গান্ধীজীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের প্রাণময় বিকাশ – পণ্ডিত জওহললাল নেহরু

গান্ধীজীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের প্রাণময় বিকাশ – পন্ডিত জওহরলাল নেহরু

গান্ধীজী প্রথমে কংগ্রেসে ঢুকেই সঙ্গে সঙ্গে তার শাসনতন্ত্রে পুরোপুরি পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। তিনি কংগ্রেসকে গণতান্ত্রিক গণ—প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন। কংগ্রেস পূর্বেও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ছিল, কিন্তু তার ভোটাধিকার সীমাবদ্ধ ছিল এবং সে ভোটের অধিকারী ছিল উচ্চশ্রেণীর লোকেরা। এখন দলে দলে কৃষকরা যোগ দিতে লাগল এবং নতুন অবস্থায় কংগ্রেসকে মনে হতে লাগল একটা বিরাট কৃষক প্রতিষ্ঠান বলে—অবশ্য তার মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বহুল সংমিশ্রণ ছিল। কংগ্রেসের এই কৃষক প্রতিষ্ঠানসুলভ রূপ ক্রমশ বেড়ে চলল। শ্রমিকসমাজও কংগ্রেসে যোগ দিল, তবে স্বতন্ত্র সঙ্ঘবদ্ধভাবে নয়, ব্যক্তিগতভাবে।

এই প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি ও মূলনীতি হল সংগ্রাম—শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংগ্রাম। এ পর্যন্ত নিম্নোক্ত দুটি পদ্ধতিতেই কাজ চলে আসছিল — নিছক কথা বলা ও প্রস্তাব পাশ করা, নতুবা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ। এ দুটি কর্মপদ্ধতিকেই বাতিল করে দেওয়া হল— বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদকে কংগ্রেসের মূলনীতির বিরোধী বলে নিন্দা করা হল। সংগ্রামের একটি নতুন পথ বের করা হল; সে পথ সম্পূর্ণ শানিপূর্ণ হলেও তার মধ্যে ছিল অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার না করার নির্দেশ এবং ফলে সংশ্লিষ্ট দুঃখ যন্ত্রণাকে স্বেচ্ছায় বরণের নির্দেশ। গান্ধীজী অদ্ভূত ধরণের শান্তিবাদী ছিলেন — কেন না তিনি ছিলেন জীবন্ত কর্ম—শক্তির পরিপূর্ণ আধার। ভাগ্যের কাছে কিংবা যাকে তিনি অন্যায় বলে মনে করতেন তার কাছে কোনদিন নতি—স্বীকার তিনি করতেন না; তিনি পরিপূর্ণরপে তার প্রতিরোধ করতেন যদিও তাঁর প্রতিরোধ ছিল শান্তিপূর্ণ ও সৌজন্যপূর্ণ।

সংগ্রামের আহ্বান ছিল বিবিধ। বিদেশী শাসনকে ‘রণং দেহি’ বলে প্রতিরোধ করার সংগ্রাম তা ছিলই — সেই সঙ্গে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার অন্যায় অনাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামও ছিল। শান্তিপূর্ণ উপাসে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন— কংগ্রেসের এই ‘মূল নীতি ছাড়াও কংগ্রেসের কর্মসূচীতে প্রধান স্থান দখল করেছিল জাতীয় সংহতি অর্থাৎ মাইনরিটি সমস্যার সমাধান, অবনত শ্রেণীর উন্নতি সাধন ও অস্পৃশ্যতারূপ পাপ বর্জন।

ভয়, মর্যাদাবোধ, ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছআয় প্রদত্ত জনগণের সহযোগিতা এবং ব্রিটিশ শাসনের ফলে যারা কায়েমী স্বার্থের মালিক এমন কতকগুলি শ্রেণী— ব্রিটিশ শাসনের প্রধান স্তম্ভ— একথা বুঝতে পেরে গান্ধীজী ভিত্তি শুদ্ধ নাড়া নিয়েছিলেন। খেতাব বর্জনের নির্দেশ দেওয়া হল। যদিও খেতাবধাবীবা তাতে কম সংখ্যায়ই সাড়া দিলেন, তবু জনগণের মন থেকে এইসব ব্রিটিশ প্রদত্ত খেতাবের প্রতি শ্রদ্ধা বিলুপ্ত হল এবং খেতাব হবে দাঁড়াল অধঃপতনের প্রতীক বিশেষ। জীবন সম্বন্ধে নতুন মান ও গুণবোধের সৃষ্টি হল। যে বড়লাটের দরবার ও দেশীয় নৃপতিদের জাঁকজমক লোকের মনে এত প্রভা বিস্তার করত, জনগণের দারিদ্র্য ও দুঃখে পরিবেষ্টিত হয়ে সেগুলোকে সহসা মনে হল হাস্যকর, নীচ রুচির পরিচায়ক এবং অনেকটা যেন ঘৃণ্য। ধনীরা আর ধনের প্রাচুর্য দেখাতে উৎসুক নয়; অন্ততপক্ষে বাহ্যিক দিকে তারা অনেকে সহজতর জীবনযাত্রা গ্রহণ করল — পোষাকে পরিচ্ছেদে তাদের আর সাধারণ লোক থেকে আলাদা কবে বোঝাব উপায় ছিল না।

সম্পূর্ণ ভিন্ন ও নিস্তরঙ্গ ঐতিহ্যে মানুষ কংগ্রেসের প্রবীণ নেতারা সহজে এইসব নতুন প্রথা পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হতে পারলেন না এবং জনগণের এই নতুন অভ্যুদয়ে তাঁরা বিব্রতই হয়ে পড়লেন। তবু দেশের উপরে যে অনুভূতি ও আবেগের তীব্র বন্যা এসেছিল তা কিছু পরিমাণে তাদেরও ছুঁয়ে গেল। সামান্য কয়েকজন দলত্যাগ করলেন এবং তার মধ্যে মিঃ এম এ জিন্না ছিলেন অন্যতম। তিনি হিন্দু মসুলমান প্রশ্নে মতভেদের দরুণ কংগ্রেস ছেড়ে যাননি, তিনি কংগ্রেস ছেড়ে গিয়েছিলেন নিজেকে নতুন এবং অধিকতর অগ্রগামী আদর্শবাদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন নি বলে। তিনি কংগ্রেস ছেড়েছিলেন আরও বেশী করে এই কারণে যে পারিপাট্যবিহীন বেশবাসধারী হিন্দুস্থানীভাষী জনগণে কংগ্রেস ভর্তি হয়ে উঠেছিল এবং এটা তাঁর বিতৃষ্ণতার উদ্রেক করেছিল। রাজনীতি সম্বন্ধে তাঁর যে ধারণা ছিল সেটা ছিল উন্নততর ধরণের — আইন সভা কিংবা কমিটি রুমের উপযোগী কংগ্রেস ছাড়ার পর কয়েক বৎসর তিনি একেবারে যবনিকার আড়ালে চলে গিয়েছিলেন এমনকি এক সময় তিনি চিরদিনের মতন ইংল্যান্ড যাত্রার সিদ্ধান্ত করেছিলেন। ইংল্যান্ডে গিয়ে তিনি কয়েক বৎসরের জন্যে সেখানে বসবাসও করেছিলেন।

নির্বিকা রত্ব ভারতীয় মানব অভ্যাস— একথা বলা হয়ে থাকে এবং আমার মনে হয় এর মধ্যে সত্য আছে। হয়তো প্রাচীন জাতি মাত্রেরই মধ্যে এ মনোভাবের বিকাশ দেখা যায় এবং দীর্ঘস্থায়ী দার্শনিক এই পথের দিকে মনকে টেনে নিয়ে যায়। তবু গান্ধীজী ভারতীয় সংস্কৃতির খাঁটি প্রতিরূপ হয়েও এ মনোভাবের বিপরীত ধর্মের বিপরীত ধর্মের প্রতিভূঃ তিনি শক্তি ও কার্যক্ষমতার অস্বাভাবিক উদাহরণ — তিনি শুধু নিজে নড়েই ক্ষান্ত হন না — অপরকেও নাড়ান। আমি যতটা জানি তাতে ভারতীয় জনমানসের নির্বিকারত্ব দূরীকরণে তাঁর মত কৃতিত্ব আর কেউ দেখাতে পাবেন নি।

তিনি আমাদের গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন এবং নব কর্মপ্রেরণায় অসংখ্য দূতের কর্মপ্রবাসে গ্রামাঞ্চল মুখর হয়ে উঠল। কৃষকদের মনে সাড়া জাগল এবং তারা তাদের নির্বিকারভাবে খোলস ঝেড়ে ফেলে জেগে উঠতে লাগল। আমাদের মনের উপর ভিন্ন প্রতিক্রিয়া হলেও সে প্রতিক্রিয়া ছিল সমান ব্যাপক— কেনা এই যেন সর্বপ্রথম ঘনিষ্ঠভাবে মাটির তৈরী কুটিরবাসী ও ক্ষুৎপীড়িত গ্রামবাসীকে আমরা দেখলাম… এবং পান্ডিত্যপূর্ণে বক্তৃতার চেয়ে এইসব ভ্রমণের থেকেই ভারতীয় অর্থনীতি সম্বন্ধে বেশী জ্ঞানার্জন করলাম। অনুভূতিজনিত বা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা ইতিপূর্বেই গিয়েছিলাম তা আরও স্পষ্ট স্পষ্ট এবং দৃঢ়তর হয়ে উঠল এবং এর পর আমাদের মতবাদ যতই বদলাক আমাদের পক্ষে আর পুরাতন জীবনে কিংবা জীবন সম্বন্ধীয় পুরাতন মানে ফিরে যাবার উপায় ছিল না।

অর্থনৈতিক সামাজিক ও অন্যান্য বিষয়ে গান্ধীজীর দৃঢ় মতবাদ ছিল। নিজের রচনাবলীর মধ্যে দিয়ে সে মতবাদের বিবর্তন এবং পরিবর্তন …. থাকলেও তিনি কখনও জোর করে কংগ্রেসের উপর সব মতবাদ চাপাতে চেষ্টা করেননি। কোন কোন মতবাদ তিনি কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। এ বিষয়ে তিনি ছিলেন সাবধানী, কেন না তিনি জনগণকেও নিজের সঙ্গে অগ্রগতির পথে নিয়ে যাবার প্রয়াসী ছিলেন। এক এক সময় তিনি হয়তো কংগ্রেসের চেয়ে বেশী দূর এগিয়ে যেতেন এবং তখন তাঁকে আবার পা গুণে ফিরে ফিরে আসতে হবে। তাঁর মতবাদকে পুরোপুরি গ্রহণ করার মত লোক বেশি ছিলেন না — কেউ কেউ তাঁর মূল নীতির সঙ্গেও একমত ছিলেন না। কিন্তু পরিবর্তিত আকারে কংগ্রেসের পৌঁছে … মতবাদ, আনত তা অনেকে এই বলে গ্রহণ পুরাতন যে তৎকালীন পরিবেশের পক্ষে সে মতবাদ উপযোগী। দুটি দিক থেকে তাঁর চিন্তাজগতের পটভূমিকা অস্পষ্ট হলেও গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল: যে কোন কাজের মূল্য বিচারে করা হত তারস্বরে জনগণের কতটা উপকার হবে তাই দিয়ে এবং কাজ কষার উপায়টাকেও সব সময় গুরুত্ব দেওয়া হত। উদ্দেশ্য সাধু হলেও উপাষকে অবজ্ঞা করা চলত না— কেন না উপায় উদ্দেশ্যকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং তার পরিবর্তন সাধনও করে।

গান্ধীজি মূলত ধর্মবোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন— তাঁর সত্ত্বেও গভীরতম বিষয়েও তিনি ছিলেন হিন্দু —তবু তাঁর ধর্মবোধের সঙ্গে সংস্কার বা ধর্মীয় রীতি পদ্ধতির কোন সংযোগ ছিল না। সে ধর্মবোধন মূল ভিত্তি ছিল নৈতিক বিধি সম্বন্ধে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাসের উপর — একেই তিনি বলেছেন সত্য কিংবা প্রেমের বিধি। সত্য এবং অহিংসা তাঁর কাছে একই জিনিস কিংবা একই জিনিসের ভিন্ন ভিন্ন দিক মাত্র এবং তিনি প্রাণ সমার্থবোধক অর্থেই এই কথাগুলি প্রয়োগ করেছেন। তার দাবী ছিল যে হিন্দুধর্মের মূল সূত্র ছিল তিনি বোঝেন এবং তাঁর আদর্শবাদী ব্যাখ্যা অনুসারে সেই ধর্ম যা হওয়া উচিত তার সঙ্গে কোন শাস্ত্রোক্তি বা প্রথার যদি সামঞ্জস্য না হত তবে তিনি তাকে বলতেন পরবর্তী যুগের অনুলিখন বা সংযোজনা। তিনি বলেছেন: ”যেসব উদাহরণ বা প্রথা আমি বুঝতে পারি না কিংবা নীতিগত দিক থেকে সমর্থন করতে পারি না তাদের দাসত্ব করতে আমি রাজি নই।” কার্যত দেখি তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তীব্র মনোমত পথ বেছে নেন নিজেকে ইচ্ছামত পরিবর্তিত করেন, তাঁর জীবনদর্শন ও কর্মপদ্ধতির বিবর্তন সাধন করেন। এসব ব্যাপারে তিনি নৈতিক বিধিকে যেভাবে বুঝেছেন তার বাঁধন ছাড়া অন্য কোন বাধন মানেন না। তাঁর এ দর্শন সত্য কি ভ্রান্ত তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু তিনি বিষয়ে, বিশেষ করে নিজের ব্যাপারে, এই একই মূল মাপকাঠি প্রয়োগ করার, উপর জোর দেন। রাজনীতিতে এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এর ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে অসুবিধার সৃষ্টি হয় এবং প্রায়ই ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়। কিন্তু কোন অসুবিধাই তাঁকে তাঁর বেছে নেওয়া সরলরেখা …. পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না — যদিও একটা বিশেষ সীমার মধ্যে পরিবর্তিত পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য তিনি প্রতিনিয়তই নিজেকে বদলাম। যে সংস্কার তিনি করতে চান, যে উপদেশ তিনি অপরকে দেন সেটা সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজের উপর প্রয়োগ করেন। তিনি সর্বদা নিজেকে দিয়েই কাজ শুরু করেন এবং হাতের সঙ্গে যেমন দস্তানার মিল তেমনি তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে পরিপূর্ণ সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। কাজেই যাই ঘটুক না কেন তাঁর চারিত্রিক নিষ্ঠা তিনি কখনও হারান না এবং তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে সর্বদাই একটা প্রাণময় সম্পূর্ণতা দেখতে পাওয়া যায়। আপাতত যেটাকে তাঁর ব্যর্থতা বলে মনে হয়ে তার মধ্যে দেখি তিনি অনেক বড় হয়ে উঠেছেন।

তিনি নিজের ইচ্ছা ও আদর্শ অনুসারে যে ভারতকে গড়ে তুলতে চাইছিলেন তার সম্বন্ধে তাঁর ধারণা কি ছিল? ”আমি এমন ভারত সৃষ্টির জন্যে কাজ কবে যাব যেখানে দীনতম জনসাধারণও অনুভব করবে যে এটা তাদের দেশষ এক গড়ে তোলার কাজে তাদের পূর্ণ অধিকার আছে। সে হবে এমন ভারত যেখানে উচ্চ শ্রেণী ও নীচ শ্রেণীর মানুষ থাকবে না যেখানে সমস্ত সম্প্রদায় পরিপূর্ণ শান্তিতে বাস করবে। সে ভারতে অস্পৃশ্যতা রূপ অভিশাপের কোন স্থান থাকবে না কিংবা মত্ততা সৃষ্টিকারক পানীয়াদিরও কোন স্থান থাকবে না।… নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমানাধিকার ভোগ করবে।… এই হল আমার কল্পলোকের ভারতবর্ষ।” নিজের হিন্দু উত্তরাধিকারের জন্যে তাঁর গর্ববোধ ছিল, হিন্দুত্বকে তিনি একটা সার্বজনীনতার আবরণে আবৃত করার চেষ্টা করতেন এবং তাঁর সত্যবোধের সীমার মধ্যে সকল ধর্মের স্থান ছিল। তিনি তাঁর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে সঙ্কীর্ণতার মধ্যে ধরে রাখতে সম্ভব ছিলেন না। তিনি লিখেছিলেন: ”ভারতীয় সংস্কৃতি পুরোপুরি হিন্দু, ঐসলামিক কিংবা অন্য কোন জাতির নয়। এ সংস্কৃতি হল সব কিছুর সমন্বয়ে গঠিত।” তিনি আরও বলেছেন,: ”আমার গৃহের চতুর্দিকে যতটা সম্ভব মুক্তভাবে সকল দেশের সংস্কৃতির চাপে আমি নিজেকে হারাতে রাজি নই। অপরের গৃহে অনধিকার প্রবেশকারী রূপে তা সে ভিক্ষুকরূপেই হোক আর দাসরূপেই হোক, আমি বাস করতে অসম্মত।” আধুনিক চিন্তাধারাগুলির প্রভাব তাঁর উপরে ছিল; কিন্তু মূলকে তিনি কখনও ছাড়েন নি বরং সজোরে আঁকড়ে ধরেই ছিলেন।

জনগণের মধ্যে আধ্যাত্মিক ঐক্য পুনঃ সংস্থাপন করতে সমাজের শীর্ষদেশবাসী পাশ্চাত্যধর্মী ক্ষুদ্র একদল নবনারী ও অগণিত জনগণের ক্ষুদ্র একদল নরনারী ও অগণিত জনগণের মধ্যবর্তী প্রাচীর ভেঙে দিতে, প্রাচীন মূলের মদ্যে জীবনীশক্তি আবিষ্কার করে তার ভিত্তিতে নতুন কিছু গড়ে তুলতে, জনগন মোহগ্রস্ত অচল থেকে …. তাদের প্রাণময় করে তুলতে — তিনি কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তাঁর একমুখী অথচ বহু—বিচিত্র প্রকৃতির যে ভাবটি মনের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করত সে স্থল জনগণের সঙ্গে তাঁর একীভূত ভাব, তাদের সঙ্গে ভাবগত বহু সাদা শুধু ভারতের নয় সারা বিশ্বের সর্বহারা ও দারিদ্র্যপীড়িতদের সঙ্গে বিস্ময়কর ঐক্যবোধ। নিষ্পেপত জনগণের উন্নতিসাধনের যে তাঁর স্পৃহা তাঁর মনে ছিল তার কাছে অন্য সব কিছুর মত ধর্মের স্থানও ছিল গৌণ। ”অর্ধাশনক্লিষ্ট জাতির ধর্ম, শিল্প কিংবা কোন প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে না।” ”অনশনক্লিষ্ট কোটি কোটি নবনারীব জীবনে যা—কিছু উপকারী আমার মতে তাই হল সুন্দর। আজ যদি প্রথমেই আমরা জীবনের অস্তিত্বের পক্ষে অতিপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলি জোগাতে পারি তবে জীবনের সকল সৌন্দর্য ও লাবণ্য আপনা থেকেই আসবে।… আমি চাই এমন শিল্প ও সাহিত্য যা কোটি কোটি নরনারীর মনে সাড়া জাগাতে পারে।” এই অসুখী সর্বহারা দল তাঁর জীবনের সব কিছুই ঘুরত তাদের কেন্দ্র করে। ”কোটি কোটি নরনারীর জন্যে আছে হয় অনন্ত জাগরণ নয়তো অনন্ত মোহনিন্দ্রা।” তিনি বলতেন যে তাঁর মনের স্বভীপ্সা হল ”প্রত্যেক চোখের প্রতি ফোঁটা জল মুছে দেওয়া।”

এই যে বিস্ময়কর ধরণের প্রাণবন মানুষটি যিনি পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস ও অস্বাভাবিক রকমের ক্ষমতার অধীশ্বব, প্রতিটি ব্যক্তির সমানাধিকার ও স্বাধীনতা যাঁর দাবি, কিন্তু এ সব কিছুরই যিনি পরিমাপ করেন দীনতম মানুষকে দিয়ে, তিনি যে ভারতের জনগণকে মুগ্ধ করবেন এবং চুম্বকের মতন তাদের আকর্ষণ করবেন — এর মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই। তিনি তাদের কাছে ছিলেন অতীত ও ভবিষ্যতের যোগসূত্রের প্রতীক বিশেষ এবং নৈরাশ্যপূর্ণ বর্তমানকে তিনি ভাবে চোখে আশা ও প্রাণপরিপূর্ণ ভবিষ্যতের সিঁড়িরূপে প্রতিভাত করাতে পেরেছিলেন। আর শুধু জনগণই নয় বুদ্ধিবাদীরাও মুগ্ধ হয়েছিল যদিও তাদের মন সময়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে সুলভ এবং আজীবনের অভ্যাস ত্যাগ করে তাদের পক্ষে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হওয়া অধিকতর কষ্টদায়ক হয়ে উঠত।। এইভাবে শুধু নিজের অনুগামীদের মধ্যে নয়, বিরোধীদের মধ্যে এবং অসংখ্য মধ্যপন্থীদের মধ্যে, যারা কোন চিন্তা বা কারো সম্বন্ধে মনস্পিত করে উঠতে পারেনি— তাদের সকলের মধ্যে তিনি একটা বিরাটি মনস্তাত্ত্বিক বিপ্লব সাধন করতে পেরেছিলেন।

কংগ্রেস গান্ধীজির প্রভাবাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল অথচ সে এক অদ্ভুত প্রভাব, কেন না কংগ্রেস …একটি সক্রিয়, বিদ্রোহী, বহুমুখী প্রতিষ্ঠান, বহু ধরণের মতবাদে পূর্ণ এক যে কোন মতের দ্বারা তাকে সহজে এদিকে ওদিকে চালাবার উপায় ছিল না। অনেক সময় গান্ধীজি অন্যের ইচ্ছার মূল্য দেবার জন্যে নিজের মতবাদকে নরম করে আনতেন, আবার তখনও বা তিনি বিপরীত সিদ্ধান্তকেই মেনে নিতেন। নিজের সম্বন্ধে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি ছিলেন বজ্রের মত কঠিন এরই এজন্যে একাধিকবার কংগ্রেসের সঙ্গে তংাকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়েছিল। কিন্তু সবসময়েই তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা ও সংগ্রামী জাতীয়তার মূর্ত প্রতীক, যারা ভারতকে দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চাইত তাদ্রে অপরাজেয় বিরোধী। তিনি স্বাধীনতার এমন প্রতীক ছিলেন যে অন্যান্য বিষয়ে তাঁর সঙ্গে মতভেদ হলেও এ ব্যাপারে মানুষ তাঁর কাছেই ছুটে যেত এবং তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিত। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম যখন থাকত না তখন তাঁর নেতৃত্ব সবাই সর্বদা মানত না, কিন্তু সংগ্রাম যখন অনিবার্য হয়ে উঠত তখন তার প্রতীকটিই নব চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াত— আর সব কিছুই হয়ে পড়ত গৌণ।

এইভাবে ১৯২০ সালে কংগ্রেস এবং বহুল পরিমাণে সমগ্র দেশ এই নতুন ও অনাবিষ্কৃত পথে যাত্রা কবল এবং বার ব্রিটিশ শাসক শক্তির সঙ্গে তার সংঘর্ষ হতে লাগল। এই সব উপায়ের মধ্যেও যে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল তার মধ্যে এই সংঘর্ষ অন্তনির্হিত ছিল, তবু এসব কিছুর পিছনে নিছক রাজনৈতিক কৌশল ও ঘুঁটি চালাচালি ছিল না— ছিল ভারতবাসীরদের শক্তিশালী করে তোলার আগ্রহ, কেননা একমাত্র এই শক্তির দ্বারাই তাদের পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন করে লক্ষ্য করা সম্ভব। একটির পর একটি আইন অমান্য আন্দোলন এসেছে— তাতে অনেক দুঃখ—যন্ত্রণা ছিল আমাদের আমন্ত্রিত, কাজেই শক্তিদায়ী— যে ধরণের দুঃখ—যন্ত্রণা অনিচ্ছুকদের অভিভূত করে ফেলে, হতাশা ও পরাজিতসুলভ মনোভাবের দিকে নিয়ে যায় — সে ধরণের দুঃখ—যন্ত্রণা এটা নয়। সরকারি নির্যাতনের বহু বিস্তৃত জালে পড়ে অনিচ্ছুকদের ভুগতে হয়েছে, এমন কি স্বেচ্ছায় যারা দুঃখ—যন্ত্রণা বরণ করে নিয়েছিল তারাও সময় সময় ভেঙে পড়েছে। কিন্তু অনেকেই সত্যাশ্রয়ী ও দৃঢ় ছিল এবং লব্ধ অভিজ্ঞতা তাদের আরও দৃঢ়তর করে তুলেছিল। কখনও এমন কি চরম দুর্দিনেও, কংগ্রেস কোনদিন উচ্চতর শক্তির কাছে কিংবা বৈদেশিক শাসকদের কাছে নতি স্বকীর করে নি। ভারতের স্বাধীনতা লাভের তাঁর স্পৃহা এবং বিদেশি শাসন প্রতিরোধের উচ্ছ্বাস প্রতীক হয়েই সে বরাবর ছিল। এই জন্যেই ভারতের অগণিত নরনারী কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিল এবং নেতৃত্বের আশাষ তার দিকেই তাকাতো — যদিও তারের মধ্যে অনেকে এত দূর্বল বা এভাবে পারিপার্শ্বিক ঘটনায় অবরুদ্ধ ছিল যে ব্যক্তিগতভাবে তাদের কিছু করাব উপায় ছিল না। কোন কোন দিক থেকে কংগ্রেস ছিল একটি রাজনৈতিক দল; আবার কয়েকটি দলের মিলিত প্ল্যাটফর্মও ছিল কংগ্রেস, কিন্তু মূলত কংগ্রেস ছিল এরও চেয়ে বেশি কিছু, কেন না কংগ্রেস ছিল অগণিত জনগণের মনোগত অভীপ্সার প্রতিনিধি। কংগ্রেসের সদস্যদের তালিকাভুক্ত নামের সংখ্যা খুব বেশী হলেও তা দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপক প্রতিনিধিমূলক; চরিত্রে পরিমাপ করে কঠিন, কেননা সদস্যভুক্ত হওয়াটা জনগণের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল ছিল না, সেটা নির্ভরশীল ছিল দূরতম পল্লী পর্যন্ত আমাদের পৌঁছানোর শক্তির উপর। বহুবার কংগ্রেসকে অবৈধ প্রতিষ্ঠান বলে ঘোষণা করা হয়েছে, আইনের চোখে তার কোন অস্তিত্বই তখন থাকেনি এবং পুলিশ আমাদের খাতাপত্র সব নিয়ে চলে গেছে।

যখন কোন প্রত্যক্ষ আইন অমান্য আন্দোলন থাকত না তখনও ভারতে ব্রিটিশ শাসনযন্ত্রের সঙ্গে অসহযোগিতার সাধারণ মনোভাব থাকত, যদিও সে মনোভাব হত আক্রমণাত্মক নীতি বিবর্জিত। তার অর্থ অবশ্য ইংরেজদের সঙ্গে অসহযোগিতা…. অনেক প্রদেশে গভর্ণমেন্ট স্থাপিত হবার পেরে অফিস ও সরকারী কাজকর্মের ব্যাপারে যতেষ্ট সহযোগিতা সম্পর্কই বিদ্যমান ছিল। তখনও কিন্তু পটভূমিকা বিশেষ বদলায় নি এবং অফিসঘটিত কাজকর্ম ছাড়া অন্যান্য ব্যাপারে কংগ্রেসপন্থীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সামগ্রিক আপোষ ও সামঞ্জস্য বিধান সময়ে সময়ে অনিবার্য হলেও ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও বৈদেশিক সাম্রাজ্যদের মধ্যে চূড়ান্ত শান্তি স্থাপিত হতে পারে না। এক—মাত্র স্বাধীন ভারতই সমান শর্তে ইংল্যান্ডের সঙ্গে সহযোগিতা করতে পারে।

মহাত্মাজী কর্ণপাত করেন নাই, তিনি জানিতেন এ যুক্তি সত্য নয়, ইহার মধ্যে একটা মস্তবড় ভুল প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে। বস্তুতঃ একথা কিছুতেই সথ্য নয় জগতে যাহা কিছু অন্যায়ের পথে অধর্মের পথে একদিন প্রতিষ্ঠিত হইয়া গেছে আজ তাহাকে ধ্বংস করাই ন্যায় যেমন কবিতা হোক তাহাকে বিদূরিত করাই আজ ধর্ম। যে ইংরাজ রাজ্যকে একদিন প্রতিহত করাই ছিল দেশের সর্বোত্তম ধর্ম, সেদিন তাহাকে ঠেকাইতে পারি নাই বলিয়া আজ যে—কোন পথে তাহাকে বিনাশ করাই দেশের একমাত্র শ্রেয়ঃ একথা কোন মতেই জোর করিয়া বলা চলে না। অবাঞ্ছিত জারজ সন্তান অধর্মের পথেই জন্মলাভ করে অতএব ইহাকে বধ করিয়াই ধর্ম—হীনতার প্রায়শ্চিত্ত করা যায় তাহা সত্য নয়।

[নারায়ণ, বৈশাখ ১৩২৯]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *