গান্ধীবাদ ও কুটীরশিল্প – মনকুমার সেন
‘বাদ” বা ”ইজম” বলতে আমরা কোন ব্যক্তি দল বা গোষ্ঠীবিশেষের যে বিশেষ মতবাদ বুঝে থাকি, ”গান্ধীবাদ” এরূপ কোন ”বাদ” নয়। আগত ও অনাগত কালের সর্বদেশের সকল মানুষের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য সত্য, প্রেম ও অহিংসার শাশ্বত ভিত্তির উপর পৃথিবীতে তাহাই ”গান্ধীবাদ” নামে খ্যাত। মহাকর্মী গান্ধীই এই কর্মনীতির দ্রষ্টা ও স্রষ্টা, তাই আমরা একে ”গান্ধীজম” বলে থাকি, নতুবা এই কর্মনীতিকে আমরা ‘হিউম্যানিজম’ বা ”মানবতাবাদ” বলে আখ্যাত করলেও, কিছু মাত্র ভুল হবে না। আধুনিক সভ্যতার ও অভ্যস্ত চিত্রাধারাকে গন্ডীমুক্ত করে মানবজীবনকে প্রকৃত সুখ ও কল্যাণের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই গান্ধীবাদের উদ্দেশ্য। যন্ত্রের উন্মাদনা থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠুক, তার প্রতিভা তার মানবীয় বৃত্তিগুলো স্বভাব—স্ফূর্ত হবে তার জীবনকে সর্বতোভাবে কল্যাণমুখী করে তুলুক গান্ধী—দর্শনের ইহাই গোড়ার কথা। মহাভারতের ইতিহাসের সত্য, প্রেম, অহিংসা কিছু নূতন কথা না হলেও মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রে সর্বদাই তার বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব এবং সে প্রয়োগের কল্যাণময় পদ্ধতিমানুষের সহিত মানুষের ব্যবহারে, জাতির সহিত জাতির সম্পর্কে রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি সকল বিষয়ে শাশ্বত কল্যাণের প্রতিষ্ঠা করতে পারে— এই অভিনব কলা কৌশলের প্রথম প্রবর্তক ও সার্থক প্রয়োগকারী গান্ধী। এই পদ্ধতির, এই পথের গতিভঙ্গী, রীতি, কর্মকৌশল সকলেই চিরাচরিত পথ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তাই চলতি মাপকাঠিতে সেই পদ্ধতিকে বুঝতে গেলে, সেই পথের হিসাব নিতে গেলে সেটা শুধু হেঁয়ালীরাজ হয়েই দাঁড়াবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তাই ‘গান্ধীবাদ’ অনেকের কাছেই একটা হে’য়ালী, একটা অতি অসম্ভব এক্সপেরিমেণ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। গান্ধীজী ছিলেন কর্মযোগী, ‘গান্ধীবাদ’ আগাগোড়া কর্মের সুরে গাঁথা। এই কল্যাণ কর্মসাধনা করতে হলে ত্যাগ চাই, ভোগীর মোহ ছাড়িয়ে ত্যাগীর উদারদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া চাই। আজিকার দিনের জগতে মানুষের কর্ম—চাঞ্চল্য, জ্ঞান—বিজ্ঞানের নব নব বিকাশ, সৃষ্টির বহুতর বৈচিত্র্য সব কিছুর দৃষ্টি ভোগের প্রতি নিবদ্ধ। ভোগ্যবস্তুর পরিমাণ বাড়িয়ে মানুষের নিত্য নুতন চাহিদা মিটানোই আধুনিক কর্ম—প্রচেষ্টার অন্তিম লক্ষ্য। সেখানে মানুষের চাইতে মানুষের ভোগের ও বিলাসের উপকরণ, জীবনের চাইতে জীবনযাত্রার মান— ‘স্ট্যান্ডার্ড অব লাইফ—এর চাইতে স্ট্যান্ডার্ড অব লিভিং প্রেয় ও শ্রেয়ঃ। সুতরাং এ যুগের দৃষ্টিতে ‘গান্ধীজম’ স্বভাবতঃই একটি অতিঅসম্ভব হেঁয়ালী।
গান্ধীজীর অর্থনৈতিক মতবাদ আধুনিক নীতিবিবর্জিত অর্থনীতির আপোষহীন প্রতিবাদ। মানুষের শাশ্বত আপোষহীন প্রতিবাদ। মানুষের শাশ্বত সুখ ও কল্যাণের পথ আধুনিক অর্থনীতি নির্দেশ করতে পারে নি, করেছে চবখাকেন্দ্রিক গান্ধীজীর গঠন—কর্মসূচী!
আধুনিক অর্থনীতির মূল কথা মুনাফা। অগ্রে পণ্যের উৎপাদন করে তৎপর তার চাহিদার সৃষ্টি করা এবং এমনি করে বহুলোক বহুতর পণ্যের বিশেষ করে মুনাফা করা আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার লক্ষ্য। এ ব্যবস্থায় প্রয়োজনানুযায়ী পণ্যের উৎপাদন হয় না, উৎপাদন করে প্রয়োজন বা চাহিদার সৃষ্টি করা হয়। জাপানের দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে শিল্পোন্নতজাপান তার শিল্পপণ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিক্রত করতে থাকে। যতই দিন যেতে থাকে জাপান বুঝতে পারে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তগত করতে না পারলে পণ্যের বাজার আশানুরূপ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না! তখুনি তার লুব্ধ হিংস্র দৃষ্টি পড়ল চীনের উপর—কারণ চীনই ছিল তার পণ্যের প্রধান বাজার। কাজেই দেখা যাচ্ছে বিদেশী পণ্য ক্রয় করার অর্থ হচ্ছে বিদেশী শাসনশক্তিকে আমন্ত্রণ করা। একই সময়ে আমরা বিদেশী পণ্য চাইব কিন্তু বিদেশী শাসন চাইব না এ অসম্ভব। গলিত শব যেখানে শকুনি সেখানে ঘুরে ফিরে আসবেই, কাজেই সর্বোত্তম পন্থা হল শব পুঁতে ফেলা। বিদেশী পণ্য এই গলিত শবমাত্র। প্রশ্ন হবে, তাহলে কি দেশ—বিদেশের মধ্যে পণ্যের আদান—প্রদান হবে না? হবে নিশ্চয়ই, তবে সেটুকু শুধুই উদ্বৃত্ত পণ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে ভারতের প্রয়োজন অনুযায়ী রেখে বাকিটুকু আমরা বিদেশে রপ্তানি করতে পারি, তার নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে তবেই উদ্বৃত্ত চাল বিদেশে রপ্তানী করতে পারে। এমনি করে বাড়তি ও ঘাটতি দেশগুলোর মধ্যে বাণিজের আদান—প্রদান হবে শুধুই পারস্পরিক সুবিধার জন্যে, লাভের জন্য নয়।
অগ্রিম উৎপাদন করে উৎপন্ন পণ্যের জন্য চাহিদা সৃষ্টির কথা আমরা বলেছি। সাধারণতঃ চাহিদা সৃষ্টির কথা আমরা বলেছি। সাধারণত প্রচার বা বিজ্ঞাপনের দ্বারা এই চাহিদা সৃষ্ট হয়ে থাকে। সুতরাং এই প্রচার অভিযানে অনেক ক্ষেত্রেই অতিরঞ্জন বা অসত্যের আশ্রয়—গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এতে প্রত্যক্ষভাবে হিংসার উদ্ভব হয়না সত্য, কিন্তু মিথ্যার উপর ভিত্তি বলেই এই ব্যবস্থা সর্বথা পরিত্যাজ্য।
ভোগ্য পণ্য ছাড়াও যে মানবজীবনের কাম্য কিছু থাকতে পারে— এবং প্রকৃতপক্ষে জীবনের আর কোন মহত্ত্ব উদ্দেশ্যও যে আছে—আমরা তা’ ভুলে গেছি। এই উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তিত্বের বিকাশ। যে মানুষের ব্যক্তিত্ব নেই, তার চরিত্রও নেই —সে মৃত, জীবন্মৃত। মানুষের প্রতিভা সহজাত মানবীয় বৃত্তিগুলোর স্বাভাবিক স্ফুরণের মধ্য দিয়েই মানুষের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে, গড়ে ওঠে তার সত্যিকারের মনুষ্যত্ব। প্রতিভার ও সহজার বৃত্তির এই স্বাভাবিক বিকাশের জন্যে নিত্য নূতন রূপ অভাব পূরণের প্রয়োজন নেই; বস্তুতঃ জীবনযাপন প্রণালী হতো সহজ সরল ব্যক্তিত্ব লাভের এই সাধনাও ততোই সুসাধ্য হয়ে ওঠে। জীবনযাত্রার মাপ নয় ‘জীবনে’র মাপ উঁচু করাই এই সাধনার লক্ষ্য। ‘স্টান্ডার্ড অব লাইফ’ ও ‘স্টান্ডার্ড অব লিভিং—এর এই মূলগত বৈষম্যটুকু স্মরণ রাখা দরকার। আমাদের মত দেশে যেখানে খেয়ে পরে বেঁচে থাকবার মতো নূন্যতম উপাদানটুকুও মিলছে না, সেখানে লিভিং বা বেঁচে থাকাটাই প্রধান কথা, লিভিং—এর স্ট্যান্ডর্ড উঁচু করবার প্রশ্ন গৌণ প্রশ্ন। আর লিভিং—এর স্ট্যান্ডার্ড উন্নততর করার অর্থেও আমরা বুঝে থাকি ভোগ্যবস্তুর পরিমাণ বৃদ্ধি, জীবনের গুণগত অবস্থা নয়। সুতরাং ‘স্ট্যান্ডার্ড’ এর কথা না তুলে ”সহজ জীবন” ও ”জটিল জীবন” বলাই সঙ্গত। ভোগ্যবস্তুর পরিমাণ ও সংখ্যা দিয়েই যদি জীবনের ”স্ট্যান্ডার্ড’ যাচাই করতে হয় তাহলে তো মিঃ চার্চিলের ‘স্ট্যান্ডার্ড’ অব লিভিং গান্ধীজীর চাইতে কতো বেশী উন্নততর। সুতরাং আমাদের কাম্য হচ্ছে সহজ সরল উন্নততর, স্ট্যান্ডার্ডের জীবন। শত সহস্রাধিক পণ্যের বেড়াজালে যে জীবন আবদ্ধ তাকেই আমরা জটিল জীবন বলব। এরূপ জটিল জীবনের মানুষের প্রতিভা স্ফূর্ত হতে পারে না, মনুষ্যত্বের স্বাভাবিক বিকাশ তাতে ব্যাহত হয়ে পড়ে।
সকল মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পূর্ণ ব্যবস্থা করাই গান্ধী পরিকল্পিত অর্থনীতির উদ্দেশ্য। এগুলি আমাদের অত্যাবশ্যক এবং আন্তরিক চেষ্টার দ্বারা সহজলভ্য। প্রকৃত কল্যাণমূলক কোন পরিকল্পনার ভিন্নতর কোন উদ্দেশ্য থাকা সম্ভব নয়।
এই পরিকল্পনার অর্থনীতি হবে এমন, এরূপ প্রণালীতে কাজ চালাতে হবে, যাতে করে উৎপাদন ও বন্টন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে সমান—তাহলেই চলতে থাকবে। তা না হলেই একদিকে সম্পদ স্তূপীকৃত হতে থাকবে অপর দিকে দেখা দেবে চরম দুঃখ ও দারিদ্র্য।
উৎপাদনের দুটি উপায় আছে, অধিক যন্ত্র ও অল্প কায়িক শ্রম এবং অধিক শ্রম ও অল্প যন্ত্রপাতি। আমাদের দেশে ‘মূলধন’ বা ‘যন্ত্রপাতি’ বা দুটিরই অভাব কিন্তু শ্রমশক্তির কিছুমাত্র অভাব নেই। আমাদের টাকা নেই লোক আছে। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের অবস্থা হচ্ছে সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে লোক শক্তিরই অভাব মূলধন বা যন্ত্রের অভাব নেই সুতরাং ওদেশগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক বিচার করবার আগে ওদের। সঙ্গে ভারতের এই মৌলিক পার্থক্যটা ভেবে দেখা দরকার। কাজে কাজেই এদেশের শিল্প—পরিকল্পনা সার্থক করতে হলেও ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গী নিদেই সেই পরিকল্পনা রচনা করতে হবে।
ভারতের কোটিপতির সংখ্যা ধরে নেওয়া যায় এক সহস্র। সম্পদশালী এই এক সহস্র কোটিপতিকে দিয়ে ভারতবাসীর ভারতকে যাচাই করা চলে না। সুতরাং আমাদের সমস্যা হচ্ছে দেশের সম্পদ এই বিশকোটির মধ্যে সুসমবন্টন করা। এমন কি সুসমবন্টনের দ্বারা উৎপাদন ছাড়াও সম্পদের মূল্য বাড়ানো চলে। একটা সহজ দৃষ্টান্ত ধরা যাক। লক্ষপতির হাতে একটি টাকা আর দৈনিক মজুরের হাতে একটি টাকা এই দুটি টাকার মূল্যে প্রভেদ অনেক। লক্ষপতির টাকাটি দিয়ে যে সিগার কেনা হবে মজুরের হাতে পড়লে তার দ্বারা সে তার উপবাসী স্ত্রী পুত্রের ক্ষুন্নিবৃত্তি করাবে। কাজেই টাকার চলতি মূল্য আর মানবিক মূল্য (human value) সম্পূর্ণ আলাদা। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেই নিখিল ভারত গ্রাম শিল্প সংঘের সভাপতি অধ্যাপক জে সি কুমারাপ্পা বলেছেন যে, সরকারী নীতি এমনভাবে নির্ধারণ হওয়া উচিত যাতে গরীবের কাছ থেকে সংগৃহীত কর ধনীর সুখ—সুবিধার্থে ব্যয়িত না হতে পারে। পক্ষান্তরে ধনীর স্ফীত তহবিল দরিদ্রের জন্যে বণ্টিত হলে সমাজে ধনসাম্য আসবে। এবং এমনি করে উৎপাদন না বাড়িয়েও জাতীয় সম্পদ বাড়ানো সম্ভব হবে।
কেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থা আধুনিক অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। এই ব্যবস্থায় যে প্রচুর মূলধনের প্রয়োজন সেটা দেশের মোট অর্থেরই একটা আবদ্ধ অংশ। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে চলতি মুদ্রা থেকে টাকা আটকে রেখেই ক্রমে এই বিরাট তহবিল সৃষ্টি করা হয়েছে। সে প্রবাহে সৃষ্টি করার ন্যায় মুদ্রার স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ করে, সুসম বণ্টন ব্যাহত—করেই মূলধনের সৃষ্টি। সময় সময় মন্দা বাজার বা চড়া—বাজার বলে আমরা যা শুনে থাকি এবং অনুভব করে থাকি সেটা শুধু এই মূলধনেরই কলাকৌশল। মূলধন বলতে এ স্থলে শুধু টাকা নয় টাকার দ্বারা ক্রয়যোগ্য দ্রব্য সামগ্রীও বুঝতে হবে। কালোবাজারের এবং চোরাবাজারের কল্যাণে এই আবদ্ধ সম্পদের গতি প্রকৃতি আমরা গত মহাযুদ্ধের সময় থেকেই হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছি।
যে মিল মালিকের মিলে দশ হাজার টাকার কাপড় তৈরী হয়, মজুরী বেতন ইত্যাদিতে তিনি হয়ত ব্যয় করলেন তিন হাজার টাকা, অর্থাৎ বাজারে দশ হাজার টাকা মূল্যের কাপড় ছাড়া হলেও ক্রয়শক্তি ছাড়া হল মাত্র তিন হাজার টাকার। স্বভাবতঃই সে মাল আর সম্পূর্ণ কাটতি হতে পারে না। এমনি করে বিভিন্ন মিলে, বিভিন্ন স্থানে মাল স্তূপীকৃত হতে থাকে এবং মন্দার বাজার বা depression—এর সৃষ্টি হয়। এ depression থেকে অব্যাহতি লাভের জন্যই হয় যুদ্ধ। সুতরাং পাশ্চাত্য অর্থনীতির এই কেন্দ্রীভূত উৎপাদন ব্যবস্থায় যুদ্ধ একটা প্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদনের এই প্রণালী যতদিন থাকবে যুদ্ধ কোনক্রমেই এড়ানো যাবে না।
কেন্দ্রীভূত শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যয় কুটীর শিল্পজাত পণ্যের চাইতে কম এ যুক্তি যাঁরা প্রদর্শন করেন তাঁদের বাস্তব—বিচারের অভাব রয়েছে। কেন্দ্রীভূত শিল্পোৎপাদনে আমরা মূল্য হ্রাসের কথাই বলব কিন্তু কুটির শিল্পের ক্ষেত্রে মূল্য বৃদ্ধিই প্রয়োজন। পণ্যের মূল্য হ্রাস করা যেতে পারে দুই প্রকারে যথা (১) কাঁচা মালের মূল্য হ্রাস করে, এবং (২) কর্তৃপক্ষের মুনাফা নিয়ন্ত্রিত করে। কাঁচামালের মূল্য হ্রাস করা আদৌ সমীচীন নয়, সুতরাং মূল্য হ্রাস করতে হলে মুনাফাই নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার। একশত টাকা মূল্যের গহনা যে ব্যক্তি চুরি করে এনেছে তার পক্ষে সেটা পনেরো টাকায় বিক্রী করেও পনেরো টাকা লাভ করা সম্ভব কারণ গহনার কোন ব্যয়ই তাকে বহন করতে হয়নি।
সীমাবদ্ধ বাজারে কুটীর শিল্পজাত পণ্যের লেনদেন হয়ে থাকে। সুতরাং বর্ধিত মূল্যের দ্বারা কুটিরশিল্পী ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, কারণ মূল্যস্ফীতির জন্য যে অর্থের প্রাচুর্য ঘটবে সেটা কোন ব্যক্তি বিশেষের মুনাফা হবে না, সহজ সরল প্রক্রিয়ায় জনসাধারণের মধ্যে সে অতিরিক্ত অর্থ হস্তান্তরিত হবে। চরখার মূল্য বৃদ্ধি পাবে এবং বর্ধির মজুরী পেলে বর্ধিত মূল্যে আহার্য পরিধের সংগ্রহ করতেও তাদের কষ্ট হবে না। সুতরাং স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে কুটীর শিল্পজাত যে সম্পদ সেটা বর্ধিত মূল্যের মাধ্যমে জন—সাধারণের মধ্যে বণ্টিত হয়ে গেল।
গান্ধীজী পরিকল্পিত এই মানবিক অর্থনীতির আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে গ্রামের সম্পদ গ্রামেই সীমাবদ্ধ রেখে লোকশক্তির পূর্ণ নিয়োগ করা। নিষ্কর্মা অলস মানুষের বৃত্তিগুলো ক্রমেই নিষ্ক্রিয় ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তার অধোগতি হয়, নৈতিক অধঃপতন ঘটে। গান্ধীজী বলেছেন, ”তিন কোটি মানুষের শ্রমের স্থলে যদি মাত্র ৩০,০০০ মানুষের মেহনতের দ্বারা আমার দেশের সমস্ত প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপন্ন হয় তাতে আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু ঐ তিন কোটি মানুষকে যেন বেকার বসে থাকতে না হয়।” ভারতের লক্ষ লক্ষ গ্রামে লোকশক্তির কত অপচয় হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। ভারতীয় কৃষক বৎসরের প্রায় ৬ মাস অলস বসে থাকে, গান্ধীজী এই লক্ষ লক্ষ অলস জীবন্ত যন্ত্রগুলোকে সক্রিয় করতে চেয়েছেন।
নোয়াখালীর একটি প্রার্থনান্তিক সভায় তিনি বলেছিলেন, ”কোন পরিকল্পনা যদি দেশকে তার কাঁচামাল থেকে বঞ্চিত করে এবং শ্রেষ্ঠ যে লোকশক্তি তাকে উপেক্ষা করে তবে সে পরিকল্পনা ধ্বংসশীল এবং তার দ্বারা মানব—সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা হতে পারে না।” পৃথিবীর সর্বপ্রধান শিল্পোন্নত দেশ আমেরিকাও যে সম্পূর্ণ রূপে দারিদ্র ও অবনতি দূর করতে পারেনি তার কারণ এঅ সর্বজনীন লোকশক্তির উপেক্ষা।
শিক্ষক, ছাত্র, উকিল, ব্যারিষ্টার, ব্যবসায়ী লেখক— সকল শ্রেণীর সকল লোকের কায়িক শ্রম করা উচিত বলে গান্ধীজী মনে করেন। এই শ্রমের দ্বারা শুরু যে বস্তুর উৎপাদন হল তাই নয়, শ্রমিকের মনেও তার এক কল্যাণময় প্রভাব বিস্তার হয়ে থাকে। বাস্তবিকপক্ষে বস্তুর চাইতেও মানুষের উপর শ্রমের এই শুভ প্রভাব অধিকতর মূল্যবান।
অনেকের কাছেই আজও একথা অস্পষ্ট যে সত্য ও অহিংসার প্রতিষ্ঠাই গান্ধী পরিকল্পিত কুটীরশিল্পের—উদ্দেশ্য। আধুনিক শোষণমূলক উৎপাদন ব্যবস্থায় মানুষ যেভাবে দূর্নীতি পরায়ণ হয়ে পড়ছে এবং দ্রুত সত্যের পথ থেকে সরে যাচ্ছে তাতে কুটীরশিল্পের সম্প্রসারণ ও ধ্বসংপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই এর প্রতিরোধের একমাত্র উপায়। অনেকের ধারণা, অর্থনীতিতে নীতিবাদের কোন স্থান নেই। কিন্তু ভাল—মন্দের বিচার করবার ও অন্যের প্রতি কর্তব্যকর্ম করবার প্রবৃত্তি আছে বলেই মানুষ মনুষ্যত্বের দাবী করতে পারে, তা না হলে পশুর সঙ্গে ভাব পার্থক্য কোথায় আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য আছে বলেই মানুষ, মানুষ। মানুষের কল্যাণের জন্য রচিত অথনৈতিক পরিকল্পনায়ও এই বৈশিষ্ট্য অপরিহার্য।