গাধা

গাধা

বিশ্বনাথের মুখটা তেতো তেতো লাগছে। ইদানীং এই এক কাণ্ড হয়েছে। মেজাজ খারাপ হলেই মুখে একটা তিতকুটে ভাব। এই মুহূর্তে অবস্থা একেবারে চরমে।

বিশ্বনাথ ডাকল, ‘মালা, অ্যাই মালা, জল এনেছিস?’

মেয়ে কোনও উত্তর দিল না। সে ট্রেনের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। তার আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে, ছুটন্ত মেদিনীপুর লোকালের বাইরের দৃশ্য পৃথিবীর সেরা কোনও দৃশ্য। এক মিনিটের জন্যও সেই দৃশ্য থেকে মুখ ফেরানো যাবে না। বিশ্বনাথের মেজাজ আরও খারাপ হল। এত বড় একটা অপরাধ করবার পরও কী নির্লিপ্ত। যেন কোনও কিছু ঘটেনি। মেয়েটার বোকামি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। মেয়ের বাবা না হয়ে এর থেকে কোনও গাধার বাবা হলে ভাল হত। বোকা মেয়ের থেকে বুদ্ধিমান গাধাকে নিয়ে চলা অনেক ভাল।।

সে চাপা গলায় বলল, ‘অ্যাই মালা, আই হতভাগা। শুনতে পাচ্ছিল না? বলছি জল এনেছিস? খাবার জল?’

মালা মুখ ঘোরাল। জলের কথা শুনে সে খুবই অবাক হয়েছে। বলল, ‘জল! কই না তো?’

‘অ্যাঁ, জল আনিসনি! এতটা পথ আসবি খাওয়ার হল তালবি না! তোর মা-টাও যেমন। সঙ্গে যে জলের বোতল দিয়ে দেবে নে বুদ্ধিটুকু পর্যন্ত হল না? মা-মেয়ে দুই গাধা নিয়ে মহা মুশকিল হল দেখছি।’

ঠিক টাইমে চললেও ট্রেনের গতি বিশ্বনাথের মনোমত হচ্ছে না। মেদিনীপুর পৌঁছোতে বারোটা না ছাড়িয়ে যায়। ছাড়িয়ে গেলে মুশকিল। খুবই মুশকিল। জামাই এবং মালার শ্বশুরমশাই দু’জনেই কাজে বেরিয়ে যাবে। তা হলে হিসেবমতো বাড়িতে থাকৰে শুই মালার শাশুড়ি। এরকম একটা সিচুয়েশনে মহিলাদের ফেস করা শক্ত।সব থেকে ভাল হত মালার মা সঙ্গে এলে।

শর্মিলা রাজি হল না। বলল, ‘আমি কিছুতেই যেতে পারব না। আমার লজ্জা করছে।’

‘কেন পারবে না। মেয়ে কাণ্ড বাধালে লা নেই, আর ও-বাড়িতে যেতে লজ্জা?’

‘তুমি যাই বলো, আমি যাব না। তুমি বরং এক কাজ করো। কাল সকালে জামাইয়ের অফিসে একটা টেলিফোন করে দাও। করে জানিয়ে দাও তুমি যাচ্ছ।’

‘জামাই কী করবে? স্টেশনে আমাদের জন্য হাতপাখা নিয়ে দাড়িয়ে থাকবে? যত্ত সব বাজে কথা। তা ছাড়া একটা দিন দেরি করবার মানে জানো? মনে হয় না জানো। জানলে এসব বলতে পারতে না। এখনও আত্মীয়স্বজনরা কেউ খবর পায়নি। যত সময় যাবে তত রটবে। চারদিকে ঢি ঢি পড়ে যাবে। কেলেঙ্কারির একশেষ হবে। তখন আর হাতে-পায়ে ধরলেও ওরা মেয়েকে ফেরত নেবে ভেবেছ? আমাদের উচিত ছিল, মেয়েকে বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়া এবং দরজা থেকেই তাকে নিয়ে মেদিনীপুরে রওনা হওয়া। কাল ফার্স্ট ট্রেনেই আমি মালাকে ফেরত দিয়ে আসব।’

শর্মিলা বলল, তুমি আমার ওপর চেঁচাচ্ছ কেন? এমন ভাব করছ যেন মেয়ে নয়, বিয়ের এক মাসের মাথায় শ্বশুরবাড়ি থেকে আমি পালিয়ে এসেছি? রাগ দেখাতে হলে মেয়েকে দেখাও। পালিয়ে তো সে এসেছে।’

‘আস্তে কথা বলো। পালিয়ে এসেছে পালিয়ে এসেছে বলে চেঁচিয়ে না। পাড়ার লোকে শুনতে পাবে। তোমার গাধা মেয়েকে আর রাগ দেখাব কী? ওকে দেখলে আমারই রাগে গা জ্বলছে। এত বড় একটা মেয়ের কোনও বোধবুদ্ধি নেই। ছি ছি। গাধাও এক পা এগোবার আগে দু’পা ভাবে। ছি ছি। হতভাগাটাকে জিজ্ঞেস করেছ কেন চলে এসেছে?’

‘হ্যাঁ, করেছি। বলছে, ভাল লাগছিল না।’

বিশ্বনাথ আকাশ থেকে পড়ল। বলল, ‘ভাল লাগছিল না! ভাল লাগছিল না আবার কী? এ কি সিনেমা না থিয়েটার যে ভাল লাগবে? তুমি শুনে কী করলে?’

‘কী আর করব? বোঝানোর চেষ্টা করছি।’

রাগে বিশ্বনাথের গলা কাঁপছে। বলল, ‘বোঝানো! এতে বোঝানোর কী আছে? গালে কষিয়ে দুটো চড় দাওনি এখনও?’

এখন মনে হচ্ছে রাতে শর্মিলার বোঝানোয় কিছুটা কাজ হয়েছে। মেয়ের মুখটা একটু হাসিহাসি লাগছে যেন। জানলা থেকে মালা মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘বাবা, একটা ভুল হয়ে গেছে।’

বিশ্বনাথ চমকে উঠল। আবার কী ভুল? এ মেয়ের তো ভুলের শেষ নেই দেখা যাচ্ছে!

মালা বলল, ‘তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে টিপের পাতাটা ফেলে এসেছি। মায়ের তাকের ওপর পড়ে আছে। ইস, কী হবে এখন?’

এরকম একটা সংকটের সময়ে টিপের পাতা। বিশ্বনাথ অতি কষ্টে রাগ সামলাল। এখন রাগ নয়। মেয়েকে কয়েকটা শক্ত কথা বলতে হবে। ছেলেমেয়ের ভালর জন্য বাবামাকে শক্ত হতে হয়।

‘মালা, আই মালা, কিছু খাবি?’

মালা মুখ ফেরাল। বিশ্বনাথ বলল, ‘খাবি কিছু? খিদে পেয়েছে?’

মালা হাসিমুখে ঘাড় নাড়ল।

বিশ্বনাথ বলল, ‘ঠিক আছে খড়গপুর আসুক। শিঙারা খেয়ে নিস দুটো।’ সে মেয়ের দিকে একটু সরে বলল, ‘মালা, ক’টা কথা বলি মন দিয়ে শোন। আগে বললে ভাল হত। মনে রাখবি ভুল সকলেই করে। তুইও করেছিস।’

মালা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ভুল বাবা? টিপের পাতার কথা বলছ?’

মেয়ের প্রশ্ন শুনে রাগে বিশ্বনাথের মাথাটা দপ করে জ্বলে উঠল। সে নিজেকে সামলে নিল। না, এখন রাগ করলে চলবে না। বলল, ‘না, টিপ নয়, অন্য ভুল! মালা, তোমাকে কয়েকটা শক্ত কথা বলব। তোমার বোঝা উচিত, আমাদের অনেক ভাগ্য ভাল যে এরকম একটা ঘরে তোমার বিয়ে হয়েছে। গরিব ঘরের মেয়েদের যে ভাল ঘরে বিয়ে হয় না তা নয়, হয়। তবে সেই মেয়েকে সুন্দরী হতে হয়। এমনি সুন্দরী নয়, বেশি রকমের সুন্দরী। তুমি তা নও। মায়ের মতো বুদ্ধি পেলেও, তুমি আমার গায়ের কালো রংটা পেয়েছ। উলটোটা হলে ভাল হত। পড়াশোনাতেও তুমি খারাপ। গানের গলা আছে কিন্তু তালিম হয়নি। এত মাইনাস সত্বেও খুব আশ্চর্যজনকভাবে। এই ফ্যামিলি থেকে তোমার সম্বন্ধ এল। আমি কোনওরকম খোঁজ না নিয়েই রাজি হয়েছি। তোমার মায়ের একটা কিন্তু কিন্তু ছিল। আমি শুনিনি। খোঁজ নিয়ে মেয়েকে টানাটানির সংসারে বিয়ে দেওয়ার থেকে, খোজ না করে পয়সাওয়ালা ঘরে বিয়ে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। আমি সেই বুদ্ধিমানের কাজ করেছি। ঠিকই করেছি।

মালা লজ্জায় মাথা নামাল। বিশ্বনাথ খুশি হল। লজ্জা পাওয়া মানে, শক্ত কথায় কাজ দিচ্ছে।

‘ওরা কি তোকে মারধর করেছে নাকি?’

মালা অবাক চোখে বাবার দিকে মুখ ফেরাল। বিশ্বনাথ হালকা গলায় বলল, ‘একটা-দুটো চড় মারলে ক্ষতি তো কিছু নেই। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িই হল মেয়ের নিজের বাড়ি।

মালা বলল, “মারবে কেন!’

‘মারেনি? বকাবকি করেছে তা হলে?’

‘না, তাও করেনি। ও-বাড়িতে কেউ চেঁচিয়ে কথাই বলে না।’

‘ও।’ বিশ্বনাথ চিন্তায় ভুরু কোঁচকাল। সত্যি চিন্তার বিষয়। মারেনি, বকেনি, ধাক্কা মেরে ছাদ থেকে ফেলে দেয়নি! একটা কিছু হলে মনে হচ্ছে, ভাল হত। মেয়ের পালিয়ে আসার কারণটা বোঝা যেত! এ তো সত্যি সত্যি গাধামির চূড়ান্ত!

মেদিনীপুর স্টেশনে ট্রেন ঠিক সময়ে ঢুকতে পারল না! আধ ঘণ্টা লেট। প্লাটফর্মে পা দিয়েই বিশ্বনাথ বুঝল, মুখটা আবার তেতো লাগছে। এত দূর এসে এখন মনে হচ্ছে, মালাকে ওরা ফিরিয়ে নেবে তো? মনে হচ্ছে, নেবে না। নেওয়ার কোনও কারণ নেই।

রিকশা একটু এগোতেই মালা বলল, ‘বাবা, বমি পাচ্ছে।’

বিশ্বনাথ ঝাঝিয়ে উঠল, ‘পাক। বমি চেপে বসে থাক।’

বিয়ের কাজকর্ম সব কলকাতাতেই হয়েছিল। মেদিনীপুরের এই বাড়িতে প্রথম এল বিশ্বনাথ। বাড়িতে ঢুকে সে একেবারে হাঁ। সত্যি বড়লোকের বাড়ি। মালার স্বামীর কাপড়ের ব্যাবসা। শ্বশুরমশাইয়ের জমির দালালি। টাউনের ওপর এত বড় দোতলা বাড়ি কি এমনি এমনি হয়েছে। মনটা ভরে গেল। বসার ঘরে বেতের চেয়ার টেবিল। টেবিলের পাশে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে বাঁকুড়ার ঘোড়া। এরকম বাড়ি ছেড়ে কেউ পালায়! ছি ছি!

খবর দেওয়ার প্রায় মিনিট কুড়ি পর শাশুড়ি একেবারে হাতে ট্রে নিয়ে ঢুকলেন। প্লেটে দুটো রসগোল্লা, দু’রকমের সন্দেশ। কাচের গ্লাসে জল। স্নানটান সেরে মহিলা বড় করে টিপ পরেছেন। চওড়া পাড়ের শাড়ি। হাসিমুখ। বিশ্বনাথ অবাক! নিজের চোখকেই তার বিশ্বাস হচ্ছে না। এইরকম সিচ্যুয়েশনে হাসিমুখে মিষ্টিটেবিলের ওপর ট্রে রেখে শাশুড়ি মহিলা হাসির ওপর আবার হাসলেন। যেন কিছুই ঘটেনি। মহিলা বললেন, ‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন ভাই? বসুন। ঠাকুরঘরে ছিলাম।’ এই আপ্যায়ন একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিল বিশ্বনাথকে। আমতা আমতা করে সে কিছু একটা বলতে যায়।

‘থাক, আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না। ছোট মেয়ে, একটা কাজ করে ফেলেছে। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর পর আমারও হত। খুব অসুবিধে হত। একবার হয়েছিল কী— সে ভারী মজার কাণ্ড, আর একদিন বলব। আপনি ভাই। কোনও চিন্তা করবেন না। এরকম একটু-আধটু হয়েই থাকে।’ মহিলা বিশ্বনাথের থেকে মুখ না সরিয়েই বললেন, ‘মালা, দরজায় হেলান দিয়ো না। রং নষ্ট হয়ে যাবে। তুমি বরং নিজের ঘরে যাও। শাড়িটাড়ি বদলে একটু বিশ্রাম নাও। পরপর দু’দিনের ট্রেন জার্নি। আমি তো বাবা এই জার্নির ভয়ে কলকাতায় যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছি। হা হা।’

বিশ্বনাথ মুগ্ধ। নিজের কানকে তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সে সত্যি শুনছে তো? বউ পালানোর ঘটনা যে এতখানি সহজ একটা ব্যাপার সে কল্পনাও করতে পারছে না। শুধু সহজ নয়, এর মধ্যে আবার মজাও আছে। মজা না থাকলে এমন শব্দ করে হাসা যায়? বড় ধরনের গুণ না থাকলে এ জিনিস হয় না।

বিশ্বনাথ রসগোল্লা শেষ করে জলের গ্লাসে চুমুক দিল। মহিলা বললেন, ‘একী, সন্দেশ পড়ে রইল যে? না ভাই, খেতেই হবে, কোনও কথা শুনব না। আমি তো কাল চিন্তায় মরছিলাম। মেয়েটা গেল কোথায়? নতুন বউ বলে কথা। রাতে খেতে বসে ছেলেকে বললাম, কলকাতায় একবার খোঁজ নে। আপনার জামাই বলল, কিচ্ছু করতে হবে না। দেখবে ঠিক ফিরে আসাব, যাবে কোথায়? আমাকে আর একটা মাছ দাও দেখি। ছেলে হল গিয়ে আমার মাছ-পাগল ছেলে। ছোটবেলায় ঠাট্টা করে ভাকতাম, মাছরাঙা। হা হা। দিনে-রাতে মাছ ছাড়া ভাত মুখে তুলবে না। এই কালই ধরুন না, ঝালের মাছ কম পড়ল, তখন দুটো ভেজে দিতে হল। সেই ভাজা পাতে রেখে তবে ছেলে ভাত খেল। খেয়েটেয়ে বলল, পান দাও। পান দিলাম। পান মুখে দিয়ে বলল, রাতদুপুরে ছোটাছুটি করার কোনও দরকার নেই। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমোতে যাও। ছেলের কথায় আমি নিশ্চিন্ত হলাম। এখন দেখছি ওমা! ঠিকই তো বলেছে। বউমা তো এসে গেছে! ভাই, এবার বুঝতে পারছেন তো জামাইটি আপনার কেমন বুদ্ধিমান? একেবারে হাতেনাতে প্রমাণ পেলেন তো? হা হা। কাল রাতে ছোটাছুটি করাটা কেমন বোকামি হত বলুন তো?’

জামাইয়ের বুদ্ধিতে বিশ্বনাথ অভিভূত। নিজেকে এখন বুদ্ধিমান জামাইয়ের শ্বশুর ভাবতেই গর্ব হচ্ছে। বেয়াইবাড়িতে সব মিষ্টি খাওয়া যায় না। এ ব্যাপারে নিয়ম হল, একটা-আধটা প্লেটে পড়ে থাকবে। বিশ্বনাথ নিয়ম মানতে পারল না। কারণ সে একটাঘোরের মধ্যে আছে। সে দুটো সন্দেশই শেষ করল। শেষ করে উঠে পড়ল। হাত জোড় করে বলল, ‘আজ তা হলে উঠি? কলকাতায় অনেকগুলো কাজ আছে।’

শাশুড়ি হাসিমুখেই বললেন, ‘সেকী! চলে যাবেন? ইস, ভাত খেয়ে যাবেন না? খুব খারাপ লাগছে। ঠিক আছে, কাজ আছে যখন তখন আর আটকাৰ না। কাজের সময় আটকেছি শুনলে উনি আবার রাগ করবেন। আর একদিন আসতে হবে। সেদিন কিন্তু না খাইয়ে ছাড়ব না। বলে রাখলাম কিন্তু, কোনও কথা শুনব না। ঠিক আছে ভাই, আর দেরি করবেন না তা হলে। একটা পাঁচ না দশে কলকাতার ট্রেন আছে না?

হাতজোড় অবস্থাতেই বিশ্বনাথ ঘর থেকে বেরিয়ে এল। আড়চোখে দেখল, গাধাটা এখনও দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে।।

মালা ফিসফিস করে ডাকল, ‘বাবা।’

শাশুড়ির সামনে মেয়ের সঙ্গে কথা বলাটা কি ঠিক হবে? মনে হয় না হবে। বিশ্বনাথ এমন ভান করল যেন মেয়ের ডাক শুনতে পায়নি।

স্টেশনে এসে বিশ্বনাথ দেখলি, কলকাতায় যাওয়ার গাড়ি একটা পঁচে নেই, একটা দশেও নেই। গাড়ি সেই দুটোয়। আরও দেরি হতে পারে।

প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা। বেঞ্চে বসেছে বিশ্বনাথ। মুখটা কেমন তেতো তেতো লাগছে না? কেন লাগছে? লাগার কথা নয়। যা ঘটেছে তাতে মেজাজ তার ভাল থাকারই কথা। বিশ্বনাথ নিজের মনেই হাসল। মেজাজটেজাজ বাজে কথা, আসলে পিত্তির গোলমাল। মেথি ভেজানো জল খেতে হবে। ট্রেন লাইনের দিকে তাকিয়ে বিশ্বনাথ অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করল। আর এমন একটা সময় মালার গলা শুনতে পেল সে।। মালা ডাকছে, ‘বাবা।’

বিশ্বনাথ চমকে পিছনে ফেরে। কোথায় মালা? স্টেশন শুনশান। একটা দেহাতি ধরনের মানুষ একটু দূরে উবু হয়ে বসে এই আলোতেও নিম ডাল দিয়ে মাজন সারছে। ভাবটা এমন যেন, ট্রেন না আসা পর্যন্ত সে দাত মেজেই যাবে। ট্রেনে উঠেও মাজবে।

ট্রেন খুব জোরে ছুটছে। এত জোরে ছোটা বিশ্বনাথের পছন্দ হচ্ছে না। যত দেরিতে কলকাতায় পৌঁছোনো যায় ততই ভাল। কারণ সে নিশিন্তু যে সে একটা বড় ধরনের বোকামি করে ফেলেছে। এই মুহূর্তে নিজেকে একটা ফুল সাইজ গাধার মতো লাগছে। এই অবস্থায় তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা যায় না। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ফিরতে হয়। বিশ্বনাথ বাইরের দিকে তাকাল। অন্ধকার হতে আর বেশি দেরি নেই। বিকেলের শেষ আলো এখন ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে দৌড়োচ্ছে। একটু পরেই এই আলো হাঁপিয়ে পড়বে এবং বিশ্রামের জন্য কোনও একটা ঝাপসা গাছের তলায় বা পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে যাবে।

এবারও মালা জানলার পাশে বসেছে এবং মুগ্ধ হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।

বিশ্বনাথ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। গাধা ফাদারের মেয়ে গাধা ছাড়া আর কী বা হবে? সে বিরক্ত গলায় ডাকল, ‘মালা, অ্যাই মালা? আই হতভাগা। জলের বোতলটা কোথায় রাখলি?’

মালা মুখ ফেরাল।

‘একী রে তুই কাঁদছিস! অ্যাঁ, তুই কাঁদছিস নাকি?’

মালা চোখের কোল থেকে জল না মুছে হাসিমুখে বলল, ‘হ্যাঁ বাবা, কাঁদছি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *