গান্ধীর উত্তরাধিকার ও আজকের ভারতবর্ষ – অমলকুমার মুখোপাধ্যায়
দেশবাসীর মধ্যে ধনী ও নিঃস্বকে একযোগে ‘গান্ধী মহারাজ’—এর শিষ্য হতে দেখে একদিন আপ্লুত বোধ করেছিলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। দুর্ভাগ্য যে স্বাধীন ভারতবর্ষে গান্ধীর জীবনাবসানের ছেচল্লিশ বছর পরে তাঁর শিষ্যদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। যাঁরা গান্ধীর রাজনীতির আকর্ষণে নয়, শুধু তাঁর জীবনাদর্শে অনুপ্রাণিত বোধ করে তাঁকে মহাত্মা বলে বরণ করে নিয়েছিলেন এবং তাঁকে গুরুর আসনে বসিয়েছিলেন তাঁরা প্রায় সকলেই কালের অমোঘ নিয়মে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। অবশ্য ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে দুয়েকজন বা সংগঠন এখনও এই ধারা বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে যেহেতু যাঁরা রাজনীতির আঙিনা থেকে স্বনির্বাসিত, সে কারণে আজকের প্রেক্ষাপটে তাঁরা সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন ও ক্ষীণকণ্ঠ। স্বভাবতই দেশবাসীকে গান্ধী সম্পর্কে সচেতন করার দায়িত্ব পালন তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যদিকে যে কংগ্রেস দলকে একদিন গান্ধীজী নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন এবং যার প্রথম সারির নেতৃবর্গ একদিন সিদ্ধান্তকরণ প্রক্রিয়ায় তাঁর অভিমতকেই শেষ কথা বলা গণ্য করতেন, সেই দলের পক্ষ থেকে বহু বছর আগে নদীর জলে শুধু গান্ধীজীর চিতাভস্মই ভাসিয়ে দেওয়া হয়নি, ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর নীতি ও আদর্শকে, এমন কি তাঁর স্মৃতিকেও। এই নেতৃবর্গের প্রায় কেউই অবশ্য আজ জীবিত নেই। তবে স্বাধীন ভারতবর্ষে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তাঁরা গান্ধীকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করেছিলেন বলে গান্ধীর অনুসৃত আদর্শ ও ঐতিহ্য রক্ষণাবেক্ষণের কোনও দায়ই তাঁরা গ্রহণ করেননি। স্বভাবতই দেশবাসীর কাছে গান্ধী আজ শুধু একটি নাম, ইতিহাসের পাতায় যার উল্লেখ পাওয়া যায়; কিন্তু যা কারও মনেই কোনও আগ্রহ জন্মায় না, কোনও স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধা বা কৃতজ্ঞতার উদ্রেক করে না, বিশেষ বর্তমান প্রজন্মকে কোনওভাবেই আকর্ষণ করে না। মহাত্মা গান্ধীকে আমরা জাতিরজনক এই আখ্যা দিয়েছি বটে, কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকার আমরা স্বীকার করি না। বর্তমান ভারতের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় তাঁর রেখে যাওয়া শিক্ষার ছায়ামাত্রও পরিলক্ষিত হয় না। অবশ্য এখনও ভারতীয় রাজনীতিকেরা তাঁরই উদ্ভাসিত আন্দোলন পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল, এ ব্যাপারে তাঁরা একদমও এগোতে পারেনি। কিন্তু যে নৈতিক শক্তি দিয়ে তিনি এই পদ্ধতিকে সঞ্জীবিত করেছিলেন একালের রাজনীতিকদের ক্ষমাহীন মূঢ়তায় তা আজ ভূলুণ্ঠিত। তাই দেশের সর্বত্রই আজ লক্ষ করা যায় গান্ধী—প্রবর্তিত আন্দোলনপদ্ধতির অপব্যবহার। তিনি যা চেয়েছিলেন তা আমরা বুঝিনি অথবা ইচ্ছাকৃতভাবেই বুঝতে চাইনি। তাই স্বাধীনতা লাভের সাতচল্লিশ বছর পরে আজ যে ভারতবষর্কে আমরা দেখতে পাচ্ছি তা আর যাই হোক, অবশ্যই গান্ধীজীর ধ্যানের ভারত নয়।
