1 of 2

গান্ধারী

গান্ধারী

শনিবার। সুতরাং বিলাস সকাল সকাল বাড়ি ফিরেছে। বগলে একটা বড় প্যাকেট। আরতি হাসিমুখে এগিয়ে এল, বাঃ আজ বেশ তাড়াতাড়ি এসেছ। কী আনলে গো? দেখি।

বিলাস আরতিকে এড়িরে ঘরে ঢুকে গেল—তুমি বড় বিরক্ত করো। দেখছ খেটেখুটে আসছি, আগে একটু জিরোতে দাও। এখনও ভদ্রতা শিখলে না!

আরতি লজ্জায় চুপসে গিয়ে বললে—নানা, আমি বুঝতে পারিনি তোমার শরীর খারাপ। ভুল হয়ে গেছে। কিছু মনে কোরো না।

বিলাস ইজিচেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। আরতি একটা হাতপাখা এনে আস্তে আস্তে হাওয়া করতে লাগল।

আরতির সঙ্গে বিলাসের বিয়ে খুব বেশিদিন না হলেও বেশকিছুদিন হয়েছে কিন্তু তাদের ব্যবহারে, চালচলনে কোথায় যেন একটা ফাঁক রয়ে গেছে। স্নেহ, প্রীতি, ভালোবাসা ইত্যাদি তাদের দুজনকে এখনও যেন নিঃশেষে মিলিয়ে দিতে পারেনি। সঙ্কোচের একটা বিরাট ব্যবধান। দুজনকে পৃথক করে রেখেছে।

বিলাস চোখ বুজিয়ে বেশ একটু কর্কশভাবেই বললে, মাথাটা টিপে দাও। স্নেহের দাবি নয়, যেন একটা প্রচণ্ড আদেশ।

আরতি পাখা রেখে মাথা টিপতে লাগল।

—জোরে জোরে। বিলাসের যেন যথেষ্ট আরাম হচ্ছে না।—আরও জোরে। বিলাস ভুরু কুঁচকে আদেশটা ছুড়ে দিল।

আরতি তার রোগা হাত দিয়ে যতদূর সম্ভব জোরে জোরে টিপতে লাগল। পরিশ্রমের বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল কপালে।

বিলাস হঠাৎ খাড়া হয়ে উঠে বসল—তোমার হাত দুটো দিন দিন লোহার খনির কুলীদের মতো খসখসে হয়ে যাচ্ছে। থাক আর দিতে হবে না।

আরতি হাঁপাতে হাঁপাতে খুব আস্তে বলল, কী করব বলো, বাসন মাজতে মাজতে আর জল তুলতে তুলতে হাতের এই অবস্থা হয়েছে। আগে কি এরকম ছিল?

বিলাস তিড়বিড় করে উঠল—তোমার ওই এক কথা। খোঁটা দিতে পারলে আর ছাড়োনা। আমার অবস্থায় কুলোয় না, তাই ঝি রাখতে পারি না। এই কথাটা সময়ে-অসময়ে তুলে খোঁটা দিতে পারলেই তোমার শান্তি

আরতি কাপড়ের আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে, ভয়ে ভয়ে বলল–না না, আমি অতসব ভেবে বলিনি। সত্যি বিশ্বাস করো।

বিলাস কিছুমাত্র নরম না হয়ে বলল—তা ছাড়া কী? থেকে থেকে তোমার ওই এক কথা। আমি বুঝি না ভাবো? তোমার হাত কবে নরম ছিল? মধ্যবিত্ত ঘরের বউ-ঝিরা দেখগে যাও তোমার। চেয়ে ভারী ভারী কাজ করেও কেমন সুন্দর তাদের একটা লাবণ্য আছে। তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। আর তোমার!

আরতি শোনাই যায় না এমনই মৃদুকণ্ঠে বলল— সে কি আমি অস্বীকার করছি? আমি তো বলছি আমাকে দেখতে সুন্দর না। তুমি দয়া করে বিয়ে করেছ।

—কী, কী বললে, এক মুহূর্তও কি বাড়িতে শান্তিতে থাকতে দেবে না? যখনই আসব এই চুলোচুলি। বিলাস রেগে উঠে পড়ল—ঠিক আছে আমি চললুম। ঘরের চেয়ে আমার রাস্তাই ভালো। অনেক শান্তি।

আরতি ভয়ে দৌড়ে এসে পথ আটকে দাঁড়াল নানা, যেয়ো না। এই দেখো তিন সত্যি করছি, আর যদি কখনও কোনও কথা বলি। আমার অন্যায় হয়েছে। তুমি বোসো, চা-জলখাবার খাও।

বিলাস কোনও উত্তর দিল না। একে একে অফিসের ধরাচুড়ো খুলতে লাগল। আরতি ইতিমধ্যে স্টোভ জ্বেলে ফেলেছে। তৈরি হবে লুচি আর আলুভাজা। বিলাস বাথরুমের তোলাজলে চান সেরে ঘরে এল। আরতি একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বললে–তোমার সাবানটা আজকে একটু দেবে? অনেকদিন সাবান মাখিনি।

—কেন, তোমাকে তো ওমাসে একটা সাবান এনে দিয়েছি!

—ওমাসে নয়তো, তারও আগের মাসে।

—ওই একই হল।

—একটা সাবান তিন মাসের বেশি চলে না।

—তোমার সাবানের খরচ জোগানো আমার সাধ্যের বাইরে। একটা জমিদারি থাকলে চেষ্টা করে দেখতুম। তা যখন নেই শুধুই গা ধোও।

বিলাস তার নিজের ভালো শৌখিন সাবান আলমারিতে চাবি দিয়ে রাখল। আরতি দ্বিতীয় আর। কোনও কথা না বলে আপনমনে লুচি ভাজতে লাগল। বিলাস ভালো জামাকাপড় পরে ইজিচেয়ারে এসে বসল। বেশভূষায় সে অতিশয় শৌখিন। মিহি ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি। কানে আতর। মুখে কিছু স্নো এবং পাউডারের প্রলেপ।

ও কী হচ্ছে? বিলাসের আকস্মিক প্রশ্নে আরতি চমকে মুখ তুলে তাকাল।

—কেন তোমার লুচি ভাজছি তো!

কজন খাবে শুনি? ও তো তুমি পঞ্চাশজনের মতো ভেজেছ। তোমার মতো লম্বা হাতে গরিবের সংসার চলে না। কতদিন বলেছি ওই একটিন ঘিয়ে পুরো মাস চালাতে হবে। সারাদিন অফিসে মাথার কাজ। সারা মাস একটু ঘি খেয়ে সামলে নেব, তোমার জন্যে তারও উপায় নেই। ধুমধাড়াক্কা সাতদিনেই সব শেষ করে দেবে দেখছি।

—তুমি যেন কী! এই তো মাত্র তোমার মতো বারোখানাই ভেজেছি। আরতি একটু হাসবার চেষ্টা করল। বড় করুণ আর ফিকে।

—একটু বুঝতে শেখো। সারাদিন যারা মাথার কাজ করে তাদের একটু করে ঘি না খেলে চলে না। যারা বাড়ি বসে থাকে, মাথার কাজ করে না তাদের শাকপাতা যা হোক খেলেই চলে— বুঝেছ?

—সে তো আমি বুঝি। আমার জন্যে আর কবে লুচি ভেজেছি?

—ওই, ওই দেখো। ঠিক বেঁকা রাস্তায় গেলে। মেয়েদের আর কিছুতেই সন্তুষ্ট করা যায় না। যা পাচ্ছো তা অনেক বাড়িতেই মিলবে না। একটু লুচি খাচ্ছি, অমনি হিংসে! তাও শখ করে নয় নিতান্তই স্বাস্থ্যের জন্যে। আশ্চর্য!

—কী বলছ তুমি? তোমার মন এত নীচু! আমি কী বললুম আর তুমি কী মানে করলে?

—ঠিক বুঝেছি। তোমার মনের কথা আমি বুঝি না! এতদিন ঘর করচি। আরতি আর কথা না বাড়িয়ে, বিলাসকে খেতে দিল। নিজের ভাগে জুটল এক কাপ চা।

—এই দেখো। বিলাস একটু শ্লেষের হাসি হেসে বলল। আরতি ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল–কী হয়েছে?

—তোমাকে হাজার দিন বলেছি, এত বড় বড় কাপে পুরো এক কাপ চা দেবার কোনও দরকার নেই। সেই এক কাপ চা!

—ভাবলুম তোমার শরীর খারাপ, তাই একদিন দিয়েছি।

—তোমার দিতে আর কী? রোজগার তো আর করতে হয় না। এদিকে মাসে মাসে চায়ের খরচ জোগাতে আমার জিভ বেরিয়ে যায়।

—ঠিক আছে আমি চা খাওয়া ছেড়েই দেব। তাহলে তোমার খরচ বেঁচে যাবে।

—ওই, কথায় কথায় অভিমান। বাপ-মা তো আর সংসার কী করে চালাতে হয় শেখাননি, খালি নাচতে আর গাইতে শিখিয়েছেন।

—সব দেখে-শুনেই তো বিয়ে করেছিলে।

–সামান্য ভদ্রতাও তো শেখোনি। অনবরত মুখে মুখে জবাব আর তক্ক।

বিলাস বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছিল।

আরতি ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল—তুমি বেরিয়ে যাচ্ছ? এখুনি আসবে তো?

-কেন?

–বাজার ফুরিয়েছে। বাজার না করলে রান্না হবে না।

বিলাস কোনও উত্তর না দিয়েই চটপট করে বেরিয়ে গেল।

***

শনিবার শনিবার জোর আড্ডা জমে। নাটুকে দল ভাড়া করা মেয়ে এনে রিহার্সাল দেয়। বিলাস সটান সেখানে গিয়ে হাজির হল। বন্ধুরা হইহই করে উঠল, —আরে এসো এসো, ঠিক সময়ে এসেছব্রাদার। পাঁচটা টাকা জলদি ছাড়ো দেখি।

—কী হবে টাকা?

—আরে ব্রাদার টাকাতে কী না হয়!

চিত্রা পার্ট মুখস্থ করবার ফাঁকে একবার আড়চোখে বিলাসের দিকে তাকাল। তারপর একটু সরে এসে বলল,টাকায় কী হবে আমার কাছে শুনুন।

–বলুন। বিলাস একগাল হেসে একেবারে যেন গলে গেল।

—আজ শনিবার জানেন তো?

—খুব জানি, ঘাড়ে যা বারবেলা চেপেছিল।

-ও, তাই নাকি?

—হ্যাঁ, শেষে পালিয়ে এসে বাঁচি।

—ও হো, বউদি বুঝি সিনেমার আবদার ধরেছিলেন? যাক শুনুন, আজ শনিবার, সবাই চাঁদা দিন। একটু ভোজের ব্যবস্থা করা যাক।

—উত্তম প্রস্তাব। তা পাঁচ টাকাতেই হবে তো?

–দশ টাকা দিলে আরও ভালো হয়।

—তা নিন না। বিলাস এক কথায় ঝট করে দশটাকার একখানা নোট বুকপকেট থেকে বার করে চিত্রার হাতে গুঁজে দিল।

—হুর-রে। থ্রি চিয়ার্স ফর বিলাসচন্দ্র।

চিৎকারে ঘর ফেটে গেল।

বিলাস সিগারেট ধরিয়ে এক কোণে ব্রিজ খেলতে বসে গেল। দেখতে দেখতে খেলা বেশ জমে উঠল। তন্ময় খেলোয়ারদের অলক্ষে ঘড়ির কাঁটা ঘুরে চলল পাকে পাকে।

রাত তখন অনেক। বিলাস বাড়ি ফিরল, লুচি, কষা মাংস আর রাবড়ির ভেঁকুর তুলতে তুলতে।

বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একটু ব্র্যান্ডি খেয়েছিল। বেশ একটা গোলাপি নেশা হয়েছে। শরীর গরম, মনও বেশ শরিফ। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ঘরে ঢুকল।

আরতি জানালার গরাদে মাথা রেখে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছিল, ঘাড় না ফিরিয়েই জিগ্যেস করল—এত রাত হল?

—হ্যাঁ, তা একটু হল। কী করা যাবে?

—ভাত যে এদিকে জুড়িয়ে জল হয়ে গেল।

—যাকগে। আমি আর খাব না। খেয়ে এসেছি।

—সত্যি! ভালো হয়েছে। আজকে যা অখাদ্য রান্না হয়েছে তুমি খেতে পারতে না।

—তাড়াতাড়ি আলো নিভিয়ে দাও, আমি এখুনি শুতে চাই।

–দাঁড়াও, তুমি তো ভালোমন্দ খেয়ে এলে, আমি দুটো পিণ্ডি গিলে নিই।

বিলাস জামা-কাপড় ছাড়ছিল, ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল হ্যাঁ, আমার সংসারের সামান্য জিনিস তো তোমার কাছে পিণ্ডিই হবে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার তো আর করতে হয় না। তোমাকে। আমি আজ সাফ বলে রাখছি এর চে ভালো সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য যদি আর কোথাও পাও, বিনা দ্বিধায় তুমি চলে যেতে পারো।

—ইশ, তুমি কী বলছ যা-তা কথা, ছিঃ ছিঃ।

—ঠিকই বলছি। ভাবো তোমার মনের কথা বুঝতে পারি না। মেয়েদের পরীক্ষার, মেয়েদের সততা আর চরিত্র পরীক্ষার সবচেয়ে ভালো উপায়-দারিদ্র, অভাব!

—তুমি কি তাই আমায় পরীক্ষা করছ? আজ দু-বছর হল একখানা কাপড় দাওনি। আমি ছেঁড়া আর ময়লা কাপড় পরে ঘরে বসে থাকি, কোথাও যেতে পারি না। ও বাড়ির দিদি এসে কত কথা বলে—তোমার স্বামী এত বড় চাকুরে, তুমি এমন ঘেঁড়া ময়লা কাপড় পরে থাকো কেন? আমি কোনওরকমে কাটিয়ে দিই—ভালো কাপড় তোলা আছে দিদি। কাজকম্মে এত ভালো কাপড় পরে আর কী হবে?

—থামাও তোমার মহাভারত। রাত বারোটার সময় ঘ্যানঘ্যান আর ভালো লাগে না।

—থামাব কেন? তুমিই তো আরম্ভ করালে। এই সেদিন তুমি নিজের জন্যে এক জোড়া ভালো কাপড় এনেছ আবার আজ এনেছ আর এক জোড়া। এদিকে আমার কাপড় আর সেলাই করে করে চলছে না।

—ও ওরই মধ্যে প্যাকেট খুলে দেখা হয়ে গেছে! আর হিংসেয় জ্বলতে আরম্ভ করেছ!

—খুলে দেখতে যাব কেন? ওই তো দেখাই যাচ্ছে ছেড়া প্যাকেটের ফাঁক দিয়ে।

—বাইরে ভদ্রসমাজে মিশতে গেলে ফরসা ভালো জামা-কাপড় না পরলে মান থাকে না, সে বুদ্ধি তোমার আছে?

—পরো না, কে বারণ করেছে। কিন্তু তোমার তো আট-দশখানা কাপড়। আর আমি বললেই বলো—এমাসে বড় টানাটানি। আসছে মাসে…তার মানে আমায় পরীক্ষা করতে চাও। আজ কতদিন সিনেমা দেখিনি! কতদিন একটু ভালো খাইনি। তুমি তো রোজই বাইরে বেশ ভালো ভালো খেয়ে আসো।

বিলাস আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল—সারারাত তুমি কোঁদল করো। আমাকে এখন ঘুমোতে দাও সারাদিন খাটুনির পর।

ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। তারার আবছা আলোয় আরতির ছায়ামূর্তি জানালার ধারে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল।

—তাহলে তুমি আমাকে খেতে দিলে না আজ, বেশ।

আরতি অন্ধকারেই ভাতের হাঁড়িতে এক ঘটি জল ঢেলে দিয়ে এল।

হঠাৎ পাশের বাড়িতে সকলে এক সঙ্গে সজোরে কেঁদে উঠল। আরতি তাড়াতাড়ি জানালার ধারে এসে দাঁড়াল। বিলাস বিছানায় একটু উশখুশ করে অবশেষে জিগ্যেস করল, —কী হল ও বাড়িতে?

—জিতেনবাবুর বউ ভুগছিলেন। বোধহয় এক্ষুনি মারা গেলেন। ওই তো বাড়ির সামনে ডাক্তারের গাড়ি দাঁড়িয়ে। আহা এই সেদিন বিয়ে হয়েছিল।

—ও। যাক ভদ্রলোক বেঁচে গেলেন। আবার একটা বিয়ে করলেই হল। জানালাটা বন্ধ করে দাও।

—কেন, থাক না খোলা।

—না, ওসব প্যানপ্যানানি রাতদুপুরে ভালো লাগে না।

আরতি জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে ওপাশের জানলার ধারে সরে গেল। তার মনটা কেমন যেন ধু-ধু হু-হু করছে। ফুটফুটে সুন্দর বউটা এই তো কেমন চলে গেল। জিতেনবাবু তো প্রাণের চেয়ে ভালোবাসতেন শোনা যায়। কই ধরে রাখতে পারলেন?

ওপাশের বড় তিনতলা বাড়ির জানালায় আলো জ্বলজ্বল করছে। ওই ঘর থেকে হঠাৎ তবলার তেহাই আর ঘুঙুরের ঝমঝম শব্দ ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের ঐকতান।

–কী কী? বিলাস অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

—ওই তিনতলা বাড়িটায় সেই সিনেমার নাচিয়ে মেয়েটা থাকে না। আজ শনিবার, দেখো না বাড়িটার সামনে কত বড় বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কত বড় বড় লোককে যে মেয়েটা নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে।

—জানালাটা বন্ধ করে দাও।

—থাক না, বেশ হাওয়া আসছে।

—না ভদ্রপাড়ায় ওসব বেলেল্লাপনা চলবে না। বন্ধ করো, বন্ধ করো।

আরতি জানলাটা বন্ধ করে সরে এল। ঘরের ভেতরে মৃদু কান্না আর সংগীত একই সঙ্গে ভেসে বেড়াতে লাগল।

—নাও, একবার আলোটা জ্বেলে চট করে খেয়ে নাও।

—নাঃ আজ আর খেতে ভালো লাগছে না সত্যি বলছি। তাছাড়া ভাতেও জল ঢেলে দিয়েছি। আজ শুয়ে পড়ি। আরতি পা গুটিয়ে মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল।

—আজ সারাদিন ভয়ানক ঘোরাঘুরি গেছে।

—কেন অত ঘুরলে? আরতি বিলাসের কপালে হাত রাখল।

—আর বোলো কেন? মাথাটা একটু টিপে দাও না।

আরতি নিঃশব্দে মাথা টিপতে লাগল। বাইরের নানারকম শব্দ ঘরে ভেসে আসছে—উচ্ছ্বসিত হাসি, মর্মন্তুদ কান্না, আবার সমের মুখে তবলা ঘুঙুর আর বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত আঘাত। সব পাশাপাশি অত্যন্ত সুস্পষ্ট।

রাত বাড়তে লাগল। ব্র্যান্ডি, মাংস আর প্রবৃত্তি সব মিলেমিশেবিলাসের মধ্যে এক কনসার্ট শুরু করে দেয়। স্বামী হিসেবে আরতির কাছ থেকে তার রাতের সব পাওনা আদায় করে নেয়। ছাড়ে না কিছুতেই রাত গড়িয়ে চলে, অন্ধকার চন্দ্রাতপের তলায়। ক্লান্ত বিলাস এখন ঘুমে অচেতন। আরতির চোখে ঘুম নেই। ভাবনা কেবল সাংসারিক সুখ-দুঃখ আর জীবনস্বপ্নকে ঘিরে পল্লবিত হয়। পরিপূর্ণ একটি সংসারের, শান্তি দিয়ে ঘেরা সুখের একটি সংসারের ছবি যেন সোনার হরিণের মতো তার সামনে দিয়ে পালিয়ে যেতে চায়।

এক সময়ে শেষরাতে হয়তো একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল, বিলাসের ধাক্কায় ধড়মড় করে উঠে বসল।

—নাও নাও ওঠো। মনে নেই আমাকে আজ সকালেই বেরোতে হবে।

আরতি চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে পড়ল। চোখ দুটো তার জ্বালা করছে। শরীরে যেন তার কোনও শক্তি নেই। স্রেফ মনের জোরে চলছে। সে একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,

—আজ তো রবিবার।

—হ্যাঁ রবিবার তো, আজ আমাদের ডায়মন্ডহারবারে স্টিমার-পার্টি আছে না!

—আজ আর যেয়ো না। চলো আমরা দুজনে কোথাও ঘুরে আসি। অনেকদিন একসঙ্গে বেরোইনি।

—ওসব বাজে কথা রাখো। চট করে একটু চা করে দাও। বিলাস ব্রাশ করতে করতে মুখ ধুতে চলে গেল।

আরতি চোখে-মুখে একটু জল দিয়ে নিল। চোখ দুটো ভীষণ কড়কড় করছে। মনে মনে ভাবল চোখ দুটো একবার ডাক্তারকে দেখাতে হয়। প্রায়ই মাথা ধরে, একটু পড়াশোনা করলেই জল। গড়ায়, ঝাপসা দেখে। কাল রাতে খোলা জানালার পাশে অতক্ষণ না দাঁড়ালেই হত। ঠান্ডা লেগে গেছে।

এখুনি স্টোভ ধরাতে হবে। বিলাসের চা চাই, ডিমসেদ্ধ চাই, টোস্ট চাই। এখুনি সে বেরোবে। স্টোভ নেড়ে দেখল, তেল আছে, চলে যাবে। স্পিরিটের শিশি খালি। বড় শিশিটা উঁচু তাকে। তোলা আছে। ভালো হাত পায় না। বিলাসের জন্যে অপেক্ষা করতে হলে দেরি হয়ে যাবে। আর দেরি মানেই গালাগাল। পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে দেহটাকে যতদূর সম্ভব উঁচু করে আরতি স্পিরিটের শিশিটা নাগালের মধ্যে পেতে চাইল। হাত লেগে পাশের একটা ছোট্ট শিশি। কাত হয়ে গড়িয়ে পড়ল। আলগা কাঁচের ছিপি ঠিকরে পড়ল মেঝের ওপর। শিশির তরল পদার্থ তাক থেকে গড়িয়ে আরতির কপালে, সেখান থেকে তার দুচোখে।

অসহ্য জ্বালায় আরতি চিৎকার করে উঠল।

বিলাস বাথরুম থেকে জিগ্যেস করল কী হল?

—শিগগির এসো, আমার চোখে কী পড়েছে!

—কী আবার পড়ল। জ্বালাতন।

বিলাস কাজ সেরে ঘরে এল—কই কোথায়? আরে এ তো কার্বলিক অ্যাসিড। কী সর্বনাশ!

—চোখ দুটো জ্বলে যাচ্ছে। কী হবে গো! একবার দেখোনা।

একবার দেখোনা! সাত তাড়াতাড়ি ওখানে কী করতে গিয়েছিলে? নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা। কোথায় চা খেয়ে তাড়াতাড়ি বেরোব।

-না না, তুমি চলে যাও। দেরি হয়ে যাবে তোমার।

—চোখে জল দাও।

আরতি হাতড়ে হাতড়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল। বিলাস ব্যস্ত হয়ে পড়ল সাজগোজ নিয়ে। ধোপদুরস্ত ফাইন জামাকাপড় চকচকে জুতো, রুমালে সেন্ট।

আরতি হাতড়ে হাতড়ে ফিরে এল। জল দেওয়ার ফলে জ্বালা আরও বেড়ে গেছে। কপালের উপর চামড়া পুড়ে কুঁচকে গেছে।

–কমল? বিলাস কোঁচা ঠিক করতে করতে জিগ্যেস করল। আরতি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, অনেকটা। যন্ত্রণায় তখন আর তার মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না।

নারকেল তেল লাগিয়ে দাও, আর চোখ বুজে চুপ করে সারাদিন শুয়ে থাকো। আমি চললুম, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

বিলাস বেরিয়ে গেল তার পিকনিকে।

* * *

সন্ধে পেরিয়ে রাত নামল। তারায় ভরা আকাশ তখন ঝিমঝিম করছে চারপাশে। বিলাস ফিরে এল। সারাদিনের হই-হুল্লোড়ে আরতির কথা তার মনেই ছিল না। বাড়ির সামনে আসতেই পাশের বাড়ির এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন,

—এই যে বিলাসবাবু, আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল।

বিলাস অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভদ্রলোক ধীরে ধীরে গুছিয়ে বললেন,

—আপনি চলে যাওয়ার পর, আপনার বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। মানে আপনার স্ত্রী তাকের ওপর থেকে কী পাড়তে গিয়েছিলেন এমন সময় তাঁর চোখে অ্যাসিড পড়ে যায়। আমার স্ত্রী। গিয়েছিলেন আপনার বাড়িতে। তিনিই প্রথম খবরটা জানতে পারেন। তারপর আমরা সবাই মিলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেছি।

বিলাস হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করল—আমি চলে যাওয়ার পর ঘটেছে?

—হ্যাঁ। আপনার স্ত্রী বললেন ঠিক আপনি বেরিয়েছেন আর সেই সময়…

—ও।

—আপনি একবার দেখে আসুন। ডাক্তার বলছিলেন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আর একটু আগে আনলে হয়তো চোখদুটো বেঁচে যেত।

বিলাস আবার ফিরে চলল যে পথে এসেছিল সেই পথে। একটা খালি ট্যাক্সি আসছিল, উঠে বসল। হাসপাতালের বিরাট হলঘর, সারি সারি বিছানা। বিচিত্র রোগের পসরা সাজিয়ে রোগীরা অপেক্ষা করে আছে। প্রত্যেকের স্বতন্ত্র চিন্তা আর বেদনার কুয়াশায় ঘরের আলো কেমন যেন ম্লান আবছায়া হয়ে গেছে।

বিলাস টিনের চেয়ারটা সরিয়ে এনে আরতির বিছানার পাশে বসল। তার কপালে আর চোখদুটোতে পুরু ব্যান্ডেজ বাঁধা।

—কে এলে?

বিলাস নীচু গলায় বলল—আমি! এখন কেমন আছ?

—ওই আছি এক রকম। আরতির মুখে ফিকে হাসি। তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল— বোধহয় অন্ধ হয়ে যাব। তখন কী হবে বলো তো?

—কী আবার হবে! দেখতে পাবে না।

আরতি বিলাসের জবাব দেওয়ার ধরন দেখে চুপ করে রইল। কিন্তু অজস্র চিন্তা তাকে আবার সবাক করে তুলল।

—এমন হবে জানলে তোমাকে শেষবারের মতো ভালো করে একবার দেখে নিতুম। আর তো তোমাকে দেখতে পাব না। কী গো? চুপ করে রইলে? ভাবছ বোধহয় অনেক খরচ হয়ে যাবে তোমার। এই হাসপাতাল, ডাক্তার, ওষুধ?

বিলাস যেন একটু চমকে উঠল—না না, কী যা-তা বলছ! তাড়তাড়ি ভালো হয়ে ওঠো।

—ভালো হয়ে উঠলেও তোমার কোনও কাজেই তো আমি আর লাগব না। আমি তো অন্ধ হয়ে যাব।

—সে দেখা যাবে।

—তুমি বরং আর একটা বিয়ে করো।

—হ্যাঁ, ওসব এই নির্ভর আশ্রয়ে থেকে কল্পনা করতেই ভালো লাগে। একটা বিয়ে করেই হিমসিম! আবার আর একটা করে না খেয়ে মরি।

—আমি না হয় ভিক্ষে করে খাব।

—ওসব তোমার মনের আশঙ্কা। আমার মনটাকে যাচাই করে দেখছ। করলে কি তোমার সত্যি ভালো লাগবে?

—কেন লাগবে না? তুমি সুখি হও এই আমি চাই।

–বাজে বোকোনা, চুপ করে শোও।

—আমার বোধহয় মরে যাওয়াই ভালো। এ জীবন আর কী কাজে লাগবে?

—ভালো হতে পারে, কিন্তু তুমি করবে না। যাক আমি এখন চলি। আবার কাল আসা যাবে।

—একবার কাছে সরে এসো না, একটু হাত দিয়ে তোমাকে দেখি।

—না না, ওসব ছেলেমানুষির কোনও মানে হয় না।

বিলাস চলে এল। আরতির দীর্ঘ হাসপাতাল জীবন বিলাসের অমনি ছাড়া ছাড়া সহানুভূতিহীন আসা-যাওয়ার মধ্যে দিয়ে শেষ হয়ে গেল। বিলাসের হাত ধরে সে ফিরে এল তার ঘরে। কত দীর্ঘ পরিচিত পরিবেশের মাঝে শুরু হল অপরিচিত জীবন।

বিলাস কখন আসে কখন যায় আরতি টের পায় না। কেবল গভীর রাতে বিছানায় তার উপস্থিতি আরতি বুঝতে পারে। তখন আরতির জগৎ আবার ফিরে আসে ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে। তখন মনে হয় সে পৃথিবীতেই আছে, পৃথিবীর কামনা-বাসনাময় অতি পরিচিত ভোগরাজ্যে। কিন্তু অন্য সময়। মনে হয় সে যেন পৃথিবীর বহু দূরে। অস্পষ্ট শব্দ আর জীবনের কলরব যেন বিগত জীবনের স্বপ্ন! চোখ দিয়ে যা দেখা যায় না, মন দিয়ে তার নাগাল পেতেই দিন কেটে যায়।

আরতির কাছে আরতির জীবন মরে গেছে। কিন্তু বিলাস বেঁচে আছে। সে যেন নতুন করে জীবন পেয়েছে। তার সব ইন্দ্রিয়ে যৌবনের জোয়ার খেলছে। বাইরের রূপ-রস-গ্রাহ্য জগতের সঙ্গে তার গভীর আত্মীয়তা। তাই আরতি যখন মাঝে মাঝে বলে,

—আজ একটু বোসোনা গো আমার পাশে। দুটো কথা বলি।

বিলাস লাফিয়ে ওঠে—আমার অত সময় নেই। ক্লাবে যেতে হবে। ওই বামুনদির সঙ্গে কথা বলো।

—ও বুড়িমানুষ রান্নায় ব্যস্ত থাকে।

—আমার সঙ্গে রাত্তিরে বোলো।

—বাবা, রাত্তিরে কি কথা বলার মতো অবস্থা থাকে তোমার! কীসব ছাইপাঁশ খেয়ে আসো। তারপর আমাকে এমন পাগলের মতো জড়িয়ে ধরো। আমার বাপু তখন যেন কেমন ভয় ভয় করে। ইচ্ছে করে তোমার চেহারাটা তখন কেমন হয় একবার দেখি।

—সারাদিন নিষ্কর্মার মতো বসে থেকে দিন দিন যাচ্ছেতাই অশ্লীল হয়ে যাচ্ছ তুমি।

—কেন যা ঘটে তা মুখে বললেই বুঝি অশ্লীল হয়ে যায়!

—তোমার সঙ্গে তর্ক করার সময় আমার নেই।

বিলাস বেরিয়ে গেল। আরতি ডুবে গেল চিন্তার অন্ধকার রাজ্যে, বিলাস চলে গেল ক্লাবে।

* * *

–এসো এসো বিলাসচন্দ্র, আজ এত দেরি?

—আর বলো কেন ভাই, ঝামেল কি একরকম! উনি ঠিক বেরোবার মুখে বললেন, আবদারই বলতে পারো—এসো, পাশে বসে একটু গল্প করি।

বন্ধুরা হো হো করে হেসে উঠল।

—আরে তুমি বলেই ভাই এইসব বেয়ার করো। একটা অন্ধ মেয়েকে সারাজীবন বয়ে বেড়াও। তুমি ভাই আদর্শ স্বামী—আইডিয়াল হাজব্যান্ড।

চিত্রা রসিকতা করে বলল—আরে মশাই, কানা মেয়েও মেয়ে। তার চোখদুটো যেতে পারে কিন্তু শরীরের আর পাঁচটা জিনিস দিয়ে সে পুরুষের দাবি মেটাতে পারে। বিলাসবাবু চালাক লোক, সব বোঝে।

বিলাস বলল—ওর চোখদুটো গিয়ে একদিকে বেশ ভালোই হয়েছে। আগে আমার ওপর ওর একটা দাবি ছিল। এখানে নিয়ে চলো, ওখানে নিয়ে চলো। এই দাও, ওই দাও। এখন আর তা নয়। এখন আমার দয়ার ওপর নির্ভর করে আছে। ভয়, পাছে আর একটা বিয়ে করে ফেলি।

বন্ধুরা একদফা হাসলেন। বিলাসের কথাটা তাঁরা রসিকতা ভাবলেন বোধহয়। আরতির নির্জন গৃহকোণের দর্শন এইসব চক্ষুষ্মানদের কাছে উপেক্ষিত। এখানে সবাই চোখ দিয়ে দেখে, মন। দিয়ে উপভোগ করে। এখানে প্রলোভন আর আনন্দের ছড়াছড়ি। এই জগতে রোজ রোজ বিলাস অবগাহন করে। ইন্দ্রিয় ভরে নেয় উত্তাপে। তারপর ফিরে যায় তার গৃহকোণে। সেখানে প্রস্তুত আছে নারী তার উত্তপ্ত যৌবনভরা দেহ নিয়ে। নাই বা থাকল তার দুটি ডাগর চোখ। রাতের গভীর অন্ধকারে বিলোল কটাক্ষের কী-ই বা প্রয়োজন! কে শুনতে চায় তার সারাদিনের চিন্তা অথবা গভীর দার্শনিক কথা? পৃথিবীর মানুষ তাকে নামিয়ে আনে। প্রয়োজনের সংকীর্ণ গণ্ডিতে। সেখানে সবাই ধৃতরাষ্ট্র, সেখানে সবাই গান্ধারী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *