গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ (রচনা ১৯৮৭-৯৪। প্রকাশ ১৯৯৪)
গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ
১
গন্ধর্ব, উন্মাদ, তুমি অর্থহীন হাতে উঠে এসে
জলমণ্ডলের ছায়া মাখিয়ে গিয়েছ এই মুখে
তবু আজও বৃষ্টিহারা হয়ে আছে সমস্ত প্রবেশ
আমারও পায়ের কাছে চাপ চাপ রক্ত লেগে আছে।
আমি সর্বনাশ দিয়ে সর্বনাশ বাঁচাতে গিয়েছি
হাত ছুঁতে গিয়ে শুধু আগুন ছুঁয়েছি, আর তুমি
শূন্যের ভিতরে ওই বিষণ্ণ প্রতিভাকণা নিয়ে
আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে বিষম পাহাড়ে।
গান কেউ অন্ধকারে নিজে নিজে লেখেনি কখনো
আমাদের সকলেরই বুকে মেঘ পাথর ভেঙেছে
সে শুধু তোমার জন্য, গন্ধর্ব, তোমার হাত ছুঁয়ে
এই শিলাগুল্ম চিরজাগরূক বোধ নিয়ে আসে।
.
২
গন্ধর্ব, যেখানে তুমি দাঁড়িয়েছ তার ঘন নীচে
সবুজ ভাণ্ডের ওই বর্তুল গহ্বর থেকে আজ
মানুষের স্তব ওঠে, হলাহলও ওঠে মাঝে মাঝে।
সে-কুয়াশাজাল থেকে তুমি দেখো কীভাবে সজল
আঙুল পাতার প্রতি বিন্দু বিন্দু মুছে দিয়ে যায়,
সে-পাতা মেয়ের দল কপালে তিলক করে রাখে।
সেদিন বিকেলে তুমি কুড়িয়ে নিয়েছ পাইনফল
চুম্বন করেছ তাকে শঙ্খের ফুৎকারমত, আর
ধ্বনি তার আলো হয়ে গড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে
গহ্বরও অঞ্জলি তুলে উঠেছে পায়ের খুব কাছে।
কে বলে বিচ্ছেদ তাবে? ঘাসের রোমাঞ্চ ধমনীতে–
শূন্য মাটি সপ্ততল একসূত্রে বেঁধেছে এ-বুকে।
.
৪
যদি বলি হাত ধরো, ভয় পাও। সবারই হাতের
ভিতরে আরেক হাত জেগে ওঠে, আরো আরো হাত
কোন্ হাত কার কেউ জানে না তা আর, পথ চলি
শতভুজ বহুমুণ্ডে, আড়ে আড়ে চেয়ে দেখি, শুনি
যদি কেউ গান গায় চিত্ররথ হংস বিশ্বাবসু
গোমায়ু তুম্বুরু নন্দী যদি গেয়ে ফেরায় আমাকে
আমার নিজের কাছে, আসমুদ্র হিমাচল ছুঁয়ে
যদি তুমি হাত ধরো, একই হাত! কিন্তু দূরে কাছে
তোমার সমস্ত গানে ডানা ভেঙে পড়ে আছে বক
বিতস্তা বা চন্দ্রভাগা শতদ্রু বিপাশা ইরাবতী
তার সব স্রোত নিয়ে ধুয়ে দিতে পারেনি সে-লাল–
প্রতি রাত্রে মরি তাই, প্রতি দিনে আমি হন্তারক।
.
৫
কিংবদন্তি জানে সেই বুড়োটির কথা, যে এখনও
খরায় জড়ানো দিনে মাটির আঘ্রাণ নিতে নিতে
বলে দিতে পারে বুকে কোন্খানে জমে আছে জল
সমস্ত গাঁয়ের লোক তার শীর্ণ চোখে চেয়ে থাকে।
সেই বুড়ো মরে গেলে পৃথিবী অনাথ হবে না কি?
আমাদের জন্য আর ভোগবতী জাগাবে না কেউ?
গন্ধর্ব, বিশ্বাস রাখো, আমরাও জেনেছি শরীর
এইখানে শুয়ে আজ মাটির উপরে কান পেতে
কেঁপে ওঠা তার সব দেশজোড়া ধ্বনি ছুঁতে পাব
সমস্ত ফাটল ঠিকই ভরে দেব জাতকের বীজে
কেননা বিনাশ সেও কোষে কোষে উৎস রেখে যায়
আমাদেরও বুকে আজ জমেছে আগুনভরা জল।
.
৬
এই শব্দকুহকের সামনে আর সময় থাকে না
আগুন জ্বালবারও আগে দিনপল অন্ধ হয়ে যায়
ছুঁয়ে শুধু বুঝে নিই পাথর জলের ফেনা ঘাস
বর্তুলতা কঠোরতা ভরে নিই হাতের মুঠোয়
বুকে এনে বলি তাকে, আমি অন্ধ, তুমি কি বধির?
শুয়ে আছো বসুন্ধরা, সর্বস্ব ছুঁয়েছ তুমি কার?
দৃশ্য নও শ্রুতি নও, স্পর্শ, তুমি শরীরবিহীন
নিশ্বাসে তামসভরা পাহাড় দেখেছ কোনোদিন?
জেনেছ কি বাতুলের অগাধ মূর্ধনা জানু পেতে?
প্রতি রোমকূপে জ্বেলে ধরেছ পাতালগান? শুধু
ইন্দ্রিয়বিহীন হয়ে ঝরে গেছ পাহাড়ের নীচে
সমস্ত বিস্মৃতি তাই রাত্রি দিয়ে বাঁধিয়ে রেখেছি।
.
৯
ধমনীতে ভরে নেয়। বলে, কিছু জানবার নেই।
ফোঁটাও মুহূর্তবিন্দু, তারপরে ভাসাও আকাশে
সপ্তর্ষিসীমার থেকে চলে যাবে আরো আরো দূরে
বারে বারে ছিঁড়ে যাবে তুমি আর তোমার সময়।
কিন্তু কাকে গান বলো? কাকে বলো সৌদামিনী পাখি?
যখন চিৎকারশব্দে মেঘ ফেটে যায় অন্ধকারে
দেখোনি কী-নামে তার রুপালি রক্তের রেখা জ্বলে?
নিমেষে মুহূর্তগুলি আরো একবার ছুটে এসে
কীভাবে অঞ্জলি ধরে পাহাড়চূড়ার মতো প্রায়
দেখোনি চলার টানে তার সেই স্থাণুতা কখনো?
বৃষ্টিঝড়ে দাঁড়াও সে চূড়ার উপরে আর জানো
সব টান থেকে এই দেশ তাকে খুলে দিয়ে যায়।
.
১০
গন্ধর্ব, সেদিন খুব মাথা নিচু করে বসেছিলে
ভিখিরির মতো অন্ধ গলিতে রকের পাশে একা।
তোমারও কি স্বর ভাঙা? তবে আর কার কাছে যাব।
তোমার ধৈবতে আজ নিজেকে লাঘব করে নিয়ে
দু-একটি কথা শুধু বলে যাব সোজাসুজি চোখে
ভেবেছি কত-না দিন জপেছি কত-না দিনরাত।
তুমি জানো কে আমাকে আজকের মুহূর্ত পাব বলে
ছল বল মিথ্যে দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে মধ্যরাতে
এবং বলেছে- যাও, অধিকার করে নাও ওকে
কোনো লজ্জা লজ্জা নয়, কোনো মিথ্যে মিথ্যে নেই আর।
আর আমি সেই লোভে ঘূর্ণিপাকে মায়াজাল ছুঁড়ে
তুলেছি হাঙর, আর তারই মুখে হেরেছি মাধুরী।
সে-মাধুরী কী দিয়ে যে খুঁড়ে গেছে সব গঞ্জ গাঁও
এ অন্ধগলিতে বসে তুমি কি জানতেও পাও সেটা?
.
১১
পদ্মপুকুরের নামে মুঠোভরা এক-গর্ত জল
তার মধ্যে ডুব দিয়ে উঠে আসি অবিকল মুখে
অবিকল- কিন্তু তবু আমাকে চেনে না কেউ আর–
এ মোহিনী ডোবা আজ দিয়েছে-বা আরেক জীবন।
কিন্তু কেন চেনে না সে? জন্ম জন্ম বেঁধে রাখা বীজে
আমার সুষুম্না ছেড়ে কোথায় সে পালাবে ভেবেছে?
‘দেখোনি কখনো আগে?’ আমি ডেকে বলি, সে আমাকে
ভূতগ্রস্ত ভেবে দূরে সরে যায়, আমি ছুটে গিয়ে
জাপটে ধরি, সে আমাকে, তারপর কে-বা আমি, সে কে
কিছু স্পষ্ট নয় আর, ঝলকে ঝলকে থেকে থেকে
উগরে ওঠা শ্লেষ্মা পাঁক ঘূর্ণি যেন সুধারসধারে
ছড়ায় দিগন্তে দিকে তলে অবতলে ঊর্ধ্বে অধে–
কোথায় দাঁড়াব আর তখন তোমার পাশে ছাড়া।
.
১২
তবে কি তোমাকে কাল আহত করেছি ভুল করে?
কথা যদি আজ আর কোনো কথা না বলে কখনো
মুখোমুখি কথামালা আমাদের কতদূরে নেবে?
টোকা দিয়ে দেখি তাই কী বলে সে, কিছু কি বলেছে?
বেঁচে আছে? মরে গেছে? বাঁচামরা এক হয়ে আছে?
না কি ও চিতায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাতিল খোলস
অক্ষরের মুখে শুধু বুনে দেওয়া হলকা, নীল নাচ!
একবিন্দু বেঁচে-থাকা চেয়েছিল স্তব্ধ কথাগুলি
চেয়েছিল ধ্বনি তার উনিশশো নব্বই থেকে ঘুরে
দাঁড়াবে তোমার দিকে মুখ তুলে। লোকেরা যে বলে
‘আচ্ছা চলি, দেখা হবে’-কোনখানে দেখা হতে পারে?
কোথাও ঠিকানা আছে? কোনো অভিজ্ঞান? কোনো ছুতো?
কীভাবে বলবে তবে উঠে এসো গান গাও বাঁচো
গন্ধর্ব তুমিও যদি মাথা নিচু করে বসে আছো!
.
১৩
মনে করো সেই রাত, এক সেল থেকে অন্য সেলে
স্ট্রেচারবাহিত চলা উত্তান মুখের ক্ষত নিয়ে
মুহূর্তের ভুলে চোখ মেলতে গিয়ে রক্তের ঝালরে
বন্ধু-আকাশের মুখে দেখা সেই একইমতো তারা!
প্রতিটি ক্ষতের মধ্যে অর্বুদ কালের মাইল মাইল
পথ পড়ে আছে তবু মনে হয় এত কাছাকাছি।
কিন্তু তারও জ্যোতি ছিল, সে ক্ষতের, স্রোতোবেগ ছিল
পাথর-ঘষটানো মুখে পাথরের ভাস্বরতা ছিল
বাণীর বিবাহ ছিল এক সেল থেকে অন্য সেলে।
আর আজ সুলাবণি ক্ষতহীন মুখের রেখায়
সব ঘাস হয়ে আছে মরা ফড়িঙের ডানা, চোখে
ব্যথা নেই, চমৎকার অসাড় দিনেরা ঘিরে আছে
দিকে দিকে। আমারও যে একদিন ছিল কিছু, তার
একমাত্র চিহ্ন হয়ে পড়ে আছে শহিদ স্ট্রেচার।
.
১৪
বালির ভিতরে ওরা ঢুকে যায় পলকে পলকে।
মুছে-যাওয়া দাগ নিয়ে কতমতো কথা বলে লোকে
কত জল ভরে রাখে ওইটুকু লাল ডানা, আর
কত স্থির হয়ে থাকে সমস্ত দিনের অস্থিরতা।
কীভাবে ভেবেছ তুমি নিয়ে যাবে পড়ন্ত ছায়ার
গলে-পড়া বিন্দুগুলি– কার সঙ্গে কাকে দেবে জুড়ে?
সব ভুল জড়ো করে জ্বালিয়ে দিয়েছ শুকনো পাতা
সে-দাহনে জেগে ওঠে জ্ঞান, ওঠে, লাফ দিয়ে ওঠে
সোনালি চিতার মতো, আর তার থাবা বুকে নিয়ে
বালির ভিতরে খুব ছোটো ছোটো পায়ে যেতে যেতে
অবশ শরীর ছুঁয়ে উড়ে যায় সমুদ্রের হাওয়া–
জীবনে বয়স নয়, বয়সে জীবন জুড়ে যাওয়া।
.
১৫
সেদিনও তোমার সঙ্গে দেখা হলো গলির বাঁ-পাশে।
ভালোই তো আছো মনে হলো। চোখের কোণের দাগ
চোখেও পড়েনি। তুমিও কি ক্লান্ত হও? ভাবিনি তা।
তার পরে বহুদিন খুঁজেছি বাজারে পথে ঘাসে
খুঁজেছি যখন ওরা টেনে ছিঁড়ে আমার পালক
কপালে উলকির টানে পাড়ার তাণ্ডবে ছোঁড়ে হোম
আলগা করে নিতে চায় হাত ঊরু বুক মূর্ধা চোখ
ছড়ানো কবন্ধ থেকে তুবড়ি জ্বলে ওঠে অন্ধ ব্যূহে
তখনও সে-ঘূর্ণি থেকে খুঁজেছি তোমার চলাচল।
আজ সব ছেড়ে এসে দেখি তুমি বাঁকানো খিলানে
কাচে ঢাকা ম্যমি হয়ে শুয়ে আছো ছায়াজাদুঘরে–
এবারের মতো আর ছুঁয়ে দেখা হলো না তোমাকে।
.
১৮
খোঁড়া পায়ে এতদূর এসেছি কি কিছু না পেয়েই
ফিরে যাব ভেবে? শোনো, তোমার চাতুরী আমি বুঝি।
হাতেরও আঙুল নেই তবুও প্রথম থেকে ফের
বানাব ছবি ও গান, ছড়াব উজাড় কথামালা।
এক পায়ে এক পায়ে শব্দ তুলে খুঁজে নেব ডেরা
আবারও তোমার সঙ্গে দেখা হবে হিম গিরিখাতে।
ব্যভিচারী তুমি, তুমি যেখানেই যাও আমি যাব
আমারই পাঁজর ভেঙে যদি শুধু মশাল জ্বালাও
আমার করোটি নিয়ে ধুনুচি নাচাতে চাও যদি
তবু আমি কোনোদিন ছেড়ে যেতে দেব না তোমাকে।
এক শতাব্দীর পরে আরেক শতাব্দী আরো এক
আমি যদি না-ও থাকি তবুও আমিই পড়ে থাকে।
.
২৩
শহর শহরতলি রংরহস্যের ঢল মুছে
চলেছি সীমান্তদেশে। ঝলসানো আলোয় খাক হয়ে
শিখেছি কাকে কী বলে। পিঁপড়ের মতন মুখোমুখি
চকিত আদর রেখে চকিতে পিছনে ফেলে যাওয়া
মুহূর্তের স্বাদে গড়া ছোটো ছোটো চিনির বেসাতি—
এসব তো খুব হলো। আজ তার অন্ধিসন্ধি ফেলে
দূরে ছুঁড়ে জয়োচ্ছল শিখা ভাঁড় ঘুঙুর মাদল
কেবলই পায়ের দাগ ছুঁয়ে ছুঁয়ে পল-অনুপল
শস্যশরীরের দিকে যেতে যেতে আলপথ ভেঙে
নিশানা বাড়ানো এই শরীরের শস্য ঝরে যায়।
আবহে ঘুমের চাপ, কালো হয়ে আসে মখমল,
বহুদিন পরে আজ শরীরে শরীর যায় মিশে,
হাজার আলোকবর্ষ নিশ্বাসের মধ্যে শুষে নিয়ে
মাথার উপরে জাগে কন্যারাশি, হাতে গমশিষ।
.
২৪
যেসব মানুষ নেই যেসব মানুষ মরে গেছে
যেসব মানুষ তবু কথা বলেছিল একদিন
দ্বাদশীর রাতে তারা আমার বাঁকের কাছে এসে
সরাসরি প্রশ্ন করে : বলো কাকে বলে বহমান।
যেসব মানুষ আজও কষ্ট পায়, যেসব মানুষ
শুধু বেঁচে আছে বলে মরে যেতে চায় বারে বারে
তাদের ক্ষতের নীচে আমার চুমুর শব্দ শুনে
কেউ-বা ঘুমিয়ে পড়ে অতর্কিত ডালপালা ফেলে।
কেবল বটের পাতা নিজের ছায়ার থেকে উড়ে
এমন ছলাৎ বুকে ভোররাতে ভেসে যায়, আর
যেসব মানুষ তবু ভুলে থাকে, যেসব মানুষ
ছেঁড়াজবা নিয়ে আজও আসে না এ জলের কিনারে
তাদের সবার শিরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘোলা স্রোতে
সকালবেলার বিষ
সকালবেলার বিষ রোজ আমি ছুঁয়ে গেছি ঠোঁটে।
.
২৫
এই রাত্রি, টোডরমল, ভেসে আছে আতুর আলোয়
আকাশ আভাসমাত্র, স্থল জল বাষ্প হয়ে আছে
শূন্যের পূর্ণতা নিয়ে ভরে আছে ইবাদতখানা—
এই রাত্রে মনে হয় স্বপ্ন দেখলে দোষ নেই কোনো।
একদিন এই দেশে- সুজলা সুফলা এই দেশে
পাথরে পাথর গেঁথে উঁচু করে বানাব মিনার
সেখানে দাঁড়িয়ে যারা ছিন্নভিন্ন পক্ষাঘাত থেকে
চন্দ্ৰগরিমার দিকে বাড়াবে অশোক হাতগুলি
তারা কেউ এরা নয়- হিন্দুও না, মুসলমানও নয়,
জৈন বৌদ্ধ খ্রিষ্টানও না, জরথুষ্ট্রি নয়, কিন্তু সবই
একাকার কোনো দীন ইলাহির গোলাপবাগানে
উৎসের আতর ছুঁয়ে প্রাচী-র প্রান্তর ভরে দেবে।
আর এই ফতেপুর- ফতেপুর সিক্রি যার নাম
তারই মর্মমূল থেকে এ জাহান পেয়ে যাবে নূর–
তখন কোথায় আমি, কোথায়-বা ক্ষত্রবংশী তুমি
মানুষই তখন গান, মানুষই তখন ত্রুবাদুর।
.
২৯
এবার আসোনি তুমি সাবলীল কালো জলাধারে
এবার আসোনি তুমি মেঘাতুর পাহাড়চূড়ায়
আমার গরিবজন্ম তোমাকেও করেছে গরিব
এবার বৃষ্টির দিনে বসে আছো চায়ের দোকানে।
ঘর করা হলো কি না বলে একজন, অন্যজনে
আজও খুঁজে ফেরে মুখ মিছিলে যা হারিয়ে গিয়েছে,
কারো মুখে ব্রণচিহ্ন, বঙ্গদর্শনের পাতা খুলে
ভাবে কোন্ আন্দোলনে নিশ্বাস ফেরাবে পৃথিবীর।
পথে জমে আছে জল, কথাও নামিয়ে আনে ভার
সারাৎসার উড়ে যায় চায়ের ধোঁয়ায়, তার পাশে
ধর্মজিজ্ঞাসার মতো চিহ্ন হয়ে বসে আছো তুমি
যেন সব ভুলে আছে দীপংকর শ্রীজ্ঞান অতীশ।
.
৩১
তোমারই ঠোঁটের দাগ এ-অসাড় পাথরে পাথরে
ফসিলের ফুল হয়ে ফুটে আছে পাণ্ডুরেখাজালে
কারা তার মাঝখানে বর্শাফলকের দিন খুঁজে
মুখ গুঁজে পড়ে আছে যেখানে ইটের প্রহেলিকা।
আমি দূর থেকে দেখি নেশায় বিকল কটা চোখ
স্বপ্নের ভিতরে শুধু শুনি তার ওম ওম্ ধ্বনি
শয়ে শয়ে ধুনিজ্বালা যেখানে হলুদ কুয়াশাতে
পাখিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে আড়াআড়ি আত্মঘাতকামী
আর তার মাংসখণ্ডে ভরে থাকে আদিগন্ত মাটি
সরযুর টানও তাকে ভাসাতে পারে না, সেই স্রোতে
আমরা যে কথা বলি আমরা যে গান গাই, তার
তোমার বুকের ক্ষতে অন্য কোনো মানে আছে আর?
.
৩২
ডানায় রক্তের দাগ, উড়ে তুমি কোথা থেকে এলে
এই অশথের নীচে দুদণ্ড জিরোও, এর নীচে
কোনো ক্লান্তি ক্লান্তি নয়, কোনো ক্ষোভ নয় কোনো ক্ষোভ
তোমারও তো শেষ নেই, তুমি কেন ভাবো অপারগ?
ওরা এর মসৃণতা হাতের পাতায় পেয়ে গেছে
ওরা এর রক্তিমাভা তুলে নিয়ে মেখেছে শরীরে
হৃৎপিণ্ডে তীর আর দুচোখে উড্ডীন নিয়ে ওরা
কতদিন কতরাত তোমার প্রসারে চেয়ে আছে।
ডানার সীমানা নেই, নাশকের নিশানা পেরিয়ে
কোথায় তোমার বাড়ি কোথায় তোমার দেশগাঁও–
গ্রহতারকার নীচে পড়ে আছে সজল সময়
বুকে হাত দিয়ে বলো আজও তাকে কতখানি চাও।
.
৩৬
সব চোখ মেলে দিয়ে এ বাতাসে জড়িয়ে ধরেছ
তুমিই আগুন তুমি জল তুমি আকাশ বা মাটি
শরীরে শিহর তুমি মনে আমরণ আরাধনা
অমৃত পাহাড় থেকে সাগরের তরল গরল।
পুরোনো বছরগুলি ফুলের স্তবক নিয়ে প্রায়
পায়ে পায়ে হেঁটে যায় পার্ক স্ট্রিট থেকে গড়িয়ায়
আর তার মুক্তদেশে সোনালি সপ্তর্ষিরেখা রেখে
গভীর প্রান্তরে ঝুঁকে যখন এ ওকে চুমু খায়
তখনই শূন্যের থেকে ঝাঁপ দেয় লক্ষ লক্ষ তারা
তখনই অশথপাতা হাওয়ায় হাওয়ায় মাতোয়ারা
তখনই উৎসের থেকে নেমে আসে প্রলয়ের জল
তখনই গন্ধর্ব তুমি খুলে দাও মাটির আগল
আমার শরীরে তার ছোঁয়া লেগে থাকে অবিরল
আমার শরীরে সেই ছোঁয়া লেগে আছে অবিরল
আমার শরীরে সেই ছোঁয়া লেগে আছে অবিরল