগসমূহে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। বস্তুত, পরে জানা গিয়েছিল যে, আর এস.এস.—এর শাখাসমূহ বিভিন্ন সরকারী বিভাগে, পুলিশ কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ বাহিনীর মধ্যে এতদূর বিস্তৃত হয়েছিল যে তাদের কাজকর্মের প্রতি এই সব ব্যক্তিদের সহানুভূতি ও সক্রিয় সহযোগিতা ছিল। এমন কি বোমা—বিস্ফোরণের ঘটনার পূর্বেও, দিল্লির নান্স উদ্বাস্তু—শিবিরে গান্ধীজাকে হত্যা করা হবে এমন জনরব বেশ চালু ছিল, এমন কি অনেক কংগ্রেসী নেতার মধ্যেও যাঁরা সাম্প্রদায়িক আদর্শ বিরোধী হিসাবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। গান্ধীহত্যার পর সর্দার প্যাটেল একজন যুবকের কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন যে, তার নিজের বক্তব্য অনুযায়ী, আর.এস. এস—এ যোগদান করতে আকৃষ্ট হয়েছিল এবং পরে যার মোহভঙ্গ হয়। ওই চিঠিতে বলা ছিল যে বহুস্থানে আর.এস.এস—এর আকৃষ্ট হয়েছিল এবং পরে যার মোহভঙ্গ হয়। ওই চিঠিতে বলা ছিল যে বহুস্থানে আর.এস.এস.এস—এর সদস্যদের সেই ভাগ্যনির্ধারিত শুক্রবার রেডিও খুলে রাখতে নির্দেশ আগেভাগেই দেওয়া হয় যাতে তারা সুসংবাদটি শুনতে পায়। সংবাদ ঘোষিত হবার পর দিল্লি সহ বহু স্থানে আর এস এস মহলে মিষ্টান্ন বিতরিত হয়। পরে যখন সরকারী আদেশে আর.এস.এস নিষিদ্ধ হয়ে যায় তখন, সর্দারের সংবাদদাতার খবর অনুযায়ী জানা যায় যে একটি ভারতীয় রাজ্যের পুলিশের বড়কর্তা সংগঠকদের বার্তা মারফৎ জানান যে তারা যেন শোক চিহ্ন হিসাবে তের দিন অফিস বন্ধ রাখে এবং এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু কখনও যেন সংগঠন বন্ধ না করে।”
মৌলানা আজাদ, প্যারেলাল সকলেই বোম্বাই থেকে প্রাপ্ত পাকা খবরের কথা বলেছেন। এই পাকা খবরটি গান্ধী—হত্যা চক্রান্তের। চক্রান্তকারীরা যে কারা সে—বিষয়েও ইঙ্গিত ওই খবরের মধ্যে ছিল। এই চক্রান্তের প্রথম সংবাদ পান ২৮ নম্বর শিবাজী পার্রে বাসিন্দা বোম্বাই—এর রুইয়া কলেজের অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র জৈন। পাঞ্জাব থেকে আগত মদনলালা নামক একজন উদ্বাস্তু যুবকের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ ছিল। এই মদনলালই তার কোন এক দুর্বল মুহূর্তে অধ্যাপক জৈনকে জানায় যে সে আহমদনগরের বিষ্ণু করকরে নামক জনৈক ব্যক্তির কাছে কাজ নিয়েছে, এবং তারা গান্ধীজীকে হত্যা করার মনস্থ করেছে এবং এই পরিকল্পনার পিছনে সাভারকরের আশীর্বাদ আছে। অধ্যাপক জৈনের নিজের ভাষায় : ”জানুয়ারির গোড়ার দিকে একদিন রাত আটটা নাগাদ আমি যখন আমার বন্ধু অঙ্গদ সিং—এর সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলাম তখন মদনলাল কতকগুলি খবরের কাগজ নিয়ে সেখানে আসে এবং দেখায় যে সেগুলিতে তার নাম বেরিয়েছে। … অঙ্গদ সিরং চলে যাবার পর… মদনলাল বলে যে কয়েকদিন আগে সে যে লোকটিকে সঙ্গে নিয়ে আমার কাছে এসেছিল তার নাম করকরে যার আহমদনগরে দুটি হোটেল ও কয়েকটি ফলের দোকান আছে।
‘… আহমদনগরে আমরা একটি দল তৈরি করেছি, যাতে করকরে টাকা যোগায়, এবং আমরা অনেক অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করে জঙ্গলে লুকিয়ে রেখেছি।’… মদনলাল আরও বলে, ‘করকরের নাম ওয়ারেন্ট আছে, কিন্তু পুলিশ আমাদের পক্ষে।’… ক্রমশ মদনলাল প্রকাশ করে যে একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে হত্যা করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আমি সেই নেতার নাম জানতে চাইলে মদনলাল বলে যে সে তা জানে না, তবে কয়েকদিন পরে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। নাম জানার জন্য তাকে আমি রীতিমত চাপ দেওয়াতে সে নিম্নস্বরে বলে ‘গান্ধী’। আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি, কেননা মহাত্মা গান্ধীকে কেউ হত্যা করার চিন্তা করতে পারে সেটা বিশ্বাস করাই আমার পক্ষে কঠিন। … আমি বেড়াবার অছিলায় তাকে সমুদ্রের তীরে নিয়ে যাই এবং ওই চক্রান্ত সম্পর্কে বিশদ সংবাদ জানার জন্য এবং তাকে প্রতিনিবৃত্ত করার জন্য সাধারণভাবে কথাবার্তা বলতে শুরু করি। … আমি তাকে বোঝাই যে সে খুব বাজে লোকদের খপ্পরে পড়েছে। … তাকে বলি, ‘এই শেঠ (করকরে) তোমাকে বোকা পেয়ে দুষ্কর্মে লিপ্ত করাচ্ছে। সে যে আহমদনগরের মুসলমান ফলওয়ালাদের দোকানগুলি দখল করেছে তা হিন্দুদের প্রতি ভালবাসার জন্য নয়, নিজের লাভের জন্য। শেষ পর্যন্ত সে তোমাকেই ফাঁসাবে।’…
”পরদিন আমি অঙ্গদ সিং—এর সঙ্গে দেখা করে সব কথা খুলে বলি এবং তাঁকে জিজ্ঞাসা করি যে কর্তৃপক্ষের নিকট এই খবরটা পৌঁছে দেওয়া উচিত কিনা। তিনি বলেন, ‘আপনি কিভাবে এই ছোকরাকে বিশ্বাস করতে পারেন? সে হয়ত মিছে জাঁক করছে। আপনি কি জানেন না আজকাল এইসব রেফিউজিরা গান্ধীজী এবং কংগ্রেস সম্পর্কে যা নয় তাই বলে? তারা অনেক কথাই বলে থাকে যার উপর গুরুত্ব দেবার কোন মানে হয় না। আপনি ব্যাপারটিকে সরকারী কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর করাতে চাইছেন। তাদের সঙ্গে দেখা করা মোটেই সহজ নয়, আর তারা বুঝতেও চাইবে না। এমনকি যদিও আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হই, আমার আশঙ্কা তাতে আমরাই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ব।’ দুদিন পরে মদনলাল আবার আমার কাছে আসে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি আমার সেদিনের কথাগুলি সে বিবেচনা করেছে কিনা। মদনলাল জবাব দেয়, আমি আপনাকে পিতৃতুল্য জ্ঞান করি। আপনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। আপনি যা বলেছেন তা নিশ্চয়ই আমার ভালর জন্য। আপনার কথা না শুনলে আমার সর্বনাশ হবে।’ এর কয়েকদিন পর মদনলাল একদিন রাত্রে খুব ব্যস্তভাবে বলে, ‘আমি চললাম।’ ‘কোথায়?’ ‘দিল্লিতে’। ‘কেন?’ ‘কিছু কাজ আছে।’ আমি তাকে বসতে বললাম, কিন্তু সে জানাল যে তাকে ট্রেন ধরার জন্য এখনই স্টেশন যেতে হবে। আমি তাকে সাবধান করলাম। জবাবে মদনলাল জানাল, ‘আমি সবই বুঝি। ফিরে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করব।’ আমি দুশ্চিন্তায় পড়লাম। কেন সে দিল্লি যাচ্ছে? সে কি কোন কু—অভিপ্রায়ে যাচ্ছে?”
অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র জৈন এরপর লিখেছেন : ”১৯৪৮—এর ১৩—ই জানুয়ারি বোম্বাই—এর পোদার কলেজ অব কমার্সে হিন্দি অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সভায় আমি আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। জয়প্রকাশ নারায়ণ ছিলেন সেই সভার প্রধান অতিথি। তাঁর ভাষণে তিনি বলেন, ‘দিল্লির অবস্থা অতি বিপজ্জনক। এমনকি মৌলানা আবুল কামাল আজাদের মত লোকও স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করতে পারছেন না। সাম্প্রদায়িকতার অবসানের জন্য মহাত্মা গান্ধী জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন (গান্ধীজী তখন অনশন জন্য করছিলেন।) তাই আমাদের প্রধান কর্তব্য সাম্প্রদায়িকতার বিষ বরাবরের জন্য উচ্ছেদ করা। … যখন জয়প্রকাশ সভাগৃহ ত্যাগ করছিলেন, তখনই মদনলালের কথা আমার মনে হল। যেহেতু জয়প্রকাশ দিল্লি যাচ্ছেন, আমি ভাবলাম, তিনি হয়ত এ—বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে সচেতন করতে পারবেন। যখন তিনি হলের বাইরে এলেন, আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম তিনি আমায় সামান্য সময় দিতে পারেন কিনা। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমি তাঁকে কিছু বলতে চাই। কি বিষয় তা তিনি জানতে চাইলেন। ভীড়ের মধ্যে কথাবার্তা বলতে আমি ইতস্তত করছিলাম। তাই ভাবলাম, তাঁকে সামান্য একটু আভাস দেব যাতে তাঁর কৌতূহল জাগ্রত হয়। আমি বললাম, সম্ভবত দিল্লিতে একটা চক্রান্ত?’ আমি জানলাম, সকলের সামনে তা বলা যাবে না। তিনি আমাকে পরদিন সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন।” দুর্ভাগ্যক্রমে সাক্ষাৎকারটি ঘটেনি।
এবারে আমরা একটু দিল্লির দিকে ফিরব। গান্ধী হত্যা মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, ১৯৪৭—এর নভেম্বরে দিগম্বর বাগড়ের (যার পুনায় শস্ত্র ভাণ্ডার নামে একটি আগ্নেয়াস্ত্রের দোকান ছিল এবং যে পরে রাজসাক্ষী হয়) সঙ্গে নারায়ণ আল্টের যোগাযোগ হয়, এবং তখন থেকেই গান্ধী হত্যার চক্রান্তের শুরু। ১৯৪৮—এর ১৩ ই ও ১৪ ই জানুয়ারি নাথুরাম গোড়সে (গান্ধীজীর হত্যাকারী) তার দুটি জীবনবীমা পলিসির উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যথাক্রমে তার নিজের স্ত্রীও তার ভাই গোপাল গোড়সের স্ত্রীর নামে। ১৪ তারিখেই নাথুরাম ও আল্টে পুনা থেকে বোম্বাই চলে আসে। ওই দিনই দিগম্বর বাগড়ে ও তার ভৃত্য শংকর কিন্তায়া বোম্বাই—তে এসে নাথুরাম ও আল্টের কাছে কিছু আগ্নেয়াস্ত্র হস্তান্তর করে। সেই দিনই তারা সাভারকরের বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। ওই একই দিনে বাগড়ের সঙ্গে মদনলালের দেখা হয় দাদারে হিন্দুমহাসভার অফিসে। ১৫ ই জানুয়ারি নাথুরাম, আল্টে, বাগড়ে ও মদনলাল জি.এম. যোশী পরিচালিত শিবাজী প্রিণ্টিং প্রেসে বিষ্ণু করকরের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে। আপ্টে বাগড়েকে জানায় যে তাত্যারাও সাভারকর — গান্ধীজী, জওহরলাল নেহরু ও সুরাবর্দীকে খতম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তাদের উপর এই দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন। এই দিনই রাত্রিকালে মদনলাল অদ্যাপক জগদীশচন্দ্র জৈনের সঙ্গে দেখা করে জানায় দেখা করে জানায় যে সে একটি বিশেষ কাজে দিল্লি যাচ্ছে। তারপর মদনলাল ও বিষ্ণু করকরে ট্রেনে চেপে দিল্লির উদ্দেশে পাড়ি দেয়।
১৬ ই জানুয়ারি নাথুরাম, আপ্টে ও বাগড়ে বোম্বে—ডাইং কারখানায় যায় এবং সেখানে চরণদাস মেখজি মথুরদাসের কাছ থেকে ১০০০ টাকা পায়। অতঃপর তারা সাভারকরের বাড়ি যায় এবং কথিত আছে সাভারকর তাদের ‘যশস্বী হোউন যা’ (বিজয়ী হয়ে ফিরে এস) বলে আশীর্বাদ করেন। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তারা যথাক্রমে আফজলপুরকর এবং কালের কাছ থেকে ১০০ এবং ১০০০ টাকা নেয় এবং দীক্ষিতজী মহারাজের সঙ্গে দেখা করে সান্তাক্রুজ বিমানবন্দর অভিমুখে যাত্রা করে। আপ্টে ট্রেন করে দিল্লি যাবার জন্য বাগড়েকে ৩০০ টাকা দেয়। ১৭—ই জানুয়ারি নাথুরাম ও আপ্টে বিমানযোগে দিল্লি পৌঁছায়। ওই দিনই ট্রেনযোগে দিল্লিতে আসে মদনলাল ও করকরে। নাথুরামের ভাই গোপাল গোড়সে আগেই দিল্লি পৌঁছেছিল। বাগড়ে এবং শংকর ১৯ তারিখে দিল্লি আসে।
২০ শেষ জানুয়ারি সকালে তারা বিড়লা—বাড়ির প্রাঙ্গণ ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে। স্থির হয় যে মদনলাল প্রথমে বোমা ফাটাবে এবং তার ফলে প্রাঙ্গণে যে বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি হবে সেই সুযোগে মহাত্মাকে গুলি করা হবে। ওই দিন বিকালে প্রার্থনসভায়, উপবাস ভঙ্গের দু’দিন পর গান্ধীজী দেশে সাম্প্রদায়িক হানাহানির প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছিলেন। সেদিন তাঁকে অত্যন্ত ক্লান্ত দেখাচ্ছিল এবং কথা বলতে বলতে তাঁর গলার স্বর ভারী হয়ে উঠছিল। অকস্মাৎ সভাস্থলে প্রচণ্ড শব্দে একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে এবং উপস্থিত শ্রোতারা আতঙ্কে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সেই মুহূর্তে গান্ধীজী অত্যন্ত কঠোর কণ্ঠে বলে ওঠেন, ”এই সামান্য ব্যাপারে আপনারা যদি এরকম ভীতিবিহ্বল হয়ে ওঠেন, আসল বিপদ এলে করবেন কি?” গান্ধীজীর তীব্র ভৎর্সনায় শ্রোতৃবৃন্দ শান্ত হয়ে বসেন। ওদিকে, যে বোমা ছুঁড়েছিল — আমাদের পূর্বপরিচিতি মদনলাল — হাতে নাতে ধরা পড়ে। তাকে তল্লাসী করে আরও একটি হাত গ্রেনেড পাওয়া যায়। তাকে পুলিশের হাতে সমর্পণ করা হয়। পুলিশদের গান্ধীজী বলেন এ ব্যাপারে যেন মদনলালকে কোন হয়রানি না করা হয়। পরে তিনি শান্ত কণ্ঠে শ্রোতৃবর্গকে বলেন যে উক্ত বোমানিক্ষেপকারীর দোষের কথা না ভেবে নিজেদের মনের মধ্যে যে হিংসাবৃত্তি রয়েছে তাঁরা যে সে—বিষয়ে সচেতন হন। গান্ধীজী তাঁর উপযুক্ত ভূমিকাই পালন করেছিলেন, কিন্তু দিল্লির পুলিশ কর্তৃপক্ষ তা করেননি। আসলে সেই দিনই গান্ধীজীর জীবনান্ত হবার কথা ছিল।
এরপর অধ্যাপক জৈনের নিজের কথায় আসা যাক। তিনি লিখেছেন : ”সেদিন ছিল ২১ শে জানুয়ারি। সকালের সংবাদপত্র হাতে নেবার পর সহসা একটি সংবাদের উপর আমার চোখ পড়ল। বোম্বাই—এর বাসিন্দা জনৈক মদনলাল নামক পাঞ্জাবী উদ্বাস্তু গান্ধীজীর প্রার্থনা সভায় বোমা বিস্ফোরণ করেছে। বিশৃংখল শ্রোতাদের গান্ধীজী শান্ত করেন এবং যথারীতি ভাষণদান সম্পূর্ণ করেন। মদনলালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গী সাথীরা একটি গাড়িতে চেপে পলায়ন করেছে। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। মদনলাল তাহলে সত্য কথাই বলেছিল। যাতে পুনরায় সর্বনাশ না হয় সেজন্য আমাকে দ্রুত চেষ্টা করতে হবে। তখনও কাগজটা আমার হাতে ধরা রয়েছে, এমন সময় অঙ্গদ সিং দ্রুত আমার কাছে এসে বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছিলেন। আমাদের আর নষ্ট করার মত সময় নেই। আমাদের এখনই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার।’ সেই সময় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ঘটনাচক্রে বোম্বাইতে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে জানলাম যে তিনি বিমানবন্দরের দিকে রওনা হয়ে গেছেন, এবং পনের মিনিটের মধ্যে প্লেন ছাড়বে। আমরা তখন তৎকালীন বোম্বাই প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি এস কে পাতিলকে ধরার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তিনিও প্যাটেলের সহযাত্রী হয়েছেন। তখন আমরা টেলিফোনে বোম্বাই—এর মুখ্যমন্ত্রী বি.জি. খেরকে ধরলাম, এবং সচিবলায়ে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার একটা ব্যবস্থা হল।”
”আমি বি.জি খের এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে সব কথা খুলে বললাম। আমি জানালাম যে লোকের ধারণা বোমা ফাটানোর ঘটনাটি কোন মাথা—খারাপ রেফিউজির কাজ। এই ধারণা ঠিক নয়, এবং এই বোমার ঘটনার পিছনে একটা বড় চক্রান্ত আছে। আমি জানালাম যে মদনলাল আমাকে জানিয়েছিল যে গান্ধীজীকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে একটি গোষ্ঠী গঠিত হয়েছে, এবং এই ব্যাপারে টাকা যোগায় আহমদনগরের বিষ্ণু করকরে, যাকে সে একদিন আমার বাড়িতেও এনেছিল। আমি তাঁদের আরও জানিয়েছিলাম যে মদনলালের সঙ্গে সাভারকরের দীর্ঘ কথাবার্তা হয়েছিল। মদনলাল কর্তৃক আশ্বাস দান সত্ত্বেও আমি এখন নিশ্চিত যে সে একটি গভীর চক্রান্তের অংশীদার। চক্রান্তকারীরা পুনরায় গান্ধীজীর উপর আঘাত হানবে। কাজেই মহাত্মার জীবন রক্ষার জন্য এখনই তৎপর হওয়া দরকার। যদি তাঁরা (মন্ত্রীরা) মনে করেন যে আমি দিল্লি গেলে এ ব্যাপারে কিছু সুবিধা হয়, তা হলে আমি সেখানে গিয়ে জেলহাজতে মদনলালের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আরও বেশি খবর আনতে পারি।”
এরপর অধ্যাপক জৈন লিখেছেন : ” মোরারজি দেশাই আমাকে বললেন যে তিনি সেই রাত্রে আমেদাবাদ যাচ্ছেন, এবং তিনি সেখান থেকে বিষয়টি সর্দার প্যাটেলকে জানিয়ে দেবেন। তিনি আরও বললেন যে যদি আমি খবরটি আরও আগে তাঁর জানাতাম তাহলে চক্রান্তকারীরা দিল্লি পৌঁছাবার আগেই তাদের তিনি গ্রেপ্তার করতেন। জবাবে আমি বলেছিলাম যে গোড়ার দিকে মদনলালের কথায় আমি তেমন গুরুত্ব দিইনি। এই রকম আজেবাজে কথা রেফিউজি ছোকরারা প্রায়ই বলে থাকে। আর তাছাড়া গান্ধীজীর মতন মানুষকে কেউ হত্যাক করতে চাইবে এটা সহসা বিশ্বাসযোগ্য নয়।”
কিন্ত মোরারজি দেশাই যথাসময়ে দিল্লিতে খবর পাঠানো সত্ত্বেও দিল্লি পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা কোন রহস্যজনক কারণে এই বিষয়ে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়তা প্রদর্শন করেছিল। জেল—হাজতে মদনলালকে জেরা করে বা অন্য কোন অসুবিধা ছিল না। এ বিষয়ে অধ্যাপক জৈনকেও কাজে লাগানো যেত, কেননা মদনলাল তার চরম দুর্দিনে সাহায্যকারী অধ্যাপক জৈনকে ভক্তিশ্রদ্ধা করত। কিন্তু পুলিশ কিছুই করেনি।
সে যাই হোক ২০ শে জানুয়ারি তারিখের গান্ধী—হত্যা পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে বাগড়ে বিরক্ত হয়ে সেই সন্ধ্যাতেই শংকরকে নিয়ে পুনা অভিমুখে যাত্রা করে, নাথুরাম ও আপ্টে কানপুর অভিমুখে। করকরে ও গোপাল গোড়সে ফ্রন্টিয়ার হিন্দু হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন দিল্লি পরিত্যাগ করে। জানুয়ারির ২৩ তারিখে নাথুরাম ও আপ্টে কানপুর থেকে বোম্বাই এসে পৌঁছায় এবং ছদ্মনামে প্রথমে আর্য পথিক আশ্রম ও পরে এলফিনস্টোন হোটেলে আশ্রয় নেয়। এইখানেই বাকি সকলের সঙ্গে তাদের দেখা হয় এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও এখানে ঠিক হয়। পরিকল্পনাটি হচ্ছে গান্ধীজীর ভক্ত শ্রোতার ভান করে তাঁর খুব কাছাকাছি থাকা, এবং অত্যন্ত নিকট থেকে তাঁকে গুলিবিদ্ধ করা। তদনুযায়ী ২৭ শে জানুয়ারি তারিখে নাথুরাম গোড়সে এবং নারায়ণ আপ্টে বিমানযোগে পুনরায় দিল্লিতে হাজির হয়। সেখান থেকে তারা গোয়ালিয়র যায় এবং সেখানে দত্তাত্রেয় পরচুরের কাছ থেকে রিভলবার নিয়ে দিল্লিতে ফিরে আসে এবং দিল্লি স্টেশনের রিটায়ারিং রুমে আশ্রয় নেয়। নাথুরামের লাগেজ একটি প্রথম শ্রেণীর ওয়েটিং রুম—এ ফেলে আসা হয়। সেই দিনই বিকাল পাঁচটায় নাগাদ নাথুরাম গান্ধীজীর দেহে পর পর তিনবার গুলি করে এবং ঘটনাস্থলেই ধৃত হয়।
গান্ধীজী নিহত হবার কয়েকদিন পরে অধ্যাপক জৈন বি.জি খেরের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। ক্ষমাপ্রার্থনার সুরে মুখ্যমন্ত্রী বি.জি খের তাঁকে বলেন, এটা ঈশ্বরেরই অভিপ্রায় ছিল। গান্ধীজী চাইতেন না যে তাঁর প্রার্থনাসভায় যোগদানকারী লোকদের দেহতল্লাসী করা হোক। ঘটনাটা বোম্বাই—এর হলে তাঁদের কিছু করার ছিল। দিল্লির ব্যাপারে তাঁরা অসহায়। অধ্যাপক জৈনের দেওয়ার খবর তাঁরা সর্দার প্যাটেলকে পাঠিয়ে দিয়েছিএলন। তিনি স্বয়ং এই বিষয়টি প্যাটেল ও গান্ধীজীকে জানিয়েছিলেন। প্রত্যুত্তরে অধ্যাপক জৈন জানান যে বিশেষ নিরাপত্তা গান্ধীজী চাননি সেটা তাঁর মহত্ত্ব। কিন্তু এই যুক্তি অনুসরণ করে সরকার জাতির জনকের প্রাণরক্ষায় তার কর্তব্য করবেন না, সেটা কেমন কথা? তাছাড়া তাঁকে (অধ্যাপক জৈনকে) যদি দিল্লিতে মদনলালের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হত, যে অনুমতি তিনি চেয়েছিলেন, তাহলে হয়ত গান্ধীজীর জীবন রক্ষা পেত। অবরুদ্ধ আবেগ দমন করে বি.জি. খের তাঁকে বলেছিলেন, ”আপনি ঠিকই বলেছেন, হয়ত গান্ধীজীকে রক্ষা করা যেত।”
এমন সময় মোরারজি দেশাই সেখানে হাজির হন। তাঁকে দেখে বি.জি. খের বলেন, ”এই ভদ্রলোক আমাদের বিরুদ্ধে অবহেলায় অভিযোগ চীৎকার করে বলেন, ”আপনিও চক্রান্তকারীদের একজন। আপনাকে আমার গারদে পোরা উচিত ছিল। আপনি মদনলালকে সাহায্য করেছেন।’ মোরারজির চীৎকারে বি.জি—খেরের পরিবার—পরিজন, পিওন, শোফার, মালী, হাবিলদার সকলেই ছুটে আসেন। তখনও মোরারজি চীৎকার করে যাচ্ছেন। কিছু পরে এই আচরণের জন্য লজ্জা পেয়ে তিনি শান্ত স্বরে বলেন, ”আপনাকে যদি চক্রান্তকারী মনে করতাম, তাহলে বহু আগেই আপনাকে গ্রেপ্তার করতাম। আমি যা বলেছি তা আপনার কথার প্রত্যুত্তরেই বলেছি। যখন দিল্লির পুলিশ আমার পুলিশের উপর দোষারোপ করার চেষ্টা করেছিল, আমরা তাদের বলেছি যে ২১ শে জানুয়ারি আপনার কাছ থেকে আমরা যে সংবাদ পেয়েছি, তা আমরা তদ্দণ্ডেই দিল্লির কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সুতরাং এটা আমাদের দোষ নয়।”
প্যারেলালের মতে পুলিশ এবং প্রশাসনের মধ্যে, এমন কি গান্ধীজীর প্রতি উচ্চকণ্ঠ—আনুগত্য সম্পন্ন রাজনীতিবিদদের মধ্যেও এমন মানুষ অনেক ছিল যারা গান্ধীজীর মৃত্যুকামনা করত। এই কারণে খবর থাকা সত্ত্বেও মদনলালের কাছ থেকে চক্রান্তকারীদের নাম—ধাম—পরিচয় সংগ্রহ করা হয়নি বা তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি।
দিল্লির লালকেল্লায় গান্ধী—হত্যা মামলার জন্য যে বিশেষ আদালতে বসে সেখানে সাক্ষ্যগ্রহণ চলে ১৯৪৮—এর ২৪ শে জুন থেকে ৬ই নভেম্বর পর্যন্ত। আদালতে মোররজি দেশাই নিম্নোক্ত জবানবন্দী দেন : ”২১ শে জানুয়ারি তারিখে রুইয়া কলেজের অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র জৈন আমাকে খবর দেন যে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করার একটা চক্রান্ত চলছে। এই সংবাদ পেয়ে আমি গোয়েন্দা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অফিসার নাগরওয়ালাকে ডেকে পাঠাই। তাঁকে তখনই পাওয়া যায়নি কেননা তিনি অন্যত্র ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু সেই রাত্রেই আমাকে আমেদাবাদ যেতে হয় এবং সেই জন্য আমি তাঁকে রেল স্টেশনে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলি। নাগরওয়ালা স্টেশনে আমার সঙ্গে দেখা করেন। আমি তাঁকে