১৭
এক্সপ্রেস ট্রেনটা থেকে নেমে সাত্যকি রাজামুন্দ্রি স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে আসতেই ভিড়ের স্রোতে ভেসে গেল। এখানকার রাস্তাঘাট, বাস ডিপো, ট্যাক্সি স্ট্যান্ড ইত্যাদি সবই এখন তার নখদর্পণে। অতএব জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সময় নষ্টের কোনো ব্যাপার নেই। সাত্যকি সোজাসুজি দূরপাল্লার বাস ডিপোতে গিয়ে রামেশ্বরমের লাইনের ভিড়ে মানুষের গুঁতোগুঁতি-ঠেলাঠেলি দেখে অবাক হলো। আসলে ব্যাপারটা হয়েছে, আগের দুটো বাসই যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য বসে গিয়েছে। ফলে তৃতীয় বাসটাতে ওঠার জন্য মানুষের ভেতরে শৃঙ্খলার কোনো শাসন নেই, সেখানে হাতাহাতি চলছে।
সাত্যকি পায়ে-পায়ে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে চলে এলো। শেয়ারের ট্যাক্সি। ঠিক কতো জনকে তুলবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এই মুহূর্তে মওকা বুঝে দর হাঁকছে জন প্রতি একশো তিরিশ টাকা। সাত্যকি দ্বিতীয় আর একটাও কথা না বাড়িয়ে ট্যাক্সির ডানদিকের জানলা ঘেঁষে বসে পড়লো। এ বারে যখন ছাড়ার ছাড়ুক। যতো জনকে তোলার তুলুক। সাত্যকি শুধু আহিরার কাছে পৌঁছাতে চাইছে। কিন্তু যাকে দেখার বাসনায় সে উন্মুখ হয়ে রয়েছে সেই অধ্যাপিকা কি সুমিঠ্ঠাগুরমে পৌঁছেছে? স্বাভাবিক কৌতূহলে সাত্যকি অবশ্য এক ঝলকে আনেক্কাপল্লী স্টেশন ও রাজামুন্দ্রি স্টেশনের ভিড়ে চোখ রেখেছে কোথাও যদি বিশেষ একজনকে নজরে পড়ে যায়। তা যে যায়নি, সাত্যকির একা একা ট্যাক্সির কোণে চুপচাপ বসে থাকা দেখেই বোঝা যায়।
ট্যাক্সিটা যখন ছাড়লো স্বভাবতই সাত্যকি তখন বিরক্তির পর্যায়ে। বসে থাকা লোকেরও কোলে, হাঁটুতে গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে বসিয়ে মোট এগারো জনকে তোলা হয়েছে। পরে ওঠা মানুষগুলো স্রেফ হামাগুড়ি দিয়ে কীভাবে যে বসে আছে তা আর বলার নয়। সাত্যকি শুধু মাঝে একবার বলেছিল, আর ক’জনকে এ ভাবে তুলবেন? ট্যাক্সির চালক মধ্যবয়সী লোকটা মুচকি হেসে জানিয়েছিল, আপ স্রিফ দেখতে রহে যাইয়ে। অর্থাৎ আপনি শুধু দেখে যান। তা সাত্যকি প্রতিবাদটা করেছিল অষ্টম জনকে তোলার পর আতঙ্কিত হয়ে, তারপর সে দেখলো আরও তিনজনকে সেই ট্যাক্সিতে কী অদ্ভুত কৌশলেই না তুলে নেওয়া হলো! এরপরেও আর কিছু বলার মুখ থাকে? সাত্যকি তাই নিরূপায় হয়ে দেখেই গেছে, তবে একটা প্রার্থনা নিয়ে— কতোক্ষণে সুমিঠ্ঠাগুরমে নামবে? ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ ভাবে নড়াচড়া না করে, হাঁটু ভেঙে, ঘাড় গুঁজে….. না, এতো কষ্ট করে সাত্যকি এর আগে কোনো সফর করেনি।
.
কষ্টের শেষে এতো আনন্দও সাত্যকি এর আগে কখনও পায়নি। এ যেন দু’হাত ভরে পাওয়া। দু’চোখ মেলে দেখা। সুমিঠ্ঠাগুরমে ট্যাক্সি থেকে নেমে সাত্যকি টাকা- পয়সা মিটিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতাবশত কুপুস্বামীর দোকান থেকে দু’প্যাকেট সিগারেট কিনে নিল। আপ্লুত হয়ে মিনিট দশেক কথাও বললো পুরু লেন্সের চশমা পরা আটাত্তর বছরের সেই বৃদ্ধের সঙ্গে। কুপুস্বামী মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, মানি ব্যাগ-ট্যাগ আর হারায়নি তো?
আজ্ঞে না।
খুব ভালো কথা। নেশারও আগে নিজেকে রক্ষা করা, নিজের জিনিসকে রক্ষা করা—এটা যেন আজীবন মনে থাকে!
অবশ্যই থাকবে।
তারপর কুপুস্বামীর দোকান ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে সাত্যকি। রাস্তা পার হতে যাবে রাজামুন্দ্রি থেকে সরকারি গাড়িটা এসে বাস স্টপে দাঁড়ালো। গিজগিজে ভিড় ঠেলে লোকজন নামছে সেই বাস থেকে। সাত্যকির অতো তাড়া নেই। বাসটা চলে যাওয়ার পরেই সে ওপারে যাবে। আপাতত একটা সিগারেট ধরানো যাক। কিন্তু ও কে? ছোট একটা স্যুটকেস হাতে নিয়ে ও কাঁধে একটা সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে বাস থেকে গলদঘর্ম হয়ে কে নামছে? সারা রাস্তা, আশেপাশের বনাঞ্চল, পুরো প্রকৃতিই যেন কুসুম ঘ্রাণের সেই দীর্ঘাঙ্গীকে স্বাগত জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিস্মিত, বিমোহিত হয়ে সাত্যকি ওকেই দেখছে।
সাত্যকি আর আহিরা তখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সাত্যকিই এগিয়ে গিয়েছে। ওর চোখে মুখে যে দীপ্তি ও আনন্দের ঢল নেমেছে তা ছেলেটা আটকাবে কী করে? আটকানো সম্ভব নয় বলেই তো ওর চলনে-বলনে, শরীরের ভাষায় হঠাৎ পাওয়ার সে সব দ্যুতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আর আহিরা ভাবছে, ধৈর্য ও সঙ্কল্পে একই রকমের আত্মবিশ্বাস নিয়ে সাত্যকি সত্যি-সত্যিই এক মাসের মধ্যে কলকাতা থেকে ফের ছুটে এলো। এই গরজের উৎস সন্ধানে নতুন করে নামার প্রয়োজন আছে কী? আহিরা অন্য এক উপলব্ধি নিয়ে সাত্যকিকে দেখতে লাগলো। নীরবতার সেই দেখায় নেমে আসছে এক নিবিড় নির্জনতা। চোখে চোখ রেখে স্নিগ্ধ হেসে আহিরা মুখ খুললো, আপনি কি এই বাস থেকে নামলেন?
না। রাজামুন্দ্রি থেকে আমি তো বাসেই উঠতে পারিনি—ট্যাক্সিতে এলাম। তবে এখন মনে হচ্ছে হেঁটে আসাই উচিত ছিল। ড্রাইভারকে নিয়ে একটা ট্যাক্সিতে বারোজন—এই ম্যাজিক কোনো জাদুকরও দেখাতে পারবে কিনা সন্দেহ! যাক গিয়ে সে সব কথা। আমি তো …. সাত্যকি সামান্য থমকালো। তারপর বলেই ফেললো, আসার পথে আমি তো আনেক্কাপল্লী, রাজামুন্দ্রি স্টেশনে আপনাকে দেখার আশায় ছিলাম।
আহিরা হেসে উত্তর দিল এই তো আমি!
আপনি মৃণ্ময়ী না মানবী?
আপনার কী মনে হচ্ছে?
আনন্দে-বিস্ময়ে সাত্যকির ঘোর লাগা উত্তর, আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।
তা হলে আরাধনায় বসে যান। নয়তো ……. আহিরার শ্বাস-প্রশ্বাস বেশ দ্রুত ওঠা- নামা করছে, নয়তো আমাকে স্পর্শ করে দেখুন কিছু বুঝে উঠতে পারেন কি না।
আহিরার সেই নিষ্কম্প দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে সাত্যকি নিজেকে দারুণ অপরিহার্য মনে করলো। তবে কথা বলে এই নির্জন নীরবতাকে ভাঙতে চাইলো না। আসলে কথা না বলেও তো অনেক কথাই বলা যায়। অহেতুক শব্দ খরচের কী প্রয়োজন! আহিরা তো স্পর্শের কথাটা বলে মায়ার কাজল পরিয়েই দিয়েছে। একরাশ মমতার মেঘ এসে তার সমস্ত অনুভূতিকে প্রায় আচ্ছন্ন করে রেখে এক স্বর্গসুখের শীর্ষে পৌঁছে দিতেই সাত্যকি দেখলো আহিরা দরদর করে ঘামছে। কপাল, নাক, গলার ভাজে ঘাম জমে ওকে যেন স্নান করিয়ে চলেছে। ভাবাভাবির জন্য সাত্যকি খুব বেশি একটা সময় নিল না। প্যান্টের পকেট থেকে রুমালটা বের করে অসীম মমতা আর অনিঃশেষ ভালোবাসায় আহিরার কপাল ও নাকের ঘামটা মুছিয়ে দিল।
ওদের পাশ দিয়ে একটা ট্রাক বেরিয়ে গেল। ড্রাইভার মুখ বাড়িয়ে একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করে যে কথাটা ছুড়ে দিল তা হলো, মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রেম জীবনেও দেখিনি। ইচ্ছে ছিল দিই দুটোকেই চাপা দিয়ে, কিন্তু এমন সুন্দর জুটিও যে জীবনে দেখিনি—যারা মৃত্যুকেও ভয় পায় না।
ট্রাক-ড্রাইভাররা সব সময়ে শুধু গালাগালই করে না, মাঝেমধ্যে দু’একটা বেশ ভালো কথাও বলে। পরম নিশ্চিন্তে সাত্যকি নতুন করে আহিরার চোখের দিকে তাকাতেই সে সলজ্জ হেসে মুখটা নামিয়ে নিল। সাত্যকি হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো, আপনার স্যুটকেসটা আমাকে দিন।
আর ব্যাগটা নেবেন না? আহিরার সুচারু হাসিটি যথেষ্টই তাৎপর্যপূর্ণ।
আমি তো অনেক কিছুই নিজের দায়িত্বে নিতে চাই।
অনেক কিছু বলতে?
আপনি একজন অধ্যাপিকা–আপনাকে এতো কিছু যদি ভেঙে বুঝিয়ে বলতে হয় তা হলে আমি কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো?
প্রশ্ন একটা করতে হয়, করা। নতুন আরও কোনো আভাস বা ইঙ্গিত বেরিয়ে আসে কি না তারই পথ চাওয়া। নয়তো সাত্যকির ‘আমি তো অনেক কিছুই নিজের দায়িত্বে নিতে চাই’ বলাটাই যথেষ্ট। ওই কথাটার মধ্যেই অনেক গভীরতা। বছর পনেরোর এক কিশোরীও সে সব বোঝার জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও আহিরা ‘অনেক কিছু বলতে’ প্রশ্নটা করার মধ্যে ছিল নতুন আভাসের সঙ্গে কিছুটা সময়ও নেওয়া। আসলে আহিরা তখন ভেতরে ভেতরে কাঁপছিল। গা শিরশির করা অনুভূতি নিয়ে সব কথাই হারিয়ে ফেলছিল। হারাতে হারাতেও আহিরা শেষ পর্যন্ত একটা কথা বলে ফেললো, আপনাকে কোথাও যেতে হবে না। কারও কাছেই যেতে হবে না।
.
সুমিঠ্ঠাগুরমের পথ ধরে দু’জনে নিচু সুরে কথা বলতে বলতে হাঁটছিল। এখন বিকেল চারটের মতো বাজে। এবং ওই সময়েও দিঘির ঘাটে মানুষের জটলা। সারাক্ষণই লোকে সেখানে স্নান, কাচাকাচি করছে। সাত্যকি ঘাটের দিকে একবার তাকালো। ওই অসময়েও সে হরিহরণকে দেখতে পাবে বলে আশা করেছিল। মানুষটা নেই। হঠাৎ যেন কেমন উদাস-উদাস লাগে। ওই মানুষটা তো একদিন এই পৃথিবীতেও থাকবে না।
বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে সাত্যকিই কথা বলছিল বেশি। আহিরা নির্বাক শ্রোতা। আসলে সে ওর কথাগুলোর মর্মার্থ হৃদয় দিয়ে অনুভব করছিল। সাত্যকি নিরুচ্চার কণ্ঠে বলে যাচ্ছিলো, আমি আমার বাবার হয়ে সাফাই গাইবো এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমি অন্যায় কিছু বলছি কিনা এটুকু তো বিচার করবেন! আমার সারাক্ষণই মনে হচ্ছে বাবা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছেন। এরপরেও তিনি তাঁর বন্ধুকে ফিরে পেতে চান। এই অবস্থায় তাঁর ওপর গোপাল মনোহরজির আরও দীর্ঘশ্বাস পড়ুক এটা আর চাই না। প্রকৃত বন্ধুর সঙ্গে কেউ কখনও শান্তির জন্য চুক্তি করে না, করার প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় শুধু চিনে নেওয়ার। গোপাল মনোহর বালযোগীর কি সেই চেনার কাজটা আজও শেষ হয়নি? আমি এটাও বিশ্বাস করি আপনার বাবার ভেতরে অতীতের অনেক অভাব-অভিযোগ থাকতে পারে, কিন্তু আমরা যে স্বতঃস্ফূর্ততায় বারবার এখানে ছুটে আসছি তাতে কী সব কিছু ধুয়ে মুছে যায় না? সমঝোতা করার অর্থ এই নয় যে নত হওয়া। গোপাল মনোহরজি তাঁর বন্ধুর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলে খাদের কিনারা থেকে অবশ্যই উঠে আসবেন নিখিল মৈত্র— কিন্তু গৌরবের অলঙ্কারটা থাকবে আপনার বাবারই হাতে। আপনি এ নিয়ে গোপাল মনোহরজির সঙ্গে কথা বলুন, আরও চিন্তা-ভাবনা করুন এটুকুই আমার শেষ অনুরোধ।
গোপাল মনোহর বালযোগীকে কিছু বলতে হয়নি। কিছু বোঝাতেও হয়নি। আহিরার সঙ্গে-সঙ্গে সাত্যকিকেও কঞ্চিবেড়ার গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে তিনি প্রথমে বিস্মিত হলেও নিজেকে সামলে নিয়েছেন। তাঁর মনে হলো, এই একটা মাস বুঝি ছেলেটা আহিরার ফিরে আসার অপেক্ষাতেই ছিল। কিন্তু তাঁর মেয়েটা আঠাশ তারিখেই বাড়ি আসবে সেটা নিখিলের ছেলেটা জানলো কী করে? জরাজীর্ণ পৃথিবীর খোলস পাল্টাচ্ছে। মানুষ আর নিজেকে বদ্ধ গণ্ডির ভেতরে গুটিয়ে রাখতে আগ্রহী নয়। সংযোগ আর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এতো বড়ো পৃথিবীটাকেই মনে করা হচ্ছে একটা ছোট্ট গ্রাম—যেখানে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের প্রতি মুহূর্তের অগ্রগতির খবর রাখে। সেখানে কি না গোপাল মনোহর পড়ে রয়েছেন আঠাশ, তিরিশ বছর আগের একটা ত্রুটি ধরে আজও বন্ধুর দিকে মুখ ফিরিয়ে! বিরূপ এই মনোভাব নিয়ে একমাত্র গুমরানো ছাড়া তিনি এই সুদীর্ঘ বছরগুলোতে কী পেলেন আর আগামী দিনেই বা কী পাবেন? আহিরা ও সাত্যকি কিন্তু নিজেদের সেতুটাকে পাকাপোক্ত করে মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলেছে।
চেতনার ঘুম ভাঙছে। ধীরে ধীরে জেগে উঠছেন গোপাল মনোহর বালযোগী। অন্তত এটুকু বুঝলেন, নিখিলের সঙ্গে ….. মানে তাদের নিজেদের মধ্যে যা’ই হয়ে থাক না, তাদের সন্তানরা কেন সে সবের ভার বহণ করবে? পরম্পরায় এই বৈরিতা টিকিয়ে রেখে ক্রমাগত বিষবাষ্প টানার ফলে বুকের পাঁজরে যে ক্ষয়রোগের বাসা বেধে রয়েছে তার চিকিৎসা শুরু হবে কবে? আহিরা আর সাত্যকিকে এক সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে দেখে গোপাল মনোহর টের পেলেন তাদের দিন শেষ। নতুন দিনে নতুন চিন্তার শুরু। সদ্ভাব ধরে রাখাই যেখানে আগামী দিনের বৈভব, ঐশ্বর্য— সেখানে হালকা মেঘের মতো ভেসে বেড়ানো ছুটকো এক টুকরো অভিমান নিয়ে তিক্ততা বাড়িয়ে চলার কী কোনো প্রয়োজন আছে? নাকি তেমনটা করলেই ফিরে আসতে পারে সুস্থতার নির্যাস? আহিরা এবং সাত্যকির ফিরে আসাটা তাঁর মনের অনেক দরজা-জানালাই খুলে দিয়েছে, যেগুলো প্রাচীন ধ্যান-ধারণায় এতোদিন বন্ধ ছিল।
অনেক হালকা হয়ে নিজের মনেই একটু হাসলেন গোপাল মনোহর। তারুণ্যের এই জোয়ারকে কে ঠেকাবে? বয়সের যে সন্ধিক্ষণে তাঁর মেয়ে আর নিখিলের ছেলেটা সজীব মন নিয়ে দাঁড়িয়ে সেখানে আর যাই হোক কাঁটা ছড়ানো যায় না। সন্তানদের ক্ষতবিক্ষত করে কী লাভ? কার তাতে উপকার? আগের বার সাত্যকি চলে যাওয়ার ফলে গোপাল মনোহরের ভুলটা যতো বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিল, এ বারে অন্তত সেই একই ভুল দ্বিতীয়বার করার কোনো মানে হয় না। সংশোধনের সুযোগ যখন একবার পাওয়া গেছে ….. তা ছাড়া সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে ও তো বদলাতে হবে। নইলে যে অনেক পিছিয়েই পড়ে থাকতে হবে। পরিস্থিতি অনুযায়ী চলতে পারাটাই তো মনের প্রসারতা। আহিরার মনের দিকে তাকিয়ে গোপাল মনোহর হেরে যেতেও রাজি। এই হারের মধ্যে অগৌরবের কিছু নেই।
.
উঠোনে পেরিয়ে আহিরা প্রশস্ত দাওয়ায় উঠে মা, বাবার সামনা সামনি হলেও অদ্ভুত এক হিসেব কষে সাত্যকি কিছুটা সঙ্কোচের সঙ্গে উঠোনের তেঁতুল তলায় দাঁড়িয়ে পড়লো। এ যেন লক্ষণের গণ্ডি কেটে দেওয়া আর এগোনো যাবে না। ওর হিসেবটাই বা কী? প্রতিটা কাজের মধ্যে দিয়ে তিল তিল করে গোপাল মনোহর বালযোগীকে চিনে নেওয়া কতোটা ভাঙছেন, কতোটা ভাঙছেন না? আসলে ও যে কী করতে চাইছে বা বলতে চাইছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
আহিরার মুখের দিকে স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মন্দাকিনী ও গোপাল মনোহর যে হাসিটা দিলেন তাতেই যেন লক্ষ কথার ঝিলিক। নতুন করে আর কিছু বলার প্রয়োজন হয় না। অথবা ভাবা যেতে পারে, একটা হাসির ভেতরেও এতো কথা লুকিয়ে থাকতে পারে! গোপাল মনোহর এখন বেশ সহিষ্ণু। বুঝতে পারছেন সেতু হয়ে দাঁড়াতে হবে তাঁকেই। চাপা গলায় মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, সাত্যকিকে তেঁতুল তলায় দাঁড় করিয়ে রাখলি কেন?
ও আমার কাছে আসেনি বাবা—নরম হেসে আহিরা বললো, সাত্যকি এসেছে তোমার কাছে। তবে গতবারের উপেক্ষায়, হতাশায় ও হয়তো তোমার কাছে এগিয়ে আসতে আর ভরসা পাচ্ছে না।
নিজেকে আবদ্ধ না রেখে নিঃশব্দে এক বিপ্লব ঘটালেন গোপাল মনোহর মেয়েকে স্পষ্ট নির্দেশ দিলেন, ওকে ডেকে আন।
কথাটা মন দিয়ে শুনলো আহিরা। গোপাল মনোহর ঠিক ডেকে আনার কথাটাই বলেছেন তো? এতো কাছ থেকে ভুল শোনার কোনো প্রশ্ন নেই। আহিরা বাবার দিকে তাকিয়ে যে হাসিটা উপহার দিল তার একটাই অর্থ, এমন বাবা ক’জন মেয়ে পায়?
আহিরা সেই মুহূর্তে উদ্বেলিত, উৎফুল্ল। অনিন্দ্য রূপ আর সুরেলা কণ্ঠ নিয়ে দাওয়া ছেড়ে সে তখন আধা উঠোন পেরিয়ে সাত্যকির সামনে। বুকের মধ্যের গহন অন্দরে নিঃশব্দ ভালোবাসার আগুন ছড়িয়ে বললো, ভেতরে আসুন। বাবা ডাকছেন।
সাত্যকি ওরা দাওয়ায় উঠে এলে গোপাল মনোহর জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির ভেতরে না এসে তেঁতুল তলায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলে কেন?
আমি আসতামই। এখানে আসতে পারাকে আমি তীর্থযাত্রা বলে মনে করি। মৃদু হেসে সাত্যকি ওটুকুই বললো। যেটা বললো না তা হলো, এখানকার রীতি- রেওয়াজ অনুযায়ী বিশেষ একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠার মুখে কোনো ছেলেই স্বেচ্ছায় তার সেই পছন্দের বাড়ির ভেতরে আগে ঢোকে না— তাকে অনুরোধ করে নিয়ে যেতে হয়। সাত্যকি এই অনুরোধ আসার অপেক্ষাতেই ছিল।
তাঁর মেয়েটা কী সব অস্ত্রই সাত্যকির হাতে তুলে দিয়েছে? দিলে দিক। গোপাল মনোহর সাত্যকির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসলেন, যাও, তোমরা ভেতরে যাও— আসলে তিনি ভাবছিলেন, ভালোবাসা এবং সম্প্রীতির মধ্যে দিয়ে নতুন প্রজন্মের হাতে একটা অপরূপ, অমলিন পৃথিবী তুলে দেওয়াই হবে তাঁর বাকি জীবনের একমাত্র কাজ।
সাত্যকি ততোক্ষণে আহিরার ঘরে পা রেখেছে।
সেই প্ৰথম।
***