৬
ভেঙ্কটেশ্বরের মন্দিরের কাছাকাছি এসে অটো থামতে মিটারটা একঝলক দেখে নিয়ে আহিরা ব্যাগ খুলতেই সাত্যকি নিচু গলায় অথচ স্পষ্ট এক জোরালো আবেদনের ভঙ্গিতে শুধু ছোট্ট একটা শব্দ উচ্চারণ করলো, প্লিজ! বাধ্য নিতান্ত বাধ্য মেয়ের মতো কথাটা শুনলো আহিরা। আসলে অটোওয়ালার সামনে সে পয়সা দেওয়া নিয়ে সামান্য একটু তর্ক করতেও রাজি নয়। ছোকরা অটোওয়ালরা এ সবে দারুণ মজা পেয়ে নিজে নিজেই হাসে।
দুনিয়ার সব মন্দির এলাকাই বোধহয় একই রকম। সাত্যকি অবশ্য খুব বেশি মন্দির দেখার সুযোগ পায়নি। কালীঘাট এবং দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে ঢুকবার আগে যে রকম ঘিঞ্জি ছোট ছোট দোকান, বিক্রির সামগ্রী যা-যা, এখানেও প্রায় সে সবই উপস্থিত। সেই বিভিন্ন রংয়ের কাচের চুড়ি, বালা, কানের দুল, হার, দেব-দেবীর বাঁধানো ফটো, পূজার উপাচার, ফুল-মালার পাহাড়, রান্নাঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের হাজারো মেলা। সংসারের টুকিটাকি কাজের মনলোভা পসরা।
আহিরা পুজো দেবে বলে ডালি সাজাতে ব্যস্ত। সাত্যকি পাশে পাশে থেকে চুপচাপ শুধু দেখে যেতে লাগলো। তার ভূমিকা এখন নিতান্তই এক মূক যুবকের। আহিরা পুজো দেবার জন্য দুটো নারকেল কিনেছে। কিনেছে ধুপকাঠির প্যাকেট, কপালে টিপ পরার জন্য বিভূতি জাতীয় কিছু গুঁড়োর একটা আধার, ফুল, বড়ো একটা মালা, প্যাড়া ধরনের মিষ্টি। এই পর্যন্ত ব্যাপারটা ঠিকই আছে। কিন্তু পাতিলেবু আর কাঁচালঙ্কা কিনে ডালির সঙ্গে সাজিয়ে দেওয়াতে সাত্যকি বেশ অবাকই হলো। তবে কোনো রকম প্রশ্ন তুলে কাউকে আঘাত করতে চাইলো না। নয়তো পাতিলেবু এবং কাঁচা লঙ্কা যে পুজোর কোন কাজে লাগে সেটা তার মাথায় ঢুকলো না। তবে ভারতবর্ষের মতো এতো বড়ো একটা দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন রকমের রীতিনীতি তো থাকেই পারে। কলকাতার কিছু দোকানে এবং বাসের সামনেও তো আজকাল দেখা যাচ্ছে।
পুজোটুজো দিয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে হাঁফ ছাড়লো সাত্যকি। ভেঙ্কটেশ্বরের মন্দিরের এই ভিড় তার কল্পনায়ও ছিল না। সাত্যকির স্পষ্টই মনে হলো, পুজোর নামে এই ভিড় সত্যিই বাড়াবাড়ি। এর মধ্যে কতো জন নিয়ম নিষ্ঠা মেনে আর কতো জন হুজুগে মেতে তা সে বলতে পারবে না। তবে কাউকেই আঘাত করা তো তার উদ্দেশ্য নয়। অতএব ও নিয়ে একটা কথাও সে বলবে না।
আহিরা রাস্তার এক পাশে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। সাত্যকির চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, পুজোর মাঙ্গলিক টিপ পরতে কি আপত্তি আছে?
সচেতনভাবে এটা জিজ্ঞাসা করার অর্থ আপনি পরিণতির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন, আমি টিপ পরার লোক নই। সাত্যকি দারুণভাবে হেসে বলে উঠলো, নয়তো এই সংশয় কেন? তেমন কথা কি আমি বলেছি?
সোজাসুজি ‘না’ অবশ্য বলেননি—তবে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ইচ্ছে-অনিচ্ছে ইত্যাদি বিষয়ে….
আলাপ-আলোচনা তো অনেক বিষয় নিয়েই করতে পারি। সাত্যকি হালকা হেসে উত্তর দিল, সেটা তো আরও গভীরভাবে জানার আকাঙ্ক্ষায়ও হতে পারে। আগে থেকেই আমাকে চিহ্নিত করে রেখেছেন?
মানুষ চিহ্নিত হয় তার কাজে, তার কথায়। ম্রিয়মান এক চিলতে হাসি আহিরার দুই ঠোঁটে লেগে রয়েছে। সে খুব শান্ত গলায় বললো, অপরের ভুল ধারণা ভেঙে দিতে আরও সাহসী কাজের দরকার। আপনি কি সেই সাহসটুকু দেখাবেন?
অন্তত আপনার কাছে তো দেখানো যাক। সাত্যকি মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে দিল।
ডালি থেকে সাদা ছাইয়ের মতো বিভূতি তুলে নিয়ে আহিরা সাত্যকির কপালের ঠিক মাঝখানে পরিয়ে দিল। পুজোর প্রসাদ অর্থাৎ প্যাড়া জাতীয় সন্দেশ, নারকেলের টুকরো ওর হাতে তুলে দিয়ে নিস্তেজ সুরে বললো, চলুন চত্বর ছেড়ে এ বারে এগোনো যাক।
আঙুর ফলের থোকার মতো দু’ধারের দোকানগুলোতে রঙিন রঙিন কাচের চুড়ি যেন দোল খাচ্ছে। গাঢ় সবুজ রংয়ের চুড়িগুলোর রিনরিনে আওয়াজ সাত্যকির কানে গানের সুরের মতোই বেজে চলেছে। সে অতো শতো ভাবনা-চিন্তার জন্য বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় করলো না। ছেলেমানুষের মতো একরাশ উচ্ছ্বাস দেখিয়ে বলে উঠলো, কাচের চুড়ি পরবেন? সবুজ রংয়ের!
একটা পরিমন্ডল যে মানুষকে অনেকখানি পাল্টে দিতে পারে, সাত্যকির আবেগ দেখে আহিরা সেটাই অনুভব করলো। এই রকম নির্মল পরিস্থিতিতে কাউকে দমিয়ে দেওয়া উচিত নয়। তা ছাড়া ছেলেটার আবদারে তো অশোভন কোনো আচরণ নেই। নেই শালীনতা ছাড়ানোর স্পর্ধা বা ইঙ্গিত। এবং তার চেয়েও বড়ো কথাটা হলো, মুখ ফুটে সাত্যকির ওই বলায় তার তো খারাপ লাগেনি। আরও সত্যি হলো, সে আনন্দই পেয়েছে। একটা ছেলে তার আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছে অতএব নাকচ করার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু মুশকিলটা হয়েছে আহিরা খুব একটা কাচের চুড়ি পরে না। পরতে যে খারাপ লাগে তা নয়। আসলে তাড়াতাড়ি ভেঙে যায় বলেই মনটাও এক ধরনের শূন্যতায় ভরে ওঠে। সেই কারণেই পরার আকাঙ্ক্ষাটাও নিভু নিভু প্রদীপ শিখার মতোই। আহিরা পরবে কী পরবে না সে প্রশ্নে না গিয়ে শুধু জানতে চাইলো, সবুজ রং বুঝি আপনার খুব পছন্দের?
দারুণ! আহিরার কথায় সম্মতির সুর এটুকু বুঝতে পেরেই সাত্যকি আনন্দে বুজে আসা গলায় যেন মন্ত্র উচ্চারণ করলো, দু’হাতে দু’ ডজন পরবেন।
অতো কেউ পরে? আহিরা সাত্যকির চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসলো। অদ্ভুত এক শান্ত গলায় উত্তর দিল, দু’দিন বাদেই তো ভেঙে যাবে।
গেলে যাবে। কোনো মানুষই চিরকাল বাঁচার জন্য এই পৃথিবীতে আসে না। এ তো সামান্য কাচের চুড়ি— ভাঙলে ভাঙবে।
তা হলে? আহিরার দুই ভ্রূ ধনুকের মতো হতেই সাত্যকি বেশ দিশেহারা হয়ে পড়লো। তার বলাটা কী দোষের হয়েছে? হয়তো। আহিরা ভ্রূ কুঁচকে ‘তা হলে’ বললো কেন? হয়তো অসন্তুষ্ট হয়েছে সে, আর সেই কারণেই ছোট্ট ওই প্রশ্নটা সামনে ঝুলিয়ে রেখে বিপদ সীমার ইঙ্গিত দিতে চাইছে। কিন্তু সাত্যকি কোণঠাসা হয়ে পড়তে রাজি নয়। শেষ কথাটা সে’ই বলবে। আর সেই কারণেই ওর ভেতরের ঢেউয়ের তালে তালে নিজেই এক মহা আনন্দের স্রোতে ভেসে চলেছে। এই মুহূর্তে হঠাৎ বাঁধ দিয়ে সেই উৎস মুখ বন্ধ করার কোনো মানে হয় না। সাত্যকি বিন্দুমাত্র নিজেকে গুটিয়ে না নিয়ে আগের মতোই এক অনন্ত ঝর্নাধারায় স্নান করে উঠলো। গাঢ় গলায় আস্তে আস্তে বললো, আপনি পরবেন এটাই বড়ো কথা। আর এই মুহূর্তটা যখন কখনওই ম্লান হবে না, সব কটা চুড়ি ভেঙে গেলেই বা ক্ষতি কী? আপনি—সাত্যকি হঠাৎ থেমে গেল।
আমি কী?
আপনি যদি পরতে না চান আমি আর জোর করবো না।
এই সন্ন্যাস নেওয়ার কারণ?
জোর হয়তো খাটানো যেতে পারে, তবে স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপারটা না থাকলে সেই জোর যে নিতান্তই পলকা সেটা কে না জানে? আপনাকে তেমনভাবে রাজি হতে হবে না।
চুড়ি পরবো না এ কথা কিন্তু একবারও বলিনি। আহিরা হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেললো। বললো, বলেছি অল্প কয়েকটা পরবো।
অবস্থার দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সূক্ষ্ম অনুভূতিতে যে রঙের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়লো তার স্পষ্ট আভাস সাত্যকির সমস্ত মুখে। অত্যন্ত সহজ এবং সুচারুভাবে, স্বাভাবিকভাবে আহিরা নিজেকে ধরা দিলেও তার মাধুর্যটুকু যে এমন পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে এতোটা আশা সে কিছুক্ষণ আগেও করেনি। সেই কারণেই সাত্যকি হঠাৎ পাওয়ার আনন্দে গভীরতার দরজা পেরিয়ে সবুজ বনের উন্মুক্ত এক প্রান্তরে এসে দাঁড়ালো। সেই বনের বনদেবী কী আহিরা বালযোগী? আনেক্কাপল্লী গার্লস কলেজের ভুগোলের অধ্যাপিকা এক অপরূপা বিদ্যাদায়িনী? তাৎক্ষণিক এক বিদ্যুৎ ঝলকের উন্মাদনায় খসে পড়লো যাবতীয় কুন্ঠা, ঘিরে থাকা লাজুকতা। আলাদা এক উপলব্ধি ও আবিষ্কারের নেশায় সাত্যকি স্থির দৃষ্টিতে আহিরার দিকে চেয়ে থেকে বললো, আপনি একটা পরলেও আমার আনন্দ।
আর ভাঙলে নিরানন্দটুকু আমার।
তা কেন? আপনি নিজে ইচ্ছে করে তো ভাঙছেন না। আর ওর মধ্যেও এক ধরনের আনন্দ থাকে যা পাওয়াকেই বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়।
গাঢ় সবুজ রংয়ের বারোটা চুড়ি আহিরা দু’হাতে ছ’টা ছটা করে পরলো। এ কথা ঠিক যে দোকানদার যখন তাকে সাজিয়ে দিচ্ছিলো, সাত্যকির মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকার মধ্যে সে একরাশ লজ্জা পেয়ে বারবার নিজেকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে দৃষ্টিকে নিচু করেই রেখেছিল। একবার চোখ তুলতেই ওর সঙ্গে চোখাচোখি হওয়ার ফলে লজ্জাটা যেন শত গুণে বেড়ে গেল।
অদ্ভুত এক সাহস সঞ্চয় করে সাত্যকি হেসে বললো, আরও এক ডজন পরুন না-
দু’হাত তুলে ধরে সবুজের চ্ছটা দেখিয়ে আহিরা ফিসফিস করে উত্তর দিল, এরপরেও?
হাতটা ভরাট দেখাবে।
এখনও তাইই দেখাচ্ছে।
অনুগ্রহ করে তর্ক করবেন না—সাত্যকি হাসতে হাসতে বলেই ফেললো, আপনি এতো আপত্তি জানাচ্ছেন কেন?
আপত্তি নয়, এক সঙ্গে এতো চুড়ি আমি সামলাতে পারবো না।
আপনার এই কথাটায় যুক্তি আছে।
এবং আপনিও মেনে নিলেন দেখে আমি এ বারে বেশ স্বস্তি পাচ্ছি।
দোকানের লোকটা বেশ ধুরন্ধর। এদের কাছে কোনো জিনিসেরই দাম টাম নির্দিষ্ট করে কিছু নেই। অর্থাৎ যার কাছ থেকে যেমন দাম আদায় করে নিতে পারে। এবং সেটা খরিদ্দার বুঝে। তা দোকানদারটি তার অভিজ্ঞ চোখে বেশ বুঝতে পারলো, এই দুই যুবক-যুবতীর মধ্যে ভালবাসার একটা ছায়া টায়া বিস্তার করছে অথবা মেঘ টেঘ ভেসে বেড়ানোর মতো একটা কিছু চলছে। অতএব অনায়াসেই আরও এক ডজন চাপানো যেতে পারে। তা হলে দামটাও বেশি বেশি ফেলতে অসুবিধের কোনো ব্যাপারই হবে না। দোকানদার লোকটা তার জোড়া ভ্রূ তুলে ধরে প্রশান্ত হাসলো। বিনয়ের সঙ্গে বলে উঠলো, তবে আর এক ডজন পরলে আপনার হাত দুটি কিন্তু আরও ভরাট…..ইচ্ছে করেই লোকটা থেমে যায়। সে শুধু সাত্যকির মুখের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে থাকে।
এখানেই সাত্যকির আপত্তি। এবং অসন্তুষ্টি। আর রয়েছে গভীর ব্যক্তিত্ব। আহিরা ক’ডজন চুড়ি পরবে না পরবে সেটা তারাই ঠিক করবে। দোকানদার লোকটি বলার কে? তাদের একান্ত ইচ্ছে অনিচ্ছের মধ্যে ওই মানুষটার কোনো ভূমিকাই থাকতে পারে না। তা সত্বেও সে তার ‘ব্যবসায়ী’ কথাবার্তা চালাচ্ছে দেখে সাত্যকি একটু গম্ভীর হলো। এই ক্ষেত্রে অন্যান্য ছেলেরা খুশি হয়ে উঠলেও কলকাতার ছেলেটা কিন্তু ওই দোকানদারের হ্যা-হ্যা, হি-হি-র নাক গলানোটা মোটেও ভালো চোখে দেখলো না। ওর কথা বন্ধ করতে তাই সে সোজাসুজি বলে দিল, আপনার দামটাম কী হলো একটু বলবেন?
হ্যাঁ-হ্যাঁ নিশ্চয়ই। জোড়া ভ্রূ ঢোক গিলে নিজেকে যথারীতি সামলে নিয়ে তার বজ্জাতি দেখালো অনেক বেশি দাম হাঁকিয়ে। সে সব বুঝলেও ওই দামাদামি নিয়ে কিন্তু সাত্যকি একটাও কথা বললো না। আহিরা বালযোগীর জন্য সে তার মানি- ব্যাগ নির্দ্বিধায় ফাঁকা করতে পারে।
যাইহোক দামটাম মিটিয়ে দিয়ে সাত্যকি দোকান ছেড়ে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে এক সময় বললো, চমৎকার দেখাচ্ছে। আপনাকে একটাই অনুরোধ করবো, না ভাঙা পর্যন্ত চুড়িগুলো পরেই থাকবেন।
তাইই থাকবো।
ইচ্ছে হলেও খুলে ফেলবেন না—
ফেলবো না।
ধাক্কাটাক্কা যেন না লাগে সেদিকেও একটু খেয়াল রাখবেন। অন্তত একটাকেও বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন।
নিশ্চয়ই করবো।
আপন খেয়ালে সাত্যকি কথাগুলো বলে যাচ্ছিলো। আহিরার উত্তরগুলো শুনতে শুনতে এক সময় মনে হলো ও কি ঠাট্টা করছে? বাধ্য এবং শান্ত মেয়ের মতো এমন করে প্রতিটি কথায় সম্মতি জানিয়ে সত্যিই যেন এক বিরাট ধাঁধায় ফেলে দিল। এ বারে অবিশ্বাস করার পালা সাত্যকির। সে বেশ অবাক হয়েই জানতে চাইলো, তার মানে আপনি একটা কথাও শুনছেন না, তাই তো?
আপনি কি এই মানে করলেন? আহিরা এ বারে নিজেকে অধ্যাপিকার আসনে বসিয়ে যথেষ্ট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললো, সত্যি কথাটাকেও উল্টো আয়নায় দেখছেন কেন?
সাত্যকি হাসতে হাসতে উত্তর দিল, সহজ ব্যাপারটা সহজই। কিন্তু অতিরিক্ত সহজ মনে হলে ভয় লাগে কোথাও আবার অন্য কিছু লুকিয়ে নেই তো?
হাঁটতে হাঁটতে ওরা রামেশ্বরমের সেন্ট্রাল বাস ডিপোর কাছাকাছি গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। আহিরা বাসে উঠে সুমিঠ্ঠাগুরমে ফিরে যাবে। আর সাত্যকি সময় কাটাতে মুনিয়াপ্পার খোঁজ খবর নিয়ে পরে এখানকার হোটেলে রাতটা কাটিয়ে পরের দিন সুমিঠ্ঠাগুরম রওনা দেবে। সুতরাং এই মুহূর্তে আলাদা হওয়ার ছবিটা ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
আহিরা বাসে উঠে জানালার ধার ঘেঁষে বসলো। সাত্যকি দৃষ্টির ফ্রেমে ওকে ধরে রেখে চুপচাপ সিগারেট খেতে লাগলো নীচে দাঁড়িয়ে। আহিরা অলস কন্ঠে একবার বললো, বাস ছাড়তে এখনও মিনিট দশেক বাকি। আপনি কতোক্ষণ এইভাবে অপেক্ষা করবেন?
যতোক্ষণ না বাস ছাড়ে!
রোদের মধ্যে এমনভাবে দাঁড়াবেন না। আমার কথাটা শুনুন।
সব কথা শুনতে নেই। তৃপ্তির কলস তাতে পূর্ণ হয় না। সাত্যকি হেসে ফেললো। বললো, রোদের কথাটা আপনি বললেন তাই, আমি কিন্তু কোনো কষ্টই বোধ করছি না।
ছেলেমানুষি করবেন না। আহিরা আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেই দিল, আমার এই কথাটা অন্তত শুনুন।
এই ব্যাপারটায় আমাকে আমার মতোই থাকতে দিন না—কথাটা শেষ করে সাত্যকি নতুন এক ভাবনায় উদ্দীপ্ত হয়ে প্রায় নিবেদনের ভঙ্গিতে বললো, আমি কি আপনাকে সুমিঠ্ঠাগুরমে পৌঁছে দিয়ে আসবো?
ওমা কেন? আহিরা বেশ অবাক হয়ে বলে উঠলো, আপনি আবার অতো ছোটাছুটি করবেন?
এই ছোটাছুটিতে আমি যদি আনন্দ পাই?
তা হলেও না। আহিরার স্পষ্ট উত্তর, পরিশ্রম বলে একটা কথা আছে তো— আজ সারা দিনে আপনাকে প্রচুর জার্নি করতে হয়েছে, আর নয়। হোটেলে ফিরে গিয়ে এ বারে একটু বিশ্রাম নিন। কালকে সময় মতো চলে আসুন সুমিঠ্ঠাগুরমে।
ড্রাইভার যখন তার আসনে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিল ওই লোকটাকে শুধু নিষ্ঠুরই নয়, খুব কুৎসিত এবং কদর্যও মনে হতে লাগলো সাত্যকির। সময় দ্রুততালে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সে শেষ বারের মতো আহিরার চোখের দিকে চেয়ে সামান্য একটু হাসলো।
আসছি তা হলে! আহিরার গলায় অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা।
আসুন।
সাক্ষাৎ যমদূতের মতো ড্রাইভারটা বাসটাকে নিয়ে উধাও হতেই প্রগাঢ় এক শূন্যতা সাত্যকিকে ঘিরে ধরে এক নিস্তব্ধতার জগতে পৌঁছে দিল। পাইন বনের দীর্ঘ ছায়া এবং ঝাউগাছের দীর্ঘনিঃশ্বাস দুটোই যেন মিলেমিশে ওকে নিয়ে লোফালুফি খেলতে খেলতে এমন এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিল যেখানে কোলাহলের ব্যস্ততা বুঝি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। সাত্যকি আহিরার মুখটা কল্পনার রঙ, তুলি দিয়ে শূন্য আকাশের বুকে আঁকতে আঁকতে দারুণভাবে ইচ্ছে হলো ওর সঙ্গে কথা বলে নেয়। কিন্তু আহিরা বালযোগী নামের সুন্দরী মেয়েটি এখন ভীষণভাবে পলাতক। আগামীকালের আগে তাকে কাছে পাওয়া যাবে না, অর্থাৎ কি না তার দেখা পাওয়া যাবে না।
আহিরা চলে গেছে আট মিনিট হতে চললো। সাত্যকি তখনও ঠায় সেখানে দাঁড়িয়ে। নিঃশব্দের দূরত্ব তার পায়ে আশ্চর্য এক জাদুর বেড়ি পরিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছে করলেই নড়াচড়া করা যাবে না। মন্ত্রশক্তির সেই গিঁট খুলতে আবার হয়তো ওই অলৌকিক মহিমাময়ীকেই ফিরে আসতে হবে। সাত্যকি সত্যি সত্যিই ছেলেমানুষের মতো এক চিন্তা করে বসলো। আচ্ছা, এমন হয় না, বাসটা কিছু দূরে গিয়ে হঠাৎ খারাপ হয়ে যাওয়ায় আহিরা দ্রুতপায়ে এখানেই ফিরে আসছে। সাত্যকি সোজা রাস্তার দিকে একবার তাকালো। যেন তার চিন্তার প্রতিফলন সে এক্ষুণি দেখতে পাবে। ব্যাপারটা আরও অন্তরঙ্গভাবে ভাবা যেতে পারে। আহিরা যদি সাত্যকির স্ত্রী হতো তবে কী সে তাকে এইভাবে ছেড়ে দিতে পারতো? এতোটা সহজে এবং এতোটা নিশ্চিন্তে? আহিরার পক্ষে এই পথটুকু একা একা পাড়ি দেওয়া এমন কোনো ব্যাপার নয়। সে তো পুজো দিতে এসে প্রতি মাসেই এমনটা করে থাকে। কিন্তু ফুলের ঘ্রাণে ভরা স্ত্রীর সান্নিধ্য থেকে এইভাবে নিশ্চয়ই বঞ্চিত হয়ে সময়কে শুধুই বয়ে যেতে দিতো না। বরং সেই সময়কে আরও অর্থবহ করে তুলতে সাত্যকি ওকে নিজের চোখের ছায়াতেই রেখে দিতো।
মুনিয়াপ্পা নাইডুর তাল, নারকেল, তেঁতুল, আমলকির ছায়াঘেরা বাড়িটা খুঁজে পেতে সাত্যকির খুব একটা অসুবিধে হলো না। বুড়োর বাড়ির সামনে তখন তিনটে ম্যাটাডোর ভ্যান দাঁড়িয়ে। লোকজন ইতস্তত ছোটাছুটি করছে। মজুররা জোয়ারি, তামাক পাতা ইত্যাদির বস্তা বাড়ির ভেতর থেকে মাথায় করে বয়ে এনে অপেক্ষারত সেই ম্যাটাডোরে পরপর সাজিয়ে রাখছে। তিন, চারজন লোক বাইরের দাওয়ায় বসে কী যেন লিখতে লিখতে তেলুগু ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথাও বলে চলেছে। সাত্যকি একজনকে জিজ্ঞেস করলো, মুনিয়াপ্পা নাইডু ….
ভেতর দালানে চলে যান। যাকে জিজ্ঞেস করা সে আসলে সময়কে নষ্ট করতে চাইলো না। সম্ভবত প্রত্যেকেই কাজের মানুষ। সেই কারণেই সাত্যকির পুরো কথাটা শোনার প্রয়োজনও সে অনুভব না করে দায়সারা গোছের উত্তরটা দিয়ে কী সব হিসাবপত্র লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
বাড়িতে মুনিয়াপ্পা নাইডু ছিলেন না। তাঁর বড়ো ছেলে শশীকান্ত ভেতর দালানের প্রশস্ত একটা ঘরে বিরাট এক দাঁড়িপাল্লার সামনে বসে একটা লম্বা খাতায় আরও বেশি মনোযোগ দিয়ে হিসেব-নিকেশ করতেই ব্যস্ত। ব্যবসাগত দিক দিয়ে সাত্যকির সঙ্গে তার বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই, এটা জানার পর শশীকান্ত খুব বেশি উৎসাহ পেল না। যেটুকু নিতান্ত না বললেই নয় সেটুকু গড়গড় করে বলে ফেললো, বাবা আজকেই সেকেন্দ্রাবাদ গিয়েছেন। ওখান থেকে যাবেন চাদরঘাট। ফিরতে ফিরতে দিন পাঁচকে তো লাগবেই।
আমি তা হলে আসছি।
হ্যাঁ আসুন। খাতা থেকে মাথা না তুলেই শশীকান্তর হাঁকডাক, ওরে শ্রীধরন, গত সপ্তাহের টাকাটা কে শোধ করবে? আমার বাবা? আর বাবা পুন্নারিলাল, বাপ- ঠাকুর্দার ব্যবসা কি তোমার জন্য গুটিয়ে ফেলবো? আরে এই শালা উজবুক….. ব্যবসা কি মানুষকে তার স্বাভাবিক ভদ্রতা থেকে দূরে ছিটকে ফেলে দেয়? নাকি বিশেষ কর্মব্যস্ত দেখানোটাই একটা রেওয়াজ? এ নিয়ে সাত্যকি আর মাথা ঘামাতে চাইলো না। তার শুধু একটা কথাই মনে হলো, বৃদ্ধ মুনিয়াপ্পা নাইডুর কাছে ভদ্রতার পাঠ নিতে শশীকান্তের এতো কার্পণ্য কেন?