গান্ধীর ১২৫ তম জন্মদিন : আমরা আরও অকৃতজ্ঞ হয়েছি – অমলেশ ত্রিপাঠী
ঠিক মনে নেই, খুব সম্ভব গান্ধীর সত্তরতম জন্মদিনে মালব্যজি শুভকামনা করে তার পাঠালেন, ‘May you live for a hundred years.” সঙ্গে সঙ্গে গান্ধীর জবাব এল — ”What about twenty five?” অস্যার্থ, গান্ধী বার বার বলছিলেন, আমি একশ পঁচিশ বছর বাঁচতে চাই। মালব্য একশত কামনা করলেন, বাকি পঁচিশ বছরের কী হল? কেন জানি না, আজ তাঁর একশ পঁচিশতম জন্মদিনে, এই ঘটনা মনে পড়ছে। তিনি বাঁচতে চেয়েছিলেন এবং দেশের মঙ্গলের জন্যই চেয়েছিলেন। তার মধ্যে যযাতির যৌবনের কামনা ছিল না, ছিল ঈশোপনিষদের কর্মময় আর্য জীবন কামনা — ‘কুর্বেন্নেবেহ কর্ম্মাণি জিজীবিষেৎ শতং সমাঃ।’ কর্মময় দীর্ঘ জীবন।
আমরা তাঁকে এক বছরও বাঁচতে দিইনি। ”তিনটি গুলির শব্দ/তারপর কণ্ঠরুদ্ধ রাত/ ভুলে গেছে চন্দ্র সূর্য/ভুলে গেছে কখন প্রভাত।” প্রেমেন্দ্র মিত্র সে দিন আমাদের বেদনা, আমাদের আত্মধিক্কারকে কাব্যরূপ দিয়েছিলেন। তিনি আমাদের কত কিছু দিলেন, তার প্রতিদানে ”আমরা দিলাম হাতে তুলি / তিনটি কঠিন ক্রুর গুলি।”
আমরা আরও অকৃতজ্ঞ হয়েছি। না হলে যিনি ‘হে রাম!’ বলে কারও প্রতি কোনও অবিযোগের অঙ্গুলি না তুলে, মাটির বুকে ঢলে পড়লেন, সেই ‘জাতির জনক’কে ‘দেশের প্রধান শত্রু’ অভিধা দেবার সাহস পেতেন না কাঁসিরাম, তাঁর বহুজন সমাজ পার্টি ও তার ধৃষ্ট মহিলা মুখপাত্রী। কিন্তু কাঁসিরামরা একা নন। কংগ্রেসের কতজন সদস্য বুকে হাত রেখে বলবেন, ”Gandhi, thou shouldst be living at this hour…? ”
শতেক জনের শতেক অভিযোগ। বিপ্লবীরা বলবেন, অহিংসার মন্ত্র না জপালে আমরা দেশভাগ না করেই স্বাধীনতা আনতাম। সামব্যাদরী বললেন, শ্রেণী সংগ্রামের বিরোধিতা করে তিনি ভারতকে সমাজতন্ত্রের পথ থেকে বিচ্যুত করেছেন এবং তা টাটা—বিড়লার স্বার্থে। নিম্নবর্ণ ও নিম্নবর্গের প্রশ্ন — ‘হরিজন’ শব্দটাই একটা প্রচণ্ড ভাঁওতা। তাদের সত্যকার আর্থিক উন্নতি, সামাজিক মর্যাদা ও রাজনৈতিক ক্ষমতারে জন্য গান্ধী কিছু করেননি (যা করেছেন অম্বেডকর, মণ্ডল, ভি পি সিংহ আর সম্প্রতি যদুবংশের মুলায়ম, লালুপ্রসাদরা)। ‘হিন্দুরা মার্জনা করেনি তাঁর দেশভাগ মেনে নেওয়া, বাঙালিরা — সুভাষচন্দ্রের প্রতি অবিচার। নীরদ চৌধুরীর মতো লোকও এ ব্যাপারে ট্রটস্কিঘাতক স্তালিনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বহু মুসলমানের ধারণা গান্ধীর নেতৃত্বের দাবি জিন্নাহকে পাকিস্তানের পথে নিয়ে গেছে, তিনি কোনও দিন জিন্নাহর সঙ্গে সমানে সমানে সমঝোতার চেষ্টা করেননি। রবীন্দ্রনাথ উপহাস করেছেন চরখার অর্থনীতি ও অসহযোগের রাজনীতি, জওহরলাল নেহরু — ‘হিন্দু স্বরাজ্রে’ রিভাইভ্যালিজম, সুভাষচন্দ্র — ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের অনীহা, সাম্যবাদীরা— কৃষক মজদুরের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। অধিক উদাহরণ নিষ্প্রয়োজন। প্রায় সর্বম্মতিক্রমে গান্ধীজি এখন ইতিহাসের বাজে কাগজ ফেলার ঝুড়িতে — আধুনিক যুগের সবচেয়ে বড় anachronism, ডিনোসরের মতো প্রাগৈতিহাসিক। তাঁর মৃত্যুর পর আইনস্টাইন লিখেছিলেন, ”একদিন কেউ বিশ্বাসই করবে না যে এমন একজন মানুষ পৃথিবীতে বিচরণ করেছে।” আপেক্ষিকতাবাদের মতো তা—ই সত্য হবে, আজকের মূঢ় প্রহসন নয়।
যাঁরা সমকালীন পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে উঠে বিচার করতে চাইবেন, তাঁর অসার প্রগলভতার সম্মুখে থমকে দাঁড়াবেন। ইতিহাস আজ যাকে ত্রাতা বলে, কাল তাকে ক্রুশে চড়ায়। পুনর্মূল্যায়ন অবশ্যই প্রয়োজন, কারণ সত্যের রহস্য ক্রমপ্রকাশ্য। কিন্তু ডিবাঙ্কিং আর ইতিহাস সমার্থক নয়। ভিক্টোরিয়া ও তাঁর যুগ নিয়ে সে খেলা খেলেছিলেন লিটন স্ট্রেচি, বাহবাও কুড়িয়েছেন। কিন্তু মানবিক দুর্বলতা আবিষ্কার এক কথা (তাতে বীরভজনা থামে), তার নামে প্রকৃত মহত্ত্বকে খর্ব করা, আমাদের ছোট মাপে ছেঁটে ফেলার — সাংস্কৃতিক অবক্ষয়েরই পরিচয়। যারা উপহাস করতে এসেছে, তারা একদিন প্রার্থনায় নতজানু হবে।
আসলে, নানা কারণে, গান্ধীজির বেতার তরঙ্গের সঙ্গে আজকের বেতার তরঙ্গ মিলছে না। প্রথমেই চোখে পড়বে পাবলিক রিলেশনস ও মাস মিডিয়া—নির্মিত ইমেজের ব্যাপারটা। কে তাকাবে এই মুণ্ডিত শির, কুঞ্চিত কপোল, কৃষ্ণকায়, কটিবাস পরিহিত বৃদ্ধের দিকে? যদি তিনি নীতিবাদী হন, খাদ্য বস্ত্র থেকে যৌনজীবন, ঈশ্বর থেকে গোপালন — সব বিষয়ে ‘জ্ঞান’ দেন, তা হলে তো কথাই নেই। রাজনীতির স্টাইল? মাকিয়া ভেল্লি তো দূরস্থান, প্রত্যেক পার্টির স্থানীয় দাদারাও সে বিষয়ে ঢের পটু। কিন্তু সত্যই কি তাই? এ প্রজন্ম দেখেনি ডাণ্ডি অভিযানের সময়কার দৃপ্ত সিংহের পদক্ষেপ, যাতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সারা ভারত, দেখেনি নোয়াখালি ও বেলেঘাটার গান্ধীকে, যাঁকে কৃতজ্ঞ বড়লাট বলেছিলেন, ”my one man boundary force in the east.” তাঁর সেই বিরল দন্ত মুখে মিষ্ট এবং দুষ্ট হাস্যের বিস্তার — কে তার সম্মোহন প্রতিরোধ করবে? তাঁর কথার চেয়ে বড় ছিল কাজ, যা ভীতকে দেয় অভয়, দুঃখী দুঃখ বহন করার শক্তি, দীনকে মাথা উঁচু করে স্বাবলম্বী হবার প্রতিজ্ঞা। গান্ধীর ‘কারিশমা’ একটা কথার কথা ছিল না। তার টান চিত্তরঞ্জন দাস, মতিলাল নেহরু, মদনমোহন মালব্য, লাজপত রায় এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম — জওহরলাল, বল্লভভাই, সুভাষ— কেউই রুখতে পারেননি. পারেননি দেবকান্তি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, আর অ্যানড্রুজের মতো, মীরা বেনের মতো, লুই ফিশারের মতো শত শত বিদেশি বিদেশিনীরা।
কেন? না, তা আজকের নেতাদের স্টাইল নয়। এখন নেতা কে? ”ক্ষুব্ধ যারা, লুব্ধ যারা, মাংসগন্ধে মুগ্ধ যারা, আপন আত্মায় দৃষ্টিহারা।” সে নেতা বাক্যবীর নয়, টাকা ছড়ায় না, আর তাকে সক্রিয় রাখার জন্য আরক্ষাবাহিনীর সাহায্য। সে নেতা ধর্মের জিগির তোলে না, ধর্মের মধ্যে জাতপাতের অঙ্ক কষে না। রাজনীতি টেনে ধর্মকে ভেজাল করে না, গান্ধীকে আত্মার গভীরে তাকিয়ে আপন দোষ—দুর্বলতার পরিচয় নিতে হয়েছিল, নিরন্তর কঠোর তপস্যার তা জয় করতে হয়েছিল। তবে তিনি হতে পেরেছিলেন ‘স্থিতপ্রজ্ঞ’— দুঃখে অনুদ্বিগ্ন, সুখে বিগতস্পৃহে, ভয় ক্রোধে অবিচল, মৈত্রী ও করুণার আধার। এবং সব সময় ঈশ্বরে (অর্থাৎ সত্যে) সমর্পিত। সত্য দর্শন সহজ নয়। তার জন্য শিক্ষা চাই, সাধনা চাই। তার এক মুখ দেখছেন তিনি, আর এক মুখ দেখছে প্রতিপক্ষ। তাই এই রাজনৈতিক সাধনসমরে হিংসার স্থান নেই. অপর পক্ষ হিংসার আশ্রয় নিলেও নয়। মার খেয়েই সাম্রাজ্যবাদের বিবেক জাগ্রত করতে হবে। শারদীয়া ‘দেশ’ পত্রিকায় নীরদ চৌধুরী গান্ধীর ‘ব্রিটিশ শাসনের রূপ ও ফল বুঝবার অক্ষমতা’ এবং তৎপ্রসূত বিদ্বেষ সম্বন্ধে অনেক বিষোদগার করেছেন (সবই They hand, Great Anarch থেকে অনুবাদ)। কিন্তু ঐতিহাসিক হিসেবে স্পষ্টই তার প্রতিবাদ করেছি। ওটা প্রতিভাধর নীরদের blind spot ব্রিটিশ সাম্রাজ্য মডারেটরা, বঙ্কিমচন্দ্র তো বটেই, ইচ্ছা করে চোখ বুজে থাকেননি। মহাত্মার প্রতিক্রিয়া ছিল অভিনব। তা মডারেটদের কাছ থেকে নিয়েছে নন—ভায়োলেন্স, আর একস্ট্রিমিস্টদের কাছ থেকে নন—কোঅপারেশন। তার সঙ্গে মিশিয়েছে থোরোর আইন অমান্যের আদর্শ। সবটা দেখেছে তলস্তয় ও গীতার জৈন ব্যাখ্যার আলোকে। এরকম ইডিওলজি ছাড়া সব শ্রেণীর জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা যায় না। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মিশিয়ে তিনি যদি ধর্মকে জোলো ও রাজনীতিকে ক্লীব করে থাকেন, তবে বুঝব — কোথাও বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্তে বিরাট ভুল থেকে যাচ্ছে। তাঁর তিনটি আন্দোলনে নানা ক্রুটি থাকতে পারে, হিংসাও ঘটেছে কিন্তু কে বলবে তাতে দরিদ্রতম কৃষকও আত্মার অজেয় শক্তি দেখায়নি? গুরু নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন — তা না হলে এমন সব দ্বিতীয় সারির শিষ্য তৈরি করতে পারতেন না। তবে কাঁচা গুরু নয়। গান্ধী নিজেকে নিয়েও পরিহাস করতে পারতেন! এত অবিচার সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র তাঁকেই ‘জাতির জনক’ বলে গেছেন। উভয়েই মহৎ ছিলেন।
তিনি হিন্দু (এবং বর্ণাশ্রমী হিন্দু) ছিলেন। কিন্তু তাঁরই প্রার্থনাসভায় গীতা, কোরান, বাইবেল পড়া আবশ্যিক ছিল। একই সঙ্গে উঠত রাম ও রহিমের কৃষ্ণ ও করিমের জয়ধ্বনি। তাঁর রামভক্তি মৌখিক ছিল না, ছিল প্রাণবায়ুর মতো। কিন্তু সে রাম হৃদয়—মন্দিরে থাকেন, ইঁট কাঠের পাথরের মন্দিরে নয়। বর্ণ মানলেও অস্পৃশ্যতা তিনি মানেননি। অচ্ছুতের মন্দির প্রবেশের অধিকার নিয়ে কী লড়াই তিনি দিয়েছিলেন। শাসনতন্ত্রের বিশেষ তফসিলে ঢুকে, ও বি সি হয়ে, যারা অন্যায় এবং চিরন্তন সংরক্ষণের দাবি তুলছে, তারা শুধু তাদের ভোটে, এম এল এ এম পি মন্ত্রী হতে চায়— ভালবাসে না।
একটি সংবাদপত্র মন্তব্য করছে — ” The BSP leaders who project the Mahatma as a representative of the upper castes are both ignorant and shameless.” কেন অজ্ঞ? কারণ তারা জানে না যে ১৯৩২ সালের কমিউন্যাল অ্যাওয়ার্ডে নিম্নবর্ণকে আলাদা ভোট দিয়ে ব্রিটিশ সরকার যে খেলা খেলতে চেয়েছিলেন, তা ১৯০৯ সালে মুসলিমদের স্বতন্ত্র ভোটাধিকার দেওয়ার মত—বিভেদকামী। এতে অম্বেডকরের নীরব সম্মতি ছিল — জানাচ্ছেন ভারত সচিব হোর। কিন্তু ফন্দিটা গান্ধীর চোখ এড়ায়নি— তাই পুনা জেলে আমৃত্যু অনশন। তার পরিণাম — পুনা চুক্তি। তাঁর অনশন বর্ণহিন্দুদের বিবেক জাগ্রত করুক, তারা স্বার্থত্যাগ করে প্রাক্তন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করুক, এই ছিল মহাত্মার অভিপ্রায়। কেন নির্লজ্জ? — না, এরপরও তফসিলি জাতিদের বিভেদকামী লিগের সঙ্গে হাত মেলাতে দ্বিধা হয়নি। আজও কাঁসিরাম লখনউয়ের জনসভায় বলেন, তিনি গান্ধী ও অম্বেডকরকে সমান শ্রদ্ধা করেন, এবং পরক্ষণেই বলেন — অম্বেডকর জনৈক সামান্য মহর নেতা, যাকে গান্ধীই তুলেছেন। তাঁর চেলারা রাজঘাটে গুণ্ডামি করেছে। গান্ধীকে Son of Satan বলতে তাঁদের বাধেনি। সারা জীবন যিনি দরিদ্রের কুটিরে আশ্রমিক জীবনযাপন করেছেন, বিলাসবহুল বাংলোয় বসে মায়াবতী তাঁকে উপহাস করতে লজ্জা বোধ করেননি। বেঁচে থাকলে গান্ধী ক্ষমা করতেন। যিশুও তাই করেছেন। কিন্তু আসলে অক্ষমনীয়।
গান্ধীর ক্ষমা করার ঔদার্য ছিল কারণ তাঁর ব্যক্তিগত স্বার্থ ছিল না। তিনি তো কোনও দিন রাজ্যভার চাননি, ক্ষমতার প্রলোভন থেকে হৃদয়কে শুচি রাখতে চেয়েছেন। হয়তো এটা তাঁর ভুল, যেমন রাজ্যভার না নেওয়ার প্রতিজ্ঞা ভীষ্মের ভুল। কুরু ও পাণ্ডু উভয়কে তার খেসারত দিতে হয়েছে। এখানে দিতে হচ্ছে হিন্দু ও মুসলিম, উচ্চ ও নিম্ন জাতকে, ধনী ও নির্ধনকে,, গ্রাম ও শহরবাসীকে, এমন কী কৃষক ও মজুরকে। কিন্তু তাঁর রাজনীতির মূলমন্ত্র শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন নয়, আত্মার স্বরাজ ঘোষণা। সেই সংগ্রামের পূর্ব শর্ত সংহতি। জমিদার—চাষি, মালিক—মজুর, ব্রাহ্মণ—শূদ্র, সব ভারতীয় বিভেদও বৈষম্য ভুলে সংঘবদ্ধ হোক জাতীয়তাবাদের পতাকার তলায়, সংগ্রাম করুক সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে মিলিত শক্তিতে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আছে, আছে জাতপাতের অবিচার, শ্রেণী শোষণও দিবালোকের মতো স্পষ্ট। কিন্তু সে আগুনে যদি ইন্ধন দেওয়া হয় তবে ভারতবর্ষই পুড়বে, সাম্রাজ্যবাদারী হাসবে জয়ের উল্লাসে। আজও অনেকে বলবেন— এ তো ধামা চাপা দেওয়া এবং তাও শ্রেণী বর্ণের স্বার্থে। আমি বলব— না, একেই বলে রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতা (political wisdom) যা সম্ভব তা স্বীকার করে নিয়ে (পলিটিকস ইজ দি আর্ট অব দি পসিবল), যার প্রাগাধিকার তাকে সমাধান করে, বিজয়ের পর, আর্থসামাজিক সংস্কার সংশোধনের পালা। কোনও কিছু প্রাপনীয়ের জন্য তিনি সত্য ও অহিংসা ত্যাগ করতে রাজি ছিলেন না। বিত্তের জন্য তো নয়ই। ‘ন বিত্তেন তপর্ণীয়ো মনুষ্যঃ’ আজকালকার প্রত্যেক নেতার শোবার ঘরের দেওয়ালে টাঙিয়ে দেওয়া হোক। তাতে গান্ধীর আত্মা তৃপ্ত হবে।
তাঁর একশত পঁচিশতম জন্মদিনে যেন মনে রাখি — ‘আমার জীবনই আমার বাণী’। সে জীবন ছিল সরল, স্বাবলম্বী, সৎ। তার কেন্দ্র ছিল গ্রাম। তার লক্ষ্য ছিল স্বল্পে সন্তুষ্টি, স্বয়ম্ভরতা, সহযোগিতা, স্বায়ত্তশাসন। রবীন্দ্রনাথ এর সঙ্গে যোগ করতেন — সৌন্দর্যপ্রিয়তা। তা—ও যে গান্ধীর ছিল না তা নয়, তবে তা কবির নয়, ঋষির। এ গ্রাম অন্য গ্রাম, শহর, বিশ্ব থেকে আলাদ নয়। গান্ধী কোনও অচলায়তন সৃষ্টি করতে চাননি। পরিবেশও উন্মুক্ত, মনও উদার। কোনও বৃহৎ, জটিল, অমানবিক (মানুষের নিয়ন্ত্রণের অতীত), যান্ত্রিক, জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চাননি তিনি। বাঁধতে চাননি বিভূতির বাঁধ, গড়তে চাননি বহুতল দৈত্যের সৌধ (আবাস বড় কথা আড়ম্বর নয়), নষ্ট করতে চাননি প্রাকৃতিক পরিবেশ। তাঁর নইতালিম শিক্ষার ভারে শিশুকে ন্যুব্জ করেননি, তাকে মুক্তি দিয়েছে খেলার মাঠে, মনের মতো বৃত্তি সন্ধ্যানে, হাঁ, প্রয়োজন হলে, ঈশ্বরের ধ্যানে। মানুষ, প্রকৃতি, ঈশ্বর — এই নিয়ে গান্ধীর ত্রিভুজ। মানবপুত্র যিনি, তিনি যে ঈশ্বরেরও পুত্র। বিষের পাত্র অমৃতের পাত্রে পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে মরতেই হবে।