গাধা
সেদিন কে যেন আমাকে বললেন, ‘আপনি কখনও গাধাকে নিয়ে কিছু লেখেননি।’
মহামতি ক্লিন্টনের ভারত সফরকালে আগ্রার গাধারা ক্লিন্টন সাহেবের তাজমহল দর্শনের সময় স্থানীয় প্রশাসনকে খুব হয়রানি করেছিল। সেই সময় একবার গাধা নিয়ে লিখেছিলাম, কিন্তু।
ক্লিন্টন সফরের আগে অন্যান্য শহরের মতো আগ্রাতেও ভিখিরি, ভবঘুরে, অটো, ঝুপড়ি ইত্যাদি উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এই সঙ্গে শহরের সব গাধাও আগ্রার বাইরে বের করে দেওয়া হয়।
যাঁরাই আগ্রায় গেছেন, লক্ষ করেছেন আগ্রার রাস্তায় রাস্তায় গলিতে গলিতে গাধা। গাধার জন্যে ট্রাফিক আটকিয়ে যাচ্ছে, বাজারে ঢোকা যাচ্ছে না। এমনকী অফিস-কাছারির ঘরে বারান্দায় গাধা গটগট করে হাঁটছে।
ক্লিন্টন সফরের সময় সাময়িকভাবে সেই গাধাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল আগ্রা নগরী থেকে। কিন্তু প্রশাসনের শুধু হয়রানি হয়েছে, কাজের কাজ কিছু হয়নি। শহর থেকে পাঁচ ক্রোশ দূরে হটিয়ে দেওয়া হয়েছিল গাধাকুলকে। কিন্তু যেদিন ক্লিন্টন তাজদর্শনে আগ্রা এলেন, সেদিনই দেখা গেল শহরে ঢোকার বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে কিলবিল করে ফিরে আসছে বিতাড়িত গর্দভেরা। এত গাধা দেখে মাননীয় মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিচলিত বোধ করেছিলেন কিনা, তা অবশ্য বলা কঠিন।
তা, ক্লাবের নৈশ আড্ডায় বারান্দায় বসে যখন গাধা নিয়ে এই সব আলোচনা হচ্ছিল, আমাকে আচমকা একজন স্মরণ করিয়ে দিলেন যে গাধা নিয়ে আমি কখনও নাকি কিছু লিখিনি।
এ অনুযোগ অবশ্য সত্যি নয়। গাধা সম্পর্কে ইতস্তত আমি বেশ কয়েকবার লিখেছি। এমন কি ‘বভ্রূবাহন’ নামক একটি গাধার গল্পও একদা লিখেছিলাম। তবে মোট অর্থে গাধা বা গর্দভ শীর্ষক কোনও রচনা আমি এর আগে লিখিনি।
কিন্তু নৈশকালীন এ ধরনের তরল আড্ডায় এসব সাফাই মোটেই গ্রাহ্য হয় না।
তাই আমি রহস্য করে বললাম, ‘গাধা নিয়ে কিছু লেখা তো কঠিন ব্যাপার নয়। একটা আয়না সামনে নিয়ে বসলে আমি তরতর করে লিখে যেতে পারব।’
ব্যাপারটা সেদিন ওখানেই মিটে গেল, কিন্তু গাধার ভাবনা আমার মাথায় ঢুকে গেল।
গাধা বিষয়ে আমি কিছু কম জানি না। ভেবেচিন্তে চেষ্টা করলে অনায়াসে একপ্রস্থ ‘গাধাসিরিজ’ লিখে ফেলতে পারি।
প্রথমেই সেই বহুপরিচিত গোলমেলে গল্পটি দিয়ে শুরু করি।
স্বামী-স্ত্রী এবং আট-দশ বছরের একটি ছেলে, এই সুখী পরিবারটি বিহারের একটি স্বাস্থ্যকর শহরে বড়দিনের ছুটিতে বেড়াতে গেছে। দুঃখের বিষয়, এই প্রবাসেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে খিটিমিটি চলছে। আজ বিকেলে রীতিমতো দাম্পত্যকলহ হয়ে গেছে। স্ত্রী হোটেলের ঘর থেকে বেরননি। স্বামী ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন।
সামনের একটা সবুজ ঘাসের মাঠ, চারদিক গাছ দিয়ে ঘেরা। ভদ্রলোক ছেলেকে নিয়ে মাঠের পাশে দাঁড়ালেন। মা-বাবার নৈমিত্তিক কলহে উদাসীন ছেলে বকবক করে কথা বলে যাচ্ছে, প্রশ্ন করছে।
সামনের মাঠে একটা গাধা চরছে। কলকাতার ছেলে, আগে গাধা দেখেনি, সে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা এটা কী? বাবা বললেন, ‘এটা একটা গাধা।’ একটু পরে আর একটা গাধা এসে জুটল, ছেলের প্রশ্নে বাবা বললেন, ‘এটা গাধার বউ।’
একথা শুনে ছেলের সরল প্রশ্ন, ‘বাবা, গাধারা বিয়ে করে?’ বাবা বিরসবদনে বললেন, ‘হ্যাঁ’। গাধারাই শুধু বিয়ে করে।’
গাধার কথা সহজে ফুরতে চায় না। প্রথমে ভেবেছিলাম, কী লিখব। তারপর লিখতে লিখতে এখন দেখছি, অনেক কথাই লেখার আছে।
তবে গাধা নিয়ে বাড়াবাড়ি করব না। গাধা সিরিজের এটাই শেষ কিন্তু। পরে আবার কখনও না হয় লেখা যাবে।
গাধা নিয়ে আমার একটা তিক্ত বাল্যস্মৃতি আছে।
তখন আমি স্কুলের মাঝারি ক্লাসের ছাত্র, সেভেন এইট হবে। আমাদের সংস্কৃতের সেকেন্ড পণ্ডিত ছিলেন অত্যন্ত রগচটা প্রকৃতির ছেলে, রীতিমতো মারকুটে স্বভাব। একদিন ‘পঞ্চতন্ত্র’ পড়াতে পড়াতেই বোধ হয় তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘রাসভ মানে কী?’
ক্লাসে কেউই পারল না মানেটা বলতে। তখন পণ্ডিতমশাই আদেশ করলেন, ‘এই শ্রেণীকক্ষে যারা রাসভ রয়েছ, সবাই উঠে দাঁড়াও।’
কেউই উঠে দাঁড়াল না। আমার যে কী খেয়াল হল আমি প্রায় কিছু না বুঝে একাই উঠে দাঁড়ালাম। তখন কি আর জানতাম যে রাসভ মানে গাধা, তা হলে কি উঠে দাঁড়াই।
পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘তুমি দাঁড়ালে যে, তুমি কি রাসভ?’
আমি বিনীতভাবে বললাম, ‘আপনি দাঁড়িয়ে আছেন তাই দাঁড়ালাম।’
পণ্ডিতমশাই রেগে গেলেন, ‘তা হলে এই শ্রেণীকক্ষে তুমি আর আমি দু’জনে রাসভ! আমাদের চার চরণ কোথায়?’
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘স্যার, আমার দুই চরণ আর আপনার দুই চরণ, এই নিয়ে চার চরণ।’ এবার পণ্ডিতমশাই খেপে গেলেন, তালপাতার হাতপাখার ডাঁট দিয়ে আমাকে মারতে লাগলেন। অর্ধেক গর্দভত্বের রাগে তিনি দিশেহারা হয়ে পেটালেন।
গাধামির জন্যে জীবনে বহুবার বহুরকম মার খেয়েছি কিন্তু অমন পিটুনি আর খাইনি।
অবশেষে একটি সুপ্রাচীন আশাব্যঞ্জক কাহিনী দিয়ে গাধা বৃত্তান্তের ইতি টানছি। এক ধোপা তার গাধাকে কারণে অকারণে প্রচণ্ড পেটাত। গাধার বন্ধু ছিল প্রতিবেশীদের এক বলদ। সেই বলদ একদিন গাধাকে বলল, ‘তুমি কী জন্যে পড়ে পড়ে মার খাও, পালিয়ে গেলেই পার।’
গাধা বলল, ‘পালাতে চাইলেই তো পালাতে পারি, কিন্তু একটা আশায় বুক বেঁধে এখানে আছি।’ গাধার সেই আশাব্যঞ্জক ব্যাপারটা এই রকম। ধোপর একটা সুন্দরী মেয়ে আছে। ধোপা তাকে পাঠশালায় ভর্তি করেছে। কিন্ত সেই মেয়ের লেখাপড়ায় মোটেই মন নেই, সে সারাদিন খেলে বেড়ায়। গাধার মতোই মেয়েকেও পেটায়, আর বলে, ‘লেখাপড়া না করলে তোকে ওই গাধার সঙ্গে বিয়ে দেব।’ ব্যাপারটা বিবৃত করে, গলা নামিয়ে গাধা বন্ধু বলদকে বলল, ‘মেয়েটার একদম লেখাপড়ায় মন নেই। আমার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল বলে।’
গাধারা ছিল, আছে, এবং থাকবে।