প্রায় পঁচিশ বছর ধরে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীই ছিলেন ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সর্বোচ্চ সেনাপতি। এই দীর্ঘ সময় ধরে কংগ্রেস দলের শক্তির প্রধান উৎস ছিলেন তিনিই, যদিচ কংগ্রেসের সঙ্গে তিনি আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন ১৯৩৪ সালে। এই সময়ের মধ্যে তিনি শুধু কংগ্রেস দল ও স্বাধীনতা আন্দোলনকেই পরিচালিত করেননি, পথ নির্দেশ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন জাতি ও সমাজকেও এবং নিজের বিশ্বাস ও আদর্শ স্পষ্টভাষায় ব্যক্ত করে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি কী চান, তাঁর স্বপ্নের ভারতবর্ষের সামনে নির্ভয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে, স্বরাজ হল ভারতবাসীর জন্মগত অধিকার। কিন্তু এই স্বরাজকে তিনি নিছক রাজনৈতিক স্বাধীনতার সমার্থক হিসাবে গ্রহণ করেনি। দেশবাসীকে তিনি আজীবন বোঝাবার চেষ্টা চেষ্টা করেছিলেন যে তাঁদের এই স্বরাজের লক্ষ্যকে গ্রহণ করতে হবে ব্যাপকতর অর্থে ও বৃহত্তর পটভূমিতে। গান্ধীজীর জন্মের এক পঁচিশ বছর পরে এবং অবিস্মরণীয় এক রাজনৈতিক নেতা হিসাবে তাঁর উদ্ভবের চুয়াত্তর বছর পরে ভারতবর্ষ আর সর্বার্থেই গান্ধীহীন। কিন্তু গান্ধীকে বিসর্জন দিয়ে স্বাধীন ভারতবর্ষের আমাদের ভাল হয়েছে, অথবা ভাল আছি—একথা কখনই বলা যায় না। দেশ ও সমাজের সর্বত্র আজ বিভ্রান্তি ও সংশয়, উদ্বেগ, অশান্তি ও অস্থিরতা। পরিপার্শ্বের ঘনায়মান অবক্ষয়ের অন্ধকারে আমরা আজ দিশেহারা। এই পরিস্থিতিতে আজ নতুন করে আবার গান্ধীর আদর্শ ও প্রত্যয় সম্পর্কে আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন, আমাদের জানা দরকার তিনি কী চেয়েছিলেন, জাতিকে তিনি কোন পথে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন, কোন স্বরাজের জন্য তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
ভারতীয় রাজনীতিতে গান্ধীর আবির্ভাব ঘটেছিল একেবারে সঠিক সময়ে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর কংগ্রেস তথা স্বাধীনতাকামী সকল ভারতীয়ের কাছেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে আবেদন—নিবেদনের রাজনীতি অথবা বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাস বা চরমপন্থা দিয়ে বিদেশি শাসকের আসন টলানো যাবে না, পরাধীন ভারতবর্ষকে বিদেশি শাসনের বন্ধন মুক্ত হতে হলে প্রয়োজন ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত গণ—আন্দোলনের। পরাধীন ভারতে প্রয়োজনীয় এই গণ—আন্দোলনের ধারার সূত্রপাত করেন গান্ধীজি। বস্তুত, বিশ্বের ইতিহাসে অনন্য এক গণ—আন্দোলনের ভগীরথ হিসাবে তাঁকে চিহ্নিত করাটা কোনও বিচারেই অযৌক্তিক নয়। কারণ ভারতীয় গণ—আন্দোলনের রূপকার হিসাবে তিনি যে বিচক্ষণতা, বাস্তববোধ ও দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে আজও তা তুলনাহীন হয়ে আছে। বিচক্ষণ গান্ধী বুঝেছিলেন যে সার্থক গণ—আন্দোলনের জন্য সর্বাগ্রে চাই জাতি—ধর্ম ও ধনী—নির্ধন নির্বিশেষে সর্বশ্রেণীর মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। তিনি এও বুঝিছিলেন যে ভারতবর্ষের মতো বিশাল ও বৈচিত্র্যময় দেশে এ জন্য সবিশেষ প্রয়োজন বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং অবশ্যই শ্রেণী সমন্বয়। যেহেতু ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ই ছিল প্রধান দুই ধর্মগোষ্ঠী সে কারণে গান্ধী হিন্দু—মুসলিম সম্প্রীতিকেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হিসাবে স্থির করে নেন। এই লক্ষ্যপূরণের জন্য তাঁর যাত্রা শুরু হয় খিলাফত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এবং অনেক ‘পতন—অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা’র মধ্য দিয়ে এই যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটে তাঁর হত্যাকাণ্ডে। অন্যদিকে প্রখর বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন গান্ধী বুঝেছিলেন যে আধুনিক সমাজে শ্রেণী সমন্বয়ের স্বপ্ন দেখা যেতে পারে, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তা অর্জন প্রায় এক অসম্ভব কাজ। অবশ্য ইতিহাসে কখনও কখন এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে যখন তীব্র কোনও আকর্ষণ শ্রেণী নির্বিশেষে সকল মানুষকে একই অনুভূতির স্তরে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গান্ধীজী একথা জানতেন, তাই এ ব্যাপারে তিনি ব্যবহার করেছিলেন নিজ নেতৃত্বের জনপ্রিয়তার জাদুমন্ত্র। বস্তুত, ধনী—নির্ধন সকলেই তাঁর প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন কারণ তিনি ছিলেন তাদের সকলের কাছেই ভালবাসার মানুষ, কাছের মানুষ, পরম বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার পাত্র। অর্থাৎ, একজন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধী অসামান্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। এই ধারণা একেবারেই ভুল না হলেও তা পূর্ণ সত্যের দ্যোতক নয়। প্রকৃত সত্য হল এই যে দেশবাসী তাঁকে ভালোবেসেছিল, তাঁর সম্পর্কে সতত শ্রদ্ধাশীল ছিল এক অনন্য মানুষ হিসাবে যে মানুষ ভোগের পথ ছেড়ে ত্যাগব্রতী হয়েছেন, তিনি আচারে, অভ্যাসে ও বেশভূষায় দরিদ্র ভারতবাসীর সার্থক প্রতিনিধি, যিনি ব্যক্তিগত স্বার্থের পিছনে ধাবিত না হয়ে দেশের স্বার্থে নিবেদিত প্রাণ এবং যিনি বিদেশি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও ভারতবর্ষের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমের দ্বারস্থ হননি।
আবার দূরদর্শী গান্ধী এ—ও উপলব্ধি করেছিলেন, যে গণ—আন্দোলনের লক্ষ্য যতই মহৎ হোক না কেন তাকে সতত যদি সুনির্দিষ্ট আদর্শের রশিতে বেঁধে রাখা না যায় তাহলে গণ—মনস্তত্ত্বের প্রভাবে তা যে কোনও মুহূর্তে এক সর্বনাশা বিশৃঙ্খলরূপ ধারণ করে আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দেবে এবং বিপথগামী হয়ে যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন তাকেই আরও শক্তিশালী করে তুলবে। এই কারণেই অহিংসার মন্ত্র দিয়ে তিনি সুনিয়ন্ত্রিত রাখতে চেয়েছিলেন গণ—আন্দোলনকে এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে চৌরিচৌরার ঘটনাবলীতে বিচলিত গান্ধী কালবিলম্ব না করে তার অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। এর অর্থ এই যে গণ—আন্দোলনের প্রবক্তা গান্ধী তথাকথিত বাহুবলের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর আন্তরিক বিশ্বাস ছিল এই যে গণ—আন্দোলনের প্রবল নৈতিক শক্তিই প্রতিপক্ষকে বাধ্য করবে নতিস্বীকারে। এই জন্য সত্যাগ্রহ তাঁর কাছে ছিল প্রকৃতপক্ষে আত্মশক্তির জাগরণ এবং পাশব শক্তি নয়, বিশুদ্ধ নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হতে হবে একজন সত্যাগ্রহীকে, কঠোর অনুশীলন ও অধ্যবয়াসের মধ্য দিয়ে তাকে শিখতে হবে আত্মসংযম আর অভ্যস্ত হতে হবে কৃচ্ছ্রসাধনে—এই ছিল তাঁর অন্যতম শিক্ষা। আরও লক্ষণীয় যে গণ—আন্দোলনের নেতা হিসাবে গান্ধীজি শুধু বক্তৃতা, উপদেশ আর নির্দেশ দিয়ে ক্ষান্ত হননি; ব্যক্তিগত পর্যায়ে দৃষ্টান্তের পর দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, অনুগতদের মতো নেতাকেও আত্মশক্তি অর্জনে সচেষ্ট হতে হবে, পরিচালকের উঁচু আসনে বসে না থেকে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সব ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়ে তাঁকেও আন্দোলনের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং জনস্বার্থে তিনিও যে কঠোর কৃচ্ছ্রতা বরণ করে নিতে পারেন সে প্রমাণও তাঁকে দিতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁর অনশনের কর্মসূচি, তাঁর লবণ সত্যাগ্রহ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিরক্ষার স্বার্থে দিনের পর দিন ও মাইলের পর মাইল তার শান্তি—পদযাত্রা।
১৯১৭ সালের চম্পারণ সত্যাগ্রহ থেকে শুরু করে ১৯৪২ সালের ভারতছাড় আন্দোলন পর্যন্ত সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে গান্ধীজি তাঁর গণ—আন্দোলন চালিয়েছিলেন ভারতভূমিতে। মনে রাখতে হবে যে এই আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনই ছিল না, পাশাপাশি তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সামাজিক আন্দোলনেও। অর্থাৎ, ভারতবর্ষের রাজনৈতিক স্বাধীনতাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল না, একই সঙ্গে দেশবাসীর মনের অন্ধকার দূর করে তিনি তাদের মধ্যে নৈতিক স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন এবং সমাজকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন কুসংস্কার থেকে, প্রচলিত অন্যায় ও অবিচার থেকে। এই জন্যই বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে যেমন তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তেমন তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছিলেন হিন্দু—মুসলিম ঐক্যের সপক্ষে, উৎপীড়িতের এবং অনগ্রসর ও অচ্ছুত হিসাবে জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার্থে এবং নারীর সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়। এ থকেই বোঝা যাবে যে মহাত্মা গান্ধী যে স্বরাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন তার মধ্য দিয়ে তিনি শুধু স্বাধীন ভারতরাষ্ট্রের উদ্ভব সম্পর্কিত আকুতিই ব্যক্ত করেননি, একই সঙ্গে তিনি চেয়েছিলেন এক স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ জাতির আত্মপ্রকাশ। তিনি বারবার দেশবাসীকে একথাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে রাজনৈতিক পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হলেই একটা জাতি আপনা—আপনি স্বাধীন, স্বনির্ভর ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে না, তাকে মুক্ত হতে হয় অভ্যন্তরীণ বিভেদ—বৈষম্য, সংকীর্ণতা ও সংস্কার থেকে। অর্থাৎ, তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে, স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জাতিগঠনের কাজও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং এই পরিপ্রেক্ষিতেই রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি আজীবন চালিয়ে গিয়েছিলেন সামাজিক আন্দোলন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে জাতিগঠনের জন্য দেশব্যাপী সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি একটা সচেতন ছিলেন যে, যখন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রাপ্তির লগ্ন সমাগত তখন রাজনৈতিক দল হিসাবে কংগ্রেসের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে তিনি তাকে সম্পূর্ণরূপে সামাজিক আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে, বলা বাহুল্য, জাতিরজনক হিসাবে গান্ধীর আখ্যালাভ নিতান্ত সঙ্গত।
জাতি গঠনের কর্মসূচি প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়ে গান্ধী এমন একটি অবস্থান নিয়েছিলেন যা ছিল তাঁর অসামান্য দূরদৃষ্টিরই পরিচায়ক। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে যন্ত্রসভ্যতা একদিন মানবজীবনে এমনই স্থূল বস্তুবাদ ও ভোগবাদের বিস্ফোরণ ঘটাবে যে মনুষ্যত্ব ও মূল্যবোধ হারিয়ে মানুষ আক্রান্ত হবে এক চরম নৈতিক সংকটে। একই সঙ্গে ভারতীয় জাতির আত্মপরিচয়ের উৎস খুঁজতে গিয়ে তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে গ্রামই হল ভারতীয় জীবনের প্রাণকেন্দ্র এবং গ্রামীণ সভ্যতার মধ্যেই নিহিত আছে ভারতীয় জীবনের স্বকীয়তা। এই কারণে দেশ স্বাধীন হলে জাতীয় অর্থনীতির মূল চরিত্র কী হবে সেই প্রশ্নের মীমাংসা করতে গিয়ে তিনি পশ্চিমি শিল্পায়ন ও নগরায়ন প্রক্রিয়াকে সমর্থন করতে পারেননি অর্থাৎ আধুনিক ধনতন্ত্রকে তিনি বর্জন করতে চেয়েছিলেন। আবার যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতার অবাধ বিস্তারে তিনি ব্যক্তির অধিকার ও মর্যাদাহানির সম্ভাবনা দেখেছিলেন যে কারণে সমাজতান্ত্রিক রীতিতে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়নও তিনি অন্তর থেকে গ্রহণ করতে পারেনি। তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীন ভারতবর্ষে দেশ জুড়ে গ্রামভিত্তিক ক্ষুদ্র ও কুটীর শিল্পের দ্রুত উন্নয়ন অগ্রগতি যাতে দেশের মানুষ অথনৈতিক ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারে, যাতে শিল্পায়নের দুই অনিবার্য কুফল, সামাজিক ও বৈষম্য ও ক্ষমতা—কেন্দ্রীকরণ, ভারতবর্ষের জাতীয় জীবনে এড়ানো যায় এবং ভারতবাসী তার মনুষ্যত্ব ও মূল্যবোধ বজায় রেখে তার নৈতিক অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুত না হয়।
গান্ধীজির এই অর্থনীতি সংক্রান্ত চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য তাঁর জীবতকালেই বিবেচিত হয়েছিল। অনাধুনিক ও অবাস্তব এক পশাদগামিতা হিসাবে। তাঁর একান্ত রাজনৈতিক সহযোগীদের কেউই গান্ধীর এই পরামর্শ গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেননি। বস্তুতপক্ষে, শুধু তাঁর অর্থনৈতিক পরিকল্পনাই নয়, শেষ পর্যন্ত তাঁর কোনও পরামর্শ বা নির্দেশই আর তাঁর রাজনৈতিক সহযোগীদের প্রভাবিত করতে পারেননি। যে মানুষটির অঙ্গুলিহেলনে একদিন সারা দেশ আলোড়িত হত, যাঁর প্রতি আনুগত্যের টানে তাঁর সহযোগীরা একদিন তাঁর নির্দেশকে অলঙ্ঘনীয় বলে মান্য করেছিলেন, জীবনের শেষ বেলায় তাঁর রাজনৈতিক শিষ্যেরা তাঁকে কার্যত পরিত্যাগ করেন। স্বাধীনতার প্রথম প্রহরের ঘণ্টাধ্বনির যখন আর দেরি নেই তখন ভারতীয় রাজনীতিতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এক নিঃসঙ্গ ব্যক্তিত্ব। আজ অনেকেরই ধারণা এই যে ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণার পর স্বাধীনতার প্রাপ্তির সম্ভাবনা সুনিশ্চিত হয়ে গেলে কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতৃবর্গ রাষ্ট্রক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার জন্য এতই ব্যগ্র হয়ে পড়েন যে পাছে গান্ধী নীতিগত কারণে কোনও বাধা দেন—এই আশঙ্কায় তাঁরা গান্ধীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। এই ধারণা সম্ভবত অমূলক নয়। কিন্তু সেই সঙ্গে এই কথাটাও বলা দরকার যে সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাঁর মতাদর্শে প্রকৃত অনুপ্রাণিত কিছু যোগ্য শিষ্য গান্ধী তৈরি করতে পেরেছিলেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতৃবর্গকে তিনি তাঁর যথার্থ অনুগামী করে তুলতে পারেননি। অর্থা, তাঁর নীতি ও আদর্শকে আত্মস্থ করে এই নেতৃবর্গ তাঁর অনুগত্য স্বীকার করেছিলেন ব্যাপারটা এরকম নয়। তাঁরা গান্ধীজির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন নিতান্ত প্রায়োগিক কারণে। তাঁরা দেখেছিলেন জনমানসে মহাত্মা গান্ধীর জনমোহন শক্তির আশ্চর্য প্রভাব, তাঁরা বুঝেছিলেন যে গণ—আন্দোলন পরিচালনার সর্বোত্তম দক্ষতা ও সর্বোৎকৃষ্ট কৌশল গান্ধীর করায়ত্ত। তাই পরাধীন ভারতবর্ষে যতদিন ব্যাপক গণ—আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ছিল ততদিন তাঁরা সকলেই ছিলেন গান্ধী মহারাজের অনুগত শিষ্য। তাছাড়া এই অসামান্য ব্যক্তির গৌরবলোকে নিজেদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠাও তাঁদের কাছে সহজ হয়েছিল। যখন নিজেদের নেতৃত্বের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং যখন গণ—আন্দোলনের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা গান্ধী শিষ্যত্বের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। অনিবার্য পরিণামেই তাই গান্ধীর জীবনের শেষ পর্বে তাঁরা কংগ্রেস তথা জাতীয় রাজনীতিতে গান্ধী—বিসর্জনের বাজনা বাজাতে শুরু করেন।
এই প্রেক্ষাপটে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই যে স্বাধীন ভারতবর্ষের হাল ধরেন যে তথাকথিত গান্ধী—শিষ্যেরা তাঁর অনুষ্ঠানিক গান্ধী—পূজা অব্যাহত রাখেন এবং প্রয়োজনে গান্ধীর নাম ব্যবহার করতে থাকেন, কিন্তু নতুন রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় কাঠামো তৈরি করতে গিয়ে তাঁরা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেন গান্ধীর নীতি ও আদর্শকে। অবশ্য সংবিধানের চতুর্থভাগে লিপিবদ্ধ রাষ্ট্রীয় নির্দেশাত্মক নীতিগুচ্ছ অনেকাংশেই গান্ধীর আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত। কিন্তু এই নির্দেশাত্মক নীতি পালনে রাষ্ট্রের কোনও আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। যে কারণে শাসন ব্যবস্থায় গান্ধী আবাহনের কোনও অবকাশই ঘটেনি।
রাষ্ট্রনায়কদের পক্ষ থেকে গান্ধী সম্পর্কিত এই উপেক্ষা ও উদাসীনতা কালক্রমে দেশবাসী ও মহাত্মা গান্ধীর মাঝখানে বিস্মৃতির এক বড় দেওয়াল তুলে দিয়েছে। স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর পরে ভারতবর্ষে আজ গান্ধীর স্থান জাদুঘরে, কিছু ধূলিমলিন মর্মরমূর্তিতে আর প্রথামাফিক কিছু প্রাণহীন অনুষ্ঠানে। আধুনিক পৃথিবীতে গান্ধীই প্রথম রাজনৈতিক নেতা, যিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকেও সত্যানুসন্ধানের প্রেরণার জোগাতে চেয়েছিলেন মানুষের মনে এবং নৈতিকতার কাছে রাজনীতির দায় স্বীকার করে নিয়ে রাজনীনিকের মূল্যবোধ জাগরণের সচেষ্ট হয়েছিলেন। গান্ধীবিবর্জিত আজকের ভারতবর্ষে রাজনীতি মূল্যবোধ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন আর রাজনীতির জগতে আজ হিংসা—হানাহানি ও পাশবশক্তির আস্ফালন, মিথ্যাচার ও ভ্রষ্টাচার এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় নিয়মহীনতার প্রাবল্য। অন্যদিকে আমাদের দেশে যে গণ—আন্দোলনের জনক ছিলেন গান্ধীজি সে আন্দোলনের ধারা আজও বহমান। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, এই আন্দোলনের পিছনে আজ সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন নেই, কারণ এই আন্দোলন পরিচালনার জন্য এমন কোনও নেতা নেই যাঁকে জনগণ ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে এবং যার ওপর সাধারণ মানুষের প্রভূত আস্থা আছে। স্বভাবতই আজকের ভারতবর্ষে গণ—আন্দোলনের তথাকথিত ভার হয়তো আছে, কিন্তু ধার নেই। আবার স্বাধীন ভারতবর্ষে রাজনৈতিক আন্দোলনের ব্যাপারে রাজনীতিকেরা সতত আগ্রহী ও তৎপর, কিন্তু গান্ধী প্রবর্তিত সামাজিক আন্দোলনের উত্তরাধিকার বহনের ইচ্ছা ও যোগ্যতা কোনও রাজনীতিকেরই নেই। স্বভাবই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিত্য নতুন সংকল্প গ্রহণ করেছেন এবং প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন অজস্র। অথচ সমাজজীবনে অন্ধকার বেড়েই চলেছে এবং এই অন্ধকারের অন্তরে আশা ও ভরসার আলো জ্বালানোর মতো মানুষ আজ আর নেই।
স্বভাবতই যে স্বরাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন গান্ধীজি রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়ার সাতচল্লিশ বছর পরেও তা আমাদের নাগালের বাইরে, যে ঐক্যবদ্ধ, স্বনির্ভর ও শক্তিশালী জাতি তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সে জাতি আজ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে দিশেহারা এবং কার্যত আত্মহননে উদ্যত। অন্যদিকে সুদীর্ঘ সাতচল্লিশ বছর ধরে পশ্চিমি ধাঁচের শিল্পায়ন প্রক্রিয়া সচল থাকা সত্ত্বেও আজ ভারতীয় সমাজের বিনাসে কোনাও মৌলিক পরিবর্তন দেখা দেয়নি, আজও গ্রামই ভারতের প্রাণ কেন্দ্র এবং জনগোষ্ঠীর প্রায় দুই তৃতীয়াংশই গ্রামবাসী। এই পরিস্থিতি তথাকথিত আধুনিকতার মোহ ত্যাগ ককরে গান্ধী—চিন্তার ভাণ্ডার থেকে আমাদের পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করার প্রয়াস, বোধ করি, নিরর্থক হবে না।