অধ্যাপক জৈন বর্ণিত পুরো কাহিনীটা শোনাই এবং যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করি। আমি তাঁকে তিনটি নির্দেশ দিয়েছিলাম। প্রথম, করকরেকে যেন তদ্দণ্ডেই গ্রেপ্তার করা হয়। অন্য একটি ব্যাপারে দশ বারোদিন আগে থেকেই পুলিশ তাকে খুঁজছিল, কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়ত, সাভারকরের বাড়ির উপর এবং তাঁর গতিবিধির উপর নজর রাখার নির্দেশ আমি নাগরওয়ালাকে দিয়েছিলাম, এবং তৃতীয়ত এই চক্রান্তে কারা কারা লিপ্ত আছে তা খুঁজে বার করার নির্দেশও আমি দিয়েছিলাম। ২২ তারিখে সকালে আমি আমেদাবাদে পৌঁছাই, সেখানে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়, যিনি আগের দিন সেখানে গিয়েছিলেন। অধ্যাপক জৈনের কাছ থেকে আমি যা শুনেছিলাম এবং যে—সকল ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলাম তা আমি সর্দার প্যাটেল ও তাঁর সচিবকে জানাই।”
সাভারকরের পক্ষের আইনজীবী ভোপৎকর অতঃপর মোরারজি দেশাইকে জেরা করেন। তাঁর প্রশ্ন ও মোরারজির উত্তর নিম্নে প্রদত্ত হল :
অধ্যাপক জৈনের সঙ্গে কতবার আপনার দেখা হয়েছিল?
নাগরওয়ালার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটিয়ে দেবার পূর্ব পর্যন্ত ২১ শে জানুয়ারির পর থেকে তিনবার। প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল ২১ শে জানুয়ারি তারিখে সেক্রেটারিয়েটে, দ্বিতীয় ফেব্রুয়ারি তিন—চার তারিখে।
আপনি কি জানেন তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ ঘটিয়ে দেবার পর নাগরওয়ালার সঙ্গে অধ্যাপক জৈনের কতবার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল।
আমি জানি না।
আপনি কি অধ্যাপক জৈনের অতীত জীবন অনুসন্ধান করেছিলেন?
না, আমি তা করিনি।
আপনি কি অধ্যাপক জৈনের সাহায্য গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন যখন তিনি আপনাকে বলেছিলেন যে তিনি পুলিশকে খোলাখুলি সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন?
সেইজন্যই আমি তাঁকে নাগরওয়ালার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলাম।
অদ্যাপক জৈনের কাহিনী সত্য কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধান করার জন্য আপনি কি নাগরওয়ালাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন?
আমি নিশ্চিতভাবেই নাগরওয়ালেক এই বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছিলাম।
আপনি কি জানেন ২১ শে জানুয়ারির পূর্বে অধ্যাপক জৈন এই চক্রান্তে বিষয় অন্য কোন পুলিশ অফিসারকে জানিয়েছিলেন?
আমি জানি না।
আপনি কি জানেন অধ্যাপক জৈনের সঙ্গে মদনলালের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল?
অধ্যাপক জৈন আমাকে বলেছিলেন যে মদনলালের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
আপনি কি অধ্যাপক জৈনের উপর নজর রাখার জন্য নাগরওয়ালাকে কোন কোন নির্দেশ দিয়েছিলেন?
না, আমি দিইনি।
শুধুমাত্র অধ্যাপক জৈনের কথায় নির্ভর করে সাভারকরের বাড়ির উপর নজর রাখা কি সঙ্গত হয়েছে?
(বিচারক এই প্রশ্নটি অনুমতি দিলেন না।)
অধ্যাপক জৈনের বক্তব্য ছাড়া আপনার কাছে কি আর কোন সংবাদ ছিল যার উপর নির্ভর করে আপনি সাভারকরের বাড়ি ও তাঁর গতিবিধির উপর নজর রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন?
আমি কি আমার যুক্তি দেব? সেক্ষেত্র সাভারকরকেই ঠিক করতে হবে আমি উত্তর দেব কিনা। আমি আমার কারণসমূহ প্রদর্শন করতে প্রস্তুত।
(বিচারক : যদি সাক্ষী তাঁর নিজস্ব উত্তর দেন তাহলে আমাকে তা পুরো লিখে নিতে হবে)।
(ভোপৎকর : আমি আমার প্রশ্ন প্রত্যাহার করছি)।
যখন অধ্যাপক জৈনকে ২১ শে জানুয়ারি আপনার কাছে আনা হল, তাঁর সঙ্গে মদনলালের সম্পর্কের বিষয়ে আপনি কিছু কি জিজ্ঞাসা করেছিলেন?
জিজ্ঞাসা করার কোন প্রয়োজন ছিল না কেননা তিনি নিজেই তা আমাকে বলেছিলেন।
যখন অধ্যাপক জৈন আপনার কাছে এই কাহিনী বলেন, রাজনীতিবিদ হিসাবে আপনার কি মনে বয়নি এটা একটা চোখে ধোঁকা দেবার মতন ব্যাপার হতে পারে, কেননা মদনলালের সঙ্গে সম্পর্কের জন্য তাঁর অপরাধমূলক দায়িত্ব থেকে তিনি নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন?
আমি এটাকে ছল হিসাবে মনে করিনি, প্রকৃত সত্য বলেই স্থির করেছিলাম।
অধ্যাপক জৈনের কাহিনী সত্য বলে মনে করার কারণসমূহ সম্পর্কে আপনি কি আদালতকে অবহিত করবেন?
কাহিনীর সত্যাসত্য বিচারের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আমার আছে কেননা আমি এগারো বছর ধরে ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ করেছি। যে সারল্যের সঙ্গে অধ্যাপক জৈন তাঁর কথা ব্যক্ত করেছিলেন তা থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তিনি সত্য কথা বলছেন। যখন অধ্যাপক জৈন তাঁর কাহিনী আমাকে বলছিলেন, ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কার্যকর হয়েছিল।
পরিশিষ্ট হিসাবে গান্ধী—হত্যা নাটকের শেষ অঙ্কের ব্যাপারটি উল্লেখ না করলে রচনাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ১০ ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯—এ বিশেষ আদালতের বিচারপতি আত্মাচরণ গান্ধীহত্যা মামলার রায় দান করেন। নাথুরাম গোড়সে ও নারায়ণ আপ্টের প্রতি প্রাণদণ্ডের বিধান হয়। পরচুরে, করকরে ও গোপাল গোড়সের প্রতি যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আজ্ঞা হয়। মদনলাল ও শঙ্কর কিস্তায়াকে সাত বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। বাগড়ে রাজসাক্ষী হওয়ায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সাভারকরের বিরুদ্ধে কোন অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। গান্ধীহত্যা মামলার আপীলের শুনানী হয় সিমলায়, জার্স্টিস ভাণ্ডারী, জাস্টিস অশ্রুরাম এবং জাস্টিস খোসলার নেতৃত্বে। ২১ জুন তারিখে এই মামলার রায় দেওয়া হয়। রায়দান প্রসঙ্গে বিচারপতিরা একমত হন এবং তাঁদের মুখপাত্র হিসাবে জাস্টিস ভাণ্ডারী যে রায় দেন তার সংক্ষিপ্তসার নিম্নে দেওয়া গল।
”আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে ফরিয়াদি পক্ষ পরচুরের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে স্থাপন করতে পারেননি। … এই কারণে তাঁকে মুক্তি দেবার নির্দেশ দেওয়া হল। … শঙ্কর কিস্তায়া হত্যাচক্রান্তের শরিক ছিল কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। … তার মনিব বাগরে অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরকের ব্যবসা করে এবং এটা সম্ভব যে এই অভিযুক্ত ওই দুটি ক্ষেত্রে অপরাধ করেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে, ন্যায়বিচারের প্রয়োজনে, বাগড়ের জবানবন্দীকে সমর্থন করে, এমন কোন অন্যনিরপেক্ষ সাক্ষ্য এক্ষেত্রে উপস্থাপিত করা হয়নি। এই কারণে আমার সিদ্ধান্তে এই যে, যদিও সন্দেহের কারণে আছে যে সে ওই দুটি আইনবিরোধী (অস্ত্র আইন ও বিস্ফোরক আইন) কাজ করেছিল, তৎসত্ত্বে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। … অবশিষ্ট আসামীদের ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। নাথুরাম এবং আপ্টে বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য একটি সংবাদপত্র চালু করেছিল। মহাত্মা গান্ধীকে তাঁর পথ থেকে নিবৃত্ত করার জন্য তারা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভও পরিচালনা করেছিল। তাদের মনে হয়েছিল মহাত্মার নীতি ও কর্মধারা দেশের স্বার্থের প্রতি আত্মঘাতী স্বরূপ। যখন তারা উপলব্ধি করে যে মৌখিক অথবা লিখিত প্রতিবাদে যখন মহাত্মা গান্ধীকে তাঁর আজীবন অনুসৃত নীতি থেকে টলানো যাবে না, তখন তারা এই অহিংসার প্রতিরূপকে হিংসাত্মক পথে জগৎ পথে জগৎ থেকে সরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। এই হত্যা পূর্বপরিকল্পিত, শীতল—রক্তপ্রসূত এবং নিষ্ঠুর এবং এই দুই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এই ঘৃণ্য অপরাধের জন্য একমাত্র মৃত্যুদণ্ডই বিধে। করকরে ও মদনলাল ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০/বি/৩০২ ধারায় অপরাধী প্রমাণিত হয়েছে। … এবং তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছে। করকরে নাথুরাম ও আপ্টের চিন্তাধারায় অনুপ্রাণিত। … মদনলালের মধ্যে তারা একটি উদ্দেশ্যসাধনের হাতিয়ার আবিষ্কার করেছিল এবং ২০ শে জানুয়ারি তারিখে বিড়লা ভবনে অনুষ্ঠিত ঘটনায় সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। … মহাত্মা গান্ধীর জীবন ২০ শে জানুয়ারিই শেষ হতে পারত। … সে কুড়ি বছর বয়স্ক বিপথচালিত যুবক, এবং মনুষ্যজীবনে পবিত্রতার উপর তার কোন শ্রদ্ধা নেই। তার বিষয়টি রাজসকালে পাঠিয়ে তাকে মার্জনা পাইয়ে দেবার কোন কারণই আমি দেখছি না।”
অদ্যাপক জৈনের সাক্ষ্য প্রসঙ্গে বিশেষ আদালতে বিচারপতি আত্মাচরণ মন্তব্য করেন :” আসামীপক্ষের আইনজীবীরা তাঁর বিরুদ্ধে এই কথা বলতে চেয়েছেন যে দিল্লিতে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় মদনলালের নাম পেয়ে তিনি সরকারি কর্তাব্যক্তিদের অনুগ্রহ পাবার জন্য এবং মদনলালের সঙ্গে তাঁর সাহচর্যের জন্য যাতে তাঁকে গ্রেপ্তার হতে না হয় সেজন্য চেষ্টা করেছিলেন। এটা একটা কষ্টকল্পিত চিন্তা বলে মনে হয়। তাঁর মত একজন সরল মানুষের পক্ষে এভারে বিষয়টি আগে থেকে দেখা সম্ভব নয়। একজন উদ্বাস্তু হিসাবে তিনি মদনলালকে দয়া করেছিলেন এবং তাকে পয়সাকড়ি দিয়েও সাহায্য করেছিলেন। এই মামলার নথিপত্রসমূহে এমন কিছু নেই যা থেকে দেখানো যেতে পারে যে তিনি মদনলাল বা আর কারও সঙ্গে কোন রহস্যময় লেনদেনে জড়িত ছিলেন। তিনি যেরকম মরীয়া হয়ে একের পর এক উচ্চ পদাধিকারীর কাছে গিয়েছিলেন তাতে তাঁর জ্ঞাত বিষয়কে তাঁদের অবহিত করানোর জন্য একাগ্র প্রচেষ্টাই চোখে পড়ে, তাঁদের কাছ থেকে অনুগ্রহলাভের কথাই ওঠে না।”
এই প্রসঙ্গে জাস্টিস ভাণ্ডারী বলেন : ”অধ্যাপক জৈনের সাক্ষ্যের কিছু বিরূপ সমালোচনা করা হয়েছে। প্রথমত বলা হয়েছে যে ১৯৪৮—এর ১২ ই জানুয়ারি তারিখে তিনি অবগত হয়েছিলেন যে একটা ভয়ঙ্কর অপরাধ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, অথচ তিনি এই খবরটি কর্তৃপক্ষকে দিতে বিরত হয়েছিলেন। … আমি দুঃখিত, এই ধারণার সঙ্গে একমত নই। … অধ্যাপক জৈন মদনলালের কথার উপর তেমন গুরত্ব আরোপ করেননি, কেননা মদনলালকে এ বিষয়ে কিছু সদুপদেশ দেওয়া হয়েছিল, এবং সে সময় বাজারে অনেক গুজবই চালু ছিল। মদনলাল তাঁকে নিজে বলেছিল যে তাঁর দেওয়া উপদেশ তাকে প্রভাবিত করেছে, সে অধ্যাপক জৈনের নিকট কৃতজ্ঞাবদ্ধ, তাঁকে সে পিতার মত মনে করে। … দিল্লি যাবার অব্যবহিত পূর্বে মদনলাল তাঁর সঙ্গে দেখা করে, এবং তখনও সে তাঁকে একথা বলেনি যে হত্যা পরিকল্পনা তার মাথায় আছে। মদনলালকে সৎ ও সোজাসুজি ধরনের মানুষ মনে কারণও অধ্যাপক জৈনের ছিল। … মদনলাল যা বলেছিল, তা নিছক কথার কথাও হতে পারে, মনের কথা নাও হতে পারে।.. এইরকম মানসিক অবস্থায় ইতিকর্তব্য নিরূপণে অধ্যাপক জৈনের দ্বিধা থাকারই কথা। কিন্তু যখন ২০ শে জানুয়ারি তারিখে বোমা ফাটানো হয়, অধ্যাপক জৈন তাঁর ভুলের গুরুত্ব বুঝতে পারেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে মদনলাল তাঁকে যে সংবাদ দিয়েছিল তা একজন উদ্বাস্তুর দায়িত্বহীন বাগাড়ম্বরের চেয়ে অনেক বেশি অর্থবহ। সেই মুহুর্তেই তিনি যথাকর্তব্যে উদ্বুদ্ধ হন। তিনি অনিবার্য পরিণতিসমূহের বোঝা নিজ স্কন্ধে গ্রহণ করেন এবং সমাজের প্রতি তাঁর কর্তব্যসাধন।”
গান্ধী—হত্যার চক্রান্তের ব্যাপারে সম্ভব সাভারকরের কোন ভূমিকা ছিল না। অধ্যাপক জৈন এখনও জীবিত আছেন এবং বর্তমান লেখকের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তাঁর মতে সাভারকরের বাড়িতে অনেকেই যাওয়া আসা করত, এবং চক্রান্তকারীরাও সেখানে বহুবার গিয়েছিল। কিন্তু সাভারকর তাদের সঙ্গে সত্যই দেখা করেছিলেন কিনা, জেখআ করলেও, এই ব্যাপারে কোন আলোচনা করেছিলেন কিনা অথবা উৎসাহ দিয়েছিলেন কিনা সে—বিষয়ে প্রমাণাভাব। সম্ভবত চক্রান্তকারীদের মনোবল বাড়ানোর জন্য ওদেরই মধ্যে দু’একজন তাঁর নাম এই ব্যাপারে সংযুক্ত করেছিল এবং অবশিষ্টদের বুঝিয়েছিল যে এই পরিকল্পনার পিছনে সাভারকরের আশীর্বাদ আছে। অধ্যাপক জৈনের মতে দত্তাত্রেয় পরচুরের একটি বিশেষ ভূমিকা এই চক্রান্তের মধ্যে ছিল। সে ছিল আপ্টের মতই একজন নাটের গুরু, কিন্তু আইনের ফাঁক দিয়ে সে গলে বেরিয়ে যেতে সমর্থ হয়। এটা অবশ্য অধ্যাপক জৈনের নিজস্ব ধারণা যা তিনি বর্তমান লেখকে কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন।
দেশ, ২৮ জানুয়ারি, ১৯৮৪