৭
আড়িমাপ্পন ছবিটা যে হলে চলছে তার ঠিক উল্টো দিকের একটা মাঝারি মানের হোটেল হলো কাবেরী। সাত্যকি সেখানেই উঠেছে। বেলা তখন পৌনে চারটের কাছাকাছি। প্রথমেই সে স্নান করে নিল। আসলে সারা দিনের বাস জার্নি, আহিরার সঙ্গে পুজো দিতে আসা, মুনিয়াপ্পা নাইডুর বাড়ি যাওয়া, একটা উঠতি মাস্তান ঠ্যাঙ্গানো এবং সারাক্ষণ ধুলোবালি গায়ে মাখতে মাখতে পথ চলার ক্লান্তিতে জলের সংস্পর্শটা একান্তই জরুরি। সুখের কথা জলটা বেশ ঠান্ডা। সাত্যকি তাই অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে তাজা ও ঝরঝরে হয়ে নিল। খাওয়ার প্রশ্ন নেই। কেন না রামেশ্বরমে পুজো দেওয়ার পরে সে এবং আহিরা একটা ‘ভোজনালয়ে’ ঢুকে ভাত, ডাল, ভাজা, সবজি আর টক দই দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছিল।
একটা সিগারেট ধরিয়ে সাত্যকি টানটান হয়ে বিছানার ওপর নিজেকে ছেড়ে দিল। এখন যদি আহিরা কাছে থাকতো নিশ্চয়ই ঘুম আসতো না। বরং গল্প করার শুরুতেই সময়টা যেতো ফুরিয়ে। এবং আরও সময়ের জন্য ঈশ্বরের কাছে এক নীরব প্রার্থনাও জানাতে হতো। কিন্তু যেহেতু আহিরা তার ধারেকাছেও নেই অতএব প্রচন্ডভাবে ঘুম নেমে আসতে বাধ্য। কোনোরকমে সিগারেটটা খেতে খেতে সাত্যকি এক সময় সেটা নিভিয়ে ফেলে দেয়। এইবারে একটা টানা ঘুম দেওয়া যেতে পারে।
সাত্যকির ঘুম ভাঙলো আটটারও অনেক পরে। অর্থাৎ উত্তীর্ণ সন্ধ্যেয় ঘরে বসে নতুন করে আর কিছু চিন্তা-ভাবনার নেই। চা-জলখাবার ইত্যাদি খেয়েই সে বেরিয়ে পড়লো শহরের রাজপথে। সিগারেট কেনা এবং পথ চলার ফাঁকে কোথাও দাঁড়িয়ে বা বসে চা খাওয়ার অবসরে বড়ো রেস্টুরেন্ট থেকে ছোটখাটো দোকানেও সাত্যকি একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে, সেটা হলো ঢালাও ভাবে মদ, চোলাই বিক্রির রমরমা ব্যাপারটা। এমনকী রাস্তার দু’ধারেরও একেবারে গরীব শ্রেণীর মেয়ে, বাচ্চারা আকণ্ঠ পানু করে দুনিয়ার সব অভাবকে পকেটে পুরে নিয়ে রাজ্য জয়ের আনন্দে টাল- মাটাল পায়ে এগিয়ে চলেছে।
ইতিমধ্যে সাত্যকি এখানকার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে কলকাতায় ফোন করে বাবার সঙ্গে একবার কথা বলে নিয়েছে। কথা বলেছে মায়ের সঙ্গেও। বিজয়া তো ফোনের মধ্যেই ছেলের স্পর্শ নিতে চাইলেন। বললেন, তোর বাবা বাড়িতে গুম হয়ে বসে আছেন আর তুই অন্ধ্রে গিয়ে উধাও হয়ে পড়লি। আমি একা এখন এ সব সামলাতে পারি বল? এই অবস্থায় আমাকে কে সান্ত্বনা দেবে?
মায়ের জন্য মনটা খুবই খারাপ লাগছে সাত্যকির। কিন্তু এই অবস্থায় তারও তো কিছু করার নেই। বরং হতাশার মেঘ কাটিয়ে ঠান্ডা মাথায় সময়ের অপেক্ষায় থেকে সমাধানের সূত্র খোঁজাটাই তো তদের মুক্তির পথ। ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লে চলবে না। মা’কে সেই কথাটাই সাত্যকি বোঝালো, তুমিও যদি ভেঙে পড়ো আমি তা হলে এতো দুরে কীসের আশায় ছুটে এলাম?
কৃষ্ণা সিনেমা হলটার সামনে তখন জনসমুদ্র। ‘হাউসফুল’ বোর্ড ঝুলছে। টিকিটের আশায় দর্শকদের ছোটাছুটি, লাফালাফি। ব্ল্যাকারদের নিচু গলায় ফিসফিসানির কোনো গুঞ্জন নেই। বরং তাদেরই দাপুটে গলার হইচইয়ে পুরো চত্বর গমগম করছে পঞ্চাশটাকা, পঞ্চাশ টাকা। লোকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনেক বেশি দাম দিয়ে সেই টিকিট কিনে নিচ্ছে। এই আড়িমাপ্পন কী এমন বই রে বাবা যে লোকে হাতাহাতি, গুঁতোগুঁতি করেও….সাত্যকি বেশ মজা পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। বছর বত্রিশের একটা ছেলে দু’খানা টিকিট জোগাড় করতে পেরে বউয়ের সামনে এসে সে কী হাসি! যেন তার সমস্ত মান-সম্মান ক্ষমতা যোগ্যতা সবই প্রায় চলে যেতে বসেছিল। যায়নি, তাই ওই বিজয়ীর হাসি। কৃষ্ণা হলের চত্বরে ভিড়ের হালচাল ক্রমশ বাড়ছে দেখে মনে হলো, ছবিটা মারকাটারি কিছু একটা হবে। তা সে সব যাইহোক, সে আর এখানে দাঁড়ালো না। হোটেল কাবেরীর দিকে পা বাড়ালো। আসলে সাত্যকির কেমন যেন একটু শীত-শীত করছে। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। বিকেল পৌনে চারটেয় কুড়ি মিনিট ধরে ঠান্ডা জলে স্নানের ফল এটা? হতে পারে। সাত্যকি ঠিক করলো, রাতে আর ভাত খাবে না। রুটি খাওয়ারও কি দরকার আছে? গায়ে কিন্তু তাপ ছড়াচ্ছে। শুরু হয়ে গেছে কপালের টিপটিপে ব্যথাও। হোটেলের ঘরে ঢুকে কতোক্ষণে শুয়ে পড়বে সাত্যকির এখন সেই চিন্তা।
.
রাত এখন সাড়ে এগারোটা হবে। মা, মেয়ে পাশাপাশি শুয়ে। সুমিঠ্ঠাগুরম গ্রাম নিস্তব্ধতার চাদর টেনে নিলেও ঘুমোননি মন্দাকিনী, আহিরাও সারা ঘর অন্ধকার থাকলেও বারবার এপাশ-ওপাশ করা ও নড়াচড়ার মধ্যে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে দু’জনের কারও চোখেই ঘুম নামেনি। মন্দাকিনী নিচু গলায় জানতে চাইলেন, কী রে ঘুমাচ্ছিস না কেন?
তুমি ঘুমাচ্ছো না কেন? আহিরা কোমল সুরে মা’কে পাল্টা প্রশ্ন করলো।
ঘুম আসছে না রে…
বাবার কথা ভাবছো?
হুম।
চিন্তা করে কিছু করতে পারবে? আহিরা সাফ সাফ বললো, বুকের ওপর চিন্তার কোনো পাথর রাখবে না। সমস্যা যা আসবে দেখা যাবে। কালকে তো বাবা চলেই আসছেন—তুমি এ বারে ঘুমিয়ে পড়ো মা।
আচ্ছা আহিরা—
বলো মা—
এই সাত্যকি ছেলেটা কেমন রে? তোর কী মনে হয়? আমরা কোনো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে পারি মানে ও কী আমাদের কোনো স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করতে পারে?
তোমার কী মনে হয়?
.
আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না রে। তবে মনে হয়….মন্দাকিনী মেয়ের গায়ে একটা হাত রেখে স্নেহের সুরে বললেন, ছেলেটা ভালো। আসলে কী জানিস, মনই চাইছে না সাত্যকিকে খারাপ ভাবতে।
এখনও পর্যন্ত ও কিন্তু একটাও খারাপ কাজ করেনি মা। আহিরা কোনোরকম দুর্বলতার বাধনে না জড়িয়ে পরিষ্কার বললো, সম্ভবত ওর সেই ক্ষমতাও নেই। বরং এমন কিছু বোধ বিবেচনার পরিচয় রেখেছে যে কলকাতা থেকে আসা সাত্যকি মৈত্র নামের ছেলেটার মধ্যে সেই বিবেকের কিরণ যথেষ্ট পরিমাণে মজুত রয়েছে বলেই মনে হয়। তা ছাড়া ও এখানে কী করবে? সাত্যকি এসেছে ওর বাবা একটা চিরকুট নিয়ে। ওর আর ভুমিকা কোথায়?
ওর মজুতের কথা কী বলছিলি যেন! মন্দাকিনী আগের কথায় ফিরে গেলেন। বলছিলাম, ওর বোধ-বিবেচনার কথা। আমরা দু’জনে এক সঙ্গে এখান থেকে রামেশ্বরম গেলেও আমাকে ছেড়ে দিয়ে সাত্যকি কিন্তু হোটেলে বিশ্রাম নেওয়ার বিলাসিতা দেখায়নি। আরও সৌজন্য দেখিয়ে ও আবার আমাকে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল এই সুমিঠ্ঠাগুরমে। এটা একটা মানুষের ভেতরের দায়িত্ব ও মমত্বকেই বোঝায়।
তুই কিন্তু ব্যাপারটা বুঝছিস না। মন্দাকিনী অন্ধকারেই মেয়ের দিকে তাকালেন।
কী বুঝতে পারিনি বলো?
একটা সুন্দরী মেয়েকে, ঝকঝকে একটা মেয়েকে….মানে যে কোনো ছেলেই এটুকু করবে। এতে তার বিশেষত্ব খোঁজার কিছু নেই। বলতে পারিস এটা বয়সের ধর্ম।
ঠিক আছে মা, তোমার এই কথাটা মেনে নিলাম। আহিরা এ বারে আরও স্পষ্ট করে বললো, তোমার ভদ্রতা-আন্তরিকতায় তুমি তো সাত্যকিকে আমাদের এই বাড়িতে থাকার জন্য কম অনুরোধ করোনি! সে সব কী তোমার ভন্ডামি ছিল?
তা থাকবে কেন? আমি সত্যিই চেয়েছিলাম ছেলেটা যেন…..
তা সত্ত্বেও সাত্যকি আমাদের বাড়িতে রাত কাটায়নি। তোমার কথাতেই বলি, বয়সের ধর্ম নিয়ে সে তো একজন সুন্দরী মেয়ের কাছাকাছি আরও অনেকটা সময় বেশি করেই থাকতে পারতো। তোমার দেওয়া সেই অযাচিত সুযোগ পেয়েও ছেলেটা কিন্তু তা গ্রহণ করেনি। আমি নিশ্চিত অন্য যে কোনো লোক হলে এই সুবিধেটুকু ছাড়তো না। বাস ভাড়া, এগারো-বারো ঘন্টার জার্নি, হোটেলের বিল বাঁচানো ছাড়াও মোহিনী মায়ার আকর্ষণে সে পড়ে থাকতো আমাদের এই বাড়ির যে কোনো প্রান্তে। অন্যদের থেকে সাত্যকি এখানেই তার তফাত গড়ে নিয়েছে। ওর সম্ভ্রমবোধ, বিবেচনা সত্যিই আলাদা মা।
একটু চুপচাপ থেকে কী যেন ভাবতে ভাবতে মন্দাকিনী এ বারে মৃদু একটু হাসলেন। ফিরলেন মেয়ের দিকে। আহিরার কাঁধে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হঠাৎ এক সময় জিজ্ঞেস করলেন, তোকে এই চুড়ি কে দিয়েছে?
সাত্যকি। আহিরার খোলামেলা উত্তর। দু’ডজন পরতে বলেছিল। অতো পরে কী করবো? দু’দিনেই তো ভেঙে সব খান খান হয়ে যাবে। তবে অন্তত একটাকেও যদি বাঁচিয়ে রাখতে পারি সেই অনুরোধটা করেছে।
তুই এক কাজ কর—আগে থেকেই একটা চুড়ি খুলে বাক্সে তুলে রেখে দে। মন্দাকিনী গভীর গলায় বলে উঠলেন, ছেলেটা ওর কোন আকাঙ্ক্ষা থেকে বলেছে তা তো বলতে পারবো না, তবে এই মর্যাদাটুকু তার প্রাপ্য।
তুমিও যেমন মা, এই কথাটা স্রেফ একটা কথারই কথা। কিছু দেওয়ার পরে বলতে হয় বলা। আহিরা সরাসরি বললো, এর মধ্যে তুমি আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ইত্যাদির বিন্দুবিসর্গও খুঁজতে যেয়ো না। নাও এ বারে ঘুমিয়ে পড়ো তো!
ওরে ঘুম এলে কি আমি তোর সঙ্গে এমন করে বকবক করতাম? আমি শুধু ভাবছি মানুষটা ফিরে আসার পর কী অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি হয় তা নিয়ে। যে মানুষটা কলকাতার কথা এমন সচেতনভাবে লুকিয়ে রাখতে পারে, ওই শহরের নাম শোনার পর খ্যাপা উন্মাদ না হয়ে পড়েন। বুঝতে পারছি সাত্যকি ছেলেটা খুবই বিড়ম্বনায় পড়বে। কিন্তু আমাদের কী করনীয় আছে বল তো আহিরা? না পারবো ওঁকে থামাতে না পারবো ছেলেটাকে রক্ষা করতে! এই মাঝখানে থাকার যন্ত্রণাই সব থেকে বেশি। আমারই হবে সমস্যা।
তুমি কিন্তু মা আবার ভাবতে শুরু করে দিলে। আহিরা মন্দাকিনীকে একটু ধমকে উঠলো, সমস্যা সমস্যা করে চিৎকার জুড়লে হবে? পালিয়ে না গিয়ে সমাধানের জন্য সাহস থাকাও জরুরি। আর কথা নয় একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করো এ বারে।
.
রাত এখন কতো কে জানে। গ্রামের কুকুরগুলোর একটারও কোনো ডাকাডাকি নেই। বস্তুত ওদের সাড়া পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের উঠোনে যে দুটো প্ৰায় নিজেদের অধিকারেই থাকে তারাও চুপচাপ। ঝিঁঝিঁ পোকাদের একটা ঝিল্লিরব গানের সুরের মতো মিহিভাবে ভেসে আসছে বটে তবে তাতে নিশুতি রাতের নির্জনতার আবরু বিন্দুমাত্র নষ্ট হচ্ছে না। দু’একবার পেঁচার ডাকও শোনা গেল। এবং কী আশ্চর্য, তাতে যেন রাতের নিরিবিলি মুহূর্তটা আরও বেশি মায়াবী হয়ে উঠলো।
মন্দাকিনী অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুম নামেনি আহিরার চোখের পাতায়। অন্ধকার ঘরে মায়ের পাশে সে শুয়ে রয়েছে পরিষ্কার চোখ মেলেই। সে সাত্যকির কথা ভাবছে। ছেলেটার মধ্যে যে ছেলেমানুষি মিশে রয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। চোখ খোলা রেখে হরিহরণ চাচাজির রোগটা ঠিক ধরতে পেরেছে। এবং তাতেই সন্তুষ্ট না হয়ে ওঁর পেছনেও দিব্যি লেগে পড়েছে। দূর দেশ থেকে একটা ছেলে এসে এই ভাবে নিজেকে মজার স্রোতে ভাসাবে? আসলে যার ভেতরে মজা নেওয়ার উপাদান রয়েছে সে মজবেই। তারচেয়েও বড়ো কথাটা হলো ছেলেটা ভঙ্গুর মানসিকতার নয়। রামেশ্বরম যাওয়ার পথে সে দু’দুবার যে ভাবে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে এ গুলো কি সবই ফেনা ওঠা বুদবুদ? আহিরার জোয়ারের ঢল? হতে পারে না। আহিরা তেমনটা বিশ্বাস করে না। ভেতরের নিজস্বতাই সাত্যকিকে পৌঁছে দিয়েছে সম্পূর্ণ এক অন্য মাত্রায় যেখানে সততা ও সত্যের তেজ ছাড়া আর কিছুই ঘাপটি মেরে থাকতে পারে না। অতএব সাত্যকির ওসব লোক দেখানো নয়, ও লড়াই করে অস্থিরতার বিরুদ্ধে, সুন্দরের সন্ধানে।
আহিরা নতুন করে আবারও ভাবতে বসলো, ছেলেটা পারেও বটে। তামাকপাতা বোঝাই গরুর গাড়ির সেই গোঁফওয়ালা চালকের ব্যাপারটা তার মনে পড়লো। ওই লোকটাকে উপকার করেও “সব জিনিস ডাকঘরে পাওয়া যায় না। মানুষের জিম্মাতেও কিছু থাকে” বলে সাত্যকি যে মন্তব্যটা করেছিল আহিরা তো তার মাথামুন্ডু কোনো অর্থই বুঝে উঠতে পারছিল না। এতো খাপছাড়া এতো অসংলগ্ন বলে তখন মনে হয়েছিল যে সাত্যকিকেই ভুল বুঝতে শুরু করেছিল। ফলে ব্যাপারটা তার মনের কোণে চাপা ছিল। এ বারে হলো কী, ভেঙ্কটেশ্বরের মন্দিরে পুজো দিয়ে চুড়িটুড়ি কেনার পর ভোজনালয়ে দুপুরের ভাত খেতে বসেই ঘটনাটা মাথাচাড়া দিল। আহিরাও আর দেরি না করে একটু জেরার ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, আপনি সুমিঠ্ঠাগুরমের ওই গোঁফওয়ালাকে অহেতুক ডাকঘর দেখাতে গেলেন কেন? লোকটা যেখানে আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য এগিয়ে এসেছে সেখানে কি না আপনি প্রচ্ছন্নভাবে ওকেই শাসালেন। এটার কি কোনো প্রয়োজন ছিল? আমি তো আপনার কথারই মানে খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
পাবেনও না। সাত্যকির নিস্পৃহ উত্তর।
তার মানে? আহিরার ভ্রু কুঁচকে গেল। চিবোনো বন্ধ করে মুখের ভাত মুখেই রেখে সে সাত্যকিকে এক দৃষ্টিতে মেপে চললো।
ব্যাপারটা খুবই সহজ। মুশকিল হলো আপনি তো ওর আগের ঘটনাটাই জানেন না। সাত্যকি কৌতুকের সুরে প্রথম দিনের পুরো ছবিটা তুলে ধরে বললো, ওই গোঁফু কিছুতেই আপনাদের ঠিকানা না বলে আমাকে মেজাজে ডাকঘরে যাবার পরামর্শ দিয়েছিল। তা ডাকঘরে কী কী পাওয়া যায় এবং যায় না সেটা জানতে হলে তো ওকেও একবার ওই ডাকঘরেই…..
হা-উ-ফ………..আহিরার ভেতরে হাসির যে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হচ্ছিলো তা যেন এক দমকা বাতাসে বেরিয়ে আসার উপক্রম হতেই সে নিজেকে প্রাণপণে ধরে রাখার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি সামালাতে পারলো না। ওর মুখের ভেতরে ভাত তো ছিলই—তারই কয়েকটা গিয়ে পড়লো সাত্যকির বুকে এবং অবশ্যই পাতে। আহিরা তখন লজ্জার শেষ ঘাটে দাঁড়িয়ে রীতিমতো মুখ লুকাতে ব্যস্ত। বার দুয়েক ‘দুঃখিত’ বললেও কি তাতে অবস্থার সামাল দেওয়া যায়? বরং ওটা আরও বেশি ঠাট্টার মতো লাগে। আহিরা আড়চোখে একবার সাত্যকিকে দেখে নিয়ে ভাতের থালার ওপর নিজের মাথাটাকে যেন একেবারে মিশিয়ে দিল। অথচ থালাটা পাল্টে দেবার জন্য ওর বলার ইচ্ছে ছিল। কাজের ছেলেটাকে ডেকে টেবিলটা পরিষ্কার করার কথাও মনে ছিল। সাত্যকির শার্টটা ঝেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। এবং কী আশ্চর্য, এতো সব কিছু মনে থাকা সত্ত্বেও আহিরা একটা কথা পর্যন্ত বলতে পারলো না সঘন লজ্জার কুয়াশায় ঢাকা পড়ে।
লজ্জায় ডুবন্ত মেয়েটাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলো সাত্যকিই। কোনোরকম হইচই নয়, নয় উদারতার ভাষণ। অথবা ‘আমাকে দেখো’ গোছের কোনো কথাবার্তা। সাত্যকি লাজুকলতাকে দেখতে দেখতে নিজেই লজ্জা পেল। আর সেই লজ্জা কাটাতে খুবই স্বাভাবিক গলায় বলে উঠলো, নিন খাওয়া শুরু করুন।
আপনার থালায়…
আমার থালায় কিচ্ছু হয়নি। আপনি খেতে থাকুন।
প্লিজ খাবেন না—আমার মুখের ভাত আপনার …..
আমার কোনো অসুবিধে হবে না। সাত্যকি সত্যিই খেতে শুরু করে দিল। বিস্ময়ে ওর খাওয়া দেখতে দেখতে আহিরা নিজেকে আরও বেশি দোষী ভেবে ক্রমশ যেন তলিয়ে যাচ্ছে। এবং ওরই মধ্যে খড়কুটো ধরে বাঁচার মতো প্রচ্ছন্ন এক গর্বও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। ওই গর্ব কীসের উৎস তা আহিরা বলতে পারবে না। তবে স্পষ্ট অনুভব করলো ধীরে ধীরে তার লজ্জার পালক খসে পড়ছে। তার ভেতরে প্রাণ ফিরে আসছে। সাহসের পাখনায় ভর দিয়ে আহিরা এ বারে খোলামেলা জিজ্ঞেস করলো, আপনার ঘেন্না লাগছে না?
না তো! খেতে খেতে সাত্যকি উত্তর দিল, ঘেন্না লাগবে কেন?
সত্যি বলছেন?
মিথ্যে বলবো কেন? আপনি যেটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন আমি সেটা মাথাতেই রাখছি না। আর সত্যি কথাটা হলো, কারও কারও ব্যবহারেই যেমন ঘেন্না হয় তেমনি আবার কারও কারও মুখেরটা খেতেও কোনো বিকার হয় না।
এরপরে আমার কিছু বলার নেই।
বললে? সাত্যকি কৌতুকের ঝিলিক তুলে প্রশ্ন করলো।
আবার হয়তো মুখের ভাত পড়ে যাবে!
দারুণ! দারুণ বলেছেন। সাত্যকি উত্তাল হেসে বলে উঠলো, আর আমরা পাবো নতুন এক ভাত-পড়া দেবী—দেবী ভাতেশ্বরী।
দয়া করে আর হাসাবেন না আমাকে— যথেষ্ট অপ্রস্তুত হয়েছি আজ। কী কুক্ষণেই না ডাকঘরের …….. আহিরা আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়াটা শেষ করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আজকের লজ্জার কথা তার আজীবন মনে থাকবে। মনে থাকবে সাত্যকিকেও।
.
এই মধ্যরাতেও আহিরা তাই সাত্যকিকেই ভেবে চলেছে। সুমিঠ্ঠাগুরম থেকে রামেশ্বরম যাওয়া পর্যন্ত ওর ছোট্ট ছোট্ট অনুভূতির খন্ড খন্ড ছবিগুলো এক এক করে সাজালে নিটোল, পরিপূর্ণ এমন একটা ছেলেকেই পাওয়া যায় যার সান্নিধ্যে কখনওই উষ্ণতার অভাব হবে না। এখন প্রশ্নটা যেটা দাঁড়াচ্ছে, ও যে কোন প্রলয় ঝঞ্ঝা নিয়ে বাবার খোঁজে এসেছে আহিরা তো তার আঁচই করতে পারছে না। না-জানা সেই অধ্যায়কে বালিশের তলায় রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমানো যায়? এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি রাগ হচ্ছে বাবার ওপর। আজ আসছি, কাল আসছি করে উনি যে কবে আসবেন ঠিক বলা যাচ্ছে না। যদিও জানা গেছে আগামীকাল ফিরবেন। এখন দেখা যাক।
মন্দাকিনীর কোনো সাড়াশব্দ নেই। অর্থাৎ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আহিরা খুব আলতোভাবে মায়ের গায়ে একটা হাত রাখলো। ছোটবেলায় যার গলা জড়িয়ে ধরে না শুলে তার ঘুমই হতো না। সেই মা এখন পরিত্রানে ঘুমাচ্ছেন। অবশ্য যতোক্ষণ ঘুমিয়ে থাকেন ততোক্ষণই ভালো। নয়তো জেগে উঠেই তো আবার সেই কলকাতা, সাত্যকি, ওর বাবার নির্দেশ ইত্যাদি প্রভৃতি নিয়ে হোঁচট খেতে থাকবেন। নিঝুম রাতের এই শীতলতার মধ্যে আহিরা মায়ের জন্যই মন খারাপ করে চলেছে। হুট করে এই দুঃখটা কেন বুকের মধ্যে বারবার মোচড় দিয়ে উঠছে আহিরা কিছুতেই সেই হিসেব মেলাতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারছে, পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, মায়ের পাশে তাকে থাকতেই হবে।
মন্দাকিনী জিজ্ঞেস করেছিলেন, সাত্যকি ছেলেটা কেমন। মায়ের সঙ্গে ও নিয়ে আলোচনা হলেও এই মুহূর্তে আহিরার মনে হচ্ছে ওর সম্পর্কে যতো ভালোই বলা হোক না কেন, সাত্যকি সম্ভবত তার চেয়েও বেশি। অন্য সব কিছুকে দু’হাতে দূরে সরিয়ে রেখেও আহিরার এখনও বিস্ময় কাটতে চায় না, তার মুখের ছিটকে পড়া ভাত সমেত ছেলেটা অবলীলায় খেয়ে উঠলো কী করে? ব্যাপারটা যদি এ ভাবেও ধরা হয় যে সাত্যকি ওটা করেছে স্রেফ বাহাদুরি দেখানোর জন্য, বড়ো মানুষের কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য; তারপরের প্রশ্নটাই তা হলে অনায়াসেই উঠবে, আহিরা নিজে কী তেমনটা করতে পারতো? এখানেই আনেক্কাপল্লী গার্লস কলেজের ভূগোলের অধ্যাপিকাটি বারবার হোঁচট খেয়ে চলেছে।