গাত্রহরিদ্রা – ২

কলকাতার যোধপুর পার্কে ঝিলের ধারে সাত্যকিদের চমৎকার দোতলা বাড়ি। নীচের ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে পুরো ওপরটা নিয়ে ওরাই থাকে। ওরা বলতে সাত্যকি, ওর মা এবং বাবা। বাবা নিখিল মৈত্র চাকরি করতেন কেন্দ্রীয় সরকারের একটি নামী সংস্থায়। সেখানকার ডিরেক্টর হিসেবে তিনি অবসর নিয়েছেন এই মাসের চার তারিখে। অর্থাৎ মাত্র বারো দিন হয়েছে তিনি অফিসের সুউচ্চ পদের চাকরির মেয়াদ শেষ করে এখন রাতদিন বাড়িতেই বসে আছেন। টাকা-পয়সা যা পেয়েছেন এবং আরও যা পাবেন সেটা রীতিমতো মোটো অঙ্কের। তা ছাড়া সাত্যকি নিজেও একটা চমৎকার চাকরি করে। এই শুরুতেই তার বেতন এগারো হাজার টাকার মতো। সুতরাং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তো পড়েই আছে। এই যখন তাদের ফ্যামিলির অর্থনৈতিক অবস্থা সেখানে অবসরের পরেও নিখিল মৈত্রর যে হাসিখুশি চেহারাটা সাত্যকি দেখবে বলে আশা করেছিল তেমন করে কিন্তু বাবাকে সে একটা মুহূর্তের জন্যেও দেখলো না। অথচ বাবার মতো এমন প্রাণখোলা মানুষ সত্যি দেখা যায় না। সাত্যকির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা রীতিমতো বন্ধুর মতো। শুধু কী তার সঙ্গেই? মোটেই তা নয়। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী প্রত্যেকের কাছেই তিনি একজন চমৎকার ও স্বচ্ছ দৃষ্টির মানুষ। উদার মনের মানুষ। সবচেয়ে বড়ো কথাটা হলো, যিনি যতোই ভালোমানুষ হোন না কেন—অফিসে অন্তত সবার কাছে সমান গ্রহণীয় হতে পারেন না। বিশেষ করে তিনি যদি আবার উঁচু পদে আবৃত থাকেন। নিখিল মৈত্র অবশ্যই সেই ব্যতিক্রমী পুরুষ যিনি অফিসেও তাঁর একজন নিন্দুকও তৈরি করে আসতে পারেননি। সেই মানুষটা যদি অবসরের সঙ্গে সঙ্গেই এমনভাবে মুষড়ে পড়েন, মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যায়., সে কষ্ট তো সাত্যকিরই।

পুরো চার চারটে দিন সাত্যকি নীরবে লক্ষ্য করেছে বাবাকে। ঘুরে ফিরে শুধু মাকে জিজ্ঞেস করেছে, বাবার কী হয়েছে বলো তো?

সেই প্রশ্নের উত্তর তো আমিই খুঁজছি।

তুমি কিছু জিজ্ঞেস করোনি?

করিনি আবার! বিজয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে আরও বললেন, আমি অনেক, অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি। নানারকম কথাবার্তা বলে বোঝাবার এবং ভেতরের ব্যাপারটা জেনে নেবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু মানুষটাকে টলানো যায়নি। এরপরেও যদি আমি ‘তোমাকে বলতেই হবে’ বলে জেদাজেদি করতাম ব্যাপারটা অন্যদিকে গড়াতে পারে ভেবে চুপচাপ থাকাই শ্রেয় মনে করেছি। ওঁরও ওই এক কথা, আমাকে একটু চুপচাপ থাকতে দাও। তা আমার কাছে না এসে বাবার কাছে তুইই যা না—

সেটা না হয় যাবো। কিন্তু মা—সাত্যকি হঠাৎ থেমে পড়লো।

কী বলছিলি বল?

ওই যে তুমি একটু আগেই বললে না, জেদাজেদি করলে ব্যাপারটা অন্যদিকে গড়াতে পারে— সেই অন্য দিক বলতে?

বিষণ্ণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন বিজয়া। বাবার গুম হয়ে থাকার দরুণ ছেলেটা তাঁর খুবই কষ্ট পাচ্ছে। ওকে আর কতো কষ্ট দেওয়া যায়? কতো আর আশঙ্কার কথা বলা যায়? অথচ এই সময়ে ছেলের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা না করলে সমাধানের রাস্তাটা বের হবে কী করে? বিজয়া ছলছলে চোখে বললেন, ওঁর সঙ্গে এখন কোনোরকম জোরাজুরি করা ঠিক নয়। অনেক ধৈর্য নিয়ে অনেক মমতা নিয়ে আমাদের চলতে হবে। আমাদের সামান্য কথাতেও উনি যেন এতোটুকুও আঘাত না পান, দেখতে হবে সেই দিকটাও। খুব কঠিন অবস্থার মধ্যেও….বিজয়া থেমে পড়লেন।

খুব কঠিন অবস্থার মধ্যেও কী? সাত্যকি মায়ের চোখের দিকে তাকিয়েই রইলো।

খুব কঠিন অবস্থার মধ্যেও আমাদের স্বাভাবিক থাকতে হবে। নয়তো এই সব অস্থিরতা মানে ভেতরের নিরুচ্চার ঝড়-ঝাপটার সময়ে কোমল মন নিয়ে পাশে পাশে পায়ে-পায়ে না থাকলে মানুষটা দূরে সরে যেতে পারে। হারিয়ে যেতে পারে। এমনকী নিজেকে শেষ করেও ফেলতে পারে। অবসাদের এইসময়ে দরকার শুধু ভালোবাসার দৃষ্টিতে মানুষটাকে সারাক্ষণ ঘিরে রাখা। তাঁকেই বেশি করে গুরুত্ব দেওয়া। এখানে বিন্দুমাত্র অসহিষ্ণুতা দেখানো চলবে না।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে সাত্যকি দেখলো বাবা যথারীতি ব্যালকনিতে তাঁর নির্দিষ্ট আরামকেদারায় গুম হয়ে বসে আছেন। সাত্যকি কিছু বললো না। অফিসের জামা-প্যান্ট ছেড়ে হাত,মুখ ধুয়ে সে ফ্রেশ হয়ে নিল। পাজামা, পাঞ্জাবি পরে সাত্যকি যখন হালকা হয়ে বাবার পাশে গিয়ে বসলো ওঁর মুখখানা তখনও মেঘ-মেদুর আকাশের মতো থমথমে।

সাধারণত বাবা ওকে আগে যেমন জিজ্ঞাসা করতেন, কখন ফিরলি? আজ একটু দেরিই হয়েছে, পথে নিশ্চয়ই জ্যামে পড়েছিলি? অথবা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবার জন্য মনকে উতলা করে কক্ষনো ড্রাইভ করবি না। কিন্তু তিনি এ সব কিছুই বললেন না। যে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন তেমনভাবেই নিঃশব্দের প্রহর পেরিয়ে যেন এক বোবা মানুষের ভূমিকায় নিজেকে সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলবার জন্য গভীর থেকে আরও গভীরে চলে যাচ্ছিলেন।

এই ক’দিনের অভিজ্ঞতায় সাত্যকি একটা জিনিস বুঝতে পারছে, বাবাকে এ ভাবে ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। অর্থাৎ তিনি যে ভাবে নিজেকে বাড়ির সবার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে গুটিয়ে নিয়ে মৌনী হয়ে থাকছেন এটার ফল ভালো হতে পারে না। এর অর্থ বাবা তো নিজেই নিজের দুশ্চিন্তার জালে জড়িয়ে পড়ে আরও দ্রুত ধ্বংসের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় বাবার সঙ্গে বরং সারাক্ষণ কথা বলাই উচিত। ওঁকে ওঁর চিন্তার জগৎ থেকে সরিয়ে এনে স্বাভাবিক করে তোলার আকাঙ্ক্ষায় সাত্যকি খুব নরম গলায় ডাকলো, বাবা!

নিখিল কোনো উত্তর দিলেন না। নিস্তেজ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে একবার তাকাতেই সাত্যকি আরও আবেগ নিয়ে আরও অন্তরঙ্গ সুরে জিজ্ঞেস করলো, তোমার কী হয়েছে বাবা? তুমি নিজেকে হঠাৎ এইভাবে গুটিয়ে নিলে কেন? আমি….আমি তো আমার বাবাকে এ ভাবে দেখতে অভ্যস্ত নই। আমার খুব খারাপ লাগছে….আমি কষ্ট পাচ্ছি। আমি এও বুঝতে পারছি আমার চেয়েও তোমার কষ্টটা নিশ্চয়ই বেশি….কিন্তু আবারও বলছিল বাবা, তোমাকে আমি এইভাবে কখনো পাইনি, দেখিনি—দুঃখ পেতে পেতে আমার বোধটাই ক্রমশ অসাড় হয়ে যাচ্ছে। আমিই শেষ হয়ে যাচ্ছি….আমিই…. পুরোপুরি ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা তখন সাত্যকির।

চকিতে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই রইলেন নিখিল। সত্যিই তো ওর কী দোষ? ছেলেটা ওর বাবাকে গভীরভাবে ভালোবাসে বলেই তো এতো কষ্ট পাচ্ছে। এ বারে নিখিলেরও তো তাতে সাড়া দেওয়া উচিত। ওকে কেন এই টানা-পোড়েনের মধ্যে ফেলে রাখা? তা ছাড়া নিখিল নিজেও তাঁর মনের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আর পারছিলেন না। এ বারে একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। মানসিক দিক দিয়ে একটু হালকা হয়ে নেওয়ার বিশ্রাম। সেজন্য তো অপর একজনের কাছে নিজেকে মেলে ধরতেই হবে। তাই যদি হয়, সেটা তো তবে নিজের ছেলের কাছে হওয়াই ভালো। নিখিল ব্যথাতুর এক দৃষ্টিতে সাত্যকির দিকে তাকিয়েছিলেন। আস্তে কিন্তু স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলেন, তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।

প্রচন্ড আগ্রহে সাত্যকি বললো, আমি তো শুনতেই চাইছি বাবা।

কথাটা আমি….শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই নিখিল অদ্ভুত এক সংকোচে নিজেকে লুকিয়ে রাখতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আরও সত্যি কথাটা হলো, তিনি যেন পালিয়ে যেতে চাইছেন। কিন্তু এ ভাবে কতোদিন আড়ালের ঢাল খোঁজা যায়? সবার আগে যে কথাটা মনে রাখা প্রয়োজন তা হলো তাঁর ছেলেটা কাঁটার মুকুট পরে প্রতিনিয়ত বিদ্ধ হচ্ছে। ওকে একটু স্বস্তি দেওয়া দরকার। নিজের চেয়েও নিখিল এ বারে সাত্যকির চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তার মনটা এক সময় হু-হু করে উঠতেই নিজেকে আর এক প্রস্থ ধরে রেখে পরিষ্কার বললেন, অহেতুক চিন্তা করিস না। কিছু দিন বাদে আমিই তোকে ডেকে সব বলবো। আমার কেন জানি আজকাল ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। এখন একটু ঘুমাবো।

নিখিল আরাম কেদারা ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করতেই সাত্যকি ওঁর পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে উঠলো, বাবা আমি কী ডাক্তার করগুপ্তকে একবার ডাকবো? তোমাকে এসে দেখে যাবেন—

আরে না-না, তুই অতো ভাবিস না।

তোমার খাওয়া-দাওয়া অনেক কমে গেছে।

ওসব দু’দিনের। ছেলেকে নিশ্চিন্ত করতে নিখিল অতঃপর বলে উঠলেন, এই বয়সে শরীর সব সময় এক রকম ভাবে চলে না।

সাত্যকি বলতে পারতো, অসুখটা তোমার শরীরের নয় মনের। কিন্তু তেমনটা বললে বাবা কষ্ট পাবেন। বাবাকে এখন এতোটুকুও আঘাত্ব দেওয়া ঠিক নয়। তা ছাড়া উনি তো বললেনই, ‘কিছুদিন বাদে আমিই তোকে ডেকে সব বলবো।’ এরপর আর চাপাচাপি, জোরাজুরি করা চলে? বাবা নিজে থেকে যেদিন ডেকে সব বলবেন, সেই দিনটার জন্যেই এখন থেকে অপেক্ষা করা যাক। এই বিষয়ে ওঁকে আর বিরক্ত করা নয়।

আরও সাত, আটটা দিন নিঃশব্দের প্রহর গুণে শেষ হলো। সাত্যকি এতোটুকু ধৈর্য হারালো না। বাবাকেও খোঁচাখুঁচি করলো না। মানুষটার প্রতি তার আস্থা আছে। সাত্যকি বেশ বুঝতে পারছিল বাবা আসলে এই সময়টুকু নিয়ে নিজেকে তৈরি করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। সময় হলেই ডাকবেন।

হলোও ঠিক তাই। সেদিন খুব ভোরে সাত্যকির ঘুম ভেঙে গেল। সময়টা সাড়ে চারটে, পৌনে পাঁচটা হবে। পাখিদের অবিরাম ডাকাডাকিতে ওর ঘুম ভেঙে যেতেই বিছানায় পড়ে না থেকে বাথরুমে যাবার জন্য উঠে পড়তেই দেখতে পেল বারান্দার আরাম কেদারায় শরীরটাকে ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ বসে রয়েছেন নিখিল।

সাত্যকি জিজ্ঞেস করলো, বাবা তুমি কী সারারাত ঘুমাওনি? তোমাকে দেখে তো আমার তেমনই মনে হচ্ছে।

তা ঘুমিয়েছি। তবে চারটে নাগাদ ঘুম ভেঙে যাবার পর আর বিছানায় না থেকে বারান্দায় চলে এলাম। এখানে বসলে চারপাশের গাছপালা দেখতে দেখতে মনে হয় যেন প্রকৃতির কোলেই বিশ্রাম নিচ্ছি। ভোরের এই নির্জনতাটুকু বড়ো ভালো লাগে রে। কথাগুলো শেষ করে নিখিল ছেলেকে সস্নেহে ডাকলেন, সাত্যকি আমার কাছে বোস তোর সঙ্গে কথা আছে।

এক মিনিট বাবা—সাত্যকি যথেষ্ট আপ্লুত হলো, আমি এক্ষুণি আসছি।

আয়।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে সাত্যকি বাবার পাশের চেয়ারটায় গিয়ে ঝুপ করে বসে পড়লো বটে তবে নিজে থেকে কোনো প্রশ্নই রাখলো না। বাবা তো বললেনই ‘তোর সঙ্গে কথা আছে।’ এরপরেও কোনো প্রশ্নমালা ধরিয়ে দেওয়া যায়?

ছেলেকে এক ঝলক দেখলেন নিখিল। পরম মমতায় ওর কাঁধে একটা হাত রেখে আস্তে আস্তে বুলিয়ে দিতে লাগলেন। এক সময় বলে উঠলেন, কথাটা আমি ঠিক কীভাবে আরম্ভ করবো, আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। নিখিল অগাধ এবং অন্তহীন নৈরাশ্যের প্রগাঢ় এক শূন্যতা নিয়ে বললেন, আমার সাংসারিক শান্তির সুখ- সুষমা ছুঁয়েই তো থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যেদিন রিটায়ার করলাম…. আমাকে অফিসের সহকর্মীরা সংবর্ধনা জানালেন….. আমার সম্পর্কে দারুণ ভালো ভালো সব কথা বললেন… ঠিক সেই দিনই হঠাৎ আমি যেন একটু একটু করে জেগে উঠলাম। ওই পর্যন্ত বলে নিখিল একটু থামলেন। তারপরে উদাস সুরে আবার বলতে লাগলেন, আমি দীর্ঘদিন বাদে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। সকলেই আমার প্রশংসা করেন, আমাকে ভালো মানুষ বলে জানেন। তাঁদের সেই বিশ্বাসের কতোটা কাছাকাছি আমি, আমার হিসেব সে সব নিয়ে নয়। এতোদিন সেটা ছিলও না। কিন্তু চাকরির বিদায় মুহর্তে সহকর্মীরা যখন একের পর এক মঞ্চে উঠে অফিসে আমার আচার-ব্যবহারের আন্তরিক ছবিটা এঁকে চলছিলেন—ঠিক সেই মুহূর্তে আমি একান্ত মনে অন্য এক ছবি দেখতে পেলাম। আঠাশ বছর আগে আমি একজনকে চুরির দায়ে বরখাস্ত করেছিলাম।

কে সে?

জি.এম. বালযোগী।

সেইজন্যই কী তুমি এখন মন খারাপ করছো? সাত্যকি স্পষ্টই বললো, যে চুরি করেছে তুমি তাকেই সাসপেন্ড করেছো। এর মধ্যে অন্যায়টা কীসের?

গোপাল মনোহর বালযোগী চুরি করেনি। নিখিল অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের লজ্জা ঢাকতে চাইলেন। কাঁপা গলায় বললেন, ওর বিরুদ্ধে কেসটা আমি মিথ্যেই সাজিয়েছিলাম। আমার সারা জীবনে ওই একটাই….নিখিল মাথা নিচু করে নিজেকে এক পাপবোধের গহ্বরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সাত্যকি বাবার বিধ্বস্ত চেহারাটার ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলো, ওই অন্যায়টা তুমি কেন করেছিলে? তোমার কোনো ওপরওয়ালার নির্দেশে?

কোনো ওপরওয়ালার নির্দেশে নয়। নিখিল পরিষ্কারই উত্তর দিলেন, তোকে তো একটু আগেই জানালাম কেসটা আমিই সাজিয়েছিলাম। গোপাল মনোহর বালযোগী সম্পূর্ণ নির্দোষ।

নিখিলের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সাত্যকি হাজারো কথা ভেবে চলেছে। এক সময় সে প্রশ্ন করলো, কোনো ব্যক্তিগত সংঘাত অথবা….

আমাকে কোনো প্রশ্ন করিস না সাত্যকি। নিখিল এ বারে সোজাসুজিই বললেন, নেপথ্যের ব্যাপারটা আর টেনে বার করার কোনো প্রয়োজন নেই। আসল কথাটা হলো, আমি তো সেদিন একজনের ওপর অবিচার করেছিলাম। পদমর্যাদার সুযোগ নিয়ে গোপাল মনোহরকে….হ্যাঁ, তোর কাছে এটুকু অন্তত স্বীকার করা উচিত ব্যক্তিগত একটা ব্যাপারেই ওকে ওই ভাবে সরিয়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ থাকতে চেয়েছিলাম। এতোদিন ওসব আমি দিব্যি ভুলেছিলাম। কিন্তু বেলা শেষের ছবিটা আঁকতে গিয়ে দেখলাম বেজায় ফাঁকিতে পড়ে যাচ্ছি। সব কিছু পেয়েও যেন রুক্ষ- শূন্য এক প্রান্তরে একা দাঁড়িয়ে আছি। আসলে হঠাৎ জেগে ওঠা দ্বীপের মতো অন্যায়ের পাহাড়টা আমার বুকের ওপর এমনই চেপে বসে আছে যে, আমি নিঃশ্বাস ফেলতেই পারছি না।

তুমি এখন কী করতে চাও? সাত্যকি বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

তার যেটুকু সর্বনাশ হওয়ার তা তো হয়েছেই। শত চেষ্টা করলেও এখন আর তাকে কিছুই ফিরিয়ে দেওয়ার নেই। নিখিল সূর্যের শেষ আলোর মতো ম্লান গলায় বললেন, গোপাল মনোহর আমার বন্ধু ছিল। একেবারেই ঘনিষ্ঠ। আর ও-ও আমায় খুবই ভালোবাসতো। অথচ…. মানসিক এক যন্ত্রণায়, হতাশায় শেষ পর্যন্ত আমিই কি না গোপাল মনোহরকে ফাঁসিয়ে দিলাম…. মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে দিলাম। এই অন্যায়ের ক্ষমা হয় না। তবুও…. তবুও আমি সামান্য একটু হলেও শান্তি পেতে চাই। তুই যদি বিজয়ওয়াড়া গিয়ে পট্টভিনগরে ওর খোঁজ পাস তবে আমি সেখানে একবার যেতে পারি। গোপালের কাছে ক্ষমা চাইবো। ওর ক্ষমা পেলে অন্তত কিছুটা ভারমুক্ত হয়ে পরবর্তী জীবনটা কোনোরকমে কাটিয়ে দিতে পারবো। যাবি তুই?

বাবার ব্যথার উৎসের সন্ধান পাবার পর স্বাভাবিক কারণেই সাত্যকি এখন অনেকটা শান্ত। এ বারে প্রয়োজন বাবাকে একটু শান্তি দেওয়া। অফিস থেকে ছুটিছাটা পাবার ব্যাপারটা নিয়ে নিজের মনেই একটু হিসেব টিসেব করে বাবার মুখের দিকে তাকাতেই দেখলো নিখিল প্রায় ছলছল চোখে তারই দিকে চেয়ে রয়েছেন। উনি যে ক্রমশ ভেঙে পড়ছিলেন সেটা বোঝা যাচ্ছিলো। সাত্যকি তাই অনেকটা সময় নিয়ে বেশি কিছু ভাবার সুযোগ পেল না। বাবাকে সবার আগে নিশ্চিন্ত করা দরকার। সে স্পষ্ট গলায় বললো, কেন যাবো না? আমি বিজয়ওয়াড়াতে গিয়ে তোমার হয়ে তো ক্ষমা চাইবোই, টেলিফান করে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়ে তোমাকেও সেখানে নিয়ে যাবো। আর যদি সম্ভব হয় তবে জি.এম. বালযোগীকে নিয়েই কলকাতায় ফিরবো।

সেটা যদি করতে পারিস তো… ছেলের প্রতি মমতা মেশানো এক কৃতজ্ঞতায় নিখিলের গলাটা প্রায় বুজেই এলো। কোনোরকমে বললেন, ওকে কাছে পেলে ওর দেওয়া যে কোনো সাজা মাথা পেতে নেব। অনুশোচনার তুষের আগুনে যে ধিকধিক করে জ্বলছি, গোপাল মনোহরের উপস্থিতিই পারে শান্তির জল ছিটিয়ে মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দিতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *