গান্ধী মহাপ্রয়াণ

গান্ধী মহাপ্রয়াণ

১৬ ই মাঘ, শুক্রবার, ভারতের দুর্দিন। গান্ধীজিকে হত্যা করিয়া নাথুরাম বিনায়ক গডসে প্রমাণ করিয়া দিল যে হিংসায় পৃথিবী আজ উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছে, তার প্রভাব ভারতবর্ষেও ব্যাপ্ত হইয়াছে। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট যে রক্তারক্তির সূচনা হয় কলিকাতার বুকে, তাহা আজ প্রসারিত হইয়াছে চট্টগ্রাম হইতে পেশোয়ারে। ইহার দাপটে কত লোকের প্রাণ গিয়াছে, কত শিশু পিতৃ—মাতৃহীন হইয়াছে, কত সহস্র স্ত্রীলোকের সতীত্ব নষ্ট হইয়াছে এবং কত কোটি টাকার সম্পত্তি লুন্ঠিত ও দগ্ধ হইয়াছে, তার হিসাব হয় নাই, কখনও হইবে বলিয়াও মনে হয় না। যে ক্ষতি আমাদের হইল, তাহা অর্থের উপর দিয়া গেলে আমাদের মনে কোন ক্ষোভ থাকিত না হয়ত। কিন্তু মুসলিম লীগ প্রবর্তিত এই অমানুষ রাজনীতি যে আমাদেরও পশুর অধম করিয় দিল, সেই অপমানে ও ধিক্কারের জ্বালায় সতর মাস পুড়িয়া পুড়িয়া গান্ধীজি আমাদের মধ্য হইতে সরিয়া গেলেন, তার গ্লানি আমাদের সামাজিক জীবনকে বহু দিন ক্লিষ্ট করিয়া রাখিবে। গান্ধীজির শ্রাদ্ধের উপলক্ষে যে কর্ম্মব্যস্ততা ছিল, তাহা আজ অবসান হইয়াছে। সমাজের মনে দেখিতেছি একটা অবসাদ।

আমাদের কবি এক দিন আমাদের শুনাইয়াছিলেন, ”মোর তরে না করিও শোক।” গান্ধীজিও তাঁর জীবনে এই শিক্ষাই আমাদের দিয়া গিয়াছেন যে ভগবানের কাজ তিনি করিয়া যাইতেছেন, সেই কাজের প্রয়োজনেই তাঁহাকে বাঁচিয়া থাকতে হইবে এবং সেই কাজের প্রয়োজনে যত দিন তাঁহার উপস্থিতি প্রয়োজন, ততদিনই তিনি বাঁচিয়া থাকিবেন। তিনি অবশ্য আমাদিগকে শুনাইয়াছিলেন যে এক শত পঁচিশ বৎসর তিনি বাঁচিয়া থাকতে চান তাঁর কল্পনার ও আকাঙ্ক্ষার ভারতবর্ষকে গড়িয়া তুলিবার জন্য। সেইকাজ অপূর্ণ রাখিয়া গেলেন। ইহার কারণ আমরা খুঁজিয়া পাই না। একটা কথা আমাদের যন্ত্রণা দিতেছে। যে হিংসার উন্মাদনা পনের মাস ভারতবর্ষের বুকে তাঁহাকে দেখিতে হইয়াছে, তাহার ফলে বাঁচিয়া থাকবার স্পৃহাও তাঁহার মন হইতে শিথিল হইয়া যাইতেছিল। অনেক সময় তাই মনে হয়, নাথুরামকে নিমিত্তরূপে ব্যবহার করিয়া তাঁহার প্রাণের ভগবান ভক্তের যন্ত্রণার লাঘব করিলেন কি?

আজ গান্ধীজির পঞ্চভূতসমষ্টি দেহের অনুকণার ভস্ম ভারতের নদ—নদীর জলস্রোতের বুকে ভাসাইয়া দিয়া আমাদের দেশের লোক ফিরিয়াছে পূজামন্দিরে। সাধারণ মানুষ এই দৃশ্যে অভিভূত হইয়া পড়ে। সাধক যাঁহারা তাঁহারা শূন্য মন্দিরে ভাব—মূর্তির প্রতিষ্ঠা করেন; সাধনায় নিমগ্ন হইয়া যান মূর্ত্তিকে প্রাণময় করিতে। ভারতের দিকে দিকে সেই অস্ফূট আকাঙ্ক্ষাই ধ্বনিত হইয়া উঠিবার জন্য চেষ্টা করিতেছে। ভারতের ”মহাত্মা’ যে আদর্শের প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন তপস্যা করিয়া গিয়াছেন, যে প্রেমধর্মের প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনের শেষ কয়েক মাস সীমাহীন আকূতি এবং অদম্য উৎসাহ লইয়া দিল্লীর প্রাসাদে—প্রান্তরে প্রাণান্ত চেষ্টা করিয়াছেন, সেই ব্রত আজও অপূর্ণ। বোধন তিনি আরম্ভ করিয়া গিয়াছেন, হিংসুক তাহার মঙ্গলঘট ভাঙ্গিয়া দিয়াছে। অসমাপ্ত পূজা আমাদের সমাপ্ত করিতেই হইবে। এই ব্রত ও এই পূজা আমাদের জাতীয় জীবনের মরণ—বাঁচন সমস্যায় পরিণত হইয়াছে। এই সমস্যা সমাধান না করিলে আমাদের নব অর্জিত স্বাধীনতা ব্যর্থ হইবে, অসার্থক হইবে। ভারতের সমাজের বুকে দ্বেষ ও অনৈক্য জিয়াইয়া রাখিয়া এই স্বাধীনতা আমরা রক্ষা করিতে পারবি না, এই আশঙ্কায় গান্ধীজি আমাদের আত্মস্থ করিতে প্রাণপাত করিয়াছেন। গুপ্ত হত্যাকারীর গুলিতে তাঁহার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। কিন্তু তাঁহার অশরীরী আত্মা ভারতবর্ষের এই কর্ত্তব্য নির্দেশ করিতেছে।

আজ এই নির্দেশের কথাই আমাদের নতুন করিয়া ধ্যান করিতে হইবে। গান্ধীজির উপস্থিতির সময় এই নির্দেশ সম্বন্ধে আমরা নানা সংশয় প্রকাশ করিয়াছি, এই নির্দেশ লইয়া নানা তর্ক করিয়াছি। এই নির্দেশের ও তার সার্থকতার আলোচনা লইয়া সমাজতন্ত্রের মহাভারত সৃষ্টি হইয়াছে। আজ ভারতবর্ষের হিন্দুকুশ পর্ব্বত হইতে চন্দ্রনাথ পাহাড় বেষ্টিত ভূ—খণ্ডের মধ্যে যে উন্মত্ততার সৃষ্টি হইয়াছে, যে সমাজধ্বংসী কার্য্যকলাপ অনুষ্ঠিত হইয়াছে, সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের নতুন করিয়া গান্ধীজির নির্দেশের প্রকৃত মর্ম—কথা বুঝিয়া লইতে হইবে। ১৯১৯ সালের মধ্যভাগে যখন তিনি আসিয়া আমাদের রাজনীতিক জীবনের পুরোভাগে দাঁড়াইলেন, তখন আমাদের রাজনীতিক জীবন নানাকারণে ছত্রভঙ্গ। বিপ্লবী ও সন্ত্রাসবাদী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইয়া পড়িয়াছে, সব রাজনীতিক আন্দোলন বন্ধ্যা বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। দেশের জনগণের মন এই সব ভাবনা চিন্তা সম্বন্ধে নিরুৎসুক; তাহা আপনার ভাবনায় মগ্ন। সেই মন ছিল মূঢ়, ম্লান, মূক; সে ভাবনা সম্বন্ধে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের কোন সম্যক জ্ঞান ছিল না। শিক্ষিত সমাজ নিজেদের অভিজ্ঞতার সাহায্যে, সমাজজীবনের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের তাড়নায়, জনগণ মনের ভাবনা—চিন্তার একটা অর্থ করিয়া তাহা প্রচার করিতেছিলেন। পরদেশী শাসন ও শোষণের ফলেই যে এই দারিদ্র্যের সৃষ্টি হইয়াছে, তাহা প্রমাণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। শিক্ষিত লোকের মনে অপমানের জ্বালা, দেশের জনসাধারণের মধ্যে দারিদ্র্যের তাড়না— এই ভাবের ও বাস্তবের চাপে একটা বিক্ষোভ ঘনীভূত হইয়া প্রকাশের নতুন পথ খুঁজিতেছিল। গান্ধীজি সেই পথ কাটিয়া দিলেন। গোপনতার, বিপ্লবী ও সন্ত্রাসবাদী গোপনতার, বদ্ধ ঘরে মানব মন পীড়িত হইতেছিল; গান্ধীজি ভাঙিয়া দিলেন সে গোপনতার প্রয়োজন; রাজপথের মাঝে ”প্রকাশ্য ষড়যন্ত্র” (open conspiracy) ঘোষণা করিয়া সকলের মন—বুদ্ধিকে করিলেন মুক্ত; লোকের কর্মপ্রচেষ্টাকে করিলেন সহজ গতিশীল।

সেইজন্য দেখিতে পাই অসহযোগ আন্দোলনে আবালবৃদ্ধবনিতা মুক্তিস্নানের মতন একটা সহজ আনন্দ লাভ করিয়াছে। ”স্বদেশী” যুগে, বিপ্লবী ও সন্ত্রাসবাদী যুগে আমাদের দেশের মেয়েরা নানাভাবে সাহায্য করিয়াছিলেন নিজেদের স্বভাবসিদ্ধ আবরুর পশ্চাৎ হইতে অভিভাবকদের অমতে ও অগোচরে। এই গোপনতার মধ্যে ছিল একটা ভয়, একটা উদ্বেগ, একটা অনিশ্চয়তার আশঙ্কা। গান্ধীজি—প্রবর্তিত পথে এই ভয়, উদ্বেগ, আশঙ্কা দূরীভূত হইল। মুক্ত আকাশের নীচে, মুক্ত প্রান্তরে দেশের মেয়েরা নির্ভীক কর্ত্তব্যের একটা সন্ধান পাইলেন। তাহাও ত্যাগের পথ, জীবনব্যাপী সাধনার পথ, নীরব, শান্ত পল্লী—পথের মত।

এই সাধনা আত্মশুদ্ধির; এই সাধনা সংস্কার বর্জনের, যে সংস্কার হিন্দু মুসলমানকে পরস্পর হইতে পৃথক করিয়া রাখিয়াছে, হিন্দু সমাজের বুকের উপর দিয়া ফালি কাটিয়া সবর্ণ অবর্ণ ভেদের সৃষ্টি করিয়াছে এবং ভেদকে বিস্তত্রাদ্দর করিয়া সহস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গণ্ডীতে পরিণত করিয়াছে ভারতের হিন্দু—মুসলমান সমাজব্যবস্থাকে। এই সহস্র গণ্ডী ভাঙিবার জন্য গান্ধীজি আবেদন করিলেন মানুষের ভ্রাতৃত্বের নামে। সাম্প্রদায়িক প্রীতির ধ্বনি এই আকুতির বহিঃপ্রকাশ। ইংরেজের ব্যবসায় নীতির কল্যাণে ভারতবর্ষের নানা শিল্প বিনষ্ট হইয়াছে; গৃহে গৃহে সেই শিল্প চলিত। এই ধ্বংসের ফলে কোটি কোটি লোক বৃত্তিহীন হইয়া একমাত্র কৃষিকার্য্যের উপর নির্ভরশীল হইয়া পড়িল, এবং বৎসরের মধ্যে প্রায় চারি মাস কর্মহীন, বেকার জীবনযাপন করিতে বাধ্য হইল। ভারতের প্রাচীন অর্থনীতিক ব্যবস্থায় দরিদ্র, অপুত্রক বিধবার পর্যন্ত একটা বৃত্তি ছিল; ”চরকা আমার নাতিপুতি” বলিয়া সে নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিত। ইংরেজ সে বৃত্তি, সে ভরসা তাহার কাড়িয়া হইল। এই বৃত্তিহীনতার যন্ত্রণার কথা আমাদের কবি গাহিয়াছেন— ”তাঁতি কর্মকার করে হাহাকার”—এইভাবে দুরবস্থার বর্ণনা করিয়াছেন। এই দেশব্যাপী বৃত্তিহীনতার প্রতিকার চেষ্টা অনেকেই করিয়াছেন কলকারখানায় প্রতিষ্ঠা করিয়া। কিন্তু যেখানে চারি—পাঁচ কোটি লোক বৃত্তিহীন, বেকার, সেখানে এক কোটি লোকের নতুন বৃত্তির ব্যবস্থা করিয়া সমস্যার সমাধান হয় না। সেইজন্য গান্ধীজি চরকা তাঁতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলিয়া গ্রাম্য শিল্পের প্রতি দেশের শিক্ষিত লোকের কর্তব্যের কথা মনে করাইয়া দিলেন। এই প্রস্তাবে উপার্জন হয়ত প্রচুর নয়, কিন্তু কর্মহীনতার যে গ্লানি দেশের শরীর—মনকে অচ্ছন্ন করিয়া অপটু করিয়া তুলিতেছিল তাহা ত দূর হইতে পারে। সেইজন্য আপদ্ধর্ম রূপেও এই নতুন সংগঠনের জন্য আহ্বান করিতে গান্ধীজি দ্বিধা করিলেন না। বর্তমান যুগের যন্ত্রদানবের নানা ব্যবস্থার তুলনায় চরকা তাঁত তুচ্ছ হইতে পারে। কিন্তু এই যন্ত্রদানবের কল্যাণে মানুষ এত পরনির্ভরশীল হইয়া পড়িয়াছে যে তাহার আত্মবিশ্বাস ফিরাইয়া আনিতে হইলে তাহাকে হইতে হইবে স্বয়ং—সিদ্ধ, নিজের প্রয়োজন মিটাইবার জন্য আত্মনির্ভরশীল। এই ব্যবস্থার প্রস্তাব করিয়া গান্ধীজি যুগধর্মকে অস্বীকার করিয়াছেন বলিয়া অনেকে তাহা গ্রহণ করিতে পারিলেন না। শিক্ষিত অশিক্ষিত প্রায় কেহই এই নতুন সত্য মনে প্রাণে গ্রহণ করিতে পারিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না।

ইংরেজের শাসন ও শোষণ ব্যবস্থা অসহযোগ আন্দোলনের আঘাতে দুর্বল হইল, কিন্তু তাহার পুরাতন কাঠামোটা প্রায় অটুট থাকিয়া গেল। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে এই সময় যে হানাহানি উগ্র হইয়া উঠিল, তাহার পূর্ণ সুযোগ ইংরেজ গ্রহণ করিতে পশ্চাৎপদ হইল না। প্রায় আট বৎসর ইংরেজের নানা কৌশল আমাদের সংগঠন শক্তিকে আঘাত করিয়াছে। লর্ড বার্কেনহেড ভারতবাসীর প্রতিনিধিকে বাদ দিয়া আমাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপায় উদ্ভাবনের জন্য পাঠাইলেন সাইমন কমিশনকে। ভারতবর্ষের সমস্ত রাজনীতিক দল একত্র হইয়া তাহাতে বাধা দিল; ফলে সাইমন কমিশনের রিপোর্ট বস্তাপচা হইয়া পড়িয়া রহিল। লাহোর কংগ্রেসে আনুষ্ঠানিকভাবে যখন পূর্ণ স্বরাজের আদর্শ গৃহীত হইল, তখন গান্ধীজি আর একবার রাজনীতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্ব গ্রহণ করিলেন। লবণ আইন ভঙ্গ করিয়া ইংরেজের রাষ্ট্র শক্তিকে তিনি যে সংগ্রামে আহ্বান করিলেন তাহার মধ্যে দেশের লোকের যে সহযোগিতা পাওয়া গেল তাহা অভূতপূর্ব। অসহযোগের গণজাগরণকে তাহা ম্লান করিয়া দিয়াছিল বলিয়া মনে করিলে ভুল হইবে না। মুসলমান জনসাধারণ ইহাতে তেমন সাড়া দেয় নাই। কিন্তু মুসলমান যাঁহারা এই আন্দোলনে যোগদান করিলেন তাঁহারা খেলাফৎ আন্দোলনের ধর্মোন্মাদনায় করিলেন না; একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে, রাজনীতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তাঁহারা কারাগার ও অন্যান্য অত্যাচার বরণ করিয়া লইলেন। এই সময়েই মুসলমানগরিষ্ঠ উত্তর—পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে খান আবদুল গফুর খাঁর নেতৃত্বে এক অপূর্ব গণজাগরণ স্ফূর্ত হইয়া উঠে। স্বভাবতঃ সীমান্তের দুর্দ্ধর্ষ পাঠানকে তিনি অহিংসামন্ত্রে দীক্ষা দিয়া এক নতুন কর্মধারার সৃষ্টি করিলেন; দেশ তাঁহাকে ”সীমান্ত গান্ধী” নামে অভিহিত করিয়া এই নতুন কর্মধারাকে অভিনন্দিত করিল।

গান্ধীজি ও ভারতবর্ষের বড়লাট লর্ড আরউইনের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হইয়া এই আন্দোলনের শেষ হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তগত করার পক্ষে এই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ কোন সার্থকতা নাই। কিন্তু দেশের লোক গান্ধী—আরউইন চুক্তির বলে এই ভরসা পাইল যে তাহাদের সংগঠন শক্তি বাড়িয়াছে এবং অদূর ভবিষ্যতে কংগ্রেসের হাতেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ন্যস্ত হইবার পটভূমি প্রস্তুত হইতেছে। লর্ড আরউইনের পরবর্তী বড়লাট লর্ড উইলিংডন কংগ্রেসের এই শক্তিবৃদ্ধির নিশ্চয়তা সহজ মনে গ্রহণ করিতে পারিলেন না। সুতরাং দ্বন্দ্ব আবার ফুটিয়া উঠিল; দ্বিতীয় আইন অমান্য আন্দোলন আরম্ভ হইল। দমননীতির দাপটে দেশের মনে যে বিদ্রোহের আগুন ধিকি ধিকি করিয়া জ্বলিতেছিল তাহা নতুন পথে আত্মপ্রকাশ করিল ১৯৩৫ সালের আইন অনুসারে নির্বাচনের উপলক্ষে। এই নির্বাচনে সর্বদল নিরপেক্ষ হইয়া এগারটা প্রদেশের মধ্যে আটটায় কংগ্রেসের জয়লাভ হইল। কংগ্রেসের প্রভাব এইভাবে প্রমাণিত হইলেও বিরোধের অবসান হইল না। দুই বৎসর যাইতে না যাইতে আবার বিরোধ দেখা দিল।

প্রচারবিদ ইংরেজ মুখে প্রচার করিয়া দিল যে ভারতবর্ষের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভারতবাসীর ক্ষমতা লন্ডন হইতে নিয়ন্ত্রিত হয় না যেমন হয় না কানাডা,অস্ট্রেলিয়া রাষ্ট্র ব্যাপারে। এই দুই রাষ্ট্র প্রকৃত পক্ষে স্বাধীন; লন্ডন—প্রবাসী রাজার নামে শাসনকার্য্য চলিলেও, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মন্ত্রিসভার কর্তৃত্বে ও পরামর্শে রাজাকে চলিতে হয়। ব্রিটিশ দ্বীপের মন্ত্রী—সভার এই বিষয়ে কোন কথা বলিবার অধিকার নাই। এই ব্যবস্থার নাম Dominion Status। ইংরেজ বলিল, ১৯৩৫ সালের আইনে এইরূপ অধিকারের কোন ইঙ্গিত না থাকিলেও ভারতবর্ষে Dominion Status in action, ভারতবর্ষে এই স্বাধিকার কার্য্যতঃ প্রচলিত আছে। এই কথাটা যে কত মিথ্যা তাহা প্রমাণিত হইল যখন বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বাধিয়া উঠিল। কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্র—সভা আলোচনা করিয়া, তর্ক করিয়া স্থির করিল জার্মানির বিরুদ্ধে ও ব্রিটেনের পক্ষে তাহাদের যুদ্ধে যোগদান করা উচিত; দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্র—সভায় এই বিষয়ে ভোট লইয়া টায়ে টায়ে ব্রিটেনের পক্ষেই যোগদান বাঞ্ছনীয় মনে করা হইল; আয়ার (দক্ষিণ আয়ারল্যান্ড) ত ব্রিটেনের এই জীবন—মরণ সমস্যায় নিরপেক্ষ থাকাই স্থির করিল এবং ব্রিটেন Dominion Status —এর এই স্বাধিকার মানিয়া লইল। কিন্তু ভারতবর্ষের বেলায় ইংরেজ এই সংযম দেখাইতে পারিল না। কোনও ভারতীয় নেতাকে বা কেন্দ্রীয় পরিষদকে জিজ্ঞাসা না করিয়াই ব্রিটেন ভারতবর্ষের পক্ষে, ভারতবর্ষের অছিরূপে, জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া বসিল; ভারতবর্ষকে ইউরোপের যুদ্ধে ঠেলিয়া দিল।

কার্য্যের দ্বারা ইংরেজ প্রমাণ করিয়া দিল যে ভারতবর্ষ তাহার খাস জমিদারী। এই অপমান কংগ্রেস মানিয়া লইতে পারিল না; কংগ্রেস মন্ত্রীমণ্ডলীর আটটি প্রদেশের শাসন কার্য্যের দায়িত্ব ত্যাগ করিল। আবার প্রমাণিত হইল যে ভারতবর্ষের জনমত পদদলিত করিয়া, দেশের জনমতের বিরুদ্ধে ইংরেজ শাসন ও শোষণকার্য চালাইতেছে। গান্ধীজি এই অপমানজনক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কংগ্রেস মন্ত্রীমণ্ডলীর পদত্যাগ বাঞ্ছনীয় মনে করিলেও, ব্রিটেনের বিপদের সময় তাহার যুদ্ধ—প্রচেষ্টাকে কোনরূপ বাধা দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। তাঁহার ধর্মবুদ্ধি এইরূপ কাজের পক্ষে রীতিমত বিঘ্ন ঘটাইয়া বসিল। বিপন্ন শত্রুর গায়ে হাত তোলা প্রাচীন রণনীতির মতে অধর্ম। এই ভাবাবেশে গান্ধীজি এই সমস্যার সময় তাঁহার কর্তব্য স্থির করেন নাই; তাঁহার চক্ষে ব্রিটেন শত্রু ছিল না, জার্মানীও মিত্র ছিল না, সমদর্শী তিনি; কর্তব্য স্থির করিয়াছিলেন ধর্মবুদ্ধির ও প্রেমধর্মের প্রেরণায়। পাপী অপাপী সমজ্ঞান, এই শিক্ষা যুগযুগান্ত ধরিয়া ভারতবর্ষের জনগণকে চালিত করিতেছে এবং সে শিক্ষা জীবনে প্রতিফলিত করিবার জন্য গান্ধীজি সাধনা করিয়া যাইতেছিলেন। এই সনাতন ঐতিহ্য রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে প্রবর্তন করিয়া এক দ্বিধা ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করিল যাহা কংগ্রেসের চিন্তা ও কর্মধারাকে অস্বচ্ছ ও জটিলতাসঙ্কুল করিয়া তুলিল। গান্ধীজির এই মনোভাবের বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্র বসু প্রতিবাদের ধ্বনি তুলিলেন; ইংরেজের বিপদ ভারতবর্ষের সুযোগ— এই বাস্তব বুদ্ধির আলোকে চলিবার জন্য তিনি ব্যর্থমনোরথ হইয়া দেশ ত্যাগ করিলেন এবং ইউরোপ ও পূর্ব—এশিয়ায় ইংরেজের বিরুদ্ধে আয়োজন করিয়া প্রমাণ করিলেন যে, ভারতবাসী রাষ্ট্র গঠন করিতে পারে ও সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করিতে পারে। ”নেতাজীর” চেষ্টা ব্যর্থ হইতে পারে। কিন্তু যখন ”আজাদ হিন্দ সরকার” ও ”আজাদ হিন্দ সৈন্যবাহিনীর” কথা দেশের লোক জানিতে পারিল, তখন জন—গণ—মনের উচ্ছ্বাস গান্ধীজির আদর্শের অনুকূল ছিল না, এই কথা স্বীকার করিয়া লইতে হইবে।

গান্ধীজির মহানুভবতার সম্মান ব্রিটিশ শাসক সম্প্রদায় দেখাইতে পারিল না। যুদ্ধ—বিগ্রহের বিরুদ্ধে গান্ধীজির মনোভাব সর্বজনবিদিত। কংগ্রেসের নেতৃমণ্ডলী সকলেই এই মনোভাবের সমর্থক ছিলেন না। ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপরিচালনায় ভারতীয় জনগণের অধিকার স্বীকৃত হইলে তাঁহারা ব্রিটিশের বিপদে সাহায্য করিতে পারেন, এই ভাবের প্রস্তাব নিখিল—ভারত জনগণের অধিকার স্বীকৃত হইলে তাঁহারা ব্রিটিশের বিপদে সাহায্য করিতে পারেন, এই ভাবের প্রস্তাব নিখিল ভারত কংগ্রেসের কমিটির ১৯৪০ সালের জুলাই মাসের এক অধিবেশনে পাস হইয়াছিল। এই প্রস্তাব গ্রহণের ফলে গান্ধীজি প্রায় দুই বৎসরের জন্য কংগ্রেসের নেতৃত্ব হইতে সরিয়া দাঁড়ান। কারণ ভারতবর্ষের নামে নৈতিক সাহায্য ছাড়া অন্য কোন প্রকার সাহায্য ব্রিটেনকে দিতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। এই মতভেদের মীমাংসা কখনও হয় না; তাঁহার দেহত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত রাষ্ট্ররক্ষায় সংগঠিত সামরিক শক্তি প্রয়োগের সীমা কোথায় তাহার কোন মীমাংসা হয় না। এই যুদ্ধের সময় কংগ্রেস—নেতৃবর্গ ঘোষণা করেন যে তাঁহারা ইংরেজের হাত হইতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা উদ্ধার করিবার জন্য হিংসা ও বল প্রয়োগের পক্ষপাতী নন, কিন্তু তাঁহারা এই কথা দিতে পারেন না যে স্বাধীন ভারতে রাষ্ট্রের রক্ষার জন্য বলপ্রয়োগের প্রয়োজন হইবে না।

ভারতবর্ষের রাষ্ট্রজীবনের উপর ব্রিটিশ কর্তৃত্বের অবসান হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট। তারপর সাড়ে পাঁচ মাস গান্ধীজি বাঁচিয়াছিলেন; নতুন রাষ্ট্রপরিচালনায় তাঁহার পরামর্শ ও উৎসাহ পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু প্রমুখ কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের মন্ত্রীবৃন্দ লাভ করিয়াছেন। রাষ্ট্রশাসন ও রক্ষার ব্যাপারে বলপ্রয়োগে প্রয়োজনে যে সমস্যা গান্ধীজির মতকে কেন্দ্র করিয়া সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহার সুমীমাংসা হয় নাই। ইহা স্বীকার্য্য ও হিংসা ও বলপ্রয়োগের দ্বারা কোন বিষয়ের বা বিবাদের চূড়ান্ত সমাধান হয় না। কিন্তু মানুষের বুদ্ধি, রাজনীতিক বুদ্ধি আজ পর্যন্ত এমন কোন অস্ত্র আবিষ্কার করিতে পারিল না যার প্রয়োগে অবিচারের শেষ হয়। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বলপ্রয়োগের স্থান নাই; ব্যষ্টির শারীরিক বল সংযত করিয়াই মানুষের সমাজ গড়িয়া উঠিয়াছে। কিন্তু সমষ্টির জীবনে এই সংযমের প্রয়োগ হয় না, এই ত ইতিহাসের অভিজ্ঞতা। গত ত্রিশ বৎসর হইতে দেখা যাইতেছে যে সমষ্টির ব্যবহারে একটা অধৈর্য্য ক্রমশ বর্দ্ধিত আকারে প্রকাশ পাইতেছে; ত্রিশ বৎসরের মধ্যে দুইটা বিশ্বযুদ্ধ হইয়া গেল। ব্যষ্টির শুভবুদ্ধি বা সমষ্টির অনিচ্ছা তাহা আটকাইতে পারিল না। এক অশরীরী উন্মাদনা দেশে দেশে বিস্তারলাভ করিয়া মানুষের সহজবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে, তাহার বিচারবুদ্ধি ও স্বার্থবুদ্ধিকে হরণ করিয়া লয়। রণদেবতার পায়ে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি লোক নিজেকে বলি দেয়, জাতি বৈরের আগুনে কোটি কোটি লোকের শ্রমলব্ধ ধন পুড়িয়া যায় বন্দুক কামানের বারুদ ও গোলাবর্ষণে। এই ধ্বংসের সার্থকতা কিছুই নাই, এ কথা মুর্খেও বোঝে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি, ধর্মবেত্তা, চিন্তানায়ক, বৈজ্ঞানিক — কেহই এই ধ্বংসলীলার অবসানে কোন পথ আবিষ্কার করিতে পারিলেন না।

পরাধীন ভারতবর্ষের একজন লোক এই যুগসন্ধিক্ষণে মানুষের এই দুর্বুদ্ধি, এই লোভ, এই অপরাধের বিরুদ্ধে জীবনব্যাপী সংগ্রাম করিয়া গেলেন। যে দেশের শাসক সম্প্রদায় ভারতবর্ষের স্বাধীনতা হরণ করিয়াছিল, তাহারা অহিংসায় বিশ্বাসী নয়। তাহাদের সাম্রাজ্য রক্ষার প্রয়োজনে দুই দুইটা মহাযুদ্ধে দুই শত বৎসরের সঞ্চিত তাহাদের ধনভাণ্ডার পুড়িয়া গেল। ভারতবর্ষের উপর প্রভুত্ব অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য তাহারা নানাভাবে অত্যাচারের বিভীষিকা বিস্তার করিয়াছে। শেষে তাহারা পরাজয় স্বীকার করিয়াছে অবস্থার নিকট, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সীমাহীন ক্ষতির নিকট। মনুষ্য সমাজের যে আকূতি মহাত্মা গান্ধীকে অবলম্বন করিয়া প্রকাশ পাইয়াছিল এই নতি স্বীকার তাহার নিকট হইলে পৃথিবী আজ স্বর্গরাজ্যে পরিণত হইত। স্বল্পবিশ্বাসী আমরা আজও ভাবিতে পারিতেছি না যে আমাদের একজন তাঁহার সাধনার বলে এ অসাধ্য সাধন করিয়াছেন; ইংরেজ অহিংসার নিকট পরাজয় মানিয়া লইয়াছে। একজন বিদেশী সাংবাদিক কিন্তু যুদ্ধোত্তর যুগের সমস্ত ঘটনা পর্য্যালোচনা করিয়া এই তত্ত্বই প্রতিষ্ঠা করিতে চেষ্টা করিয়াছেন যে গান্ধীজি জয়লাভ করিয়াছেন। অর্থবলের সাহায্যে নয়, বলপ্রয়োগ দ্বারা নয়, খুব সুসংগঠিত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে নয়। একটি বিশ্বাসের প্রয়োগের দ্বারা তিনি বিজয়ী হইয়াছেন; মন মুখ এক হইলে যে শান্তি লাভ করা যায় তাহার সাহায্যেই তিনি জয়লাভ করিয়াছেন। উপায় ও আদর্শের সততা রক্ষা করিলে যে আধ্যাত্মিক শক্তির উদ্ভব হয়, তাহার সাহায্যেই তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যায়কে স্তব্ধ করিয়াছেন, বিধ্বস্ত করিয়াছেন। লুই ফিসারের ”গান্ধী ও স্ট্যালিন” এই বইয়ের কথাগুলি অনুধাবন করিলে এ তত্ত্বই প্রতিষ্ঠিত হয়:

”Gandhi stood against the might of the British Empire– and won. He did it without money, with violence, without much organization. He did it with an idea, and through the power that comes in honest means and honest words.” কংগ্রেস সম্পর্কে মহাত্মা গান্ধীর শেষ রচনা ‘হরিজন’ পত্রিকায় মহাত্মা গান্ধী ”Congress position” শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। এইটিই তাঁহার শেষ রচনা প্রবন্ধটির মর্মানুবাদ এখানে দেওয়া হইল:

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দেশে সর্ব্বপ্রাচীন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। কংগ্রেস অহিংস নীতি অনুসরণ করিয়া বহুবার স্বাধীনতা—সংগ্রাম চালাবার পর বর্ত্তমানে ইহার অস্তিত্ব বিলোপ হইতে দেওয়া চলে না। একমাত্র জাতি নিশ্চিহ্ন হইলেই কংগ্রেস ধ্বংস হতে পারে। প্রাণবন্ত বস্তু ক্রমবর্দ্ধনশীল — অন্যথায় ধ্বংস অবধারিত। কংগ্রেস রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করিয়াছে — আর্থিক, সামাজিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে তাহাকে স্বাধীনতা লাভ করিতে হইবে। রাজনৈতিক বন্ধন মুক্তি অপেক্ষা শেষোক্ত ক্ষেত্রগুলিতে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা অধিকতর কঠোর। কারণ উহা সংগঠনমূলক — উন্মাদনা সৃষ্টিকারী বাহ্যাড়ম্বর ইহার মধ্যে কিছুই নাই। প্রকৃত গঠনমূলক পরিকল্পনাকে কার্যকরী করার ক্ষেত্রে দেশের নরনারী নির্ব্বিশেষে সহযোগিতা প্রয়োজন।

লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাবার ক্ষেত্রে অপরিহার্য্য প্রাথমিক অধিকার মাত্র সংগ্রেস লাভ করিয়াছে। অগ্নিপরীক্ষা এখনও বাকি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুকঠোর পথে যাত্রা করিয়া কংগ্রেস কত দুর্নীতি প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিয়াছে। এইগুলি নামে মাত্র জনপ্রিয় ও গণতন্ত্রসম্মত। এই অবাঞ্ছিত পরিণতি হইতে অব্যাহতি লাভের উপায় কি?

কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্য—সংক্যা কোনকালেই এক কোটির অধিক হয় নেই। এক কোটি নরনারী সদস্য হইয়াছেন ইহাও অবশ্য সঠিকভাবে নির্ণয় করা চলে না। এক্ষণে কংগ্রেস সদস্য—তালিকায় সেই বিশেষ রেজিষ্টারটি অবশ্যই বাতিল করিতে হইবে। যাহাদের কোনরূপ পরিচয় জানা যায় না, এইরূপ লক্ষ লক্ষ সদস্যের নামের তালিকাসম্বলিত অজ্ঞাত রেজিষ্টার আছে। ভোটদান ক্ষমতাসম্পন্ন নরনারীর তালিকার অনুরূপভাবে এক্ষুণি কংগ্রেসের রেজিষ্টার তৈরি হওয়া কর্তব্য। উহার মধ্যে কোন ভুয়ো নাম না থাকে এবং কোন ব্যক্তির নাম বাদ না যায়, তৎপ্রতিই কংগ্রেসকে লক্ষ্য রাখিতে হইবে। এই রেজিষ্টারে জাতির সেবকদের তালিকা থাকিবে এবং উক্ত কর্মীদের উপর যখন যে কার্য্যের ভার প্রস্তুত হইবে তাহা তাঁহারা সুসম্পন্ন করিবেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ বর্ত্তমানে মুখ্যতঃ শহরবাসীদের লইয়া উক্ত তালিকা প্রস্তুত হইবে। তাঁহাদের অনেককেই হয় ভারতের পল্লিগুলিতে কাজ করিতে হইবে। পল্লী—অঞ্চল হইতে সংগৃহীত কর্ম্মীর সংখ্যা ক্রমশঃ বৃদ্ধি করতে হইবে।

উল্লিখিত দেশসেবকেদর আইনসম্মতভাবে স্ব—স্ব অঞ্চলের নরনারীর সেবায় আত্মনিয়োগ করিতে হইবে। বহু নরনারী ও বহু দল তাঁহাদের খোসামোদে প্রবৃত্ত হইবেন। খাঁটি কর্ম্মীরাই সাফল্যলাভ করিতে সমর্থ হইবেন। যেরূপ দ্রুতগতিতে কংগ্রেসের মর্যাদা হ্রাস পাইতেছে, একমাত্র উল্লেখিত নীতি অনুসরণদ্বারা ইহা পুনরায় সুপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। কিছুদিন পূর্ব্ব পর্য্যন্ত কংগ্রেস জাতির সেবক ঈশ্বরের ভৃত্য ছিল। আজ কংগ্রেসকে ঘোষণা করিতে হইবে যে, ঈশ্বরের ভৃত্যদের প্রতিষ্ঠান ব্যতীত ইহা অপর কিছুই নহে। কংগ্রেস যদি ক্ষমতালাভের অবাঞ্ছিত দলাদলিতে লিপ্ত হয় তাহা হইলে অচিরাৎ দেখা যাইবে যে, কংগ্রেসের অস্তিত্ব লোপ পাইয়াছে। ভারতের রাজনীতি ক্ষেত্রে কংগ্রেস আজ অপ্রতিদ্বন্দ্বী নহে।

এই সম্পর্কিত আলোচনার ইহা ভূমিকামাত্র — শরীর ভাল থাকিলে এবং সময় পেলে দেশসেকবগণ কীভাবে দেশের পূর্ণবয়স্ক নরনারী নির্ব্বিশেষের শ্রদ্ধাভাজন হইতে সমর্থ হইবেন, সেই সম্পর্কে ‘হরিজনে’ বিস্তারিত আলোচনা করিব।

গান্ধীজীর প্রতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিগত ৩০ শে জানুয়ারি (১৬ ই মাঘ) শুক্রবার বিকালে আততায়ীর গুলির আঘাতে মহাত্মা গান্ধীর জীবন—প্রদীপ নির্ব্বাপিত হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় দিল্লির বেতার—কেন্দ্র হইতে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু পরলোকগত মহামানবের প্রতি নিম্নোক্ত রূপ শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন,—

আমার দেশের ভাই—বোনেরা, এক নিদারুণ দুঃখশোকের অন্ধকার দেশের চারিদিক ছাইয়া ফেলিয়াছে। এই অবস্থায় আমি আপনাদের কি কথা শুনাইব? কেমন করিয়া আমি আপনাদের বলি যে, আমাদের বাপুজি সমগ্র জাতির জনক আর ইহলোর নেই! আর তাঁহাকে চক্ষে দেখিব না। দেশের নানা দুঃখ—দুর্যোগে আর তাঁহার কাছে মন্ত্রণার জন্য ছুটিয়া যাইতে পারিব না। দেশের এই পরম দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করিতেও আমার মন সরিতেছে না। যে অনির্বাণ দীপশিখা সুদীর্ঘকাল সমগ্র পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া ছিল তাহা বর্তমানকে অতিক্রম করিয়া ভবিষ্যতের মাঝে ব্যপ্ত হইল। সেই আলোকেই সত্যের পথে, এই সনাতন ভারতবর্ষকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে দিয়েছে। ভারতের বর্তমান দুঃখসঙ্কুল দিনে মহাত্মাজীর বাঁচিয়া থাকিবার কতই না প্রয়োজন ছিল, অথচ তিনি নেই। এক উন্মাদ গান্ধীজীর জীবননাশের কারণ হইল। যাহা হইবার তাহা হইল কিন্তু যে বাণী গান্ধীজী জীবনভোর আমাদের শুনিয়েছেন তাহাকে সমগ্র জাতীয় জীবনে ফুটিয়া তুলিতে আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। একনিষ্ঠ সৈনিকের ন্যায় তাঁহার দীপবর্ত্তিকা লইয়া আমাদের অগ্রসর হতে হবে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মাঝে এমন কোন খলন যেন না থাকে ভীষণ দুর্দ্দিনে হিংসা, ভীরুতা ও সকল ক্ষুদ্র কলহের চিরতরে অবসান হোক।

অনেকে গান্ধীজীর দেহ কয়েক দিন রক্ষা করিবার কথা বলিয়াছেন। ইহাতে ভারতের বিভিন্ন স্থান হইতে শেষ দর্শনেচ্ছু অগণিত দেশবাসী আসিয়া তাঁহাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করিবার সুযোগ লাভ করিবেন। জীবিতাবস্থায় গান্ধীজী বারবার ইহার বিরোধিতা করিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন। সেইজন্য সেইজন্য বহু লোকের এই প্রকার অভিলাষ থাকা সত্বেও গান্ধীজীর অন্তিম ইচ্ছাই পূর্ণ করিতে হইবে। শনিবার সকাল সাড়ে এগারোটায়ে শবযাত্র যমুনার ধারে নীত হইবে। বিকাল চারটে নাগাদ তাঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমআপ্ত হইবে। কোন পথ ধরিয়া এই শবযাত্রা যমুনার ধারে নীত হইবে। বিকাল চারটে নাগাদ যখন যমুনার তীরে গান্ধীজীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হইবে সেই সময় দিল্লির বাহিরে লোক যেন নদী অথভা সমুদ্রের তীরে গান্ধীজীর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানান। যে মহান ব্রত উদযাপনের জন্য গান্ধীজী জীবন হারাইলেন তাহাকে অন্তরে গভীরভাবে উপলব্ধি করিয়া জীবনপণ করিতে পারিলেই তাঁহাকে শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য নিবেদন করা হইবে। আজ আমরা তাঁহার জীবনের সাধনাকে স্মরণ, মনন ও পালন করিব।

সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের শ্রদ্ধাঞ্জলি

পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর পরে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ফক্ত বেতারকেন্দ্র হইতে বলেন, —

আপনারা আমার প্রিয় ভাই জওহরলালের বক্তৃতা এইমাত্র শুনিলেন। আমার বুক ব্যথায় ভরা— কি বলি, কি করি, কি না করি, কি না করি ঠিক বুঝিয়া উঠতে পারছে না। আমার মুখে কথা আসিছে না। ভারতের আজ দুঃখ শোক ও লজ্জার দিন।

আক বিকেল প্রায় চারটের সময় আমি গান্ধীজীর কাছে যাই। সেখানে তাঁহার সহিত আমার এক ঘণ্টা কাল কথাবার্তা হয়। তিনি ঘড়ি বাহির করিয়া বলেন যে, এখন প্রার্থনার সময় হইয়াছে— আমাকে যাইতে দাও। তিনি যখন রওয়ানা হইলেন তখন আমিও বাড়ির দিকে চলিলাম। বাড়ি পৌঁছাবার আগেই এক ভাই আমার নিকট আসিয়া বলিল যে, এক হিন্দু যুবক গান্ধীজীকে প্রার্থনায় যাবার সময় পিস্তল দিয়ে তিনবার গুলি করেছে। তিনি পড়ে গেলে তাঁকে তুলে নিয়ে বিরলা ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়।

খবর পেয়ে সেখানে গেলাম। দেখলাম শান্তি, সৌম্য ও ক্ষমার মধ্যে তিনি শুয়ে আছেন। সেই শান্ত চেহারার! হৃদয়ে দয়ার প্রকাশে যে চেহারা তাঁহার দেখা যায়, সেই চেহারাই দেখিলাম। আশেপাশে বহুলোক জমায়েত হইয়াছেন। কিন্তু গান্ধীজী চলে গিয়েছেন।

সম্প্রতি অনশনের ঝুঁকি নেওয়ার পরও গান্ধীজীকে বাঁচিয়া উঠিয়ে দেখা গিয়েছে। বোধ হয়, ভারতের জন্য তাঁহার কাজ তখনও অসমাপ্ত বলে তাঁহার জীবান্ত হয়নি। কিছুদিন হতে গান্ধীজীর মনে বেদনার ভাব লক্ষ্য করা যাইতেছিল। গত সপ্তাহে এক উন্মাদ হিন্দু যুবক তাঁহার উপর বোমা নিক্ষেপের চেষ্টা করে। তখনও তিনি বাঁচিয়া যান। কিন্তু এবারে এক উন্মাদ যুবকের গুলিতে তিনি চিরবিদায় নেন। ইহা লজ্জার কথা যে পৃথিবীর সেরা মানুষটি তাঁহার জীবন দিয়ে জাতির পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলেন।

কিন্তু ক্রুদ্ধ হলে ত চলবে না। এখন ক্রুদ্ধ হলে তিনি সারাজীবন ধরিয়া যাহা শিখিয়েছেন তা আমরা ভুলিয়া যাইব। গান্ধীজীর জীবিতকালে তাঁহার যে আদেশ আমরা মানি নাই, সে আদেশ তাঁহার মরণের পরে আমাদের অবশ্যই মানা কর্তব্য। আমার প্রার্থনা এই যে যত দুঃখ ব্যথাই হোক, আর যত ক্রোধ হোক, আজ ক্রোধকে সামলাইয়া লইতে হইবে। তিনি তাঁহার সারা জীবনে যাহা শিখাইয়াছেন, তাঁহার মরণের পরে সেই শিক্ষারই পরীক্ষা দিতে হইবে।

শান্তি, ভাল ব্যবহার ও বিনয় সহকারে পরস্পরের সহিত মিলিয়া মাটিতে শক্ত হইয়া দাঁড়াইতে হইবে। আমাদের উপর মহান দায়িত্ব বর্ত্তাইয়াছে। আমাদের এখন কোমর ভাঙ্গিয়া গিয়েছে। হিন্দুস্থানের মহান পুরুষ আমাদের বিরাট ভরসা চলিয়া গিয়াছেন। কিন্তু তিনি চলিয়া গেলেও আমাদের সঙ্গে সব সময়েই আছেন ও থাকিবেন। তিনি যাহা দিয়াছেন তাহা যাইবার নহে, তারা চিরকালই থাকিবে। আগামিকাল চারটার সময় তাঁহার দেহ মাটি হইতে পারে, কিন্তু তাঁহার আত্মা আমরা কি করিতেছি তাহা দেখিবার জন্য জাগিয়া থাকিবে। তিনি ত অমর।

যে যুবক পাগল হইয়া গান্ধীজী হত্যা করিল সেই যুবকের পাগলামি হইতেই হিন্দুস্থানের যুবক জাগিয়া উঠিবে বলিয়া আশা করি। গান্ধীজীর জীবন বিনিময়ে গান্ধীজীর সাধনাকে সার্থক করিবার জন্য কে জানে ঈশ্বরই হয়ত এই মৃত্যু চাহিয়াছেন।

কিন্তু আমাদের কাজ বাকি রয়েছে। আমাদের পিছাইয়া গেলে চলিবে না। একসঙ্গে দাঁড়াইয়া মিলিতভাবে সকলকে বিপর্য্যকে রোধ করিতে হইবে। যে কাজ হয় নাই, তাহাই করিতে হইবে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা, আমরা যেন গান্ধীজীর আরব্ধ সাধনাকে সফল করিতে পারি।

ভারতীয় পার্লামেণ্টে পণ্ডিত নেহরুর ভাষণ

মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর গত ২ রা ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে ইউনিয়ন পার্লামেণ্টের প্রথম অধিবেশন হয়। এই অধিবেশনে ভারতীয় ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এই শোকাবহ দুর্ঘটনার উল্লেখ করিয়া নিন্মরূপ বক্তৃতাকরেন —

এই দুর্ঘটনা (গান্ধীজীকে হত্যা) কোন উন্মাদ ব্যক্তির অনন্য নিরপেক্ষ কার্য্য নহে। দীর্ঘকাল ধরিয়া, বিশেষভাবে গত কয়েক মাস দেশে যে হিংসা ও বিদ্বেষের বিষাক্ত পরিবেশ বিরাজ করিতেছে এই ঘটনা তাহারই ফল। এই পরিবেশ আমাদিগকে আচ্ছন্ন করিয়া আছে, ইহা আমাদের বেষ্টন করিয়া আছে। মহাত্মাজী আমাদের জন্য যে কার্য রাখিয়া গিয়াছেন, তাহা করিতে হইলে আমাদিগকে এই পরিবেশের সম্মুখীন হইতে হইবে। ইহার সঙ্গে সংগ্রাম করিতে হইবে। গভর্মেণ্টের পক্ষ হইতে আমি বলিতে পারি, তাহার এজন্য কোন চেষ্টারই ত্রুটি করিবে না। কারণ আমাদের দুর্ব্বলতা বা অন্য কোন কারণে আমরা যদি ইহা না করি, এই হিংসা ও বিদ্বেষ প্রচার যদি বন্ধ না করি তাহা হইলে আমরা গভর্মেণ্টের থাকিবার যোগ্য নই, তাঁহার অনুগামী হওয়ার যোগ্য নই, মৃত মহাত্মার প্রতি শ্রদ্ধার বাণী উচ্চচারণের যোগ্যতাও আমাদের নেই।

শত শত এবং লক্ষ লক্ষ বছর পরে লোক এই সময়ের কথা মনে করিবে যে জগতে এই ঈশ্বর—প্রেরিত মহামানব বিচরণ করিতেন। তাহারা হয়ত আমাদের কথাও ভাবিবে যে, যে পবিত্রভূমিতে তাঁহার পদাঙ্ক পড়িয়াছে, আমরা যত ক্ষুদ্রই হই না কেন সেই ভূমিতে আমরাও বিচরণ করিয়াছি। আমরা যেন এই যোগ্যতা অর্জন করিতে পারি।

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মৃত্যুতে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করা, তাঁহাদের জন্য প্রশংসাবাণী উচ্চচারণ করা তাঁহাদের জন্য শোক প্রকাশ করা এই পরিষদের রীতি। আজ এই দিনে আমরা অথবা এই পরিষদের অন্য কাহারও বিশেষ কিছু বলার যোগ্যতা আছে কিনা, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত হইতে পারিতেছি না। ব্যক্তিগতভাবে এবং গভর্মেণ্টের কর্মকর্তা হিসাবে আমি বিশেষ লজ্জা অনুভব করিতেছি। জাতির সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সম্পদকে আমরা রক্ষা করিতে পারিলাম না। ইহা আমাদের ব্যর্থতা। গত কয়েক মাসে বহু অসহায় নরনারী ও শিশুকে আমরা রক্ষা করিতে পারি নাই। আমাদের পক্ষে অথবা যে কোনো গভর্মেণ্টের পক্ষে ইহা দুঃসাধ্য কর্তব্য হইতে পারে কিন্তু তবুও ইহা ব্যর্থতা। যে মহামানবকে আমরা অপরিসীম সম্মান করিতাম, ভালোবাসিতাম, তিনি যে চলিয়া গিয়াছেন, আমরাই তাহার কারণ। একজন ভারতীয় তাঁহার বিরুদ্ধে হস্ত উত্থিত করিয়াছে সেজন্য ভারতীয় হিসাবে আমি লজ্জিত। একজন হিন্দু এই কার্য করিয়াছে, সেজন্য আমি হিন্দু হিসাবে লজ্জা অনুভব করেছি। বর্তমান যুগের তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ভারতীয় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হিন্দু ছিলেন।

প্রসিদ্ধ ও মহৎ ব্যক্তিগণের স্মৃতিস্তম্ভ ব্রঞ্জ ও মার্ব্বেলে নির্মিত হয়ে থাকে। কিন্তু ঐশ্বরিক শক্তিবিশিষ্ট এই মহাপুরুষ লক্ষ লক্ষ হৃদয়কে তাঁহার জীবিতকালের মধ্যেই এমনভাবে একাত্ম করিয়া লইয়াছিলেন যে বহুলাংশে ক্ষুদ্র হইলেও আমরা সকলেই যেন সেই একই উপকরণে গঠিত হইয়া গিয়াছি। তিনি আপনার প্রভাব বিস্তার করিয়াছিলেন — রাজপ্রাসাদে নয়, শুধু নির্দিষ্ট স্থানে নয়; জনসমাবেশ নয়; দরিদ্রদের কুটিরে লাঞ্ছিত ও নিপীড়িতদের ভবনে তিনি আপনার স্থান করিয়া লইয়াছেন।

গত ৩০ বছর ধরিয়া এই দেশকে তিনিই প্রধানতঃ গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। আত্মত্যাগের এত উন্নত স্তরে তিনি উঠিয়াছিলেন যে অন্যত্র তাঁহার তুলনা বিরল। তিনি সফল হইয়াছিলেন। কিন্তু পরিশেষে অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছে যে তিনি ইহার জন্য পীড়া অনুভব করিয়াছেন। তাঁহার মুখে যদিও সর্বদা হাসি লাগিয়াই থাকিত, যদিও কখনও তিনি কাহারও প্রতি কঠোর বাক্য প্রয়োগ করে নাই, তবুও যাহাদিগকে তিনি শিক্ষা দিয়াছেন, তাহাদের ভুলত্রুটির জন্য বেদনা অনুভব করিয়াছেন কারণ আমরা তাঁহার প্রদর্শিত পথ হইতে বিচলিত হইয়াছি। পরিশেষে তাঁহারই এক সন্তান তাঁহাকে হত্যা করিল, কারণ যে—কোন ভারতীয়ই তাঁহার সন্তানস্বরূপ।

প্রয়াগে পণ্ডিত নেহরুর বক্তৃতা

বিগত ১২ ই ফেব্রুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর দেহাবশেষ গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতীর সঙ্গমস্থলে বিসর্জনের পর বিপুল জনতার সম্মুখে পণ্ডিত নেহরু তাঁহার সম্পর্কে এক মর্মস্পর্শী বক্তৃতা করেন। ইহাতে তিনি বলেন, —

মহাত্মা গান্ধীর চিতাভস্ম বিসর্জনের সঙ্গে তাঁহার সহিত তাঁহাদের সম্পর্ক শেষ হইয়া যায় নাই, পক্ষান্তরে যোগসূত্র আরও দৃঢ় হইল।

আমাদের সৌভাগ্য যে, মহাত্মা গান্ধীর সমসাময়িক যুগে আমরা এই পৃথিবীতে জন্মিয়াছি এবং তাঁহাকে প্রত্যক্ষ করিয়াছি. পরবর্তী বংশধরগণ তাঁহাকে দেখিতে পাইবেন না, কিন্তু তাঁহারাও আমাদের ন্যায় তাঁহার নিকট হইতে প্রেরণা লাভ করিবেন, তাঁহার মহান ব্যক্তিত্ব অনন্তকালস্থায়ী।

তাঁহার মৃত্যুর পূর্বে আমরা সর্বদা তাঁহার নিকট যাইতে পারিতাম এবং তাঁহার পরামর্শ গ্রহণ করিয়া উপকৃত হইতাম। এক্ষুণি আমরা আর তাহা করিতে পারিব না। আমরা এক্ষুণি তাঁহাকে আমাদের বোঝার অংশ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করিতে পারিব না। আমাদিগকে এক্ষুণি তাঁহার সাহায্য ব্যতীত সব কিছুরই সম্মুখীন হইতে হইবে। কিন্তু তিনি আমাদিগকে যাহা শিক্ষা দিয়া গিয়াছেন,, তাহা সর্বদাই আমাদিগকে অনুপ্রাণিত ও পরিচালিত করিবে।

ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রাম পরিচালনাকালে গান্ধীজী হিংসা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও প্রচারকার্য্য চালান। কিন্তু ভারতবাসীর স্বাধীনতা অর্জিত হবার অব্যাহতি পরে তাহারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িল এবং দেশব্যাপী হিংসার তাণ্ডব চলিল। তিনি যেভাবে একটি নিবীর্য্য জাতির স্বাধীনতা অর্জনে সহায়ক হন তাহা ইতিহাসে অভূতপূর্ব। কিন্তু সম্প্রতি স্বাধীন ভারতই জগতের সমক্ষে অপদস্থ হইয়াছে এবং ভারতবাসীর অন্তরাত্মা ক্ষতবিক্ষত হইয়াছে। দেশের বিষাক্ত আবহাওয়ায় সাম্প্রদায়িকতা প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। জনসাধরণের মধ্যে কয়েকটি সম্প্রদায় হিংসা—কর্ম্মতৎপরতা অবলম্বনের প্রতি ঝোঁক দেয় এবং পরিণামে সর্বাধিক শ্রদ্ধাভাজন বাপুজীই নিহত হইয়াছেন।

এইরূপ হিংসাতৎপরতা বন্ধ না হইলে অর্জিত স্বাধীনতার বিনাশ ঘটিবে। কাজেই হিংসার অবসান ঘটাইবার উদ্দেশ্যে লইয়া সকলকে গঙ্গাতীর হইতে গৃহে প্রত্যাবর্তন করিতে হইবে। ভারতের বহু যুবক হিংসার পথ আশ্রয় করিয়াছে; তাহাদের এখন নিজেদের অনুসৃত উপায়ের অযৌক্তিকতা উপলব্ধি করিয়া ভ্রান্ত বুদ্ধি পরিহার করিতে হইবে।

রাজনীতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করিবার যে মনোভাব রহিয়াছে তাহা আমাদের নিকট অপ্রীতিকর এবং আমাদের ভবিষ্যতের পক্ষে বিপজ্জনক। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক গর্ভমেণ্ট প্রতিষ্ঠিত হইবে বলিয়া আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছি। শান্তি বিঘ্ন না ঘটাইয়াও এখানে প্রত্যেক নাগরিকের স্বীয় অভিমত প্রচারের অধিকার আছে। তবে যে গভর্নমেণ্ট জনসাধরণের অধিকাংশের বিশ্বাস অর্জন করিবে, তাহারাই শাসনকার্য নির্বাহ করিবে। এ ধরণের গভর্নমেণ্ট যাঁহারা পছন্দ করেন না এবং যাঁহারা বলপ্রয়োগে সরকারি শাসনযন্ত্র অধিকার করিতে ইচ্ছুক, তাঁহাদের স্বাধীন ভারতে কোন স্থান নেই।

এদেশে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও হিংসাত্মক কার্যতৎপরতার প্রসার ঘটিল কি করিয়া? জনসাধারণের বিশ্বাসভাজন কতিপয় ব্যক্তি যুব—সম্প্রদায়কে চালিত করিয়া নিজেদের স্বার্থোদ্ধার করিয়াছে। অতীতে হয়ত আমরা ইহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করিতে পারিতাম না। কিন্তু আমাদের জাতির জনকের শেষকৃত্য সম্পন্ন হইবার পরও কি কেহ হিংসা ও সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটাইতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হইবে না?

ইহার পর আমরা বিষাদক্লিষ্ট অন্তরে গৃহে প্রত্যাবর্তন করিব। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর ন্যায় বিরাট নেতাকে পাইয়া আমরা যে গর্ববোধ করিতে পারি, এই মনোভাবও আমাদের মর্মান্তিক বেদনার মধ্যে আনন্দ সঞ্চার করিতেছে। স্বাধীনতার যুদ্ধে তিনি আমাদের নতুন অস্ত্রের সন্ধান দেন এবং উহার ফলে আমাদের সংগ্রাম অহিংস ও শান্তিপূর্ণ হয়। তিনি আমাদের জন্য যাহা করিয়াছেন তজন্য তাঁহার প্রতি আমাদের কর্তব্য রহিয়াছে। তাঁহার আরম্ভ কার্য আমাদের সম্পন্ন করিতে হইবে এবং তাঁহার আদর্শ অনুযায়ী ভারতবর্ষ গড়িতে হইবে। ভারতে ধর্মনির্বিশেষে প্রত্যেককে সম—অধিকার দানের ব্যবস্থা হইবে এবং বিশ্ববাসীদেরও প্রতিও আমরা অনুরূপ মনোভাবে উদ্বুদ্ধ হইব। সর্বমানবের প্রতি সম—আচরণই হইল গান্ধীজীর প্রদত্ত শিক্ষা। আমরা যদি ইহাতে বিফল হই তাহা হইলে বুঝা যাইবে যে, তাঁহার মত বিরাট নেতা লাভের যোগ্য আমরা ছিলাম না। বিগত চল্লিশ বৎসরকাল ধরিয়া গান্ধীজীর জয়ধ্বনি করা হইতেছে। গান্ধীজী কখনও ব্যক্তিগত জয় কামনা করেন নাই। প্রকৃতপক্ষে ভারতের জয়ই ছিল তাঁহার কাম্য। তিনি সত্য ও অহিংসার সুদৃঢ় ভিত্তির উপর ভারতের স্বাধীনতা—সৌধ নির্মাণ করেন; এরূপ অবস্থায় তাঁহার বিজয় সম্পর্কে নিঃসংশয় হইতে হইলে উহাকেই স্থায়ী করিয়া তুলিতে হইবে।

মহাত্মাজীর প্রতি বড়লাটের শ্রদ্ধাঞ্জলি

দিল্লির বেতার—কেন্দ্র হইতে গত ১২ ই ফেব্রুয়ারি ভারতের বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি বলেন,—

মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু সংবাদে সমগ্র সভ্য জগতের লক্ষ লক্ষ লোক ব্যক্তিগত শোকে বেদনায় মুহ্যমান হইয়াছে। যাঁহারা সারাজীবন তাঁহার কর্মসঙ্গী ছিলেন অথবা আমার মত যাঁহার তাহার সহিত অল্পদিনের পরিচিত ছিলেন, কেবল যে তাঁহারাই বন্ধুবিয়োগের বেদনা বোধ করিয়াছেন তাহা নয়; যাঁহারা জীবনে গান্ধীজীর সহিত কখনও সাক্ষাৎ করেন নাই, তাঁহাকে একবারও দেখেন নাই কিংবা তাঁহার রচনাবলীর একটি বর্ণও পাঠ করেন নাই তাঁহারাও তাঁহার মৃত্যু সংবাদে বন্ধুবিয়োগের বেদনাই অন্তরে অনুভব করিয়াছেন।

”প্রিয় বন্ধু” বলিয়া সর্বদা চিঠিতে আমাকে তিনি সম্ভাষণের ইহা অপেক্ষা যোগ্যতর কিছু যে ছিল না, তাহাতে সন্দেহ নাই। এই কথাটাই আমার পরিবারের সকলে এবং আমি সর্বদা মনে রাখিব।

গত বছর মার্চ মাসে গান্ধীজীর সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ভারতে পৌঁছিয়া আমার প্রথম কাজই হইয়াছিল গান্ধীজীর কাছে চিঠি লেখা, আমাদের উভয়ের মধ্যে যত শীঘ্র সম্ভব সাক্ষাতের প্রয়োজনের বিষয় উল্লেখ করা। যে দুরূহ সমস্যা আমাদের সম্মুখে উপস্থাপিত হইয়াছে তাহার সমাধান করিতে হইলে আমাদের ব্যক্তিগত সংযোগ অবিচ্ছিন্ন রাখার বিশেষ প্রয়োজন বিষয় উল্লেখ করা। যে দুরূহ সমস্যা আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছে তাহার সমাধান করিতে হইলে আমাদের ব্যক্তিগত সংযোগ অবিচ্ছিন্ন রাখার বিশেষ প্রয়োজন — ইহা আমরা আমাদের প্রথম সাক্ষাতেই স্থির করিয়াছিলাম। শেষবার তিনি আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসেন ঠিক এক মাস আগে; যে প্রার্থনা সভায় গান্ধীজী ঘোষণা করেন সাম্প্রদায়িক লিন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হইলে তিনি আমার কাছে আসেন। তাঁহার অনশনের চতুর্থ দিবসে আমার স্ত্রীকে লইয়া তাঁহাকে দেখিতে যাই; জীবিত অবস্থায় গান্ধীজীকে উহাই আমার শেষবার দেখিয়ে যাওয়া। এই দশ মাস ধরিয়া আমরা পরস্পরকে জানিতে পারিয়াছিলাম; নিতান্ত মামুলি ধরণের দেখা—সাক্ষাতের মধ্যেই, আমাদের পারস্পরিক আলাপ—আলোচনাগুলি শেষ হইত না। সে সব যেন ছিল দুই বন্ধুর মধ্যে কথাবার্তা। আমরা উভয়েই উভয়ের প্রতি বিশ্বাস জন্মাইতে পারিয়াছিলাম। দুই জনেই দুই জনকে যেন বুঝিতে পারিয়াছিলাম। ইহার স্মৃতিই এখন আমার কাছে চিরদিনের মত এক মূল্যবান সম্পদ হইয়া রহিল। ভারতের নবলব্ধ স্বাধীনতার দেহে যে মারাত্মক রোগের বীজাণু তাহার সর্বনাশ সাধনে উদ্যত হইয়াছে, সেই ধর্ম্মোন্মত্ততার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে গিয়া শান্তির অবতার, অহিংসার মূর্ত প্রতীক গান্ধীজী এক জিঘাংসুর হাতে প্রাণ দিলেন, শহীদ হইলেন।

জাতিকে গড়িয়া তুলিবার যে গুরুদায়িত্ব রহিয়াছে, সেই ভার লইবার আগে জাতি দেহ হইতে এই বিষাক্ত বীজাণুকে সমূলে উৎপাচন করিতে হইবে— ইহা তিনি উপলব্ধি করিয়াছিলেন।

আমাদের মহাপ্রাণ প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহেরু চিরস্থায়ী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আদর্শ আমাদের সামনে তুলিয়া ধরিয়াছেন। এই রাষ্ট্রের সকলেই সার্থক ও নব উন্মেষময় জীবন যাপন করিতে পারিবে। এই রাষ্ট্রে যথার্থ প্রগতিশীল সমাজ গড়িয়া উঠিতে পারিবে, যাঁহার ভিত্তি হইবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য।

যে স্বাধীনতার ভিত্তি গান্ধীজী তাঁহার জীবদ্দশায় প্রতিষ্ঠা করিয়া গিয়াছেন, তাঁহার যোগ্য সম্মান রাখিতে হইলে সেই ভিত্তির উপরে এইরূপ একটি সমাজ আমাদের স্থাপন করিতে হইবে। আমাদের হৃদয় মন ও কর্মের পরিবর্তন করিতে হইবে। যে শোকাবহ ও মর্ম্মভেদী মৃত্যুতে গান্ধীজীকে আমরা হারাইলাম, সেই শোকের আঘাতে যদি আমাদের সকল বিভেদ দূর হইয়া যায়; যদি এখনই এই মুহূর্তেই আমরা স্থায়ীভাবে সম্মিলিত চেষ্টায় এক হইতে পারি তবেই গান্ধীজী যাহাদের এত ভালবাসিতেন সেই জনগণের প্রতি তাঁহার চরম সেবার সুযোগ আমরা করিয়া দিতে পারিব।

কেবল এই উপায়েই তাঁহার আদর্শ রূপায়িত হইতে পারিবে, ভারতবর্ষ তার পূর্ণ ঐতিহ্যের অধিকারী হবে।

গান্ধীজীর নির্দেশিত পন্থা ও ভারতবাসীর কর্তব্য

ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু দিল্লির বেতার কেন্দ্র হইতে গত ১৪ ই ফেব্রুয়ারি জাতির উদ্দেশ্যে একটি বক্তৃতা করেন। ইহাতে তিনি মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশিত পথ ও ভারতবাসীর কর্তব্য সম্বন্ধে সবিশেষ আলোচনা করেন। এই বক্তৃতায় মর্ম এই,—

যে শোচনীয় ঘটনার জন্য ভারতবর্ষের নাম কলঙ্কিত হইয়াছে তাহার পর হইতে দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হইয়াছে। এই দুইটি সপ্তাহ জাতির জীবনের দুঃখময় অমানিশা, এই দুই সপ্তাহ ধরিয়া ভারতের লক্ষ লক্ষ অধিবাসী বেদনাক্লিষ্ট অন্তরে অশ্রু বিসর্জন করিয়াছে। আমরা মহান নেতার জন্য যে অশ্রু বিসর্জন করিয়াছি তাহা দ্বারা কি আমাদের অন্তরের দৌর্বল্য ও মালিন্য ধৌত হইয়া যাইবে? উহার ফলে কি আমরা তাঁহার এতটুকু উপযুক্ত হইতে পারি? এই দুই সপ্তাহ ধরিয়া পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের সাধারণ লোক হইতে রাষ্ট্রের অধিপতি পর্যন্ত মহাত্মার স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিয়াছেন। এই ভাবাবেগ ধীরে ধীরে হ্রাস পাইবে, কিন্তু তাহা হইলেও আমরা পূর্বের অবস্থা ফিরিয়া পাইব না, কারণ তিনি আমাদের জীবন ও মনের প্রত্যেক স্তরে তাঁহার ছাপ রাখিয়া গিয়াছেন।

তাঁহার জন্য ব্রোঞ্জ ধাতু অথবা মর্মরের প্রতিমূর্তি অথবা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য অনেকে প্রস্তাব করিয়াছেন। ইহার দ্বারা তাঁহাকে উপহাস করা হয় এবং বাণীর মূল্যকে হীন করা হয়। তাঁহার সম্মানযোগ্য কি স্মৃতিস্তম্ভ আমরা নির্মাণ করিতে পারি। তিনি আমাদের জীবন ধারণের ও জীবন উৎসর্গের পথ দেখাইয়া গিয়াছেন। আমরা যদি সেই শিক্ষার মর্ম উপলব্ধি করিতে না পারি তবে তাঁহার জন্য কোন স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ না করাই ভাল; মহাত্মাজী আমাদের যে পথ দেখাইয়া গিয়াছেন; শ্রদ্ধাবনতচিত্তে সেই পথ অনুসরণ করা এবং জীবনে ও মরণে আমাদের কর্তব্যপালন করাই তাঁহার স্মৃতিরক্ষার একমাত্র উপযুক্ত উপায়।

তিনি ছিলেন হিন্দু ও ভারতীয়; বহুকাল তাঁহার ন্যায় মহৎ লোকের জন্ম হয় নাই। ভারতীয় ও হিন্দু হওয়ার জন্য তিনি গর্ববোধ করিতেন। ভারতবর্ষ তাঁহার নিকট অত্যন্ত প্রিয় ছিল, কারণ বহু শতাব্দী ধরিয়া ভারতবর্ষ শাশ্বত সত্যের প্রচার করিয়া আসিয়াছে। তিনি ধর্মপ্রবণ ছিলেন এবং জাতির জনক বলিয়া অভিহিত হইলেও সঙ্কীর্ণ ধর্মভাব অথবা সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবোধ তাঁহার মনকে আচ্ছন্ন করিতে পারে নাই। এইজন্যই তিনি আন্তর্জাতিক মনোভাব সম্পন্ন ব্যক্তিতে পরিণত হন। তিনি মানুষের ঐক্যে বিশ্বাসী ছিলেন, প্রত্যেক ধর্মের অন্তর্নিহিত ঐক্যে তিনি আস্থাবান ছিলেন এবং দরিদ্র মানবের সেবায় আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন।

তাঁহার স্মৃতির প্রতি অগণিত লোক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করিয়াছে। ইতিহাসে ইহার তুলনা নাই। পাকিস্থানের অধিবাসীরা যেরূপ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিয়াছে — ইহাতে তিনি বোধহয় সর্বাপেক্ষা আনন্দিত হইতেন। সেই শোচনীয় ঘটনার পরদিন আমরা মুহূর্তের জন্য সকল তিক্ততা ভুলিয়া গিয়াছিলাম, গত কয়েক মাসের বিবাদ ও মতানৈক্য ক্ষণকের জন্য আমরা বিস্মৃত হইয়াছিলাম — গান্ধীজী আমাদের মানসনেত্রের সম্মুখে ভারত বিভাগের পূর্বে অখণ্ড ভারতের অবিসংবাদী ও প্রিয় নেতারূপে প্রতিভাত হইতেছিলেন।

মহাত্মাজী ছিলেন ভারতের মিলনকারী; তিনি কেবল আমাদের অপরকে সহ করিবার শিক্ষাই দেন নাই — পরন্তু তিনি আমাদের সেই সকল ব্যক্তিকে বন্ধু ও সহকর্মী হিসাবে গ্রহণ করিবার শিক্ষাও দিয়াছেন। তিনি আমাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ও সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠিতে এবং অন্যের মধ্যে শুভের লক্ষণ দেখিবার শিক্ষাও দিয়াছেন।

তাঁহার জীবনের শেষ কয়টি মাস এবং তাঁহার মৃত্যু হইতেছে ঐক্য, উদারতা এবং পরম সিহষ্ণুতার মূর্ত প্রতীক। তাঁহার মৃত্যুর কিছু পূর্বে আমরা ওই সকল আদর্শ অনুসরণ করিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলাম। আমরা সেই প্রতিশ্রুতি পালন করিব। আমাদের ইহা স্মরণ রাখিতে হইবে যে, ভারতে যাহারা বাস করে তাহারা যে ধর্মাবলম্বী হোক না কেন ভারতবর্ষ তাহারদের মাতৃভূমি। তাহারা আমাদের মহান ঐতিহ্যের সমান অংশীদার। তাহাদের বাধ্যবাধকতা ও অধিকারও সকলের সমান। সকল বিরাট জাতির ন্যায় আমাদের জাতিও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক লইয়া গঠিত। সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী দিয়া দেখিলে অথবা এই বিরাট জাতিকে ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করিবার চেষ্টা করা হইলে তাঁহার শিক্ষার অবমাননা করা হইবে, উহার ফলে বিপদের সৃষ্টি হইবে এবং তিনি যে স্বাধীনতার জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করিয়া গিয়াছেন ও যে স্বাধীনতা তিনি আমাদের জন্য অর্জন করিয়া গিয়াছেন সেই স্বাধীনতাও নষ্ট হইবে।

অতীতে ভারতের সাধারণ ব্যক্তিরাও দুঃখকষ্ট সহ্য করিয়াছেন। তাঁহাদের ত্যাগও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁহাদের দাবিও বিবেচনা করিতে হইবে। কেবল নৈতিক ও মানবতার দিক হইতে নহে, পরন্তু সাধারণ রাজনীতিক জ্ঞানের দিক হইতেও সাধারণ লোকের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন করা এবং তাহাকে উন্নত করিবার সর্ব্ব প্রকার সুযোগ দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। যে সমাজ—ব্যবস্থায় মানুষ এই সুযোগ লাভ করিতে পারে না তাহার পরিবর্তন করিতেই হইবে।

মহাত্মাজী চলিয়া গিয়াছেন কিন্তু তাঁহার প্রভাব আমাদের অনুপ্রাণিত করিতেছে। কর্তব্যভার এখন আমাদের উপর বর্তাইয়াছে। সাধ্যমত সেই কর্তব্য পালনে সচেষ্ট হওয়াই আমাদের সর্বপ্রথম করণীয়। যে সাম্প্রদায়িকতার জন্য বর্তমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবকে জীবন বিসর্জন দিতে হইয়াছে সেই সাম্প্রদায়িকতারূপ বিষকে দূরীভূত করিবার জন্য সঙ্ঘবদ্ধভাবে আমাদের সংগ্রাম করিতে হইবে। কোন বিপথগামী ব্যক্তির প্রতি বিদ্বেষভাবে লইয়া আমরা এই বিষকে দূর করিব না, পরন্তু আমরা ওই ক্ষতিকর মনোবৃত্তির বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করিব। গান্ধীজীর হত্যার আনন্দানুষ্ঠান আরও কলঙ্কের বিষয়। যাহারা উহা করিয়াছিল অথবা যাহার ওই রূপ চিন্তা করে তাহাদের নিজেদের ভারতবাসী বলিয়া দাবি করার অধিকারও নষ্ট হইয়াছে।

আমি বলিয়াছি যে, এই সঙ্কট—সময়ে জাতির স্বার্থের জন্য আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ হইতে হইবে এবং যতদূর সম্ভব প্রকাশে বাগবিতণ্ডা এড়াইয়া প্রয়োজনীয় ব্যাপারে সকলে যাহাতে একমত হইতে পারি তাহাতেই গুরুত্ব আরোপ করিতে হইবে। এই প্রয়োজনীয় কার্যে সাহায্যের জন্য আমি সংবাদপত্রসমূহের নিকট বিশেষ আবেদেন জানাইতেছি। দেশে যাহাতে বিভেদমূলক মনোভাবের সৃষ্ট হইতে পারে তাঁহারা যেন এইরূপ কোন সমালোচনা করিতে বিরত থাকেন। কংগ্রেস আমার যে সকল সহকর্ম্মী অনেক সময় ইতস্ততঃ করিয়া মহাত্মাজীর নেতৃত্ব অনুসরণ করিয়াছেন তাঁহাদের নিকটও আমি বিশেষ ভাবে আবেদন জানাইতেছি।

সংবাদপত্রে ও অনান্য মহলে সর্দার প্যাটেলের সহিত আমার মতানৈক্য সম্বন্ধে যে আলোচনা হইয়াছে তাহাতে আমি ব্যথিত হইয়াছি। বহু সমস্যা সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে প্রকৃতিগত ও মানসিক পার্থক্য আছে। কিন্তু ভারতবাসীর জানা উচিত— আমাদের জাতীয় জীবনের প্রয়োজনীয় ব্যাপারে আমাদের মতের ঐক্য সেই মতানৈকাকে ম্লান করিয়া দিয়াছে এবং পঁচিশ বৎসর অথবা তাহারও অধিক কাল আমরা অনেক বড় বড় কাজ পরস্পর একযোগে করিয়াছি। আমরা পরস্পরের সুখদুঃখের অংশভাগী। জাতির এই সঙ্কটকালে আমাদের পক্ষে কি সঙ্কীর্ণচিত্ত হওয়া অথবা জাতির মঙ্গল ব্যতীত অন্য কিছু চিন্তা করা স্মভব? সর্দার প্যাটেল জাতির জীবনব্যাপী যে সেবা করিয়াছেন কেবল তজন্য নহে পরন্তু তিনি ও আমি ভারত গর্ভমেণ্টের কার্য পরিচালনের দায়িত্ব গ্রহণের পর হইতে তিনি যে কাজ করিয়াছেন তজন্য আমি তাঁহাকে অভিনন্দিত করিতেছি। শান্তি ও সংগ্রামের সময় সর্দার প্যাটেল জাতির একজন সাহসী অধিনায়ক। অন্যে যখন কোন কাজ করিতে ইতস্ততঃ করে তখন তিনি নিঃশঙ্কচিত্তে সেই কাজ সমাধা করেন। তিনি একজন শক্তিশালী সংগঠক। বহু দিন হইতে আমি তাঁহার গুণমুগ্ধ হইয়া পড়িতেছি এবং তাঁহার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পাইতেছে।

সম্প্রতি একটি ঘরোয়া সভায় আমি যে বক্তৃতা করি সংবাদপত্রে তাহা প্রকাশিত হয়, তাহা অনুমোদিত, উহার ফলে লোকের মনে এই ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে যে, আমি পুরাতন বন্ধু ও সহকর্মী শ্রীজয়প্রকাশ নারায়ণের সমালোচনা করিয়া কঠোর ও তীব্র ভাষা ব্যবহার করিয়াছিলাম। ওই সংবাদ ঠিক নহে। আমি বলিতে চাই যে, সমাজতন্ত্রী দল কর্তক অনুসৃত কয়েকটি নীতি আমি সমর্থন করি না এবং আমার বিশ্বাস এই যে, ঘটনার চাপে পড়িয়া অথবা ভাবাবেগের দ্বারা পরিচালিত হইয়া তাঁহার ভ্রান্ত পথে চলিয়াছেন। শ্রীজয়প্রকাশ নারায়ণের কর্মশক্তি সম্বন্ধে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই। তাঁহাকে আমি বন্ধু বলিয়া মনে করি। আমার দঢ় বিশ্বাস এই যে, এমন সময় আসিবে যখন ভারতের ভাগ্য নির্ধারণের কার্যে তিনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ গ্রহণ করিবেন। দুর্ভাগা বশতঃ সমাজতন্ত্রী দল দীর্ঘ দিন হইতে নেতিমূলক নীতি অনুসরণ করিতেছে এবং যেসব বিষয়ে সর্বাগ্রে বিবেচনা করা প্রয়োজন, সেই সকল বিষয়কে উপেক্ষা করিয়া আসিতেছে।

জাতীয় জীবনে পরমতসহিষ্ণুতা ও সহযোগিতা করার জন্য এবং যাঁহারা ভারতীয়দের একটি বিরাট জাতিতে পরিণত করিতে চাহেন তাঁহাদের সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া কাজ করিবার আবেদন জানাইতেছি। সাম্প্রদায়িকতা এবং সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতা দূর করিবার জন্য সচেষ্ট হইতে আমি সকলকে অনুরোধ জানাইতেছি। ভারতবর্ষকে নতুনরূপে গড়িয়া তুলিবার জন্য শ্রমিক—মালিক বিরোধ বন্ধ করিতে সকলকে আবেদন জানাইতেছি। আমি এই সকল কাজ করিবার সঙ্কল্প গ্রহণ করিয়াছি। আমি বিশ্বাস করি যে, এই জীবনেই আমরা মহাত্মাজীর স্বপ্ন কিয়ৎ পরিমাণে সার্থক করিতে পারিব। ইহা করিলেই তাঁহার স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হইবে এবং ইহাই তাঁহার স্মৃতিরক্ষার সর্বোত্তম পন্থা।

___

প্রবাসী, ফাল্গুন ১৩৫৪; বিবিধপ্রসঙ্গ, স্তম্ভ থেকে আহৃত। সম্ভবত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়—লিখিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *