গাত্রহরিদ্রা – ১৬

১৬

কলকাতা শহর থেকে কয়েক বছরের মধ্যে দ্রুত যে কয়েকটা জিনিস হারিয়ে গেছে তার একটা হলো পাখির ডাক। কয়েকটা অঞ্চল বাদ দিলে তেমনভাবে সেই ডাক আজকাল শোনা যায় না। সেদিক দিকে যোধপুর পার্কে এখনও পাখিদের কলকাকলিতে ভোরের ঘুম ভেঙ্গে যায়। আসলে পাশেই সুবিস্তৃত লেক। আর সেই লেক ঘিরেই দীর্ঘাঙ্গী এবং প্রাচীন সব গাছগাছালির শাখায়, কোটরে নানা ধরনের পাখিদের যেন গাজনের মেলা বসে যায়। ফলে ওদের সুমিষ্ট স্বরের ডাকাডাকিতে মনটাও ফুরফুরে হয়ে ওঠে।

ভোর সাড়ে চারটেয় ঘুম ভেঙে যাবার পর থেকে সাত্যকি বিছানায় শুয়ে শুয়েই পাখিদের প্রভাত-বন্দনার গান শুনতে লাগলো। এই প্রথম সে অনুভব করলো পাখিরা কেউই খুব একটা উলটো-পালটা ধুন তোলে না। প্রত্যেকের মধ্যেই আছে নিজস্ব একটা ছন্দ। ছন্দ আর কোমল স্বরের চিন্তা করতে করতে সাত্যকি পৌঁছে গেল সুমিঠ্‌ঠাগুরমে। ওখানে একটা বড়ো মায়াবী আর জীবন্ত পাখি আছে। সেই পাখিটার নাম আহিরা। সে কি এখানে এই ঘরে এসে বাসা বাধতে পারে না?

এক একজন মেয়ের শরীরী গঠন, মুখের আদল, বাচনভঙ্গি, চাহনি এবং সেই চাহনির ভাষা—সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে এমনই একটা স্নিগ্ধতার, জ্যোৎস্নার ফিনফিনে চাদরে আধা ঢাকা থাকে যে যাবতীয় আকর্ষণ, কৌতূহল বেড়ে যেতে বাধ্য। সেই সঙ্গে আর একটা বোধও কাজ করে। দেখার পর থেকে সেই উতল হাওয়ায় তাকে ভীষণভাবেই কাছের মানুষ বলে মনে হয়। মনে হয় ‘বিদায়’ শব্দটা অনর্থক সৃষ্টি হয়েছে। ওকে যে অনেক কথা বলার আছে—সেটা কখন বলবে? এই কখন বলবে, কবে বলবের চিন্তাটাই তিল তিল করে অন্য এক তাজমহল গড়তে শুরু করে দেয়। যা কিনা সাত্যকির ভেতর গত সতেরো দিন ধরে শুরু হয়ে গেছে।

আহিরার কথা ভাবতে ভাবতে সাত্যকি হঠাৎই ওর একটা কথা নিয়ে একটু চিন্তিত হলো। আনেক্কাপল্লীতে নামার আগে আহিরা কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিল, ‘আমি কখনওই আগে ভালো কিছু দেখার সাহস পাই না। তা হলে ভীষণভাবে ভেঙে পড়তে হয়। আমি তাই প্রথমেই খারাপ দিকটা, খারাপ ছবিটা দেখার চেষ্টা করি। পরে বাজে কিছু হলে অতোটা কষ্ট পাওয়ার প্রশ্ন থাকে না।’

সাত্যকির ভেতরে এখান থেকেই একটা ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হচ্ছে। আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রত্যয় ইত্যাদি থাকা খুব ভালো। তার সেটা আছেও। কিন্তু সাত্যকি যে ভাবে শেষ দৃশ্যটা আলিঙ্গনের মোহনায় দেখতে চাইছে, দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, তেমনটা যদি কোনোদিনই না হয়? ধরা যাক গোপাল মনোহর বালযোগী — কিছুতেই তার অবস্থান থেকে এতোটুকুও সরলেন না তা হলে? তারপরের ছবিটা তা হলে কী দাঁড়াচ্ছে? এবং এই দিকটা নিয়ে সাত্যকি কোনো মুহূর্তেই অন্য কিছু চিন্তা করেনি। এতোটা নিশ্চিন্ত সে কী করে থাকছে মূল প্রশ্নটা তো এখানেই। সেই বিশ্বাসের মন্ত্র কী আহিরা? খুব স্বাভাবিকভাবে দেখলে এটা বোঝা উচিত যে, নিখিল মৈত্র ও গোপাল মনোহর বালযোগীর মধ্যে যে দেওয়ালটা উঠেছে সেটার কারিগর তার বাবা। অর্থাৎ একপেশে অন্যায়টা নিখিল মৈত্রর তরফেই। এবং স্বাভাবিক কারণেই গোপাল মনোহর বালযোগীও তাই মুখ ফিরিয়ে থাকবেন। এখানে সাত্যকির যতোই বিশ্বাস থাক আহিরা নামের মেয়েটা কী করবে? সে কী তার বাবাকে সব কিছু মেনে নেওয়ার অনুরোধ বা নির্দেশ দিতে পারে? দেওয়া উচিত? আহিরা একজন অধ্যাপিকা। সে তার ‘আহত’ বাবাকে এমন একটা ….. অবিবেচকের মতো এমন একটা সমঝোতা করতে বলবে কেন?

অফিসে যাওয়ার সময়ে প্রায় প্রতি দিনই সাত্যকির তাড়াহুড়ো লেগে যায়। সেই সঙ্গে সমানে চলতে থাকে ওর হাঁকডাক, চিৎকার। ও মা, আমার গেঞ্জিটা গেল কোথায়? সবুজ স্ট্রাইপের জামাটাই বা কোথায় গেল? মোজাও দেখতে পাচ্ছি না— এ কী ভুতুড়ে বাড়ি রে বাবা! একটা জিনিসও যদি কোথাও ঠিকঠাক থাকে—সাত্যকির ওই গজগজানির মধ্যেই বিজয়া এসে সামনে দাঁড়ান। ছেলের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেন, গতকাল মোজা খুলে বসার ঘরের সোফার নীচে রেখে দিয়েছিলি, সবুজ স্ট্রাইপের জামাটা তিন দিন হলো ইস্ত্রি করতে দিয়েছিস—সম্ভবত এখনও নিয়ে আসিসনি। নিজে একের পর এক ভুল করবি আর বাড়িটার ঘাড়ে ভুতুড়ে হওয়ার দোষ চাপাবি, এটা তো হয় না। নিজের জিনিস নিজে গুছিয়ে রাখতে চেষ্টা কর।

মায়ের কাছে সব ছেলেই অগোছালো।

একদম চালাকি করবি না। বিজয়া প্রশ্রয়ের হাসি ছড়িয়ে বলে উঠলেন, তোর এই এটা কোথায়, ওটা কোথায় শুনে পাশের বাড়ির রায় মাসিমা তাঁর ছেলেকে ডেকে তোলেন, আর ঘুমাতে হবে না, উঠে পড়। সাত্যকির জুতো, মোজা খোঁজা শুরু হয়ে গেছে— নিশ্চয়ই আটটা বাজে।

অফিসে যাবার জন্য আমার এই সময় নিষ্ঠার দাম অন্তত একজন প্রতিবেশীর কাছ থেকে তো পেলাম। এটাই বা কম কীসের? সাত্যকি হাসতে হাসতে বিজয়াকে জড়িয়ে ধরে বললো, আজ কিন্তু ফিরতে আমার রাত হবে মা, চিন্তা করবে না।

কোথাও যাবি?

অফিসের কাজে একবার কৃষ্ণনগর যাবো। কখন ফিরবো বলতে পারছি না। তোমরা খেয়ে নিয়ো। আমার জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। বিজয়াকে প্রণাম করে এবং নিখিলকে নিষ্পাপ এক হাসি উপহার দিয়ে সাত্যকি ওর গাড়ি নিয়ে অফিসের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে।

সময় তো এক বহতা নদী। সে চলে তার আপন খেয়ালে। আপন গতিতে। সুখ, শান্তি, দুঃখ, কষ্টের মায়া ও জড়তা কাটিয়ে সে শুধু নিঃশব্দে বয়েই যায়। মানুষের মনে রেখে যায় অতীত এবং ভবিষ্যতের কিছু কিছু ছবি

সুমিঠ্‌ঠাগুরম থেকে ফিরে এসে ফের সেখানে যাবার সময়ও হয়ে এলো। সাত্যকি আগামীকালই ট্রেন ধরছে রাজামুন্দ্রির উদ্দেশে। আসলে এমনিতে যে কোনো দিনই রওনা হওয়া যায়। কিন্তু এতো দূর থেকে আহিরা-শূন্য সেই বাড়িতে গিয়ে আশ্বাসের কোন ছবিটা সে দেখতে পাবে? আঠাশ তারিখটা যেন একটা শপথ নেওয়ার দিন। বিশ্বাসের দিন। ঝড়-ঝাপটা, ভূমিকম্প যাই হয়ে যাক না কেন, আনেক্কাপল্লী থেকে প্রতি মাসের ওই তারিখে আহিরা স্বমহিমায় থাকবে তাদের নিজেদের বাড়িতে। কুসুমের ঘ্রাণ নিতে সেই সময়ে সাত্যকিকে যেতেই হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *