গানের বাগান
রাইচাদবাবু তখন সবে চলে গেছেন। আগে রেডিওতে দুপুরের অধিবেশন শুরুই হত ফৈয়াজ খাঁকে নিয়ে। মাঝে রাইবাবুর বাবা লালাদ বড়াল। রাস্তার পিচ গলে গেছে। দরজা-জানলা বন্ধ করে ফৈয়াজ, লালচঁাদ—সুরেলা দাপটে অন্ধকার ঘর ভরাট। শুনি আর গলার এক-একটা দানাদার কাজ বহুদিন বিধে থাকে মাথায়।
মনে করার চেষ্টা করি—ওঁরা যখন গেয়েছেন—মানে ওঁদের মাপের সব গাইয়ে যখন রাজত্ব করছেন, তখন কোন সাল ? এই শতাব্দী সবে দোর খুলেছে। প্রথম মহাযুদ্ধ আসেনি। সারেঙ্গি, হারমােনিয়াম ওঁদের গলার আগুপিছু কথা বলতে বলতে এগােয়।
কুচকুচে কালাে কাক গরমের দুপুরে তৃষ্ণায় নির্জন কলতলায় গিয়ে হাঁ। করে যা দু-একফোঁটা জল পাওয়া যায়—তাই খাবার প্রাণপণ চেষ্টা করে। তখন কালাে কাকের হাঁ-মুখ দেখা যায়। দগদগে লাল। সবে কাটা আধখানা তরমুজের বুক একদম। ওঁদের গান মানুষের বুকের ঠিক অমন জায়গা থেকে সিধে উঠে আসে।
এইসব গান যখন কলকাতা দখল করে নিচ্ছে—তখন ট্রাম ইলেকট্রিকে ছুটতে শুরু করল। বড়ােদিনে জয়পুর, মাইশােরের মহারাজারা কলকাতায় বড়ােলাটকে ভেট দিতে আসছেন। গওহরজান একদা খিদমতগার আবদুল্লাকে বুক থেকে নামিয়ে ভিটেছাড়া করতে বি এল মিত্তিরের মতাে ব্যারিস্টার লাগাল। শিশির ভাদুড়ি, সুনীতি চাটুজ্জে মতি শীলের ফ্রি কলেজে এগজামিন দিচ্ছেন। লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করবেনই।
পুরনাে রেকর্ড আঁতিপাঁতি করে খুঁজি আর চোখ বুজলে সময়টা আবছা দেখতে পাই। চোরবাজার, গােপালনগর, ধর্মতলা—কোথায় নয়। ওঁদের গলার এক-একটি টুকরাে কাজ আমার চোখের সামনে টপাং করে ১৯০৮, ১৯১০, ১৯১৩ লাফিয়ে পড়ে। একদম মুখােমুখি।
কিশাের কৃষ্ণচন্দ্র ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে অন্ধ হয়ে নীচে নেমে এল। ওস্তাদ জামিরুদ্দিন তালিম দিচ্ছেন তাঁকে। নজরুল ইসলাম এসে জুটে যাওয়ায় হয়ে গেলেন কৃষ্ণচন্দ্রের গুরুভাই। মেঘ হেরি নীল গগনে। মিস লাইট। কে—
মল্লিকের রেকর্ড বেরুল। ওই মহাসিন্ধুর… | টকি নিয়ে এল পঙ্কজ, সায়গল, কাননকে। হলুদ গাঁদার ফুল। চব্বিশ বছর বয়সেই ভীষ্মদেব ভীষ্মদেব। জ্ঞান গোঁসাইয়ের ক্ষয়রােগ ধরা পড়েছে। শূন্য এ বুকে পাখি মাের। শচীনদেব আড্ডা দিচ্ছেন গােপালনগর যাবার ব্রিজে উঠতে বাঁ-হাতে গ্রহশান্তি মন্দিরের পাশে বাটার দোকানের লাগােয়া বায়া-তবলার দোকানে। তুমি যে গিয়াছাে..হেমন্ত মুখােপাধ্যায় এই তাে সেদিন বললেন, রাজা বসন্ত রায় রােডে শচীনদা গলা সাধছেন—আমি পায়ের বুড়াে আঙুলে ভর দিয়ে যতটা পারি লম্বা হয়ে ওঁকে দেখার চেষ্টা করছি। যদি দেখা যায়। ফাংশনে গাইতে যাই। পঙ্কজদা এলেন, গাইলেন, চলে গেলেন। আকাশে হেলান দিয়ে। বসে আছি তাে বসেই আছি। কখন ডাক পড়বে। জানি না। এইসব ভাবি আর হাতের বুড়াে আঙুলের নখ দিয়ে বাতাস চুলকে তার ভেতর থেকে সায়গলকে বের করতে চেষ্টা করি। হুইস্কি না খেয়ে গাইলে গানই হয়—
—এ রকম বিশ্বাস ছিল তার। নাই বা ঘুমালে প্রিয় রজনী এখনও বাকি। রাইবাবু হিন্দিতে কীর্তন গাওয়ালেন তাকে দিয়ে।
আনােয়ার শা রােড দিয়ে শীতের সন্ধ্যায় যাচ্ছি। রাস্তাটা তখন সরু। নিউ থিয়েটার্স দু-নম্বর স্টুডিওর গেটে সিমেন্ট করা বেঞ্চে বসে পঙ্কজ মল্লিক। গাড়ির অপেক্ষায়। পাড়ার কয়লার উনুনের ধোঁয়া এখানে-সেখানে ঝুলে আছে। ডাক্তার ছবিতে পালঙ্কে বসে পঙ্কজ সেতার বাজিয়ে গাইছেন। গালে দাড়ি। গানটা মনে নেই আর। কেন ভুলে যাই? সেই যে—চরণ ধরিতে দিয়াে—
গাে আমারে…
পঞ্চাশ-বাহান্ন বছর আগে গড়িয়াহাটের মােড় ফঁকা ফাঁকা। বড়ুয়ার নতুন নায়ক রবীন মজুমদার পাজামা-পাঞ্জাবির ওপর চাদর জড়িয়ে কী কিনতে এসেছেন দোকানে। সেই আমার কলকাতায় প্রথম আসা। বড়দার হাঁপানির চিকিৎসার জন্যে। এই লােকটাই গায়? কত সহজে একটিন বিস্কুট কিনলেন। টিনটা হাতে নিলেন। হাত কাঁপল না। আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ যদি নাই বা জ্বলে…
স্কুলের নিচু ক্লাসে মফস্বলের ছবিঘরে শরৎচন্দ্রের কাশীনাথে অসিতবরণ গাইছেন। পরে অনেক পরে কলকাতায় মুদিয়ালির মােড়ে র্যাম্বলার গাড়ি থেকে অসিতবরণ নামলেন। খাঁচায় বন্দি পাখির সামনে গান—ও বনের পাখি-ই-ই…
তখনও উত্তম আসেননি। গায়ক-নায়কদের যুগটা প্রায় শেষ। সায়গল নেই। পাহাড়ি সান্যাল আর কবি বিদ্যাপতি হয়ে গান গান না সিনেমায়। রবীন মজুমদার, অসিতবরণ গান থামিয়ে প্রথমে বিকাশ রায়, তারপর উত্তমকুমারকে জায়গা করে দিচ্ছেন। আমি চোখ বুজলে দেখতে পাই কানন দেবী মন খারাপ করে যােগাযােগে ট্রেন ধরতে ছুটে এসেছেন রেলস্টেশনে। মালতীর গন্ধে ভরা…
গানের এ এক অদ্ভুত ন্যাশনাল হাইওয়ে। রাস্তার দুধারে মােটেলগুলাের নাম এইসব কিন্নর-কিন্নরীর নামে। লালাদ। গওহরজান। সায়গল। জ্ঞান। গোঁসাই। কৃষ্ণচন্দ্র। পঙ্কজ। কানন। রবীন মজুমদার। অসিতবরণ। ভীষ্মদেব। হেমন্ত। শচীনদেব। রােদে পুড়ে যাচ্ছে হাইওয়ে। কৃষ্ণচন্দ্র, সায়গল, শচীনদেব—যেকোনও মােটেলে ঢুকলে শান্ত, গাঢ় ছায়া। মেঘ হেরি নীল গগনে। রজনী এখনও বাকি। তুমি যে গিয়াছাে বকুল বিছানাে পথে…।
এই ছায়ার খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে এমন এমন গলার স্বরের স্বাদ পাই—যা কিনা সেই গান যেদিন গাওয়া হয়েছিল—সেই সময়কার আলাে, বাতাস, গন্ধ, লােকজন, রাস্তাঘাট নিয়ে আসে চোখের সামনে। জন্মের আগের এই পৃথিবী কেমন ছিল। যখন হামাগুড়ি দিচ্ছি তখন। কিশাের ছিলাম যখন। প্রথম যৌবনে। সব—সব দেখতে পাই। এক-একটি গলা সেই বুজে যাওয়া কুয়াে খুঁড়ে বের করে আনে এক-একখানা পৃথিবী। এ-এক অদ্ভুত বাগান। নিজে শরীর থেকে স্বর বের করে ফুল ফোটালাম। নিজে চলে গেলাম একদিন। কোনও চিহ্ন থাকল না। থেকে গেল শরীর দিয়ে ফোটানাে ফুলটা।
প্রেম যদি না দিলে তাকে…সায়গলের বাকিটা উদ্ধার করা গেল না। ওখানটায় সাত পুরনাে আটাত্তর আর পি এম রেকর্ড ঘষে গিয়ে প্লেন হয়ে গেছে। পিন পিছলে যাচ্ছে। গানের কথা নির্ঘাত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগেকার। এই উনিশশাে ছত্রিশ-সাঁইত্রিশের। তার মানে সায়গলের তখন বত্রিশ-তেত্রিশ বছর বয়স। আমার মা সায়গলের বয়সি। ঠিক বঙ্গভঙ্গের আগে-পিছনে জন্ম। এ গান শুনে মায়ের ভালাে লেগেছিল। আমার বড়াে মেয়ের এখন ওই বয়স। এই গান আমাকে এখন আমার মায়ের যৌবনে নিয়ে গেল। আবার একই সঙ্গে আমার বড়াে মেয়ের যৌবনেও পৌছে যাচ্ছি। এ-এক অদ্ভুত বাগান। যেখানে ফুল ফুটেই থাকে। কখনও ঝরে না। এ-এক অক্ষয় উদ্যান।
পুরনাে অমৃতবাজার অফিস বাগবাজারে, তার পেছনে শৈলেন মিত্তির থাকেন। পাট কোম্পানিতে চাকরি করেন। তার বাবা বিলেত থেকে মাছ ধরার ম্যাগাজিন এনে ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে পড়েন। এক সময় এরিয়ান ক্লাব গড়ে তুলেছিলেন। তা সেই শৈলেনবাবু মৈজুদ্দিনের পিচবাের্ডের রেকর্ড বাজিয়ে উনিশশাে দুই-তিন সালের ঠুংরি শােনালেন। গাইবার আগে মৈজুদ্দিন খুব সন্দেশ খেতেন। আমি যখন প্রথম বাড়ি করি-বড়াে মিস্ত্রি ছিলেন দেবেনবাবু। তিনি সন্ধেবেলা বাংলা পাকি মদের সঙ্গে আড়াইশাে গ্রাম সন্দেশ খেতেন।
মৈজুদ্দিনের ঠুংরির টোরকিপ শুনে বেরিয়ে এসে সন্ধেবেলায় বাগবাজারের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাবি—এত এত হারিয়ে যাওয়া সব ফুল পুরনাে ভাঙা রেকর্ড হয়ে এই বিশাল কলকাতায় কার কার বাড়ি পড়ে আছে—তা খুঁজে পাব কী করে ? এক জীবনে তাে হবে না। আফসােস। আফসােস। কিছু করার নেই।
ধর্মতলায় রাস্তার দোকানিদের রেকর্ডের গাদি থেকে পরশপাথর খুঁজি। বেশির ভাগ রেকর্ডে লেখা মুছে গেছে। অমুক বাণীচিত্রে সত্যভামিনী। তমুক বাণীচিত্রে অমুকের ক্ল্যারিওনেট। দরকারি নামগুলােই মুছে গেছে। বাড়ি এনে সাবান ঘষে রেকর্ড প্লেয়ারে চড়াতে সেই সুদূরে আশি-নব্বই বছর পেছন থেকে ক্ষীণ গলা ভেসে আসে। হাতড়াই। ফুলটি একেবারে ঝরে যায়নি। কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে।
এইভাবেই পেয়ে যাই জহুরাবাই। আমিরবাই কর্নাটকি। মিস পদ্মারানী। যেন সিঙ্গিল লাইনের কোনও পুরনাে রেলস্টেশন। এক সময় গাড়ি যেত-আসত। ডিসট্যান্ট সিগনালটাও আছে। কিন্তু এখন আর ট্রেন দাঁড়ায় না।
এইভাবেই একদিন লালাদ বড়ালদের বাড়ি গিয়ে হাজির। খুবই অল্প বয়সে মারা যান তিনি। তার তিন ছেলে—জলু বড়াল, গঙ্গু বড়াল, রাইচাঁদ বড়ালও তখন নেই। আছেন লালচঁাদের নাতি-নাতনিরা। দুনিচঁাদ। চাদুদ। দুনিবাবু ধ্রুপদ গাইছেন। থামওয়ালা বাড়ি। ভেতরে উঠান। লালচঁাদের বাবা অ্যাটর্নি ছিলেন। তাঁর বানানাে। মানে একশাে বছরেরও আগে তৈরি এই বাড়ি। ঢুকেই ডান হাতে সিঁড়ি। পায়ে পায়ে উঠি। উঠেই দোতলায় বিরাট অয়েল পেইন্টিং। গত শতাব্দীতে নেপালের রাজার সঙ্গে সারা ভারতের সব শাহেনশা গাইয়ে-বাজিয়ের গ্রুপ ছবি। দাড়ি। পাগড়ি। পায়ে লপেটা। যাকে বলে হ্যান্ডেলবার গোঁফ। কেউ এলিয়ে বসেছেন। একজন মহিলাও আছেন। দুনিৰ্চাদবাবু বললেন, উনি মুস্তরিবাই। কিছুই জানি না। ভয়ে, ভক্তিতে ছবির চারদিকে দৈবী আলাের বলয় দেখতে পাই। বসবার ঘরখানি লাগােয়া। তার একদেওয়াল জুড়ে বিশাল আয়না। দুনিবাবু বললেন, ড্রেসডেনের। মল্লিক প্যালেসের সিলিং থেকে ঝুলে থাকা ঝাড় দেখেছি। তাও ড্রেসডেনের।
আয়নার পাশেই বাঁধানাে ফটোতে জলু বড়াল বসে তবলা বাজাচ্ছেন। বিরাট গোঁফ। বাড়িটি ফাঁকা। এই বাড়ি থেকে এক সময় কয়লার উনুনের ধোঁয়ার মতােই সুর বেরুত। দুনিবাবু জানালেন, তিনি নিখিল বঙ্গ বাঈজি সমিতির সভাপতি। বুঝলাম, দুনিৰ্চাদবাবু গানের বাগানেই থাকেন। ফুল দেখেন। গন্ধ পান। নিজেও সুবাস ছড়ান।
এইভাবে একটু-একটু শােনা, একটু-একটু পাওয়া, একটু-একটু দেখা আর একটু-একটু ভাবা নিয়েই আমার ঝােলা ভর্তি হচ্ছিল। আবার আহ্লাদ—আনন্দ গানটি গাওয়ার সময়কার বাতাসে, আলােয়, গন্ধে চলে যাওয়া। হাতড়ে হাতড়ে ধরে ফেলা। রাস্তাঘাট। লােকজন। তখনকার শীতের গরম শিঙাড়া ভেঙে তার ভেতরকার ফুলকপির গন্ধ, ফিকে সবুজ উঁটি। গােলাপ হয়ে উঠুক ফুটে তােমার রাঙা কপােলখানি….
একদিন দুপুরে রাস্তার পিচ গলে গেছে। গােপালনগরের মােড়ে পুরনাে ফার্নিচারের কেনাবেচা রাস্তার দিকে। শুড়ি গলি ধরে ভেতরে গেলে দেখা যাবে দড়ির মাচা করে পরেপ্পর মানুষ ঘুমােচ্ছে। এরা কি সারা রাত জেগে চুরি করে ? টালির ছাদ অবধি দড়ির খাটিয়া ওপরের দিকে উঠে গেছে সাত থাক। সেখানেই পুরনাে বাতিল জিনিসের কারবার।
ঘাঁটতে-ঘাঁটতে পেয়ে যাই নার্স সি সি বাণীচিত্রে অসিতবরণ। ছবিটি দেখা। নায়িকা ছিলেন ভারতী। তিনিই নার্স সেজেছিলেন। সে পঞ্চাশ বছরেরও আগে। বাড়ি ফিরে সাবান দিয়ে ভালাে করে ধুয়ে বাজাই। তিন মিনিটের জন্যে উনিশশাে তেতাল্লিশ ঝাপিয়ে পড়ে। নিখাদ ভালােবাসার গান। তাতে দেশভাগ নেই। পেনিসিলিন নেই। সে এক অক্ষয় উনিশশাে তেতাল্লিশ।
ঘুরে ঘুরে দেখি। কোনও দোকানে অসিতবরণ নেই। রবীন মজুমদার আছেন। অসিতবরণ নেই। কোনও এল পি নেই। কোনও ক্যাসেট নেই। খুব কষ্ট হয়। প্রতিশ্রুতিতে পাহাড়ি সান্যালের সেই ছােটোভাই অসিতবরণ। খােলামেলা গলা। একদিন রেডিওতে শুনলাম ওকে—
আয়িরে আমিরে মেরে বাগিয়ামে
কুকে কোয়েলিয়া বৈরী বসন্তি আয়িরে—
কুকে কোয়েলিয়া। কোকিল ডাকছে। সত্যিই গলায় বসন্ত এসে ভর করেছে অসিতবরণের। এই তাে সেই অক্ষয় ফুল। গানের বাগানে।
কোথায় অসিতবরণ ! কোথাও পাওয়া যায় না তাকে। কোনও গানের দোকানে তিনি নেই। তার গলায় বসন্ত যেন যৌবনে পৌছল। খনখনে, খােলমােলা, ভঁটো দেখতে মানুষটি।
একদিন দেখা পেলাম মানুষটির। ব্যাগ হাতে সকালবেলা বাজার করতে যাচ্ছেন। ওঁর পাড়াতেই তখন বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে এসেছি। মাথা সাদা-কালাে। একদিন কথায় কথায় সিনেমার কথা বলতে যাচ্ছিলেন। গানের কথাও। মাঝখানে থেমে পড়লেন হঠাৎ। কী হবে এসব কথা বলে!
হিন্দিতে ওঁর একটা জানা গান গাইবার চেষ্টা করি—
ম্যায় জান গয়া
পহেচান গয়া
তুনে মুঝে পুকারা—আ
আমাকে শুধরে দিয়ে তিনি নিজেই গেয়ে উঠলেন। ওঁরই পুরনাে রেকর্ডে শােনা গান। গলা এখন আর তেমন নয়। গান থামিয়ে বললেন, হিন্দিতে আমার হিরাে হওয়া এগােল না।
কেন? | ডিস্ট্রিবিউটররা বললেন, আমার হিন্দি উচ্চারণে ত্রুটি আছে। সত্যি? সত্যিই কি হিন্দি উচ্চারণে ভুল আছে আমার?
চুপ করে থাকি। আমি কী করে বলব? শেষে বলি, গান শুনেছি রেকর্ডে। আমার তাে ভালাে লাগে।
হবেও বা! কে জানে? বলতে বলতে বাজারে চলে গেলেন তিনি। সিনেমা। গানের জগৎ। কিছুই জানি না। নানা কাজের ভেতর ভুলতে পারি না—ওঁর কেন কোনও রেকর্ড নেই? ক্যাসেট নেই? সবাই ভুলে গেল? গানের বাগানে ফুটে থাকা এই অক্ষয় ফুলটির কথা কেউ জানবে না ? কোথায় কোন অজানা বাড়িতে ধুলাের ভেতর কোনও একখানা ভাঙা রেকর্ডে হয়তাে উনি পড়ে আছেন।
কাগজ খুলে একদিন দেখি তিনি নেই। শেষকৃত্যও হয়ে গেছে। ওঁর এক ছেলে আমাকে একখানি শ্রাদ্ধের চিঠিও দিয়ে গেলেন। আমাকে দেখেছেন তাঁর বাবার সঙ্গে কথা বলতে। সেই সুবাদে।
তারপর আস্তে আস্তে সব চুকেবুকেও গেল। দু-একটা বছরও ঘুরে গেল। আমিও ভুলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কী খেয়াল হল। ওঁর বাড়িতে তাে ওঁর রেকর্ড থাকতে পারে।
বাড়িতে বড়াে ছেলে ছিলেন। সুদর্শন। জানতে চাইলে তিনি বললেন, না। বাবার কোনও রেকর্ড নেই। উনি নিজেই রাখতে দিতেন না শেষ কয়েক বছর।
যা ছিল বিলিয়ে দিয়েছিলেন।
কার কাছে? তা তাে বলতে পারব না। কোথাও নেই ? কারও কাছে থাকতে পারে, সে তাে আমরা জানি না। রেকর্ড কোম্পানিতে? ওদের কাছে মাস্টার টেপে ধরা আছে হয়তাে। আছে কি? ঠিক জানেন? তা বলতে পারব না। হয়তাে নষ্ট হয়ে গেছে। একবার দেখুন না— কী হবে দেখে? আমি টেপ করে নিতাম। নিয়ে কী করবেন?
শুনতাম। ওঁর গান খুব ভালাে লাগে। ওই গান শুনলে ওঁর গাওয়ার সময়টার স্বাদ পাই। সেই সময়ের গন্ধ পাই। সময়টাকে দেখতে পাই।
বড়াে ছেলে মধ্যবয়সি। সংসারধর্মের একেবারে মাঝখানে। আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন।
একদিন ওঁর বাড়ি গিয়ে কয়েকখানা ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটও দিয়ে এলাম। দেবার সময় জানতে চাই, খোঁজ নিয়েছিলেন?
এই নেব। এখনও নেওয়া হয়ে ওঠেনি। একমাস দু-মাসের ফাক দিয়ে প্রায়ই যাই। কখনও দেখা হয়। কখনও হয় । এক-একবার মনে হয় আর যাব না। কেন এই বিরক্ত করা ? কবে কোন আমলে নায়ক ছিলেন! কবে কোন যুগে গায়ক ছিলেন !! এখন মানুষটাই নেই। তাঁকে নিয়ে এই বাড়াবাড়ি করা কেন? হয়তাে ওঁদের এই গায়ে পড়া ভাব ভালাে লাগছে না। মুখে বলতে পারছেন না চক্ষুলজ্জায়।
প্রায় হাল ছেড়ে দিয়ে একদিন গেছি। ঠিকই করে ফেলেছি, এই শেষ। আর যাব না। ওঁর বড়াে ছেলে হাসতে হাসতে বললেন, আপনার ভাগ্য ভালাে। মাস্টার টেপ আছে। নষ্ট হয়নি।
আমার চোখ বােধ হয় জ্বলে উঠেছিল। আনন্দে। উৎসাহে। বললাম, তবে তাে খুব ভালাে কথা। চারটে ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেট দিয়ে গেছি। যতগুলাে গান পারেন তুলে আনবেন। একটু কষ্ট করে।
আবার সেই যাই আর আসি। বড়াে ছেলে বাড়ি নেই। কিংবা তিনিই বলেন, যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এইবার যাব। ভাবি, তীরে এসে নৌকো ডুববে? সেই খােলামেলা—তাজা বসন্তের সঙ্গে দেখা হবে না? যে বসন্তের আলাদা সুবাস। যার ক্ষয় নেই। নিজের সময়কে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অটুট। শুধু বালি খুঁড়ে ফন্তুর সঙ্গে দেখা হওয়া বাকি।
গায়ক-নায়ক তার সময়ে এই বাড়িটি করেন। দোতলা। বড়াে বড়াে ঘর । আশপাশে এখন অনেক বাড়ি উঠে গেছে। একদিন সন্ধে-সন্ধে যেতেই বড়াে ছেলে বললেন, হয়ে গেছে আপনারটা—
আমার বুক ঢিপঢিপ করতে থাকে। মনে মনে বলি, শুধু আমার কেন? আপনারও তাে।
দোতলায় মাঝের ঘরটি বড়াে। বিরাট তক্তপােশে ক্যাসেট প্লেয়ার। পাশে আমার দেওয়া ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটগুলাে।
তক্তপােশে ওঁর বড়াে ছেলে বসতে যাবেন। স্কুলের দু-তিনটি বড়াে ছেলে এগিয়ে এল। সঙ্গে সবে শাড়ি ধরা একটি মেয়ে। ভদ্রলােক বললেন, এই তােমরা কিন্তু গােলমাল করবে না। ওদিকে মা ঠাকুরঘরে এখন—
বাবা। না বাবা—
মার তাে খেয়ালই হয়নি। এই অক্ষয় যৌবনের সাক্ষী অসিতজায়ার সঙ্গে তাে কোনওদিন দেখা হয়নি। মুখে বললাম, আপনাদের মা—
হ্যা আমাদের একটি বােন ছিল। মােটর অ্যাকসিডেন্টে বিয়ে হয়েছিল?
হা। তারপর থেকেই মা-বাবা দুজনেই—
হঠাৎ ক্যাসেট বেজে উঠল। বড়াে ছেলে বললেন, শুধু একটা ক্যাসেটের মতাে গান জোগাড় করতে পেরেছি। মাত্র একখানাই মাস্টার টেপ ভালাে আছে
এখনও।
মনে মনে বলি, তাই বা কম কী ?
এগুলাে বাবা সব হিন্দি ছবিতে গেয়েছিলেন বাংলা পাইনি।
ততক্ষণে ঘর ভরে গেছে। সেই সব অক্ষয় ফুলের সুবাসে। স্কুলপড়ুয়া ছেলে দুটি কোনওদিন এসব গান শােনেনি। বােঝাই যাচ্ছে। ওরা কান খাড়া করে সবটুকু মাথায় শুষে নিতে চাইছে।
মতােয়ালে
নয়নােসে ও দিলকো
যারাসা খাে গয়ে—এ—এ
শাড়িপরা মেয়েটি মুখ তুলে তাকাল। চোখদুটো আচ্ছন্ন। হয়তাে কলেজে ঢুকেছে। কোনওদিন যে এসব গান শােনেনি বােঝাই যাচ্ছে। তার ঠোট ফেটে বেরিয়ে এল—দাদু এত ভালাে গাইতেন?
চোখ তুলে তাকাই। বলতে যাব—নিজের দাদুর গলা শােননি? কিন্তু মেয়েটির মাথার পেছনে দূরে আরেকখানি মুখ। ঘরের লাগােয়া করিডরে তিনি এইমাত্র এসে দাঁড়ালেন। চোখে চশমা। মুখে হাসি। যেন অনেকদিনের চেনা কাউকে দেখতে পেয়ে অল্প হেসে এইমাত্র তাকালেন। পরনে সাদা থান।
—