গান্ধীজী ও সুভাষচন্দ্র – পান্নালাল দাশগুপ্ত
সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে গান্ধীজীর মত—পার্থক্য এবং সে কারণে তাঁদের বাদ—বিসম্বাদের পর্ব দুবছরেরও কম, ১৯৩৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৪১ সালে জানুয়ারি পর্যন্ত—বহু তিক্ততায় কণ্টকিত। ওয়ার্ধার সেবাগ্রাম আশ্রমে ১৯৩৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির দেশ ও পৃথিবীর তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে গান্ধীজী ও সুভাষচন্দ্রের দীর্ঘ আলোচনা হয়। সেই সময় সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের সভাপতি। সুভাষচন্দ্র যখন প্রথমবার কংগ্রেসের সভাপতি হন, সেসময় গান্ধীজীর অনুমোদনক্রমে জওহরলাল নেহরুই তাঁর নাম উত্থাপন করেছিলেন এবং সর্বজনের সমর্থনে বিপুল উৎসাহের মধ্যে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু কিছুকালের মধ্যে দেশের ভিতরে ও বাইরে গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হল। সুভাষচন্দ্র ইতিপূর্বে ইয়োরোপে থাকার সময়েই দেখে এবং বুঝে এসেছিলেন যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জন্য জোর প্রস্তুতি চলেছে—জার্মানির তরফ থেকে। এ খবর অন্যান্য রাষ্ট্রগুলির অজানা নয়। ফ্রান্স, রাশিয়া, ইতালি, ইংল্যান্ড ইত্যাদি দেশ আতঙ্কিত, তারা প্রস্তুতও হতে চলেছে। নেতাজীর মতে আসন্ন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সুযোগ ভারতকে নিতে হবে, পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য এটাই মুক্তির জন্য এটাই মহা সুযোগ। একটা পরাধীন জাতির শত্রুর শত্রু তার মিত্র, রিয়্যালপলিটিকের এই সূত্র কোনপ্রকার আদর্শবাদের নবনীত কোমল হিতবাদ দিয়ে অগ্রাহ্য করা ঠিক নয়। গান্ধীজীর মতে শত্রুর বিপদের সুযোগ নেওয়া অহিংসার আদর্শ নয়। পণ্ডিত নেহরু এবং তৎকালীন ফ্যাসীবিরোধী প্রগতিবাদীদের মতে এমন কোন পদক্ষেপ নেওয়া চলে না যা ফ্যাসীপন্থী হিটলারের সমর্থনে যায়। কারণ ভারতবর্ষ যে ফ্যাসীবিরোধী চিন্তাধারায় অঙ্গীকৃত একথা মনে রাখা দরকার। ১৫ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ বৈঠকে সুভাষচন্দ্র মহাত্মা গান্ধীর কাছে প্রস্তাব রাখলেন, অবিলম্বে ব্রিটিশ সরকারের কাছে ভারতের স্বাধীনতার দাবি একটা আলটিমেটাম হিসাবে রাখা হোক এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশকে আইন অমান্য আন্দোলন ও সত্যাগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা হোক। আর তার নেতৃত্ব গান্ধীজী নিজের হাতে নিন।
দেশের মধ্যে তখন সাতটি রাজ্যে রয়েছে কংগ্রেস সরকার। আর ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে সারা ভারতের জন্য কেন্দ্রে ফেডারেশনের প্রস্তাব উপস্থিত হয়ে রয়েছে। ফেডারেশন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হয়ে থাকলেও কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী ও সংগ্রামবিরোধী মহল থেকে ফেডারেশনের প্রস্তাব একটু উল্টে পাল্টে নেবার লোভ কোনকালেই দূর হয়নি এবং ব্রিটিশের সঙ্গে আপোস রফায় একটা সমঝোতা করে দিল্লির মসনদে বসবার বাসনাও তাঁদের একদম দূর হয়ে গিয়েছে সেটা বলা যায় না। তাছাড়া যে সাতটি রাজ্যে কংগ্রেস—সরকার রয়েছে সেখানকার মন্ত্রীরাও ক্রমশ ক্ষমতা ভোগে অভাস্ত হয়ে পড়েছেন। আবার গদি ছেড়ে সহসা মাঠে ময়দানে লড়তে নেমে যাবেন ততটা আশা রাখা বড় সহজ বোধ হচ্ছে না। একদিকে যদিও কোন আলটিমেটাম দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার নীতি নেওয়া হচ্ছে না, তথাপি ব্রিটিশ সরকারের নানা এজেন্ট দাবার ঘুঁটি সংগ্রহের জন্য সর্বত্র নেমে পড়েছেন। প্রকাশে ও গোপনে ভারতের সব দল ও গোষ্ঠী বিশেষ করে কংগ্রেস, লীগ, দেশীয় রাজন্যবর্গ এমনকি ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে প্রভাবিত করার নিরন্তর চেষ্টা চলেছে। কাজেই সবরকম আপোসবিরোধী বামপন্থী নেতৃত্বের দায়িত্ব সুভাষচন্দ্রের উপর এসে বার্তায়। তিনি সকলরকম আপোসসন্ধানীদের সম্ভাব্য ছিদ্রগুলি বন্ধ করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। দেশের বামপন্থী দল উপদলগুলি সুভাষচন্দ্রকে এ ব্যাপারে প্রথম প্রথম খুবই উৎসাহ দেন। কংগ্রসে সোশালিস্ট পার্টি, কমিউনিষ্ট পার্টি, ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস, কৃষাণ সভার নেতারা কংগ্রেসের ভিতরে ও বাইরে সুভাষচন্দ্রকে খুবই সমর্থন করতে থাকেন। দেশের বাইরে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আসন্ন প্রস্তুতি ও আশঙ্কা, দেশের ভিতরে একদিকে ক্রমবর্ধমান সংগ্রামী চেতনা অন্যদিকে শান্তিসোয়াস্তির অছিদার নরমপন্থী বা দক্ষিণপন্থীদের আপোসের ইচ্ছা—এই উভয় পরিস্থিতির ঘনায়মান সঙ্কটের মধ্যে সুভাষচন্দ্রকে দক্ষিণপন্থী ও গান্ধীপন্থী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের সভাপতি পদের জন্য দ্বিতীয়বার দাঁড়াতে হয় এবং তৎকালীন ওয়ার্কিং কমিটির বারো জন্য বাঘা বাঘা নেতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং স্বয়ং গান্ধীজীর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তিনি নির্বাচিত হয়ে যান।
কিন্তু তৎপরবর্তী ত্রিপুরী কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র হেরে গেলেন। ওয়ার্কিং কমিটির ‘কার্যকলাপ ও গান্ধীজীর নেতৃত্বে আস্থা প্রকাশ করে যে পন্থ—প্রস্তাব ত্রিপুরী কংগ্রসের সামনে উপস্থিত করা হয় তা ভোটে জিতে যায়, সুভাষচন্দ্রের পক্ষ হেরে যান। কংগ্রেস সোশ্যালিষ্ট পার্টি ও কমিউনিষ্ট পার্টি সেদিন সহসা সুভাষচন্দ্রের পিছন থেকে সরে যান। সে এক অভাবনীয় বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস, যার ফলে সুভাষচন্দ্র ধীরে ধীরে কোণঠাসা হতে থাকেন, বাইরে বিপুল সমর্থন থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস সংগঠনে তাঁর স্থান ক্রমশ সঙ্কুচিত হতে থাকে। তাঁকে প্রথমে কংগ্রেসের মধ্যেই ফরওয়ার্ড ব্লক তৈরি করতে হয়, পরে তাঁকে ও তাঁর অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসুকে তিন বছরের জন্য কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয়। ফরওয়ার্ড ব্লক তখন কংগ্রেসের বাইরে চলে যেতেই বাধ্য হয়। সুভাষচন্দ্র নিখিল ভারত ফরওয়ার্ড ব্লক, আপোস বিরোধী কংগ্রেস (রামগড়) ইত্যাদি সংগঠন ও মোর্চার মাধ্যমে দেশব্যাপী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগঠন চালু করার চেষ্টা করেন, হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের জন্য সত্যাগ্রহ যার অন্যতম অঙ্গ। আবুল কালাম আজাদ তখন কংগ্রেসের সভাপতি। আজাদের নেতৃত্বে (আসলে প্যাটেল, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, কৃপালিনী ও নেহরুর নেতৃত্বে ও গান্ধীজীর সমর্থনে) তখনকার কংগ্রেসে ইংরেজের বিরুদ্ধে সংগ্রামের তাগিদের চেয়ে সুভাষ—বিরোধী বা ফরওয়ার্ড ব্লক বিরোধী সংগঠন গড়ার তৎপরতাই যেন বেশি। বিহারের বিখ্যাত কৃষাণ নেতা স্বামী সহজানন্দকে তখন ব্রিটিশ সরকার ভারত রক্ষা আইনে বন্দী করেছে, আরও অনেক সুভাষপন্থী নেতা একে একে বন্দী হচ্ছেন। এমনকি কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট নেতা জয়প্রকাশ নায়ারণকে বন্দী করা হয়েছে। (এই বন্দীদশা থেকেই জয়প্রকাশ নারায়ণ গোপনে লোক মারফৎ সুভাষচন্দ্রের কাছে এক দীর্ঘ পত্র পাঠান, যাতে জয়প্রকাশ তাঁর ভুল অপকটে স্বীকারপূর্বক সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা প্রকাশ করে কতকগুলি প্রস্তাব রেখেছিলেন। সুভাষচন্দ্র দেশ ছেড়ে চলে যাবার ঠিক প্রাককালে পত্রবাহক চিঠিটি তাঁর হাতে পৌঁছে দিয়েছিলেন কিন্তু তখন সুভাষচন্দ্রের পক্ষে বাইরে চলে যাবার সিদ্ধান্তের আর পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। (চিঠিটি এখন নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোতে একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে রক্ষিত আছে।) হলওয়েল মনুমেন্ট বিরোধী সত্যাগ্রহ চলা কালে সুভাষচন্দ্রকে রাষ্ট্রদ্রোহী বক্তৃতার অভিযোগে ভারতরক্ষা আইনে আটক করে বিনা বিচারে বন্দী করে রাখা হয় প্রেসিডেন্সী জেলে। এই প্রেসিডেন্সী জেলে থাকার সময়েই তিনি দেশত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি আমরণ আনশন ঘোষণা করেন এবং তৎকালীন লীগ মন্দ্রিসভা ভয়ে ভয়ে বাধ্য হয়ে তাঁর বন্দীদশার আদেশ স্থগিত করে তাঁকে এলগিন রোডের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। সেখানে থেকে একদিন রাত্রিতে তিনি ভারত থেকে অন্তর্ধান করার পথে বেরিয়ে যান। কাবুল, রাশিয়া, জার্মানী হয়ে ডুবোজাহাজে শেষ পর্যন্ত জাপানে চলে আসেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে রেডিও মারফৎ গান্ধীজীকে প্রথমেই প্রণাম জানিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আশ্চর্যের কথা এত তিক্ততার পরেও সুভাষচন্দ্র (তখন তিনি নেতাজী ) টোকিও থেকে প্রথম বক্তৃতাতে মহাত্মা গান্ধীকেই প্রথমে স্মরণ করেন। তাঁকে জাতির পিতা বলে সম্বোধন করতে তাঁর একটুও বাধেনি।
এই কথাটুকুর তাৎপর্য আমাদের ভাল করে বুঝতে হবে, শেষপর্যন্ত গান্ধী ও সুভাষচন্দ্রের মধ্যে কী ধরনের সম্পর্ক ছিল। আধুনিক মনোবিজ্ঞানসম্মত অর্থ সরলীকৃত করে লাভ অ্যান্ড হেট—এর সম্পর্ক এটা নয়। ১৯৩৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৪১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধীজী ও বসুর মধ্যে যে পত্রালাপ হয় তা জাতির ইতিহাস রচনা জন্য অপরিহার্য দলিল। নেতাজী রিসার্চব্যুরো থেকে Cross Roads নামে যে একটি অমূল্য গ্রন্থ বের হয়েছে তার মধ্যে Bose-Gandhi Correspondence (পৃঃ ১৪৫—১৮৯) অধ্যায়টি মূল্যবান দলিল হিসাবে ইতিহাস ও রাজনীতির ছাত্র এবং গবেষকদের কাছে অবশ্য—বিচার্য বিষয় বলে গৃহীত হবে সন্দেহ নেই। ঐ গ্রন্থ ও বিশেষ করে ঐ অধ্যায়টি গান্ধীজীর সঙ্গে সুভাষের দ্বন্দ্ব ও মতপার্থক্য বুঝবার পক্ষে অপরিহার্য। এবং শুধু তাঁদের দুজনের মধ্যে বিতর্ক বুঝবার জন্যই নয়, অহিংসা ও হিংসা, সংগ্রাম ও সহযোগিতা, বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তর বিচারবিতর্কের খাদ্য ও এখানে পাওয়া যায়। ভারতের পক্ষে দ্বিখণ্ডিত না হয়েও অন্য কোন বিকল্প ঘটনা ঘটতে পারত কিনা বিচার করাও রসদ পাওয়া যায়। আমাদের এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে তার সবটা আলোচনা করতে পারি না। কেবল গান্ধী চরিত্র বিশ্লেষণের প্রয়োজনে সুভাষচন্দ্র ও তাঁর বিকল্প পথের পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধীনীতি ইতিহাসের ধোপে কতটা টিকে ছিল কি টেকেনি, সেই চিত্রটুকুই মাত্র উপস্থিত করব। মননশীল ও অনুসন্ধিৎসু পাঠক পাঠিকা তা থেকে হয়ত গভীরতর গবেষণায় উদ্বুদ্ধ হতে পারবেন।
তাত্ত্বিক ও সংগ্রামী কৌশলের দিক থেকে গান্ধীপন্থা ও সুভাষপথের মিল ও অমিল কোথায় তা সংক্ষেপে উল্লেখ করতে চাই। তবে তা খুবই সংক্ষিপ্ত হতে বাধ্য।
১। ব্রিটিশ সরকারের নিকট আলটিমেটাম দিতে গান্ধীজীর আপত্তি কোথায় ছিল? গান্ধীজীর মতে আলটিমেটাম দিলে তা পালন করার জন্য যে অহিংস সত্যাগ্রহী গণশক্তি প্রয়োজন তা সে সময়ে দেশে উপস্থিত ছিল না। তাঁর মতে দেশে তখন প্রচণ্ড হিংসার বাতাবরণ, তিনি জাতির নিশ্বাস প্রশ্বাসে তার উত্তাপ অনুভব করেছেন। দ্বিতীয়ত কংগ্রেসের মধ্যে তখন ভীষণভাবে দুর্নীতি ঢুকে গিয়েছে। তার মেম্বারশিপ একেবারেই বোগাস বা ভুয়ো, ফলে তা থেকে সত্যাগ্রহী আন্দোলন সৃষ্টি হতে পারে না। সুভাষচন্দ্রের মতে কিন্তু সে সময় ভারতবর্ষে সাধারণভাবে হিংসা বা হিংসাশ্রয়ী রাজনীতির প্রভাব তেমন কিছু ছিল না। যে বাংলা, উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের একটা ঐতিহ্য ছিল, ১৯৩৯ সাল নাগাদ সেখানকার সংগ্রামপন্থীরাও অমান্য আন্দোলন ও সত্যাগ্রহকেই স্থায়ী রণকৌশল হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছেন, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শ্রমিক ও কৃষকদের সঙ্ঘবদ্ধ গণ—আন্দোলন। কিন্তু গান্ধীজী তা স্বীকার করেছে না বা তার উপর নির্ভর করে সংগ্রাম শুরু করতে রাজি হতে পারছেন না।
২। গান্ধীজী উল্লেখ করেন, দেশের মুসলিম লীগ নেতৃত্বে হিংসাশ্রয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ অবস্থায় সংগ্রাম শুরু করলে সাম্প্রদায়িকতার বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। সুভাষচন্দ্রের মতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সর্বব্যাপী সংগ্রাম শুরু করলেই সাম্প্রদায়িকতার শক্তি ক্ষয়ে যাবে। তাছাড়া সংগ্রাম শুরু না করার মানে সাম্প্রদায়িক মুসলমান ও সাম্প্রদায়িক হিন্দু সংগঠনগুলিকে নিজেদের গুছিয়ে নেবার সময় বা অসবর দেওয়া মাত্র। যত দিন যাবে, জনগণের উদার দেশচেতনার বহিঃপ্রকাশে যত অন্তরায় ঘটবে, ততই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীগুলি নিজেদের ঘাঁটি শক্ত করে নেবে। যদিও সুভাষচন্দ্র এ যুক্তি পরিষ্কারভাবে উপস্থিত করেননি, তবু লেনিনের ভাষায় বলা যায়, যদি ঠিক ঠিক সময়ে বিপ্লবের ডাক দেওয়া না যায় তবে প্রতিবিপ্লবই জোরদার হয়ে আক্রমণ করে। বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব মল্লযুদ্ধের জন সর্বদাই সময় ও সুযোগ সন্ধানে ব্যস্ত। তাছাড়া মহাত্মা গান্ধীর নিজের অহিংস সংগ্রামের দর্শনেও হিংসাকে দেখে চুপ করে থাকার নীতি সমর্থিত হয় না। তিনি নিজেই অনেকবার বলেছেন, হিংসার আগুন কোথাও জ্বলছে দেখে অহিংসা নিষ্ক্রিয় দর্শক হয়ে থাকতে পারে না, ‘Ahimsa must enter the jaw of himsa, willingly, deliberately, অর্থাৎ অহিংসা হিংসাকে এড়িয়ে যাবে না, বরং তার রক্তরাঙা চোখ ও ভয়াল আগ্রাসী মূর্তিকে নির্ভয়ে চ্যালেঞ্জ জানাবে। অহিংসা যদি হিংসারই মোকাবিলা করতে না পারে, তবে হিংসার ক্ষেত্র বা কার্যকারিতা কতটুকু? অহিংসার সঙ্গে তো অহিংসার কোন লড়াই থাকতে পরে না। তবে দুর্বলের অহিংসা ও সাহসী বা সবলের অহিংসা এক নয়। জীবনের শেষ পর্যায়ে নোয়াখালিতে বসে বিনিদ্র রজনীতে গান্ধীজী বারবার আত্মজিজ্ঞাসা করেছেন, তবে এতদিন ভারতে কোথায় কতটুকু তাঁর অহিংসা কার্যকর ছিল? তিনি শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিলেন, অহিংসার নামে যারা তাঁর দলবল ভারী করত তারা আসলে ভীরু, মৃত্যুভীরু, সুবিধাবাদী। তাদের অহিংসা ছিল ভীরুর অহিংসা। তাই যে মুহূর্তে দেশে হিংসার আগুন জ্বলে উঠল সেই মুহূর্তে তাদের অহিংসা উধাও হয়ে গেল, দেশ জুড়ে এমন একটা লজ্জাকর, গ্লানিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হল, এমন কদর্য হিংস্রতা জ্বলে উঠল যা প্রকৃত সুশিক্ষিত ভায়োলেন্ট স্ট্রাগল—এ থাকতে পারে না। যুদ্ধবিগ্রহের একটা নিয়ম আছে—যদিও তা হিংস্রাশ্রয়ী। কিন্তু ভারতে সেদিন যে হিংসা ফেটে পড়েছিল তার কোনো ন্যায় ছিল না, নীতি ছিল না, ধর্মাধর্ম জ্ঞান ছিল না, নারী পুরুষ শিশু ভেদাভেদ—বোধ ছিল না। তাঁর স্বপ্নের ভারতে এত কদর্য জঘন্য হিংসা এল কোথা থেকে—তাঁর ত্রিশ বছরব্যাপী হিংসার সাধনা ও সত্যাগ্রহ সত্ত্বেও?
৩। এদিকে সুভাষচন্দ্রকে বরাবরই বিপ্লবী পথের পথিক বলে আমরা মেনে নিতে পারি না। কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার পর ঐ পদে থাকাকালীন তিনি পুরোপুরি গান্ধী নেতৃত্বে বিশ্বাসী। সেসময় অহিংসা, সত্যাগ্রহ ও আইন অমান্য আন্দোলনের মধ্যেই তাঁর সংগ্রামী চেতনা ও কৌশলের সীমা নির্ধারিত দেখতে পাই। গোড়া থেকেই তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের কথা ভাবেননি। আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিগ্রহের সুযোগ নিয়েই দেশ স্বাধীন করতে হবে এমন কথাও তিনি বরাবরই ভাবেননি। যদিও যুদ্ধবিগ্রহ বা অস্ত্রশস্ত্রকে কোন নিষিদ্ধ ব্যাপার বলে বর্জনও করেননি চিন্তার দিক থেকে। যদি তা করতেন, যদি আগাগোড়া বিপ্লবী পথই তিনি অনুসরণ করতেন, তবে এতদিন কংগ্রেসের মধ্যে বসে থাকা বা গান্ধীনেতৃত্বে বিশ্বাস করে চলা কি যুক্তিসঙ্গত হয়েছে? প্রথম থেকেই কংগ্রেসের বাইরে গণসংগঠন ও নেতৃত্ব সৃষ্টি করা উচিত ছিল না কি? তিনি শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসে থাকতে পারলেন? অবশেষে তাঁকেই কি তিন বছরের জন্য সাসপেণ্ড করে দেওয়া হল না?
৪। কংগ্রেসের মধ্যে তাঁর থাকা ও গান্ধীনেতৃত্ব মেনে নেওয়ার পক্ষে একটিই মাত্র যুক্তি ছিল, ভারতের অগণিত জনগণের সঙ্গে তাহলে যুক্ত থাকা যায়। রাজনীতিকে জনগণের দুয়ারে পৌঁছে দেবার কৃতিত্ব গান্ধীজীরই, একথা সবাই স্বীকার করেন এবং সুভাষচন্দ্রও সেকথা জানতেন। কংগ্রেস ও গান্ধীনেতৃত্বের বাইরে তৎকালীন সর্বস্তরের ভারতীয়দের ধরবার কোন ক্ষেত্র বা ক্ষমতাই তাদের ছিল না। গান্ধীজীর হাতেই যেন জনতার চাবিকাঠি। কেমন করে গান্ধীজী এই অদ্ভূত অপূর্ব গণসংযোগ করতে পেরেছিলেন যে জন্য বামপন্থীদের (এমন কি সুভাষচন্দ্রকেও) বারবার বলতে হতো Gandhiji, give us the marching order! বামপন্থীরা নিজেরা কেন সেই মার্চিং অর্ডার দিতে পারতেন না? এখানেই রয়েছে গান্ধীজীর আসল শক্তি একদিকে গঠনমূলক কর্মকাণ্ড, অপরদিকে সত্যাগ্রহী গণ—আন্দোলনের সাহায্যে তিনি এই শক্তি অর্জন করেছিলেন। গঠনমূলক কাজ ও সংগ্রাম এই উভয় শক্তিকে তিনি পরস্পরের পরিপূরক হিসাবে দাঁড়া করিয়েছিলেন, একটার বিকল্প বা সাবস্টিটিউট হিসাবে অপরদিকে দাড় করাননি। সুভাষচন্দ্র, নেহরু বামপন্থী নেতাদের চমকপ্রদ সংগ্রামী দৃষ্টিভঙ্গী, ব্যক্তিত্ব বা মতাদর্শগত আকর্ষণ যতই থাকুক, কার্যকালে ঐ বৃদ্ধের সাহায্য ছাড়াও এদেশে সেদিন কেউ কিছু করতে পারতেন না। ঐ বৃদ্ধ বেঁচে থাকতে এদেশে কিছু করা যাবে না, শেষ পর্যন্ত এই তিক্ততার বশবর্তী হয়েই সুভাষচন্দ্র ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়ে একদিন রাতের অন্ধকারে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, দেশের মধ্যে তাঁর অতদিনের সাধনার সবকিছু ত্যাগ করে এক বেপরোয়া জুয়াড়ির মত অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু আজ একথা বুঝতে হবে যে, শেষ পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র যখন গান্ধীজীর কর্মপন্থাকে ঠাট্টা করে spinning the way to swaraj ইত্যাদি কটাক্ষ করেছিলেন তখনও বামপন্থী বিপ্লব বা নিজের কর্মপন্থায় দুর্বলতা কোথায় ছিল তা নজর দিয়ে দেখেননি। আর পণ্ডিত নেহরু, জয়প্রকাশ ও কনিউনিস্টরা এদেশে সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের গরমাগরম বুলি আনয়ন করলেও গান্ধীজীর প্রতি নির্যাতিত নিপীড়িত কৃষক মজুদূর জনসাধারণের একান্ত আনুগত্যকে কেন তাঁরা সেদিন ছিনিয়ে নিতে পারেননি, কেন সেদিন জনগণ নেহরু সুভাষ জয়প্রকাশ কনিউনিস্টদের চেয়ে গান্ধীজীকেই বেশি নির্ভরযোগ্য নেতা বলে মনে করতেন সেকথাও বিচার করতে হবে সমস্ত ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজের সাক্ষ্য প্রমাণ সহ, সমাজ ও দর্শনের যাবতীয় সম্ভারের বিচারাদি সহ।
৫। এতদসত্বেও গান্ধীজী শেষ পর্যন্ত ফেল করলেন কেন? কেন তাঁকে চূড়ান্ত নৈরাশ্য নিয়ে জীবনের শেষ পর্যন্ত কাটাতে হল? নাথুরাম গডসেই তাঁর শেষরক্ষা করে দিলেন! অহিংসার নামে তিনি রাজনীতিকে যেমন কয়েক ধাপ গিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তেমনি অহিংসার ডগমাই হয়তো তাঁর রাজনৈতিক প্রতিভাকে খর্ব ও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ করে দিয়েছিল। আজ অনেকেই হয়ত এ প্রশ্ন তুলতে পারেন, কেন অহিংসার স্বার্থে তিনি রাজনৈতিক সংগ্রামকে এত দীর্ঘায়ত ও বিলম্বিত করেছিলেন, যার ফলে প্রতিবিপ্লবী শক্তিগুলিই শক্ত হয়ে ঘাঁটি গেড়ে বসার সুযোগ পেয়েছিল? ভারতে যে জনশক্তি সেদিন জেগেছিল তার যথাযথ প্রয়োগ করলে হয়তো এত রক্তারক্তি হত না, দেশ ভাগ না হয়েই ভারতবর্ষ স্বাধীন হতে ও এক থাকতে পারত। পৃথিবীতে অনেক দেশই তো স্বাধীন হয়েছে, শক্তিশালী হয়েছে, তাদের তো সেজন্য অহিংসার দরকার হয়নি। কিন্তু গান্ধীবাদীরা হয়তো বলবেন, অদূর বা নিকটবর্তী কালের ক্ষেত্রে গান্ধীজী ফেল করতে পারেন কিন্তু শাশ্বত কালের পটভূমিকায় পথিকৃৎ হিসাবে গান্ধীজীর স্থায়ী মূল্য থাকবে, যতটা সুভাষচন্দ্রের থাকবে না।
৬। কংগ্রেসের সভাপতিত্বের জন্য সুভাষচন্দ্রের দ্বিতীয়বার প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় দক্ষিণপন্থী ও গান্ধীবাদীদের মনোনীত পট্টাভি সীতারামাইয়া তাঁর কাছে পরাজিত হন। গান্ধীজী অকপটে বলে দেন, এটা আসলে তাঁর পরাজয়, সীতারামাইয়ার নয়। এই উক্তিতে তখনকার বাঙালী ও বামপন্থীরা গান্ধীজীর উপর অসন্তুষ্ট হন। কেন তিনি সুভাষচন্দ্রের জয়কে ভাল চোখে দেখতে পারলেন না, কেন সেটা তাঁর নিজের পরাজয় বলে ঘোষণা করলেন? গান্ধীজী অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে একথাও তখন বলেছিলেন, তাঁর নিজের নীতির পরাজয় হলেও দেশবাসীর তাতে শঙ্কিত হবার কোন কারণ নেই, কারণ যতই হোক সুভাষচন্দ্র বসু দেশের শত্রু নন। এই উক্তিটাও অনেকেই খুব অপছন্দ করেন। সুভাষচন্দ্রের দেশের শত্রু নন এ ধরনের নেগেটিভ সার্টিফিকেট দেবার মত কার্পণ্য কেন? সুভাষচন্দ্রকে সোজাসুজি ‘দেশনায়ক’ বলে রবীন্দ্রনাথ বরণ করে নিয়েছিলেন। তাঁর উক্তির সঙ্গে গান্ধীজীর এই নেগেটিভ সার্টিফিকেট মেলাতে গেলেই দুইয়ের প্রকৃত তফাৎ বোঝা যাবে। সুভাষচন্দ্র নিজেও গান্ধীজীর এই উক্তিটিকে ভালো চোখে দেখতে পারেননি, তাঁর একটি বিবৃতিতে তা প্রকাশ পেয়েছে।
৭। সেদিনকার সেই ঐতিহাসিক বিতর্ক ও অন্তর্দ্বন্দ্বে পন্থ—প্রস্তাবের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। গান্ধীজী ও তাঁর অনুগামী নেতাদের হুইপ সত্ত্বেও সুভাষচন্দ্র যখন দ্বিতীয়বারের জন্য কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তখন অবস্থাগতিতেই ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের মধ্যে একটা অনাস্থার বাতাবরণ এসে যায়। ওয়ার্কিং কমিটির একজন সদস্য হিসাবে পণ্ডিত গোবিব্দবল্লভ পন্থ তখন উক্ত প্রস্তাব পরবর্তী ত্রিপুরী কংগ্রসের এ. আই. সি. বৈঠকে উপস্থিত করার জন্য ওয়ার্কিং কমিটিতে পাস করিয়ে নেন। সেই প্রস্তাব গোটা তিনেক প্রধান বক্তব্য ছিল। এক, ওয়াকিং কমিটি ও তাঁর সদস্যদের প্রতি বা তাঁদের কার্যকলাপের প্রতি আস্থা প্রকাশ। দুই, তৎকালীন সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে মহাত্মা গান্ধীর নীতির উপরে আস্থাজ্ঞাপন। তিন, নব—নির্বাচিত কংগ্রেস সভাপতি যে নতুন করে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য বেছে নেবেন, তাঁর জন্য মহাত্মা গান্ধীর অনুমোদন নিতে হবে।
পন্থ প্রস্তাব সম্বন্ধে সুভাষচন্দ্র বসু গান্ধীজীর মতামত চেয়ে পাঠালেন। মহাত্মা গান্ধী ও তখন রাজকোট সমস্যা, সেখানকার সত্যাগ্রহ ও তজ্জনিত অপশন ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত এবং অসুস্থও। এদিকে কংগ্রেস মহলে দক্ষিণপন্থীরা রটিয়ে দিয়েছে যে পন্থ প্রস্তাব গান্ধীজীকে দেখিয়েই তোলা হয়েছে। অথচ তা আদৌ হয়নি। অনেক পরে এলাহাবাদে গান্ধীজী তা দেখতে পান। অবশ্য রাজকোটে যখন তিনি সেখানকর সমস্যা ও সঙ্কট নিয়ে ব্যস্ত ও নিজে অসুস্থ, তখন তাঁর কোনো এক অনুগামী তাঁকে কথায় কথায় বলেছিলেন যে, ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের মান—সম্মান রক্ষা করার জন্য (সুভাষচন্দ্রের দ্বিতীয়বার সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর) একটা প্রস্তাব পাস করা হবে। গান্ধীজী তাতে আপত্তিজনক কিছু আছে বলে মনে করেননি। পরবর্তী কালে সুভাষচন্দ্রের যখন বারবার গান্ধীজীর স্পষ্ট মতামত দাবি করতে থাকেন, পন্থ প্রস্তাবের তাৎপর্য সম্পর্কে—তখন ১৯৩৯ সালের ১০ এপ্রিল রাজকোট থেকে থেকে এক পত্র তিনি তাঁকে পরিষ্কার বলে দেন, ‘Pandit Pant’s resolution I cannot interpret, the more I study it, the more I dislike it.’
পন্থ প্রস্তাব যদিও কংগ্রেসের সংবিধান অনুযায়ী বেআইনী তবু ওয়ার্কিং কমিটির সম্মানিত সদস্যদের খাতিরে ও গণতন্ত্রের খাতিরে সুভাষচন্দ্র এর প্রতিবন্ধকতা করেননি। বেআইনী হলেও তিনি তা মেনে নিয়েছিলেন। কংগ্রেসের পরবর্তী অধিবেশনে তা পেশও করতে দিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ প্রস্তাবের নির্দেশনা মনত এবার তাহলে মহাত্মা গান্ধীকেই নতুন ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য বেছে দিতে হয়। কিন্তু তিনি তাতে রাজি নন, কিছুতেই কোনো শর্তেই রাজি নন। তিনি বারবার জানিয়ে দেন, সুভাষ যেন নিজের পছন্দমত নতুন সদস্য মনোনীত করে নেন এবং অকুতোভয়ে নিজের প্রোগ্রাম মত কংগ্রেস ও দেশকে পরিচালিত করেত অগ্রসর হন। সুভাষচন্দ্রের মতে এই সময়ে কেবল তাঁর মতাবলম্বী বামপন্থী সদস্যদের নিয়েই ওয়াকিং কমিটি করতে গেলে কংগ্রেসে বিরাট ভাঙন আসবে, দেশের ক্ষতি হবে। তৎকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ভারতের যখন একতাবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশের কাছে তথা বিশ্বের দরবারে ভারতের স্বাধীনতার জন্য আলটিমেটাম দেবার প্রয়োজন, তখন দেশের মধ্যে ও কংগ্রেসের মধ্যে ভাঙ্গন ধরানো অন্যায় এবং অনুচিত। তাছাড়া সুভাষচন্দ্র গান্ধীজীর কাছে লেখা এক পত্রে পরিষ্কার জানিয়ে দেন I feel it galling to my conscience to hold on to office if the greatest personality in India today feel, though he may not say it openly, that the passing of the resolution (Pant resolution) should automoatically have brought in my reisgnation’…….
তিনি বারবার জিজ্ঞেস করেছেন, পন্থ প্রস্তাবে কি তাঁর প্রতিই অনাস্থা প্রকাশ করা হয়েছে? তবে কি গান্ধীজীর মতে তাঁর পদত্যাগ করা উচিত? তার উত্তরেই গান্ধীজী জানিয়েছিলেন যে, পন্থ প্রস্তাবটি তিনি যত দেখছেন ততই বিরক্ত হচ্ছেন। আর সুভাষ যদি মনে করে থাকেন পন্থ প্রস্তাবটি বেআইনী তাহলে তাঁর প্রতি অনাস্থার কথা ওঠেই না। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁর মত ও পথ অনুযায়ীই কংগ্রেসকে পরিচালিত করুন। তাতে গান্ধীজীর সমর্থন ও বিরোধিতা কোনটার কথাই ওঠে না। একটি টেলিগ্রামেও পরিষ্কার নির্দেশ দিচ্ছে My Advice Form cabinet and publish Programme.
আবার ১০ এপ্রিলের চিঠিতে লিখছেন, ‘‘I cannot and will not, impose a cabinet on you, nor can I guarantee approval by AICC of your cabinet and policy. It would amount to suppression. Let the members exercise their own judgment. If you do not get the vote, lead the opposition till you converted the majority.’
সুভাষচন্দ্র বারবার অনুরোধ করলেন, গান্ধীজী যেন কোনো পক্ষ না নেন, অথবা কোনো পক্ষকে তাঁর নাম ও প্রভাব ব্যবহার করার সুযোগ না দেন, তাঁর ভাবমূর্তিকে যেন সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে সাহায্য না করেন। দেশ ও দলের মধ্যে সেই আসন্ন ভাঙনের বিরুদ্ধে একটি ব্যক্তিই সেদিন কার্যকর হতে পারতেন, তিনি গান্ধীজী। কিন্তু গান্ধীজী দেখা যায় প্রতিবাদে শুধু এটুকুই বলেছেন, ‘Nobody put me against you. What I told you in Sewagaon was based on my own personal observations. You are wrong if you think that you have a single personal enemy among the old guard’’.
কিন্তু গান্ধীজীর এই উক্তি সম্পূর্ণরূপে ভুল। তৎকালীন রাজনৈতিক কোন্দলের এতটুকু খবর যিনি রাখেন তিনিই বলবেন সুভাষচন্দ্রকে নিজেদের শক্তিতে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বা মুরোদ সেদিন old guard ও তাঁদের অনুগামীদের সামান্যই ছিল। গান্ধীজীর নাম ও প্রভাবকে ব্যবহার করেই এবং কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি ও সি পি আই—এর ভীরুতা ও বিশ্বাসঘাতকতার ছোবল দিয়ে সুভাষচন্দ্রকে তাঁরা কাবু করে ফেলেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে কংগ্রেস থেকে তাড়াতে সমর্থ হয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্রের ব্যক্তিগত শত্রু ওল্ড গার্ডদের মধ্যে কেউ ছিলেন না, তৎপরবর্তী ঘটনার বিচারে একথা একান্তভাবে ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই ভুল বিচারের পরিণাম মহাত্মা গান্ধীকে হাড়ে হাড়ে অনুভব করতে হয়, ঘোর সাম্প্রাদায়িক পরিস্থিতিতে দেশ ভাগের সময়, তাঁকে কতকটা বাদ দিয়েই ইংরেজেদের সঙ্গে ওল্ড গার্ডদের সমঝোতার সময়। তখন সর্ববিষয় প্রায় নিঃসঙ্গ এই একক নেতা আর একবার সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গেলে কাকে কাকে সহায়কারী পাবেন তা খুঁজতে গিয়ে দেখলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হলে তাঁকে তখন কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করতে হবে। সেদিন নির্ভরযোগ্য কোন সাথী খুঁজে পাননি তিনি। এমনকি তখন disillusioned জয়প্রকাশ নারায়ণ, অরুণা আসফ আলি প্রভৃতির উপরে নির্ভর করেও আবার সংগ্রামের ডাক দেওয়া কিনা তাও সঙ্গোপনে বিচার করে দেখেছিলেন। কিন্তু কোথাও আশার আলো দেখতে পাননি। সেই নিঃস্ব দিনগুলিতে মহাত্মা গান্ধী একামাত্র সুভাষচন্দ্র বা জাপানে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নেতাজী সুভাষের উপর আবার নতুন করে একটা টান অনুভব করতেন। সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু সংবাদ তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাননি এবং সুভাষ মৃত, তিনি আর নেই, নিজের মৃত্যুকাল পর্যন্তও গান্ধীজী এ—কথা বিশ্বাস করে যাননি।
সুভাষচন্দ্র নিজে জানতেন, Nobody has done more harm to me personally and to our cause in this crisis than Pandit Nahru. If he had been with us–we would have a mojority. But he was with the old guard at Tripuri. His open propaganda against me has done me more harm than the activities of the 12 stalwarts. What a pity!’ (১৯৩৯ সালের ১৭ এপ্রিল জামাডোবা থেকে ইংল্যান্ডবাসী অমিয়নাথ বসুকে লেখা।) তাছাড়া ১৯৩৯ সালের ২৮ মার্চ জওহরলালকে তিনি একটি চিঠি লিখেছিলেন। তাঁর নিজের ভাষায় ও a brutally frank letter, প্রায় বিশ পৃষ্ঠার সেই দীর্ঘ চিঠির জবাব পণ্ডিত নেহরু কোনোদিনই দেননি। একেবারে চারপাশ থেকে পণ্ডিত নেহরুর সমালোচনা করে সুভাষচন্দ্র ঐ পত্রটি দিয়েছিলেন। জওহরলালের আন্তরিকতা ও ব্যক্তিগত মর্যাদাবোধ কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণমাত্র না করেও তিনি সোজাসুজি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘I should now invite you to clarify your policy and programme not in vague generalities but in realistic details. I should also like to know you are, scocialist or leftist or centrist or rightist or Gandhist or something else ?’ দুঃখের বিষয় পণ্ডিত নেহরু তারপর দীর্ঘকাল বেঁচে থাকলেও এবং দীর্ঘদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকলেও সুভাষচন্দ্রের ঐ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে পারেননি, তিনি শেষ পর্যন্ত কি ছিলেন!
৮। আমি বলতে চেষ্টা করেছি, মত ও পথের যত পার্থক্যই থাকুক, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে গান্ধীজী যদি সঙ্গী হিসেবে সুভাষচন্দ্রকেই বেছে নিতেন, পরবর্তীকালে ভারতের ইতিহাস তাহলে এমন বিয়োগান্তক নাও হতে পারতো। অথচ মত ও পথের ক্ষেত্রে দু’জনের মধ্যে নীতিগত পার্থক্য ছিল বিরাট। অহিংসার সঙ্গে realpolitik-এর মিলন কঠিন, অসম্ভব না হলেও Realpolitik-এর রীতিনীতিতে সশস্ত্র—নিরস্ত্র সহিংস—অহিংস সংগ্রামের অচ্ছুৎ সম্পর্ক থাকতে পারে না। সেখানে কোন ব্যাপারেই কোন জলঅচল ভাগ রাখা যায় না। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর গভীরতম মিশন ছিল পৃথিবীর সংগ্রামের একটা নতুন হাতিয়ার দেওয়া, অহিংসা, যে সংগ্রামের নাম অহিংস—সংগ্রাম। ভারতের স্বাধীনতা সম্বন্ধে তিনি উদাসীন ছিলেন এমন কখনই মনে করা যায় না। তবে তিনি আশা করতেন ভারতের স্বাধীনতা হয়তো ইংরেজদের সঙ্গে বোঝাপড়া করেও, বিনা সংগ্রামে পাওয়া যেতে পারে, তারা স্বাধীনতা দিতে বাধ্য করতে পারে নানা রকম অবস্থার চাপে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন, পৃথিবীতে শান্তির প্রতিষ্ঠা করা, মনুষ্যসভ্যতার যাত্রাপথে একটা নতুন মোড় সৃষ্টি করা, এসবই তাঁর স্বপ্নের ভারতের সাধনা। এখানে বা এক্ষেত্রে তিনি রাজনৈতিক নেতার চেয়ে অনেক বড়, তিনি প্রফেট। পলিটিশিয়ান বা স্টেটসম্যানকে সার্থক রাজনীতিক হতেই হবে কিন্তু একজন প্রফেটকে তাঁর নিজের সময়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়, নতুবা তাঁকে ক্রশবিদ্ধ করে মেরে ফেলা হয়। প্রফেটরা নিজ নিজ যুগে ফেল করবেনই। এই বিফলতা, এই ট্রাজেডির মধ্য দিয়ে তাঁদের জীবনের এমন একটা শাশ্বত মূল্য থেকে যায় যা ইতিহাস বা মানব সভ্যতার মেরুদণ্ড রচনায় সাহায্য করে, সর্বকালে, সর্বযুগে। একজন স্টেটসম্যান তাঁর সময়টুকুতে যা দেবার ছিল দিয়ে ফুরিয়ে যান। কিন্তু একজন প্রফেট, একজন সাধক, অনন্তকালের জন্য অফুরান সম্পদ দিয়েই দিয়েই যান। তাই প্রশ্ন করতে হয়: কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো।
আগের কথায় ফিরে আসি। একটা ছোট পয়েন্ট উল্লেখ করা দরকার। সুভাষচন্দ্রের ক্ষমাহীন ও আপসবিরোধী সংগ্রামের চাপে পড়ে দক্ষিণপন্থী বা গান্ধী—অনুগত কংগ্রেস কর্তৃপক্ষকেও শেষ পর্যন্ত আইন অমান্যের কথা বলতে হয়। তার জন্য স্থানে স্থানে সত্যাগ্রহ কমিটি গঠিত হতে থাকে, এমনকি ড্রিল পর্যন্ত শুরু হয়! কিন্তু সুভাষচন্দ্র জাতিকে হুঁশিয়ার করে দেন, কংগ্রেসের তরফ থেকে সংগ্রামী তোড়জোড় দেখেই যেন কেউ নিশ্চিন্ত না থাকেন। আবার একটা চৌরীচৌরা, হরিজন উদ্ধার বা গান্ধী—আরইন প্যাক্টের মত অজুহাতে যেন গান্ধীজী বা তাঁর অনুগামীরা সহসা সংগ্রাম বন্ধ করে দিতে না পারেন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এমনকি শেষকালে জয়প্রকাশ নারায়ণও সুভাষচন্দ্রের কাছে তাঁর শেষ পত্রে এ সম্ভাবনা আছে বলে স্বীকার করেন যে, সংগ্রাম চালু করে দিয়ে দক্ষিণপন্ধীরা ভিতরে ভিতরে সমঝোতার প্রয়াসও চালিয়ে যেতে পারে, সে সম্বন্ধে সাবধান থাকতে হবে।
রাজকোট প্রজা আন্দোলন ও সে উপলক্ষে গান্ধীজীর অনশন ইত্যাদি ব্যাপারে কংগ্রেস সভাপতি গান্ধীজীর অনশন পছন্দ করেননি। রাজকোটের ব্যাপারে বারবার অনশন, বড়লাটের হস্তক্ষেপ কামনা, ফেডারেল কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার মরিস গাওয়ারের মধ্যস্থতা স্বীকার সুভাষচন্দ্রের ভালো লাগেনি। রাজকোটের ব্যাপারে শেষপর্যন্ত গান্ধীজী বোকাই বনে গিয়েছিলেন বাল যায়। নিজের ভুল সংশোধন করতেও অবশেষে তাঁকে একবার অনশন করতে হয়। সুভাষচন্দ্রের প্রধান আপত্তি এই যে গান্ধীজী দেশের মধ্যে হিংসার বাতাবরণের যুক্তিতে দেশব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধ আন্দোলন করছেন না, দেশের মধ্যে তখন ছয় শতাধিক রাজারাজড়া ছিলেন, তাঁদের অধীনস্থ প্রজাদের নিয়ে সামরিক প্রজা আন্দোলন বন্ধ রেখেছেন, অথচ রাজকোটের রাজা ঠাকুর সাহেবের সঙ্গে লড়াই করতে লেগে গেলেন, সমগ্র দেশের তুলনায় ও সমস্ত প্রজা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যার একটা মাছির সমানও মূল্য হতে পারে না। তাছাড়া তাঁর এক চিঠিতে তিনি এ ব্যাপারে যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগটি উত্থাপন করেছিলেন, তা হল রাজকোটের প্রজাদের নিজস্ব দায়িত্ব পালনে তাদের বিরত রেখে গান্ধীজী একা কেন তাদের হয়ে লড়তে বা অনশন করে মরতে যাবেন? দেশের সর্বসাধারণের তাদের নিজেদের বোঝা নিজেরা যদি বহন করতে, নিজেদের স্বাধীনতা নিজেরা অর্জন করতে অগ্রসর না হয় তবে ব্যক্তিবিশেষ বা গান্ধীজীর একার সংগ্রামে তাদের কখনও সত্যিকার মুক্তি হতে পারে কি? সুভাষচন্দ্র বারবার বলেছেন যে দেশের আপামর জনসাধারণকে প্রত্যক্ষভাবে সংগ্রামে লিপ্ত করতে হবে, তাদের সংগ্রাম প্রধানত তাদেরই করতে হবে, তাদের হয়ে তাদের স্বরাজ গান্ধীজী বা কয়েকজন নেতা এনে দিতে পারেন না, তা করতে গেলে জনসাধারণকে জাগানোই হবে না, তাদের স্বার্থত্যাগ করতে ও শক্তি অর্জন করতে সাহায্য করবে না। তাতে দেশের ক্ষতিই হবে।
আপামর জনসাধারণকে সংগ্রামে লিপ্ত করতে গান্ধীজী কিছু করেননি একথা কিন্তু ঠিক নয়, বস্তুত ভারতকে গান্ধীজীর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক মূল্য বোধহয় এখানেই যে তিনি সর্বসাধারণকে এমনকি গ্রামের মেয়েদেরও সংগ্রামে টেনে এনেছিলেন। শেষ পর্যন্ত এই সংগ্রামের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কোথায় কতটা ভুল করেছিলেন সে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু তিনি দেশের লোককে সংগ্রামের বোঝা নিতে উদ্বুদ্ধ করেননি, এমন অভিযোগ করাই চলে না।
তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সহসা সবাইকে বাদ দিয়ে একাই তিনি মরণপণ অনশন করতে লেগেছিলেন। গোটা দেশ তাতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে, কিন্তু অপর কাউকে তিনি তাঁর অনশনের সমর্থনে ডাকেননি, দেশকে নীরব দর্শক হিসেবে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। বস্তুত কখনও কখনও দেখা গিয়েছে যে অতি সামান্য কারণেও হয়তো কোনো কারাসঙ্গীর প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরণ অনশন ঘোষণা করে বসেছেন, এবং নিজেই আবার বলেছেন যে তার কাছে কোন সংগ্রামটার প্রায়োরিটি বা অগ্রাধিকার বেশি, কোনটা অপেক্ষাকৃত কম প্রয়োজনীয়, এসব বিচার—টিচারের জ্ঞান তাঁর সবসময় থাকে না। ‘ইনার ভয়েস’—এর আদেশ তাঁর কাছে কখন কীভাবে উপস্থিত হবে তা যেন তিনি নিজেও বুঝতে পারেন না। তাঁর চলাফেরা মতিগতি তাই অনেকের কাছেই আনপ্রেডিকটিবল হয়েছিল, হয়তো নিজের কাছেও।
সুভাষচন্দ্র গান্ধীজীকে লিখেছিলেন পন্থ প্রস্তাবের মূল্য যদি স্বীকার করতে হয় তবে এবারে আপনার উচিত প্রত্যক্ষভাবে কংগ্রেসের চার আনা সদস্য হয়ে কংগ্রেসের দায়িত্ব পুরোপুরি হাতে নেওয়া। গান্ধীজী কংগ্রেসের চার আনার সদস্যও নন, কংগ্রেসের তিনি কেউ নন, তথাপি কংগ্রেসকে তার মতানুযায়ী চলতেত হবে এমনকি ওয়াকিং কমিটির সদস্য কে কে হবেন তারও তাঁরই মতামত নিয়ে করতে হবে। তাই যদি হয় তবে গান্ধীজী কংগ্রেসের সদস্য হয়ে তার পুরো দায়িত্ব হাতে নিন। কিন্তু গান্ধীজী তা নেবেন না, কংগ্রেসের দায়িত্ব ও রীতিনীতি পরিচালনা করার অধিকারও তিনি চান বা দাবি করেন না। অথচ কংগ্রেস সর্বদা তাঁরই মুখ চেয়ে বসে থাকবে। এ এক অসম্ভব পরিস্থিতি।
শুধু তাই নয়, কংগ্রেসের বাইরে বসেই কংগ্রেস ও দেশের উপর তিনি যেন এক একটা আন্দোলন ও সংগ্রামের দায়িত্ব চাপিয়ে দিতেন। কখন তিনি অনশন করে বসবেন তা কংগ্রেসের ওয়াকিং কমিটি বা সভাপতিরও সবসময় আগে জানার উপায় থাকত না, এ ব্যাপারে তিনি পরামর্শ করতেন না। আন্দোলন বন্ধ করে দেওয়াও যেন একমাত্র তিনি নিজেই নিজের খুশিমত করে দিতে পারতেন।
তাঁর অনশনের প্রকৃতি নানারকমের এবং আনপ্রেডিকটেবল, যা আগে থেকে বোঝার উপায় নেই। সুভাষচন্দ্র বলেছেন যে অনশনের তিনি বিরোধী নন, ব্যক্তিগত অনশনেরও নন, কিন্তু সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে মহাত্মা গান্ধীর মত ব্যক্তি সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্ব ও সীমার মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ ব্যক্তিমাত্র নন, তিনি যে কারণে হোক সমগ্র জাতির প্রতিভূ, জাতির পিতা। জাতির পিতার পক্ষে যখন তখন যা তা করা বা ঘোষণা করে দেওয়ার অধিকার কি এতই স্বাধীনভাবে খাটানো যায়? সমগ্র জাতির বোঝা তাঁকে একা বহন করারও অভিমান রাখা উচিত নয়। ব্যক্তিগত অনশন যথার্থ বলে মেনে নেওয়া চলে যেখানে তা গণজাগরণ ও গণসংগ্রামের জন্য প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া মহাত্মা গান্ধী জাতির এমন একটা সম্পদ যাঁকে সহজে হারানো দেশের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই নিজর জীবন নিয়ে অমন ঘন ঘন ঝুঁকি নেবার অধিকার তাঁর হয়তো নেই। মহাত্মা কেন তাঁর এই জাতীয় দায়িত্বের কথা ভুলে যান যেখানে তাঁর জীবন সমস্ত দেশের মানুষের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ? দেশের সকল শ্রেণির কংগ্রেসের ভিতরকার সব দল—উপদলেরই আস্থা আছে একমাত্র গান্ধীজীর উপর একমাত্র তিনি দেশকে একত্রিত রাখতে পারেন। তাই তাঁর পক্ষে কোনোরকম ঝোঁক বা পক্ষপাতিত্ব নেওয়া উচিত নয়। ‘If for any reason that confidence is shaken which God forbid and you and regarded as partisan, then God help us and the Congress.’
গান্ধীজীর জীবনের মূল্য অথবা রাজনৈতিক দলাদলির ক্ষেত্রে তাঁর নিরপেক্ষ ভাবমূর্তিকে বিপন্ন করার বিরুদ্ধে সুভাষচন্দ্র যেসব কথা গান্ধীজীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন তার তাৎপর্য গান্ধীজী বুঝতেন না তা নয়। তবে তিনি বলেছেন, ‘My prestige does not count. It has an independent value of its own. When my motive is suspected or my policy or programme rejected by the country, the prestige must go. India will rise and fall by the quality of the sum total of her many millions. Individuals, however high they may be, are of no account except in so far as they represent the many millions, therefore let us rule it out of consideration.
গান্ধীজী ও সুভাষচন্দ্র—দুজনের মধ্যে কোথাও খুব গভীর একটা টান ছিল গান্ধীজী তাঁকে প্রত্যেক পত্রে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, রাজনৈতিক দিক থেকে তাঁর এবং তাঁর দাদা শরৎচন্দ্র বসুর সঙ্গে গান্ধীজীর যত পার্থক্যই থাকুক, যত মতান্তরই থাকুক, কোন অবস্থাতেই তা মনান্তরে পরিণত হবে না। প্রত্যেক চিঠিতেই বাপুর ভালবাসা, রুগ্ন সুভাষচন্দ্রকে নিজের হাতে সেবাযত্ন করার ইচ্ছা তিনি বারবার প্রকাশ করেছেন। সুভাষচন্দ্রও তাঁকে প্রত্যক পত্রে ব্যক্তিগতভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাতে ভুল করেননি।
এতৎ সত্ত্বেও দুজনের মধ্যে মত ও পথের পার্থক্য কিছুতেই দূর করা গেল না। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা বা উদ্যমে দুই বিরোধী মত—পথের মিল কোথায় হতে পারে পারে গান্ধীজী তা বুঝতে পারেননি। কিন্তু সুভাষচন্দ্র বারবার বলেছেন, যদি আবার ইংরেজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করেন গান্ধীজী, তাহলে তিনি সব ভুলে মহাত্মার অনুগত একজন সৈনিক হিসাবে সব কিছু এমনকি প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত। তাঁর সহকর্মীরাও তখন গান্ধীজীর পথে অগ্রসর হতে দ্বিধা করবেন না। সুভাষচন্দ্রের এই আত্মসমপর্ণের সেদিন একটিই মাত্র শর্ত ছিল, তা হল অবিলম্বে চরমপত্র দিয়ে দেশব্যাপী সংগ্রামের প্রস্তুতিতে লাগা এবং সব রকম আপোসপন্থা বা আপোসের মোহ পরিত্যাগ করা। কিন্তু গান্ধীজী দেখাচ্ছেন দেশে প্রচ্ছন্ন হিংসার বাতাবরণ রয়েছে, শুধু সংগ্রামের কৌশলের ব্যাপারে নয় ভবিষ্যৎ জাতি গঠনের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা রচনা নিয়েও পার্থক্য রয়েছে। বলা বাহুল্য, সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীনই তাঁর নেতৃত্বে ভারতের প্ল্যানিং কমিটি তৈরি হয়। শিল্পায়নের পথেই ভারতের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের প্রয়োজন স্বীকার করা হয়। পণ্ডিত নেহেরুকে তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গান্ধীজী ও কট্টর গান্ধীবাদীরা মনে করেছিলেন সুভাষচন্দ্রের এই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কুটিরশিল্প খদি ও গ্রামস্বরাজের পরিপন্থী চিন্তা। অতএব রাজনৈতিক সংগ্রামের কলাকৌশলের ক্ষেত্রেই শুরু হয়, ভবিষ্যৎ ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনর্গঠনের ক্ষেত্রেও সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর দুস্তর ব্যবধান আছে বলে গান্ধীজী ও তাঁর অনুগামীরা মনে করেছিলেন। কিন্তু ভারত স্বাধীন হবার হর পণ্ডিত নেহরুর নেতৃত্বে দেশের অর্থনৈতিক ব্যাপারে প্ল্যানিং কমিশন প্রায় স্ট্যাটুটারি মর্যাদা পেয়ে এসেছে। পাশ্চাত্য ও সোবিয়েত ধাঁচের শিল্পায়নের পথে ভারতের এক ধরনের ‘বিকাশ’ ঘটেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ধরনের বিকাশ ভারতের সত্যিই ভাল করেছে কিনা, ভারতকে অর্থনৈতিক ও (শেষ পর্যন্ত) রাজনৈতিক দিক থেকেও পরনির্ভর করেছে কিনা সে প্রশ্ন আজ উঠেছে, বিকল্প পথের অনুসন্ধানও চলেছে, গান্ধীবাদী পথও গ্রাহ্য হচ্ছে না। সে অনেক কথা, অনেক বিতর্ক, কিন্তু তার মূল ঐদিন সূক্ষ্মভাবে উপস্থিত হয়েছিল। একথা বলা যায় মহাত্মা গান্ধীর অর্থনৈতিক স্বপ্ন যেমন ব্যর্থ হয়েছে বা ব্যর্থ করা হয়েছে তেমনি সুভাষচন্দ্রও আজ থাকলে প্ল্যানিং কমিশনের কীর্তিকলাপ কোন চক্ষে দেখতে কে জানে? আমরা বলতে পারি ঘটনা স্রোতে এই দুই মহানায়কই ঠিক কাজ করেছিলেন, আবার ভুল কাজও করেছিলেন।
৯। তবু ক্ষেত্রবিশেষেও কি দুজনে স্বেচ্ছায় মিলিত হতে পারতেন না? গান্ধীজী মনে করতেন যে তা পারা যায় না, কিন্তু সুভাষচন্দ্র মনে করতেন নিশ্চয়ই পারা যায় ও যেত। এবং এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে ১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্রই ঠিক ছিলেন, গান্ধীজীরই ভুল ছিল। এই যে ১৯৩৯, ১৯৪০—৪১ সালে আন্দোলন শুরু করার ব্যাপারে এত সব নীতিগত শর্ত পালনের উপর জোর দিয়েছিলেন গান্ধীজী, ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তাঁর কোন শর্তটা প্রতিপালিত হয়েছিল? তখন তিনি কোন যুক্তিতে leave us to god and Anarchy বলে, ”করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে” বলে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে আদেশ দিয়েছিলেন? তখন কোথায় ছিল তাঁর দেশের মধ্যে অবিমিশ্র অহিংসার বাতাবরণ বা কংগ্রেসের মধ্যে দুনীর্তি অবসানের শর্ত? ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে তিন বছরে ভারতের সামরিক অবস্থার কী পরিবর্তন হয়েছিল? সুভাষবিহীন ভারতবর্ষ গান্ধীজীর সর্বাত্মক বিপ্লব ঘোষণার পক্ষে কতটুকু তৈরি হয়েছিল? বরং বলা যায় গান্ধীজীর পক্ষে ও কংগ্রেসের পক্ষে অবস্থাটা তখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, কিছু না করলেই যেন নয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাঁদের সম্পূর্ণভাবে নিরাশ করেছে, এদিকে জাপান থেকে নতুন আগ্রাসনের বিপদ দেখা দিয়েছে, দেশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ছায়া, ভারতকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে ফেলেছে, ইংরেজ। মুসলিম লীগের দাবিদাওয়া আরও বেশি জোরদার হচ্ছে, যুদ্ধে ব্রিটিশদের হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে এবং পরাজিত ইংল্যান্ডের পক্ষে ভারতকে কিছু দেবার ক্ষমতা থাকাও সম্ভব নয়, চতুর্দিকের এহেন উপায়ান্তরহীন পরিস্থিতিতেই গান্ধীজী তখন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দেন। তবে ডাক দিয়েও গান্ধীজী তক্ষুণি লড়াই ঘোষণা করেননি, বড়লাটের সঙ্গে শেষ কথা বলার অবসর খুঁজেছিলেন। কিন্তু বড়লাট সসৈন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন বিদ্রোহবাভাপন্ন ভারতের উপর।
১৯৩৯ সালে সুভাষচন্দ্র যখন ভারত সরকারকে চরমপত্র দিয়ে কংগ্রেস ও গান্ধীজীকে সংগ্রামী পথে অগ্রসর হতে বলেছিলেন, তখন তাঁরা নিজেদের সুবিধামত পরিস্থিতিতে নিজেদের শর্ত অনুযায়ী পরিকল্পিত ও সংগঠিত উপায়ে লড়তে পারতেন। কিন্তু ১৯৪২ সালে না ছিল সেই সংগঠন, না ছিল সেই প্রস্তুতি, না ছিল সুস্পষ্ট দৃঢ় নেতৃত্ব অথচ ইংরেজ ও সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহ তখন অনেক বেশি সংগঠিত। সুভাষচন্দ্র তাঁর এক পত্রে একথাও বলেছিলেন যে, শত্রুর সঙ্গে লড়াইতে সময় ও সুবিধার বিচারও করতে হবে, নিজেদের সুবিধামত আমরা সংগ্রাম ঘোষণা করব, না শত্রুপক্ষ আমাদের উপরে একটা সংগ্রাম চাপিয়ে দেবে, এ প্রশ্ন প্রত্যেক স্ট্র্যাটেজিস্টকে প্রত্যেক জেনারেলকে বিচার করে দেখতেই হবে। ১৯৪২ সালে সর্বাত্মক সংগ্রামের ডাকটা সময়োচিত হয়েছিল, না ঠিক মুহূর্তটা আগেই পার হতে গিয়েছিল, তার বিচার করার এখন সময় হয়েছে। মনে রাখা দরকার, ১৯৪২ সালের সংগ্রাম ব্যর্থ ও পরাজিত হয়েছিল। আজাদ হিন্দ বাহিনীর কার্যকলাপ ও নৌ—বিদ্রোহ দিয়েই সম্ভব হয়েছিল ভারতের সংগ্রামী চেতনার পুনরুদ্ধার, যার পরিণামে মিলে ছিল ভারতের তথাকথিত স্বাধীনতা, যার স্বাদ মহাত্মা গান্ধী ও অসংখ্য নিরপরাধ জীবন্মৃত নরনারীর কাছে অত্যন্ত তিক্ত হয়েছিল, যে—তিক্ততা আজও দূর হয়নি।
১০। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪১ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র দক্ষিণপন্থীদের শান্তিতে থাকতে দেননি। শেষবারের মত গান্ধীজীর সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি ১৯৪০ সালের ২৩ ডিসেম্বরে লেখা চিঠিতে। অথচ সে সময় তিনি জেলখানায় অনশন করার পর এলগিন রোডের বাড়িতে এসেছেন এবং দেশ থেকে পালাবার আয়োজন করেছেন। জবাবে মহাত্মা প্রথমেই তাঁকে একটা কমিপ্লমেন্ট দেন এই বলে ‘you are irrespressible whether ill or well.’ সুভাষচন্দ্র বসু একজন অদ্বিতীয় অদম্য নেতাই শুধু ছিলেন না, গান্ধীজীর কাছে এই একটিই মাত্র ব্যক্তি সেদিন ভারতে ছিলেন যিনি তাঁর প্রকৃত বিরোধিতা করার সাহস ও শক্তি রাখতেন। আর সবাই ছিলেন গান্ধীজীর ছায়া মাত্র। বাংলা কংগ্রেস এবং তাঁর ও শরৎচন্দ্র বসুর উপর থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করার জন্য সুভাষচন্দ্র মহাত্মাকে লিখেছিলেন চিঠি। ২৯ ডিসেম্বর তার জবাবেই গান্ধীজী ঐ কথা দিয়ে শুরু করে জানান ‘I have not been in consultation with Moulana Sahib’ (অর্থাৎ সুভাষচন্দ্র, শরৎচন্দ্র ও বাংলা কংগ্রেসের উপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা জারি করার আগে তৎকালীন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মৌলানা আজাদ বা তাঁর ওয়ার্কিং কমিটি গান্ধীজীর মতামত নেননি। এই খবরটা পাওয়া গেল এবং গান্ধীজীর সঙ্গে মৌলানা কতটা পরামর্শ করে চলতেন তাও বোঝা গেল। নেতারা তখন এক একটা ঘটনা ঘটিয়ে ‘গান্ধীজীকি জয়’ বলে সব শুদ্ধ করে নিতেন।) তারপরই গান্ধী লিখেছেন ‘But when I read in the paper about the decision I could not help approving of it. I am surprised that you won’t distinguish between discipline and indiscipline.’
হায়, কংগ্রেসের মধ্যে শৃঙ্খলা বা ডিসিপ্লিন রক্ষার উদ্বেগ। এই কংগ্রেসেরই ভিতরকার দূনীর্তি ও বোগাস মেম্বারশিপের অজুহাতে গান্ধীজী সুভাষচন্দ্রের ডাকে সত্যাগ্রহ জাতীয় আন্দোলন শুরু করতে নারাজ ছিলেন। আবার ১৯৪৮ সালে মৃত্যুর অল্পদিন আগে মহাত্মা গান্ধীই কংগ্রেসকে একদম ভেঙ্গে দিতে বলেছিলেন, যা বলা যায় তাঁর লাস্ট টেস্টামেন্ট। কংগ্রেসকে তিনি অরাজনৈতিক লোকসেবক সঙ্ঘে পরিণত করতে বলেছিলেন নিজের সঙ্গীসাথীদের। সুভাষচন্দ্র যখন ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করতে বাধ্য হন, তখন তিনি কংগ্রেসের একজন মহাভক্ত, তখনও তিনি কংগ্রেসের আরও লক্ষ লক্ষ লোক টানতে হবে বলে নির্দেশ দিচ্ছিলেন তাঁর বন্ধুবান্ধবদের এবং কংগ্রেসের কোনো ক্ষতি করতেই তিনি রাজি হননি। ডিসিপ্লিন ভাঙতে তিনিও তো রাজি ছিলেন না। কিন্তু হায় গান্ধীজী, হায় সুভাষচন্দ্র, উভয়কেই শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসকেই একটা দুর্গন্ধযুক্ত প্রতিষ্ঠান মনে করে তাকে পরিত্যাগ করার নির্দেশ দিতে হয় দেশবাসীকে। ইতিহাসের কী নিষ্ঠুর পরিহাস।
গান্ধীজী সুভাষচন্দ্রকে সেই চিঠিতে লিখছেন, But I quite agree with you, either of you is more than a match for the Moulana Sahib as far as popularity is concerned. But a man has to put conscience before popularity. I know that in Bengal it is difficult to function effectively without you two. I know too that you can carry on even without congress. But the Congress has to manage somehow under the severe handicap.
……As for your Bloc joining C.D. (civil disobedience) I think with fundamental differences between you and me, it is not possible. Till one of us is concerted to the other’s veiw, we must sail in different boats though their destination may appear to be the same.
Meanwhile let us love one another remaining members of the same family that we are. Yours, Bapu
এটাই সুভাষচন্দ্রের কাছে গান্ধীজীর লেখা শেষ পত্র। জীবনে আর তাঁরা মিলতে পারেননি। কিন্তু দুজনের শোচনীয় মৃত্যুর পর একটা মিলনভূমি দেখতে পাই, যদিও তা এক বৃহৎ ও মহতী সর্বনাশের পরে। ১৯৩৯ সালে বা ১৯৪০ সালে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তিনি হাত মেলাতে পারেননি। কিন্তু ১৯৪২ সালে তো কেউ অচ্ছুৎ ছিলেন না। Man proposes but God disposes এর মত এই দুই ব্যক্তি যা ভাবতেন যা চাইতেন, তা সব মুছে দিয়ে ইতিহাস সবাইকে তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার বাইরে ঘাড় ধরে ঠেলে নিয়ে যায়। যার জন্য বলা হয় সাবজেকটিভ ফোর্সের চেয়ে অবজেকটিভ ফোর্সের শক্তি কয়েক গুণ বেশি। তবে একথা ইতিহাস মনে রাখবে যে সুভাষচন্দ্রের দিক থেকে মহাত্মাগান্ধীর দিকে হাত প্রসারিত করে রাখার চেষ্টা কখনই ক্লান্ত হয়নি, এমনকি টোকিওতে পৌঁছে আজাদ হিন্দ বাহিনী গড়ে যুদ্ধে নামার পরেও। সেদিক থেকে সুভাষচন্দ্রের দূরদৃষ্টি মহাত্মার চেয়ে কম ছিল না বলেই মনে হয়।
১১। জনৈক জৈন মুনি গান্ধীজী সম্পর্কে বলেছিলেন যে কোনও পরিস্থিতিতে সত্য ও অহিংসার মধ্যে যদি একটা বিরোধ দেখা যায়, তাহলে গান্ধীজী সত্যের খাতিরে অহিংসাকে ত্যাগ করতে পারেন। যদি কখনও কোন পরিস্থিতিতে দেখা যায় যে গান্ধীজীর হাতে, যে অহিংসার অস্ত্র আছে তার দ্বারা সত্যের মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছে না, তখন সত্যকে বড় বলে মেনে নিয়ে অংহিসার ক্ষেত্রে অতো rigidity (রিজিডিটি) পরিত্যাগ করা সম্ভব।
এক্ষেত্রে গান্ধীজীর সত্য ও অহিংসার সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের real politic-এর বিরোধ ১৯৩৯ সালে প্রকটভাবে একটা সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। গান্ধীজীর সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের মতবিরোধ এবং তা থেকে সুভাষচন্দ্রের কংগ্রেস ত্যাগ এবং পরে দেশত্যাগ করে প্রথমে জার্মানি এবং পরে জাপানে গিয়ে আজাদহিন্দ বাহিনী নিয়ে ভারতকে মুক্ত করার অভিযানের নীতিগত তাৎপর্য বিচারের একটা মস্তবড় ক্ষেত্র আছে।
গান্ধীচরিত্র ও কার্যকলাপের জটিলতার অন্ত নেই। কোথায় যে ব্যক্তিটির আরম্ভ কোথায় তার শেষ, তাঁর দৃষ্টিতে কোথায় যে সংগঠনের দায় আর কোথায় যে ব্যক্তির দায়দায়িত্বের ভূমিকা, সে—সব সাধারণ নিয়মে বোঝা বা রীতিনীতিবদ্ধ নিয়মাবলীতে দাঁড় করানো সম্ভব নয়। তাঁকে দেখে বা তাঁর অনুসরণ করে অপর কোনো ব্যক্তি বা নেতা যদি চলতে চান তবে তা সম্ভব, যদি না মহাত্মা গান্ধীর মতই তিনিও আর এক অসাধারণ ব্যক্তি হন। এই অনন্য ব্যক্তিটিকে কী করে সাধারণ মাপের লোকের মধ্যে খাপ খাওয়ানো যাবে? তাঁর অনুকরণ করতে গেলে তাই তা হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়, এমনকি তা বিপরীত ফলপ্রসূও হয়ে যেতে পারে। গান্ধীজী সত্যিকার অর্থে এমন সব আগুন নিয়ে খেলা করতে চেষ্টা করেছেন যে আগুন, বিশেষ করে ব্যক্তিগত জীবনের গভীর খাতে প্রবাহিত সেই লাভাকে হয়তো হাওয়া না দেওয়াই উচিত ছিল, অনেকে বলবেন। সত্যকে নিয়ে তাঁর অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার (একসপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ) ফলাফল চূড়ান্তরূপে প্রমাণিত হয়ে যায়নি। অহিংসার ক্ষেত্রেও, বিশেষ করে সবলের অহিংসার প্রকৃত তাৎপর্য ও স্বরূপ তিনি দেখিয়ে যেতে পারেননি। তাঁর ফিলসফিকাল অ্যানার্কিজম—এ, সংগঠনের দায়দায়িত্ব অস্বীকার করার ক্ষেত্রে বহু জটিলতার সমাধান—সূত্র তিনি বের করতে পারেননি। নিজের চার আনা দামের সদস্য না থেকেও দেশের ও পৃথিবীর একটি অন্যতম বিশাল সংগঠনের দায়দায়িত্ব বহন করার যুক্তিটা তা কী ছিল, তা পরিষ্কার হয়নি। তথাপি তিনি বলে গেছেন অহিংসা ও অন্যান্য সত্যসন্ধানের ক্ষেত্রে তিনি ফেল করলেও একথা প্রমাণ হয় না যে অহিংসার ও সত্যের পরাজয় হল। বলেছেন তিনি নিজে দুর্বল ও অক্ষম বলে পরাস্ত হয়েছেন, কিন্তু তাই বলে অহিংসা ও সত্যের পরাজয় হয়নি, হতে পারে না। তাঁর চেয়ে শক্তিমান মানুষেরা একদিন এসে সেইসব শাশ্বত মূল্যবোধের অধিকতর সার্থকতা দেখাবেন। এ সম্পর্কে সন্দেহ করা মানেই তাঁর সত্য—ভগবানকে অস্বীকার করা।
কিন্তু শেষ কথাটি তবে কী দাঁড়াল? গান্ধী না সুভাষ কে বেশি সত্যের কাছাকাছি? হিংসারই জয় হল না অহিংসার? বলা যায় হিংসারও জয় হয়নি, অহিংসাও নয়। কোনোটারই সত্যাসত্য চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হল না। কেবল বোধ হয় একটু বলা যায়, হিংসা অহিংসা সত্যাসত্য এসবই আপেক্ষিক তাৎপর্যপূর্ণ। এরা পরস্পর বিরুদ্ধ বলে মনে হলেও মহাকালের পরিপ্রেক্ষিতে তত বিরুদ্ধধর্মী নয়। হিংসা যাঁর প্রকাশ অহিংসাও তাঁরই প্রকাশ। Monism ছেড়ে Pluralism বিশ্বদর্শনের বিচারে টেঁকে না। সেখানে মৃত্যুও জীবনেরই বাহন, ‘মরণ বলে আমি তোমার জীবন তরী বাই’। শেষ তাহলে কোথায়? ঋষি কবির গানের কলিটা দিয়েই শেষ করি ‘শেষ নাহি যার, শেষ কথা কে বলবে?