গান্ধীজির দেশে ফেরা
১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালি থেকে জাহাজে ফিরছিলুম; ঝকঝকে চকচকে নতুন জাহাজ, তিলটি পড়লে কুড়িয়ে তোলা যায়। যাত্রী-পালের সুখ-সুবিধার তদারক করনেওয়ালা স্টুয়ার্ডের সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। তাকে বললুম, এরকম সাফা জাহাজ কখনও দেখিনি।
সে বিশেষ উৎসাহ না দেখিয়ে বলল, হবে না! নতুন জাহাজ! তার ওপর এই কিছুদিন আগে তোমাদের মহাত্মা গাঁধী এই জাহাজে দেশে ফেরেন।
আমার অদ্ভুত লাগল। মহাত্মাজি শরীর খুব পরিষ্কার রাখেন জানি, কাপড়-চোপড়, বাড়ি ঘর-দোরও, কিন্তু এত বড় জাহাজখানাও কি তিনি মেজে ঘষে–? বললুম, সে কী কথা?
স্টুয়ার্ড বলল–মশায়, সে এক মস্ত ইতিহাস। এ যাত্রায় খুব বেঁচে গেছি। ইংরেজ যদি ঘন ঘন গোলটেবিল বৈঠক বসায়, আর তোমাদের ওই গাঁধী যদি নিত্যি নিত্যি এই জাহাজে যাওয়া-আসা আরম্ভ করেন, তবে আর বেশিদিন বাঁচতে হবে না।
আমি বললাম তোমার কথাগুলো নতুন ঠেকছে। গান্ধীজি তো কাউকে কখনও জ্বালাতন করেন না।
স্টুয়ার্ড বলল- আজব কথা কইছেন স্যার কে বলল গাঁধী জ্বালাতন করেন? কোথায় তিনি, আর কোথায় আমি। ব্যাপারটা তা হলে শুনুন–
ইতালির বন্দরে জাহাজ বাধা। দিব্যি খাচ্ছি-দাচ্ছি-ঘুমোচ্ছি, কাজকর্ম চুকে গেছে, এমন সময় বলা নেই কওয়া নেই, শুনতে পেলুম কাপ্তেন সাহেব পাগল হয়ে গেছেন। ছুটে গেলুম খবর নিতে গিয়ে দিখি তিনি দু হাত দিয়ে মাথার চুল ছিঁড়ছেন আর সাতান্নবার করে এই টেলিগ্রাম পড়ছেন। খবর সবাই জেনে গেছে ততক্ষণে। ইল দুচে (অর্থাৎ মুসোলিনি) তার করেছেন, মহাত্মা গাঁধী এই জাহাজে করে দেশে ফিরছেন। বন্দোবস্তের যেন কোনও ক্রটি না হয়।
তার পর যা কাণ্ড শুরু হল, সে ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। গোটা জাহাজখানাকে চেপে ধরে ঝাড়ামোছা, ধোওয়া-মাজা, মালিশ-পালিশ যা আরম্ভ হল তা দেখে মনে হল ক্ষয়ে গিয়ে জাহাজখানা কপুর হয়ে উবে যাবে। কাপ্তেনের খাওয়া নেই, নাওয়া নেই। যেখানে যাও, সেখানেই তিনি তদারক করছেন। দেখছেন, শুনছেন, শুঁকছেন, চাখছেন, আর সবাইকে কানে কানে বলছেন, গোপনীয় খবর, নিতান্ত তোমাকেই আপনজন জেনে বলছি, মহাত্মা গাঁধী আমাদের জাহাজে করে দেশে ফিরছেন। এই যে আমি, নগণ্য স্টুয়ার্ড, আমাকেও নিদেনপক্ষে বাহান্নবার বলেছেন ওই খবরটা যদিও ততদিন সব খবরের কাগজে বেরিয়ে গেছে গাঁধীজি এই জাহাজে যাচ্ছেন; কিন্তু কাপ্তেনের কি আর খবরের কাগজ পড়ার ফুরসত আছে?
আমাদের ফার্স্ট ক্লাসের শৌখিন কেবিন-(কাবিন্ দ্য লক্ষ)গুলো দেখেছেন? সেগুলো ভাড়া নেবার মতো যখের ধন আছে শুধু রাজা-মহারাজাদের আর মার্কিন কারবারিদের। সেবারে যারা ভাড়া নিয়েছিল তাদের তার করে দেওয়া হল, তোমাদের যাওয়া হবে না, গাঁধীজি যাচ্ছেন। আধেকখানা জাহাজ গাঁধীজির জন্য রিজার্ভ পল্টনের একটা দল যাবার মতো জায়গা তাতে আছে।
শৌখিন কেবিনের আসবাবপত্র দেখেছেন কখনও? সোনার গিল্টি রুপোর পাতে মোড়া সব। দেয়ালে দামি সিল্ক, মেঝেতে ঘন সবুজ রঙের বর আর ইরানি গাচে ছ ইঞ্চি পুরু– পা দিলে পা বসে যায়। সেগুলো পর্যন্ত সরিয়ে ফেলা হল। ইল দুচে বিশেষ করে পালাদসো ভেনেসিয়া (অর্থাৎ ভেনিসীয় রাজপ্রাসাদ) থেকে চেয়ার-টেবিল, খাটপালঙ্ক পাঠিয়েছেন। আর সে খাট, মশয়, এমন তার সাইজ, ফুটবলের বি-টিমের খেলা তার উপরে চলে। কেবিনের ছোট দরজা দিয়ে ঢেকে কী করে! আন্ মিস্ত্রি, ডাক কারিগর, খোল কবজা, ঢোকা খাট। হৈ হৈ ব্যাপার মার-মার কাণ্ড। খাবারদাবার আর বাদবাকি যা সব মালমশলা। জোগাড় হল, সে না হয় আরেক হপ্তা ধরে শুনবেন।
সব তৈরি। ফিটফাট। ওই যে বললেন, তিলটি পড়লে কুড়িয়ে তোলা যায়, উঁচটি পড়লে মনে হয় হাতি শুয়ে আছে।
গাঁধীজি যেদিন আসবেন সেদিন কাগকোকিল ডাকার আগে থেকেই কাপ্তেন সিঁড়ির কাছে। ঠায় দাঁড়িয়ে, পিছনে সেকেন্ড অফিসার, তার পিছনে আর সব বড়কর্তারা, তার পিছনে বড় স্টুয়ার্ড, তার পিছনে লাইব্রেরিয়ান, তার পিছনে শেফ দ্য কুইজিন (পাঁচকদের সর্দার), তার পিছনে ব্যান্ড-বাদ্যির বড়কর্তা, তার পিছনে এক কথায় শুনে নিন, গোটা জাহাজের বেবাক কর্মচারী। আমি যে নগণ্য স্টুয়ার্ড, আমার ওপর কড়া হুকুম, নট-নড়নচড়ন-নট-কিছু। বড় স্টুয়ার্ডের কাছে যেন চব্বিশ ঘন্টা থাকি। আমার দোষ? দু-চারটে হিন্দি কথা বলতে পারি। যদি গাঁধীজি হিন্দি বলেন, আমাকে তর্জমা করতে হবে। আমি তো বলির পাঁঠার মতো কাঁপছি।
গাঁধীজি এলেন। মুখে হাসি, চোখে হাসি। এদিকে স্যর, ওদিকে স্যর বলে কাপ্তেন নিয়ে চললেন গাঁধীজিকে তার ঘর কেবিন দেখাতে। পিছনে আমরা সবাই মিছিল করে চলেছি। কেবিন দেখানো হল–এটা আপনার বসবার ঘর, এটা আপনার সঙ্গে যারা দেখা করতে আসবেন তাদের অপেক্ষা করার ঘর, এটা আপনার পড়ার, চিঠিপত্র লেখার ঘর, এটা আপনার উপাসনার ঘর, এটা আপনার খাবারঘর যদি বড় খাস কামরায় যেতে না চান, এটা আপনার শোবারঘর, এটা আপনার কাপড় ছাড়ার ঘর, এটা আপনার গোসলখানা, এটা চাকরবাকরদের ঘর। আর এ অধম তো আছেই- আপনি আমার অতিথি নন, আপনি রাজা ইমানুয়েল ও ইল দুচের অতিথি। অধম, রাজা আর দুচের সেবক।
গাঁধীজি তো অনেকক্ষণ ধরে ধন্যবাদ দিলেন। তার পর বললেন, কাপ্তেন সায়েব, আপনার জাহাজখানা তারি সুন্দর। কেবিনগুলো তো দেখলুম; বাকি গোটা জাহাজটা দেখারও আমার বাসনা হয়েছে। তাতে কোনও আপত্তি।
কাপ্তেন সায়েব তো আহ্লাদে আটখানা, গলে জল। গাঁধীজির মতো লোক যে তার জাহাজ দেখতে চাইবেন এ তিনি আশাই করতে পারেননি। চলুন চলুন বলে তো সব দেখাতে শুরু করলেন। গাঁধীজি এটা দেখলেন, এটা দেখলেন, সবকিছু দেখলেন। ভারি খুশি। তার পর গেলেন এঞ্জিন-ঘরে। জানেন তো সেখানে কী অসহ্য গরম। যে বেচারিরা সেখানে খাটে তাদের ঘেমে ঘেমে যে কী অবস্থা হয় কল্পনা করতে পারবেন না। আপনি গেছেন কখনও?
আমি বললুম, না।
গাঁধীজি তাদের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ গুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কাণ্ডেনের মুখেও হাসি নেই। আমাদের কাঞ্জেটির বড় নরম হৃদয়; বুঝতে পারলেন গাঁধীজির কোথায় বেজেছে।
খানিকক্ষণ পরে গাঁধীজি নিজেই বললেন, চলুন কাপ্তেন। তখন তিনি তাকে বাকি সব দেখালেন। সব শেষে নিয়ে গেলেন খোলা ডেকের উপর। সেখানে কাঠফাটা রোদ্দুর! কাপ্তেন বললেন, ওখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াবেন না, স্যার। সর্দিামি হতে পারে।
গাঁধীজি বললেন, কাপ্তেন সায়েব, এ জায়গাটি আমার বড় পছন্দ হয়েছে। আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবে এখানে একটা তাবু খাঁটিয়ে দিন, আমি তাতেই থাকব। কাপ্তেনের চক্ষু স্থির! অনেক বোঝালেন, পড়ালেন। গাঁধীজি শুধু বলেন, অবিশ্যি আপনার যদি কোনও আপত্তি না থাকে। কাপ্তেন কী করেন। তবু এল, খাটানো হল। গাঁধী সেই খোলা ছাদের তাবুতে ঝাড়া বারোটা দিন কাটালেন।
কাপ্তেন শয্যাগ্রহণ করলেন। জাহাজের ডাক্তারকে ডেকে বললেন, তোমার হাতে আমার প্রাণ। গাঁধীজিকে কোনওরকম জ্যান্ত অবস্থায় বোম্বাই পৌঁছিয়ে দাও। তোমাকে তিন ডবল প্রমোশন দেব।
আমি অবাক হয়ে শুধালম,-সব বন্দোবস্ত?
স্টুয়ার্ড হাতের তেলো উঁচিয়ে বলল, পড়ে রইল। গাঁধীজি খেলেন তো বরির দুধ আর পেঁয়াজের শুরুয়া। কোথায় বড় বাবুর্চি, আর কোথায় গান-বাজনা। সব ভণ্ডুল। শুধু রোজ সকালবেলা একবার নেবে আসতেন আর জাহাজের সবচেয়ে বড় ঘরে উপাসনা করতেন। তখন সেখানে সকলের অবাধ গতি–কেবিন-বয় পর্যন্ত।
কাপ্তেনের সব দুঃখ জল হয়ে গেল বোম্বাই পৌঁছে। গাঁধীজি তাকে সই করা একখানা ফোটো দিলেন। তখন আর কাপ্তেনকে পায় কে? আপনার সঙ্গে তার বুঝি আলাপ হয়নি? পরিচয় হওয়ার আড়াই সেকেন্ডের ভিতর আপনাকে যদি সেই ছবি উনি না দেখান তবে আমি এখান থেকে ইতালি অবধি নাকে খং দিতে রাজি আছি। হিসাব করে দেখা গেছে ইতালির শতকরা ৮৪.২৭১৯ জন লোক সে ছবি দেখেছে।
স্টুয়ার্ড কতটা লবণ-লঙ্কা গল্পে লাগিয়েছিল জানিনে; তবে সেই কথাগুলো ঠিক যে গান্ধীজি ওই জাহাজেই দেশে ফিরেছিলেন– পালাসো ভেনেসিয়া থেকে আসবাব এসেছিল, গান্ধীজি এঞ্জিনরুমে গিয়েছিলেন, জাহাজের দিনগুলো কাটিয়েছিলেন তাঁবুতে, আর নিচে নাবতেন উপাসনার সময়ে। অন্য লোকের মুখেও শুনেছি।