গান্ধীজির শিল্পদৃষ্টি – মন্মথনাথ সান্যাল

গান্ধীজির শিল্পদৃষ্টি – মন্মথনাথ সান্যাল

‘গান্ধীজীর শিল্প দৃষ্টি। কথাটা প্রথমে একটু অদ্ভূতই শোনাবে। কটিবাস—পরিহিত, মুণ্ডিত—মস্তক, নিরাবরণ দেহ, প্রায় অনাবৃত পদ মানুষ একটি, অন্য শিল্পচর্চা দূরে থাকুক, নিজের পোষাকে পরিচ্ছদে, নিত্য ব্যবহার্য উপকরণে আয়োজনেও যিনি নিতান্তই অনাড়ম্বর, একেবারে বহুলতাবর্জিত, তাঁর ত্যাগপূত জীবন, মহনীয় নিশ্চয়ই, দেবতার মতই তিনি পূজ্য, কিন্তু রসেব ব্যাপারে তো তিনি পাষাণ দেবতারই মত সংবেদনশূন্য, আর নিঃস্পৃহ। গান্ধীজীর জীবন সম্বন্ধে সাধারণ মনের এই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া। কাজেই গান্ধীজীর একটা শিল্পদৃষ্টি আছে এবং তা আলোচনার বিষয়ীভূত হতে পারে এতে অনেকের মনে একটু বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়তো করবে।

কিন্তু তাঁরাই যদি একটু নিবিষ্ট হয়ে কথাটা চিন্তা করেন হলে বুঝতে পারবেন, কথাটা শশবিষাণের মত অলীক কিছু নয়। অন্যান্য দশটা কথার মতই বাস্তবভিত্তিক। কেন?— তারই সামান্য দু’একটা সূত্র এখানে ধরবার চেষ্টা করবো।

একটা উপমা নিয়ে আরম্ভ করা যাক। কুমোরের হাতে একতাল মাটি এল। কুমোর তাকে গুঁড়িয়ে, জলে ভিজিয়ে, মেখে নমনীয় করে নিজের মনের মত করে একটি মূর্তি তৈরী করলো। নিজের মনের ভাবকে ফুটিয়ে তুললো রূপে। কুমোর কি শিল্পী? এমনি করে চিত্রকর কতকগুলো রঙকে, ভাস্কর একখণ্ড পাথরকে, গীতকার গলার আওয়াজকে নিয়ে যে রূপসৃষ্টি করলেন, আমরা তাকে বললাম শিল্প। চিত্রকর, ভাস্কর, আর গীতকার— যাদের সাধনার রঙ, পাথর আর আওয়াজের শুষ্ক সত্তা রসনিষেকে সঞ্জীবিত হয়ে উঠবেন তাদের আমরা বলি শিল্পী।

আরও একটা উপমার আমদানী করা যাক। মরসুমী ফুলের রঙের বাহার আমাদের চোখকে তৃপ্ত করে, মন বলে ওঠে চমৎকার। সেই রঙের মহোৎসবকে আমরা সুন্দর বলে অভিনন্দিত করি। একটা গাছে ফুটে রয়েছে সাদা সাদা বেল ফুল। রঙের বৈচিত্র্য নেই, অনেকের চোখে হয়তো গড়নেও তার কোন বিচিত্রতা ধরা পড়বে না। কিন্তু তবু বেলফুলের নিটোল নিখুঁত গড়ন, ভাব শুচিস্নিগ্ধ শুভ্রতাও সুন্দর নয় কি? তা দেখেও কি চোখ বলে ওঠে না বাঃ। আরও কাছে এগিয়ে যাও, তার দিব্যগন্ধের মাধুর্যে ঘ্রাণেন্দ্রিয় আমোদিত হোক— মন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠবে এ শুধু সৌন্দর্য নয়— এ যে সুষমা। কাজেই দেখতে পাচ্ছি যে, সৌন্দর্য শুধু রূপের ফুলঝুরির মধ্যেই নিহিত নেই, ‘শুচিশুভ্র নিরাভরণতার মধ্যে, নিরাড়ম্বর সহজ বিকাশের মধ্যেও একটা সৌন্দর্য আছে এবং সে সৌন্দর্য যখন মাধুর্যের মহিমায় মণ্ডিত হয়, তখন সে উন্নীত হয় সুষমার স্তবে। অবশ্য রূপরসাস্বাদনেও রুচিভেদ, আর অধিকারী ভেদ মানতেই হবে।

যিনি জড় উপকরণকে রূপের মহিমায় বিকশিত করে তোলেন, তাঁকে তো আমরা বিনা দ্বিধায়ই শিল্পী অভিধা দিয়ে থাকি। কিন্তু যিনি কাদামাটির মতই অপরিণত জীবনকে একাগ্র নিষ্ঠা, নিরলস সাধনা, সূক্ষ্ম মাত্রাবোধ আর পরিচ্ছন্ন সংযম দিয়ে সুঠাম সুসম করে গড়ে তোলেন, বিকশিত করে তোলেন, তাতে সুভ্র শুচিতা, জ্বালাহীন উজ্জ্বলতা, অতীক্ষ্ন ঋজুতা, মাধুর্যানুলিপ্ত কাঠিন্য, দৈন্যহীন সাবল্য, আব অনুগ্র সংযম, তিনিও কি শিল্পী নন? তার সাধনার সে সৃষ্টি কি শিল্পবস্তুর মহিমায় মহিমান্বিত নয়? পটে, পাথরে, বা মাটিতে যাঁর ভাব রূপ পেলো তিনি যদি শিল্পী হন, তাহলে যাঁর ভাবের শ্বেত পদ্মটি জীবনের অনুপম মহিমায় বিকশিত হয়ে উঠলো; তিনিও যে শিল্পী, শুধু শিল্পী নন শ্রেষ্ঠ শিল্পী; সহজ যুক্তিতে ও সরল বিচার বুদ্ধিতে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছুতে হয়। অন্য দেশের কথা জানিনে, আমাদের দেশের মনীষীরা কিন্তু জীবনশিল্পের যিনি শিল্পী তাঁকেই বলেছেন শ্রেষ্ঠ শিল্পী, তাঁর সৃষ্টিকেই বলেছেন প্রকৃত সৌন্দর্য। একথার পরিপোষককার জন্য দুএকটা উদ্ধৃতি দেওয়া যাক।

ঐতরেয় ব্রাহ্মণ বলেছেন— আত্মসংস্কৃতির্বাব শিল্পানি ছন্দোময়ং বা এতৈ—র্বজমান আত্মনং সংস্কুরুতে। অর্থাৎ আত্মসংস্কৃতিই শিল্প। যজমান শিল্পের ছন্দে আত্মারই সংস্কার করে।

আত্মসংস্কার সাধন করা,— জীবনকে ছন্দোময় করে তোলাই যে শিল্পসাধনা বৈদিক ঋষি সে কথাটা স্পষ্ট ভাষায়ই বলেছেন। জীবনশিল্প সাধনার প্রসঙ্গে বৈদিক ঋষির ছন্দ কথাটার প্রয়োগ শুধু সার্থক নয় অপরিহার্য। ছন্দ বলতে বুঝায় নিয়মানুগ গতি বা স্পন্দন। কোন কোন ভারতীয় দার্শনিকের মতে সমস্ত জগতেরই সৃষ্টি হয়েছে ছন্দ থেকে। আর বিশ্ব জগৎ বিধৃতও হয়ে আছে ছন্দে। এই বিশ্বছন্দের সঙ্গে জীবনের ছন্দ মিলনই জীবনশিল্পের সাধনা। যিনি বিশ্ব—বীণকরের হাতে বাঁধা বীণার তারের সঙ্গে নিজের জীবনবীণার তারগুলোকে যতটা সুরসঙ্গতে বাঁধতে পারবেন তাঁর জীবন শিল্পের সাধনা সেই পরিমাণেই সার্থক হয়ে উঠবে, সেই পরিমাণে তাঁর জীবন হবে সুন্দর, হবে সুষমাময়। ছন্দের সঙ্গে সুন্দর কথাটার সম্বন্ধ অঙ্গাঙ্গী। বেসুরো যা যা কিছু এলোমেলো তাকে কোন অরসিকও সুন্দর বলতে সম্মত হবেন না নিশ্চয়ই। রসশাস্ত্রের অনুপম গ্রন্থ উজ্জ্বল নীলমণি প্রণেতা শ্রীমদ রূপগোস্বামী একটি মাত্র বাক্যে সৌন্দর্যের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তাতে অতি সহজেই সৌন্দর্যের মূল তত্ত্বটি ধরা পড়েছে। তিনি বলেছেন ‘ভবেৎ সৌন্দর্যমঙ্গানাং সন্নিবেশঃ যথোচিতম।’ অর্থাৎ যে অঙ্গের যেখানে সন্নিবেশ করা দরকার তাকে যদি ঠিক সেই জায়গায় সন্নিবিষ্ট করা যায় তাহলেই সৌন্দর্যের সৃষ্টি করা হয়। একথা যেমন চিত্র, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, কাব্য, সঙ্গীত সম্বন্ধে খাটে তেমনি খাটে জীবন সম্বন্ধেও। বিশ্বচ্ছন্দের সঙ্গে জীবনের ছন্দকে এক সুষম সঙ্গতে যিনি বাঁধতে পেরেছেন, তাঁর জীবনকেই বলা চলে সত্যকার সুন্দর জীবন, আর যিনি নিরলস সাধনার দ্বারা সেই সুছন্দ জীবনকে গড়ে তুলেছেন, তিনিই সত্যকার শিল্পী। জীবনকে বিশ্বছন্দের সঙ্গে মেলাতে গেলে, দেহ মন আত্মার অনন্ত বৃত্তিগুলোর যথাযথ সন্নিবেশের কথাই এসে পড়ে। কারণ শীতের হাওয়ায় যেমন গাছের শ্যামল শোভা বিশীর্ণ হয়ে ঝরে পড়ে ছন্দহীন বিশৃঙ্খল জীবনের নিঃশ্বাসেও সৌন্দর্যের পাপড়িগুলো তেমনি শোভাহীন হয়ে যায়।

এই কথাটিই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনুপম ভাষায় বলেছেন তাঁর সৌন্দর্য বোধ শীর্ষক প্রবন্ধে। তিনি বলেছেন: সৌন্দর্য মূর্তিই মঙ্গলের পূর্ণ মূর্তি এবং মঙ্গল মূর্তিই সৌন্দর্যের পূর্ণস্বরূপ। তিনি আরও বলেছেন:— বস্তুত সৌন্দর্য যেখানেই পরিণতি লাভ করিতেছে সেখানেই সে আপনার প্রগলভতা দূর করিয়া দিয়াছে। সেখানেই ফুল আপনার বর্ণগন্ধের বাহুল্যকে ফলের গূঢ়তর মাধুর্যে পরিণত করিয়াছে। সেই পরিণতিতেই সৌন্দর্যের সহিত মঙ্গল একাত্ব হইয়া উঠিয়াছে।

সৌন্দর্য ও মঙ্গলের এই সম্মেলন সাধিত হয়েছে সেই অসামান্য মানুষ যে কেবল নিজের জীবনকেই এক অপূর্ব শিল্প সত্তাকে পরিণত করেছেন, তা নয়, মানুষের শিল্পী মনকেও তা এমনভাবে নাড়া দিয়েছে যে তার ফলে কাব্য চিত্র ভাস্কর্য পেয়েছে প্রকর্ষের আস্বাদ। রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই আবার কথাটা বলা যাক — মানুষের মধ্যে যাঁহারা নরোত্তম, ধরাতলে যাঁহারা ঈশ্বরের মঙ্গলস্বরূপের প্রকাশ, তাঁহারা আমদের মনকে এতদূর পর্যন্ত টান দেন; সেখানে আমরা নিজেরাই নাগাল পাই না। এইজন্য যে রাজপুত্র মানুষের দুঃখমোচনের উপায় চিন্তা করিতে রাজ্য ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন, তাঁহার মনোহারিতা মানুষকে কত কাব্য, কত চিত্র রচনায় লাগাইয়াছে, তাহার সীমা নাই।”

এতক্ষণ যে কথাগুলো বলতে চেয়েছি তা হল এই যে, জীবনকে যিনি সুন্দর ও মহৎ করে গড়ে তুলেছেন, বিশ্বছন্দের সঙ্গে যিনি নিজের জীবনের ছন্দকে সামঞ্জস্যের সুষমায় মিলিয়ে দিতে পেরেছেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ শিল্পী এবং তাঁর সাধনাই প্রকৃত শিল্পসাধনা। সেইসঙ্গে একথাও বলতে চেয়েছি যে, প্রকৃত যে সৌন্দর্য রঙচঙের ঘটা, প্রসাধনের আড়ম্বর, বা অলঙ্করণের প্রাচুর্যের মধ্যে তা নিহিত নেই, সহজ সংযত সারল্য আর শুচিশুভ্র সংস্কার মধ্যে। এবং এদিক দিয়ে বিচার করলে মহাত্মা গান্ধীর জীবন একটি শ্রেষ্ঠ শিল্পসৃষ্টি আর তিনি মহত্তম শিল্পীদেরই একজন।

দিলীপকুমার মহাত্মাজীর উক্তি বলে যা লিপিবদ্ধ করেছেন, এ প্রসঙ্গে সে কথাগুলো উল্লেখযোগ্য। দিলীপকুমার বলেছিলেন যে, মহাত্মাজী যেরূপ কৃচ্ছ্রসাধনার জীবন যাপন করেন তাতে জনসাধারণের এই ভাবাই তো স্বাভাবিক যে তাঁর শিল্পপ্রীতি নেই। উত্তরে মহাত্মাজী বলেন,— ”কিন্তু কেন তারা বুঝবে না যে, সন্ন্যাসই হল জীবনের সব চেয়ে বড় শিল্প?” সন্ন্যাসকে শিল্প বলাতে দিলীপকুমারও একটু চমকিত হলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন— ”সন্ন্যাস—শিল্প?” উত্তরে মহাত্মাজী যা বললেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বললেন, ”নব’ শিল্প আসলে কী? না, সরল সুষমা বটেতো? আর সন্ন্যাস কী? না, সবলতম সুষমাকে প্রতিদিনের জীবনে পরম সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা—সব চোখধাঁধান কৃত্রিমতা ও ভাণ বাদ দিয়ে প্রতিপদে খাঁটী থাকার সাধনা। তাই তো আমি প্রায়ই বলি যে সাচ্চচা সন্ন্যাসী যে কেবল শিল্পের সাধনা করে তাই নয়—তার জীবনটাই অখন্ড শিল্পকারু।’

একথা যাঁরা মেনে নেবেন, তাঁদের মনেও এ প্রশ্ন জাগবে এবং জাগাই স্বাভাবিক যে, সাধারণ কথায় আমরা যাকে শিল্প বলি, আমাদের চিত্রকর, ভাস্কর, সুরকার, বা কবির মনের সাধনা যাতে রূপ গ্রহণ করে, সেই শিল্পগুলো সম্বন্ধে মহাত্মাজী কি বলতে চেয়েছেন, কি দৃষ্টিতেই বা তিনি সেগুলোকে দেখেছেন। যাঁরা মহাত্মাজীর লেখা নিয়ে আলোচনা করেছেন, তাঁরা জানেন তাঁর কোন লেখার ভেতরে এ সম্বন্ধে তিনি যা বলতে চেয়েছেন তা তাঁর বিশাল রচনাসম্ভারের নানা স্থানে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে রয়েছে। ১৯২৪ সালে শান্তিনিকেতনের তদানীন্তন ছাত্র শ্রীরামচন্দ্রনের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে এবং ১৯২৪ ও ১৯২৬ সালে বিখ্যাত সুরশিল্পী শ্রীদিলীপকুমার রায় মহাশয়ের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি শিল্পতত্ত্ব সম্বন্ধে একটু বিস্তৃতভাবেই তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। প্রথম আলোচনার বিবরণ মরাত্মাজীর নিত্য সহচর ‘মহাদেবদেশাই ১৯২৪ সালের ১৩ নভেম্বরের ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় প্রকাশ করেন। দিলীপকুমার তাঁর তীর্থঙ্কর গ্রন্থে মহাত্মাজীর সঙ্গে তাঁর আলোচনার কথা বিবৃত করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, তাঁর এই বিবরণ মহাত্মাজী দেখে দিয়েছেন এবং তাঁর অনুমতি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। মহাত্মাজীর শিল্পদর্শন সম্বন্ধে অনুসন্ধিৎসু পাঠক মহাত্মাজী শিল্পকে কি দৃষ্টিতে দেখতেন তার একটা মোটামুটি পরিচয় এই প্রবন্ধ দুটোতে পাবেন। তাঁর শিল্প—দর্শন সম্বন্ধে পূর্ণতর পরিচয় পেতে হলে তাঁর রচনার বিভিন্ন স্থানে ছড়ানো বাণীগুলোকে একত্রে গ্রথিত করে তা নিয়ে আলোচনা করা আবশ্যক। এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে সেরূপ বিস্তৃত আলোচনা করা সম্ভবপর হবে না। এখানে আমরা কেবল তার শিল্প—দর্শনের মূল কথাগুলো সংক্ষেপে বোঝবার চেষ্টা করবো।

শ্রীমতী আগাথা হ্যারিসন এক সময়ে মহাত্মাজীকে প্রশ্ন করেছিলেন ”আপনি কি মানুষকে বলবেন না যে, ক্ষুদ্র এক খন্ড ভূমিতে ফুলের চাষ করো? দেহের পক্ষে যেমন খাদ্য আবশ্যক আত্মার পক্ষেও তো রঙ ও সৌন্দর্যের প্রয়োজন তেমনি!” এই প্রশ্নের উত্তরে মহাত্মাজী যা লিখেছিলেন তার থেকেই অল্পকথায় তাঁর শিল্পদৃষ্টির একদিককার একটা আভাস পাওয়া যাবে। তিনি বলেছিলেন —”No I won’t Why can’t you see the beauty of colour in vegetables? And then, there is beauty in the speckless sky. But no, you want the colours of the rainbow which is a mere optical illusion. We have been taught to believe that what is beautiful need not be useful and what is useful cannot be beautiful. I want to show that what is useful can also be beautiful.”

অর্থাৎ না, আমি বলবো না। শাকসব্জীর মধ্যে তোমরা রঙের সৌন্দর্য দেখতে পাও না কেন? তাছাড়া, নির্মেঘ আকাশেও সৌন্দর্য রয়েছে। কিন্তু না, তোমরা রামধনুর রঙ, যা দৃষ্টির বিভ্রম মাত্র, তাই চাও। আমাদের এই বিশ্বাস করতে শেখানো হয়েছে যে, যা সুন্দর তাকে প্রয়োজনীয় হতে হবে না, আর যা প্রয়োজনীয় তা সুন্দর হতে পারেনা। আমি দেখতে চাই যে, যা প্রয়োজনীয় তাও সুন্দর হতে পারে।

সৌন্দর্য ও প্রয়োজনের মধ্যে সম্পর্ক কি এ নিয়ে রূপতাত্ত্বিকদের মধ্যে বহুকাল মতবিরোধ চলে আসছে। কিন্তু কোন মীমাংসায়ই এ পর্যন্ত তাঁরা পৌঁছান নি। প্রয়োজনের স্পর্শ লাগলেই সৌন্দর্য তার জাত খোয়াবে এ মত যাঁরা পোষণ করেন, মহাত্মাজী যে রূপতত্ত্বে সে দলভুক্ত নন উপরের উদ্ধৃতি থেকেই তা বোঝা যাবে। প্রসঙ্গত এখানে একটা কথা বলা যেতে পারে। সে কথাটা এই যে, যারা শুধু প্রয়োজনাতীতের মধ্যেই সৌন্দর্যের সন্ধান পান, তাঁদের সৃষ্টি যে অপর দলের চেয়ে অপরিসর, তা বললে বোধ হয় অবিচার করা হবে না। কারণ দ্বিতীয়দলের রূপতাত্ত্বিক যাঁরা, তাঁরা প্রয়োজনীয়তার মধ্যেও যেমন সুন্দরকে দেখেন, প্রয়োজনাতীতের মধ্যেও তেমনি সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে তাঁরা কুন্ঠিত হন না। উদাহরণ দিয়ে বলা যেতে পারে যাঁরা পালংশাকের সবুজ শোভায় সৌন্দর্যের সন্ধান করেন, ফুলের সৌন্দর্য উপভোগে তাঁদের কোন বাধা হয় না। কিন্তু প্রথম দল ফুলের সৌন্দর্য উপলব্ধিতে যতই মুখর হন না কেন, পালং ক্ষেত্রের হরিৎ শোভাকে সুন্দর বলে মেনে নিতে মতবাদের খাতিরেও অন্তত একটা কুন্ঠা বোধ করেন। প্রয়োজন ও সৌন্দর্য সম্বন্ধে মনীষী এমার্সন যা বলেছেন, প্রাসঙ্গিক বলেই তা এখানে উদ্বৃত করে দিচ্ছি। তিনি বলেছেন—“Beauty must come back to the useful arts, and the distinction between the fine and the useful arts be forgotten. If history were truly told, if life were nobly spent, it would be no longer easy or possible to distinguish the one from the other. It is therefore beautiful, because it is alive, moving, reproductive, it is therefore useful, because it is symmctrical and fan.”

অর্থাৎ প্রয়োজনীয় শিল্পের মধ্যেও সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করতে হবে এবং চারুশিল্প ও কারুশিল্পের পার্থক্য ভুলে যেতে হবে। ইতিহাসকে যদি সত্যভাবে বিবৃত করা হয়, জীবন যদি মহৎভাবে ব্যাপিত হয়, তা হলে ওর একটিকে আর একটি থেকে পৃথক করা আর সহজ বা সম্ভব হবে না। প্রকৃতিতে সবই প্রয়োজনীয়, অথচ সবই সুন্দর। সে জীবন্ত, চলন্ত ও সৃষ্টিশীল বলেই সুন্দর আর সুসমঞ্জস ও মনোরম বলেই প্রয়োজনীয়।

শিল্পকলা সম্বন্ধে গান্ধীজীর মতামত, আলোচনা করতে গিয়ে মোটামুটি দুটি কথা বলতে চেয়েছি। তার প্রথমটি হল এই যে, জীবনকে যিনি সদাজাগ্রত সাধনার দ্বারা পরিপূর্ণ বিকাশের পথে যত বেশীদূর এগিয়ে দিয়েছেন, যিনি তাকে পরিপূর্ণতার যত কাছাকাছি নিয়ে গেছেন, তিনি তত বড় শিল্পী। একথাটি যে ভারতীয় শিল্পতত্ত্বের গোড়ার কথা বৈদিক ঋষি, রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজীর উক্তি উদ্বৃত করে তা দেখাতে চেষ্টা করেছি। শিল্পতত্ত্বে ভারতীয় চিন্তাধারার একটা ঐতিহ্যগত যোগসূত্রের ইঙ্গিতও এতে নিশ্চয়ই পাওয়া যায়। এ সম্বন্ধে গান্ধীজীর অভিমত যে কত দৃঢ় ও সুস্পষ্ট, তা দেখাবার জন্য তাঁর লেখা থেকে এখানেও একটি অংশ উদ্ধৃত করছি। তিনি লিখেছেন:—

“As I am nearing the end of my earthly life I can say that purity of lits is the highest and truest art. The art of producing good music from a cultivated voice can be achieved by many, but art of producing that music from the harmony of a pure life is achieved very rarely.”

অর্থাৎ ‘আমি পার্থিব জীবনের সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি বলেই বলতে পারি যে, জীবনের শুচিতাই হল মহত্তম ও সভ্যতম শিল্প। স্বরানুশীলনের ফলে অনেকেই ভাল সঙ্গীতকলা সৃষ্টি করতে পারন, কিন্তু শুচিশুভ্র জীবনের, সুসমতার ফলে যে সঙ্গীতের সৃষ্টি হয়, তা কদাচিৎ কারো আয়ত্ত হয়।’

দ্বিতীয়ত আমরা দেখেছি যে, গান্ধীজীর সৌন্দর্যবোধ প্রয়োজন আর প্রয়োজনাতীতের গণ্ডি দিয়ে সীমাবদ্ধ নয়। প্রয়োজনীয়ের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যও যেমন তাঁর সমুদার দৃষ্টির সম্মুখে স্ফূরিত হয়, শিল্পতাত্ত্বিকরা যাকে ‘শিল্প’ সংজ্ঞা দিয়ে বলতে চান প্রয়োজনাতীত তারও মধ্যে প্রয়োজনের সত্তাটি তাঁর সন্ধানী চোখে তেমনই ধরা পড়ে। কিন্তু কেবল প্রয়োজন—প্রয়োজনাতীতের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিলেই ত আর শিল্পতত্ত্বের সবকথা বলা হয় না। আরও অনেক প্রশ্ন মনের মধ্যে জেগে ওঠে, অনেক সন্দেহ উঁকিঝুকি মারে। প্রথমেই যে কথাটা মনে জাগে তা হ’ল এই যে, প্রয়োজনীয় ও তথাকথিত প্রয়োজনাতীত উভয়ই গান্ধীজীর মতে শিল্প বলে পরিগণিত হতে কোন বাধা নেই বটে, কিন্তু শিল্প বলতে বস্তুত তিনি কি বোঝেন বা বোঝাতে চান তা ঐ কথাতে মোটেই স্পষ্ট হয় না। কাজেই গান্ধীজীর মতে শিল্প কি, সে কথাটা বোঝবার চেষ্টা করা প্রয়োজন।

গান্ধীজীর মতে শিল্প যা, তা সত্যকে প্রকাশ করবে, করবে আত্মার বিকাশে সহায়তা। সেই শিল্পের যিনি স্রষ্টা তিনিই হলেন প্রকৃত শিল্পী।

“ Jesus, to my mind, was a supreme artist because he saw and expressed truth.”

আমার মতে যীশু একজন পরম শিল্পী, কারণ তিনি সত্যের দেখা পেয়েছিলেন এবং সত্যকে সত্যকে প্রকাশ করেছিলেন— একথা তিনি খুব দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছিলেন। জিজ্ঞাসু গান্ধীজীকে প্রশ্ন করেছিলেন, কিন্তু এমনও তো দেখা গেছে, জীবন যাদের সংযত ও সুন্দর নয় তাঁরাও অপূর্ব সৌন্দর্যের, অনুপম শিল্পের সৃষ্টি করেছেন।

এর উত্তরে গান্ধীজী যা বলেছিলেন, তাতে যে শুধু তাঁর সত্যনিষ্ঠা ও শিল্পরুচিরই পরিচয় পাওয়া যায় তা নয়, মনোবিজ্ঞানের একটা বড় তত্ত্ব সম্বন্ধেও তাঁর সচেতনতার প্রমাণ আমরা পাই। সে তত্ত্বটি হল দ্বৈত ব্যক্তিত্ব বা ইংরেজিতে যাকে বলে dual personality। একই মানুষের মধ্যে যে পাশাপাশি দেবত্ব ও দানবত্ব, শিল্পী আর অশিল্পী, সাধু ও অসাধু একই সঙ্গে বর্তমান থাকতে পারে, মনোবিদেরা মানুষের ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণ করে তা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। জীবনের সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা সেই সত্যেরই পরিচয় পাই। কাজেই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নটির জবাবে গান্ধীজী সেই সত্যটিকেই জিজ্ঞাসুর কাছে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন:—

“Trust only means that truth and untruth often co-exist, good and evil are often found together. In an artist also not seldom the right perception of things and the wrong co-exit. Truly beauttiful creations come when right perception is at work. If these moments are rare in life they are also rare in Art.”

অর্থাৎ তাতে শুধু এই বোঝা যায় যে, সত্য ও অসত্য অনেক সময় এক সঙ্গেই থাকে, ভাল এবং মন্দকে প্রায়ই পাশাপাশিই থাকতে দেখা যায়। শিল্পীর মধ্যেও বস্তুর সত্যানুভূতি ও অসত্যানুভূতি অনেক সময়ই পাশাপাশি থাকে। যখন সত্যানুভূতি সক্রিয় হয়, তখনই সত্যিকার রূপসৃষ্টি সম্ভব হয়। এরূপ মুহূর্ত জীবনেও যেমন শিল্পেও তেমনি দুর্লভ।”

রবীন্দ্রনাথও একস্থানে তাঁর কাব্যময় ভাষায় এই কথাই বলেছেন:—

”কলাবান গুণীরাও যেখানে বস্তুত গুণী, সেখানে তাঁহারা তপস্বী, সেখানে যথেচ্ছাচার চলিতে পারে না; সেখানে চিত্তের সাধনা ও সংযম আছেই। অল্প লোকই এমন পুরোপুরি বলিষ্ঠ যে, তাঁহাদের ধর্মবোধকে ষোলো আনা কাজে লাগাইতে পারেন। কিছু না কিছু ভ্রষ্টতা আসিয়া পড়ে। কারণ, আমরা সকলে হীনতা হইতে পূর্ণতার দিকে অগ্রসর হইয়া চলিয়াছি। চরমে আসিয়া দাঁড়াই নাই। কিন্তু জীবনে আমরা যে কোনো স্থায়ী বড়ো জিনিস গড়িয়া তুলি, তাহা আমাদের অন্তরের ধর্মবুদ্ধির সাহায্যেই ঘটে, ভ্রষ্টতার সাহায্যে নহে। গুণী ব্যক্তিরাও যেখানে তাঁহাদের কলা রচনা স্থাপন করিয়াছেন, সেখানে তাঁহাদের চরিত্রই দেখাইয়াছেন, যেখানে তাঁহাদের জীবনকে নষ্ট করিয়াছেন, যেখানে চরিত্রের অভাব প্রকাশ পাইয়াছে, সেখানে, তাঁহাদের মনের ভিতরে ধর্মের যে একটি সুন্দর আদর্শ আছে, রিপুর টানে তাহার বিরুদ্ধে গিয়া পীড়িত হইয়াছেন। গড়িয়া তুলিতে সংযম দরকার হয়, নষ্ট করিতে অসংযম। ধারণা করিতে সংযম চাই, আর মিথ্যা বুঝিতেই অসংযম।”

যেমন শিল্পী সম্বন্ধে তেমনি শিল্প সম্বন্ধেও গান্ধীজীর বিচারের মানদণ্ড হল সত্য। যাতে মানুষকে সত্য উপলব্ধিতে সাহায্য করে না, মানুষকে যা পরিপূর্ণতার পথে এগিয়ে দেয় না, তাকে ‘শিল্প’ সংজ্ঞা দিতে তিনি স্বভাবতই কুন্ঠিত। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন—

“These production of man’s Art have their value onl;y so far as they help the soul onwards towards self-realisation.”

অর্থাৎ মানুষের শিল্পসৃষ্টির ততটুকুই সার্থকতা আছে যতটুকু আত্মোপলব্ধির দিকে তা অগ্রসর করে দেয়।’ একটা কথা এখানে বোঝা আবশ্যক, যে গান্ধীজী আত্মোপলব্ধি বা সত্যোপলব্ধি বলতে বস্তুতঃ একই জিনিস বোঝাতে চেয়েছেন।

তারপর গান্ধীজী আরও অগ্রসর হয়ে গেছেন। সত্যিকার যা শিল্প তাতে মানুষকে তার আত্মোপলব্ধিতে সাহায্য করবে বটে কিন্তু সেরূপ শিল্প সৃষ্টি কি যে কেউ করতে পারে? গান্ধীজী বলেছেন, না। যাঁর স্বচ্ছ দৃষ্টিতে সত্যের মধ্যে রূপ ফুটে ওঠে, সত্যকেই যিনি সৌন্দর্য বলে উপলব্ধি করতে পেরেছেন ঐরূপ মহৎ শিল্পের সৃষ্টি সেইরূপ শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব।

Whenever men begin to see beauty in truth, then true Art will arise.

অর্থাৎ তখনই সত্যকার শিল্পের সৃষ্টি হবে, যখন মানুষ (শিল্পী) সত্যের মধ্যে সৌন্দর্যের সন্ধান পাবে। কারণ সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন সৌন্দর্যের পৃথক অস্তিত্বকেই গান্ধীজী স্বীকার করেন না।

(There is then, as I have said. no Beauty apart from Truth)

সত্য ও সৌন্দর্যের এই অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধের কথা প্রতীচোর কয়েকজন মনীষীও এমনই জোরের সঙ্গে বহু স্থানে বলেছেন। আমরা তার মধ্যে একজনের লেখা থেকে সামান্য দু—একটা অংশ উদ্ধৃত করে দিচ্ছি।

ইংলন্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক ও শিল্প—সমালোচক মনস্বী রাস্কিন বলেছেন :—

But I say that the art is greatest which conveys to the mind of the spectator, by any means whatsoever, the greatest number of the greatest idea : and I call an idea great in proportion as it is received by a higher faculty of the mind and as it more fully occupies, and in occupying, exercises and exalts the faculty by which it, is received.

If this then be the definition of great art that of a great artist naturally follows. Be is the greatest artist who has embodied, in the sum of his works, the greatest number of the greatest ideas.

অর্থাৎ যে শিল্প দর্শকের মনে যে কোন উপায়েই হউক না, সবচেয়ে বেশি পরিমাণে মহৎভাব সঞ্চারিত করতে পারে, আমি সেই শিল্পকেই শ্রেষ্ঠ শিল্প বলি। চিত্তের উন্নত বৃত্তির কাছে যে পরিমাণে সেই ভাব গ্রহণীয় হয় এবং সেই বৃত্তিতে অধিষ্ঠিত হবে যেভাব তাকে ক্রিয়াশীল ও উন্নীত করে মহৎ ভাব বলতে আমি সেইভাবই বুঝি।

এই যদি শ্রেষ্ঠ শিল্পের সংজ্ঞা হয়, তাহলে এর থেকেই বুঝা যাবে, শ্রেষ্ঠ শিল্পীর সংজ্ঞা কি হবে। যে শিল্পী তার দৃষ্টিতে সব চেয়ে বেশি মহৎ ভাবের সন্নিবেশ করতে পেরেছেন তিনিই শ্রেষ্ঠ শিল্পী।

মিঃ রাস্কিন অন্যত্র বলেছেন:—

 “The next characteristic of great art is that it includes the largest possible quantity of truth in the most perfect possible harmony.”

অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ শিল্পের আর একটা বৈশিষ্ট্য এই যে সত্য অত্যন্ত সুসমঞ্জভাবে তার অন্তর্নিহিত হয়ে থাকে।

ঋষিপ্রতিম টলস্টয়, মনীষী এমার্সন এবং প্রতীচ্যের আরও অনেক শিল্পরসজ্ঞ মনীষীর লেখা থেকে অনুরূপ উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু প্রবন্ধে অতিবিস্তৃতির আশঙ্কায় আমরা সেগুলোর উল্লেখ এখানে আর করলাম না।

শিল্প সম্বন্ধে গান্ধীজীর আর একটা দাবী এই যে, সত্যকার যে শিল্প তার আবেদন হবে সর্বজনীন। যে শিল্পের আবেদন পৃথিবীতে কেবল কয়েকজন মানুষের মনেই সাড়া জাগায়, কোটি কোটি মানুষের চিত্ত যার কাছে গিয়ে ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে, তা থেকে কোনই প্রেরণা পায় না, যার রহস্যলোকের চাবি কাঠিটি কয়েকজন বিশেষ মানুষের কেবল অধিকারে, অগণিত রসপিপাসু মনের আকুতি যার রহস্যের দ্বার উদ্ঘাটিত করতে পাবে না, না পায় তাতে প্রবেশের অধিকার, সে আর্ট গান্ধীজীর মতে ব্যর্থ— তাঁকে মহৎ শিল্প নামে অভিহিত করতেও গান্ধীজী কুন্ঠিত। যেমন ধর্মজগতে তেমনি শিল্পের ক্ষেত্রেয়ও গান্ধীজী সে দেবতার পায়ে মাথা নোয়াতে নারাজ, যার কাছে কোটি কোটি মানুষ অচ্ছুত বলে পায় না প্রবেশের অধিকার। দিলীপকুমারের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে গান্ধীজী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই কথাই বলেছেন:—

”…আমি তাহাকে মহৎ শিল্প বলি না যার কদর শুধুই বিশেষজ্ঞদের কাছে—অর্থাৎ টেকনিকের অন্ধি সন্ধি না জানলে যার কোনো মাথামুণ্ডুই পাওয়া যায় না। আমি মনে করি যে মহৎ শিল্পের আবেদন ঠিক প্রকৃতির সৌন্দর্যের মতই বিশ্বজনীন। চুলচেরা বিচার নিয়ে মাথা ঘামানোর নামই যে শিল্পবোধ এ আমি ভাবতেই পারি না। খাঁটি রসবোধের সঙ্গে সমজদারিয়ানা ও তানটানের চেকনাইয়ের কোন সম্বন্ধই নেই। ভাব বেশ হবে সরল— তার প্রকাশ হবে সহজ—ঐ যে বললাম ঠিক প্রকৃতির প্রাঞ্জল ভাষার মতন।” (তীর্থঙ্কর, ৬১ পৃঃ) অন্যত্রও তিনি এই ধরণের অভিমত অনেক স্থানে ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন—

“I want art and literature that can speak top the millions.”

যে শিল্প ও সাহিত্য কোটি কোটি মানুষের বোধগম্য সেইরূপ শিল্প ও সাহিত্যই আমি চাই।”

“Here too, just as elsewhere, I must think in term of millions.”

”যেমন অন্যত্র তেমনি শিল্পের ক্ষেত্রেও আমি জনসাধারণের দিকে লক্ষ্য রেখেই বিচার করবো।” আর এক স্থানে তিনি বলেছেন—

“I love music and all other arts, but I do not attach such value to them as is generally done. I cannot for example recognise the value of those activities which require technical knowledge for their understanding.”

আমি সঙ্গীত ও অন্যান্য শিল্প ভালবাসি, কিন্তু সাধারণতঃ এর উপর যে মূল্য আরোপ করা হয় তা আমি করি না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, যে সমস্ত শিল্পকার্য বুঝতে হলে টেকনিকের জ্ঞান অপরিহার্য তার মূল্য আমি উপলব্ধি করতে পারি না।”

পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক মনীষী কাউন্ট লিও টলস্টয়ের ‘What is art?’ বইখানায় নাম অনেকেরই জানা। মনস্বী লেখক এই গ্রন্থে যে নিষ্ঠা, যে দরদ এবং যেরূপ তদগত হয়ে শিল্পতত্ত্বের আলোচনা করেছেন তাঁর তুলনা দুর্লভ। আমরা শিল্পী ও শিল্পরসিক সকলকেই বইখানা পড়ে দেখতে অনুরোধ করি। শিল্পের ভবিষ্যৎ রূপ সম্বন্ধে টলস্টয় যে স্বপ্ন দেখেছেন, গান্ধীজীর পূর্বোক্ত মতবাদের সঙ্গে তার আশ্চর্য সঙ্গতি রয়েছে। তিনি বলেছেন:—

Artistic activity will then be acessible to all men. It will become accessible to all men. It will become accessible to the whole people because (in the first place) in the art of the future not only will that complex technique which deforms the productions of the art of today, and requires so great an effort and expenditure of time, not be demanded but on the contrary the demand will be for clearness, simplicity and brevity–conditions brought about not by mechanical methods but through the education of taste.

অর্থাৎ শিল্পকার্য তখন সকল মানুষেরই অধিগম্য হবে। আজিকার শিল্পদৃষ্টি টেকনিকের যেযে মারপ্যাচে বিকৃত হয়, তাতে যে বিফল প্রবাস ও সমবরায়ের প্রয়োজন হয় ভবিষ্যৎ কালের শিল্পে তা থাকবে না বলেই তা সর্বজনের অধিগম্য হবে। ভবিষ্যতের শিল্প হবে স্পষ্ট, সরল ও সংহত। শিল্পে এ অবস্থা আনতে কোন যন্ত্রবন্ধ পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হবে না, রুচিশিক্ষার ভিতর দিয়েই শিল্পে এ (স্পষ্ট ও সংহত সরলতা) আনা যাবে।

এখানে মনে রাখা দরকার যে, গান্ধীজী শিল্প সম্বন্ধে যা বলেছেন তা’হল তাঁর মতে শিল্পের আদর্শ। যে শিল্পী এই আদর্শের যত কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছুতে পারবেন, তাঁর শিল্প সাধনা হবে সেই পরিমাণে সার্থক, শিল্পী হিসাবে তাঁর স্থান কোথায় তার বিচারও সেই নিরিখেই করা হবে। তবে শিল্পসৃষ্টি করতে গিয়ে শিল্পীকে কোন লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে হবে। গান্ধীজীর পুর্বোদ্ধৃত উক্তিগুলো থেকে তার যেমন ইঙ্গিত পাওয়া যাবে তেমনি পাওয়া যাবে তাঁর নিম্নোদ্ধৃত উক্তিটি থেকে আমাদের দেশে, শুধু আমাদের দেশে কেন সব দেশেই এমন শিল্পীর অভাব নেই যাঁরা আঙ্গিকের কারিকুরির উপরই শিল্পের সার্থকতা নির্ভর করে বলে মনে করেন এবং তার উৎকর্ষ সাধনেই সময় ও চিন্তা ব্যয় করেন। এই আঙ্গিকপ্রাণ শিল্পবাদের প্রতিবাদ—স্বরূপই যেন গান্ধীজী বলেছেন—

“True art takes note not merely of form but also of what lies behind. There is an art that kills and an art that gives life. True art must be evidence of happiness contentment and purity of its authors.”

অর্থাৎ ”প্রকৃত যে শিল্প তা শুধু বাহ্য আকার সম্বন্ধেই অবহিত নয়, আকারের অন্তরালে যা আছে সে সম্বন্ধেও সচেতন। শিল্প যেমন জীবনপ্রদ হতে পারে তেমনি এমন শিল্পও আছে যা জীবনধ্বংসী। সত্যকার যে শিল্প তা শিল্পীর আনন্দ, তৃপ্তি ও পবিত্রতার পরিচয় দেবে।”

শিল্পকে গান্ধীজী কি দৃষ্টিতে দেখেন তার মোটামুটি আলোচনা করেছি। এই আলোচনা প্রসঙ্গে দেশী ও বিদেশী অনেক মনীষীর উক্তিও উদ্ধৃত করা হয়েছে। গান্ধীজীর শিল্প—দর্শন যে খাপছাড়া উদ্ভট কিছু নয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষী ও শিল্পস্রষ্টাদের অনেকেই যে অনরূপভাবে ভাবিত এই দেখাবার জন্যই উদ্ধৃতিগুলো দেওয়া হয়েছে। মানব—প্রেমিক গান্ধীজী সব কিছুকেই মানুষের কল্যাণের দিক থেকে বিচার করেছেন। যাতে মানুষের কল্যাণ কবেনা, মানুষের জীবনকে করে না মহত্তর, সুন্দরতর ও পবিত্রতর গান্ধীজীর কাছে সেরূপ কোন কিছুরই বড় একটা আবেদন নেই। মানুষকে যাঁরা শান্তির নিলয়ে পরিণত করতে চান সুস্থতর সুন্দরতর করে গড়ে তুলতে চান, তাঁদের শিল্পরুচিতেও এই বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটাতে হবে। বিভিন্ন দেশের মানবপ্রেমিক মনীষীদের চিন্তাধারার অনুসরণ করলেও আমরা এই সত্যেরই সন্ধান পাই। মানুষের জীবন ও সমাজকে যদি শোভন ও সুন্দর করে তুলতে হয়, সত্যকার শিল্পরুচিকে সৌন্দর্যবোধকে কতিপয় মানুষের বিলাসকলার অন্তর্ভূক্ত করে না রেখে তাকে মানুষ মাত্রেরই জীবনগত করে ফেলতে হবে। তা হলে এই রুচিবোধ— এই সৌন্দর্যশ্রীতেই মানুষকে হীনতা ও জীবনের কদর্যতা থেকে রক্ষা করবে, মানুষের জীবন মধুময় হয়ে উঠবে। শ্রীঅরবিন্দ তাঁর ‘The National Value of Art’ পুস্তিকায় এ সম্বন্ধে একটি সুন্দর কথা বলেছেন। আমরা নিম্নে তা উদ্ধৃত করে দিলাম:—

“Art galleries can not be brought into every home, but, if all the appointments of our life and furnitures of our homes are things of taste and beauty, it is inevitable that the habits, thought and feelings of the people should be raised, ennobled, harmonised, made more sweet and dignified.”

অর্থাৎ ”আর্ট গ্যালারি প্রতি গৃহে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের  জীবনের প্রতিটি কাজ ও গৃহের প্রতিটি আসবাব যদি রুচিসম্মত ও সুন্দর হয় তাহলে মানুষের আচার, চিন্তা ও মনোবৃত্তি ও উন্নততর, মহত্তর, সামঞ্জস্যপূর্ণ, মাধুর্যমন্ডিত ও মহিমান্বিত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।”

অবশেষে গান্ধীজীর ব্যক্তিগত শিল্পরুচি ও সৌনন্দর্যবোধ সম্বন্ধে দু’একটা কথা বলে এ প্রবন্ধের উপসংহার করবো। গান্ধীজী বহুবার বহুস্থলে বলেছেন যে, তারায় ভরা নীল আকাশ, প্রকৃতির অফুরন্ত শোভাসম্পদই তার সৌন্দর্যস্পৃহা তৃপ্ত করার পক্ষে যথেষ্ট। তবু মহৎ শিল্প মহাত্মাজীর মনে যে কিরুপ সুগভীর আবেদন নিয়ে উপস্থিত হয়, একটি মাত্র দৃষ্টান্ত উল্লেখ করলেই তা বোঝা যাবে। ভ্যাটিকানের সিস্টাইন ভজনালয়ে (Chapel) যীশুখ্রিস্টের মূর্তি দেখে মহাত্মাজী কিরূপ বিস্ময়বিমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, ভাবের আবেগে তাঁর হৃদয় কেমন উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল তাঁর নিজের ভাষায়ই তা আমরা এখানে পরিবেশন করছি। তিনি বলেছেন:—

“I saw a figure of Christ there. It was wonderful. I could not tear myself away. The tears sprang to my eyes as I gazed.”

অর্থাৎ সেখানে আমি খ্রিস্টের একটি মূর্তি দেখি। মূর্তিটি অপূর্ব। আমি সেস্থান থেকে চলে আসতে পারছিলাম না। আমি যখন তাকিয়েছিলাম আমার চোখ জলে ভরে উঠছিল।

সাধারণ লৌকিক অর্থে আমরা যাকে শিল্পী বলি মহাত্মাজী যে তা নন তা আমরা পূর্বেই বলেছি। তিনি কবি নন কিন্তু সত্যের সৌন্দর্যে মুগ্ধ তাঁর মনের ভাব তাঁর লেখায় আপনা—আপনি কাব্যময় হয়ে ফুটে উঠেছে ‘The Cow is a poem of pity’র মত ছন্দ শুধু পৃথিবীর মহত্তম কবিদের হাত দিয়ে বেরুনোই সম্ভব। ভজন গানের মাধুর্য তাঁর সমগ্র সত্তাকে পরিপ্লুত করে দিত। তিনি বলেছেন:—

‘Music means rhythm Its effect is electrical. It immediately soothes.’

‘সঙ্গীত অর্থ ছন্দ ও শৃঙ্খলা। সঙ্গীত বিদ্যুতের মত দ্রুত প্রভাব বিস্তার করে এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রশান্তি এনে দেয়।’ সত্যের অকৃত্রিম সাধক বলেই তিনি সত্যকার সৌন্দর্যেরও পূজারী। তাই তিনি সুস্পষ্ট ভাষায়ই বলেছেন:—

‘Truth and beauty I crave for live for and would die for.’

অর্থাৎ আমি সত্য ও সৌন্দর্য—পিপাসু তার জন্যই আমার জীবন এবং জীবন দানও আমি তার জন্য করবো। বস্তুতঃ তার সমগ্র সত্তাই শিল্পময়, সহজ সরল সৌন্দর্যময় বলে তাঁর প্রতি বাক্য, কার্য ও আচরণই শিল্পের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে উঠতো। তাই ফরাসী মনীষী রোমা রোল্যাঁ বলেছেন:—

He becomes lyrical when he describes the ‘music of the spinning wheel,’ the oldest music in India, which delighted Kabir the poet-weaver.

অর্থাৎ যখন ভারতের প্রাচীনতম সঙ্গীত, যে সঙ্গীতে কবি—তন্তুবায় কবির মুগ্ধ হতেন, সেই চরকার সঙ্গীতের কথা তিনি যখন বর্ণনা করতেন তখন তাঁর ভাষা কাব্যময় হয়ে উঠতো।

‘সংগঠন’ থেকে উদ্ধৃত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *