গান্ধীস্মৃতি সেবাগ্রাম – নির্মলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়

গান্ধীস্মৃতি সেবাগ্রাম – নির্মলচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়

এক

উনত্রিশ বছর আগেকার কথা। এক ঘন বর্ষা সমাগমের দিনে গান্ধীজী বার হয়েছিলেন এক মহাতীর্থের উদ্দেশে। পথ বলতে কিছুই নেই—চাষীরা হাঁটে, কিছুটা কিছুটা গরুর গাড়ি চলে। দু’পাশে শুকনো মাঠ—মাঝে মাঝে বাবলা বন।

বৃষ্টি নামল। তৃষিত মাঠ দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল— পথ হয়ে উঠল কর্দম—পিচ্ছিল। অঝোর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে খানাখন্দ ভেঙে নগ্নপদে হেঁটে চললেন গান্ধীজী।

সাতষট্টি বছর বয়েস— কিন্তু এ—হাঁটা তাঁর পক্ষে কিছুই না। সারা জীবন তিনি হেঁটেছেন— তিনি এগিয়ে গেছেন—তাঁকে অনুসরণ করে ধন্য হয়েছে অপরে। অনুসরণ করেছে অগণিত মানুষ, কিন্তু তিনি চলেছেন সকলের আগে। নিঃসঙ্গ যাত্রাতে নিঃশঙ্ক মনের মনে গুঞ্জরিত হয়েছে—যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।

চিরপথিক গান্ধীজী। চিরযাত্রী নদীর মতো তাঁর চলা গিয়ে পৌঁছেছে বিশ্বমানবের হৃদয়—সঙ্গমে। সত্যাগ্রহী তিনি— তাঁর যাত্রা সত্যের সন্ধানে, সত্যের পরীক্ষায়। মানুষের অধিকারের জন্য গান্ধীজী চলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রান্সভালে, মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে তাঁর দান্ডী—অভিযান, মানবতার করুণা উৎসের সন্ধানে নোয়াখালির পথে তাঁর পদযাত্রা।

স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অধ্যায় শেষ হল। পর বৎসর ১৯৩৫ সালের গোড়ার দিকে গান্ধীজী এলেন ওয়ার্ধায়, মগনবাড়ির গ্রামশিল্প সংস্থা পরিচালনা করতে। কিন্তু ওয়ার্ধা গ্রাম নয়। ওয়ার্ধা ভারতবর্ষের কেন্দ্রে, তাকে ঘিরে তাকে ছাড়িয়ে পরাধীন ভারতের সহস্র সহস্র অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রাম। যেখানে খাদ্য নেই, শিক্ষা নেই, স্বাস্থ্য নেই। আছে ক্ষুধা, ব্যাধি, ভীতি আর কুসংস্কার। আছে জীর্ণ ম্লান ভাগ্য নিয়ে অসংখ্য পরদানত মানুষ। গ্রামসেবার মধ্যেই সেই মানুষের মুক্তি সাধনা।

ওয়ার্ধার কাছাকাছি গ্রামাঞ্চলে সেবাকার্যে যেতে লাগলেন গান্ধীজী ও তাঁর অনুগামীরা। কিন্ত তাতে মন ভরল না। ওয়ার্ধা পরিত্যাগ করে প্রথমে গেলেন মীরাবেন। পাঁচ মাইল দূরে সেগাঁও গ্রামে পল্লীসেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। তারপর আহ্বান করলেন গান্ধীজীকে। ১৬ই জুন, ১৯৩৬ সাল। সেই পাঁচ মাইল পথ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে পার হয়ে এলেন গান্ধীজী। মীরাবেনের কুটীরের পাশে আর —একটি দীন কুটীরে হল গান্ধীজীর আশ্রয়।

দুদিকে দুই শীর্ণ নদীর খাড়ির মাঝখানে নিম্নভূমিতে সেগাঁও গ্রাম। ম্যালেরিয়া, উদরাময় আর নানা সংক্রামক ব্যাধির আস্তানা। জীর্ণ স্বাস্থ্য, প্রতিকারহীন মৃত্যু। নিরক্ষর চাষীদের বাস, জনসংখ্যা শ—ছয়েক। অনুর্বর মাটিতে চাষের অবস্থা সঙ্গীন। অধিকাংশ বাসিন্দাই অপাঙক্তেয় হরিজন—যাদের ছায়া মাড়ালেও পাপ।

এই হল আসল ভারতবর্ষ। রক্তশূন্য শোষিত ভারতবর্ষ। এই ভারতবর্ষের বুকের উপরেই বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী তার প্রাসাদ রচনা করেছে। সেই প্রাসাদ শিখরে নয়— এই অন্ধকার মাটির বুকেই মুমূর্ষু জাতির প্রাণ ধুকধুক করছে। এইখানেই তার শুশ্রূষা করতে হবে সেবা করতে হবে— হৃৎপিন্ডে রক্ত সঞ্চার করতে হবে।

সেগাঁও গ্রাম শেঠ যমুনালাল বাজাজের জমিদারি। তিনি গান্ধীজীর কুটীরটি বানিয়ে দিলেন। সারা জীবন কাটাবেন, এই ইচ্ছা নিয়ে গান্ধীজী সেই কুটীরের দাওয়ায় গিয়ে বসলেন। সেগাঁও গ্রামের নতুন নামকরণ করলেন, সেবাগ্রাম।

ঊনত্রিশ বছর কেটেছে তারপরে। গত শীতকালে এই গান্ধীতীর্থ সেবাগ্রামে যাবার সুযোগ হল। ওয়ার্ধা থেকে পাঁচ মাইল এখন পাকা রাস্তা। যাওয়ার কোনো কষ্টই নেই। আশ্রমে ঢুকে আশাদির কুটীরের সামনে যখন দাঁড়ালাম, তখন বেলা দ্বিপ্রহর। ঝাঁকড়া গাছে ঘুঘু ডাকছে। লালে লাল গেটের মাথার বুগনভিলিয়া।

জানিনে নববর্ষার শ্যামস্নিগ্ধ কাজল মেঘ দেখে কে মুগ্ধ হয়নি— কে মুগ্ধ হয়নি আশাদিকে দেখে? কত মানুষের সংস্পর্শে তিনি এসেছেন, কত দেশি—বিদেশি, কত ধনী দরিদ্র, কত পণ্ডিত আর মূর্খ, কত বৃদ্ধ আর শিশু—আশাদি সকলের হৃদয়হরণী। আমরা তাঁকে দিদি বলে ডাকি— তাঁর আশ্রমবাসীদের কাছে তিনি মাতাজী। তাঁর মাতৃরূপের তুলনা নেই।

এর আগে দেখা হয়েছিল য়ার এক তীর্থে। কপিল তীর্থ গঙ্গাসাগরে। ভূদান পরিক্রমায় বাংলা দেশে এসেছিলেন বিনোবাজীর সঙ্গে। আমিও গিয়ে দেখা করেছিলাম সাগরে।

রোদে পোড়া শ্যামবর্ণ মুখ, মাথায় আধময়লা মোটা খদ্দরের ঘোমটা, লাল পাড়ের দু ধার দিয়ে নেমেছে কাঁচাপাকা চুলের ঢল, সিঁথিতে সিঁদুর, ক্লান্তিরেখাঙ্কিত কপালে আধমোছা মস্ত একটা লাল টিপ। সেবাগ্রামের সেবাপ্রাণা মাতাজী আশা দেবী আর্যনায়কম। বলেছিলেন— অনেক তো ঘুরে ঘুরে বেড়াও, একবার এসো আমার কাছে—সেবাগ্রামে।

শীতের পড়ন্ত বেলায় সেবাগ্রামে তাঁর কুটীরের সামনে দাঁড়িয়ে ডাকলাম—

আশাদি, আমি এসেছি।

ছুটে বেরিয়ে এলেন আশাদি। প্রসন্ন হাসিতে তাঁর উদার চোখ দুটি স্বচ্ছ হ্রদের মতো টলটল করে উঠল। কথা বললেন— যেন সুরধনীগঙ্গার কুলুকুলু ধ্বনি।

এসো এসো। কষ্ট হয়নি তো? খুব খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই।

আমি যেন তাঁর কত আপন। অর এই গতকালই বুঝি দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে।

আমার ঝুলিটা নিজে হাতে তুলে নিয়ে রুস্তম ভবন পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেলেন আশাদি। খাবারের বন্দোবস্ত করলেন। ছুটে এসে ঘরের চাবি খুলে দিল মধুকর সাভারকর। ঘর ঝাঁট দিয়ে কলসিতে জল ভরে খাটিয়ায় কম্বল বিছিয়ে দিল গেস্ট মিনিস্টার জ্ঞানেশ্বর ভাই।

দুই

আশ্রমবাসী আত্মশ্রম—নির্ভরশীল। আশ্রমবাসীর দিনযাত্রী সরল সংযত ও সত্যনিবেদিত। মাটির কাছাকাছি তার জীবন— যে মাটি সাধারণতমের আশ্রয়। তাই আশ্রমই সর্বোদয়ের সাধনপীঠ।

রাসকিনের ‘আনটু দি লাস্ট’ গ্রন্থ গান্ধীজীকে আশ্রম—জীবনে উদ্বুদ্ধ করে। মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে তিনি প্রথম আশ্রম স্থাপন করেন, দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান শহরের প্রান্তে ফিনিকস আশ্রম। ছ’বছর পরে জোহান্সবার্গের কাছে তিনি দ্বিতীয় আশ্রম স্থাপন করেন ও তার নামকরণ করেন টলস্টয়ের নামে। ভারতবর্ষে ফিরে ১৯১৫ সালে তিনি তাঁর তৃতীয় অশ্রম করেন আমেদাবাদের নিকটবর্তী কোচরার গ্রামে ও বছর দুই পরে সেই আশ্রমকে স্থানান্তরিত করেন সাবরমতীতে। সত্যাগ্রহের আদর্শকে গান্ধীজী উপলব্ধি করেন ফিনিকস আশ্রমে। সাবরমতীতে তিনি প্রথম চরকা কাটতে শেখেন।

শেষ আশ্রম সেবাগ্রাম। এই সেবাগ্রামে তিনি জাতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনুরুজ্জীবনের বুনিয়াদ স্থাপন করেন। সেবাগ্রাম তাঁর সর্বোদয় পরিকল্পনার আধার। আবার তাঁর উপস্থিতিতে এই সেবাগ্রাম হয়েছিল সংগ্রামী ভারতের রাজধানী। সেবাগ্রাম গান্ধীজীর প্রিয় আশ্রয়। এইখানে হয়তো তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাটত—এরই মাটিতে বিলীন হত তাঁর দেহ। কিন্তু বিধাতা চেয়েছিলেন অন্য। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অমরত্বের আশীর্বাদ বিধাতা তাঁকে করেছিলেন। তাই সেবাগ্রামে তাঁর জীবনের চলা থামেনি।

সেই অমর অবিস্মরণীয় মানুষের স্মৃতিভার নিয়ে পড়ে আছে শোকস্তব্ধ সেবাগ্রাম। স্মৃতিচিহ্নগুলি দেখে বেড়াচ্ছি। সঙ্গে সদাহাস্যময় স্থানীয় কর্মী মধুকর সাভারকর।

পায়ে পায়ে শ্রেষ্ঠ স্মৃতি প্রতীকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ইতস্তত করবার দরকার নেই— দরজা খোলা আছে। দরজা খোলা থাকে সারা দিন রাত— দেশবাসীর জন্য, পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জন্য। স্পৃশ্য আর অস্পৃশ্য, প্রেমিক আর ধ্বংসকামী, বিশ্বাসী আর নাস্তিক— সকলের জন্য। সামান্য একটু প্রাঙ্গণ। কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা, বেড়ার গায়ে গায়ে কয়েকটি ছায়াতরু, এক পাশ করে একটি মাটির কুটীর। মাটির মেঝে, মাটিলেপা দেয়াল, খোলার ছাদ। ছোট ছোট কয়েকটি জানলা—দরজার পাশে দেয়ালের গায়ে কাঠের ফলকে লেখা— বাপু কুঠী।

একটি মাত্র চালা। গোল গুঁড়ির থাম। নিচের আয়তক্ষেত্রটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি অংশে ভাগ করা। দুটি থাকার ঘর, একটি স্নানঘর, ঢাকা দেউড়ি, দুটি দাওয়া। বহু বছর গান্ধীজী এখানে বাস করেছেন। ভারতের বিভিন্ন জননেতা পৃথিবীর নানা মনীষী এখানে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে গেছেন, তাঁর সান্নিধ্য লাভ করে ধন্য হয়েছেন। জাতির মহারাজ তিনি—গান্ধী মহারাজ। এই সেই মহারাজের প্রাসাদ। দীন কৃষকের কুটীরের সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই।

গান্ধীজী নেই— তাঁর ব্যবহৃত জিনিসগুলি সযত্নে রক্ষিত আছে। অমূল্য সে সংগৃহীত ধনকে মণিমাণিক্য দিয়ে কেনা যায় না। মেঝেতে দুটি চাটাই পাতা। একটি পাতলা তোশকের উপর মোটা খদ্দরের সাদা চাদর, দুটি ছোট বালিশ— হেলান দিয়ে বসবার সুবিধের জন্য দেয়ালে লাগানো কাঠের একটি পিঁড়ি। এই মহারাজের রাজশয্যা। বিছানার ধারে কার্পেটের একটি পুরোনো আসন আর বাঁ দিকে কাঠের দুটি টুল— অতিথিদের বসবার জন্য। একটি লন্ঠন। ডানদিকে জানলার নিচে বইয়ের ছোট তাক—তাতে পাঁচখানি বই। গীতা, বাইবেল, মহম্মদ জীবনী, রামচরিত মানস ও আশ্রম ভজনাবলী। একটি নিচু গ্লাস কেস বানিয়ে তার মধ্যে তাঁর ব্যবহৃত টুকিটাকি কয়েকটি জিনিস সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যেনন, তাঁর চরকা, জপমালা, দোয়াতকলম, কয়েকটি পাথরের কাগজচাপা। আর তাঁর প্রিয় খেলনা পাথরে কোঁদা তিনটি বাঁদর। এক কোণে লম্বা একটি কাঁচের আলমারিতে তাঁর লাঠি আর খড়ম।

পাশের ঘরটিতে একটি কাঠের চৌকি আর একটি লম্বা উঁচু টেবিল। এই টেবিলে শুয়ে গান্ধীজী মালিশ নিতেন। স্নানঘরের মধ্যে সেপটিক ট্যাঙ্ক পায়খানা যা তিনি প্রতিদিন নিজে হাতে পরিষ্কার করতেন। আর তামাপিতলের কয়েকটি জলপাত্র, টিনের বালতি। দেউড়ির এক কোণে একটি চরকা ও কয়েক ফেটি সুতা।

গান্ধীজীর শয্যার সামনে দেয়ালে দুটি কাগজের বোর্ড—একটিতে লেখা ‘ওঁ’ অপরটিতে ‘হে রাম’। আর দুটি কার্ডবোর্ডে ইংরেজীতে লেখা দুটি মহাপুরুষ—বাণী। রাসকিন ও লারিমারের। সত্য ও সংযমের বাণী। একটি মাত্র ছবি দেয়ালে। সে ছবি যীশুখ্রিস্টের। ছবির নিচে বাইবেল থেকে উদ্বৃত পরম শান্তির একটি বাণী।

এই বাপুকুঠি। প্রথমে কুটীরটি আরো ছোট ছিল। একটি মাত্র ঘর— যেটি মীরা বেন নিজের জন্য তৈরি করেন। গান্ধীজী আর তাঁর সঙ্গীরা প্রথমে এসে যে কুটীরে আশ্রয় নেন তার নাম আদি নিবাস। পরে মীরা বেন তাঁর কুটীরটি গান্ধীজীকে ছেড়ে দেন ও নিজের জন্য আর একটি কুটীর তৈরি করে নেন। সেই কুটীর পরে গান্ধীজীর অফিস হয়। সে কুটীরটি বাপু দপ্তর নামে পরিচিত। আদি নিবাস পরে আশ্রমের ভোজনাগার হয়।

বাপু কুটীর অদূরে বা—কুঠি। গান্ধীজী ও তাঁর সহকর্মীদের জন্যে তখন একমাত্র আশ্রয় আদি নিবাস। এই ক্ষুদ্র কুটীরটি গড়া হল কস্তুরবার আশ্রমের জন্য। কুটীরটি এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা দেয়ালে একটি ফটোগ্রাফ মাত্র। ছবিটি অপূর্ব, গান্ধীজী একটি টুলের উপর বসে আছেন। আর সামনে মাটিতে বসে স্বামীর ক্লান্ত চরণ দুটি ধয়ে দিচ্ছেন সেবাময়ী সাধ্বী পত্নী কস্তুরবা।

সব চাইতে বড়সড় কুটীরটির নাম আখিরী নিবাস। সেবাগ্রামে গান্ধীজীর শেষ আশ্রয় এই কুটীরটি যমুনালাল বাজাজ নিজের জন্য করলেও এটি আশ্রমের অতিথি নিবাস রূপে ব্যবহৃত হয়। সম্মানিত অতিথিরা এখানে থাকতেন। লর্ড লোথিয়ান গান্ধীজীর কাছে সেবাগ্রামে এসে এই কুটীরে উঠেছিলেন। সেবাগ্রামের শেষ কয়েক মাস এই কুটীরে ছিলেন গান্ধীজী। তাই আখিরী নিবাস এর নাম। কস্তুরবা হাসপাতালের সূচনা হয়েছিল এই কুটীরে।

এ ছাড়া আর দুটি স্মৃতি—কুটীর। একটিতে থাকতেন গান্ধীজীর সেক্রেটারি মহাদেব দেশাই, অপরটিতে হরিজন পত্রিকার সম্পাদক কিশোর মশরুওয়ালা। এই কুটীরগুলি সেবাগ্রামের গান্ধীযুগের স্মারক হিসাবে রক্ষিত। স্নেহ ভক্তির নিত্য কল্যাণ স্পর্শে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দেশ—বিদেশের দর্শকদের জন্য সদা উন্মুক্ত।

সেবাগ্রামে গান্ধীজীর শ্রেষ্ঠ স্মৃতি উন্মুক্ত একটি আয়তক্ষেত্র। বাপুকুঠি, বা—কুঠি ও আদিনিবাসের সামনে। এটি প্রার্থনার স্থান। সেবাগ্রামে কোনো ধর্ম মন্দির নেই, কোনো প্রার্থনা গৃহ নেই। অবরুদ্ধ হবার মতো নেই কোনো দ্বার। মাথার উপর আকাশ, পায়ের নিচে মাটি, ধরিত্রীর উন্মুক্ত প্রাঙ্গণই সেবাগ্রামের প্রার্থনা ক্ষেত্র। ক্ষেত্রের এক কোণে বাপু কুঠীর সামনে একটি পিপুলবৃক্ষ। এই গাছটি ১৯৩৬ সালে গান্ধীজী নিজ হাতে রোপণ করেছিলেন। অনতিদূরে একটি বকুল গাছ— এটি রোপণ করেছিলেন কস্তুরবা। প্রার্থনা ক্ষেত্রের মাঝখানে কিছুটা জায়গা কাঁকর বিছানো, যাতে বৃষ্টির দিনে জলকাদা না জমতে পারে। পিপুল গাছটির সামনে মাঝামাঝি জায়গায় কয়েকটি কাঠের টুকরো পোঁতা— প্রার্থনার সময় এই রুক্ষ কাঠের বাটামে হেলান দিয়ে গান্ধীজী বসতেন। এই পিপুল গাছের ছায়া আর গ্রীষ্ককালে এই প্রার্থনা ভূমিতে রাত্রি যাপন গান্ধীজীর বড়ো প্রিয় ছিল।

পড়ন্ত বেলায় সেই পিপুল গাছের ছায়ায় আমি কিছুক্ষণ বসে রইলাম। সেই কাঠের বাটামের সামনে মাথা নিচু করে প্রণাম করলাম। গান্ধীজী এই সেবাগ্রামে ফিরে আসতে পারেন নি। জীবনের শেষ প্রার্থনা তিনি করেছিলেন স্বাধীন ভারতের রাজধানী দিল্লীতে। কিন্তু ১৯৪৮ সালের সেই সর্বনাশা তিরিশে জানুয়ারি তারিখে তাঁর চরম আত্মাহূতির কয়েক ঘন্টা আগেও তিনি সেবাগ্রামে ফিরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি।

শীতের সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। অন্ধকার ঘনাতে না ঘনাতেই আশ্রমবাসীরা এই প্রার্থনাক্ষেত্রে উপস্থিত হবেন। গান্ধীজীকে স্মরণ করে এখানে বসে তাঁরা দিনান্তের প্রার্থনা করবেন। তারপর একে একে সব আলো নিভবে। সব চোখে ঘুম নামবে। শুধু সারারাত্রি ধরে তুহিন—শীতল বাদাস ঐ পিপুল গাছের পাতায়—পাতায় জাগবে বিরহ—স্মৃতির দীর্ঘশ্বাস।

তিন

বড়ো আরোমে কদিন কাটল— বড়ো শান্তিতে। গান্ধীজীর দক্ষিণ আফ্রিকার বন্ধু পার্শী। রুস্তমজীর পুত্র পিতৃ স্মরণে একটি বনো কুটীর বানিয়ে দেন। কুটীর বললে কম বলা হবে,— পাশাপাশি অনেকগুলি ঘর, সামনে চওড়া বারান্দা। পাথরের মেঝে, পাকা দেওয়াল,— মাথায় অবশ্য খোলার চাল।

এই রুস্তমভবন সেবাগ্রামের যাত্রী নিবাস। এখানে কোণের একটি ঘরে আশ্রয় পেয়েছি। চৌকির কাঠের বাটাম পিঠে ফুটবে, তাই আশাদি নিজে হত্রা৺তে চৌকিতে একটি তোশক বিছিয়ে দিয়েছেন।

পূর্বদিগন্তে অরুণাভার স্পর্শ তখনো লাগে নি। চারদিক ঘন অন্ধকার আকাশ—জোড়া অতন্দ্র তারকার দল। কঠিন শীতের হিম বাতাস।

তখনি আমার ঘুম ভাঙে। কোনোদিন ডাক দিয়ে যায় জ্ঞানেশ্বর ভাই। বিছানা তুলি, ঘর ঝাঁট দিই। প্রাতঃকৃত্য সেরে প্রভাতী প্রার্থনায় যোগ দিই। প্রার্থনা শেষে ভোজনগৃহে আশ্রমবাসীদের সঙ্গে সার দিয়ে বসি। ভিজে ছোলা, পাকা কলা আর আখের রসের প্রাতরাশ। তারপর ছাত্রদের সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রে যাই।

বেলা দশটা নাগাদ মাঠ থেকে ফিরে আসি। সামনের বারান্দাটা ঝাঁট দিয়ে তোশক কম্বলগুলি রোদে দিই। কলসীতে জল তুলে রাখি। জামাকাপড় কাচি,,— স্নান করি। ভোজগৃহে যাই। পরিবেশনে সাহায্য করি। দল বেঁধে খাই। মোটা চালের ভাত আর পাতলা ডাল, একটু তরকারি, চাটনি বা আচার।

তারপর সারাদিন ঘুরে ঘুরে বেড়াই। তালিমী সংঘের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি দেখি, শিক্ষক অধ্যাপকদের সঙ্গে আলাপ করি। লাইব্রেরি আর সর্বোদয় গ্রন্থ—কেন্দ্রে গিয়ে বই—এর পাতা ওলটাই। আশ্রম থেকে বার হয়ে ছায়াঘেরা রাস্তা দিয়ে উত্তরদিকে হাঁটি। ছাত্রাবাস আর খাদি অনুসন্ধান তথা প্রশিক্ষণ সংস্থা। কোনোদিন কিছুটা সময় বাপু কুঠির সামনে গিয়ে চুপ করে বসে থাকি।

বিকেলবেলা কোনোদিন কোনো অধ্যাপক আলাপের আমন্ত্রণ করেন, কোনোদিন ডাকেন আশাদি। তাঁদের সাম্প্রতিক বিদেশ ভ্রমণের গল্প আমাকে শোনান, শোনান সেবাগ্রামের পুরনো কথা।

সন্ধ্যা হতে না হতেই ভোজনের ডাক আসে। একই সরল আহার—ব্যবস্থা, তবে ভাতের বদলে কোনেদিন খিছুড়ি, কোনোদিন জওয়ারের মোটি রুটি। শিক্ষক, ছাত্র, কর্মী ও শ্রমিক একসঙ্গে এক পংক্তিতে বসে খায়। আশাদি আমার পাশে এসে বসেন। তিনি হয়তো ভাবেন এই অপ্রতুল ও নিকৃষ্ট খাদ্যে অনভ্যস্ত অতিথির কষ্ট হচ্ছে— তাই স্নেহ—সম্ভাষণে সেই কষ্ট ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করেন।

তারপর আধো—অন্ধকার রাস্তায় পা ফেলে প্রার্থনা ক্ষেত্রে আমরা যাই। আশাদি আসেন, আর্যনায়কমজী আসেন, ছাত্র, অধ্যাপক, কর্মী ও অন্যান্য আশ্রমবাসীরা আসেন। গান্ধীজীর শূন্য আসনের দিকে মুখ করে মাটির উপর সার দিয়ে স্তব্ধ হয়ে সকলে বসেন। এক বৃদ্ধ আশ্রমবাসী সেই অন্ধকারে বসে চরকা কাটেন। নিস্তব্ধতার মাঝখানে সেই চরকার গুনগুন শব্দ এক আশ্চর্য ভাষাহীন মন্ত্রের মতো বাজে। তারপর সেই মন্ত্রে মিশে যায় সমবেত কন্ঠের প্রার্থনা মন্ত্র ও প্রার্থনা গীতি।

সেবাগ্রাম কেবলমাত্র গান্ধীস্মারক নয়— সেবাগ্রাম গান্ধীক্ষেত্র। ১৯৩৮ সালে গান্ধীজী হিন্দুস্তানী তালিমী সংঘের প্রতিষ্ঠা করেন সেবাগ্রামে। আশ্রমের উত্তরাংশে প্রথম বুনিয়াদী বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। গান্ধীজীর অর্থনৈতিক পরিকল্পনার মূলে ছিল গ্রামীণ স্বয়ং—সম্পূর্ণতা। বুনিয়াদী শিক্ষাই এই স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রাণশক্তি। এই প্রাণশক্তির উদ্ভব তিনি করতে চেয়েছিলেন সেবাগ্রামের বুনিয়াদী শিক্ষাকেন্দ্রে। সেই কেন্দ্রের বর্তমান পরিচালক আর্যনায়কমজী।

সংঘ—সঞ্চালক শ্রীমুক্তেশ্বর বেহারা অতি মিষ্টভাষী ভদ্রলোক। তিনি শিক্ষায়তনগুলি আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন ও শিক্ষাক্রমগুলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পূর্ব—প্রাথমিক পর্যায়ে তিন থেকে পাঁচ বছরের শিশু। তাদের জন্য বালওয়াড়ী। আনন্দ—নিকেতন বুনিয়াদী বা প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাকেন্দ্র। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ষষ্ঠ থেকে একাদশ শ্রেণী উত্তর বুনিয়াদী। তার উপর উত্তম বুনিয়াদী বা কৃষি—কলেজের কোর্স। এই কোর্স চার বছরের— কৃষিবিদ্যার বি এস সি—র সমতুল। কৃষিবিদ্যার ভিত্তিস্বরূপ রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদ ও ভূবিদ্যা পড়ানো হয়। প্রতিদিন সকালে সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত ক্ষেতে গিয়ে নিজ হাতে কৃষির ব্যবহারিক অনুশীলন অবশ্য—পালনীয়। কুড়ি—বাইশটি ছেলে এই কোর্সে পড়ছে। সবসুদ্ধ ছাত্র সংখ্যা একশোর বেশি। দেশের সকল অঞ্চল থেকেই ছাত্ররা এসেছে। তাদের শিক্ষা ও বসবাস সম্পূর্ণ অবৈতনিক।

কৃষিই সেবাগ্রামের প্রাণ। প্রায় দেড়শো একর জমির ফসল সেবাগ্রামের প্রধান আয়। গম, জওয়ার ও চাল— তিন প্রকাল শষ্যেরই চাষ হয়। আখ একটি বিশেষ ফলন। ফলের মধ্যে কমলালেবু, কলা, পেয়ারা ও আঙুর উল্লেখযোগ্য। কৃষিই সেবাগ্রামের প্রধান শিক্ষা। আর্যনায়কমজী মাঝে কয়েক বছর সেবাগ্রামে ছিলেন না। সে ক’ বছরের অযত্নে সংঘের অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে। কৃষি ছাড়া বুনিয়াদী কারিগরী শিক্ষার বাকি কেন্দ্রগুলি প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছে, যেমন কাগজ শিল্প, কাষ্ঠশিল্প, তৈলনিষ্কাশন শিল্প। চারুকলার ক্লাসও বন্ধ, কবীরভনের এক পাশে তাঁত শিল্পের যাদুঘর আর একপাশে ছাপাখানাটি টিমটিম করছে।

গান্ধীজী ছিলেন পরাধীন জাতির জনক। তাঁর পরিকল্পনা ছিল গ্রামভিত্তিক ও সেবা নির্ভর। তাঁর সেই পরিকল্পনার সঙ্গে স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতের বিজ্ঞান ও শক্তির নির্ভর সর্বার্থসাধক পরিকল্পনার সঙ্গে স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতের বিজ্ঞান ও শক্তির নির্ভর সর্বার্থসাধক পরিকল্পনার মিল খুঁজে পাওয়া দায়। যুগ যুগের বিষণ্ণতা আর দৈনভরা অনড় কৃষি অর্থনীতিকে পিছনে ফেলে নবীন স্বাধীন ভারত এক দুর্দান্ত শিল্প—বিপ্লবের প্রচেষ্টায় ঝাঁপ দিয়েছে—পিছু ফেরার উপায় নেই। চাষী—বউ আজ ঢেঁকিতে ধান কোটে না—ধান কোটে যন্ত্র। কলুর বলদ ঘানি ঘোরায় না, —ঘানি ঘোরায় বিদ্যুৎ। হাতে রুটি—বেলা কাগজ দিয়ে লক্ষ লক্ষ দেশবাসীর নিরক্ষরতা দূর করা যাবে না, নগ্নতার লজ্জা ঢাকা যাবে না চরকায় কাটা সুতা আর তাঁতে বোনা খাদি দিয়ে। শ্রমনির্ভরতার দৈন্য ও পশ্চাদবর্তিতা থেকে বুনিয়াদী শিক্ষাকেও ক্রমে ক্রমে মুক্তি দিতে হবে,— শিল্প বিপ্লবের ও যন্ত্র—কুশলতার সঙ্গে তাল রেখে সেই শিক্ষাকে বহুমুখী ও কার্যকরী করতে হবে। শিল্প যদি কেবল শ্রমনির্ভর হয়, তাহলে তা পশ্চাদমুখী হতে বাধ্য। শক্তি—নির্ভর শিল্পের শিক্ষা দিতে হবে— ক্ষুদ্র শিল্প হলেও। নইলে আগুয়ান জগতে প্রাচীন বুনিয়াদী শিক্ষা অকর্মণ্যতার অন্ধকারে তলিয়ে যাবে।

গান্ধীজী সেই শিক্ষাই আমাদের দিয়েছিলেন। শুধু চরকা আর খাদিই কি তিনি আমাদের দিয়েছিলেন? তাঁরই অনুপ্রেরণায় কি সমৃদ্ধি লাভ করেনি আমাদের বস্ত্র আর ইস্পাত শিল্প ? তাঁরই জনশিক্ষার স্বপ্ন আজ সুদূর গ্রামাঞ্চলে প্রাইমারী স্কুলে স্কুলে রূপায়িত হচ্ছে, তাঁরই বুনিয়াদী শিক্ষার আদর্শে জেলায় জেলায় গড়ে উঠছে নানা বহুমুখী শিল্প শিক্ষায়তন, টেকনিকাল স্কুল আর ইন্সটিটিউট। সেবাগ্রামের শস্যক্ষেত্রে যে ছাত্র কাজ করে, সেই ছাত্রই শিক্ষানবিশ হয়ে ঘাম ঝরায় কলকারখানায়। গোষ্ঠীর স্বয়ং সম্পূর্ণতার যে ধ্রুব লক্ষ্য তিনি স্থির করে দিয়েছিলেন— সেই লক্ষ্য পথেই এ যুগের সমবায় অন্দোলনের যাত্রা।

আমি খাদির অর্থনীতি বুঝিনে। জাতির যুগ স্মারক বলে আমি খাদিকে সম্মান করি। পরাধীন শোষিত জনগণের হাতে গান্ধীজী তুলে দিয়েছিলেন সংগ্রামের অমোঘ অহিংসা অস্ত্র—খাদি। এই খাদির মধ্য দিয়েই গান্ধীজী জাতির বুকে দেশাত্মবোধর সঞ্চার করেছিলেন। খাদির প্রতীক রূপ অমূল্য ও অবিনশ্বর। তেমনি পরাধীন ভারতে যখন শিক্ষা নেই, স্বাস্থ্য নেই, উদ্যোগ নেই, উৎপাদন নেই, তখন বঞ্চিত গণমানুষের হাতে গান্ধীজী তুলে দিয়েছিলেন স্বাবলম্বন ও আত্মনির্ভরতার আর এক মহান অস্ত্র— যার নম বুনিয়াদী শিক্ষা। গান্ধীজীর নিজের হাতে প্রতিষ্ঠিত সেবাগ্রামের এই বুনিয়াদী শিক্ষা কেন্দ্রের প্রতীক মূল্য অপরিসীম। এই কেন্দ্রকে জীবন্ত রাখা জাতীয় কর্তব্য।

আজই সেবাগ্রামে আমার শেষ দিন। আজ সন্ধ্যায় শেষবারের মতো প্রার্থনা সভায় যোগ দেব। তারপর বিদায় নেব আশাদির কাছ থেকে। যে যত্ন তিনি আমায় করেছেন তার জন্য মুখের কথায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চেষ্টা করব না।

কাল সূর্যোদয়ের পূর্বেই সেবাগ্রাম ছেড়ে যায়। শুকনো মাঠ আর পাথুরে জমি ভেঙে হাঁটব পাঁচ মাইল। ধাম নদী পার হয়ে পৌঁছব হরিজন গ্রাম পৌনারে। বিনোবাজীর আশ্রম।

বিকেলবেলা বৃদ্ধ অধ্যাপক গোখলেজীর সঙ্গে আলাপ করছিলাম। আমার আশঙ্কার কথা তাঁকে বললাম, জিজ্ঞাসা করলাম,—

আপনাদের এই প্রতিষ্ঠান কি টিঁকে থাকবে?

এ কথা তোমার কেন মনে হল বলো তো?

আমি বললাম— আপনারা যে বড়ো দূরে সরে আছেন, বড়ো পিছিয়ে আছেন?

গোখলেজী বললেন আশ্চর্য কথা। বললেন— আমি তো তাই চাই। চাই পিছিয়ে পড়তে, হারিয়ে যেতে। কবে সেদিন আসবে, কবে এ প্রতিষ্ঠানে ধুলোয় মিশিয়ে যাবে— আমি কি তা দেখে যেতে পারব?

আমার পুরোনো চিন্তার জের টেনে আমি বললাম,—

এ আপনার অভিমানের কথা হল গোখলেজী।

অধ্যাপক শান্ত হাসি হাসলেন, বললেন—

ভুল বুঝেছ তুমি। যেদিন দেশের সমস্ত চাষীর ছেলে অবৈতনিক শিক্ষা পাবে, যেদিন সমস্ত শিক্ষা কর্মের সুফল লাভে ধন্য হবে, সেদিন এই প্রতিষ্ঠানের কোনো দাম থাকবে না। যেদিন দেশের প্রতিটি শিক্ষক এখানকার দীন শিক্ষকদের মতো ছাত্র কল্যাণে আত্মনিবেদিত হবেন সেদিন আমরা হার মেনে মুক্তি পাব। আমাদের ছাত্রদের অত্যন্ত দরিদ্র জীবন—যেদিন দেশের প্রত্যেকটি ছাত্র আমাদের ছাত্রদের চেয়ে সুখ—সুবিধা—স্বাচ্ছন্দ্য পাবে সেদিন এখানকার চালাঘরের ভাঙা ছাত্রাবাস পরম আনন্দে মাটিতে মিশিয়ে যাবে।

এ কথার উত্তরে তর্ক নেই। একটু নীরব থেকে শুধু বললাম—

সে কবে হবে গোখলেজী?

যেদিন সত্যকে ফিরে পাব। জাতীয় পরিকল্পনা যেদিন সত্যাগ্রহের আশীর্বাদে পবিত্র হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *