গান্ধীজি ও সেবাগ্রাম – রণজিৎ চৌধুরী

গান্ধীজি ও সেবাগ্রাম – রণজিৎ চৌধুরী

গান্ধীজি ১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তন করেন। তারপর থেকে গান্ধীজির কর্মময় জীবনকে দুটো অধ্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। এক, সবরমতী আশ্রম অধ্যায় এব দুই, সেবাগ্রাম আশ্রম অধ্যায়। সবরমতী আশ্রম অধ্যায় মোটামুটি ১৯১৫ সালে শুরু হয় এবং ১৯৩৩ সালে শেষ হয়। সেবাগ্রাম আশ্রম অধ্যায় আরম্ভ হয় ১৯৩৬ সালে এবং বলা যেতে পারে, শেষ হয় ১৯৪৬ সালে। ওই বছর গান্ধীজি নোয়াখালি যাত্রা করেন। আর ফিরে আসার সুযোগ হয়নি।

সবরমতী আশ্রম গান্ধীজির পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এই আশ্রম সম্পর্কে গান্ধীজির অভিজ্ঞতা খুব সুখের ছিল না। আশ্রমে নীতিবিরুদ্ধ কার্যকলাপ প্রায়ই ঘটছে এমন অভিযোগ অহরহ গান্ধীজির কানে যাচ্ছিল। তাছাড়া ভ্রাতুষ্পুত্র মগনলাল গান্ধীর মৃত্যু হয় ১৯২৮ সালের এপ্রিল মাসে মগনলালের মৃত্যুর পরে আশ্রম চালাতে পারে এমন দায়িত্বশীল এবং নির্ভরযোগ্য দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি গান্ধীজি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। যদিও মগনলালের বিরুদ্ধেও আশ্রমিকদের বহু অভিযোগ ছিল, তবুও মগনলালের যোগ্যতার ব্যাপারে গান্ধীজির বিশ্বাস ছিল অটুট। সবরমতী আশ্রমে বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন ধর্মের, উচ্চশিক্ষিত, অশিক্ষিত, শিশু, যুবা, বৃদ্ধ। এই বিভিন্ন ধরনের লোককে নিয়ে চলতে গিয়ে এবং তাদের অভিযোগ শুনে শুনে গান্ধীজি মানসিকভাবে ক্লান্ত এবং হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এ বিষয়ে পরিচয় পাওয়া যায় গান্ধীজির সঙ্গে মীরাবেনের পত্র বিনিময়ে। মীরাবেন ছিলেন গান্ধীজির ঘনিষ্ঠ এবং প্রিয়পাত্রী। দুজনের মধ্যে পত্র বিনিময়ে দেখা যায় গান্ধীজি সবরমতী আশ্রমের ব্যাপারে ক্রমেই বিরক্ত হয়ে পড়ছিলেন। এই বিরক্তি শেষ পর্যন্ত তাঁকে আশ্রম সম্পর্কে নিরাশ করে তুলেছিল। ১৯৩০ সালে লবণ সত্যাগ্রহের সময় তিনি প্রতিজ্ঞা করেন দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি আর সবরমতী আশ্রমে ফিরবেন না। পরিশেষে ১৯৩৩ সালে সবরমতী আশ্রম বন্ধ করে দেওয়ার তিনি সিদ্ধান্ত নেন। এই মর্মে গান্ধীজি ভারত সরকারের গৃহ সচিবকে এক পত্রও লেখেন। এই পত্রে সবরমতী আশ্রমের সমস্ত সম্পত্তি গ্রহণ করে কোনো মঙ্গলজনক কাজে লাগাবার জন্য ভারত সরকারের কাছে প্রস্তাবও রাখেন। আশ্রমিকদের কলহ, বিবাদ এবং ভ্রষ্টাচারের অজস্র অভিযোগ গান্ধীজির সবরমতী আশ্রমের জীবনকে তিক্ত করে দিয়েছিল।

গান্ধীজির তাই সেবাগ্রামে কোনও আশ্রম তৈরি করার ইচ্ছা ছিল না। ১৯৩৬ সালে যখন ঠিক করে ফেলেন যে তিনি সেবাগ্রামে বাস করবেন, দ্বিতীয়বার আশ্রমের অপ্রিয় অভিজ্ঞতা তিনি নিতে বোধহয় প্রস্তুত ছিলেন না। এই বছর ছোট এক কুটির নির্মাণ করে গান্ধীজির সেবাগ্রাম জীবন শুরু হয়েছিল। সেই সঙ্গে পল্লী সংগঠনের রচনাত্মক কার্যক্রম আরম্ভ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর ইচ্ছার প্রায় বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে সেবাগ্রাম আপন গতিতে এক বিরাট কর্মযজ্ঞের আশ্রম হয়ে উঠল। কুমারাপ্পার ভাষায় সেবাগ্রাম হয়ে উঠেছিল— ”The de facto capital of India.”

সবরমতী আশ্রম অধ্যায় এবং সেবাগ্রাম আশ্রম অধ্যায়ের মধ্যে কয়েকটি মৌলিক পার্থক্য চোখে পড়েয এই পার্থক্যগুলি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে দুটি অধ্যায় দুটি আলাদা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সবরমতী আশ্রম সত্যাগ্রহ পরিচালনার এবং সত্যাগ্রহী তৈরি করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় চম্পারন, খায়রা প্রভৃতি সত্যাগ্রহ পরিচালন এই সবরমতী আশ্রম থেকেই হয়েছিল। সেই সঙ্গে গান্ধীজির মূল লক্ষ্য ছিল কংগ্রেস রাজনীতির পুরোধায় আসা। যার দ্বারা তিনি কংগ্রেস রাজনীতির আমূল পরিবর্তন করতে পারবেন। ১৯২০ সাল পর্যন্ত তিলকের নেতৃত্বে কংগ্রেস রাজনীতি যেভাবে চলে আসছিল তার ভাগবত পরিবর্তন গান্ধীজির কাছে অনেক জরুরি ছিল। গান্ধীজির উদ্দেশ্য ছিল অহিংস রাজনীতির প্রবর্তন। ১৯২০ সালে তিলকের মৃত্যুর পরে গান্ধীজি কংগ্রেস নেতৃত্বের সামনে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারপর থেকে একটানা অসহযোগ আন্দোলন এবং আইন অমান্য আন্দোলনের মত আন্দোলনী রাজনীতিই ছিল এই সময়ের প্রধান চরিত্র। ১৯২৯ সালের মধ্যে গান্ধীজি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন ভারতবর্ষের রাজনীতিতে তাঁর নেতৃত্ব ছিল অপরিহার্য। লবণ সত্যাগ্রহ এই আন্দোলনী রাজনীতির শেষ ফসল।

অন্যদিকে সেবাগ্রাম আশ্রম অধ্যায় ছিল পল্লী উন্নয়নের রচনাত্মক অধ্যায়। ক্ষমতার উচ্চশিখরে উঠে ১৯৩৪ সালে গান্ধীজি কংগ্রেসের সদস্যপদ ত্যাগ করেন। এই বছরেই অসহযোগ এবং সত্যাগ্রহ আন্দোলন সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেন। সবরমতীর আন্দোলন পর্ব শেষ হল, আরম্ভ হল সেবাগ্রামের পল্লীজীবনে গঠনমূলক অধ্যায়। এই অধ্যায়ে কেবল ১৯৪০—৪১ সালের একক সত্যাগ্রহ এবং ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো’ অন্দোলন ছাড়া আর কোন আন্দোলন কর্মসূচী তিনি গ্রহণ করেননি। এর মধ্যে একক সত্যাগ্রহ বড় আকারে আন্দোলনের রূপ নেয়নি। গান্ধীজি নিজেই বলেছেন একক সত্যাগ্রহ মূলত ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে নৈতিক প্রতিবাদ। ১৯৪১ সালে Constructive Programme পুস্তিকায় তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন স্বরাজের জন্য অইন অমান্য আন্দোলন অপরিহার্য নয় কিন্তু গঠনমূলক কাজ অপরিহার্য। হঠাৎ আন্দোলনী রাজনীতি থেকে রচনাত্মক কাজে এই পরিবর্তনের কারণ কি? এর সঠিক কারণ মনে হয় একমাত্র মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে বিশ্লেষণ সম্ভব। এটা ঠিক সমাজ পরিবর্তনের জন্য রাজনীতির প্রায়োজন আছে এমন ধারণা তিনি পোষণ করতেন না। অথচ বাস্তব দরকারে রাজনীতির ব্যবহার তিনি বর্জন করতে পারেননি। এই দুই—এর মধ্যে তিনি মানসিক দোলায় দুলছিলেন। অর্থাৎ গান্ধীজির মধ্যে একটি দ্বৈতভাব এই সময় কাজ করতে থাকে। ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনীতি তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ উত্তরোত্তর ক্ষমতার দিকেই ঝুঁকছিলেন। ১৯৩৪ সালে গান্ধীজি লেখেন— ”If Congressmen forget the constructive programme and simply confine Congress activities to winning Assembly and Council elections and fruitless debates in the Assembly and Councils, they will soon find that I have taken with me the carnel of politics and they have kept for themselves only the outermost husk, without even the vitamins.” ক্ষমতার জন্য যে লালসা রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল, এটা গান্ধীজির অত্যন্ত অপছন্দ ছিল। পল্লীসংগঠনের মত উন্নয়নমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করার মানসিকতা কংগ্রেসের মধ্যে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। সেই জন্য গান্ধীজি সেবাগ্রামে গ্রাম গঠনের কাজে সক্রিয় হয়েছিলেন। আশা করেছিলেন তাঁর উদাহরণ অন্তত কিছু কংগ্রেস—কর্মী নেবেন এবং গঠনমূলক কাজের থেকে অনেকে উপকৃত হতে চাইবেন। বাস্তবতা থেকে দূরে দাঁড়িয়ে সামাজিক কাজের এবং সাংগঠনিক কার্যক্রমের কেবল ধারণা করা চলে। কিন্তু বাস্তবতার ফলিত ক্ষেত্রে সেই ধারণার সঙ্গে জনজীবনের অনেক সময় মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বাস্তবতা মানুষকে ভালো—মন্দের অনেকটা নিকটে নিয়ে আসে। তাঁর পল্লীগঠনের নতুন ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তিনি হরিজনের পাতায় ১৯৩৬ সালে লেখেন—”Why am I at Sevagram? Because I believe that my message will have a better chance of penetrating the masses of India, and may be through them to the world, and I am otherwise not a man capable of setting myself up.” সেবাগ্রামের পল্লীজীবনের মাঝে গ্রামগঠনের ফলিত রূপ দিতে চেয়েছিলেন। তিনি সেবাগ্রামে সবরমতীর অনুরূপ আশ্রম তৈরি করতে চাননি।

সেবাগ্রামে গান্ধীজির নিরুত্তাপ এবং অনেকটা অনাটকীয় অধ্যায় শুরু হল। কংগ্রেসের সঙ্গে সরকারিভাবে যোগাযোগ ছিন্ন করার মাধ্যমে তার শুরু। ১৯১৫ সাল থেকে ১৯২৯ সালের যেকংগ্রেস, সে কংগ্রেসের মধ্যে ধীরে ধীরে এক মৌলিক পরিবর্তন এসেছিল। ১৯৩৩ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে পঁচাত্তর হাজারের বেশি লোক কারাবরণ করে। এরা মূলত শহুরে শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বেশি সংখ্যায় রাজনীতিতে প্রবেশের পরে কংগ্রেসের চরিত্র ক্রমে বদলে যাচ্ছিল। এই মধ্যবিত্ত যুবকদের মধ্যে ক্রমশ সমাজবাদের প্রভাব পড়তে শুরু করে। তা থেকে কংগ্রেসের কর্ণধাররাও বাদ পড়েনি। জওহরলাল নেহরুর পরিবর্তন এই ব্যাপারে লক্ষণীয়। ১৯৩৬ সালে নেহরু ইউরোপ থেকে বিমানযোগে ফিরে আসেন কংগ্রেসের লখনউ অধিবেশনে যোগ দিতে। এই অধিবেশনে সমাজবাদকে কংগ্রেসের আদর্শ করতে তিনি বদ্ধপরিকর হন। তাঁর সক্রিয় চেষ্টায় লখনউ অধিবেশনে সর্বপ্রথম সমাজবাদকে কংগ্রেস মেনে নিল। নেহরু সমাজবাদ নিয়ে এই সময় এতই উন্মত্ত ছিলেন যে তিনি জোরালো কন্ঠে ব্যক্ত করলেন যে একমাত্র সমাজবাদের মাধ্যমে সত্যিকারের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব। গান্ধীজি বুঝতে পারছিলেন তিনি ক্রমে তাঁর অহিংস নীতি নিয়ে অনেকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন। ১৯৩০ পর্যন্ত তিন অনেকটা ঈশ্বরপ্রেরিত দূত হিসাবে রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই ঈশ্বরপ্রেরিত দূতের ভূমিকার মধ্যে ক্রমে ভাটা দেখা দিয়েছে। গোড়ার দিকের চমক ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসছিল। আদর্শের দিক থেকে তাঁর অনুগামীর সংখ্যা কমে যাচ্ছিল। কংগ্রেসের মধ্যে সেই সময় পরিষ্কার দুটি দল গড়ে উঠেছিল—প্রগতিশীল আর রক্ষণশীল। রাজনীতিতে তখন একটা অস্বচ্ছ লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। রাজনীতির এই ঘোলা জলে গান্ধীজি খুব স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। নেহরুকে ১৯৩৮ সালে এক চিঠিতে তাঁর ক্রমবর্ধমান নিঃসঙ্গতাবোধের কথা উল্লেখ করেন। এই নিঃসঙ্গতাবোধ সম্ভবত এই কারণেই দেখা দিয়েছিল যে তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে তিনি আদর্শগত একটা দূরত্ব অনুভব করছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন তাঁর অহিংস নীতি এবং স্বরাজের অর্থ বোঝার কারো তরফ থেকে কোনো চেষ্টা নেই। অহিংসা, সত্য এবং স্বরাজ চিন্তার জগতে যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছিল তা উপলব্ধি করার মত ধৈর্য এবং বুদ্ধিজীবী মন তখনও গড়ে ওঠেনি। বরং সমাজবাদের রোমাঞ্চকর হাতছানি তাঁদের কাছে অনেক প্রগতিশীল বলে মনে হয়েছিল। আসলে প্রগতিশীল এবং রক্ষণশীল দুই গোষ্ঠীই গান্ধীজির চিন্তাজগৎ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। এঁরা কেবল রাজনৈতিক লাভের জন্য তাঁর প্রতি আনুগত্য দেখাত। আদর্শের অনুরক্তি শিথিল হয়ে যাচ্ছিল। তাঁর প্রতি নেহরুর আচরণে এটা বিশেষ করে ধরা পড়ে। ১৯৩৯ সালে রাজকোট অনশনের পর নেহরু গান্ধীজির প্রতি অসহিষ্ণু, উত্তপ্ত এবং দুর্বিনীত আচরণ করেন। গান্ধীজি এতই ক্ষুণ্ণ এবং আহত হয়েছিলেন যে সেদিন তিনি রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ অবসর নেওয়ার কথা ভাবেন। আগে গান্ধীজি অনুরূপ ক্ষেত্রে প্রত্যাঘাত করতেন। ১৯২৮ সালে নেহরু একটি পত্রে গান্ধীজির নেতৃত্বের প্রতি সংশয় ব্যক্তকরেন। তার উত্তর গান্ধীজি কঠোর ভাষায় দেন। সঙ্গে সঙ্গে নেহরু অতি বিনীতভাবে লেখেন—”Dear Bapu : Nothing that can ever happen can alter or lessen my deep regard and affection for you.” সেই চিঠিতে তিনি অতি বিনয়ের সঙ্গে এও লেখেন—”Am I not your child in politics, though perhaps a truant and errant child.” ১৯৩৯ সালে নেহরুর সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ গভীর হয়। সাংবাদিকমহলে গুজবকে কিছুটা কাটাতে গান্ধীজি হরিজন পত্রিকায় ০Are We Rivals? এই শিরোনামায় একটি প্রবন্ধ ছাপালেন।১০ কিন্তু গান্ধীজি নেহরুর সঙ্গে মতবিরোধের কথা অনেক ক্ষেত্রে সহজে স্বীকার করেছেন। Basil Mathews যখন প্রশ্ন করেন—”Your actual economic policy would differ from Mr. Neheru’s?” গান্ধীজি বলেন— ”Yes. We seem to differ in our ideas of village uplift and reconstruction. The difference is of emphasis. He does not mind the village movement. He believes in idustrialization. I have grave doubt about its usefulness for India.”১১

এই মতবিরোধ পরে ধীরে ধীরে চাপা ক্ষোভে পরিণত হয়। এই প্রচ্ছন্ন ক্ষোভ থেকে তিনি আর কোনওদিন মুক্তি পাননি। নেহরুকে তিনি রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করেন। সেই নেহরুর কাছ থেকে রূঢ় ব্যবহার অপ্রত্যাশিত ছিল। যাঁদের উপর তিনি ভরসা করেছিলেন তাঁরা আগের মত কাছের রইল না। এই সময়ের সব কাজের মধ্যে এই চাপা ক্ষোভ এবং নিঃসঙ্গতা ধরা পড়ে।

কয়েক বছরের ব্যবধানে তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু—বিয়োগ ঘটে। ১৯৩৬ সালে আনসারি মারা যান। আনসারির বিয়োগে তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। হিন্দু—মুসলমান সম্পর্কের ব্যাপারে আনসারি ছিলেন গান্ধীজির প্রধান পরামর্শদাতা। তার এক মাস পরে আব্বাস ত্যাবজি মারা যান। ১৯৪০ সালে তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু এন্ড্রুজের মৃত্যু হয়। যমনালাল বাজাজ মারা যান ১৯৪২ সালে। এবং সে বছরই গান্ধীজির সন্তানতূল্য মহাদেব দেশাই—এর মৃত্যু হয়। একই বছরে পত্নী কস্তুরবার প্রয়াণ ঘটে। এইসব প্রিয়জনের মৃত্যুতে গান্ধীজি আরো বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করছিলেন। যমনালালের মৃত্যুর পরে একটি চিঠিতে গান্ধীজি লেখেন যে যমনালালের এবং তাঁর নিজের রাজনীতিতে কোনওদিনই বিশেষ আগ্রহ ছিল না। তাঁদের উভয়ের সত্যিকারের রাজনীতি ছিল গঠনমূলক কাজ।১২ নীতিশূন্য রাজনীতির প্রতি তিনি বার বার কংগ্রেসীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। কংগ্রেস—কর্মীরা বোঝেননি যে ক্ষমতা হস্তান্তর হলেই কেবল স্বরাজ আসে না। নতুন করে সমাজকে এবং সামাজিক মূল্যকে গড়ে না তুললে স্বরাজ কখনই সত্যিকারের স্বরাজ হয় না।

বস্তুত স্বরাজের অর্থ কী এবং স্বরাজ অর্জন করার ক্ষমতা কীভাবে আসে সে বিষয়ে গান্ধীজির অনুগামীদের অধিকাংশই কোনওদিন গভীরভাবে ভাবেননি। অবিনীত হলেও বলতে হয় গান্ধী—অনুরাগীরা গান্ধীজির স্বরাজের অর্থ বোঝেননি। যাঁরা বুঝেছিলেন তাঁরা ক্ষমতায় পৌঁছুতে পারেননি। পরবর্তীকালে তাঁরা পরাভূত হয়ে হতাশায় ভুগছিলেন। আসলে সত্য এবং স্বরাজকে চরম অর্থে বোঝার চেষ্টা গান্ধীজির জীবিতকালে হয়নি। খুব অল্পসংখ্যক ব্যক্তিই উপলব্ধি করেছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অর্ন্তনিহিত অপূর্ণতা, সেইসঙ্গে মানবিক জীবনে ও ব্যবহারে স্বরাজের পূর্ণতা কিভাবে আসে। গান্ধীজির লেখায় এই সম্বন্ধে পরিষ্কার বক্তব্য ছিল। আন্তর্জাতিক সমাজবাদের মোহে বৃহত্তর সত্য সেদিন আচ্ছন্ন হয়েপড়েছিল। এই কারণে তাঁর মন উত্তরোত্তর অর্ন্তমুখী হয়ে ওঠে। তিনি হরিজন পত্রিকায় ব্যক্ত করেন যে এই সময় তাঁর মন ঈশ্বর চিন্তায় বেশি ব্যস্ত থাকত এবং ধীরে ধীরে তিনি ঈশ্বরের দিকে সরে যাচ্ছিলেন।১৩ কর্মযোগী গান্ধীজির মন ক্রমশই বৈরাগ্য প্রভাবিত হয়েপড়ছিল। সবরমতী আশ্রমে তিনি কখনও বৈরাগ্যের কথা চিন্তা করেননি। হয়তো তিনি এখন বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছিলেন। কিন্তু সেবাগ্রামে তাঁর যে মানসিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় তা কেবল বয়সের ভার বলে ব্যাখ্যা করা যায় না। এরমধ্যে একটি সূক্ষ্ম মানবিক সম্পর্কের কারণ প্রচ্ছন্ন ছিল। তিনি বুঝেছিলেন মানবিক মূল্যবোধের কোথায় যেন গভীর ফাটল ধরেছে। মানবিক সম্পর্কের অন্তরঙ্গতা হারিয়ে যাচ্ছে। মনে হয় এই অনুভব তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল। মৃত্যুর আগে স্বাধীন ভারতে তিনি আর একটি এবং শেষ অন্দোলন শুরু করার কথা ভাবছিলেন। এটাও তাঁর প্রচ্ছন্ন অভিমান এবং চাপা—পড়া ক্ষোভ থেকে উৎসারিত। একটু গভীরভাবে বিচার করলে দেখা যাবে তাঁর মনে একটা দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। এই দ্বন্দ্বের কারণ তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্য থেকে মনে হয় গড়ে উঠেছিল। ব্রহ্মচর্য নিয়ে তাঁর অসফলতা এক অন্যতম কারণ হতে পারে। সেবাগ্রাম জীবনের গোড়ার দিকে এই মানসিক দ্বন্দ্ব এতটা প্রকট ছিল না। শেষের দিকে দ্বন্দ্ব, স্ববিরোধ এবং নিঃসঙ্গতাবোধ গান্ধীজির মনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তা থেকে উত্তরণের কথাও তিনি ভাবছিলেন। এই উত্তরণ এক আদর্শ সমাজ সর্বোদয় সমাজ। সর্বোদয় সম্মেলনের জন্য তিনি সেই সময় তাই ব্যাকুল হয়েছিলেন। সম্মেলনের তারিখও নির্ধারিত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি পারেননি।

দুই

সেবাগ্রামের আসল নাম ছিল সেগাঁও। এই নামে আর একটি বড় গ্রাম থাকাতে গান্ধীজির চিঠিপত্র প্রায়ই বড় সেগাঁওয়ে চলে যাচ্ছিল। সেই জন্য এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সেবাগ্রাম। মীরাবেন আগে থেকেই সেবাগ্রামে সংগঠনের কাজে রত ছিলেন। মীরাবেনের পূর্ব উপস্থিতি গান্ধীজির সেবাগ্রাম বেছে নেওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল। যমনালালের বদান্যতারও কম আকর্ষণ ছিল না। যদিও গান্ধীজির ঘনিষ্ঠদের অনেকেই সেবাগ্রামে গান্ধীজি বাস করুন এটা চাননি। তা সত্ত্বেও তিনি এই ব্যাপারে পাকাপাকি মনস্থির করে ফেললেন। যমনালাল ছিলেন এখানকার মালগুজার অর্থাৎ জমিদার। সেবাগ্রামে গান্ধীজির যাতে কোনোপ্রকার অসুবিধা না হয়, সে ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টি ছিল সজাগ। সেবাগ্রামে গান্ধীজির কাজকে অনেকে ”সেবাগ্রাম মডেল” এবং ”সেবাগ্রাম মেথড” বলে বর্ণনা করেছেন। ১৪ মনে হয় এই বর্ণনা সঠিক নয়। কারণ গান্ধীজি গ্রাম উন্নয়নের সচেতনভাবে কোনো মডেল তৈরি করেননি। তাঁর সব কাজ বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। এই সময় একটি চিঠিতে গান্ধীজি মীরাবেনকে লেখেন গ্রামের কাজে তাঁর অন্তর পড়ে আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই গ্রাম গঠনের কাজ কি রকম হবে সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।১৫ ১৯৩৬ সালে Basil Mathews-এর একটি প্রশ্নের উত্তরে গান্ধীজি বলেন—“I cannot speak with either the definiteness or confidence of a Stalin or a Hitler as I have no cut and dried programme which I can impsoe on villagers”১৬ এ থেকে বোঝা যায় কোনো পূর্বপরিকল্পিত মডেল নিয়ে গান্ধীজি গ্রামের কাজে এগিয়ে আসেননি।

ইংরেজ সরকার কিন্তু তাঁর পল্লী সংগঠনের কাজে একটি গূঢ় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দেখতে পায়। ইংরেজসরকার মনে করেছিল গান্ধীজি এবার গ্রামের লোককে সংগঠিত করতে চলেছেন। সরকার খুবই বিচলিত বোধ করছিল। ১৯৩৫ সালের বাজেটে তাই পল্লী উন্নয়নের জন্য এক কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে গান্ধীজি বলেন— ”I should be glad if Government were to take the wind out of my sail. Much of the work that I propsoe doing is what Government ought to do.”১৭ ১৯৩৩ সাল থেকে গান্ধীজি হরিজনদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। সে বছরেই তৈরি হয় হরিজন সেবক সংঘ। সারা ভারত ঘুরে তিনি অস্পৃশ্যতা বর্জন আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। পরিশেষে নিবিড়ভাবে পরীক্ষার ক্ষেত্র হিসাবে সেবাগ্রামকে বেছে নেন। গান্ধীজি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল হরিজন সমস্যা নিয়ে। একদিকে যেমন ডাঃ অম্বেডকর তিক্ত ছিলেন অপরদিকে বর্ণহিন্দুরাও তাঁর প্রতি বিরূপ ছিল। গান্ধীজির বর্ণাশ্রমধর্ম সমর্থন হরিজনরা ভালো চোখে দেখেনি। আবার বর্ণাশ্রমধর্মের নতুন অর্থ বর্ণহিন্দুদের মোটেই পছন্দ হয়নি। হরিজন সমস্যা নিয়ে গান্ধীজি যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন তার পরীক্ষাগার ছিল সেবাগ্রাম। সেবাগ্রাম মহারাষ্ট্রের একটি ছোট গ্রাম। জনসংখ্যা ছিল ৬৩৯। গ্রামে মোট জমির পরিমাণ ছিল ১৫৫০ একর। লোকসংখ্যার অধিকাংশ ছিল মাহার, মাং, চামার আর ভাঙ্গি। এদের মধ্যে মাহার আর মাং—রাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। বর্ণহিন্দুদের মধ্যে কুনবিরাই প্রধান ছিল। ব্রাহ্মণ ছিল এক ঘর।

গ্রামবাসীদের সঙ্গে গান্ধীজিকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য যমনালাল বাজাজ একটি সভার আয়োজন করেন। সেই প্রথমসভা এক অর্থে স্মরণীয় হয়েছিল। গান্ধীজি তাঁর ভাষণে সেবাগ্রামে আসার উদ্দেশ্য বুঝিয়ে বলেন। গ্রাম গঠনের জন্য, গ্রামের উন্নতির জন্য তিনি বিভিন্ন কাজের কথা বলেন এবং তার জন্য গ্রামবাসীদের সহযোগিতার কথা বলেন। এই প্রসঙ্গে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের উপর বিশেষ জোর দেন। কিন্তু গ্রামের মোড়ল, যাকে মারাঠিতে পাটিল বলা হয়, সে অস্পৃশ্যতা দূর করার ব্যাপারে প্রতিবাদ করে ওঠে। পাটিল ছিল বর্ণহিন্দু কুনবি জাতের। সে বলে গ্রাম উন্নয়নের ব্যাপারে সহযোগিতায় তার কোনও আপত্তি নেই। অস্পৃশত্যতা নিরোধের ব্যাপারে সে সহযোগিতা করতে পারবেনা। প্রথম দিন থেকে গান্ধীজির হরিজন মুক্তির কাজে বিরোধিতা দেখা যায়। এই সেবাগ্রামেই হরিজনরা অন্যান্য মানুষের মত গণ্য হত না। তারা মন্দিরে প্রবেশ করতে পারত না। নাপিত, দর্জি, পুরোহিত এদের কাজ করত না। গ্রামের কুয়ো ব্যবহার করার অধিকার এদের ছিল না। সবাই যে রাস্তা দিয়ে চলত সে রাস্তা দিয়ে ওরা চলতে পারত না।

গান্ধীজি প্রথমে যমনালালের ক্ষেতের একটি কুয়ো হরিজনদের ব্যবহারের জন্য খুলে দেন। কিন্তু কোনো হরিজন সাহস করে কুয়োর জল নিতে আসেনি। কিছুদিন পর দু—একজন জল নিতে এলে গ্রামে তা নিয়ে এত হৈ চৈ শুরু হয় যে তারা আসা বন্ধ করে দেয়। গান্ধীজি একটি হরিজন বালককে নিজের পুত্র হিসাবে পোষ্য নেন। গ্রামের নাপিত তার চুল কাটতে অস্বীকার করে। তিনি আশ্রমের রান্নাঘরে বেশ কয়েকজন হরিজনকে নিয়োগ করেছিলেন। গ্রামের বর্ণহিন্দুরা এটা মোটেই ভালোভাবে নেয়নি।

আসলে মানুষের নৈতিকতাবোধ যে এক জটিল অভ্যাসের গ্রন্থি দিয়ে তৈরি, গান্ধীজি পরিষ্কার তা বুঝতে পারেন। সামাজিক নীতিপরায়ণতার যুক্তির উপর মোটেই নির্ভর করে না। বহুকালের সংস্কার কখন যুক্তিকে নির্বাসন দেয় বোঝাই যায় না। এই সংস্কারের পরিবর্তন অত্যন্ত জটিল কাজ। প্রথম দিন থেকে গান্ধীজির কাজকে বর্ণহিন্দুরা যেমন মেনে নিতে পারেননি, হরিজনরাও তাদের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনকে গ্রহণ করার মত মন তৈরি করতে হয়। আসলে আশ্রম এবং সেবাগ্রাম এই দুইয়ের মধ্যে একটি দূরত্ব চিরদিন রয়ে গেছে। প্রথম দিনের ফাঁক আজও ভরাট হয়নি। গান্ধীজির সহানুভূতি, প্রতিদিন গ্রামের গলির আবর্জনা পরিষ্কার, হরিজন বালককে নিজের পুত্র বলে গ্রহণ করা, আশ্রমের রসুই ঘরে হরিজন এবং অন্যান্যদের মধ্যে কোনও পার্থক্য না রাখা, তাদের শিক্ষার জন্য অক্লান্ত চেষ্টা— এত সত্ত্বেও গান্ধীজি ওদের খুব কাছের মানুষ হতে পারেননি। এ দৈন্য ছিল মুখ্যত গ্রামের মানুষের। সেবাগ্রামের মানুষ, বর্ণহিন্দু এবং হরিজন গান্ধীজির ব্যক্তিত্বের দ্বারা কতটা প্রভাবিত হয়েছিল তার সঠিক মূল্য্যায়ন হয়নি। শেষ পর্যন্ত আশ্রম এবং গ্রাম, এদের ফাঁক রয়েই গেল। মহাদেব দেশাঈ স্বীকার করেছেন— ”There is a hiatus between the villagers and us. There is yet no living link between us.”১৮ গান্ধীজি এর জন্য হাজার বছরের সামাজিক অন্যায়কে দায়ী করেন। তিনি বার বার বলেছেন একদিনে হাজার বছরের সংস্কার যায় না। তিনি এও বলেছেন সমাজ পরিবর্তন কেবল অর্থনৈতিক উপাদানের উপর নির্ভর করে না। তিরিশের দশকে গান্ধীজি যে—গভীর বাস্তব জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন তার তুলনা মেলে না। তিনি লক্ষ্য করেছেন বাইরে থেকে গ্রামবাসীর মধ্যে পরিবর্তন আনা যায় না। গান্ধীজির সমাজ সংস্কারের চেষ্টা তাদের অভ্যস্ত জীবনযাত্রার মধ্যে একটা মানসিক নাড়া দিতে পেরেছিল। তাতে তাদের স্থবির জীবনের শেকড় নড়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে পরিবর্তনের আলো ধীরে ধীরে আসতে পেরেছিল।

গ্রাম সংগঠকের ভূমিকায় গান্ধীজির অবদান উল্লেখযোগ্য। গান্ধীজিই প্রথম সমাজবিজ্ঞানী যিনি গ্রাম উন্নয়নে বিভিন্ন বিজ্ঞানের মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধযুক্ত একটি সম্পূর্ণ উন্নয়নর কথা বলেন। Inter-disciplinary approach for integrated develepment-এর কথা গান্ধীজির আগে কেউ এভাবে ভেবেছেন কি না এবং তার ফলিতরূপ দেবার চেষ্টা করেছেন কিনা সন্দেহ। যে—কোন সমস্যা নিয়েই ভাবা যাক না কেন সেই সমস্যা সামাজিক অন্যান্য সমস্যার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কোনও একটি সমস্যাকে অন্য সমস্যা থেকে আলাদা করা যায় না। গান্ধীজি সেবাগ্রামকে ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, আমাশা প্রভৃতি রোগ থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এরকম একটি মসস্যা যে এককভাবে সমাধান করা যায় না এ কথাটা গান্ধীজি প্রথম সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। রোগমুক্ত করতে হলে গ্রামের আবর্জনা পরিষ্কার করা অপরিহার্য। যে—সমস্ত জায়গায় জল জমে এবং মশার উৎপত্তি হয় সে—সব জত্রায়গায় কেরোসিন ছড়াবার ব্যবস্থা করেন। তিনি জানতেন সেইসঙ্গে লোকের পুরোনো অভ্যেসগুলোর পরিবর্তন দরকার। প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকার উন্নতি প্রয়োজন। তখন সেবাগ্রামে ভাল সবজি উৎপন্ন হত না। তিনি বিভিন্ন সবজি চাষের ব্যবস্থা করেন। সবজি চাষর জন্য দরকার জৈব সার। মানুষের মল এবং আবর্জনাকে জৈব সারে পরিণত করার ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন দুধ প্রায় দুষ্প্রাপ্য ছিল। গান্ধীজি একটি গোশালা আরম্ভ করে দেখালেন গোপালন একটি লাভজনক পেশা। ক্রমে সেবাগ্রামে পর্যাপ্ত দুধ পাওয়া যেতে লাগল। চাষের বহুমুখী উন্নতি দেখা দিল। সেবাগ্রামে ফলের চাষ হত না। পেয়ারা, পেঁপে ইত্যাদির ফলন হতে লাগল। চাষের ক্ষেত্রে গান্ধীজি কিছুটা সাংগঠনিক পরিবর্তন আনতে পেরেছিলেন। তিনি বার বার বলেছেন জমিদার গ্রামে ট্রাস্টি হিসাবে কাজ করবেন। যমনালাল সেবাগ্রামের জমিদার হওয়া সত্ত্বেও তিনি গ্রামবাসীদের খোলাখুলি বলেন জমিদার যদি গ্রামের উন্নতি না দেখেন তাহলে গ্রামের লোকে যেন জমিদারের জমিতে কাজ না করেন। সেবাগ্রাম আদর্শ গ্রাম হয়ে উঠুক এটা একসময় তিনি চেয়েছিলেন যাতে পরে উত্তরসূরীরা সেবাগ্রামের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু এই ইচ্ছা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তার কারণ গ্রামের সহযোগিতা তিনি তেমন পাননি। গ্রামের লোকের যাতে আয় বাড়ে তার জন্য তিনি খাদি শিক্ষা কেন্দ্র গঠন করেন। বুনিয়াদি শিক্ষার প্রবর্তনও আরম্ভ করেন। কিন্তু সেবাগ্রামের লোকেরা খাদিকে জীবনযাত্রার উপায় হিসাবে মেনে নেয়নি। সেবাগ্রামে আনুমানিক দশ শতাংশের বেশি লোক খাদিবস্ত্র পরিধান করেনি। বুনিয়াদি শিক্ষা জনপ্রিয় হয়নি। প্রয়াজন—ভিত্তিক শিক্ষা তাই গড়ে ওঠেনি। সেইজন্য গান্ধীজির উৎসাহ ধীরে ধীরে কমে যায়। তাঁর আশ্রমের লোকেরাও তাঁদের দায়িত্ব পালনে বিফল হয়েছিলেন। ফলে ১৯৪৪ সালে হতাশ গান্ধীজি সেবাগ্রাম আশ্রমও বন্ধ করে দিতে চেযেছিলেন। মানুষ নিয়ে তাঁর পরীক্ষা মনে হয় তাঁর মনের মত রূপ পায়নি। তাই সেবাগ্রাম পল্লীউন্নয়ন বেশিদূর এগোয়নি।

তিন

গান্ধীজির সেবাগ্রাম পর্ব আরম্ভ হয়েছিল ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে। তখন পরিকল্পিত অর্থনীতির সুবর্ণ যুগ। সোভিয়েত রাশিয়ার তখন কৃষিক্ষেত্রে সমষ্টিবদ্ধ পদ্ধতি চালু হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীতে সমষ্টিবদ্ধ পদ্ধতির জনয়গান চলছিল। অর্থনীতিতে এবং কৃষিতে ব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রতিক্রিয়াশীল বলে গণ্য হত। রাজনীতিতে ইউরোপে একটা প্রচণ্ড অস্থিরতা চলছিল। ১৯৩৬ সালে স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। তার তিন বছর বাদে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়। এই সময় ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা সব চেয়ে সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে। সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, সোভিয়েত সমষ্টিবাদ ব্যক্তির স্বাধীনতাকে পদদলিত করছিল। এই সময়ে প্রধান বিষয় ছিল যন্ত্রের প্রগতি। কৃষিতে সমষ্টিবদ্ধতার পেছনে সব চেয়ে বড় যুক্তি ছিল যন্ত্রীকরণ। বড় যন্ত্রের ব্যবহারে কৃষিতে কাঠামোগত দ্রুত পরিবর্তন আসবে এমন কল্পনা অনেকের মনেই স্থান পেয়েছিল। একমাত্র গান্ধীজি এর প্রতিবাদ হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। ইতিহাস প্রমাণ করে দিয়েছে গান্ধীজি বিষয়টির কত গভীরে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি শুধুমাত্র কল্পনাবিলাসী ছিলেন না।

গান্ধীজির কাজে সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্য ছিল পরিষ্কার। সে লক্ষ্য স্বরাজে পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা। স্বরাজ মানে প্রতিটি ব্যক্তির স্বরাজ। ব্যক্তির বাইরে সমষ্টিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান কোন না কোনভাবে ব্যক্তির স্বরাজকে ব্যাহত করে। সেই জন্য বৃহৎ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে গান্ধীজির তীব্র সন্দেহ ছিল। এই প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র হতে পারে, বৃহৎ শিল্প হতে পারে, যে—কোন বড় যন্ত্রপাতি হতে পারে। এ সবের যূপকাষ্ঠে কি ভাবে কত লোক রক্তাক্ত হয়েছে এটা সর্ববিদিত। গান্ধীজি সেবাগ্রাম পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিটি লোককে একটা সম্মানের আসন দিতে চেষ্টা করেছেন। সমষ্টিবাদের মধ্যে ব্যক্তি অহরহ উপেক্ষিত হয়। গান্ধীজি প্রতিটি ব্যাক্তিকে যোগ্য আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। আপাতব্যর্থতার ভেতর দিয়ে এই সত্যই বার বার উজ্জ্বল হয়ে দেখা যায়।

পাদটীকা

১. Bapu’s Letters to Mira, 1924-1948, Ahmedabad, 1949,

Mark Thomson, Gandhi and His Ashrams, Bombay, 1993,

. D.G. Tedulkar, Mahatma, 1969, Vol 6,

. গান্ধীজির সমগ্র রচনাবলী, Vol 59  পৃঃ, ২৬৪

৫. হরিজন, ১২ ডিসেম্বর, ১৯৩৬

. Judith M. Brown, Gandhi, 1990, পৃঃ ২৬৩

. জওহরলালকে লিখিত গান্ধীজির পত্র, ২৫ এপ্রিল, ১৯৩৮

. গান্ধীজি মহাদেব দেশাইকে বলেন “I am after all a sinking ship, who would choose to sail in such a ship” Mark Thompson কর্তৃক উদ্ধৃত, ঐ, পৃঃ ২২৮

. নেহরুকে লেখা রাজকুমারী অমৃত কাউরের পত্র, ৬ জুলাই, ১৯৩৯। নেহরুকে লেখা সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের পত্র, ৩ জুলাই, ১৯৩৯

১০. Tendulkar, ঐ Vol 4, পৃঃ ৮৬

১১. Tendulkar, ঐ Vol.4 পৃঃ ১০৭

১২. Mark Thomson, ঐ, পৃঃ ১৭৬

১৩. হরিজন, ১৮ এপ্রিল, ১৯৩৬

১৪. Mark Thomson, ঐ The Village of Service, India in a Village দ্রষ্টব্য।

১৫. Bapu’s Leters to Mira দ্রষ্টব্য।

১৬. Tendulkar, ঐ Vol 4, পৃঃ, ১০৬

১৭. Tendulkar যুক্তভাবে সম্পাদিকGandhi– His Life and Work, Bombay, 1944 পুস্তকে মহাদেব দেশাই—এর প্রবন্ধ At Sevagram.পৃঃ ১৯৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *