‘গান্ধী’ – জন কেনেথ গলব্রেথ
(আমেরিকার হারভারড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেথ বিশ্বের প্রথম সারির অর্থনীতিবিদদের অন্যতম। প্রেসিডেন্ট কেনেডির শাসনকালে তিনি ভারতে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ লাভ করেছিলেন এবং এ দেশে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। রিচার্ড অ্যাটেনব্রার ‘গান্ধী’ চলচ্চিচত্রটি দেখার পর সে সম্বন্ধে তাঁর মনোজ্ঞ আলোচনা সে—দেশের Flim Comments পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।)
সন্দেহাতীতভাবেই এ এক অত্যাশ্চর্য কৃতিত্ব। বলতে ইচ্ছা জাগে অপরূপ। পরে আমি নানারকমের প্রশ্ন তুলে ধরব, কেন না চলচ্চিচত্রের সমালোচনার কাজে নিতান্ত কাঁচা হলেও আমার বিচারবুদ্ধি যে কাঁচা নয় তা প্রমাণিত করতেই হবে। কিন্তু যতই খুঁত ধরি না কেন, একথা অস্বীকার করার চেষ্টা করব না যে ভারতীয় পরিবেশের উপস্থাপনায় চিত্রনাট্যের কুশলতায় কিংবা চিত্রগ্রহণের আগেও যে—সব প্রারম্ভিক কাজ থাকে তার সংগঠনের নৈপুণ্যে এই চলচ্চিচত্রকে বলা চলে অনন্যসাধারণ। দর্শকরা যে চিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েন, সেই একাত্মতাও এক অসামান্য বস্তু।
বিশেষ একটা দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা দরকার মনে করি। এই চিত্র নির্মাণের কাজে হাত দিতে গিয়ে রাজনৈতিক স্তরে কিংবা সরকারি কর্মচারীদের মহলে যে—বিপুল পরিমাণ তদ্বির—তদারক চালাতে হয়েছে, তার পরিমাপ সাধারণ দর্শক হয়তো উপলব্ধি করতে পারবেন না, কিন্তু আমার নিজের এ বিষয়ে কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই জটিল আলাপ—আলোচনার দায়িত্ব যাঁরা স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছিলেন তাঁরা বাস্তবিকই অভিনন্দনের যোগ্য।
ছায়াছবিতে কাহিনীর শুরু দক্ষিণ আফ্রিকায়। তরুণ, মেধাবী অ্যাটর্নি গান্ধী সে দেশের কঠোর বর্ণবৈষম্য প্রথার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। বেশ দাপটের সঙ্গেই সেই প্রথা বলবৎ রাখা হচ্ছিল। গান্ধী যথাযথ টিকিট কিনেও প্রথম শ্রেণীর রেল—কামরা থেকে সরাসরি পদাঘাতেই বিতাড়িত সেদিন। শুধু কামরা থেকেই নয়, একেবারে গাড়িখানা থেকেই। ফলে গান্ধীর মনে প্রতিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তিনি নেতৃত্ব দিলেন সেই দেশের সংখ্যালঘু ভারতীয়দের পরিচয়পত্র বহন এবং আঙুলের ছাপ দিতে বাধ্য হওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আন্দোলনে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে সোজাসুজি জেলারেল স্মাটস (Smuts)—এর সামনে দিয়ে দাঁড়াতে দেখা গেল। ব্রিটিশ ন্যায়বিচারের দুমুখো নীতির পরিচয় আরও একবার পাওয়া গেল সেই উপলক্ষে। পরবর্তী যুগে ভারতেও যেমন হয়েছে, একদিকে দমন—পীড়নের প্রথা বহাল রাখা আর একই সঙ্গে সাংবিধানিক নীতি—নিয়মের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে চলা, দক্ষিণ আফ্রিকাতেও দেখি তাই। এই দুই বিপরীতমুখী প্রবণতার সুযোগ গ্রহণ করার ব্যাপারে গান্ধীর প্রতিভার পরিচয় পাই তাঁর সারা জীবনের ঘটনাবলীর মধ্যে। যুগটা যদি আজকের হত আর শাসকশ্রেণীর মেজাজও আজকের মত হত, তবে তড়িঘড়ি সব ব্যাপারটা মিটে যেত। গান্ধীকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠানো হত কিংবা বন্দুকের গুলিতে তাঁর মরতে হত। গান্ধী বিশ্বাস করতেন এবং কথাচ্ছলে অনেকবারই বলেছেন যে তাঁর সংগ্রামের রীতি শুধু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেই সার্থকভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব ছিল। কিংবা বলা যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বলেই তাঁর আন্দোলনের পদ্ধতি যতটুকু সফল হবার তা হতে পেরেছে।
কাহিনীর পরবর্তী অংশ ভারতে। কংগ্রেস পার্টির অভুদ্যয়, জনমানসে গান্ধী—নেতৃত্বের বিপুল প্রভাব, অসহযোগের বাণী প্রচার, হিংসাত্মক ঘটনাবলীর বিরুদ্ধে অহিংসার আদর্শকে দ্বিধাহীনভাবে আঁকড়ে ধরা, একাধিকবার অনশন, বিশ্বযুদ্ধে ঘটনাবলী, বারবার কারাবরণ, লগুনে গোল টেবিল বৈঠকে উপস্থিতি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পুনরায় কারান্তরালে যাওয়া পরিশেষে দেশের স্বাধীনতা এবং দেশবিভাগ আর তার ফলে পাঞ্জাবে আর বাংলায় মারাত্মক হিংসার বিস্ফোরণ। ছবির শেষে, এবং একেবারে শুরুতেও দেখানো হয়েছে ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮—র সেই হৃদয়স্পর্শী ঘটনা। হিন্দুধর্মের এক গোঁড়া সমর্থকের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে গান্ধী বলে ওঠেন ‘হা রাম’ আর পরক্ষণেই তাঁর প্রাণ দেহ থেকে বিমুক্ত হয়। গান্ধী ছিলেন দেশবিভাগের ঘোরতর বিরোধী, দেশবিভাগকে তিনি মনে করতেন পাপ। মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিষ যাতে কায়েম হয়ে সমাজে প্রবেশ না করে সেই উদ্দেশ্য নিয়ে পাকিস্তানে গিয়ে বাসা বাধবার সংকল্প ব্যক্ত করেছিলেন।
ছবিখানার মধ্যে ভারতের দৃশ্য ও শ্রাব্য নানা বস্তুর অকৃত্রিম সব নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। এর জন্য অবাক না হয়ে পারা যায় না। বিদেশে বসে ছবি দেখবার সময়েও মন চলে যায় ভারতের শহর ও গ্রামের সেই পূর্ব—পরিচিত বাতাবরণে। গান্ধী—যুগের নানাবিধ অতি—পরিচিত ঘটনা উপস্থাপনের মধ্যে সেই একই মন—কাড়া ভাব। ১৯১৯—এর ১৩ই এপ্রিল তারিখে অমৃতসরের (জালিয়ানওয়ালা বাগ) হত্যাকাণ্ডের দৃশ্যগুলি এই ছবির সম্পদ। সম্ভবত আর কোনো দৃশ্য ছবির গুরুত্ব বাড়াতে এতটা সাহায্য করেনি। দেয়ালের বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ ভয়ার্ত জনতার উপর শৃঙ্খলার জালে জড়ানো গোরখা সৈন্যদের মুহুর্মূহু গুলিবর্ষণ আর গুলির ভাণ্ডার নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত সেই তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়া, এর সব কটি দৃশ্যই নৈপুণ্যের সঙ্গে গ্রথিত হয়েছে। (ছবিতে হতাহতের সংখ্যা সম্ভবত সামান্য হলেও বাড়িয়ে বলা হয়েছে। আরও একটু সঠিক হিসাব নিলে দেখা যেত, সেদিন নিহতের সংখ্যা ছিল ৩৭৯ আর আহতদের সংখ্যা ছিল ১২০০।) অনেকের মতে সেই ঘটনা থেকেই ভারতভূমি থেকে ব্রিটিশদের পাততাড়ি গুটানোর পালার সূত্রপাত হয়েছিল। ছবিতে জেনারেল ডায়ারের প্রতি নিন্দাবাচক আলোচনার যতটুকু দেখানো হয়েছে তাতে এই মতের সমর্থন খুঁজে পাওয়া যায়।
দর্শকের স্মরণপটে বহুকাল ভেসে থাকবে পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে আসা শরণার্থী জনতার সারি আর তারই বিপরীতমুখী আর এক জনস্রোত যা বয়ে চলেছে ভারত থেকে পাকিস্তানের দিকে। মাঝপথে এই দুই দলের শরণার্থীর মধ্যে দাঙ্গা বেধে যাওয়ার দৃশ্যটিও ভোলা সহজ নয়। লবণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সমুদ্রের (ডাণ্ডীর) পথে যাত্রার দৃশ্যটিও প্রশংসনীয়। বহু মানুষকে একত্রিত করে নিয়ে তোলা এই দৃশ্যটির সংগঠন নিশ্চয়ই সহজসাধ্য ছিল না। (এই দৃশ্যে যাত্রীরা যতটা জোর কদমে এগিয়ে চলেছে ততটা দ্রুত পায়ে হাঁটতে ভারত্রে মানুষদের দেখেছি বলে মনে পড়ে না।) যাত্রীদের উপর পুলিশ—বাহিনীর ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্যটিও সুসংগঠিত। দাঙ্গার মত একটা ব্যাপারকে শিল্পের পর্যায়ে তুলে আনতে রিচার্ড অ্যাটেনব্রা প্রকৃতই পারদর্শিতার পরিচয় রেখেছেন।
ভারতের মাটিতে তোলা সব ছবিতেই সাধারণত শুধু দ্রষ্টব্য বস্তু আর মানুষজনের ছড়াছড়ি। এই ছবিতে কিন্তু সব কিছুই ব্যবহৃত হয়েছে কাহিনীর প্রয়োজনে। শুধু মানুষজন নয়, এমন কি মাঠের গোরুমোষগুলোও যেন ছবির পরিচালকের একান্ত নিয়ন্ত্রণে। ভারতীয় ছবিতে রেলগাড়ি চলাচলের দৃশ্য একটু মাত্রাতীতভাবেই ব্যবৃহত হয়, এই ছবিতেও তার ব্যবহার একটু অতিরিক্তই বলা চলে, যদিও মাত্রাতিরিক্ত নয়। কাহিনীকে অতিরিক্ত সরল করার জন্য গান্ধী—চরিত্রের নানা ধরনের জটিলতাকে ছেঁটে ফেলার প্রলোভনের কাছে পরিচালক মাথা নোয়াননি। যদিও সব ধরনের চরিত্রগত জটিলতা কিংবা মানসিক দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ ছায়াচিত্রের মাধ্যমে করা সম্ভব নয়, পরিচালক নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে চেষ্টা করেছেন গান্ধী মানুষটিকে তার চরিত্রের সব দিক থেকে এবং সব বৈপরীত্য উন্মোচন করে দেখাতে। সিনেমার ছবি কোনো এক সুগভীর অর্থে এবং বিদ্বজ্জনের সমর্থনযোগ্য মাপকাঠিতে প্রকৃত ইতিহাসের সমকক্ষ বলে গণ্য হবে এমন আশা করা অনুচিত। পুস্তক আকারে ইতিহাস লিখতে গিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যেতে বাধা নেই। অধ্যাপকরা একই বিষয় নিয়ে কয়েক মাস ধরে বক্তৃতা চালিয়ে যেতে পারেন। সিনেমাতে কিন্তু বড় জোর তিন ঘন্টা সময়ের মধ্যে সমাপ্তি টানতেই হবে। তবে এই প্রচেষ্টার মধ্যে নিষ্ঠার ত্রুটি কোথায়ও দেখতে পেলাম না।
ছবিতে আরও একটি কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যাবে, এর সময়—বোধের ব্যাপারে। অনেকে অবিশ্বাস করলেও রিচার্ড অ্যাটেনব্রার এই প্রত্যয় খুবই সুদৃঢ় ছিল যে তিনি যৌবনকাল থেকে অন্তিম দিন পর্যন্ত গান্ধী—চরিত্রটিকে কালানুক্রমে উপস্থাপিত করতে ব্যর্থ হবেন না। সত্যি তিনি ব্যর্থ হন নি, আর তার একটা মস্ত বড় কারণ হল যে তিনি সারাক্ষণই দর্শকদের মনে সময়—বোধ জাগিয়ে রেখেছেন। এর খানিকটা সম্ভব হয়েছে প্রতি যুগের উপযোগী ভিন্ন ভিন্ন পোশাক—আশাক ব্যবহার করে, খানিকটা হয়েছে সমকালীন পত্র—পত্রিকার ছাপার হরফ ছবিতে দেখিয়ে, আরও খানিকটা সাহায্য করেছে বিভিন্ন সময়ের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মোটরগাড়ির মডেলের ব্যবহার। কিন্তু সময় যে এগিয়ে চলেছে তা বোঝাতে সব চেয়ে বেশী সাহায্য করেছে গান্ধীর নিজের চেহারার বিবর্তন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চেহারা পালটেছে, বয়স বেড়েছে আর তাঁর হাবভাবের পরিবর্তনও অসামান্য নৈপুণ্যের সঙ্গে যথযথভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ছবিটির বিরুদ্ধে আমার যে মোটেই কোনো অভিযোগ নেই তা নয়। একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করি। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর আবির্ভাবের আগে কোনো প্রস্তুতির পালা নেই। চটকদার ইংরেজি পোশাক—পরা এবং চলন—বলনে কৃত্রিম এই যুবকটির আগের ইতিহাস সেখানে অকথিতই থেকে গিয়েছে। বলা হতে পারে যে তিন ঘন্টার ছবিকে ইতিহাস দিয়ে আরও ভারাক্রান্ত করা সঙ্গত হত না,কিন্তু আমার বিবেচনায় পরের ইতিহাসের কিছু অংশ ছেঁটে দিয়েও গান্ধীর যৌবনের দিনগুলি দেখানো সঙ্গত হত। এক দেশীয় রাজ্যের পদস্থ কর্মচারীর সন্তান, যার শৈশব ও কৈশোর অতিবাহিত হয়েছে একটা বাঁধা ধরা সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে, যিনি কৈশোরেই বিবাহ করে সন্তানের পিতা হয়েছিলেন, সেই গান্ধীর কথা এই ছবিতে নেই, যদিও গান্ধীর আত্মজীবনীতে পাই যে জীবনের প্রারম্ভে এই দিলগুলি খুব গভীরভাবে তাঁর বাকী জীবনকে প্রভাবিত করেছিল। এই সময়কার গান্ধীকে একেবারেই না জানলে দক্ষিণ আফ্রিকার রেলগাড়ীর কামরার সেই যুবাপুরুষটিকে এবং তার পরবর্তী জীবনের অনেক ঘটনাকে ঠিকভাবে বোঝা শক্ত।
জানি না কে স্থির করেছিলেন যে ছবিটিকে আমেরিকার দর্শকদের নিকট গ্রহণীয় করে তুলতে নানা অবান্তর জিনিসের আমদানি করতেই হবে। ‘লাইফ’ পত্রিকার ফটোগ্রাফার মার্গারেট বোর্ক (অভিনয়াংশে ক্যাণ্ডিস বার্গেন) ছবিতে স্থান পেয়েছেন, গান্ধীর সঙ্গে তাঁর কিছু এলোমেলো কথাবার্তাও শোনা গেছে। কিন্তু এই জিনিস আমদামি করার প্রয়োজন তো ছিলই না, বরঞ্চ এতে আমেরিকার মানুষ বিব্রতই বোধ করবেন। লবণ সত্যাগ্রহের সময় ঘটনাস্থলে এক জোড়া আমেরিকান সাংবাদিকের উপস্থিতিও সেই রকমই অবান্তর। যদি আমেরিকার দর্শকদের জন্য বিশেষ কিছু দেখাতেই হত তবে স্বাধীনতার আন্দোলনে প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের সমর্থনের উল্লেখ করলে জিনিসটা শোভন হত। এই ব্যাপারে উইন্সটন চার্চিলের বিরোধিতায় অবতীর্ণ হতেও রুজভেল্ট দ্বিধা করেননি।
ছবির সবচেয়ে মারাত্মক দোষ ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্কের চিত্রণে। ব্রিটিশদের সঙ্গে ভারতীয়দের সম্পর্কের মধ্যে ঘৃণা আর অনুরাগ দুটি ধারাই সমান্তরালে বয়ে চলেছিল। ব্রিটিশ শাসকদের অনেকের সম্পর্কে কিংবা ব্রিটিশ সংস্কৃতির প্রতি গান্ধী আর নেহেরু দুজনেরই প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ও অনুরাগ ছিল। ছবির মধ্যে সেই দিকটা ভালভাবেই ফুটে উঠেছে। কিন্তু ভারতের প্রতি ব্রিটিশদের মনোভাবেও যে একই ধরনের জটিলতা ছিল তার পরিচয় ছবিতে পাই না। ব্রিটিশরা ভারতে এসেছিল এক ধরনের জটিলতা ছিল তার পরিচয় ছবিতে পাই না। ব্রিটিশরা ভারতে এসেছিল এক ধরনের ত্রাণকর্তার ভূমিকা নিয়ে। তাদের আগে ভারতের শাসনভার ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, অত্যাচারী কিংবা অকর্মণ্য নানা স্বেচ্ছাচারী রাজারাজড়ার হাতে। সেই ধরনের শাসনের সঙ্গে তুলনায় ব্রিটিশ শাসন ছিল অনেক উদার। গত শতাব্দীতে কার্ল মার্কস পর্যন্ত লিখে গেছেন যে ভারতে ব্রিটিশ শাসন একটা প্রগতিশীল শক্তি। হাজার হাজার ইংরেজ তাঁদের জীবনের একটা বড় অংশ ভারতের সেবায় নিয়োগ করেছেন অনেকে ভারতে জীবন বিসর্জনও দিয়েছেন। ভারতের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন বলে গর্ব বোধ করা তাঁদের পক্ষে বেমানান হত না। সব জিনিসের মত সাম্রাজ্যবাদেরও ভূমিকা একটা বিশেষ কালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ যখনকার যে রীতি, তখন তাই ভআলো।
কিন্তু এই ধরনের ইংরেজদের ছবিতে দেখতে পাওয়া গেল না বললেই চলে। ছবিতে যে ইংরেজদের দেখা মিলল তারা হয় জেনারেল ডায়ারের মত আত্মসন্তুষ্ট, ভাবনাহীন, নিয়মের নিয়মের নিগড়ে আবদ্ধ নয় উপযুক্ত সেনাবাহিনীর কেউকেটা, অথবা নয়া দিল্লির মুষড়ে পড়া, তিতি—বিরক্ত সিভিলিয়ানদের কয়েকজন। বুদ্ধিতে দীপ্ত কোনো ইংরেজের উপস্থিতি ছবিতে নেই বললেই চলে। একমাত্র মাউন্টব্যাটেনই যেন সাম্রাজ্যের অবসান ঘোষণা করতে এসে সাম্রাজ্যের ভালোর দিকটা তুলে ধরলেন। কিন্তু দয়াপরবশ আরও ইংরেজ অবশ্যই ভারতে এসেছিলেন, আর সেই জন্যেই ব্রিটিশ শাসক আর ভারতীয়দের সম্পর্কে নানা জটিলতার অবতারণা ঘটেছিল। ছবিতে এই কথাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে না ব্রিটিশ যুগের অবসানের দিনগুলিতে ভারতের শাসনভার প্রায় সর্বাংশে ভারতীয়দের হাতেই চলে এসেছিল। এই শাসক—শ্রেণী শিক্ষা গ্রহণ করেছিল ব্রিটিশ শাসকদেরই কাছে আর এরাই পরবর্তী যুগে ভারত এবং পাকিস্তানের শাসনের দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছিল।
সব শেষে উল্লেখ করব গান্ধীর মৃত্যুর দৃশ্যটি উপস্থাপনা করার ব্যাপারে আমার অস্বস্তির কথা। হয়তো দর্শকরা সকলেই এই দৃশ্য দেখে অস্বস্তি বোধ করবেন। জনতার ভিড়ে আততায়ীর মুখ হঠাৎ দেখা গেল, তার পর হঠাৎ সে বন্দুক তুলে গুলি করে বসল। ছবিতে কোথায়ও এর ব্যাখ্যা নেই। বাস্তবে সত্যিই হয়তো এর ব্যাখ্যা নেই, কেন না কোনো হৃদয়বান, বিচক্ষণ ব্যক্তির পক্ষে এই কাজ করা সম্ভবই হত না। কিন্তু দর্শকরা অবশ্যই প্রশ্ন তুলতে পারেন, লোকটা কে আর কেনই বা সে গুলি করে গান্ধীকে হত্যা করল।
চরিত্র রূপায়ণের মধ্যে আমার যাওয়া অনুচিত কেন না আমার মতামতের এখানে বিশেষ কোনো মূল্য নেই। বেন কিংসলে গান্ধী চরিত্রের প্রায় হুবহু অনুসরণ করে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। গান্ধীর ব্যঙ্গ ও রসিকতা তিনি খুব ভালো ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আশঙ্কা ছিল গান্ধী চরিত্রের এই দিকটা না চাপা পড়ে যায়। শুধু খারাপ লাগল দেখে যে চিত্রনাট্যে গান্ধীর সেই অমর কথাগুলি স্থান পায়নি। যে কথাগুলি তিনি লর্ড আরউইন সম্পর্কে একবার বলেছিলেন। গান্ধীর কোনো শিষ্য একবার লর্ড আরউইনকে প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন যে বড়লাট সাহেব ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা না করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছান না। শিষ্যের কথা শুনে গুরু একটু থমকে গিয়ে বলেন উঠলেন, তবে ঈশ্বর তাঁকে একটানা ভুল পরামর্শই দিয়ে যাচ্ছেন কেন?
জওহরলাল নেহেরু চরিত্রে রোশন শেঠের অভিনয় আমার তেমন পছন্দ হয়নি। ছবির মধ্যে গান্ধীব উপস্থিতি অনুভব করতে আমার অসুবিধা হয়েছে। অবশ্য এর একটা কারণ হতে পারে যে নেহরুকে আমি সামনাসামনি দেখেছি, গান্ধীকে কখনও দেখিনি। কিন্তু মনে হয় নেহরুর চরিত্রের প্রতি সুবিচারও দেখানো হয়নি। ছবিতে নেহরুকে দেখি বেটেখাটো, লাজুক—লাজুক একটি মানুষ গান্ধী সঙ্গীসাথীদের মধ্যে তাঁর বৈশিষ্ট্য কিছু ধরা পড়ে না। কিন্তু বাস্তবে নেহরু এবং বল্লভভাই প্যাটেল দুজনেই নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। দেশকে স্বাধীনতার পরবর্তীকালে সমস্যার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য যে সব গুণের দরকার, ধৈর্য, মাথা ঠাণ্ডা রাখার ক্ষমতা, শাসনব্যবস্থার প্রতি অকপট আনুগত্য, সে সব গুণই নেহেরুর ছিল। গান্ধীর মধ্যে এই সব গুণেব সমাবেশ পাই না। এই ছবির শেষ দিকের সময়টাতে নেহেরুর যতটা মর্যাদা পাওয়ার কথা তা কিন্তু তাঁকে দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া লর্ড আরউইনের ভূমিকায় জন গিলগুডের অভিনয়কে বাদ দিলে আর কোনো ব্রিটিশ সরকাকারী কর্মচারীর অভিনয়ই যথাযথ বলে মনে হয়নি। এখানে তাঁদের উপর যে—রূপ আরোপ করা হয়েছে তার চেয়ে নিশ্চয়ই উঁচু দরের মানুষ তাঁরা ছিলেন।
সমালোচনা করেই শুধু নিজের বিজ্ঞতার প্রমাণ দেওয়া সম্ভব। সেই প্রলোভন থেকেই এত সব সমালোচনা। কিন্তু পাঠক যেন এই সমালোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে ছবিটি দেখতে অবহেলা না করেন। ছবিটি সত্যিকারের ভালো না হলে তার সমালোচনা করে আমি মোটেই আত্মপ্রসাদ লাভ করতাম না।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বর্তমান শতাব্দীর অন্যতম মহান পুরুষ। সেই সঙ্গে সর্বকালের রাজনৈতিক উদ্ভাবকদের মধ্যে যাঁরা শ্রেষ্ঠ তাঁদের মধ্যেও তিনি অন্যতম। সাধারণ নিয়মে ক্ষমতার রেষারেষিতে শক্তি দিয়ে শক্তিকে, অর্থ দিয়ে অর্থকে, অপপ্রচার দিয়ে অপপ্রচারকে প্রতিহত করার চেষ্টা চলে। আগুনের তাপকে আগুন দিয়ে চাপা দেবার চেষ্টার মতই যেন মানুষের আঘাত আর প্রতিঘাতের সম্পর্ক। যেমন ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়াও ঠিক তোর অনুরূপ। গান্ধীর প্রতিভা এইখানেইযে তিনি প্রতিক্রিয়াকে ক্রিয়ার পথাবলম্বী না করার মধ্যে যে—শক্তি নিহিত রয়েছে তার সন্ধান পেয়েছিলেন। হিংসার বিপক্ষে তাই তিনি দাঁড় করালেন অহিংসার প্রতি নিয়ত নিষ্ঠাকে, দমনপীড়নের মুখোমুখি হলেন সযত্নে বিধিবিধান অমান্য করার সাধনা করে। ব্রিটিশ রাজত্বে যদি তিনি সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি নিয়ে লড়াইয়ে নামতেন, তবে তাঁর প্রতিরোধ এক সপ্তাহও টিকত কিনা সন্দেহ। কিন্তু অহিংস প্রতিরোধে তিনি হয়ে উঠলেন অজেয়। এই পদ্ধতির ব্যবহার করে পরবর্তীকালে মার্টিন লুথার কিং একই রকম সাফল্য লাভ করেছিলেন। গান্ধী ছবিটিতে হিংসা আর অহিংসার এই ক্রিয়া—প্রতিক্রিয়া মুখ্য স্থান গ্রহণ করেছে। এক মুহূর্তের জন্যও ছবিটি এই মূল বিষয় থেকে সরে যায়নি। ছবিটি দেখে দর্শক নিশ্চয়ই গান্ধীচরিত্রকে, এবং ভারতকে, আরও ভালো করে বোঝার সুযোগ পাবেন।
অনুবাদ : ধীরেশ ভট্টাচার্য
দেশ, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৮৩