গান্ধারী

গান্ধারী

গভীর রাত। বাড়ি নিস্তব্ধ। দূর থেকে ভেসে আসছে নাক ডাকার একটানা শব্দ। একেবারে শেষ মাথায় হরিদার ঘর। সারাদিন খুব খাটেন। এই বাড়ির ম্যানেজার। মাসিমার ডান হাত। বালিশে মাথা ফেলা মাত্রই ঘুম। তারপর চলল ক্যানেডিয়ান এঞ্জিন ভোরের স্টেশান ধরতে। বাইরে দমকা বাতাস। বিরাট চাঁদ ফানুসের মতো ভাসছে। গাছের পাতার ঝাপুস-ঝুপুস শব্দ। গাছের মাথায় পাখির ছানা চিঁচিঁ করে ডাকছে। আমার মাথার দু’দিকে বড় বড় দুটো জানলা। ঘুম আসছে। মিষ্টি ঘুম। সারা দিনের সব ঘটনা ভেসে ভেসে আসছে। নীলের জগতে চলে যাচ্ছি। সব নীল। রূপোলি মূর্তি সব। দেব, দেবী, মানুষ, পাখি। কারোরই ওজন নেই। সব ভাসমান।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। একটা অস্বস্তি। ঘরে কেউ এসেছে। আমি একা নই। ঘরের টকটকে লাল মেঝেতে পাতলা একটা ছায়া লুটিয়ে আছে। চাঁদের আলোয় বাইরেটা কাঁচের মতো হয়ে গেছে। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটা মূর্তি। ভূত? দেবদূত! ভয় করছে। চাঁদের আলোয় তার পোশাক দুধের মতো সাদা। যেখানে যেখানে ভাঁজ সেখানে হালকা গোলাপি।

কে?

ফিরে তাকাল। মুখের একপাশে আলো, একপাশে ছায়া।

গান্ধারী! এত সুন্দরী!

গান্ধারী ধীরে ধীরে আমার কাছে এগিয়ে এল। আমি বিছানায় উঠে বসেছি। খাটের ধারে আমার পা দুটো ঝুলছে। গান্ধারীর দুটো হাত আমার দু-কাঁধে। ফসলের ভরা ক্ষেতের মতো তার মুখ আমার মুখের সামনে। অদ্ভুত একটা মিষ্টি গন্ধ! মধ্যরাত। চারপাশ নিদ্রিত। বাইরে নেশার মতো চাঁদের আলো। পাখির ছানার চিঁ চিঁ ডাক। রাতের গান্ধারী। গান্ধারীর রাত। তার এই রূপ আমি আগে দেখিনি। মেয়েরা রাতে রূপসী হয়। অদিতি!

দুচোখে তার জল গড়াচ্ছে ভোরের শিশিরের মতো। দানা দানা, ফোঁটা ফোঁটা। গান্ধারী অদ্ভুত একটা কথা বললে, তুমি মাধুরীকেই বিয়ে করো। মাধুরীকেই বিয়ে করো। মাধুরীকে। মাধুরীকে।

আর কিছু বলতে পারল না। তার গলা ধরে এল। আমি অবাক হয়ে তার মুখ দেখছি। এত কাছ থেকে কখনো দেখিনি। নাক, চোখ, ঠোঁট, চিবুক, গলা। নিজেকে ধরে রাখা আর সম্ভব হল না। এত কাছে! এত আপনার! মাটির মতো, নদীর মতো, আকাশের মতো, জলের বুকে নেমে আসা তারার মতো।

প্রথম জাগরণ। গান্ধারী আমার ঘুম ভাঙালে। চাঁদ চলে গেল আকাশ সীমায়। তারারা ফ্যাকাসে। প্রথম পাখির প্রথম ডাক। ভোরের মঙ্গল আরতি। গালে একটা চিহ্ন রেখে, শরীরে শরীরের উত্তাপ রেখে, মনে গভীর ছাপ ফেলে, নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে গান্ধারী চলে গেল। তখনই জানলুম, সে কোন পথে এসেছিল! আমার পাশের ঘরে কেউ থাকে না। দু’ঘরের মাঝখানে দরজা। দরজার ছিটকিনি ওপাশ থেকে তোলা। ওই দরজা খুলে সে এসেছিল।

এই ঘটনা তো গোপন করা যাবে না! গোপনীয়তাই পাপ। সবার আগে মাসিমাকে জানাতে হবে। তিনি আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। তারপরে আর এক বন্ধু আমার বড়মামা। কাল রাতের ঘটনায় আমার ভূমিকা কতটুকু! ঘটে গেছে। মাসিমা পায়রাদের দানা ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। রোজ যা করেন।

তুমি একটু বসো।

কি হল, আমার কি এখন বসার সময় আছে রে?

একটু সময় দিতেই হবে।

আমরা দুজনে বাগানের যে-অংশটা সবচেয়ে নির্জন সেই জায়গায় গিয়ে বসলুম। যা ঘটেছে, অকপটে সব বললুম। সব, সব।

মাসিমা সব শুনে বললেন, বেশ হয়েছে। মাধুরীকে আমি ভালোবাসি। ঘরের ছেলে, ঘরের মেয়ে ঘরেই থাক। ফাটল ধরিয়ে কাজ নেই। গান্ধারী খুব ভালো মেয়ে। সরল মেয়ে। ওর গোটা শরীরটা প্রেম দিয়ে তৈরি। রাধিকা ভাব। চল, বড়দার কাছে যাই।

বড়মামার হাতে বিরাট এক রুগি। ভোর রাত থেকে মেডিকেল জার্নালে ডুবে আছেন। কাপের পর কাপ চা। মাসিমা বললেন, বড়দা! গুরুতর একটা কথা আছে।

বড়মামা চোখ না তুলেই বললেন, রাতে গুরুপাক খেলেই সকালে গুরুতর অবস্থা হবে। আমার কিছু করার নেই। অনেকরকম ওষুধ আছে, একের পর এক চালিয়ে দাও।

নাকের ডগায় রিডিং গ্লাস ঝুলছে। অদ্ভুত দেখাচ্ছে বড়মামাকে।

মাসিমা বললেন, পাঁচ মিনিট সময় দিলে একটা আত্মহত্যা আর হয় না।

আত্মহত্যা? বড়মামা ঘুরে বসলেন। সব শুনে বললেন, বলিস কী, আমার এত বড় ভাগ্য! মেয়েটাকে স্টেশান থেকে তুলে এনেছিলুম বুকে করে। মাধুরীকে হাজারটা ছেলে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত। আমার গান্ধারীকে বিয়ে করবে কোন গান্ধার?

বড়মামা আমার দিকে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতো বললেন, বাবা! পাকা কথা। পরে ব্যাক আউট করবে না তো? না, আশীর্বাদটা সেরে রাখা যাক। কুসি! তুই হলি ছেলের তরফে। আর আমি হলুম মেয়ের তরফে। দেনা-পাওনার কথাটা হয়ে যাক।

বড়মামা আঙুল থেকে একটা আংটি খুলে আমার মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, বাবা! মেয়েটাকে দেখো। কষ্ট দিয়ো না। বড় দুঃখী মেয়ে। জীবনের কারো কাছ থেকে চোখের জল ছাড়া কিছুই পায়নি।

উঠে গিয়ে নিজেই ফোন করলেন, হ্যালো বিকাশ! আই অ্যাম অ্যান এস। রাধা আর কৃষ্ণ দুটোই বাড়িতে মজুত। মন্দিরটাই কেবল ইনকমপ্লিট। না, না, পাঁচিল আর ভাঙতে হবে না, সুড়ঙ্গও করতে হবে না। একটা ভালো সানাই। প্যান্ডেলের লোক নিয়ে কাম শার্প।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *