গান্ধীজীর ”ষ্টাইলই” তার চরিত্র – মঈনউদ্দীন চিশতী

গান্ধীজীর ”ষ্টাইলই” তার চরিত্র – মঈনউদ্দীন চিশতী

ইংরেজিতে একটা সুপরিচিত কথা আছে, Style is the man himself’—ষ্টাইলের মধ্যেই মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া যায়। কথাটা মিথ্যা নয় বললেও সব বলা হয় না। আমাদের দেশের আলঙ্কারিকেরা বলেছেন—কাব্যের আত্মা হল ‘রীতি’। কাব্যের আত্মা রীতি তো নিশ্চয়ই, কবির আত্মা রীতি, কবির এবং মানুষের ষ্টাইলের বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে ‘রীতি’ কথা ব্যবহার করা সঙ্গত নয়। ‘রীতি’ হল ভাষার দোষগুণ বিচার, ষ্টাইল কিন্তু ঠিক তা নয়। ষ্টাইল তার চাইতে আরও অনেক বড় জিনিস। বিষয়বস্তুর বিশিষ্টতার জন্য, প্রেরণার বৈচিত্র্যের জন্য, একই লেখকের রচনার রীতির তারতম্য হওয়া স্বাভাবিক। কোথাও ভাষার গতি খরস্রোতা নদীর মতন স্বচ্ছ সাবলীল, কোথাও ‘শান্ত শ্যাম স্তব্ধ সুগম্ভীর’, কোথাও বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের মতন উত্তাল তার ভঙ্গিমা ভয়ঙ্কর অথচ অদ্ভূত সুন্দর। ওজস, গুণ, প্রসাদ ও শ্লিষ্টতা গুণ, গাঢ়বন্ধতা—এসব হ’ল ভাষার গুণাগুণ। ষ্টাইল এই ভাষাগত গুণাগুণের এক অপূর্ব সমন্বয়, যার মধ্যে প্রেরণার সঙ্গে মানুষের ভিতরের প্রাণটিও নিরাভরণ মূর্তিতে প্রকাশ পায়। ‘ষ্টাইল’ ভাব ও ভাষার মিলনে এমনই এক অভিনব সৃষ্টি যার মধ্যে স্রষ্টার সম্পূর্ণ সত্তাটি চেনা যায়। ‘রীতি’ তাই ‘ষ্টাইলের’ প্রতিশব্দ হতে পারে না। লেখকের চরিত্র ব্যাত্ত্বি, লেখকের মেজাজ আবেশ দৃষ্টিভঙ্গি, সমস্ত এই ‘ষ্টাইলের’ প্রতিশব্দ হতে পারে না। লেখকের চরিত্র, লেখকের ব্যক্তিত্ব, লেখকের মেজাজ আবেশ দৃষ্টিভঙ্গি, সমস্ত এই ‘ষ্টাইলের’ মধ্যে ধরা পড়ে যায়। এ—রকমটি আর কোথাও ধরা পড়ে না। রীতি ষ্টাইলের একটা অপরিহার্য অঙ্গ হতে পারে, কিন্তু ষ্টাইলের সর্বস্ব নয়। ”ভাব পেতে চায় রূপের মাঝারে অঙ্গ, রূপ পেতে চায় ভাবের মাঝারে ছাড়া”—ষ্টাইল কতকটা তাই। ষ্টাইলকে তাই অলঙ্কারিকদের রীতি—বিচারের মতন বিচার বা ব্যাখ্যা করা যায় না। কোন মানুষকে যেমন সম্পূর্ণ চিনতে পেরেছি বলা ভুল, তেমনি ষ্টাইলকেও অলঙ্কার—শাস্ত্রের নিয়মে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া ভুল। মনের মানুষটি যেমন ধরা দিয়েও একেবারে ধরা পড়তে চায় না, কাছে এলেও যেমন মনে হয় দূরে—বহু দূরে ধরা—ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে, বড় বড় মানুষের ব্যক্তিসত্তার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব তার গভীর সান্নিধ্য, তার হাব—ভাবে কথা—বার্তায় কাজ—কর্মে অথবা ভাব—প্রকাশের বিশেষ ভঙ্গিমার মধ্যে প্রতিফলিত হলেও এ কথা বলা যায় না, সে ব্যক্তিটিকে একেবারে ইট—পাথরের মতন চিনে ফেলেছি, অথবা কারও ব্যক্তিসত্তাকে একেবারে মুঠোর মধ্যে বন্দী করে ফেলেছি। আরশিতে যে চেহারাটা দেখা যায় সেটা আসল চেহারার একটা অতি—নিকট নকল চেহারা মাত্র। আসল মানুষের রক্ত—মাংসের তপ্ত স্পর্শ তার মধ্যে কখনই প্যায়া যেতে পারে না। প্রাণের শ্বাস—প্রশ্বাস তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া বৃথা। তবু বলা যায়, আরশির চেহারাটা ফটোগ্রাফ নয়। আসল মানুষটা সামনেই আছে, কাচের সাধ্য নেই অবশ্য যে তার শ্বাস—প্রশ্বাসের উষ্ণতা বিচ্ছুরিত করে, অথবা তার প্রাণের স্পন্দন প্রতিধ্বনিত করে। তবু শ্বাস—প্রশ্বাসের তালে তালে বক্ষঃস্থলের যে ওঠা—নামার ছন্দ তা ঐ আরশির মধ্যেই প্রতিফলিত হয় রক্ত—মাংসের গন্ধ বা উষ্ণতা না বিচ্ছুরিত হলেও তার আভাটা সেখানে নিশ্চয়ই ফুটে ওঠে। ক্যামেরার চাইতে আরশির ক্ষমতা এই দিক দিয়ে বিচার করলে অনেক বেশি। আরশির কাছাকাছি আসল মানুষটিকে সব সময় থাকতে হয়। ‘ষ্টাইলকে’ তাই ‘আরশির’ সঙ্গে তুলনা করলে ভুল করা হয় না। এর অত্যন্ত কাছাকাছি আসল মানুষটি সব সময়ই থাকে, তার প্রাণের স্পন্দন, তার রক্ত—মাংসের জীবন্ত সত্তাকে তার মধ্যে অনুভব করা যায়। তপ্ততার অনুভূতিটুকু কল্পনাসাপেক্ষ। ‘ষ্টাইল’ তাই আরশি তো নিশ্চয়ই, ভেনিসিয়ান আরশি।

‘ষ্টাইল’ সম্বন্ধে এর বেশি প্রগোক্তির প্রয়োজন নেই। এখানে এটুকুর প্রয়োজন ছিল সেই জন্য, গান্ধীজীর ব্যক্তিত্ব তাঁর ষ্টাইলের মধ্যে যে ভাবে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়, এমনটি আর কোথাও দেখা যায় না। অথচ গান্ধীজীর ব্যক্তিত্বকে অনির্বচনীয়, তা ভাষায় প্রকাশ করার শক্তি কোন শিল্পীরও নেই। তবু যে সব গুণাগুণ নিয়ে তাঁর ব্যক্তিত্বের বিকাশ হয়েছে, তার চরিত্র পূর্ণতা লাভ করেছে, কোটি কোটি মানুষের মধ্যে তিনি ‘একটি মানুষ’ হিসাবে সূর্যের মতন প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছেন, এই সমস্ত গুণাগুণের অনেকটা পরিচয় তাঁর লেখার ষ্টাইলের মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। তবু এ কথা বলতেই হবে, গান্ধীজীর ব্যক্তিগত জীবনের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে যাঁরা আসেননি, তাঁদের পক্ষে ষ্টাইলের ভিতর দিয়ে তাঁর ব্যক্তিত্বকে চিনতে পারা সাধনাতীত ব্যাপার। তা’হলেও চিনতে পারা যায় না তা নয়, ‘চোখ’ যদি সজাগ থাকে, ‘মন’ যদি উন্মুখ হয়, তা’হলে চেনা নিশ্চই যায়, অবশ্য সে—চেনা যদিও আরশির ভিতর দিয়ে চেনার মতনই হবে। তাই গোড়াতেই বোঝা প্রয়োজন যে, ‘ষ্টাইল’ আরশি ছাড়া আর কিছুই নয়, যদিও সেটা ভেনিসিয়ান আরশি।

আরও একটা কথা ‘প্রাগোক্তি’ হিসাবে বলা এখানে বিশেষ প্রয়োজন। গান্ধীজীর যে ষ্টাইলের কথা এখানে বলা হবে সেটা হ’ল তাঁর ইংরেজী ‘ষ্টাইল’। গান্ধীজীর মাতৃভাষা ইংরেজি নয়, হিন্দুস্থানীও নয়। গান্ধীজীর মাতৃভাষা গুজরাটী। ভারতীয় ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে গুজরাটী ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী। কিন্তু গুজরাটী ভাষায় গান্ধীজীর লেখার বা বক্তৃতা করার সুযোগ জীবনে বিশেষ হয়নি। গুজরাটী ভাষায় তাঁর রচনা বা বক্তৃতা যে নেই তা নয়, আছে। তাঁর ব্যক্তিত্বের ঘনিষ্ঠতম পরিচয় সেই গুজরাটী ষ্টাইলের মধ্যে পাওয়া যাবে। গুজরাটী ষ্টাইলটাই হল গান্ধীজীর ব্যক্তিত্বের ভেনিসিয়ান আরশি। হিন্দুস্থানী বা ইংরেজি আর যাই হোক, ভেনিসয়ান আরশি নিশ্চয়ই নয়! কিন্তু গান্ধীজীর রচনা বেশি ভাগই হ’ল ইংরেজি ভাষায় লেখা। সেই রচনার ষ্টাইলের ভিতর দিয়েই তাঁকে এ দেশের এবং বিদেশের অধিকাংশ লোক চেনে। ইংরেজি ভাষাকে তিনি যে রকম আপনার ক’রে নিয়েছিলেন তাতে অনেক ইংরেজও লজ্জিত হবেন। এখানে সব চেয়ে বড় কথা হ’ল, ইংরেজি ভাষাকে যে তিনি শুধু আত্মসাৎ করেছিলেন তা নয়, ইংরেজ জাতের যা কিছু বৈশিষ্ট্য ও মহত্ত্ব তাও তাঁর মতন এমন ভাবে একেবারে আপনার করে নিতে কাউকে দেখা যায়নি। তাঁর চরিত্রের যে নিয়মানুগত্য, যে শৃংখলা ও সংযমবোধ, যে নিষ্ঠা ও একাগ্রতা তা ভারতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য নয়। ভারতীয় চরিত্রের যে ঐতিহাসিক ঢিলেমি ও দীর্ঘসূত্রতা তার ছিটেফোঁটাও ছিল না তাঁর মধ্যে। এ দেশের রাজা—বাদশারা, সাধক—সংস্কারকরা জীবনটাকে দেখেছেন ‘শাশ্বতের’ পটভূমিতে—’মহাকালের’ পরিপ্রেক্ষিতে। গান্ধীজী কোন দিনই তা দেখেননি। বাইরের জগতেও না, বক্তিগত জীবনেও না। তাই মহাসাধক হলেও তাঁকে বিপ্লবী মহাসাধক বলে খুব অন্যায় হয় না। ”শাশ্বতের” নয়, গান্ধীজীর জীবনে ”ঘড়ির” মূল্য অসাধারণ। ‘মহাকাল’ নয়, প্রত্যেকটা দিন, ঘণ্টা, মিনিট পর্যন্ত তাঁর কাছে মূল্যবান। তাঁর খাওয়া—শোয়া, বিশ্বাম, কাজ—কর্ম, প্রার্থনা পর্যন্ত সবই ঘড়ির কাঁটা ধ’রে, মহাকালের বৈঠা ধ’রে নয়। এটা এদেশি রীতি নয়। এটা পাশ্চাত্য রীতি। এইভাবে পাশ্চাত্য সভ্যতার শ্রেষ্ঠতার সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে তিনি আত্মসাৎ করেছিলেন। আশ্চর্য! যিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার ”যন্ত্রকে” দানব ভেবে কোনো দিন অভিনন্দন জানাতে পারেননি, তিনি মনে—প্রাণে এমন বাবে ‘যান্ত্রিক নিয়মানুগত্য’কে গ্রহণ করলেন কি করে’? বিদেশির জাতীয় বিশিষ্টতাকে এই ভাবে আত্তীকরণের অসাধারণ ক্ষমতা যাঁর আছে, একমাত্র তাঁর পক্ষেই বিদেশির মাতৃভাষাকে নিজের মাতৃভাষার নতমন আয়ত্ত করা সম্ভবপর। তা ছাড়া, আদর্শ ইংরেজের মতন এতটা আপনার ক’রে ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করার মধ্যেই গান্ধীজীর ঐকান্তিক সার্বজাতিকতাবোধ প্রকাশ পেয়েছে বলা চলে। বিশ্বমানবতাবোধ যাঁর অস্থি—মজ্জায় মিশে যায় তিনি যে গুজরাটী এবং ভারতীয় হয়েও ইংরেজি ষ্টাইলের প্রবর্তক হবেন, তাতে বিস্ময়ের বিশেষ কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ এবং শ্রীঅরবিন্দও তো বাঙালি। কিন্তু তাঁদের ইংরেজি ‘ষ্টাইল’ কি তাঁদের সর্বজনীন ব্যক্তিত্বের প্রকাশ নয়? এ সব কথা স্বীকার করেও বলতেও হবে, অন্তত সত্যের খাতিরে যে, ইংরেজি ভাষা এ দেশের মাতৃভাষা নয়, তাই ‘ইংরেজি, ষ্টাইলও’ এদেশ কারও ব্যক্তিত্বের ভেনিসিয়ান আরশি নয়, যদিও আরশি নিশ্চয়ই।

এই ক’টি কথা মনে রেখে আমরা এখানে গান্ধীজীর ইংরেজি ষ্টাইলের আলোচনা করব। অবশ্য আলোচনাটা ঠিক ষ্টাইলের সাহিত্যিক বিচার নয়, তা স্বল্প—পরিসরে করা সম্ভবও নয়, এখানে তার প্রয়োজনও বিশেষ নেই। এখানে সেই ষ্টাইলের মধ্যে গান্ধীজীর চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব কতটা ফুটে উঠেছে তারই বিচার করব। বিচার—প্রসঙ্গে দেখব, ইংরেজি ষ্টাইলটা গান্ধীজীর ব্যক্তিত্বের কাছে ভেনিসিয়ান আরশি না হলেও, বেশ ঝকঝকে পরিষ্কার আরশি। তার মধ্যেই তাঁর আসল সত্তাটি চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর মাতৃভাষায় লেখা রচনার ষ্টাইলের মধ্যে নিশ্চয়ই তাঁর সত্তার গভীরতম পরিচয়ই পাওয়া যাবে. কিন্তু এখানে গুজরাটী রচনার উল্লেখ না ক’রে আমরা ইংরেজি রচনা উদধৃত করব কেন তা আগেই বলেছি। খুব বেশি উদধৃতির প্রয়োজন নেই, কারণ গান্ধীজীর ‘ষ্টাইল’ একটি, তাঁর ষ্টাইলের মূলগত বিশিষ্টতাও একটি এবং তাঁর ব্যক্তিত্বও এক ও অবিভাজ্য. সুতরাং তাঁর প্রায় প্রত্যেক রচনার মধ্যেই একই ‘ষ্টাইল’ প্রকাশ পাবে, এবং সেই ষ্টাইলের মধ্যে তাঁর ব্যক্তিত্বও ফুটে উঠবে। তাই ষ্টাইলের নমুনা হিসাবে কতকগুলি দৃষ্টান্ত দিলেও যা কাজ হবে, দু—একটি দৃষ্টান্ত দিলেও তার চাইলে কিছু কম কাজ হবে না।

গান্ধীজীর ইংরেজি ষ্টাইল ও তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে কিছু বলার আগে, এ যুগের ইংরেজি ষ্টাইলের দু’—এক জন যুগপ্রবর্তকদের রচনা উল্লেখ করব। এক জন টি. ই. লরেন্স (ডি. এইচ,—নন), আর একজন উইনষ্টন চার্চিল। এই দু’জনেই ইংরেজ জাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দু’টো দিকের প্রতিমূর্তি। টি. ই—র মধ্যে ইংরেজ জাতির ঐতিহাসিক চরিত্র পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে, সে—চরিত্রের জন্য ইংরেজদের জাতিগত শ্রেষ্ঠতা আজও রাজনৈতিক কারণে আমাদের দেশের কোন ইংরেজ—বিদ্বেষী ও অস্বীকার করতে পারেন না। সেই চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হল নিষ্ঠা, নির্ভীকতা, উদারতা ও স্পষ্টতাবাদিতা। টি. ই. লরেন্সের চরিত্রে এই বৈশিষ্ট্যগুলি পূর্ণমাত্রায় ছিল। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা তাঁকে আরবদের সংঘবদ্ধ ক’রে যুদ্ধে নামাবার জন্যে পাঠিয়েছিল এবং প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে যুদ্ধের পরে আরবদের স্বাধীনতা দেওয়া হবে. যুদ্ধে জয় হবার পর ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করল না। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীরা হ’ল স্বতন্ত্র জাতের, সেখানে ইংরেজ, জাতের বৈশিষ্ট্য নিশ্চয়ই তা নয়। তাই টি. ই. যুদ্ধের খেতাব বর্জন করলেন, সৈনিকের জীবন থেকেও অবসর গ্রহণ করলেন এবং শেষে ‘‘Seven Pillars of Wisdom’’ নামক বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থে আরবদের সঙ্গে তাঁর জীবনের এই বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনী লিপিবদ্ধ ক’রে গেলেন। টি. ই’র নিজের ভাষাতে বলতে গেলে, ‘‘The book is just a designed procession of Arab freedom from Mecca to Damascus’’ তাই লেখা যখন হ’ল তখন উইনষ্টনের মতন লোকও বলতে বাধ্য হলেনঃ

‘‘It ranks with the greastest books ever written in the English language…It will take its place at once as an English classic. His books will be read as long as te English language is spoken.’’

পূর্ব কথাটি ঠিক। এক একটা যুগে এ রকম অমর রচনা সৃষ্টি হয় হয় কি না সন্দেহ। কিন্তু ” সেভন পিলাস” ইংরেজি ভাষায় যদি অমরত্ব লাভ করে তা হলে তা করবে শুদু এই জন্যে যে, ইংরেজের জাতীয় চরিত্রের যা কিছু শ্রেষ্ঠ ও মহৎ তা টি, ই’র চরিত্রে ছিল এবং তাঁর সেই চরিত্র, সেই আদর্শ সত্তা ও ব্যক্তিত্ব তাঁর ষ্টাইলের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে। ইংরেজি ভাষা এবং ইংরেজ জাতের অস্তিত্ব যত দিন থাকবে তত দিন টি. ই’র সেভন পিলার্স সকলে মহাকাব্যের মতন পড়বে, যদিও তা যুদ্ধের কাহিনি মাত্র। গ্রামের ভূমিকাতে টি. ই. তাঁর নিজস্ব অননুকরণীয় ষ্টাইলের লিখছেন:

‘‘We were fond together because of the sweep of the open places, the taste of wide winde, the sunlight, and the hopes in which we worked. The morning freshness of the world-be intoxicated us. were wroght up with ideas inexpressible and vaporous, but to be fought for. We lived many lives in those whirling campaigns, never sparing ourselves : Yet when we achieved and the new world dawned, the old men came out again and took our victory to remake in the likeness of the former world they knew….We itstammeved that we had worked for a new heaven and a new earth, and they thanked us kindly and made their peace.’’

এ রকম অজস্র দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় এবং না দিলে যেন খুশি হওয়া যায় না। এ শুধু এক জন ইংরেজের ষ্টাইল নয়, এ যেন ইংরেজ জাতের জাতীয় ষ্টাইল। ইংরেজ জাতির যা কিছু মহত্ত্ব তা যেন এই ষ্টাইলের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। স্পষ্টবাদিতা, নির্ভীকতা, পরিচ্ছন্নতা, উদারতা এবং সবার উপরে কঠোরতা—জনিত গাঢ়বন্ধতা, কিছুরই অভাব নেই এই ষ্টাইলের মধ্যে। ঠিক এরই পাশে উইনষ্টন চার্চিলের ‘ষ্টাইলে’র নমুনা যদি তুলে দেওয়া হয়ে ওঠে। গান্ধী—আরউইন প্যাক্ট সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে বিলেতে রক্ষণশীলদের এক সভায় চার্চিল সাহেব বলছেনঃ

‘‘It is alarming and also nauseating to see Mr. Gandhi, a seditious Middle Temple Lawyer, now posing as a fakir of a type well-knwon in the East. striding half-naked up the steps of the Viceregal place. while he is still organising and conducting a sefiant campaign of civil disobedience, to parley on equal terms with the representative of the King Emperor…These are his well known aims. Surely they form a strange basis for heart to heart discussions—‘Sweet’ we are told they were—between this malignant’ subversive fanatic and the Viceroy of India.

টি. ই.র আগেকার উদ্ধৃতির সঙ্গে চার্চিলের এই ভাষার তুলনা করলে বোঝায় যায়, একটা ইংরেজ জাতির ভাষা আর একটা দাম্ভিক, গর্বোদ্ধত, অভিজাতবংশীয় সাম্রাজ্যবাদীর ভাষা, যার কোন জাত নেই। চার্চিল ইংরেজি ষ্টাইলের মাষ্টার, কিন্তু তা’হলেও এ কথা বলতেই হবে যে, তাঁর রচনা অথবা বক্তৃতার মধ্যে ইংরেজের জাতীয় চরিত্রের সামান্যই প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু টি. ই’র ষ্টাইল তা নয়। টি. ই’র ষ্টাইলের মধ্যে ইংরেজ জাতির অন্তরাত্মার স্পন্দন পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হ’চ্ছে। গান্ধীজী যে ইংরেজি ষ্টাইলের প্রবর্তক, যে ষ্টাইলকে তিনি আত্মসাৎ ক’রে আপনার করে নিয়েছিলেন, সে হ’ল ইরেজ জাতের ষ্টাইল। চার্চিলের শ্রেণিগত ষ্টাইল নয়, টি. ইর জাতীয় ষ্টাইলের ধারাই গান্ধীজীর ধারার সঙ্গে এক হয়ে মিশে গেছে। তার কারণ, ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের প্রতি গান্ধীজীর বিরোধিতা গোটা ইংরেজ জাতির প্রতি অন্ধ বিদ্বেষে পরিণত হয়নি কোন দিন। কোন বিশেষ শ্রেণির ঔদ্ধত্য বা অন্যায় তাঁর বিশ্বমানবতাবোধ হিংসা—দ্বেষের মলিন স্পর্শে কলঙ্কিত করতে পারেনি। তাই তিনি কিছু আগেও লিখেছেনঃ

But it is no use brooding over the past or British mistakes. It is more profitable to look within. The British will take care of themselves, if we will take care of ourselves. Our mistakes or rather defects are many. Why blame the British for our own limitations ? Attainment of Independence is an imposiblility till we have solved the communal tangle. There are two ways of soling that has almost become insoluble. The one is the royal way of non-violence, and the other violence.

এই হ’ল গান্ধীজীর ষ্টাইল, চার্চিল যাঁকে ‘‘Seditious Middle Temple Lawyer, now posing as a fakir এবং ‘‘Malignant aubversive fanatic’’ বলেছেন। আশ্চর্য এই যে, ”ফকির—বেশধারী মিডল টেম্পলের— বারিষ্টার” গান্ধীজীর আজীবনের রচনাবলীর মধ্যে ‘malignant’ ‘subversive’ বা ‘fanatic’-এর কোন পরিচয়ই পাওয়া যায় না যদিও চার্চিলের প্রত্যেকটি রচনার মধ্যে এই সব ক’টি উপবর্গই অত্যন্ত প্রকট। চার্চিলের জাত্যভিমান, শ্রেণি—আভিজাত্য ও ঔদ্ধত্য, লর্ড বংশের ‘ম্যালিগন্যাণ্ট’ রক্তের প্রবাহ, কোনটাই গান্ধীজীর মধ্যেই নেই। এ কথা ঠিক যে, তিনি ফকির এবং ‘‘of a type well-known in the East’’, কিন্তু সেটা তাঁর pose’ নয়, যেমন ইংরেজের জাত্যভিমানটা চার্চিলের কাছে ”পোজ” বা ভান মাত্র, কিন্তু ইংরেজের মতন ইংরেজ টি, ই’র কাছে কখনই নয়। পাশ্চাত্য সভ্যতার ‘creation’ বা সৃষ্টি তাই চার্চিলারা নন, কয়েক জন মাত্র টি. ই. লরেন্স। চার্চিলেরা হলেন ‘Slag’ এবং ‘by-product’ মাত্র। এই স্লাগ গান্ধীজী আর্বর্জনার মতনই বর্জন করেছেন, তাই তাঁর ষ্টাইলে মেকলে—গ্লাডষ্টোন—চার্চিলের ছোঁয়াচ লাগেনি।

শুধু বিদেশের চার্চিলদের নয়, এ দেশের চার্চিলিয়ান মেজাজের অনেক নেতার তীক্ষ্ন বাণের খোঁচাতেও তাই গান্ধীজীর ষ্টাইলের মধ্যে ‘ম্যালিগন্যাণ্ট ফ্যানাটিকের’ বিরক্তি বা শ্লেষ কটূক্তি বা হটোক্তি, কিছুরই পরিচয় পাওয়া যায়নি। হিন্দু মুসলমানের একতা এবং ভারতের একজাতিত্বে গান্ধীজীর অগাধ বিশ্বোসের উত্তরে একবার জিহ্না সাহেব তাঁকে লেখেন:

‘‘I, however, regret to have to say that your premises are wrong as you start with the theory naturally, therefore, your conclusions are wrong…There is so much in your article which is the result of imagination. It is due partly to the fact that you are living a secluded life at Segaon and partly because all your thoughts and actionss are guided by ‘inner voice‘. You have very little concern with realities, or what maight be termed by an ordinary mortal ‘partical politics’… Events are moving fast, a campaign of polemics, or your weekly discourse in the Harijan on Metaphysics, philosophy and ethics, or your peculiar dectrines regarding Khadders, ahimsa and spinning are not going to win India’s freedom. Acting and statesmanship alone will help us in our foward march.

এর পাশে গান্ধীজীর রচনা তুলে দিচ্ছি:

‘‘There was a time when every Muslim was professing that India was his motherland. The Ali brothers belived in it. I am not prepared to believe for a moment tht it was a lie or bluff. I would prefer to be ignorant Mother than to doubt my collegues…From my childhood, I am a firm believer in Hindu-Muslim and communal unity…When I had been to Africa, I undertook a brief for a Muslim client. I campioned their cause there. I never distrust them. I did not return from Africa as a disappointed or as a defeated man. I do not care for the abuses which are being hurled on me by some of my Muslim friends. I do not know what I have done that has offended them…I dine with the Muslims. I dine with all without any consideration to their caste or religion. I hate none and there is no hatred in me…Jinnai Sabhib has been a congressman in the past. He seems now to be misguided. I pray long life for him and wish that he may survive me. A day will certainly dawn when he will realise that I have never wronged him or the Muslims. I have the fullest confidence in the sincerity of the Muslims. I will never talk ill of them even if they kill me.’’

জিন্না সাহেবের ষ্টাইলের মধ্যে তাঁর চরিত্রগত সমস্ত বৈশিষ্ট্য চমৎকার ফুটে উঠেছে। তিনি যে প্র্যাকটিকাল পলিটিসিয়ান এবং কল্পনার ধারও ধারেন না, তা বেশ হাড়ে—হাড়ে মালুম হয়। তাঁর হতাশা—জনিত বিরক্তির ভাব তাঁর ষ্টাইলে সুস্পষ্ট। তাঁর চারিত্রিক কাঠিন্য ও রুক্ষতাও তাঁর প্রত্যেকটি শব্দ—ঝঙ্কারের মধ্যে ফুটে উঠেছে। সহনশীলতা, উদারতা এবং সম্প্রীতিবোধের শোচনীয় অভাবও তাঁর নিষ্ঠুর শ্লেষোক্তির মধ্যে সুপরিস্ফুট। উদ্ধত, ম্যালিগন্যাণ্ট এবং ফ্যানাটিক চার্চিলের ভারতীয় সংস্করণ যে জিন্না সাহেব, তা তাঁর ও চার্চিলের ষ্টাইলের ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায়।

গান্ধীজীর ষ্টাইল ঠিক এর বিপরীতধর্মী। কারণ গান্ধীজীর চরিত্র চার্চিল—জিন্নার বিপরীত। গান্ধীজীর চরিত্র সরলস্বভাব শিশুর মতন, তাই তাঁর রচনাও যেন শিশুকণ্ঠের কাকলি। তার মধ্যে অভিমান আছে, আত্মাভিমান নেই, গভীর অনুভূতি আছে, ফ্যানাটিকের উন্মত্ততা বা সস্তা ভাব—প্রবণতা নেই। তার মধ্যে যুক্তি আছে, সে যুক্তি অচল অটল আত্মবিশ্বাসের প্রাঞ্জল যুক্তি, হিসাবনিকাশের শুকনো নীরস লড়বড়ে যুক্তি নয়। তার মধ্যে শ্রেণি, জাতি বা ধর্মের সঙ্কীর্ণতা নেই, ঔদ্ধত্য বা গোঁড়ামি নেই, তাই তাঁর ষ্টাইলের মধ্যে ভুলেও কখন নিষ্ঠুর শ্লেষ খো যায় না, উদারতার দিগন্তলীন মহাসমুদ্রে সব অভিযোগ মিলে—মিশে একাকার হয়ে যায়, সত্যের নির্মল দিবালোকের মতন তাঁর উক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আগেই বলেছি, এ ষ্টাইল মেকেল—গ্লাডষ্টোন—চার্চিলের ষ্টাইল নয়, জিন্না সাহেবেরও নয়। এ ষ্টাইল শিশুখৃষ্টের ষ্টাইল রামকৃষ্ণ—চৈতন্যের ষ্টাইল। এ ষ্টাইল প্রাচ্যের পাশ্চাত্য ষ্টাইল, যেখানে পূব আর পশ্চিম দেওয়া—নেওয়া এক হয়ে গেছে। টি. ই’র ষ্টাইলে যে ইংরেসুলভ কঠোর গাঢ়বন্ধতা আছে, গান্ধীজীর ষ্টাইলে তা নেই। গান্ধীজীর ষ্টাইলে আছে। পশ্চিমের আত্মবিশ্বাস, নির্ভীকতা, স্পষ্টবাদিতা এবং তার সঙ্গে আত্মার মতন অদৃশ্য ভাবে মিশে আছে প্রাচ্যের বিনয় ভাব কুণ্ঠা ও নম্রতা। গান্ধীজীর ষ্টাইলই তাই তাঁর চরিত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *