গান্ধীজী – অতুলচন্দ্র গুপ্ত

গান্ধীজী – অতুলচন্দ্র গুপ্ত

স্বীকার করতে হবে বাংলাদেশ তার সমস্ত অন্তর দিয়ে গান্ধীজীর শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি। মহাত্মার চরিত্রের উত্তুঙ্গ মহত্ত্ব, তাঁর অলৌকিক বীর্য ও মৈত্রীর কাছে অন্য সকলের মতো বাঙালি মাথা নুইয়েছে। মানুষের ও তার সামাজিক জীবনের যে আদর্শ মহাত্মার জীবনের কর্মে ও কথায় পরিস্ফুট তার ডাকে বাঙালি অনেকবার বড় রকম সাড়া দিয়েছে। কিন্তু সে আদর্শের কল্পনা তার মনকে কানায় কানায় ভরে দেয়নি। বিচিত্র জীবনের পরিপূর্ণতার যে আদর্শে বাঙালি তার স্বাদ পায়নি। ও আদর্শের আহ্বান উপেক্ষা করা যে কাপুরুষতা বাঙালি মর্মে তা উপলব্ধি করেছে। কিন্তু সে আহ্বান কর্তব্যের আহ্বান, বহুমুখী জীবনের বর্ণগন্ধময় অহৈতুক আনন্দের আকর্ষণ নয়।

যাঁরা বলবেন গান্ধীজী কাজের লোক, কর্মমহাযোগী, প্রকৃত কর্মীর মতো উদ্দিষ্ট লক্ষ্যের যা উপায় তাতে তাঁর একাগ্র মন নিবন্ধ, তার যা অবান্তর সে চিন্তায় তিনি চিত্তের বিক্ষেপ ঘটাননি, তাঁরা মহাত্মার কাজকে দেখেছেন অত্যন্ত বাইরে থেকে, তার মর্মকথা উপলব্ধি করেননি। সন্দেহ নেই গান্ধীজী মহাকর্মযোগী; তাঁর জীবনব্যাপী বহু বিচিত্র কর্মের অপ্রমত্ত অনুষ্ঠানের তুলনা পাওয়া যায় না। কিন্তু তাঁর সকল কর্মের এক লক্ষ্য মানুষ, ব্যক্তিগত মানুষ। মহাত্মার রাষ্ট্রনীতি সমাজচিন্তা ধনতন্ত্র শিক্ষাতত্ত্ব সব—কিছুতে এক মাপকাঠি; মানুষের, ব্যক্তিগত মানুষের, চরিত্রের উপর কোন ব্যবস্থার কী ফল ফলবে তাই দিয়ে সকল ব্যবস্থার বিচার যে ব্যবস্থা চরিত্রের আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করবে মনে হয়েছে তাকে তিনি নির্মম হয়ে বর্জন করেছেন, যতই আশুফলপ্রদ সে ব্যবস্থা হোক—না কেন। মানুষের প্রয়োজনে আধুনিক বিজ্ঞানের অনেক প্রয়োগের যে তিনি বিরোধী ছিলেন তার মূল এইখানে। সে প্রয়োগে মানুষের দারিদ্র্য কিছু কমবে, যে মানুষকে তিনি অসীম ভালবাসতেন তার দুঃখকষ্টের কিছু লাঘব হবে সে তিনি অবশ্য জানতেন। কিন্তু চরিত্রের অমৃতকে যা আবিল করে তা থেকে বঞ্চিত করাই যে প্রিয়জনকে বাঁচানো সে সম্বন্ধে তাঁর চিত্ত দৃঢ় ছিল। বৃহৎ রাষ্ট্র—আন্দোলন আরম্ভ করে তিনি মধ্যপথে থামিয়ে দিয়েছেন, যখনই দেখেছেন তাঁর ডাকে যারা আন্দোলনে যোগ দিয়েছে তাদের চরিত্রের উপর ফল হচ্ছে অমনুষ্যোচিত। বলেছেন, তাঁর ভুল হয়েছিল, পর্বতপ্রমাণ ভুল। ভুল আর কিছু নয়; মানুষের চরিত্রের উপর যে ভরসা তিনি রেখেছিলেন মানুষ তার উপযুক্ত হতে পারেনি। তাদের সকল ত্রুটি তিনি নিজের ত্রুটি বলে স্বীকার করেছেন। ফললোভী কোন কর্মীমাত্রের এমন সাধ্য ও সাহস হবে?

যে রাষ্ট্রনায়কদের বলে ‘পলিটিশ্যান’, তাঁদের সঙ্গে মহাত্মার রাষ্ট্রনেতৃত্বের প্রভেদ এইজন্য একেবারে মূলগত। তাঁদের কথা বলছি না—রাষ্ট্রের কাজ আর হিত যাঁদের উপায় ও উপলক্ষ, আসলে নিজের উন্নতি ও প্রতিপত্তিই প্রধান লক্ষ্য, ইংরেজিতে যাদের নাম ‘কেরিয়ারিস্ট’; সেই পলিটিশ্যানদের কথাই বলছি—নিজের কাজ দিয়ে রাষ্ট্রে মঙ্গল করতে পারবেন বিশ্বাসেই যাঁরা রাষ্ট্রীই ক্ষমতা ও প্রভাব কামনা ও অনুসরণ করেন। অবশ্য মানুষের জটিল মনোবৃত্তিতে রাষ্ট্রের হিত ও নিজের প্রতিপত্তি অনেক সময় জ্ঞানে ও অজ্ঞানে অভেদে মিশে যায়। কিন্তু তাঁরা প্রকৃত পলিটিশ্যান তাঁদের কাছে নিজের প্রতিপত্তি মোটের উপর গৌণ, সকল রাষ্ট্রীয় কর্মোদ্যমের উপায়মাত্র। যেসব বিধিব্যবস্থা রাষ্ট্র ও সমাজের মঙ্গলকর মনে করেন সেসকল বিধিব্যবস্থা রাষ্ট্রে প্রবর্তনের চেষ্টা করেন পলিটিশ্যানেরা। এ চেষ্টায় তাঁরা ধরে নেন যে, সাধারণ মানুষের, অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষের চরিত্রের যা মৌলিক গড়ন তা ওই রকমই থাকবে, অন্তত বর্তমানে ও নিকট ভবিষ্যতে। অত্যন্ত মিশ্র গড়ন; ভালমন্দ, ঔদার্য—নীচতা, দয়া—নিষ্ঠুরতা, সাহস—ভীরুতা, বুদ্ধি—নির্বুদ্ধির বর্ণসংকর। বিশেষ বিপন্মুক্তি কি ভাবের উত্তেজনায় এ চরিত্রের সাময়িক পরিবর্তন ঘটে। যা বড় তা প্রকট ও ক্রিয়াশীল হয়, যা ছোট তা চাপা থাকে। অবস্থার যোগাযোগে দেশের মানুষের মন যখন এর অনুকূল হয় তখন পলিটিশ্যানেরা এর সুযোগ নেন প্রয়োজনসিদ্ধির তাগিদে, এ আনুকুল্যকে প্রসার ও তীক্ষ্নতা দেন বাগবিভূতির মহা অস্ত্রে। তাঁরা জানেন চোখের জল আর বুকের রক্ত দাবি করলে ভয় না পেয়ে লোকে তখন উৎসাহ পাবে; দশের জন্য নিজেকে বলি দেওয়া মনে হবে অতি স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁরা এ—ও জানেন এ পরিবর্তন সাময়িক। উৎকট প্রয়োজনের টানে এর আকস্মিক আবির্ভাব। সে টান শিথিল হইে মূল প্রকৃতি নেমে যাবে তার বিমিশ্র সাম্যাবস্থায়। বরং উত্তেজনার অবসাদে সাধারণ স্তর থেকেও কিছুকালের জন্য নেমে যাবে একটু বেশি নীচে। নীচতা নির্বুদ্ধি ভীরুতা স্বার্থাল্পতা কিছুদিনের জন্য স্বাভাবিকের চেয়েও প্রবল থাকবে। মানুষের এই প্রকৃতির স্থায়ী পরিবর্তন ঘটাবার চেষ্টা করা পলিটিশ্যানদের কাজ নয়। এঁদের মধ্যে যাঁরা যথার্থ বড় তাঁরা সম্ভবত ভরসা করেন যে, তাঁদের প্রবর্তিত রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধের ফলে তাঁদের কালে দেশের বেশির ভাগ লোকের চরিত্রের শ্রেষ্ঠ অংশগুলি বিকাশের যা সব বাধা আছে, আর্থিক রাষ্ট্রিক সামাজিক বাধা, তা কতকটা দূর হবে। বোধ্য ও দুর্বোধ্য কারণে যেসব মানুষের চরিত্রে স্থায়ী কাম্য পরিবর্তন আসে তারা শক্তি প্রয়োগের পথ পাবে। এমনধারা গৌণ উপায়েই পলিটিশ্যানেরা চরিত্রের স্থায়ী পরিবর্তনের চেষ্টা করতে পারেন। সোজাসুজি সে চেষ্টা তাঁদের ক্ষমতার বাইরে। একসঙ্গে পলিটিশ্যান ও চরিত্র সংস্কারকের কাজ কেবল দুঃসাধ্য নয়, তার ফল যে ভাল হয় না ইতিহাসে তার নজির আছে।

পলিটিশ্যানের এই পলিটিকস আর গান্ধীজীর পলিটিকস দুয়ের প্রস্থানভূমি ভিন্ন গান্ধীজীর পলিটিকসে চারপাশের আগাছা—জঙ্গল কেটে গাছকে বাড়বার সুযোগ দেওয়া, গাছকে বড় করার উপায় নয়। গাছের গোড়ায় এমন সার দিতে হবে, শিকড়কে রস টানার জন্য এমন শক্তিমান করতে হবে, যাতে গাছ আপনি বেড়ে উঠবে, আর তার ঘন ডালপালার আওতায় আগাছার ঝাড় শুকিয়ে মরবে। মানুষের চরিত্রবিকাশের চেষ্টায় অনুকূল পারিপার্শ্বিকে সামাজিক ও মানসিক কারণের জটিল কার্যকারিতার ধীর গতিতে ভরসা রাখা গান্ধীজীর কর্মনীতি নয়। গান্ধীজী চেয়েছেন, মানুষকে এমন প্রভাবের মধ্যে আনতে যার শক্তিতেই তার চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্ব বিকশিত হয়ে উঠবে, পারিপার্শ্বিককে প্রায় উপেক্ষা করে। আর এ পরিবর্তন আসবে দ্রুত। কোনও কোনও মানুষের জীবনেও ও চরিত্রে যেমন হঠাৎ পরিবর্তন দেখা যায়, পাপী হয় সাধু, সাংসারিক হয় উদাসীন ভক্ত। তবে এ পরিবর্তন হবে ব্যাপক; দু’—একটি অসাধারণ মানুষের জীবনে ঘটবে না, বহু সাধারণ মানুষের জীবনে ও চরিত্রে দেখা দেবে। পারিপার্শ্বিককে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা অবশ্য সম্ভব নয়, কিন্তু এ ফল ফলাতে তার যে পরিবর্তন প্রয়োজন তার পরিমাণ সামান্য। এবং বিকশিতচরিত্র মানুষ নিজের চেষ্টাতেই পারিপার্শ্বিকে এমন পরিবর্তন আনবে যা চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্বের অনুকূল, শ্রেষ্ঠত্বকে স্থায়ী রাখার উপযোগী। পলিটিশ্যানেরা যে ব্যাপক ও আকস্মিক পরিবর্তনকে কাজে লাগান ও পরিবর্তন সেরকমের নয়। কারণ এ পরিবর্তন হবে স্থায়ী, কোনও বিশেষ কার্যসিদ্ধির সুযোগ ও উপায় নয়, সকল কাজের লক্ষ্য ও ফল।

নানা দেশের বহু ধর্মপ্রবর্তক মানুষের চরিত্রে এমনধারা স্থায়ী পরিবর্তন আনতে চেয়েছেন, তাঁদের ধর্মোপদেশে ধর্মজীবনের আদর্শে লোককে আকৃষ্ট করে। সে উপদেশ ও আকর্ষণে লোকে সাড়া দিয়েছে। চরিত্রে পরিবর্তন এসেছে; কোথাও স্থায়ী ও গভীর, কোথাও চঞ্চল ও বাহ্যিক। কিন্তু এ—উপদেশ ও আদর্শের লক্ষ্য মানুষের সমগ্র জীবন নয়, জীবনের একটা দিক, যাকে বলা হয় আধ্যাত্মিক বা ‘স্পিরিচুয়াল’। রাষ্ট্রিক ও সামাজিক পরিবেশ এবং তাদের ধনতান্ত্রিক কাঠামো স্বীকার করে তার মধ্যেই মহত্তর ও বিশুদ্ধ জীবনের দিকে এ আদর্শের আহ্বান। এর কোনও আদর্শ ঐহিক ও আধ্যাত্মিক, লৌকিক ও লোকাতীতের মধ্যে গভীর ভেদরেখা টেনেছে। যা রাষ্ট্রের তার দাবি রাষ্ট্রকে মিটিয়ে দাও, যা ভগবানের তা দাও ভগবানকে। যিশুর চরিতলেখকেরা তাঁর মুখের এই উপদেশে ওই প্রভেদের বাণীই প্রচার করেছেন। কোনও আদর্শ অনুসরণ বা সাংসারিক জীবন যাপন করেও মনকে তা থেকে মুক্ত রেখে অসাংসারিক আধ্যাত্মিক প্রেরণা দিয়েছে। পরমহংসদেবের পাঁকাল মাছের দৃষ্টান্ত, কাদায় বাস করেও গায়ে কাদা না লাগা, আমাদের দেশে প্রসিদ্ধ। এসব আদর্শ মানুষের সামাজিক জীবনকে চরম মূল্য দেয় না। সে জীবনকে হয় এড়িয়ে নয় মাড়িয়ে চলতে হবে, তাকে পাশ কেটে প্রকৃত জীবনে পৌঁছতে হবে, অথবা তার আকর্ষণকে জয়ের চেষ্টায় আধ্যাত্মিক জীবনের মেরুদণ্ডকে সবল করাই হবে তার সার্থকতা। সেইজন্য ধর্মোপদেষ্টারা সামাজিক ব্যবস্থাকে ভেঙে গড়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। সে ব্যবস্থা যেরকম হোক সংসারের পাঁক তাতে থাকবেই। তাকে নির্মল করার বিফল চেষ্টা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। জীবনের সমগ্রতায় প্রসার নেই বলে যদি এ—আদর্শকে বলতে হয় অসম্যকদর্শী, তবে এ—ও স্বীকার করতে হবে যে, এক লক্ষ্যে এর একান্ত নিবদ্ধদৃষ্টি, এর পথের ঋজু সংকীর্ণতাই একে প্রচণ্ড শক্তি ও নিত্যতা দিয়েছে। রাষ্ট্রিক সামাজিক ও আর্থিক পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্যে এ আদর্শ স্থির নিষ্কম্প থাকে, ভাঙাগড়ার প্রলয় ও সৃষ্টির আবর্তনে মানুষকে টেনে রাখে। অনেক লোক আছে এই আদর্শের ডাকেই যারা বড় সাড়া দেয়। সমাজ শরীরের তারাই লবণ, পচন থেকে রক্ষা করাই তাদের কাজ।

এর ব্যতিক্রম আছে। এমন ধর্ম ও ধর্মমত আছে যা কেবল আধ্যাত্মিক জীবনকেই জাগাতে ও গড়তে চায় না, মানুষের সমগ্র জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রিত করতে চায়; রাষ্ট্র ও সমাজকে করতে চায় নিজের কুক্ষিগত, বিশেষ ধর্মমতের আদর্শের অনুকূল বিধিনিষেধে এদের বেঁধে দিয়ে। রোমান চার্চের অনুসৃত খ্রিস্টধর্ম এর পরিচিত উদাহরণ। এ ধর্মসংঘে এমন বহু সাধক জন্মেছেন, আধ্যাত্মিক জীবন ছাড়া কোনও কিছুতে যাঁরা দৃষ্টি দেননি। কিন্তু এ সংঘের যারা গুরু তাঁরা বলেছেন, ধর্ম যখন সকলের উপরে তখন রাষ্ট্র ও সমাজ হবে তার অধীন; ধর্মের অনুশাসনে এদের চলতে হবে। রাজা হবে সংঘের আজ্ঞাবহ, আর ধর্ম হবে রাজ্যশাসনে রাজার সহায়। ঐহিক রাজদণ্ডের ভয় পারত্রিক যমদণ্ডের ভয়ে দুর্বার হবে। ধর্মের এই একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ক্যাথলিক সংঘের ধর্মগুরুরা ইউরোপের রাজাদের বিরুদ্ধে অনেক লড়াই লড়েছেন। কখনও প্রকাণ্ড জিত হয়েছে, কখনও প্রকাণ্ড হার। শেষ পর্যন্ত ইউরোপের দেশে দেশে জাতীয়—রাজ্যের অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রের শক্তিবৃদ্ধিতে, আর ধর্মের অনুশাসন লঙ্ঘনে পারলৌকিক দণ্ডের বিশ্বাসহ্রাসে এ চেষ্টার চরম পরাজয় ঘটেছে। ইতিহাস সাক্ষী দেয় ধর্ম ও রাষ্ট্রের এই সমন্বয়চেষ্টায় ধার্মিকদের মনে আধ্যাত্মিক জীবনের আকর্ষণের চেয়ে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণের কূটনৈতিক উৎসাহ শতগুণ প্রবল ছিল। আধ্যাত্মিকতা বেঁচে ছিল তাঁদের অবল্বন করে যাঁরা সংঘচক্র এড়িয়ে সাধকের একনিষ্ঠ জীবন যাপন করতেন। ইউরোপের জাতির সঙ্গে জাতির সংঘর্ষের নিদারুণতায় সে—মহাদেশের অনেক ভাবুক আজ ধর্মের অভিভাবকতায় এক ধর্মরাষ্ট্রের প্রাচীন আদর্শের দিকে লুব্ধ চোখে তাকাচ্ছেন। যিশুর উপদেশ যা—ই হোক, রোমান সংঘ চেয়েছিল রাষ্ট্রকে ধর্মের কাজে লাগাতে; এরা চাচ্ছেন ধর্মকে রাষ্ট্রের কাজে লাগাতে। ফল ভিন্ন হবার কারণ নেই।

ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ার আদর্শ ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মের চেয়ে অনেক বেশি সফল হয়েছিল হজরত মহম্মদের প্রবর্তিত ইসলামধর্মে। রোমান পদ্ধতি ছিল রাজাকে ধর্মসংঘ ও ধর্মগুরুর শাসনে আনা। আরব পদ্ধতিতে রাজা ও ধর্মগুরু এক লোক। পদ্ধতির ভিন্নতার কারণ ঐতিহাসিক। ক্যাথলিক ধর্মগুরু ও নেতারা তাঁদের ধর্ম প্রচার করেছিলেন অখ্রিস্টান রাজাদের অখ্রিস্টান রাষ্ট্রের লোকের মধ্যে। তত্ত্ব হিসাবে তাঁদের বলতে হয়েছে তাঁদের ধর্মরাজ্য এ পৃথিবীর নয়, লোকাতীত স্বর্গলোকের, সেইজন্যই পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের উপর তার আধিপত্য। ইসলামরাষ্ট্র আরম্ভ হয়েছিল ইসলামধর্মের দিগ্বিজয়ে। সত্যধর্ম প্রচারের জন্যই রাজ্যজয়। পুরাতন রাজব্যবস্থা লোপ করে ইসলামরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। ধর্মপ্রবর্তক মহম্মদ একধারে ছিলেন ইসলাম ধর্মগুরু, ইসলামসেনার সেনাপতি, ইসলাম—রাষ্ট্রের রাজা। ধর্ম—অভিযানের উত্তেজনার পিছনে আর্থিক ও রাষ্ট্রিক প্রেরণা অবশ্যই ছিল। কিন্তু সত্যধর্ম প্রচারের আবেগও ছিল প্রকট ও প্রবল। মহম্মদের মৃত্যুর পরও এই প্রথম বেগ যতদিন অব্যাহত ছিল নেতার ত্রিনেতৃত্বও ততদিন ছিল বাস্তব সত্য। কালক্রমে যখন ভাটা এল তখন স্বভাবতই এই একনেতৃত্ব হয়েছিল প্রাণহীন অবাস্তব; তবুও মুসলিম রাষ্ট্রের ভিত্তির অনস্বীকার্য তত্ত্বরূপে টিকে থাকল। ফলে মুসলমান জনসাধারণের রাষ্ট্র যে মুসলিম অনস্বীকার্য তত্ত্বরূপে টিকে থাকল। ফলে মুসলমান জনসাধারণের রাষ্ট্র যে মুসলিম ধর্মসমাজের সঙ্গে একাঙ্গ মুসলান রাষ্ট্রের রাজবিধি চলবে মুসলিম ধর্মবিশ্বাস ও আচারের পথ ধরে, এ ধারণার মূল বিচলিত হয়নি। মুসলমান রাষ্ট্রগুলির ইতিহাসে দেখা যায় যে—যুগে ওর কোনও রাষ্ট্র ও সমাজ সর্বমানবীয় সভ্যতার ধারণায় স্মরণীয় কিছু করেছে সে যুগে রাষ্ট্র ও ধর্মের একাঙ্গতত্ত্বের ব্যাবহারিক প্রয়োগ ছিল শিথিল। সে যুগে বিশুদ্ধ সনাতনতত্ত্বের নামে ওদের সম্বন্ধকে অচ্ছেদ্য করার চেষ্টা হয়েছে সে যুগে রাষ্ট্র নিজেকে ও অন্যকে শুধু পীড়ন করেছে; সভ্যতার ভাণ্ডারে শূন্য অঙ্কের বেশি কিছু দান করতে পারেনি।

বাহ্যদৃষ্টিতে মনে হতে পারে গান্ধীজী যে রামরাজ্যের কথা বলেছেন তা এই ক্যাথলিক ও মুসলিম আদর্শের সগোত্র। একটু সাবধানে দেখলেই সে দৃষ্টিবিভ্রম দূর হয়, ভুল ধরা পড়ে। ধর্মের অনুশাসনে রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের খ্রিস্টান কি মুসলমান আদর্শে ধর্ম কতকগুলি বিশেষ বিশ্বাস ও তার অনুবর্তী আচারের সঙ্গে প্রকাশ্য ও নিগূঢ় যোগে যুক্ত। সে বিশ্বাস ও আচারে যাদের আস্থা নেই রাষ্ট্রের ভিতরে থেকেও তারা থাকবে বাইরের লোক। ধর্মের নির্দেশ তাদের অন্তরের বাণী না হয়ে হবে বাহ্যিক বাধানিষেধের কাঁটাবেড়া। এ কাঠামোর মধ্যে উদার মুক্ত মানবতাকে দাঁড় করানো যায় না; দার্শনিক তত্ত্বের ও আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার ঠেকা দিয়েও নয়। বেশি টানাটানিতে কাঠামোই ভেঙে যাবে, যা থাকবে তাতে খ্রিস্টত্ব ও মুসলিমত্বের অবশেষ পাওয়া যাবে না। গান্ধীজী রাষ্ট্রব্যাপারে যে ধর্মের কথা বলেছেন সে হচ্ছে বিশেষ ধর্মবিশ্বাসনিরপেক্ষ চারিত্রিক আধ্যত্মিকতা। তিনি বলেছেন, সকল ধর্মবিশ্বাসকে সমান ভক্তি করতে। তার এক অর্থ প্রতি ধর্মমতের যা ঐকান্তিক বিশেষ তাকে অবান্তর জ্ঞানে তাদের মধ্যে যে সর্বধর্মসাধারণ আধ্যাত্মিকতা ও মানবতা নিহিত আছে তাকেই ধর্ম করা। এদের ধর্মবিশেষের কোনও বিশেষত্ব থাকে না। সেইজন্য গান্ধীজী তাঁর প্রার্থনাসভায় যখন কোরান থেকে বচন পড়িয়েছেন তখন অনেক মুসলমান তাতে খুশি হননি এবং অনেক হিন্দু আপত্তি তুলেছেন। ধর্মের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা আছে, কিন্তু ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা এক বস্তু নয়। যাঁরা ধর্মবিশেষের নিষ্ঠাবান ধার্মিক তাঁরা আধ্যাত্মিকতাকে নমস্কার করেন, কিন্তু ধর্মের আচার—বিশ্বাসময় দেহকেই ধর্ম বলে মানেন।

যে আ্যাত্মিকতায় প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রসমাজের আদর্শকে গান্ধীজী রামরাজা বলেছেন সে আধ্যাত্মিকতা সাধকের আত্মোপলব্ধির আধ্যাত্মিকতা নয়। ঊর্ধ্ব থেকে দৈবশক্তির অবতারণে অতি—মানুষের অধ্যাত্মিক সমাজের যে কল্পনা, সে আধ্যাত্মিকতা নয়। পরিচিত সমাজের সাধারণ মানুষকে নিয়ে গান্ধীজীর চেষ্টা ও চিন্তা। এই মানুষের জীবন ও চরিত্রের এক আদর্শ গান্ধীজীর মনে ছিল। তাঁর সকল কাজের চরম লক্ষ্য মানুষকে এই আদর্শে পৌঁছে দেওয়া। রাষ্ট্রের বিধি, সমাজের গড়ন, ধন উৎপাদন ও বণ্টনের কৌশল এই লক্ষ্যের পথকে সুগম করার ও চারিত্রিক আদর্শকে স্থায়ী করার উপায়। শিক্ষার লক্ষ্য এই চরিত্র গড়া। সেইজন্য উপায় ও উদ্দেশ্যের প্রভেদকল্পনা গান্ধীজী করেননি। যে কাজের ধারা চরিত্রের আদর্শকে ক্ষুণ্ণ করে, শীঘ্র ও সহজে উদ্দেশ্যসিদ্ধির আগ্রহে সে উপায়ের উপদেশ তিনি কখনও করতেন না। এ ছিল তাঁর কাছে বিধেয় মতন পরিত্যাজা। সিদ্ধির মহত্ত্ব সাধনের উপায়কে শোধন করবে তাঁর আছে এ কথার অর্থ ছিল না। কারণ, সিদ্ধির বাইরের কোনও কিছুর লাভ নয়। মানুষের চরিত্রকে গড়ে তোলাই সকল সাধনার সিদ্ধি। যা উপায় তার চেষ্টাই এ চরিত্র গড়ে। উপায়ের প্রত্যেক পদক্ষেপ কেবল উদ্দেশ্যের দিকে এগিয়ে নেয় না, উপায়ের মধ্যেই উদ্দেশ্যকে লাভ করে।

গান্ধীজী মানুষের যে আদর্শচরিত্রের কল্পনা করেছেন তার মধ্যে জটিলতা নেই। মানুষের মনে থাকবে মৈত্রী সকল মানুষের উপর। সেইজন্য সে হবে অহিংস ও অক্রোধ। তার জীবনযাত্রা হবে সরল, উপকরণবাহুল্যশূন্য; অন্যের শ্রমের উপর যত সম্ভব কম যাতে নির্ভর করতে হয়। নিজের শরীরযাত্রার অনেক উপাদান সে নিজেই তৈরি করবে, কারণ প্রতিদান না দিয়ে পরের শ্রমের ফল সে আত্মসাৎ করবে না। যে জন্য সে হবে নিরলস। সমাজ ও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার জটিলতায় এই দান—প্রতিদানের পরিমাণের তুলনা করা দুরূহ। সেজন্য ও ব্যবস্থাকে সরল করার প্রয়োজন, নিজের অল্পের বিনিময়ে অপরের অনেক যাতে আত্মসাৎ না করতে হয়। মানুষ হবে সত্যাগ্রহী, অসত্য ও অন্যায় সে আশ্রয় করবে না, নিজের স্বার্থে কি দশের স্বার্থে। অন্যের অসত্য ও অন্যায় আচারও সহ্য করবে না, ভয়ে কি উপেক্ষায়; নির্ভীক বীর্যে তার প্রতিরোধ করবে। সমাজের শত্রুজ্ঞানে ক্রোধে আঘাত দিয়ে নয়; সে আচারের সঙ্গে অসহযোগ করে, মৈত্রীতে ক্রুদ্ধের ক্রোধকে জয় করে, অলোভে লোভীর লোভকে লজ্জা দিয়ে; প্রয়োজন হলে নিজের প্রাণকে বিসর্জন করে। এমন চরিত্রের মানুষের সমাজেরই সাম্য আনতে পারে; যে সমাজে হিংসা ক্রোধ অসুয়া নেই। কেবল ধনের উৎপাদন ও বাটোয়ার কৌশলে সে সামা লাভ নয়।

মৃদুণি কুসুমাদপি তবুও বজ্রাদপি কঠোর এ মনকে কবি কল্পনা করেছেন লোকোত্তর মহাপুরুষদের দুর্জ্ঞেয় চরিত্র বলে। গান্ধীজী একে কল্পনা করেছেন সাধারণ মানুষের চরিত্রের আদর্শরূপে। সাধারণ মানুষের জীবনে এ আদর্শ বাস্তব হবে কোন উপায়ে? মানবসমাজের ক্রমবিকাশে ভরসা রেখে সুদূর ভবিষ্যবংশীয়দের জীবনে এক বাস্তবতা কল্পনা নিরাসক্ত বিজ্ঞানীর চিন্তাভঙ্গি, কর্মীর মনোভাব নয়। সাধারণ মানুষের জীবনে এই চরিত্র বিকাশের জন্য তাকে আবাল্য বিশেষ ও শিক্ষা ও পরিবেশের মদ্যে রাখার উপদেশও গান্ধীজী করেননি।রবীন্দ্রনাথকে এক চিঠিতে গান্ধীজী লিখেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন না যে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে মহত্ত্ব আছে উপযুক্ত ডাকেও তা সাড়া দেবে না। মানুষের এই মৌলিক সহত্ব স্বার্থের তুচ্ছতায়, ঈর্ষাদ্বেষের জড়তায় আচ্ছন্ন থাকে। ডাকের মতো ডাক শুনলেই সমস্ত হীনতা কাটিয়ে সে জেগে ওঠে, মানুষের মহৎ চরিত অম্লান ঔজ্জ্বল্যে প্রকাশ হয়। সাধারণ মানুষকে আদর্শ চরিত্রের প্রতিষ্ঠার গান্ধীজীর এই পন্থা। কর্মের যাত্রাপথে এ ডাক গান্ধীজী অনেকবার দিয়েছেন। যাদের ডেকেছেন কখনও তারা অদ্ভুত সাড়া দিয়েছে, লোকে বলেছে অলৌকিক ঘটনা ঘটল। কখনও তারা সাড়া দেয়নি। যখন সাড়া পেয়েছেন তখন বলেছেন, মানুষের মনুষ্যত্বের গুণ; যখন সাড়া আসেনি মহাত্মা বলেছেন তাঁর নিজের দোষ; যে মনে তিনি ডেকেছেন তার বিশুদ্ধিতে খাদ ছিল। মানুষের উপর মহাপুরুষের এই মহাবিশ্বাস হল সেই শক্তি যে শক্তি পর্বতের স্থাণুত্বকে বিচলিত করে। মানুষ্যত্বের যেখানে জয় হয়েছে ইতিহাসের গভীরে ছিল এই শক্তির ব্যঞ্জনা।

মানুষের প্রকৃতিতে বড়—ছোট ভাল—মন্দর দ্বৈত এমন প্রকট যে প্রাচীন কাল থেকে তত্ত্বজ্ঞেরা নানা রূপকে এ তথ্যকে বর্ণনা করেছেন—দেবাসুরের সংগ্রাম, আলো—অন্ধকারের বিরোধ, নিত্যানিত্যের দ্বন্দ্ব। নিজের প্রবৃত্তির অন্তরের উপর শুভকে জয়ী করার নানা কৌশল ও পথ জ্ঞানীরা উপদেশ করেছেন। একজন জ্ঞানী বলেছেন, বুদ্ধির বিশ্লেষণে শুভ ও অশুভের স্বরূপের জ্ঞান হলেই মানুষ অশুভকে দমন করে চিন্তায় ও চরিত্রে শুভকে প্রতিষ্ঠা করবে। সুতরাং শুভের সাধনা এই বিবেক—জ্ঞানের সাধনা। অন্য জ্ঞানীরা বলেছেন, এ উপদেশের ভিত্তি মানুষের মূল প্রকৃতির এক ভ্রান্ত ধারণা। ধর্ম কি তা জানলেই মানুষের তাতে প্রবৃত্তি হয় না, অর্ধ কি তা জানে তবুও তা থেকে নিবৃত্তি নেই। তার হৃদিস্থিত হৃষিকেশ যে পথে চালান সে সেই পথে চলে। প্রাচীনেরা বলেছেন সে হচ্ছে ভগবৎকৃপা, যা না হলে স্বভাব—শুচিতা কিছুতে আসে না। সে কৃপার জন্য একাগ্র ভক্তিতে তাঁর প্রার্থনা করতে হবে। নবীনেরা বলেন, মনের অতিগহনে চেতনার অবচেতনে রাগ—বিতৃষ্ণা আকাঙ্ক্ষা—প্রবৃত্তির যে আলোড়ন চলছে সেই হৃদিস্থিত হৃষিকেশ মানুষের প্রকৃতিকে আকার দেয় সে সেই আকার নেয়। জন্ম থেকে শৈশবের, জন্মপূর্ব থেকে বংশের পূর্বতনদের অনুভূতি চুইয়ে এই অতলে জমা হয়েছে। বাষ্পের মতো এদের পরিচ্ছিন্ন আকার নেই, রুদ্ধ বাষ্পের মতোই এদের শক্তি। যেদিকে মানুষকে টানে, সচেতন চেষ্টায় তার ভিন্নমুখে চলা দুরূহ, হয়তো অসম্ভব। বাইরের চাপ, সমাজ ও রাজার ভয় পরলোকে দুর্গগতির আশঙ্কা বাহ্যিক কার্যকলাপ অনেকটা নিয়ন্ত্রিত রাখে কিন্তু মূল প্রকৃতি অশোধিত থেকে যায়। চাপ ও বিশ্বাস শিথিল হলেই সেই প্রকৃতি চরিত্রে প্রকাশ হয়। অন্যের বলেন, মানুষের প্রকৃতির বলবৎ দৃঢ় হীনতার উপর তার মহত্ত্বের স্থায়ী প্রতিষ্ঠা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজন এই হীনপ্রকৃতিকে নিগ্রহের যা—কিছু প্রবৃত্তিকে সেই নিচু দিকে টানে তার উপর বৈরাগ্যের অভ্যাস। কিন্তু কেন মানুষ এই বিগ্রহ—বৈরাগ্য—অভ্যাসের কৃচ্ছসাধনায় রত হবে? কষ্টলভ্য শ্রেয়ের আকর্ষণে, আর কিছুর নয়। মোট লাভক্ষতি হিসাবের পাটোয়ারিবুদ্ধি মানুষের প্রকৃতিতে বদলায় না, এ—লোকের লাভক্ষতিও নয়, পরলোকের লাভক্ষতিও নয়। চরিত্রের শ্রেষ্ঠত্বের আদর্শ যখন মানুষকে আকর্ষণ করে ফললাভে লোভে নয়, স্বে মহিম্নি, তখনই মূল প্রকৃতির পরিবর্তন আরম্ভ হয়; মানুষের প্রকৃতি নবজন্ম লাভ করে দ্বিজকে উপনীত হয়। হীনতার আকর্ষণকে জয় করার কৃচ্ছ্রকে আর কৃচ্ছ্রমনে হয় না।

যে উপযুক্ত ডাকে মানুষের অন্তরতর মনুষ্যত্বে সাড়া দেবেই, গান্ধীজী বিশ্বাস করতেন, তা এই চরিত্রের আদর্শের আহ্বান। এ আদর্শ কোন পথে মনে পৌঁছলে মনকে সাড়া দেয়, মূল প্রকৃতিতে পরিবর্তন আনে? গান্ধীজী চরিত্রের যে আদর্শ কল্পনা করেছেন তা অচিন্তিতপূর্ব নূতন নয়। কিন্তু এ আদর্শ মানুষের অন্তরে প্রতিষ্ঠা করে তার চরিত্র পরিবর্তনের যে উপায় তিনি অনুসরণ করেছিলেন তা নূতন। সে উপায় হচ্ছে নিজের জীবনে সে আদর্শচরিত্রকে মূর্ত করা। স্বভাবতই বেশির ভাগ লোক বলবে এর মধ্যে নূতন কিছুই নেই। সকল ধর্ম ও নীতি প্রবর্তক মহাপুরুষেরা এই উপায়ই অনুসরণ করেছেন। তাঁদের জীবন ও ব্যক্তিত্বের আকর্ষণেই লোক আকৃষ্ট হয়েছে; তাঁদের ঘিরে শিষ্যসেবক সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখায়’, ‘Imitation of Christ’–এসব মহাপুরুষ মানুষের জীবনের অন্তস্তলে পরিবর্তন এনে তাকে নবজীবন দিতে চেয়েছেন তাঁরা সমাজে, বিশেষ করে রাষ্ট্রে, সে জীবনের প্রকাশকে কখনও বড় মূল্য দেননি। হয় এদের উপেক্ষা করেছেন, না হয় অপরিহার্য পরিবেশ বলে অল্প কিছুটা স্বীকার করেছেন। অন্তরটাই মূলতত্ত্ব, বাহিরটা অবশ্য আছে কিন্তু তার সঙ্গে যোগ যত কম ততই ভাল। গান্ধীজী তার জীবনে কর্মে ও বাক্যে এ দ্বৈত স্বীকার করেননি।

সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনের সঙ্গে নিঃসম্পর্ক একক ধ্যানের আসনে মানুষের জীবনাদর্শ তাঁর কল্পিত আদর্শ নয়। এরকম ধ্যানের আসনে তিনি অনেক বসেছেন, হয়তো প্রতিদিন বসতেন। কিন্তু সে উপবেশন মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে নেমে এসে দৃঢ়পায়ে দাঁড়াবার প্রস্থানভূমি। মানুষের চরিত্রের পরিবর্তন তার সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্র ও চেহারার বদল ঘটাবে না এমন পরিবর্তনকে তিনি বিশ্বাস করতেন না। অথচ মানুষের চরিত্রের পরিবর্তন রাষ্ট্র ও সমাজের পরিবর্তনের উপায়মাত্র, এ কথা তিনি নিশ্চয়ই মানতেন না। যেসব মহাপুরুষ মানুষের অন্তরের মহত্বকে তার বাহ্যিক কর্মের চেয়ে বড় দেখেছেন গান্ধীজী যে তাদের অগোত্র তাতে সন্দেহের অবসর নেই। ধর্মরাজ্যস্থাপয়িতা মহম্মদের সঙ্গে নয়, যে খ্রিস্ট বলেছিলেন তাঁর রাজ্য পৃথিবীর নয় তাঁর সঙ্গেই যে গান্ধীজীই সাজাত্য অতিক্ষীণদৃষ্টি লোকেরও তা চোখ এড়ায়নি। গান্ধীজী যে—মন নিয়ে জন্মেছিলেন সে—মন মানুষের ভবদুঃখত্রাতা পরমকারুণিক মহাপুরুষের মন। কিন্তু তাকে তিনি প্রয়োগ ও প্রকাশ করেছিলেন সমাজ ও রাষ্ট্রের ছোটবড় শতকর্মে। তাঁর কল্পিত আদর্শচরিত্রের মানুষ নিজের চরিত্রকে এমনি করেই প্রকাশ করেই প্রকাশ ও প্রমাণ করবে সেই আদর্শই গান্ধীজী তাঁর জীবনে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। সমাজের, বিশেষ রাষ্ট্রের, কর্মীর যে কাজ তা বহু লোকের মধ্যে কাজ ও বহু লোককে নিয়ে কাজ। এই জনসংঘের ক্ষুদ্র স্বার্থ ও সংকীর্ণ মনের পঙ্কিলতা মেনে নিয়ে তার সঙ্গে আপস করে কাজের সফলতার চেষ্টা অনেক কর্মীর কর্মপন্থা। সেই হচ্ছে তাদের মতে বাস্তব পথ, সফলতার সদুপায়। এ পথের কাদা যে কর্মীদের গায়ে কিছু লাগবে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেজন্য বেশি ব্যস্ত হবার প্রয়োজন নেই। গন্তব্য স্থির থাকলেই হল। পথ যেমন হোক, লক্ষ্যে পৌঁছনো নিয়ে কথা। কিছু গুণ ও অনেক দোষে সাধারণ মানুষের চরিত্র গড়া। তাদের নিয়ে কাজ শুচি বাই পথের বাধা। যে অল্প কর্মী এ আপসে রাজি নন, সাধারণ মানুষের চরিত্রকেই যাঁরা বদলাতে চান, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাজ মানুষের কল্যাণে তাঁদের কাজের ক্ষেত্র কি না তাতে অনেকের সংশয় আছে। মানুষ তার নিজের স্তরে এঁদের টেনে নামাতে চেষ্টা করবে, যদি না পারে একদিন তাঁদের ছেঁটে ফেলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে। গান্ধীজীর হত্যার পর ইংরেজ লেখক অলডাস হাক্সলি এ সংশয় প্রকাশ করেছেন। বার্নাড শ রহস্যের আবরণে এই কথাই বলেছেন, ‘দেখ, বেশি ভাল হওয়ার কি বিপদ।’ গান্ধীজী অবশ্য বলতেন, মর্ত্যকে যা অমর্ত্য না করে সে অমৃত দিয়ে তিনি কি করবেন।

ভারতবর্ষের মুক্তি—আন্দোলনে যখন গান্ধীজীর পথ ও মতের প্রভাব হয়ে উঠেছিল তখন বালগঙ্গাধর তিলক বলেছিলেন, রাষ্ট্রকর্মে মহাত্মার প্রয়োজন নয়, প্রয়োজন ‘মেজরিটি’র রাষ্ট্রনীতিবেত্তার কথা। কিন্তু ভারতবর্ষ রাষ্ট্রসংকটের মহাসন্ধিক্ষণে এক মহাত্মাকেই রাষ্ট্রসংগ্রামের নেতা স্বীকার করেছিল। ফল সে পেয়েছে। অন্য ফল যদি থাকে ভোগ করতে হবে। কবি বলেছেন, সৃষ্টির কেবল শুভকেই জন্ম দেবে, দোষ কিছু মিশে থাকবে না এমন দেখা যায় না।

এইজন্য গান্ধীজীর চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ হয়েছিল রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্মের বহুধা বৈচিত্র্যের মধ্যে। তাঁর চরিত্রের ভাব ও শক্তির যা কেন্দ্র—সকল মানুষের উপর বাক্য—কায় মনে অহিংসা ও মৈত্রী, বিন্দুমাত্র অসত্য ও অন্যায়কে বৃহৎ কাম্যফললাভের প্রয়োজনেও অস্বীকার—তাঁর বড়—ছোট সকল কাজেই প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু তাঁর উদ্দিষ্ট কর্ম কোন পথ নেবে তাঁরা অন্তরঙ্গ শিষ্যরাও পূর্ব থেকে তা প্রায় অনুমান করতে পারতেন না। এর দুই কারণ। তাঁর মনের গভীরে অহিংসা ও সত্যের যে পরশমণি ছিল তার পরীক্ষায় কোনটা সোনা আর কোনটা লোহা প্রমাণ হবে তাঁর শিষ্যেরা তা জানতেন না। কারণ সে পরশমণি তাঁদের মনে ছিল না, থাকার কথা নয়। তাঁর মহাত্মা গান্ধী নন, অনুসরণকারী মাত্র। দ্বিতীয় কারণ, গান্ধীজীর কোনও কর্মপ্রচেষ্টা কেবল হৃদয়বৃত্তি থেকে উৎসারিত স্রোতের মতো নিজের বেগে নিজের পথ কেটে চলত না, অনন্যসাধারণ এক কর্মকুশলী বুদ্ধি তাঁর উদ্দেশ্যের উপায় উদ্ভাবন করত। বহু কর্মের আরম্ভে তাঁর উপদিষ্ট উপায় বহুজনের সংশয় জাগিয়েছে; কর্মশেষে তার সফলতা সকলকে বিস্মিত করেছে। ভুল হয়নি তা নয়, কিন্তু অভ্রান্তির তুলনায় তার পরিমাণ সামান্য। আর সে ভুল সর্বপ্রথমে ও অকপটে গান্ধীজীই স্বীকার করেছেন। রাষ্ট্রীয় কর্মে এই বুদ্ধির নৈপুণ্যে অনেকে, বিশেষ ভারতবর্ষের বাইরে আমাদের ভূতপর্ব রাজার জাতির জাতির অনেক বুদ্ধিমান লোকে বলেছেন যে গান্ধীজী মূলত ক্ষুরবুদ্ধি পলিটিশ্যান, তার মহাত্মতা বা ‘সেন্টলিনেস’ বহিরঙ্গ—পূর্বদেশের জনসাধারণকে নিজের পলিটিক্যাল কর্মপন্থায় আকর্ষণের উপায়। যে সকল মহাপুরুষ মানুষের সাংসারিক ব্যাপারে উপদেশ করেননি তাঁদের অনেকের গভীর বাস্তববুদ্ধি প্রসিদ্ধ। বাস্তবে অসম্যকদৃষ্টি শুদ্ধচিত মহাত্মার ভক্ত ও ধার্মিক হন, মহাপুরুষ হন না। গান্ধীজী একাধারেই সেন্ট ও পলিটিশ্যান ছিলেন। ওর কোনটাই বহিরঙ্গ নয়। কেবল তাঁর তীক্ষ্ন বাস্তববুদ্ধি মানুষের এমন সব প্রয়োজনে প্রয়োগ করেছিলেন সেন্টরা সচররাচর যা করেন না। আর সে বুদ্ধির অনন্যসাধারণতার মূলে ওই সেন্টলিনেস। যাতে মনের অতিগহনের রাগদ্বেষ সে বুদ্ধিকে বিকৃত কি ম্লান করে না। কোনও মমত্বের টান তার সরল পথকে বেঁকে দেয় না, কোনও মোহের কুয়াশা দৃষ্টির বিভ্রম ঘটায় না।

সেইজন্য মনে বিস্ময় লাগে আজ যখন গান্ধীজীর মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্য—সহচরেরা দেশের লোককে ক্রমাগত বলেন, এই কাজের এই পথ, কারণ গান্ধীজীর অভিপ্রেত পথ। তিনি বেঁচে থাকলে এই পথের উপদেশই তোমাদের দিতেন। গান্ধীজীর কর্মপথের যেগুলি মূলসূত্র তা তাঁর নিকটশিষ্যেরা যেমন জানেন, বাইরের লোকেও তেমনি জানে। তার মধ্যে গুহ্য ও গুরুগম্য কিছু নেই। কিন্তু সেই মূলসূত্রের প্রয়োগে কোনও ব্যাপক ও জটিল রাষ্ট্রকর্মের পথ গান্ধীজীর অলৌকিক মৈত্রী ও অনাবিল বুদ্ধিবিশুদ্ধ মনে যা উদয় হয়েছে তাঁর শিষ্যদেরও ঠিক তাই হয়েছে গান্ধীজীর জীবনকালে এমন ঘটনা ঘটেনি। পথ তিনিই আবিষ্কার করতেন, নির্দেশ তিনিই দিতেন। শিষ্য—সেবকরা তা শিরোধার্য করতেন, প্রচার করতেন, অনুসরণ করতেন; অনেকে বুঝে, অনেকে না বুঝে। তাঁর মতামতকে যে তাঁর শিষ্যেরা বিনাবিচারে মেনে নিচ্ছেন সে সম্বন্ধে গান্ধীজী সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। এর বিরুদ্ধে তিনি উপদেশ অনেক দিয়েছেন। বিশেষ ফল হয়নি। তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের কাছে সাধারণ ঐতিহাসিক—মানে যাঁরা বড় পলিটিক্যাল কর্মী ও নেতা তাঁরাও অসম্ভব খাটো হয়ে যেতেন, অন্যের চোখে ও নিজের মনে। কারণ গান্ধীজী ঐতিহাসিক—মনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী পলিটিক্যাল নেতা ছিলেন ন। জন—গণ—মনের উপর তাঁর যে অধিকার তার মূল হিমালয়ের মতো তার চারিত্রিক মহত্ত্ব, আকাশের মতো তাঁর উদার মন। যাতে দেশের পণ্ডিত মূর্খ সকলেই মর্মে জেনেছে এরকম মানুষ মানুষের ইতিহাসে কদাচিৎ দেখা দেয়; এবং রাষ্ট্রিক ইতিহাসে কখনও দেখা দেয়নি। গান্ধীজীর মৃত্যুর পর তাঁর সেই চরিত্র ও মন তাঁর শিষ্যেরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন এ কল্পনায় মনে ভরসা আসে, কিন্তু তার কারণ ও প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় না। গান্ধীজীর যেসব শিষ্য নিজের মত ও পথকে গান্ধীজীর মত ও পথ ভাবছেন খুব সম্ভব নিজের মনকে তাঁরা গান্ধীজীর মনের উপর আরোপ করছেন—সেই অধ্যায়ন, মায়া ও মিথ্যাজ্ঞানের যা বীজ।

গান্ধীজীর অনেক শিষ্যের এ ভুলের বিশেষ কারণও আছে। যাঁরা মহাপুরুষের জীবনকালে তাঁর আনুষ্ঠানিক শিষ্য হন ও সান্নিধ্য পান তাঁদের অনেকে গুরুর বাহ্য আচার ও রীতির অনুসরণ করেন দেখা যায়। এর কতকটা ভক্তির বাহ্য অভিব্যক্তির আবেগ, কতকটা বাহ্যিক অনুকরণে অন্তরটা গুরুর অন্তঃকরণের কতক গড়ন পাবে এই বিশ্বাস। গান্ধীজীর খদ্দরের খাটো বহির্বাস, তাঁর আহারের সংযম ও আহার্যের অনন্যসাধারণতা, চরকায় নিয়মিত সুতো কাটা, নিরলস দৈনন্দিন জীবনযাপন, নানা উদ্দেশ্যে ও উপলক্ষে উপবাস, নিজের গৃহ বলে কিছু না রেখে আশ্রমিক জীবন গ্রহণ, বস্তুর উপর ব্যক্তিস্বস্ত ও স্বামিতত্ব যেখানে আসে লোপের সীমারেখায়—এইসব বৈশিষ্ট্য অতিসাধারণ বৈশিষ্ট্য। এর দুটো—একটার অনুকরণেই সাধারণ মানুষের মধ্যে লোকে বাহ্যজীবনে অসাধারণ হয়। আর গান্ধীজীর এসব আচরণ বাহ্যিক নয়। তাঁর অন্তরের যা সব গভীর অনুভূতি ও প্রিয়তম আদর্শ তাদেরই স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ। গান্ধীজীর অনুকারী শিষ্যেরা যদি মনে করেন যে এই অনুকরণে তাঁরা গান্ধীজীর চরিত্রের মহত্ত্ব অনেকটা আয়ত্ত করেছেন তবে আশ্চর্যের কিছু নেই। বিশেষ যে অহিংসা ও মৈত্রীর কথা গান্ধীজী সকল সময়ে বলতেন তার বাচনিক পুনরুক্তি, এমনকী কায়িক পালন, বিশেষ কঠিন নয়। এতে কুশলী যেসব শিষ্য মনে করেন গান্ধীজীর মনে অহিংসা ও মৈত্রী তাঁরা নিজের মনে পেয়েছেন তাঁরা হয়তো মায়াগ্রস্ত, সজ্ঞানে মিথ্যাচারী নন। যদিও প্রথমটি থেকে দ্বিতীয়টি পৌঁছানোর পথ খাড়া নিচু ও পিচ্ছিল। কারণ ভুল ভাঙলেও ভোল ছাড়া অনেক সাধুর পক্ষেই দুঃসাধ্য হয়।

বিদেশিরা অধীনতা থেকে ভারতবর্ষের মুক্তি হতে না হতেই গান্ধীজীর মৃত্যুতে দেশে যে হতাশা ও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তার বড় কারণ রয়েছে গান্ধীজী ও তাঁর নিকট শিষ্যদের মন ও চরিত্রের বিরাট পার্থক্যের মধ্যে। ইংরেজের হাতেথেকে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপ্রধান সহজেই এসেছে সেই প্রতিষ্ঠানের হাতে যেখানে গান্ধীজী প্রধান শিষ্যদের অবাধ কর্তৃত্ব। সেই কর্তৃত্বের মূলে গান্ধীজীর উপর দেশের লোকের সীমাহীন আস্থা। সেই আস্থা সঞ্চারিত হয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানের উপর, যা ছিল গান্ধীজীর নানা কাজের শক্তিসঞ্চয়ের আধার ও শক্তিপ্রবাহের প্রণালী। শতাব্দীর চতুর্থাংশ যে যন্ত্রের তিনি ছিলেন প্রধান যন্ত্রী। দেশের লোকে আশা করেছিল যে গান্ধীজীর শিষ্যদের হাতে স্বাধীন ভারতবর্ষের শাসনের ও গড়নে গান্ধীজীর মনের মনের ও কাজের ছাপ থাকবে যাতে যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর নিদারুণতা ও ভারতবিভাগের বিভীষিকার মধ্যেও অন্তরের আশ্বাস ও কর্মে উৎসাহ পাবে। তাদের সে আশা পূর্ণ হয়নি। কী আশা? এবং কেন তা পূরণ হয়নি?

ভারতবর্ষের রাষ্ট্রব্যবস্থায় আজ যাঁরা নেতৃস্থানীয়, আধুনিক কি প্রাচীন রাষ্ট্রনেতৃত্বের মাপকাঠির মাপে তাঁরা খাটো নন। পৃথিবীর এক অতি দুঃসময়ে দেশ যখন বহু সমস্যায় পীড়িত ও নানা উৎপাতে বিব্রত তখন অল্পকালের মধ্যে একাধিক রাষ্ট্রসমস্যা সমাধানে তাঁরা যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা নিপুণ রাজনীতিজ্ঞতার পরিচয়, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘স্টেটসম্যানশিপ’। কিন্তু দেশ নিঃসংশয়ে ভরসা পায়নি, মন উৎসাহে জ্বলে ওঠেনি—অনেক কালের পরাধীনতার অবসানে যা স্বাভাবিক। সত্য কথা, জ্বলে উঠে স্তিমিত হয়ে এসেছে তেলের অভাবে। লোকে অনুভব করেছে এর মধ্যে কোথাও যেন ফাঁক আছে। যন্ত্র ঠিক সুরে বাজছে না। এর প্রধান কারণ নয় যে বহু সমস্যার তাঁরা সমাধান করতে পারেননি—অন্নবস্ত্র আবাস স্বাস্থ্য শিক্ষার সমস্যা—যা লোকের জীবন দুঃসহ করে তুলেছে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোক নিরক্ষর অশিক্ষিত, কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানশূন্য নয়। সেজন্য গান্ধীজীর শিষ্যদের ভাষণে রামরাজ্যের মনোহারী বর্ণনা শুনেও কেউ মনে করেনি যে, ইংরেজের হাতে থেকে গান্ধীজীর শিষ্যদের হাতে দেশের শাসন আসামাত্রই সকল দুঃখকষ্টের অবসান হবে, ধন—ধান্যে—স্বাস্থ্যে দেশ ভরে উঠবে। জনসাধারণের দুর্দশা ও দেশে সুপ্রাচীন। স্বাধীনতার সোনার কাঠির স্পর্শ লাগলেই সকল লোহা নিমেষে সোনা হয়ে উঠবে এমন স্বপ্ন কেউ দেখলেও, আশা কেউ করেনি। সুতরাং সে আশাভঙ্গের মনস্তাপেও দেশ ভুগছে না। দেশের মনকে যা পীড়া দিচ্ছে, তার কর্মোদ্যমের মুখে বিফলতার সেতুবন্ধ বেঁধে সে শক্তিকে যা উজ্জ্বল করে তুলছে সে হচ্ছে গান্ধীজীর দেশ—শাসক শিষ্যদের দেশের লোকের সঙ্গে অসহযোগ। তাঁদের রাষ্ট্রনীতি ও কর্মনীতির সঙ্গে দেশের জনসাধারণের যোগ নেই। যেমন ছিল না সদ্য—অপগত বিদেশি শাসনের আমলে। দেশের লোকের জন্য তাঁরা কাজ করছেন, কিন্তু সে কাজের জন্য তাঁদের প্রয়োজন কেবল সৈন্য, পুলিশ, সরকারি আমলা— জনসাধারণের উৎসাহ ও কর্মোদ্যম নয়। তাঁদের রাষ্ট্রশাসনের সঙ্গে ‘কো—অপারেশন’ করতে তাঁরা অবশ্য দেশের লোককে প্রতিনিয়ত বলছেন। কিন্তু তাঁদের কোন ‘অপারেশন’ কেমন করে কোথায় কাঁধ লাগাতে হবে দেশের লোক তার হদিশ পাচ্ছে না। সুতরাং তাঁদের মনে যাই থাক, মুখে তাঁরা যাই বলুন, এ ‘কো—অপারেশন’ দাবির কার্যত অর্থ দাঁড়িয়েছে তাঁদের সকল ব্যবস্থাকে বিনা হাঙ্গামায় পরমহিতকারী বলে মেনে নেওয়া। আর সভায় মিছিলে নেতাদের নামে জয়ধ্বনি তোলা। আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী ও হিতকর্মী ভূতপূর্ব ইংরেজ রাজপুরুষের অভ্যর্থনায় কলাগাজ ও শালুর রাজসংরক্ষণ।

সবেমাত্র স্বাধীন ভারতবর্ষের রাষ্ট্রকর্মে ভারতবাসীকে স্বদেশি শাসকদের সঙ্গে ‘কো—অপারেশনে’ ডাকার মনোভাবের তলায় যে প্রকাণ্ড ফাঁক রয়েছে, দেশ ও রাষ্ট্রের মধ্যে ভেদসৃষ্টিতে তার মারাত্মক গভীরতাই দেশের মনকে চঞ্চল করে তুলেছে। এর অর্থ স্বাধীনতার যে দায় তা সমগ্র দেশবাসীর নয়, শাসকসম্প্রদায়ের। ঊর্ধ্ব থেকে তাঁরা যন্ত্র ঘোরাবেন, ফলভোগ অবশ্য করবে দেশের লোক, সুফল ও কুফল। কিন্তু তারা ভোক্তামাত্র, কর্তা নয়। ঠিক ব্রিটিশ আমলের ব্যবস্থা। কেবল যন্ত্রী ও কর্তার রং বদল হয়েছে। গান্ধীজী তখন ‘কুইট ইন্ডিয়া’ দাবিকে সফল করার জন্য দেশবাসীকে ডেকেছিলেন তখন বলেননি, আমার সঙ্গে কি কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতা—’কো—অপারেট’ করো। সে ডাকে সবাই বুঝেছিলেন এ কাজ তাদের নিজেদের কাজ, নিজেদের করতে হবে। গান্ধীজী ও কংগ্রেস পথদর্শয়িতা ও যন্ত্র। গান্ধীজীর সকল ডাক ছিল এই রকম ডাক। সহযোগিতা করতে ডাকার মধ্যে যে ডাকে ও যাদের ডাকা হয় তাদের মধ্যে যে ভেদরেখা থাকে সে ভেদরেখা গান্ধীজী কখনও টানেননি। অভিনব সব পথ তিনি আবিষ্কার করেছেন ও তাদে যাত্রা করেছেন দেশবাসীকে সেই পথে জলার পথ দেখিয়ে। এ কথা ঠিক যে বিদেশির হাতে থেকে স্বাধীনতা কাড়তে দেশের জনসাধারণের যে কাজ ও তার যা উপায় স্বাধীনতা পাওয়ার পর দেশের শাসনে ও গড়নে জনসাধারণের কাজ ও রীতি তার সঙ্গে এক হতে পারে না। কিন্তু এ কথাও সমান সত্য যে, ভারতবর্ষের মতো পিছিয়ে—পড়া দেশ, অপুষ্টি—অস্বাস্থ্য—অশিক্ষা পীড়িত জনসাধারণের দেশ ও স্বাভাবিক ঐতিহাসিক কারণে দেশাত্ম—অনুভূতিশূন্য জনগণের দেশ—এ দেশের রাষ্ট্রশাসন পৃথিবীর অগ্রসর দেশগুলির সঙ্গে এক হতে পারে না। শতাব্দীর পথ আমাদের চলতে হবে বছরে। শাসনকালে মসৃণ চাকা নির্ভুল ও যত জোরে ঘুরুক সে গতির শক্তি জন্মায় না। সে শক্তির একমাত্র উৎস জনসাধারণের আশা ও উৎসাহ। ইংল্যান্ডের মতো দেশকে নকলের চেষ্টায় লাভ নেই। সেখানে বহুদিনের রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্রমবিকাশে দেশের কর্মশক্তির বড় অংশের প্রবাহ চলে রাজশাসনের প্রণালী দিয়ে। দেশের লোক তাতেই অভ্যস্ত। আর সকলেই জানে সে শক্তির সাফল্যের পথে কোনও বাধা দাঁড়াতে পারবে না; বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বার্থের বাধা, সরকারি আমাদের শৈথিল্য অক্ষমতা দুর্লোভের বাধা। রাষ্ট্রপ্রধান কঠোর নির্মম হাতে সকল বাধা চূর্ণ করবে। এমন বাধার সম্ভাবনার বিরুদ্ধে জনসাধারণের দৃষ্টি যেমন প্রখর, তার মতামতের প্রতাপ তেমনি প্রবল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনোভাব গড়ে উঠেছে সেই পরিবেশে। অত্যন্ত প্রলোভনেও সে শক্তিকে বাধা দেওয়া কি এড়িয়ে যাবার কথা সচরাচর কারও মনে হয় না। বহুদিনের সাধনায় এ সিদ্ধি। সুতরাং শাসনযন্ত্রের বোতাম টিপলে ইংল্যান্ডে যে কাজ হবে, ও কলের চাবি ঘুরিয়ে আজকের ভারতবর্ষেও সমান ফললাভ হবে, এটা অক্ষমতার আত্মপ্রতরণা, দাম না দিয়ে বস্তু লাভের দিবাস্বপ্ন। তা যে হয় না তার ভূরি ভূরি প্রমাণ ইতিমধ্যেই দেশের শাসন ও দেশের গড়নের মধ্যে প্রায় অন্যন্যভাব। সেজন্য আকস্মিক বিপৎপাত কি অসাধারণ প্রয়োজন তাগিত ছাড়া ওদেশে আধুনিক সভ্যসমাজে বিপুলায়তন নিত্যনৈমিত্তিক শাসন ও গড়নের সুষ্টু সমাধার জন্য জনসাধারণের কর্মোৎসাহকে রাষ্ট্রের শাসকদের চেষ্টা করে জাগিয়ে তুলতে ও জাগিয়ে রাখতে হয় না। সে শক্তির সঞ্চয় ও সক্রিয়তা স্বভাবতই দেশের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু যে দেশের সে অবস্থা নয় সে অনগ্রসর দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শাসনের চেয়ে গড়নের কাজ অনেক বড় ও অনেক বেশি। তার জন্য জনগণের উৎসাহ ও শক্তির উদ্বোধন করতে হয় সজীব আশার মন্ত্রে। যে আশাকে কর্ম দিয়ে বাস্তবে গড়া যায়; আসল কল্পনার আত্মতুষ্ট বাচনের ফুলঝুরি নয়। উদ্বোধিত শক্তিকে সংহত করতে হয় বিশেষ কর্মে তাকে প্রয়োগের ব্যবস্থায়। উৎসাহ জাগিয়ে রাখতে হয় সে কর্মের ক্রম—সফলতার চাক্ষুষ প্রমাণে। শাসনের কারখানায় আমলাতন্ত্রের মজুরিতে এ কাজ সম্ভব নয়।

১০

এর আধুনিক দৃষ্টান্ত রয়েছে বলভেশিক বিপ্লবের রুশীয় রাষ্ট্রে। বলশেভিক রাষ্ট্রনেতারা হাতে পেয়েছিলেন ভারতবর্ষের মতো প্রচাণ্ড জনসংঘ, আর ঠিক ভারতবর্ষের মতোই অন্নহীন স্বাস্থ্যহীন শিক্ষাহীন রাষ্ট্রবুদ্ধিশূন্য সে জনসমাজ। এ দেশকে যখন তারা গড়তে চেয়েছিলেন নিজেদের আদর্শমতো উন্নত দেশে এবং অল্পকালের মধ্যে, তখন তাঁরা শাসনের চাকার সাধারণ গতিকে সন্তুষ্ট থাকেননি, আর সরকারি আমাদের কুর্মকুশলতার উপর ভরসা রাখেননি। তাঁরা দেশময় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দলের উৎসাহী সভ্যদের যারা দেশের লোককে দুর্দশামুক্তির আশা দিয়েছে, মনে বড় হবার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছে, সঙ্গে কাজ করে কাজের পথ দেখিয়েছে। প্রপাগাণ্ডা—প্রভাবে যাদের মনে ধারণা হয়েছে এসব ভুয়ো, বলশেভিক দলের লোকেরা রুশিয়ার জনসাধারণের মধ্যে উৎসাহ আনেনি, এনেছে ত্রাস, চাবুক উঁচিয়ে রুজিবন্ধের বিভীষিকায় কাজ আদায় করেছে, ক্রীতদাসের কাজ যেমন করে আদায় করে, কার্য—কারণের কাণ্ডজ্ঞান তাদের কম। আর সব ছেড়ে দিলেও যে জার্মানির শক্তির সম্মুখে আধুনিক সভ্যতায় সুপ্রাচীন, জ্ঞানবিজ্ঞানে ধনবলে সমৃদ্ধ পশ্চিম—ইউরোপ এক বছরও খাড়া থাকতে পারেনি সে দেশকে আধুনিক যান্ত্রিক যুদ্ধে পরাস্ত করতে যে আয়োজন ও মনোবলের প্রয়োজন ক্রীতদাসের শ্রমে তা গড়ে তোলা যায় না। কোটি কোটি নিরক্ষর জনসাধারণের দেশে আধুনিক সভ্যজগতের বিদ্যার প্রথম পাঠকে ভয় দেখিয়ে সর্বজনীন করা যায় না। এই বলশেভিক দলের লোকেরা দেশের নানাশ্রেণিকে পীড়ন করেছে সন্দেহ নেই। নিষ্ঠুর অত্যাচারে অনেক শ্রেণির, অনেক মনোভাবের লোকদের উচ্ছেদ করেছে, বলশেভিক নেতাদের আদেশে ও শাসনশক্তির সাহায্যে। রাষ্ট্রনেতারা এই উচ্ছেদ—পর্বকে মনে করেছিলেন তাঁদের কল্পিত আদর্শসমাজ ও রাষ্ট্রগড়ার অলঙ্ঘ্য উপায়, ধর্মরাজ্যের শান্তিপর্বে পৌঁছবার সোজা পথ। মার্কিন দেশের দেশের আদি উপনিবেশীরা যে প্রয়োজনবোধে সে দেশের আদিম অধিবাসীদের উচ্ছেদ করেছিল। দেশের বেশির ভাগ লোকের মন এ অত্যাচারের বিরুদ্ধ ছিল এমন মনে করার কারণ নেই। এ অত্যাচার সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগরিষ্ঠের নামে রাষ্ট্রের অত্যাচার। এ নিষ্ঠুরতা চরম ফল কী হবে, দেশের লোকের ও নেতাদের মনে সর্বনাশের বীজ এতে রোপণ হল কি না, আর ব্যাবহারিক চোখে কোনও সুফল যদি প্রকট না—ও হয় এ নিষ্ঠুরতা নিজেই নিজেকে ধিক্কৃত করেছে কি না—এসব প্রশ্ন অবান্তর। বলশেভিক নেতারা দেশের সামনে সমাজ ও রাষ্ট্রের যে আদর্শ ও উপায় উপস্থিত করেছেন তাতে রুশিয়ার লোকচরিত্র কী গড়ন নেবে, শোভন না কুৎসিত, সে তর্কও অপ্রাসঙ্গিক। অনগ্রসর দেশকে যে—কোনও আদর্শের দিকে এগিয়ে নিতে সে দেশের শিথিল—শক্তিমন জনসাধারণকে যে উৎসাহে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, আর তার যা অপরিহার্য উপায় আধুনিক রুশিয়া তার দৃষ্টান্ত। এ দেশের রাষ্টনেতারা এ চেষ্টায় ব্রতী হতে চান ও সে চেষ্টাকে সফল করতে চান সে দৃষ্টান্ত তারে অনুসরণ করতে হবে।

ইংরেজের হাতে থেকে গান্ধীজীর শিষ্যদের হাতে যখন ভারতবর্ষের রাষ্ট্রক্ষমতা এসেছিল তখন বলশেভিক দলের অনুরূপ একটি দল তাঁদের পাশে ছিল, তাঁদেরই সহচর—অনুচর কংগ্রেসের কর্মীর দল। গান্ধীজী প্রস্তাব করেছিলেন দেশের শাসন থেকে তার গড়নের কাজ যতটা সম্ভব তফাত করা হোক। যে কাজ দেশের জনসাধারণের হাত না লাগলে, অচল, এবং সে কাজে হাত না লাগলে জনসাধারণের শরীরমনে মানুষ হয়ে ওঠার পথ অচল, সে কাজকে রাখা হোক বহু পরিমাণে শাসনযন্ত্রের শক্তিচক্রের বাইরে। আর সে কাজের ভার নিক কংগ্রেসের কর্মীর দল। দেশময় তারা ছড়িয়ে পড়ুক দেশের লোককে আশা দিতে, তাদের মনে মানুষ হবার আকাঙ্ক্ষা আনতে, কাজের সাথি হয়ে কাজের পথ দেখাতে ও উৎসাহ জাগাতে। কিন্তু তাদের পিছনে রাষ্ট্রের শক্তি থাকবে না, যেমন ছিল রুশিয়ায়। দেশবাসীকে তাদের কাজে টানতে হবে নিজেদের সেবা দিয়ে। দেশবাসীর শ্রদ্ধা ও আস্থার মধ্যে সঞ্চিত হবে তাদের বল। এ প্রস্তাব গান্ধীজী করেছিলে সম্ভব দুই কারণে। দেশের কর্মীর হাতে যদি থাকে রাষ্ট্রের বল তবে দেশের লোকের মন অনুকূল করার ঝঞ্ঝাটে না গিয়ে সেই বলে তার হাত দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া অনেক সহজ, আর অনেক তাগিদ তাতে কাজ হয়, যেমন রুশিয়াতে বহু সময় নিশ্চয় হয়েছে। এ প্রলোভন দুর্দম্য। কিন্তু গান্ধীজীর কাছে কাজের ফল কাজের প্রধান ফল নয়। সে কাজের ফল মানুষের চরিত্রের উপর কেমন ফলবে সেই বিচার চরম। আর সে বিচারে জবরদস্তির ফল যে ভাল নয়, যে করে আর যে সয় দুজনার উপরেই নয়, তাতে সন্দেহ নেই। কেবল ব্যাবহারিক পক্ষেই যদি বিচার করা যায় তবে গান্ধীজীর প্রণালীতে কাজের ফিল বিলম্বিত কিন্তু তার ভিত্তি যে হয় দৃঢ় ও স্থায়ী তাতেও সন্দেহ করা চলে না। কারণ কাজের শেষেই তা শেষ হয় না। এ প্রণালীর কাজে কর্মীর মনের গড়ন বদল হয়, বহু ভারী কাজের শক্তি ও উৎসাহ যা সঞ্চয় করে রাখতে পারে। দ্বিতীয় কারণ, গান্ধীজী তাঁর শিষ্যদের চিনতেন শিষ্যদের নিজেদের চেয়ে অনেক বেশি। তাঁর মনে সংশয় ছিল না তাঁর যে—শিষ্যদের হাতে যাবে রাষ্ট্রশাসন, যদি তাদের হাতেই থাকে দেশকে গড়ার ভার, যে গড়ার কাজে উৎসাহ দিয়ে ও পথ দেখিয়ে জনসাধারণের নিজেদেরই প্রবৃত্ত করাতে হবে, তবে শাসনের নীচে গড়ন চাপা পড়বে। শাসনকালে নৈর্ব্যক্তিক চাকা চালাতে তাঁরা এত তদ্গত হবেন যে, জনসাধারণের ব্যক্তিরূপ, তাদের ব্যক্তিগত সুখ—দুঃখ অভাব—অভিযোগের ছোট সব কথা তাঁদের মনে ঝাপসা হয়ে আসবে। দেশের কর্মী বলতে মনে হবে এই কলের মজুর আমলা সম্প্রদায়, যাদের কাছেই প্রকৃত কাজ কিছু আশা করা যায়। ফলে দেশের জনসাধারণের মনেও তাদের উপর শ্রদ্ধা ও আস্থা ফিকে হতে থাকবে। যেসব বৃহৎ গঠনের কাজ রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ চেষ্টাতেই সম্ভব তার দিকে এঁরা অবশ্য দৃষ্টি দেবেন। মহাকরণের প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে নানা শ্রেণির বিশেষজ্ঞ কর্মচারী প্রথম মধ্য ও চরম রিপোর্ট রচনা করবে, জমা—খরচের বিস্তৃত হিসাব—নিকাশ তৈরি হবে, কিন্তু তার বেশির ভাগ রাজদপ্তরের নথির ভার বাড়ানো ছাড়া আর কোনও ফল ফলবে না, যেমন ব্রিটিশ আমলে ফলত না। কারণ কল্পনাকে কাজে ফলিয়ে তোলা কর্মচারীদের দায় নয়; আর বিশেষজ্ঞ হতে হাতেকলমে কাজ করতে জানা, সুতরাং অন্যকে সে কাজ করিতে নিতে জানা, দরকার হয় না। রিপোর্ট লেখার কৌশল জানলেই হল। তাতেই তারা অভ্যস্ত। এ আমলা—সম্প্রদায়ের কাছ থেকে গঠনের কাজ আদায়ে শাসক—শিষ্যদের সামর্থ্য হবে না; কারণ তাঁরাই হবেন এদের করায়ত্ত; অভিজ্ঞতার অভাবে এবং একাগ্র নিষ্ঠা সমস্ত অনভিজ্ঞতাকে অতিক্রম করে এ ব্যাপারে তার অভাবে। কংগ্রেসের যে সকল কর্মী দেশের স্বাধীনতালাভে দেশের লোককে পথ দেখিয়েছে নিজেদের জীবনে কাজে ও আদর্শে, তারে উপর কংগ্রেসের নেতাদের হাতে রাষ্ট্রশাসনের এই রূপ কি ফল ফলাবে সে সম্বন্ধে গান্ধীজীর মনের আশঙ্কা তাঁর জীবনকালেই ফলতে আরম্ভ করেছিল। নেতাদের প্রদান কাজ দেশের শাসন। সে কাজে এই কর্মীদের কোনও প্রকৃত স্থান, সুতরাং ডাক, নেই। কিন্তু নেতাদের হাতেই যখন শাসন তখন সে যন্ত্রে এবং শাসনের আনুষঙ্গিক যে গঠনের কাজে তাঁদের কর্তৃত্ব তারর মনে একটু স্থান পাওয়ার লোভ ও চেষ্টা অনেক কংগ্রেসকর্মীকেই আকৃষ্ট করবে। কারণ ও দেশের কাজ পূর্বেকার শুষ্ক দেশসেবা নয়, সরকারি শাসনের রসাল মর্যাদার কাজ। নেতাদের পূর্বাবস্থার অনুচর হাওয়াতে সুবিধাও একটু বেশি। এ প্রলোভন হাজারে ক্বচিৎ একজন দমন করতে পারে। বানপ্রস্থের পর এই গার্হস্থ্যে কংগ্রেসকর্মীরা যে পূর্বজীবনের দেশসেবায় ত্যাগের লোকসান নূতন জীবনে উঁচু হারে সুদসমেত পুষিয়ে নেবার কাড়াকাড়িতে দেশের চরিত্র ও দুর্দশাকে ঘনকৃষ্ণ করে তুলেছেন ছোট—বড় কংগ্রেস নেতারা সরবে ও সাড়ম্বরে সেজন্য বিলাপ করেছেন। যে অল্পসংখ্যা কংগ্রেসকর্মীদের এই প্রলোভন প্রলুব্ধ করতে পারেনি, তাঁরা আছেন দেশের রাষ্ট্রনেতাদের দিকচক্রবালের বাইরে। নেতারা তাঁদের চেনেন না, এবং তাদের সঙ্গে নেতাদের যোগ নেই, কারণ নেতাদের কর্মপথে তাঁরা নিষ্প্রয়োজন। দেশের যে কাজ কেবল তাঁরাই করতে পারতেন নেতৃত্ব ও উৎসাহের অভাবে সে কাজ তাঁদের সম্ভব হচ্ছে না। কর্মীর দারুম অভাবের দিকে যাঁরা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মী হতে পারতেন তাঁরা বেকার। যে নিশ্চিত কঠিন সমস্যার দিন ছিল অত্যন্ত সহজেই অনুমেয় সে দিনে রাষ্ট্রনেতারা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মীসংঘের কর্মশক্তি থেকে দেশকে ও নিজেদের বঞ্চিত করেছেন, কাজ দিয়ে ও কাজ করতে না দিয়ে। গান্ধীজী যখন কংগ্রেসের কাঠামো বদলে সে প্রতিষ্ঠানের শাসন ও সেবাকে পৃথক করতে চেয়েছিলেন সেটা সাংসারিক বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে মহান আত্মার আদর্শপ্রীতির খেয়াল নয়। সে প্রস্তাব ছিল মানুষের চরিত্রের ও দেশের বাস্তব অবস্থার অর্ন্তদর্শী প্রতিভাবান রাষ্ট্রনীতিজ্ঞের পরিকল্পনা। নূতন অবস্থার নূতন উপায় আবিষ্কার যে প্রতিভার কাজ। অচিন্তিতত অভিবনকে গতানুগতিক প্রাচীন কৌশলে আয়ত্তের নিরুদ্বেগ মোহান্ধতা ও মানসিক জড়তা যাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।

১১

গান্ধীজীর রাষ্ট্রনায়ক শিষ্যেরা এ পথে চলতে ভরসা করেননি; হাতে পুরাতনকে ভেঙে নূতনকে গড়তে যে সাহসের প্রয়োজন সে সাহস তাঁদের হয়নি। কারণ বোঝা কঠিন নয়। গান্ধীজীর নব মন—কলেবর কংগ্রেসের পর দেশের লোকের যে আস্থা ও শ্রদ্ধা তার মূলে ওই কংগ্রেসের নেতা ও কর্মীদের দেশের স্বাধীনতার জন্য কষ্টবরণ এবং দেশের লোকের প্রতি মৈত্রী ও তাদের সেবায় স্বার্থত্যাগ। রাষ্ট্রশাসন—পরিচালক কংগ্রেসের সঙ্গে দেশের লোকের পরিচয় নেই সেজন্য স্বাধীন ভারতবর্ষে যখন অধীনতামোচনের জন্য দুঃখবরণ অপ্রয়োজন তখন যদি কংগ্রেসের এক দলের কাজ হয় পূর্বের মতো সাক্ষাৎ মৈত্রী ও সেবা, এবং অন্য দলের হাতে থাকে রাষ্ট্রশাসন তবে স্বভাবই দেশের লোকের শ্রদ্ধা ও আস্থা যাবে প্রথম দলের উপর, এবং শাসকদলের উপর সশ্রদ্ধ ও অকুণ্ঠ আনুগত্যের দৈন্যে রাষ্ট্রশাসনের বিরাট ও জটিল গতি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অর্থাৎ অন্য শ্রেণির তুলনায় শাসকশ্রেণির প্রভাব দেশের লোকের মনে ক্রমে কমার আশঙ্কা থাকে, যদি না শাসনের কুশলতায় ও জনসাধারণের হিতে তার সুস্পষ্ট আন্তরিকতায় অচিরকালেই সেই শ্রদ্ধা ও আস্থা অর্জন করা যায়। সেইজন্য গান্ধীজীর রাষ্ট্রশাসক শিষ্যদের প্রয়োজন তাঁদের রাষ্ট্রশাসনের অনুকূলে কংগ্রেসের উপর দেশের শ্রদ্ধা ও আস্থা, যে শ্রদ্ধা ও আস্থা কংগ্রেস অর্জন করেছে রাষ্ট্রশাসন কুশলতার ফলে নয়। এইজন্যেই স্বাধীন ভারতবর্ষেও কংগ্রেস দেশের সকল লোকের প্রতিনিধি, আবার রাষ্ট্রক্ষমতালাভে গণতান্ত্রিক ভোটের সময় কংগ্রেস পলিটিক্যাল দলের একটি দল। এবং এ অসংগতিকে নিজে মনে ও পরের কাছে ব্যাখ্যা করতে হয় হঠাৎ—উপস্থিত পরিস্থিতি ও তার বিপদকুশলাতর অজুহাত দিয়ে!

গান্ধীজীর প্রধান শিষ্যদের নূতন অবস্থার নূতন ব্যবস্থা আবিষ্কারে এই অক্ষমতা ও প্রয়োগে অসাহসিকতা নির্ভুল প্রমাণ যে গান্ধীজীর জীবন ও কর্ম এই শিষ্যদের মনে নবজীবন সঞ্চার করেনি। তাঁদের জীবনে গান্ধীজীর জীবনের প্রভাব বাহ্য। কারও মনের গড়ন গান্ধীজীর মনে গড়নের প্রায় বিপরীত। তার জীবনকালে তাঁর দেশব্যাপী প্রায় অলৌকিক প্রভাবের কাছে অবশ্য নতিস্বীকার করতে হয়েছে। কোনও বড় ব্যাপারে তাঁর নির্দেশ অমান্যের সাহস হয়নি। তাঁর প্রতি দেশের বেশির ভাগ লোকের দ্বিধীহন আনুগত্যের সুযোও অনেক নিতে হয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর কাজে প্রকাশ হচ্চেচ অশোধিত মূল চরিত্রের, তার দোষে তার গুণ। কারও মন অনেকটা গান্ধীজীর মনের সধর্মী। কিন্তু চরিত্রে গান্ধীজীর দৃঢ়তা ও বুদ্ধিতে তাঁর প্রতিভার অংশের অভাবে সে মনের উপর গান্ধীজীর মনের প্রভাব পরিণতি পেয়েছে ভাবাশিষ্ট কল্পনাবিলাসে, মনোমোহন উদার বাক্যে যা নিজেকে চরিতার্থ করে। কাজ চলে গতানুগতিক সংগীর্ণ পথে, যে পথে রাষ্ট্রনেতাদের কাজ চিরকাল চলেছে; যার মধ্যে গান্ধীজীর শিষ্যত্বের পরিচয় নেই। কারও মন ও চরিত্র গান্ধীজীর মন ও চরিত্রের প্রভাবে উৎসন্নপ্রায় হয়েছে। চোখে পড়ার মতো নিজের বৈশিষ্ট্য কিছু অবশেষ নেই। তাঁদের চরম সাফল্যবোধ গান্ধীজীর কথা ও কাজের অনুকরণে। উপস্থিত প্রসঙ্গে ও অবস্থায় সে কথা ও কাজ প্রাসঙ্গিক কি অপ্রাসঙ্গিক তাঁদের মনে সে বিচারের দুয়ার বন্ধ। গান্ধীজীর জীবন ও কর্মের বিশাল বেগবান প্রবাহকে তাঁরা নিজের মনে পরিণত করেছেন কঠিন বরফের জমাট পঙক্তিতে; যার পরিচ্ছন্ন অচল জ্যামিতিক রূপের নকল সম্ভব। গান্ধীজী তাঁর কর্মের গতিপথ কতবার পরিবর্তন করেছেন সেদিকে তাঁরা চোখ দিতে চান না। আর সকল পরিবর্তনের মধ্যে আদর্শেরে যে ধ্রুব ত্ব তার দার্শনিক তত্ত্বজ্ঞানে কর্মবিশেষে তাকে প্রয়োগের কৌশল আয়ত্ত হয় না। যদি হত তবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিকেরা ও মহাপুরুষদের চরিত্রলেখকেরা হতেন পৃথিবীর বড় সব কর্মী। গান্ধীজীর এই শিষ্যেরা গান্ধীসংঘে থেরবাদী। নূতন অবস্থাকে তাঁরা স্বীকার করেন না, নূতন উপায়কে গ্রহণ করেন না।

সংসারের গুরুর পাওয়া যায় অনেক, কিন্তু শিষ্য মেলে অল্প—এ প্রবাদের মৌলিক তথা হচ্ছে যে—শিষ্যেরা গুরুর বাক্য ও আচারের অনুকরণে তৃপ্ত তারা উপযুক্ত শিষ্য নয়। শিষ্যদের সাধনা গুরুর জীবনের ধারাকে নিজের জীবনে আনার ‘পাইপ—লেয়িং’—এর সাধনা নয়। গুরুর জীবনের প্রভাবে শিষ্যের মন ও চরিত্রের শক্তি অর্গলমুক্ত হয় হয়তো নূতন পথে চলে, যে পথ গুরুর জীবনের পথ নয়—যেমন রামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ শিষ্য। কিন্তু সে শক্তি শিষ্যের নিজস্ব শক্তি, গুরুর কাছে ধার করা নয়। তার বেগ ও পরিমাণ নির্ভর করে শিষ্যের জীবনে সে শক্তির সঞ্চিত ভাণ্ডারের আয়তনের উপর। কবি বলেছেন, সূর্যের কিরণে মণি থেকে আলো ঠিকরে পড়ে, মাটির ঢেলা থেকে নয়। প্রদীপের স্পর্শে দীপ জ্বলে, কিন্তু তেল—সলতে দীপের নিজের। তাদের উপরে নির্ভর করে তার আলোর ঔজ্জ্বল্য ও স্থায়িত্বের কাল।

গান্ধীজীর সাক্ষাৎ—শিষ্যদের জীবনে গান্ধীজীর চরিত্রের প্রভাবে শক্তির কোনও বিশাল ও বিচিত্র স্ফূর্তি দেখা যায়নি। নূতন ভারতবর্ষের নূতন রাষ্ট্রিক, সামাজিক, আর্থিক সমস্যার সমাধানের তাঁরা এমন নূতন পথ আবিষ্কার করেননি যার নূতনত্ব ও কুশলতা মনে বিস্ময় ও আনন্দ আনে; সে নূতন পথে গান্ধীজী কখনও না হাঁটলেও তাঁর পায়ের চিহ্ন যেখানে চোখ এড়ায় না। গান্ধীজীর স্পর্শে তাঁর শিষ্যদের মন ও চরিত্রে শক্তির পথমুক্তি হয়নি। যদি হয়ে থাকে তবে গান্ধীজীর মাপে সে শক্তির পরিমাণ ছিল অতি অল্প।

১২

সেইজন্য গান্ধীজীর রাষ্ট্রনেতা—শিষ্যদের রাষ্ট্রীয় কাজ সেখানেই সফল হয়েছে যে কাজে নূতন কল্পনার প্রয়োজন হয়নি। ভারতের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বহু বিচ্ছিন্ন শিথিল অংশকে কাঠামোর সঙ্গে জুড়ে তাঁরা কাঠামোর আভ্যন্তরিক গড়নকে সুদৃঢ় করেছেন। সে মিলনের জন্য যে বিচ্ছিন্ন অংশগুলির জনসমষ্টি প্রস্তুত ও উন্মুখ ছিল তাতে এ কাজের সার্থকতা ও কৌশলের মূল্য কিছুমাত্র কমে নয়। কিন্তু একরাষ্ট্র ভারতবর্ষের দৃঢ়সম্বন্ধ কাঠামোর কল্পনা পুরাতন। ইংরেজ রাজশাসন সে কল্পনা করেছিল এবং কল্পনাকে কাজে পরিণত করতে আরম্ভ করে রাজনৈতিক মতপরিবর্তনেই তা থেকে বিরত হয়েছিল। এই দৃঢ় কাঠামোয় রাষ্ট্রের সবল, সুঠাম, কল্যাণমূর্তির প্রতিষ্ঠায় নূতন কল্পনার প্রয়োজন। সেই মূর্তি যে রাষ্ট্রনেতাদের ধ্যানেও আছে এ পর্যন্ত তার প্রমাণ নেই। রাষ্ট্রের কাঠামো রাষ্ট্রের কঙ্কাল। কঙ্কালের মতোই দেহের আশ্রয়। কিন্তু রাষ্ট্রের কঙ্কালকেই রাষ্ট্রের দেহ বলে ভুল করা মারাত্মক। অস্থিবিদ্যা ও শারীরবিদ্যা এক বিদ্যা নয়।

গান্ধীজীর শিষ্যদের পররাষ্ট্রনীতি বাচনিক প্রতিজ্ঞায় মহীয়ান। ভারতবর্ষ এশিয়ার অশ্বেতজাতির লোকের রাষ্ট্র। শ্বেতজাতির পরাধীনতার দুঃখ সে জানে। তার পররাষ্ট্রনীতি পরপীড়ক শ্বেতরাষ্ট্রগুলির ‘ডিপ্লমেসি’ হবে না। উদার মানবতার উপর তার প্রতিষ্ঠা। সকল রাষ্ট্রের প্রতি তার মৈত্রী, সকল উৎপীড়িতের সে বন্ধু। এই নীতিকে বাস্তবে যখন মূর্ত করতে হয় তখন দেখা যায় আমাদের রাষ্ট্রনেতারা হালে, চালে, মৌখিক সৌজন্যে, অপ্রিয় সত্যের অকথনে, প্রিয় অসত্যের ব্যঞ্জনায়, ইউরোপ আমেরিকার বড় বড় রাষ্ট্রের নেতাদের ‘ডিপ্লমেসি’র অনুকরণে ব্যস্ত। সে নেতারা বড় কথার ফেনরাশির তলায় ও অশ্বেত চামড়ার নীচের নিজেদের শিষ্য সহাধ্যায়ীর মূর্তি সহজেই দেখতে পান। সুতরাং নিরুদ্বেগ প্রশংসায় তাঁরা অকৃপণ। গান্ধীজীর নিজের ও পরের সম্বন্ধে সে অপক্ষপাত সত্যনিষ্ঠা ও সত্যভাষণ তাঁর অনুচরদের লজ্জিত করত, পরের মনে জাগাত অসন্তুষ্ট বিস্ময়—এ নীতিতে তার প্রাণস্পর্শ নেই। ভারতবর্ষের পররাষ্ট্রনীতিতে ইউরামেরিকার রাজনীতিজ্ঞেরা অর্ধনগ্ন ফকিরের ছায়া না দেখে নিশ্চিত হয়েছেন।

গান্ধীজীর যেসকল শিষ্যেরা রাষ্ট্রশাসনে স্থান দেননি। যাকে গান্ধীজীর ‘গঠনমূলক কাজ’ বলে তাতে রত আছেন, তাঁরা গান্ধীজীর মৃত্যুর পর থেকে আজ পর্যন্ত গান্ধীজী তাঁর জীবনকালে যে পথের যে নির্দেশ দিয়েছেন তাকে রেকামাত্র প্রসারের কল্পনা করেননি। অথচ এ কথা স্পষ্ট যে গান্ধীজী অনেক কাজের প্রকার ও পরিমাণের উপদেশ করেছেন, উপায়ের অনেক কৌশলের নির্দেশ দিয়েছেন ভারতবর্ষের অধীনতার পটভূমিতে। যে কাজ ও উপায়ের সফলতা সে অবস্থায় সম্ভব মনে করেননি তার উপদেশও করেননি। অনেক কাজের কোনও উপদেশ দেননি, সে কাজের প্রয়োজন নেই বলে নয়, তার গুরুত্ব মক বলে নয়, কিন্তু তখন অন্য অনেক কাজে তার উপদেশ ও নির্দেশের প্রয়োজন বেশি মনে করে। কারণ স্বভাবতই তাঁর অনেক কাজ ছিল ভারতবর্ষের অধীনতামুক্তির উপায়ের প্রস্তুতি; যদিও তাঁর কোনও উপায়ের উপদেশ এমন ছিল না লক্ষ্যে পৌঁছানো ছাড়া যার অন্য ফল নেই। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর গান্ধীজী অল্প দিন বেঁচে ছিলেন। এবং সে অল্প কয়েকদিনও কেটেছে মানুষের আকস্মিক নির্দয় পশুত্বকে তাঁরর নিজের উপায়ে প্রতিরোধের চেষ্টায় এই অস্বাভাবিক আকস্মিকতার প্রশমনের পর গান্ধীজী কিছুকাল বেঁচে থাকলে যে অনেক নূতন কাজ ও পথের সন্ধান দিতেন, পুরাতন কাজ ও পথের সম্প্রসার করতেন তাতে সন্দেহ নেই। কারণ গান্ধীজীর গান্ধীবাদে আস্থা ছিল না, গান্ধীদর্শনে তিনি পণ্ডিত ছিলেন না। গান্ধীজী মত ও পথের এক অংশ ভারতবর্ষের লোকদের ভারতবর্ষের এক বিশেষ অবস্থায় উপদেশ; অন্য অংশ সকল দেশের ও সর্বকালের। কিন্তু এ সনাতন আত্মাতেও জড়ত্ব আসে যদি না নূতন অবস্থার নূতন দেহে পুনঃ পুনঃ তার নবজন্ম হয়। গান্ধীজীর শিষ্যদের মধ্যে এ নবজাতকের ধাত্রী কাকেও দেখা যায় না। তাঁরা গান্ধীজীর কথা মন্ত্রের মতো আবৃত্তি করেন, তাঁর আচার অচল নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। গান্ধীজীর জীবনে আগুনে তাঁদের জীবনে বহুবর্ণের শিখা জ্বলে ওঠেনি। তার মালমশলা ছিল না। যে সব নব উন্মেষশালিনী বুদ্ধি গান্ধীজীর একনিষ্ঠ কর্মে বৈচিত্র্যের বিস্ময় আনত শিষ্যদের জীবনে তার স্ফূর্তি নেই। কারণ, এর উত্তরাধিকারিত্ব নেই, কি সন্তানের কি শিষ্যের।

গান্ধীজীর জীবনকালের শিষ্যদের কথা যা হোক, এমন আশা দুরাশা নয় যে, গান্ধীজীর চরিতকথা যখন ভবিষ্যবংশীয়দের বিস্মিত কল্পনার বস্তু হবে, যখন তাঁর জীবন সমসাময়িক পরিবেশের স্বল্পতা থেকে মুক্ত হয়ে মহাকালের পটে অঙ্কিত হবে তখন গান্ধীজীর উপযুক্ত শিষ্যের আবির্ভাব হবে। যে শিষ্য গান্ধীজীর জীবন ও কর্মের বাহ্যিক অনুকরণ করবে না। যার শক্তির প্রাচুর্য ও প্রতিভার সঞ্চয় গান্ধীজীর জীবনস্মৃতির স্পর্শে প্রাণের গতিতে বেগবান হবে। মানুষের চরিত্রে মহত্ত্বের নূতন সম্ভাবনা দেখাবে; মানুষের সমাজবন্ধনে মৈত্রীর নূতন ভিত্তি স্থাপন করবে। সে শিষ্যের জীবনে গান্ধীজীর জীবনে আশীর্বাদ বর্ষণ হবে। এমন শিষ্যত্বের দৃষ্টান্ত মানুষের ইতিহাসে অজ্ঞাত নয়।

১৩

মানুষের ব্যক্তিত্ব গান্ধীজীর চিন্তা ও কর্মের লক্ষ্য। সমাজনিরপেক্ষ বুনো মানুষের নয়, যোগের আসনে একক তপস্বী মানুষেরও নয়। সমাজের মধ্যে সামাজিক মানুষের ব্যক্তিত্ব। সে ব্যক্তিত্বের জন্ম ও বিকাশ হয় সমাজের অন্যসব ব্যক্তির আদানপ্রদান প্রীতিমমতার সম্পর্কের বন্ধনে। কিন্তু ব্যক্তিত্ব মানুষের ব্যক্তিত্ব, সমাজের জনসমষ্টির নয়। যে মানুষ সবার উপর সত্য সে মানুষ ব্যক্তিগত মানুষ, মানুষের সমাজ নয়। মহত্ত্ব ব্যক্তির মহত্ত্ব, হীনতা ব্যক্তির হীনতা। ব্যক্তির মহত্ত্ব হীনতার চিন্তা না করে মহৎ সমাজ গড়ার সম্ভাবনার কল্পনা, কাজকে সহজ করার কল্পনা। তাতে কাজ সহজ হয়, কিন্তু কাজ হয় না। সেইজন্য বহুব্যাপী রাষ্ট্রচেষ্টার মধ্যেও গান্ধীজীর দৃষ্টি নিবন্ধ থাকত কেবল চেষ্টার ফলের উপরে নয়, ব্যক্তির মহত্ত্ব—হীনতা বল—দুর্বলতার উপর। এটি একশ্রেণির মার্কসপন্থীর বহুনিন্দিত সমাজসচেতনতার অভাব নয়। সমাজের চরম মঙ্গল ও তার অপরিহার্য উপায়ের সচেতনতা।

ব্যক্তিত্বের উপর গান্ধীজীর এই চরম মূল্যের আরোপ বাঙালির কৃষ্টির আদর্শের অন্তরঙ্গ। ঠিক সেই কারণেই গান্ধীজী মানুষের কাম্য চরিত্রের যে কল্পনা করেছেন তার শুষ্ক সম্পূর্ণতা বাঙালির মনকে পীড়া দিয়েছে। নিকট—আত্মীয়ের তেজোদ্দীপ্ত তপঃশীর্ণা বিধবার মূর্তি মনকে যেমন পীড়া দেয়, কাব্য ও সাহিত্য, শিল্প ও সংগীত—এদের রসজ্ঞতা, জ্ঞানের নিঃস্বার্থ আকর্ষণে উন্মুখতা, জীবনে যে বিচিত্রের আস্বাদ আনে, জীবনকে জৈবিকচক্র থেকে মুক্তির যে আনন্দ দেয়—সে স্বাদ ও আনন্দ গান্ধীজীর আদর্শ মানুষের জীবনে নেই। তার চরিত্রের ঋজু দৃঢ়তা, উদার মৈত্রী, সর্বহিতে কর্মের অক্লান্তি—মনকে শ্রদ্ধায় নত করে, প্রীতিতে পূর্ণ করে না। গান্ধীজী যে সাম্য ও মৈত্রী সমাজ কল্পনা করেছেন তার প্রতিষ্ঠা ও স্থায়িত্বের সামাজিক মানুষের এই চরিত্র হল ভিত্তি ও আশ্রয়। কিন্তু সে সমাজে মানুষের এ রূপ তার পূর্ণাঙ্গ রূপ নয়। এই হচ্ছে সৈনিকের বাহুল্যবর্জিত জীবন। যুদ্ধের উন্মাদনায়, আদর্শে পৌছবার আকুতিতে এ জীবনে লোকে সাময়িক তুষ্ট থাকে; আর কোনও আকর্ষণ, অন্য কিছুর অভাব সে বোধ করে না। সে উন্মাদনা ও আকুতি শিথিল হলেই এ জীবন আর লোককে তুষ্টি দেয় না। তার শীর্ণতার নিরানন্দ জীবনকে বিরস করে। মানুষের সভ্যতার অহৈতুক আনন্দের যা সব বড় সৃষ্টি জীবনে তার জেগান না থাকলে হালকা আমাদের মত্ততা মানুষের মনকে ছোট ও উচ্ছৃঙ্খল করে। সমাজের ভিত্তি চঞ্চল হয়, গড়নে ফাটল ধরে। এমন মানুষ অবশ্য আছে আদর্শের জন্য সংগ্রামের আকুতি যাদের মনের স্থায়ীভাব তাদের সংখ্যা কম। সম্ভব মানুষের আদিম সামরিকতা তাদের মনে এই মঙ্গলময় রূপান্তর নিয়েছে।

যে ব্যক্তিত্বকে গান্ধীজী চরম মূল্য দিয়েছেন তার কল্পনা ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য বাদ দিয়ে ব্যক্তিত্বের কল্পনা। ব্যক্তির মনের ও চরিত্রের মনের ও চরিত্রের বহুমুখিত্ব ও বহুভিন্নমুখিত্বের তাতে স্থান নেই। মূর্তির সুঠাম গড়ন, কিন্তু সকল মূর্তির এক গড়ন। গান্ধীজীর চরিত্রকল্পনার মূলে ছিল তার নিজের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা, আর মানুষের মর্যাদার জন্য যে সংগ্রামের পর সংগ্রামে তিনি যৌবন থেকে বার্ধক্যের শেষসীমা পর্যন্ত রত ছিলেন তার অভিনব সংগ্রামরীতির উপযুক্ত সৈনিক্যের চরিত্রকল্পনা। সে চরিত্র যত শ্রেষ্ঠ হোক, বিশেষ প্রয়োজনসিদ্ধির অনুকূলে উপকরণের ঐকান্তিকতায় সে প্রয়োজন যতই বড় হোক, এ চরিত্রে যে রিক্ততার দৈন্য আসে, গান্ধীজী কি সে সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন না? এমন কল্পনা কি বাস্তব ভিত্তিহীন যে গান্ধীজীর জীবনকাল যদি আরও দীর্ঘ হত, আর তাঁর জীবনকালে এ সংগ্রামের তীব্রতা কিছু কমত, তবে গান্ধীজী তাঁর মানুষের আদর্শে আরও উপাদান আনতেন? যে ব্যক্তিত্ব মানুষের জীবনের তাঁর চরম মাপকাঠি সে ব্যক্তিত্বকে পূর্ণতা দিতেন? গান্ধীজী রবীন্দ্রনাথকে বলতেন গুরুদেব। তাঁর মুখের ডাকেও মৌলিক সন্ধান ও সৌজন্য ছাড়া আর কিছু সত্য নেই, এ কথা মনে করার সাহস হয় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজীর কীসে গুরুদেব? তাঁদের দুজনার সকল মানুষের উত্তর মৈত্রী, সত্যনিষ্ঠা, অহিংসবীর্য তাঁদের মনে গভীর সাজাত্যবোধ এনেছিল। কিন্তু এতে রবীন্দ্রনাথ গান্ধীজীর গুরুদেব ছিলে না। বরং গান্ধীজীর চরিত্রে এদের অচল প্রতিষ্ঠাই রবীন্দ্রনাথকে গান্ধীজীর উপর চরম শ্রদ্ধাশীল করেছিল। এ কল্পনা কি অসংগত যে গান্ধীজী তাঁর আদর্শ—চরিত্রের কল্পনায় যে অসর্ম্পূতা বোধ করতেন রবীন্দ্রনাথের মধ্যে তার পূর্ণতা দেখেছিলেন? রবীন্দ্রনাথ যদি কেবল মহাকবি হতেন, কেবল অসাধারণ সাহিত্যিক অসাধারণ কলাস্রষ্টা ও কলারসজ্ঞ হতেন, গান্ধীজী কখনই তাঁকে গুরুদেব বলতেন না। তাঁর চরিত্রের আদর্শে অসীম অনুরাগী, কিন্তু তার রিক্ততা যাঁর জীবনের আদর্শের পরিপূর্ণতায় পূর্ণ সেই রবীন্দ্রনাথকেই সম্ভব গান্ধীজী বলেছেন গুরুদেব। এ কল্পনা সত্য হোক, মিথ্যা হোক, এ দুয়ের সমন্বয়ের সুস্থ ও সবল, সাম্য ও মৈত্রীর আনন্দময় সমাজ গড়তে পারে। এ সমন্বয় কঠিন। মানুষের ও তার সমাজের সকল সমস্যাই কঠিন। কোনও সমাজে এর কথঞ্চিৎপূর্ণ রূপ যখন কখনও দেখা যায় মানুষের স্বভাব—চঞ্চলতা তার নানা শক্তির দুর্ঘট সাম্যকে অচিরকালেই বিপর্যস্ত করে। তবুও যতকাল থাকে মানুষের তা পরম সম্পদ। এর স্থায়িত্বের দৈর্ঘ্যে এর মূল্য নয়। এর স্বল্পও ‘ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ’—কাপুরুষের হীনতা ও কঙ্কালের রিক্ততার ভয় থেকে মানুষের সমাজকে রক্ষা করে।

বিশ্বভারতী পত্রিকা, মাঘ—চৈত্র ১৩৫৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *