গান্ধীবাদের কালোপযোগিতা – বিনয় ঘোষ

গান্ধীবাদের কালোপযোগিতা – বিনয় ঘোষ

ভারতজনের জাতীয়তাবোধের উন্মেষপর্বে মহাত্মা গান্ধীর জন্ম, ১৯৬৯ সালে। ভারতের জাতীয় আন্দোলনের এক সুদীর্ঘ পর্বের প্রান্ত পর্যন্ত তাঁর জীবনের কীর্তি বিস্তৃত। আমাদের সংগ্রামক্ষেত্রের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত তাঁরই আহ্বানে প্রথম জনসাধারণের কোলাহলে মুখর হয়ে উঠেছিল, এবং সেই জনকল্লোল যে কুলভাঙা বৈপ্লিক বন্যায় উচ্ছ্বসিত হয়ে কোনো বিপর্যয় সৃষ্টি করেনি, তাও তাঁর কঠোর নৈতিক অনুশাসনের গুণে। জাতীয় আন্দোলনের প্রবাহের দুই তীর গান্ধী তাঁর দু’টি নীতির শিলাবন্ধনে এমন নির্মমভবে বেঁধে দিয়েছিলেন যে তার তরঙ্গোচ্ছ্বাস কখনও সেই বন্ধন ভাঙতে পারেনি। এই নীতি দু’টি হল—অহিংসা নীতি ও সত্যাগ্রহ নীতি। যখন ভাঙনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তখন একটি অমোঘ অস্ত্র প্রয়োগ করে তিনি তাঁর সক্ষম প্রতিরোধ করেছেন। অস্ত্রটি হল ‘আমৃত্যু উপবাসের সংকল্প’। অন্যায়ের জন্য, অসত্যের জন্য অনশন, এবং অনশনের দ্বারা মানসিক শুদ্ধি ও প্রায়শ্চিত্ত। এ হল ভারতের সনাতন শাস্ত্রীয় বিধান। অহিংসা ও সত্যাগ্রহ, উপবাস ও প্রার্থনা—এই ছিল গান্ধীর জাতীয় সংগ্রামের প্রধান হাতিয়ার—এবং তাঁর নিজের জীবনদর্শনের গ্র্যানিট ভিত্তিস্তম্ভ। এই হাতিয়ার প্রয়োগ করেই অবশ্যই তিনি ভারতের জাতীয় জীবনে অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি অদ্বিতীয় ও একক। গান্ধীর চেহারা ও সহজ—সরল অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার কথা উল্লেখ করে ফরাসী মনীষী রোমাঁ রোলাঁ বলেছেন

This is the man who has stirred three hundred millions to revolt, who has shaken the foundations of the British Empire and who has introduced into human politics the strongest religious impetus of the last two thousand years. ( Italics লেখকের)

গান্ধী সম্বন্ধে রোমাঁ রোলাঁর এই উক্তির মধ্যে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ অংশটি হল এই—’যিনি মানুষের রাজনীতিকে গত দুহাজার বছরের সবচেয়ে শক্তিশালী ধর্মীয় প্রেরণায় উজ্জীবিত করেছিলেন।’ গান্ধীরাজনীতির এইটাই হল প্রধান বৈশিষ্ট্য। ধর্মের যে প্রেরণা গান্ধী ভারতীয় রাজনীতিতে সঞ্চার করেছিলেন তা তাঁর নিজস্ব কোনো মৌলিক দান নয়, অথবা তার মধ্যে অভিনবত্বও কিছু নেই। এমনকি ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে সংযোগ স্থাপনও তাঁর কৃতিত্ব নয়। আমরা জানি, ভারতের জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ হয়েছিল উনিশ শতকে, প্রায় গান্ধীর জন্মকালে, মূলত ধর্মীয় প্রেরণা থেকে। বাংলা দেশেই ছিল তখন এই জাতীয় জাগরণের প্রাণকেন্দ্র। জাতীয়তার অন্যতম দীক্ষাগুরু রাজনারায়ণ বসু যে জাতীয় গৌরবসঞ্চারিণী সভা ও স্বাদেশিকের সভা স্থাপন করেছিলেন, নবগোপাল তথা ‘ন্যাশনাল’ মিত্র যে ‘হিন্দুমেলার’ প্রবর্তন করেছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দ মৃতপ্রায় জাতিকে পুনর্জীবনদানের জন্য ধর্মের যে সঞ্জীবনী বাণী প্রচার করেছিলেন, এবং স্বদেশী আন্দোলনের যে প্রবল জোয়ার বয়ে গিয়েছিল দেশে—তার প্রত্যেকটির মধ্যে ধর্মের সুর উচ্চগ্রামে ধ্বনিত হয়েছিল, এবং এই ধর্মের সুর হিন্দুধর্মের গৌরবময় প্রাচীন ঐতিহ্যের সুর। হিন্দুধর্মের এই পুনরুজ্জীবনের সঙ্গে ভারতের জাতীয় জাগরণের সঙ্গমের অবশ্যম্ভাবী ফল যে হিন্দু—মুসলমানের জাতীয়তাবোধের সমান্তরাল বিচ্ছিন্নতা, সে—কথাও অস্বীকার করার অর্থ হল ইতিহাস বিকৃত করা। গান্ধী তাঁর জীবন উৎসর্গ করেও এই দ্বিখণ্ডিত জাতীয়তাবোধকে অখণ্ড রূপ দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, এবং ভারত খণ্ডিত হয়েছে। এই ব্যর্থতা আমাদের জাতীয় সংগ্রামের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা, যার গ্লানি ও অভিশাপ হয়ত পুরুষানুক্রমে আমাদের বহন করতে হবে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, গান্ধী তাঁর পূরসূরীদের ধারা অক্ষুণ্ণ রেখেই রাজনীতিক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন এবং জাতীয় সংগ্রামে যে ধর্মাদেশের প্রতি তিনি জনসাধারণের আনুগত্য দাবি করেছিলেন তা নতূন নয়, অন্তত দুহাজার বছরের প্রাচীন। গৌতমবুদ্ধ ও সম্রাট অশোকের সময় থেকে যুগে যুগে ভারতে ধর্মপ্রবর্তকদের কণ্ঠে অহিংসা ও সত্যের বাণী প্রচারিত হয়েছে। গান্ধী এই প্রাচীন ধর্মীয় আদর্শকে রাজনীতিক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন, এইটাই তাঁর ঐতিহাসিক কীর্তি। জাতীয়তাবোধের উদবোধনকালে ধর্মপ্রেরণা যে জাতীয় চৈতন্যের বিকাশে সহায় হয়েছিল, তা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে প্রসৃত হয়নি। তৎকালে যাঁরা এই প্রেরণার মুখপাত্র ছিলেন তাঁরা রাজনীতিক্ষেত্রে নিজেদের ব্যক্তিগত আচরণে অথবা জীবনযাত্রায় কোনো দর্মাদর্শনিষ্ঠার পরিচয় দেননি। গান্ধীর সঙ্গে তাঁদের পার্থক্য এইখানে। গান্ধী যে ভারতের জাতীয় জনসংগ্রামের প্রথম সার্থক অধিনায়ক হতে পেরেছিলেন তার কারণ ধর্মের শক্তিকে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন যা আগে কেউ করেননি—এবং নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে তার ‘মডেল’ বা প্রতিমূর্তিরূপে গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর পোশাক—পরিচ্ছেদ, জীবনযাত্রা, কথাবার্তা, প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্ম অনুষ্ঠান—সব কিছুর ভিতর দিয়ে তিনি ভারতের জনসাধারণের সামনে নতুন ধর্মসংস্থাপকরূপে প্রতিভাত হয়েছিলেন, যে—ধর্ম রাজনৈতিক ধর্ম। জনসমর্থন পেলে ধর্মের শক্তিকে যে কত ব্যাপক রাজনৈতিক আলোড়নের হাতিয়ারে পরিণত করা যায়, তার দৃষ্টান্ত বিভিন্ন পর্বে গান্ধীর ‘অসহযোগ’ ও ‘সত্যগ্রাহ’ আন্দোলন।

মহাত্মা গান্ধীর এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রকৃত স্বরূপ কি? অধ্যাপক গিলবার্ট মারি (Gilbert Murray) গান্ধীর এই ব্যক্তিত্ব ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন

His patriotism….is interwoven with his religion, and aims at the moral regeneration of India on the lines of the Indian thought …. Oriental people, perhaps owing to causes connected with their form of civilization, are apt to be enormously influenced by great saintliness of character when they see it. Like all great masses of ignorant people, however, they need some very plain and simple test to assure them that their hero is realy a saint…and the test they habitually apply is that of self-denied.

মারির উক্তির সমর্থন শ্রীনিবাস শাস্ত্রীর এই কথাতেও পাওয়া যায়

In fact it is….his relisation of a ‘sannyasin’ in all the rigour of its Eastern conception, which accounts for the great hold he has over the masses of India and has crowned him with the title of Mahatma,

ভারতের সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর আদর্শে গান্ধী নিজের জীবন রূপায়িত করেছিলেন, অথচ সন্ন্যাসধর্ম প্রচার করা তাঁর কাজ ছিল না, জাতীয়তাবোধের প্রসারণই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। কাজেই রাজনৈতিক স্বার্থে যদি তিনি ত্যাগী সন্ন্যাসীর মডেলে নিজের জীবনকে গড়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে ভারতজনচিত্তের মৌল উপাদান সম্বন্ধে তাঁর চেতনা অত্যন্ত প্রখর ছিল। তিনি জানতেন যে রাজনীতির চারিদিকে ধর্মের ইন্দ্রজাল রচনা করতে না পারলে, দেশের বিশাল জনসমাজের মনে সাড়া জাগানো সম্ভব হবে না। এ—সত্য গান্ধীর আগে—এবং বোধ হয় সর্বপ্রথম আমাদের দেশে, স্বামী বিবেকানন্দ উপলব্ধি করেছিলেন। ধর্মের সীমানা অতিক্রান্ত করে স্বামী বিবেকানন্দ যদি প্রত্যক্ষ রাজনীতিক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতেন, তাহলে গান্ধীর রাজনৈতিক আবির্ভাব সম্ভব হত কি না, এবং হলেও তাঁর আদর্শের প্রভাব ভারতের জনসমাজে কতদূর বিস্তৃত হত তা ভাববার বিষয়। উনিশ শতকের শেষদিকে স্বামী বিবেকানন্দ গান্ধীর আবির্ভাবের পথ সুগম ও প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন।

গান্ধীর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রসঙ্গে বলা যায়, ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে তিনিই প্রথম সার্থক ‘charismatic leader’. ‘Charisma’ কথার অর্থ হল ‘gift of grance’—বাংলা ভাষায় অলৌকিক শক্তি বা ‘বিভূতি’ বলা যায়। মানবেতিহাসে দেখা যায়, পৃথিবীর বড় বড় ধর্মপ্রবর্তক, ধর্মগুরু, রাষ্ট্রনায়ক ও রণনায়ক হলেন এই ‘charismatic authority’র সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি। বিখ্যাত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকস হেববার (Max Weber) তাঁর Power গ্রন্থে ‘‘The sociology of Charismatic Authority’ প্রসঙ্গে বলেছেন যে এই বিভূতিময় বা অলৌকিক শক্তিশালী নায়কদের শক্তির উৎস হল আত্মসংযম, অনুগামীদের অন্যায়ের জন্য আত্মনিগ্রহ, অনুরাগীদে প্রশ্নাতীত বাধ্যতা, এবং নিজের পন্থাকে ঈশ্বরের আদিষ্ট পন্থা বলে মনে করা। বিভূতিশালী মহাপুরুষদের বিভূতির জ্যোতি লোকচক্ষে দীপ্যমান রাখার জন্য কতকগুলি টেকনিক বা কৌশল অবলম্বন করতে হয়। গান্ধীর টেকনিক ছিল—সত্যাগ্রহ, অহিংসা, উপবাস, প্রার্থনা ও আশ্রম। জাতীয় সংগ্রামের পর্বে পর্বে এই কৌশলে জনবিক্ষোভ উদ্দীপন ও নিয়ন্ত্রণের সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ‘charisma’ বা বিভূতির জ্যোতি ক্রমে লোকমানসে উজ্জ্বলতর হয়েছে। কিন্তু ‘charisma’ দিব্যজ্যোতির আকর্ষণ, অন্তত রাজনীতিক্ষেত্রে, বর্তমান ভারতে যে নিশ্চিত অস্তগামী তাতে সন্দেহ নেই। গত ২০—২৫ বছরের মধ্যে ভারতের জনসমাজে গণতান্ত্রিক ব্যক্তিচেতনা, গোষ্ঠীচেতনা ও সংঘচেতনার এমন ব্যাপক বিস্তার হয়েছে যে ধর্মের ক্ষেত্রে আজও বহু ধর্মাবতাররের অস্তিত্ব থাকলেও, রাজনীতিক্ষেত্রে কোনো ছদ্মবেশী ধর্মবতারের পক্ষে চারিত্রিক দিব্যজ্যোতির মহিমায় ‘miracle’ ঘটনো সম্ভব নয়। কোনো রাষ্ট্রনেতার পক্ষে আজকের ভারতে উপবাস ও প্রার্থনা করে নিজের ইচ্ছামত গণ—আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভাবা যায় না। এ ছাড়া গান্ধী তাঁর নিজের জীবনেই রাজনীতিতে অহিংসানীতির যথেষ্ট ব্যর্থত্য দেখেছেন। কিন্তু বর্তমান ভারতে যদি তিনি বেঁচে থাকতেন, তাহলে ভারতের পথ—ঘাট—বাজার থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন অঞ্চল, প্রদেশ, বিদ্যায়তন, অফিস, কলকারখানা সর্বত্র ব্যষ্টি ও সমষ্টির মধ্যে হিংসাত্মক হানাহানির সর্বাত্মক প্রকাশ দেখে নিশ্চয় তিনি পাগল হয়ে যেতেন। মর্মে মর্মে বুঝতে পারতেন যে অহিংসার আদর্শ সম্রাট অশোকের মতো শিলাগাত্রে খোদাই করে প্রচার করলে, অথবা উপর থেকে নিচের জীবন্ত ও ক্ষুব্ধ জনসমাজের উপর আরোপ করতে চাইলে তা এমনিভাবেই ব্যর্থ হয়, এবং অনুকূল সামাজিক ও মানবিকপরিবেশের মূল থেকে উৎসারিত না হলে কখনও তার সার্থকতার সম্ভাবনা থাকে না। অতএব গান্ধীর ‘charismatic authority’ বা তার সংশ্লিষ্ট কলাকৌশল, অথবা তাঁর বিমূর্ত অহিংসানীতি বর্তমান ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে anachronistic বা কালবিরুদ্ধ বলে মনে হয়।

গান্ধীর জীবনদর্শনের প্রতিচ্ছবি তাঁর সমাজদর্শন। তাঁর জীবনদর্শন যেমন ঐতিহাসিক ধারার উজানমুখী, তাঁর সমাজদর্শনও তেমনি প্রবহমান সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। আধুনিক সমাজ ও সভ্যতা সম্বন্ধে গান্ধীর মতামতের সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় ১৯০৯ সালে লেখা তাঁর ‘হিন্দু স্বরাজ’ রচনায়। তিনি বলেন: ‘ব্রিটিশ শাসকরা যে ভারতবর্ষ শাসন করছে তা নয়, আসলে শাসন করছে আধুনিক সভ্যতা। এই আধুনিক সভ্যতা তার রেলওয়ে, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন এবং নানারকমের আবিষ্কার ও কলাকৌশল দিয়ে দেশটাকে বেঁধে ফেলেছে। বোম্বাই, কলকাতা ও অন্যান্য বড় বড় শহর হল এই সভ্যতাব্যাধির প্রধান বীবাণুকেন্দ্র। যদি সভ্যতার উপাদানগুলি সব থাকে এবং ব্রিটিশ শাসকরা ভারত ছেড়ে চলে যায়, তাতে ভারতের কোনো পরিবর্তন বা উন্নতি হবে না, কিঞ্চিৎ আর্থিক লাভ ছাড়া। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান হল এক ধরনের black magic, তার চেয়ে আমাদের দেশীয় হাতুড়ে চিকিৎসা অনেক ভাল।’ অতএব গান্ধী মনে করেন।

India’s salvation conists in unlearning what the she has learnt during the past fifty years or so. The railways, telegraphs, hospitals, lawyers, doctors and such like have all to go.

১৯০৯ সালে গান্ধী যখন এই অভিমত প্রকাশ করেন তখন তাঁর বয়স ৪০ বছর। বেশ পরিণত বয়স বলা চলে। অথচ ভাগ্যবান গান্ধী ইংলণ্ডে যাবার সুযোগ পান মাত্র ১৯ বছর বয়সে, ১৮৮৮ সালে। ১৮৯১ সাল পর্যন্ত ইংলণ্ডে থেকে ২২ বছর বয়সে ব্যারিষ্টার পাস করে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ইংলণ্ডে সামাজিক ও মানবিক পরিবেশ তখন কিরকম ছিল? গান্ধী ইংলণ্ডে পৌঁছবার আগের বছর—১৮৮৭ সালে—কার্ল মার্কস—এর Capital মহাগ্রন্থের ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়, Labour Party গঠিত হয়। Fabian Society এই সময় সোশ্যালিজমের আদর্শ প্রচার করতে থাকে। ১৮৭১ সালে প্রকাশিত ডারুইনের Descent of Man মহাগ্রন্থ চিন্তারাজ্যে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এই প্রগতিশীল চিন্তাধারার পাশাপাশি দেখা যায়, বৈজ্ঞানিক ও যান্ত্রিক অগ্রগতিতে বীতশ্রদ্ধ উইলিয়ম মরি, জন রাস্কিন প্রমুখ মনীষীদের অতীতে প্রত্যাবর্তনের চিন্তাধারা। এ—কথা ঠিক যে শিল্পবিপ্লবের পর দ্রুতগতিতে ইংলণ্ড ও ইয়োরোপের কোনো—কোনো দেশের শিল্পনগর, শহর, মহান; ক্রমেই নিসর্গ বিকৃত করে একটা শ্রীহীন যান্ত্রিক রূপ ধারণ করেছিল এবং মানুষের মনের চেহারাও কতটা যন্ত্রের ধাঁচে গড়ে উঠেছিল। এই পরিবেশ প্রসঙ্গে ট্রেভেলিয়ান তাঁর English Social History গ্রন্থে লিখেছেন

‘To millions the divorce from nature was absolute, and so too was the divorce from all dignity and beauty…the stage was set for the gradual standardisation of human personality.

রাস্কিন ও মরিস তাই ‘back to nature’-এর বাণী প্রচার করেছিলেন। রাস্কিনের Unto this Last ও Fors Clavigera গ্রন্থে এই ‘back to Nature’-এর জীবনাদর্শই ঘোষিত হয়েছে।

লক্ষণীয় হল, এই পরিবেশে—যৌবনের প্রারম্ভে—গান্ধীর মানসিক প্রবণতা। যৌবনের স্বাভাবিক ধর্ম হল অগ্রগামিতা, এবং সাধারণ দিকবিদিক—জ্ঞানশূন্য অগ্রগামিতা। কিন্তু গান্ধীর জীবনে এই স্বাভাবিক ধর্মের বিকাশ দেখা যায় না। ইংলণ্ডে যখন ডারুইন, কার্ল মার্কস, ওয়েন ও অন্যান্য মনীষীদের প্রচারিত আদর্শের ঘাতপ্রতিঘাতে চিন্তাজগতে একটা বৈপ্লবিক আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল, সুশিক্ষিত যুবক গান্ধী তখন কারখানার চিমনির ও স্টীম ইঞ্জিনের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে তাঁর দৃষ্টি অতীতের প্রত্যক্ষ প্রকৃতিনির্ভর জীবনের দিকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। ধোঁয়ার আস্তরণ ভেদ করে তাঁর দৃষ্টি অগ্রগামী ইতিহাসের দিগন্তবিসর্পী পথে প্রসারিত হয়নি। মরিস—রাস্কিন—তলস্তয় প্রমুখ মনীষীদের ‘দাও ফিরে সেই অরণ্য—সেই তপোবন’ আদর্শ তাঁকে অভিভূত করেছিল। এবং ভারতের মাটিতে ‘ফিউডাল’ বা সমান্ততান্ত্রিক উৎপাদনের এই প্রাচুর্য ছিল গান্ধীমতের অভ্যুদয়কালে—যে এই আর্দশের বীজ ছড়িয়ে সুফল লাভ করতে তাঁর কষ্ট হয়নি।

অনেক মনীষীর চিন্তাধারা অনুশীলন করলে দেখা যায় যে জীবনের গতিপথে পরিবর্তনশীল সামাজিক পরিবেশের আবর্তে তাঁদের চিন্তাধারার পরিবর্তন ও বিকাশ হয়েছে, কিন্তু গান্ধীচিন্তায় সেরকম বিশেষ কিছু দেখা যায় না। যৌবনের প্রারম্ভে ২০—২২ বছর বয়সে সে সমাজচিন্তার অনুগামী তিনি হয়েছিলেন, সারাজীবন স্থিরদৃষ্টিতে সেই চিন্তারই পশ্চাদধাবন করেছিলেন। এতে তাঁর সাধকসুলভ একাগ্রতা, নিষ্ঠার ও সততার পরিচয় পাওয়া যায় বটে, কিন্তু মানসিক সজাগতা ও গতিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় না। বহমান সমাজে গান্ধী বহুচিন্তার হাল ধরে চলেছিলেন। ১৯০৯ সালে ৪০ বছর বয়সে গান্ধী ‘হিন্দ স্বরাজ’—এ যে রামরাজ্যের আদর্শ ধ্যান করেছিলেন, ৭০ বছর বয়সেও দেখা যায় তিনি তা বদলাননি। ১৯৩৯ সালে ‘হরিজন’ পত্রিকায় তিনি লেখেন

God forbid that Indian should ever take to industrialism after the manner of the West. (28 January, 1939)

জীবনের বাকি নয় বছরেও তাঁর এই মতের পরিবর্তন হয়নি। প্রথম মহাযুদ্ধের রুশবিপ্লব ও তার পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণীর জাগরণের গান্ধীর মনে বিভীষিকার সঞ্চার করেছিল কোনো নতুন আশা বা প্রেরণা সঞ্চার করেননি। ১৯২১ সালেই তিনি পরিষ্কার বলেছিলেন—‘India does not want communism.’ ১৯২৪ সালে রুশবিপ্লব সম্বন্ধে তিনি বলেন

I do not know wheter it is for the good of Russia in the long run. But I do know that in so far as it is based on violence and denial of God, it repels me.

শোনা যায় কারাজীবনে গান্ধী একবার মার্কসের Capital গ্রন্থে পাঠ করে মন্তব্য করেন

I think I could have written it better, assuming of course, that I had the leisure for the study he has put in.

যদি তাঁর বই পড়ার পর্যাপ্ত অবকাশ থাকত তাহলে, গান্ধীর ধারণা ছিল, তিনি মার্কসের Capital—এর চেয়ে আরও ভাল গ্রন্থ লিখতে পারতেন। গান্ধীর বিদ্যাবুদ্ধি ও ক্ষমতার প্রতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধা বজায় রেখেও বলা যায়—তাঁর এই উক্তি যুক্তিহীন এবং হয়ত তাঁর শিশুসুলভ সারল্যের প্রকাশ। অনেক পণ্ডিতের রচনায় মার্কসের চেয়ে অনেক বেশি পাণ্ডিত্য ও অতীত—বিদ্যার পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু তার জন্য ইতিহাসে তাঁরা কেউ মার্কসের সমকক্ষ অথবা সগোত্র বলে স্বীকৃতি পাননি। আদিকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত মানবচিন্তার সুদীর্ঘ পথের উপর তিনিটি কি চারটি বাঁক দেখা যায়, তার সর্বশেষ বাঁকটিতে মার্কসের স্থান। গান্ধী শুধু মার্কসের বাইরের খোলসটুকু দেখেছিলেন, তার ভিতরের সারটুকু দেখতে পাননি। তার কারণ, আগেই বলেছি, গান্ধীর ধারণা ছিল সমাজগতি কতকগুলি বদ্ধমূল অচল—অটল নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। সমাজগতির পরিবর্তনশীলতায় তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই সুদূর অতীতের সত্যযুগের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে অতীতে প্রত্যাবর্তনের আকুতি তাঁর জীবনে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু মানবজীবনে যেমন অতিক্রান্ত বয়সে আর ফিরে যাওয়া যায় না, তেমনি সমাজজীবনেও অতিক্রান্ত কালে প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়। এ! কালবিরুদ্ধতার জন্য গান্ধীর সামাজিক আদর্শ অচল বলে মনে হয়।

অচল নীতি দিয়ে সচল সমাজের সমস্যা সমাধান করা যায় না। তাই মহাত্মা গান্ধীর কোনো নীতি আজ পর্যন্ত ভারতের কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হয় না। গান্ধী বর্তমান ধনতান্ত্রিক সমাজের শ্রেণীবৈষম্য বাস্তব সত্য হিসাবে প্রত্যক্ষ করেছিলেন, কিন্তু বিরোধের মধ্যে হিংসা আছে বলে শ্রেণীবিরোধ স্বীকার করতে পারেননি। তিনি ভাবতেন, হৃদয়ের ভালাবাসা দিয়ে শ্রেণীবিরোধের অবসান ঘটানো যায়। যুক্তিটা কতকটা এইরকম : জমিদাররা ও শিল্পপতিরা যদি প্রজাদের ও শ্রমিকদের ভালবাসে এবং প্রজারা ও শ্রমিকরা যদি তার প্রতিদান দেয়, তাহলে শ্রেণিবিরোধ অনিবার্য হয়ে ওঠে না। ১৯৪৫ সালে, মৃত্যুর কয়েকবছর আগেও গান্ধী তাঁর Constructive Programme-এ বলেন।

A violent and bloody revolution is a certainty one day unless there is a voluntary abdication of riches and the power that rich give, and sharing them for the cmmon good.

কিন্তু অর্থ ও অর্থাশ্রিত ক্ষমতার স্বার্থ স্বেচ্ছায় কেউ ত্যাগ করছেন বলে জানা যায়নি। লুই ফিশার লিখেছেন: ‘No report of voluntary abdication‘ by a landlord or mill-owner reached Gandhi before the day of his death.

তা সত্ত্বেও শ্রেণীসংগ্রাম গান্ধীর কাছে সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য ছিল। Class collaboration বা শ্রেণী—সহযোগিতার নীতিতে তাঁর আস্থা ছিল অটল। ধনবৈষম্য সমাজ থেকে দূর করা সম্ভব, একথাও তিনি বিশ্বাস করতেন না। ১৯৩৭ সালে ‘হরিজন’ পত্রিকায় তিনি লেখেন

Even in the most perfrct world, we shall fail to avoid ineqalities, but we can and must avoid strife and bitterness. There are numerous examples extant of the rich and the poor living in perfect friendliness. We have but to multiply such intsances (January, 1937)

ধনী—নির্ধনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের যে দৃষ্টান্তের কথা গান্ধী এখানে উল্লেখ করেছেন তা ‘ফিউডাল’ সমাজের দৃষ্টান্ত—যখন রাজা—মহারাজাদের ‘benevolent desportism’—এর মধ্যে মানবিক সম্পর্কের সূত্র খুঁজে পাওয়া যেত এবং মানুষ বাইরের প্রকৃতি ও সমাজের সঙ্গে জীবনের অবিচ্ছিন্নতা অনুভব করত। ধনতান্ত্রিক সমাজে মানুষ নিজের জীবন থেকে কর্ম থেকে ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ছিল বাজারের পণ্যের সম্পর্ক। কাজেই ‘হৃদয়’ নামে পদার্থটি ক্যাপিটালিস্ট সমাজে প্রথম casualty এবং কাব্যকল্পনালোকের ‘হৃদয়’ ধনতান্ত্রিক যন্ত্রলোকে কেবল অ্যানাটমির ‘হৃদয়যন্ত্র’ ছাড়া কিছু নয়। Frich Fromm তাঁর The Sane society গ্রন্থে love বা ভালাবাসা সম্বন্ধে বলেছেন: ‘Love is one aspect of productive orientation : the active and creative relatedness of man to his fellow man, to himself and to nature.’

মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে তার নিজের ও বাইরের প্রকৃতির সৃজনী সংযোগবোধ থেকে ভালবাসার বিকাশ হয়। ধনতান্ত্রিক সমাজে এই সংযোগবোধ ছিন্ন হয়ে যায়, ভালবাসার মূল যায় শুকিয়ে এবং তার অস্বাভাবিক বিকৃতি ও ব্যাভিচারের পথ ক্রমে প্রশস্ত হয়। সেইজন্য শ্রেণীসহযোগিতার স্বপক্ষে গান্ধী ‘change of heart’-এর জন্য যে আবেদন করেছিলেন জমিদার ও কৃষক, মালিক ও শ্রমিকদের কাছে, সেই আবেদন ‘হৃদয়ে’ নয়, ‘হৃদযন্ত্রে’ প্রতিহত হয়ে ব্যর্থতার শূন্যতায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে। আজকের ভারতে এই প্রতিধ্বনিত প্রচণ্ড শব্দে গান্ধীর শ্রবণেন্দ্রিয় হয়ত বিকল হয়ে যেত এবং তিনি স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হলেও মনে মনে বুঝতে পারতেন বর্তমান শ্রেণীভুক্ত সমাজে তাঁর হৃদয়নির্ভর শ্রেণীসহযোগিতার নীতির মারাত্মক গলদ কোথায়।

গান্ধীচিন্তার একটা ক্রমিক বিকাশ শুধু হিন্দু সমাজের জাতিবর্ণভেদ বিষয়ে লক্ষ্য করা হয়। ১৯২০—২১ সালে, প্রায় ৫১—৫২ বছর বয়সেও দেখা যায়—গান্ধী হিন্দুসমাজের সনাতন চাতুর্বর্ণ্যের গোঁড়া সমর্থক ছিলেন। ‘Young India’ পত্রিকায় তখন তিনি লিখেছেন: ‘I consider the four divisions to be fundamental, natural and essential.’ (1920) ‘Prohibition against intermarriage and interdining is essential for the rapid evolution of the soul.’

জাতিবর্ণভেদ সম্বন্ধে গান্ধীর এই মতের কালিক গুরুত্ব গভীর। রাজনীতিক্ষেত্রে তখন তিনি অনেক দূর অগ্রসর হয়েছেন এবং অসহোযোগনীতির প্রস্তুতিপর্বে ব্যস্ত তখনও—যথেষ্ট পরিণত বয়সেও তাঁর বিশ্বাস ছিল—হিন্দুসমাজের বর্ণভেদ আবশ্যিক এবং বিভিন্ন জাতিবর্ণের মধ্যে আহারবিহার ও বিবাহ নিষিদ্ধ থাকা আত্মার অভিব্যক্তির জন্য একান্ত প্রয়োজন. ৫২ বছর বয়সেও যাঁর সামাজিক দৃষ্টি প্রাচীন ব্রাহ্মণসভ্যতার সীমারেখা অতিক্রম করতে পারেননি এবং বিংশ শতকের প্রথম পর্বেও—তাঁর সমাজচিন্তার আসল কঙ্কালটি যে কি তা বুঝতে আদৌ কষ্ট হয় না। যাই হোক, পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে গান্ধী জাতিবর্ণভেদ সম্বন্ধে তাঁর মত পরিবর্তন করেন। ১৯৩২ সালে তিনি বলেনঃ ‘Restriction on intercaste dining and intercaste marriage is no part of the Hindu religion. It crept into Hinduism when perhaps it was in its decline.’ (4 November, 1932) বছরের মধ্যে মতের আমূল পরিবর্তন লক্ষণীয়। ১৯৪৬ সালে তিনি লেখেনঃ

‘I therefore tell all boys and girls who want to marry that they cannot be married at Sewagram Ashram unless one of the parties is Harijan.’ (Hindusthan Standard, 5 January, 1646)

মতের পরিবর্তন নয়, শুদু, তার দৃঢ়তারও লক্ষণীয়। কিন্তু প্রশ্ন গল সেবাগ্রাম আশ্রমে, অথবা অন্য যেকোন আশ্রমের গণ্ডির মধ্যে, শুদু অসবর্ণ বিবাহ মঞ্জুর করলে, অথবা আহারবিহারের বর্ণগত নিষেধ উপেক্ষা করলেই কি সমাজ থেকে জাতিবর্ণের সংস্কার দূর হতে পারে? তা যদি হত তাহলে বহুকাল আগেই ভারতীয় সাধক ও সমাজসংস্কারকদের জাতিবর্ণসাম্যের আহ্বানে এই বৈষম্যের সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু তা যখন হয়নি তখন বুঝতে হবে, কেবল একটা নিরবয়ব আদর্শের মাহাত্ম প্রচার করলেই ভারতীয় হিন্দুসমাজের জাতি—বর্ণ—বৈষম্যবোধ দূর হতে পারে না। তার জন্য আরও গভীরতর মূলে প্রবেশ করা প্রয়োজন। বর্তমান ভারতের রাজনীতিতে দেখা যায়—এবং এবিষয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধানও অনেক হয়েছে—যে ক্রমে আমাদের দেশে ‘casteism’ বা জাতিবর্ণবাদের প্রভাব গভীর ও ব্যাপক ও ব্যাহক হচ্ছে। গণতান্ত্রিক চেতনার বিস্তারের ফলে বিভিন্ন জাতি—বর্ণের আত্মনিয়ন্ত্রণের চেতনা যত বিস্তৃত হচ্ছে, তত আত্মপ্রতিষ্ঠার আগ্রহ থেকে জাতিবর্ণের মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। কাজেই গান্ধীর অসবর্ণ বিবাহ অস্পৃশ্যতাবর্জন প্রভৃতি আদর্শ আশ্রমিক নীতিকথার মতো প্রচার করলে জাতিবর্ণসাম্য ভারতীয় সমাজে বাস্তব সত্যে রূপায়িত হবে না। তার জন্য অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে—গান্ধীনীতি ও গান্ধী—অনুসৃত সামাজিক আদর্শ অধিকাংশই বর্তমান কালোপযোগী নয়, কালবিরুদ্ধ। গান্ধী ছিলেন মূলত ‘charismatic personality’—ভারতীয় সাধুসন্তদের মতো তাঁর ব্যক্তিত্বের বিভূতিতে বারতে জনসাধারণ আকৃষ্ট হয়েছিলেন বেশি এবং সেইকারণেই একদা রাজনীতিক্ষেত্রে তিনি সার্থক জননেতা হতে পেরেছিলেন। তাঁর এই বিভূতিময় আদর্শনিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের কথা ভারতের মানুষ—এমনকি পৃথিবীর মানুষ—শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করবে, কিন্তু তাঁর ইতিহাসবোধ ও সামাজিক গতিবোধ সত্য বলে স্বীকার করতে পারবে না, এবং সেই বোধসম্ভূত প্রত্যয় ও নীতিগুলিকে অভ্রান্ত বলে মেনে নিতেও পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *