৪
রাতে কিন্তু আহিরা ঘুমাতেই পারলো না। মায়ের মনে সাহস জোগাতে সে নানারকম কথাবার্তা বলে নির্ভয়ের বাণী শুনিয়েছে বটে কিন্তু নিজের তৈরি করা সেই সব যুক্তিতে আহিরা নিজেই কী সন্তুষ্ট? ওর মনের ভেতরেও কী সন্দেহের বীজগুলো একটু একটু করে চারাগাছে পরিণত হচ্ছে না? দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনার ডালপালাগুলো এতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে কোনটা সাফ করে কোনটা সরিয়ে পথ করে চলবে তা সে নিজেই বুঝতে পারছে না। কোন নিয়তি সমন নিয়ে একেবারে শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে এটা যেমন আন্দাজ করা যাচ্ছে না, ঠিক তেমনই পরিষ্কার হচ্ছে না কলকাতার অধ্যায়টাকে এ ভাবে অস্বীকার করে গোদাবরীর জলে বাবা কেন হাত ধুয়ে বসে আছেন? কার দোষ কার ত্রুটি এ সব তো অনেক পরের প্রশ্ন, পুরো ব্যাপারটাকেই আড়ালে রাখার এই মানসিকতা…………বাবা নিজেই কী কোনো অপরাধ করে এসেছেন? ঘটনার সামান্য সূত্র ধরে প্রাথমিকভাবে এক পা এগোলেও তেমনটাই কিন্তু মনে হয়। সেখানে প্রথম প্রশ্নটাই বড়ো হয়ে দেখা দেয়, বাবা নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন কেন? মা’কে যাই’ই বলুক ওই প্রশ্নের কোনো উত্তর আহিরার কাছেও নেই। স্বেচ্ছায় এই নির্বাসন, এই বনবাসের ব্যাখ্যা কী?
ঝামেলা আর একটাও হবে। বাবা ফিরে আসার পর। যে সংযম এবং সূক্ষ্মতা নিয়ে, সহনশীলতা নিয়ে তাঁর কাছে প্রশ্নগুলো রাখা যেতে পারে, মা কী সে সব ঠিকঠাক রাখতে দেবেন? তাঁর ভেতরের তীব্রতা নিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়বেনই। এটা যার যেমন যন্ত্রণা তার প্রকাশও তেমন ভঙ্গিতেই হবে। কিন্তু তেমনটা করলে এখানে চলবে না। ঠিক এখানেই মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখতে হবে। মাকে সেই তালিম দেওয়ার কাজটা শুরু করতে হবে কাল সকাল থেকেই। তবুও একটা সান্ত্বনা, কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে আহিরা বাড়িতেই রয়েছে। এই যদি সে এখানে না থাকতো একা একা মা যে কী করতেন, কতোখানি অসহায় হয়ে বাবার সঙ্গে গন্ডগোল বাধাতেন সে সব আর নতুন করে না ভাবাই ভালো। এখন একটাই প্রার্থনা, বাবা আগে বাড়িতে তো ফিরুন।
.
রাজামুন্দ্রি থেকে সাত্যকি সময় মতোই আবার সুমিঠ্ঠাগুরমে ফিরে এলো। পথে পড়লো সেই টলটলে জলের দিঘিটা। বিভিন্ন বয়সের মেয়ে-মহিলারা স্নান করছে। যথারীতি পুরুষরাও রয়েছে। যে যার স্নান, কাচাকাচিতে ব্যস্ত। কিন্তু বছর সাতষট্টি- আটষট্টির এক সাদা চুলের বুড়ো অনন্ত আগ্রহ নিয়ে সতেরোর এক ভেজা শরীরকে দেখেই চলেছে। লোকটা স্নান টান কিছুই করছে না। স্রেফ পাড়ে বসে রয়েছে। এক একটা বুড়োর এমন নিরীক্ষণ করার স্বভাব থাকে। সেটা কী ঘাটে কী বাসে! বিসদৃশভাবে দেখেই চলে।
সাত্যকির মাথায় হঠাৎই দুষ্টবুদ্ধি চাগাড় দিল। একজন বয়স্ক মানুষ ওই ভাবে নাতনির বয়সী এক কিশোরীকে হ্যাংলামো করে দেখবে কেন? লোকটার পেছনে লাগতে হবে। সাত্যকি পায়ে পায়ে এগিয়ে একেবারে বুড়োর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বিনীত সুরে জিজ্ঞেস করলো, দাদু একটা ঠিকানা বলতে পারবেন?
পারবো না। বুড়োর সোজাসাপটা উত্তর, আরও এগিয়ে যান।
আরে আপনি তো আমার ঠিকানাটাই শুনলেন না—
দরকার নেই। বুড়োটা মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে সাত্যকিকে সরে যাবার নির্দেশ দিল।
সাত্যকি সরলো তো নাই, উল্টে সাতষট্টির দৃষ্টিপথে যতোটা পারা যায় বাধার সৃষ্টি করে দাঁড়ালো। আরে দাদু অনুগ্রহ করে একটু বলুনই না—
বলছি তো আপনি সরে যান। যত্ত সব ঝুট ঝামেলা।
সরে তো যাবোই। যদি গোপাল মনোহর বালযোগীর………..
এই গ্রামে ওই নামে কেউ থাকে না।
ঠিক বলছেন?
আরে বাপু আপনি এখন সরুন তো, এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করুন। বুড়ো রীতিমতো ধমক লাগালো। তার মানে ভেতরে জ্বলছে। আর বাড়াবাড়ি করাটা ঠিক নয়। সাত্যকি হাসতে হাসতে গোপাল মনোহর বালযোগীর বাড়ির পথ ধরলো। জীবনের প্রচলিত পথ থেকে সরে গিয়ে ওভাবে কচিৎ কখনও মজা নিতে পারার মধ্যে কেমন করে যেন ছেলেবেলাটাই ফিরে আসে।
আহিরাদের বাড়িতে পৌঁছে সাত্যকি জানতে পারলো আসল মানুষটা অর্থাৎ গোপাল মনোহর তখনও বাড়ি ফেরেননি। অবশ্য এখন বেলা সওয়া এগোরোটার মতো বাজে। সুতরাং সারা দিনটাই পড়ে রয়েছে তাঁর ফেরার জন্য। সাত্যকিকে তো অপেক্ষা করতেই হবে। এখন প্রশ্ন হলো, আজও যদি গোপাল মনোহরের দেখা না পায় তা হলে সে কী করবে? গোপাল মনোহরের জন্য তো রাত আটটা- নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না। কেন-না তাকে ফেরার ব্যাপারটা মাথায় রাখতেই হবে।
আজও মন্দাকিনী আগের দিনের মতোই সাত্যকিকে আন্তরিকতার সঙ্গে আহ্বান জানিয়ে বসতে বললেন। এবং সাত্যকিও যথারীতি একটা মোড়া টেনে নিয়ে বারান্দায় অর্থাৎ ঘরের দাওয়ায় বসে পড়লো।
ওই সময়ে ঘর থেকে আহিরা বের হয়ে এলো। আজ ওর পরনে অফ হোয়াইট কালারের সিল্কের শাড়ি। ওই রংয়েরই ব্লাউজ। চোখে বেশ পুরু করে কাজলটানা। কপালে মেরুন টিপ এবং খোলা চুলের মধ্যে সামান্য একটা জুঁই ফুলের মালাতেই ওকে অলৌকিক এক দেবী বলে মনে হচ্ছিলো। ও বোধহয় কোথাও বেরুবে। পায়ের ছন্দে তেমনই ব্যস্ততা। হরিণ-চঞ্চলতা।
হঠাৎ একটা ছেলে উঠোন পেরিয়ে বারান্দার সামনে চলে এলো। সাত্যকি চিনতে পারলো ওকে। প্রথম দিন দিঘির পথে দাঁড়িয়ে ওর কাছেই গোপাল মনোহরের বাড়ির খোঁজ করেছিল। ছেলেটি সাত্যকির দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। তারপরেই মুখ ফেরালো মন্দাকিনীর দিকে। প্রায় এক নিঃশ্বাসেই বললো, পিতাজির সঙ্গে কাঁকিনাড়ায় চাচাজির দেখা হয়েছিল। চাচাজি বলে পাঠিয়েছেন, আজকে আর ফিরবেন না। আগামীকাল সকালের বাসে আসবেন। অবশ্য না এলে চিন্তা করতেও বারণ করে দিয়েছেন।
ছেলেটি আর দাঁড়ালো না। কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই সে সকলের কাছ থেকে বিদায় চেয়ে নিয়ে যেমনভাবে এসেছিল তেমনিভাবেই উধাও হয়ে গেল। আসলে সে নিশ্চয়ই অন্য একটা কাজে ব্যস্ত ছিল। নেহাত সংবাদটা না দিলে নয় তাই জানাতে আসা। এই সামান্য সৌজন্যটুকুই বা কে দেখায়! অথবা এটাকেই বোধহয় বলে গ্রামীণ আত্মীয়তা।
গোপাল মনোহর বালযোগী আজও ফিরছেন না—এই খবরটা শুনে সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে পড়লো সাত্যকি। এমনিতে বালযোগীজি দু’দিন কেন আটদিন পরে এলেও তার কিছু বলার নেই। কিন্তু এইভাবে আসছেন, আসবেন শুনে শুনে প্রতিদিন তো পাঁচ ঘণ্টা, দশ ঘণ্টা জার্নি করা সম্ভব নয়। এক এক পিঠের বাসভাড়াই পঞ্চান্ন টাকা। তবে এটা ঠিক, সাত্যকি টাকা-পয়সার হিসেবটা করছেই না। দশ, এগারো ঘণ্টা জার্নির পরিশ্রমই কষ্টের শেষ সীমায় পৌঁছে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কলকাতায় ওই কষ্ট তাকে জীবনেও করতে হয়নি। নিজেদের গাড়িতেই সর্বত্র যাতায়াত করেছে। কখনও যদি অ্যামবাসাডরটা বিকল হয়েছে তো সাত্যকির মোটরবাইকটা রয়েছে। যাক্ গিয়ে সে সব কথা, এখন রোজ রোজ এই রাজামুন্দ্রি-সুমিঠ্ঠাগুরম- রাজামুন্দ্রি…….সাত্যকির হঠাৎ একটা নতুন কথা মনে এলো। মন্দাকিনী তাকে যথারীতি এখানে থাকতে বলবেন এবং সেও উত্তরে বেশ বিনীতভাবে সেটা নাকচ করে দেবে। এর মধ্যে কোনো নতুনত্ব নেই। এবং সেটা সমাধানের পথও হলো না। আসলে সাত্যকি ঠিক করেই নিয়েছে বালযোগীজির না-ফেরা পর্যন্ত এই বাড়িতে তার রাত কাটানোটা শোভন নয়। সেটা পরিস্থিতির সঙ্গে নিশ্চয়ই সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে না। এখন রাজামুন্দ্রিতে ফিরে যাবার দূরত্বটুকু অন্তত বেশ খানিকটা কমিয়ে ফেলা যেতে পারে। সেই সঙ্গে নতুন একটা জায়গা দেখারও আনন্দ বা তৃপ্তি পাওয়া যাবে। আর কিছু না হোক একঘেয়েমিটা তো কাটবে।
প্রথমদিন এখানে আসার সময় বাসে আলাপ বৃদ্ধ মুনিয়াপ্পা নাইডুর কথা মনে পড়লো। ওঁর কাছেই জানা গেছে রামেশ্বরম শহর এই সুমিঠ্ঠাগুরম থেকে বাসে মাত্রই আধ ঘণ্টার পথ। এবং ওই শহরে থাকার জন্য যথেষ্ট হোটেল, লজ, ধরমশালা, পান্থনিবাস ইত্যাদি রয়েছে। সাত্যকি নিজের দুর্বল চিন্তা-ভাবনাকে দায়ী করে নিজেকেই ধিক্কার জানালো। আহাম্মকের মতো সে এই ক’দিন ফালতু, সুমিঠ্ঠাগুরম-রাজামুন্দ্রি করেছে। করেছে অনাবশ্যকভাবে সময় ও অর্থের অর্থহীন অপচয়। আধ ঘণ্টা দূরত্বের রামেশ্বরম শহরের কথা তখন তার একবারও কেন মনে পড়লো না? এই বোকামি অন্য কেউ করলে সাত্যকি হাসাহাসি করতো। বুদ্ধুরামের উপাধি দিতো। এখন নিজেকে কী বলবে? আসলে এক একটা সমস্যা যখন আসে তখন সেই সমস্যাটাকেই খুব বড়ো করে দেখা হয়। ফলে চিন্তা-ভাবনার শাখা-প্রশাখা ওই মুহূর্তে কেমন যেন থমকে যায়। অথচ একটু আত্মবিশ্বাস নিয়ে খোলা মনে সমস্যার জট ছাড়াতে বসলে দেখা যাবে কোনো সমস্যাই সমস্যা নয়, প্রাথমিক একটা আড়াল বা ধাক্কামাত্র।
না, বোকার মতো সাত্যকি আর রাজামুন্দ্রি গিয়ে বাসে পাঁচ ঘণ্টার পথ পাড়ি দেবে না। সে এ বার থেকে থাকবে ওই রামেশ্বরম শহরের কোনো হোটেল অথবা লজে। এখন খুবই আফসোস হচ্ছে এই ক’দিনের নির্বুদ্ধিতার জন্য।
সাত্যকি নিজেকে হালকা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে অপরূপা আহিরার দিকে একবার তাকালো মাত্র। কিন্তু ওর চোখে চোখ রাখার সাহস পেল না। কলেজের অধ্যাপিকা বলে? হতে পারে। সাত্যকি এগারো হাজার টাকার একটা চাকরি করলেও ও এখনও পড়ছে। এম. বি. এ পড়া ছাত্র হিসেবে ওর ভেতরে পড়ুয়াসুলভ একটা মনোভাব থাকলেও থাকতে পারে। তবে মন্দাকিনীর সামনে লজ্জাতেই যে সে আহিরার চোখে চোখ রাখতে পারলো না এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
মুনিয়াপ্পা নাইডুর কাছে ভাসা-ভাসা শুনেছিল বটে তবে নতুন করে আবার সামগ্রিক একটা ছবি পেতে সাত্যকি মন্দাকিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, রামেশ্বরম শহর এখান থেকে তো খুব কাছেই তাই না?
হ্যাঁ। বাসে বড়ো জোর পঁয়ত্রিশ, চল্লিশ মিনিট লাগতে পারে।
তা হলে আর রাজামুন্দ্রি ছোটার দরকার কী!
আমি তো প্রথম থেকেই বলছি দরকার নেই। মন্দাকিনী হাসলেন।
সাত্যকিও সমান হেসে উত্তর দিল, না, না ওটা ঠিকই আছে। তবে আজ থেকে ওই পাঁচ ঘণ্টার পথ না দৌড়ে পঁয়ত্রিশ, চল্লিশ মিনিট দূরত্বের রামেশ্বরম শহরেই থাকবো।
তুমি কী এখনই রামেশ্বরমে রওনা দেবে না কি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
সাত্যকির ওই ছোট্ট উত্তরটা শুনে মন্দাকিনী মেয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। ওই হাসি ভরা মুখ নিয়েই আবার সাত্যকির ওপর চোখ ফেরালেন। আসলে মাঝেমাঝেই এমন মিল হয় কী করে? মন্দাকিনী মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে এই কারণেই হাসলেন যে, আহিরা এই মুহূর্তে রামেশ্বরম রওনা হচ্ছে। আনেকাপল্লী থেকে ছুটিছাটায় ও যখনই সুমিঠ্ঠাগুরমে আসুক না কেন, একবার না একবার ভেঙ্কটেশ্বরের মন্দিরে গিয়ে পুজো দেবেই দেবে। আজকে সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যও তাই। মন্দাকিনী আগের হাসিটাকে ধরে রেখেই সাত্যকিকে বললেন, তুমি তা হলে আহিরার সঙ্গেই চলে যাও। ও তো পুজো দিতে রামেশ্বরমেই যাচ্ছে। আর পারো তো তুমিও একটা পুজো দিয়ো—এই বাড়ির কর্তাটির সঙ্গে তাড়াতাড়ি দেখা হওয়ার প্রার্থনা জানিয়ে। সত্যি, কলকাতা থেকে ছুটে এসেও তোমার নিস্তার নেই। এখনও সেই ছোটাছুটি – দৌড়াদৌড়ি লেগেই রয়েছে।
গ্রামের কাঁচা পথ দিয়ে আহিরার পাশে পাশে নীরবে হাঁটতে হাঁটতে বাস রাস্তার দিকে এগোবার সময় সাত্যকি দূরে দূরে পাহাড়ের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা, সবুজ জঙ্গলে দীর্ঘ বনানীর গাঢ় সবুজ ছায়া, কাছে এবং দূরে সেই ছায়া ঘেরার ফাঁকফোকরে মাটির বাড়ি, টুং-টাং ঘণ্টা বাজিয়ে শস্য বোঝাই গরুর গাড়িগুলোর এগিয়ে চলা, প্রায় উদোম হওয়া ছোট্ট ছোট্ট শিশুর হাসির কলরব ইত্যাদি ছায়াছবির মতো খণ্ড খণ্ড সুষমার দিকেই চোখ রাখছিল। দু’জনের কেউই একটাও কথা বলেনি। আসলে এই মুহূর্তে হঠাৎ এক সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে দু’জনেই দু’জনের কাছে অনেক বেশি অপরিচিত হয়ে উঠেছে। এটা ঠিক আড়ষ্টতা নয়, তবে আগে থেকে তেমন মেলামেশা না থাকার দরুন এক সঙ্কোচের ঢেউ তো দু’জনকে ছাপাতেই পারে। ওরা এখন যার যার ভেতরে সেই ঢেউ সামলাতেই ব্যস্ত। সুতরাং কথা বলবে কী?
সাত্যকির খেয়াল হলো আর যাই হোক, এ ভাবে মুখে কুলুপ এঁটে পাশাপাশি হাঁটাটা বিচ্ছিরি ব্যাপার। একটা কিছু অন্তত বলা দরকার। কিন্তু এই মুহূর্তে বলবেটা কী? ওহ্ আপনাকে দারুণ দেখতে! এতো সুন্দর আমি এর আগে দেখিনি। আপনার পাশে হেঁটে বেড়ালে নিজেকে গর্বিত মনে হয়। ওসব ঝুরি নামানো তোষামোদ করা কথা সাত্যকি বলতে পারবে না। তবে এটা ঠিক, একটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে মুখ বুজে হাঁটার মতো অস্বস্তি বা বিড়ম্বনা আর দ্বিতীয় নেই।
সাত্যকিরা দিঘির কাছে চলে এসেছে। গ্রামের সার্বজনীন জলাশয়ে যেন সারাক্ষণই ভিড়। সপসপে ভেজা শরীরে এক বাইশ-তেইশের যুবতী সাত্যকির সামনে দিয়ে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ এবং অস্তিত্বের ঢেউ তুলে রাস্তা পার হলেও কলকাতার ছেলেটা চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারলো না। ডান দিকে মুখটা সামান্য ঘুরিয়ে নিতেই সাত্যকির চোখে পড়লো সেই সাতষট্টির বুড়োটাকে। ঠায় বসে বসে তখনও স্নানরত মেয়েদের দেখেই চলেছে। আহিরার সঙ্গে মৌনতা কাটাতে সাত্যকি এ বারে ওই বুড়োটাকে নিয়েই পড়লো। সে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো, সে কী দাদু এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন? সাতষট্টির মানুষটা সম্ভবত কানে কম শোনে। সে কোনো উত্তর তো দিলই না এমনকী সাত্যকির দিকে ফিরেও তাকালো না।
তবে সাত্যকিকে মৃদু কিন্তু অত্যন্ত সুচারুভাবে ধমকে উঠলো আহিরা। আপনি কী ওই লোকটাকে চেনেন?
তা চিনি না।
তা হলে ওঁকে ঘাঁটাবেন না।
আসলে আপনাদের ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিলাম……..মানুষটা কিছুতেই বলতে চাইছিলেন না। একবার তো বললেন, গোপাল মনোহর বালযোগী নামে এই গ্রামে কেউ থাকেই না। আর আমার কথা উত্তর দেবেন কী আমাকে তাড়াতেই উনি বেশি ব্যস্ত। সম্ভবত স্নানের দৃশ্য দেখতেই তাঁর আনন্দ!
আর একটা আনন্দ অন্যদের গালিগালাজ করতে। এতোক্ষণে আহিরা মূল কথাটা ভাঙলো, যেকোনো লোককে উনি যাচ্ছেতাই গালাগাল করেন। অনেকটা খ্যাপাটে ধরনের। তাই বলছিলাম ওঁকে ঘাঁটাবেন না। আর আশ্চর্য হচ্ছিলাম, দু’দিন সুমিঠ্ঠাগুরমে কয়েক ঘণ্টার জন্য এসে আপনিও কীভাবে হরিহরণ চাচাজিকে চিহ্নিত করলেন?
ওঁর মধুর স্বভাবের জন্য। সাত্যকি হেসে ফেললো।
মৃদু হাসির ছোঁয়া আহিরার দুই ঠোটে নয়, চোখের কোণে। সে লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল। মেয়েদের ভেজা শরীর দেখা হরিহরণ চাচার এক অসুখ। সারা সুমিঠ্ঠাগুরম তা জানে। জানে সাত্যকিও। অথচ ‘সম্ভবত স্নানের দৃশ্য দেখতেই তাঁর আনন্দ’ কিংবা ‘ওর মধুর স্বভাবের জন্য’ বলার মধ্যে কতোই না রাখঢাক ব্যবস্থা। আর কতো শালীনতার মোড়কে হরিহরণ চাচাকে উপস্থিত করবে সাত্যকি? ছেলেটা কিন্তু বেশ বাকপটু।
যাক গিয়ে, হরিহরণ নামের সাতষট্টি বছরের অসুস্থ রুচির মানুষটার কথা এ বারে থাক। এখন কোন প্রসঙ্গ নিয়ে সাত্যকি আহিরার সঙ্গে কথা চালাচালি করবে? নাকি আবার ভেসে যাবে মৌনতার স্রোতে? কথার অন্বেষণে নেমে সাত্যকি নানা প্রসঙ্গ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বলে ফেললো, এই যে আপনি পুজো দিতে যাচ্ছেন, এটা বিশ্বাস করেন?
বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাসের কোনো প্রশ্ন নেই। আহিরা নিরীহ সুরে উত্তর দিল, এটাকে একটা রীতি-রেওয়াজও বলতে পারেন। বরাবর দিয়ে আসছি তাই দিচ্ছি।
তার মানে ব্যাপারটা কী যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে না?
মোটেও না। এর সঙ্গে ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা, ভালোলাগার প্রশ্নগুলোও জড়িয়ে থাকে।
ইচ্ছে করলে এই পুজো দেওয়াটা বন্ধ করতে পারেন?
তেমন ইচ্ছে তো কখনও হয়নি। আহিরা সূক্ষ্ম হাসির ঘেরাটোপে নিজেকে লুকিয়ে রেখে বললো, এটাকেই যদি বিশ্বাস বলেন আপত্তি নেই।
পুজো দেওয়ার সময় একটা কিছু তো নিশ্চয়ই প্রার্থনা করেন?
করি। তবে সেটা ব্যক্তিগত নয়। আহিরা নিবিড় এক উপলব্ধিতে গভীর সুরে বললো, সব সময়েই একটা কথা বলি, সবাইকে সুখে রেখো। সব মানুষকে।
একটা আলোচনা চালাবার জন্যই চালিয়ে যাচ্ছিলো সাত্যকি। কিন্তু আহিরার শেষ কথাটা শুনে একটু নড়েচড়ে উঠলো। এই মেয়েটির মমত্ববোধ কোন স্তরে পৌঁছেছে সেটা ভাবতে ভাবতে সেও বলে ফেললো, সব মানুষ কি সুখে আছে?
তা নেই। আহিরার পরিষ্কার উত্তর, কিন্তু আমার ওই একটি মাত্রই প্রার্থনা। তারপরেই মৃদু হেসে বললো, এমনকী যখন পড়াশুনা করতাম তখনও পাশের জন্য একবারও ধর্না দিইনি। প্রার্থনা শুধুই মানুষের মঙ্গলের জন্য। এরপরে হয়তো আপনি ঈশ্বর, সংস্কার, বিশ্বাস ইত্যাদি বিষয়ে আমাকে অনেক প্রশ্ন করতে পারেন, কিন্তু সে সব কথা তুলে কী লাভ বলুন? ব্যাপারটা হলো, যে যেমন ভাবে চলতে চায় চলুক না! গোঁড়ামির পর্যায়ে না গেলেই হলো। দেখতে হবে ধর্মান্ধতা মানুষকে যেন কখনই অজ্ঞ করে না দেয়। দূরে সরিয়ে না রাখে।
এই কথাগুলো কিন্তু চমৎকার বলেছেন।
আগের কথাগুলো বুঝি ভালো লাগেনি? আহিরা চলতে চলতে মুখটা সামান্য একটু ঘুরিয়ে সাত্যকি মৈত্র নামের কলকাতা থেকে আসা ঝকঝকে ছেলেটাকে এক পলক দেখে নিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য অত্যন্ত সহজ সুরে বললো, বাবা আজ আসছেন, কাল আসছেন করে এখনও পর্যন্ত এলেনই না। ব্যাপারটা আবার আগামীকাল পর্যন্ত গড়িয়েছে। অথচ আপনার চেয়ে আমরাই এখন বেশি উতলা হয়ে পড়েছি।
কেন? সাত্যকি ছোট্ট প্রশ্নটা করে আহিরার চোখের দিকে তাকালো। বাবার সঙ্গে আপনার মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত একটা জটিলতার, একটা ভূমিকম্পের আশঙ্কায় আমরাও স্বস্তি পাচ্ছি না।
ও নিয়ে আপনারা ভাবছেন কেন? আমি তো আগেই বলেছি দুশ্চিন্তার কিছু নেই। সাত্যকি গলাটা একটু নামিয়ে আরও কী যেন বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার আগেই আহিরা একটা কথা স্পষ্ট করেই বলে ফেললো, বাবার শোনার আগে আমি কিন্তু ওই প্রসঙ্গের একটা কথাও শুনতে আগ্রহী নই। অতিরিক্ত কৌতূহল দেখানো শুধু দোষের নয়—কুরুচিকরও বটে। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন আমি পুরো ঘটনাটা এই মুহূর্তে শোনবার জন্য………
আমি তেমন ভাবছিই না। আহিরাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সাত্যকি ভরাট গলায় উত্তর দিল, সেটা তো প্রথম দিনেই করতে পারতেন। তা যখন করেননি আপনাদের রুচি-প্রকৃতি যে কিছু অন্য রকমের সেটা বুঝতে আমার এতোটা সময় লাগার কথা নয়। আসলে আমি নিজের থেকেই কিছু বলতে যাচ্ছিলাম—যাক, ও ব্যাপারটা ছেড়ে দিন।
.
গ্রামের মাটির পথ শেষ করে ওরা বড়ো রাস্তা অর্থাৎ বাস রাস্তায় এসে পৌঁছালো। হাইওয়ে দিয়ে তখন সমানে বিশাল বিশাল ট্রাক ছুটে চলেছে। সেই সঙ্গে রুটের বাস এবং হেভি ওয়াটার প্ল্যান্টের জিপ, ট্রেকার, অটোরিকশা তো রয়েছেই। পথ চলতি দু’চারজন গ্রাম্য সাদাসিধে মানুষ হাতজোড় করে আহিরাকে নমস্কার জানালো। ব্যাপারটা না বোঝার কিছু নেই। আহিরা বালযোগী সম্ভবত এই এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি লেখাপড়া জানা মেয়ে। কলেজের অধ্যাপিকা সুতরাং সুমিঠ্ঠাণ্ডরমে তার মর্যাদা নিশ্চয়ই অন্য পাঁচজনের থেকে একটু আলাদাই হবে। আর মজাটা হলো, একজন কিশোর এবং তার বাবা দু’জনেই এক সঙ্গে আহিরাকে নমস্কার জানাচ্ছে। আহিরা যে খুব একটা উপভোগ করছে তা কিন্তু মোটেও নয়। একরাশ অস্বস্তি নিয়েই তাকে প্রতি নমস্কারের কাজটা সারতে হচ্ছে।
সাত্যকি পকেট থেকে সিগারেট এবং লাইটারটা বের করে আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। সে এমনভাবে কাজটা করলো যেন তার কোনো গুরুজন একেবারে সামনাসামনি এসে পড়েছে। অতএব না লুকিয়ে আর উপায় নেই।
আড়াল করার ব্যাপারটা আহিরার নজর এড়ালো না। এই নিয়ে তার কিছু বলার নেই। কোনো কথা বলার ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু একটা ছেলে সিগারেট খায় অথচ খেতে পারছে না—এই অসুবিধেটুকু সেই-ই পারে দূর করে দিতে। আহিরা জানতে চাইলো, সিগারেট রেখে দিলেন কেন?
একজন অধ্যাপিকার সামনে খাওয়াটা কী ঠিক? আমি চাকরি করার সঙ্গে সঙ্গে এম. বি. এ. পড়ছি। সেই হিসেব একজন ছাত্রের কী…
সাত্যকির আন্তরিকতায় আহিরা যে খুশি হলো না তা নয়। ওর কথা শুনে একটু বেশি পরিমাণেই কোমল হয়ে পড়লো। ছেলেটা ভন্ডামি করে যদি কিছু বলতো তা হলে কী ওর কথায় এতো উষ্ণতা থাকতো? যতো বড়ো শহরের ছেলেই হোক না কেন, চালাকি বা বজ্জাতি লুকিয়ে রেখে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে গিয়ে সন্তুষ্ট করে কথা বলার মানসিকতা এখনও রপ্ত করেনি। ওর চোখ-মুখে সেই চালিয়াতি নেই। যেটা ভাবে সেটাই বলে। তা সত্ত্বেও আহিরার অবশ্য একবার ইচ্ছে হলো, অনুমতি না দিয়ে দেখাই যাক না, কতোক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারে! অন্তত সাত্যকির কথার আন্তরিকতা কতোখানি সেটা বোঝা যেতে পারে। পর মুহূর্তেই আহিরার চিন্তা অন্য স্রোতে বইতে লাগলো। ওসব ছেলেমানুষির খেলায় মেতে ওঠা তার পক্ষে কতোটুকু সম্ভব? আহিরা বেশ সহজ সুরেই বললো, আপনি তো আমার ছাত্র নন। সিগারেট খাবেন এতে আপত্তির কী আছে?
না, অনেকে আবার ধোঁয়াটা সহ্য করতে পারে না।
এখন প্রত্যেকেই নানা অসুবিধের মধ্যে চলতে চলতে সব কিছুর সঙ্গেই মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কথাটা বলে আহিরা ডান দিকে চোখ ঘোরালো। ওদিক থেকে কোনো বাস আসছে কিনা সেটাই লক্ষ্য করলো। আপাতত ট্রাক ছাড়া অন্য কিচ্ছু নজরে এলো না।
সাত্যকি, আর কথা বাড়ালো না। তবে সিগারেটটা এই মুহূর্তেই মানে এতো আলোচনার পরেও খেতে হবে এমনটাও ঠিক বলে মনে করলো না। খাওয়ার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে না।
আহিরা ডান দিকে মুখ ঘুরিয়ে দৃষ্টি ওই দিকে ধরে রাখার দরুন সাত্যকি ওর মুখটা দেখতে পাচ্ছিলো না। ওর চোখ দুটো বারবার আটকে যাচ্ছিলো আহিরার কালো মেঘের ঢল নামা মাথায়। সেখান থেকে জুঁই ফুলের গন্ধটা এসে সমস্ত মনটাকেই ভালোলাগার শিরশিরে হাওয়ায় যেন এক অচেনা দারুচিনি দ্বীপের বনে হারিয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। কোমর ছাপানো একরাশ চুল যে একজনকে সৌন্দর্যের আইফেল টাওয়ারের মাথায় বসাতে পারে সেটা আহিরাকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। কলকাতায় কিন্তু এই দীঘল চুলের ব্যাপারটার বড়োই অভাব। বরং ঘটনাটা এখন উল্টো হয়ে চলেছে! ববড় হেয়ার, বয়েজ-কাট করে চুল ছাঁটতে ছাঁটতে মেয়েরা তাদের মাথাটাকে পুরো না হলেও ঘাড়টাকে চেঁছেপুছে ঘাসহীন ক্রিকেট পিচের মতো বানিয়ে ছাড়ছে। এবং সত্যি কথাটা হলো, সবাইকে না হলেও কাউকে কাউকে যে কী কদাকারই না লাগে সেটা তারা বুঝে উঠতেও পারে না। গত বছরেই সাত্যকি ওর এক জ্যাঠতুতো দাদা ধীমানের বিয়েতে গিয়েছিল। বউ- ভাতের দিন সে এক মজার ব্যাপারই হয়েছে। ধীমানদাদার বউ পায়েলা তার মাথার চুলগুলোকে সমান করে ছেঁটে একেবারে ফুটবল গ্রাউন্ডের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এখন বিপদ হয়েছে কী, মাথার ওই চুল টুল দিয়ে ভেজা পা মুছিয়ে দেবার কী সব নাকি নিয়ম একটা রয়েছে। এ বারে ডাবের জলটল দিয়ে তো ধীমানদার পা দুটোকে ধুয়ে দেওয়া হলো। তারপর নতুন বউ তোয়ালে দিয়ে মোছাতে গেলে প্রচন্ডভাবে বাধা দিয়েছিলেন ঠাকুমা। তবে হাসতে হাসতেই পরিষ্কার বলেছিলেন, প্রথম দিন থেকেই ফাঁকিবাজি! সেটা ঠিক নয়। মাথার চুল যখন উড়িয়ে দিয়েছো অন্তত ধীমানের পায়ে মাথাটা একবার রাখো। তাতেই চুলের সঙ্গে যেটুকু সম্পর্ক ঘটে ঘটুক। উপস্থিত সকলের হাসির ফোয়ারায় এক অদৃশ্য ব্যঙ্গ ও কাঁটার যন্ত্রণা নিয়ে পায়েলা ঠিক তাইই করেছিল, তবে ঠাকুমাকে পাক্কা তিরিশ সেকেন্ডের এক কঠিন দৃষ্টি হেনে। এখন ঠাকুমার সঙ্গে পায়েলার সম্পর্ক সতীনের চেয়েও সাঙ্ঘাতিক। প্রথম দিনের খোঁচাটার উত্তরে সে আজও নীরবে এক অবজ্ঞার সঙ্গে তাঁকে তফাতে সরিয়ে রেখেছে।
পরিবেশ, পরিস্থিতি বোধহয় মানুষকে তার অবস্থান থেকে অন্য এক কুসুম বনে পৌঁছে দেয়। সবুজে ঘেরা পাহাড়, বনাঞ্চলের ঘেরাটোপে, নীল আকাশের চাঁদোয়ার নীচে কলকাতা থেকে দেড়, দুই হাজার কিলোমিটার দূরে অন্ধ্রপ্রদেশের এই সুমিঠ্ঠাগুরমের মতো মনোরম এক উষ্ণতায় আহিরার পাশে দাঁড়িয়ে সাত্যকি যেন অন্য জগতে পৌঁছে গেল। পৃথিবীর যাবতীয় আবীলতা, সঙ্কীর্ণতার কোনো কণাও যদি তার ভেতরে থেকে থাকে, সে সব যেন অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। আহিরার মাথার চুলে ফুলের গন্ধ। জুঁইফুলের সেই ঘ্রাণ নিতে নিতে সাত্যকির মনে হলো, আহিরাকে যেন আর পর বলেই মনে হচ্ছে না। এই আহিরা বালযোগীকে রাজামুন্দ্রির সুমিঠ্ঠাগুরমে ফেলে সে কলকাতার যোধপুর পার্কে ফিরে যাবে কেমন করে? অথচ সে এক সংশয়ের মোহনায় অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে। জটিলতার ঘূর্ণিপাকে আপাদমস্তক জড়িয়ে। কেন-না আহিরা যখন জানবে তার বাবা এক চূড়ান্ত অন্যায়ের শিকার হয়ে চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়েছেন, আর নেপথ্যের জাল গোটানোর মানুষটি সাত্যকির বাবা তখন……..তখনও কী আহিরা তাকে ক্ষমার চোখে দেখবে?
‘বাস যেন আজই ইচ্ছে করে আরও দেরি করছে।’ আহিরা ওই মন্তব্যটা করতেই সাত্যকি সরস উত্তর দিল, কলকাতায় গেলে আপনি তবে বাস স্টপে দাঁড়িয়েই একটা মাঝারি মাপের ঘুম দিয়ে উঠতে পারেন।
ওমা কেন, ওখানে কতো দেরিতে বাস আসে? আহিরা ভ্রূ কুঁচকে সাত্যকির চোখের দিকে চেয়ে রইলো।
এমনিতে তো হরদম রাস্তায় বাস দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। প্রতি দিন গড়ে চার, পাঁচজনকে পিষেও মেরে ফেলছে। তা সে সব নিত্যকর্মের ব্যাপারটা ঠিক থাকলেও এমন কয়েকটা রুট আছে প্রয়োজনের সময় আপনাকে ঠায় সওয়া ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই নির্দিষ্ট বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমার অবশ্য তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তবে বন্ধুদের কাছে ওই দেরির নির্যাসটুকু যে মন্তব্যে শুনি সেটা হলো, ওই রুটে নাকি শুক্লপক্ষে একটা আর কৃষ্ণপক্ষে একটা বাস চলাচল করে।
দারুণ, দারুণ! আহিরা খিলখিল করে হেসে উঠলো।
একটা মেয়ের হাসিতেও এতো সৌন্দর্য! মোহিনী কিরণে ভেসে যাওয়া আহিরার মুখের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সাত্যকি। এই মেয়েটিই যখন শুনবে……. ঘুরে ফিরে সাত্যকির মনে আবারও ওই একই চিন্তা। আসলে আঠাশ-তিরিশ বছর আগে নিখিল মৈত্র যে মিথ্যাচারের মুকুট গোপাল মনোহর বালযোগীর মাথায় চাপিয়ে দিয়েছেন তারপরেও সাত্যকি আহিরার পাশে দাঁড়িয়ে ওকেই কীভাবে আহ্বান জানাতে পারে? এবং আহ্বান জানালেই তো হলো না, আহিরা যে সেই ডাকে সাড়া দেবে না, এটা বোঝার জন্য বুদ্ধিমান হওয়ার দরকার নেই। একমাত্র রাস্তাটা যেটা খোলা রয়েছে তা হলো, গোপাল মনোহর বালযোগীর হৃদয়ের বরফটা যদি গলে! কিন্তু আঘাতে, বেদনায় মূক হয়ে এই আঠাশ বছরে বালযোগীজির হৃদয়ের সেই ‘হিমশৈল’ কি এতো সহজেই গলতে শুরু করবে? সাত্যকি তেমনটা মনে করে না। স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই বলে মানুষটা কঠিন সিদ্ধান্তের পাহাড় চূড়ায় বসে আছেন। তাঁকে নরম করতে অনেক নাস্তানাবুদ হতে হবে। এটা জেনেই তো সাত্যকি এখানে এসেছে। কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। সমস্যা হলো, সাত্যকি কী এই কাজের জন্য আহিরা বালযোগীকে তার পাশে পাবে?
সুমিঠ্ঠাগুরম বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আহিরা বিরক্ত হলেও সাত্যকির তেমন কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। সে এ বারে অনায়াসেই একটা সিগারেট ধরালো। খোলামেলা প্রকৃতির নৈঃসর্গিক ছবিটা দেখতে দেখতে তার মনটাও ফুরফুরে হয়ে উঠেছে। গ্রামের লাল সুরকি বিছানো পথ পেরিয়ে এসে হাইওয়েতে উঠতে গিয়ে তামাকপাতা বোঝাই গরুর গাড়িটা পাশের গর্তে এমনভাবে চেপে বসে গেল যে ডানদিকের চাকাটা আর উঠছেই না। গরুর গাড়ির চালক প্রথম দিনের সেই মধ্যবয়সী বিরাট গোঁফওয়ালা লোকটা— যে নাকি সাত্যকিকে ডাকঘরে গিয়ে ঠিকানা জানার পরামর্শ দিয়েছিল। যাইহোক, গোঁফু তো বলদ দুটোকে মেরে-ধরে, ল্যাজ মুড়িয়ে দিয়ে খোঁচাখুঁচি করে তাদের শক্তি বাড়িয়েও গাড়িটাকে বড়ো রাস্তায় তুলতে পারলো না। ‘হ্যাট-হ্যাট’ করতে করতে লোকটার মাথাটাই বুকের ওপর ঝুলে পড়েছে।
ওই অবস্থায় আসরে নামলো সাত্যকি। পথচারী চার, পাঁচজনকে জড়ো করে নিজেও হাত লাগিয়ে অনায়াসেই তামাকপাতার গাড়িটাকে বড়ো রাস্তায় তুলে দিল। গোঁফু ততোক্ষণে সাত্যকিকে চিনতে পেরেছে। কিন্তু ওর ধন্যবাদ পাওয়ার তোয়াক্কা না করেই সাত্যকি আবার যথারীতি আহিরার পাশে। হাত জোড় করে লোকটাও লজ্জিত হয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো। ক্ষমাটমা চাইবার উপক্রম করতেই সাত্যকি হেসে বলে উঠলো, ওসবের কোনো দরকার নেই। শুধু মনে রাখবেন, সব জিনিস ডাকঘরে পাওয়া যায় না। মানুষের জিম্মাতেও কিছু থাকে।
কথাটা শুনে আহিরার চোখ বড়ো হলো। এ আবার কী কথা! এর মধ্যে ডাকঘরের মাহাত্ম্যটাই বা কী? পুরো ব্যাপারটাই বেশ অসংলগ্ন লাগছে। খাপছাড়া।
.
ইতিমধ্যে একটা ট্রেকার জিপ এসে ওদের প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। ভেতরে চালক ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই। ড্রাইভারের আসনে বসে বছর পঞ্চান্নর এক ভদ্রলোক। তিনি মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আহিরা বিটিয়া যানা হ্যায় ক্যয়া?
আহিরা নিজের নাম শুনে সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফেরালো। স্টিয়ারিং হাতে বসে আছেন যেশুদাস চাচা। তাদের বাড়ির কাছাকাছিই ওঁর বাড়ি। গোপাল মনোহর বালযোগীর বন্ধু। সেই হিসেবে চাচা। পড়শি যেশুদাস শুধু তাদেরই পারিবারিক শুভাকাঙ্ক্ষী তা নয়, তিনি গ্রামের সবার সঙ্গেই অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে মেলামেশা করেন। এবং তাঁর দ্বারা যেটুকু উপহার হওয়া সম্ভব তা তিনি অবশ্যই করেন। আসলে যেশুদাস রামেশ্বরমের সামান্য আগে অনন্তপুরম হেভি ওয়াটার প্ল্যান্টের বড়ো সাহেবের ড্রাইভার। চাকরির প্রয়োজন তো প্রতিটি বেকার ছেলেরই। কিন্তু সবাইকেই তো কাজ দেওয়া সম্ভব নয়। তার মধ্যেও যে পাঁচ, ছ-জনের একান্ত জরুরি- সুমিঠ্ঠাগুরমের তেমন ছেলেদেরকে বড়ো সাহেবের কাছে নিয়ে গিয়ে যেশুদাস শুধু একটা কথাই বলেছেন, ‘এরা না খেয়ে রয়েছে। আত্মহত্যা করার দড়িটুকু কিনবার পর্যন্ত পয়সা ওদের নেই।’ হ্যাঁ ওই কথাতেই দারুণ ফল পাওয়া গেছে। সেই গল্প এখন সুমিঠ্ঠাগুরমের প্রতিটা ঘরে ঘরে লোকগাঁথা হয়ে বারবার শোনা যায়। তারপরেও সুযোগ ও সময় মতো যেশুদাস নিশ্চুপে তার বড়ো সাহেবের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। দাঁড়িয়েছেন বিনীত ভঙ্গিতে নতুন করে আর্জি নিয়ে। ফলে গ্রামের আরও কয়েকটি ছেলের স্থান হয়েছে ওই হেভি ওয়াটার প্ল্যান্টে। এ হেন পরোপকারী মানুষটির কাছ থেকে সাড়া পেয়ে আহিরা বলেই ফেললো, যানা হ্যায় তো রামেশ্বরম……
তো ফিকির কিস বাত কী? গাড্ডি পে বৈঠ যাও। অনন্তপুরমের মোড়ে নামিয়ে দিলে রামেশ্বরম তো কয়েক পা হাঁটার পথ।
চাচাজি সে সব ঠিক আছে
আহিরা বিটিয়া বেঠিকটা তা হলে কী?
সেটা হলো আহিরার প্রচুর পরিমাণে দ্বিধা-সঙ্কোচ দেখে যেশুদাস’ একটু অবাকই হলেন। কেন-না এর আগেও বেশ কয়েকবার তিনি তার গাড়িতে গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করা অধ্যাপিকা মেয়েটিকে পৌঁছে দিয়েছেন। তা হলে আজ কীসের এই আড়ষ্টতা? যেশুদাস এ বারে পরিষ্কারই জানতে চাইলেন, বিটিয়া তোমার কী হয়েছে বলো তো?
চাচাজি বাত ইয়ে হ্যায় কি……… আহিরা অস্ফুট স্বরে বললো, আমার সঙ্গে আরও একজন রয়েছেন।
আমি কী তাঁকে উঠতে মানা করেছি নাকি? যেশুদাস আহিরার সঙ্কোচের হদিস পেয়ে হেসে ফেললেন। বললেন, আহিরা বিটিয়া, তুমি সেই ছেলেমানুষটি এখনও রয়েছো—বছর কুড়ি আগে তোমাকে যতো ছোটটি দেখেছিলাম।
বাঃ! আপনার অনুমতি নিতে হবে না?
এতো সংশয় নিয়ে!
সংশয়, দাবি আমি বুঝি না—বুঝি সবার আগে আপনার অনুমতি।
আহিরা বিটিয়া, কয়েকটা জায়গায় অনুমতি অবশ্যই লাগে, আবার কিছু ক্ষেত্রে তার কোনো প্রয়োজন হয় না।
যেমন?
যেমন ধরো, আমি যদি কোনো বাড়িতে যাই নিশ্চয়ই তাদের অনুমতি নিয়েই ঘরে ঢুকবো। কিন্তু তারা যখন আমার সামনে খাবারের প্লেট এগিয়ে দেবে তখনও কি অনুমতি নেওয়ার দরকার আছে? কথাটা শেষ করেই যেশুদাস আর এক প্রস্থ উত্তাল হাসলেন। সাত্যকির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, পাঠশালার ছাত্রীকে বোঝানোর মতো আমি কিনা একজন কলেজের প্রফেসারকে বোঝাচ্ছি। আমার সাহসটা একবার দেখুন! নিন, নিন আর দেরি করবেন না। গাড়িতে উঠুন
ফাঁকা রাস্তা পেয়ে ট্রেকার ছুটছে। সেই সঙ্গে আহিরার মনও ছুটছে। এই মুহূর্তে সে বেশ একটা সঙ্কোচের মধ্যেই পড়ে গেল। স্বাভাবিক ভদ্রতায় যেশুদাস চাচাজির সঙ্গে সাত্যকির পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত। এখন প্রশ্নটা হলো, আলাপ করিয়ে দেবার সময় সে মুখবন্ধে কী বলবে? সাত্যকির সঙ্গে তার বাবারই এখনও পর্যন্ত আলাপ হলো না, বাবা ছেলেটাকে চেনেনই না। উনি শুধু গোপাল মনোহর বালযোগীর খোঁজে কলকাতা থেকে সুমিঠ্ঠাগুরমে এসেছেন এই রকম একটা ভাসা- ভাসা নড়বড়ে সাঁকোর ওপর কাউকে হেঁটে যেতে বলা যায়? অথচ কিছু একটা তো বলতেই হবে। নয়তো নিঃশব্দের প্রহর যদি একবার বাড়তে থাকে তারপর আর কিছুতেই স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসা যাবে না। সুতরাং সময় থাকতে থাকতেই নুয়ে পড়া পরিচয়ের চারা গাছটাকে একটু তরতাজা রাখার চেষ্টা করা যেতে পারে।
ভালো গতিতেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন যেশুদাস। পেছনের আসনে আহিরা এবং সাত্যকি যে ভাবে বসে আছে ওদের মাঝখানে আরও দু’জন অনায়াসেই বসতে পারে। আসলে ওরা দু’জনেই ভেতরে ভেতরে এমন এক ধরনের লজ্জা পাচ্ছে যার কোনো ব্যাখ্যা নেই। অথচ এমনভাবে থাকলে দুরত্ব আরও বহু দূর পর্যন্ত গড়াতে পারে। আহিরা সাত্যকিকে আড় চোখে দেখে নিয়ে যেশুদাসের ওপর চোখ রেখে বললো, চাচাজি আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, ওঁর নাম সাত্যকি মৈত্র। কলকাতা থেকে এসেছেন বাবার কাছে বিশেষ এক কাজে
আমার নাম যেশুদাস রেড্ডি।
সাত্যকি হাতজোড় করে নমস্কার জানালো।
নমস্কার। যেশুদাস মুখে উত্তরটা দিয়ে এক গাল হেসে বলে উঠলেন, আমি কিন্তু ভাই আপনার মতো হাত দুটো জড়ো করতে পারছি না— তেমনটা করলে আমাদের তিনজনেরই স্থান হবে কোডোলম্ হাসপাতালে অথবা একেবারেই ……. আমি না হয় এই পৃথিবীর নিঃশ্বাস অনেকদিন নিয়েছি, এখন চলে গেলেও আফসোস নেই। কিন্তু আপনি, এই আহিরা বিটিয়া—আপনাদের মতো তরতাজা যুবক-যুবতীর সামনে অনেক স্বপ্ন, অনেক আকাঙ্ক্ষা। এই পৃথিবীটাকে আরও সুন্দর করে গড়ে তোলার দায়িত্ব আপনাদেরই। অতএব সাত্যকিজি—যেশুদাস এক পলকে ঘাড়টা ঘুরিয়ে কলকাতার ছেলেটাকে দেখে নিয়েই আবার সামনে পথের ওপর দৃষ্টি রেখে বলে উঠলেন, আপনার সঙ্গে পরে নিশ্চয়ই ভালো করে জমিয়ে গল্প করবো। আপাতত স্টিয়ারিং আমার হাতে। এই সময় বেশি কথা বলা, পেছন ফিরে তাকানোটা ঠিক নয়।
আপনি ঠিকই বলেছেন। সাত্যকি পরিষ্কার বললো, গাড়ি চালাবার সময় কথা বলাটা বিপজ্জনক ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনি এতো স্পষ্ট করে বলাতে আপনাকে আরও ভালো লাগলো।
স্পষ্ট কথায় কষ্ট নেই। কী বলেন? যেশুদাস হাসির মোড়ক খুলে দিলেও সেই যে সামনের রাস্তায় চোখ রেখে গাড়ি ড্রাইভ করে চলেছেন সেই নীতি থেকে কিন্তু সরে গেলেন না।