গান্ধীর অহিংস-যুদ্ধ কি ‘সোনার পাথর বাটি’? – নন্দলাল চক্রবর্তী
স্বর্ণ মন্দিরের থেকে বেশি দূরে নয়, ইংরেজ অত্যাচারের সাক্ষী জালিয়ানওয়ালাবাগে ঢোকার রাস্তা। ফটকের কাছেই স্মৃতি ফলকে লেখা রয়েছে এক মর্মস্তুদ কাহিনী। ১৩ ই এপ্রিল ১৯১৯ সাল — অকতারে মানুষ প্রাণ দিয়েছিল জেনারেল ডায়ারের সৈন্যবাহিনীর গুলিতে, বুটের তলায়, বেওনেটের খোঁচায়। দুর্দমনীয় এক রাক্ষসের দাপাদাপিতে সারা পাঞ্জাব সেদিন উথাল পাথাল। কারুর হাতে কোন অস্ত্র ছিল না, সবাই জড় হয়েছিল এক অহিংস শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সভায়। তবু ডায়ার ছাড়েনি। সাদা চামড়ার যখন দাঁত নখ বেরোয়, বোধহয় জঙ্গলের হিংস্রতম শ্বাপদও শিউরে ওঠে ভয়ে। মৃত স্বামীর মাথা বুকে করে এক মহাশ্মশানে সারা রাত্রি রতন দেবী কেঁদেছিলেন, কেউ শোনেননি কান্না। আহত মানুষ জলের জন্য ডুকরে উঠেছে— কেউ আর্তনাদে সাড়া দেয়নি। সারা ভারতে শাসন—শোষণের এক ঘোর অমানিশা বিরাজ করছে। রবীন্দ্রনাথ ‘নাইট’ উপাধি ছাড়লেন। কিন্তু আর কেউ? না, যে সত্যাগ্রহীর সাহস করে বুক পেতে এগিয়ে আসা উচিত ছিল, তিনি ধৈর্য করতে বলেছিলেন, আন্দোলন বন্ধ রাখতে বলেছিলেন, পথে নামেননি আর অসহযোগ আন্দোলনের ডাকও দেননি। সেদিন ব্রিটিশ প্রভুর দয়ায় সামান্য সুযোগ সুবিধা যা পাওয়া যায় তাই আঁকড়ে ধরে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল, গোটা পাঞ্জাবের মানুষ নীরবে শেকল পরেছিল। শেকল ভাঙার গান যিনি শোনাতে পারতেন, তিনি তখন বধির, বিপ্লবের ডাক তাঁর কানে পৌঁছায়নি। কিন্তু কেমন এমল হ’ল? সত্যাগ্রহকে যিনি সবলের অস্ত্র বলেই প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, সেই তিনিই ঐ সময় দরজায় খিল তুলে দিলেন। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী— নামটার সঙ্গে অনেক রহস্য, অনেক বাধা জড়িয়ে।
১৯১৯ সালের ৬ ই এপ্রিল। গান্ধীজির ডাকে সারা ভারত হরতাল। ১৮ ই মার্চ রাওলাট আইন পাশ হলে গান্ধী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সত্যাগ্রহ করার। অহিংস আন্দোলনের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর এমন সুযোগকে তিনি অবহেলা করতে পারেননি। দেশের বৈপ্লবিক সত্তাকে টঁটি চেপে ধরার চেষ্টা ইংরেজ অনেকদিন ধরেই করছিল। এবার রাওলাট আইন পাশ করে যেন বহুদিনের স্বপ্ন সফল হল। বিদেশি প্রভুরা কল্পনাও করতে পারেননি, গান্ধীর আন্দোলনে এত লোক সাড়া দেবে। ঘুণাক্ষরেও কেউ কখনও চিন্তা করেননি, দেশটা মুহূর্তে কানায় কানায় ভরে উঠবে বিদ্বেষে, ঘৃণায়। কাজের ৬ এপ্রিলের হরতাল সর্বাত্মক সফল। অমৃতসরে ঘটল কিছু বিক্ষিপ্ত হিংসাত্মক ঘটনা। বেশিরভাগটাই সরকারের দমননীতির দোষে। যাই হোক ৯ ই এপ্রিল, রামনবমী পর্যন্ত কোথাও তেমন কোন বড় হিংসাত্মক ঘটনা গটেনি। তবু পাঞ্জাবের গভর্নর স্যার মাইকেল ও ডায়ার আদেশ দিলেন ডঃ সত্যপাল এবং ডঃ কিচল্যুর মত জনপ্রিয় নেতাদের পাঞ্জাব থেকে সরিয়ে নিতে। গান্ধীকেও ইংরেজ পাঞ্জাবে ঢুকতে বাধা দিয়েছিল। মানুষ ক্ষেপে গেল। ধাওয়া করে চলল ডেপুটি কমিশনারের বাংলার দিকে, ডঃ কিচল্যু আর সত্যপালকে তারা ধরে নিয়ে যেতে দেবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারা ‘রুখে—দাঁড়াবেই কর্তব্যরত সৈন্যরা বাধা দিল। বাঁধল খণ্ড যুদ্ধ। একজন ইউরোপীয়ান ব্যাঙ্ক ম্যানেজার এবং বেশ কিছু আন্দোলনকারী সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাল। ব্যস, অমৃতসরে জারি হয়ে গেল ‘মার্শাল ল’।
জেনারেল ডায়ার প্রতিহিংসায় জ্বলছেন। ভারতীয়দের এত সাহস। ইংরেজদের গায়ে হাত পড়েছে, যে করেই হোক ভারী বুটের নিষ্পেশনে মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে নেটিভদের দর্প। ১৩ এপ্রিল, হিন্দুদের নববর্ষ (পয়লা বৈশাখ)। অমৃতসরের মানুষ এক শান্তিপূর্ণ সমাবেশে যোগদান করতে চলল জালিয়ানওয়ালাবাগে। হিংসা নয়, অহিংস পন্থাতেই তারা তাদের প্রিয় নেতাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদ করবে। এর আগে তারা শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের কাছে দরবার করেছিল — অকপটে স্বীকার করেছিল যে হিংসাত্মক আন্দোলন করে তারা ভুল করেছে, তারা এরজন্য অনুতপ্ত। কিন্তু দাসের আবার দোষ স্বীকার কি, ওদের জন্যে রয়েছে চাবুক, গুলি, পদাঘাত। আবেদন নিবেদন ব্যর্থ হয়ে, আত্মীয়বর্গের মৃতদেহ নিয়ে শোক মিছিলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তারা ঐ শান্তিপূর্ণ সমাবেশেই মনের কথা প্রকাশ করবে বলে ঠিক করেছিল। ডায়ার কিন্তু এই অহিংস আন্দোলনকেও সহ্য করতে পারেননি। চারদিক থেকে ঘিরে নারী, শিশু, বৃদ্ধ, যুবা সবাইকে অবিশ্রান্ত গুলিয়ে চালিয়ে হত্যা করেছিলেন। এরকম কাপুরুষোচিত ঘৃণ্য কাজ করেও সদর্পে ডায়ার হাণ্টার কমিশনের সামনে বলেছিলেন — ‘আমি যা করেছি ঠিক করেছি। পাঞ্জাবের মানুষের নৈতিক অবনতি রোধ করতেই আমি একাজ করেছিলাম।’ সারা দেশ লজ্জায়, অভিমানে,আক্রোশে ফুঁসছে। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকার সেই বীর সত্যাগ্রহী চুপ। ২১ জুলাই ১৯১৯ সাল — ভারতবাসীর এক কাল রাত্রি। গান্ধীজীর প্রেস স্টেটমেণ্টে দেশবাসী স্তম্ভিত। তিনি বলেছিলেন —
”ভারত সরকার আমাকে শাসিয়েছেন যে যদি আবার সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করা হয়, তা হলে সরকার এমন ব্যবস্থা নেবেন যে তাতে জনগণের নিরাপত্তা বজায় নাও থাকতে পারে। এই সাবধানবাণী এবং দেওয়ান বাহাদুর এল এ, গোবিন্দ রাঘব আয়ার, স্যার নারায়ণ চন্দ্রভারকার এবং আরও কয়েকজন কাগজের সম্পাদকের কাছে দেশের লোকের মনগত ইচ্ছার কথা শুনে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আপাতত এখন কোন সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করব না।”
অর্থাৎ যুদ্ধ নাস্তি। গান্ধী এও বলেছিলেন, সরকার ‘মার্শাল ল কোর্টের’ বিচারে দোষীদের মাথার উপর থেকে কঠোর শাস্তি কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমিয়ে এবং আরও কয়েকটি সুযোগ সুবিধা দিয়ে তাঁকে কৃতজ্ঞাবদ্ধ করে রেখেছেন। যেন এই মহানুভবতার কথা স্মরণ করেই মানুষকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে. একবারও ভাবলেন না, সরকার অমৃতসরের এক রাস্তায় মানুষকে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে বাধ্য করেছিল। মানবতার এই চরমতম অবমাননা তাঁর মন গলাতে পারেনি। আত্মরক্ষার তাগিদ যদি এতটাই, তবে অহিংসা কোন সবলের অস্ত্র?
পিছন ফিরলে আরও এমন কিছু বলা যেতে পারে গান্ধীর এই ব্যবহার অপ্রত্যাশিত মনে হবে না। যে দক্ষিণ আফ্রিকার তিনি বীর সত্যাগ্রহী, সেই দক্ষিণ আফ্রিকাতেই এমন কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন যাতে শ্যামাজী কৃষ্ণবর্মা জ্বলে উঠেছিলেন ধিক্কারে। বুয়র যুদ্ধে গান্ধী নাটালে ইংরেজদের সমর্থনে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেছিলেন। এদের কাজ ছিল লুকিয়ে বসে লক্ষ্য রাখা, কখন কোথা দিয়ে ব্রিটিশের শত্রু বুয়ের যোদ্ধারা ধেয়ে আসছে।
অহিংস গান্ধীর এই সহিংস ইতিহাস লজ্জাকর। আরও আছে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর মেমোয়ার্সে বলেছেন — ‘গান্ধীজি আমাকে বলেছিলেন ওঠ— দেশ বিভাগ যদি হয়, তবে তা হবে আমার মৃতদেহের উপর দিয়ে।’ কিন্তু তিনিই পরে একে সমর্থন করে বসলেন। কথায় ও কাজে এত অমিল থাকা সত্ত্বেও কোন সত্যের বড়াই গান্ধী করতেন, তা ভগবানই জানেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গান্ধীর ভূমিকা কম রহস্যজনক নয়। একবার বললেন, দেশবাসীকে ব্রিটিশদের হয়ে সংগ্রাম করতে, কেন না ফ্যাসিস্টদের যেন তেমন প্রকারেণ রুখতে হবে। আবার তাঁর Letter to every Briton’ — এ এক কিম্ভূত উপদেশ দিলেন। বললেন, — তোমরা তোমাদের সমস্ত কিছু, বাড়ি ঘর সব নাৎসীদের হাতে তুলে দাও। ওরা তোমাদের খুন করলেও বাধা দিও না। শুধু ওদের কাজকে তোমরা মনে প্রাণে সমর্থন করো না।’ মাউন্ট ব্যাটনের সামনেও গান্ধী একই উক্তি করেছিলেন। অনেকে মনে করেছেন গান্ধীর আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থাই তাঁকে ঐ অদ্ভুত মতামত প্রকাশ করতে বাধ্য করেছিল। বেশ কথা। কিন্তু নোয়াখালির দাঙ্গা?
যখন হাঙ্গামা চরম পর্যায়ে, রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে, কই তখন তো গান্ধী গেলেন না হিংসা থামাতে। গেলেন এমন সময় যখন দাঙ্গা থেমে গেছে।
অহিংসা কি তাহলে দুর্বলের কাকুতি? বিপদ বুঝে পিছু হটে আসা?
উদাহরণ ইতিহাসে মজুত আছে অনেক। অহিংসা যুদ্ধ, আর যাই হোক গান্ধীর নিজের কথা ও কাজের পরিপ্রেক্ষিতে নিঃসন্দেহে এক সোনার পাথর বাটি। একথা বুঝতে হয়তো আমাদের একটু দেরি হয়ে গিয়েছে।