গান্ধীর প্রাসঙ্গিকতা – অমলেশ ত্রিপাঠী

গান্ধীর প্রাসঙ্গিকতা – অমলেশ ত্রিপাঠী

যাঁরা মহাপুরুষ তাঁরা যখন আসেন, আমরা ভালো করে চিনতেপারিনে তাঁদের। কেননা, আমাদের মন ভীরু অস্বচ্ছ, স্বভাব শিথিল, অভ্যাস দুর্বল। মনেতে সেই সহজ শক্তি নেই যাতে করে মহৎকে সম্পূর্ণ বুঝতে পারি, গ্রহণ করতে পারি। বারেবারে এমন ঘটেছে। যাঁরা সকলের বড় তাঁদেরই সকলের চেয়ে দূরে ফেলে রেখেছি। — গান্ধী সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি একটু অন্যভাবে সমর্থন করেছেন মোৎসার্টের চিরবিদ্বেষী — স্যালিয়েরি। ‘আমাদিউসে’ তিনি বলছেন —”মাঝারিয়া চিরকালই মহৎ মানুষদের নিজেদের মাপে ছেঁটে ছোট করতে চায়।” যাঁকে রবীন্দ্রনাথ মহাত্মা আখ্যা দিয়েছিলেন, জওহরলাল তুলনা করেছিলেন সোক্রাতেসের সঙ্গে, সুভাষচন্দ্র স্বীকার করেছেন ‘জাতির জনক’ বলে, তাঁকে মায়াবতীর মতো ভুঁইফোঁড় রাজনৈতিক নেতা ‘শয়তানের সন্তান’ বলতে দ্বিধা করেন না। করবেন নাই বা কেন! হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে আপন ভূমিকা ভুলে কি দেশভাগের জন্য তাঁকে দায়ী করিনি? দরিদ্র কৃষক মজুরশ্রেণীর বঞ্চক, দলিতদের শত্রু বলে নিন্দা করিনি? জিন্নাহর মতো প্রতিদ্বন্দ্বীর কথা ছেড়েই দিলাম— পুরনো বিপ্লবী, সাম্যবাদী, সুভাষপন্থী, আধুনিকতা ও প্রগতির ধ্বজাধারী কেই বা তাঁকে ছেড়ে কথা বলেছে? নীরদ সি চৌধুরী Xenophobia—র অপবাদ এনেছেন (যেমন খুশবন্ত সিং—এর মতো তৃতীয় শ্রেণীর লেখক রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি ভাষায় অজ্ঞতা নিয়ে)। জন্মের একশো পঁচিশ বছর পরেও গান্ধীর কোনো পূর্ণাঙ্গ জীবনী প্রকাশিত হয়নি অথচ বহু আগে জওহরলাল নেহরুর সে সৌভাগ্য ঘটেছে। একদা হয়েছে বীরভজনা, আজ হচ্ছে অবমাননা, যাকে debunking বলা হয়। সত্যকার মূল্যায়নের জন্য কি আমাদের ভবভূতিকথিত ‘কোপি সমানধর্মা’র জন্য অপেক্ষা করতে হবে?

কাজটা অবশ্য সহজ নয়। কারণ ব্যক্তি হিসেবে এমন জটিল চরিত্র ইতিহাসে দুর্লভ। ‘মহাত্মা’ উপাধি বহুল ব্যবহৃত হলেও তিনি বুদ্ধ, যীশু বা চৈতন্যের সমগোত্রীয় ছিলেন না। তাঁর মধ্যে বিচিত্র, এমনকি আপাতবিরোধী, চৈতন্যের স্তর লক্ষ করি। কখনও তিনি ভিক্টোরিয় যুগান্তরের সুভদ্র উদারতন্ত্রী, কখনও বা আপসহীন নৈরাজ্যবাদী (বাকুনিনের অর্থে নয়); কখনও গীতার স্থিতপ্রজ্ঞ, কখনও কৌটিল্যোপম ঝানু রাজনীতিজ্ঞ; কখনও নিজেকে বর্ণাশ্রমী রক্ষণশীল হিন্দু বলেছেন, কখনও হরিজনদের মন্দিরে প্রবেশাধিকার আন্দোলনের পুরোভাগে, অসবর্ণ বিবাহে উৎসাহী, প্রার্থনাসভায় রাম ও রহিমের সমীকরণ করেছেন। এই তিনি ধনিক—বণিকদের মুখপাত্র, এই কৃষক—শ্রমিকের সহযোদ্ধা। জাতীয়তাবাদের অনমনীয় এই প্রবক্তা কোনদিন জাতিবৈরের প্রশ্রয় দেননি, আবার ইংরেজের সবচেয়ে বড় দুর্দিনে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন করতে দ্বিধা করেননি। খিলাফৎ আন্দোলনে মুসলমানদের এত বড় বন্ধু কেউ ছিল না। বিহার, কলকাতা, দিল্লির দাঙ্গায় সময় তাদের ধনপ্রাণ রক্ষার্থ জীবন দিতেও তিনি প্রস্তুত ছিলেন; আবার ধর্মের অজুহাতে বিভেদকামী মুসলমানের এত বড় প্রতিবাদীও কেউ ছিলেন না। সহযোগিতার সঙ্গে অসহযোগের, বিরোধের সঙ্গে আপসের, ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে নিরাসক্তির অদ্ভুত মিশ্রণ এই চরিত্র নানা শ্রেণীর, নানা স্বার্থের মানুষকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছে শুধু সততা, ও ভালোবাসার জোরে। এক সময়ে তিনি বলতেন— ঈশ্বরই সত্য, শেষে বলতেন — সত্যই ঈশ্বর। আর এ ঈশ্বর, ঈশোপনিষদের ভাষায়, সকলকে ব্যাপ্ত করে আছেন। যিনি সর্বভূতহিতো রত, মানুষের মঙ্গল সাধনের লক্ষ্যে অবিচল, তিনিই প্রকৃত ধার্মিক। কারও ধনে তাঁর লাভ নেই, ত্যাগ দ্বারা ভোগ করেন তিনি। কিন্তু এ ধর্ম অসত্য ও হিংসার দ্বারা সাধিত হয় না। উপায় শুদ্ধ না হলে লক্ষ্যও সিদ্ধ হবে না। আবার এ ধর্মকে রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে হবে। মাকিয়াভেল্লির সময় থেকে রাজনীতির যে সংজ্ঞা চলে আসছিল তাকে বাতিল করে দিলেন তিনি। রাজনীতি নয় দুর্নীতি, স্বার্থপূরণ, স্বজনপোষণ, শ্রেণীশোষণ, পরিবেশ বিনষ্ট করে ধন উৎপাদন এবং দরিদ্র ও দুর্বলদের বঞ্চিত করে ধনবন্টনের ক্ষেত্র। ছলের বদলে ছল নয়, বলের বদলে বল নয়, প্রয়োজনের অতিরিক্ত লোভ নয়, বৃহৎ রাষ্ট্র ও বৃহৎ যন্ত্রের দাসত্ব নয় — কিন্তু অন্যায় ও অত্যাচারকে অহিংস প্রতিরোধ করার সুমহান দায়িত্ব। এ যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ। এর পরিণাম রামরাজ্য বা সত্য, অহিংসা, প্রেমের রাজ্য। স্বরাজ্যের চেয়ে ঢের বড় — সর্বোদয়।

কেন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে মহাত্মা আখ্যা দিলেন? প্রচলিত অর্থে নয়। ”মহাত্মা তিনিই, সকলের সুখ—দুঃখ যিনি আপনার করে নিয়েছেন, সকলের ভালো তিনি আপনার ভালো বলে জানেন…. আমাদের শাস্ত্রে ঈশ্বরকে বলে মহাত্মা, মর্ত্যলোকে সেই দিব্য ভালোবাসা সেই প্রেমের ঐশ্বর্য দৈবাৎ মেলে।” মহাত্মা তিনি, কারণ আমাদের মজ্জাগত ভীরুতাকে নিজে জয় করে জয় করতে শিখিয়েছেন, মহাত্মা কারণ তিনি দেখিয়েছেন কোনখানে আমাদের বিপদ— মানুষ যেখানে মানুষকে অপমান করে, মানুষের ভগবান সেখানে বিমুথ। হাজার বছর ধরে অপমানের ভার চাপিয়ে দিয়েছি কোটি কোটি মানুষের ওপর। সেই পাপে আমরা নিজ গৃহে পরবাসী, মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারি না, নির্ভর করি পরদেশীর কামান বন্দুক শিক্ষা বিচারব্যবস্থার ওপর। ভাইকে ভাইয়ের সম্মান দিইনি, তাই বিদেশি শাসক বা দর্শক আমাদের সম্মান দেয়নি। মহাত্মা তিনি, আমাদের যাতে তাঁর তপের আগুনে আমরা জ্বলে উঠি। রাষ্ট্রিক পরাধীনতা বা আর্থিক দীনতা সামাজিক ভেদবিচ্ছেদকে অবলম্বন করেই পুষ্ট। মহাত্মা দেখালেন— মুক্তির পথ মানুষের ঐক্য সাধনায়, মানুষের আত্মজয়ে।

নবীন প্রজন্মের জওহরলাল নেহরু তাঁকে কীভাবে দেখলেন, তা পড়ি Discovery of India- তে। ”টাটকা হাওয়ার একটা প্রবল প্রবাহের মতো ছিলেন তিনি। আমাদের জাগিয়ে দিলেন, গভীর নিঃশ্বাস নিলাম আমরা। তিনি ছিলেন আলোর ঝলকের মতো যা অন্ধকার ভেদ করে আমাদের চোখের সামনের পর্দাগুলো খুলে দিল। ঝড়ের মতো এলেন তিনি, তাতে কত কি যে উড়ে গেল — সব থেকে উড়ে গেল মানুষের চিন্তাধারার পুরনো পদ্ধতি। তিনি ওপর থেকে নেমে আসেননি, তিনি যেন ভারতের কোটি কোটি মানুষের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন, তাদেরই ভাষায় কথা বললেন, তাদেরই ভয়াবহ অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকষর্ণ করে। তাঁর শিক্ষার সার কথা — অভয় ও সত্য এবং কর্ম যা গণ কল্যাণমুখী।”

আর শুধু এদেশি নয়, বিদেশিদের প্রতিক্রিয়া শোনা যাবে সি এফ অ্যান্ড্রুজের ভাষায় ”The entire force of depressed humanity in India- not Khilafat and Punjab- but the whole misery of a continent, oppressed and crushed by an outrageous system of imperial aggression” . — গান্ধী তারই প্রতীক। (রবীন্দ্রনাথকে অ্যান্ড্রুজ, ২৮ অক্টোবর, ১৯২০)

দুই

কিসের প্রেরণা ছিল তাঁর জীবনদর্শনের পেছনে? একটা আদরা পাওয়া যাবে ১৯০৯ সালে লেখা Hind Swaraj গ্রন্থে। জন্মস্থান গুজরাতের জৈনধর্ম, পারিবারিক বৈষ্ণব পরিবেশ, সাধু রাইচাঁদের সংস্পর্শ এবং শেষে ভগবদগীতা — বলা যেতে পরে এগুলি স্বদেশের প্রভাব। কিন্তু পাশ্চাত্য ভাবধারা সম্বন্ধে অনবহিত ছিলেন না তিনি। ছিল বাইবেলের প্রেরণা, রাসকিন, থোরো ও টলস্টয়ের বাণী। যে—গীতা তাঁর প্রদান অলম্বন হয়ে দাঁড়ায়, তার শঙ্কর, রামানুজ, তিলক বা অরবিন্দ কোনো ভাষ্যই তিনি গ্রহণ করলেন না। তাঁর ভাষ্যে কুরুক্ষেত্র আমাদেরই অন্তর, সেখানে সু ও কু প্রবৃত্তি (অর্থাৎ ইন্দ্রিয়) পাণ্ডব—কৌরবের মতো নিত্য যুযুধান। যুদ্ধে জয়ী হলে স্বরাজের আশা থাকতে পারে কিন্তু তা শুধু পরশাসন থেকে মুক্তি নয়— আপন প্রবৃত্তির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, বিবেকের অনুশাসনে মানবকল্যাণে নিরাসক্ত কর্ম। এতে জয় নেই, পরাজয়ও নেই, আছে অন্তহীন পরীক্ষা—নিরীক্ষা — বৃহত্তর সত্যে উত্তরণের জন্য।

কিন্তু সত্যদর্শন তো সহজ নয়। সত্যের একদিক দেখছি আমি, বিপক্ষ দেখছে আরেক দিক। কোনটা কতটা সত্য? বৈজ্ঞানিকের আছে কতকগুলো স্বতঃসিদ্ধ, কিছু অর্ধ বা অপরীক্ষিত hypothesis। আফ্রিকার থাকার সময় ১৮৯৯ সালে গান্ধী পড়লেন টলস্টয়ের Kingdom of God is Within You। সত্য পরীক্ষার এক টেকনিক তিনি পেলেন — অহিংসা। জৈন ঐতিহ্য তাতে পূর্ণ সায় দিল। ১৯১০ সাল পর্যন্ত টলস্টয়ের সঙ্গে পত্র বিনিময়ের ফলে এ সম্বন্ধে তাঁর প্রীতি দৃঢ় হয়। ১৯০৪ সালে তিনি পড়লেন রাস্কিনের Unto This Last — যা তাঁকে কায়িক শ্রমের মর্যাদা ও সামাজিক মূল্য সম্বন্ধে সচেতন করে। ১৯০৭ সালে পড়লেন থোরোর Civil Disobedience। যে—দরকার দাসপ্রথা সমর্থন করে থোরো তাকে কর দেবেন না এবং তার জন্য জেলে যাবেন। গান্ধী তা পরীক্ষা করে দেখলেন আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গের ক্ষেত্রে। এবং শ্বেতাঙ্গ সরকারকে আপস করতে বাধ্য করলেন। এভাবে গড়ে উঠল ‘হিন্দ স্বরাজে’র ধ্যানধারণা।

‘হিন্দ স্বরাজ’ আসলে বস্তুবাদী সভ্যতা সম্বন্ধে এক সারবান নিবন্ধ। এ সভ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল আঠারো শতকেই — যন্ত্রশিল্প বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে তুলেছিলেন রোমান্টিক কবিরা। শেলীর মতো কেউ ফিরে যেতে চান পেগান গ্রিসে, কেউ কীটসের মতো মধ্যযুগে, কেউ নির্জন প্রকৃতির কোলে ওয়ার্ডস্বার্থের মতো। প্রশ্ন উঠেছিল — What man has made of man? এর সঙ্গে সুর মিলিয়েছিলেন গডউইনের মতো নৈরাজ্যবাদীর, ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রীরা। টলস্টয় জারের রাষ্ট্রযন্ত্রের পেছনে দেখেছিলেন ভূম্যধিকারী ও শিল্পপতিদের অমানুষিক শোষণ। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় বিপ্লবী নারদনিকদের হিংসা ও উত্তরে রাষ্ট্রের প্রতিহিংসা ভয়াবহ রূপ ধারণ করল। নারদনিক পন্থা ত্যাগ করে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা মার্ক্সীয় বিপ্লবের আদর্শ নিলেন, তার মূল কথা — শ্রেণীসংগ্রাম। নেতৃত্ব দেবে সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণী, তার পুরোভাগে থাকবে সুশৃঙ্খল কম্যুনিস্ট পার্টি। এখানেও হিংসাই মুখ্য উপায়। টলস্টয় এই হিংসা প্রতিহিংসার দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেন অহিংসার পথে। খ্রিস্ট তাঁকে শিখিয়েছিলেন প্রেম ও ত্যাগের মন্ত্র। তা অহিংসা ছাড়া সম্ভব নয়। ১৯১০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর গান্ধীকে লেখা চিঠিতে টলস্টয় — ” He (Christ) knew that, once violence is admitted, doesn’t matter in even a single case, the law of love is thereby rendered futile.” দুর্ভাগ্যের বিষয় বাইরে থেকে দেখতে এমন মনোহর খ্রিস্টান সভ্যতা এটা বুঝতে পারেনি।

বস্তুবাদী সভ্যতোর আর কতকগুলি কুশ্রী রূপ দেখেছিলেন গান্ধী, যা এক দশক পরে এলিয়টের অনবদ্য ভাষায় রূপ পেয়েছিল, ‘Where is the life we have lost in living?/ Where is the wisdom we have lost in knowledge?/ Where is the knowledge we have lost in information?’

আজকের কথাই ভাবুন না। এই যে স্যাটেলাইট, কমপিউটার নেটওয়ার্ক, সেল্যুলার টেলিফোন, পেজার দ্বারা আমরা দ্রুততম গতিতে খবর আদান—প্রদান করছি, তাতে ব্যবসা—বাণিজ্য ছাড়া কার লাভ হয়েছে? ভোগ্যপণ্যের স্তূপে হারিয়েছি শান্তি। নিরাত্মা প্রগতির পরিণাম — ফণিমনসায় আকীর্ণ পোড়ো জমি এবং কিছু ফাঁপা মানুষ।

গান্ধী বললেন, প্রাচীন ভারতের কৃষি ও কুটির শিল্প উৎপাদন বা বিনিময় —নির্ভর গ্রামজীবনে শোষণ ছিল না, তাই হিংসা ছিল না। বৃহৎ যন্ত্র ও বেপরোয়া নগরায়ণ হিংসার সম্ভাবনা বাড়িয়েছে। গ্রামের মানুষ স্বল্পে সন্তুষ্ট ছিল, সমবায়িক জীবনে অভ্যস্ত ছিল। অন্য দিকে বৃহৎ শিল্পের মূল কথাই হল মূলধনের সর্বাধিক লাভের প্রয়োজনে যথেচ্ছ ভোগ্যপণ্য উৎপাদন এবং বাজারের বিস্তার, যা করতে গিয়ে এল উপনিবেশ আর সাম্রাজ্য। বস্তুবাদ থেকে শিল্পবিপ্লব, আবার তার থেকে সাম্রাজ্যবাদ যা হিংসাকে বিশ্বব্যাপী করেছে। তাকে নিরস্ত করতে হবে। কিন্তু প্রতিরোধ অস্ত্র দিয়ে নয়, সত্য ও অহিংসা দিয়ে। এ লড়াই কোনও বিশেষ শ্রেণীর নয়, কারুর বিশেষ স্বার্থসাধনও করবে না, সভ্যতার চিরন্তন মূল্যবোধ — প্রেমকে রক্ষা করবে।

গান্ধী সংসার ত্যাগ করে বনবাসে যেতে বলেননি, সংসারের সংঘাতের মধ্যেই সত্যের পরীক্ষা। রাজনৈতিক ক্ষেত্র তার বাইরে নয়। রাজনীতি তখন জনমোহন নায়ক, দল, গোষ্ঠী, শ্রেণীর নামে মুষ্টিমেয় নেতার শক্তিসাধনা থাকবে না, নিছক বৃত্তিতে পরিণত হবে না, হবে আত্মিক মুক্তির উপায়। রাজনীতিকে ইউরোপীয় প্রথায় ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করেননি তিনি, আবার সে ধর্ম কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সঙ্গে যুক্তও করেননি। বলা যেতে পারে মানবধর্ম। তার পেছনে রয়েছে ঋত— অর্থাৎ বিশ্ববিধান। ইংরেজ আফ্রিকায় ও ভারতে সে বিধান লঙ্ঘন করেছে। তাকে রুখতে হবে সত্যাগ্রহ দিয়ে। অহিংসা হবে অস্ত্র, ত্যাগ ও দুঃখবরণ হবে বর্ম, লক্ষ্য হবে বিপক্ষের মনোজয়। গান্ধী আমাদের আশ্বাস দেননি— ”হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম।” এতে না আছে স্বর্গের আশ্বাস না পার্থিব সম্পদ ভোগের আহ্বান। আমাদের সত্যাগ্রহের শুদ্ধতায় ও বিপক্ষের বিবেকের উদ্বোধনে উভয়েরই আত্মার উত্তরণ। উভয়ের আংশিক সত্যদৃষ্টি মিলে প্রতিভাত হবে সত্যের পূর্ণতর রূপ। এ সংগ্রামে নেই অবসাদ, নেই তিক্ততা ও প্রতিশোধবাসনা —

both a new world/ And the old world made explicit, understood/ In the completion of its partial ecstasy/ The resolution of its partial horror.

(Burnt Norton, Eliot)

কিন্তু সত্যের পরীক্ষার জন্য চাই দীর্ঘ নৈতিক প্রস্তুতি। ভারতের লোকেরা অন্যায়ের প্রতিকারে মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করেনি তা নয়। ধর্নাও বসত। কিন্তু ইংরেজ তো স্থানীয় জমিদার বা মহাজন নয়। তারা পৃথিবী বিস্তৃত, প্রবল প্রতাপান্বিত, অসংখ্য দেশীয় সহযোগী দ্বারা সমর্থিত। তাদের সঙ্গে অসহযোগের জন্য চাই অভয়, অনমনীয় মনোবল। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, দৈহিক অত্যাচার, দীর্ঘকারাবাস, এমনকি মৃত্যুরও ঝুঁকি ছিল। তাদের মনোবল অটুট রাখতে চাই সংঘশক্তি ও উপযুক্ত নেতৃত্ব। গ্রামের পঞ্চায়েত থেকে শহরের ভদ্রলোক — উকিল, শিক্ষক, সাংবাদিক — পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল গান্ধী কংগ্রেসের নেতৃত্ব—শৃঙ্খল। টলস্টয় ফার্মের মতো আশ্রম (সবরমতী, পরে ওয়ার্ধা) ছিল তাঁর ও প্রথম/মধ্যম সারির নেতার মধ্যে সেতু। আবার তাঁরাই একেকটা অঞ্চলে তৈরি করতেন নিজস্ব আশ্রম (যেমন রাজেন্দ্রপ্রসাদের সদাকৎ)। তাঁরা সরল জীবন যাপন করতেন, উৎপাদন করতেন নিত্য ব্যবহৃত সামগ্রী নিজেদের কায়িক শ্রমে। বেকার চাষি মজুর, তাঁতি, তাদের বউ—মেয়েদের দিয়ে তৈরি করাতেন দিশি সুতো, খদ্দরের কাপড়, ঘানির তেল, ঘি, মধু, দিশি সাবান। তারা পেত পারিশ্রমিক, সস্তায় ভোগ্যপণ্য, নতুন করে বাঁচার উৎসাহ। বন্যা বা দুর্ভিক্ষের দিনে তাদের বাঁচাত আশ্রমের দাক্ষিণ্য, জোতদার মহাজনদের সঙ্গে বিবাদে— সালিশি। সঙ্গে সঙ্গে চলত সহজ ভাষায় স্বরাজের বাণী প্রচার। যেদিন কেন্দ্রীয় কংগ্রেস আন্দোলনের ডাক দিত, সবাই বেরিয়ে পড়ত কণ্ঠে ‘বন্দেমাতরম’, হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে বিলাতি কাপড়ের বা মদের দোকানে পিকেটিং করতে বা আইন ভেঙে লবণ তৈরি করতে। এরাই ”গান্ধী মহারাজের শিষ্য— কেউ বা ধনী কেউ বা নিঃস্ব।” Subaltern-দের ঐতিহাসিকরা দেখিয়েছেন দরিদ্রতম চাষী মজুর, আদিবাসী বনবাসী হরিজন গিরিজনদের মতো পিছড়ে বর্গ গান্ধীর বাণীকে তাদের যুগ যুগের স্বপ্নের রঙে মিশিয়ে কি দুর্ধর্ষ সংগ্রামের কৌশলে পরিণত করেছিল। সেই নীতি—প্রাণিত কর্মভিত্তিক শৃঙ্খলা থেকে বহু দূরে সরে এসেছে বলে আজকের কংগ্রেস জড়িয়ে পড়েছে রাজনীতির চিরকালীন দুষ্টচক্রে।

তিন

পুরাতন নেতারা গান্ধী বা গান্ধীবাদকে বিনা যুদ্ধে মেনে নেয়নি। ১৯১৪ সালে যখন তিনি শেষবারের মতো ভারতে ফিরলেন, তখন নরম ও চরমপন্থীদের এক রাজনৈতিক বোঝাপড়ার চেষ্টা চলছে প্রকাশ্যে, আর পেছনে বিপ্লবীদের সশস্ত্র সংগ্রাম প্রচেষ্টা। ১৯১৬ সালে লখনউ চুক্তি হল নরমে গরমে। কিন্তু বাঘা যতীন, রাসবিহারী বসু, মানবেন্দ্রনাথ রায়দের অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হল, ধিকি ধিকি জ্বলতে লাগল বিপ্লবের আগুন — অনুশীলন, যুগান্তর, গদর প্রভৃতি দলের নেতাদের মধ্যে, কখনও আশ্রয় নিল দেশের বাইরে। ১৯১৭ সালে ভারতসচিব মণ্টেগু ঘোষণা করলেন ইংল্যান্ড বা ডোমিনিয়ানের আদর্শে ভারতের শাসন ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হবে। কিন্তু এ নিয়ে ক্যাবিনেটে মতভেদ ছিল, শর্ত ছিল এবং শর্ত পূর্ণ হচ্ছে কিনা দেখবার জন্য পার্লামেন্টের অধিকার। সঙ্গে সঙ্গে সব প্রদেশে পুরনো বিরোধ মাথাচাড়া দিল, বাংলায় নরমপন্থী সুরেন্দ্রনাথ বললেন — নেওয়া হ’ক, চরমপন্থী চিত্তরঞ্জন বললেন — না। ১৯১৮ সাল পর্যন্ত গান্ধী কোনও পক্ষে যোগ দেননি। তবে তিলককে লেখা চিঠি থেকে জানা যায়, গ্রহণ করার পক্ষে ছিলেন তিনি, কিন্তু মনোমত না হলে প্রতিবাদের — অবশ্য তাঁর পরীক্ষিত পদ্ধতি সত্যাগ্রহ দ্বারা। ১৯১৭ থেকে তিনটি ছোট ক্ষেত্রে, আঞ্চলিক ইস্যুতে, সত্যাগ্রহ করে তার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তিনি — (১) চম্পারনে নীল চাষীদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে, (২) গুজরাতে খেড়ার কৃষকদের ওপর চাপানো অতিরিক্ত খাজনার বিরুদ্ধে এবং (৩) আমেদাবাদে মিল মজুরদের ন্যায্য ভাতার আন্দোলনে মিল মালিকদের বিরুদ্ধে। সারা ভারতবর্ষে সত্যাগ্রহের প্রথম প্রয়োগ — রাওলাট (সন্ত্রাসবাদবিরোধী) বিলের বিরুদ্ধে। প্রথম তিনটি মোটামুটি সফল হলেও শেষেরটিতে সর্বত্র ভাল সাড়া মেলেনি। কোনো কোনো স্থানে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটায় তিনি একে ‘দুরগ্রহ’ অ্যাখ্যা দেন এবং প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু এর থেকে ঘটল জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরস্ত্র জনতার ওপর জেনারেল ডায়ারের নির্বিচারে গুলিচালনার ফলে গণহত্যা ও পাঞ্জাবব্যপী সামরিক আইন জারি। ১৯১৯—এর ১ অক্টোবর অ্যান্ড্রুজ রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন, ”সে সময় থেকে সন্ত্রাসের রাজত্ব ভেঙে গেল, গভীরচারী ভয়, যা ভারতবাসীদের উপর মহামারীর মত ঝুলেছিল তা উড়ে গেল।”রবীন্দ্রনাথের ‘নাইট’ পদত্যাগ বিশ্বের প্রচার করল সাম্রাজবাদী তাণ্ডবের বীভৎসতা। এর পর মতিলাল নেহরু রিপোর্ট প্রমাণ করল পাঞ্জাব প্রশাসনের (মাইকেল ও’ডায়ারের) ও সেনাবাহিনীর (ডায়ারের) অবিমৃশ্যকারিতার ইতিহাস। পার্লামেন্টে তা অগ্রাহ্য হল, উপরন্তু লর্ডস সভা ডায়ারের স্তুতি গাইল, মাঝখান থেকে বিশ্বাসযোগ্যতা হারালো মন্টেগু সংস্কার।

এ সবের মধ্য থেকে গান্ধী স্থির করলেন অসহযোগ পদ্ধতি পরীক্ষা করার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। কিন্তু তাঁকে পুরনো নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। নিজে হাল ধরতে হবে। ১৯২০—র শেষে কলকাতা স্পেশ্যাল কংগ্রেস ও নাগপুর কংগ্রেসে জিতলেন তিনি — চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে সমঝোতা করে। ১৯২১ —এ শুরু হল তাঁর নেতৃত্বে প্রথম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধ সংগ্রাম — অহিংস অসহযোগ।

কিন্তু নিরপেক্ষঐতিহাসিককে স্বীকার করতেই হবে আন্দোলনের ছকে ( ছিল কি?) বেশ কিছু ত্রুটি ছিল। প্রথমত, প্রত্যেক ইডিওলজির জন্মদাতা মনে করেন তিনি ছাড়া কেউ তার সুষ্ঠু রূপায়ণ করতে পারবেন না। গান্ধী শুধু ১৯২১—এ নয়, ১৯৩০—এর আইন অমান্য আন্দোলনে শুধু শেষ কথা বলার দায় নেননি। প্রতি পদক্ষেপে হস্তনিক্ষেপ করেছেন। এতে ভুল হওয়া স্বাভাবিক, হয়েও ছিল। চৌরিচৌরার ঘটনার পর সত্যাগ্রহ প্রত্যাহারের জন্য জওহরলালকে তিনি সান্ত্বনা দিলেও মতিলাল, চিত্তরঞ্জন, মালব্য, লাজপৎ, সুভাষের মতো রাজনৈতিক নেতারা তাতে সান্ত্বনা পাননি। স্বরাজীদের বিদ্রোহই তার প্রমাণ। দ্বিতীয়ত, এর একটা প্রধান (এবং চরম) অঙ্গ ছিল খাজনা বন্ধ। হাজার হাজার কৃষক সত্যাগ্রহে যোগ দিয়েছিল, দুর্ভার কর/খাজনা সহ্য করতে না পেরে। গুন্টুরে ও বারদোলিতে (দুবার) — তাদের আন্দোলন পিছিয়ে দিয়ে তিনি একটা প্রচণ্ড হতাশার সৃষ্টি করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশের সম্বন্ধে একই কথা। পিছড়ে বর্গের চম্পার স্বপ্ন সফল হয়নি। তৃতীয়ত, চৌরিচৌরার অজুহাত আপাতদৃষ্টিতে কট্টর অহিংসবাদ হতে পারে কিন্তু প্রথম থেকেই খিলাফতীদের মধ্যে, বিশেষত, আলি—ভাইদের মধ্যে, হিংসার মনোভাব প্রচ্ছন্ন ছিল না। অর্থাৎ এ বিষয়ে দেশকে ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী শিক্ষা না দিয়ে তাদের কাছ থেকে নির্ভেজাল অহিংসা দাবি করা কল্পনাবিলাস। চতুর্থত, খিলাফৎ আন্দোলনের সঙ্গে স্বরাজ আন্দোলন যুক্ত করার মধ্যে একটা সুবিধাবাদী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। খিলাফতীদের সাহায্যে গান্ধী প্রথম সারির নেতৃপদে উঠে এসেছিলেন কলকাতা কংগ্রেসে। হয়তো তাদের সাহায্য ছাড়া নাগপুরেও দাশের সঙ্গে সন্ধি হত না। কিন্তু এর ফল শেষ পর্যন্ত ভাল হয়নি—আমি তা দেখিয়েছি ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’ গ্রন্থে। মোপলা বিদ্রোহ, আলি ভাইদের সঙ্গে সংঘাত, আন্দোলন—পরবর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা— একটা ‘প্রতিক্রিয়ার শৃঙ্খল’ বলা যেতে পারে। ভারতের বাইরের কোনো মৌলবাদী আন্দোলনের সাহায্য নেওয়া মুসলিম মনোজয়ের উপায় নয়। মুসলিম জনসাধারণের দুঃখদুর্দশার ওপর জোর না দিয়ে তাদের ওপরতলার নেতাদের সঙ্গে আইনসভার আসন নিয়ে বোঝাপড়া সফল হতে পারে না। উত্তরপ্রদেশে তা কিছুটা কাজ দিয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু বাংলায় ও পাঞ্জাবে বেশি ফল দেয়নি। নরমপন্থী মুসলিম নেতা জিন্নাহ তো কলকাতা কংগ্রেস থেকে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। শেষে ভারত সরকারের চালে বামপন্থী আব্দুল বারি খিলাফৎ আন্দোলন বন্ধ করেন এবং দক্ষিণপন্থী মহম্মদ সফি প্রকাশ্যে কংগ্রেস—বিরোধী মুসলিমদের নেতৃত্ব দিতে নামেন। বৈদেশিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে গান্ধীর অজ্ঞতার নিদর্শন মেলে — তা না হলে এক অতীতমুখী প্যান ইসলামিক মতবাদকে তিনি সমর্থন করতে গেলেন কেন? কামাল আতাতুর্কের কথা কি তিনি শোনেননি? রোলাঁর ডায়েরিতে রবীন্দ্রনাথের মত স্মর্তব্য—

”Gandhi was not working… for the unity of India but for the pride and force of Islam.”

বারদোলিতে আন্দোলন প্রত্যাহার গান্ধী নেতৃত্বের পক্ষে একটা বড় আঘাত। রজনী পাম দত্তর ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ অভিযোগ ধোপে টিকবে না। তবে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতারা সহজে তা মানেননি। দাশ মনে করেছিলেন রিডিং—এর গোলটেবল বৈঠকের প্রস্তাব উড়িয়ে দেওয়া উচিত হয়নি। কাউন্সিল বর্জন প্রস্তাব অমান্য করে কাউন্সিলের মধ্য থেকেই ‘ডায়ার্কি’ বানচাল করতে চেয়েছিলেন তিনি। এ নিয়ে প্রো—চেঞ্জার (দাশ—নেহরু) ও নো—চেঞ্জার (গান্ধীবাদী) কলহ বেশ কিছুদিন চলে। গান্ধীকে শেষ অবধি হার মানতে হয়। বিপ্লবপন্থীরা ‘বছরের মধ্যে স্বরাজ’ প্রতিশ্রুতি পেয়ে অসহযোগ আন্দোলনে নেমেছিল। বিফল হয়ে তারা দাশের সঙ্গে যোগ দিল। দাশ নিজে ব্যক্তিগত সন্ত্রাস পছন্দ না করলেও স্বরাজ দল ও কর্পোরেশনের কাজে তাদের সাহায্য দরকার ছিল। গোপীনাথ সাহার ব্যাপারে গান্ধীর প্রকাশ্য বিরোধিতা করতে তিনি দ্বিধা করেননি। আসলে গান্ধী কাউন্সিল—রাজনীতিতে কোনদিন বিশ্বাস করতেন না। আর দাশ চান প্রদেশে ডায়ার্কি বানচাল করে ও কেন্দ্রে চাপ সৃষ্টি করে তিনি ডোমিনিয়ান স্ট্যাটাস আদায় করবেন। তার জন্য ফরিদপুর কংগ্রেসে সন্ত্রাসবাদীদের চটাতেও তিনি দ্বিধা করেননি। তাঁর আর এক সহায় ছিল হিন্দু—মুসলিম প্যাক্ট। কিন্তু অকালমৃত্যুর পর প্রাদেশিক কংগ্রেসে দলাদলি (যতীন্দ্রমোহন বনাম সুভাষচন্দ্র) চরমে ওঠ। কিছু হিন্দু নেতার চাপে মুসলিমদের সঙ্গে চুক্তিও ভেঙে যায়। কেন্দ্রে মতিলাল নেহরুর স্বেচ্ছাচারিতায় জয়াকর, মালব্য প্রমুখ স্বরাজী নেতা ও সহযোগী ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টির নেতা জিন্নাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ১৯২৬ সালের নির্বাচনে স্বরাজ দলের ভরাডুবি হয়।

মোটামুটি এটাই ছিল কংগ্রেস নেতৃত্বে গান্ধীর প্রত্যাবর্তনের পটভূমিকা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দমনে অসমর্থ হয়ে ও স্বরাজীদের আপন কৌশল মানাতে না পেরে ১৯২৫ থেকে গান্ধী রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। স্বরাজী দলের আত্মকলহ ও পরাজয় তাঁকে ফিরে আসার সুযোগ করে দিল। এ সময় তিনটি নতুন শক্তির উদ্ভব হয়েছিল — (১) জওহরলাল, সুভাষচন্দ্র প্রভৃতি তরুণ কংগ্রেসি, যাঁরা দাস—মতিলালের ডোমিনিয়ান স্ট্যাটাস মানতে অরাজি, (২) কংগ্রেসের বাইরে সামব্যাদী দলের অভ্যুদয় ও তার নেতৃত্ব শ্রমিক সংগঠনের প্রসার এবং বোম্বাই অঞ্চলে দর্শনীয় সাফল্য, (৩) হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন প্রভৃতি নতুন ও পুরাতন যুগান্তর—অনুশীলন বিপ্লবীদের পুনরুত্থান (এদের মধ্যে সূর্য সেন, ভগৎ সিং প্রমুখ ছিলেন)।

মতিলাল নরমপন্থী সাপ্রুর সঙ্গে মিলে তখন ভারতীয়দের জন্য এক শাসনতন্ত্র প্রস্তুত করেছিলেন, যার লক্ষ্য হবে ডোমিনিয়ান স্ট্যাটাস। এই সঙ্গে চলছিল সর্বদলীয় কনফারেন্সের মাধ্যমে হিন্দু—মুসলিন সমঝোতার নানা চেষ্টা।

মতিলাল ও সাপ্রু মিলে বহু কষ্টে এক শাসনতন্ত্রের খসড়া রচনা করলেন বটে কিন্তু হিন্দু মহাসভা ও শিখ লিগের চাপে পড়ে মতিলাল বাংলা ও পাঞ্জাবে মুসলিম আসন সংরক্ষণ তুলে নিলেন। আর মুসলমানরা দাবি করল পাঁচটি প্রদেশে নিশ্চিত মুসলিম শাসন, যুক্তরাষ্ট্র ও প্রদেশের হাতে রেসিডুয়ারি ক্ষমতা অর্পণ। উত্তরপ্রদেশের মুসলমানরা স্বতন্ত্র নির্বাচন, ওয়েটেজ কোনটাই ছাড়তে রাজি নয়। বাংলার মুসলমানও জনসংখ্যার হাতে ৫৪% আসন চাইল। এসব চিন্তা না করেই, তরুণ তুর্কীরা পূর্ণ স্বরাজের দাবি তুললেন। তা ঠেকাতে বিলেত থেকে সাইমন কমিশনের আবির্ভাব ঘটল। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিল কমিশনের প্রতিবাদে সোচ্চচার জন সমারোহের ওপর লাঠিচালনার ফলে লাজপৎ রায়ের মৃত্যু। মতিলালদের শরণ নিতে হলে গান্ধীর—যাঁর কথা নবীনপ্রবীণ, হিন্দুমুসলিম, কৃষকশ্রমিক, শুনলেও শুনতে পারে। তিনি ১৯২৭—এ জওহরলাল নেহরু আনীত স্বরাজ প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়ে, ১৯২৮—এ মতিলালকে সভাপতিরূপে বসিয়ে এবং তাঁর ডোমিনিয়ান প্রস্তাবকে পূর্ণ সমর্থন জুগিয়ে কংগ্রেসের ভাঙন ঠেকালেন। ১৯২৮—এর কলকাতা কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র ও বিপ্লবী—শ্রমিক নেতাদের ঘোর প্রতিবাদের ফলে গান্ধী ব্রিটিশ সরকারকে এক বছরের বেশি সময় দিতে পারলেন না। বোঝা গেল—তিনি সাময়িক শান্তি স্থাপন করতে পারেন কিন্তু নবউদ্বোধিত শক্তির পুরো মোকাবিলা করতে পারেন না। তাঁর সত্যিকারের ভূমিকা ছিল ভারতীয় বিভিন্ন দলের মধ্যে এবং তাঁদের ও ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতা। আরুইনের ডোমিনিয়ান প্রস্তাব যখন ব্রিটিশ সরকারের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে বানচাল হয়ে গেল, তখন তিনি লাহোর কংগ্রেসে পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব সমর্থন করলেন। অনিচ্ছা ছিল, কারণ (১) সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির অবনতি। (২) কংগ্রেসে অর্থ ও শৃঙ্খলার অভাব। কিন্তু বিশ্বব্যাপী মান্দ্য তাঁকে বাধ্য করল। মান্দ্যের ফলে ভারতের কৃষিজাত পণ্য মার খেল— হঠাৎ বেড়ে গেল খাজনা, সুদ ও করভার। দরিদ্র কৃষকশ্রেণীর মধ্যে যে বিদ্রোহের মানসিকতা সৃষ্টি হল তা কংগ্রেসের অহিংস আন্দোলনের খাতে প্রবাহিত করতে না পারলে বিপ্লবী ও সাম্যবাদীরা তা হিংসার পথে নেবে—বুঝতে পারলেন গান্ধী।

অতএব ১৯৩০ সালে লবণ আইন অমান্য দিয়ে তাঁর নেতৃত্বে দ্বিতীয় আন্দোলন শুরু হল। ডাণ্ডি অভিযান আবার দেখাল গান্ধীর প্রতি বলিষ্ঠ পদক্ষেপে ভারত কিভাবে উত্তাল হয়ে ওঠে — আর নিরস্ত্র জনসাধারণ কি অসাধারণ সহ্য শক্তি দ্বারা হিংস্র সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণ প্রতিহত করে। সবচেয়ে ধৈর্য্য দেখায় পেশওয়ারের পাঠান— আব্দুল গফফর খানের খুদাই খিদমদগার। নতুন মাত্রা যোগ করে মহিলা স্বেচ্ছাসেবীরা। বেআইনি লবণ তৈরি, বিলেতি কাপড় ও মাদক দ্রব্য বিক্রেতার পিকেটিং, ইউনিয়ান বোর্ডের সভ্য এমনকি চৌকিদারদের পদত্যাগ, কর বন্ধ করার ফলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, বন আইন অমান্য, মাদ্রাজে খাজনা বন্ধ, গুজরাটে পটিদার পাটেল প্রভৃতি কর্মচারিদের পদত্যাগ ও সরকারি চাকুরেদের সামাজিক বয়কট, আগ্রা ও রায়বেরিলির ব্যাপাক কৃষক আন্দোলন — প্রমাণ করে যে এবারকার অভিযান কী বিচিত্র ও ব্যাপক ছিল।

কিন্তু গান্ধী চিরদিন সবরকম মতবাদীদের নিয়ে চলতে চেয়েছেন। প্রতিবাদ এল দু পক্ষ থেকে — (১) নরমপন্থী— যাঁরা চেয়েছিলেন সাময়িক চুক্তির পর দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান, (২) তাদের পিছনে পুরুষোত্তমদাস ঠাকুরদাস, কে. স্রফ প্রমুখ বোম্বাইয়ের বণিককুল। বয়কটের ফলে বিলাতি বস্ত্রশিল্পের মালিকরাও খুব ঘা খেয়েছিল। তারা বড়লাট আরুইনকে সন্ধির জন্য চাপ দিচ্ছিল। উভয়ের মিলিত ফল — গান্ধী—আরুইন চুক্তি এবং করাচি কংগ্রেসের পর গান্ধীর দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান।

বলা বাহুল্য, কি জওহর, কি সুভাষ, আন্দোলন বন্ধ করা পছন্দ করেননি। কিন্তু তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন এই আন্দোলনে মুসলমানরা ও শ্রমিকরা যোগ দেয়নি। গান্ধীর কাছে আরও বড় ঘটনা— বাংলায় হিংসাত্মক বিপ্লবপন্থার পুনরাবর্তন। শুধু ১৯৩০ সালেই চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন, জালালাবাদে যুদ্ধ, লোম্যান হত্যা ও বিনয়—বাদল—দীনেশের রাইটার্স অভিযান ঘটে।

গান্ধীকে চুক্তির জন্য দোষ দিয়েছে বামপন্থীরা। বিপান চন্দ্রের মতে, গান্ধীর এগার দফা দাবি FICCI— র দাবির প্রতিধ্বনি কিন্তু শ্রমিকদের অসহযোগ সম্বন্ধে কি বলবেন তাঁরা? কি বলবেন হিংসাত্মক ঘটনা সম্বন্ধে? আরুইনের মতে গান্ধী চাইছলেন Independence with partnership —সম্পর্ক ছেদ নয়, উভয়ের সমান মর্যাদাও লাভ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ডোমিনিয়ান স্ট্যাটাস পাওয়া যাবেই — ১৯৩০—৩১ এর সংগ্রাম তার পথ প্রশস্ত করেছে। কিন্তু মুসলিম ও রাজন্যদের সঙ্গে বোঝাপড়া চাই। তাছাড়া চুক্তির শর্ত বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে— গান্ধী সব শ্রেণীর জন্য কিছু কিছু সুবিধা আদায় করেছিলেন। হয়তো উত্তরপ্রদেশের গুজরাটের ক্ষেত্রে আমলারা তা হতে দেয়নি, কিন্তু তা গান্ধীর দোষে নয়। সর্বোপরি বৈঠক প্রত্যাখ্যান করলে ভারত বৈদেশিক সহানুভূতি হারাত। ভগৎ সিং এর ফাঁসি মকুব করতে পারেননি বলে সুভাষচন্দ্র তাঁকে করাচিতে কালো পতাকা দেখান। কিন্তু তাঁর ও যতীন্দ্রমোহনের বাদানুবাদে বাংলার আন্দোলন ব্যাহত হয়নি কি? গান্ধীজি তরুণদের খুশি করতে ভারতীয়দের মৌলিক অধিকার বিষয়ক প্রস্তাব মেনে নিলেন।

চার

কিন্তু গোলটেবিল বৈঠক থেকে তিনি কিছু আনতে পারেননি। সবটা দোষ তাঁর নয়। প্রথমত ব্রিটেনের নবগঠিত জাতীয় সরকারে রক্ষণশীলতা প্রাধান্য পেয়েছিল, (২) ব্রিটেনের আর্থিক সংকট চরমে উঠেছিল — যার ফলে স্বর্ণমান ত্যাগ, (৩) দেশীয় রাজা, মুসলমান ও তফসিলিদের বিরোধিতা — যার পেছনে কলকাঠি নাড়ছিলেন — হোর। ভুল হয়েছিল (১) গান্ধীর একক প্রতিনিধিত্ব। তিনি এত বিরোধী শক্তির সঙ্গে লড়াই করতে পারেননি। (২) সাম্প্রদায়িক বিরোধের সমাধান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকডোনাল্ডের হাতে সমর্পণ করা উচিত হয়নি। তিনি একদা শ্রমিক দলের প্রধানমন্ত্রী হলেও তখন রক্ষণশীলদের হাতের পুতুল — এ কথা বোঝা উচিত ছিল। অতএব, হরিজনদের পৃথক নির্বাচন ঠেকাতে তাঁকে আমৃত্যু অনশনের শপথ নিতে হল। ”It is a call of conscience I dare not disobey.” হিন্দুদের মধ্যে বিভেধ ঠেকাতে পুনাচুক্তি দ্বারা তিনি হরিজনদের অনেক বেশি আসন দিতে রাজি হলেন। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হল বাংলার হিন্দুরা। এই সময় থেকে হিন্দুমহাসভা ও শ্যামাপ্রসাদের অভ্যুত্থান। হিন্দু—মুসলিম সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নিয়ে কংগ্রেসের ‘না গ্রহণ না বর্জন নীতি’ সমর্থন করা যায় না। ভিয়েনা থেকে সুভাষচন্দ্র আপত্তিও জানান। কিন্তু এখানে কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতা আনসারি, খলিকুজ্জমানও গান্ধীকে প্রভাবিত করেছিলেন। আসলে ব্রিটিশ বিভাজন নীতির শিকার হয়েছিলেন তিনি। ফেডারেশন ও কেন্দ্রীয় সরকারের সংগঠনে কংগ্রেসের দাবি নস্যাৎ হয়। এতসব শাসনতান্ত্রিক গোলমালে গুজরাটে ও উত্তরপ্রদেশের কৃষকদের অভিযোগ হারিয়ে যায়।

গান্ধীজি আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান— নেহরু ত বটেই। কিন্তু নতুন সংস্কার আইনে নির্বাচন যত এগিয়ে আসে তত নরমপন্থী এবং পরিষদীয় রাজনীতিতে আগ্রহী সুবিধাবাদী কংগ্রেসীদের চাপ বাড়ে। অথচ পুরো প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনও গভর্নরের বিশেষ ক্ষমতা দ্বারা ব্যাহত হয়েছিল। নেহরুর ডায়েরিতে গান্ধীর সম্বন্ধেও কটাক্ষ রয়েছে। প্রথমে অনশন, মুক্তির পর আইন অমান্য মুলতুবি, বড়লাটের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা তাঁর ভালো লাগেনি। তিনি গান্ধীকে হরিজন আন্দোলন নিয়ে সময় কাটাতে বললেন— সত্যাগ্রহ চলবে। অন্যদিকে নরিম্যান, আনসারি, বিধান রায়, মুন্সী — সবাই নির্বাচনের পক্ষে। বল্লভভাইকে গান্ধী লিখলেন — ”যারা জিলিপির স্বপ্ন দেখছে তারা খেয়ে দেখুক কেমন লাগে।” তিনি আবার কংগ্রেস রাজনীতি ছেড়ে খাদি, চরখা, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণে ফিরে গেলেন। বম্বে কংগ্রেস তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নিল।

কংগ্রেসে এক নতুন মোড় নিল সমাজতন্ত্রের প্রশ্নে। জওহরলাল শুধু সংস্কার প্রত্যাখ্যান করলেন না, জয়প্রকাশ, লোহিয়া ইত্যাদির মদতে এক নতুন ইডিওলজি ঘোষণা করলেন। দক্ষিণপন্থরী গান্ধীর শরণ নিলেন, কারণ তাঁরা চান সংস্কারানুযায়ী নির্বাচনে জিতে মন্ত্রিত্ব। গান্ধী নেহরুকে সভাপতি করে তাঁর ডানা ছাঁটলেন। সভাপতির ভাষণে অবশ্যই তিনি বললেন, সরকার গঠন লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য ফেডারেশনের বিরোধিতা, সংস্কার বানচাল করা। দ্বিতীয়ত, দেশকে সমাজতন্ত্রের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। সমাজতন্ত্র রুশ মডেলে হতেই হবে তা নয়। ভারতের অবস্থানুযায়ী হবে, তাকে গণতন্ত্র অবশ্যই মানতে হবে, অহিংসার পথ ছাড়াও চলবে না। গান্ধীজির কথায় চোদ্দজনের ওয়ার্কিং কমিটিতে দশজন পুরনোপন্থী স্থান পেলেন। নেহরু সুভাষের মত ভুল করেননি, গান্ধীর সঙ্গে তর্ক করতে গিয়ে ভর্ৎসিত হয়েও। কংগ্রেসের এতে লাভও হয়েছিল। সমাজতন্ত্রী নেহরুকে দেখিয়ে ১৯৩৭ এর নির্বাচনে তারা দারুণ সুফল পায়— সাত সাতটা প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠন করে। গান্ধীর একটা শর্ত ছিল— কংগ্রেসের উন্নয়নকর্মে ছোটলাটরা বিশেষ ক্ষমতাদ্বারা বাধা সৃষ্টি করতে পারবেন না। তিনি নিজে কিন্তু সংস্কার ও গণপরিষদ চেয়েছিলেন। লিনলিথগোর চিঠিতে পাই — না করলে সি.পি, ইউ.পি., বিহার ও মাদ্রাজের কংগ্রেসীরা ভেঙে যেত। নেহরু হয়তো তা অগ্রাহ্য করতে পারেন, গান্ধী পারেন না। এটা দেশভাগের প্রস্তাবেও দেখা গেছে। তবে মনে রাখতে হবে ভারত সচিব এবং ক্যাবিনেটও গান্ধীর শর্ত নিয়ে গোলমাল করতে চাননি। অন্যদিকে প্রথম সারির নেতারাও মন্ত্রীপদ নেননি। সরকার গঠনের সমর্থনে ‘হরিজন’—এ গান্ধীজি জোর দেন (১) সরল জীবন চর্যা, (২) মাদক বর্জন (৩) কৃষকদের অবস্থার উন্নতিসাধন (৪) প্রাথমিক শিক্ষা ও কলেজি শিক্ষার পরিবর্তন। ওয়ার্কিং কমিটি এক চোদ্দ দফার কর্মনীতি ঘোষণা করে। দমনমূলক আইন প্রত্যাহার ও বন্দীমুক্তির স্থান ছিল প্রথম।

গান্ধীজির আসল পরীক্ষা হল ১৯৩৮—৩৯—এ নতুন সভাপতি সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বে। রাসকিন—টলস্টয়ের শিষ্য এবং হেগেলের শিষ্যে তফাৎ ত থাকবেই। গান্ধীর স্বরাজ আধ্যাত্মিক, সুভাষের রাজ্য অর্থনৈতিক, গান্ধীর উপায় সত্য ও অহিংসা, সুভাষের— কৌটিল্যাচার : আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী বাস্তববুদ্ধির, প্রয়োগ, শত্রুর শত্রুর সঙ্গে মিত্রবৎ আচরণ। ”We should take a leaf out of Russian diplomacy.” দাশের সঙ্গে গান্ধীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা উভয়ের সম্পর্কের ওপর ছায়া ফেলেছে — তার চেয়েও বড় ছায়া — সুভাষের সঙ্গে বিপ্লবপন্থীদের যোগাযোগ। তরুণ জওহরকে গান্ধী বশ করেছেন কিন্তু কলকাতা ও করাচিতে সুভাষকে নয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন কখন ও কিভাবে পরিচালনা করতে হবে এ নিয়ে দুজনে ছিলেন বিপরীত মেরুতে এবং তাই ত্রিপুরীতে সংঘাত চরমে ওঠে। উভয়েই messianic এবং উভয়েই নিজের মত ও পথ সম্বন্ধে আপসহীন।

স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস গ্রন্থে গান্ধী ও সুভাষের সংঘর্ষ আমি অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছি। প্রজন্মের পার্থক্য ছিল, আদর্শের বিরোধ ছিল, আন্দোলনের নীতি ও প্রয়োগ নিয়ে বৈষম্য ছিল, সর্বোপরি ছিল গান্ধীর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটা অপ্রচ্ছন্ন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সুভাষ একটা ভুল করেছিলেন — কংগ্রেসের সভাপতি পদে নির্বাচনকে শেষ কথা মনে করে, যেখানে ওয়ার্কিং কমিটি ও এ.আই.সি.সি ছিল গান্ধীবাদীর হাতে। অতএব গান্ধীর সমর্থিত সীতারামাইয়াকে হারালেই কংগ্রেসের সর্বময় কর্তৃত্ব দখল করা যায় না। তারা নেহরুর সমাজতন্ত্রে আপত্তি জানিয়েছে, হরিপুরার প্রস্তাবে করবে আশ্চর্য কি!

গান্ধী মনে করতেন আন্দোলনের সময় হয়নি (১) সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের জন্য। (২) কংগ্রেসে ব্যাপক দুর্নীতির জন্য। অথচ সুভাষ মনে করতেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, অর্থাৎ আসন্ন বিশ্বযুদ্ধ, সে পথ প্রস্তুত করেছে। তাঁর ভয় ছিল কংগ্রেস ফেডারেশনের ফাঁদে পা দিতে পারে। গান্ধী আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নেহরুর ওপর নির্ভর ছিলেন। আর ফেডারেশনে তিনি বা কংগ্রেসের প্রধান কর্তারা বিনা শর্তে গ্রহণ করতেন না। অবিশ্বাস ছিল উভয়পক্ষে। সুভাষকে সমাজতন্ত্রী ও সামব্যবাদীরা সমর্থন করছে এটা দক্ষিণপন্থীদের মনঃপূত হতে পারে না। সুভাষের ক্রোধের একটা কারণ — বাংলায় হকের সঙ্গে কোয়ালিশন গড়তে দেওয়া হয়নি।

ত্রিপুরী কংগ্রেসে পন্থ—প্রস্তাবের পটভূমিকায় এই ভুল ভুল বোঝাবুঝি। ব্যাপারটা হয়ত গড়াত না যদি নেহরুর পরামর্শ শুনে সুভাষ ওয়ার্ধা গিয়ে একটা মিটমাট করে নিতেন। দক্ষিণপন্থীরা আবার এককাট্টা হল — প্যাটেল প্রমুখ বারোজন সদস্য পদত্যাগ করলেন, ত্রিপুরীতে সমাজতন্ত্রীরা পুরো সমর্থন করেনি। গান্ধী ছিলেন রাজকোটে। সুভাষ গুরুতর অসুস্থ। যাইহোক, পরে তিনি যদি নিজে ওয়ার্কিং কমিটি তৈরি করতেন, কিছু বলার ছিল না। তিনি চাইলেন গান্ধীকে দিয়ে এক Composite committee তৈরি করিয়ে এ.আই.সি.সি.তে পাশ করাতে। গান্ধীর দিকে থেকে কোনও নমনীয় ভাবের পরিচয় মেলে না— রবীন্দ্রনাথের সুপারিশেও নয়। তাঁর নানা মহাত্মাসুলভ কাজের সঙ্গে এই দাক্ষিণ্যের অভাব মেলাতে পারা যায় না। ১৯৩৪ সালে তিনি বলেছিলেন, কংগ্রেসের দৈনন্দিন বা স্থানীয় রাজনীতির ব্যাপারে তিনি নাক গলাবেন না। কিন্তু, মনে রাখতে হবে, সুভাষ তাঁকে সর্বভারতীয় নেতৃত্বের খাতে প্রবাহিত করতে চাইছেন। জুডিথ ব্রাউনের মন্তব্য স্মরণীয় — ”he could be ruthless if he felt the unity of The Congress was threatened, or that its acceptance of non-violence was being compromised.” সুভাষের বাঙালি (এবং বিপ্লবপন্থা ঘেঁষা), সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদী অনুচরদের কোনো ব্যতিক্রমী কাজ তিনি সহ্য করতে রাজি হননি। যাঁরা এ বিষয়ে আগ্রহী তাঁরা আমার বই ছাড়া টমলিনসনের ‘‘The Indian National Congress and the Raj’ এবং লেনার্ড গর্ডনের ‘‘The Brothers against the Raj” পড়তে পারেন।

রামগড় কংগ্রেসে যে আবার তাঁর অবিসংবাদিত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল তা সব গোয়েন্দা প্রতিবেদন স্বীকার করছে। কিন্তু যুদ্ধ বাধলে, স্বাধীনতার দ্ব্যর্থহীন শপথের বদলে কংগ্রেস রাজকে সমর্থন করবে কিনা বা সৈন্য জোগাবে কিনা এ সব প্রশ্নে মত বিরোধে তা প্রমাণিত হয় না। ১৯৪০ এর জুন—জুলাই এর ওয়ার্কিং কমিটি ও এ.আই.সি.সি প্রস্তাব দ্রষ্টব্য। ২৯ জুন ‘হরিজন’—এ কিন্তু সব সম্পর্ক ছাড়ার কথা তিনি বলেননি। ফিরে আসার পথ খোলা রেখেছিলেন এবং সেই পথ দিয়েই ‘ভারতছাড়ো’ আন্দোলনের নেতা হয়েছিলেন।

১৯৩০ সালে আরুইনের সঙ্গে আলোচনার মতো এবারও লিনলিথগোর সঙ্গে আলোচনা দিয়ে শুরু হল। কিন্তু রাজের অনমনীয় মনোভাব তাঁর ধৈর্যও ভঙ্গ করল। যে তিনটি প্রধান গণআন্দোলন তিনি শুরু করেন, তার মধ্যে প্রথম দুটি তিনি শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেছেন বা প্রত্যাহার। কিন্তু ‘ভারত ছাড়ো’ এর ব্যতিক্রম। অবশ্যই তিনি এর সূচনা করে গেছেন — কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে প্রথম সারির নেতা সহ গ্রেফতার হওয়ার জন্য এর নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে ছিল না। দ্বিতীয়ত, এতদিন অহিংসার ওপর এত জোর দেবার পর, এমন কি অনেকটা এইজন্য সুভাষের সঙ্গে বিরোধের পর, তিনি এবার দোফাঁদা কিছু কথা বলেছিলেন, (যেমন করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে) যার সুযোগ নিয়েছে সমাজতন্ত্রী, ফরোয়ার্ড ব্লক, বিপ্লববাদী এবং উগ্র অসহিষ্ণু কংগ্রেসীরা। তৃতীয়ত, ব্রিটিশ সরকার এবং তার ভারতীয় প্রতিনিধিদের অনমনীয় অবিবেচনার জন্য গান্ধীর ক্রোধ হওয়া স্বাভাবিক। গান্ধীর কথাবার্তায় এই প্রথম একটা চাপা ক্রোধের সুর শোনা গেল। চতুর্থত, হয়তো নিজে তিনি তা সংবরণ করতে পারতেন, কিন্তু সমগ্র ভারতবাসীর অপমানকে একটা প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের ভাষা দিতেই হত। তিনি ভেবেছিলেন ‘ভারত ছাড়ো’ সেরকম কিছু হবে এবং বাড়াবাড়ি হলে তিনি তা সংযত করতে পারবেন। লিনলিথগো যে আরুইন নন, চার্চিল নন ম্যাকডোনাল্ড — এ কথা ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধে কোণঠাসা হলে ব্রিটিশ জাতের কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে বোধ তাঁর ছিল না। নেহরু বারবার যুদ্ধের ইডিওলজিকাল প্রকৃতি সম্বন্ধ তাঁকে অবহিত করেন, করেন লুই ফিশারের মত সাংবাদিক, কিন্তু কেউই তাঁকে স্পর্শ করতে পারেননি। দুটো মানসিকতা কাজ করেছে — (১) ইংরেজদের ভয় দেখিয়ে আলোচনায় বসতে বাধ্য করা এবং ক্রিপস—প্রস্তাবের চেয়ে কিছু বেশি প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য করা, (২) সুভাষচন্দ্রের বিদেশ থেকে ভারত অভিযানের একটা জবাব দেওয়া। স্বদেশে বসেই লড়াই দিতে হবে। তাঁর একটা অদ্ভুত ধারণা ছিল, ব্রিটিশ ভারত ত্যাগ করলে জাপান আক্রমণ করবে না; যদি করে তিনি তা অহিংসা দিয়ে ঠেকাবেন। এ সব ধারণার মূলে ফাসিজম সম্বন্ধে তাঁর অজ্ঞতা প্রকট— যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ চেক ও পোলদের হিটলারকে অহিংস অসহযোগ দিয়ে ঠেকানোর প্রস্তাব। কিন্তু তাঁর এ যুক্তিও সত্য যে ভারতই হচ্ছে সেই নিকষ যাতে ব্রিটেন ও আমেরিকা ঘোষিত Waraims- এর যাচাই হবে। ব্রিটিশ স্বৈরতন্ত্র মানলে জাপানি স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধ করার নৈতিক শক্তি ভারতের থাকবে না, রাশিয়া বা চিনকে সাহায্য করার ক্ষমতাও। তবু তিনি রুজভেল্টকে লিখেছিলেন (১ জুলাই ১৯৪২) — স্বাধীন ভারতে মিত্রশক্তি সৈন্য রাখতে তিনি রাজি। আপসের জন্য এটা তাঁর পক্ষে বিরাট ত্যাগ— একথা ভুললে চলবে না। কিন্তু আন্দোলন যদি হিংসার পথে যায়? তিনি বললেন, অরাজকতার ভয় উত্তীর্ণ হতে না পারলে অহিংসা ত’ দুর্বল থেকে যাবে। সাপ্রুর চিঠিতে পড়ি, এটা অহিংসার জন্য একটা ”Last and risky throw.” তারপর বললেন, আন্দোলন হবে — ”Short and sharp” — তা বেশিদিন স্থায়ী হবে না, অর্থাৎ হিংসার সম্ভাবনা স্বল্প। কিন্তু কেন তা ভাবলেন? তাঁর এ বিষয়ে কোনো রণকৌশল ছিল না। তার প্রমাণ সেই দুর্ভাগ্যজনক মন্তব্য — ”Leave India to God or to anarchy.” এ তো কোনও অভিজ্ঞ সেনাপতির কথা নয়। অথচ প্রতিপক্ষের চিঠিপত্রে পড়ি সর্বরকম সম্ভাব্য রণকৌশল আলোচিত হয়েছে। তাঁর শেষ উপদেশ— ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ যে নানাভাবে ব্যাখাত হতে পারে এ ধারণা তাঁর ছিল না। ”করো অথবা মরো’র চেয়ে বড়ো হল ”করো অথবা মারো”। যেখানে লিনলিথগোরা তাঁর বিরুদ্ধে তিনটি প্রকার রচনা করেছিলেন— রাজন্যবর্গ, লিগ ও কম্যুনিস্ট পার্টি — সেখানে তিনি দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির নেতাও নির্বাচন করে যাননি। ‘এখন প্রত্যেক ভারতীয়ই নেতা’— এই যদি নির্দেশন হয় — তবে বেপরোয়া এবং হিংস্র পথে আন্দোলন যেতে বাধ্য।

ফল কি হল? (১) বাংলায় ও পাঞ্জাবে লিগের হাত শক্ত হল, (২) এখন থেকে বড়লাটরা কংগ্রেস ও লিগকে সমপর্যায়ভুক্ত করলেন, ওয়াভেল আবার গান্ধী ও জিন্নাকে সমান আসন দিলেন, (৩) গান্ধীর অনশনকে আগে সমীহ করা হত। এখন ব্যঙ্গ করা হল, (৪) শুধু রক্ষণশীলন দল নয়, অ্যাটলির মত শ্রমিক দলের নেতাও একে পিছন থেকে ছুরি মারা ভাবলেন— তাই দেশভাগ রুখতে সাহায্য করেননি, (৫) সাধারণের হাতে নেতৃত্ব যাওয়ায় চৌরিচৌরার চেয়ে ঢের বেশি হিংসা দেখা দিল। জুডিথ ব্রাউনের ভাষায়, ”The Quite India movement was totally un-Gandhian in its from and intention.”

তবে স্বীকার করতে হবে ভারত অপমানজনক কোন শর্তের কাছে মাথা নত করেনি, দমননীতি Counter-productive হয়, কিছু এলাকা সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ কবলমুক্ত হয় এবং বৎসরাধিক কাল সর্বোপরি এই সুবাদে (এবং সুভাষের আই.এন. এ—র সুনাম জড়িয়ে) ১৯৪৬ সালে বিপুল ভোটাধিক্যে জিতল কংগ্রেস। তবু প্রশ্ন থাকে — ঢোঁড়াইদের কি সুবিধা হল? এবং লিগের পাকিস্তান দাবি কি আরও সরব ও জোরদার হল না? রাজাজি প্রস্তাব নিয়ে জিন্নার সঙ্গে আলোচনা হল। জিন্না বললেন— ”It is quite clear that you represent no body but the Hindus.” তাঁর জোর কত! পেছনে ক্রিপসের Local option এর প্রতিশ্রুতি, লিনলিথগোর ভিটো, ওয়ালভেলের প্রচ্ছন্ন সমর্থন। সাত সাতটা প্রদেশে কংগ্রেসী মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করার পুরো ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছেন তিনি। সফল হয়েছে আসামে, সিন্ধুতে, বাংলায়, এমনকি কিছুটা পাঞ্জাবেও। তাঁর সঙ্গে রাজাজি—প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা ভুল হল — স্বীকার করেছেন সাপ্রু ও আজাদ। ১৯৪৪ থেকে মোল্লা ও মৌলবিদের কল্যাণে পাকিস্তান ভাবনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল।

গান্ধীজি যে কত বড় আইনজ্ঞ ছিলেন তার বিবরণ আমরা সচরাচর পাই না। বহুবার তিনি ইংরেজদের তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করেছেন। তাদের খসড়ার ভুল ধরেছেন বা কূটচাল প্রকাশ করে দিয়েছেন। এখন থেকে যে তিনটি বিস্তৃত শাসনসংস্কার বিষয়ক আলোচনা হয় তাতে এই পরিচয় মেলে। সিমলা বৈঠকের প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বর্ণহিন্দু ও মুসলিম সমতায় আপত্তি জানান এবং মুসলমান তপসিলীদের মনোনয়ন দেবার ক্ষমতা কংগ্রেসের থাকবে ঘোষণা করেন। অর্থাৎ কংগ্রেস সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান এবং সেই সুবাদেই একজিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে হিন্দু ও মুসলিমের দুটি করে এবং পার্শি ও খ্রিস্টানদের একটি করে নাম দিয়েছিল। জিন্না শুধু সমস্ত মুসলিম নাম দেবার দাবি তুললেন না, কাউন্সিলে মুসলিমদের আপত্তি উঠলে সাম্প্রদায়িক ভিটো দাবি করলেন। ওয়াভেল ঠিকই ধরেছিলেন — ”জিন্না প্রথম চান ‘পাকিস্তান’, তারপর স্বাধীনতা, আর গান্ধী প্রথম চান স্বাধীনতা, এবং তার সঙ্গে মুসলিমদের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণ যা দেবে সাময়িক সরকার (এবং যা অবশ্যই মুখ্যত হিন্দু হবে)”। তিনি জিন্নার সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীল রূপ ভাল ভাবেই চিনতেন। পাকিস্তান বলতে জিন্না বুঝতেন — ভারতের কয়েকটি মুসলিম অঞ্চলে শুধু মুসলিম ভোটের মাধ্যমে স্বতন্ত্র শাসন। অন্যদিকে কংগ্রেসের সম্বন্ধে। বহু তিক্ত স্মৃতি (যার অন্যতম ক্রিপস মিশন ও ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন) তাঁকে কংগ্রেস প্রভাবিত কাউন্সিলে রাজি করাতে পারেনি। তাছাড়া চার্চিল তা হতেও দিতেন না।

ক্যাবিনেট মিশনের পেছনে কিন্তু কোনও বামপন্থী বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের চাপ ছিল না। ১৯৪৫, ২১ শে নভেম্বরের আই.এন.এ প্রতিবাদ দিবস (রামেশ্বর যাতে শহীদ), ১৯৪৬—এ ১১ ফেব্রুয়ারি (রসিদ আলি নিয়ে) পুলিশ—মিছিল সংঘর্ষ ও ১৫ ই পর্যন্ত তা নিয়ে অশান্তি, ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে নৌ—বিদ্রোহ— নাকি ব্রিটিশ সরকারকে ক্যাবিনেট মিশন পাঠাতে বাধ্য করে। বড় লাটের ডায়েরি পড়লে তা মনে হবে না। তাছাড়া ক্যাবিনেট এ—বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ২২ জানুয়ারি। বরং কাজ করেছিল ১৯৪৫—৪৬—এর সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল। ভারতে যে ভোগ্যপণ্যের বিরাট বাজার, বিপুল স্টারলিং ব্যালান্সের মালিক, মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রতিরক্ষার খুঁটি।

গান্ধী প্রথমেই যে—চাল চাললেন তাতে জিন্না ছাড়া যে—কেউ মাত হবেন — অর্থাৎ জিন্নাই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করুন। জিন্না তা প্রত্যাখ্যান করে চাইলেন সার্বভৌম পাকিস্তান, যাতে থাকবে বাংলা, আসাম, পাঞ্জাব, সীমান্ত, সিন্ধু ও বালুচিস্তান এবং যার সীমানা নির্ধারণে কোন অঞ্চলের লোক গণনা চলবে না। একটা উদাহরণ দেন তিনি — পূর্বে পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যে কলকাতাকে থাকতেই হবে। মুখ্য বিরোধ বাধল (১) এক সার্বভৌম দেশ না দুই সার্বভৌম দেশের ইউনিয়ন? (২) শক্তিশালী কেন্দ্র না বিভিন্ন প্রদেশ ও প্রদেশের জোট? গান্ধী জোট বাঁধার নীতি ও সরকারে হিন্দু—মুসলিম সমতা প্রত্যাখ্যান করলেন।

১৬ মে ক্যাবিনেট মিশন যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ঘোষণা করল গান্ধী দেখিয়ে দিলেন তার ১৯ ধারা ও ১৫ ধারা স্ববিরোধী। তাছাড়া গণ পরিষদ সার্বভৌম, অতএব এসব শর্ত পরিবর্তন বা বাতিল করার অধিকার তার আছে। আসলে গান্ধী সীমান্তকে ‘বি’সেকশন ও আসামকে ‘সি’ সেকশানের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছেন না (আসলে পাকিস্তানের নামে দেশ ভাগের বিরোধিতা করেছেন)। ওয়াভেল প্রত্যেক ব্যাপারে, বিশেষ করে আবশ্যিক গ্রুপিং—এর ব্যাপারে (যদিও ১৯ ও ১৫ ধারা স্ববিরোধী), অনড়। অন্তর্বর্তী সরকারের ক্যাবিনেট মর্যাদা দিতেও তাঁর আপত্তি ছিল। সবাই ব্যস্ত সরকার গড়া নিয়ে, গান্ধীর লক্ষ্য— দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা। শেষে শর্তসাপেক্ষ লিগও একই রূপে কংগ্রেস ১৬ মে—র প্রস্তাব মেনে নেয়। কিন্তু কংগ্রেস ১৬ জুনের (সরকার গড়ার) প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস চায় মুসলিম প্রতিনিধি মনোনয়নের অধিকার আর জিন্না আবদার ধরেন তিনিই (অর্থাৎ লিগ) একমাত্র তাতে অধিকারী। ওয়াভেলের পক্ষপাতিত্ব এত স্পষ্ট যে নতুন প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি স্থির করেন তাঁকে সরিয়ে দেওয়া উচিত। ওয়াভেলের ডায়েরি পড়লে মনে হবে গান্ধীর মত শয়তান তিনি দেখেননি ( ‘real wrecker’ ‘Snake in the grass’, ‘Double tongued’ ইত্যাদি)।

এইবার শেষ পর্ব। কংগ্রেস রাজনীতির দিক থেকে — গান্ধী বহিষ্কার (মাউন্টব্যাটেন তাতে সানন্দে সম্মত)আবার দেশজোড়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিপ্রেক্ষিতে — গান্ধীর finest hour । নতুন রাষ্ট্রপতি (তখন তাই বলা হত) নেহরুর ১০ জুলাই এর প্রেস সাক্ষাৎকার (কংগ্রেস গণপরিষদে যাবে— absolutely free to act) জিন্নাকে ক্ষিপ্ত করল। শুধু তিনি ১৬ জুনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন না, উপরন্তু দেশ জোড়া direct action অর্থাৎ দাঙ্গাহাঙ্গামার হুমকি দিলেন — যার পরিণতি ‘The great Calcutta killing’। তার উত্তরে বিহার, তার উত্তরে নোয়াখালি — ইত্যাদি। এখানে আমার একটা বক্তব্য আছে। ১৫ টি প্রাদেশিক কমিটির ১২ টি প্যাটেলকে সমর্থন করলেও গান্ধী নেহরুকে তুলে ধরলেন কেন? রাজেন্দ্রপ্রসাদও বলেছেন — ”Gandhi had sacrificed his trusted lieutenant …” কেন trusted? নেহরু তাঁর ঘোষিত উত্তরাধিকারী? মনে হয়, সেইজন্য তিনি করলেন।

সত্যিই কি তাই? এখানেই ট্র্যাজেডি। ১৯৪৫ সালে স্বাধীন ভারতের রূপরেখা নিয়ে নেহরুর সঙ্গে যে—বিতর্ক হয়ে গেল তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি জানালেন তখনও তিনি ‘হিন্দু স্বরাজ’—এর ইডিওলজি আঁকড়ে আছেন। সত্যিকার স্বাধীনতা পেতে গেলে গ্রামে ফিরে যেতে হবে। গ্রামের সরল সহজ স্বনির্ভর জীবনযাত্রায় হিংসা ও অসত্য ত্যাগ সম্ভব, শহরে নয়। ব্যক্তি যদি তার জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়, তবে প্রথমে বলি হবে দলের কাছে, পরে রাষ্ট্রের কাছে। ”Ultimately, the world is made up of individuals. If there were no drops, there would be no ocean. ” তাঁর স্বপ্নের গ্রামবাসী আজকের গ্রামবাসীর মত জড়, নিশ্চেষ্ট, অচেতন নয়। সে শহরের বস্তিতে আবর্জনার স্তূপে বাস করবে না। কেউ রইবে না অলস বা ভোগের স্রোতে ভাসমান। কায়িক শ্রম হবে আবশ্যিক। যেমন আবশ্যিক আধুনিক প্রযুক্তিপ্রসূত ভোগ্যপণ্যের প্রাচুর্য ত্যাগ। রেল বা তার থাকুক না থাকুক, যায় আসে না। নেহরুর কাছে করুণ আবেদন — ”I want that we two should understand each other fully… our bond is not merely political. It is much deeper… neither of us considers himself as worthless… it is only proper that I should at least understand my hair and my hair in trun show to understand me. I shall then be at peace.” সোক্রাতেস জানতে চাইছেন তাঁর শিষ্য অ্যালকিবায়াডেস কোন virtue বা মূল্যবোধের ওপর স্বাধীন ভারতের প্রজাতন্ত্র স্থাপন করবেন।

উত্তরটা আমাদের জানা দরকার — কারণ এরপর থেকে নেহরু গান্ধীকে এড়িয়ে যাবেন, মাউন্টব্যাটেনকে আশ্রয় করবেন। বেশ রূঢ় ভাষায় তিনি লিখলেন, ”Even when I read it (Hind Swaraj) twenty or more years ago it seemed to be completely unreal… the world has completely unreal… the world has completely changed since then…” বিশ বছরে প্রযুক্তির যে উন্নতি হয়েছে তাতে মধ্যযুগীয় রামরাজ্যে বিশ্বাস আঁকড়ে থাকার জনগণকে বঞ্চিত করা। খাদি ও কুটির শিল্পের সম্প্রসারণে কোনও সমাধান হবে না। যে পরিকল্পনার ভিত্তি সুভাষের নির্দেশ তিনি রচনা করছেন তাকেই সুদৃঢ় করতে হবে — অর্থাৎ রুশ মডেলে planned economy. তার ওপর গড়ে উঠবে বিপুল ইস্পাত কারখানা, সার কারখানা, জলাধার, বিদ্যুৎ প্রকল্প। নতুন যুগের নতুন মন্দির এবং যন্ত্রদেবতার উপাসনায় সিদ্ধি নিশ্চিত, আর সিদ্ধির ফলে সমৃদ্ধি যা কল্যাণকামী রাষ্ট্র সবাইকার মধ্যে সুষমভাবে বন্টন করে দেবে। এর কথাই তিনি বলেছেন, লাহোরে, করাচিতে, লখনউ—এ। সুভাষ তাকে কংগ্রেসের নীতিতে পরিণত করেছেন হরিপুরায়। তা মেনে নিয়েছেন দেশের শিল্পপতিরাও। এ সব ছেড়ে ভারতবর্ষ কি ঘড়ির কাঁটাতে যুগের পর যুগ পিছিয়ে নিয়ে যাবে? তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে, স্তালিনের শিল্পনীতির ফলে রাশিয়া এত বড় যুদ্ধের টাল সামলেছে। হায়রে! তখনও তিনি গুলাগ দ্বীপপুঞ্জের কথা জানেন না। অপমানিত মর্মাহত গান্ধী ফিরে গেলেন দুর্ভিক্ষ পীড়িত বাংলায়, পরে দাঙ্গাপীড়িত কলকাতা, নোয়াখালি, বিহার, দিল্লি। রাজনীতিতে তিনি কেউ নন— মাউন্টব্যাটেনের ভাষায় — ‘dear old puppet’ মাত্র। বিড়লাতে তিনি জানালেন ”my voice carries no weight in the W.C… I do not like the shape that things are taking and, I can not speak out.”

তিনি যখন বিহারে, তখন ওয়ার্কিং কমিটি বর্তমানে হিংসা থামাবার উপায় স্বরূপ পাঞ্জাব ভাগ মেনে নেয়। গান্ধী এর জবাবদিহি চান। নেহরুর সোজা উত্তর — বাস্তবকে না মেনে উপায় নেই (২৫ মার্চ ১৯৪৭)। প্যাটেল ঈষৎ ব্যঙ্গের সুরে — ”আপনি অবশ্য নিজের মতে অটল থাকতে পারেন।” (২৪ মার্চ, ১৯৪৭)। ১ লা এপ্রিলের প্রার্থনাসভায়, কংগ্রেসের অবিসংবাদিত নেতা স্বীকার করলেন, ”my write runs no more … I am crying in the wilderness.” ১১ এপ্রিল বড়লাটকে — ”I have to ask you to omit me from your consideration.”

আশ্চর্য এই যে শেষ পর্যন্ত তিনি দেশ ভাগের বিরোধিতা করেছেন। দু’ভাগ হলে দেশ একদিন দশ ভাগ হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁদের আনা স্বরাজকে অভিশাপ দেবে (বড় লাটকে গান্ধী, ৮ মে ১৯৪৭)। ২ জুন বড় লাট যখন তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা নেতাদের জানান, গান্ধীর ছিল নীরবতা দিবস। তাঁর মতামত লেখা আছে পাঁচটি ব্যবহৃত খামের পিঠে। প্রশ্ন উঠবে ব্যক্তিগত আপত্তি সত্ত্বেও কেন তিনি ওয়ার্কিং ও এ. আই.সি. সি —তে বিরোধিতা করলেন না? ঝানু প্যাটেল জানতেন কংগ্রেসের প্রতি তাঁর আনুগত্য তাঁকে বিরোধী শিবিরের নেতৃত্বে করতে দেবে না। শুধু তাই কি? চাইলেই কি তিনি কংগ্রেসের অনুগামী পেতেন? সকলেই তখন ক্ষমতার নেশায় উন্মত্ত। নির্মল বসু অন্য কারণ দেখিয়েছেন।

গান্ধী বুঝলেন, এটা স্বরাজ নয়, রাম রাজ্য তো নয়ই। চারদিকে শুধু ”madness and the vain imitation of the west. প্রতিরোধের জন্য চাই কংগ্রেসের আমূল পরিবর্তন— কতবার তিনি উৎসর্গিত গঠনকর্মী দলে পরিণত করতে চাইছেন কংগ্রেসকে, প্রতিবার জয়ী হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতার দুর্বার লোভ। জীবনের প্রায় শেষ প্রহরে এমনি এক কংগ্রেসের রূপরেখা তিনি রচনা করেছেন কিন্তু ইন্দ্রপ্রস্থের নতুন রাজাদের আলোচনা করার সময় হয়নি। ২৯ জানুয়ারি ১৯৪৮ মৃত্যুর আগের দিন — এমনি এক খসড়া তৈরি হয় — তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্র। কংগ্রেসের রাজনৈতিক কাজ সমাপ্ত, এখন তাকে সত্যকার সামাজিক, নৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য লড়তে হবে।

তার অনেক আগে থেকে তিনি একলা চলেছেন বজ্রানলে বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে। তাঁকে হিংসার উলঙ্গ প্রকাশ রুখতেই হবে— নোয়াখালিতে, বিহারে, দিল্লিতে, কলকাতায়। ডি জি ডলটন ‘দেশভাগের সময় গান্ধী’ নামে সত্যাগ্রহের প্রকৃতি ও গান্ধীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। বেলেঘাটায় তিনি। নিরুপায় হয়ে অনশনের পথ গ্রহণ করেছেন। হয়তো তা নীরব দর্শক হিন্দুদের মনে ঘা দেবে এবং তারা গুণ্ডাদের নিরস্ত করবে। মাউন্টব্যাটেন আগেই তাঁকে ‘One man boundary force’ বলে অভিহিত করেছেন। এখন লিখলেন — ”চার ডিভিশন সৈন্য যা করতে হিমসিম খেয়ে যেত তাঁর moral persuasion তা করল।”

কিন্তু এতই কি সহজ কাজ? দিল্লির উন্মত্ততা দেখে বড় লাট প্যামেলাকে লিখেছিলেন ”মহাযুদ্ধ, বড়লাটগিরি— এই জীবনমরণ সংগ্রামে পরিহাসে পরিণত হয়েছে।” তখনই কথা উঠেছিল প্রত্যেক শরণার্থীকে নিজ ঘরে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রত্যেক সরকাকে তার নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি দিতে হবে (Delhi Diary) কিন্তু তা হয়নি। ”এখানে কিছু করতে পারলাম না কিন্তু আমার অন্য প্রতিজ্ঞা মৃত্যুবরণ নিশ্চয়ই পূর্ণ হবে।” ১২ জানুয়ারি ১৯৪৮ — আরম্ভ হল শেষ অনশন।

কিন্তু হিন্দু মহাসভার মুক্তের রোজনামচায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনা যায় প্যাটেলের সঙ্গেও পাকিস্তানকে দেয় অর্থ নিয়ে মনোমালিন্য। ২০ জানুয়ারি প্রার্থনা সভায় বোমা পড়ল কিন্ত পুলিশের সাহায্য তিনি নিলেন না। গেথসিমানির অন্তর্দাহ শেষ হয়েছে। এবার পূর্ণ আত্মসমর্পণ। ”শেষে রাম যা নির্দেশ দেবেন তাই হবে। তিনি যেমন নাচান তেমনি আমি নাচি।…”

ক্যাম্বেল জনসন ঠিকই বলেছেন (৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮) এই মৃত্যুতে আছে একটা বিজয়ের আস্বাদ। এই ছোটখাট মানুষটির ভাবনা ও আর্ত ঘাতকের গুলির চেয়ে শক্তিশালী। নেহরু বলেছিলেন, ”আলো নিবে গেছে…। কিন্তু আমি ভুল বলছি, এ আলো সাধারণ নয়, it represented the living, the eternal truths, reminding us of the right path, drawing us from error….” তিনি আশা করেছিলেন, তাঁর মহান মৃত্যু ও মহত্তর সংগ্রাম আমাদের বৃহৎকে, মহৎকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে। আজ তাঁর একশো পঁচিশতম জন্মবর্ষের শেষে আমরা কি বুকে হাত রেখে তা বলতে পারি? নেহরু নিজেই কি তা পারতেন?

কিন্তু এই বোধ হয় অনিত্য পৃথিবীর নিয়ম,

Between the idea

And the reality

Between the motion

And the act

Falls a shadow. (Eliot)

 গান্ধীজির মহত্ত্ব স্বীকার করেও তাঁর মতের প্রাসঙ্গিকতা সম্বন্ধে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। আমার ‘হিন্দ স্বরাজ’—এ গান্ধীজির জীবন দর্শন পাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত তিনি তা বদলাননি। কিন্তু ‘হিন্দু স্বরাজ’—এ প্রাচীন ভারতের গ্রামজীবন সম্বন্ধে তাঁর ধারণা কি ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে নির্ভুল ছিল? যদি সেই Premises-ত্রুটি থাকে তবে তার ওপর নির্মিত সৌধও টিকবে না। গান্ধীকে আমরা messianic nationalist বলতে পারি, এবং এ ধরনের প্রত্যেক জাতীয়তাবাদী অতীতের স্বর্গযুগের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। ভারতের ক্ষেত্রে কখনও তা স্থাপিত হয়েছে আর্যযুগে, কখনও রামরাজ্যে। কখনও কৃষ্ণকথিত ধর্মরাজ্যে। নানা কারণে, বিশেষত বৈদেশিক আক্রমণ ও শাসনের ফলে, তাতে বিকৃতি এসেছে। তবু স্বার্থ, প্রয়োজনে প্রাণ, ত্যাগের শুল্কে তা ফিরিয়ে আনা যায়। গান্ধীর, এমনকি অরবিন্দের আগে, বঙ্কিমচন্দ্র সত্যানন্দের মুখ দিয়ে কথাটা বলতে চেয়েছিলেন— মায়ের তিনমূর্তি দেখিয়ে। মা আজ কালীমূর্তি ধরেছেন— ‘হৃতসর্বস্বা তাই নগ্নিকা’; কিন্তু যিনি আদিতে জগদ্ধাত্রী ছিলেন, পরে তিনিই হবেন দশপ্রহরণধারিণী, সর্বৈশ্বর্যশালিনী দুর্গা। ইহুদিদের মধ্যে messianic nationalism খুবই কাজ করেছিল, এমনকি তা খ্রিস্টানদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়। স্বর্গোদ্যান থেকে শয়তানের চক্রান্তে মর্ত্যে পতনেই নাটকের শেষ হয়নি। মিল্টন Paradise Lost লিখেই ক্ষান্ত হননি, লিখেছেন Paradise Regained.

কিন্তু এই স্বর্গ কি আমাদের অবদমিত ইচ্ছাপূরণ নয়? ইতিহাস বলবে — স্বর্ণযুগটা আমাদের পেছনে নেই, হয়তো সামনে কোথাও থাকতে পারে। রামমোহন থেকে বিবেকানন্দ ভারতীয় সভ্যতা সম্বন্ধে উচ্চধারণা পোষণ করলেও তাকে সর্বোত্তম মনে করেননি। অতীত গৌরবের সোনার হরিণের পেছনে না ছুটে পূর্ব ও পশ্চিমের শ্রেষ্ঠ ঐতিহ্য মিলিয়ে তাঁরা নতুন ভারত গড়তে চেয়েছিলেন। দয়ানন্দই আর্য যুগে তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তারপর অবনতি ছাড়া কিছুই দেখতে পাননি। খানিকটা প্রবণতাবশত, খানিকটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অরবিন্দ ও তিলক তাঁকে অনুসরণ করেন।

গান্ধীকে তাঁদের উত্তরসূরী বলা ঠিক হবে না — তবে নানা কারণে চিন্তাক্ষেত্রে ঋণী বলতেই হবে। ওরিয়েন্টালিস্টরা জেমস মিল থেকে শুরু করে ভারতীয় সভ্যতার যে—ছবিটা আঁকছিলেন — অর্থাৎ কিছুদূর এগিয়ে তার গতি স্তব্ধ হয়ে গেছে; এগোতে গেলে তাদের পশ্চিমের (‘we’) সাহায্য নিতেই হবে; তারা হবে কর্ম আর পশ্চিম হবে কর্তা; এমন hegemonic idea- র বিরুদ্ধেই ত গান্ধীর প্রতিক্রিয়া। কিন্তু তা করতে গিয়ে পশ্চিমের ফাঁদেই পড়লেন তিনি — unchanging east = superior east ভাবনাটা অতি সরলীকৃত।

এত হাজার বছরে সত্যি কি প্রাচ্যের সমাজ তথা অর্থনীতিতে কোনও পরিবর্তন হয়নি? তার গ্রামজীবন চিরদিন সরল, সংযত, স্বাবলম্বী, সমবায়িক ছিল? না—অধুনা প্রাছীন ভারতের ইতিহাস তা বলছে না। ষোড়শ মহাজনপদের আবির্ভাবের পূর্বেই প্রয়োজনের অধিক উৎপাদন, বিদেশের সঙ্গে বিনিময় অর্থাৎ বাণিজ্য, সার্থবাহ ও শ্রেষ্ঠী এবং তাদের সংগঠন— শ্রেণী দেখা দিয়েছিল। কোশাম্বী, থাপার প্রমুখের বিবরণে মেগালিথিক সংস্কৃতি থেকে রোমক বাণিজ্যের কাল পর্যন্ত মোটামুটি জানা গেছে। সম্পত্তির সম্পর্ক সব সময়ই বদলে যাচ্ছিল। জাতক এবং অন্যান্য বৌদ্ধ শাস্ত্র ব্যবহার করে অতীন্দ্রনাথ বসু যে অর্থনৈতিক ইতিহাস রেখে গেছেন, বেদ থেকে পুরাণ পর্যন্ত হিন্দু শাস্ত্র মন্থন করে উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল— তাকে প্রতিপদে কি নগর, কি গ্রামে উৎপাদন—পদ্ধতি ও সম্পর্ক পরিবর্তনের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। প্লিনি তো ভারতের বহির্বাণিজ্যকে রোমের স্বার্থবিরোধী বলেই গেছেন। সে বাণিজ্য চোল আমল পর্যন্ত পূর্ব সাগরে এবং গুর্জন প্রতীহার পর্যন্ত পশ্চিম সাগরে প্রসরমাণ। তাতে ভাঠা এল পূর্ব দিক থেকে চিনা ‘জাঙ্ক’ (junk) ও পশ্চিম থেকে আরব ‘ধাও’—এর আক্রমণে। কুষাণরা তো ‘রেশমপথ’ (silk road) নিয়ন্ত্রণই করত। বিনা কারণে গুপ্তযুগ ‘স্বর্ণ যুগ’ হয়নি। ভারত থেকে শুধু বৌদ্ধধর্মই চিন, কোরিয়াস জাপান, মধ্য এশিয়ায় যায়নি, সঙ্গে গেছে সার্থবাহ, স্থপতি, ভাস্কর। বদলে শুধু ফা হিয়েন থেকে ইচিং আসেননি — এসেছে ‘চীনপট্ট চীন ভূমিজ’ (China silk)। ইন্দোনেশিয়া ও ইন্দোচিনকে তো ‘দ্বীপময় ভারত’ অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলকাব্যে সে লাভজনক বাণিজ্যের স্মৃতি বিধৃত হয়ে আছে।

হর্ষবর্ধন বা তারও আগে থেকে ভারতে সামন্ততন্ত্র প্রচলিত হয়েছিল কিনা সে বিতর্ক প্রবল। তা অন্তত ইউরোপীয় ধাঁচের ছিল না। তবু ভূমি হস্তান্তরের অজস্র সাক্ষ্য রয়েছে। স্বর্ণমুদ্রার দ্রুত অবলুপ্তি পতনের নির্দেশখ. দক্ষিণ ভারতে চোলদের কল্যাণে আরও কিছুদিন পুরনো ব্যবস্থা টিকল। কিন্তু তুর্কো আফঘান ও মুঘল আমলে গ্রামজীবনের পরিবর্তন সম্বন্ধের সন্দেহের অবকাশ রাখেননি ইরফান হবিবরা। ধীরে ধীরে বহির্বাণিজ্য চলে গেল পর্তুগজ, ডাচ, ইংরেজ, ফরাসিদের হাতে। কিছু ভারতীয় বস্তুর চাহিদা বাড়ল, কিন্তু উৎপাদন—পদ্ধতি—ব্যবস্থা বদলাল না। অষ্টাদশ শতক জুড়ে চলল time of troubles। সুরাটের উঠল নাভিশ্বাস, মুম্বই, সুতানুটিতে উল্লাস। সেখানেও যখন সঙ্কট দেখা দিল, পড়ল রাজত্বের প্রতি চোখ। পলাশীর পর, শতকের মধ্যপাদে, অন্তর্বাণিজ্য চলে গেল ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের হাতে। তৃতীয় পদে চলে গেল রাজস্ব আদায়ের অধিরার। হেস্টিংস—কর্ণওয়ালিশ থেকে ডালহৌসি পর্যন্ত অন্তহীন পরীক্ষা—নিরীক্ষার ফলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রামজীবনের ছবিটা কিভাবে বদলে গেল তার সাক্ষ্য প্রচুর। তারপর এল রেল, জাহাজ ইত্যাদি। বিলেতে বসে মার্ক্স বুঝলেন না? সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা (১) শ্রেণীবিন্যাস্রে সঙ্গে জাতিভেদ প্রথার জট (২) জমিদার, জোতদার, ধানচালের ব্যাপারি ও মাহজনের সমন্বয়।

গান্ধী ম্যালথাসের ব্যাপারটা গ্রাহ্যই করলেন না (বঙ্কিম করেছিলেন)। ১৯১১ সাল থেকে ১৯৪১ সাল (ইনফ্লুয়েঝা মহামারী বাদ দিলে) জনসংখ্যা বাড়ল বিপুল হারে। যদি গান্ধীর আদর্শ গ্রাম থেকেও থাকে, জনসংখ্যার চাপে তা ভেঙে পড়তে বাধ্য। শিল্পায়ন ছাড়া অন্য কোনও পন্থার কথা ভাবা গেল না। ভারত সরকার প্রথম মহাযুদ্ধের সময় থেকে, অর্থনীতিবিদরা — তারও আগে থেকে, নয়া শিল্পপতিরা — সবাই বুঝতে পারলেন ইংল্যান্ডের ক্লাসিক বিবর্তনের পথ নিতেই হবে অর্থাৎ প্রাথমিক মূলধন সংগ্রহ, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, কৃষিবিপ্লব, শিল্পবিপ্লব। নেহরু ও সুভাষের মত কোনও কংগ্রেসী নেতা হয়তো রাশিয়ার gosplan দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, কিন্তু তা যে কি মূল্যে হচ্ছিল, জানতেনও না। যাই হোক, অবাক লাগে, গান্ধীর চারদিকের শিল্পপতিরা — বিড়লা, ঠাকুরদাস, সারাভাই, তাঁরা কি কিছু বলেননি? মুম্বইয়ে প্ল্যান সম্বন্ধেও তিনি অবহেলিত।

মনে হয়, তাঁর অনেক সংশয় ছিল। যেমন এত মূলধন কোথা থেকে আসবে? সবেধন তো sterling balance । আবার পশ্চিমের সঙ্গে সহযোগিতা বা পশ্চিম থেকে ঋণ গ্রহণ তো হবে স্বদেশিয়ানার পরিপন্থী। তাছাড়া এত entrepreneur কোথায়? নিজে বানিয়া বলে গান্ধী টাটা ছাড়া সবাইকে বানিয়া মনে করতেন, তাদের দৌড় বুঝতেন। অভ্যন্তরীণ বাজারই বা কোথায়? তা ছাড়া বৃহৎ শিল্প সম্পর্কে তাঁর নৈতিক/ আধ্যাত্মিক আপত্তির কথা আগেই বলেছি। বৃহৎ শিল্প থেকে সাম্রাজ্যবাদ তার থেকে হিংসা — এই যুক্তিশৃঙ্খল তাঁর মনে গেঁথে নিয়েছিল। প্রথমটা যত সীমিত হয় তত বাঞ্ছনীয়। মনে রাখা দরকার — চরখা ছাড়া অন্য কোনও যন্ত্র তিনি চাননি, তা নয়। আরও একটা কারণ ছিল মনে হয়। শ্রমিকদের চেয়ে কৃষকদের তিনি বেশি বুঝতেন। চম্পারনে তাঁর শিক্ষার আরম্ভে, খেড়া, বারদোলি ইত্যাদিতে তার পূর্ণতা। আমেদাবাদে শ্রমিকদের নিয়ে লড়তে নিয়ে তিনি হাত পুড়িয়েছিলেন। তারপর কানপুর, মুম্বই ইত্যাদি অঞ্চলে কম্যুনিস্ট প্রভাবিত শ্রমিক আন্দোলন তিনি আদৌ পছন্দ করেননি। তারা হিংসা গোপন করেনি, তিনিও তাঁর বিরূপ মনোভাব। আইন অমান্য থেকে শ্রমিকদের সম্পূর্ণ নিয়ে নিল রুশ নির্দেশে। রবীন্দ্রনাথ বৃহৎশিল্প সম্বন্ধে একই রকম সন্দিহান ছিলেন। তার প্রমাণ — ‘মুক্তধারা’, রক্তকরবী’ ইত্যাদি। নিজের হাতে আনন্দে চাষ করব, নিজের হাতে কাটা সুতোয় নিজের হাতে বোনা খাদি পরব— পারলে তৈরি করে নেব গুড়, মধু, ঘানির তেল। যা পাব তাতেই সন্তুষ্ট থাকব এবং অভাবীদের মধ্যে, প্রয়োজনে, ভাগ করে নেব। অবশ্যই অলসদের প্রশ্রয় নেই — উদ্ধরেৎ আত্মানামাত্মনম। যে দেশে একদা মসলিন, বালুচরী, বেনারসী, জামদানি তৈরি হত, কেন তারা সেই মহান ঐতিহ্য নষ্ট করবে সস্তা কলের সুতোয় তৈরি অশালীন পোশাকে আশাকে? দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠকে ম্যাঞ্চেস্টার গিয়ে শ্রমিকদের যে দুর্দশা তিনি দেখে এসেছেন, তাতে শিল্পায়নের ওপর ভরসা রাখা যায় না। বৃহৎ শিল্প যদি রাখতে পারি, তবে বৃহৎ রাষ্ট্রকেও পারব। গান্ধী ইতালি, জার্মানি, রাশিয়া, জাপানের সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের প্রতাপ জানতেন, তাই এদেশে তার দ্বিতীয় শ্রেণীর অনুকরণ চাননি। আমরা নেহরুকে অনুসরণ করে big is beautiful ভেবেছি — বৃহৎ বাঁধ, নদী সেচ—প্রকল্প, সার কারখানা, লৌহ কারখানা ইত্যাদি। আজ ডি ভি সি—র অতিরিক্ত জলে গাটাল, মেদিনীপুর ডুবছে; ফারাক্কার জলে বাংলাদেশে ও ভারতে বন্যা হচ্ছে; নর্মদা বাঁধ আমদের চোখ খুলে দেয়নি। নেহরু জনসংখ্যা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন, মহাত্মা নন। গ্রামোন্নয়নের ব্যাপারে যেমন প্রয়োজনমত উৎপাদন, এ ব্যাপারে তেমনি ইন্দ্রিয়মন। বৃদ্ধবয়সে রেতঃস্খলন নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তা থেকে আমরা মজা পাই কিন্তু কাম যে লোভের চেয়েও ভয়াবহ তা কি জননায়কদের আচরণ দেখে বুঝি না? জনসাধারণ তো তাঁদেরই আদর্শে চলবে।

এত বৃহৎশিল্প, কল্যাণকামী রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কি দিয়েছে আমাদের? দিয়েছে লাইসেন্স রাজ, মন্ত্রী—আমলা—ব্যবসায়ীদের দুষ্টচক্র, ছোটবড় ‘স্ক্যাম’ — এবং ক্রমবর্ধমান বেকারির সঙ্গে সর্বশ্রেণীব্যাপী হিংসা। ‘নেহরুভিয়ান সোস্যালিজমের’ প্রশংসা তাঁর প্রসাদপ্রার্থী ও প্রসাদধন্য (কংগ্রেসী ও কম্যুনিস্ট) নির্বিশেষে কে না করেছে? কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও চারিত্রিক বিশুদ্ধতা ১৯৩৭—এর নির্বাচন থেকেই লুপ্ত হতে শুরু করেছিল; ১৯৪৭/৪৮ সালে তা এতদূরে পৌঁছেছিল যে স্বয়ং গান্ধী তার অবলুপ্তি চান। তা তো হয়নি বরং কেন্দ্রের রোগ সংক্রামিত হয়েছে প্রত্যেক প্রদেশে। পরবর্তী নির্বাচনে হয়তো আসবে মহাবিচারের লগ্ন। আসলে বাজার অর্থনীতিও আমাদের সমস্যার সুরাহা করতে পারছে না। রাষ্ট্রীয় শিল্প নয়, বাজার অর্থনীতিও নয়, হয়তো অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে মানবসমাজের উদ্বর্তনের দিশা। যতদিন তা না পাচ্ছি, গান্ধী অপ্রাসঙ্গিক হবেন না। অন্তত আমার মতো সামান্য ঐতিহাসিকের চোখে নয়। তবে তো হবে গান্ধীর পথ পরীক্ষা—নিরীক্ষা দ্বারা, myth বা cult figure বানিয়ে নয়। বা তাঁর প্রত্যেকটি fad -এর অন্ধ অনুকরণ করেও নয়। সংঘ যখন বুদ্ধকে ছাড়িয়ে যায়, ধম্মকেও ছাড়িয়ে যায়, তখনকার মত অবস্থা চলছে। ত্রিশরণমন্ত্রের নিষ্প্রাণ জপে আর কোনও লাভ হবে না।

প্রসঙ্গত জেনে রাখা দরকার, ১৯৪৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজ্যসভায় ডঃ আম্বেদকর গান্ধীজি সম্বন্ধে বলেছিলেন, ”I respect him and suggest, in the name of Gandhiji, a Gandhi Trust Fund be created for development or settlement of the untouchables. After all, the untouchables according to all of us, were the nearest and dearest to him and there is no reason why Gandhiji may not bless this project from heaven. ”  He added, ”You may keep it quite outside the budget just as a sort of Gandhi welfare scheme, which will perpetuate the name of Gandhiji and which will give relief to the people whom he wanted to protect and whom he wanted to elevate.”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *