গান্ধীজীর পাঠ-চর্চা – চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
গান্ধীজী তাঁর আত্মকথায় বলেছেন: ”বিদ্যাভ্যাস কালে আমি পাঠ্য—পুস্তকের বাইরে কিছুই পড়ি নাই বলা যায়। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিবার পরও খুব কম পড়িয়াছি। এমনকি আজও এ—কথা বলা যায় যে, আমার পুস্তকের জ্ঞান খুবই কম। এই অনায়াসলব্ধ বা বাধ্যতামূলক সংযম দ্বারা আমার ক্ষতি হয় নাই বলিয়াই আমি মনে করি। যে অল্পস্বল্প পুস্তক পড়িয়াছি তাহা আমি ভাল রকম হৃদগত করিয়াছি এ—কথা বলা যায়।”
গান্ধীজী জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভের জন্য প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার পক্ষপাতী ছিলেন। তাই তিনি নিজের জীবনকে দেখেছেন সত্যের পরীক্ষা হিসাবে। নিজের অভিজ্ঞতা অথবা চিন্তাধারারর সমর্থন কোনো বই থেকেপেলে তিনি নতুন প্রেরণা লাভ করতেন। ভালো বই তাঁর কাছে ছিল প্রতিভার দীপশলাকা। মহৎ চিন্তার সংস্পর্শে এসে পাঠকের মন উজ্জীবিত হয়; চারপাশে যখন সংশয় ও অবিশ্বাস তখন একটি ভালো বই প্রত্যয়ের সঞ্জীবনী নিয়ে আসে। যেসব বই গান্ধীজীর চিন্তা ও কর্ম প্রভাবান্বিত করেছে তাদের ঋণ তিনি স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হননি। এইসব বই—এর কথা আলোচনা করলে গান্ধীজীর চিন্তাধারার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস স্পষ্টতর হবে। তাছাড়া চিন্তাক্ষেত্রে গান্ধীজীর সমধর্মী কারা ছিলেন তা—ও পাঠপঞ্জি থেকে জানা যেতে পারে। এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন, যে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে যেসব লেখকের মিল আাছে শুধু তাঁদের বই—ই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। গান্ধীজীর মনের ক্ষেত্র পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল; তাই রাস্কিন কিংবা টলস্টয়ের বই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পেরেছে। এছাড়াও কত ভালো বই হয়তো গান্ধীজীর হাতে কাছেই ছিল। কিন্তু তারা গান্ধীজীকে প্রভাবান্বিত করতে পারেনি। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গান্ধীজী মার্কস—এর ‘ক্যাপিটাল’ পড়েননি। সরে পড়েছেন বলে শুনেছি; কিন্তু এ বই নিয়ে বিশেষ আলোচনা করেননি।
তবে গান্ধীজী যত কম বই পড়েছেন বলে জানিয়েছেন গ্রন্থজগতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় প্রকৃতপক্ষে তত কম ছিল না। তাঁর পিতার বই—এর জ্ঞান অপেক্ষা ব্যবহারিক জ্ঞান ছিল অধিক। তাই ছেলেবেলায় পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্য বই—এর প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করবার কেউ ছিল না। লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়বার সময় (১৮৮৮—১৮১৯) নানা লোকের সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ের বই পড়তে আরম্ভ করেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকবার সময়ও তাঁর বই পড়বার সুযোগ হয়েছে। ভারতে ফিরে তিনি কর্মস্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন থেকে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সম্পর্কিত পুঁথিপত্রই তিনি প্রধানত পড়েছেন। সময়ের অভাবে অন্যান্য বইপত্র বিশেষ পড়তে পারেননি। জেলে যখন বাধ্যতামূলক অসবরলাভ করেছেন তখন কিছু কিছু বই পড়বার সুযোগ পেয়েছেন।
বিচিত্র ধরনের বই সম্বন্ধে যে গান্ধীজীর আগ্রহ ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় মহাদেব দেশাই—এর দিনলিপি থেকে। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে যখন য়ারবেদা জেলে ছিলেন তখন গান্ধীজী জানতে চান জেল লাইব্রেরিতে স্কট, মেকলে, জুলে ভার্ন, ভিক্টর হুগোর বই এবং কিংসলির ‘ওয়েস্টওয়ার্ড হো’ এবং গ্যেটের ‘ফাউস্ট’ আছে কিনা। লাইব্রেরি থেকে এডওয়ার্ড কার্পেন্টার—এর ‘অ্যাডামস পিক টু এলিফ্যান্টা’ এবং নিবেদিতার ‘ক্র্যাডল টেলস অব হিন্দুইজম’ তাঁকে এনে দিতে বলেন। গান্ধীজী আরো বলেন যে, আফ্রিকার জেলে তিনি প্রথম স্টিভেনসনের ‘দি স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডাঃ জেকিল অ্যান্ড মিঃ হাইড’ পড়েছেন। জেল লাইব্রেরিতে স্টিভেনসনের ‘ভার্জিনিবাস পুয়েরিস্ক’ (বালক—বালিকাদের জন্য প্রবন্ধের বই) আছে জেনে গান্ধীজী বললেন, এই বই নিশ্চয়ই পড়বার যোগ্য।
ছেলেবেলায় সাধারণ স্কুলপাঠ্য বই ছাড়া অন্য কিছু পড়বার আগ্রহ গান্ধীজীর ছিল না। পাঠ্যতালিকায় বাইরে যে বই সর্বপ্রথম তাঁক আকৃষ্ট করে সেটি হল ‘শ্রবণের পিতৃভক্তি’ এই নাটকটি তাঁর বাবা কিনেছিলেন। বইটি তিনি পড়েছিলেন বিশেষ আগ্রহের সঙ্গে। এর পরে আর কি কি বই তিনি পড়েছিলেন তা জানা যায় না।
নতুন অধ্যায় আরম্ভ হয় লন্ডনে। ইংলন্ড প্রবাসের এক বছর পরে গান্ধীজীর দু’জন থিয়োসফিস্টের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁরা গান্ধীজীকে গীতা পাঠের জন্য আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু তিনি তখনও মূল সংস্কৃত অথবা গুজরাটি অনুবাদে গীতা পাঠ করেননি। এই থিয়োসফিস্ট ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে তিনি প্রথম গীতা পাঠ আরম্ভ করেন। ক্রমশ গীতা তাঁর নিত্যসঙ্গী হয়ে পড়ে। গান্ধীজীর জীবনে গীতার প্রভাব অসামান্য। তিনি বলেছেন, ”তখন আমার মনে হইল যে, ভগবদগীতা অমূল্য গ্রন্থ। তত্ত্বজ্ঞান সম্বন্ধে উহাকেই আমি সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বলিয়া মনে করি। আমার নিরাশার সময় ঐ গ্রন্থ হইতে অমূল্য সাহায্য পাইয়া থাকি।”
গান্ধীজী গীতার প্রায় সকল উল্লেখযোগ্য ইংরেজি অনুবাদই পড়ে ফেললেন। এডুইন আর্নল্ডের অনুবাদ Song Celestial তাঁর নিকট শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে গীতার প্রতি তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন আর্নল্ডের অনুবাদের মাধ্যমে। কারণ প্রথমে তাঁর সংস্কৃত জ্ঞান মূল গ্রন্থের মর্ম গ্রহণের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না।
এডুইন আর্নল্ডের ‘বুদ্ধচরিত’ বা ‘দি লাইট অব এশিয়া’ কাব্য জীবনীও এই সময় তিনি পড়েন। গান্ধীজী বলেছেন, এই বই তিনি ভগবদগীতার চেয়ে অধিক আনন্দেদর সঙ্গে পড়েছেন, এবং বই হাতে নিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামতে পারেননি।
আর্নল্ডের অন্যান্য বইও গান্ধীজী পড়েছিলেন মনে হয়। তাই দেখি তিনি মীরা বেনকে আর্নল্ডের ‘ইন্ডিয়ান ইডিলস’ ও ‘পার্লস অব ফেথ’ পড়তে উপদেশ দিয়েছেন।
উপরে যে থিয়োসফিস্ট ভ্রাতৃদ্বয়ের কথা বলেছি তাঁদের অনুরোধে গান্ধীজী মাদাম ব্লাভাটস্কির ‘কী টু থিয়োসফি’ পড়েন। এই বই পড়বার ফলে গান্ধীজী হিন্দুধর্ম সম্বন্ধীয় বই পড়তে ইচ্ছা হয়। এই ইচ্ছার পরিণামস্বরূপ তিনি একে একে রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, উপনিষদ, মনুস্মৃতি প্রভৃতি আত্মস্থ করে ফেললেন। অবশ্য সবই তিনি লন্ডনে পড়েননি। তবে পড়ার সূত্রপাত হয় ঐ সময় থেকেই। তুলসীদাসের রামায়ণ ভগবদগীতার মতোই গান্ধীজীর নিকট ছিল আধ্যাত্মিক প্রেরণার উৎস। এছাড়া পড়েছেন পুরাণ। গান্ধীজীর মতে পুরাণের মধ্যে আছে আমাদের প্রকৃত ইতিহাস। রমেশচন্দ্র দত্তের রামায়ণ ও মহাভারতের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ এবং গ্রিফিথের রামায়ণের অনুবাদ পাঠ করবার জন্য গান্ধীজী মীরা বেনকে উপদেশ দিয়েছিলেন।
হিন্দুধর্মের শাস্ত্র—গ্রন্থের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হবার সঙ্গে সঙ্গেই বাইবেলও পড়তে আরম্ভ করলেন গান্ধীজী। ওল্ড টেস্টামেন্ট তাঁর বিশেষ ভালো লাগেনি। কিন্তু নিউ টেস্টামেন্ট তাঁর মনের উপর প্রভাব বিস্তার করল। ‘সারমন অন দি মাউন্ট’—এর শিক্ষা তাঁর হৃদয়ে সাড়া জাগালো। এক গালে মারলে আর এক গাল এগিয়ে দেবার উপদেশ গান্ধীজী সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, গীতা আর্নল্ড এর বুদ্ধ চরিত এবং যিশুর উপদেশের মধ্যে ঐক্য সুস্পষ্ট। সকল ধর্মেরই মূল কথা ত্যাগ।
এর পর মুসলমান ধর্ম সম্বন্ধে জানবার জন্যও গান্ধীজীর আগ্রহ হয়। টমাস কার্লাইল—এর ‘অন হিরোজ’ (On Heroes, Hero-worship, and the Heroic in History) পড়ে জানতে পারলেন মহম্মদের বীরত্ব, মহত্ত্ব ও সাধনার কথা। ওয়াশিংটন আরভিং রচিত Mehomet and his successors পড়ে গান্ধীজী মহম্মদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। সেল কর্তৃক অনূদিত কোরান কিনে পড়তে আরম্ভ করেন। পিকথলের অনুবাদও তিনি পরে পড়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে গান্ধীজী মুসলমান ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে অনেক বই পড়েছেন। গ্রাহামের সৈয়দ আহমেদ খাঁ—র জীবনী; হান্টারের ‘ইন্ডিয়ান মুসলমানস’, ক্যান্টওয়েল স্মিথ—এর ‘মডার্ন ইসলাম ইন ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি কয়েকটি বই—এর নাম উল্লেখ করা যায়। আমীর আলির ‘স্পিরিট অব ইসলাম’ গুজরাটিতে অনুবাদ করবার ইচ্ছাও গান্ধীজীর হয়েছিল।
পার্শীদির ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য এই সময় তিনি ‘জরথুস্ট্রের বাণী’ নামে এই বই পড়েছিলেন। কয়েকজন খ্রিস্টান বন্ধুর অনুরোধে তাঁকে পড়তে হয়েছিল কয়েকটি প্রচারধর্মী খ্রিস্টধর্ম বিষয়ক বই। এদের মধ্যে পিয়ার্সন—এর Many Infallible Proofs তাঁর ভালো লেগেছিল। বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে আলোচনা করবার ফলে গান্ধীজী জোসেফ বাটলার—এর ‘দি অ্যানালজি অব রিলিজিয়ন’ আগ্রহের সঙ্গেই পড়েছিলেন।
লন্ডনে নিরামিষাশী হবার ফলে অনেকেরই তাঁর উপর দৃষ্টি পড়ে। বন্ধু—বান্ধব এবং পরিচিত অনেকেই তাঁকে খাদ্য পরিবর্জন করতে বলেন। মাংস খাবার সমর্থনে কেউ কেউ বেন্থামের ‘থিয়োরি অব ইউটিলিটি’ তাঁকে পড়তে বলেন। তাঁর কাছে বেন্থামের ভাষা খুব কঠিন বলে মনে হয়েছিল। গান্ধীজী নিজেও খাদ্য নিয়ে ভাবতে আরম্ভ করেন। তিনি নিরামিষ আহার এবং খাদ্যতত্ত্ব সম্বন্ধে সল্ট, হাওয়ার্ড উইলিয়ামস ও অন্না কিংসফোর্ড—এর বই পড়েছিলেন। খাদ্য ও প্রাকৃতিক চিকিৎসা নিয়ে গান্ধীজী সারা জীবন নানানা পরীক্ষা—নিরীক্ষা করতে ভালবাসতেন। পরবর্তী সময়ে এই বিষয়ে তিনি আরো অনেক বই পড়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীজী জাস্টের ‘রিটার্ন টু নেচার’ বইটি পড়ে প্রাকৃতিক চিকিৎসার মূল নীতিগুলি নিজের উপর প্রয়োগ করেছিলেন।
গান্ধীজীর ভবিষ্যৎ কর্মজীবন ও ভাবজীবনের ভিত্তি রচিত হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। নানা সংঘাতের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর জীবনদর্শন গড়ে উঠেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার জীবন ভারতে তাঁর ভবিষ্যৎ সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্ব। এই প্রস্তুতিপর্বে তিনি কয়েকটি পুস্তকের দ্বারা বিশেষরূপে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন।
ম্যাক্সমূলারের ‘ভারত আমাদের কী শিক্ষা দিতে পারে’ বইটি পড়ে ভারতীয় সভ্যতার শাশ্বত বাণী সম্বন্ধে নতুন তরে তিনি আগ্রহান্বিত হন। বিবেকানন্দের ‘রাজযোগ’ও তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাতেই পড়েন। লন্ডনে থাকতেই গান্ধীজী কনজারভেটিভ দলের মিঃ পিওকাটের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন সকল বিষয়ে কিছু কিছু জ্ঞান না থাকলে আইন ব্যবসায়ে সাফল্যলাভ করা যায় না। মিঃ পিওকাট তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করে বললেন, তোমার সাধারণ পড়াশোনা খুবই কম। …ভারতের ইতিহাস পর্যন্ত তুমি পড়োনি।
মিঃ পিওকাট ম্যালিসন রচিত ১৮৫৭ বিপ্লবের ইতিহাস পড়বার উপদেশ দিয়েছিলেন। গান্ধীজী তা পালন করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। এই বই থেকে তিনি কিছু তথ্য জেনেছেন, কিন্তু তাঁর মনে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীজী হেনরি ডেভিড থোরো, জন রাস্কিন এবং লিও টলস্টয়ের রচনার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবান্বিত হন। এই প্রভাবের চিহ্ন তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের কর্মধারার মধ্যে সুস্পষ্টরূপে দেখা দিয়েছে।
থোরোর ‘সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স’ পড়ে গান্ধীজী সত্যাগ্রহের সমর্থন পান। থোরোর মূল কথা হল এই যে, যে গভর্নমেন্ট সবচেয়ে কম শাসন করে সেই গভর্নমেন্ট সবচেয়ে ভালো। থোরো কর দিতে অস্বীকার করায় কারারুদ্ধ হয়েছেন। তিনি সম্পূর্ণরূপে অহিংসায় বিশ্বাসী ছিলেন না বলে গান্ধীজীর মনে হয়েছে। তাছাড়া থেরো সংকীর্ণ ক্ষেত্রে অসহযোগের নীতি কার্যকর করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তথাপি থোরোর পুস্তিকাটি সত্যাগ্রহের আদর্শ প্রচারে বিশেষরূপে সহায়ক হয়েছে। গান্ধীজী ‘সিফিল ডিসওডিবিয়েন্স’—কে ‘মাস্টার্লি টিটিজ’ বলে অভিমত করেছেন।
কেউ কেউ বলেছেন, গান্ধীজী সত্যাগ্রহের আদর্শ পেয়েছেন থোরোর কাছ থেকে। কোদণ্ড রাও—এর নিকট লিখিত এক চিঠিতে গান্ধীজী এর প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার আইন অমান্য আন্দোলন অনেকদূর অগ্রসর হবার পর থোরোর বই তাঁর হাতে এসেছে।
টলস্টয়ের ‘দি গসপেল ইন ব্রিফ’, ‘হোয়াট টু ডু’ এবং ‘দি কিংডম অব গড উইদিন ইউ’ গান্ধীজীর মনের উপর স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছিল। গান্ধীজী বলেছেন: টলস্টয়ের ‘ঈশ্বরের রাজ্য তোমার অন্তরে’ বইটি পড়ে আমি অভিভূত হয়েছি। এই বই আমার মনে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছে।
কিন্তু রাস্কিনের ‘আনটু দিস লাস্ট’ বইটি গান্ধীজীকে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রভাবান্বিত করেছে। সর্বোদয় কর্মসূচীর মধ্যে এ বইয়ের প্রভাব দেখা যায়। রাস্কিনের জীবনাদর্শ এখনও সর্বোদয় কর্মপন্থার প্রেরণাস্বরূপ।
গান্ধীজীর আত্মচরিতের ‘পুস্তকের যাদুমন্ত্র’ অধ্যায়টি পড়লেই দেখা যাবে ‘আনটু দিস লাস্ট’ তাঁর মনে কি গভীর আলোড়ন এনেছিল। নাটালের পথে গাড়িতে পড়বার জন্য পোলক গান্ধীজীর হাতে দিলেন ‘আনটু দিস লাস্ট’। এই বই প্রথম থেকেই তাঁকে এমন মুগ্ধ করল যে, শেষ না করা পর্যন্ত তিনি থামতে পারলেন না।
”আনটু দিস লাস্ট’ চারটি প্রবন্ধের সংকলন (১৮৬০—৬২); প্রবন্ধগুলির বিষয়বস্তু শ্রমিকদের চাকরি ও বেতন সম্পর্কিত সমস্যা। ‘কর্নহিল ম্যাগাজিন’—এ ধারাবাহিকরূপে প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে এমন প্রতিবাদ উঠল যে সম্পাদক প্রবন্ধ ছাপা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন। তখন সম্পাদক ছিলেন থ্যাকারে। গান্ধীজীর মতে ‘আনটু দিস লাস্ট’—এর মূল কথা তিনটি: (ক) সমাজের কল্যাণেই ব্যক্তির কল্যাণ; (খ) উকিল ও নাপিতের বাঁচবার অধিকার সমান, সুতরাং তাদের পারিশ্রমিকের হার একই নীতিতে নির্ধারিত হওয়া উচিত; (গ) যারা কায়িক পরিশ্রম করে তাদের জীবনই আদর্শ জীবন।
এই আদর্শ স্বার্থের বিরোধী বলেই ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায় রাস্কিনের বিরোধিতা করেছে। তখন যদিও রাস্কিনের মত অসম্ভব কল্পনা বলে উড়িয়ে দিয়ে হয়েছিল, তথাপি পরবর্তী সময়ে প্রস্তাবিত অনেক সংস্কার কার্যকর করা হয়েছে।
গান্ধীজী ‘সর্বোদয়’ নাম দিয়ে ‘আনটু দিস লাস্ট’ গুজরাটিতে অনুবাদ করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর জনগণের সর্বাত্মক উন্নতির জন্য গান্ধীজী সর্বোদয় কর্মপন্থার উপর জোর দিয়েছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তন করে গান্ধীজী কংগ্রেসের কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। তখন তাঁর পড়াশোনা করবার মতো সময় ছিল কম এবং একটি বিশেষ কাজে আত্মনিয়োগ করায় প্রধানত ঐ সম্পর্কিত বই সম্বন্ধেই তাঁর আগ্রহই ছিল বেশি। অবশ্য গীতা প্রভৃতি কয়েকটি ধর্মপুস্তক ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। একমাত্র রবীন্দ্রনাথের বই ছাড়া অধিকাংশ বই পড়তে হয়েছে কংগ্রেসের আন্দোলন, ভারতের ইতিহাস, জনসাধারণের অবস্থা ইত্যাদি জানবার জন্য। মিস মেয়োর ‘মাদার ইন্ডিয়া’, ব্রেলসফোর্ডের ‘সাবজেক্ট ইন্ডিয়া’, কেসির ‘অ্যান অস্ট্রেলিয়ান ইন ইন্ডিয়া’ প্রভৃতি বই তিনি পড়েছেন ভারত সম্বন্ধে বিদেশী লেখকদের মতামত জানবার জন্য জেলে নিজের রুচি অনুযায়ী বই পড়ার সুযোগ পেয়েছেন।
ভারতের জেলে গান্ধীজী পড়েছেন কার্লাইলের ‘ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস’। গিবনের ‘রোম সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস’—ও তিনি পড়েছেন জেলে,—১৯২২ কি ১৯২৩ সালে।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজী যখন য়ারবেদা জেলে ছিলেন তখন সেখানে কী কী বই পড়েছেন তার কিছু কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। এখানে তিনি মৈথিলীশরণ গুপ্তের কয়েকটি বই, কার্পেন্টারের ‘অ্যাডামস পীক টু এলিফ্যান্টা’ এবং এডওয়ার্ড টম্পসনের ‘দি আদার সাইড অব দি মেডাল’ প্রভৃতি বইগুলি পড়েছেন। টম্পসনের উপর বল্লভভাই প্যাটেল বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না। গান্ধীজী তাঁকে বুঝিয়ে বললেন, টম্পসন ‘দি আদার সাইড অব দি মেডাল’—এ এমন সব তথ্য উদঘাটিত করেছেন যা এতদিন ইংরেজ ইতিহাসিকরা গোপন করে রেখেছিল।
এই জেলে তিনি যেসব বই পড়েছেন তার মধ্যে দু’টি বই তাঁকে বিশেষ করে আকৃষ্ট করেছিল। একটি হল রাস্কিনের Fors Clavigera (Fortune, the club-bearer)। দারিদ্র্যের প্রতিকার সম্বন্ধে রাস্কিন ব্রিটিশ শ্রমিকদের উদ্দেশ্য করে ৯৬টি খোলা চিঠি প্রকাশ করেছিলেন। সেই চিঠিগুলির সংকলন এ বই। গান্ধীজীর অভিমত এই যে, এই বই বার বার পড়েও মন ক্লান্ত হয় না।
আর একটি বই হল আপটন সিনক্লেয়ারের We parade। সিনক্লেয়ার এই উপন্যাসে আমেরিকায় মদ্যপানের সামাজিক দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। কাহিনীর আবেদন গান্ধীজীর অন্তর স্পর্শ করে। গান্ধীজী মন্তব্য করেছেন, ”সিনক্লেয়ার সমাজের বিশেষ কল্যাণ করছেন। তিনি একটির পর একটি সামাজিক পাপের উপর আলোকপাত করে চলেছেন।” এই উপন্যাস তাঁর এত ভালো লেগেছিল যে তিনি বল্লভভাই প্যাটেল ও পুত্র দেবদাসকে পড়তে বলেছিলেন। রাজাজীর কিন্তু ‘ওয়েট প্যারেড’ ভালো লাগেনি। তাঁর মতে এই বই শিল্পকর্ম নয়, শুধু প্রচার। গান্ধীজী তার উত্তরে লিখলেন, ”মনে হয় রাজাজীর আমেরিকান লেখকদের সম্বন্ধে বিরূপতা আছে। আমি হার্ডি বা জোলার লেখা পড়িনি। কিন্তু আপটন সিনক্লেয়ারও অবজ্ঞা করবার মতো লেখক নন। শুধু প্রচার আছে বলেই কোনো উপন্যাসকে উপেক্ষা করা যায় না।…. ‘আঙ্কল টমস কেবিল’—এ প্রচারের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট; কিন্তু এর শিল্পের দিকটি অননুকরণীয়।”
গান্ধীজীর বই পড়া সম্বন্ধে আমরা উপরে মোটামুটি পরিচয় দিয়েছি। যত কম বই তিনি পড়েছেন বলে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন প্রকৃতপক্ষে তার চেয়ে অনেক বেশি বই পড়েছেন। যেসব বই তিনি পড়েছেন তার সবগুলির নাম পাওয়া যায় না।
পাঠক হিসাবে গান্ধীজীর দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। প্রথমত, পুস্তক নির্বাচনের জন্য তিনি নিজের মানসিক প্রবণতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁর চিন্তাভাবনার সঙ্গে যে বইয়ের যোগ আছে সে বই পড়তেই আগ্রহ ছিল। নিছক পড়বার জন্য উৎসাহে ছিল না। তাই রাস্কিনের শিল্প—সম্বন্ধীয় বিখ্যাত রচনা বাদ দিয়ে তিনি পড়েছেন ‘আনটু দিস লাস্ট’। টলস্টয়ের ক্লাসিক উপন্যাসগুলি অপেক্ষা তাঁকে আকৃষ্ট করেছে কয়েকটি স্বল্প পরিচিত ছোট রচনা। এই রচনাগুলির মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন তাঁর জীবনাদর্শের সামঞ্জস্য। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, পঠিত পুস্তকের অন্তনির্হিত ভাবধারা তিনি হৃদগত করে নিতেন। থোরো, রাস্কিন এবং টলস্টয়ের জীবনাদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়েই তিনি ক্ষান্ত ছিলেন না; নিজের জীবন ও কর্মে তাদের প্রয়োগ করেছেন।