গান্ধীজির স্বপ্ন – ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষাল
স্বপ্ন বললে আমরা এমন কিছু বুঝি যেটা বাস্তব বা সত্য নয়, যার বাস্তব জগতে কোন অস্তিত্ব নেই, যা মানুষ কল্পনা করে তাকেই আমরা স্বপ্ন বলি।
গ্রীক দার্শনিক প্লেটো জগৎটাকে চমকে দিয়েছিলেন একটা খুব নতুন মত প্রকাশ করে। তিনি বলেছিলেন, এই যে জগৎ এবং জাগতিক বস্তুসমূহ এসব সত্য বটে, কিন্তু এ সবের পিছনে একটা মনোময় জগৎ আছে যা এই প্রকাশমান জগতের উৎপত্তিস্থল। আমরা কোন একটা বস্তু দেখি এবং মনে তার একটা ছবি তুলে নিই এবং বস্তুটাকেই সত্য বা সত্তাবান বলি আর মনের ছবিটাকে সত্তাহীন প্রতিবিম্ব মনে করি। কিন্তু প্লেটো বলেন যে, সমস্ত জগৎটাই মনোময় অস্তিত্বে সত্তাবান। রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতায় আছে— রামের জন্মস্থান অযোধ্যায় নয়, জগতের শ্রেষ্ঠ কবি বাল্মীকির মনে। ঋষি নারদ কবিগুরু বাল্মীকিকে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, ”তোমার মনে রামের ছবি উঠেছে সেইটি প্রকৃত সত্য, ঐতিহাসিক রামের চেয়ে বেশী সত্য, যা ঘটে সব সত্য নয়।” প্লেটো বলেছেন, আমরা মনে যেসব ছবি আঁকি তার বাস্তবতা বাইরের জিনিসের চেয়ে অনেক বেশী। সৌন্দর্যের যে ছবি আমাদের চিত্তফুটে ওঠে তা জগতের সমস্ত সুন্দর জিনিসের সমষ্টিকে নিষ্প্রভ করে দেয়।
“The idea of beauty is more beautiful than all the beautiful things in the world put together.”
জগতে অনেক রকম জিনিস আছে; সেগুলিকে তাদের মিল এবং অমিলের ভিত্তিতে পৃথক পৃথক শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়; এইভাবে সমস্ত জিনিসই আমাদের মনে সাজানো—গোছানো হয়ে গেছে। কোনো কিছু দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তাকে কোনো একটা বিশেষ পর্যায়ে বা শ্রেণীতে ফেলি এবং যেমন আমাদের মনে ব্যক্তিবিশেষের একটা ছবি ওঠে তেমনি একটা শ্রেণীরও ছবি ওঠে। এই যে শ্রেণী বা জাতির ছবি, তার অস্তিত্ব মনোময় মাত্র বলে তাচ্ছিল্য করে থাকি। এর মধ্যে একটি দুর্জয় অফুরন্ত শক্তি নিহিত আছে। এই শক্তির প্রভাবে যুগ—যুগান্তর ধরে অসংখ্য বিশিষ্ট বস্তুসমূহের উৎপত্তি হচ্ছে। আমরা জগতে অসংখ্য নরনারী দেখে থাকি। এদের কালে উৎপত্তি হচ্ছে এবং লয় হচ্ছে। এই যে ব্যক্তিসমূহ যা জল—বুদবুদের মত উঠে লয় প্রাপ্ত হয়, তাদের পশ্চাতে আছে একটি মনোময় নর এবং মনোময় নারী; এদের আদর্শ নর এবং আদর্শ নারী বলা যেতে পারে। এই যে আদর্শ নর এবং নারী তাদের পূর্ণ বাস্তবতা আছে আর যে সকল নরনারী আমরা দেখি তাদের বাস্তবতা অপূর্ণ এবং আংশিক মাত্র। রাম এবং শ্যামের মধ্যে বাস্তবতার প্রভেদ আছে; যদি রামের মধ্যে আদর্শ নরের ধর্ম বেশী প্রকাশ পায়, তাহলে রামের বাস্তবতাই বেশী বলতে হবে। মনুষ্য জাতির মূলে যে আদর্শ নরনারী অলক্ষ্যে সক্রিয় রয়েছে এবং নিজেদের বাস্তব জগতে বিশিষ্ট রূপ দিয়ে প্রকাশ করার চেষ্টা করছে তারাই সেই আদি জগৎশক্তি যার প্রভাবে এবং যাকে প্রকাশ করার জন্যে অনন্তকাল ধরে অগণিত নরনারীর সৃষ্টি হয়েছে এবং হবে। আমাদের বাস্তবতা সেই পরিমাণে যে পরিমাণে সেই আদি শক্তির প্রকাশ আমাদের মধ্যে হয়। সৃষ্টির মূলে একটি প্রেরণা আছে, সে প্রেরণা আদর্শের প্রেরণা। সে আদর্শকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, তাকে সম্পূর্ণভাবে নিজের করা যায় না অথচ তারই তাগিদে আমরা মনে কত ছবি আঁকছি এবং সেই ছবির জগৎকে জীবনে সত্য কররা চেষ্টা করছি। মানুষের সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে আদর্শের প্রভাব যে কতো বেশী, মানুষ জাতির অতীত ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই তা বোঝা যায়। যেসব বড় বড় বিপ্লব মনুষ্য সমাজে ঘটেছে তার মূলে আছে আদর্শ। এই আদর্শকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই যে আদর্শ একে চোখে দেখা যায় না এবং ইন্দ্রিয়—পথে উপলব্ধি করা যায় না, এর শক্তি কত অপরিসীম তা আমাদের বোধগম্য হয় না। জগতে আমরা চারিদিকে পরিবর্তন দেখতে পাই। সর্বদাই অসংখ্য পরিবর্তন জগতে ঘটছে, জগতের রূপ প্রতি মুহূর্তে বদলে যাচ্ছে। গ্রীক দার্শনিক হিরাক্লিটাস বলেছিলেন,
“You can not bathe twice in the same stream.”
( তুমি একই স্রোতে দুবার স্নান করতে পারো না। তিনি জগতে পরিবর্তনশীলতার কথা মানুষকে এইভাবে বোঝাতে চেয়েছেন। জগৎটা নদীর মত সর্বদা নিজের গতিবেগ নিয়েই ছুটে চলেছে। এই মুহূর্তে যে জগৎ আছে পর মুহূর্তে আর তার অস্তিত্ব থাকবে না। কিন্তু এই গতিশীলতার এই যে পরিণাম এর অর্থ কি? কিসের জন্যে এ জগৎ এরূপ প্রচন্ড গতিতে ছুটে চলেছে, এ কি পেতে চায়? এ পেতে চায় কোনো একটা নতুন অবস্থা, যে অবস্থাটা জগতের পিছনে আদর্শভাবে একটি মনোময় অস্তিত্ব নিয়ে বিরাজ করছে এবং জগতে পরিবর্তনের বন্যার সৃষ্টি করছে। ‘ক’ যখন নিজের রূপ বদলে ‘খ’ হয়, কার ইঙ্গিতে কার প্রেরণায় এই পরিবর্তনটি ঘটে? ‘ক’—এর ‘খ’—রূপী ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব ক—এর অন্তরে আদর্শভাবে বাস করে এবং নিজের প্রেরণা শক্তিতে ক—কে ‘খ’—এ পরিণত করে। আমরা ভাবি, বর্তমান অনাগত ভবিষ্যৎকে সৃষ্টি করে; কিন্তু আনাগত ভবিষ্যৎ যাকে আমরা সত্তাহীন এবং নিষ্ক্রিয় মনে করি সে যে বর্তমানের মধ্যে তার অপরিসীম প্রভাব নিয়ে লুকিয়ে থাকে এবং আদর্শের প্রেরণার দ্বারা বর্তমানকে নতুন করে গড়ে তোলে তা আমরা ভাবতে পারি না। জগতের সমস্ত পরিবর্তনের মূলে আছে অনাগত ভবিষ্যতের প্রেরণার চাপ। এ কথাটা অস্বীকার করলে জড়বাদের আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়।
এই যে আদর্শ, এ মানুষের চিত্তপটে অনেক রকম ছবি আঁকে। মানুষের মনে আদর্শ ফুটে ওঠে কারণ যে জগৎ মানুষকে সৃষ্টি করেছে, সে জগতের মূলে একটা বিরাট আদর্শের প্রেরণা আছে। এই প্রেরণা কখনও দেশপ্রেম রূপে দেখা দেয়, কখনও মানুষকে ভগবৎপ্রেমে ডুবিয়ে দেয়, কখনও বা সমগ্র মানবজাতির ওপর প্রেমের আকার ধারণ করে। মহাত্মাজীর স্বপ্ন শুধু দেশহিতৈষীর স্বপ্ন নয়, তিনি প্রধানতঃ চেয়েছিলেন মানুষকে দেবতা করতে। তিনি সমস্ত মানুষের মধ্যে দেবতাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং চেয়েছিলেন প্রত্যেক মানুষই অন্তরের দেবতাকে প্রত্যক্ষ করুক। তিনি সমস্ত জগৎটাকে একটি বিরাট ঐশী শক্তির প্রকাশ বলে গ্রহণ করেছিলেন এবং চেয়েছিলেন সমস্ত দেশ এবং সমগ্র মানবজাতি যেন জগৎটাকে শ্রীভগবানের প্রকাশ বলে গ্রহণ করে। এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে তিনি জগতে স্বর্গরাজ্য স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তিনি যে অহিংসা এবং প্রেমের ধর্ম ভারতবর্ষে প্রচার করেছিলেন তাঁর সে বাণী শুধু ভারতবর্ষের জন্যে নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্যে। তিনি নিজে ভারতবাসী এবং এই জন্যে ভারতবর্ষকেই তাঁর কর্মক্ষেত্র করেছিলেন। কিন্তু অনেক দিন পূর্বে দক্ষিণ আফ্রিকাই তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল; সেখানেই তিনি প্রথমে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন এবং সম্পূর্ণ অহিংস নীতি প্রয়োগ করে যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন। তিনি অহিংস মন্ত্রের অসীম ক্ষমতা অন্তরের মধ্যে উপলব্ধি করেছিলেন। সত্যাগ্রহকে তিনি বৈজ্ঞানিকের চোখে দেখতেন এবং অব্যর্থ অস্ত্র বলে মনে করতেন। শত্রু যত বলশালী হোক, যদি তার বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ শুদ্ধচিত্তে নির্ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়, তার পরাজয় নিশ্চিত। তাঁর নিষ্কলুষ চিত্তে সত্যাগ্রহ তার সমগ্র রূপটি নিয়ে এমনভাবে ফুটে উঠেছিল যে, তিনি তাঁর সমস্ত জীবন সেই দেবতার পূজায় সমর্পণ করেছিলেন। তিনি সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চেয়েছিএলন যে, মনুষ্য সমাজে কোনো দুর্নীতি, কোনো মিথ্যাচার থাকবে না, সকলেই ঈশ্বরে বিশ্বাসী হবে এবং সত্যাগ্রহী হবে। তাঁর এই স্বপ্ন তাঁকে যে কর্মশক্তি এবং কর্মপ্রেরণা দিয়েছিল, তাতে সমস্ত জগৎ বিস্মিত হয়েছিল! তিনি সকল মানুষকেই সমান চোখে দেখতেন। মানুষের প্রধান পাপ হচ্ছে অপর মানুষকে নিজের উদ্দেশ্যসাধনের উপায়স্বরূপ ব্যবহার করা। এই শোষণকে মনুষ্য সমাজ থেকে সম্পূর্ণরূপে দূর করতে না পারলে মনুষ্য সমাজের শ্রেয় হবে না।
”Treat humanity, whether in your own person or in that of another as an end and never as a means.”
এতে দুটি পাপের ইঙ্গিত আছে, একটি হচ্ছে অপরকে নিজের উপায় বা যন্ত্রস্বরূপ ব্যবহার করা এবং অপরটি হচ্ছে নিজেকে অপরের উপায় বা যন্ত্ররূপে পরিণত করা। এই যে নীতি এর সঙ্গে আর একটি নীতির উল্লেখ করা যেতে পারে। সেটি হচ্ছে—এমনভাবে কাজ করবে যেন তোমার কর্মের নীতি অপর সকলে গ্রহণ করতে পারবে।
”Act in such a way that the principle according to which you act may be adopted as a rule of action by all men.”
মহাত্মার স্বপ্নরাজ্য— পূর্বোক্ত নীতি দুটির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল।