৩
ঘড়ির কাঁটা এখন চারটের কাছাকাছি। রাজামুন্দ্রি শহরের রামাকৃষ্ণা লজের মাঝারি সাইজের একটা ঘরে শুয়ে সাত্যকি হাজারো চিন্তা করতে করতে রাতটাকে কখন যে ফুরিয়ে ফেললো তা সে নিজেও টের পেল না। ভোর তো হয়েই এলো। লজের সামনের সুদীর্ঘ ইউক্যালিপটাস আর পান্থপাদবের ডানা মেলা উড়ন্ত ভঙ্গিমা আবছা আলোয় ঘোমটা দেওয়া কোনো এক দল দীর্ঘাঙ্গিনীদের মিছিল বলে মনে হয়। এখন বেশ ঠান্ডা বাতাস বইছে। বাতাসে ভেজা-ভেজা ভাব। কোথাও কি বৃষ্টি হচ্ছে? যদিও এখন বৃষ্টির মরসুম নয় তবে প্রকৃতি আর কোনো বাধা ধরা নিয়ম মেনে আজকাল চলে না। সে চলে তার আপন খেয়ালে।
রামেশ্বরের বাস ছাড়বে সেই সকাল ছটায় অর্থাৎ এখনও ঘন্টা দুই দেরি আছে। চুপচাপ শুয়ে থাকা ছাড়া এই মুহূর্তে সাত্যকির অন্য কোনো কাজ নেই। আর শুয়ে থাকা মানেই আর এক প্রস্থ চিন্তা। বাবার মন খারাপের ব্যাপারটা না হয় জানা গেছে। কিন্তু গোপাল মনোহর বালযোগীকে তিনি ঠিক কী জন্য ওই মিথ্যে কেসে জড়িয়েছিলেন সেটা নেপথ্যেই থেকে গেল। নিখিল ওর বেশি আর বলতে চাননি আরও খোলাখুলি ভেঙে বলতে না চাওয়ার কারণটা অবশ্যই লজ্জার। সাত্যকি পরিষ্কারই বুঝতে পারছিল বাবা সঙ্কোচের একটা বেড়াজালের মধ্যে এমনই আটকে রয়েছেন, ছেলের কাছে সেটুকু স্বীকার করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এক একটা অনৈতিক কাজের মধ্যে দিয়ে মানুষ সম্ভবত এমনিভাবেই তলিয়ে যায়। অনেক মেরামত করার পরেও সেই কাজটা বৈধতার ছাড়পত্র পায় না। অথচ ঝড়-ঝাপটার শেষে সব কিছু শান্ত হয়ে যাওয়ার পর সামান্য একটু মান্যতা পাওয়ার জন্য মনটাই কাঙাল হয়ে ওঠে। যাই হোক, ওই অবস্থায় তো বাবাকে আর জেরা করা চলে না। সেটা অত্যন্ত অশোভন ব্যাপার। তা ছাড়া সাত্যকির তেমন শিক্ষাও নয়। বাবা যতোটুকু বলেছেন, তার কর্তব্য হবে সেই মতো কাজ করা। তবে সাত্যকি কিন্তু একটা ব্যাপারে সারাক্ষণই ডুবে রয়েছে। বাবা কেন গোপাল মনোহর বালযোগী, যে কি না তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু— তাঁর সঙ্গেই অমন ব্যবহারটা করতে গেলেন? তাঁর লাভের হিসেবটা কী? বালযোগীকে ওইভাবে সরিয়ে দিয়ে মানে চাকরি থেকেই বরখাস্ত করে তিনি কী পেতে চেয়েছিলেন? সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর অনুক্তই রয়ে গেল। বাবার এইভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পুরোপুরি ভেঙে পড়া, অনুশোচনায় দগ্ধ হওয়ার মধ্যেই তো পরিষ্কার গোপাল মনোহর বালযোগী নামের মানুষটা সম্পূর্ণ নির্দোষ। আর ঠিক এই জায়গাতেই সাত্যকির খারাপ লাগছে। তার বাবা কেন এই নীচ ধরনের কাজটা করলেন? অবশ্য সান্ত্বনাও রয়েছে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তার বাবা বলেই নিজের অপরাধ কবুল করলেন। জীবনের বাকি দিন কটা বাবা অবশ্যই চেপে যেতে পারতেন। থাকতে পারতেন হাত ধুয়ে যে ভাবে এতো দিন ছিলেন। কিন্তু তিনি নিখিল মৈত্র। উদার এবং বিরাট হৃদয়ের মানুষটা মানুষের মতোই কাজ করলেন। তা ছাড়া এটা তো ঠিক, একটা লোককে তার সারা জীবনের কাজের সঠিক মূল্যায়ন না করে শুধুমাত্র একটা—একটাই ভুল বা অন্যায় কাজের ফলে তাঁকে দাগী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়? বাবাকে সমর্থন করার মানসিকতা নিয়ে সাত্যকি কিছুমাত্র সাফাই গাইছে না। সে শুধু নিজের মনের কাছে পরিষ্কার থাকতে চাইছে, বাবা একটা দূষিত কাজ করে ফেলেছেন বটে তবে মানুষটা বড়ো মায়াবী!
বাস ছুটে চলেছে তো চলেছেই। সাত্যকির এখন একমাত্র চিন্তা বাবার মন খারাপের ওই মানুষটাকে খুঁজে পেতেই হবে। সুমিঠ্ঠাগুরমে গিয়ে যদি শোনে গোপাল মনোহর বালযোগী ওখানেও নেই, তা হলে সাত্যকি অফিসের ছুটি আরও বাড়াবে। আরও দৌড়ঝাঁপ করেও ওই বালযোগীকে বের করতেই হবে। বাবা বিন্দুমাত্র শান্তি পাচ্ছেন না—এই ব্যাপারটাই সাত্যকিকে অস্থির করে তুলছে। ওর এই মুহূর্তে একটাই প্রার্থনা, সুমিঠ্ঠাগুরমে পৌঁছে যেন আর নিরাশ হতে না হয়। আর একটা প্রার্থনাও সাত্যকির সারা মন জুড়ে, মানুষটা যেন বেঁচে থাকেন।
.
লাক্সারি এক্সপ্রেস বাসের আরামদায়ক আসনে বসে সাত্যকি তার চোখ দুটোকে বাইরের দু’পাশে ছড়িয়ে দিল। মাঝে মাঝে দু’একটা করে গ্রাম দেখা যাচ্ছে। তারপরেই আবার জমির পর জমি। চাষীরা মাঠে কাজ করছে। জোয়ারি, কাঁচালঙ্কা এবং তামাক পাতার চাষই খুব বেশি করে চোখে পড়ছে। দূরে, বহু দূরে সেই আকাশের গায়ে গা লাগিয়ে পাহাড়ের সারি এঁকেবেঁকে সেই নিঃসীম আকাশের নীল চাদরের মধ্যেই মুখ লুকিয়ে রেখেছে। দূরে দেখা যাচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। চমৎকার সবুজ নির্জনতার মধ্যে দিয়ে এক্সপ্রেস বাসটা যেন চকচকে একটা সুদীর্ঘ কালো কাপড়ের জট ছাড়াতে ছাড়াতে চলেছে।
একটানা অনেকক্ষণ প্রায় বোবা হয়েই চলার পর সাত্যকির হঠাৎ একটু কথা বলার ইচ্ছে হলো। ভাষা একটা সমস্যা বটে তবে সেটা কখনওই বিরাট একটা বাধা নয়। বাংলা এখানে চলবে না। চলার প্রশ্নই ওঠে না। এখানকার মাতৃভাষা তেলুগু হলেও ইংরেজি এবং হিন্দী ভাষাও সাধারণভাবে কথাবার্তা মতামত ইত্যাদি আদান-প্রদানের অন্যতম মাধ্যম।
সাত্যকির পাশে এক বুড়ো বসে আছেন। একাত্তর-বাহাত্তর বছর বয়স হবে। সারা মুখে ছোটদের এক্কা-দোক্কার ঘর কাটার মতো অসংখ্য রেখা। মাথায় সাদা কাপড়ের বড়ো ধরনের একটা পাগড়ি। কানে মাকড়ি। পরনের পোশাকটা সামান্য একটু ময়লা। দেখলেই বোঝা যায় গ্রামের দেহাতি মানুষ। এবং দেহাতি মানুষদের শরীর থেকে যে একটা বুনো গন্ধ পাওয়া যায় সাত্যকি সেটা পুরোপুরিই পাচ্ছে। ওই গন্ধটাই যেন শহর আর গ্রামকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রেখেছে। সত্যি কথাটা হলো, সাত্যকির কিন্তু খারাপ লাগছিল না। সে বুড়োকে জিজ্ঞেস করলো, আপনার নাম কী?
বুড়ো সাত্যকির মুখের দিকে তাকিয়ে উল্টে প্রশ্ন করলেন, আপনার নাম কী? আমার নাম সাত্যকি মৈত্র।
সামান্য একটু হেসে বুড়ো উত্তর দিলেন, আমি মুনিয়াপ্পা নাইডু।
আপনি কতো দূর যাবেন? সাত্যকি দ্বিতীয় প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গেই মুনিয়াপ্পা অম্লানকন্ঠে জানতে চাইলেন, আপনার যাওয়ার ঠিকানাটা কী?
আমি সুমিঠ্ঠাগুরম পর্যন্ত যাবো।
আমি যাবো রামেশ্বরম। মুনিয়াপ্পা সহজ সুরে বললেন, এই বাসটা ওই পর্যন্তই যাবে।
আপনার বাড়ি কি ওখানেই?
বুড়ো মিটমিটি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়ি কোথায়?
সাত্যকি হেসে ফেললো। বললো, কলকাতায়। এখানে একটা কাজে এসেছি।
আমার বাড়ি রামেশ্বরমেই। কোট্টাই গ্রামে। আমিও রাজামুন্দ্রি শহরে একটা কাজে এসেছিলাম।
সাত্যকি চতুর্থ প্রশ্নটা করতে যাচ্ছিলো, আপনি কী একা একাই পথে বেরিয়েছেন, না কি সঙ্গে আরও কেউ আছেন? কিন্তু করলো না। মুনিয়াপ্পা নাইডু নামের ওই বাহাত্তরের বুড়ো মানুষটার স্বভাবটাই হলো পাল্টা প্রশ্ন করা। অন্তত তাঁর ঝোঁক যে ওই দিকেই বেশি, তিনটে মাত্র জিজ্ঞাসার মধ্যেই সেটি প্রকাশ পেয়েছে। সুতরাং অপরেরটা আগে শুনে নিজেরটা পরে বলাতেই যখন তাঁর আগ্রহ, সেই হিসেব মতোই সাত্যকি বললো, আমি একা একাই পথে বেরিয়ে পড়েছি, আপনিও কি তাই?
বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধ মানুষ মুনিয়াপ্পা নাইডু হঠাৎ হেসে ফেললেন। তাঁর সেই হাসিটা বড়ো নির্মল আর বড়ো বেশি পবিত্র মনে হওয়ার দরুন সাত্যকি ওঁর মুখের দিকে এক মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়েই রইলো। মুনিয়াপ্পা বললেন, তোমার প্রশ্ন করার মধ্যে বেশ এক ধরনের ছেলেমানুষি মিশে রয়েছে। বিলকুল আমার নাতির মতো।
তা বয়সের দিক দিয়ে আমি তো আপনার কাছে ছেলেমানুষই।
.
আমি সে হিসেব করে কিছু বলছি না। মুনিয়াপ্পা অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন, আমার নাতির নাম যোহানন। তোমারই সমবয়সী। ছোটবেলা থেকেই ওর কথা বলার ধরন তোমার মতো।
যথা? সাত্যকি একরাশ কৌতুক নিয়ে বুড়োকে দৃষ্টির ফ্রেমে আটকে রাখলো।
যথা? মুনিয়াপ্পা চমৎকার এক হাসির ফোয়ারা ছড়িয়ে বললেন, যেমন ধরো, যোহাননের খাবার ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু সরাসরি সে সেকথা বলবে না। বলবে দাদাজি, তোমার খিদে টিদে পায়নি? আমার তো পেয়েছে। একটু থেমে মুনিয়াপ্পা আরও বললেন, তুমি অবশ্য আগে আগেই তোমার কথাটা জানিয়ে দিয়েছো। তা একা একা কলকাতা থেকে এই রাজামুন্দ্রিতে এসে এখন আবার সুমিঠ্ঠাগুরম কেন?
আমি ওখানে একজনের বাড়িতে যাচ্ছি।
এর আগে আমাদের এদিকে তুমি এসেছো কখনো?
এই প্রথম
সে তোমার ছেলেমানুষি ছটফটানি দেখেই বুঝেছি। মুনিয়াপ্পা অভিজ্ঞতার পাহাড়ে বসে পরম দার্শনিকের মতো উত্তর দিলেন, বাইরে বেরিয়ে অপরিচিত লোককে প্রথমে দেখো, একটু চেনার চেষ্টা করো। তারপর তো তার নামধাম জানতে চাইবে। প্রথমেই নাম জিজ্ঞেস করলে নানারকম সন্দেহ দেখা দিতে পারে। সফরকে কখনওই জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে রেখো না। আসলে তোমরা আজকাল ছেলেরা একটুও ধৈর্য ধরতে পারো না। মুহূর্তে সব কিছুকে কাছে পেতে চাও।
মুনিয়াপ্পার উপদেশটা মৃদু হেসে সাত্যকি নীরবেই মাথা পেতে মেনে নিল। সত্যিই তো এতো অস্থিরতা, সম্পর্কহীনতার মধ্যে পথে বেশি খোলামেলা হওয়াও তো ঠিক নয়। ভবিষ্যতে বৃদ্ধের উপদেশটা কাজে লাগাবে। সাত্যকি জানতে চাইলো সুমিঠ্ঠাগুরম পৌঁছাতে কতো সময় লাগবে?
পুরো পাঁচ ঘন্টা।
মানে এখনও পাঁচ ঘন্টা?
না তা নয়। রাজামুন্দ্রি থেকে বাস যদি পথে কোনো বেগরবাই না করে তা হলে সাধারণত পাঁচ ঘন্টা সময়ই লাগে।
আর আপনার রামেশ্বরম?
সাড়ে পাঁচ ঘন্টা।
তার মানে সুমিঠ্ঠাগুরম থেকে বাসে রামেশ্বরম আধ ঘন্টার পথ। সাত্যকি আসলে যেখানে যাচ্ছে তার চারপাশের ছবিটাও একটু আগেভাগে জেনে নিয়ে জায়গাগুলোর দূরত্বের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠতে চাইছে।
মুনিয়াপ্পা শুভ্র হেসে বললেন, হিসেবে তাই-ই বলছে।
আচ্ছা, সাত্যকি কী যেন ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞেস করে বসলো, রামেশ্বরম কী শহর না কি…..
আরে বেটে রামেশ্বরম বড়ো শহর। মুনিয়াপ্পা নাইডু হাসতে হাসতে বললেন, স্কুল-কলেজ, মন্দির, চার্চ, মসজিদ, গাদাগুচ্ছের সিনেমা হল, ব্যবসা-বাণিজ্য, কোর্ট- কাছারি কী নেই সেখানে? শুধু ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরেই পূজো দেবার জন্য প্রতি দিন হাজারে হাজারে লোক আসে। ফলে প্রচুর হোটেল, লজ, ধর্মশালা, আরও কতো কী?
.
সামনেই সুমিঠ্ঠাগুরম। সাত্যকি তার আসন থেকে উঠে দাঁড়াতেই মুনিয়াপ্পা অশেষ এক স্নেহ নিয়ে হঠাৎ বললেন, এখানকার কাজ শেষ হলে রামেশ্বরমে ভেঙ্কটেশ্বর মন্দির আর রামজি-সীতা মাঈয়া কি মন্দির দেখতে একবার আসতে পারো। কাছেই কোট্টাই গ্রামে মুনিয়াপ্পা নাইডুর নাম বললে কেউ তোমাকে বাড়ি না দেখিয়ে অন্য পথ দেখাবে না।
একঝলক তাজা বাতাসের মতো আন্তরিকতার এমন এক স্পর্শ পেয়ে সাত্যকি সত্যিই অভিভুত হয়ে পড়লো। পথের কষ্ট বোধহয় এই সব কারণেই মাঝে মাঝে এমনই মধুর হয়ে ওঠে। হয়তো ওই বুড়ো মানুষটার সঙ্গে আর কখনওই তার দেখা হবে না। তবুও যেন ওঁকেই নিজের লোক বলে মনে হয়। এটাই বোধহয় বিদায়বেলার ধর্ম।
লাক্সারি এক্সপ্রেস বাসটা সাত্যকিকে সুমিঠ্ঠাগুরমে নামিয়ে দিয়ে যেন সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে চিরদিনের মতো চলে গেল। সাত্যকি নীরবে চারপাশের ওপর চোখ দুটিকে একবার ঘুরিয়ে নিল। সাধারণ মানের কয়েকটা দোকান-পসার থাকলেও সুমিঠ্ঠাগুরম মূলত একটা গ্রাম। পাহাড় আর পাহাড়ের কোলে সবুজ অরণ্যের ছায়া মেখে সুমিঠ্ঠাগুরমের ঘর-বাড়িগুলো যেন শিল্পীর আঁকা ছবি হয়ে নীল আকাশের ফ্রেমে টাঙানো রয়েছে। নিচু হাইটের মাটির দেওয়াল। উপরে তালপাতার ছাউনি। ছোট ছোট জানালাগুলো দেওয়ালের উপরের দিকেই বসানো। কয়েকটা বাড়ির দরজার আকৃতি এবং এমনভাবে বসানো যে প্রায় হামাগুড়ি দিয়েই ভেতরে ঢুকতে হয়। কিছু কিছু বাড়ি রয়েছে সেগুলো আবার ইটের। উপরে খাপরা টালির চাল।
সাত্যকি গ্রামের কাঁচা লাল সুরকির পথ ধরে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দেখলো ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা হইহই করে খুব মজা করতে করতে কী যেন একটা খেলা খেলছে। সাত্যকি ওদের কিছু জিজ্ঞেস করলো না। আসলে ওদেরকে জিজ্ঞেস করে খেলার ছন্দ নষ্ট করতে চাইলো না। একটা গরুর গাড়িতে তামাকপাতার পাহাড় চাপিয়ে ‘হ্যাট-হ্যাট’ করতে করতে একজন মধ্যবয়সী লোক এদিকেই আসছে। সাত্যকি বালযোগীর নাম জিজ্ঞাসা করতেই সে একটু বিরক্ত হয়েই উত্তর দিল, ডাকঘরমে যাইয়ে। আউর উহা পর পুছতাছ কিজিয়ে। বিরাট গোঁফওয়ালা লোকটা আর একটিও শব্দ ব্যয় না করে তার গাড়ির বলদ দুটোকে সঠিক রাস্তায় নিয়ে যাবার জন্য নতুন করে আবার ‘হ্যাট-হ্যাট’ করতে লাগলো।
লোকটা কী রাগারাগী করেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছে? সাত্যকি ভেবে পেল না তার ওই সামান্য নিরীহ একটা প্রশ্নের উত্তরে অতো উষ্মা ছড়িয়ে মানুষটা বদমেজাজী হয়ে উঠলো কেন? সাংসারিক অশান্তি? হতে পারে। তাই বলে সেটা কী তারই ওপর ফলাতে হবে? পথে এই ধরনের মানুষদের সঙ্গেই ছোটখাটো ব্যাপারেও গোলমাল বেধে যায়। ওই আস্ফালন, ওই মেজাজ কে সহ্য করবে? অবশ্য সাত্যকি পারে। সে হাসি মুখে অনেক কিছুই সহ্য করতে পারে।
সামনেই একটা চমৎকার পুকুর। ওটাকে অবশ্য পুকুর না বলে দিঘি বলাই উচিত। পাশাপাশি দুটো ঘাটে গ্রামের ছেলেরা, মেয়েরা স্নান করছে। সার্বজনীন আত্মীয়তার এক দারুণ জায়গা। অথবা সমগ্র গ্রামের দর্পণও বলা যায়। এখানে একবার খোঁজ করা যেতে পারে গোপাল মনোহর বালযোগীর।
কাঁধে একটা গামছা এবং পরনের লুঙ্গিটাকে দু’ভাজ করে গিঁট বেঁধে গুড়াকু দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে বছর আঠারো, উনিশের একটা ছেলে এদিকেই আসছিল। সাত্যকি পায়ে-পায়ে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমি গোপাল মনোহর বালযোগীর বাড়িটা খুঁজছি। তুমি কী
গোপাল মনোহর বালযোগী … ছেলেটা বিড়বিড় করে উচ্চারণ করতে করতে বলে ফেললো, দেখুন, এই গ্রামে দু’জন গোপাল মনোহর বালযোগী আছেন— আপনি কার বাড়িতে যাবেন তা তো আচ্ছা, ওঁর মেয়ে কী আনেক্কাপল্লীর স্টিফেন গার্লস কলেজের অধ্যাপিকা?
তা তো ভাই কিছু বলতে পারবো না।
উনি কী করেন সেটা তো বলতে পারবেন— ছেলেটা দাঁত মাজা থামিয়ে দিয়েছে।
তাও বলতে পারবো না। সাত্যকির দুই ঠোঁটে অসহায়ের হাসি।
আপনি তা হলে এক কাজ করুন, গুড়াকু-ছেলেটা সহজ ভঙ্গিতেই বলে উঠলো, আপনি ওই বাড়িতে গিয়েই প্রথমে একবার খোঁজ করুন। এখান থেকে এই রাস্তাটা ধরে আপনি সোজা মিনিট সাতেক চলে যাবেন। তিন রাস্তার একটা মোড় পড়বে। ডানদিকের রাস্তা ধরে উত্তর দিকে কিছুটা যাবার পর আবার বাঁ দিকে ঘুরবেন। কয়েক পা এগোলেই দেখবেন ইটের দেওয়াল, বড়ো টালির ছাদ দেওয়া একটা বাড়ি। ওখানে ওই একটাই ইটের দেওয়ালের বাড়ি। উঠোনে দেখবেন বেশ বড়ো একটা ইমলি গাছ। দেখুন গিয়ে যদি ওটাই হয়……
ছেলেটাকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে সাত্যকি হাতঘড়িতে সময়টা একবার দেখে নিয়ে বালযোগীর বাড়ির পথ ধরলো। এখন বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি। ওর চিন্তা হলো এই সময়ে মানুষটাকে বাড়িতে পাওয়া যাবে তো? গোপাল মনোহর বালযোগী এখন কী করেন না করেন ইত্যাদি তার কিছুই জানা নেই। অবশ্য এই মুহূর্তে তাঁকে না পেলেও সাত্যকিকে তো অপেক্ষা করতেই হবে। এখন সবচেয়ে জরুরি ব্যাপারটা হলো, ওই তেঁতুলগাছের ছায়ার নীচের টালির ছাউনি দেওয়া পাকা বাড়িটাই যেন বালযোগীর হয়—যে বালযোগী তার বাবার বন্ধু। নতুবা এই খর রোদের মধ্যে আবার নতুন করে হাতড়ে বেড়াতে হবে।
.
নির্দিষ্ট বাড়িটার সামনে গিয়ে সাত্যকি একটু থমকে দাঁড়ালো। তারই সমবয়সী একটি সুঠাম স্বাস্থ্যের দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে এখানকার অভ্যস্ত পোশাকে অর্থাৎ কি না ঘাগরা, ব্লাউজ এবং বুকের ওপর দিয়ে একটা উড়নি ঘুরিয়ে কোমরে গুঁজে ঝাঁটা হাতে সারা উঠোনের পাতা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। এক ঢাল কাজল-কালো চুল বাঁধ- ভাঙা বন্যার মতো পিঠ ছাপিয়ে, কোমর ছাপিয়ে নীচে নেমে গেছে। নাকের পাটার খাঁজে ছোট্ট একটা দুধ সাদা পাথরের নাকছাবি যেন গেঁথে বসে আছে। চোখ দুটো দিঘির মতোই টানা এবং পর্যাপ্ত এক গভীরতায় এতোই শান্ত যা প্রথম দর্শনেই ভালো লাগে, মানে খুব ভালো লাগে। গায়ের রংটা মোটেও ফর্সা নয়। শ্যামবর্ণা। তবে ওর মুখের ত্বক এতো উজ্জ্বল আভায় মসৃণ যে মেয়েটি গৌরবর্ণা না শ্যামবর্ণা ওসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো ব্যাপারই নেই। বস্তুত সাত্যকির তো মনে হলো, মেয়েটির রং চাপা বলেই ওকে এতো আকর্ষণীয়া লাগছে। ডিম্বাকৃতি ধরনের মুখে গাল দুটো ঈষৎ ফোলা ফোলা, যা কি না মেয়েটির গড়নের সঙ্গে ওকে আর এক মাত্রা সৌন্দর্য অতিরিক্তভাবে ঘিরে রেখেছে।
সাত্যকি এ বারে মনে মনে একটু হেসে নিজেই নিজেকে ধমকালো। এতো নিখুঁতভাবে লাবণ্যময়ীকে দেখার কী আছে? সে কী পাত্রী দেখতে এসেছে নাকি ‘চলো দেবী কলকাতা’ বলে গাঁটছড়া বাঁধতে এসেছে? এটা যদি সত্যি সত্যিই গোপাল মনোহর বালযোগীর বাড়ি না হয় তা হলে তো তাকে এই মুহূর্তে দ্বিতীয় গোপাল মনোহরের বাড়ি খুঁজে বার করতে হবে। তখন কোথায় থাকবে ওই শ্রীময়ী? যদিও মেয়েটিকে চট করে ভোলা সম্ভব নয়। বেশ কিছুদিন স্মৃতির স্মরণিতে জেগে থাকবে। তবুও…… তবুও সাত্যকির আসল উদ্দেশ্য তার বাবার ক্ষতে শান্তির প্রলেপ লাগাতে আগে ওই গোপাল মনোহর বালযোগীকেই খুঁজে পাওয়া চাই। অতএব নিজের আঙিনায় নিজের মতো থাক সুমিঠ্ঠাগুরম সুন্দরী।
সাত্যকি উঠোনের কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই মেয়েটি হাতের ঝাঁটাটা মাটিতে নামিয়ে রেখে উড়নি দিয়ে গালের দু’পাশ এবং গলার ঘাম মুছে নিয়ে অত্যন্ত শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?
এটা কি গোপাল মনোহর বালযোগীর বাড়ি?
মেয়েটি তার ধারালো চিবুকটা বুকের কাছে নামিয়ে নীরবে জানালো, হ্যাঁ। সাত্যকির মনের ভেতরে—মানে পরিশ্রমের পুরস্কার পাওয়ার পর সাফল্যের যে হাসিটা সমস্ত মন-প্রাণকে ভিজিয়ে রাখে, সাত্যকির মনের ভেতরে এখন সেই রকমেরই এক শীতল বাতাস। কলকাতা থেকে এতো দূরে এসে দু’দফায় খোঁজ করতে করতে শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই গোপাল মনোহর বালযোগীই কী বাবার বন্ধু? ভুল করে যদি এটা অন্য আর এক বালযোগীর বাড়ি হয় তা হলে আবার পরিশ্রমের অর্থাৎ নতুন করে নতুন উদ্যমে পরিশ্রমের কষ্টটুকুকে স্বীকার করে নিতে হবে। সাত্যকি একটু বেশি রকমের নিশ্চিন্ত হতে চাইলো। মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে এক পলক কী যেন একটু ভাবলো। তারপরে নিচু সুরে জিজ্ঞেস করলো, গোপাল মনোহর বালযোগী কি আগে বিজয়ওয়াড়ার পট্টভিনগরে থাকতেন? মানে ওখান থেকেই কি তিনি এই সুমিঠ্ঠাগুরমে চলে এসেছেন?
হ্যাঁ। লাবণ্যময়ী আবার তার চিবুক বুকের সঙ্গে মিশিয়ে দিল।
আমি কলকাতা থেকে ওঁর খোঁজেই এখানে এসেছি। সাত্যকি অস্ফুট সুরে বললো, ওঁকে একটু ডেকে দেবেন?
বাবা তো বাড়ি নেই। শ্রীময়ী ধীরস্থির এক শান্ত গলায় উত্তর দিল, উনি ব্যবসার কাজে রাজামুন্দ্রি, শাহবাগ গিয়েছেন। কালকে অথবা পরশুদিন ফিরবেন। কিন্তু কলকাতা থেকে এসেছেন আপনি………….বলতে বলতে শ্রীময়ী থেমে পড়লো। একটু চিন্তিত মুখে পরে বললো, আপনি ভেতরে এসে বসুন।
কার সঙ্গে কথা বলছিস রে আহিরা? উঠোনের লাগোয়া ছোট্ট একটা ঘর থেকে যে মহিলাটি বেরিয়ে একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালেন তাঁর বয়স তিপ্পান্ন-চুয়ান্ন হবে। একেবারে তার মায়ের বয়সী। দোহারা গড়ন। গায়ের রং ময়লাই বলা চলে। নাকের দু’পাশেই দুটো বড়ো আকারের নাকছাবি। গলায় কালো কারের মঙ্গলসূত্র। ওই দেশীয় ঢঙে একটি গাঢ় নীল রংয়ের শাড়ি তাঁর পরনে। সব মিলিয়ে একজন গ্রাম্য সাদাসিধে মহিলা।
আহিরা নামের আকর্ষণীয়া মেয়েটি এ বারে সাত্যকির দিকে এক ঝলক তাকালো। ছোট্ট সুরে বললো, আমার মা।
কথাটা কানে গেলেও সাত্যকির চিন্তা-ভাবনা এই মুহূর্তে অন্য দিকে বইতে লাগলো। জি, এম, বালযোগী বাড়িতে নেই। কাল অথবা পরশু যেদিনই উনি ওই রাজামুন্দ্রি, শাহবাগ থেকে ফিরে আসুন না কেন এই দীর্ঘ সময়টা সে কী করবে? এখানে কোনো হোটেল বা ধরমশালা নেই। স্রেফ একটা দেহাতি গ্রাম এই সুমিঠ্ঠাগুরম যা কি না অতিরিক্ত তামাক পাতার চাষ ও ফলনের জন্যই বেশি বিখ্যাত। সেখানে কী করবে সাত্যকি? গাছতলায় দাঁড়ানো ছাড়া সত্যিই তো দ্বিতীয় আর কোনো পথ নেই। সাত্যকি নিজের ব্যক্তিগত দুশ্চিন্তা ছেড়ে ভদ্রতার জগতে ফিরে এলো। আহিরা যখন জানিয়েছে ওই মহিলাটি তার মা অর্থাৎ গোপাল মনোহর বালযোগীর স্ত্রী, সুতরাং ওঁকে সৌজন্যের খাতিরে একটা প্রণাম করতেই হবে। যেহেতু থাকার সুরাহার ব্যাপারে সাত্যকি খুবই চিন্তিত, তাই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম ট্রনাম করার বিশেষ একটা উৎসাহ পেল না। হাত জোড় করে শুধু বললো, নমস্কার মাতাজি।
আহিরার মা মন্দাকিনী মৌখিক ওই নমস্কারটুকু সানন্দে গ্রহণ করলেন বটে তবে গভীর আন্তরিকতার সঙ্গে উচ্চারিত অমন ‘মাতাজি’ ডাক শুনে একেবারে অভিভূত হয়ে পড়লেন। মৃদু হেসে বলে উঠলেন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী কথা হয়? ভেতরে এসে বসো। স্বাভাবিক ভদ্রতাবোধেই মন্দাকিনী ওই কথাগুলো বললেন। নয়তো এই ছেলেটি কে, কোথা থেকে এসেছে, ওর পরিচয়ই বা কী ইত্যাদি কিছুই তিনি জানেন না। ছেলেটিকে এর আগে কখনও দেখেছেন বলেও মনে হলো না। খুব সম্ভবত ও এখানকারই নয়। অবশ্য ওতে কিছু এসে যায় না। বেলা বারোটার সময় অর্থাৎ কিনা এই ভরদুপুরে রোদ মাথায় করে একটা ছেলে ঠায় উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবে এতে কী বাড়ির মঙ্গল হয় না মর্যাদা বাড়ে? তা ছাড়া শিষ্টাচার বলেও তো একটা কথা আছে। সেই কারণেই ওকে আপ্যায়ন করা।
সাত্যকি কিন্তু চমৎকার একটা বুদ্ধির পরিচয় দিল। বাড়ির প্রশস্ত বারান্দায় বেতের একটা মোড়ায় বসে সে মন্দাকিনীকে কোনোরকম প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে নিজে থেকেই মোটামুটি নিজের সম্পর্কে জানালো। নিখিল যে বালযোগীকে একদিন মিথ্যে বদনাম দিয়ে চাকরি থেকে তাড়িয়েছেন সেটাই বললো না। এই মুহূর্তে সেটা বলাও যায় না। শুধু বললো, আমার বাবা বিশেষ একটা কারণে আমাকে গোপাল মনোহর বালযোগীর কাছে পাঠিয়েছেন। ওঁর সঙ্গে দেখা হওয়াটা খুবই জরুরি।
ও। মন্দাকিনী ছোট্ট শব্দটা করেই ভাবনার স্তর পেরোতে কিছুটা সময় নিলেন। পরে আমতা-আমতা করে বললেন, কিন্তু কলকাতায় ওঁর কোনো বন্ধু আছে বলে তো কখনও শুনিনি।
গোপাল মনোহর বালযোগী যখন কলকাতায় চাকরি করতেন ……
কী বললে? বিস্ময়ে ভেঙ্গে পড়লেন মন্দাকিনী। উনি কলকাতায় চাকরি করতেন?
অবশ্যই। সাত্যকি অবিচলকণ্ঠে উত্তর দিল, আমার বাবার সঙ্গেই উনি চাকরি করতেন। গভীর বন্ধুত্ব ছিল দু’জনের।
তোমার কোথাও ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো?
আপাতত তেমন কিছু মনে হচ্ছে না।
আসলে কলকাতায় ওঁর চাকরি করার কথা…….. এই আঠাশ, তিরিশ বছরের মধ্যে কই কোনোদিন তো শুনিনি। মন্দাকিনী বিহ্বল দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে অজানা এক দ্বীপে পা রাখার চেষ্টা করলেন, আমাকে তো আজ পর্যন্ত কিছু বলেননি। ‘কলকাতা’ শব্দটাই ওঁর মুখে উচ্চারিত হয়নি। তোকেও কী কোনোদিন কিছু বলেছে?
না তো। আহিরা নামের তরতাজা মেয়েটি ওর ভ্রু দুটোকে সামান্য ভাঁজ করে চিন্তার দেওয়াল তুলে চলেছে সেটা বোঝা গেল। মা’কে দেখতে দেখতে সাত্যকিকেও একবার দেখে নিল। আচ্ছা, কোথাও একটা গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে না তো? কোথাও না কোথাও নিঃশব্দে একটা ভুল অবশ্যই হচ্ছে। নয়তো বাবা একসময়ে কলকাতায় চাকরি করতেন, এই খবরটা তারা কেউই জানে না। এটা কী সম্ভব? যদি তাই হয়, এর মানেটা তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে? দাঁড়াচ্ছে, বাবা ইচ্ছে করেই তাদেরকে কিছু জানায়নি। কিন্তু কেন এই নেপথ্যে থাকার, নিজেকে সম্পূর্ণভাবে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা? কী এমন কারণ থাকতে পারে যা কি না নিজের স্ত্রী, নিজের মেয়েকেও বলা যায় না। বলা যেতে পারে না। অন্তত স্ত্রীর কাছেও নিজেকে মেলে ধরা গেল না? মনের তলদেশে এইভাবে পাথর চাপা দিয়ে কোন ঘটনাকে ভুলে থাকতে চাইছেন বাবা, আহিরা সেটা কিছুতেই ভেবে পেল না। হঠাৎ তার ধারণা হলো, সাত্যকি নামের ছেলেটি যে গোপাল মনোহর বালযোগীকে খুঁজতে এসেছে তিনি নিশ্চয়ই অন্য কেউ। কিছুতেই তার বাবা হতে পারে না। তবে…… আহিরার চিন্তার স্রোত এ বারে একটু অন্য দিকে মোড় নিল। এই পর্যন্ত নাম ছাড়া কিন্তু আরও একটা জিনিসেরও মিল পাওয়া যাচ্ছে। যেটাকে কোনক্রমেই অবহেলা বা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তা হলো, তারা যে আগে বিজয়ওয়াড়ার পট্টভিনগরে থাকতো সেটা তো সঠিক। এটাকে তো অস্বীকার করা যাচ্ছে না। তা হলে?
আহিরা ক্রমাগত ভাবনার এক পর্যায় থেকে আর এক পর্যায়ে ডুবে যেতে যেতে নতুন করে আর একটা প্রশ্ন করলো, আচ্ছা, আপনি কি আমার বাবাকে এর আগে দেখেছেন?
না।
ফটো দেখালে কি ……..
তাতেও কোনো সমাধান হবে না। আহিরাকে মাঝপথে থামিয়ে সাত্যকি সত্যি কথাটাই বলে ফেললো, আসলে আমাদের বাড়িতেও তাঁর কোনো ছবি নেই। আমি শুধু আমার বাবার কাছে ওঁর গল্পই শুনেছি।
বেলা বেড়েই চলেছে দেখে মন্দাকিনী হঠাৎ মেয়ের কানে কানে চাপা সুরে যে নির্দেশ দিলেন তার মানেটা হলো, যাকে খুঁজতে এসেছে সেই মানুষটা আমাদের বাড়ির হোক অথবা অন্য কোনো লোক হোক সেটা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। এই ছেলেটা তো সেই কলকাতা থেকে বিজয়ওয়াড়া হয়ে আবার এই সুমিঠ্ঠাগুরমে ছুটে এসেছে, সুতরাং সবার আগে এই মুহূর্তে ওর যেটা প্রয়োজন তা হলো একটু জলখাবার। আহিরাকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে মন্দাকিনী তাই প্রাথমিক কাজটা সেরে ফেললেন। পরে সাত্যকির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন, যার খোঁজে তুমি এসেছো সেই বালযোগীর ছেলেমেয়ে, স্ত্রীর ব্যাপারে তোমার বাবা কী কিছু বলেছেন?
.
বাবা সে সব কিছুই বলেননি। তাঁর মুখে শুধুই বালযোগী।
আসলে বেটে আমি হিসেব মেলাতে চাইছি। মন্দাকিনী সস্নেহে বললেন, তুমি তো ওই একটা নাম ছাড়া দ্বিতীয় আর কিছুই বলতে পারছো না। তোমাকে তাই জিজ্ঞেস করেও কোনো লাভ নেই। এখন অসুবিধেটা হয়েছে ওঁর ফিরতে ফিরতে কাল অথবা পরশু। তোমাকে ওই পর্যন্ত তো অপেক্ষা করতে হবে।
বাস থেকে সুমিঠ্ঠাগুরমে নেমে সাত্যকি অবশ্যই জানতো না যে আজ বালযোগীর দেখা পাওয়া যাবে না। তবুও নতুন এক জায়গায় এসে স্বাভাবিক মনোভাব নিয়েই সে আস্তানা-টাস্তানার খোঁজে চারপাশে চোখ বুলিয়েছিল। তেমন কিছুই নজরে পড়েনি। সাত্যকি অবশ্য একটা খোঁজ পেয়েছে। কিন্তু সুমিঠ্ঠাগুরম ছাড়িয়ে অনন্তপুরমে যে ওয়াটার প্ল্যান্টের গেস্ট হাউস রয়েছে সেখানে আবার বাইরের কাউকে রাখার নিয়ম নেই। ফলে এখন যে মুহূর্তে মন্দাকিনী বললেন, ‘তোমাকে ওই পর্যন্ত তো অপেক্ষা করতেই হবে’ ঠিক তখনই আবার আশ্রয়ের ব্যাপারটা নিয়ে সে মাথা ঘামাতে শুরু করে দিল। এবং মুহূর্তে সমাধানও করে ফেললো। বালযোগী ফিরবেন কাল অথবা পরশু। সাত্যকি সেই রাজামুন্দ্রিতেই ফিরে গিয়ে রামাকৃষ্ণা লজে ওই সময়টা কাটিয়ে পরশুদিনই এখানে আবার চলে আসবে। সুতরাং অতিরিক্ত চিন্তা-ভাবনার কিছু নেই। জার্নির ধকলটা একটু নিতে হবে এই যা। আর টাকা-পয়সা? অতিরিক্ত খরচের ব্যাপারটা তার মনের কোনো স্তরেই নেই।
সাত্যকি বললো, আমি তা হলে আসি। পরশুদিনই আসবো। আর মিঃ বালযোগী রাজামুন্দ্রির কোথায় আছেন সেটা যদি অনুগ্রহ করে বলেন তো আমি না হয় সেখানেই একবার খোঁজ করে দেখতে পারি।
প্রথম কথাটা হলো, আমাদের তামাকপাতা আর কাঁচালঙ্কার ব্যবসা আছে। মন্দাকিনী মৃদু হেসে পরিষ্কার উত্তর দিলেন, উনি সেই ব্যবসার খাতিরেই রাজামুন্দ্রি গিয়েছেন। এখন কোথায় কোথায় থাকবেন, না-থাকবেন অথবা ওখান থেকে শাহবাগ ও আরও অন্য কোথাও যাবেন কি না কিছুই জানি না। এই অবস্থায় তোমাকে কী বলি বলো তো? তারপরেই অনুযোগের সুরে বলে উঠলেন, আর তুমি এখনই চলে যেতে চাইছো যে? সেই কলকাতা থেকে এসেছো তো ওঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যই। তা উনি ফিরুন।
মন্দাকিনী স্পষ্টই এই বাড়িতে থাকার কথাই বললেন। দুনিয়ার সব মায়েদের স্নেহ বা টান যা, তা থেকে মন্দাকিনী কিছুমাত্র আলাদা নন। অতএব তিনি তেমন করে বলতেই পারেন। তবে সাত্যকি ঠিক করেই নিয়েছে এখানে মানে এই বাড়িতে থাকবে না। প্রথমত, তার নিজেরই দারুণ সঙ্কোচ হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, যদি ধরে নেওয়া যায় যে, এই বালযোগী তার বাবার বন্ধু নন তা হলে অপরিচিত একজনকে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে বাড়িতে তুলকালাম কান্ড হয়ে যেতে পারে। আবার এই বালযোগী বাবার বন্ধু হলে তো আর দেখতেহবে না। মনোমালিন্যের শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। অতএব সাত্যকি কোনো গোলমালের মধ্যেই যেতে চাইলো না। সুমিঠ্ঠাগুরমের একটা পরিবারে অশান্তির ঘূর্ণিঝড় তুলে কী লাভ? সঙ্গে সঙ্গে এই চিন্তাটাও মাথায় ঢুকলো, বাবার দেওয়া বিজয়ওয়াড়ার ঠিকানা যখন মিলে গেছে এবং বিজয়ওয়াড়ার পট্টভিনগরের সেই ভদ্রলোকের কথা মতো সুমিঠ্ঠাগুরমে যে বালযোগীর হদিস পাওয়া গেছে তিনিই গোপাল মনোহর বালযোগী। এ ব্যাপারে সাত্যকির আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সন্দেহের যে বাঁকটা চিন্তার স্রোতকে সম্পূর্ণ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে সেটা হলো স্ত্রী এবং মেয়ের কাছে নিরুচ্চার থাকার ব্যাপারটা। কলকাতার জীবনের কথা ঘুণাক্ষরেও কারও কাছে প্রকাশ করেননি। হয়তো সেটাই স্বাভাবিক। বন্ধুর কাছ থেকে মিথ্যে বদনামের শিরোপা পেয়ে আঘাতে বেদনায় গোপাল মনোহর এমনই মুক হয়ে গেছেন যে স্ত্রীকেও কিছু বলেননি। অর্থাৎ কি না স্ত্রীর কাছেও চিরতরে মৌন থাকার ব্রত নিয়েছেন। দুঃখের এক পুঞ্জীভূত মেঘ কী পরিমাণে বালযোগীজির বুকে জমাট বেঁধে রয়েছে সাত্যকি সেটা সহজেই অনুমান করতে পারলো। এক একজনের জীবনে এমন ঘটনা ঘটতেই পারে যা কিনা নিজের একান্ত প্রিয়জনকেও বলা চলে না। কেন না প্রিয়জনও অনেক সময় সব কিছু বিশ্বাস করে মেনে নিতে পারে না। কোথায় যেন একটা বাধার প্রাচীর আপন গতিতেই তৈরি হয়ে যায়। তা সংঘাতের কোনোরকম সুযোগ না দিয়ে কেউ যদি নীরব সাধনার ঊর্ধ্বে উঠে যেতে পারে তো মন্দ কী? বাবার কাছে তো জানতেই পেরেছে, ওঁরা দু’জনে বন্ধু ছিলেন। পদমর্যাদায় যদিও নিখিল একটু বড়োই ছিলেন, কিন্তু বন্ধুত্বে কখনও তার ছাপ পড়েনি। এবং ওই সময়ে তখনও কারও বিয়েই হয়নি। সুতরাং এটা তো পরিষ্কারই বোঝা যাচ্ছে, বন্ধুর দেওয়া মিথ্যে গ্লানির চাদরে নিজের মুখ ঢেকে বালযোগীজি কলকাতা থেকে এখানে ফিরে আসেন। ফিরে আসেন নিজের একান্ত পরিচিত পরিবেশে, নিজস্ব জল-বায়ু, আবহাওয়ায়। পরে যখন বিয়ে টিয়ে করেন কলকাতার চাদরটা পুড়িয়ে ফেলে ওই বিষাক্ত অধ্যায় থেকে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে গুটিয়ে নেন। স্ত্রী এবং মেয়ের কাছে কলকাতার ব্যাপারটা তাই এক আশ্চর্যের! পরম বিস্ময়ের!! তারা ওসবের কোনো বিন্দুবিসর্গও জানেন না।
সাত্যকি লাজুক হেসে এক সময় বললো, ওঁর সঙ্গে দেখা তো আমাকে করতেই হবে। আমি বরং পরশুদিন একবার আসবো। কালকে এসে যদি দেখা না পাই আবার আমাকে সেই রাজামুন্দ্রিতে ফিরে যেতে হবে।
তা কেন? মন্দাকিনী এ বারে আরও খোলাখুলিই জানালেন, এখান থেকে রাজামুন্দ্রি যাতায়াতেও তো নব্বই, একশো টাকা লেগে যাবে। তারপরেই হেসে আরও যোগ করলেন, তোমার নিশ্চয়ই অনেক টাকা। সেটা অন্য প্রশ্ন। তবে বারবার এই যাওয়া-আসার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি আমাদের এখানেই থাকতে পারো। তোমার হয়তো অনেক অসুবিধে হবে, আমাদের কোনো অসুবিধে নেই।
কলকাতার ছেলে সাত্যকির কাছে এই আপ্যায়ন, এতোখানি আন্তরিকতা অভাবিত। বিশেষ করে আজকের এই অস্থির এবং প্রতিনিয়ত মানুষ ঠকানোর দিনে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি ছেলেকে এইভাবে নিজের বাড়িতে স্থান দেওয়া প্রায় কল্পনার বাইরে। যে কোনো পটভূমিতে দেখলেই ব্যাপারটা একেবারেই অস্বাভাবিক পর্যায়ের। অথচ মন্দাকিনী নামের এই ভদ্রমিহিলাটি মায়ের স্নেহের আঁচল উড়িয়ে ওসব কুট- কাচালি, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দুশ্চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে কতো অনায়াসেই না বিচরণ করতে পারেন। অবশ্য মায়েদের বোধহয় একটা ‘তৃতীয়’ চোখ থাকে। যাকে বলা হয় অন্তর্দৃষ্টি! তা দিয়েই তাঁরা বুঝতে পারেন ভালোমন্দ সব কিছু।
সাত্যকি নিচু সুরে বললো, আমাকে রাজামুন্দ্রির রামাকৃষ্ণা লজে ফিরতেই হবে।
ওর সঙ্গে দেখা হলে তুমি কি আজই সেখানে ফিরতে?
মন্দাকিনীর ওই প্রশ্নে সাত্যকি শিশুর মতো একগাল হাসি ছড়ালো। আসলে ওর চিন্তাটা একটু অন্যরকম। এখানে এমনিতে থাকতে তার আপত্তির কোনো কারণ নেই। কিন্তু গোপাল মনোহর বালযোগী ফিরে এসে তাঁর অনুপস্থিতিতে বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া নিয়ে বিরূপ একটা কিছু ভাবতেই পারেন। নিখিল মৈত্রর সঙ্গেই যাঁর এখন আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক, তারই ছেলেকে উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো এমন একটা তৈরি সাম্রাজ্যে অধিষ্ঠিত হতে দেখলে এ. কে-৪৭ না ধরুন অন্তত দাঁতে দাঁত তো ঘষবেন। সাত্যকির তাই ভাঙা আয়নায় নিজের ছায়া ফেলতে মন উঠলো না। বাবার সম্পর্কে মানুষটা এখনও এক বুক অভিমান নিয়ে দূরত্বের প্রহর তৈরি করে চলেছেন। সেই সঙ্গে নিশ্চয়ই আরও একরাশ ঘৃণা! ওই অবস্থায় হিসেব করেই পা ফেলে এগোতে হবে। সাত্যকি নরম গলায় উত্তর দিল, সেটা তো বালযোগীজির ওপরই নির্ভর করছে। রাজামুন্দ্রিতে ফিরতেও পারতাম, নাও পারতাম। আসল ব্যাপারটা হলো ওঁকে যখন পেলামই না, এখানকার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে কলকাতায় বাবাকে সেটা জানাতে পারলে ভালো হয়। বাবাও তো একটা উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা নিয়ে রয়েছেন।
এ বারের যুক্তিটা মেনে নিলেন মন্দাকিনী। সাত্যকি যখন চলেই যাবে অর্থাৎ দুপুরের খাওয়ার সুযোগই পাচ্ছে না, তখন তো ওকে জলখাবারটা একটু ভালোভাবেই সাজিয়ে দেওয়া উচিত। মন্দাকিনীর সহজ হিসেব। ছেলেটা কলকাতা থেকে এসেছে সেটা বড়ো কথা নয়। সে এসেছে তার স্বামীর কাছে তাদেরই বাড়িতে। এবং সেটা আবার দুপুরবেলা। না খাইয়ে একজনকে ছেড়ে দেওয়া যায়?
মন্দাকিনী রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই সাত্যকি সামনের দিকে দৃষ্টিকে ছড়িয়ে দিল। প্রশস্ত উঠোনটা যদিও মাটির কিন্তু সিমেন্টের বাধানোর মতোই ঝকঝকে দেখাচ্ছে। বাড়ির চারপাশের সীমানা ঘিরে অজস্র বড়ো বড়ো গাছ-গাছালিতে ভর্তি। সাত্যকি সে সবের নাম জানে না। শীতল এবং স্নিগ্ধ এক নিবিড় ছায়া দিয়ে সেগুলো যেন এই বাড়িটাকেই চোখের মণির মতো রক্ষা করে চলেছে। সাত্যকির সবচেয়ে যেটা আশ্চর্য লাগলো, অন্য গাছগুলো বেশ কিছুটা দূরে দূরে অর্থাৎ জমির সীমানার কাছাকাছি থাকলেও উঠোনোর ঠিক মাঝখানেই একটা বড়ো তেঁতুল গাছ দেখে। ওই গাছটাকে যে বিশেষ একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সেটা সহজেই বুঝতে পারা যাচ্ছে। গ্রামের ঘর-বাড়ি ছাড়িয়ে দূরের পাহাড়গুলো যেন অগস্ত্যযাত্রায় চলেছে। এই রকম একটা মনোরম জায়গায় এসে পড়বে সাত্যকি কি আগে কখনও ভাবতে পেরেছিল? বিজয়ওয়াড়া, রাজামুন্দ্রি, সুমিঠ্ঠাগুরম এ সব তো তার হিসেবের মানচিত্রে ছিলই না। গভীরভাবে ভাবতে বসলে অনুভূতিতে সত্যিই একটা শিহরন খেলে যায়। রাত-জাগা পাখির ডানা ঝাপটানোর মোচড় এখন সারা বুকে। কলকাতা ছেড়ে এই জায়গাটাকেই এখন এক স্বপ্নের মতো মনে হয়।
.
উঠোনোর পেছন দিকের শেষ প্রান্তে একটা গোয়াল ঘর। সেখানে বাছুর সমেত একটা দুধেল কালো গাই। নিজের মনে চেটেপুটে সন্তানের সারা শরীরে স্নেহের লালা ঝরাচ্ছে। মাকে কাছে পেয়ে বাছুরটাও ঢুসোচুসিতে কম যায় না। উঠোনের পশ্চিম কোণে একটা ছাগল বাঁধা রয়েছে। পৃথিবী ওলোট-পালোট হয়ে গেলেও সেদিকে তার কোনোরকম ভ্রূক্ষেপ নেই। কচি কচি একরাশ কাঁঠাল পাতা ছাগলটা যে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে চলেছে, মনে হতেই পারে এই খাওয়া বন্ধ করতে তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। ব্যাপারটা অনন্তকাল ধরেই চলতে পারে। হঠাৎ সাত্যকির নজরে পড়লো একটা বড়ো সম্ভবত অর্জুন গাছের মাথায় এবং ডালপালার ফাঁক- ফোকরে টিয়া পাখির যেন এক বিরাট মেলা বসে গেছে। বেশ কয়েকটা আবার এক চক্কর আকাশে উড়েই ঝপাঝপ গাছের সবুজ পাতার মধ্যে নিজেদেরকে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিচ্ছে। এক সঙ্গে এতো টিয়াপাখি সাত্যকি ওর চব্বিশ- পঁচিশ বছরের জীবনে কখনও দেখেনি। কলকাতায় এক সঙ্গে বারো-চোদ্দটা দেখেছে বটে তবে সে সব পাখিওয়ালাদের সেই তারে ঘেরা বদ্ধ খাঁচায়। এমন উন্মুক্ত পরিবেশে প্রকৃতির কোলে নিশ্চিন্তে ওড়াওড়ি কলকাতায় বসে যেন ভাবাই যায় না। অমন সুন্দর সুন্দর সবুজ দেহ আর লাল টুকটুকে লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙিয়ে ওই এক ঝাঁক পাখিগুলো কেন যে কলকাতায় যায় না কে জানে!
সাত্যকির মনে পড়লো ছেলেবেলায় বন্ধুরা মিলে একদিন ক্রিকেট খেলছিল। ওদের বয়স তখন নয়-দশ হবে। সাত্যকি ব্যাট করছিল। আর মাত্র সাত রান করলেই তারা জিতে যাবে। হঠাৎ ওই সময়ে ঝিলের ওপাশ থেকে দুটো টিয়া উড়ে আসতেই খেলাটেলা মাথায় উঠলো। সবার আগে সাত্যকিই ওদের পিছু নিল। সেই সঙ্গে অন্যান্য বন্ধুরাও। সবার মুখে তখন একটাই আওয়াজ, টিয়া পাখি—টিয়া পাখি, একটু দাঁড়া তোকে দেখি।
ছেলেবেলার স্মৃতিই আলাদা! কতো অল্পেতে এবং কতো সহজেই না তারা সন্তুষ্ট হতো। বড়ো হলে কি সেই মনটাই হারিয়ে যায়? নাকি ভালোলাগার সেই চোখ দুটোই ক্রমশ বুজে আসে? আর একটা কথাও এই মুহূর্তে মনে হলো সাত্যকির। সে যদি এই অন্ধ্রপ্রদেশের রাজামুন্দ্রির সুমিঠ্ঠাগুরম গ্রামে এসে এক দঙ্গল টিয়া পাখি না দেখতো তা হলে কী ছেলেবেলার কথাটা কোনোদিনও মনে পড়তো? স্মৃতির লেপের তলায় ক্রিকেট খেলতে খেলতে দুটো টিয়া পাখি দেখার সেই আনন্দটা চাপাই পড়ে থাকতো। ভেতরের সব কিছুকে উসকে দেবার জন্য মাঝে মাঝে বোধহয় এমনই এক প্রদীপের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, যা মনকে অবশ্যই নাড়া দেয়।
সাত্যকির নজরে পড়লো, উঠোনের এক কোণে যে কূয়োটা রয়েছে সেখান থেকে এক বালতি জল তুলে সেটা এই পর্যন্ত টেনে আনলেন মন্দাকিনী। সামান্য হেসে বললেন, হাত, মুখটা ধুয়ে নাও।
আপনি কি আমার জন্যই জলের বালতিটা টেনে আনলেন? সাত্যকি বেশ অবাক হয়ে মন্দাকিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
তাতে হয়েছে কী? ছেলের জন্য মা এটুকু করে না?
সে তো ছেলে যখন ছোট্টটি থাকে তখন—সাত্যকি লজ্জার শেষ প্রান্তে পৌঁছে ভরা জলের বালতিটা নিয়ে আবার কুয়োতলার দিকে চলে গেল। কেন না মন্দকিনীর স্নেহমাখা এই বাৎসল্য মনকে অবশ্যই স্পর্শ করে কিন্তু মায়ের বয়সী একজনের শ্রমটুকুর সুযোগ নিতে কিছুতেই মন ওঠে না।
হাত, মুখ ধুয়ে সাত্যকি ঘাড়ে, গলাতেও জল লাগালো। কূয়োর জলটা শুধু ঠাণ্ডাই নয়, মিষ্টিও। সাত্যকির একবার ইচ্ছে হলো এই জামা-প্যান্ট পরা অবস্থাতেই দু’বালতি জল মাথায় ঢেলে দেয়। আসলে জলের যে এমন একটা স্বাদ হতে পারে ওর কোনো ধারণাই ছিল না। যাইহোক, কূয়োতলা থেকে সে যখন আবার উঠোন পেরিয়ে বারান্দায় চলে এলো, আহিরা নামের চব্বিশ বর্ষীয়া এক বনমল্লিকা, শ্যামসুন্দরী তখন খাবারের থালা হাতে দাঁড়িয়ে। ইতিমধ্যে মন্দাকিনী আসন-টাসন পেতে রেখেছিলেন। ছোট্ট গলায় সাত্যকিকে আহ্বান জানালেন, বসে পড়ো।
আহিরা থালাতে মোটামুটি যা সাজিয়ে দিতে পেরেছে তা হলো, আতপ চালের ভাত, সঙ্গে জোয়ারির মোটা রুটি। সম্বার ডাল, আলু-তিন্ডার সবজি, কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ, টমেটো-কারিপাতার স্যালাড, রসম এবং টক দই। এই হলো জলখাবার।!
সাত্যকি খেতে বসে শুধু বললো, এতো কিছু করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
বেশিটা তুমি কোথায় দেখলে? মন্দাকিনী ভুবন ভরিয়ে হাসলেন। অনুচ্চ কণ্ঠে বললেন, সেই সাত সকালের বাসে রাজামুন্দ্রি থেকে এখানে এসেছো, এখন আবার ফিরে গিয়ে সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত সাড়ে সাতটা, আটটা হয়ে যাবে। এটুকু না খেলে চলে?
এটা ঠিক, সাত্যকির বেশ খিদে পেয়েছিল। অনভ্যস্ত খাবারেও তার খুব একটা অসুবিধে হচ্ছিলো না। তবে প্রতিটা রান্নাতেই একটা টক স্বাদ রয়েছে। আর বেশি করে যেটা রয়েছে তা হলো লঙ্কার যথেচ্ছ ব্যবহার। আলু-তিন্ডার সবজিতে যেন শুধু লঙ্কা বেটেই গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে চূড়ান্ত পর্যায়ের ঝাল মেশানো হয়েছে তাতে খাওয়াটাই কষ্টকর। আসলে সাত্যকি জীবনেও এতো ওর জিভটিভ রীতিমতো জ্বলতে লাগলো। এতোক্ষণ ভদ্রতা এবং সৌজন্যের খাতিরে চেপেটেপে থাকলেও সাত্যকি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। লজ্জার শেষ আবরণটুকু সরিয়ে ফেলে সে তখন সমানে হু-হা করে চলছে। ঢকঢক করে জল খেয়েও কিছু হচ্ছে না।
আপনার কী অসুবিধে হচ্ছে? আহিরা বড়ো বড়ো চোখে জিজ্ঞাসা করতেই সাত্যকি মনে মনে বললো, অসুবিধে বলে অসুবিধে। মাথা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ঝালে ঝলসে যাচ্ছে। কিন্তু মুখে, কাঁদো কাঁদো মুখে শুধু বললো, ভীষণই ঝাল। আপনারা এতো লঙ্কা …….
তুমি তা হলে আগে দইটা মুখে দাও। মন্দাকিনী উদ্বেগের সঙ্গে বললেন, তোমার হয়তো একটুও ঝাল খাওয়ার অভ্যেস নেই।
তা একটু আছে। কিন্তু এই ঝালটা মোটেও ‘একটু’ নয়। চোখে জল নিয়েও সাত্যকি সহজ ভঙ্গিতে বলে সামান্য হাসবার চেষ্টা করলো।
আমাদেরও ঠিক খেয়াল ছিল না, দেখো তো কী কান্ড! খেতে বসিয়ে তোমাকেই বিপদে ফেললাম। তুমি পুরো দইটা আগে খেয়ে ফেলো। মন্দাকিনী এ বারে মেয়ের দিকে তাকালেন। নিচু গলায় বলে উঠলেন, ওকে আরও একটু দই এনে দে।
কথাটা সাত্যকির কানে যেতেই সে একবার আহিরা একবার মন্দাকিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার বললো, এই একবাটি দই-ই যথেষ্ট। আর আনতে হবে না। তারপরেই ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন করলো, আপনাদের ঝাল লাগে না।
ঝাল আমরা একটু বেশি খাই। মন্দাকিনী কথাটা শেষ করেছেন কী করেননি সাত্যকি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, একটু বেশি?
মন্দাকিনী ও কথায় দারুণভাবে হেসে উঠলেন। সাত্যকির জিজ্ঞাসা করার ধরন দেখে হাসির মৃদু একটা ঢেউ খেলে গেল আহিরার দুই ঠোঁটেও।
ঝালের জ্বালা-যন্ত্রণা তখন কমে এসেছে। সাত্যকি আলু-তিন্ডার সবজিটাকে আর স্পর্শ পর্যন্ত করলো না। জোয়ারির রুটিটা টুকরো টুকরো করে দই মাখিয়ে আস্তে আস্তে খেতে লাগলো। মাঝে একবার মাথা তুলতেই আহিরার সঙ্গে চোখাচোখি হলো। কোনোরকম চঞ্চলতা নেই। আশ্চর্য রকমের বনভূমির নির্জনতার মতোই শ্যামল ছায়া ঘেরা এক সুগভীর অরণ্যের হাতছানি। যেখানে বিন্দুমাত্র ঝড় নেই, আছে শরতের হালকা মেঘের খেলা। সাত্যকি কী যেন একটা বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার আগেই মন্দাকিনী হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, তোমার বাবার কাছ থেকে কী নির্দেশ পেয়ে তুমি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছো সেটা আমরা এই মুহূর্তে শুনতে চাই না। যাঁর শোনার কথা তিনিই শুনবেন। আমি শুধু জানতে চাইছি কোনো খারাপ কিছু নয়তো?
নতুন করে ক্ষতিটতি হওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। সাত্যকি স্পষ্টই বললো, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।
তবে কী পুরানো কোনো ক্ষতি ….কথাটা বলতে বলতে আহিরা একেবারেই থেমে পড়লো। মিনিটখানেক সময় পার করে, পরে বলে উঠলো, আমাদের অবশ্য কোনোরকম প্রশ্ন করা উচিত হবে না। যেহেতু আমরা কিছুই জানি না। তা ছাড়া আপনার যাবতীয় কথা তো বাবার সঙ্গেই। এই অবস্থায় বুঝতেও পারছি না, আপনার প্রয়োজনটা যেখানে বাবার কাছে তিনি তো কোনোদিনই …. আরও জরুরি কথাটা হলো, বাবার অনুপস্থিতিতে আমাদের বাড়তি কোনো কৌতূহল দেখানো ঠিক নয়। সুতরাং ও আলোচনা থাক।
আহিরা ঠিকই বলেছে। মন্দাকিনী মেয়েকে সমর্থন করেই হঠাৎ কী যেন মনে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, লীলার বাচ্চাগুলো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। তুই শীগগির ওর দুধটা দুইয়ে ওকে ছেড়ে দে।
অ্যালুমিনিয়ামের ছোট একটা বালতি নিয়ে আহিরা লীলা অর্থাৎ উঠোনে বাঁধা সেই ছাগলটার দুধ দুইতে বসে গেল। অভিজ্ঞ হাতে সেই কাজটা শেষ করে সে লীলার গলার দড়িটা খুলে দিতেই ওর লাফঝাঁপের বহর দেখে কে! একটু আগে সাত্যকির মনে হয়েছিল এই দুনিয়ায় একমাত্র কাঁঠালপাতা খাওয়া ছাড়া ছাগলটা আর কিছু জানে না। কিন্তু সে যে তার সন্তানগুলোকে দুধ খাইয়ে বড়ো করেও তুলতে চায়, স্নেহের পরশ বুলিয়ে ওদেরকে কাছে পেতে চায় সেটাও বোঝা গেল। গলার বাঁধন আলগা হতেই গোটা চার-পাঁচেক লাফ দিয়ে সত্যি সত্যিই মুক্ত হয়েছে কি না ব্যাপারটা পরখ করে নিয়েই দে ছুট। ওর বাচ্চাগুলো যেদিকে বাঁধা ছিল, চলে গেল সেদিকেই।
দুধের বালতিটা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আহিরা আবার ছুটে গেল ওপাশে। কেন-না লীলার বাচ্চাগুলোকে এ বারে ছেড়ে দিতে হবে। নয়তো ওদের ডাকাডাকি, চিৎকার চেঁচামেচিতে এখন পাড়া মাথায় করে তুলবে।
ওদিকের ঝামেলা মিটিয়ে আহিরা যখন আবার বারান্দায় ফিরে এলো সাত্যকির খাওয়া দাওয়া তখন শেষ। আহিরার এতোক্ষণের কাজের কাজলটুকু চোখে মেখে নিয়ে সে মন্দাকিনীকে হঠাৎ প্রশ্ন করলো, আচ্ছা, আপনার এক মেয়ে কি আনেক্কাপল্লীর স্টিফেন গার্লস কলেজের অধ্যাপিকা?
আমাদের এই একই মেয়ে। মন্দাকিনী হাসির ফুল ছড়ালেন। আহিরার দিকে সস্নেহ এক দৃষ্টি মেলে বললেন, ও-ই আনেক্কাপল্লীর স্টিফেন গার্লস কলেজের অধ্যাপিকা। ওখানকার হোস্টেলেই থাকে। ছুটিছাটায় আমাদের কাছে আসে। মন্দাকিনী এ বারে আরও একটু জোরে হেসে উঠলেন। বললেন, আজকালকার কলেজগুলো বেশ ভালো। মড়ক লাগার মতো ছুটিছাটা লেগেই আছে। আর ঠিক সেই কারণেই তো আহিরাকে কাছে পাই। নয়তো এই চাকরি করতেই পাঠাতাম না।
‘মড়ক লাগা’ শব্দটায় সাত্যকি বেশ মজাই পেল। অতিরিক্ত ছুটি পাওয়ার ব্যাপারটা কী চমৎকারভাবেই না গ্রাম্য সরলতায় বুঝিয়ে দিলেন। সাত্যকি বলে উঠলো, কিন্তু যাই বলুন এই চাকরিতেই এখন অর্থ এবং সম্মান দুটোই এক সঙ্গে পাওয়া যায়।
তা যায়। আমার প্রশ্নটা হলো, বিয়ের পর মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতেই হবে। সেটাই নিয়ম। এখন চাকরি উপলক্ষ্যে বিয়ের আগেও যদি বাড়িছাড়া, কাছছাড়া থাকতে হয় তা হলে কী কোনো আনন্দ থাকে? ধারে কাছে আর কোনো কলেজে তো সুযোগ পেল না— সেই আনেক্কাপল্লী শহরের সঙ্গেই ওর দানাপানি লেখা হয়ে গেল।
সাত্যকি এ বারে আহিরার দিকে তাকালো। এই মেয়েটি বেশ কিছুক্ষণ আগে উঠোনে ঝাঁটা দিচ্ছিলো, ছাগলের দুধ দুয়ে বাড়ির প্রতিটি খুঁটিনাটি কাজে নিজেকে প্রায় অপরিহার্য করে তুললেও মূলত সে একজন অধ্যাপিকা। অথচ ওকে দেখে সেটা বিন্দুমাত্র বোঝার উপায় নেই। এতো সাধারণভাবে এবং অতি সরল জীবনযাত্রায় সাত্যকি এর আগে কোনো অধ্যাপিকাকে দেখেনি। তার সেই দৃষ্টিতে তাই বিস্ময়ের সঙ্গে আর যেটা মিশেছিল তা হলো একরাশ শ্রদ্ধা। সাত্যকি সামান্য একটু হেসে জানতে চাইলো, আপনার পড়াবার বিষয় কী?
ভূগোল।
যখন স্কুলে পড়তাম, ওই বিষয়টাকে কেন জানি না, আমার যেন কিছুতেই ভালো লাগতো না। সাত্যকি হাসিটাকে ধরে রেখেই বললো, আসল ব্যাপারটা আপনাকে জানিয়ে দিই, ভূগোলটা আমার মাথাতেই ঢুকতো না। আর আমার সব সময়েই যেন মনে হতো, ওই সাবজেক্টের মতো কঠিন এবং আরও কঠিন ব্যাপার দুনিয়ায় দুটো নেই। সেই ভয়টা আজও কাটলো না।
যে কোনো সাবজেক্টেই আনন্দ পাওয়ার ব্যাপারটা নিজের কাছে। এবং ভয় পেয়ে প্রথম থেকেই মুখ ঘুরিয়ে না থাকাটা তার প্রধান শর্ত।
দারুণ বলেছেন তো! এতোক্ষণের প্রায় চুপচাপ থাকা শান্ত আহিরার অল্প কথার চমৎকার প্রকাশ দেখে সাত্যকি স্পষ্টই অনুভব করলো, মেয়েটি বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে। সে এ বারে স্বচ্ছন্দেই বলে ফেললো, আপনাকে অধ্যাপিকা বলে মনেই হয় না। মনে হয় আপনি এখনও একজন পড়ুয়া।
আমি কিন্তু অতো ছোটটি আর নেই।
তবুও তাই-ই মনে হয়। সাত্যকি খুশির প্রলেপ বুলিয়ে উত্তর দিল, কলেজে আপনাকে ভুল করে ছাত্রী ভাবাটা খুবই স্বাভাবিক। কেউ করেনি?
প্রথম কয়েকটা দিন অবশ্য তেমনই হয়েছিল। আহিরা ঝিরঝিরে বাতাসের মতো চিকন হাসি নিয়ে খুব আস্তে বললো, সেজন্য একই ভুল কী বারবার হয়?
.
একদিন বাদে ফিরে আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সাত্যকি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মা এবং মেয়ে দু’জনেই দু’জনের মুখের দিকে পলকহীন চোখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। যেন এক স্বপ্নের ঘোর কাটিয়ে উঠতে সময় লাগছে। এটা তো ঠিক, এইমাত্র যে দৃশ্যটা অভিনীত হলো সেটা বালযোগী পরিবারের চিত্রনাট্যে লেখা ছিল না। নির্দিষ্ট ছকের বাইরে অতিরিক্ত এক সংযোজনের আকস্মিকতায় মন্দাকিনী এবং আহিরা দু’জনেই মূক। প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে এ বারে একটু পর্যালোচনা করা যেতে পারে। আহিরাই প্রথমে কথা বললো। সে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, মা, কী হতে পারে বলো তো?
আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না রে।
আমিও কী কিছু বুঝতে পারছি নাকি? সরল এক অভিব্যক্তিতে নিজেকে ছড়িয়ে দিল আহিরা। কী যেন ভাবতে ভাবতে উত্তর দিল, আচ্ছা মা, এমনও তো হতে পারে বাবা সত্যি সত্যিই কলকাতায় চাকরি করতেন। যেটা কোনো এক কারণে আমাদের কাছে প্রকাশ করেননি।
তোর বাবা একবারও সেটা ….
ওই যে বললাম, যে কোনো কারণেই হোক সেটা বলার মতো বলে মনে করেননি।
বেশ, তোর কথাটা মেনে নিলাম।
মানতেই হবে। আহিরা পরিষ্কার যুক্তি দেখালো, আমরা আগে বিজয়ওয়াড়ার পট্টভিনগরে থাকতাম। সাত্যকি মৈত্র নামের ছেলেটি সেটা জানবে কেমন করে?
তাই তো!
আমার ধারণা বাবার ওই আদি বাড়ির ঠিকানা নিশ্চয়ই কলকাতায় ওদের কাছে রয়েছে। নয়তো সঠিক ঠিকানায় ছেলেটা পৌঁছালো কীভাবে? ঠিকানাটা অবশ্যই ওদের হাতে।
হতে পারে। মন্দাকিনী একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, কিন্তু এ সব আঠাশ- তিরিশ বছর পর নতুন কী শুরু হতে চললো বলতো? জানিস, আমার কিন্তু একটু ভয় ভয়ই করছে।
ভয় পাওয়াটা তোমার বাতিক।
না রে আহিরা, তুই বুঝঝিস না……..
ভয়ের কোনো ব্যাপারই নয় মা। আহিরা সোজাসুজিই বললো, ওসব হলে এতো বছর সময় নিতো না। আমার কী মনে হয় জানো? মান-অভিমানের একটা জটিলতা, সূক্ষ্মতা থাকতে পারে। অথবা ওই ধরনেরই একটা কিছু। শুনলে না, সাত্যকি মৈত্র একটা কথা পরিষ্কার বলেছে, ‘বাবার একটা নির্দেশ নিয়ে আমি এখানে বালযোগীজির কাছে এসেছি।’
এতো বছর বাদে এ সব নির্দেশের মানে কী? সেই নির্দেশটাই বা কীসের? মন্দাকিনী একটু বেশি মাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
সেটা জানতে পারলে আর আমরা মাথা খুঁড়ছি কেন? আহিরা সকালের কাঁচা সোনা রোদের হাসির ঝিলিক তুলে বললো, অনেক কিছু হতে পারে। যেমন ধরো, দুই বন্ধুতে কলকাতায় ব্যবসা করতেন। বাবাকে বঞ্চিত করে তিনি হয়তো আজ কোটিপতি। বিবেকের দংশনে এ বারে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে চাইছেন। অথবা বাবার হয়তো মূল্যবান কিছু কাগজপত্র তিনি ফিরিয়ে দিতে চাইছেন। সম্পত্তি ভাগাভাগির প্রশ্নও থাকতে পারে। আবার এও হতে পারে ..আহিরা কথাটা শেষ করলো না।
থামলি কেন, আবারটা কী? মন্দাকিনী মেয়েকে তাড়া লাগালেন।
বাবা এক বিরাট দায়িত্বের বোঝা ওই ভদ্রলোকের ওপর দিয়ে এসেছিলেন। উনি সেটা সুষ্ঠুভাবে এতো বছর ধরে পালনের পরেই বাবাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
সেটা কী? মন্দাকিনীর দুই চোখে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ যেন ভেসে বেড়াচ্ছে। অস্থির গলায় বলে উঠলেন, মানুষটা কলকাতার নাম পর্যন্ত মুখে আনলো না অথচ সেই শহরের একটা ছেলে এসে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত ঘুরে গেল তার বাবার আদেশে। দীর্ঘদিনের কোনো চাপা কাহিনী—এর পেছনে না থেকে পারে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না রে আহিরা।
তুমি দেখছি এখনই ভেঙে পড়ছো—আহিরা মাকে চাঙ্গা করে তুলতে একটা আবদারের ধমক লাগালো। এটা কেন বুঝতে পারছো না, পুরো ব্যাপারটা মানে নেপথ্যের ঘটনা প্রবাহর আমরা বিন্দুবিসর্গ জানি না। এ সবই কল্পনাভিত্তিক আলোচনা। রাস্তা খুঁজে পাওয়ার জন্য মতামত বিনিময়ের এক অনলস প্রচেষ্টা। আবার এটাও হতে পারে, আমরা যা যা ভাবলাম এর একটাও সত্যি না হতেও পারে। সুতরাং আগে থেকেই তুমি এতো মুষড়ে পড়ছো কেন? তোমাকে তো একটা কথা প্রথমেই বলেছি, বিপদ কখনও এতো দেরিতে মানে দেরি করেই আসে না, আসতে পারে না। অতএব আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবার মতো কোনো ব্যাপার স্যাপার নেই। একটা গাছ লাগালে তুমি কি তার ফল সঙ্গে সঙ্গে পাও? এটাও সেই ধরনের দেরিতে পাওয়া কিছু একটা হবে। আর যদি খারাপ কিছু হয় তো হোক। আমাদের ভাগ্যকে কে কেড়ে নেবে?
তুই তো আমাকে তোর কলেজের ছাত্রী মনে করে দিব্যি একটা লেকচার দিয়ে দিলি, কিন্তু আমার যে কোথায় তোলপাড় হচ্ছে, কোথায় কতোখানি বুকটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে সেটা তুই এই মুহূর্তে কিছুতেই বুঝবি না। মন্দাকিনী গভীর হতাশার মধ্যে নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করেও বলেই ফেললেন, তোর বিয়ে-থা হোক তখন টের পাবি।
টের পাওয়ার জন্য বিয়ের প্রয়োজন নেই। তার দরকার পড়ে না। আহিরার হাসিতে সন্ধ্যা প্রদীপের স্নিগ্ধ আলো ছড়ানো। সে মায়ের চোখে চোখ রেখে আবেগ নিয়ে বলে উঠলো, তুমি যা আশঙ্কা করছো তেমনটা হবার কোনো কারণ নেই। তুমি কী বলতে চাইছো আমি তা যথেষ্টই অনুমান করতে পারছি, আর পারছি বলেই বলতে চাইছি বাবাকে কী তুমি এখনও চিনলে না? তারপরেই আহিরা মাকে মেয়ের মতো কাছে টেনে নিয়ে মধুর এক ধমক দিল, ওসব চিন্তা টিন্তা এখন ছাড়ো। কাজ করো, কাজের মধ্যে ডুবে যাও।
সময় যেন আর কাটতেই চায় না। বিশেষ করে মন্দাকিনীর কাছে সময়টা এখন পাথরের চেয়েও ভারী। কিছুতেই বুকের ওপর থেকে নামতে চায় না। মানুষটা বাড়ি ফিরে না আসা পর্যন্ত ভেতরের এই উথালপাথাল ছটফটানি বিন্দুমাত্র কমবে না—তা সে যতোই সান্ত্বনা দিক না কেন। মন্দাকিনী যদি রাজামুন্দ্রির ঠিকানা জানতেন এই মুহূর্তে স্বামীর কাছে ছুটে চলে যেতেন। কিন্তু তা হবার উপায় নেই। ব্যবসার জন্য তাঁকে কোথায় কোথায় না দৌড়াদৌড়ি করতে হয়? গোপাল মনোহর আজ রাজামুন্দ্রি রয়েছেন তো কালকেই কাঁকিনাড়া, বিশাখাপত্তনম যাচ্ছেন। আজ সকালে যদি পশ্চিম গোদাবরী টাউনে তো সন্ধ্যার সময় আনেক্কাপল্লী শহরে পা রাখছেন আবার যখন বাড়িতে থাকছেন, তখন থাকছেনই। সেই সময়টা বাড়ি থেকে বেরুনোর প্রয়োজনও হয় না। মন্দাকিনী ভাবলেন, আহা, সেই অধ্যায়টা যদি এই মুহূর্ত থেকেই আরম্ভ হতো!